একসময় অ্যাডলফ হিটলার বলেছেন, দুনীয়ায় যেকোনাে উল্লেখযােগ্য অপরাধকান্ডের পেছনে থাকে কোনাে কোনাে ইহুদীর হাত।
হিটলার যখন একথা বলেন তখন ইহুদীরা ছিল গােটা দুনীয়া জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। বিচ্ছিন্ন সংগঠনহীন। রাষ্ট্রহীন। কিন্তু অত্যাচারী আমেরিকা-ব্রিটেন গােটা বিশ্বের ইহুদীদের জড় করে। ফিলিস্তীনে, ফিলিস্তীনীদের তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে। গড়ে ওঠে অবৈধ ইসরাঈল রাষ্ট্র। এরপর ওই আমেরিকা-ব্রিটেন ও ইউরােপীয়দেরই সহযােগিতায় দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে ওঠে ইসরাঈল। হিটলারের মন্তব্য অনুযায়ী বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রহীন ইহুদীরা ছিল অত বিপজ্জনক। তাহলে রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক, খ্রীস্টান ইউরােপ-আমেরিকার পােষ্য ইসরাঈল কত ভয়ানক হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না নিশ্চয়ই।
হয়েছেও তাই। ইসরাঈল শুধুমাত্র ফিলিস্তীনীদের জীবন ও অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক নয়। গােটা আরব মুলুকের জন্য বিপজ্জনক। এমনকি, তামাম বিশ্বের জন্য চরম আতঙ্কের কারণ।
পশ্চিমা মুলুকের অন্যায় আদরে শক্তি সঞ্চয় করে ইসরাঈল। ফলে সামরিক শক্তিতে উন্নত হলেও ইসরাঈলের শক্তির মূল উৎস এর গােয়েন্দা বিভাগ ‘মােসাদ’। বিশ্বব্যাপী বিপদের কারণ এই ‘মােসাদ’। হিটলারের কথামত, ১৯৫০ সালের আগে পর্যন্ত যেকোনাে উল্লেখযোেগ্য অন্তর্ঘাতের পেছনে যদি থাকে কোনাে না কোনাে ব্যক্তি ইহুদীর হাত তাহলে ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর হয়তঃ যেকোনাে উল্লেখযােগ্য অন্তর্ঘাতের পেছনে থাকে ইহুদী গােয়েন্দা সংগঠন মােসাদের হাত।
মােসাদ এমনই বিপজ্জনক সংগঠন যে যাদের পৃষ্ঠপােষকতায় ইসরাঈলের জন্ম এবং – ইসরাঈলের বৃদ্ধি, তারাও মােসাদের ভয়ে তটস্থ। ইসরাঈলের অন্যতম জন্মদাতা আমেরিকার গােয়েন্দা সংস্থা সিআইএ মার্কিন সংসদে একটি গােপন রিপাের্ট পেশ করে মােসাদ প্রসঙ্গে। এতে বলা হয়, মােসাদের গােয়েন্দারা আমেরিকায় আর্থিক ও বৈজ্ঞানিক টেকনলজি চুরি করার প্রয়াসে লেগে থাকে। কথায় বলে, স্বর্ণকার মায়ের কানের সােনায়ও হাত মারে। ইসরাঈলের জন্মদাতা বাপ বা মা এই আমেরিকা। ইসরাঈলকে খাইয়ে-পরিয়ে, হেফাযত করে লালনপালনও করে চলেছে এই আমেরিকাই। সেই জন্মদাতার ঘরেই অন্ধকারে সিঁধ দেওয়া এই মােসাদের কাজ। এমনই বিশ্বাসঘাতক এবং বিপজ্জনক ইসরাঈল এবং এর গােয়েন্দা সংগঠন মােসাদ। আসলে অবৈধ সৃষ্টি অবৈধভাবে লালনপালন করলে যা হয়।
ইসরাঈলের দ্বিতীয় জন্মদাতা ও পালক-পিতা ব্রিটেন। সুযােগ পেলে তার ঘরেও ইসরাঈল চুরি করতে ছাড়ে না। ব্রিটেনের গােয়েন্দা সংস্থা এম আই-৫ প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারকে জানায় যে ব্রিটেনের বিজ্ঞান ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি গােপনে সংগ্রহ করার প্রয়াসে লেগে আছে মােসাদ।
অন্যান্য ইউরােপীয় পালক পিতারাও রেহাই পায় না ইসরাঈলের হাত থেকে। জার্মানীর মত শক্তিশালী দেশও তা টের পেয়ে যায় হাড়ে হাড়ে। ১৯৯৮ সালে জার্মান স্বরাষ্ট্র বিভাগীয় গােয়েন্দা সংস্থা বিএফডি তার সরকারকে অবগত করায় যে মােসাদের গােয়েন্দারা আধুনিক কমপিউটার টেকনলজি চুরি করার চক্করে লেগে আছে। এই আলােচনায় দেখা যাচ্ছে মােসাদ এমনই ভয়ংকর বিপজ্জনক গােয়েন্দা সংস্থা যে সে তার রাষ্ট্রের জন্মদাতাই শুধু নয়, পালক পিতাদেরও ঘরে সিঁধ কাটতে কসুর করে না।
আমেরিকার সিআইএ, রাশিয়ার কেজিবি, ব্রিটেনের এম, আই-৫, জার্মানীর বি এন ডি পাকিস্তানের আইএসআই এবং ভারতের ‘র’ ইত্যাদি গােয়েন্দা সংস্থা আন্তর্জাতিক স্তরে বিশেষ পরিচিতি বহন করে। বিশেষভাবে সিআইএ এবং কেজিবি। কিন্তু এসবকে ছাপিয়ে গেছে ইসরাঈলের মােসাদ।
প্রত্যেক দেশের গােয়েন্দা সংস্থার চরিত্র দুরকমের। এক একটি দেশের একাধিক গােয়েন্দা সংস্থা থাকে। একই দেশের এক বা একাধিক সংস্থা কাজ করে আভ্যন্তরীণ স্তরে, আর কোনাে একটি সংস্থা কাজ করে আন্তর্জাতিক স্তরে। উপরােক্ত সংস্থাগুলাে সবই কাজ করে আন্তর্জাতিক স্তরে।
যেমন আমাদের দেশে মূলতঃ তিনটি গােয়েন্দা সংস্থা আছে। সিবিআই, আইবি এবং ‘র’। এরমধ্যে, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ‘র’ কাজ করে আন্তর্জাতিক স্তরে। ইসরাঈলের ক্ষেত্রেও মােসাদ মূলতঃ আন্তর্জাতিক স্তরে কাজ করে। শেন বাইয়েত আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আর আমান যুক্ত সামরিক বাহিনীর সঙ্গে।
মােটামুটি সি আই এ-কে গােটা দুনীয়া একটি খতরনাক সংস্থা বলে জানে। কিন্তু মজার কথা হল এই সিআইএ-ই আবার স্বয়ং মােসাদকে অনেক খতরনাক বলে মনে করে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সিআইএ-র ৯৫ পাতার একটি রিপাের্টে। এতে খুন, যখম, স্মাগলিং এবং এধরনের অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধকান্ডের সঙ্গে জড়িত একটি বিপজ্জনক সংগঠন হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে মােসাদকে।
মােসাদের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৮ সালে, অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাঈলের জন্মের তিন বছর পরে। সন্ত্রাসবাদী ইহুদী নেতৃবৃন্দ এমন কিছু গুন্ডা, পেশাদার খুনী ও জঙ্গী গ্রুপের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন যারা বৃহত্তর ইসরাঈল রাষ্ট্র গঠনের পথে প্রতিবন্ধক এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে হত্যা করবে, প্রত্যেক সংস্থাকে ধ্বংস করবে এবং প্রতিটি পরিকল্পনা বানচাল করে দেবে। এই লক্ষ্যপূরণে তামাম দুনীয়া খুঁজে এমন ইহুদীদের নির্বাচন করা হয় যারা যে ফিল্ডে দক্ষ। এছাড়াও জঙ্গী যুবক ইহুদীদেরকে অন্তর্ভূক্ত করা হয় এই সংগঠনে।
এরপর রুশ ও আমেরিকা মােসাদের সদস্যদের তাদের দেশে নিয়ে গিয়ে উঁচু স্তরের প্রশিক্ষণ দেন। এছাড়াও সিআইএ এবং কেজিবি-র উচ্চতর অফিসারদের কোর্সও তাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়। এসব করা হয় আমেরিকা-রাশিয়ার বিশেষ স্বার্থে। কারণ তাদের গােপন এজেন্ডা, এই মােসাদই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের স্বার্থরক্ষা করবে আগামী দিনে। তাদের এই পরিকল্পনা যে সফল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মােসাদের প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ইতিহাস এর প্রমাণ।
মােসাদের একটি বৈশিষ্ট হল এই সংস্থাটি খুবই কম লােকজন নিয়ে কাজ করে। একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যান গ্রহণ করলে বিষয়টি উপলব্ধি করা যাবে। সি আই এর এজেন্ট এক লক্ষ পঁচিশ হাজারের মত আর কেজিবি-র এজেন্টের সংখ্যা অন্ততঃ আড়াই লক্ষ। অথচ মােসাদের মেন বডিতে এজেন্টের সংখ্যা মাত্র ১২০০। এদেরকে ‘কাটসা’ বলা হয়। এই নগন্য সংখ্যা নিয়ে।
মােসাদ দুনীয়ার অন্যতম শক্তিশালী গােয়েন্দা সংস্থা হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এর এজেন্টদের পেশাদারিত্ব এবং বিশ্বস্থতা। একথা স্বীকার করে যেমন সি আই এ তেমনি মােসাদসম্পর্কে যারা অল্পবিস্তরও জানে তারাও।
তবে এটা সম্ভব হয় মূলতঃ অন্য একটি কারণেও। ইসরাঈলে ফৌজী প্রশিক্ষণ আবশ্যিক। সেজন্য মােসাদ অল্প পারিশ্রমিকে পেয়ে যায় হাজারাে স্বেচ্ছাসেবীর সাহায্য।এই স্বেচ্ছাসেবীদেরকে ‘সাপানম’ বলা হয়। মােসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘সাপানুমের’ সংখ্যা অন্ততঃ ৩৫০০০।
মােসাদের প্রধান লক্ষ্য মুসলিম দুশমনী। ইসলাম ও মুসলিম বিরােধী ছােট-বড় প্রায় সকল ঘটনার পেছনে থাকে মােসাদের গােপন ভূমিকা। সাম্প্রতিককালের এর এক বড় উদাহরণ চেচনিয়া। এখানে মুসলিম নিধনযজ্ঞে রাশিয়াকে ভরপুর সহযােগিতা করে ইহুদীরা। মােসাদ রাশিয়াকে ২০ বিলিয়ন ডলার আইএমএফ আর্থিক সাহায্য পাইয়ে দেয়। কারণ আইএমএফ মূলতঃ ইহুদী সংগঠন। কিন্তু মােসাদের এজেন্ট ওখানে যা কিছু করে তার কোনাে প্রত্যক্ষ রের্কড পাওয়া যায়।
মােসাদের প্রােপাগান্ডার আরও একটি বিপজ্জনক উদাহরণ ইরাক। পরমানু গবেষণায় আরব দুনীয়ার মধ্যে ইরাকই প্রথম উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি লাভ করে। এটা অসহ্য হয়ে ওঠে যিয়নবাদী, ইসরাঈলের কাছে। ইসরাঈল মনে করে, তার প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্র পরমানু শক্তিধর হয়ে উঠলে তার যথেচ্ছাচার আর চলবে না আরব দুনীয়ায়। এই পরিস্থিতিতে মােসাদ হয়ে ওঠে তৎপর। ইসরাঈলের সাবেক ফৌজী জেনারেল এবং মােসাদের ডাইরেকটর একটি গােপন চক্রান্তের ছক রচনা করে। এই চক্রান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসরাঈলের এফ-১৫ এবং এফ-১৬ জঙ্গী বিমান হামলা করে ইরাকের পরমানু রিএ্যাক্টরের ওপর যাবতীয় আন্তর্জাতিক আইন-কানুন লঙ্ঘন করে। ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয় ইরাকের পরমানু রি-এ্যাক্টর এবং ১২টি এফ-১৬ জঙ্গী বিমান। উপরন্তু, ইরাকের অন্যতম পরমানু বিজ্ঞানী নিহত হয় মােসাদের এজেন্টের হাতে প্যারিসের একটি হােটেলে। এভাবে ইরাকের পরমানু পরিকল্পনা ধ্বংস হয়ে যায় মােসাদের নিপুন চক্রান্তে।
কিন্তু কাহিনী এখানেই শেষ হয় না। বরং বলা যায়, এখান থেকেই শুরু আরাে বিপজ্জনক পর্যায়ের। ইরাকের সামরিক শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার এক সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া শুরু হয়। আমেরিকার সিআইএ-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে মােসাদ বাস্তবায়ন করে ওপারেসান ডেজার্ট স্টর্ম (Operation Desert Storm)। সাদ্দাম হােসেনের নেতৃত্বাধীন ইরাকী প্রশাসনকে নানানভাবে উস্কানী দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র কুয়েতকে হামলা করতে প্রলােভিত করা হয়। সাদ্দামের জেহাদী চরিত্রে প্রভাবিত হয়ে দুনীয়ার লক্ষ লক্ষ মুসলিম জনগণ এতদিন এ ধারণা পােষণ করত যে তিনি ইসরাঈলকে সমুচিত শিক্ষা দেবেন। সেইসব জনগণই চরম বিস্ময়বােধ করে যখন তারা দেখে যে ইরাক বাহিনী দখল করেছে কুয়েত। এমনকি সৌদী আরবের বিরুদ্ধেও হুমকী দিতে থাকে ইরাক সরকার।
এই পরিস্থিতিতে এবং এই পর্যায়ে সৌদী সরকার করে আমেরিকার সাহায্য প্রার্থনা। ইরাককে পঙ্গু করার জন্য এমনই একটি সুযােগের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে বসেছিল সুচতুর মার্কিন প্রশাসন বহুদিন থেকে। সে সুযােগ এসে যাওয়ায় আমেরিকা আর কালবিলম্ব করেনি। এতটুকুও। ৩১টি সহযােগী রাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা ঝাপিয়ে পড়ে ইরাকের ওপর। উন্নত প্রযুক্তির দেশ ও সমৃদ্ধশালী ইরাককে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া হয় মাত্র কয়েক সপ্তাহে।
ইরাক ভূমির প্রতিটি কণা রক্ত রঞ্জিত হয়ে যায় হাজারাে নিরীহ মুসলমানের খুনে। এখানেও থেমে থাকে না এই মর্মবিদারী কাহিনী। ইসরাঈলের অস্তিত্ত্বের জমানত হিসাবে সৌদী আরবের পবিত্র ভূমিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেড় লাখ মার্কিন ফৌজ। সৌদী আরবের মাটিতে মােতায়েন এই তামাম বাহিনীর ভরণপােষণের দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় সৌদী আরবের ঘাড়ে। রাষ্ট্রীয় তেলের পয়সায় এই বিপুল খরচ নির্বাহ করতে করতে সমৃদ্ধশালী সৌদীর আর্থিক অবস্থা সঙ্গীনতর হয়ে ওঠে। এমনকি, এই আর্থিক বেহাল অবস্থা সামাল দিতে সৌদী আরবকে ঋণের জন্য হাত পাততে হয় অন্য দেশের কাছে। অথচ এই অন্যতম সমৃদ্ধশালী সৌদী আরব একদিন প্রতিটি দরিদ্র ও দৃর্গত দেশের পাশে দাঁড়াত এবং তাদেরকে যথাসম্ভব সাহায্য করা আবশ্যিক কর্তব্য মনে করত। খােদ সেই সৌদী আরবই এখন অন্যের ভিক্ষাপ্রার্থী। এর চেয়ে করুণতম পরিণতি আর কি হতে পারে!
অন্যান্য উদ্দেশ্য সিদ্ধি ছাড়াও মােসাদ সমর্থ হয় এক তীরে দুটি প্রধানতম শিকার করতে। একদিকে ইরাকের উন্নত প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তি ধ্বংস অন্যদিকে সমৃদ্ধশালী সৌদী আরবকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া।
তবে শুধু সৌদী আরব নয়। অন্যান্য আরব দেশকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের তামাম খরচ বহন করতে হয় গােটা আরব বিশ্বের দেশগুলােকে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ যােগাতে বহু দেশের আর্থিক ব্যবস্থায় টান পড়ে। অথচ ভাগ্যের কি করুণ পরিহাস, আমেরিকার যতসব গুদাম-পচা হাতিয়ার ব্যবহৃত হয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের অর্থের বিনিময়ে। আমেরিকা-ব্রিটেন যখনই চায় ইরাকের ওপর বােমাবাজি করতে পারে। উপরন্তু, নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ক্ষুধার্ত-পিপাসার্ত-রােগাক্রান্ত করে তাে রাখাই হয়েছে ইরাকী জনগণকে। এই অপারেসানে লাখাে মুসলমানের জীবনহানি হয় অথচ আঁচ পর্যন্ত লাগেনি ইহুদীদের গায়ে।
দ্বিতীয় আরব-ইসরাঈল যুদ্ধেও মিসরের করুণ পরিণতি মােসাদেরই কৃতিত্বের ফসল। মিসরের তামাম বিমানবহর ধ্বংস হয়ে যায় ইসরাঈলের পরিকল্পিত ছকেই। আসলে ইনস্ট্রাক্টরের ছদ্মবেশে মােসাদের এজেন্টরা মিসরীয় বিমানবহরের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে। এদেরই পরিকল্পিত ছকে তামাম মিসরীয় জঙ্গী বিমানকে যুদ্ধের প্রথম দিনেই ব্যাঙ্গারের বাইরে লাইনে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় যেন অপেক্ষা করা হতে থাকে কখন ইসরাঈলী জঙ্গী বিমান এসে আক্রমণ। করবে এবং ধ্বংস করে দেবে গােটা বিমানবহরকে। বাস্তবে ঘটেও তাই। ইসরাঈল একইসঙ্গে সেইসব তামাম স্থানে আক্রমণ হানে যেখানে যেখানে মিসরীয় বিমানবহর নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিল ধ্বংসের অপেক্ষায়। মিসরের প্রায় ৫০০ বিমানকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। মুহুর্তের মধ্যেই।
কোনােরূপ প্রতিরােধ ছাড়াই। মাটিতে অপেক্ষারত মিসরীয় বিমানবহর মিশে যায় মিশরের মাটিতে। ফলে শক্তিহীন হয়ে পড়ে মিসর। তার আর কোনাে ভূমিকা থাকে না এ যুদ্ধে। ইসরাঈল বিজয়ী হয় সহজেই।
আফগানিস্তানে রাশিয়ায় বিরুদ্ধে জেহাদের সময় এবং মােসাদ ও কেজিবি কাজ করে হাত ধরাধরি করে। তারা সর্বদা তৎপর থাকে মজাহিদদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আফগানিস্তানে পরাজিত হয় রাশিয়া। তবুও ক্ষান্ত হয়নি মােসাদ। তারা পালন করে অন্য ভূমিকা। এবার তারা মদদ যােগাতে থাকে কমিউনিস্ট গ্রুপকে। একথা হাতেনাতে প্রমাণিত হয় যখন তালিবানরা আক্রমণ করে কামউনিস্টদের কেন্দ্র পাঞ্জশের। এখানে মােসাদের এজেন্টরা তালিবানদের সঙ্গে মুখােমুখি লড়তে লড়তে নিহতও হয় এবং গ্রেফতারও হয়।
ইসরাঈল বিরােধী পলিসি গ্রহণের শাস্তিস্বরূপ কলােম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরদ্ধে মােসাদ রচনা করে এক চরম ঘৃণ্য পরিকল্পনা। তাকে জড়িয়ে দেওয়া হয় হিরােইন স্মাগলিং কেলেঙ্কারির সঙ্গে। গােটা দুনীয়ার কাছে তাকে কলঙ্কিত করা হয়। অথচ এই হিরােইন স্মাগলিং সম্পর্কে সাবেক প্রেসিডেন্ট জানতেন না কিছুই।
ইসলামী সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলেমূনের বিরুদ্ধে যাতে কড়া ব্যবস্থা গৃহীত হয় সেজন্য মােসাদ তার নিজস্ব ছকে হামলা করিয়ে দেয় মিসরের প্রেসিডেন্ট হুসনী মুবারকের ওপর। অথচ এই আক্রমণের জন্য দোষারােপ করা হয় ইখওয়ানুল মুসলেমূনকে।
ইসরাঈলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তীনীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন হামাস। এই সংগঠনের রাজনৈতিক শাখার প্রধান খালিদ মাশয়ালকে হত্যা করার জন্য মােসাদ তার ওপর অতর্কিত হামলা করে জর্ডনে। তবে তিনি বেঁচে যান সৌভাগ্যক্রমে।
মােসাদ নিজের লােককেও খুন করতে পিছপা হয় না যদি সে মনে করে সেই ইহুদী নেতা বা ব্যক্তি ইহুদী স্বার্থবিরােধী কাজ করছে। এই পরিণতির শিকার হন ইসরাঈলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইজহাক রবীন। মােসাদ মনে করে, ইজহাক নরম পলিসি গ্রহণ করে চলেছে ফিলিস্তীনীদের প্রতি। তাই মােসাদ তাকে হত্যা করে সরিয়ে দেয় দুনীয়ার রঙ্গমঞ্চ থেকে।
আবার ইসরাঈলের তৈরী অস্ত্রশস্ত্রের ক্রেতা সন্ধান করাও মােসাদের দায়িত্ব। তবে একাজেও মােসাদ ভুমিকা পালন করে দক্ষতার সঙ্গে। উস্কানী দিয়ে দু’দেশের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ বাড়িয়ে দেয় মােসাদ। এর পরিণতিস্বরূপ তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তখন উভয়পক্ষের অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়ােজন মেটানাের জন্য ইসরাঈল তাদের কাছে হাজির হয় তার অস্ত্রভাণ্ডারের প্রস্তাব নিয়ে।
এর উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্ব জুড়ে। ইসরাঈলী অস্ত্রভাণ্ডারের সবচেয়ে বড় ক্রেতা তুরস্ক। তুরস্ক সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণও দেয় ইহুদীরা। আবার তুকাবিরােধী কুর্দদেরও প্রশিক্ষণ দেয় ইসরাঈলই।
এই পরিস্থিতি বিরাজমান শ্রীলঙ্কাতেও। তামিল টাইগার্সদের অস্ত্রশস্ত্র যােগান ও প্রশিক্ষণ উভয়ই দেয় ইসরাঈল। কবরজে তুর্কী ও গ্রীকদের মধ্যে অব্যাহত সংঘর্ষেও ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের বেশীরভাগই ইসরাঈল নির্মিত।
আফ্রিকার জাতিদ্বন্দ্বেও মােসাদ সমান সক্রিয়। কালাে এবং গােরা উভয়েরই ঘনিষ্ঠতা অর্জন করে ইসরাঈল। আর উভয়েরই কাছ থেকে তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করতে সমর্থ হয়।
তবে বিভিন্ন দেশে ইসরাঈলের স্বার্থ পূরণের জন্য মােসাদের অব্যর্থ অস্ত্র হল ইহুদী সুন্দরীরা। ইসরাঈলের স্বার্থের খাতিরে এইসব সুন্দরীরা তাদের জীবন-যৌবন উৎসর্গ করে দেয়। তাদের যৌবন ও সৌন্দর্যের বিনিময়ে মােসাদ পূরণ করে তার অভীষ্ট লক্ষ্য। মুসলিম দেশগুলােতে এইসব যুবতীদের আনাগােনা অবাধ। শিকার ধরতে তারা জাল পেতেই থাকে সদা-সর্বদা। আর সেই জালে সহজেই ধরা পড়ে মুসলিম বিশ্বের ধনদৌলত ও কামনাবাসনার পূজারী বহু নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা। এইসব সুন্দরীদের মােহময়ী ছলনায় তারা এমনসব কাজ করে বসে যা অত্যন্ত ক্ষতিকর ও অবমাননাকর মুসলিম উম্মাহর জন্য। সামগ্রিকভাবে।
কিন্তু মুসলিম উম্মাহর এত বড় বিপজ্জনক দুশমন মােসাদকে প্রতিরােধ করার মত কোনাে পাল্টা সংগঠন নেই গােটা মুসলিম দুনীয়ায়। তেমন সামগ্রিক চিন্তাভাবনাও নেই। এখানেই নিহীত বিশ্ব-মুসলিমের করুণ ট্রাজেডী।
একথা বারবার বলা হয়েছে যে ইসরাঈল ও মােসাদের শক্তির উৎস আমেরিকার মত, সুপারপাওয়ার। আর এটা সম্ভব হয় কারণ আমেরিকার সমাজ ও রাজনীতির ঘরে-বাইরে রয়েছে ইসরাঈলের মজবুত নিয়ন্ত্রণ। মাত্র কয়েক হাজার ইহুদীর নাগপাশে বাধ্য আমেরিকা। এটাও মােসাদের নেটওয়ার্কের ফসল।
বিভিন্ন দেশে আমেরিকার পলিসি, উদ্দেশ্য ও গােপন তৎপরতার ওপর কড়া নজর রাখে মােসাদ এবং মার্কিন সিনেটে ইহুদী লবীর মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে এইসব পলিসিতে। এমনকি আর্থিক বিনিয়ােগের মাধ্যমে তারা প্রভাব বিস্তার করে অন্যান্য, সিনেটরদের ওপরও। এভাবে মার্কিন সিনেটে গড়ে ওঠে এক বড় ইসরাঈল সমর্থক গােষ্ঠী। ফলে মােসাদ যা কিছুই চায় তা প্রায় সবকিছুই অনুমােদিত হয় মার্কিন সিনেটে।
এই লবী এত সংগঠিত ও শক্তিশালী যে কোনাে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী এই লবীকে উপেক্ষা করার কথা ভাবতেই পারেন না। এই বিশেষ লবীর পলিসিই মার্কিন পলিসি হিসাবে পরিগণিত হয় যদিও তা মার্কিন স্বার্থবিরােধী হয়। কিন্তু কোনােক্রমে ইসরাঈলের স্বার্থহানি যেন না হয়। কিছু বিশেষজ্ঞ এও পর্যন্ত বলেন যে আমেরিকার ভাগ্য এখন নির্ধারিত হয় ওয়াশিংটনে খুব কমই, বেশীরভাগই নির্ধারিত হয় তেল আবীবেই। আবার এটাও সত্য যে মার্কিন ফৌজও মােসাদের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। বরং সামরিক বাহিনীতে এক বড় সংখ্যক অফিসার ইহুদী গােষ্ঠীভূক্ত। সুতরাং মার্কিন সামরিক নীতিতেও মােসাদের প্রভাব প্রবল।
সুতরাং নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে ভয়ংকর হানাদারীর পেছনে মােসাদের হাত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বেশ কিছু মহল থেকে, বিশেষ করে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক আরবী বুদ্ধিজীবী, আরবী পত্র-পত্রিকা ও মুসলিম দুনীয়ার তরফ থেকে জোরদার অভিযােগ আনা হয় মােসাদ ও ইসরাঈলের বিরুদ্ধে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।