লিখেছেনঃ দোল গোবিন্দ চ্যাটার্জী
আঁতুর ঘরের দরজার সামনেই দুদিনের শিশুটি মরে পড়ে আছে। মাছি ভন্ করছে সেখানে। একটু ভিতরে আলো আঁধারিতে বেলী পা ছড়িয়ে, দুই হাত এক করে দুপায়ের ফাঁকে খুঁজে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে। মাথাটা উঁচুকরে দেওয়ালে ঠেকানো। চোখ দুটো বোজা। সেই বোজা চোখের দু-কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
উঠোনে লোকে লোকারণ্য। আবাল-বৃদ্ধ বণিতার গমনাগমন চলছে। আঁতুর ঘরের সামনে উঠোনেই বসে বাঁ হাত কপালে ঠেকিয়ে বিবিধ শব্দ প্রয়োগে কেঁদে চলেছে বেলীর মা। বড় ঘরের বারান্দায় প্রায় উবু হয়ে বসে বেলীর বাবা নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে চলেছে। সেই সঙ্গে আগন্তুকদের প্রশ্নের যথাসম্ভব উত্তর দিচ্ছে।
যাকে নিয়ে এত কান্ড সেই বেলী কিন্তু সম্পূর্ণ নিরুত্তর। বহু চেষ্টা করেও ওর মুখ থেকে একটা কথাও বার হয়নি। সেই কখন থেকে যে ওই একভাবে বসে আছে ও এমনি-ই কে জানে?
বেলীর বিয়ে হয়েছে গ্রামেই। এর পেছনেও একটা ঘটনা আছে। গ্রামটি বড় এবং বর্ধিষ্ণু। সপ্তাহে দুদিন হাট বসলেও অন্যান্য দিনও সবই পাওয়া যায়। হাইস্কুল, উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র সবই আছে।
প্রবোধবাবু সেদিন বাজার করে ফিরলেন। অভ্যাসবশত বাজার এনে থলি আজার করে বিভিন্ন সবজি পৃথক পৃথক ভাবে সাজিয়ে রাখলেন। এবং সেই সঙ্গে কোনটা বেশ কম দামে পেয়েছেন, আজ কী রান্না হবে-আপন মনেই বলে গেলেন। ওনার স্ত্রী কতক শুনতো কতক শুনতো না। কিন্তু চা-এর কাপ হাতে নিয়ে হাজির হত। আসলে এই সময় প্রবোধ বাবুর চা চাই-ই।
আজও জয়ন্তী দেবী চা নিয়ে দাঁড়াতেই বললেন -একটা কথা আছে, লাল্টু কই? জয়ন্তী দেবী ভেজা হাতকাপড়ের খুঁটে মুছতে মুছতে বললেন ‘আছে কোথাও-কেন?’ প্রবোধবাবুচায়ে একটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বললেন ‘আমি লাল্টুর বিয়ের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ আরও একটা চুমুক দিয়ে বললেন -“ওই যে সন্তোষ – ওরই মেয়ে। _ জয়ন্তী দেবীর মনঃপুত হল না যেন, সে কথা না বলে বললেন, দেবগ্রামের ওরা যে আসবে বলেছে ….! প্রবোধবাবু চশমাটা খুলে বললেন -আসুকনা। ওদের সঙ্গে তোআর ফাইন্যাল কথাবার্তা হয়নি। শুধু আমরাই যা দেখেছি আর …।
লান্টু ওর মার কাছে সব শুনতো। ওরও মত নেই বোঝা গেল। বললে, বাবা চিরদিন শুধু নিজের ইচ্ছাটাই চাপিয়ে দিল। এটা ঠিক নয়। আমার মত নেই বলে দিও। মাকে বললেও বাবার মুখের ওপর বলার ক্ষমতা ওর নেই। সেটা ও ভালভাবেই জানে। আর এটাও জানে। বাবা যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই হবে।
এই যে প্রবোধবাবু কথা দিয়ে ফেলল এর পেছনেও একটা কারণ আছে। সন্তোষবাবু আর প্রবোধবাবু বাল্যবন্ধু। স্কুলেরও সহপাঠি। আজও সেই বন্ধুত্বটা অটুট আছে। যদিও বর্তমানে সন্তোষবাবুরা যথেষ্ট গরিব এবং প্রবোধবাবুদের ধারেকাছেও আসেনা, তবুও প্রবোধবাবু প্রাণ খুলেই মেশেন, এখনো।
যদিও সন্তোষবাবুরা গরিব ছিলনা। এখনো থাকার কথা নয়। তবুও কালের নিয়মেই হোক বা সামান্য ভুলের জন্যই হোক বর্তমানে অবস্থা নিতান্তই সঙ্গীন। সেকথা এখানে প্রযোজ্য নয়। সন্তোষবাবুর চার কন্যা। বেলী তিন নম্বর। প্রথম দুটির মধ্যে বড়োদুটির বিয়ে দিয়েছেন। মেজোর শ্বশুড় বাড়ীর অবস্থা ভালো, কিন্তু দ্বিতীয় পক্ষ। এই তৃতীয়টিকে নিয়ে যত দুশ্চিন্তা। মূলত অর্থাভাবে ঠিকমতো পণ দিতে না পারাই প্রধান কারণ। যদিও বেলী দেখতে মোটামুটি ভালোই।
যে দিনের ঘটনা, সেদিন প্রবোধবাবু আর সন্তোষবাবুর বাজারে দেখা। চা-এর দোকানে বসে এই নিয়েই কথা হচ্ছিল। একথা ও কথার পর সন্তোষবাবু বলেন ‘আমি যে কী করে আর দুটোকে পার করব? বেলীটার তো এখনই না দিলে নয়।’ প্রবোধ বললেন, তাই তো হে ভালো ছেলে….।’ ওঁর কথা শেষ না হতেই সন্তোষ বাবু বাধা দিয়ে বলে ওঠেন না-না-না ভালো ছেলে আছে…। প্রবোধবাবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সন্তোষ বাবুবলে ওঠেন ‘যেখানে যোগাযোগ করছি – প্রথমেই জিজ্ঞাসা কেমন দিতে টিতে পারবেন? – নয়তো টাকা পয়সা দেবেন তো? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন কিছুই ভালো লাগে না হে….! – দুজনে একমুহূর্তচুপচাপ। সহসা প্রবোধবাবু বন্ধুর পানে চেয়ে বললেন “আমার লান্টুর সঙ্গে বিয়ে দেবে?” চমকে ওঠার মতো সন্তোষ বাবু বন্ধুর কথার উত্তরে বলেন – ‘লা-ল-টু – মানে….?’ প্রবোধবাবু মাথা নাড়েন। সহসা কন্যাদায়গ্রস্থ সন্তোষ প্রবোধবাবুর দুহাত চেপে ধরে বলেন “তুমি উদ্ধার করবে আমায়? প্রবোধবাবু বলেন ‘উদ্ধার নয় আত্মীয়তা স্থাপন বলো।’ আরও এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলেন – “টাকা পয়সা লাগবে না। সন্তোষ বন্ধুর মুখপানে চেয়ে থাকে অপলক। প্রবোধ বাবু উঠে দাঁড়ান। বলেন ‘বাড়ী যাও। সময়ে কথা হবে।‘ বলেই একটুখানি হেসে ভর্তি থলি দুটি হাতে বেরিয়ে যান। সন্তোষ ওই দিকে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
লান্টু এবং ওর মার অনিচ্ছা সত্ত্বে বিয়েটা ঠিক হল। বাবাকে কিছু বলতে না পেরে মার কাছে গজগজ করতে লাগল লান্টু। বললে, ‘তুমিও তো বাবাকে বোঝাতে পারতে মা?’ জয়ন্তী দেবীমুখ বিকৃত করে বললে ‘হুঁঃ আমার কথা কত যেন শোনে, চিরকাল শুধু….।’
লান্টুর দুই দিদি সবিতা আর নমিতারও মত নেই এতে। কারণটা ওই একই। এদের সঙ্গে আমাদের খাপ খায় না। সেদিন সবিতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল প্রবোধবাবুর। সবিতা শুনে বললে ‘এটা তুমি কি করলে বাবা? ওদের সঙ্গে….।
‘না-বাবা-মানে…., তোমাদের জামাই তো…।’
—আরে নন্দন, বাপী ওরা তো ওদের শ্বশুর বাড়ী আসবে। আমার ছেলের শ্বশুর বাড়ী ওদের না গেলেও চলবে।
সবিতা আরও কি বলতে যাচ্ছিল। প্রবোধবাবু ধমকের সুরে বললেন, শোন টাকা পয়সা হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু লান্টুর অভাবটা কীসের যে পরের কাছে হাত পাততে হবে? আমি নিশ্চয় ভালো বুঝেছি।
বিয়েটা হয়ে গেল। কিন্তু দুভার্গ্যবশতঃ মাত্র মাস কয়েকের মধ্যেই প্রবোধবাবু হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। এই সুযোগে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেল। এতদিন অল্পে স্বল্পে চলছিল। এবার মাত্রাটা বাড়ল। বলছি বেলীর প্রতি লান্টুর আর ওর মায়ের মানসিক নির্যাতনের কথা। এতদিন যাও-বা হচ্ছিল তা সামাল দেওয়া গেলেও প্রবোধবাবুর অকাল প্রয়াণের জন্য অলুক্ষুণে বেলীই দায়ী এমনটা উঠতে বসতে শুনতে হচ্ছিল বেলীকে। প্রায়ই কথায় কথায় জয়ন্তী দেবী রোদন করেন আর বলেন কী অলুক্ষুনে মেয়ে ঘরে ঢোকালিরে বাবা লান্টু, আমার সব ঘুচিয়ে ছাড়লে। মুখপুড়ি শ্বশুর খেয়ে তবে….।’ – অসহায় বেলী নীরবে সহ্য করে সব।
ইদানিং মানসিক নির্যাতন যথেষ্ট মাত্রায় চলছে। যেমন লাল্টু খাবার সময় কাছে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও মাকে উদ্দেশ্য করে বলে—মা—ক্ষিদে পেয়েছে….! যদিও জানে বেলীই দেবে তবুও। জয়ন্তীদেবী রাগতস্বরে চিৎকার করে বলেন—“কি হলো, শুনতে পাচ্ছো না?—ছেলেটা কখন থেকে ক্ষিদেয় জ্বলছে।”—বেলী মেনে নিত এটাই তার ভবিতব্য বলে। সে সবসময়েই ভয়ে ভয়ে থাকে। পাছে কিছু ত্রুটি হয়। তবু গঞ্জনা তার নিত্য প্রাপ্ত। লান্টু এমনিতে কোনো কাজই করে না। আড্ডা মেরেই কাটায়। তবু যখন বিশেষ কিছু প্রয়োজন হয় তখনই সে লান্টুকে বলে। কিছু দরকার হলে বেলী হয়তো চাইল। লান্টু তৎক্ষণাৎ বলে ‘আমার কাছে টাকা পয়সা নেই। মাকে বলো।’ বেলি জানে শ্বাশুড়ী দেবে না তবুও–। জয়ন্তী দেবী শুনেই বলবে—“কেন লান্টুকে বলতে পারো। আমি মেয়েছেলে কোথায় কী পাব?”
এমনি করেই চলছিল। বছর দুয়েক পরে বেলী প্রথম মা হল। কিন্তু কন্যাসন্তান হওয়ায় জয়ন্তী দেবী বা লাল্টু কেউ খুশি হতে পারেনি। এবং যেহেতু তার দুটি মেয়েরই দুটি করে পুত্র সুতরাং এজন্য দায়ী বেলীই। জয়ন্তী দেবী তো বলেই দিলেন ওসব ভগবান টগবান কিছু না—লক্ষমান মেয়েদের ব্যাটা ছেলেই হয়। আমার দুই মেয়ের কী করে হল?
আরও তাচ্ছিল্যের পাত্রী হল বেলী, সঙ্গে নবজাতিকাও। ক্রমে উঠতে বসতে কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য গঞ্জনা শুনতে হত খুব। এমনি করেই তিনটে বছর কেটে গেল। আবারও অন্তসত্ত্বা হল বেলী। এবারেও এমন সব কথা ওকে বলা হতে লাগল—যেন ও সাবধান হয়ে থাকে। পুত্র সন্তানই যাতে জন্মায়। শুধু তাই নয়, লান্টু আরেক কাঠি উপরে উঠে এমন কথাও বললে ‘ছেলে হতে বাপের বাড়ি যাবে যাও, কিন্তু আবার যদি মেয়ে হয় তো আর এ বাড়ি এসো না। মা মেয়েতে ওখানেই থাকবে, এই বলে দিলাম।
দুভার্গ যখন যাকে তাড়া করে তখন যেন তার শেষ না দেখে ছাড়ে না। বেলীর ক্ষেত্রেও তাই। এবারেও ওর কন্যাসন্তানই হল। মনে আশঙ্কা ছিলই। হলও সত্যি। প্রসবের ঘোর কাটতেই যখন শুনল আবার কন্যাসন্তান হয়েছে তখনই বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। লান্টু যা বলেছিল তাও বাবা মাকে বলেনি ঠিকই, কিন্তু ও তো ভালোভাবেই জানে কীরকম দুর্ব্যবহারটা ওরা করে। এবার মাত্রাটা বাড়বেই।
এমনিতেই প্রথম মেয়েটাকে বলে ঢেপসি, মার পেটে এক…., ব্যাটাছেলে হসনি কেন? ছোটশিশু বোঝে না বলেই দাঁত বার করে হাসে।
পূর্বের প্রসঙ্গেই আসি। অনেকেই চেয়েছিল লান্টু আর ওর মা’র কিছু একটা হওয়া দরকার, যা বজ্জাত! কিন্তু এতদিন মুখে প্রকাশ করে বলতে না পারলেও এই সুযোগটাকেই কাজে লাগানো হল। সন্তোষবাবুর ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও কে যেন পুলিশে খবর দিয়েছে। পুলিশ এল। প্রথমে সন্তোষ আর ওর স্ত্রীর মুখে শুনল সব কিছু। ওর মা-ই বললে রাতেই কখন গলা টিপে মেরেছে। তখন থেকেই ওরকম বসে আছে চুপচাপ। সকালে ওর মা মুখ ধুয়ে চা খাবার কথা বলতে গিয়ে প্রথম লক্ষ করে। প্রথমে বুঝতে না পারলেও আস্তে আস্তে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর একবারই শুধু ওর মাকে চোখ পাকিয়ে দাঁত কটমট করে বলেছে ‘আমি মেরেছি বেশ করেছি, ও মেয়ে হল কেন….?’ – বলেই কেমন দাঁত কটমট করতে লাগল….। তারপর আবারও চুপচাপ।
পুলিশ বললে পোষ্টমর্টেম করতে হবে। আর বেলী দেবী, আপনার কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে? বেলী তেমনিভাবেই না বাচক মাথা নাড়ল শুধু। পুলিশ শুধাল ‘ভালো করে ভেবে দেখুন,…।’ এতক্ষণে একবার চোখ মেলে চাইল। পুলিশের মুখের পানে চোখ মেলে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অস্ফুটে বলল ‘না।’ পুলিশ বলল ‘তাহলে তো আপনাকেই অ্যারেস্ট করতে হয় বেলী দেবী! আমরা নিরুপায়।’ এবারেও কোনো উত্তর দিল না ও।
ছোট্ট লাশটা তোলা হল একটা ভ্যান রিক্সায়। বেলী ধীরে ধীরে গিয়ে উঠল পুলিশের গাড়িতে। কারো পানে ফিরেও চাইল না। পুলিশ সন্তোষ বাবুকে বললে কাল কোর্টে তুলব একবার যাবেন। গাড়ি বেরিয়ে যেতেই মুহূর্তে ভিড় পাতলা হতে লাগল। মাতৃহারা চার বছরের শিশুটি আপন মনে খেলতে লাগল ধুলোয়। সেইদিকে চেয়ে সন্তোষবাবু হু-হুকরে কেঁদে উঠল।
নিচের ছোটগল্প দুটি পড়ুন,