বাংলা সাহিত্যের সূচনা : খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বঙ্গদেশ মৌর্যাধিকারে আসে এবং সম্ভবত সেইসঙ্গে আর্যভাষাও এদেশে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। আর্যভাষার সরাসরি প্রভাব ছাড়াই প্রাকৃত ভাষা হতে বাংলা ভাষার উৎপত্তি—সঠিক কোন সময় হতে তা সুস্পষ্ট বলা না গেলেও বৌদ্ধ জনগােষ্ঠীর দ্বারাই যে বাংলা ভাষা-সাহিত্য চর্চার সূচনা হয়েছিল তা বলাই যায়। শুধু তাই নয়, বৌদ্ধধর্মকে আশ্রয় করেই বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন পর্বটি অগ্রসর হয়েছিল। এই পর্বটি খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি হতে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। এ যুগে বাংলা সাহিত্যের তাে দূরের কথা, বাংলা ভাষার নিজস্ব রূপটিও সৃষ্টি হয়নি। এ যুগের ভাষা-সাহিত্যের নিদর্শনরূপে বৌদ্ধ ধর্মাচার্যদের রচিত কতকগুলাে প্রহেলিকাপূর্ণ পদ পাওয়া যায়। এগুলােকে চর্যাপদ বলা হয়। চর্যাগুলাে খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত হয়ে থাকবে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) এবং রাহুল সাংকৃত্যায়নের (১৮৯৩-১৯৬৩) মতে, দোহা ও চর্যাসমূহের রচনাকালকে আরও দু’শাে বছর পিছিয়ে দিয়ে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন তার ‘পুরাতাত্ত্বিক নিবন্ধাবলী’১ গ্রন্থে এবং জার্নাল অব এশিয়াটিক সােসাইটি’২ পত্রিকায় প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন যে, পাল রাজা ধর্মপালের (৭৬৯-৮০৯) সময়ে বর্তমান ছিলেন চর্যা-রচয়িতা সিদ্ধাচার্য লুইপাদ এবং সরহপাদ। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ পত্রিকায়৩ পদকর্তা ভুসুকপাদ ও কাহ্নপাদকে অষ্টম শতাব্দীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কিন্তু সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) তার সুবিখ্যাত ‘দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে (১৯২৬) এবং প্রবােধচন্দ্র বাগচী (১৮৯৮-১৯৫৬) তাঁর ‘দোহাকোষ’ গ্রন্থে চর্যা রচনার সীমা নির্দেশ করেছেন দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) বলেছেন যে, লুইপাদের ‘অভিসময়বিহঙ্গ’ রচনায় প্রসিদ্ধ বৌদ্ধাচার্য দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮২-১০৫৪) সাহায্য করেছিলেন। কথিত আছে, আটান্ন বছর বয়সে (১০৩০) দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বত যাত্রা করেছিলেন। তা সত্য হলে লুইপাদও মধ্যযুগে দশম শতাব্দীর কাছাকাছি আবির্ভূত হয়ে থাকবেন। তিব্বতী কিংবদন্তি মতে, সিদ্ধাচার্যদের আদিগুরু লুইপাদ। সুতরাং চর্যাপদ রচনার প্রাচীনতম সীমাকে দশম শতকের শেষভাগ পর্যন্ত নির্দেশ করা যায়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাপদের ভাষা এবং কাহ্নপাদ ও গােরক্ষনাথের আনুমানিক আবির্ভাবকাল ধরে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, চর্যাপদগুলাে ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়ে থাকবে।
বৌদ্ধধর্মের সহজযান শাখার সিদ্ধাচার্যগণ তাদের শিষ্য ও অনুসারীদের কাছে ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে চর্যাপদগুলাে রচনা করেছিলেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের পুঁথিশালা থেকে সহজপন্থী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রচিত এই পুঁথি আবিষ্কার করেন। এই পুঁথিতে চর্যাপদ ছাড়া সরহপাদ ও কাহহ্নপাদের দোহাকোষ সংযােজিত ছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সবকটি গ্রন্থের সমন্বয়ে হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় ‘বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে এই গ্রন্থ ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (১৩২৩ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয়। সবকটি গ্রন্থের ভাষা হাজার বছরের পুরনাে বাংলাভাষা বলে তার অনুমান।
চর্যাপদের মােট ৫০টি পদের ২৩ জন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। আরাে একজন পদকর্তার নাম আছে কিন্তু তার পদটি নেই। সেটি ধরলে চর্যার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১ এবং পদকর্তা ২৪ জন।৪ নেপালী পুঁথিতে কয়েকটি পাতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে সাড়ে তিনটি চর্যা (যথা ২৩ সংখ্যক চর্যার অর্ধেক, ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক চর্যা) পাওয়া যায়নি। কিন্তু তিব্বতী অনুবাদে সেগুলাে পাওয়া যায়।৫ তিব্বতী অনুবাদ অবলম্বনে সুকুমার সেন (১৮৯৯-১৯৬১) তাঁর ‘চর্যাগীতি পদাবলী’র পাঠ স্থির করেছেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দৃঢ় অভিমত, চর্যাপদের ভাষায় বাংলা ভাষার প্রাচীনত্বের লক্ষণ বিদ্যমান। চর্যাপদে ব্যবহৃত শব্দাবলীর একটি তালিকাও তিনি প্রস্তুত করেছেন। সংস্কৃত (তৎসম) শব্দগুলােকে বাদ দিয়ে তিনি চর্যার বিভিন্ন পদে প্রাপ্ত তদ্ভব ও দেশী শব্দের সঙ্গে প্রাচীন বাংলা ভাষার শব্দ ও ব্যাকরণের একটি তুলনামূলক আলােচনা করেছেন। এইভাবে তিনি প্রাচীন বাংলাভাষার শব্দকোষ ও ব্যকরণ আলােচনায় সুষ্ঠু পথনির্দেশ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন,
“আমার বিশ্বাস যাঁরা এই ভাষা লিখিয়াছেন তাহারা বাঙ্গালা ও তন্নিকটবর্তী দেশের লােক। অনেকে যে বাঙালি ছিলেন, তাহার প্রমাণও পাওয়া গিয়াছে। যদিও অনেকের ভাষায় একটু আধটু ব্যাকরণের প্রভেদ আছে, তথাপি সমস্তই বাঙ্গালা বলিয়া বােধহয়।”
চর্যাগীতির ভাষা যে প্রধানত ও মূলত বাংলা সুনীতিকুমার চট্টেপাধ্যায় ‘দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ও চুলচেরা ভাষাতাত্ত্বিক আলােচনার দ্বারা সেকথা প্রতিপন্ন করেছেন সুস্পষ্টরূপে। অধিকাংশ ভাষাবিজ্ঞানী পণ্ডিতের দ্বারা সমর্থিত হয়েছে তার এই অভিমত। চর্যাপদের ব্যাকরণ, ছন্দ ও অলঙ্কারে কিছু কিছু ব্যতিক্রম দৃষ্টিগােচর হলেও সেগুলােতে বাংলা ভাষার আদিরূপ বিধৃত। এগুলাের সাহিত্যিক মূল্য তেমন না থাকলেও ভাষা-সাহিত্যের আদিম রূপের অতি মূল্যবান নিদর্শন হিসেবে তা ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
বাংলা সাহিত্যের ‘অন্ধকার যুগ’ : পুনর্বিবেচনা
মধ্যযুগে তথা ত্রয়ােদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুসলিম আগমনের ফলে দেশের পরিবেশ পরিবর্তিত হয়ে যায়। বখতিয়ার খলজির বাংলা দখল (১২০৪) এবং পরবর্তীতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির দুয়ার খুলে দেয়। অথচ বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের শুরুতেই ১২০৪ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত সময়কে তথাকথিত ‘অন্ধকার যুগ’ বলে একটি বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। মধ্যযুগের সাহিত্যের অস্পষ্ট আঙিনায় যথােপযুক্ত আলােকপাত না করেই গুরুত্বপূর্ণ অবদানের প্রতি যথার্থ মর্যাদা না দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণােদিত হয়ে বিতর্কের ধূম্রজাল সৃষ্টি করার উদ্যোগ এতে লক্ষ করা যায়। অতীত দিনের লুপ্ত সাহিত্যের সম্পদ অনুসন্ধান প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়ে যায়নি। গবেষণা কর্মের মাধ্যমে নিত্য নতুন তথ্যের আবিষ্কার করে সাহিত্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার অনেক অবকাশ এখনও রয়েছে। তা না করে তথাকথিত অন্ধকার যুগ আখ্যা দিয়ে মধ্যযুগের মূল্যবান অবদানকে অস্বীকার করার চেষ্টা চলছে।
১২০৪ সালে মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলার শাসক লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নদীয়া বিনা বাধায় জয় করে এদেশে মুসলমান শাসনের সূত্রপাত করেন। ১৩৪২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ গৌড়ের সিংহাসন দখল করে বাংলায় দিল্লির শাসনমুক্ত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর পুত্র সেকান্দর শাহের আমলে বড়ু চণ্ডীদাসের আবির্ভাব হয়। বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মধ্যযুগের প্রথম সার্থক নিদর্শন।
মুসলমান শাসনের সূত্রপাতে দেশে রাজনৈতিক অরাজকতার অনুমান করে কোনও কোনও পণ্ডিত মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ বলে চিহ্নিত করেছেন। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯২-১৯৭০) তঁার ‘বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা’ গ্রন্থে৬ উল্লেখ করেন,
“তুর্কীরা শুধু দেশ জয় করেই সন্তুষ্ট হয়নি, তারা বংলার …জীবনে গুরুতর আঘাত হেনেছিল। তুর্কী মুসলমানরা হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ মঠবিহারের মধ্যে একটি ব্যাপক ধ্বংস অভিযান চালিয়েছিল। এই হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ মঠই ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র এবং এই কারণেই বােধ হয় তুর্কী বিজয়ের প্রায় দুইশত বছর ধরে বাংলা সাহিত্য রচনার আর কোন নিদর্শন মেলে না। মঠ-মন্দিরে রক্ষিত গ্রন্থাবলী বিনষ্ট হয়েছিল। এবং এই অন্তর্বর্তীকালে সমস্ত বাংলা রচনাও এই বিনাশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। সেই জন্য চর্যাপদের পর বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (১৩৫০) পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে একটি বিরাট শূন্যতার যুগ।”
শ্রীকুমার বাবুর এই অভিমত ভূদেব চৌধুরী তার ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা’য়৭ স্বীকার করেছেন। গােপাল হালদারও তার ‘বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা’য়৮ এই মতই সমর্থন করেছেন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’-এ৯ লিখেছেন,
“শারীরিক বল, সমরকুশলতা ও বীভৎস হিংস্রতার দ্বারা মুসলমানেরা অমানুষিক বর্বরতার মাধ্যমে বঙ্গসংস্কৃতির ক্ষেত্রে তামস যুগের সৃষ্টি করে। তিনি মনে করেন, ‘বর্বর শক্তির নির্মম আঘাতে বাঙালি চৈতন্য’ হারিয়েছিল।” তিনি আরও লিখেছেন, “তুর্কি রাজত্বের আশি বছরের মধ্যে বাংলার হিন্দু সমাজে প্রাণহীন অখণ্ড জড়তা ও নাম-পরিচয়হীন সন্ত্রাস বিরাজ করিতেছিল।…কারণ সেমীয় জাতির মজ্জাগত জাতিদ্বেষণা ও ধর্মীয় অনুদারতা।…১৩ শ শতাব্দীর প্রারম্ভেই বাংলাদেশ মুসলমান শাসনকর্তা, সেনাবাহিনী ও পীর ফকির গাজীর উৎপাতে উৎসন্নে যাইতে বসিয়াছিল।”
তবে বৌদ্ধযুগে যে কিছুটা বাংলা ভাষার চর্চা হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু বৌদ্ধ যুগের পরে সেন বংশের রাজত্বকালে অথবা পাল বংশের রাজত্বকালে বাংলা ভাষার যে বিশেষ শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল এমন কোনাে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বৌদ্ধযুগের পর হতে মুসলিম শাসনে কিছুকাল পর্যন্ত বাংলায় কোনাে উচ্চস্তরের রচনা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বাংলা সাহিত্য চর্চার এই বন্ধ্যাকালকে সুনীতিকুমার ও সুকুমার সেন উভয়েও মুসলিম আক্রমণের ফল বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,
“বাঙ্গালা ভাষার উৎপত্তি হইতে খ্রীষ্টীয় ১২৮০ পর্যন্ত হইল বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম বা আদি যুগ। তুর্কীদের বাঙ্গালা বিজয়ের কালে দেশের উপর দিয়া একটা ঝড় বহিয়া গিয়াছিল। ১২০০ হইতে প্রায় দেড়শত বৎসর ধরিয়া…দেশময় মহামারী, কাটাকাটি, নগর ও মন্দির ধ্বংস,…পণ্ডিতদের উচ্ছেদ প্রভৃতি অরাজকতা চলিয়াছিল। এরূপ সময়ে বড় ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব।”
সুকুমার সেন একটু সুর চড়িয়ে বলেছেন,
“তুর্কী আক্রমণের ফলে বাঙ্গালীর বিদ্যা ও সাহিত্যচর্চার মূলে কুঠারাঘাত পড়িল। প্রায় আড়াই শত বৎসরের মতাে দেশ সকল দিকেই পিছাইয়া পড়িল। দেশে শান্তি নাই, সুতরাং সাহিত্যচর্চা তাে হইতেই পারে না। প্রধানত এই কারণেই ত্রয়ােদশ ও চতুর্দশ এই দুই শতাব্দীতে রচিত কোনাে বাঙ্গালা সাহিত্য পাওয়া যায় নাই।”
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই সমস্ত পণ্ডিতদের বক্তব্য হতে মনে হচ্ছে যে, তুর্কি আক্রমণের পূর্বে বাংলা সাহিত্যের যথেষ্ট চর্চা তাে হতই, এমনকি ‘বড় দরের সাহিত্য’ও সৃষ্টি হয়েছিল যা তুর্কি আক্রমণের ফলে আর হতে পারেনি। বাস্তবে এটা হয়ে থাকলে সুখের কথা। কিন্তু কথিত অন্ধকার যুগে ‘বড় দরের সাহিত্যটি’ কী এবং তুর্কি আক্রমণের ফলে কোন ‘সাহিত্যচর্চার মূলে কুঠারাঘাত’ পড়ল তা বুঝতে পারা সহজ নয়। কারণ বৌদ্ধযুগের দু-একটি বাংলা রচনা পাওয়া গেছে তা ঠিক, তারপর হতে তুর্কি আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য শাসনের চেষ্টায় বাংলা সাহিত্যে যে যে উন্নতি ঘটেছিল তা জানতে পারলে তুর্কি আক্রমণ কার মূলে কুঠারাঘাত করল বুঝতে পারা যাবে না। যা ছিল না তার যদি মূল থাকে তবে অবশ্যই সুকুমার বাবুর কথাই সত্য, আর যা ছিল না তা যদি বড় হয় তবে সুনীতি বাবুর কথা আরাে বেশি সত্য।
তাছাড়া তাঁরা কি জানতেন না যে, নদীয়া থেকে বঙ্গ তথা পুরাে ভারতবর্ষ জয় করতে মুসলমানদের শতাধিক বছর লেগেছিল এবং এ সব স্থানে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে সুশৃঙ্খল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্য এক থেকে দেড়শাে বছর সময়কাল তাদের ব্যয় করতে হয়েছিল? যদি তাই হয়, তবে এ সময়কালের কোনও সাহিত্যিক নিদর্শন না পাওয়ার জন্য দায়ী কি মুসলিম রাজশক্তি? একথা কেন তারা বলেননি যে, বৌদ্ধ-হিন্দু সংঘাতে বৌদ্ধদের পরাজিত করতে গিয়ে ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধদের মঠগুলাে ভেঙে ফেলেছিল? বৌদ্ধদের রচিত সাহিত্যগুলাে ব্রাহ্মণরা ধ্বংস করে তাদের পবিত্র দায়িত্ব পালন করেছিল? কেন তারা বলেননি যে, বাংলা ভাষার চর্চাকারী বৌদ্ধগণ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারে টিকতে পারেনি বলে তাদের পক্ষে এসময় কোনও সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়নি?
বিদেশাগত মুসলমান আক্রমণকারীরা নাকি বিবেচনাহীন সংগ্রাম শাসন আর শােষণের মাধ্যমে দেশে এক অস্বস্তিকর আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছিল। চাক্ষুজ্ঞান বিবর্জিত জঙ্গীবাদী শাসকদের অত্যাচারে সাহিত্য সৃষ্টি করার মত সুকুমার বৃত্তির চর্চা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক সংঘর্ষের ফলে বাঙালির বহির্জীবনে ও অন্তর্জীবনে ভীতি বিহ্বলতার সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু মুসলমান শাসনের সূত্রপাত এদেশের জন্য কোনও কল্যাণ বহন করে এনেছিল কিনা তা সর্বাগ্রে পর্যালােচনা করে বিতর্কের অবতারণা করা উচিত ছিল।
প্রকৃতপক্ষে বাংলা সাহিত্যবর্জিত তথাকথিত অন্ধকার যুগের জন্য তুর্কি বিজয় ও তার ধ্বংসলীলাকে দায়ী করা বিভ্রান্তিকর। এ সময়ের যেসব সাহিত্য নিদর্শন মিলেছে এবং এ সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে অন্ধকার যুগের অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় না। অন্ধকার যুগের ১৫০ বছর মুসলমান শাসকেরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন একথা সত্য নয়। ইলিয়াস শাহি আমলের পূর্ব পর্যন্ত খিলজি বলবন ও মামলুক বংশের যে পঁচিশ জন শাসক বাংলা শাসন করেছিলেন তাদের কারও কারও রাজত্বে সাকুল্যে পনের-বিশ বছর মাত্র দেশে অশান্তি ছিল, অন্যদের বেলায় শান্ত পরিবেশ বিদ্যমান ছিল বলে ইতিহাস সমর্থন করে। তৎকালীন যুদ্ধবিগ্রহ দিল্লির শাসকের বিরুদ্ধে অথবা অন্তর্বিরােধে ঘটেছে বলে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। ফলে তাতে জনজীবন ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার কোনও কারণ ঘটেনি। মুসলিম আক্রমণকারীরা না হয় গৌড়-লখনােতিতে চলার পথে, সম্মুখ সমরে বা শাসনকেন্দ্র দখলের সময় মন্দির অপবিত্র বা ধ্বংস করেছে, নেতাদের কতল করেছে, গ্রামীণ এলাকা লুণ্ঠন করেছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা কত বা ক’জন? কিন্তু সারা বাংলা জুড়ে যে সমস্ত হিন্দু বেঁচে রইলেন তাদের বাড়ির ও দেশের অন্যান্য মন্দিরের পুঁথিপত্র বিনষ্ট হওয়ার কারণ কি? এ তাে খােদ গৌড়েরই কথা। রাঢ়ে বা বঙ্গে তাে মুসলমানরা প্রবেশ করেছে বহুকাল পরে (১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজিনদীয়া আক্রমণ করে দখল করেন। অবশ্য সমগ্র বঙ্গদেশ অধিকার করতে মুসলমানদের প্রায় শতাধিক বছর সময় লেগেছিল। তখন হতে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের প্রেরিত শাসকগণ কর্তৃক বঙ্গদেশ শাসিত হতে থাকে) । সেখানকার হিন্দুদের বাংলা-সংস্কৃতে অবদান কতটুকু?
যখন হিন্দু সমাজের গোড়াপন্থীদের ধর্ম প্রবাহে সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষায় শাস্ত্রজ্ঞান বিস্তারে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল, যখন শাস্ত্রানুবাদকারীদের গালি দিয়ে ‘কৃত্তিবেসে, কাশীদেশে, আর বামুন ঘেঁষে—এই তিন সর্বনেশে’ বলা হত, তখন মুসলমান শাসকদের সান্নিধ্যের প্রভাবেই শাস্ত্রানুবাদ ও অন্যবিধ কাব্যচর্চা বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকেনি। ইসলামের প্রভাব রােধ করার জন্য ব্রাহ্মণেরা তাদের বিধিনিষেধ শিথিল করতে বাধ্য হয়। ফলে গােটা হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সূচনা হয়। সুতরাং অন্য কারণ বাদ দিলেও শুধু মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়াতেই বাংলা সাহিত্য বিকাশের পথ সুগম হয়। মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপােষকতার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে১০ মন্তব্য করেছেন,
“আমাদের বিশ্বাস, মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয়ই বঙ্গভাষার এই সৌভাগ্যের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।…গৌড়ের সম্রাটগণের প্রবর্তনায় হিন্দুশাস্ত্র গ্রন্থের অনুবাদ আরম্ভ হইল।” তাঁর মতে, “মুসলমানগণ ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান হইতেই আসুন না কেন, এ দেশে আসিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙালি হইয়া পড়িলেন।”
তথাকথিত অন্ধকার যুগের সাহিত্য সৃষ্টির কোনও নিদর্শন পাওয়া যায়নি একথাও সত্য নয়। এ সময়ে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক নিদর্শন পাওয়া না গেলেও অন্যান্য ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির নিদর্শন বর্তমান থাকাতে অন্ধকার যুগের অপবাদের অসারতা প্রমাণিত হয়। এ সময়ের প্রথমেই ‘প্রাকৃত পৈঙ্গলের’ মত প্রাকৃত ভাষার গীতিকবিতা গ্রন্থ (সদুক্তিকর্ণামৃত) সংকলিত হয়েছে। ধ্বংসের মধ্যেও ‘মূৰ্ছাহত’ বাঙালি এমন সংকলন করবার প্রেরণা ও সংকলনের জন্য কবিতা পেলেন কোথায়? আর প্রাকৃত-অবহট্ঠের মতাে বাংলা কবিতা থাকলেও কি এমন সংকলন হত না?১১ এ সময়ে রচনার অনুকূল পরিবেশ না থাকলে এ সময়কার কিছু কিছু সংস্কৃত রচনার (টীকা-ভাষ্য পুরাণাদির) সন্ধান মিলল কিভাবে? শৌরসেনী ছাড়া অন্য কোনও অবহট্টেই কি লিখিত বিশেষ কোনও রচনা আছে? গৌড়ী অবহট্টে রচনার প্রচলন না থাকলে প্রাচীন বাংলাতেই বা থাকবে কেন? এ সত্বেও রামাই পণ্ডিত রচিত ‘শূন্যপুরাণ’ এবং এর ‘কলিমা জালাল’ বা ‘নিরঞ্জনের ক্ষস্মা’, খনার বচন, হলায়ুধ মিশ্র রচিত ‘শেখ শুভােদয়া’র অন্তর্গত পীর-মাহাত্মজ্ঞাপক বাংলা ‘আর্যা’ অথবা ‘ভাটিয়ালী রাগ’ নির্দেশক বাংলা গান প্রভৃতি এই সময়ে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির নমুনা হিসেবে উল্লেখযােগ্য। রাহুল সংকৃত্যায়ন তথাকথিত অন্ধকার যুগে রচিত কিছু চর্যাপদ সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন।১২
স্মরণ রাখা দরকার যে, মুসলিম শাসনামলে রাজ ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটলেও বাঙালির জীবনব্যবস্থা মােটামুটি অচঞ্চল ছিল। তখন রাজনৈতিক বিরােধ রাজধানী আর দুর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বাঙালির ব্যবহারিক জীবনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর কোনও হস্তক্ষেপ করা হয়নি। সে আমলে ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখড়ের প্রাণ যায়’—কথাটা কি আক্ষরিক অর্থে সত্য ছিল না? আমাদের মধ্যযুগীয় শেষ লড়াই ‘পলাশির যুদ্ধ’ও এরূপ নয় কি? জয়ের পরে দুই একদিন নিশ্চয়ই যুদ্ধক্ষেত্রের চারপাশে, রাজধানী প্রবেশের পথে ও রাজধানীতে লুটতরাজ চলে। তাই বলে তা বছরের পর বছর ধরে চলেছে বলে ভাববার কারণ কি?
তাছাড়া দেশের বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেও সাহিত্য সৃষ্টি করা যে সম্ভব হয়েছে তা বিভিন্ন আমলে সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে উপলব্ধি করা যাবে। আকবর-জাহাঙ্গীরের শাসনামলে দেশে মােগল-পাঠান তথা রাজশক্তি-সামন্ত শক্তির মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত। আওরঙ্গজেবের আমলে বাণিজ্যে ইউরােপীয় বণিকদের দৌরাত্মে জনগণ অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বর্গীয় হামলার মতাে রাজশক্তির ও রাজার সুপরিকল্পিত বর্বরতা, লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ডের নজির দুনিয়ার ইতিহাসে আর আছে কি? তবু বর্গী উপদ্ৰত অঞ্চলে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা, পালা-পার্বণ ও বিবাহ উৎসবাদি কি বন্ধ ছিল? ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষ কালে যখন বাংলার প্রায় ৩৫ লক্ষ লােক প্রাণ হারাল, তখন কি সাহিত্য চর্চা এবং বাংলার দৈনিক সংবাদপত্রে-সাময়িকপত্রে তা কি ছাপা হয়নি?১৩ পলাশির যুদ্ধের পরে, ১৮৫৭-র সিপাহি বিপ্লবকালে, ১৯৪২-এর আগষ্ট আন্দোলনের সময়ে কিংবা ১৯৪৬-৫০ এর পাক-ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বেপরােয়া হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজের সময়ে (দৈনিক সংবাদপত্রে-সাময়িকপত্রাদির মাধ্যমে উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়াস থাকা সত্ত্বেও) বাংলার অধিকাংশ লােকের প্রাত্যহিক জীবনে ও মননে বিপর্যয় ঘটার প্রমাণ আছে কি? তখন কি স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত সব বন্ধ ছিল? ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যায় দেশে জনজীবনে আলােড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযােগ চলেছিল। এসব অশান্ত ও প্রতিকূল পরিবেশে বাংলা সাহিত্যের চর্চা অবরুদ্ধ হয়নি। শাসকেরা অত্যাচারী হলে কেবল সাহিত্যের বিকাশই বাধাগ্রস্ত হত না, হিন্দু জীবনের সমস্ত কার্যকলাপ স্তিমিত হয়ে যেত। কিন্তু সে আমলে তা না হয়ে যথারীতি জীবনধারা অগ্রসর হয়েছে। এই কারণে অন্ধকার যুগের বিতর্কটি নিতান্তই অর্থহীন।
পণ্ডিতদের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার হাস্যকর প্রচেষ্টা ধােপে টেকে না। অন্ধকার যুগের জন্য কুলীন সম্প্রদায় কি পরিমাণ দায়ী তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে রাজা শশাঙ্কের রাজ-ঘােষণা থেকে। বৌদ্ধদের নির্মূল করার জন্য শশাঙ্ক ঘােষণা করেন,
“সেতুবন্ধ হতে হিমালয় পর্যন্ত যেখানে যত বৌদ্ধ আছে তাদের বৃদ্ধ ও বালকদের যে হত্যা না করবে সে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হবে।”
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও সুকুমার সেন যে সত্য আড়াল করার চেষ্টা করেছেন দীনেশচন্দ্র সেনকে ধন্যবাদ যে, তিনি তা তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে১৪ স্বীকার করেছেন, হিন্দু রাজাদের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকলে বাংলাভাষা রাজদরবারে স্থান লাভ করার কোনও সুযােগই পেত না। এ কথা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, অন্ধকার যুগ মুসলমানদের সৃষ্ট নয় বরং বাংলাভাষাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার পণ্ডিতদের প্রচেষ্টার ফলে যে অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল, মাত্র দেড়শাে বছরের মধ্যে সেই অন্ধকার যুগকে অপসারিত করে বাংলা চর্চার ফল্গুধারা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল এই মুসলিম শক্তি।
এসব যুক্তির বাইরে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য অন্ধকার যুগের বিপক্ষে রায় দেয়। এই আমলের সাহিত্য সৃষ্টির নিদর্শন না পাওয়ার পেছনে আরও কারণ আছে। এদেশের মানুষের চিরন্তন জীবনযাপন ব্যবস্থা, এখানকার আবহাওয়া, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা আকস্মিক দুর্ঘটনার ফলে এই সময়ের কোনও সাহিত্য নিদর্শনের অস্তিত্ব বর্তমান থাকা হয়ত সম্ভব হয়নি। চর্যাগীতি, শেখ শুভােদয়া ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের একটি করে পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে। এগুলাের এই একটি মাত্র নমুনা যদি না পাওয়া যেত তবে এসব সাহিত্যও লােকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যেত। তাই মনে করা যায় যে, এ সময়ে সাহিত্য সৃষ্টি হয়ে থাকলেও তার অস্তিত্ব হয়ত লুপ্ত হয়ে গেছে।
তথাকথিত অন্ধকার যুগ চিহ্নিত করার কোনও যৌক্তিকতা নেই। ১২০৪ সাল থেকে মধ্যযুগ শুরু হয়েছে মনে করাই সমীচীন। এ সময় থেকে অপরিণত রূপের প্রাথমিক পর্যায় থেকে ক্রমান্বয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উৎকর্ষের পথে অগ্রসর হয়েছে। পূর্বাপর নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে বাংলা সাহিত্যে যে ধারাবাহিকতা প্রত্যক্ষ করা যায় তাতে অন্ধকার যুগের দাবি সহজেই উপেক্ষা করা চলে। আরও উল্লেখযােগ্য বিষয় হল, দ্বাদশ শতকে পাল রাজাদের পরে সেন রাজাগণ বঙ্গদেশ অধিকার করে শাসন করতে থাকেন। তারা সংস্কৃত সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। স্বভাবতই রাজসভার প্রতিকূল আচরণে শীঘ্রই বাংলা সাহিত্যের গতি ব্যহত হয়ে গেল। যাইহােক, আহমদ শরীফ তথাকথিত অন্ধকার যুগে বাংলা সাহিত্যের কোনও নিদর্শন না পাওয়ার কারণগুলাে১৫ এভাবে একত্রিত করেছেন,
১. ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্যশাসনের বাহন হয়নি বলে বাংলা তুর্কি বিজয়ের পূর্বে লেখ্য ভাষার মর্যাদা পায়নি।
২. তের-চৌদ্দ শতক অবধি বাংলা ভাষা উচ্চবিত্তের সাহিত্য রচনার যােগ্য হয়ে ওঠেনি। এ সময় প্রাকৃতজনের মুখে মুখে গাথা ও ছড়া-পাঁচালিই চলত। কোনও ভাষাতেই রসসাহিত্য চৌদ্দ শতকের পূর্বে রচিত হয়নি। তুর্কি বিজয়ের পর প্রাকৃতজনেরা প্রশ্রয় পেয়ে বাংলা রচনা করেছে মুখে মুখে। তাই লিখিত সাহিত্য অনেককাল গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তা সত্বেও ভাষা বিকশিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনই তার বড় প্রমাণ।
৪. তের-চৌদ্দ শতক সংস্কৃত চর্চার কেন্দ্র ছিল হিন্দু শাসিত মিথিলায়, তাই এ সময় বাংলাদেশে সংস্কৃত চর্চা বিশেষ হয়নি। শুধু কিছু কিছু শাস্ত্র গ্রন্থের অনুশীলন হয়েছিল।
৫. আলােচ্য যুগে বাংলায় কিছু পুঁথিপত্র রচিত হলেও জনপ্রিয়তার অভাবে, ভাষার বিবর্তনে এবং অনুলিপিকরণের গরজ ও আগ্রহের অভাবে তা নষ্ট হয়েছে। অযত্নে অপ্রিয় বা বাজে ছাপা বইও অকালে লুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আগুন-জল-উই কীট তাে রয়েইছে।
৬. লিখিত হলেও কালে লুপ্ত হওয়ার বড় প্রমাণ চর্যাগীতি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, শেখ শুভােদয়া প্রভৃতির একাধিক পাণ্ডুলিপির অভাব।
৭. চর্যাগীতি রচনার শেষ সীমা যদি বার শতক হয়, তাহলে তের-চৌদ্দ শতক বাংলা ভাষার গঠন যুগ তথা স্বরূপ প্রাপ্তির যুগ। কাজেই এ সময়কার কোনও লিখিত রচনা না থাকারই কথা। তখনকার সমাজে বাংলা জনপ্রিয় হয়ে উঠলে লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় আমরা বাংলা-কবিও দেখতে পেতাম।
৮. দেশজ মুসলমানের ভাষা চিরকালই বাংলা। বাংলায় লেখ্য রচনার রেওয়াজ থাকলে তুর্কি বিজয়ের পূর্বের বা পরের মুসলমানের রচনা নষ্ট হবার কারণ ছিল না। হিন্দুরা যে অশ্রদ্ধাবশত বাংলা ভাষায় কখনও সাহিত্য সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়নি, লৌকিক দেবতার পূজা প্রচারেই প্রয়াসী ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে আঠার শতক অবধি লিখিত হিন্দুর রচনায়।
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের প্রতি মুসলমান শাসকগণের উদার পৃষ্ঠপােষকতার বিষয়টি বাংলা সাহিত্যের কতিপয় ইতিহাসকার সরলভাবে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মুসলমান শাসনের পূর্বে সংস্কৃত ভাষার যে প্রাধান্য ছিল তার অবসান ঘটে এদেশে মুসলিম আগমনের ফলেই। অবহেলিত বাংলা ভাষার মর্যাদাহীনতার জন্য সংস্কৃত ভাষানুসারীরা মােটেই উদ্বিগ্ন ছিলেন না। তাদের এই অবজ্ঞার প্রেক্ষিতে মুসলমান শাসন বাংলা ভাষার জন্য আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে একথা অনেক পণ্ডিতও সমর্থন করেছেন। কেউ কেউ এত উদারতা তাে দূরের কথা, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতেও বিবেচনা করতে সক্ষম হননি। সেজন্য মধ্যযুগের শুরুতেই একটি অবাস্তব অন্ধকার যুগের নিরর্থক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে।
মুসলমান শাসন প্রবর্তিত হলে নতুন ধর্ম-দর্শন-সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্গে পরিচয়ের ফলে এদেশে একটা ভাববি-বও সৃষ্টি হয়েছিল। কাজেই তুর্কি বিজয় কেবল সদ্ধর্মীদের মুক্তির আশ্বাস দেয়নি, ব্রাত্যজন বাঙালিরও আত্মপ্রতিষ্ঠার ও সৌভাগ্যের দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। এ দেশে ইসলাম প্রচারের জন্য রাজশক্তির হস্তক্ষেপের অভিযােগ যথার্থ নয়। ভারতে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে সুফী-দরবেশ-আলিমের ব্যক্তিত্ব ও সদাচারের প্রভাবে। সরকার অর্থ-বিত্ত দিয়ে তাদের পরােক্ষ সাহায্য করেছে। বটে, তবে প্রকাশ্যে ফরমান যােগে কোথাও প্রচার সহায়তার আবাস দেয়নি।
প্রাগাধুনিক সাহিত্যের বিভাগ, বিস্তৃতি ও বিষয়বস্তু
মুসলিম আগমনের (১২০৪) ফলে এদেশের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। এ সময় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের মধ্যযুগ তথা প্রাগাধুনিক যুগের সূচনা। এ যুগ মােটামুটি ত্রয়ােদশ থেকে অষ্টাদশ শতক (১২০৪-১৮০০) পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন থেকে বাংলা সাহিত্যে আরবি ও ফারসি ভাষা-সাহিত্যের প্রভাবও লক্ষ করা। এ যুগের মুসলিম-রচিত সাহিত্যকে মােটামুটি কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়—
১. আরবি, ফারসি ও উর্দু-হিন্দি থেকে অনূদিত বাংলা কাহিনি-কাব্য।
২. ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধীয় কাব্য। যেমন মহানবী হযরত মােহাম্মদ (সাঃ) ও অন্যান্য নবীদের জীবনকথা, বিভিন্ন ধর্মযুদ্ধ, ধর্ম গ্রন্থালােচনা, পীর-মাহাত্ম বিষয়ক কাব্য।
৩. প্রণয়কাব্য। যেমন- ইউসুফ জোলেখা, লাইলী-মজনুকে আশ্রয় করে কিংবা অন্যান্য নর-নারীকে কেন্দ্র করে রচিত কাল্পনিক কাব্য। আরাকানের কাব্যগুলিও এর মধ্যে পড়ে।
৪. কড়চা-নিবন্ধ। এই রচনাগুলিতে সাহিত্য রস খুব বেশি নেই, তত্ত্ব ও সাধন সংক্রান্ত আলােচনা প্রকাশ পেয়েছে। ইসলামি সওয়াল অংশত কড়চা-নিবন্ধ জাতীয় রচনা।
৫. বিবিধ। অন্যান্য কাব্যগুলিকে এর মধ্যে ধরা যায়। যেমন- ঐতিহাসিক বাংলা কাব্য প্রভৃতি।
এ যুগেই সৃষ্ট হয়েছে আমাদের বিরাট সম্ভাবনাময় লােকসাহিত্য। এছাড়া এ যুগের শেষের দিকে রচিত হয়েছে একদিকে বিরাট পুঁথি সাহিত্য ও অপর দিকে কবিগান, টপ্পা ইত্যাদি। তবে কল্পনাবিহারী মানুষের মন শিল্প-সাহিত্যে যেহেতু কাহিনি সন্ধান করে এবং সে কাহিনি অবশ্যই রােমান্টিক ও চিত্তাকর্ষক হবে—এই কামনা করে, সেজন্য ধর্মকথার মধ্যেও তৎকালীন কবিরা নির্বিচারে তাদের কাব্যে স্থান দিয়েছেন অনেক বানানাে ও উদ্ভট কল্প-কাহিনি। মুসলিম ধর্মকাহিনিগুলাের মধ্যে অবশ্য ইসলাম ধর্মের গৌরব ও মহিমা প্রচারেরও প্রয়াস আছে, তবে তাতে বর্ণনার অতিরঞ্জিত বিষয়কে বেশি প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে যে, মধ্যযুগে রচিত সমস্ত সাহিত্যই পদ্যে রচিত। এ যুগের শেষ পর্যন্ত বাংলায় সাহিত্য পদবাচ্য কোনাে গদ্য সাহিত্য রচিত হয়নি। এ সময়ে রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি। কিন্তু এ যুগের মুসলিম সুলতানগণ বাংলায় সাহিত্য-রচনায় যে অকৃত্রিম উৎসাহ দান ও পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন, তার নজির বিরল। সে সময় বাংলা ভাষার চর্চা যারা করতেন, তারা ছিলেন মূলত বৌদ্ধ ও অন্ত্যজ হিন্দু শ্রেণি। ফলে ব্রাহ্মণদের দ্বারা অত্যাচারিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত এবং মানবাধিকার বঞ্চিত ঐ সকল ব্রাত্যজনেরা ইসলামের ভ্রাতৃবােধে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এই প্রোপটের মধ্য দিয়েই কবি-সত্তা প্রবাহী বৌদ্ধ সাধকদের হাতে রচিত হয় ব্রাহ্মণ রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপূরাণ’, এর ‘নিরঞ্জনের ক্ষস্মা’ কবিতায় ব্রাহ্মণদের প্রতি তীব্র শ্লেষই বর্ষিত হয়েছে—
“ব্রহ্মা হৈল মহাম্মদ
বিষ্ণু হৈলা পেগাম্বর
আদম্য হইল শূলপাণি।
গণেশ হইআ গাজী
কার্তিক হৈল কাজী
ফকির হইল্যা জত মুনি।।
তেজিয়া আপন ভেক
নারদ হৈল্যা শেক
পুরন্দর হৈল মলনা।…
যতেক দেবতাগণ
হয়্যা সবে একমন
প্রবেশ করিল জাজপুর।।।
দেউল দেহারা ভাঙ্গে
ক্যাড়া ফিড়্যা খায় রঙ্গে
পাখড় পাখড় বলে বােল।।
ধরিয়া ধর্মের পায় রামাক্রি পণ্ডিত গায়।
ই বড় বিষম গণ্ডগােল।।”
(শূন্যপুরাণ, পৃ. ১৪০)
কোন ঐতিহাসিক উপদ্রবকে লক্ষ করে এই কবিতা লেখা, তা বলা যায় না। কিন্তু ব্রাহ্মণদের নিপীড়ন-অত্যাচারের প্রতিশােধ মনে করে বৌদ্ধরা যে হিন্দু মন্দির প্রভৃতির উপর উৎপাত দর্শনে উৎফুল্ল হয়েছিল, তা স্পষ্টই বােঝা যায় বলে মনে করেন বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ইতিহাসকার দীনেশচন্দ্র সেন (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, খণ্ড-১, পৃ. ৫৪-৫৬)। যাইহােক, এই সময়েই বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে ফারসি, উর্দু, আরবি শব্দের স্বতঃস্ফূর্ত প্রবেশ ঘটেছিল। এইসব শব্দের সঙ্গে প্রাকৃতজনের মুখের কথার প্রয়ােগে রচিত শূন্যপূরাণ বাংলা কবিতায় সংযােজিত করে কথ্যরীতির কাব্যশৈলী। যেখানে প্রাকৃতজনের অবদমিত কণ্ঠটি ধর্মবিদ্বেষের আবেশে পরিস্ফুট। কবিতা হিসেবে ‘শূন্যপূরাণ’ উল্লেখযােগ্য না হলেও কবিতার বিবর্তনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে সব সময়ই উল্লেখযােগ্য। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, চর্যাপদের মত উচ্চমার্গীয় কবিতা দিয়ে যে বাংলা সাহিত্যের সূচনা, সে সাহিত্যের ঠিক পরবর্তী কবিতা প্রবহমান ধারায় গভীরতর হবে না ঠিক এমনটি হতে পারে না। নিশ্চয়ই ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর পূর্ব প্রেক্ষাপট হিসেবে রচিত হচ্ছিল আরও কিছু কবিতা যা হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত, না হয় এখনও অনাবিষ্কৃত। কেননা এর পরপরই আমরা বাংলা কবিতায় আবিষ্কার করি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে (১৩৫০)।
উল্লেখ্য, সেন রাজত্বকালে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ফলে পূর্ববর্তী বৌদ্ধ পাল রাজত্বের আমলের স্থানীয় বৌদ্ধদের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ছিল। বৌদ্ধদের প্রতি ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের বর্ণনা ‘শূন্য পুরাণে’ লিপিবদ্ধ আছে। সমাজে নিম্নশ্রেণির হিন্দু ও বৌদ্ধদের এই যখন মানসিক অবস্থা তখন তারা উভয়েই আক্রমণকারী তুর্কি মুসলমানদিগকে তাদের ত্রাণকর্তা বলে মনে করেছিল। ভয়ে ও অবিচারে বিচলিত হয়ে বৌদ্ধভক্তরা ধর্ম-ঠাকুরের নিকট প্রার্থনা করল পরিত্রাণের জন্য। ভক্তের প্রার্থনা শুনে বৈকুণ্ঠে ধর্মঠাকুরের আসন টলল এবং ভক্তদের বাঁচানাের জন্যই সকল দেবদেবী মুসলমানের বেশ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতরণ করলেন ও ব্রাহ্মণদের দেউল দেহারা ভেঙে উচিত শাস্তি দিলেন। তারই বর্ণনা ‘শূন্যপূরাণ’-এর ‘নিরঞ্জনের ক্ষষ্মা’ অংশে বর্ণিত হয়েছে।।
মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক নদীয়া অধিকারের (১২০৪) মাধ্যমে ধীরে ধীরে একশ বছরের মধ্যে সমগ্র বাংলায় মুসলমান শাসনাধীনে আসে। মুসলিম শাসন জনজীবনে শক্তি সংহতি ও কল্যাণ সাধনে নিয়ােজিত হয়েছিল। কারণ অধিকাংশ বিদেশি শাসক নিজের দেশ হিসেবেই বাংলাকে বিবেচনা করেছেন। জনগণের কাছে যাওয়ার জন্য দেশীয় ভাষার মর্যাদা প্রদান করে, কবিগণের প্রতি উদার পৃষ্ঠপােষকতা দিয়ে মুসলমান শাসকেরা প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। দীর্ঘ সময়ের অনুশীলনের ফলে বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয়েছে বৈচিত্র্য, এসেছে উৎকর্ষ, সেই সঙ্গে খুলে দিয়েছে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বার।১৬
প্রাগাধুনিক বা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পরিধি যেমন বিস্তৃত, তেমনি তার বিষয়বস্তুও বৈচিত্র্যপূর্ণ। মধ্যযুগের সমগ্র বাংলা সাহিত্যের যে খসড়াচিত্র আহমদ শরীফ তার ‘বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে (পরিশিষ্ট-ক) উল্লেখ করেছেন তা কিছুটা সংস্কার করে নিচে তুলে ধরলাম—
প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সাহিত্য : নাথ ও সহজিয়া সাহিত্য
অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক চর্যাগীতি, দোহা, ডাকের বচন, নাথগীতিকা, পালাগীতি প্রভৃতির উদ্ভবকাল। ষােল শতক শেখ ফয়জুল্লাহ। সতের শতক ভবানীপ্রসাদ। আঠার শতক দুর্লভ মল্লিক, শুকুর মাহমুদ, বাউল গান।
ধর্মমঙ্গল
তের শতক শূন্যপুরাণ, ধর্মপূজা বিধান। ষােল শতক ময়ূর ভট্ট, আদি রূপরাম, মাণিকরাম, খেলারাম। সতের শতক মাণিকরাম দাস, শ্রীশ্যাম পণ্ডিত, রূপরাম, মাধবনাথ, রামদাস আদক, সীতারাম দাস। আঠার শতক ঘনরাম, রামচন্দ্র, প্রভুরাম, নরসিংহ বসু, হৃদয়রাম, রামকান্ত, শঙ্কর চক্রবর্তী, সহদেব চক্রবর্তী, ক্ষেত্রনাথ, নিধিরাম, গােবিন্দ বন্দ্যোপাধ্যয়, রামনারায়ণ, লক্ষণ।
প্রণয়ােপাখ্যান
পনের শতক শাহ মুহম্মদ সগীর। ষােল শতক সাবিরিদ খান, দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ কবীর, দোনাগাজী। সতের শতক কাজী দৌলত, সৈয়দ আলাওল, মাগন ঠাকুর, সৈয়দ মুহম্মদ আকবর, মঙ্গলচাঁদ, শরীফ শাহ, মরদন, কমর আলি, আবদুল হাকিম। আঠার শতক মােহাম্মদ মুকীম, মুহম্মদ আলী, নওয়াজিস খান, পরাগল, কাজী বদিউদ্দিন, মুহম্মদ জীবন, নূর মুহম্মদ, শাকের মাহমুদ, সৈয়দ হামজা, শাহ গরীবুল্লাহ, মুহম্মদ আবদুর রাজ্জাক, দ্বিজ পশুপতি, সুশীল মিশ্র, বাণীরাম ধর, রামজী দাস, সৈয়দ নাসির, শেখ সাদী, মুহম্মদ রফিউদ্দিন, শমসের আলী, মুহম্মদ বাকির আগা, মুহম্মদ আলী রাজা, আরিফ, আসলাম, হাকিম আলী, সেদমত আলী, মুহম্মদ আলীম।
রামায়ণ
পনের শতক কৃত্তিবাস। ষােল শতক মাধব কন্দলী, শঙ্কর দেব। সতের শতক চন্দ্রাবতী, নিত্যানন্দ (অদ্ভূতাচার্য), ভবানীনাথ, শ্রীলক্ষ্মণ। আঠার শতক রামানন্দ যতি, রামানন্দ ঘােষ, রামচন্দ্র, রামানারায়ণ, জগত্রাম, রামপ্রসাদ রায়, দয়ারাম, ফকিররাম, রামশঙ্কর, রাম হাজরা, কৃষ্ণদাস, রামগােবিন্দ, ভবানীশঙ্কর, শিবচন্দ্র, গঙ্গারাম, কল্যাণদেব, ষষ্ঠীবর, গুণরাজ খান, সুবুদ্ধিরাম, সর্বাণীনন্দন, দ্বিজ তুলসী, জগন্নাথ, মতিরাম।
মহাভারত ও ভাগবত বা কৃষ্ণমঙ্গল
চৌদ্দ শতক বড়ু চণ্ডীদাস। পনের শতক মালাধর বসু। ষােল শতক কবীন্দ্র পরমেথর, শ্রীকর নন্দী, দ্বিজ গােবিন্দ, যশােরাজ খান, পরমানন্দ, মাধব সেন, মাধবাচার্য, রামচরণ, কবিশেখর রায়, দুঃখী শ্যামদাস, কৃষ্ণদাস, রামচন্দ্র খান, পীতাম্বর, রঘুনাথ, অনিরুদ্ধ, রাম সরস্বতী, ঘনশ্যাম দাস, সঞ্জয়। সতের শতক শ্রীকৃষ্ণকিঙ্কর, ভবানন্দ, পরশুরাম, ঘনশ্যাম, যশচন্দ্র, কাশীরাম দাস, নন্দরাম দাস, বিশারদ, নিত্যানন্দ ঘােষ, কৃষ্ণনন্দ বসু, রামনারায়ণ, হরিদাস, চন্দন দাস, রামের নন্দী, অনন্ত মিশ্র, গঙ্গাদাস সেন, দ্বিজ রামচন্দ্র। আঠার শতক বলরাম দাস, রমানাথ, গােপাল সিংহদেব, শঙ্কর চক্রবর্তী, দ্বিজ রামের, দ্বিজ মাধবচন্দ্র, সনাতন বিদ্যাবাগীশ।
মুসলিম ধর্মসাহিত্য
ষােল শতক শেখ পরান, হাজী মুহম্মদ, আইনুদ্দীন। সতের শতক নিয়াজ, মুত্তালিব, আলাওল, নসরুল্লাহ খােন্দকার, মীর মুহম্মদ সফী, মুহাম্মদ ফসীহ, আবদুল হাকিম, আবদুল করিম খােন্দকার। আঠার শতক আফজল আলি, কাজী বদিউদ্দিন, মুহম্মদ আলী, শেখ আশরাফ, আলী মােহাম্মদ, আলী রাজা, মােহাম্মদ মুকীম, কমর আলি, বালক ফকির, শেখ সােলায়মান, সৈয়দ নূরুদ্দিন, মুহম্মদ কাসিম, নওয়াজিস খান, কাজী শেখ মনসুর, বুরহানউল্লাহ, জান মােহাম্মদ।
বৈষ্ণব পদাবলি ও শাক্ত পদাবলি
চৌদ্দ শতক বিদ্যাপতি, বডু চণ্ডীদাস। পনের শতক যশােরাজ খান। ষােল শতক চাঁদ কাজী, বলরাম দাস, জ্ঞানদাস, গােবিন্দদাস, রামানন্দ বসু, বৃন্দাবন দাস, নরহরি দাস, বাসুদেব, মাধব দাস, বংশীবদন, লােচনদস, অনন্ত দাস, যদুনন্দন, আইনুদ্দিন, সালিহ বেগ, শাহ আকবর, আফজল, সৈয়দ সুলতান, শেখ কবির, শেখ ফয়জুল্লাহ, মুরারি গুপ্ত, নাসির মােহাম্মদ, মুকুন্দ, ফতে খান, পরমানন্দ, পুরুষােত্তম, হরহরি সরকার, চণ্ডীদাস। সতের শতক নরােত্তম, গােবিন্দদাস কবিরাজ, বিদ্যাপতি, গােপাল দাস, ঘনশ্যাম দাস, চম্পতি, যশােদানন্দ, সৈয়দ মর্তুজা, গিয়াস খান, আলাওল, দীন চণ্ডীদাস। আঠার শতক প্রেমদাস, গােকুলানন্দ, চন্দ্রশেখর, শশীশেখর, দ্বিজ রঘুনাথ, কমলাকান্ত, রামতনু, পাগল শঙ্কর, গােপীবল্লভ, ভবানন্দ, রামশঙ্কর, ফাজিল নাসির মুহম্মদ, হরিদাস, হীরামণি, আলী রাজা, মির্জা কাঙালী, শিবরাম, চম্পাগাজী, কমর আলি, মনােহর, পীর মুহম্মদ। শাক্ত পদাবলি কমলাকান্ত, নন্দকুমার, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন (প্রায় ১০০ জন মুসলিম বৈষ্ণব পদকর্তা তথা কবিদের নাম তথ্যসূত্রের ১৮নং-এ উল্লেখ করা হয়েছে)।
জীবনী সাহিত্য
ষােল শতক গােবিন্দদাস, চূড়ামণিদাস, বৃন্দাবন দাস, লােচনদাস, জয়ানন্দ, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, হরিচরণ দাস, ঈশান নাগর, লােকনাথ দাস, সৈয়দ সুলতান, শেখ ফয়জুল্লাহ। সতের শতক গােপীবল্লভ, তিলকরাম দাস, উদ্ধব দাস, শেখ চান্দ, আবদুন নবী, আবদুল হাকিম। আঠার শতক প্রেমদাস, শচীনন্দন, হৃদানন্দ, রামরত্ন, পুরন্দর, নিত্যানন্দ, রামশরণ, জগন্নাথ, লবনী দাস, কৃষ্ণচরণ দাস, নরহরি চক্রবর্তী, মুহম্মদ উজির আলী, শাহ গরীবুল্লাহ, সৈয়দ হামজা, শেখ মনােহর, সায়াদতউল্লাহ, শাহ শরফুদ্দিন, সৈয়দ হেলু মীরা শাহ, শাহ বকশউল্লাহ, ফকির মুহম্মদ।
মনসামঙ্গল
পনের শতক কানা হরিদত্ত, বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই। ষােল শতক নারায়ণ দেব। সতের শতক দ্বিজ বংশীবদন, ষষ্ঠীবর সেন, বিষ্ণুপাল, কালিদাস, ক্ষেমানন্দ, কবিবল্লভ, কবিচন্দ্র, সীতারাম দাস, ষষ্ঠীবর দত্ত, গঙ্গাদাস সেন। আঠার শতক জগজ্জীবন ঘােষাল, জীবনকৃষ্ণ মিত্র, তন্ত্রবিভূতি, রাজসিংহ, রামজীবন, দ্বিজ বাণের, জগন্নাথ, দ্বিজ রসিক, জানকীনাথ।
চণ্ডীমঙ্গল
ষােল শতক মাণিক দত্ত, বলরাম, দ্বিজ মাধব, মুকুন্দরাম। সতের শতক হরিরাম, দ্বিজরাম দেব। আঠার শতক মুক্তারাম সেন, লালা জয়নারায়ণ সেন, ভবানীশঙ্কর দাস, ভারতচন্দ্র রায়, অকিঞ্চন চক্রবর্তী। কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর।
ষােল শতক দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ, সাবিরিদ খান (সত্যপীর পাঁচালী)। সতের শতক বলরাম চক্রবর্তী, কৃষ্ণরাম দাস, প্রাণরাম, গােবিন্দ দাস। আঠার শতক রামপ্রসাদ সেন, ভারতচন্দ্র রায়, দ্বিজ রাধাকান্ত, মধুসূদন চক্রবর্তী, মদন দত্ত, নিধিরাম আচার্য।
শিবায়ন
সতের শতক রামকৃষ্ণ রায়, শঙ্কর কবিচন্দ্র, দ্বিজ রতিদেব, রামরাজা। আঠার শতক বিনয় লক্ষ্মণ (হরমঙ্গল), রামের ভট্টাচার্য, দ্বিজ কালিদাস, দ্বিজ মণিরাম।
অপ্রধান মঙ্গলকাব্য
ষােল শতক মাধবাচার্য (গঙ্গামঙ্গল)। সতের শতক বলরাম, দ্বিজ হরিদেব (শীতলামঙ্গল), কৃষ্ণরামদাস, মুকুন্দ (বাসুলীমঙ্গল)
আঠার শতক দ্বিজ নরােত্তম (লক্ষ্মীমঙ্গল), (দুর্গামঙ্গল, সূর্যমঙ্গল, শীতলা, মনিমঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, কপিলামঙ্গল), প্রাণবল্লভ, শঙ্কর নিত্যানন্দ, (দ্ররাম, রামজীবন, গৌরাঙ্গ, জয়রাম, কমলাকান্ত।
লৌকিক দেবতা ও পাঁচালী
ষােল শতক ফয়জুল্লাহ, মাধবাচার্য (রায়মঙ্গল)। সতের শতক কৃষ্ণরাম দাস। আঠার শতক ভারতচন্দ্র, ভৈরবচন্দ্র, ঘনরাম, রামেশ্বর, ফকিররাম, বিকাশ চট্টোপাধ্যায়, রামশঙ্কর, কৃষ্ণকান্ত, অযােধ্যারাম, জনার্দন, আরিফ, শাহ গরীবুল্লাহ, বিদ্যাপতি, লালা জয়নারায়ণ, শিবনারায়ণ।
সুফী সাহিত্য
ষােল শতক সৈয়দ সুলতান, হাজী মুহম্মদ, শেখ ফয়জুল্লাহ, নিয়াজ। সতের শতক শেখ চান্দ, মীর মুহম্মদ শফী, আবদুল হাকিম, শেখ জাহিদ। আঠার শতক কাজী শেখ মনসুর, আলী রাজা, মুহম্মদ কাসিম, আব্দুস সামাদ, বালক ফকির।
লােকসাহিত্য
তের শতক রূপকথা, কাঞ্চনমালা, শঙ্খমালা, শীতবসন্ত। চৌদ্দ শতক ও পনের শতক রামপাঁচালী, ভারত পাঁচালী, লৌকিক দেবতার পাঁচালী, রাধাকৃষ্ণ ধামালী, পালাগীতি, নাথগীতিকা। ষােল শতক ও সতের শতক ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, নাথগীতিকা। আঠার শতক ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, আদ্যের গম্ভীরা, নাথগীতিকা, ঝুমুর, ঘাটু, বাউল, কবিগান, সিরিয়ার যুদ্ধ, পলাশীর যুদ্ধ, মীর কাসিমের পতন কাহিনি ও ছড়া গান।
জঙ্গনামা বা যুদ্ধকাব্য
পনের শতক জয়েনউদ্দিন (রসুল বিজয়’)। যােল শতক দৌলত উজির বাহরাম খান, সাবিরিদ খান, সৈয়দ সুলতান। সতের শতক মুহম্মদ খান, মােহাম্মদ আকিল, নসরুল্লাহ খােন্দকার, মুহম্মদ আলিম, আবদুন নবী, আমানুল্লাহ। আঠার শতক শাহ গরীবুল্লাহ, মুহম্মদ ইয়াকুব, হায়াৎ মাহমুদ, আলী মুহম্মদ, জাফর, মনসুর, আবদুল হামিদ, নজর আলী।
সওয়াল সাহিত্য
সতের শতক আবদুল হাকিম, নসরুল্লাহ খােন্দকার, মােহাম্মদ খান (‘সত্যকলি বিবাদ সংবাদ’)। আঠার শতক আলী রাজা, কাজী শেখ মনসুর, মােহাম্মদ আকিল, শেরবাজ চৌধুরী, শেখ সাদী, হায়াৎ মাহমুদ, সৈয়দ নূরুদ্দিন, আবদুল করিম খােন্দকার, মুজাফফর।।
রাগতালনামা
ষােল শতক ফয়জুল্লাহ। সতের শতক সৈয়দ আলাওল। আঠার শতক ফাজিল নাসির মুহম্মদ, আলী রাজা, বকশ আলি, মুজাফফর, চামাক্ষ, দ্বিজ রামতনু, দ্বিজ ভবানন্দ, দ্বিজ রঘুনাথ, দ্বিজ রামগােপাল, দ্বিজ পঞ্চানন, চম্পাগাজী।
বিবিধ রচনা
ষােল শতক বৈষ্ণব শাস্ত্রীয় গ্রন্থ, মুজাম্মিল (নীতিশাস্ত্র বার্তা), রস খান। সতের শতক বৈষ্ণব শাস্ত্রীয় গ্রন্থ, কমর আলী, জয়নুল আবেদিন। আঠার শতক মুহম্মদ দানিশ, মােহাম্মদ দানেশ, আমিরুদ্দিন, আসমতুল্লাহ, তাহির মাহমুদ, মহসিন আলি, হাবুত রােয়াজা, আবদুস সােবহান, আবদুল গনির ফালনামা, জ্যোতিষ, বৈষ্ণব শাস্ত্রীয় গ্রন্থ, দাক্ষটোনার পুঁথি, ইসাপুরের ইতিহাস, শমশের গাজীনামা, মহারাষ্ট্র পুরাণ ইত্যাদি।
সাহিত্যচর্চা : পনের শতক
প্রাগাধুনিক মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্য ও কাব্যচর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল দুটি—একটি গৌড় ও অপরটি আরাকান রাজ্য। উল্লেখ্য, ১৩৪২ সালে বাংলার রাজধানী গৌড়ে যে ইলিয়াস শাহি শাসনের সূত্রপাত হয় তা বাংলা সাহিত্যের সফল বিকাশের বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের এই যুগকে ‘সুলতানি যুগ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এর পরিধি ১৩৫১ থেকে ১৫৭৫ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়ে গৌড়ীয় শাহি দরবার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সাংস্কৃতিক স্নায়ুকেন্দ্ররূপে গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে মুসলমানেরা যেখান থেকেই আগমন করেন না কেন তারা সহজে মনেপ্রাণে বাঙালি হয়ে পড়েছিলেন। ফলে অবহেলিত বাংলা ভাষা তাদের সহানুভূতি অর্জনে সক্ষম হয়। ইসলাম ধর্মের উদারতা, সহনশীল মনােভাব ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ হিন্দুজনগণকে আকৃষ্ট করে এবং উভয় জাতির মধ্যে মৈত্রী স্থাপিত হয়।
স্বাধীন সুলতানগণের শাসনের দীর্ঘ সময়ে অনেকেই বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। প্রথমে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের কথা উল্লেখযােগ্য। তিনি ইউসুফ জোলেখা কাব্যের কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। শাহ মুহম্মদ সগীরই প্রথম কবি যিনি গৌড়েধরের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করে কাব্য রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যের জন্য গৌড় দরবারে স্বীকৃতি অর্জনের কৃতিত্ব রামায়ণের অনুবাদক কবি কৃত্তিবাসের। গৌড়ের তাঁকে পুষ্পমাল্য দানে সম্মানিত করেন। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যের রচয়িতা কবি মালাধর বসু সুলতান রুকনউদ্দিন বারবক শাহের কাছ থেকে ‘গুণরাজ খান’ উপাধি পেয়েছিলেন। তাছাড়া সুলতান ইউসুফ শাহের কাছ থেকে পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করে কবি জৈনুদ্দিন ‘রসুল বিজয়’ কাব্য রচনা করেন।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ১৪৯৩ সালে গৌড়ের সিংহাসনে বসলে এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়। মুহম্মদ এনামুল হকের মতে,
“বাংলার ইতিহাসে হুসেনী বংশের ৪৫ বর্ষব্যাপী রাজত্বকাল (১৪৯৩-১৫৩৮) রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতার জন্য, অধিকন্তু সুখশান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য চিরবিখ্যাত। এই বংশ বংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি ও বিস্তৃতির জন্য যাহা করিয়াছে, তাহার তুলনা ইতিহাসে বিরল।”১৭
‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের কবি বিজয়গুপ্ত এবং ‘মনসাবিজয়’ কাব্যের কবি বিপ্রদাস পিপিলাই হুসেন শাহের প্রশংসা করেছেন। বিজয়গুপ্তের কথায়, ‘হুসেন শাহ নৃপতি তিলক। কবীন্দ্র পরমের হুসেন শাহকে কৃষ্ণের অবতার বলেছেন-
“নৃপতি হুসেন সাহ হএ মহামতি।
পঞ্চম গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি।।
অস্ত্র শস্ত্রে সুপণ্ডিত মহিমা অপার।।
কলিকালে হৈব যেন কৃষ্ণ অবতার।।”
কবি যশােরাজ খান বজবুলিতে বৈষ্ণবপদ১৮ রচনা করে হুসেন শাহের যেভাবে গুণকীর্তন করেছেন তাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি হুসেন শাহের সীমাহীন প্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁর আদেশে কবীন্দ্র পরমের কর্তৃক ‘মহাভারত পাঁচালী’ রচিত হয়। এই কাব্য ‘পরাগলী মহাভারত’ নামে খ্যাত। হুসেন শাহের সুযােগ্য পুত্র নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতা দান করতেন। ‘কবিরঞ্জন’ উপাধিধারী বিদ্যাপতি নসরত শাহের পৃষ্ঠপােষকতায় বৈষ্ণবপদ রচনা করেন। নসরত শাহের পুত্র ফিরােজ শাহ কবি শ্রীধরকে ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনার আদেশ দেন। তার পৃষ্ঠপােষকতায় কবি আফজাল আলী কর্তৃক কিছু বৈষ্ণবপদ রচিত হয়েছিল। গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে বৃন্দাবন দাস ‘চৈতন্যভাগবত’ এবং লােচনদাস ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন।
মুসলমান আমল সাহিত্য সৃষ্টির যে বিশেষ অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল সে সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেছেন,
“তুর্কিরা এদেশে বাস করিয়া এদেশের একরূপ অধিবাসী হইয়া পড়িয়াছিলেন, তাঁহারা বাঙ্গালা কথা কহিতে ও লিখিতে জানিতেন।…তাহারা সংস্কৃত হইতে মহাভারত, ভাগবৎ প্রভৃতি পুস্তক বাঙ্গালা ভাষায় অনুদিত করিয়া তাহাদিগকে শুনাইতে আদেশ করিলেন। এই কার্য ব্রাহ্মণগণ অবশ্য ঘাের অনিচ্ছায় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।”১৯
ওয়াকিল আহমদ লিখেছেন,
“বাংলা সাহিত্যের বিকাশে গৌড় রাজশক্তির একটা নীরব হাতছানি ছিল।…তারা বাংলা ভাষার চর্চা প্রতিকূলাচরণ করেননি। কৃত্তিবাস, কবীন্দ্র পরমের, শ্রীকর নন্দী, শাহ মুহম্মদ সগীরকে অনুবাদ কার্যে নির্দেশ দেওয়ার পেছনে বাংলা ভাষার চর্চায় সুলতানদের পৃষ্ঠপােষকতারই প্রমাণ পাওয়া যায়। মালাধর বসুকে উপাধিতে ভূষিত করে বাংলা ভাষার গৌরব বর্ধন করেন। ..ধর্মের বাণী স্থানীয় ভাষায় চর্চা করা নিষিদ্ধ—হিন্দু-মুসলমান জনগণের এরূপ অন্ধমুখােশ খুলে দেওয়া হয়। বাংলা সাহিত্যের উন্নতিতে গৌড়রাজের এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল।”
সুলতানগণের সাহিত্যানুরাগী মনােভাবের ফলে তখন বাংলা সাহিত্যের বিকাশের অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপােষ্ঠপােষকতা লাভ না করেও অনেক কবি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে স্বীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। মুসলমান শাসকগণের উদার ও সহনশীল মনােভাবের জন্য হিন্দু কবিগণ নানা বিষয়ে কাব্য রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৫৩৯ থেকে ১৫৬৪ সাল পর্যন্ত শের শাহ ও তাঁর বংশের অন্যান্য শাসকের পঁচিশ বছর শাসনকালেও বাংলা সাহিত্যের যথেষ্ট বিস্তার সাধিত হয়। এ সময়ে অনুবাদ, জীবনী সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি ইত্যাদি সাহিত্যের অনেক নিদর্শন সৃষ্টি হয়েছিল। ১২০৪ থেকে ১৫৭৫ সাল পর্যন্ত এই পৌনে চারশ বছর গৌড়ের মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিজস্ব মূর্তিতে যেভাবে বিকশিত হয়েছিল তার জন্য এ সময়টুকুকে ‘গৌড় যুগ’ বলে অভিহিত করে বিশেষ মর্যাদা দান করা হয়েছে। গৌড়, গৌড়ের বা গৌড় রাজদরবার বাদ দিয়ে এ সময়ে বাংলা সাহিত্যের অস্তিত্ব কল্পনা করা মােটেই সম্ভব ছিল না।
সেকালে অমুসলিমদের মধ্যে একমাত্র আরাকান রাজসভার বৌদ্ধ অধিপতিগণই মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের স্বাধীনভাবে সাহিত্য রচনা করার পৃষ্ঠপােষকতা দান করেছিলেন। বৌদ্ধ-বিদ্বেষী আর্য-হিন্দু শাসকগণ বৌদ্ধদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন বলে তারা উদার মতাবলম্বী বিজেতা নবীন মুসলিমদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছিলেন। তাই রােসাঙ্গ রাজসভায় কবি-সাহিত্যিক ছাড়াও মন্ত্রী সেনাপতিদের অনেকেই ছিলেন মুসলিম।
এ সময়ের মুসলিম বাংলা সাহিত্যে রােমান্টিক কাহিনির রমরমা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এ হেন কাহিনি সৃষ্টির প্রেরণা আসে মূলত দুই দিক থেকে। একদিকে উত্তর ভারতীয় রােমান্টিক কাহিনিগুলাে মুসলিম কবিদের প্রেরণা যােগায়। অন্যদিকে আরবীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতির ফলে মুসলিম কবিরা উৎসাহের সঙ্গে ইরানি গালগল্পকে বাংলা সাহিত্যে আমদানী করেন। এসব কাহিনিতে বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেও আনন্দের পরিচর্যা বেশি থাকে বলে সাধারণের মনে তার একটি স্থায়ী আসন গড়ে ওঠে। মধ্যযুগের কবিরা হয়তাে তাদের বাস্তববুদ্ধি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন যে বাস্তব জীবনের অনেক অভাব পূরণ করে সাহিত্য এবং সেই সাহিত্যের ধারাটি যদি রােমান্স রসে বেগবান হয় তবে সেই রস পান করে সাধারণ মানুষ বাস্তবতার রূঢ়তাকে ভুলতে পারে। তাই মধ্যযুগের মুসলিম কবিদের সাহিত্যধারায় আমরা একদিকে যেমন রােমান্স সৃষ্টির সার্থকতা লক্ষ করি অন্যদিকে প্রণয়জীবনের আকুতি ও মিলন-বিরহের মধ্যে মানবীয় জীবন-মহিমার স্বভাবসুন্দর স্পন্দন অনুভব করি।
শাহ মুহম্মদ সগীর (১৩৩৯-১৪১৯) এ শতাব্দীর অন্যতম মরমী কবি এবং নিঃসন্দেহে বলা চলে, তিনি মধ্যযুগের হয়ে আধুনিক চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ উচ্চমানের দেশপ্রেমিক কবি। মানবমনে প্রেমের ধারা নিয়ত বহমান, সেই ধারারই সুন্দর প্রকাশ দেখা যায় কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্যে। এই ধারার কাব্যে অলৌকিকতা প্রকাশের কিছু সুযােগ থাকলেও মুহম্মদ সগীর নিজেকে সেই প্রভাব থেকে সংযত রেখেছেন। বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির ভালােবাসার বিষয়টিও তার শিল্পীমানসে লক্ষ করা যায়। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন পণ্ডিত মনে করেন মুহম্মদ সগীরই বাংলার আদি মুসলিম কবি। তার নিবাস কোথায় ছিল আমরা জানি না। কাব্যগ্রন্থে কবির জন্মভূমির কোনাে উল্লেখ নেই। হয়ত ভবিষ্যতে গােটা পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হলে তার সন্ধান মিলবে। আপাতত যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যায়, গ্রন্থের তিনটি প্রতিলিপি চট্টগ্রামে আবিষ্কৃত ও একটি ত্রিপুরা থেকে সংগৃহীত। এ থেকে মুহম্মদ এনামুল হক মনে করেন, শাহ মুহম্মদ সগীরের নিবাস ছিল চট্টগ্রাম।
বাংলা সাহিত্যে যখন মুহম্মদ সগীরের আবির্ভাব হয়, তখন প্রেমের কাহিনি রচনায় হিন্দু কবিদের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু সগীর মুসলমান কবি হয়েও এই ধারার কাব্য রচনায় তার নিজের ধ্যান-ধারণার পরিচয় রেখেছেন। মুহম্মদ সগীরের কাব্যের একটি উল্লেখযােগ্য দিক এই যে, এতে প্রেমের বিষয়টি মানবমনের চাহিদা অনুযায়ীই রূপায়িত হয়েছে। সেই চাহিদার বাইরে কল্পনাকে সেখানে বড় করে দেখানাের চেষ্টা নেই। মানবীয় প্রেম-ভাবনার একজন খাঁটি রূপকার ছিলেন বলে তার পক্ষে এটা সম্ভভ হয়েছে।
মুহম্মদ সগীরের শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘ইউসুফ জোলেখা’।২০ গৌড়ের সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৮৯১৪০৯) কবি এই কাব্যটি রচনা করেছিলেন। বাঙালি মুসলিমের বাংলা ভাষার প্রতি জন্মগত প্রীতি প্রকাশ পেয়েছে পঞ্চদশ শতকের এ সুফি মননশীল কবির কাব্যের ছত্রে ছত্রে। সমকালীন কোনাে ফারসি কাব্য মুহম্মদ সগীরের কবিমনে কতখানি প্রভাব ফেলেছিল সে সম্পর্কে সঠিক করে কিছু বলা যায় না। কেননা তার নিজের কথা অনুযায়ী কোরআনের কোনাে বিষয় হয়তাে তাকে উৎসাহিত করে থাকবে। তিনি বলেছেন—
“কিতাব কোরান মধ্যে দেখিলু বিশেষ।
ইউসুফ জলিখা কথা অমৃত বিশেষ।।
কহিব কেতাব চাহি সুধারস পুরি।
শুনহ ভকত জন শ্রুতি ঘট ভরি।।
দোষ ক্ষম গুণ ধর রসিক সুজন।
মােহাম্মদ ছগির ভণে প্রেমক বচন।।”
লায়লী-মজনু এবং শিরি-ফরহাদের অমরপ্রেমের কাহিনি যেমন সারা বিশ্বে আদরের বস্তু, ‘ইউসুফ জোলেখা’ও সেই দিক থেকে সেরকম দাবি করে। ‘ইউসুফ জোলেখা’র প্রেম কাহিনির আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে আধ্যাত্মতত্ত্ব ও পারস্যের মরমিয়াবাদ খুব বেশি প্রভাব না ফেলায় রহস্যঘেরা রূপকের কর্তৃত্ব থেকে এটি প্রায় মুক্ত। ফলে সাধারণ লােক ‘ইউসুফ জোলেখা’র কাহিনিটি সহজে ধারণ করতে পারে।
কবি তাঁর রচনায় আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেননি, তিনি সংস্কৃত রীতিরই অনুসরণ করেছেন। কিন্তু এ সত্বেও তার রচনায় মুসলিম বিধাস ও জীবনাচারণের প্রতিফলন লক্ষ করা যায় বাংলা কাব্যে মানব মহিমার প্রথম উদগাতা হিসেবেই নয়, মুসলিম বিশ্বাসের রূপকার হিসেবেও তিনি সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। তিনি যখন বলেন—
“ইছুপে বুলিলা দুই বাধা আছে বড়।
আজিজক ভয় আর নিরঞ্জন ডর।।
আজিজক কৃপাণ শমন সমসর।
শিরছেদ করিয়া পাঠাইব যমঘর।।
ধর্মেত বিরােধ হয় এহি আর ভয়।
পরলােকে নরকে ডুবি অতিশয়।।
বহু ধন ভাণ্ডার আছএ পাশ।
দান ধর্ম করিলে হইব পাপ নাশ৷৷”
তখন যে ধর্ম বিশ্বাস ও পাপ-পুণ্যবােধের বাণী উচ্চারিত হয় তার সাথে মুসিলম জীবন-দর্শনের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ।
ইউসুফ-জোলেখা কাব্যের আরম্ভে আল্লাহ ও রসুলের বন্দনা, মাতাপিতা ও গুরুজনের প্রশংসা এবং রাজস্তুতি আছে। এর পর তৈমুর বাদশাহের কন্যা জোলেখার জন্ম, বয়ঃপ্রাপ্তি, স্বপ্নদর্শনে এক রূপবান পুরুষের প্রতি তার প্রেমাসক্তি, স্বপ্নদৃষ্ট প্রেমিক সম্ভাবনায় আজিজ-মিশরকে নির্বাচন ও তার সাথে জোলেখার বিবাহ, আজিজ-মিশর ভিন্ন পুরুষ হওয়ায় জোলেখার হতাবাস ও বিলাপ ইত্যাদি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কাহিনি বিবর্তিত হয়েছে। ইউসুফের জন্মবৃত্তান্ত ও ভ্রাতৃদ্রোহ বিড়ম্বনার কথা এসেছে এর পরে। এখানে লক্ষণীয়, কোরআনে এবং পারস্যের কবি ফিরদৌসীর কাব্যে বর্ণিত ইউসুফের বৃত্তান্ত দিয়ে কাহিনির সূত্রপাত হয়েছে। ঘটনার ঈষৎ পরিবর্তন অথবা কমবেশি বর্ণনা নিয়ে জোলেখা ও ইউসুফের পরিণয় পর্যন্ত মােল্লা জামীর কাহিনির মূল কাঠামাের সাথে সগীরের সাদৃশ্য আছে। ফারসি কাব্যের আখ্যান ভাগে ইউসুফ-জোলেখার মিলন ও পরিশেষে মৃত্যু দেখান হয়েছে, কিন্তু সগীরের কাব্যে ইউসুফ-সহােদর ইবিন আমিনের সাথে মধুপুরের রাজদুহিতা বিধুপ্রভার পরিণয়কে কেন্দ্র করে কাহিনি পল্লবিত ও প্রলম্বিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, অংশটি কবির কল্পনাপ্রসূত, গল্পরস সৃষ্টির জন্য নতুন সংযােজন।
মুহম্মদ সগীর তাঁর কাব্যে ইউসুফের প্রতি জোলেখার প্রেমের গভীরতাকে বাস্তববােধের নিরিখে বিচার করেছেন। জোলেখা ইউসুফকে পাওয়ার আশায় সমাজ ও নিজের সংসারটি ছাড়তে দ্বিধা করেনি, এমনকি নিজের অধিকারের ধনসম্পদও তাকে টেনে রাখতে পারেনি, একাল-পরকাল কিংবা পাপ-পূণ্য সবই তার কাছে মিথ্যে। ইউসুফকে এক পলক দেখলে জোলেখার দেহমনে সুখ যেন উপছে পড়ে—
“আজি সে সাফল্য মাের সর্ব অঙ্গে সুখ।।
সমদিষ্টে ইচ্ছুফে দেখিল মাের মুখ।।
ক্ষুদিত নয়ন তান সন্তাপিত মন।
ছল ছল নয়ন সজলে হবে ঘন।।
মুক্রি শুষ্ক শস্য তুমি জলদ নিপুণ।
বিন্দোক পড়িলে জল ন হৈবেক উন।।”
সগীরের রচনায় কবিত্বের পরিচয় আছে। যেমন
“মদনমঞ্জরী তনু ত্রিবলি সুবলি।
অরবিন্দে কুসুমিত জেহ্ন পেখি অলি।।
তনুকান্তি নির্মল কমল কলাবতী।
প্রভাতে উদয় জেহ্ন সুরজ দীপতি।।
হিমকর জনি জ্যোতি বদন প্রকাশ।
আকাশ প্রদীপ কি প্রফুল্ল মনিহাস।।
বদন নির্মল জেহ্ন বিকচ কমল।
জেহ্ন পূর্ণ শশধর জ্যোতি নিরমল।।”
ইউসুফ জোলেখা কাব্যের রূপায়ণে কবি শাহ মুহম্মদ সগীর ফারসি উৎসের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য দেখাননি বলে কাব্যে কবি প্রতিভার মৌলিকতার নিদর্শন বিদ্যমান। ফেরদৌসীর কাব্যের ঘটনার সঙ্গে সগীরের অনৈক্য অনেক স্থানেই লক্ষ করা যায়। বিশেষত ইবিন আমিন ও বিধুপ্রভার প্রণয় ও পরিণয় কাহিনি শাহ মুহম্মদ সগীরের নিজস্ব কল্পনা। কাব্যটিতে কোনও বিদেশি আবহ নেই বললেও চলে। বাংলার পরিবেশ এই কাব্যের রক্তমাংস ও বাংলার আবহ এর প্রাণ বলে কাব্যটি পাঠ করতে করতে মনেই হয় না যে, এটা কোনও বিদেশীয় পুস্তকের অনুবাদ অথবা ভাবানুবাদ। মুহম্মদ সগীর রােমান্টিক প্রণয়ােপাখ্যানের বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করতে গিয়ে কিছু অলৌকিক উপাদান সংযােজন করেছেন। কাব্যে আছে অনেক স্বপ্নের কথা, আকাশবাণী, শিশু ও পশুর মুখে কথা বলানাে ইত্যাদি অপ্রাকৃত ঘটনা, কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি কবির নিজের রােমান্সসুলভ খেয়ালী কল্পনার বহিঃপ্রকাশ বলে বিবেচনা করা যায়।
অবলীলাক্রমে গল্প লিখতে পেরেছেন, এটাই সগীরের কৃতিত্ব। গল্পের ঘনঘটায় চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করা রােমান্টিক কবিদের লক্ষ ছিল। দর্শনচিন্তা, তত্ত্বচিন্তা অথবা চরিত্র-চিত্রণের প্রতি তারা বেশী নজর দেননি। সরস গল্প সৃষ্টি করে নিছক আনন্দের ভােজে পাঠকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সগীরের কলম সে পথ বেছে নিয়েছে। গল্প রচনা কবির লক্ষ বলে ঘটনার গ্রহণ বর্জনের কোনও হিসেব করেননি। কাহিনির যে অংশ কোরআন ও কাব্য থেকে গ্রহণ করেছেন তাতে মৌলিকতা না থাকলেও ঘটনা পরম্পরায় একটি গতি আছে।
ইউসুফ জোলেখা কাব্যে প্রেমরসে ধর্মবাণীর পরিবর্তে প্রেমরসে মানববাণী প্রচার মুখ্য হয়ে উঠেছে। রােমান্টিক কাব্যে প্রেম প্রতিপাদ্য বিষয় বলে উপাখ্যানটির ধর্মীয় পটভূমি থাকলেও তা হয়ে উঠেছে মানবিক প্রেমােপাখ্যান। কাব্যে রূপজ ও মােহজ প্রেমের বৈশিষ্ট্য চাক্ষভাবেই রূপায়িত হয়েছে। কাব্যের মুখ্য চরিত্র ইউসুফ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। কিন্তু কবি তাঁকে নিপ্রাণ এক ধর্ম সাধক রূপে মাত্র অঙ্কন করেননি। তাঁর পৌরুষ ও ব্যক্তিত্বকে মানবিক মহিমার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তাকে শুধুই কামজয়ী পুরুষ রূপে দেখানাে হয়নি, তার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক নিপুণতা বিশেষ দক্ষ তার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে। তবে চরিত্র হিসেবে জোলেখা এক কথায় অসাধারণ। সজীবতায় ও বাস্তবতায় সে উজ্জ্বল। জোলেখা মানবিক কামনাবাসনায় বাত্ময় মূর্তি। তার রূপের নেশা ও ভােগের আকাঙ্খ এক চিরঞ্জীব শার্বত প্রেমে উত্তীর্ণ হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ইউসুফ জোলেখা’র বিশেষ গুরুত্ব আছে। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে খাঁটি বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম গ্রন্থ বলে বিবেচনা করা হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাহিনিতে যেমন বাঙালি জীবনের বর্ণনা দেখা যায়, তেমনি সমসাময়িক কাব্য ‘ইউসুফ জোলেখা’তেও দেখা যায়। ‘ইউসুফ জোলেখা’র মূল কাহিনিটি মিসরের হলেও এতে বাংলার আবহাওয়া, পরিবেশ ও চরিত্রের উল্লেখ রয়েছে। বিদেশি কাহিনিকে বাংলার উপযােগী করে উপস্থাপনের মাধ্যমে কাব্যটি রচিত।
সগীর বাংলায় কাব্য রচনা করে মাতৃভাষার প্রতি তার অপার মমতার পরিচয় দিয়েছেন। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রাখার জন্য গোড়াদের উদ্দেশ্যে কিছু উপদেশও দিয়েছেন। যেমন—
“নানা কাব্য-কথা রসে মজে নরগণ।
যার যেই শ্ৰধএ সন্তোষ করে মন।
না লেখে কেতাব কথা মনে ভয় পায়।
দুষিব সকল তাক ইহ না জুয়ায়।।
গুনিয়া দেখি আম্মি ইহ ভয় মিছা।
না হয় ভাষায় কিছু হয় কথা সাচা।।
পরবর্তী মুসলিম কবিদের রচনায় সগীরের প্রভাব লক্ষণীয়। শুধু তাই নয়, আধুনিক ভারতীয় ভাষার মধ্যে সম্ভবত বাংলা ভাষাতেই প্রথম রােমান্টিক কাব্য রচিত হয় এবং সেটি হল শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ-জোলেখা। তিনি ব্যতীত ইউসুফ জোলেখা’র অন্যান্য রচয়িতা হচ্ছেন আবদুল হাকিম, গরীবুল্লাহ, গােলাম সাফাতউল্লাহ, সাদেক আলি ও ফকির মুহম্মদ।
চট্টগ্রামের জয়েনউদ্দিন এ শতাব্দীর আর একজন বিখ্যাত কবি। তাঁর ‘রসুল বিজয়’ কাব্যের একটিমাত্র পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে। সংগ্রাহক ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। পাণ্ডুলিপিটি শুরু হতে শেষ পর্যন্ত খণ্ডিত। এরপর ১০০ বছরেরও বেশি সময় গত হয়েছে, কিন্তু এ কাব্যের আর কোনাে পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া যায়নি। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ১৩২০ সালে২১ এই পাণ্ডুলিপির বিস্তারিত বিবরণ দেন এবং তখন থেকেই বুদ্ধিজীবী মহলে কাব্যটি নিয়ে বিবরণ ভিত্তিক আলােচনা শুরু হয় ।
উল্লেখ্য, বাংলা কাব্যে বিষয় বিবর্তনের ক্ষেত্রে মুসলিম সাধনা ঐতিহাসিক তাৎপর্যে মহিমান্বিত। কিন্তু বাংলা কাব্যের নিবিষ্ট চিত্ত পাঠকমাত্র জানেন যে, প্রয়ােগরীতি ও বাস্তব প্রতিফলনের ক্ষেত্র মুসলিম ঐতিহ্য দীর্ঘকালব্যাপী বাংলা কাব্যে স্বপ্রতিষ্ঠ হতে পারেনি। এই ব্যর্থতা ও দীর্ঘসূত্রিতার মূলে রয়েছে মুসলিম কবিদের গতানুগতিক মনােবৃত্তি ও মূল্যবােধ সম্পর্কে অনীহা। ফলে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ জাতীয় কাব্যের অনুসরণে কবি জয়েনউদ্দিনকে আমরা ‘রসুল বিজয়’ কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হতে দেখি।
‘রসুল বিজয়’-এর ভাষার সৌকর্য কবিকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করেছে। তাঁর কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য চেতনা ভক্তিরসের সংগে মিশ্রিত হয়ে সাহিত্য রসে প্রসারিত হয়েছে। জয়েনউদ্দিন গৌড়াধিপতি বারবাক শাহের পুত্র ইউসুফ খান (১৪৭৪৮০) কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর ‘রসুল বিজয়’ (১৪৭৪) কাব্য রচনা করেন। কবি ‘রসুল বিজয়’ কাব্যে সুলতান ইউসুফ খানকে তাঁর পৃষ্ঠপােষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেমন—
“শ্ৰীযুত ঈছুপ খান
আরতি কারণ জান,
বিরচিন্টু পাঞ্চালি সন্ধান।
ভাবে ভবকল্পতরু
দানে শুত্রু জ্ঞানে গুরু,
ধ্যানে হয় মহেশ সমান।।”২২
হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) জীবনের মূল কাহিনির সঙ্গে কতগুলি মনগড়া বা অসত্য উপ-কাহিনিও সংযােজিত হয়েছে কাব্যে। হযরত আবুবকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), ইমাম হাসান (রাঃ) ও ইমাম হােসেন (রাঃ), হানিফা প্রমুখের সংগে জড়িত উপ-কাহিনি ‘রসূল বিজয়ের’ ধারাবর্ণনা সমৃদ্ধ করেছে। জয়েনউদ্দিনের ‘রসুল বিজয়’ মৌলিক কাব্য নয়, আবার অনুবাদও নয়। এটি একটি ফারসি কাব্যের অনুসরণে লিখিত।২৩ ‘রসুল বিজয়’ যে মধুর ভাব ও বিষয়ে ভরা, কবি তার উল্লেখ করে বলেছেন,
“রসুল বিজয় বাণী সুধারস ধার।
শুনি গুণিগণ মন আনন্দ অপার।।”
আসলে হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) জীবনকাহিনি সুধারসে ভরপুর। এই সুধায় ভরা জীবনকথার সঙ্গে মুসলিম ধর্মীয় ঐতিহ্যের সুন্দর সংযােগ থাকায় ঐতিহ্যবর্গী মুসলমানদের কাছে জয়েনউদ্দিনের ‘রসুল বিজয়’ খুবই প্রিয়। আবার কাব্যের বিষয়বস্তুতে কবিকল্পনারও যােগ আছে। ফলে জাতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে কল্পিত আনন্দরস যােগান দিয়ে কাব্যটিকে লােকপ্রিয় করার চেষ্টাও কবি করেছেন।
হজরত মুহাম্মদের (সাঃ) সঙ্গে ইরাকের সম্রাট জয়কুমের যুদ্ধকাহিনি ‘রসুল বিজয়ের’ একটি উল্লেখযােগ্য অংশ। এটি যে ঐতিহাসিক কোনাে যুদ্ধ নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মূল কাহিনির সঙ্গে ইসলামের অন্যান্য বীরের কাহিনিও যুক্ত হয়েছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) মানব হিসেবে যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন, যােদ্ধা হিসেবেও তেমন। হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) যুদ্ধযাত্রায় তাঁর সুসজ্জিত বাহিনীর পরিচয় দিয়েছেন কবি এভাবে,
“কেহ অশ্বে কেহ গজে কেহ দিব্যরথে।
সুসজ্জ হইলা সব সংগ্রাম করিতে।।
তার পাছে সুসজ্জ হইলা নবীবর,
আকাশে উদিত যেন হইল শশধর।।
ধবল অর্ধেতে নবী আরােহিলা যবে,
আকাশের মেঘে ছায়া ধরিয়াছে তবে।।
নিঃসরিলা নবীবর সঙ্গে অর্থবার,
প্রচণ্ড মৃগেন্দ্র যেন সাতাইশ হাজার।।
চলিল সকল সৈন্য করিয়া যে রােল।
প্রলয়ের কালে যেন সমুদ্র হিল্লোল।।”
এখানে কাহিনি বিন্যাসের ক্ষেত্রে কল্পনাশক্তির অতিরেকদোষ যে প্রশ্রয় পেয়েছে তা বলাই যায়।
যাইহােক, জয়েনউদ্দিন তার ‘রসুল বিজয়’ কাব্য রচনায় ফারসি কাব্যকে আদর্শ করলেও তার স্বাধীন শিল্প-কৌশলটি তিনি এতে রক্ষা করেছেন। যুদ্ধ কাব্যে কবিত্ব প্রকাশের সুযােগ নেই বললেই চলে, তবুও কাব্যের স্থানে স্থানে সৌন্দর্য দুর্লভ নয়। যেমন-
“রহিত বরণ হৈল দোহান বদন
দ্বিজরাজ মিশি যেন উদিত তপন।”
এখানে উদ্ধৃত রচনাগুলি (কবিতাংশ) এটাও প্রমাণ করে যে, মুঘল যুগের পূর্বে মুসলমানরা হিন্দু কবিদের মতােই সংস্কৃতমূলক ভাষা ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
বাকি পর্বগুলি পড়ুন,
১. মধ্যযুগে মুসলিম কবিদের অবস্থান ও বাংলা সাহিত্যে কাব্যচর্চার ক্রমবিকাশ [পর্ব ১]
২. মধ্যযুগে মুসলিম কবিদের অবস্থান ও বাংলা সাহিত্যে কাব্যচর্চার ক্রমবিকাশ [পর্ব ২]
৩. মধ্যযুগে মুসলিম কবিদের অবস্থান ও বাংলা সাহিত্যে কাব্যচর্চার ক্রমবিকাশ [পর্ব ৩]
৪. মধ্যযুগে মুসলিম কবিদের অবস্থান ও বাংলা সাহিত্যে কাব্যচর্চার ক্রমবিকাশ [পর্ব ৪]
৫. মধ্যযুগে মুসলিম কবিদের অবস্থান ও বাংলা সাহিত্যে কাব্যচর্চার ক্রমবিকাশ [পর্ব ৫]
তথ্যসূত্রঃ
- ১. রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন, পুরাতাত্ত্বিক নিবন্ধাবলী, প্রথম প্রকাশ, এলাহাবাদ, ১৯২৭।
- ২. জার্নাল অব এশিয়াটিক সােসাইটি, নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৩৪, কলকাতা।
- ৩. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রবন্ধ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা ১৩২৭, ১৩৪৮, ১৩৪৯, কলকাতা। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্মের ইতিহাস বিস্তারিতভাবে জানতে দেখুন-মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা সাহিত্যের কথা, খণ্ড-১, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৯-৬১। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ, কলকাতা বিবিদ্যালয়, ১৯২৬। দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, খণ্ড১, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ সং, কলকাতা, ২০০২। আরও দেখুন-বিজয়চন্দ্র মজুমদার, হিস্টরি অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ, কলকাতা বিবিদ্যালয়, ১৯২০।
- ৪. মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনােয়ার পাশা সম্পাদিত, চর্যাগীতিকা, পঞ্চম সংস্করণ, ঢাকা, ১৪০২, পৃ. ১০। আরও দেখুন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা সাহিত্যের কথা, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮।
- ৫. মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনােয়ার পাশা সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০।
- ৬. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, বর্ধিত সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৬৩।
- ৭. ভূদেব চৌধুরী, বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা, ১ম পর্যায়, দে’জ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ২০১৫।
- ৮. গােপাল হালদার, বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা, খণ্ড-১, অরুণা প্রকাশনী, চতুর্থ মুদ্রণ, কলকাতা, ১৪১২, পৃ. ৩৫-৩৭।
- ৯. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড, মডার্ন বুক এজেন্সি, প্রথম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৯৬।
- ১০. দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৭।
- ১১. আহমদ শরীফ, বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য, খণ্ড-১, নিউ এজ পাবলিকেশন, পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা, ২০০৭, পৃ. ১১৫।
- ১২. মাহবুবুল আলম, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৮৩।
- ১৩. আহমদ শরীফ, বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৪।
- ১৪. দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, খণ্ড-২, দে’জ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ৬৫৬-৫৭ ও ৯৭৮। সেন রাজাদের কীর্তি হল অপভ্রংশ তথা বাংলা ভাষার চর্চা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে এদেশে সংস্কৃত চর্চা প্রবর্তন করা। বঙ্গভূমিতে সংস্কৃত চর্চার একটি বিশেষ ক্ষেত্র নির্মাণ করবার প্রয়াস সেন রাজারা করেছিলেন। রাজা লক্ষ্মণ সেন তার দরবারে যে সমস্ত কবি ও পণ্ডিতগণকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তারা সকলেই ছিলেন সংস্কৃত ভাষার। দু’জন কবির নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তাদের একজন আচার্য গােবর্ধন এবং জয়দেব। লক্ষ্মণ সেনের দরবারী কবি হিসাবে এরা দুজনেই বিখ্যাত হয়েছিলেন। জয়দেবের গীতগােবিন্দ তার সুললিত ছন্দ মাধুর্যের জন্য লােকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। জনসাধারণ এ ভাষা বুঝতে পারেনি কিন্তু এর ছন্দ তাদের জন্য শ্রবণ সুখকর ছিল। জয়দেব নিজে তার কাব্যের এক জায়গায় লােকভাষায় গীতগােবিন্দের মতাে প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যায় না এমন কথা বলেছেন। আচার্য গােবর্ধনের রচিত কাব্যের নাম ছিল “আর্যা সত্যাসতী’। প্রাকৃতে ‘গাথা সত্যাসতী’ বলে একটি বহুল প্রচলিত কাব্য ছিল, তারই কিছুটা পরিবর্তন সাধন করে সংস্কৃত ভাষায় ‘আর্যা সত্যাসতী’ রচনা করা হয়। এ কাব্যের ছন্দও গীতগােবিন্দের মতাে সুললিত এবং মধুর। লক্ষ্মণ সেনের উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের মধ্যে অপভ্রংশ তথা বাংলার প্রচার বন্ধ করে সংস্কৃতকে প্রিয় করে তােলা। গীতগােবিন্দের সাহায্যে তিনি কিছুটা সফলকামও হয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র গীতগােবিন্দ কুরুচিকর কাব্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ কাব্যের মধ্যে নর-নারীর যৌন মিলনটাই একমাত্র উপজীব্য। যার ফলে একটি যুগের অবক্ষয়কালে সাধারণ মানুষের কাছে এ কাব্যটি আকর্ষণীয় হয়েছিল। পাল রাজত্বের সমৃদ্ধির শেষে সেনদের সময়কালটি বাংলা সংস্কৃতি শিল্প ও সাহিত্যের জন্য একটি অবক্ষয়কাল। যদি সেন রাজত্বকাল দীর্ঘস্থায়ী হত তবে চিরকালের জন্য বাংলা ভাষা নিঃশেষ হয়ে যেত। সুতরাং আমরা বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের অন্ধকার যুগ হিসেবে সেন রাজত্বকালকে চিহিত করতে পারি। বহিরাগত অবাঙালি সেনদের একটি বিশেষ চেষ্টা ছিল বাঙালিদের অস্তিত্ব বিলােপ করা। তাদের হাতে দুটি প্রধান অস্ত্র ছিল। একটি হচ্ছে—বঙ্গভূমিতে অবাঙালি ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয় হচ্ছে—দেশজ ভাষার পরিবর্তে সংস্কৃত ভাষার চর্চাকে উৎসাহিত করা এবং এ অঞ্চলের একমাত্র ভাষা বলে প্রতিষ্ঠিত করা। মােহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বঙ্গভূমিতে এলেন একটি প্রবল প্রতিবাদের নায়ক হিসেবে। তার আগমনের ফলে এ অঞ্চলে সংস্কৃতের রাজ-সমর্থিত চর্চা বন্ধ হয়ে যায়, ব্রাহ্মণদের প্রতাপ সম্পূর্ণরূপে দূরীকৃত হয় এবং একটি নতুন বাঙালি সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে।
- ১৫. আহমদ শরীফ, বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৯-২১।
- বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট ইতিহাসকার ক্ষেত্র গুপ্ত বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার পর্বের প্রসঙ্গে একরকম আহমদ শরীফের মূল বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পােষণ করেন। তিনি লিখেছেন ত্রয়ােদশ-চতুর্দশ শতকের সাহিত্যের কোন লিখিত নিদর্শন এখনও মেলেনি। চর্যার যুগ থেকে এক পদক্ষেপে দু’শ বছর ডিঙিয়ে আমরা কৃত্তিবাস-মালাধর বসুর সময়ে গিয়ে পৌঁছই। অবশ্য কোন বস্তুগত নিদর্শনের অভাবে এমন সিদ্ধান্ত করা যায় না যে, এ দুশ বছর বাংলা ভাষায় কিছু লেখা হয়নি। হয়ত কিছু লেখা হয়েছিল। কিন্তু তা রক্ষিত হয়নি এবং আবিষ্কৃত হয়নি। তবুও একথা বলা যায় যে, এই কালসীমায় আদৌ কিছু লেখা হয়ে থাকলেও তার পরিমাণ বেশি নয়। লেখ্য সাহিত্য সম্পর্কে এই কথা। লােকসাহিত্য-সৃজন নিশ্চয়ই চলেছে, তাকে কিছুতেই সুনির্দিষ্ট কালানুক্রমিক ইতিহাসের অঙ্গীভূত করা চলে না। যে পর্বের রচনা-সম্পদই কিছু নেই, তাকে একটা স্বতন্ত্র পর্ব বলে চিহ্নিত করে আলােচনার তাৎপর্য কি, এমন প্রণ উঠতে পারে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এই দু’শ বছরের শূন্য স্থানটি যে একেবারে শূন্যগর্ভ নয় এ কথা বিাস করার কারণ আছে। কোন জাতির ইতিহাস থেকে মাঝখানের কিছু সময়কে কেটে বাদ দেওয়া চলে না। সাহিত্য-সৃষ্টি জাতির মানসলােকের ইতিহাস। মনােপ্রবাহ দুশ বছর ধরে নিবৃত্ত ছিল না। কারণ গতিই তার ধর্ম। এই কালস্রোত বাঙালির মনে অনেক পলি জমিয়েছিল, না হলে হঠাৎ পঞ্চদশ শতকে শুকনাে ডাঙা দেখা যেত না। কৃত্তিবাস-মালাধর-বড়ু চণ্ডীদাসের অথবা মনসামঙ্গলের আদি কবিদের সৃষ্টিজগৎ চর্যা থেকে অনেকটা দূরে। আলােচ্য অন্ধকার পর্ব এই দূরত্বকে সম্বন্ধে বেঁধেছে। সে সৃষ্টি করেনি, পুরাতনের সমাপ্তি ঘটিয়ে নূতনের জন্য পথ তৈরি করেছে। এই দুশ বছর বাঙালির মনের রাজ্যে যে ভাঙাগড়া চলেছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার গুরুত্ব অনেকখানি। বাঙালি ইতিহাসেও। এই দুশ বছর তাই একটি স্বতন্ত্র পর্ব—অন্ধকার পর্ব। ‘অন্ধকার’ শব্দটির অর্থ এক্ষেত্রে শূন্য নয়। ইতিহাসে কোন শূন্যস্থান থাকতে পারে না।” দেখুন-ক্ষেত্র গুপ্ত, বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস, গ্রন্থ নিলয়, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ৪৭-৪৮।
- ১৬. বাংলায় মুসলিম অভ্যুত্থানের পূর্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অস্তিত্ব তেমন স্পষ্ট ছিল বলা যায় না। উচবর্ণের হিন্দুরা সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য চর্চা করতেন। এ সময় বাংলা ভাষা মূলত গ্রামের অশিক্ষিত লােকদের মুখেই জীবিত ছিল। এ ভাষায় কোনও সামাজিক প্রতিপত্তি ছিল না, ছিল না কোনও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। সাধারণ নিম্নবর্ণের হিন্দুর মতাে এ ভাষাও ছিল অবহেলিত ও অবজ্ঞাত। স্বাধীন মুসলমান রাজারা গণজীবনের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে লৌকিক ভাষাকে গুরুত্ব প্রদান করলেন। সে-ভাষাই বাংলা—যার সঙ্গে উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজ ও ধর্মাশ্রিত সংস্কৃত ভাষার তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। পাল যুগের ‘তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাহিত্য’ বাঙালির একটি বিশেষ মূল্যবান সম্পদ বলিয়া গণ্য হইবার যােগ্য হলেও ‘সেন রাজাগণের অভ্যুদয়ের ফলে অপভ্রংশ ও বাংলায় রচিত তান্ত্রিক সহজিয়া সাহিত্যের প্রসার কমিয়া পুনরায় সংস্কৃত সাহিত্যের উন্নতির যুগ আরম্ভ হয়। ফলে সংস্কৃত পণ্ডিতেরাই হয়ে পড়েন রাজানুগ্রাহী। সে রাজদরবারে সাধারণ মানুষের কোনও স্থান ছিল না। মুসলিম আধিপত্যের পর হঠাৎ এই অবস্থা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেল। মুসলমান রাজারা শুধু বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপােষকতায় আত্মনিয়ােগ করলেন না, তাঁরা বৃহত্তর বাঙালি জাতির সঙ্গে গড়ে তুললেন একটা নিবিড় আত্মীয়তা। ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতে নিগৃহীত বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এই আত্মীয়তার পরশে নতুনভাবে প্রাণস্পন্দন অনুভব করলেন। তাদের আত্মার তীব্র যন্ত্রণা যেন উপশমের পথ খুঁজে পেল। সমগ্র বাংলায় একটি সামাজিক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও মুহম্মদ এনামুল হক এ সম্বন্ধে লিখেছেন, “খ্রষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষপাদ হইতে ষােড়শ শতাব্দীর মধ্যে হুসেন শাহ, নসরত শাহ, পরাগল খাঁ ও ছুটি খাঁ প্রমুখ গৌড়ের স্বাধীন মুসলমান সুলতান ও তাহাদের আমীর ওমরাহদের উৎসাহে বাঙ্গালা সাহিত্য দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে সমর্থ হয়। বাঙ্গালা সাহিত্যের সে অপােগণ্ড শৈশবযুগে মুসলমান সুলতান ও আমীরগণ ইহাকে রাজানুগ্রহ দান না করিয়া গলা টিপিয়া মারিয়া ফেলিবার ব্যবস্থা করিলে, ইহা যে কি অবস্থা প্রাপ্ত হইত, তাহা সঠিকভাবে বলা না গেলেও মুসলমান রাজানুগ্রহে তখন ইহার দ্রুত বর্ধন ও বিকাশে সাহায্য করিয়াছিল, সন্দেহ নাই। সপ্তদশ শতাব্দীতে আসিয়াও আবার আমরা রােসাঙ্গ-রাজসভায় অনুরূপ ব্যাপারই ঘটিতে দেখি। রােসাঙ্গ রাজসভাসদ লস্কর উজীর’ (সমর সচিব) আশরফ খান, মুখপাত্র (প্রধান মন্ত্রী) মাগন ঠাকুর, সমর সচিব সােলেমান, পাত্র মুসা প্রমুখ মুসলমান আমীর ওমরাহগণ সপ্তদশ শতাব্দীতে বাঙ্গালা সাহিত্যকে আমল না দিলে, এই সাহিত্যের দীনতা সহসা ঘুচিত না। এই সকল ব্যাপার দেখিলে মনে হয়, বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে বাঙ্গালার মুসলমানদের যতখানি হাত রহিয়াছে, হিন্দুদের ততখানি নহে। এদেশের হিন্দুগণ বাঙ্গালাভাষা ও সাহিত্যের জন্মদাতা বটে কিন্তু তাহার আশৈশব লালন, পালন ও রক্ষাকর্তা বাঙ্গালার মুসলমান। স্বীকার করি, মুসলমান না হইলে বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য মনােরম বন-ফুলের ন্যায় পল্লীর কৃষক কণ্ঠেই ফুটিয়া উঠিত ও বিলীন হইত, কিন্তু তাহা জগতকে মুগ্ধ করিবার জন্য উপবনের মুখ দেখিতে পাইত না, বা ভদ্র সমাজে সমাদৃত হইত না। এইরূপে ঘরে-বাহিরে মুসলমানেরা খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ হইতে বাঙ্গালা সাহিত্যকে ক্রমান্বয়ে নানাভাবে পরিপুষ্ট করিয়া তুলিয়াছিল।” দেখুন- আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও মুহম্মদ এনামুল হক, আরকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০১-১০২।
- ১৭. মুহম্মদ এনামুল হক, মুসলিম বাংলা সাহিত্য, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃ. ৩১।
- ১৮. মুসলমান বৈষ্ণব পদকর্তার সঠিক সংখ্যা নির্ণীত হয়নি। যতীন্দ্রমােহন ভট্টাচার্য তাঁর গ্রন্থে ১০২ জন মুসলমান বৈষব পদকর্তার নামােল্লেখ ও তাদের ৪৫০টি পদ উদ্ধৃত করেছেন। মুসলমান বৈষ্ণব পদকর্তাগণ যাঁরা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের রূপক’কে অবলম্বন করে বহু সংখক পদ বা কবিতা রচনা করেছেন তারা হলেন—শাহ আকবর, আকবর আলী, আফজল আলী, আফজল, আনাল ফকির, আব্বাস, অনন্ত, আম্মান, আলাওল, আলাওল খান, আনিসুদ্দিন, এতিম কাসেম, সালিহ বেগ, এবাদত বা এবাদতউল্লাহ, এরশাদউল্লাহ, কবীর, কমর আলী, খলিল, গিয়াস খান, গরীব খান, চম্পা গাজী, চাঁদ গাজী, চামার, জীবন, তাহির মাহমুদ, তুফানউদ্দিন, নজর মুহাম্মদ, নাসির মাহমুদ, দানিশ, দুলামিয়া, নওয়াজিস খান, নাসির মুহাম্মদ, নাসিরউদ্দিন, নাসির, পীর মুহাম্মদ, পােতন, ফকির ওহাব, ফকির ভেলা শাহ, ফকির শাহ, ফতন, ফতে খান, ফয়জুল্লাহ, বকসা আলী, বদিউদ্দিন, বদিউজ্জামান, বাহরাম খান, বােলন, মহন। তাজ, মনােহর, মানিক দাস, মীর্জা বাঙ্গালী, মােহন আলী, মুহম্মদ, মমতাজ, মুহম্মদ আলী, আলী রাজা, মােহাম্মদ জীবন, মুহম্মদ হানিফ, রজব আলী, বােরসেক, লালবেগ, শমশের, শেখ চান্দ, শেখ ভিখন, শেখ লাল, সফতুল্লাহ, সিরতাজ, সুন্দর ফকির, শেরবাজ, হাসমত আলী, জিরত, সৈয়দ মর্তুজা, মােহাম্মদ হাসিম, আসাউদ্দিন, সৈয়দ সুলতান, ফকির হাবিব প্রমুখ। দেখুন-যতীন্দ্রমােহন ভট্টাচার্য, বাংলার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবির পদমঞ্জুষা, কলকাতা বিবিদ্যালয়, প্রথম প্রকাশ, কলকাতা, ১৯৮৪। ব্রজসুন্দর সান্যাল সম্পাদিত, মুসলমান বৈষ্ণব কবি (৪খণ্ড), কলকাতা। যতীন্দ্রমােহন ভট্টাচার্য, বাঙ্গালার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবি, মাহে নও, জুলাই ১৯৫৩, ঢাকা। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা সাহিত্যের কথা, খণ্ড-২, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ৫৯। আরও দেখুন- মুহম্মদ আবদুল হাই ও আহমদ শরীফ সম্পাদিত, মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১০।
- ১৯. দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭৭।
- ২০. মুহম্মদ এনামুল হক সম্পাদিত, শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ-জোলেখা’, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৫। শাহ মুহম্মদ সগীর ও তাঁর কাব্য ইউসুফ জোলেখা’ সম্বন্ধে জানতে দেখুন- মুহম্মদ এনামুল হক, বাংলা ভাষায় প্রাচীনতম মুসলিম কবি, মাহে নাও, তৃতীয় বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা, ১৩৫৮, ঢাকা।
- ২১. আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সংকলিত ও আহমদ শরীফ সম্পাদিত, জয়েনউদ্দিনের ‘রসুল বিজয়’, সাহিত্য পত্রিকা, সপ্তম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৩৭০, ঢাকা বিধবিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ। আরও দেখুন-আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, বাঙ্গালা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ, খণ্ড-১, দ্বিতীয় সংখ্যা, পৃ. ১০৬-৮, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, ১৩২০-২১। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সৃষ্টিতে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের (১৮৬৯-১৯৫৩) কথা বিশেষভাবে স্মরণযােগ্য। তাঁর প্রচেষ্টায় ও অবদানে প্রায় পৌনে ৪০০ বছরের সাহিত্যিক নিদর্শন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। মধ্যযুগের দেড় শতাধিক কবিকে আবিষ্কারের কৃতিত্ব এককভাবে তার। তিনি যেসব পুঁথি সংগ্রহ করেন তার মধ্যে বহু পুঁথি ছিল মুসলমান সাহিত্যস্রষ্টার। এসব পুঁথি আবিষ্কারের ফলে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের ইতিহাসে মুসলমান সাহিত্য-স্রষ্টাদের যথাযথ স্থান ও অবদান স্বীকৃত হয়েছে। এসব পুঁথি সংগৃহীত না হলে সৈয়দ আলাওল, দৌলত কাজী, শাহ মুহম্মদ সগীর, দৌলত উজির বাহরাম খান, মাগন ঠাকুর, সৈয়দ সুলতান, শেখ ফয়জুল্লাহ, মুহম্মদ কবীর, শাহ গরীবুল্লাহ, আবদুল হাকিম, মুহম্মদ খান, সাবিরিদ খান, শেখ পরান, দোনাগাজী, শেখ চান্দ, হায়াত মাহমুদ, সৈয়দ মর্তুজা, জয়েনউদ্দিন, মুহম্মদ আকিল, মুহম্মদ নওয়াজ প্রমুখ কবির অস্তিত্ব চিরতরে হারিয়ে যেত এবং এঁদের অবদান একেবারে অজানা থেকে যেত। মধ্যযুগের সাহিত্য-নিদর্শন আরাে অনেকেই আবিষ্কার ও সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু মুসলমান কবিদের গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস রচনার উপাদানগুলাে সংগ্রহের প্রধান কৃতিত্ব আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের। শুধু মুসলমান কবিদের নয়, ত্রিশ জনের বেশি হিন্দু কবির সাহিত্য নিদর্শনও তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছেন—শ্রীধর কবিরাজ, কবীন্দ্র পরমের, শ্রীকর নন্দী, দ্বিজ মাধব, রতিদেব, রামরাজা, মুক্তরাম সেন, দ্বিজ লক্ষ্মণ, গােবিন্দদাস প্রমুখ। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ শুধু প্রাচীন পুঁথিরই সংগ্রাহক ছিলেন না, গবেষণা ও সম্পাদনে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাড়া তার জুড়ি বাংলায় বিরল। সংগৃহীত পুঁথিগুলির মধ্যে যাদের ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক মূল্য রয়েছে সেগুলিরই তিনি কিছু কিছু সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। সংগৃহীত পুঁথিগুলির সূচীপত্রও সম্পাদনা করে রেখেছিলেন, অর্থাভাবে প্রকাশ করতে পারেননি। তার প্রথম সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থ নরােত্তম ঠাকুরের ‘রাধিকার মানভঙ্গ’ (১৯০৯) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। তারপর দু’খণ্ডে ‘বাঙ্গালা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ’ (১৩২০-২১) পরিষদ থেকে বেরােয়। এই গ্রন্থটিকে প্রাচীন সাহিত্যের গেজেট বলা যেতে পারে। এখানে ৬০০ পুঁথির বিবরণ রয়েছে। জীর্ণ পুঁথির পাঠোদ্ধার করার ক্ষমতা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ দেখে সাহিত্য পরিষদের সহায়তায় ও অর্থানুকূল্যে কবিবল্লভ বিরচিত ‘সত্যনারায়ণ পুঁথি’ (১৯১৫), দ্বিজ রতিদেবের ‘মৃগলুব্ধ’ (১৯১৫), দ্বিজমাধবের ‘গঙ্গামঙ্গল’ (১৯১৬), আলি রাজা বিরচিত ‘জ্ঞান সাগর’ (১৯১৭), বাসুদেব ঘােষের ‘শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস’ (১৯১৭), মুক্তরাম সেনের ‘সারদা মঙ্গল’ (১৯১৭), শেখ ফয়জুল্লাহ রচিত ‘গােরক্ষা বিজয়’ (১৯১৭) প্রভৃতি পুঁথি-গ্রন্থ আব্দুল করিমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।। দীনেশচন্দ্র সেন, সুকুমার সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ এনামুল হক, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতােষ ভট্টাচার্য, সুখময় মুখােপাধ্যায়, কাজী দীন মুহম্মদ, জে সি ঘােষ প্রমুখ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখক মাত্রই তার কাছে অবশ্যই ঋণী। বিকোষ অভিধানের ‘বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য’ প্রধানত তারই সংগৃহীত উপাদানে লিখিত। সুকুমার সেন (১৯০১-১৯৯২) বাংলা সাহিত্যের যে বিরাট ইতিহাস লিখেছেন, তাতেও সাহিত্যবিশারদের সংগৃহীত তথ্য ও মাল-মশলা প্রচুর ব্যবহৃত হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ এবং ‘প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান’ এই দুই গ্রন্থে সাহিত্যবিশারদের বহু উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’-এ আলাওলের ‘ননদিনী রস-বিনােদিনী’ বলে যে পদ আছে, তা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদেরই সংগ্রহ। বস্তুত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ শ্রেণিতে পাঠ্যভুক্ত এবং প্রায় সকল সহায়ক গ্রন্থের লােক সাহিত্য প্রাচীন ও মধ্যযুগ সর্বত্রই আবদুল করিমের সংগৃহীত উপাদান রয়েছে। প্রখ্যাত লােক সাহিত্য গবেষক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনও (১৯০৪-১৯৮৭) তাঁর ‘হারামণি’র (৬ খণ্ড) অনেক উপাদান পেয়েছেন সাহিত্যবিশারদের কাছ থেকে। মুহম্মদ এনামুল হকের মুসলিম বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগাংশ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’-র (মধ্যযুগ) মুসলিম রচিত সাহিত্যাংশ (দোভাষী পুথির অংশ ছাড়া), কাজী দীন মুহম্মদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে’রও ওই অংশ আর শাহেদ আলির ‘বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান’ সাহিত্যবিশারদের আবিষ্কার-নির্ভর। ব্রজসুন্দর সান্যাল সম্পাদিত চারখণ্ডে ‘মুসলমান বৈষ্ণব কবি’ নামক গ্রন্থের সমস্ত মাল-মশলা আব্দুল করিম সাহেবই সংগ্রহ করে দেন। প্রধানত তারই প্রদত্ত তথ্য ও উপাদান নিয়ে মুহম্মদ এনামূল হক (১৯০৬-১৯৮২) আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য বইখানা রচনা করেন। এটি সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের একটি অজ্ঞাত দিকের অংশ বিশেষের পরিচয়-পুস্তক। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সংগৃহীত পুঁথির মধ্যে মুসলমান-রচিত ৬৯৫টি পুঁথি ১৯৫০ সালে দান করা হয় ঢাকা বিথবিদ্যালয়কে। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে রাজশাহীর বরেন্দ্র মিউজিয়ামকে হিন্দু-রচিত ৩৮১টি পুঁথি দান করা হয়। সাহিত্যবিশারদ তখন পরলােকগমণ করেছেন। তার পক্ষে আহমদ শরীফ পুঁথিগুলি মিউজিয়ামকে দান করেন। এভাবে বাংলা সাহিত্যের উৎসসন্ধানী গবেষণায় আবদুল করিম যে অবদান রেখেছেন তার কোনাে তুলনা হয় না। তার হাতে পড়েই পুঁথিগুলাে প্রকৃত মর্যাদা পেয়েছে। সেকারণেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তাকে ছাড়া রচিত হওয়া সম্ভব নয়। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এক পত্রে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পর্কে লেখেন আপনি যেরূপ অফুরন্ত অধ্যবসায়, যত্ন ও পরিশ্রম করিয়া বাঙ্গালা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ সংগ্রহ করিয়া পাঠাইতেছেন, তাহাতে আপনার নিকট বঙ্গ সমাজ চিরঋণী থাকিবে।…আপনার ঋণ পরিশােধে আমরা অক্ষম।…আপনার প্রবন্ধগুলি পাঠক সমাজে প্রকাশ করিয়া…আপনার নিকটে ঋণমুক্ত হইতে পারিলেই আমরা যথেষ্ট জ্ঞান করিব। আপনার পুরস্কার ভবিষ্যৎ ইতিহাস লেখকের হস্তে। বর্তমানের অধম সমাজ আপনার পুরস্কার দিতে পারিবে না।” দেখুন আহমদ শরীফ, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ৬৩।
- ২২. দেখুন- ‘রসুল বিজয়’কে নিয়ে লিখিত এ টি এম রুহুল আমিনের প্রবন্ধ, মাসিক মােহাম্মদী, শ্রাবণ ১৩৭১। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা সাহিত্যের কথা, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১২। আরও দেখুন-আজহার ইসলাম, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ), অনন্যা, ঢাকা, ২০১০, পৃ. ১৩৮।
- ২৩. আহমদ শরীফ, বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮৬।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।