লিখেছেনঃ ঘনশ্যাম চৌধুরী
রোজ বৃষ্টি হচ্ছে। কখনও প্রচণ্ড বৃষ্টি, কখনও মাঝারি বৃষ্টি। টানা দু’সপ্তাহ হয়ে গেল। এর মধ্যে সূর্যের মুখ দু’একবার দেখা গেছে কিনা সন্দেহ। নদী ছুটছে হু-হু করে। কয়লা খনি এলাকা এখন একেবারেই রুক্ষ্ম নয়। বর্ষার জল পেয়ে ঘন সবুজ রং লেগেছে চারদিকে। ডানদিকে খোট্টাডি খোলামুখ খনির পাহাড়প্রমাণ পাথর-মাটির-চাঙড় দেখা যাচ্ছিল। সেখানে কোলাহল, কারণ তুমুল কাজ হচ্ছে। কিন্তু এদিকটা একেবারেই চুপচাপ, নৈঃশব্দে ঠাসা। চোদ্দো নম্বর পিট বন্ধ হয়ে গেছে পনেরো বছর হল। তাই হট্টগোল নেই। রূপান মাঝি গ্রামের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিভেজা জমি দেখছিল। গুনগুন করে গানও গাইছিল সে—
‘বধূ যদি আঁইসব্যে,
তবে কাঁদালে কেনে?
কেনে ভুলালে তুমি হাম্যাকে,
বোলো বঁধূয়া—
কী গাইনছ বটে?
‘নারীকণ্ঠ শুনে রূপান পিছন ফিরল। দেখল গোলাপীকে। গোলাপী মান্ডি।
অজয়ের ঘাট থেকে যান সেরে ঘরের দিকে যাচ্ছিল। ভেজা শাড়িতে তার সারা শরীর বাঁধনহারা। ‘কালো বর্ণ তাহার’। চড়াই-উৎরাই পাথুরে দেশের কন্যা যে! গোলাপীও দেখায় রূপানকে। জোয়ান মরদ। পেটাই শরীর। পাথুরে গায়ের রং যেন গায়ে উঠে এসেছে। জমাট মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের তীর্যক রূপোলি রেখা ওর পাথুরে শরীরটাকে পোড়াচ্ছিল। খালি গা বেয়ে দরদর করে ঘাম বেরোচ্ছে। পরনে হাঁটুর ওপর পুতি। গোলাপী ফের জিজ্ঞেস করল, কী গান গাঁইনছো বটে?
এই গাঁইনছিলাম, যা মনে আইল্য তাই। মাথামুণ্ডু নাই তার। কী কইরছ বটে ইখানে?
জমি দেখি। হামাদের পাত্থর জমি। লেকিন ভাল্য জল পাঁইনছো। ধান রুইব ইবার।
খনিতে তুমার নোকরি হল্য নায়?
না বটে। খনি সব বন্দ হঁঞি যেনঁছে। কামের রাস্তা কই ? কাম ধান্দা খতম।
বর্ষণসিক্ত উঁচু-নীচু, ঢাল-নাবাল জমির দিকে তাকিয়ে খানিকটা দীর্ঘশ্বাসের মতোই গোলাপী বলল, বাত তো সহি! লেকিন দুসরা কাম-ধান্দা করো! কাম-কাজ ঢুঁনডছ নায় কেনে?
দেখি বটে।
রূপান নানারকম ভাবছিল। গোলাপী কয়েক পা এগিয়ে ফের ফিরল।।
ঝুমুর লাচ দিখতে—যাব্যেক লাই?
কুত্থাকে?
ভামুরিয়া গিরামে। পুরুল্যা থিক্যে ঝুমুর-দল আইসছে। ভারী লাচা-গানা হব্যাক বটে আঁইজ সনঁঝায়।
তুভি যাবি গোলাপী ?
যাব্য বটে। তুমি অ চল না কেনে?
মৌন থেকে সম্মতি জানিয়ে দিল রূপান মাঝি। স্নানসিক্ত যৌবন নিয়ে ঘরে চলল গোলাপী মান্ডি।
দুই
বিকেল থেকে ঝকঝকে আকাশ। অপরাহ্নের বিদায়ক্ষণে সূর্য যখন পশ্চিমের দিগন্তরেখা থেকে অপসৃয়মান, তখন পশ্চিমাকাশের অনেকটাই আবিরগোলা লাল রঙে আচ্ছন্ন। সন্ধে এসে ধীরে ধীরে মালভূমির গ্রামগুলিকে আঁধারে ঢাকল।
সন্ধে যখন রাত্রির দিকে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনই ভামুরিয়া গ্রামের শিমূলতলায় ঝুমুর গান আর নাচ জমে উঠল। শ্রমিক ধাওড়ার মেয়ে-বউ আর পুরুষরা সেই নাচে-গানে মেতে গেছে একেবারে।
গোলাপী রূপান মাঝির কাছাকাছিই বসেছিল। আসরে যে বাঁশি বাজাচ্ছিল, তাকে একেবারে কেষ্ট ঠাকুরের মতো দেখতে। ঝুমুর দলের রসিক কিছুক্ষণ পরেপরেই তাকে বলছে, লাচা রে নাগর, তুয়ার লাচনিক্যে….।
এরপরই বাঁশের বাঁশিতে উঠছিল অপরূপ সুর। মন কেমন করে উঠছিল তাই গোলাপীর। কখন যে সে জোয়ান রূপানের গা ঘেঁষে এসে বসেছে, দু’জনের একজনও কি তা জানে।
মাদলের বোল তুলেছে রসিক–তিলাক ঝাঁই, তিলাক ঝাঁই, কিস্তি মাত। ঘেনে লাগ, ঘেনে লাগ। খেসা কদম, খেসা কদম। ঝাঁই ঝাপস, আঁই ঝাপট—বোলরে মাদল বোল!–বাঁশিতে চড়া সুর ওঠে। শ্রোতারা মদির-কামনাময় উল্লাসে হাততালি দেয়। মহিলাদের গন্ডদেশ আরক্তিম হয়ে ওঠে, গোপন শরমে। নাচনী নাচের সঙ্গে গান ধরে –
বেড়া ভেঙে কুশি বেগুন
বেশি তুলো না।
ভাঙা বেড়ার নাইকো আগল
ছাগল মানে না।
হাততালিতে ফেটে পড়ে ঝুমুর গানের আসর।
এমন রসের গানে রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করছিল যুবতী গোলাপীর। কিন্তু রূপান মাঝি ভোলাভালা, গম্ভীর। আসর ভাঙল। রাত এখন সাড়ে বারোটা। যে যার গ্রামে ফিরছে এবার। ফিরতি পথে সবাই রসের কথায় মগ্ন। কেউ সোচ্চারে, কেউ অস্ফুটে।
একে একে গ্রামগুলোয় কেউ কেউ বাড়িতে ঢুকে পড়ে। রাত পৌনে একটা। রূপানদের আগের গ্রামেই ওদের দু’জন ছাড়া বাকি দলটার ঘর এসে গেল। রূপান আর গোলাপী তাদের গ্রামের দিকে হাঁটছে তখনও। রাত একটা। চতুর্দশীর চাঁদ দেদার জ্যোৎস্না ঢালছিল। সেই মায়া মেদুরতায় আলোকস্নান সেরে নিচ্ছিল রূপান মাঝি আর গোলাপী মান্ডি।
মাঠের পথ থেকে গ্রামের মধ্যে ঢোকার মুখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল রূপান। গোলাপী জিজ্ঞেস করল, কি হলোঁ বটে?
রূপান ঘুরে দাঁড়িয়েছে গ্রাম-ছাড়া জ্যোৎস্নাঢালা জমির দিকে। বৃষ্টিজলসিক্ত সেই ভূমি জ্যোৎস্নার মায়া আলোয় চিকচিক করছিল। রূপান চুপ। সে তাকাল গোলাপীর কৃষ্ণসায়র আঁখিতারার দিকে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বহু বহু দূরে হারিয়ে গেল রূপান। তার চক্ষু স্থির। মস্তিষ্কে ঝড়। উষ্ণ রক্তকণায় প্লাবন। সে চোখ ফিরিয়ে নিল জ্যোৎস্না-ধৌত বৃষ্টিসিক্ত চাষের জমির দিকে। রূপান অস্ফুটে ডাকল—গোলাপী!
হুঁ।
বারিষে মাটি লরম হইনছে। কাইল লাইমব্য নাঙল নিইয়ে।। বহোৎ খুব। খাদানে কাম লাই। চাষই কর্য বটে। তু থাকবি হামার সঙ্গে?
এই কথা শুনে এক ঝটকায় রূপানের চোখে চোখ রাখল গোলাপী। চোখের ভাষায় লাখো লাখো কথা হয়ে গেল। পৃথিবা নিশ্চুপ। চাঁদ নিশ্চল। এক ঝাক রাতচরা পাখি হঠাৎ ডেকে উঠে ওদের না বলা শুধু একটিমাত্র কথাকে ভাষা দিয়ে গেল।
আকাশের তারারা বুঝি একসঙ্গে অনেক কথা বলে উঠল। এবার ওরা দু’জন, দুই মানব-মানবী পা রাখল গ্রামের পথে, ওদের নিজস্ব ঠিকানায়।
নিচের ছোটগল্পগুলি পড়ুন,