লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
লায়লী-মজনু বিশ্বের অমর প্রেমকাহিনীগুলির মধ্যে অন্যতম। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে লায়লী আর মজনুর প্রেম কাহিনী শোনেননি এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুস্কর। প্রায় সকলেই জানেন এই অমর প্রেম কাহিনীর আদ্যোপান্ত। লায়লী-মাজনুর রোম্যান্সকে অবলম্বন করে উর্দূ, হিন্দি, তুর্কি, আরবী এবং ফার্সিসহ বিভিন্ন ভাষায় বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র বা সিনেমা নির্মাণ করা হয়েছে।
মূল কাহিনীতে আমরা যা দেখতে পাই তা সংক্ষেপে হল, কাব্যের নায়ক মজনু আরবের ধনকুবের সুলতান আমির আল-মুলাওয়াহর একমাত্র সন্তান। দীর্ঘকাল নিঃসন্তান থেকে অনেক প্রার্থনা করার পর আল্লাহর অশেষ করুণায় তাঁরা মজনুকে লাভ করেন। মজনু দেখতে এতোটাই সুন্দর ছিল যেন তার শরীর থেকে আলোর জ্যোতি বের হয়ে গোটা প্রাসাদ আলোকিত করে তুলেছিল। সুলতান তাঁর সন্তানের জন্মে এতোটাই আনন্দিত হলেন যে তিনি নিজের প্রভূত ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে লাগলেন। সন্তান জন্মের খুশিতে তিনি তাঁর ধনসম্পদ বিতরণ করতে শুরু করলেন। প্রচুর দান পেয়ে প্রজাদের মনও ব্যাপক খুশিতে ও আনন্দে ভরে গেল।
শিশুটিকে যত্ন করার জন্য একজন দক্ষ সেবিকা রাখা হলো। প্রতি মুহূর্তে যেন তার ওপর নজর রাখা হয় সে জন্য প্রাসাদে ব্যাপক নজরদারি রাখা হল। মানুষের কুনজর থেকে রক্ষার জন্য তার কপালে টিপ দিয়ে দেওয়া হলো।
জন্মের সপ্তাহ দুয়েকের মাথায় সদ্যজাত শিশুটির নাম রাখা হলো কায়েস। যেহেতু বাবার নাম আল-মুলাওয়াহ তাই শিশুটির পুরো নাম হলো কায়েস ইবনে আল-মুলাওয়াহ।
মজনুর প্রকৃত নাম কায়েস। মজনুর জন্মের কিছুদিন পরেই লক্ষ করা গেল যে সে সুন্দরী নারীর কোল ভীষণ পছন্দ করে। একমাত্র সন্তানের জন্য তার বাবা সুন্দরী নারীর কোলের ব্যবস্থা করেন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে কায়েসের সৌন্দর্যও যেন আশ্চর্যজনকভাবে বৃদ্ধি পেতে লাগল। তার বয়স সাত বছর হল তখন প্রথম তার মুখে দাড়ির আভাস দেখা গেল। তাকে পড়াশোনার জন্য দামিস্ক শহরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হলো। খুব তাড়াতাড়ি শিশু কায়েস প্রতিষ্ঠানের সেরা ছাত্র হয়ে উঠল। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু ছেলেরাই পড়তো না, মেয়েরাও পড়তে আসতো। তারা একসাথেই পড়াশুনা করত। বিভিন্ন গোত্রের সম্ভ্রান্ত সব পরিবার থেকে মেয়েরা সেখানে পড়তে আসত। কিন্তু হঠাৎ একদিন নতুন এক মেয়ে এসে যোগ দিল তাদের প্রতিষ্ঠানে। কায়েসের মনে হলো, এত সুন্দরী মেয়ে এর আগে সে কখনও দেখেনি। যদিও তাদের বয়স তখনো দশ বছরও পেরোয়নি।
সেই অপরূপ সুন্দরী মেয়ে শিশুটির নাম লায়লা বা লায়লী। আরবী লায়লা শব্দের বাংলা অর্থ হল ‘রাত্রি’। পিতার নাম মাহদী তাই লায়লার পুরো নাম লায়লা বিনতে মাহদি। লায়লী যেন অপরূপ সুন্দরের প্রতিমূর্তি। হরিণীর মতো তার চোখ জোড়া। তার মায়াবী এক দৃষ্টির চাহনীর তীরে যেন হাজারো হৃদয় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। সত্যিই, লায়লীর কাজল দেয়া চোখের এক পলক যেন পুরো দুনিয়াকে ছারখার করে দিতে সক্ষম।
প্রথম দেখাতেই কায়েস লায়লীর প্রেমে পড়ে যায়। রীতিমত বাল্যপ্রেম যাকে বলে। এই বয়সেই কায়েস সুন্দর সুন্দর কবিতা রচনা করতে থাকে এবং সেই কবিতাগুলি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে থাকে। সেই কবিতাগুলি কেউ শুনতে না চাইলেও জোর করে শোনাতে থাকে। এক কথায় লায়লীর জন্য পুরো উন্মাদের মত আচরণ করতে থাকে ফলে লোকেরা তাকে আর কায়েস নামে না ডেকে মজনুন বা পাগল বলে আখ্যায়িত করে। আরবীতে পাগলকে ‘মজনুন’ বলা হয়।
লায়লীও মজনুর প্রেমে পড়ে যায়। তারা পাঠশালার পাঠের চেয়ে প্রেম পাঠে বেশি মনোযোগ দেয়। একে অপরকে প্রতিজ্ঞা করে যে, কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। একজন আরেক জনকে না দেখলে এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। লায়লীর প্রেমের কথা তার সহপাঠীদের মাধ্যমে লায়লীর মা জানতে পেরে যায় এবং লায়লীকে গৃহবন্দী করে রাখে। লায়লীর কক্ষের যাবতীয় খাতা কলম সব সরিয়ে নেন এবং কালির দোয়াত ভেঙে দেন। লায়লীর মা লায়লীকে বোঝাতেন যে এই কিশোরী বয়সের প্রেমের কথা শুনলে কেউ তাকে আর বিয়ে করবে না। কিন্তু লায়লী মায়ের কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করত না, সে শুধু মজনুর কথায় চিন্তা করত।
মজনু ছদ্মবেশ ধারণ করে লায়লীর সাথে দেখা করতে গেলে ধরা পড়ে লায়লীর পিতার কাছে বেদম মার খায়। লায়লীর বিরহে মজনু উন্মাদ হয়ে পড়ে। সংসার জীবন ত্যাগ করে নজদ বনে বনবাসে চলে যায় মজনু। খেয়ে না খেয়ে হিংস্র জানোয়ারদের সাথে থাকে এবং লায়লীর নাম জপে আর কাঁদে। এদিকে লায়লীও মজনুকে ভুলে থাকতে পারে না। তারও চিন্তায় শুধুই মজনু আর মজনু। মজনুও চারিদিকে প্রতিটি জিনিসের মধ্যে শুধু লায়লীকেই দেখতে পায়।
একদিন মজনু পাগল অবস্থায় একজন নামাজ পাঠরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে পেরিয়ে যায়। অথচ ইসলামী শরীয়তে স্পষ্ট নিষেধ আছে যে নামাজ পাঠরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। মজনু সেই নিষিদ্ধ কাজ করলে নামাজ পাঠরত ব্যক্তিটি উঠে এসে মজনুকে বলে, তোমার এতটুকু জ্ঞান নেই যে নামাজ পড়ার সময় নামাজীর সামনে দিয়ে যেতে নেই।
তখন মজনু সেই ব্যক্তিকে এমন জবাব দেয় যা রীতিমত চকিত করে দেওয়ার মত। মজনু জবাবে বলে,
“যখন লায়লীর প্রেমে উন্মাদ আমি এতটুকুও হুঁশ করতে পারিনি যে কেউ নামাজ পড়ছে, তাহলে লায়লীকে সৃষ্টিকারী আল্লাহর ইবাদত (উপাসনা) করার সময় আপনি কিভাবে বুঝতে পারলেন যে আমি আপনার সামনে দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছি। সঠিক ইবাদত খুবই মুশকিল। মাথা সিজদায় (স্রষ্টার জন্য প্রণিপাত) পড়ে আছে অথচ মন পার্থিব ব্যাপারে মগ্ন এটাকে কি উপাসনা বলে? এটা যদি ইবাদত হয় তাহলে আমার ভালবাসায় ঠিক আছে।”
তখন সেই নামাজ পাঠরত ব্যক্তিটি নীরব হয়ে যায়। কোন উত্তর খুঁজে পায়না।
নয়ফল রাজা নজদ বনে শিকারে গেলে সেখানে মজনুর সাথে সাক্ষাত হয়। মজনুর কাছ থেকে সব শুনে এবং ‘লায়লী – মজনুর’ প্রেমের মিলন ঘটাতে যুদ্ধ করে লায়লীর বাবাকে পরাজিত করে।
লায়লীকে দেখে নয়ফল রাজারও ভীষণ পছন্দ হয়ে যায়। সে মজনুর কাছে এসে লায়লী সম্পর্কে নিন্দা করে। কিন্তু মজনু নয়ফল রাজাকে বলেন,
“যদি আমার চোখ দিয়ে আপনি লায়লীকে দেখতেন শুধু তবেই বুঝতেন লায়লী আমার চোখে কী!”
নয়ফল রাজা তখন মজনুকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন। এক পাত্রে বিষ এবং অন্য পাত্রে মধু দিয়ে সেবক’কে বলেন মজনুকে যাতে বিষ ওয়ালা পাত্রটি দেওয়া হয়। কিন্তু সেবক ভুল করে বিষ ওয়ালা পাত্রটি নয়ফল রাজাকে দেয় এবং বিষ পানে নয়ফল রাজার মৃত্যু হয়। লায়লী চলে যায় পিতার সঙ্গে। মজনু ফিরে যায় তার অরণ্যবাসে।
লায়লীর অমতে ‘ইবনে সালাম’ নামক এক যুবকের সাথে তার বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মজনু ছাড়া লায়লী আর কাউকেই স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারে না। তাই বাসর রাতেই লায়লী তার স্বামীকে পদাঘাত করে এবং বলে, ‘বামন হইয়া চাহ ছুঁইতে আকাশ’।
লায়লীর বিয়ের খবর মজনুর যখন কাছে পৌঁছালো, তখন সে আরো পাগল হয়ে গেল। বাড়িও ফিরল না। তার বাবা-মা প্রতিদিন তার জন্য খাবার সাজিয়ে রাখতেন বাগানবাড়িতে, তাঁদের আশা ছিল একদিন তাদের ছেলে অবশ্যই বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু উন্মাদ মজনু রয়ে গেল হিংস্র জন্তুদের সাথে জঙ্গলের মধ্যেই। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে মজনু নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ত এবং নিজের শরীরের মাংস দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলত। নগ্ন হয়ে ঘুরে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কেউ কাপড় পরিয়ে দিলেও সেটাকে ছিঁড়ে ফেলে আবার নগ্ন হয়ে যেত। মজনুর এমন করুন পরিণতি হয়েছিল যে যদি সে উন্মাদ অবস্থায় লোকালয়ের দিকে ভুল ক্রমেও চলে আসত তাহলে লোকেরা ‘পাগল’ ‘পাগল’ বলে তাকে পাথর নিক্ষেপ করে তাড়া করে নিয়ে যেত এবং মজনুর শরীর ক্ষত বিক্ষত করে দিত।
একসময় মজনুর বাবাকে লোকেরা পরামর্শ দিল মজনুকে হজে পাঠিয়ে দেওয়া হোক, হতে পারে কাবার তাওয়াফের বরকতে মজনু সুস্থ হয়ে উঠবে। ফলে যখন মজনুকে হজে পাঠানো হল, কিন্তু মজনু হজে গিয়েও লায়লীকে ভুলতে পারল না। সব হাজীরা যখন ‘লাব্বাইক’ ‘লাব্বাইক’ বলত, তখন মজনু লাব্বাইকের জায়গায় ‘লায়লী’ ‘লায়লী’ বলে চিৎকার করত। লোকেরা যখন তাওয়াফ (কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ) করত তখন মজনু আল্লাহর কাছে দুয়া করে বলত,
“হে আল্লাহ যদি লায়লীকে আমি পেয়ে যায় তাহলে কেউ তওবা (ক্ষমা প্রার্থনা) করুক না করুক আমি করে নেব।”
ইতিহাসবিদ ইবনুল জওযী বলেছেন, লোকেরা জাবালে আবু কুবাইসে (আরবের আবু কুবাইস পাহাড়ে) একটি লোককে দেখতে পেল। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল এই ব্যক্তি কে? বলা হল এই ব্যক্তিই হল মজনু। সে কারো সাথে কোন কথা বলে না। একমাত্র যদি লায়লীর নাম নেওয়া হয় তবেই সে কথা বলে। সেই সময় জনৈক ব্যক্তি লায়লীর নাম নেওয়াতেই মজনু চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়। আরবের মিনা নামক একটি স্থানে কোন একজন মহিলার নাম লায়লী ছিল। তার স্বামী স্ত্রীর লায়লী নাম ধরে ডাকতেই মজনু সেটা শুনতে পায় এবং সে অজ্ঞান হয়ে যায়। ফলে হজে গিয়েও মজনু শান্তি পেল না। তাকে বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হল। পুনরায় মজনুর ঠিকানা হয় গভীর জঙ্গল।
মাঝে মাঝে কিছু পথিকের সাথে দেখা হত মজনুর, তারা বাড়িতে এসে মজনুর বাবা মাকে জানাতো মজনু একা একাই কবিতা আবৃত্তি করে, বালুতে কাঠি দিয়ে কবিতা লিখে। লায়লীর বিরহে সে পুরোটাই ভেঙে পড়েছে। মজনুকে জঙ্গলের জীবজন্তুগুলি তার চারপাশে জড়ো হয়ে ঘিরে রাখত এবং তাকে দীর্ঘ মরু রাত্রিতে তাকে পাহারা দিত। জীর্ণ শরীর নিয়ে মরুভুমি, উপত্যকা, গাছপালা ও তার চারপাশে থাকা জীবনজন্তুগুলিকে মজনু তার প্রেমের কাহিনী শোনাতে থাকে।
এরপর কেটে গেল বহু বছর, মজনুর বাবা-মা দুজনেই বয়সের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ছেলের জন্যে দুঃখে যন্ত্রণায় মারা গেলেন। লায়লী স্বয়ং মজনুর পিতা মাতার মৃত্যু সংবাদ পাঠাতে চাইলো মজনুর কাছে, শেষ পর্যন্ত লায়লী এক বৃদ্ধ লোককে ধরে রাজি করালো। বৃদ্ধ লোকটিও রাজি হয়ে গেল, জানালো যদি কোনোদিন দেখা পায় মজনুর সাথে তার সাক্ষাৎ হয় তাহলে জানিয়ে দেবে।
একদিন সেই বৃদ্ধ লোকটির সাথে সাক্ষাৎ হল মজনুর, বৃদ্ধ জানালো তার বাবা-মায়ে মারা গেছে। দুঃখে ভারাক্রান্ত মজনু প্রতিজ্ঞা করল যে সে আর কোনোদিন শহরে ফিরবে না।
পরে লায়লী তার বাবা-মায়ের সাথে শ্যামদেশে যাত্রা কালে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে নজদ বনে গিয়ে মজনুর সাথে দেখা করে। এবং লায়লী মজনুকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মজনু লোক – লজ্জা’র ভয়ে ও সামাজিক রীতিনীতির কথা ভেবে লায়লীকে ফিরিয়ে দেয়।
কবির ভাষায় লায়লীর প্রস্তাবের উত্তরে মজনু যা বলেছিল:
গুপ্ত রূপে তোহ্মাকে করিলে পরিণয়।
আরব নগরে লোকে দুষিবে নিশ্চয়।।
এদিকে লায়লীও মজনুর বিরহে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অর্থাৎ কাহিনীর পরিণতিতে লায়লীর মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে মজনু কবরস্থানে গিয়ে ঘ্রাণ শুকে শুকে লায়লীর কবর বের করে এবং লায়লীর কবরের পাশেই মজনুরও মৃত্যু হয়। এভাবেই লায়লী-মজনু কাব্যের সমাপ্তি হয়।
লায়লী মজনুর প্রণয় কাহিনীতে একটি বিষয় দেখা যায় যে, যে যুগে নারীর কন্ঠ অবরোধ করে জোর করে পিতামাতার পছন্দ করা পাত্রের সাথে বিবাহ দেওয়া হত এবং প্রেমকে সামাজিক অপরাধ হিসেবে গন্য করা হত সেই যুগে লায়লী সমাজের পরোয়া না করে পিতা মাতা, আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছে যে সে মজনু অর্থাৎ কায়েসকে ছাড়া আর কাউকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করবে না এবং স্বামীর অধিকার দেবেনা। বাবা মা জোর করে অন্য পুরুষের সাথে বিবাহ দিলেও লায়লী বাসর ঘরে স্বামীর বুকে পদাঘাত করে প্রত্যাখ্যান করে। অপরদিকে কায়েস অর্থাৎ মজনু লায়লীর প্রেমে পাগল হয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালেও শেষ পর্যন্ত লায়লীকে যখন কাছে পায় তখন এইভাবে গোপনে পালিয়ে বিয়ে করা বা একসাথে থাকাকে সে পছন্দ করেনি। সে চেয়েছিল সমাজ তাদের প্রেমকে প্রকৃত মর্জাদা দিক। এখানে আর একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, মজনু লায়লীর জন্য উন্মাদ হয়ে গেলেও লায়লী কিন্তু উন্মাদিনী হয়নি। তবে সেও মজনুর মত প্রেমে দগ্ধ হয়েছে। মজনুর চেয়ে লায়লীর প্রেম ছিল অধিক জ্বালাময়ী। মজনু লায়লীকে ফিরিয়ে দিলে সে দুঃখ, যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
প্রচলিত লায়লী মজনুর কাহিনীতে একে অপরের সাথে মিলন ঘটেনি। তবে দোভাষী পুথিকার মহম্মদ খাতের রচিত ‘দেওয়ানা মজনু’ নামের প্রেম কাহিনীটি মিলনাত্মক। কাব্যের শেষে একে অপরের সাথে মিলন ঘটছে। কাহিনীর শেষে দেখা গেছে মারা যাবার পর বেহেস্তে (স্বর্গে) গিয়ে মিলন হয়েছে। খাতের কৃত লায়লী মজনুতে শেষে উল্লেখিত আছে-
মজনুর পাকজান প্রভু সখা ছিল।।
বেহেস্তে লায়লী সঙ্গে যাইয়া মিলিল।।
(দেওয়ানা মজনু, মহম্মদ খাতের, গাওসিয়া লাইব্রেরী, কলকাতা ১৩৫৮, পৃষ্ঠা-১২৭)
লায়লী মজনুর প্রেম কাহিনীর বিভিন্ন সংস্করণে বিভিন্নভাবে কাহিনীটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। একটির সাথে অন্যটির মিল নেই। কোন কোন সংস্করণে এটাকে স্বর্গীয় প্রেম বলে উল্লেখ করা হয়েছে আবার কোথাও বলা হয়েছে যে তাদের প্রেমে এতটা প্রখরতা পেয়েছিল যে লায়লীর পিতা মজনুকে আহত করলে লায়লীও আহত হতো, এমনকি বাল্যকালে পাঠশালায় পড়ার সময় শিক্ষক যখন লায়লীকে শাস্তিস্বরূপ বেত্রাঘাত করতেন তখন মজনুর শরীরেও সেই বেতের দাগ পড়ে যেত, অপরদিকে মজনুকে বেত্রাঘাত করলে লায়লীর শরীরে দাগ পড়ে যেত। এমনই ছিল তাদের সেই স্বর্গীয় প্রেম। এমনকি একথাও উল্লেখ রয়েছে যে লায়লীকে বিয়ে করার জন্য লায়লীর ভাই তাবরেজকে মজনু হত্যা করেছিল। কেননা লায়লীর ভাই তাবরেজ লায়লী আর মজনুর বিয়ের ঘোর বিরোধী ছিল। তাবরেজকে হত্যা করলে হত্যার অপরাধে মজনুকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার আদেশ দেন বিচারক। তাই মজনু শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে যায়।
একটি সংস্করণে বলা হয়েছে যে লায়লীর সাথে বিয়ে হবার পর লায়লীর স্বামী যখন মজনুর সাথে প্রেমের ব্যাপারে জানতে পেরে যায় তখন লায়লীর বয়স্ক স্বামী মজনুর খোঁজে সৈন্য নিয়ে অভিযান চালায়। সেখানে মজনুর সাথে লায়লীর স্বামীর পাঠানো সৈন্যের চরম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই সময় লায়লীর স্বামী মজনুর বুকে তরবারি ঢুকিয়ে দেয়। ঠিক একই সময় বাড়িতে থাকা লায়লীও মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। এতে বোঝা যায় দুজনে একই সঙ্গে মারা যায়। এরপর দুজনকে পাশাপাশি সমাধীস্থ করা হয়েছিল। এখানে তাদের মৃত্যুর ঘটনা অন্যরকম আবার তাদের প্রণয় কাহিনীতে অন্যরকম ভাবে বর্ণিত হয়েছে।
একটি সংস্করণে রয়েছে যে কায়েসের জন্মের পরেই নাকি জ্যোতিষীরা কায়েসের হাতের রেখা দেখে বলে দেয় যে কায়েস একসময় একটি মেয়ের জন্য পাগল হয়ে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে। জ্যোতিষীদের এই ভবিষ্যৎবানীকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য কায়েসের পিতা মানত করেন যে তাঁর ছেলে যেন প্রেম রোগে আক্রান্ত না হয়। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে কায়েস ওরফে মজনু লায়লীর প্রেমে একসময় পাগল হয়ে যায়।
অন্য একটি সংস্করণে দেখা যায় লায়লীর বাবা উভয়ের প্রেমের ব্যাপারে জানতে পেরে পাশের গ্রামের এক বয়স্ক লোকের সাথে লায়লীর জোরপূর্বক বিয়ে দেন। লায়লী সেই বয়স্ক লোকটির সাথে ঘর-সংসার সে করতে থাকলো ঠিকই, কিন্তু বুড়ো মন পায়নি লায়লীর। এমনকি বৃদ্ধ স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্কও স্থাপন করেনি লায়লী, স্বামীও লায়লীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থানের জন্য জোর দেয়নি। লায়লীর মন শুধু তার প্রিয়তম মজনুর জন্যই কাঁদত। কিন্তু সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হিসেবে ভালো মেয়ে সেজেই স্বামীর ঘর করতে থাকলো লায়লী।
বেশ কয়েক বছর পর লায়লীর বৃদ্ধ স্বামী মারা যায়। তখন লায়লী আশা করছিল, যাক এবার সে তার মনের মানুষের সাথে সে সাক্ষাৎ করতে পারবে। আমৃত্যু থাকতে পারবে তার প্রিয়তম কায়েসের সাথে। কিন্তু তৎকালীন আরব বেদুইন রীতি ছিল যে, বিধবাকে অন্তত দু’বছর শোক পালন করতে হবে। এমনকি এই শোকপালনের সময় ঘর থেকেও বের না হতে পারবে না। লায়লীর পক্ষে দুইবছর অপেক্ষা ছিল অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। কীভাবে আরো দু’বছর মজনুকে না দেখে থাকতে পারবে সে? লায়লীর অনুভব হচ্ছিল, সে যেন পুরো এক জীবন মজনুকে না দেখে আছে। তারপর আরও দু’বছর? পারেনি। লায়লী মজনুর বিরহে মারা যায় তার নিজের বাড়িতেই।
লায়লীর মৃত্যু সংবাদ যখন জঙ্গলে থাকা মজনুর কানে পৌঁছালো। সঙ্গে সঙ্গেই সে রওনা দিল লায়লীর কবরের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে সে কাঁদতেই থাকলো।
শেষ পর্যন্ত সেও এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। লায়লীর কবরের ওপর পড়ে রইল মজনুর নিথর দেহ।
কবরের পাশে পাথরের উপর মজনুর কবিতার শিরোনাম খোদাই করা ছিল। তাঁর বাংলা অনুবাদ হল,
“আমি লায়লীর বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাই
আর তার দেওয়ালগুলিকে চুম্বন করি,
তবে বাড়িগুলো আমার ভালোবাসার বস্তু নয়,
ভালোবাসা শুধু তার জন্যই, যে একসময় এই বাড়িগুলোতে বসবাস করেছে।“
– কয়েস ইবনে আল মুলাওয়াহ (মাজনুন)
আবার অন্য একটি সংস্করণে আছে যে লায়লীকে দেখা করার জন্য কায়েস বা মজনু অন্ধ ভিখারীর বেশ ধারণ করে দেখা করতে যায় লায়লীর বাড়িতে। লায়লীর পিতা মজনুর উদ্দেশ্য জানতে পেরে কায়েসকে মেরে তাড়িয়ে দেন। কায়েসের বদনাম ছড়িয়ে যায় চারিদিকে। বেদনায়, বিরহে কায়েস উন্মাদ হয়ে যায়। তার নাম হয়ে যায় মজনু অর্থাৎ পাগল বা উন্মাদ। মজনুর বাবা বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু মজনুর উন্মাদনা কাটে না। মজনুর বাবা আমীর লায়লীর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। একজন উন্মাদে কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে অস্বীকার করেন লায়লীর বাবা।
অনেক অনুরোধের পর লায়লীর বাবা বিয়েতে রাজি হন। মজনু বিবাহ আসরে আসে। লায়লীর পোষা কুকুর দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে, চুম্বন করে এবং কুকুরের রূপের প্রশংসা করে মজনু। মজনুর এরকম পাগলামীর ফলে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। আবার কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে নগ্ন হয়ে জঙ্গলে চলে যায় মজনু। সারা পৃথিবীতে সে দেখে শুধু লায়লীকে। মজনু জঙ্গলে গিয়ে হিংস্র জীবজন্তুর সঙ্গে দিন কাটাতে লাগল। নির্জন জঙ্গলে বসেই সে লায়লীকে নিয়ে তপস্যা করতে লাগল আর কবিতা লিখতে লাগল। এইভাবে বিভিন্ন সংস্করণে লায়লী-মজনুর প্রণয় কাহিনী বিভিন্নভাবে আমাদের কাছে এসেছে। একটির সাথে অন্যটির বিস্তর অমিলও লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলা ভাষায় প্রথম লায়লী মজনুর প্রেম কাহিনী নিয়ে কাব্য রচনা করেন মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার কবি দৌলত উজির বাহরাম খান (আনু. ১৬শ শতক) । লায়লী-মজনু কাব্য রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান কাব্যধারায় একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে স্থান পেয়েছে। ডঃ মুহম্মদ এনামুল হক মনে করেন, ১৫৬০ থেকে ১৫৭৫ সালের মধ্যে কবি দৌলত খান ‘লায়লী-মজনু’ কাব্য রচনা করেছিলেন। ডঃ আহমদ শরীফ মনে করেন ১৫৪৩ থেকে ১৫৫৩ সালের মধ্যে কাব্যগ্রন্থটির রচনাকাল। ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর মতে লায়লী-মজনু কাব্যের রচনাকাল ১৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দ।
কবি দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত লায়লী-মজনু কাব্য পার্সিয়ান তথা ইরানি কবি জামীর ‘লায়লী-মজনু’ নামক কাব্যের ভাবানুবাদ। লায়লী-মজনু প্রেমকাহিনী সারা বিশ্ব জুড়ে পরিচিত। এই কাহিনীর মূল উৎস আরবি লোকগাঁথা। অনেকে কাহিনীটিকে ঐতিহাসিক দিক থেকে সত্য বিবেচনা করেছেন।
মজনুর আসল নাম নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। যেমন ক্বায়েস বিন মুলাওয়াহ, বাখতারী বিন জা‘দ বা অন্য কিছু। তাঁর গোত্রের নাম বনূ ‘আমের বিন ছা‘ছা‘আহ অথবা বনূ কা‘ব বিন সা‘দ। প্রেমিকা লায়লার নাম লায়লা বিনতে মাহদী আল-‘আমেরিয়াহ। আবু ওবায়দাহ বলেন, প্রেমে মত্ত হয়ে তিনি উন্মাদ হয়ে যান।
সত্যের খাতিরে বলতে হয় লায়লী-মজনুর প্রণয়-কাহিনীটি একটি কল্পিত উপাখ্যান। তবে এই অপরূপ প্রণয় উপাখ্যানটি কে সৃষ্টি করেছেন তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। আরবী সাহিত্যের ইতিহাসেও এই উপাখ্যান সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই। লায়লী-মজনু সম্পর্কে কোন কিংবদন্তিও চালু নেই আরবে। তাই মনে করা হয় আরবীয় লোকগাঁথা লায়লী মজনু কাহিনীর মূল উৎস বলে অনেকে অনুমান করেছেন। যদিও এ মতের পক্ষে কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। সুতরাং অনুমান করা হয় যে, এ-কাহিনী আরব উদ্ভুত নয়, যদিও ঘটনাস্থান আরব এবং পাত্র-পাত্রীও আরবীয়।
আরবি ভাষায় এই অমরপ্রেম গাঁথাকে ‘লায়লা ওয়া মাজনুন’ বলা হলেও ফারসিতে এই কাহিনীর নাম ‘লেইলি-মজনুন’। সেখান থেকেই বাংলায় এর নামকরণ হয় লায়লী-মজনু।
১১৪১ সালে জন্ম নেওয়া পারস্যের কবি নিজামি গনজবি অমর এই প্রেমগাঁথার কবিতাটি রচনা করেন। ১২০৯ সালে ফারসি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি নিজামি গনজবি মারা যান, তবে মারা যাবার আগে আর একটি অমর প্রণয় উপাখ্যান রচনা করেন যেটি শিরি-ফরহাদ প্রেমকাহিনী হিসেবে পরিচিত। শিরি-ফরহাদ প্রেমকাহিনী আরো ঘটনাবহুল, এবং যন্ত্রণাদায়ক।
সাহিত্য বিচারে লায়লী মজনুর প্রেম কাহিনী এক অনন্য স্থান দখল করে আছে বিশ্ব সাহিত্যে। ব্রিটিশ কবি বায়রন লায়লী-মজনুর কবিতাকে প্রাচ্যের ‘রোমিও-জুলিয়েট’ আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে লায়লী মজনুর এই প্রেমের উপাখ্যানটি লিখিত রূপ পাবার বহু আগে থেকেই অর্থাৎ প্রায় নবম শতক থেকেই গাথা বা উপকথা আকারে এ গল্প ছোট ছোট রূপে মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। সেটিকেই কবিতায় রূপ দেন ফারসী কবি নিজামি। তিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ রচনা করার জন্য সবগুলো মৌখিক উপকথা সংগ্রহ করেছিলেন। এরপর নিজামির কবিতা অবলম্বনে আরো অনেক ফারসি কবি লায়লী মজনুকে নিয়ে তাঁদের নিজেদের সংস্করণ রচনা করেন। এরমধ্যে রয়েছে আমির খসরু দেহলভী (১২৯৯), জামি (১৪৮৪) প্রভৃতি। লায়লী-মজনু নিয়ে মক্তবি শিরাজি, হাতেফি আর ফুজুলির সংস্করণগুলো উসমানিয়া (অটোমান) তুরস্ক ও ভারতীয় উপমহাদেশে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
লায়লী-মজনুর প্রণয় কাহিনী নিয়ে ইরানে ৫৯টি সংস্করণ পাওয়া যায়। আর শিরি-ফরহাদের কাহিনী অবলম্বনে ৫১টি ও ইউসুফ-জুলেখার ১৬টি সংস্করণ বিদ্যমান রয়েছে।
ওয়াহিদ দস্তগারদীর মনে করেন, যদি বর্তমানে বিদ্যমান গ্রন্থাগারগুলি অনুসন্ধান করা হয় তবে একজন সম্ভবত লায়লী এবং মজনুনের ১০০০ এরও বেশি সংস্করণ খুঁজে পাওয়া যাবে।
পুঁথিসাহিত্যের কবি মুহম্মদ খাতের (১৮৬৪), আবুজদ জহিরুল হক (১৯৩০), ওয়াজেদ আলী (১৯৪৪) রচিত লায়লী-মজনু কাব্য গ্রাম বাঙলার ঘরে ঘরে বহুল পঠিত ছিল। গদ্যে লেখা লায়লী-মজনু আখ্যানের রচয়িতারা হলেন মহেশ চন্দ্র মিত্র (১৮৫৩), শেখ ফজলুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৯০৩), আব্দুল গফুর সিদ্দিকী অনুসন্ধান বিশারদ, শাহাদাৎ হোসেন, মীর্জা সুলতান আহমদ, দ্বারকানাথ রায় (১৮৫৯), (নাটক) রাজকৃষ্ণ রায় (১৮৯১)। লায়লী-মজনুকে নিয়ে গীতিনাট্য রচনা করেন শ্রী বাঁশরীমোহন মুখোপাধ্যায়।
বাঙলায় রচিত লায়লী-মজনুর কাহিনীর উৎস ফারসি কাব্যগ্রন্থ মনে করা হলেও কে প্রথম এই কাহিনীটি আদি রচয়িতা তা জানা যায় না। ড. আহমদ শরীফের মতে দশ শতকের ইরানি কবি রুদকীর কবিতাতেই সম্ভবত প্রথম লায়লী মজনুর প্রেম প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। ফারসি ভাষায় নিযামী গনজাবী (১১৮৮), আমীর খসরু (১২৯৮), আব্দুর রহমান জামী (১৪৮৪), আব্দুল্লাহ হাতিভী (১৫১১), হিলালী আস্ত্রাবাদী (১৫৩৩), দামিরী (১৫২৪-৭৬), মীর্জা মুহম্মদ কামে কাসেমী গুণাবাদী (১৫৭২) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
ভারতে এমন উপকথাও প্রচলিত আছে যে, লায়লী-মজনু আরব মরুভূমিতে মৃত্যুবরণ করেনি, বরং তারা নিজেদের দেশ আরবভূমি ছেড়ে ভারতের রাজস্থানে চলে এসেছিল। আর সেখানেই তারা মৃত্যুবরণ করে। ভারতীয় উপকথা অনুযায়ী লায়লী তার স্বামীকে পরিস্কারভাবে বলে দেয় যে সে মজনুকে ভালবাসে। সে যদি মজনুকে না পায় তাহলে সে আত্মহত্যা করবে। ফলে লায়লীর স্বামী তাকে তালাক দেয়। এবং লায়লীকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এরপর মজনু যখন পুনরায় লায়লীকে দেখে তখন আবার লায়লীকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এবং তাঁরা দুজনে পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে। যখন এই কথা লায়লীর ভাই জানতে পারে তখন দুজনকে মেরে ফেলার জন্য খুঁজতে থাকে। এই সময় লায়লী আর মজনু পালিয়ে বেড়াতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে তারা ভারতের রাজস্থানে শ্রীগঙ্গানগরের অনুপগড়ে এসে উপস্থিত হয় এবং প্রচণ্ড পিপাসার কারণে তাদের মৃত্যু হয়। ভারতীয় উপকথায় এমন বিশ্বাসও প্রচলিত আছে যে, লায়লী-মজনুর মাজার বা কবর রাজস্থানের অনুপগড়ের নিকট বিজনৌর গ্রামে অবস্থিত।
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আমিনুল ইসলাম লিখেছেন, ষোড়শ শতকে দৌলত উজির বাহরাম খান ছাড়া আর কোনো কবির রচিত ‘লায়লী-মজনু’ কাব্যের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। লায়লী-মজনু কাহিনি অবলম্বনে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে দোভাষী পুঁথি লিখেছেন মোহাম্মদ খাতের। জহিরুল হক এবং ওয়াজেদ আলী গদ্যে ‘লায়লী-মজনু’ আখ্যায়িকা রচনা করেছেন। এছাড়া মহেশচন্দ্র মিত্র (১৮৫৩), দ্বারকানাথ রায় (১৮৫৯) এবং শেখ ফজলুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৯০৩) প্রমুখ পদ্যে লায়লী-মজনুর করুণ প্রেম কাহিনি নিয়ে আখ্যায়িকা প্রণয়ন করেছেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে রাজকৃষ্ণ রায় লায়লী-মজনু কাহিনির নাট্যরূপ দিয়েছেন। [সুকুমার সেন, বাংলার সংস্কৃতিতে মুসলমান প্রভাব ও মুসলমানী কেচ্ছা, সাপ্তাহিক দেশ, সাহিত্য সংখ্যা, কলকাতা, ১৩৭২, পৃ. ৫৭।]
বাহরাম খান অর্থমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে তাকে দৌলত উজির বলা হয়। আরাকানের রাজার প্রতিনিধি হিসেবে এক সময় নিজাম শাহ চট্টগ্রাম শাসন করতেন। বঙ্গাধিপতি আলাউদ্দিন হোসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) উজির হামিদ খানের বংশধর মোবারক খানকে নিজাম শাহ অর্থমন্ত্রী বা দৌলত উজির পদে বসান। মোবারক খানের আকস্মিক মৃত্যু হলে তার কিশোর পুত্র বাহরাম খান দৌলত উজির বা অর্থমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন। দৌলত উজির বাহরাম খান কবি ছিলেন। সে কারণে তিনি বিদেশী উৎসের একটি কাহিনিকে চমৎকার ভাষায় সুন্দর অলংকারের মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সামনে তুলে ধরেছিলেন। অবশ্য ‘লাইলী-মজনু’ই তার একমাত্র কাব্য নয়। তিনি এর আগেও আর একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেটি হল কারবালা কাহিনি বা ‘ইমাম বিজয়’ কাব্য।
‘লায়লী-মজনু’র নাম শুনে মনে হয় যে, এটি আরব দেশের কাহিনি কিন্তু আরবি ভাষায় এই কাহিনিকে অবলম্বন করে কোনো মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল বলে জানা যায় না। তবে ফারসি ও হিন্দিতে অনেকেই লাইলী-মজনুর প্রেম কাহিনি নিয়ে কাব্য রচনা করেছিলেন। বাহরাম খান কবে ‘লাইলী-মজনু’ কাব্যটি রচনা করেছিলেন তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে।
এনামুল হক মনে করেন যে, ১৫৪৫ খ্রি. থেকে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এটি রচিত হয়েছে। আহমদ শরীফ ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাব্যটি রচিত হয়েছিল বলে মতামত ব্যক্ত করেন।
পারস্যের একটি সুপরিচিত কাহিনি অবলম্বনে ‘লায়লী মজনু’র কাহিনি গড়ে উঠেছে। তবে মূল গল্পের সঙ্গে ফারসি কাব্যের সম্পর্ক থাকলেও এ কাহিনির বাংলা রূপান্তরে কবি দৌলত উজির বাহরাম খান তার মৌলিকতা গুণটিকে কোথাও রুগ্ন হতে দেননি। ঘটনা-চিত্রণে ফারসি সাহিত্যের প্রভাব হযতো এসেছে, কিন্তু তার পরিবেশনটি হয়েছে সম্পূর্ণত বঙ্গীয় আদর্শ ও রীতিনীতির অনুসরণে। দেশীয় ঐতিহ্য থেকে কবি কোনোক্রমেই বিস্মৃত হননি। সেজন্য দৌলত উজিরের ‘লায়লী মজনু’ বিয়োগান্তক কাব্য হিসেবে একটি সার্থক সৃষ্টি। কবির ঐতিহ্যপ্রীতি তার একটি কারণ।
অতিপ্রাকৃত ঘটনার অবতারণা মধ্যযুগের কাব্যের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তবে ‘লায়লী মজনু’ সেই দিক থেকে একটি রোমান্টিক কাব্য হলেও এর বেশিরভাগ বিষয় অলৌকিকতার স্পর্শমুক্ত। এ কাব্যের প্রথম দুই একটি অংশ ছাড়া বাকি অংশগুলোতে অতিপ্রাকৃত ঘটনাপুঞ্জের সমাবেশ নেই।
কবি দৌলত উজির ব্রজবুলি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গ ছেড়ে লায়লী-হেতুবতী প্রসঙ্গ ব্রজবুলি ভাষার প্রয়োগে তিনি নতুন ট্র্যাডিশন, নতুন টেকনিক প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ভাষার উপর কবি দৌলতের অসামান্য দখলের জন্য এটা সম্ভব হয়েছে। ফারসি ভাষার সৌন্দর্য, সংস্কৃতের গাম্ভীর্য এবং ব্রজবুলির মাধুর্য তাঁর কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
সুফীতত্ত্ব, যোগতত্ত্ব, সঙ্গীতশাস্ত্র ও নাট্যশাস্ত্র সম্পর্কে কবি দৌলতের বিশেষ জ্ঞান ছিল। ‘লায়লী-মজনু’ এমনকি ‘ইমামবিজয়’ কাব্যের অধ্যায় শীর্ষে রাগ-ছন্দের উল্লেখ রয়েছে। ‘লায়লী-মজনু’তে ভারতীয় সঙ্গীতের বিচিত্র রাগ-রাগিণী ও তালছন্দের নাম পাঠ করে হৃদয় চমৎকৃত হয়। কবির চিন্তাশক্তি জড়তামুক্ত, প্রকাশভঙ্গি স্বচ্ছন্দ। তিনি অনায়াসে পরিবেশ রচনা এবং ভাবের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম। গতি তাঁর প্রকাশভঙ্গির বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাব্য বিবৃতিসর্বস্ব নয়। কবি ঘন ঘন চরিত্রের মুখে সংলাপ দিয়ে একাধারে বর্ণনার বৈচিত্র্য ও অন্যধারে নাটকীয় স্বকীয়তা আরোপ করেছেন। দোভাষী পুঁথিকারগণ এরকমটি পারেননি বলে তাঁদের রচনাভঙ্গি একঘেঁয়ে এবং তাদের কাব্যপাঠ ক্লান্তিকর। অথচ ‘লায়লী-মজনু’ কাব্য পাঠ সুখকর।
পর্যালোচনা করলে লক্ষ করা যায় যে, কবি দৌলত উজির বাহরাম খানের বাংলা ভাষা ও শব্দশক্তির উপর অসামান্য দক্ষতা ছিল। তিনি ছিলেন শব্দকুশলী। ধ্বনিসাম্য ও ধ্বনি গাম্ভীর্য সৃষ্টিতে তিনি তৎপর ছিলেন। শব্দ সম্ভারের উপর তার কিরূপ দখল ছিল তার অন্যতম প্রমাণ ‘চৌতিশা’ অংশ। বাংলা প্রতিবর্ণ শব্দাদিতে ব্যবহার করে চরণ ও শ্লোক-সমষ্টি দ্বারা হৃদয়ের অভিব্যক্তির নাম ‘চৌতিশা’। হিন্দু কবিগণ দেবস্তুতিতে ‘চৌতিশা’ রচনা করেছেন। ‘লায়লী-মজনু’তে ‘মজনুর মদন-জ্বালা’ ‘চৌতিশা’র আকারে অভিব্যক্তি লাভ করেছে—
আদ্যে ‘ক’ বর্ণ দিয়ে-
“কুসুম সময়েত অমৃত পরবেশ।
কুসুমিত বৃন্দাবনে সুরঙ্গ বিশেষ।।”
আদ্যে ‘ঘ’ বর্ণ-দিয়ে
“ঘন ঘন বৈশাখ শুনিয়া পিক নাদ।
ঘোর হৈল নয়ান জীবনে নাহি সাধ।”
আদ্যে ‘জ’ বর্ণ দিয়ে
“জগতেত জনম হইল মাের কাল।
জীবন যৌবন মোর হইল জঞ্জাল।।”
দৌলত উজিরের ‘লায়লী মজনু’ কাব্যে অশ্লীল রস পরিবেশনের সুযোগ থাকলেও কবি সেই চিরাচরিত প্রথাটির প্রয়োগ থেকে বিরত থেকেছেন। ভাষা প্রয়োগে কবি সংস্কৃতের সঙ্গে ফারসির মিলন-সৌষ্ঠব রক্ষা করেছেন। ‘লায়লী মজনু’ কাব্যে প্রবাদ বাক্যের মতো কয়েকটি নীতিমূলক বাক্য আছে। যেমন—
“এক নারী দুই পতি নাহিক সুগতি।
এক দেশে দুই নৃপ না হয় বসতি।।”
পঙক্তিটি গভীর ভাবোদ্দীপক ও কাব্যমধুর তো বটেই।
‘লায়লী মজনু’ কাব্যে অপ্রয়োজনীয় আরবি, ফারসি কোনো শব্দের বাহুল্য লক্ষ করা যায় না। বাংলা অঞ্চলের মানুষের উপযোগী করে বাংলার প্রকৃতির বিবরণ এতে দেওয়া হয়েছে। আরবের নজদের নাম এই কাব্যে উল্লেখিত হলেও সেখানকার যে প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা আরবের নয় এবং এই কাব্যপাঠ করলে বাংলার ছবিই পাঠকের সামনে ভেসে ওঠে।
দৌলত উজির বাহরাম খানকে কবি ভারতচন্দ্রের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কাব্য ও কবিত্বের গুণে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা যথার্থ বলে মনে হয়। [প্রাগাধুনিক মুসলিম সাহিত্য বাংলা কাব্যচর্চার ক্রমবিকাশ, আমিনুল ইসলাম]
লায়লী মজনুকে নিয়ে সর্বপ্রথম উপাখ্যান রচনা করেন ফারসী কবি নিজামী। এরপর আব্দুর রহমান জামী লায়লী মজনুকে নিয়ে কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।
কবি আবিদুর রহমান জামীর কাব্যে লায়লী উমাইয়া বংশীয় খলিফা আবদুল মালিকের (৬৮৫-৭০৫ খ্রীঃ) পদস্থ কর্মচারীর কন্যা। আমীর খসরুর কাব্যের সাক্ষ্যে লায়লী-মজনু ছিল মারওয়ান ইবন হাকীমের (৬৮৩-৮৪ খ্রীঃ) সমসাময়িক। এমন কি এই কাব্যে লায়লী-মজনুর বংশ-পরিচয়ও রয়েছে। আমীর খসরুর বর্ণনায় লায়লী ছিল বনি অমির গোত্রীয় কন্যা। তার পিতার নাম মেহদী, পিতামহ সাদ এবং প্রপিতামহ মেহদী। মজনু ছিল আদির প্রপৌত্র, মোফাহামের পৌত্র এবং মলুহর পুত্র।
অন্য একটি সূত্রে দেখা যায় লায়লী এবং মজনু দুজনেই বনু কা’ব গোত্রের ছিলেন। কায়েস এবং লায়লী উভয়ই তাদের বংশ হাওয়াজিন গোত্রের ছিল, তারপরে বানু কাব (পিতৃপুরুষ কা’ব) গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়, এই বনু কা’ব ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা নবী মুহাম্মদের (সাঃ) প্রত্যক্ষ বংশের সাথেও সম্পর্কিত। সুতরাং, তারা সকলেই আদনানের বংশধর, ইব্রাহিম (আঃ) এর পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) এর অধঃস্তন। তাদের বংশটি আরবী রেকর্ডগুলি থেকে বর্ণিত:
কয়েসের বংশ তালিকাটি হ’ল: কয়েস বিন আল-মুলাওয়াহ বিন মুজাহিম ইবনে আছ বিন রাবিয়াহ বিন জাদাহ বিন কাব বিন রাবিয়াহ বিন আমির বিন সাসাআহ বিন মুআওয়িয়াহ বিন বকর বিন হাওজিন বিন মনসুর বিন ইকরিমাহ বিন খাসফাহ বিন কায়েস আইলান বিন মুদার বিন নিজার বিন মাআদ বিন আদনান।
আরবীতে কয়েসের বংশতালিকাটি হলঃ
قيس بن الملوّح بن مزاحم بن عدس بن ربيعة بن جعدة بن كعب بن ربيعة بن عامر بن صعصعة بن معاوية بن بكر بن هوازن بن منصور بن عكرمة بن خصفة بن قيس عيلان بن مضر بن نزار بن معد بن عدنان
তিনি হাওজিনের আমিরী (বনু আমিরের বংশোদ্ভূত) আল-আমিরির আল-হাওজিনি।
কায়েসের জন্ম ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে (হিজরিতে ২৪ হিজরী) হয়েছিল এবং তাঁর মৃত্যু হয় ৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে আরব মরুভূমিতে হিজরীর প্রথম শতাব্দীতে (হিজরী ৬৮সন) চতুর্থ উমাইয়া খলিফা মারওয়ান প্রথম ও পঞ্চম উমাইয়া খলিফা আবদ-মালেক ইবনে মারওয়ানের সময়ে।
এক মহিলার দ্বারা বর্ণিত আছে যে কায়েস ৬৮ হিজরিতে (৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে) মারা গিয়েছিলেন এবং তিনি মারা যাওয়ার সময় পাথরগুলির মধ্যে পড়েছিলেন যেখানে লায়লীকে সমাহিত করা হয়েছিল, এবং তাঁর লাশ তার পরিবারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
পক্ষান্তরে লায়লীর বংশতালিকাটি হল: লায়লা বিনতে মাহদী বিন সাদ ইবনে মুজাহিম বিন আদ বিন রাবিয়াহ ইবনে জাদাহ বিন কা’ব বিন রাবিয়াহ বিন হাওজিন বিন মনসুর বিন ইকরিমাহ বিন খাসফাহ বিন কায়েস আইলান বিন মুদার বিন নিজার বিন মাআদ বিন আদনান।
লায়লীকে “উম্মে মালিক” বলা হত।
আরবীতে লায়লীর বংশতালিকা হল:
ليلى بنت مهدي بن سعد بن مزاحم بن عدس بن ربيعة بن جعده بن كعب بن ربيعة بن هوازن بن منصور بن عكرمة بن خفصه بن قيس عيلان بن مضر
লায়লী ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে (হিজরিতে ২৮ হিজরী) নাজদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন প্রথম শতাব্দীর চতুর্থ উমাইয়া খলিফা মারওয়ান এবং পঞ্চম উমাইয়া খলিফা আবদ-মালেক ইবনে মারওয়ানের সময়ে।
লায়লী আন নাজু শহরে কয়েসের চার বছর পরে জন্মগ্রহণ করেন, সেই শহরটিকে পরবর্তীতে আজও তাঁর নামানুসারে “লায়লা” বলে ডাকা হয়, এবং সেটি আফলাজের রাজধানী। আফলাজ রিয়াদ অঞ্চলের একটা প্রদেশ। ‘লায়লা’ শহরটি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াধ থেকে ৩৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। লায়লা শহর ও এর আশেপাশের গ্রাম ও গ্রামগুলির জনসংখ্যা প্রায় ৭৬,০০০ মূলত দাওয়াসির উপজাতির বাসিন্দা আরব বেদুইনদের নিয়ে। ‘লায়লা’ নামের একটি হ্রদও সেখানে রয়েছে।
খুসরু ৫ ম শতাব্দীর (১০০৯ খ্রিস্টাব্দ – ১১০৬ খ্রিস্টাব্দ) ‘লায়লা’ শহরটি ভ্রমণ ও পরিদর্শন করেছিলেন এবং জবাল আল-তৌবাদ পাহাড়ের উপস্থিতিতে এই শহরটিকে সঠিকভাবে বর্ণনা করেছিলেন এবং শহরটি যে দুর্দশায় পরিণত হয়েছিল তাও বর্ণনা করেছিলেন।
লায়লী-মজনুর কাহিনীটি আজারবাইজান সাহিত্যে গল্পটির আজারবাইজানীয় ভাষাতে বিদ্যমান রয়েছে ‘দস্তান লায়লা ওয়া মজনুন’ নামে। ষোড়শ শতাব্দীতে ধ্রুপদী আজারবাইজানীয় কবি, লেখক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ফুজুলি (খ্রীষ্টাব্দ ১৪৯৪-১৫৫৬) এবং হাজিরি তাবরিজি লিখেছিলেন। তাঁদের সংস্করণটি মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম গীতিনাট্য হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের শেষদিকে এই কাহিনীটি মঞ্চস্থ করা হয়, আহমেদ শওকী লায়লী-মজনুর বিয়োগান্তক বিষয়ে একটি কাব্য নাটক রচনা করেছিলেন, যা এখন আধুনিক আরব কবিতায় অন্যতম সেরা হিসাবে বিবেচিত। গীতিনাট্যের মধ্যে লায়লীকে নিয়ে মাজনুর আসল লেখা লাইনগুলিকে মাঝে মাঝে এমনভাবে প্রয়োগ করেছেন যে তাঁর লেখা গীতিনাট্য ও মজনুর আসল কবিতার মধ্যে মানুষ গুলিয়ে ফেলে। অর্থাৎ লোকেরা বুঝতেই পারেনা কোনটি মজনুর লেখা কবিতা আর কোনটি নাট্যকারের লেখা গীতিনাট্য।
ফুজুলির জীবন ও কর্মকাণ্ড নিয়ে তাঁর ৫০০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৯৬ সালে আজারবাইজানীয় ১০০ এবং ৫০ টাকার স্মরণীয় মুদ্রার বিপরীতে কবিতাগুলি চিত্রিত করা হয়েছে।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে লায়লী-মজনুর প্রণয় কাহিনীটি প্রথম ইংরেজীতে অনুবাদ করেন আইজ্যাক ডি’সরায়েলি।
ব্রিটিশ আমলের পূর্বে দৌলত উজীর বাহরাম খান ছাড়া আর কেউ বাংলায় লায়লী-মজনুর উপাখ্যান রচনা করেছেন বলে জানা যায়নি। শিরি-ফরহাদের প্রণয়-কাব্যও বোধ হয় রচিত হয়নি তখন। এ ব্যতিক্রম সম্ভবত অহেতুক নয়। লায়লী-মজনু ও শিরি-ফরহাদ রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের মতো অধ্যাত্ম প্রেমের রূপকাশ্রিত প্রণয়ােপাখ্যান। কাহিনী-দুটো বোধ করি সুফীদেরই সৃষ্ট। ইরানই সুফী মতের বিকাশ ও প্রসার ক্ষেত্র। তাই উপাখ্যান দুটো উদ্ভুত হয় ইরানী ভাষাতেই। মধ্যযুগে দৌলত উজীর বাহারাম খানই কেবল লায়লী-মজনুর লৌকিক প্রণয়-কাব্য রচনা করে অর্জন করেছেন দুঃসাহসিকতার গৌরব।
আজ অবধি বাঙলায় রচিত যে-কয়খানি লায়লী-মজনু উপাখ্যানের নাম জানি সেগুলোর নাম দিচ্ছিঃ
বাঙলা
১. লায়লী-মজনু : দৌলত-উজির বাহরাম খান (১৫৪৫-৫৩ খ্রীঃ)
২. লায়লী-মজনু : মুহম্মদ খাতের (দোভাষী পুথি ১৮৬৪ খ্রীঃ)
৩. লায়লী-মজনু : অবিজদ জহিরুল হক (ঐ-১৯৩০ খ্রীঃ)
৪. লায়লী-মজনু : ঐ ওয়াজেদ আলী (ঐ-১৯৪8)
গদ্যে
১. লায়লী-মজনুঃ মহেশ চন্দ্র মিত্র ( ১৮৫৩ খ্রীঃ)।
২. লায়লী-মজনুঃ শেখ ফজলুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৯০৩)
৩. লায়লী-মজনুঃ আবদুল গফুর সিদ্দিকী অনুসন্ধানবিশারদ।
৪. লায়লী-মজনুঃ শাহাদাৎ হোসেন।
৫. লায়লী-মজনুঃ মীর্জা সোলতান আহমদ।
ফরাসী
ফরাসীতে লায়লী-মজনু কাব্যের আদি রচয়িতা কে তাও জানা সম্ভব হয়নি। তবে দশ শতকের ইরানী কবি রুদকীর (রুদগীর) কবিতাতেই সম্ভবত লায়লী-মজনুর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন সুত্রে যাদের সন্ধান মেলে, তাঁদের কালানুক্রমিক নাম দেওয়া হল :
১. নিযামী গঞ্জাবী (গিয়াস উদ্দিন অবি মুহম্মদ ইলিয়াস বিন ইউসুফ, গঞ্জা) ৫৮৪ হিঃ বা ১১৮৮ খ্রীষ্টাব্দ।
২. আমীর খসরু ( দিল্লী) ৬৯৮ হিঃ বা ১২৯৮ খ্রীঃ।
৩. আবদুর রহমান জামী (ইরান) ৮৮৯ হিঃ বা ১৪৮৪ খ্রীঃ।
৪. আবদুল্লাহ হাতিভী (ইরান) ৯১৭ হিঃ বা ১৫৩১ খ্রীঃ।
৫. হিলালী অস্ত্রবাদী ( অস্ত্রাবাদ) ৯৩৯ হিঃ বা ১৫৩৩ খ্রীঃ।
৬, দামিরী (ইরান, শাহ-তামাস্পের সভাকবি) ৯৩০-৮৪ হিঃ বা ১৫২৪-৬৭ খ্রীঃ।
৭. মীর্জা মুহমদ কাসেম কাসেমী গুনাবাদী (খােরাসান) ৯৭৯ হিঃ বা ১৫৭২ খ্রীঃ!
৮. মীর মহম্মদ আমীর শাহ বোস্তানী ওরফে মীরজমল (ইরান ভারত সমাট শাজাহান ও আওরঙ্গজেবের সেনানী) ১০১১ হিঃ বা ১৬২২ খ্রীঃ।
৯. জনৈক হিন্দু কবি (শাহজাহানের আমলে) ১০৫৫ হিঃ বা ১৬৪৫ খ্রীঃ।।
১০. আরিফ লাহোরী (আওরঙজেব আলমগীরের নামে উৎসর্গিত গ্রন্থ। নাম মিহির-ই ওয়াফৎ) ১৬৬০-১৭০৭ খ্রীঃ। এটি মুহমদ হবিবর রহমান খান শেরওয়ানীর সম্পাদনায় ১৩৪৫ হিঃ সনে অনীগড় থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
হিন্দুস্তানী
১. হায়দার বখশ।
২. মুহম্মদ তকী খান? (১৮৬২ খ্রী:)।
৩. ওলী মুহম্মদ মনজীর : ১৮৬৬ খ্রীস্টাবেদ লাহোরে মুদ্রিত।
৪. আবদুল্লাহ ইবনে গোলামঃ ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে বোম্বাইয়ে মুদ্রিত।
সম্ভবত নিযামীর, খসরুর কিংবা অব্দুর রহমান জামীর কাব্যকাহিনী ভিত্তি করে কবি দৌলত উজীর বাহরাম খান স্বাধীনভাবে তার কাব্যখানা রচনা করেন। এ জন্যে উক্ত তিনটে কাব্যের কোনটার সঙ্গেই তাঁর কাব্যকথার পুরোপুরি মিল নেই। [সূত্রঃ লায়লী মজনু, আহমদ শরীফ সম্পাদিত, পৃষ্ঠা – ২৮/৩০]
আহমদ শরীফ উজির বাহারাম খান রচিত লায়লী মজনু কাব্যগ্রন্থে ছয়টি যুগ-দুর্লভ গুণের উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল যথাক্রমেঃ
এক, লায়লী-মজনু কাব্য যথার্থ ট্র্যাজেডী। কারণ রামায়ণ, মহাভারত, কারবালা বিষয়ক কাব্য কিংবা অন্যান্য বিয়োগান্ত বা করুণ রসাত্মক রচনায় সত্যিকার Tragic effect নেই। রামায়ণে একটা রাজকীয় আদর্শের লালনে সীতা-বর্জনের বেদনায় প্রলেপ ও প্রবােধ মিলেছে। ন্যায়ের স্বীকৃতিতে, স্বর্গে আত্মীয় মিলনের আশ্বাস ও পরীক্ষিতের রাজ্য লাভের মাধ্যমে বেদনার বিমোচন ঘটেছে মহাভারতে। কারবালা কাহিনীতেও প্রশান্তি এসেছে ন্যায়ের জয়ে, এজিদের নিধনে অর জয়নুল আবেদিনের প্রতিষ্ঠায়। অতএব, বিয়োগান্ত কাব্য রচনায় বাহরাম খনি পথিকৃৎ এবং বাঙলায় এক নতুন কাব্যদর্শ প্রবর্তনের গৌরব তারই।
দুই, এ কাব্য-কাহিনী অলৌকিকতামুক্ত প্রায়-স্বাভাবিক জীবন-ভিত্তিক।
সে-যুগের সাহিত্যে রোমান্স সৃষ্টির প্রয়োজনে অলৌকিক-অস্বাভাবিক তথা অতিপ্রাকৃত ঘটনার সমাবেশ করা ছিল প্রায় অপরিহার্য। স্বর্গমর্ত্য-পাতালের পরিসরে, নদনদীনগরীর পরিবেশে, জ্বীন-পরী-ভূত-প্রেতের ও অসরী-কিন্নরীর উপস্থিতিতে, দেব-দৈত্য-রাক্ষস প্রভৃতির সঙ্গে দ্বন্দ সংঘাতময় মানবজীবনের বিচিত্রলীলার বর্ণালি অতি মানবিক কাহিনীই ছিল আমাদের কবিদের অবলম্বন এবং কাব্যেবর্ণিতব্য বিষয়। তাঁদের জীবনবোধও ছিল স্থুল। তাদের চেতনায় বাহুবল, মনোবল আর বিলাসবাঞ্ছাই ছিল নায়ক জীবনের আদর্শ, রূপ-তৃষ্ণাই ছিল প্রেরণার উৎস, সংগ্রামশীলা ও আত্মিপ্রতিষ্ঠাই ছিল সে জীবনের ব্রত এবং জরু ও জমি ভোগই ছিল লক্ষ্য। সে জগতে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সঞ্চরণে, নদী-গিরিঅরণ্য-কান্তার উঘনে, নাগের বাঘের কবর উত্তরণে নায়কের বাধা সামান্য। সেখানে পাখি তত্ত্বকথা বলে, রাক্ষস প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাড়ায়, দৈত্য হয় বৈরী, দেবতা করেন প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। লায়লী-মজনু কিন্তু সে ধরনের রচনা নয়।
হামিদ খানের ধার্মিকতার পরীক্ষায়, নজদ বনের শ্বাপদের মজনুপ্রীতিতে, অঙ্গের চর্মে ও রক্তে পত্র রচনার, কিংবা দৌরারিকের হস্ত – অবশতায় এবং গন্ধ শুকে কবর সন্ধানে অলৌকিকতার ছায়া থাকলেও যোগী-সন্ত-দরবেশের কেরামতিতে অস্থাবান লােকের কাছে তা হয়তো অসামান্য, কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। এগুলো ফারসী-সংকৃত সাহিত্যের ঐতিহ্য। কাজেই বলা চলে, লায়লী-মজনু কাব্যে কোথাও অতিপ্রাকৃত ঘটনা-জাল বোনা নেই। এ হিসেবে ‘লায়লী-মজনু’ ষোল শতকের একক সৃষ্টি। সতেরো শতকের ‘সতী ময়না-লোর-চন্দ্রানী’ কাব্য বাস্তব-ঘেঁষা হলেও সত্যিকার বাস্তব ঘটনাভিত্তিক নয়। এ ক্ষেত্রে লায়লী-মজনু আমাদের গাথা বা গীতিকা সাহিত্যের সমগোত্রীয়।
তিন, এ কাব্য আশ্চির্য রকমে অশ্লীলতামুক্ত।
পদ্য-সাহিত্য ছাড়া ষোলশতক অবধি বাঙলা সাহিত্য ভাবে, ভাষায় ও বর্ণন-ভঙ্গিতে সাধারণভাবে গ্রাম্য অবহে লালিত। দৌলাত উজীরের কাব্যে প্রথম নাগরিক ভব্যতার, মননশীলতার ও শিল্পরুচির সুপ্রকাশ প্রত্যক্ষ করি। এ কাব্যের বার্ণত বিষয় আদিরসাশ্রিত। কিন্তু রুচিবান কবি সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন শৃঙ্গার রসের বীভৎসতা। এখানে রূপজ মোহ ও দেহজ প্রেম মানস-আস্বাদনের স্তরে উন্নীত। এই মিলনমুখী মানবিক প্রেম সান্নিধ্য-পিসাসু, ভোগকামী নয়। এ প্রেম পাগল করে, প্রাণে মারে কিন্তু উচ্ছঋল করে না।
ডক্টর মুহমদ এনামুল হক তাই বলেন, “এ কাব্যে নায়ক-নায়িকা উন্মাদ হইলেও যৌন-প্রেরণী চপল নহেন; সেইজন্য তাঁহারা উজ্জ্বল নহেন। ইহারা সমাজ-শাসন মানেন, গুরুজন স্বীকার করেন, ধর্মের বিধিনিষেধ অনুসরণ করেন, অথচ পরস্পরের আকর্ষণে পাগল। ধর্ম, সমাজ, গুরুজন স্বীকার করেন বলিয়াই লায়লী ও মজনুর মধ্যে মিলন হইয়াও হয় নাই।”
প্রেমের অতুঙ্গ আদর্শও কাব্যে সর্বত্র সুরক্ষিত। নায়ক-নায়িকা চরিত্রে প্রেমজ মহত্ত্বের বিকাশও লক্ষণীয়। নিজের যন্ত্রণার কথা স্মরণ করে মজনু বলছেঃ
নরগণ আছে যথা জগত ভিতর
দুঃখিত না হোক কেহ মোর সমসর।
লায়লী ও মজন পরস্পরকে
পঞ্চপ্রাণ দিল দীন সুধাত রাখি।
ময়মনসিংহ গীতিকায়ও পাই প্রেমের এমনি মহতী রূপ। চন্দ্রাবতী গাথায় দেখি, নায়ক-নায়িকার গোপন মিলন হয়, গভীর প্রেমে তারা অভিভূত। কিন্তু বিসর্জন দেয়নি তারা সমাজ, ধর্ম ও নীতিবোধ। তাই নায়িকাকে বলছে নায়কঃ
দেবপূজার ফুল তুমি, তুমি গঙ্গার পানি
আমি যদি দুই কন্যা হইবা পাতকিনী।
অনুরূপ আদর্শবোধ লায়লী-মজনুতেও রয়েছে। লায়লী নজদ বনে গেল পালিয়ে। মজনুকে সেবার সুযোগ নেবার জন্যেই প্রস্তাব করল সে,
পরিণয় কর মোরে সদয় হৃদ করি এ
তোহ্মার সেবা এক মন কাএ।
কিন্তু দুঃসহ বিরহানলে দগ্ধ হলেও মজনু তখনো হারায়নি সমাজ-বোধ, সংযম ও পৌরুষ, তাই দুর্লভ প্ৰিয়া-রত্নাকে কাছে পেয়েও হয়নি নীতিভ্রষ্ট। বলে সে–
গুপ্তরূপে তোহ্মাকে করিলে পরিণয়
আরব নগরে লোকে দুষিব নিশ্চয়।
বান্ধিতে বুহ্যের দ্বার অছি উপাএ
মনুষ্যের মুখমাত্র বন্ধন না যাএ।
অথচ এই উদভ্রান্ত মজনুই লায়লীকে বলেছিল-
তোমার বদন-ইন্দু অমিয়ার অশ
চকোর চঞ্চল মতি হইলুঁ উদাস।
তোমার কমল মুখ দেখিয়া অরূপ
আকুল হইল মোর নয়ান মধুপ।
তোমার কটাক্ষ বাণে হানিল হাদয়
পুরুষ বধিনী তুহ্মি হইল নিশ্চয়।
এমনি প্রেমের সোপান বেয়েই ভূমি থেকে ভূমায়, রূপ থেকে অরূপে ঘটে উত্তরণ। তার আভাস রয়েছে এ কাব্যে। প্রেমিক মজনু হয়েছে প্রেমযোগী, সাধক।
পঞ্চবৈরী বিনাশিয়া এক মন কাএ
পরম সমাধি হৈয়া রহিল তথাএ।
চিবুক কষ্ঠেত দিয়া যোগাসনে বসি
নিরীক্ষএ লায়লীর রূপ অহনিশি।
দোলন বোলিন নাহি নীরব নয়ন
উরু ভেদি তরু হৈল নাহিক চেতন।
শরীর নগরে তার লাগিল ফাটক
কাম বোধ প্রবেশিত হইল আটক।
ভক্টর মুহম্মদ এনামুল হক যথার্থই বলেছেন–“কবি মধুসূদন ও ঈশ্বরগুপ্তের কাব্যে যেরূপ রুচি, সৌন্দর্য ও সংস্কৃতিগত প্রভেদ বিদ্যমান, লায়লী-মজনু এবং এ যুগীয় অন্যান্য কাব্যের মধ্যে অবিকল তজ্জাতীয় সংস্কৃতিগত বৈষম্য বিরাজিত।”
অতএব, কবির পরিশুত রুচি, মার্জিত রসবোধ, সুক্ষ মনন, দূর্লভ সংযম, পরিশীলিত নাগরিক ভাষা ও ঋজু বর্ণনভঙ্গি, যুগ-দুর্লভ রীতিনীতি প্রভৃতি কবির যুগোত্তর প্রতিভারই সাক্ষ্য।
চার, লায়লী-মজনু নিছক মানবিক প্রণয়োপাখ্যান। সূফীমতের বিকাশভূমি ইরানের ও মধ্য এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সুফী কবিরা জীবাত্মা-পরমাত্মার আশিক মাশুক তত্ত্বের রূপক হিসেবে নর-নারীর প্রণয়ােপাখ্যান রচনা করেছেন। তাদের প্রভাবে উত্তর আর দক্ষিণ ভারতেও অধ্যাত্মতত্ত্বের রূপকপ্রমকাব্য রচিত হয়েছে অনেক। উত্তর ভারতের সঙ্গে বাঙালীর নিবিড় সম্পর্ক চিরকালের। বাঙলায় মৌলিক উপাখ্যান বিরল। বাঙালী কবিরা অনুবাদ করেছেন ফারসী ও হিন্দুস্তানী কাব্য।
ইরানী কিংবা হিন্দুস্তানী আখ্যায়িকা কাব্যমাত্রই রূপক রচনা। কাজেই মরমীয়া মতের রূপক কাব্যই ছিল বাঙালী কবিদের অবলম্বন। কিন্তু অনুবাদে তাঁরা প্রত্যেকটি অখ্যানকেই লৌকিক রূপ দিয়েছেন রূপক রাখেননি। ইউসুফ জোলেখা, লায়লী-মজনু, সপ্তপয়কর সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল, ময়নাসাৎ, মৃগাবৎ, গুলেবাকাউলি প্রভৃতির অনুবাদ বা অনুকৃতি মেলে বাংলার নরনারীর চিরন্তন রূপজ, দেহজ ও কামজ আকর্ষণের ইতিবৃত্ত হিসেবে। এতে বাঙালীর জীবনবাদী তথা ভোগবাদী মনোবৃত্তির পরিচয় সুপ্রকট। মুখে সে যত বড় বুলিই আওড়াক, অসিলে সে এ জীবনকেই ভালোবাসে এবং সত্য বলে জানে। কোনো মহৎ আদর্শের আন্তরিক পরিচর্যা যে তার নয়, কোন বৃহতের সাধনায় যে তার প্রাণের সায় নেই –এ তার একটি পাথুরে প্রমাণ। অতএব, শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা এবং শা’বারিদ খানের বিদ্যাসুন্দরের পরেই পাচ্ছি লৌকিক প্রণয়োপাখ্যান লায়লী-মজনু।
পাঁচ, ‘লায়লী-মজনু’ নিযামী, খসরু কিংবা জামীর কাব্যের অনুবাদ নয়। এদের যে কোনো একজনের রচনার স্বাধীন অনুসৃতি কিংবা লোক-শ্রুত পুরোনো কাহিনীর স্বাধীন রূপায়ণ। এ হিসেবে লায়লী মজনু মধ্যযুগের অখ্যায়িকা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট রচনা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সতেরো শতকের কবি মাগনঠাকুরের ‘চন্দ্রাবতী’ও এমনি এক রূপকথার কাব্যিক রূপান্তর।
ছয়, এ কাব্যের আর একটি বৈশিষ্ট্য গীতিনাট্যের আকারে বিন্যস্ত ঋত-পর্যায় বর্ণন। বারোমাসী ভারতীয় লোক-সাহিত্যের প্রাচীন ঠাঁট। মানব মনে বিশেষ করে বিরহী নায়ক-নায়িকার মনে প্রকৃতির প্রস্তাব ও প্রতিকিয়া দেখানোই এর মুখ্য লক্ষ্য। যৌন-জীবনের মনস্তাত্ত্বিক স্বরূপ নিরূপণের এ ছিল আদিম রীতি। মানুষের মনের উপর প্রকৃতির প্রভাব কতো গভীর তা মেঘলা দিনে সহজেই উপলদ্ধি করে সবাই। মানুষের এ অভিজ্ঞতা আদিম কালের। রোদ ও জ্যোৎস্না হচ্ছে আনন্দের ও ঔজ্জ্বল্যের, মেঘ ও বৃষ্টি হচ্ছে বেদনার ও গ্লানিমার – এ বোধ মানুষের প্রায় সহজাত। সুখের অনুভূতি স্থল আর দুঃখের উপলবি গভীর, ব্যাপক, তীব্র ও তীক্ষ। তাই বিরহিণীর অনুবে প্রকৃতির বর্ণ ও বৈচিত্র্য, প্রভাব ও প্রতিকিয়া ধরা দেয় সহজেই। এ কারণে বারোমাসীতে সাধারণত উন্মোচিত হয় বিরহী-বিরহিণীর হৃদয়তত্ত্ব। উত্তর ভারতের লোক সাহিত্যে (এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও) চৌমাসীও আছে। আমাদের সাহিত্যে বারোমাসীই বেশী। বারোমাস আবার ষড়ঋতুতে সংহত। সঙ্গীত শাস্ত্রীয় গ্রন্থ ‘রাগতালনমা’গুলোতেও বছর মাসে নয়ঋতুতেই বিভক্ত।
লায়লী-মজনু কাব্যেও বারোমাসকে ষড়ঋতুতে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এটি নামে ‘হেতুবতী-লায়লী সংবাদ’, আকারে গীতিনাট্য এবং প্রকারে কামোদ্দীপক বটিকা। এবং স্বরূপে সংবাদী-প্রতিবাদী সংলাপ।
পতি বা প্রেমিকের বিচ্ছেদজনিত একাকিত্বের সুযোগে নায়িকার মনে কামভাব জাগিয়ে দ্বিচারিণী হবার প্রলোভন দানই এ ধরনের রচনার বিষয়। কুটনী জাতীয় সখী, ধাত্রী, দাসী কিংবা মালিনী অসে প্ররোচনা দিতে। বড়াই কিংবা হীরামলিনী এই জাতীয় কুটনী। এদের পার্থক্য বর্ণে ও ধর্মে নয় – সামর্থ্যে। ভিন্ন আদলে কালিদাসের ঋতুসংহার থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘ঋতুচক’ অবধি সব রচনাতেই মানব মনের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ সন্ধানই লক্ষ্য। হৃদয়স্থ কাম-প্রেমের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃতিকে প্রত্যেক্ষ করার অথবা প্রকৃতির রূপ-রসের অনুগত করে চিত্তবৃত্তিকে পরখ করার এ রীতি সাহিত্যে আজো অপরিহার্য বলে বিবেচিত। এরই অধুনিক নাম দেয়া চলে ‘প্রকৃতি ও পরিবেষ্টনীর পটে মন বিশ্লেষণ বা ব্যক্তি স্বরূপের পরিচয় গ্রহণ’। এ শিল্পরীতির অনুসৃতি পাই কাজী দৌলতের ‘সতীময়না লোর-চন্দ্রানী’তে এবং সরূপের ‘দামিনী চরিত্রে, নিত্যানন্দ বৈদ্য ও শ্রীধরবানিয়ার ‘নীলার বারমাসী’ নামের গাথা দুটোতে। কাব্যিক বিচারে সতেরো শতকের কবি কাজী দৌলতের শ্রেষ্ঠত্ব তর্কাতীত। [সূত্রঃ লায়লী মজনু, আহমদ শরীফ সম্পাদিত, পৃষ্ঠা – ৪৬/৫২]
লায়লী মজনুর প্রণয় কাহিনী নিয়ে অসংখ্য উপাখ্যান থাকলেও আমার মনে হয় কাহিনীটা রূপক। হতে পারে কায়েস বা মজনুন নামে কোন এক বুজুর্গ বা দরবেশ ছিলেন। তিনি রাত্রির প্রেমে পাগল ছিলেন। রাত্রিকে আরবীতে ‘লায়লা’ বলা হয়। কারণ ইসলামীয় ধারণা অনুযায়ী রাত্রি জেগে আল্লাহর উপাসনা করলে আল্লাহর কাছে গ্রহযোগ্য বেশী হয়। সেজন্য পীর, ফকির, দরবেশরা সারা রাত জেগে আল্লাহর উপাসনা আরাধনা করে কাটান। হতে পারে কায়েস বা মজনুন নামের কোন দরবেশ আল্লাহর আরাধনা করার জন্য রাত কে অর্থাৎ লায়লা এক মুহুর্তের জন্য জন্য দিবসে রূপান্তরিত হওয়াকে পছন্দ করতেন না। এক কথায় তিনি রাত্রির প্রেমে পাগল ছিলেন রাত জেগে আল্লাহর উপাসনা করার জন্য।
লায়লী মজনু কাহিনীটা কি আদৌ কাল্পনিক?
অধিকাংশ গবেষকই লায়লী-মজনুর প্রেমের উপাখ্যানগুলিটিকে কবির কল্পনা বলে উল্লেখ করেছেন। তবে অবাক করা তথ্য হল ভারত পাকিস্তানের সীমানায় রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগর জেলা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অনুপগড়ের নিকটবর্তী বিজনৌর গ্রামে লায়লী আর মজনুর কবর রয়েছে। ভারত পাকিস্তানের সীমানায় একটি ফাঁড়ি বা পোষ্টে ভারতের আধাসামরিক বাহিনী বিএসএফ লায়লী-মজনুর স্মরণে পোষ্টের নামকরণ করেছেন ‘লায়লী-মজনু পোষ্ট’। পরে এটির নাম পরিবর্তন করে শুধুমাত্র ‘মজনু পোষ্ট’ নাম দেওয়া হয়। কার্গিল যুদ্ধের আগে পাকিস্থান থেকে লোকেদের এখানে আসার জন্য রাস্তা খোলা ছিল। তবে জঙ্গীদের আনাগোনার জন্য রাস্তাটি এখন একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লায়লী মজনুর মাজারে প্রতি বছর ১৪ ও ১৫ জুন দুইদিন খুব ধুমধাম সহকারে মেলা হয়। স্থানীয়রা উৎসবের আয়োজন করে। ভারত ও পাকিস্তানের বহু প্রেমিক প্রেমিকা ও নব দম্পতি লায়লী-মজনুর কবরে এসে মানত করে তাঁদের প্রেম ও বৈবাহিক সম্পর্ক পরিপূর্ণতা পাবার আশায়। লায়লী-মজনুর এই কবরে বা মাজারে শুধু মুসলমান প্রেমিক-প্রেমিকা বা নব-দম্পতিই নয় বরং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক হিন্দু, শিখ ও খ্রিষ্টান ধর্মের লোকেরাও সেখানে অংশগ্রহণ করেন এবং নিজেদের আশা আকাঙ্কা পুরণের জন্য মানত করেন।
অপরদিকে ফ্রান্সের মিউজিয়ামে লায়লী ও মজনুর আসল ছবিও সংরক্ষিত রয়েছে। তাহলে এখানে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসে যে যদি লায়লী মজনুর কাহিনী একটি কল্পিত উপাখ্যান হয় তাহলে তাদের কবর বা মাজার এবং তাদের দুজনের ছবি এখনো সংরক্ষিত রয়েছে কেন?
এই ব্যাপারে আমি দুটি বিষয় উল্লেখ করবঃ-
এক, অনেকের মতে লায়লী মজনুর ইতিহাস মূলত নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জন্মেরও অনেক আগের ইতিহাস। অর্থাৎ প্রাক ইসলামীয় যুগের ঘটনাগুলির মধ্যে লায়লী মজনুর ঘটনা বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে জাহেলীয় বা অন্ধকার যুগের প্রথম দিকের ইতিহাস হচ্ছে তাঁদের। লায়লী-মজনু মূলত ইয়েমেন থেকে এসেছিলেন। সৌদি আরবে ‘লায়লা’ নামে একটা শহর রয়েছে। বর্তমান সৌদি আরবের ওয়াদিআল আহমারে তাঁদের বসতি ছিল। এদের ইতিহাস একেবারেই কম পাওয়া যায়। হাফেজ শামসুদ্দিন জাবের (রাঃ) তাঁর রচনায় এদের সম্পর্কে চার লাইন উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এই ব্যক্তি সম্পর্কে প্রসিদ্ধি এত বেশি লাভ করেছে যে, তাঁর প্রসিদ্ধির কারণে আমার বইয়ে তাঁর নাম উল্লেখ করলাম। অন্যথায়, আমার বইয়ে তাঁর নাম উল্লেখ করার মতো যোগ্যতা তাঁর নেই।
আবার অনেকের মতে লায়লী-মজনুর এই ঘটনা ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়া ও আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ)-এর শাসনকালে হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জন্মের পরে অর্থাৎ ইসলাম পরবর্তীকালে সংঘটিত হয়। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও রিজালশাস্ত্রবিদ ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবী (রহঃ) [৬৭৩-৭৪৮ হি.] বলেন, লায়লী-মজনুর প্রেমকাহিনীকে অনেকে ভিত্তিহীন বলেছেন। তবে তাঁরা তাঁদের দাবীর পক্ষে কোন প্রমাণ পেশ করেননি [যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/৫১১]।
সুতরাং ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবীর মতে লায়লী মজনুর প্রেম কাহিনীতে ঐতিহাসিক সত্যতার অবকাশ রয়েছে। তাঁর মতে লায়লী-মজনুর প্রেম কাহিনীকে যাঁরা ভিত্তিহীন বলেছেন তাঁদের কাছে কোন প্রমাণ নেই।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনুল জওযী (রহঃ) লায়লী-মজনুর ঘটনাকে সত্য বলে স্বীকার করেছেন। মিশরের বিখ্যাত আল আজহার ইউনিভার্সিটির উর্দূ বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক ডঃ ইবরাহীম আল মিশরী তাঁর রচিত ‘লায়লা-মজনু’ গ্রন্থে লিখেছেন, “লায়লী-মজনুর প্রেম কাহিনী কোন কল্পিত আখ্যান নয়, বরং এটা প্রথম হিজরী শতাব্দীর সত্য ঘটনা যেটি আরবের শহর নজদে ঘটেছিল এবং পরে এটা কিংবদন্তি হয়ে যায়।” [লায়লা-মজনু, ডঃ ইবরাহীম আল মিশরী]
তবে আরবী সাহিত্য সমালোচক ড. ত্বহা হোসাইন (১৩০৬-১৩৯৩ হি.) মনে করেন, লায়লী-মজনু নামে কিছুই নেই। বরং এগুলি বিভিন্ন যুগের কবিদের কল্পনা প্রসূত নাম। কবিগণ নিজেদের মজনু কল্পনা করে ও প্রেমিকাদের লায়লা ভেবে কবিতা রচনা করেছেন। [হাদীছুল আরবি‘আ ১/১৭৪-১৮০]
সুতরাং বোঝা যায় লায়লী মজনুর প্রেম কাহিনীটি সত্য। তবে কবির কল্পনায় এবং সাহিত্যের রং চড়িয়ে শব্দচয়নের পালিশ দিয়ে অতিরঞ্জিত করে কিংবদন্তি করে তোলা হয়েছে। সেজন্যই লায়লী-মজনুর প্রেমের উপাখ্যান যতগুলি রচনা করা হয়েছে তাতে একটির সাথে অন্যটির বিস্তর অমিল লক্ষ্য করা যায়।
দুই, এটাও হতে পারে রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগর জেলায় যে স্থানে লায়লী আর মজনুর কবর রয়েছে সেটা ভুয়া কবর। কবর বা মাজার ব্যবসায়ীরা সেই স্থানটিকে বিখ্যাত করে তোলার জন্য লায়লী-মজনুর নাম ব্যবহার করে এক উত্তম ব্যবসার স্থলে পরিণত করেছে। তাদের উদ্দেশ্য মূলত লোকেরা লায়লী-মজনুর কবর বা মাজার জিয়ারত (দর্শণ) করতে আসবে ফলে স্থানটি দর্শণীয় স্থানে পরিণত হয়ে যাবে এবং লোকেরা দানস্বরূপ যা কিছু দেবে তাতে উক্ত ধর্ম বা কবর ব্যবসায়ীদের উদরপূর্তী হবে।
ভারতীয় উপমহাদেশে এমন বহু মাজার রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন ওলি আউলিয়া তথা মহান ব্যক্তির নামের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করা হয় কিন্তু সেগুলি একেবারেই ভুয়া। অনুরূপভাবে লায়লী-মজনুর কবরটিও ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এর সব থেকে বড় প্রমাণ হল লায়লী-মজনুর প্রেম কাহিনীর স্থান কাল পাত্র সব আরবের। তাহলে দুই প্রেমিক প্রেমিকার কবর ভারতে হল কি করে? কারণ তাঁরা ভারতে এসেছিলেন তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই এবং যেসব বিখ্যাত কবিরা লায়লী-মজনুকে অবলম্বন করে উপাখ্যানগুলি রচনা করেছেন তাঁরাও উভয়কে ভারতের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেন নি। সুতরাং মূল কাহিনীতে সত্যতার অবকাশ থাকলেও ভারতে অবস্থিত কবরের ব্যাপারে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সেটা সম্পূর্ণভাবে ভূয়া কবর। আর যেসব লায়লী-মজনুর উপকথায় বলা হয়েছে যে দুজনে একসময় ভারতে চলে এসেছিল এবং সেখানেই পিপাসায় তাদের মৃত্যু হয় সে ব্যাপারে আমাদের মনে রাখতে হবে সেগুলো উপকথা, ইতিহাস নয়। সম্ভবত লায়লী-মজনুর ভারতে চলে আসার উপকথাগুলি তাঁরাই গড়েছেন যাঁরা লায়লী-মজনুর মাজারটিকে ব্যবসার স্থলে পরিণত করেছেন।
তবে যাই হোক না কেন লায়লী-মজনুর প্রেমের উপাখ্যান সারা পৃথিবীর মুসলমান জাতির কাছে ঘরোয়া এবং এক অনুপম সম্পদ বলে বিবেচিত। এটি বংশ পরম্পরায় ধরে রাখা ঐতিহ্যেরই একটা অংশও বলা যায়।
সব থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এখনো এই অমর প্রেমকাহিনীর আবেদন একেবারেই কমে যায়নি মুসলমানের অন্তর থেকে। এই প্রণয় আখ্যানটি মুসলমানদের ঘরোয়া সম্পদ বলে বিবেচিত হলেও এটি একেবারেই কোন সম্প্রদায় বিশেষের হয়ে থাকে নি। কবিদের হাতে শব্দে ছন্দে সুরে তালে সব সম্প্রদায়কে ছাড়িয়ে আপমর মানুষের প্রাণের সম্পদ হয়ে উঠেছে। সেজন্য কেউ প্রেমে পাগল হলে কিংবা প্রেমের উন্মত্ততা বুঝানোর জন্য ‘মজনু’ বলা হয়। আদর্শ প্রেমের উদাহরণ হিসেবে কোন কিছু বলতে গেলে প্রথমেই আসে লায়লী-মজনুর নাম।
বাঙালি মুসলমানের জীবনে আজ পর্যন্ত যত গল্প উপাখ্যান শেকড় গেড়ে আছে তার মধ্যে এই লায়লী-মজনুর প্রেমকাহিনী একটি উল্লেখযোগ্য উপাখ্যান। বাঙালি তথা বিশ্ববাসীর নিকট রাধা-কৃষ্ণ, শিরি-ফরহাদ, হীর-রাঞ্ঝা, দেবদাস-পার্বতী, রোমিও জুলিয়ট, শাহজাহান-মমতাজ, সেলিম-আনারকলি, ইউসুফ-জোলেখার প্রেমের গল্প যে ভাবে পরিচিত লায়লী-মজনুর প্রেমকাহিনীও তেমনি পরিচিতি লাভ করেছে।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গান,
লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোল
প্রিয়তম! এতদিনে বিরহের নিশি বুঝি ভোর হলো।।
মজনু! তোমার কাঁদন শুনিয়া মরু-নদী পর্বতে
বন্দিনী আজ ভেঙেছে পিঞ্জর বাহির হয়েছে পথে।
আজি দখিনা বাতাস বহে অনুকূল, ফুটেছে গোলাপ নার্গিস ফুল,
ওগো বুলবুল, ফুটন্ত সেই গুলবাগিচায় দোলো।।
বনের হরণ-হরিণী কাঁদিনী পথ দেখায়েছে মোরে,
হুরী ও পরীরা ঝুরিয়া ঝুরিয়া চাঁদের প্রদীপ ধ’রে
পথ দেখায়েছে মোরে।
আমার নয়নে নয়ন রাখিয়া
কি বলিতে চাও, হে পরান-পিয়া!
নাম ধ’রে ডাকো ডাকো মোরে স্বামী
ভোলো অভিমান ভোলো।।
এই গান শ্রোতার কানের ভেতর দিয়ে মনের ভেতরে ভাবাবেগ তৈরি করে এবং একই সঙ্গে চোখের সামনে মরু প্রান্তর অরণ্যের ভেতর দিয়ে ছুটে চলা বিরহী মজনুর একটি দৃশ্যমানতাও তৈরি হয়ে যায়। তখন এই কাহিনী সত্য কি মিথ্যা, কল্পনার না বাস্তবের তা গৌণ হয়ে ওঠে।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. লায়লী মজনু : উজির দৌলত খান রচিত, আহমদ শরীফ সম্পাদিত।
- ২. লায়লী মজনু : নিযামী গঞ্জাবী (গিয়াস উদ্দিন অবি মুহম্মদ ইলিয়াস বিন ইউসুফ, গঞ্জা) ৫৮৪ হিঃ বা ১১৮৮ খ্রীষ্টাব্দ।
- ৩. লায়লী-মজনু : অবিজদ জহিরুল হক (ঐ-১৯৩০ খ্রীঃ)।
- ৪. লায়লী-মজনু : ঐ ওয়াজেদ আলী (ঐ-১৯৪8)।
- ৫. লায়লী-মজনু : মহেশ চন্দ্র মিত্র (১৮৫৩ খ্রীঃ)।
- ৬. লায়লী-মজনু : শেখ ফজলুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৯০৩)
- ৭. লায়লী-মজনু : আবদুল গফুর সিদ্দিকী অনুসন্ধানবিশারদ।
- ৮. লায়লী-মজনু : শাহাদাৎ হোসেন।
- ৯. লায়লী-মজনু : মীর্জা সোলতান আহমদ।
- ১০. লায়লী-মজনু : আমীর খসরু (দিল্লী) ৬৯৮ হিঃ বা ১২৯৮ খ্রীঃ।
- ১১. লায়লী-মজনু : আবদুর রহমান জামী (ইরান) ৮৮৯ হিঃ বা ১৪৮৪ খ্রীঃ।
- ১২. লায়লী-মজনু : আবদুল্লাহ হাতিভী (ইরান) ৯১৭ হিঃ বা ১৫৩১ খ্রীঃ।
- ১৩. লায়লী-মজনু : হিলালী অস্ত্রবাদী (অস্ত্রাবাদ) ৯৩৯ হিঃ বা ১৫৩৩ খ্রীঃ।
- ১৪. লায়লী-মজনু : দামিরী (ইরান, শাহ-তামাস্পের সভাকবি) ৯৩০-৮৪ হিঃ বা ১৫২৪-৬৭ খ্রীঃ।
- ১৫. লায়লী-মজনু : মীর্জা মুহমদ কাসেম কাসেমী গুনাবাদী (খােরাসান) ৯৭৯ হিঃ বা ১৫৭২ খ্রীঃ!
- ১৬. লায়লী-মজনু : মীর মহম্মদ আমীর শাহ বোস্তানী ওরফে মীরজমল (ইরান ভারত সমাট শাজাহান ও আওরঙ্গজেবের সেনানী) ১০১১ হিঃ বা ১৬২২ খ্রীঃ।
- ১৭. লায়লী-মজনু : জনৈক হিন্দু কবি (শাহজাহানের আমলে) ১০৫৫ হিঃ বা ১৬৪৫ খ্রীঃ।।
- ১৮. লায়লী-মজনু : আরিফ লাহোরী (আওরঙজেব আলমগীরের নামে উৎসর্গিত গ্রন্থ। নাম মিহির-ই ওয়াফৎ) ১৬৬০-১৭০৭ খ্রীঃ। এটি মুহমদ হবিবর রহমান খান শেরওয়ানীর সম্পাদনায় ১৩৪৫ হিঃ সনে অনীগড় থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
- ১৯. লায়লী-মজনু : হায়দার বখশ।
- ২০. লায়লী-মজনু : মুহম্মদ তকীখান (১৮৬২ খ্রী:)।
- ২১. লায়লী-মজনু : ওলী মুহম্মদ মনজীর : ১৮৬৬ খ্রীস্টাবেদ লাহোরে মুদ্রিত।
- ২২. লায়লী-মজনু : আবদুল্লাহ ইবনে গোলামঃ ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে বোম্বাইয়ে মুদ্রিত।
- ২৩. লায়লা-মজনু, ডঃ ইবরাহীম আল মিশরী।
- ২৪. প্রাগাধুনিক মুসলিম সাহিত্য বাংলা কাব্যচর্চার ক্রমবিকাশ, আমিনুল ইসলাম।
- ২৫. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, আজহার ইসলাম, অনন্যা, বাংলাবাজার, ঢাকা।
- ২৬. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, সুকুমার সেন, প্রথম খণ্ড।
- ২৭. বাংলার সংস্কৃতিতে মুসলমান প্রভাব ও মুসলমানী কেচ্ছা, সাপ্তাহিক দেশ, সাহিত্য সংখ্যা, কলকাতা, ১৩৭২, সুকুমার সেন।
- ২৮. দেওয়ানা মজনু, মহম্মদ খাতের, গাওসিয়া লাইব্রেরী, কলকাতা ১৩৫৮।
- ২৯. সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবী (রহঃ)।
- ৩০. হাদীছুল আরবি‘আ, ড. ত্বহা হোসাইন।
- ৩১. ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।