আরএসএস প্রধান মােহন ভাগবত ভারতে নতুন করে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানাে শুরু করেছেন। ভাগবত ভারতের মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, সংখ্যালঘুদের শিকড় হিন্দুত্বেই এবং সেই হিন্দুত্বকে মেনে নিয়ে তাদের দেশের মূলধারার সঙ্গে সামিল হতে হবে। একথাটা শুধু অনৈতিহাসিকই নয়, রীতিমত অবৈজ্ঞানিকও—মূল থেকে যে কান্ড, শাখা-প্রশাখা ও ফুলফল বেরােয় তারা কখনও মূলের দিকে ফিরে আসে না। জ্ঞান থাকলে মােহন ভাগবত এমন কথা বলতেন না। আর ইতিহাস অনুসারে ভারতের ‘অচ্ছুৎ’ ও ‘অনুন্নত’ হিন্দুরাই মােহন ভাগবতদের মতাে বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা শােষিত ও নিপীড়িত হয়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। একথা স্বামী বিবেকানন্দও বলেছিলেন। নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের খ্রিষ্টানে ধর্মান্তরিত হওয়ার পিছনেও মূলত ঐ একই কারণ ক্রিয়াশীল ছিল (বল ও প্রলােভন কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কাজ করেছে)। তাই এটা ঠিক যে, ভারতীয় মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের সঙ্গে দেশের সামাজিক, ভৌগােলিক, ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে যদি যােগসূত্রের কথা ওঠে, তাহলে বলতে হয় তাদের সঙ্গে যােগসূত্র রয়েছে শুধুমাত্র ইসলাম বা খ্রিষ্টান ধর্মের—এখানে হিন্দুত্বের প্রশ্নই আসতে পারে না। স্বভাবতই সংখ্যালঘুদের হিন্দুত্বের দিকে আহ্বান বা তাদের হিন্দু উৎস সন্ধান করতে বলা এক ধরনের ধর্মীয় আগ্রাসন ছাড়া আর কি হতে পারে?
ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দু এবং তারা তাদের ধর্মীয় আচার, সংস্কৃতি মেনে নিজেদের জীবন চালাবে সেটা তাদের অধিকার। কিন্তু আর এস এস ‘হিন্দুত্ব’ বলে যা চালাবার চেষ্টা করছে সেটা আসলে কি জিনিস? রামকৃষ্ণের হিন্দুত্বের সঙ্গে মােহন ভাগবত-মােদির হিন্দুত্বের কতটা মিল? উত্তর ভারতে যেমন রাম জনপ্রিয়, দক্ষিণ ভারতের অনেক অংশে তেমনই রাবণ জনপ্রিয়। অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী হলে, একজন ভগবান আছে বিশ্বাসী হলে আপনি হিন্দু। আবার ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এই তিন ভগবানে বিশ্বাস করলেও আপনি হিন্দু। আপনি যদি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর সত্ত্বায় বিশ্বাসী নাও হন তাহলেও আপনি হিন্দু। ভগবান, দেবদেবী না মানলেও আপনি হিন্দু। নিজেকে হিন্দু না বললেও, মুসলমান বা খ্রিষ্টান না হয়ে গেলে, আপনি হিন্দুই থাকবেন। হিন্দুধর্ম চিরকালই এরকম ঢিলেঢালা, ছড়ানাে। হিন্দুর বিশ্বাস একটা নয়, নানা হিন্দুর নানা পরস্পর বিরােধী বিশ্বাস। এই বৈচিত্র্যটাই হিন্দুধর্মের ভিত্তি। দেখুন বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত, পুরাণ, উপনিষদ কোথাও হিন্দু কথাটা পাওয়া যাবে না। ব্রাহ্মণ্যধর্ম কথাটা আছে, যার মূলকথা। সমাজে ব্রাহ্মণরা অগ্রণী। রামায়ণে রামের পরিচয় ‘আর্যপুত্র। ইউরােপীয়রা ‘মুসলমান’ কাকে বলে জানত। কিন্তু তারা “হিন্দু” কথাটার সঙ্গে পরিচিত ছিল না। আলবেরুনি, ইবন বতুতা, হিউয়েন সাঙ, ফাহিয়েন, ম্যানরিক এইসব ভূপর্যটকদের কারও লেখাতেই ‘হিন্দু’ কথাটা পাওয়া যাবে না। কারণ অন্য ধর্মগুলি যেভাবে সংগঠিত রূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে, সেভাবে হিন্দুধর্ম গড়ে ওঠেনি। প্রথম দিকে ‘হিন্দু’ ছিল একটা ভৌগােলিক সংজ্ঞাসিন্ধুনদীর পূর্ব দিকে যাদের অবস্থান। সিন্ধু থেকে হিন্দু—এ কৃতিত্ব তাে বিদেশীদের, আরও স্পষ্ট করে পারসিক বা আরবীয়দের। তাহলে ‘হিন্দু’ উৎস বলতে কি বােঝাচ্ছে? যা বােঝায় তা হল ভারতীয় উৎস, যা বােঝায় তা হল ভারতীয় সংস্কৃতি। এই ভারত যতটা হিন্দুর, ততটাই মুসলমান, খ্রিষ্টান, শিখ ও বৌদ্ধদের, ততটাই দলিত আদিবাসী ও অনগ্রসরদের। এই ভারত শুধু হিন্দুর নয় কিংবা মুসলমান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধদের নয়। নানান সংস্কৃতির মিশ্রণ এই ভারত। একে হিন্দু উৎস বলে না, বলে ভারতীয় ঐতিহ্য। আর এস এস কিন্তু এই ঐতিহ্যকে স্বীকার করে না। তারা হিন্দুত্বকেই ভারতীয়ত্ব বলে জাহির করতে চান। তারা যখন ভারতীয় মূলধারার কথা বলেন তখন প্রকারন্তরে হিন্দুত্বকেই প্রচার করেন। সেই হিন্দুত্বকে গ্রহণীয় করার জন্য নানারকম সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার ধুম্রজাল রচনা করেন। সাধারণ মানুষ কিন্তু এতসব সূক্ষ্মকথার মারপ্যাচ বােঝে না। সুতরাং হিন্দুত্বকে ভারতীয়ত্ব বলে চালাতে চাইলে মুসলমান বা খ্রিষ্টানদের দ্বারা সেটা কিছুতেই গ্রহণীয় হয় না।
ধর্মীয় আধিপত্যবাদের তুঙ্গে উঠে মােহন ভাগবত বলেছেন, মুসলমানদের শিরায় রাম ও কৃষ্ণের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, এই কথাটা মেনে নিয়ে বাবর নামে এক বিদেশী আক্রমণকারীর সঙ্গে নিজেদের যাবতীয় সম্পর্ক ছেদ করাই উচিত। যে রাম ও কৃষ্ণকে হিন্দুত্ববাদীরা সর্বজনীন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, তারা কি তাবৎ হিন্দুদের কাছে স্বীকার্য? দক্ষিণ ভারতের অনেক অংশ ও দ্রাবিড়দের কাছে রামচন্দ্র অবাঞ্ছনীয়। এ হেন রাম মুসলমানদের কাছেই বা কি করে গ্রহণীয় হতে পারেন? যদি মােহন ভাগবতে র কথা মেনেও নেওয়া যায় তাহলে তাদের উচিত রাম ও কৃষ্ণের উত্তরাধিকারী। হিসাবে মুসলমানদের যথাযথ সম্মান জানানাে। তবেই তারা রাম ও কৃষ্ণকে প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারবেন। কিন্তু আরএসএস-এর একমাত্র ভিত্তি ও দর্শন হচ্ছে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ। একারণে গুরু গােলওয়ালকর বলতেন, মুসলমান ভারতে থাকতে পারে শুধুমাত্র তারা যদি হিন্দুত্ব মেনে নেয়। আজকে মােহন ভাগবতও তাই বলছেন। এ থেকে স্পষ্ট, বিজেপি সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্যে যে নমনীয় মনােভাবই দেখাক না কেন, বিজেপির মতাদর্শগত চিন্তার ধারক ও বাহক আর এস এস তাদের হিন্দুত্ববাদী লাইন থেকে এক চুলও সরে আসেনি। আর সেই কারণেই তারা বাবরের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করার কথা বলেন। তাদের লক্ষ্য ভারতের যাবতীয় মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটিয়ে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া। আর সেইজন্য বাবরই প্রথম লক্ষ্যবস্তু।
আরএসএস ইন্দোনেশিয়ার দোহায় দিয়ে ভারতের মুসলমানদের হিন্দু সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ রামায়ণ-মহাভারত সুকৌশলে গলাধঃকরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বলছে, ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানেরা যদি হিন্দু সংস্কৃতি মেনে নেয় তাহলে ভারতীয় মুসলমানদেরও সেটাই মেনে নিতে হবে। মােহন ভাগবল্ল বােধহয় জানেন না, ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানেরা ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ঐ দুই মহাকাব্যকে পাঠ করেন না। তবে এটা ঠিক যে, ওদের দেশের লােকসংস্কৃতির ভিত্তি রামায়ণ ও মহাভারত। ইন্দোনেশিয়ার নাটক, থিয়েটার, কবিগান এসবেরও মূল উপাদান ঐ দুই মহাকাব্য। এসবই আমােদ-প্রমােদের জন্য পরিবেশিত হয়। আমাদের ভারতেও বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের বহু কাহিনিগুলি অনুরূপভাবে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এই শ্রদ্ধা নিবেদনের অর্থ এই নয় যে, ঐ সমস্ত হিন্দুরা মুসলিম সংস্কৃতি মেনে নিল। আসলে ইন্দোনেশিয়ার অধিবাসীরা ধর্মবােধের বিচারে যেমন মুসলমান তেমনই ঐ দুই মহাকাব্যকেও তারা ভালবাসে—এই দুই ভালবাসার মধ্যে কোনাে দ্বন্দ্ব ওরা এতদিন দেখেনি। এখন বিজেপি-র আত্মা আর এস এস-এর সাম্প্রদায়িকতাকে নিয়ে ওদের ভাবতে হবে (একইভাবে ভাবাবে থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বােডিয়া ও ব্রহ্মদেশের বৌদ্ধদেরও)। যেখানে পুরাতন সাংস্কৃতিক যােগসূত্রকে ভিত্তি করে আমাদের বাণিজ্যিকসম্পর্ককে বাড়াতে পারতাম, যেমন পেরেছি নেহেরুর সময়ে, সেখানে আর এস এস-এর সাম্প্রদায়িকতা ওদের হয়তাে ভারত থেকে দূরে ঠেলে দিবে।
মােহন ভাগবত বলেছেন, হিন্দুস্থানের মধ্যেই তাদের আনুগত্যকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে অর্থাৎ পবিত্রভূমির নামে মুসলমানদের মকাপ্রীতি ও খ্রিস্টানদের ভ্যাটিকান প্রীতি ছাড়তে হবে। আর এস এস প্রধানের হিন্দুধর্মের আন্তর্জাতিক চরিত্র নিয়ে মাথা ঘামানাের অভ্যাস গড়ে উঠলে মাতৃভূমি ও পবিত্রভূমি সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে নিজের বক্তব্যের অন্তঃসারশূন্যতা টের পেতেন। ইন্দোনেশিয়ার কথাই ধরা যাক, সে দেশের জনগণের একটা অংশ হিন্দু, বিশেষ করে বালিদ্বীপের বেশিরভাগ অধিবাসীই হিন্দু। এই হিন্দুরা যে ভারতকে তাদের পবিত্রভূমি বলে মনে করে তারও প্রমাণ আছে যথেষ্ট। তাই বলে কি সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা ইন্দোনেশিয়ার প্রতি সেদেশের হিন্দুদের আনুগত্য সম্পর্কে সন্দেহ পরায়ণ ? যদি তারা সেটাই করে থাকে তা কি খুব যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচিত হবে? তথাকথিত দেশপ্রেমীরা কখনও ভেবে দেখেছেন কি, একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপালের হিন্দুদের স্বদেশানুগের কথা? নেপালী হিন্দুদেরও পবিত্রভূমি ভারত। কিন্তু তাই বলে কি নিজের দেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে ভারত-বিরােধিতায় তারা কারও চেয়ে কম যায়? মাঝে মাঝে সীমানা নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে নেপালী হিন্দুদের বিক্ষোভে ফেটে পড়তে দেখা যায়। নেপালী হিন্দুদের এই আচরণ দিয়েই প্রমাণ হয় ধর্ম বিশ্বাসজনিত কারণে কারও পবিত্রভূমি স্বদেশের সীমানার বাইরে হলেও সেটা তার স্বদেশের প্রতি আনুগত্যে ঘাটতির কোনও কারণ হতে পারে না। তাছাড়া ভারতের সমস্ত হিন্দুই কি স্বদেশের প্রতি আনুগত্যপরায়ণ? উল্লেখ্য যে, অসমের আলফা বা বােড়াে জঙ্গী সংগঠন, যেটি মূলত বর্ণহিন্দুদের নেতৃত্বাধীন, তারা স্বাধীন সার্বভৌম অসম গঠনের প্রেরণা লাভ করল কি ধরনের ধর্মীয় চেতনা থেকে? তা কি হিন্দুত্ব? কিন্তু আরএসএস নেতারা তাে বলেন, হিন্দুরা পবিত্রভূমি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। তাহলে আলাদা করে মুসলমান বা খ্রিষ্টানদের দায়ী করা হয় কেন? আবার শ্রীলঙ্কার উদাহরণ আনা যাক, সেখানকার বৌদ্ধ ও হিন্দু উভয়েরই পবিত্রভূমি ভারত। এখন শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা যদি অভিযােগ করে তামিলরা হিন্দু হওয়ার কারণেই শ্রীলঙ্কা তাদের স্বদেশ হওয়া সত্বেও তার প্রতি তারা আনুগত্যপরায়ণ নয়, তাহলে আর এস এস নেতাদের কেমন লাগবে?
কিন্তু মােহন ভাগবল্লা যুক্তির ধারে কাছে যান না। তারা তাদের জঙ্গী কট্টরপন্থী ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ দ্বারা ভারতের ঐক্য ও সংহতিকে গুঁড়িয়ে দিতে চান। তারা হিন্দু-হিন্দী-হিন্দুস্থানের নামে যা করতে চাইছেন, তা মিশ্র সংস্কৃতির দেশ এই ভারতের বিভেদ ডেকে আনতে চলেছে। সারা পৃথিবীতে যখন প্রত্যেকটি জাতি গােষ্ঠীর নিজস্ব সত্ত্বা, বিশ্বাস ও আচার আচরণকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, আর এস এস তখন উল্টো পথে হাঁটতে চাইছে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।