লিখেছেনঃ রবিয়ুল হোসেন খান
কালবৈশাখহীন এই গীষ্মে মানুষ নামক এই জনঅরণ্য দারুণভাবে বিপর্যস্ত। শহর
কলকাতা থেকে জেলা শহর, গ্রামগঞ্জ সর্বত্র বিশ্রী গরমে হাইফাই …। কোথায় হারিয়ে
গেল কালবৈশাখীর সে হর্ষ। কোথায় হারিয়ে গেল আকাশের সেই ঘনঘোর কৃষ্ণমালার
মানুষের মন-কেমন-করা ঝড় আর বৃষ্টিধারা!
সেই বৈশাখ আজ আর আমাদের জীবনে আসছে না কেন? এটা কি আমাদের পাপের
ফল? অতীতকালে তো এমনটাই মনে করা হত। পাপপুণ্যের যোগাযোগ রয়েছে।
ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, বন্যা এসবই নাকি মানুষের পাপেরই ফল। এই দৃষ্টিভঙ্গি মহাত্মা
গান্ধীরও ছিল। তবে যুক্তি দিয়ে এই উদ্যমহীন কালবৈশাখীকে যদি বিচার করি তাহলে
এই পাপ বা পুণ্য প্রলাপ বলে বিবেচিত হলেও মানুষের কৃতকর্মের পাপই তো বৈকি!
মনুষ্য সভ্যতার অগ্রগতি প্রাকৃতিক পরিবেশকে অবিরাম ধ্বংস করে চলেছে; এটা কি
পাপ নয়! নির্বিচারে অরণ্য নিধন, প্রকৃতির রূপ বৈচিত্র্যকে বিনষ্ট করা, এটা কি পাপ
নয়! প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচিয়ে এই প্রকৃতিকে যতটুকু মানুষের ভোগ করার কথা ছিল
তার থেকে ৪০ শতাংশ বেশি ইতিমধ্যেই সে ভোগ করে ফেলেছে। এখনো তার নির্মম
হাত প্রসারিত। সাময়িক সুবিধা ভোগের জন্য সে গ্রাস করছে প্রকৃতিকে…। প্রকৃতিসৃষ্ট
কোটি বছরের নদী মানব সভ্যতার উন্নয়নে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বুজে যাচ্ছে।
তার বুকে বাঁধ। উপবাঁধ। ব্যাহত তার গতি ও তার প্রকৃতি। কোথায় হারিয়ে গেল।
সেইসব পাখি। ‘হায় চিল সোনালী ডানার চিল’ তুমি তো এখন শুধুই কবিতা। কোথায়
গেল শকুনের দল। চাতক বারি যাচে রে’ সেই কবি-পাখি আজ কোথায়! টিয়া, বুলবুল
এমনকি চড়ুই পাখিরও আজ বাড়বাড়ন্ত।।
।।২।।
প্রকৃতিপ্রেমী রসিক কবিরা একসময় ‘বৈশাখ’কে নানা রূপে নানা মূর্তিতে দেখেছেন,
বর্ণনা করেছেন। বৈশাখী তাপস প্রবর। বৈশাখী যেন পুরোনো বছরের জীর্ণতাকে উড়িয়ে
নিয়ে যায় আনে নতুন দিনের সকাল।…কবিশশাভন ও মনোলোভন এই কালবৈশাখীর
সেই অপরূপ রূপ লাবণ্য এখন কল্পলোকের কল্পনামাত্র।
প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্মম হাত এতটাই প্রসারিত হয়েছে যে, প্রকৃতিও তাই আজ
প্রতিশোধস্পৃহা হয়ে উঠেছে। কালবৈশাখী তার সেই মন-কেমন করা বহতা সৌন্দর্যকে
উড়িয়ে নিয়ে আমাদের ওপর আছড়ে ফেলছে সুনামী, নার্গিস, বিজলীর মতো ভয়ঙ্কর
ভয় আর ধ্বংস। প্রকৃতি অনেকটা নারীর উপমা। নারী যেমন সত্যিই ভালোবাসতে
জানে আবার একই নারী ভয়ঙ্কর সুনামীর মতো তছনছ করে দিতে পারে সংসার, …
সব সবকিছু। ফলত সৃষ্টিসুখের আনন্দটা এই মুহূর্তে আর নেই, নেই আর বৃষ্টি পড়ে
টাপুরটুপুর বৃন্দ গান। পরিবর্তে আছে শুধু পতন আর পতনের শব্দ। আজ তাৎক্ষণিক
সুবিধা’র লোভে আমরা প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধুমানসিকভাবেই নই মহামারিতে
আক্রান্ত হবার আশঙ্কার মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছি। হায় মানব সভ্যতা! হায়!
তবু সান্ত্বনা এইটুকু হে বৈশাখ, তুমি এই মাসেই পাঠিয়েছ আমাদের রবীন্দ্রনাথ …।
(সৌজন্যেঃ নতুন গতি, মাসান্তিক, মে ২০০৯)