প্রাচীন কালে ভারতে কি আদৌ কোনও লিপি প্রচলিত ছিল? এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে কিছু প্রশ্ন রাখা যাক।
এক. প্রাচীনকালে প্রচলিত বলে প্রচারিত সংস্কৃত সাহিত্যের লিখিত অস্তিত্বের স্বপক্ষে কোনও প্রাচীন নজীর পাচ্ছিনা কেন? সংস্কৃত লেখার ব্যবস্থা ছিলনা কেন? কেনই-বা ঐ সাহিত্যকে শ্রুতি-পরম্পরা স্মৃতিপরম্পরা নামক লিপিনিরপেক্ষ আজগুবি বায়বীয় অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছিল? আমাদের তথাকথিত প্রাচীন সাহিত্যের ষোল আনা অংশ কেন বাঙ্ময় অস্তিত্বের ম্যাজিক দেখাতে গেল? সাহিত্যের সমার্থক শব্দ হিসাবে ‘বাঙ্ময়’ শব্দটা ব্যবহার করার দরকারই বা পড়ল কেন? ‘বাঙ্ময় সাহিত্য’ কি সোনার পাথরবাটির মত শোনাচ্ছে না? সোজা কথায় ঐ সাহিত্যটা কেন মুখে মুখে চলত?
দুই. ইতিহাসে পাচ্ছি তখন নাকি ব্রাহ্মী লিপি চালু ছিল। চালু ছিল খরোষ্ঠী লিপিও। দু-দুটো লিপি চালু থাকা সত্ত্বেও সংস্কৃত লেখার কাজে কোনটারই সাহায্য নেওয়া হয়নি কেন? ধ্বনি- একক (Phoneme) – সমৃদ্ধ ‘বৈদিক’ বা সংস্কৃত ভাষা প্রকাশ করার ক্ষমতা কি ঐ ব্রাহ্মীলিপির ছিল না? পণ্ডিতদের দেওয়া তথ্যে পাচ্ছি ঋগ্বেদে ৬৪টি আর যজুর্বেদে ৬৩টি ধ্বনি-একক ব্যবহার করা হয়েছিল। এবং ব্রাহ্মীলিপিতে ৪৬টি ধ্বনি-ধ্বনি-একক প্রকাশ করার ক্ষমতা ছিল। কল্পিত ঐ তথ্যটির মধ্যে সত্যতা থাকলে সামান্য কিছু পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে ঐ লিপিতে কাজ চালিয়ে নেওয়ার অসুবিধাটা কোথায় ছিল?
তিন. সে অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়েক জায়গায় ঐ ব্রাহ্মীলিপিতে সংস্কৃত শিলালিপি লেখার ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয়েছিল?
চার. তথাকথিত অশোক শিলালিপিতে ব্ৰাহ্মী অক্ষরে না-সংস্কৃত না-প্রাকৃত উদ্ভট ভাষা কেন ব্যবহার করা হয়েছিল? কোন প্রশ্নেরই উত্তর পাচ্ছি না। তবে বুঝতে কষ্ট হয়না পণ্ডিতদের দৃষ্টিটাকে ঐ উদ্ভট ভাষার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই ঐ বিকটদর্শন ভাষার ব্যবহার করা হয়েছিল। বুঝতে কষ্ট হয়না উদ্ভট ভাষার ঐ শিলালিপির সবই জাল৷ গুগুলো যে সবই জাল সেটা প্রমাণ করব ঐ লিপি এবং দু-একটি অশোক-শিলালিপির বক্তব্য বিশ্লেষণ করেই। সে-বিশ্লেষণটা রাখব পরে। অশোক নামক কল্পিত মৌর্যসম্রাটের ঐতিহাসিকত্ব এবং সাড়ে পনেরো আনি ভারতের অধীশ্বরত্ব প্রতিপাদনের জন্যই যে সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা জাল লেখগুলি তৈরী করে রাখা হয়েছিল—এটা বুঝে নিতে কিছুমাত্র অসুবিধা হয়না। বুঝে নিতে অসুবিধা হয়না ঐসব জাল ‘লেখ’ রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলেই। প্রাচীনকালে নয়। প্রমাণ হিসাবে বলব ঐসব শিলালিপির লিপিটাই জাল এবং সে-লিপির ‘উদ্ভাবন’ হয়েছিল ঐ ব্রিটিশ আমলেই। তার আগে নয়। ‘অশোকস্তম্ভের রহস্য’ শীর্ষক পরবর্তী একটি অধ্যায়ে এ-সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য রেখেছি।
ব্রাহ্মী লিপির নামকরণ রহস্য
ব্রাহ্মী লিপির নামকরণের প্রশংসা করতেই হয়। দেবলোকের বাসিন্দা ব্রহ্মার নাম জড়িয়ে লিপির নামকরণের খেলাটা বেশ ভালোই খেলা হয়েছিল। লিপিটা নাকি স্বয়ং ব্রহ্মাই বানিয়ে নিয়েছিলেন। এবং সেইজন্যই নাকি লিপির ওপর ঐ সুন্দর নামটা আরোপ করা হয়েছিল। সত্যিই ত’ সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা যখন ব্রহ্মা তখন লিপিটাই-বা তিনি বাদ রাখবেন কেন? রাখতে যাবেন-ই-বা কেন? নামকরণের মাহাত্ম্যে কিনা জানিনা পণ্ডিতেরা লিপির প্রশংসা ত’ করলেনই – করলেন ঐ নামেরও প্রশংসা। ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা Linguistic Survey of India: Languages and scripts প্রবন্ধের পাদটীকায় একটি ছোট্ট মন্তব্য পাচ্ছিঃ
“The name ‘Brahmi’ was applied to the script rather arbitrarily; nevertheless, it seems to be correct.”
যদিও arbitrarily আরোপিত তবু নাকি নামকরণটি যথার্থই হয়েছিল৷ মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। পাদটীকার ঐ মূল্যবান মন্তব্যটা আসলে কে লিখেছেন তা জানার উপায় নেই। কারণ ঐ পাদটীকায় সম্পাদক বা অন্য কারুর নাম লেখা হয়নি৷
ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভাবন রহস্য যাতে কেউ না ধরে ফেলেন সেইজন্যই ব্যবস্থা হয়েছিল নানা রকম বিভ্রান্তি আনার। দেশীবিদেশী অনেক পণ্ডিতকেই কাজে লাগানো হয়েছিল বিভ্রান্তি আনার উপযোগী নানা রকম তথ্য যোগান দেওয়ার জন্য। ঐসব পণ্ডিত অত্যন্ত নিপুণভাবেই কাজটি করেছেন। সেমিটিক লিপি থেকে ব্রাহ্মী লিপির জন্মের গল্প শোনানো হয়েছিল৷ শোনানো হয়েছিল বিভ্রান্তিটা পাকাপোক্ত করার জন্যই। সাহেব পণ্ডিতেরা নিজেদের মধ্যে তর্কের ঝড় তুলেছিলেন। সবটাই অভিনয়। সত্যি নয়। ‘ঝড়’ থেমে গেলে দেখা গেল ঐ লিপির সেমিটিক উৎস সম্পর্কে অধিকাংশ পণ্ডিতই একমত। দু-চার জন পণ্ডিত মোহেন-জো-দড়োর লিপি থেকে ব্রাহ্মীর উৎপত্তির গল্পও শুনিয়েছেন।
খরোষ্ঠী লিপি সম্পর্কেও বিদেশী পণ্ডিতদের একই ভূমিকা ছিল—ভূমিকাটা বলা বাহুল্য বিভ্রান্তি সৃষ্টির। লিপির উদ্ভট নামকরণ সম্পর্কেও কম তর্কের অভিনয় হয়নি। অভিনয়ের শেষে পণ্ডিতেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঐ লিপি নাকি অ্যারেমেইক লিপি থেকে ক্রমপরিবর্তনের খেলা খেলতে খেলতে এসে হাজির হয়েছিল পশ্চিম ভারতে। লিপিছটোর মধ্যে সত্যিকারের কোনও মিল থাক বা না থাক আর ঐ অ্যারেমেইক লিপির আদৌ অস্তিত্ব ছিল কিনা না জেনেই ভারতীয় পণ্ডিতেরা নির্বিবাদে ঐ -তত্ত্ব মেনে নিয়েছেন। জাল লিপি দুটোর জালিয়াতি কেউই ধরতে পারেননি। ধরতে পারেননি বিদেশী পণ্ডিতদের বিভ্রান্তি- সৃষ্টির সুসংহত প্রয়াসটাকেও। সেমিটিক অ্যালফাবেট কি করে চরিত্র বদলে ফেলল—কি করে অ্যালফাবেটের চরিত্রলক্ষণ ভুলে গিয়ে এমনকি সিলেবারির অবস্থা পেরিয়ে এসে ‘কারেক্টার’-এ পর্যবসিত হয়ে বসল এই সহজ প্রশ্নটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামালেন না। তামিল বাদে ভারতীয় তাবৎ ভাষার অক্ষর যে ধর্মেকর্মে স্বকীয়তা সম্পন্ন—ভারতের বাইরে যে ঐ জাতের কারেক্টার-এর প্রচলন নেই এই সোজা কথাটাকে কেউই গুরুত্ব দেননি।
ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভাবন রহস্য
পণ্ডিতেরা সেমিটিক উৎস থেকে ব্রাহ্মী লিপির উৎপত্তি সম্পর্কে যত তত্ত্বই দিন না কেন বুঝতে কষ্ট হয় না ব্রহ্মা তাঁর স্বগোত্র নামের সেমিটিক আব্রাহাম বা ইব্রাহিমদের দেশ থেকে লিপি চুরি করে আনেননি—এনেছিলেন খোদ রোম কিংবা এথেন্স থেকেই৷ না হলে তাঁর সৃষ্টি করা ঐ ব্রাহ্মী লিপিতে গ্রীকো-রোমক লিপির ‘বেশকিছু অক্ষরের সঙ্গে মিলজুল-ওলা অক্ষর দেখছি কেন? রোমকলিপির একুশটা অক্ষর [এর মধ্যে গ্রীক এবং রোমক লিপির সাধারণ (Common) অক্ষরও কিছু আছে] আর গ্রীকলিপির পাঁচটি অক্ষরের সঙ্গে মিল-যুক্ত অক্ষর ঐ ব্রাহ্মীলিপিতে সনাক্ত করে নিতে কি খুব একটা অসুবিধা হয়? বড় হাতের অক্ষর—ছোট হাতের অক্ষর বাদ ত’ তিনি কিছুই দেননি। সবই এনে হাজির করেছেন। সজ্ঞানে এত চুরিও মানুষে করে। কায়দাও কিছু কম করেননি, কোথাও লিপি অবিকৃত ভাবে এসে গেছে যেমন :—
C=ট; D=ধ; E=জ; 1=র; J =ল; L= উ; O =ঠ; Θ = থ, I-ণ; ক্রস বা যুক্ত চিহ্ন + =ক; ব্রাহ্মীর একটি রূপভেদে + = স।
কোথাও বা সামান্য কিছু বিকৃতির মধ্য দিয়ে। যেমন :—
S=র; Z=ও; W=য়; N=ড; U=প; F =শ; C = তামিল ব্রাহ্মীর ঙ; T=শ।
রোমক লিপি উল্টে নিয়েও কিছু ব্রাহ্মী অক্ষর বানিয়ে নেওয়া হয়েছে:—
V উল্টে গ; T উল্টে ন; A উল্টে ম; Y উল্টে ত; J উল্টে তামিল ব্রাহ্মীর একটি অক্ষর।
কায়দা আরো কিছু করেছেন ঐ ব্রহ্মা৷ রোমক লিপির দক্ষিণমুখী অক্ষরকে বামমুখী করেও কিছু অক্ষর তৈরী করে নিয়েছেন তিনি : K বামমুখী হয়ে অ; D বামমুখী হয়ে ধ।
দাঁড়ানো অক্ষরকে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা অনন্তশয়ান বানিয়ে নিয়েছেন। E কে শুইয়ে ∃= ঘ; H কে শুইয়ে =ণ। D কে শুইয়ে = তামিল ব্রাহ্মীর ম। B কে শুইয়ে = ৮০ (আশি)।
ছোট হাতের রোমক লিপিগুলোও কাজে লাগানো হয়েছে। যেমন :—
b=ফ; d=চ; ছোট হাতের টানা? =প; h = ঞ; = ষ; একটু কায়দা করা h=ত; ছোট হাতের টানা। উল্টে ব্রাহ্মীর খ বানানো হয়েছে; ছোট হাতের টানা b থেকে বানানো হয়েছে ‘হ’।
ব্রহ্মার হামলার হাত থেকে বেঁচেছিল রোমক লিপির মাত্র পাঁচটা অক্ষর GMPQR। d-কে p-এর উল্টে নেওয়া রূপ মনে করলে p-টাকেও বাদ দেওয়া যায়। বেঁচে যাওয়া অক্ষরের সংখ্যা দাড়ায় মাত্র চার। বলে রাখা ভালো রোমক লিপিমালায় JUW ছিলই না।
চুরির বাহাদুরী আছে বৈকি।
গ্রীক লিপিরও কয়েকটি অক্ষর ঐ ব্রহ্মা চুরি করেছিলেন : গ্রীক লিপির বড় হাতের ‘ডেল্টা’ এ ব্রাহ্মীতে এসে ‘এ’ হয়েছে। আর ঐ লিপির ছোট হাতের ‘মিউ’ μ অক্ষর থেকে তৈরী করে নেওয়া হয়েছে ব্রাহ্মীর ‘ঝ’। গ্রীক ‘শাই’ ” অক্ষর থেকে তামিল ব্রাহ্মীর ‘ল’ (±ড়) এর ব্যবস্থা হয়েছে। একটু কায়দা করা গ্রীক আলফা α = ব্রাহ্মী ১০ আর গ্রীক থিটা θ = ব্রাহ্মী ২০।
ভালো কথা। ব্রহ্মার নজর এড়িয়ে যাওয়া পাঁচটা অক্ষরের তিনটা অক্ষর খরোষ্ঠী লিপি লেখার কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল : G P এবং R। তথাকথিত খরোষ্ঠী লিপি সম্পর্কে আলোচনা পরে করা যাবে।
কয়েকটা প্রশ্ন আসছেই।
এক. রোমক লিপির সঙ্গে ব্রাহ্মীলিপির এ-হেন প্রচণ্ড মিল থাকা সত্ত্বেও ঐ লিপির ‘ওপর ‘ব্রাহ্মী’ নাম আরোপ করার ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয়েছিল?
দুই. পণ্ডিতছদ্মবেশী ‘আঁতেল’ গোয়েন্দারা রোম থেকে ‘রোমাঞ্চকর ঐ লিপি-চুরির তথ্যটি কেন চেপে গিয়েছিলেন?
তিন. ‘আর্কিয়লজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া’র পোষ্য পণ্ডিতেরাই শুধু ঐ গোয়েন্দার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কেন? সার্ভের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এমন কোনও পণ্ডিতের নাম ঐ গোয়েন্দাদের মধ্যে পাচ্ছি না কেন? তবে কি সহজবোধ্য ঐ মিল থাকার তথ্য থেকে পণ্ডিতদের দৃষ্টিটাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই ‘আদিপাপী’ ঐসব ভাড়াটে পণ্ডিত কোমর বেঁধেছিলেন? রাজ্যের বিভ্রান্তি-সৃষ্টির তাগিদেই কি ভূতুড়ে লিপি থেকে ব্রাহ্মী লিপির জন্মের গল্পটা ওঁরা বানিয়েছিলেন? তাইত আসছে৷
প্রশ্ন আরও আসছে। চুরিবিদ্যাবিশারদ ঐ ব্রহ্মাটি আসলে কে? ব্রহ্মা নামক শব্দটির ওপর দেবসত্তা আরোপ করার বহর চাপালেও বুঝতে কষ্ট হয়না ঐ ব্রহ্মা-কল্পনার জন্ম ইংরাজদের ভারতে আসার আগে হয়ইনি। ব্রহ্মা শব্দটার সঙ্গে ভারতের অধিবাসীদের পরিচয়ই ছিল না।
শব্দটির উদ্ভট ব্যুৎপত্তির বহর বানিয়ে নিলেও বুঝতে কষ্ট হয়না ঐ ব্রহ্মার নামকরণ হয়েছিল সেমিটিক কল্পিত ‘আদি-পুরুষ’ আব্রাহাম শব্দ থেকেই। সৃষ্টি-স্থিতি-লয়—এই ত্রিকাণ্ডের প্রথম কাণ্ডের ‘কর্তা’ হিসাবে ঐ ‘ব্রহ্মা’র ‘আবির্ভাব’ ঘটেছিল। ঘটেছিল ব্রিটিশেরা আসার পরে। বিচিত্রদর্শন ঐ ব্রহ্মা শব্দের ‘হ্ম’ অক্ষরটা ভারতের কোনও লিপিতেই ছিলনা। (বিস্তৃততর তথ্য ‘সংস্কৃত ভাষা কি সত্যই প্রাচীন?’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে রেখেছি।)
অনেকে প্রশ্ন করবেন রোমক লিপির যে সমস্ত অক্ষরের সঙ্গে ব্রাহ্মী অক্ষরের মিল পাওয়া যাচ্ছে ভাষা দুটোয় সেইসব মধ্যে সমতা নেই কেন। T উল্টে ব্রাহ্মীর ‘ন’ হল। ‘ন’-এর সমান? J অক্ষর দিয়ে ‘ল’ বানানো হল।
j-এর উচ্চারণ কি ‘ল’-এর মতন? ‘ল’-এর মতন? সত্যিই তো উচ্চারণের মিল যে কিছুই নেই। তবে গোলমালটা কোথায়? চোর কি ধরা পড়ার ব্যবস্থা রেখে চুরি করে? শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করলেও ধরা পড়তে হয়। অক্ষরগুলো চুরি করা হল আর ব্যবহার করা হল সম্পূর্ণ অন্য উচ্চারণ প্রকাশ করার জন্য। ব্যবস্থাটা এইরকমই হয়েছিল। হয়ে ছিল মাছ ঢাকার জন্য।
উচ্চারণের দিক দিয়ে দুটো লিপিতে মিল আছে এমন কিছু অক্ষর চুরিরও আয়োজন হয়েছিল। রায়বাহাদুর গৌরীশঙ্কর হীরাচাঁদ ওঝা মহাশয় তাঁর “ভারতীয় প্রাচীন লিপিমালা” গ্রন্থে ঐ জাতীয় কয়েকটি অক্ষরের সন্ধান দিয়েছেন। তিনি রোমক লিপির প্রথম ছ’টা অক্ষর থেকে ব্রাহ্মী লিপির সম-উচ্চারণ বিশিষ্ট ছ’টা অক্ষরের ক্রমপরিবর্তনের ছক এঁকে বোঝাতে চাইলেন কি পদ্ধতিতে ঐসব অক্ষরের রূপপরিবর্তনটা ঘটেছে। এত বড় একটা সত্যি কথা তিনি লিখে ফেললেন অথচ কোনও পণ্ডিতই কথাটাকে গুরুত্ব দিলেন না। অ, ব, চ, দ এবং ফ-এর সত্যিকারের জন্মবৃত্তান্তটাই তিনি দিলেন। পুরো বইটাতে রাজ্যের মিথ্যার মথ্যে ঐটুকুই সত্যি কথা ৷ (ছক-টা পরিশিষ্টে দ্রষ্টব্য)
প্রশ্ন উঠবে মিথ্যার কারবারীরা ঐ ছোট্ট সত্যি কথাটা বললেন কেন। ওটা মিথ্যাকে বাঁচিয়ে রাখার একটা কায়দা। কিছু সত্যি কথা পরিকল্পিত ভাবেই রাখা হয় যাতে পণ্ডিতেরা বিভ্রান্ত হন। যাতে পণ্ডিতেরা ঐ অকপট ভাষণকে সততা বলে মনে করে বসেন সেইজন্যই ব্যবস্থাটা নেওয়া হয়।
ব্রাহ্মী লিপির স্বরচিহ্ন সৃষ্টির মহিমা
ব্রাহ্মী লিপির স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ তৈরী করে নেওয়া হল গ্রীকো রোমক লিপি থেকে পুকুর চুরি করার মধ্য দিয়ে। মুশকিল দেখা দিল স্বরচিহ্ন প্রকাশ করতে গিয়ে। আ-কার, ই-কার, ঈ-কার ইত্যাদি। শুধু স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ বানিয়ে নিলেই কাজ শেষ হয়না। ভারতীয় লিপিমালাগুলোর জনক সাজতে গেলে শুধু অ্যালফাবেট হলেই চলেনা।
হতে হয় ‘কারেক্টার’ অর্থাৎ সংযুক্তবর্ণ এবং স্বরান্ত সংযুক্তবর্ণের স্বরচিহ্নগুলো ব্যঞ্জনবর্ণের মাথায় চলেনা ‘সিলেবারি’র মতন হলেও। স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, স্বরান্ত ব্যঞ্জনবর্ণ, পাঁচ রকমের অক্ষরসমন্বিত ব্যবস্থা। স্মরচিহ্নগুলো ব্যঞ্জনবর্ণের মাথায় বা নীচে, পাশে বা কোলে-কাঁকালে জুড়ে দেওয়ার দরকার পড়ে৷ না হলে যে ‘বিবর্তিত’ লিপিগুলোর আদিরূপ হিসাবে ঐ ব্রাহ্মীকে কেউ বিশ্বাসই করবেন না। স্বরচিহ্ন জুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা ঐ জন্যই রাখতে হল ব্রাহ্মী লিপিতে। সে-ব্যবস্থা করতে গিয়েই বাধল গোলমাল৷ ই-এর ব্রাহ্মী প্রতিরূপ তিনটি বিন্দু দিয়ে তৈরী—একটি কল্পিত ত্রিভুজের তিনটি শীর্ষবিন্দু। অথচ ই-কারের রূপ দেওয়া হল ব্যঞ্জনবর্ণের ওপরে কোথাও বৃত্তাকার চিহ্ন দিয়ে—কোথাও-বা ওপরে হাফদাড়ি দিয়ে। আ-কারের চিহ্ন কোথাও হল অক্ষরের মাথার ডানদিকে হাফলাইন- কোথাও-বা ঐ হাফলাইনের শেষে বিলম্বিত দাঁড়ি অর্থাৎ বাংলা-নাগরীর আ-কারের মত। ব্রাহ্মীর ‘ঈ’ চারটি বিন্দু দিয়ে তৈরী—একটি কল্পিত চতুর্ভুজের চারটি কৌণিক বিন্দু। অথচ ঈ-কার বানানো হল ব্যঞ্জন- বর্ণের ওপরে একজোড়া হাফদাড়ি দিয়ে—কোথাও-বা নাগরীর ঈ-কারের মত চিহ্ন দিয়ে। গ্রীক এ অক্ষর দিয়ে ব্রাহ্মীর ‘এ’ বানানো হল অথচ এ-কার চিহ্নটা কোথাও তামিল এ-কারের মত—কোথাও আবার অক্ষরের ওপরে বাঁয়ে হাফলাইনের মত। ভারতীয় লিপিমালার বেশ কিছু স্বরচিহ্নে সেই সেই স্বরবর্ণের আংশিক প্রকাশ দেখা যায়। আ, এ, ঐ, ঔ। ঋ-এর কথা বাদই দিলাম। কারণ ঐ ‘ঋ’ ভারতীয় কোন লিপিতেই আদিতে ছিল না। সংস্কৃত নামক অত্যাধুনিক ভাষা ‘উদ্ভাবন’-এর সূত্রেই ঐ ‘ঋ’-এর ‘আবির্ভাব’ ভারতীয় লিপিগুলোতে ঘটেছে। (বিস্তৃত আলোচনা পরে করা যাবে)। মোটকথা স্বরবর্ণের আংশিক প্রকাশও ব্রাহ্মীলিপির স্বরচিহ্নগুলোতে ঘটেনি—এইটা লক্ষণীয়। দক্ষিণী ব্রাহ্মী লিপিতে স্বরচিহ্ন প্রকাশ করার কাজে খেলাটা একটু বেশী মাত্রায় করা হয়েছিল। অশোক ব্রাহ্মীতে কম। স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণ বানিয়ে নেওয়ার কাজে খেলাটা ঐ মাত্রায় করতে হয়নি। হয়নি কারণ স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের চিহ্নগুলো গ্রীকো-রোমক লিপি থেকে চুরি করতে গিয়ে ভারতীয় লিপির সঙ্গে মিলজুল আছে এমন চিহ্ন ঐ লিপিতে খুব কমই ‘রাখা সম্ভব হয়েছিল। সম্ভবত সেই জন্যই স্বরচিহ্নের দিক দিয়ে ভারতীয় সাজার ব্যবস্থা হয়েছিল। তাই ‘তামিল- ব্রাহ্মী’র এ-কার চিহ্নের সঙ্গে বাংলা বা তামিলের এ-কারের কিছুটা মিল এসে গেছে।
রোমকলিপির Z-এর অনুকরণে তৈরী করে নেওয়া ব্রাহ্মী ‘ও’- অক্ষরের ঊর্ধাংশ থেকে ব্রাহ্মী এ-কারের চিহ্নটা আর নিম্নাংশ থেকে আ-কারের চিহ্নটা বানিয়ে নেওয়া হল। এ-ব্যবস্থা হল অশোক শিলালিপির ব্রাহ্মীতে। ব্যঞ্জনবর্ণের আগে এ-কার এবং পরে আ-কার বসিয়ে ও-কার বোঝাবার ব্যবস্থা বাংলা, ওড়িয়া, তামিল ও মালয়ালাম লিপিতে আছে। এ-কার এবং আ-কার সহযোগে ও-কার প্রকাশ করার ব্যবস্থা দক্ষিণী ব্রাহ্মীলিপিতে থাকা সত্ত্বেও ঐ লিপি থেকে উদ্ভূত বলে প্রচারিত তেলুগু বা কানাড়ী লিপিতে চালু হল না কেন? বাংলা বা ওড়িয়া লিপিতেই বা চালু হ’ল কি করে? দুটো লিপি কি দক্ষিণী ব্রাহ্মী থেকে উদ্ভুত? এ-সব প্রশ্নের উত্তর পণ্ডিতেরা দেননি। তথাকথিত তামিল-ব্রাহ্মী বা দাক্ষিণাত্যব্রাহ্মী লিপি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখলেন :
“In the Deccan and South India, we note two other main groups: One is the Telugu-Kannada group, Telugu and Kannada forming practically two styles of the same form of the Deccan Brahmi”.
তেলুগু এবং কানাড়ী লিপি যে একই লিপির দু-রকম লিখনভঙ্গী সেসম্পর্কে সন্দেহের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ও-দুটো লিপি যে দাক্ষিণাত্য-ব্রাহ্মীরই দুটো স্টাইল এ-কথা বললে কোনও ক্রমেই মেনে নেওয়া যায়না। যায়না কারণ তেলুগু-কানাড়ী লিপির সঙ্গে ঐ দাক্ষিণাত্য ব্রাহ্মীর কোনও দূরাগত সাদৃশ্যও নেই। লীলায়িত ভঙ্গীর ঐ ব্রাহ্মী লিপির সঙ্গে তেলুগু-কানাড়ী লিপির আপাতসাদৃশ্য (ভঙ্গীসাদৃশ্য বললেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়) দেখে অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন। ঘটনা হচ্ছে এই। আসলে ঐ বিভ্রান্তি আনার জন্যই যে লীলায়িত ভঙ্গীর ব্যবস্থা হয়েছিল এটা বুঝে নিতে কষ্ট হয়না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মিল কি কিছুই নেই? তেলুগু লিপির তিনটি অক্ষরের সঙ্গে দক্ষিণী ব্রাহ্মী লিপির তিনটি অক্ষরের কিছু মিল পাওয়া যাচ্ছে। কিছু মিল আছে তেলুগু ‘গ’ এবং ব্রাহ্মী ‘গ’-এর মধ্যে। বলা বাহুল্য এক্ষেত্রে উচ্চারণেরও সমতা আছে লিপিছটোতে৷ আর মিল পাচ্ছি তেলুগু ‘ঠ’ এবং ব্রাহ্মীর ‘থ’-এর মধ্যে। পাচ্ছি তেলুগু ‘র’ এবং ব্রাহ্মী ‘ম’-এর মধ্যে। এই দুই ক্ষেত্রে লিপিছটিতে অক্ষর দুটোর উচ্চারণের সমতা যে নেই তা বলাই বাহুল্য। সে যাই হোক, ঐ তিনটি ক্ষেত্রে মিলটা আছে কেন এ-প্রশ্ন উঠবেই। এ-প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় সর্বলিপিসমন্বয়ের সিনথিসিস-মার্ক। ঐ ব্রাহ্মী লিপিতে যে ভারতের প্রায় সব লিপিরই কিছু নমুনা রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। নাগরীর ছ, দ, ঢ, ং এবং ঃ এই ‘পঞ্চব্যঞ্জন’, গুরুমুখীর ঘ এবং ন (=ব্রাহ্মীর ‘ত’) গুজরাতির ভ, তামিলের প এবং য় (= ব্রাহ্মীর ঘ) মালয়ালামের অন্তঃস্থ ব (= ব্রাহ্মীর ল) এবং ওড়িয়ার ঠ—সবই যে আছে ঐ ব্রাহ্মী লিপিমালায়। তেলুগু লিপির তিনটি অক্ষর ঐ লিপিমালায় থাকলে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? অশোক-ব্রাহ্মী লিপিতে বাংলা লিপির নমুনা একটিও নেই। তবে ঐ লিপির নানান রূপভেদের একটিতে বাংলা ২-এর সন্ধান পাচ্ছি। দক্ষিণী ব্রাহ্মীর ‘এ’ সঙ্গে বাংলা ত্র-র বেশ মিল রয়েছে। এছাড়া তথাকথিত গুপ্ত ব্রাহ্মী লিপির ঢ = বাংলা ঢ; ঐ লিপির ষ = বাংলা ঝ। আট কিসিমের ব্রাহ্মী লিপি বানাতে গিয়ে কম কিসিমের অক্ষর চুরি করতে হয়নি!
ব্রাহ্মী লিপির ক্রমপরিবর্তনের ম্যাজিক
ব্রাহ্মীলিপি থেকে ভারতের উর্দু-কাশ্মীরী-সিন্ধী-বাদ দিয়ে তাবৎ (এবং বর্হিভারতেরও কয়েকটা) লিপির ‘ক্রমবিবর্তনের’ তত্ত্বটা বেশ সুন্দর কায়দায় উপস্থিত করা হয়েছিল। যে উর্বর মস্তিষ্ক থেকে সুপ্রাচীন ঐ ব্রাহ্মীলিপির জন্ম হয়েছিল সেই মস্তিষ্ক থেকেই ‘বিবর্তনের’ ক্রম-নির্দেশও তৈরী হয়ে গেল। লিপির হাত পা গজালো। প্রয়োজনের তাগিদে ঐ হাত-পা বিচিত্র কায়দায় ছোট বা বড় হল কিংবা লুপ্ত হল। কোথাও বা বিচিত্রতর কায়দায় রেখা বঙ্কিম রূপ পেল। এবং কিমাশ্চর্যম্ ‘বিবর্তনের’ নানা কায়দার শেষ পর্যায়ে দেখা গেল ভারতীয় এবং অভারতীয় নানা লিপির আবির্ভাব। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে এই যে লিপির ক্রমবিকাশের এই ম্যাজিকটা কিন্তু বাইরের কোনও নিরপেক্ষ পণ্ডিত দেখালেন না৷ দেখালেন মিথ্যার চক্রীরা। আরও পরিষ্কার করে বলি। প্রচণ্ড মিথ্যার ধারক ও বাহক ঐ আর্কিয়লজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার পোষ্য পণ্ডিতেরাই ঐ ম্যাজিকটা দেখালেন৷ এক পণ্ডিতের নাম পাচ্ছি। রায়বাহাদুর গৌরীশংকর হীরাচাঁদ ওঝা। ভদ্রলোক পাণ্ডিত্যের জোরে রায়বাহাদুর হয়েছিলেন, ন৷ অন্য কোনও কারণে তা বলার দরকার আছে কি?
বৈদিক সাহিত্য কি ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা হত?
ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ঐ ব্রাহ্মীলিপি সম্পকে এক জায়গায় লিখেছেন,
But, as a matter of fact, this Brahmi alphabet, which was current in about AD 300 throughout the greater part of India, was employed to write not only the Prakrit vernaculars of the period, but also Sanskrit, including the Vedic, as we can reasonably presume.
ব্রাহ্মীলিপি যে প্রাকৃত, সংস্কৃত এমন কি বৈদিক ভাষা লেখার কাজেও ব্যবহার করা হত-এ-তথ্য কি সঙ্গত কারণে সত্য বলে ধরে নেওয়া যায়? যায় না কারণ প্রাকৃত, সংস্কৃত কিংবা বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীন অস্তিত্বের তথ্যটাই মিথ্যা। শ্ৰুতি আর স্মৃতি নামক দুই কল্পিত ডানায় উড়ে বেড়ানো বৈদিক বা সংস্কৃত সাহিত্যের জন্মই তখনো হয়নি। হয়নি সংস্কৃত ভাষার পরিকল্পিত বিকৃতির মধ্য দিয়ে তৈরী করে নেওয়া ঐ প্রাকৃত ভাষাগুলোর জন্ম। হয়নি ‘ব্রহ্মার তৈরী’ ঐ ব্রাহ্মীলিপির প্রচলন। তাই বলতেই হয় উদ্ধৃতিটা অতিকল্পনাদুষ্ট। সত্যের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই ঐ বক্তব্যের।
ফিনিশীয় লিপি কি সত্যিই ব্রাহ্মী লিপির উৎস?
ব্রাহ্মীলিপির জন্মরহস্য সম্পর্কে সাহেব পণ্ডিতেরা নানান রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য দিলেন। ফিনিশীয়রা নাকি ভারতবাসীদের লিপি- জ্ঞান শিখিয়েছিলেন। ভারতের মানুষ আরবে যেতেন ব্যবসা করতে। আর ওখান থেকেই নাকি লিপির আমদানী। ফিনিশীয়দের নিজেদের অস্তিত্ব আদৌ ছিল কিনা এ-প্রশ্ন কেউ তুললেন না। কল্পিত ফিনিশীয়দের কল্পিত লিপির সমুদ্রযাত্রার গল্প শোনানো হল। ভারতীয় পণ্ডিতেরা সেই আজগুবি গল্পটাকে সত্য বলে মনে করে বসলেন। সেমিটিক ভাষাভাষীদের কাছে ভারতবাসীরা কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ হল ইতিহাসের খেলায়৷
পণ্ডিতেরা তত্ত্ব এগিয়ে দিয়েই খালাস। সত্যি সত্যিই ঐ ফিনিশীয় লিপির সঙ্গে ব্রাহ্মী লিপির আত্মীয়তা আছে কিনা খোঁজ করতে গিয়েই দেখা গেল সে-আত্মীয়তার ছিটেফোঁটাও নেই। আর থাকবেই বা কি করে? এক অস্তিত্বহীনের সঙ্গে আর এক অস্তিত্বহীনের আত্মীয়তা খোঁজার চিন্তাটাই যে আজগুবি। ফিনিশীয় নামে কোনও লিপির প্রচলন ছিলই না’। যেমন ছিল না ঐ ব্রাহ্মী নামক লিপিটার। রোমকলিপি চুরি করে ব্রাহ্মী আর খরোষ্ঠীলিপির ‘জন্মের’ ব্যবস্থা যাঁরা করেছিলেন তাঁরাই মধ্যপ্রাচ্যের ‘প্রাচীন’ ভাষার লিপির জন্ম দিয়েছিলেন গ্রীকলিপির পরিকল্পিত বিকৃতির আয়োজন করে। এই বিকৃতির মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছিল ঐ ফিনিশীয় লিপি৷ জন্ম নিয়েছিল ঐ মোয়াবাইট, এলিবাল, ইয়েখিমিল্ক্, শাফাবাল, আস্ক্রবাল্ ইত্যাদি লিপিগুলো। জন্ম নিয়েছিল আরেকটি অস্তিত্বহীন ভাষার ঐ অ্যারেমেইক লিপি।
প্রশ্ন উঠবে এতগুলো জাল লিপি বানিয়ে নেওয়ার দরকারটা পড়ল কেন? দরকার ছিল বৈকি। এক একটি লিপির প্রচলনের আনুমানিক সালতামামি আরোপ করার বহর দেখে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না প্রাচীনত্বের স্ট্যাম্পমারা তথ্যগুলোর সালতামামি যাতে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসে সেইজন্যই ঐ ব্যবস্থা। এক জায়গায় ইয়েখিমিল্ক, লিপির সন্ধান পাওয়া গেল বলে প্রচার করা হল৷ সঙ্গে সঙ্গেই আনুমানিক সাল তারিখ চাপিয়ে দেওয়া হল। চার্ট তৈরী করাই থাকে৷ সালটা বসিয়ে দিলেই হল। এই রকম ব্যবস্থা। তৈরী করে নেওয়া শিলালিপির ওপর তৈরী করে নেওয়া সালতামামি চাপানো। ব্যবস্থাটা ভালোই করা হয়েছিল। কেউ বোঝেননি এইটাই বিস্ময়ের।
সহজ সরল ব্রাহ্মী লিপির সারল্য
ব্রাহ্মীলিপির গঠন সম্পর্কে ‘গবেষণা’ করে পণ্ডিতেরা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন ঐ লিপির অক্ষরগুলো নাকি সহজ এবং সরল। জটিলতার লেশমাত্র নেই। অপূর্ব সারল্যমণ্ডিত লিপিটা যে প্রশংসার দাবী রাখে এটা সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন। পণ্ডিতেরা অত্যন্ত সরল বলেই কিনা জানিনা লিপির সারল্যটুকুই দেখেছেন তাঁরা৷ জালিয়াত্টিা ধরতে পারেননি। আসলে সহজ সরল চিহ্ন দিয়ে লিপি ‘উদ্ভাবনে’র ব্যবস্থা করতে গিয়ে ঐ লিপির আধুনিক কারিগরেরা একটি মারাত্মক ভুল করে বসেছেন। একটু জটিল টাইপের অক্ষর বানিয়ে নিলে তাঁরা ধরা পড়তেন না৷ সহজ সরল চিহ্ন দিয়ে লিপি বানানোর ইচ্ছাটাই বিপদ ডেকে এনেছে। ঐ ধরণের চিহ্নের সংখ্যা সীমিত। এবং সীমিত সংখ্যার ঐসব চিহ্ন দিয়ে লিপি বানিয়ে নেওয়ার কাজটা রোমীয় এবং গ্রীক লিপিকারেরা আগেই সেরে রেখেছিলেন। বিপত্তি ঘটেছে ঐ জন্যই।
ব্রাহ্মী নামক জাল লিপির আধুনিক কারিগরেরা সহজ সরল লিপি বানাতে গিয়ে বারো আনি অংশ ঐ রোমক আর গ্রীক লিপি থেকে চুরি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ-ছাড়া উপায় ছিলনা। সহজ সরল চিহ্ন তো আর আকাশ থেকে পড়েনা। গ্রীস বা রোমের চৌকস লিপিকারদের মাথা থেকেই ঐসব চিহ্নের ধারণার জন্ম হয়েছিল। আর ‘ঐসব ধারণার জন্ম একবারই হয়। দুবার হয়না। এক জায়গাতেই হয়। অনেক জায়গায় হয়না।
ব্রাহ্মীলিপির কারিগরদের দ্বৈতচরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছিল। একই সঙ্গে সহজ সরল লিপি বানানো এবং ভারতীয় লিপিমালার জনক সাজানোর ব্যবস্থা করতে গিয়েই তাঁরা মুশকিলে পড়েছিলেন। রোমক লিপি সহজ সরল—আর ভারতীয় লিপির অধিকাংশই জটিল। এই দুই-য়ের সমন্বয় সহজ ব্যাপার ছিলনা। তাঁরা সামলাতে পারেননি। ব্রাহ্মী লিপিতে সরল এবং জটিল লিপির সহাবস্থান হয়েছিল একসঙ্গে দুটো ভূমিকা পালন করার জন্যই।
স্বরচিহ্ন প্রকাশ করতে গিয়ে আর এক বিভ্রাট বাঁধালেন ঐ কারিগরেরা। এত সহজ সরল ‘বিজ্ঞানসম্মত’ স্বরচিহ্ন এঁরা বানিয়ে বসলেন যার সঙ্গে না ছিল রোমক লিপির কোনও মিল – না ছিল স্বরচিহ্নগুলো সত্যিই ভারতীয় কোনও লিপির। অশোকব্রাহ্মীর স্মরচিহ্নগুলো সত্যিই অপূর্ব এবং সুন্দর। এত সুন্দর ব্যবস্থা যে প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষেরা করে গিয়েছিলেন—এটা ভেবে সত্যিই আনন্দ হয়৷ তবে সেটা স্থায়ী হয় না৷ খট্কা লাগে। স্বরচিহ্ন সৃষ্টির দিক দিয়ে যাঁরা এত মৌলিকত্ব দেখালেন তাঁরা স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ ‘সৃষ্টি’ করতে গিয়ে সুদূর ইউরোপের শরণাপন্ন হলেন কেন? গ্রীকো-রোমকলিপি চুরির উদ্যোগ নিতে গেলেন কেন? আর চুরিই যখন করলেন বেসামাল চুরি করতে গেলেন কেন? (একমাত্র উ-কার চিহ্নটাই তামিল ও অশোকব্রাহ্মীতে একই রকম—এ-তথ্যটা দিয়ে রাখা ভালো)
ব্রাহ্মী সংযুক্ত বর্ণ ‘সৃষ্টি’ করতে গিয়ে আর এক গোলমাল করে বসলেন ‘লিপির’ কারিগরেরা৷ ভারতীয় লিপিগুলোতে সংযুক্তবর্ণ লেখা হয় ব্যঞ্জনবর্ণগুলোর পূর্ণ বা আংশিক রূপ পাশাপাশি বা ওপরে নীচে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে। ব্রাহ্মী সংযুক্তবর্ণ য-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জন বর্ণ প্রকাশ করতে গিয়ে নাগরী য-ফলা চুরি করে বসলেন ওঁরা। আর ঐ য-ফলার সঙ্গে ব্রাহ্মী ‘য’-এর কোনও দূরাগত সাদৃশ্যও থাকলনা।
ব্রাহ্মী স্বরচিহ্নের রূপ পরিবর্তন
ব্রাহ্মী লিপির ক্রমপরিবর্তনের নানান ধাপে স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের যে রূপপরিবর্তন ঘটল তা নামমাত্র অথচ ঐ লিপির স্বরচিহ্নগুলোর যে পরিবর্তন ঘটল তাকে বৈপ্লবিকই বলতে হয়৷ তথাকথিত অশোক ব্রাহ্মীলিপির স্বরচিহ্নের সঙ্গে ‘অশোক’-উত্তর ব্রাহ্মী- লিপির স্বরচিহ্নের কোনও দূরাগত সম্পর্কই নেই। আমূল পরিবর্তন স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণে হল না—হল শুধু স্বরচিহ্নে। এর কোনও ব্যাখ্যা পণ্ডিতেরা দেওয়ার চেষ্টা করেন নি। ব্যাখ্যা নেই বলেই। আসলে লিপির ক্রমপরিবর্তনের বা বিবর্তনে’র ব্যবস্থা করতে গিয়ে মিথ্যার কারবারীরা সব দিক সামলাতে পারেন নি। তাই গোলমাল করে বসেছেন। স্বরচিহ্নগুলোর নানান রূপ ‘উদ্ভাবন’ করতে গিয়ে তাঁরা পারম্পর্য রক্ষা করতে পারেননি। স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণের নানান রূপভেদে পারম্পর্য রক্ষার যেটুকু ব্যবস্থা তাঁরা নিয়েছিলেন স্বরচিহ্নগুলোর ক্ষেত্রে সেটুকু ব্যবস্থাও তাঁরা নেননি। এবং নেননি বলেই তাঁরা ধরা পড়ে গিয়েছেন। মিথ্যা বেশী দিন চাপা থাকে না।
চীনা ভাবলিপির সঙ্গে ব্রাহ্মী লিপির মিল থাকার গল্প
ব্রাহ্মীলিপির সঙ্গে চীনা ভাবলিপির মিল সম্পর্কেও অনেক তথ্য পণ্ডিতেরা সরবরাহ করেছেন। করেছেন বিভ্রান্তিটা বাড়াতে। চীনা সুব, (= দশ) শব্দের ভাবলিপির সঙ্গে ব্রাহ্মী ক-এর মিলের কথা তাঁরা বলেছেন। বলেছেন চীনা ছু (= হাত) এর সঙ্গে ব্রাহ্মীর ‘ছ’ এর মিলের কথা। চীনা তিয়েন্ (= স্বর্গ) এবং থিয়াং (= ভূমি) এই দুই ভাবলিপির সঙ্গে ব্রাহ্মী ত এবং থ-এর নাকি প্রচণ্ড মিল। ব্রাহ্মী ক, ছ, ত, এবং থ-এর রূপকল্পনার উৎস নাকি চীনা লিপির মধ্যেই খুঁজে নিতে হয়। ‘সুর্’-ভাবলিপি থেকে আসার সুবাদে ব্রাহ্মীলিপির ‘ক’ অক্ষরটাকে ঐ লিপির একটি রূপভেদে ‘স’-এর চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। করা হয়েছিল চীনা লিপির প্রভাবের তথ্যটাকে প্রমাণসিদ্ধ বানাবার তাগিদে। ‘তিয়েন’ থেকে ‘ত’ এলে কিংবা ‘থিয়া ‘ থেকে ‘থ’ এলে ‘সুব’ থেকে ‘ক’ আসার কথা নয়। আসার কথা ‘স’-এর। তাই ঐ ব্যবস্থা। চীন এবং ভারতের মধ্যে সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যে ছিল তার ‘প্রমাণে’র ব্যবস্থা হল। মিথ্যাটা ও বেঁচে থাকল। ব্যবস্থাটা ভালোই করা হয়েছিল।
তবে ইন্টেলেক্চুয়াল জিমন্যাটিক্স দেখানো হল ব্রাহ্মী ঘ-এর জন্মবৃত্তান্ত শোনাতে গিয়ে। মুণ্ডা ভাষায় ঘাট-এর অর্থ পর্বত। ঐ ঘাট-এর ঘ-উচ্চারণটা নেওয়া হল। আর ‘পর্বত’-এর চীনা প্রতিশব্দ ‘সান’-এর ভাবলিপিটা চীন থেকে আমদানী করা হল। করা হল ব্রাহ্মী ঘ-এর চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার করার জন্য। ফলে চীনা ‘সান’ ভাবলিপি ব্রাহ্মীর ‘ঘ’ হয়ে দাঁড়াল। পাণ্ডিত্যের বহর একেই বলে!
পাণ্ডিত্যের বহর আর একটি অক্ষর সম্পর্কেও ‘দেখানো হল। বলা হল ঝাণ্ডা শব্দ থেকে ঝ উচ্চারণটা নিয়ে ঝাণ্ডার চিত্রকল্প থেকে নাকি ব্রাহ্মী ঝ এর চিহ্নটা বানানো হয়েছিল৷ আসলে গ্রীক মিউ µ অক্ষর চুরি করেই ঐ ঝ-এর ব্যবস্থা হয়েছিল আর সে ব্যবস্থাটা যাতে কেউ না ধরে ফেলেন তার জন্যই ঐ বিভ্রান্তি সৃষ্টির দরকার পড়েছিল।
ব্রাহ্মী লিপির প্রামাণ্যতা প্রতিষ্ঠার কাজে পাণিনীর ভুমিকা
ম্যাকডোনেল সাহেব ব্রাহ্মীলিপির প্রামাণ্যতা সম্পর্কে একটি তথ্য সরবরাহ করেছেন। তিনি লিখেছেন :
“This (Brahmi) is the alphabet which is recog-nised in Panini’s great Sanskrit grammar of about the 4th century B. C. and has remained unmodified ever since.”
কয়েকটি প্রশ্ন আসছেই। পাণিনী তাঁর ‘ব্যাকরণ’টা কোন লিপিতে লিখেছিলেন? ওটা কি খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা হয়েছিল? ইতিহাসে সেরকম কোনও তথ্য পাচ্ছি না। ব্রাহ্মী লিপিতে যে ঐ বই লেখা হয়নি তার প্রমাণ তো ঐ বক্তব্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তা হয়ে থাকলে ঐ লিপিকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নই যে উঠত না। ঐ সময়ে প্রচলিত বলে প্রচারিত কোনও লিপিতেই ঐ ‘ব্যাকরণ’ লেখা হয়নি। লিপিনিরপেক্ষ ‘রচনা’ ঐ ব্যাকরণটা? তাইবা কি করে হয়? প্রবর্তনের আগে কি লিপিহীন ভাষায় ব্যাকরণ ‘লেখা’ সম্ভব? আজগুবি ব্যাপারটা পণ্ডিতেরা বিশ্বাস করলেন কি করে?
উল্টোদিক দিয়ে এগুনো যাক। পাণিনী তাঁর ‘অষ্টাধ্যায়ী’তে ব্রাহ্মীলিপিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি নাকি প্রাচীন কালের ‘বৈয়াকরণ’। ইতিহাস বলছে তিনি নাকি খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের। আঠারো শতকে তৈরী করে নেওয়া তথাকথিত ব্রাহ্মীলিপির সন্ধান খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের ঐ পাণিনী মহাশয় পেলেন কি করে? তবে কি ব্রাহ্মীলিপি ‘উদ্ভাবিত’ হওয়ার পরে ঐ ‘বৈয়াকরণ’চূড়ামণির জন্ম? তাইত আসছে। প্রাচীন বলে সাজালেই কেউ প্রাচীন হয়ে যান না৷ বেসামাল তথ্য দিতে গেলে গোলমাল ত বাধবেই। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। জাল ব্রাহ্মীলিপিকে প্রামাণ্য বানাবার বাড়তি উপকরণ সরবরাহ করার দায়িত্ব নিতে গিয়ে ঐ পাণিনী তাঁর নিজের ঐতিহ্যের মিথটাকেই প্রকাশ করে ফেলেছেন। আসলে সর্বশাস্ত্রপারঙ্গম মহান আর্যসন্তানেরা যে ‘ব্যাকরণে’ও প্রচণ্ড পণ্ডিত ছিলেন—এই প্রচণ্ড মিথ্যার নজীর রাখার জন্যই ঐ ‘ব্যাকরণ’ লেখানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। ব্যবস্থা হয়েছিল আধুনিক কালেই। প্রাচীন কালে নয়। অর্থ টা তখন কি ছিল? না, ঠিক আজকের অর্থে নয়। সত্যিই তো তেইশ শ’ বছর আগেও শব্দটির একই অর্থ থাকবে তাইবা কি করে হয়! মিথ্যার কারবারীরা কায়দাটা ভালোই নিয়েছিলেন।
সিদ্ধান্ত নিতেই হয় পাণিনীর প্রাচীনকালে অবস্থানের গল্পটাই আজগুবি৷
ব্রাহ্মীলিপির নানান রূপভেদ
ব্রাহ্মীলিপির মোটামুটি আট রকম রূপ ছিল। স্থানকালভেদে সে লিপির রূপভেদ হয়েছিল। হয়েছিল বলে প্রচার করা হয়েছে। হয়েছিল ‘প্রমাণ’ রাখার ব্যবস্থাও। অষ্টরম্ভার অষ্টারম্ভ একেই বলে! আসলে লিপির রূপভেদের ব্যবস্থাটা রাখা হয়েছিল পরিকল্পিত ভাবেই। রাখা হয়েছিল বিভ্রান্তিটা বাড়ানোর জন্যই। লিপির শতাব্দী- ওয়ারী রূপভেদের ব্যবস্থা মিথ্যার কারবারীদের তৈরী করে নেওয়া সব লিপিতেই করা হয়েছে। করা হয়েছে ঐ ফিনিশীয় লিপিতে। করা হয়েছে ব্রাহ্মী লিপিতেও। আর ঐসব লিপির চরিত্র বদলানো অক্ষর গুলোর কোনওটাকে পণ্ডিতেরা খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের—কোনওটাকে খ্রীস্টীয় দ্বিতীয় শতকের বলে চালিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ ধরণের লিপিতে লেখা কিছু প্রত্নলেখের সন্ধান পাওয়া গেল বলে প্রচার করা হল। সালতারিখ জানার উপায় নেই। পণ্ডিতেরা অক্ষরের ‘চরিত্র’ দেখে সালতামামি আরোপ করে নিলেন। ব্যাপারটা এইরকমই ঘটত এবং সে রকম ঘটবে জেনেই আট কিসিমের লিপি বানানোর উদ্যোগ যে নেওয়া হয়েছিল এটা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। রমেশ চন্দ্ৰ মজুমদার এক জায়গায় লিখলেন:
“Although not always dated, the character of the script enables us to determine their approximate age.”
অক্ষরের ‘চরিত্র’ দেখে প্রত্নলেখের ওপর প্রাচীনত্ব আরোপ করার খেলাটা শুধু ভারতেই হয়নি। হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যেও। হয়েছিল অন্যত্রও।
খেলাটার আর একটু নমুনা দেওয়া যাক। অক্ষরের ‘চরিত্র’ দেখে সালতামামি আরোপ করার খেলাটা বেশ মজার। হাতীগুম্ফা শিলালিপির অক্ষরের রূপবৈচিত্র্য ‘বিশ্লেষণ করে ডাঃ ডি. সি. সরকার লিখলেন:
“The angular form and straight bases of letters like b, m, p, hand y, which are usually found in the Hatigumpha record suggest a date not much earlier than the beginning of the first century A. D.”
খেলাটা কেউ বোঝেননি এইটাই আশ্চর্যের।
ব্রাহ্মীলিপি লেখার গতিক্রম
ব্রাহ্মী লিপির যেসব নমুনা পাওয়া গেছে তার বেশীর ভাগই বাঁ দিক থেকে ডান দিকে লেখা। বেশীর ভাগ শিলালিপি বা তাম্রশাসনে ঐ কায়দাতেই লিপিটা ব্যবহার করা হয়েছে। ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লেখার ব্যবস্থাও যে ঐ লিপিতে হয়নি তা নয়। ইয়েরাগুডি শিলালিপিতে সে ব্যবস্থার নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে। বুঝতে কষ্ট হয়না ব্যবস্থাটা নেওয়া হয়েছিল বিভ্রান্তি সৃষ্টির আয়োজন হিসাবেই। একই লিপি কখনো বাঁ দিক থেকে ডান দিকে—কখনো-বা ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লেখা যায়—এ তথ্যটাই আজগুবি। কারণ তা হয়না। লিপির গঠনবিন্যাস দেখে বুঝে নিতে কষ্ট হয়না কোন লিপি বাঁ দিক থেকে ডান দিকে আর কোনটা উল্টো কায়দায় লেখা হয়। মজার কথা এই যে পণ্ডিতেরা ঐ আজগুবি তথ্য নিয়ে অনেক জল ঘোলা করেছেন। করেছেন উদ্দেশ্যমূলকভাবেই। মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে নানান বিভ্রান্তি সৃষ্টির আয়োজন করতেই হয়। না হলে মিথ্যাটা পোক্ত সত্য হয়ে ওঠেনা। শিলালিপি-তাম্রশাসন বানানোর নেপথ্যশিল্পীরা পরিকল্পিতভাবেই সোজা এবং উল্টো কায়দার লিখনভঙ্গীর নিদর্শন সবই বানিয়ে রেখেছিলেন যাতে ভাড়াটে পণ্ডিতেরা ঐ আজগুবি তথ্যকে ভিত্তি করে পাণ্ডিত্যের ফুলঝুরি দেখাতে পারেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য আধুনিকতর ‘উদ্ভাবন’ ঐ মোহেন-জো-দড়োর তথাকথিত লিপিমালায় বিভ্রান্তি সৃষ্টির খেলাটা কিছুটা বেশী মাত্রায় খেলেছিলেন ঐ মিথ্যার কারবারীরা। পরের অধ্যায়ে সে-সম্পর্কে আলোচনা রাখব।
ব্রাহ্মী এবং প্রাচীন ফিনিণীয় লিপির সাদৃশ্য
ব্রাহ্মী লিপির সঙ্গে প্রাচীনতম ফিনিশীয় লিপির যে বেশ কিছু মিল ছিল এই তথ্যটি সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ও দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন:
“A certain similarity between the shape of the Brahmi letters and those of the oldest Phoenician alphabet, both standing for the same or similar sounds gave considerable support to this theory.”
চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তথ্যটির সত্যতা যাচাই করে নেননি। ইউরোপীয় পণ্ডিতদের সুসংগঠিত অপপ্রচারে তিনি বিভ্রান্ত হয়েছিলেন এইটাই মনে করে নিতে হয়। ব্রাহ্মী লিপির সঙ্গে একাধারে রূপগত এবং ধ্বনিগত মিলযুক্ত অক্ষর তথাকথিত প্রাচীন ফিনিশীয় লিপিতে আছে মাত্র একটি (একাধিক নয়)। অক্ষরটা গ-উচ্চারণজ্ঞাপক। আর ধ্বনিগত মিল নেই—শুধু রূপগত সাদৃশ্য কিছুটা আছে এমন অক্ষর ঐ ফিনিশীয় লিপিতে আছে মাত্র দুটো। ঐ লিপির ‘ল’=ব্রাহ্মীর ‘প’ এবং ঐ লিপির ‘ত’= ব্রাহ্মীর ‘ক’। আর একটা কথা। রোমক লিপির একুশটা অক্ষরের সঙ্গে ব্রাহ্মী অক্ষরের মিল থাকার তথ্যটিকে এড়িয়ে গিয়ে মাত্র তিনটি ব্রাহ্মী অক্ষরের মিল থাকার সুবাদে ফিনিশীয় উৎসের গল্পটাকে চট্টোপাধ্যায় মহাশয় এতটা গুরুত্ব দিয়ে বসলেন কেন?
ব্রাহ্মী নামক জাল লিপিতে যে পরিমাণে জাল লেখ খোদাই করার আয়োজন হয়েছিল তা থেকে অনুমান করে নিতে কষ্ট হয়না কি বিরাট সুসংগঠিত চক্রান্ত ঐ কর্মকাণ্ডের পেছনে ছিল। জাল লেখগুলো যেসব পাথরে খোদাই করা হত তা খুবই মজবুত। প্রাচীন যুগের কথা বাদ দিলাম মধ্যযুগের স্থাপত্যনিদর্শনের মধ্যেও ঐ ধরণের মজবুত পাথরের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না কেন?
খরোষ্ঠী লিপির জন্মবৃত্তান্ত
তথাকথিত খরোষ্ঠী লিপি মিথ্যার কারবারীদের আর একটি অপূর্ব ‘সৃষ্টি’। এ-লিপির ‘সৃষ্টি’র কায়দা একটু আলাদা ধরণের। ব্রাহ্মী লিপির উৎস সন্ধান করতে গিয়ে যেমন রোমক লিপির বড় এবং ছোট হাতের ছাপা অক্ষরগুলোর সন্ধান পাওয়া যায় তেমনি ঐ খরোষ্ঠীতে পাওয়া যায় রোমক লিপির বড় এবং ছোট হাতের টানা লেখার অক্ষর গুলোকে। ব্রাহ্মী লিপির মধ্যে সরল রেখার প্রাচুর্য — খরোষ্ঠীতে বক্ররেখার। লীলায়িত ভঙ্গীর খরোষ্ঠীতে ছাপা অক্ষর বেমানান তাই রোমক লিপির টানা লেখার অক্ষর চুরির’ ঢালাও ব্যবস্থা। চুরির কিছু নমুনা দেওয়া যাক :
বড় হাতের টানা
I = ও; P = স
G = খ; J = ঢ
Y = জ; S = ণ
T = অন্তঃস্থ ব; Z =র
রোমক লিপি উল্টে নিয়েও কয়েকটা খরোষ্ঠী অক্ষর বানানো হয়েছিল। ‘V’ উল্টে ‘য়’ ‘J’ উল্টে ‘ন’; ‘U’ উল্টে ‘ষ’ এবং ছোট হাতের ‘h’ উল্টে ‘ড’; ছোট হাতের ‘t’ উল্টে ‘ও’।
রোমক লিপির দক্ষিণমুখী অক্ষরকে বামমুখী করে নিয়েও কয়েকটা অক্ষর বানানো হয়েছিল। দক্ষিণমুখী ‘K’ বামমুখী হয়ে হল ‘ঝ’; দক্ষিণ মুখী ‘S’ বামমুখী হয়ে হল ‘হ’ এবং ‘উ’। E বামমুখী হয়ে হল ‘ও’। রোমকলিপির দাঁড়ানো অক্ষরকে শয়ান বানিয়েও খরোষ্ঠী অক্ষর বানানো হয়েছিল। s শয়ান হয়ে হল খরোষ্ঠীর ‘ত’; c শয়ান হয়ে খরোষ্ঠীর ‘ম’। রোমক লিপির ছোট হাতের টানা অক্ষর থেকেও কিছু অক্ষর তৈরী করে নেওয়া হল:
f=ই; h=গ; p=প; r=প (রোমক লিপির R-এর ছোট হাতের টানা দুরকম অক্ষর আছে। খরোষ্ঠীতে p-এর দুরকম রূপ ত’ থাকতেই পারে।) ছোট হাতের টানা l (এল্) উল্টে দুটো অক্ষর বানিয়ে নেওয়া হল : l উল্টে ‘অ’ এবং প্রারম্ভিক টান সহ l উল্টে ‘এ’। প্রারম্ভিক টান সহ p = ফ।
একটু কায়দা করা বড় হাতের টানা রোমক অক্ষর থেকে আরও কিছু অক্ষর বানিয়ে নেওয়া হয়েছিল :
টানা B =ধ;
টানা Y = ব; আর এক কায়দায় Y =র;
রোমকলিপির অঙ্কগুলোকেও কাজে লাগানো হয়েছে 3 = 2; কায়দাকরা 2=এ; 3 = 20 (কুড়ি); 3 =ধ; কায়দাকরা 3 = চ।
আরও আছে। বড় হাতের ছাপা Y =ঞ্জ; U=ম; T= ঢ ; I=1; X= 4 (চার); প্রারম্ভিক টান সহ Y = ল; ক্রসচিহ্ন বা ‘যুক্ত’ চিহ্ন + =থ; কায়দাকরা S = দ; কায়দাকরা মাত্রাযুক্ত Y=ন; কায়দাকরা T = ভ; আর এক কায়দার T = ষ; কায়দাকরা X=ঝ; কায়দাকরা Y = ট; আর এক কায়দার Y = চ।
গ্রীক অক্ষরও চুরি করা হয়েছে ঐ খরোষ্ঠী লিপিতে। গ্রীক ‘মিউ’ব্লু থেকে বানানো হয়েছে ‘ঞ’ আর ‘শাই’ ψ থেকে বানানো হয়েছে ‘গ’।
মোটকথা ঐ খরোষ্ঠী লিপিতে রোমক লিপির নানান কায়দার কুড়িটা অক্ষরের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে৷ আদি-রোমক লিপিতে কোন্ অক্ষর ছিল বা কোন্ অক্ষর ছিল না সে প্রশ্ন মুলতুবী রেখে বলা যায় আজকের প্রচলিত ছাব্বিশটা অক্ষরের মধ্যে A D M O Q W এই ছটা অক্ষরই শুধু ঐ খরোষ্ঠী লিপিতে ছিল না। চুরির বাহাদুরী এই লিপিতেও কিছু কম করা হয়নি। বলে রাখা ভালো ব্রাহ্মীলিপিতে যেমন নানান বিচিত্র কায়দায় রোমক লিপি চুরির আয়োজন হয়েছিল খরোষ্ঠী লিপিতেও ঠিক সেই সেই কায়দা খাটানো হয়েছিল। একই খেলা—একই খেলোয়াড়। দু-রকম কায়দা হবেই বা কেন? মিথ্যার কারবারীরা যে পাকা খেলোয়াড় ছিলেন—এটা মেনে নিতেই হয়।
অ্যারেমেইক লিপি কি সত্যিই খরোষ্ঠী লিপির উৎস?
অ্যারেমেইক লিপির সঙ্গে খরোষ্ঠী লিপির প্রচণ্ড মিল থাকার কথা পণ্ডিতেরা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। পণ্ডিতেরা স্বীকার করে নিলেও আমি তা মানতে পারছি না। কারণ মিল বলতে অ্যারেমেইক লিপির দুটো অক্ষরের সঙ্গ খরোষ্ঠী লিপির দুটো অক্ষরের কিছু মিল দেখা যাচ্ছে।
অ্যারেমেইক ‘গ’= খরোষ্ঠীর ‘য়’ এবং ঐ লিপির ‘ক’=খরোষ্ঠীর ‘ল’। মাত্র দুটো অক্ষরের মিলটাকে একটু বেশী গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছেন পণ্ডিতেরা৷ অক্ষর দুটির উচ্চারণেরও সমতা যে ভাষা দুটোয় নেই সেটাও লক্ষণীয়।
অ্যারেমেইক লিপি থেকে খরোষ্ঠী লিপির ‘বিবর্তন’ সম্পর্কে পণ্ডিতেরা কত গল্পই না বানিয়েছেন। সে-সবই নেহাৎ পশুশ্ৰম৷ কারণ ঐ অ্যারেমেইক লিপির প্রচলন ছিলই না। গ্রীক লিপির পরিকল্পিত বিকৃতির মধ্য দিয়ে ঐ লিপির ‘উদ্ভাবন’ হয়েছিল আধুনিক ‘উদ্ভাবন’ করেছিলেন মিথ্যার কারবারীরা। করেছিলেন বিভ্রান্তিসৃষ্টির তাগিদেই।
সেমিটিক লিপি বলে প্রচারিত তথাকথিত ফিনিশীয় বা অ্যারেমেইক লিপি থেকে ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী কোনও লিপিই উদ্ভুত হয়নি৷ উদ্ভূত হওয়ার প্রশ্নটাই ছিল অবান্তর। অ্যারেমেইক লিপির অক্ষর সংখ্যা মাত্র বাইশ। ধ্বনিএককের সংখ্যা আরও কম। মাত্র আঠারোটা। আঠারোটা ধ্বনি-একক-সমৃদ্ধ সেমিটিক লিপি থেকে ছেচল্লিশটা ধ্বনি-একক-সমৃদ্ধ ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী লিপির ‘জন্ম’ হল কি করে? দুটো বা তিনটে অক্ষর পাশাপাশি জুড়ে দিয়ে যে নতুন নতুন ধ্বনিএকক তৈরী করে নেওয়া হয়েছে এমন তথ্যও ত’ পাচ্ছি না৷ তাই সিদ্ধান্ত নিতেই হয় সেমিটিক উৎস থেকে ভারতীয় লিপি দুটোর জন্মের তথ্যটাই আজগুবি৷ লিপির উৎস, সৃষ্টি, ক্রমপরিবর্তন, প্রচলন এবং অবলুপ্তির পুরো গল্পটাই বানানো। বানানো হয়েছিল বানানো প্রাচীন ইতিহাসের কাঁচামালের বাহন সাজানোর জন্যই।
অ্যারেমেইক লিপি মায়া, না মতিভ্রম?
অ্যারেমেইক লিপি নাকি উত্তরে তুরস্ক থেকে দক্ষিণে ইজিপ্ট আর পূর্বে পারস্য থেকে পশ্চিমে প্যালেস্টাইন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে এককালে চালু ছিল। চালু ছিল ঐ অঞ্চলের lingua franca হিসাবেই। এমনকি উত্তর-পশ্চিম ভারতেও নাকি লিপিটা অল্পবিস্তর চলত। ইতিহাসে এই রকম তথ্যই পাচ্ছি। লিপিটা তথাকথিত আর্যগোষ্ঠীর ভাষা আখিমেনীয় কালপর্বের প্রাচীন পারসিক-এর বাহক হিসাবে চালু ছিল। চালু ছিল সেমিটিক আরবী এবং ‘অ্যারেমেইক’ নামক ভাষার বাহক হিসাবেও প্রশ্ন আসছেই।
এক. ঐ দু-ধরণের ভাষা প্রকাশ করার উপযোগী অক্ষরে কি লিপিটা সমৃদ্ধ ছিল? সম্ভবতঃ নয়- কারণ লিপিটাতে মাত্র আঠারো রকম ধ্বনিএকক (phoneme প্রকাশ করার সুযোগ ছিল। ঐ অঞ্চলের কিছু ভাষাতে ঠিকমত উচ্চারণ প্রকাশ করার কাজে আরও কিছু বেশী ধ্বনিএককের দরকার পড়ার কথা।
দুই. বিস্তৃত অঞ্চলে প্রচলিত বলে প্রচারিত এমন একটা বনেদী লিপির দু-একটা অক্ষরের প্রভাব ঐ অঞ্চলের আরবী লিপিমালার ওপর পড়েনি কেন?
তিন. ঐ লিপি যদি সত্য সত্যই চালু থাকত- তাহলে ঐ লিপি বাতিল করার দরকারটা পড়ল কেন? সহজ সরল অক্ষরযুক্ত ঐ লিপিটা যে আরবী বা হিব্রু লিপির চেয়ে গুণগতমানে হেয় ছিল এটা মনে করার তো কোনও কারণই দেখছি না।
চার. সাহেবদের ইতিহাস অন্বেষণের কর্মকাণ্ডের আগে ঐ লিপির কথা ওখানকার মানুষ বেমালুম ভুলে গেলেনই বা কেন?
আর একটা কথা। লিপির বিশ্বজনীন ক্রমিক রূপ পরিবর্তনের খেলার তত্ত্ব দিয়ে যাঁরা পণ্ডিত হয়েছেন তাঁরা ঐ অ্যারেমেইক লিপির ক্রমপরিবর্তনের গল্পটা না বানিয়ে লিপির ‘মৃত্যুর ব্যবস্থাই-বা করতে গেলেন কেন? প্রশ্ন আরও আসছে। উত্তরকালে প্রচলিত আরবী লিপির ওপর ঐ অ্যারেমেইক লিপির প্রভাব না পড়লেও গ্রীক লিপির বেশ কিছু অক্ষরের সঙ্গে ঐ লিপির সমসংখ্যক অক্ষরের লক্ষণীয় মিল খুঁজে পাচ্ছি কেন? প্রাচীনতর বলে প্রচারিত হিব্রু লিপির কোনও প্রভাবইবা ঐ অ্যারেমেইক লিপিতে পড়েনি কেন? ভাষার দিক দিয়ে হিব্রু ভাষার কাছাকাছি আবার লিপির দিক দিয়ে গ্রীক লিপির কাছাকাছি থাকার এই বিচিত্র ব্যবস্থাটা ঐ অ্যারেমেইক ভাষায় চালু হল কেন? এ-সব প্রশ্নের উত্তর পণ্ডিতেরা দেননি।’ দেননি কারণ মহান যীশুর মাতৃভাষা ঐ অ্যারেমেইক-এর অস্তিত্বহীনতার গল্পটা যে তাহলে ধরা পড়ে যেত।
অ্যারেমেইক নামের কোনও ভাষা’ কস্মিনকালেও ছিল না। ছিলনা ঐ নামের লিপিরও অস্তিত্ব। গল্পে, বলা হয়েছে যীশু খ্রীস্ট নাকি ঐ ভাষাতেই কথাবার্তা বলতেন—ঐ ভাষাতেই উপদেশ দিতেন। হিব্রু ভাষাটা যে তাঁর জন্মের অনেক আগেই পৃথিবী থেকে ‘বিদায় নিয়েছিল। তাই ঐ অ্যারেমেইক ভাষার গল্প বানানোর ব্যবস্থা। “কয়েকটি তৈরী করে নেওয়া পুঁথি আর কিছু শিলালিপির নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল ঐ হিব্রু ভাষাটা। সম্ভবত ‘মৃত’ ভাষার তালিকা স্ফীত করার উদ্দেশ্যেই। বলা বাহুল্য ঐ অ্যারেমেইক ভাষাটাও আধুনিককালে বানিয়ে নেওয়া পুঁথির মধ্যেই আশ্রিত হয়ে আছে৷ আশ্রিত হয়ে আছে আধুনিককালে বানিয়ে নেওয়া কিছু শিলালিপির মধ্যে ভাষার প্রাচীন প্রচলনের গল্প বাইবেলেও আছে। থাকলেই তা প্রামাণ্য হয়ে ওঠে না। কারণ ঐ পবিত্র গ্রন্থটিকে প্রামাণ্য ইতিহাস মনে করার কোন কারণই নেই৷ বস্তুত মিথ্যার কারবারীদের তৈরী করে নেওয়া প্রাচীনত্বের ছদ্মবেশ-চাপানো একটি উঁচু দরের প্রতারণার নামই ঐ বাইবেল। কিঞ্চিৎ ‘ইতিহাস’-মিশ্রিত ঐ বাইবেল দুনিয়ার প্রাচীনতম পুরাণ—প্রাচীনতম ইতিহাস—প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ। ঐ পবিত্র গ্রন্থ দিয়েই মিথ্যার কারবারীদের হাতেখড়ি হয়েছিল। বিস্তৃততর তথ্য পরের একটি অধ্যায়ে রেখেছি।
খরোষ্ঠী লিপির নামের বাহার
জালিয়াতি হলে কি হবে খরোষ্ঠী লিপির নামের বাহার আছে। সংস্কৃতগন্ধী ঐ নামের বানান দু-রকম : খরোষ্ঠী এবং খরোষ্ট্রী। মিথ্যার কারবারীরা অনেক শব্দেরই নানান বানান বানানোর খেলা খেলেছিলেন। খেলেছিলেন পণ্ডিতদের দৃষ্টিটাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই। জালিয়াতিটা যাতে কেউ না ধরে ফেলেন তাই এক দল পণ্ডিত বললেন, খর শব্দের অর্থ গাধা আর গাধার ঠোঁটের সঙ্গে অক্ষরগুলোর কল্পিত মিলের দরুণই নাকি ঐ প্রথম নামটা ঐ লিপির ওপর আরোপ করা হয়েছিল। আরেক দল পণ্ডিত বললেন, না, তা নয়। গাধা আর উটের দেশ পাঞ্জাব মুলুকে চালু ছিল বলেই নাকি ঐ লিপির নাম খরোষ্ট্রী রাখা হয়েছিল। খর অর্থে গাধা আর উষ্ট্র—সে তো সবাই জানে—উট। সত্যিই তো স্থানীয় জন্তুজানোয়ারের নাম থেকেই যে লিপির নামকরণ হয়! বিজ্ঞতর পণ্ডিতেরা বললেন, না ওসব কোনও কারণই নয়। সেমিটিক ভাষার খরোসেথ (= লিপি) শব্দের সংস্কৃতায়িত ছদ্মবেশের নামই নাকি ঐ খরোষ্ঠী। কে যে বিজ্ঞ আর কে যে বিজ্ঞতর বোঝা মুশকিল। আসলে ষোল আনা জালিয়াতিটা যাতে কেউ না ধরে ফেলেন সেইজন্যই ঐ নামব্রহ্মের খেলাটা খেলা হয়েছিল। আর সেটা বুঝে নিতেও কষ্ট হয়না। ভাড়াটে পণ্ডিতেরা তর্কযুদ্ধের অভিনয় করেছিলেন। বলা বাহুল্য, ওঁরা সকলেই ছিলেন সাহেবপণ্ডিত কিংবা তাঁদের ভারতীয় সাকরেদ। বলে রাখা ভালো প্রথম দু-দল পণ্ডিতের লক্ষ্য ছিল বিভ্রান্তি সৃষ্টি – বিজ্ঞতর সেজে বসে থাকা তৃতীয় দলের পণ্ডিতদের উদ্দেশ্য ছিল ঐ লিপির সেমিটিক উৎস সম্পর্কে স্থির প্রত্যয় হয়ে বক্তব্য পেশ করা। বিদ্বজ্জনমণ্ডলী ঐ তৃতীয় দলের মতটাকেই শিরোধার্য করে নিয়েছেন। নামকরণের আসল কারণটা নাকি ওরাই ঠিক জানিয়েছেন। ওস্তাদের মার শেষ রাত্রে। শেষ সিদ্ধান্তটাই নাকি পাকা। আসলে কি তাই?
প্রাচীন লিপি সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি—ভাড়াটে পণ্ডিতদের ভূমিকা
মিথ্যার কারবারীরা পাথুরে লিপি ছটো বানিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত হননি। ঐ দুটো লিপি সম্পর্কে নানা রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টির তাগিদে বেশ কয়েকজন বিদেশী পণ্ডিতকেও ওঁরা কাজে লাগিয়েছিলেন। ঐ দুই লিপির ‘জন্মরহস্য’ নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব তৈরীরও আয়োজন হয়েছিল। বার্নেল সাহেব জানালেন ফিনিশীয়রা নাকি ভারতবাসীদের লিপিজ্ঞান শিখিয়েছিলেন। অশোকলিপি (দক্ষিণী)-টা নাকি সাক্ষাৎ ফিনিশীয়দের কাছ থেকে আনা হয়েছিল। আনা হয়েছিল খ্রীস্টপূর্ব পাঁচ শ’ অব্দের আগেও নয় আবার খ্রীস্টপূর্ব চার শ’ অব্দের পরেও নয়। সালতামামি আরোপ করার ব্যাপারে ভদ্রলোক এত স্থিরনিশ্চয় হলেন কি করে সেটা অবশ্য তিনি বলেননি। সে যাই হোক, আসল কথায় আসা যাক। ফিনিশীয় লিপি এবং দক্ষিণী ব্রাহ্মী লিপির মধ্যে কোনও সাদৃশ্য কি তিনি দেখেছিলেন? ফিনিশীয় ‘গ’ এর সঙ্গে ঐ ব্রাহ্মীর ‘গ’-এর কিছুটা মিল আছে আর ফিনিশীয় ‘ত’ এর সঙ্গে ঐ ব্রাহ্মীর ‘ক’-এর। এ-ছাড়া আর কোনও মিলই তো দেখছিনা। মাত্র দুটো অক্ষরের মিল দেখে তিনি ঐ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন কি করে?
বুলার সাহেব উল্টো কথা লিখলেন। তিনি বললেন আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব পাঁচ শ’ অব্দের কিছু আগে বা পরে ব্রাহ্মী লিপি-বিঢ়ে শ্রমসে নির্মাণ করনে কা কার্য সমাপ্ত হো চুকা থা’। লিপির ভারতে প্রবেশ ঘটেছিল খ্রীস্টপূর্ব ৮০০ অব্দে। উল্টোপাল্টা নানান তথ্য নানান পণ্ডিতে দিয়েছেন। দিয়েছেন বিভ্রান্তিটা বাড়াতে। তবে বুলার সাহেব একটা সত্যি কথা বলে ফেলেছেন। ব্রাহ্মী লিপির সৃষ্টিটা যে ‘বঢ়ে শ্রমসে নির্মাণ করনে কা কার্য’ এটা তিনি স্বীকার করেছেন। সত্যিই তো রোমক লিপির একুশটা, তামিলের দুটো, তেলুগুর তিনটে, ওড়িয়ার একটা, নাগরীর পাঁচটা, গুরুমুখীর দুটো, গুজরাতির একটা, গ্রীক লিপির পাঁচটা এবং আরবী-ফারসী লিপির তিনটে অক্ষর চুরি করে ‘লিপিমালা’ তৈরী করে নিতে কি সাহেব পণ্ডিতদের কম কসরৎ করতে হয়েছে? ব্রহ্মার পরিশ্রমের কথা ভেবে পণ্ডিতের এত চিন্তা এল কেন এ-প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া যাচ্ছেনা। বিভ্রান্তির ওপর বিভ্রান্তি! কিছু আধুনিকতর পণ্ডিত আরেক তত্ত্ব উপহার দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন ভারত থেকে ফিনিশিয়ার দূরত্ব বড্ড বেশী। অত দূর থেকে লিপির আমদানীটা বিশ্বাসযোগ্য নয়৷ ব্রাহ্মী লিপিটা নাকি এসেছিল দক্ষিণ সেমিটিক সাবীয় লিপির ক্রম-পরিবর্তনের সূত্রেই। আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেছিল কারণ তথাকথিত ঐ সাবীয় লিপিটাও মিথ্যার কারবারীদেরই তৈরী করে নেওয়া।
ব্রাহ্মী-খরোষ্ঠী ও লিপির সংখ্যাবোধক অঙ্ক
ব্রাহ্মী এবং খরোষ্ঠী লিপিতে সংখ্যাবোধক অঙ্ক প্রকাশ করার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল।
নানাঘাট ও নাসিকের শিলালিপিতে ব্রাহ্মী সংখ্যালিপির কিছু নমুনা পাওয়া গেছে। খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের বলে প্রচার করা সেইসব নমুনা বিশ্লেষণ করা যাক।
নানাঘাট সংখ্যালিপির ৪ = y; ৬=গ্রীক ‘শাই’ ψ ৭ = নিচের বিন্দু বাদ দেওয়া রোমক লিপির প্রশ্নবোধক চিহ্ন; ১০ = একটু কায়দাকরা গ্রীক আল্ফা α; ২০ = O; ৬০ = ছোট হাতের টানা f; ১০০০=t
নাসিক সংখ্যান্সিপির ৪ = y; 5 = রোমক লিপির ছোট হাতের টানা ৭ −7; ১০ =গ্রীক আল্ফা α; ২০ = গ্রীক থিটা θ; ৩০ =Z; ৭০ =কায়দা করা y; ১০০ = 3।
খরোষ্ঠী সংখ্যাবোধক অঙ্ক চিহ্নগুলোর মধ্যেও রোমক লিপি চুরির ব্যবস্থা হয়েছিল। যেসব মৌলিক অঙ্কচিহ্ন ঐ লিপিতে কাজে লাগানো হয়েছিল তার মধ্যে রোমক লিপির 2, 7, ছোট হাতের টানা n (একটু বাঁকানো) এবং X-এর সন্ধান পেতে কোনও অসুবিধাই হয়না।
বুঝতে কষ্ট হয়না রোমক লিপি এবং অংশত গ্ৰীক লিপি থেকে অক্ষর চুরি করে নেওয়ার ব্যবস্থাটা ব্রাহ্মী এবং খরোষ্ঠী লিপির সংখ্যালিপি বানিয়ে নেওয়ার কাজেও অব্যাহত ছিল।
ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী অঙ্কচিহ্নগুলোতে একটি চিহ্নের অভাব লক্ষণীয়। সেটা হচ্ছে শূন্যচিহ্ন। শূন্যবোধক চিহ্ন লিপি দুটির কোনটিতেই ছিলনা। শূন্য চিহ্নের ধারণা আসার আগে শত, সহস্র, অযুত, লক্ষ, নিযুত ইত্যাদি সংখ্যার ধারণা আসতেই পারেনা। আসাটাই আজগুবি৷ ইংরাজী hundred বা thousand বা ইটালির mille বা গ্রীক murios শব্দগুলো বেশ পুরানো। কিন্তু ঐ সব শব্দের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা- জ্ঞাপকতা প্রাচীনকালে ছিলনা। অসংখ্য, প্রচুর বা অগণিত—এই ধারণা প্রকাশ করার জন্যই শব্দগুলো প্রাচীনকালে ব্যবহার করা হত। সুনির্দিষ্ট সংখ্যাজ্ঞাপকতা এসেছে অনেক পরে৷ বুঝতে কষ্ট হয়না শূন্যের ধারণাসৃষ্টির সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল ঐসব ভাষা- ভাষীদের। পরে ঐ বিশেষ অর্থ আরোপ করার ব্যবস্থা হয়েছিল।
‘সুসভ্য’ সব দেশে যে প্রাচীনকালে বিরাট বিশাল সংখ্যাধারণার জন্ম হয়েছিল—এই গল্পটা নেহাৎ-ই আজগুবি৷
প্রাচীন সব লিপিই জাল
আসলে ইন্টারপোলেশনমার্কা ‘প্রাচীন’ লিপির সবগুলোই জাল। প্রাচীন ইতিহাস তৈরীর কারখানা ইউরোপে তৈরী। সেসব লিপির মাধ্যমে যেসব নজীর রাখার ব্যবস্থা হয়েছে তার পুরোটাই বানানো—পুরোটাই মিথ্যা। ব্রাহ্মী-খরোষ্ঠী-গ্রন্থ-ওয়াত্তেলুর-মার্কা প্রাচীন লিপি শুধু ভারতের জন্যই তৈরী করতে হয়নি—হয়েছিল ইতিহাসগর্বী অনেক দেশের জন্যই। জাল-জালিয়াতি-জোচ্চুরির মাধ্যম ঐসব লিপি ‘আবিষ্কার’ না করে রাখলে যে দুনিয়ার প্রাচীন যুগের ইতিহাসই লেখা সম্ভব হতনা।
প্রচলিত লিপি কি কেউ বাতিল করে?
ব্রাহ্মী এবং খরোষ্ঠী দুটো লিপিই নাকি ভারতে প্রচলিত ছিল। ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। প্রশ্ন হল : দু-দুটো প্রচলিত লিপির অধিকারী ভারতীয়রা বিকল্প লিপির ব্যবস্থা না করে লিপিছটোকে বাতিল করে বসলেন কেন? সংস্কৃতির মাধ্যম ও বাহনের প্রয়োজনীয়তা কি হঠাৎ ফুরিয়ে গিয়েছিল? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? লিপির ব্যবহার একবার আয়ত্ত করে—লিপির কার্যকারিতায় উপকৃত হয়ে—কেউ তা বাতিল করেনা। যদি করে তবে বুঝে নিতে হয় বিকল্প লিপির ব্যবস্থা সে করেছে। সে-ব্যবস্থা না করে লিপিহীন নৈরাজ্যে অবস্থান করার ইচ্ছাটা পাগলামি৷ বুদ্ধিমান মানুষ তা করতেই পারেনা। সমষ্টিগত ভাবে মানুষ পাগলামি করেনা। অথচ ইতিহাসে সেই বৃত্তান্তই পাচ্ছি। ইতিহাসে পাচ্ছি খরোষ্ঠী লিপি নাকি ৩৩০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত চালু ছিল। তার পরে কি সেটা উবে গেল? অন্য কোনও লিপি কি তার স্থলাভিষিক্ত হল? না, তাও না। তাহলে? সমসাময়িক সুউন্নত সংস্কৃত সাহিত্য সবই মুখে মুখে চলত। কি শ্রুতি—কি স্মৃতি সবই। কাব্য মহাকাব্য পুরাণ সবই চলত মুখে মুখে। খরোষ্ঠী লিপি যদি সত্যসত্যই চালু থাকত কিংবা অন্য কোনও লিপি তার পরিবর্তে প্রচলিত হত তাহলে নিশ্চয়ই সে-সাহিত্যকে শ্রুতি-পরম্পরা নামক আজগুবি নাম নিয়ে বেঁচে থাকতে হতনা। তথাকথিত ব্রাহ্মী এবং খরোষ্ঠী লিপির ‘মৃত্যু’ এবং আধুনিক ভারতীয় (তথা বহির্ভারতীয় কয়েকটা) লিপির ‘জন্মের’ মধ্যে যে সময়ের ফারাকটা রয়েছে তা বেশ কয়েক শ’ বছরের। এর ব্যাখ্যা হয় না। যাঁরা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁরা ভুল বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। ‘বিবর্তনের’ তত্ত্বটা গোঁজামিলের তত্ত্ব । কারণ শূন্য থেকে কোনও কিছুরই ‘বিবর্তন’ হয়না। হয়না ক্রমপরিবর্তনও।
তথাকথিত স্লেচ্ছদের লিপিও চুরি করা হয়েছিল
ব্রাহ্মী লিপির ‘উদ্ভাবন’-এর আধুনিক নেপথ্যশিল্পীরা শুধু ভারত আর ইউরোপের লিপি চুরি করেই ক্ষান্ত হননি। চুরি করেছিলেন সেমিটিক লিপিরও কয়েকটা অক্ষর। বলে রাখা ভালো ঐ ব্রাহ্মী লিপির ‘উদ্ভাবন’-কালে সেমিটিক আরবোপারসীক লিপিটা উর্দু (তখন নাম ছিল হিন্দী) ভাষার বাহন হিসাবে ভারতের বিরাট অঞ্চলেই প্রচলিত ছিল। এখনও আছে। সে যাই হোক, আরবো- পারসীক লিপি-মালার তিনটি অক্ষর ঐ নেপথ্যশিল্পীরা চুরি করেছিলেন। ঐ লিপির ‘আলেফ’ ব্রাহ্মীতে এসে হল ‘র’; ‘আয়েন’ হল ব্রাহ্মীর ‘জ’ আর ‘লাম’ হল ঐ লিপির ‘ল’। ভাবতে অবাক লাগে ব্রাহ্মী লিপির শতাব্দীওয়ারী রূপভেদের ব্যবস্থা করতে গিয়ে এমন লিপিও চুরি করার আয়োজন হয়েছিল যে লিপির জন্ম ব্রাহ্মী লিপির প্রচারিত জন্মকালে হয়ইনি৷ ঐ আরবো-পারসীক লিপির জন্ম যে খ্রীস্টপূর্ব কোনও শতাব্দীতে হয়নি এ-ব্যাপারে সব পণ্ডিতই একমত। আর চুরি বলে চুরি! ব্রাহ্মী ‘ল’ আর আরবো পারসীক লিপির ‘লাম’ যে অবিকল একই অক্ষর। উচ্চারণেও এক—আকৃতিতেও তাই। এত কাঁচা চুরি ওঁরা করতে গেলেন কেন?
প্রাচীন লিপি প্রচলনের লিখিত নজীর
ব্রাহ্মী এবং খরোষ্ঠী লিপি যে একদা ভারতে প্রচলিত ছিল এ- সম্পর্কে লিখিত নজীর কি আছে দেখা যাক। প্রথমে হিন্দুধর্মসম্পর্কিত উৎসগ্রন্থের কথা আসছে। নারদস্মৃতিতে পাচ্ছি :
না করিষ্যত্যদি ব্রহ্মা লিখিতং চক্ষুরুত্তমম্
তবেয়মস্য লোকস্য নাভবিষ্যৎ শুভা গতিঃ।
নয়নমনোহর ব্রাহ্মী লিপির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উচ্ছাস দেবলোকের বাসিন্দা নারদের ছদ্মনামে নরলোকের কোন্ মহাপ্রভু লিখেছেন তা জানার উপায় নেই। কিন্তু একটি প্রশ্ন আসছেই। ব্রাহ্মী লিপি চালু থাকা সত্ত্বেও সংস্কৃত ভাষা ঐ লিপিতে লেখার ব্যবস্থা হতনা কেন? কেন ঐ লিপি শুধু শিলালিপি লেখার কাজেই ব্যবহার করা হত? কোন গ্রন্থই ঐ লিপিতে লেখা হয়নি কেন? অন্য গ্রন্থের কথা বাদই দিলাম ঐ নারদস্মৃতিটাই-বা ঐ লিপিতে লেখা হয়নি কেন? সে-গ্রন্থ কেনই বা স্মৃতির মণিকোঠায় রাখার দরকার পড়ত?
নজীরের বহুর আছে। শুধু ‘হিন্দু উৎসগ্রন্থেই ব্রাহ্মী প্রসঙ্গ নেই। আছে বৌদ্ধ এবং জৈনদের বইয়েও। বৌদ্ধদের সংস্কৃত গ্রন্থ ‘ললিত- বিস্তার’-এ ৬৪টি লিপির নাম আছে যার প্রথম নাম ব্রাহ্মী এবং দ্বিতীয় নাম খরোষ্ঠী। পন্নবণাসূত্র এবং সমবায়াংগ সূত্রে ১৮টি লিপির নাম – পাওয়া যাচ্ছে যার প্রথম নাম বংভী (ব্রাহ্মী)। লেখক একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। লিপিকে প্রণাম জানিয়ে বসেছেন ‘নমো বংভীএ লিবিএ সূত্রের মধ্য দিয়ে।
‘ললিতবিস্তার’ লেখা হয়েছে কবে?
‘হিউ-এ-সাঙ,’-ই বা কে?
সুললিত মিথ্যাবিস্তারের ঐ ‘ললিতবিস্তার’ যে একটি প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়—ওটা যে আধুনিককালে লেখা একটি ‘প্রাচীন’ বই এটা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। কষ্ট হয়না কারণ ঐ ব্রাহ্মী আর খরোষ্ঠী নামের দুটো জাল লিপির প্রাচীন প্রচলনের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ঐ বইয়ের লেখক নিজের বইয়ের আধুনিকত্বটাকেই প্রকট করে তুলেছেন। জাল লিপির সাফাই গাওয়ার যে বিপদ আছে এইটাই তিনি বুঝতে পারেননি। জাল লিপির ওপর প্রাচীনত্ব আরোপ করার দায়িত্ব নিতে গিয়ে পরোক্ষভাবে নিজের লেখা বইয়ের অর্বাচীনত্বই জাহির করে বসেছেন ভদ্রলোক৷ এ-রকম ভুল একা শুধু তিনিই করেননি। করেছিলেন অনেক নামী ‘ব্যক্তি’ই। ‘ব্যক্তি’ অর্থে ঐ ইতিহাসের একাধিক চরিত্রকেই বুঝতে হবে। আসলে আধুনিক জালিয়াতিকে প্রাচীন বলে চালানোর চেষ্টা আর তার সাফাইয়ের আধুনিক ব্যবস্থাটাকে প্রাচীন বলার আয়োজন করতে গিয়ে মিথ্যার কারবারীরা বড্ড বেশী গোলমাল করে ফেলেছেন। এবং সেই গোলমাল করার সূত্রে এমন সব তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে যা চাঞ্চল্যকর। এমন আর একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ইতিহাসে পাচ্ছি হিউ-এন-সাঙ্ নাকি ৬২৯ খ্রীস্টাব্দ থেকে ৬৪৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে কাটিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তের এক জায়গায় লিখেছিলেন “ভারতবাসীদের বর্ণমালার অক্ষর ব্রহ্মার দ্বারা সৃষ্ট হয়েছিল আর ঐটারই রূপ (রূপান্তর) আগে থেকে এখনও চলে আসছে।” (উৎস—প্রাচীন ভারতীয় লিপিমালা (হিন্দী)– লেখক গৌরীশংকর হীরাচাঁদ ওঝা) বুঝতে কষ্ট হয়না ‘ব্রহ্মার দ্বারা সৃষ্ট বর্ণমালার পরিচয় দিয়ে ব্রাহ্মীলিপির ই প্রসঙ্গ তিনি তুলেছিলেন। প্রশ্ন হল অস্তিত্বহীন ঐ জাল লিপির প্রসঙ্গ ঐ হিউ-এন-সাঙ্ তুলতে গেলেন কেন? তুলেছিলেন ঐ ব্রাহ্মী লিপির পাথুরে অস্তিত্বের প্রাচীনত্বের লিখিত প্রমাণ খাড়া করার তাগিদে৷ সিদ্ধান্ত নিতেই হচ্ছে হিউ-এন-সাঙ্, নামের কোনও চীনা পর্যটক ভারতে আসেনই নি—ঐ চরিত্রটি মিথ্যার কারবারীদের তৈরী করে নেওয়া। ভারতীয় মিথ্যার অভারতীয় প্রমাণ রাখার ব্যবস্থা হিসাবেই ঐ চরিত্রটি বানানো হয়েছিল। ঐ হিউ-এন-সাঙ, যদি সত্যিই ভারতে এসে থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই ঐ জাল লিপি চালু থাকার গল্পটা তিনি বানাতেন না৷ বানাবার দরকারই বোধ করতেন না। আঠারো কিংবা উনিশ শতকে তৈরী করে নেওয়া ঐ দুটো জাল লিপির কথা সপ্তম শতাব্দীর ঐ হিউ-এন-সাঙ্-এর জানার প্রশ্নই ওঠে না।
আর একটা কথা। ‘ললিতবিস্তার’-এর লেখক শুধু ব্রাহ্মী আর খরোষ্ঠী লিপিরই সন্ধান দেননি। দিয়েছিলেন চৌষট্টিটা লিপির তথ্য। যেযুগে ভারতে কোনও লিপিরই প্রচলন ছিলনা, সেই যুগে চালু থাকা চৌষট্টিটা লিপির গল্প লেখা ঐ ‘ললিতবিস্তার’-এর নেপথ্য লেখকের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কারণ তিনি ছিলেন ভাড়াটে লেখক–মিথ্যার কারবারীদের অনুগৃহীত আত্মগোপনকারী কোনও আধুনিক পণ্ডিত। দুঃখের কথা ছদ্মবেশটা খসে পড়েছে।
তথ্য আরও পাচ্ছি। ঐ পন্নবণাসূত্র, ঐ সমবায়াংগসূত্র বা ঐ ভগবতীসূত্র ইত্যাদি বিচিত্র উদ্ভট সব নামের বইগুলোও আধুনিককালে লেখা ‘প্রাচীন’ গ্ৰন্থ। জাল লিপির প্রচলনের সাক্ষ্য দেওয়ার অপরাধে ঐসব বইয়ের লেখকদের প্রতারক হিসাবে সনাক্ত করতে কোনও অসুবিধাই হয় না।
গ্রীকো-রোমক লিপির সঙ্গে ব্রাহ্মী খরোষ্ঠীর এত মিল-অন্য কোনও ব্যাখ্যা কি সম্ভব?
অনেকে প্রশ্ন করে বসবেন গ্রীকো-রোমক লিপির সঙ্গে ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী লিপির এই প্রচণ্ড সাদৃশ্য থাকার ব্যাপারটাকে সন্দেহ করার কি আছে। এমনও তো হতে পারে ঐ ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী লিপি থেকেই গ্রীকো-রোমক লিপির রূপকল্পনার জন্ম হয়েছে। এই আজগুবি কথার উত্তরে বলতেই হয় তা যদি সত্যিসত্যিই হত তাহলে অক্ষর- গুলোকে উল্টেপাল্টে—কখনও দাড়ানো অক্ষরের শোয়ানোর ব্যবস্থা করে—কখনও দক্ষিণমুখী অক্ষরকে বামমুখী করার নানান কায়দা দেখিয়ে তা করা হত না। আর যদি মনে করে নেওয়া যায় ঐ গ্রীকো-রোমক লিপির প্রভাবেই প্রাচীন কালে ভারতে ঐ ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী লিপির জন্ম হয়েছিল তাহলেও তো ঐ একই প্রশ্ন এসে যায়। তা যদি সত্যিই হত তাহলে উল্টোপাল্টা এত কায়দা করার দরকার পড়ত না। সিদ্ধান্ত নিতেই হয় দুটো অনুমানই আজগুবি।
আর একটা কথা। ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী লিপির সঙ্গে গ্রীকো-রোমক লিপির সাদৃশ্য থাকার ব্যাপারটাকে কোন পণ্ডিতই আলোচনার যোগ্য বলে মনে করেননি কেন? দু-একটা অক্ষরের মধ্যে মিল থাকার সুবাদে তথাকথিত ফিনিশীয় বা অ্যারেমেইক উৎসের ভূতুড়ে গল্প বানানোর আয়োজনই বা পণ্ডিতেরা করতে গেলেন কেন?
লিপি কি অপরিবর্তনীয়? – একটি তথ্য।
যত জটিলতাই থাকুক, যত অসম্পূর্ণতাই থাকুক বা যত ঔদ্ভটাই থাকুক নিজের নিজের ভাষার লিপি সম্পর্কে মানুষের অভ্যাসগত একটা সংস্কার গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে একটা মমত্ববোধ—গড়ে ওঠে একটা আত্মীয়তা। এমন একটা আত্মীয়তার ভাব যার সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র ভাষার৷ মানুষ তার নিজের নিজের লিপিকে আঁকড়ে থাকে। (যেমন আঁকড়ে থাকে নিজের নিজের ভাষাকে)। ছাড়তে চায় না৷ সে- লিপির অপরিবর্তনীয়তার ওপরও তার অগাধ বিশ্বাস। বিশ্বাস বেশীর ভাগই অন্ধ৷ তবে ঐ বিশ্বাসের মূলে কাজ করে ব্যবহারিক সুবিধা অসুবিধার প্রশ্নটাই। অ আ ক খ’র ছাত্রদের কথা বাদ দিলে আমরা কেউই বানান করে কিছু পড়িনা। শব্দের বা শব্দগুচ্ছের চিত্ররূপটা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে। আর তাইতেই কাজ হয়। অভ্যস্ত সেই চিত্ররূপের কিছু পরিবর্তন ঘটলেই চোখ থমকে যায়। সেটা বানানবিভ্রাটের জন্যই হোক বা অক্ষরের রূপপরিবর্তনের জন্যই হোক৷ আমরা কোনটাকেই মেনে নিতে চাই না৷ কোনও মানুষই চায়না। এবং চায়না বলেই লিপির পরিবর্তন হয় না। হলেও সামান্য কিছু ঘটে। তাই যে লিপি চালু হয় তাই চলে। না বদলেই বেঁচে থাকে ঐ লিপি। ভাষাভাষীর ঐকমত্যে বা রাষ্ট্রিক সিদ্ধান্তে নিজের লিপি বদলে অন্য লিপি গ্রহণ করার নজীর আছে। লিপির পরিবর্তন নৈব নৈব চ। কালের খেলায় ভাষা বদলায়—মাধ্যম ঐ লিপিটা বদলায় না। লিপির পরিবর্তনের বা তথাকথিত বিবর্তনের যত তত্ত্ব আজ পর্যন্ত তৈরী হয়েছে তা সবই ভ্রান্ত। বর্তমানে চালু লিপির উৎস বলে প্রচারিত তথাকথিত সুপ্রাচীন লিপিগুলোর কোনটারই প্রচলন ছিলনা। দুনিয়ার পণ্ডিতদের ঠকানোর খেলাটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। চলছে। দুনিয়ার তথাকথিত সুপ্রাচীন সব লিপিই ইউরোপের মিথ্যার কারবারীদের বানিয়ে নেওয়া। ‘সুপ্রাচীন’ ঐসব লিপি—আর ঐসব লিপিধৃত সুপ্রাচীন ‘মৃত’-ভাষা—সবই ওঁরা তৈরী করে নিয়েছিলেন। করে নিয়েছিলেন ‘প্রাচীন ইতিহাস’ নামক প্রতারণার ভূতুড়ে উপাদান বানিয়ে রাখার তাগিদে। ঐ হায়েরোগ্লিফিক, ঐ ডিমোটিক, ঐ লিনিয়ার A, B, ঐ কিউনিফর্ম বিশেষণে সবিশেষ প্রত্যেকটি লিপি ওঁদেরই তৈরী। ‘মৃত’ ভাষাও কিছু কম তৈরী করে রাখেননি ওঁরা। ‘মৃত’- বৎসা প্রতিভা যে ওঁদের ছিল এটা মানতেই হয়। তথাকথিত ফিনিশীয় লিপি এবং তার নানান রূপভেদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এ-বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে থাকবে।
প্রাচীন লিপি—উপসংহার
প্রাচীন লিপি সম্পর্কিত আলোচনার মধ্য দিয়ে যেসব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি তা সংক্ষেপে জানানো যাক।
এক. ব্রাহ্মী, খরোষ্ঠী বা ঐ দুই লিপির নানান রূপভেদ ব্যবহার-করা প্রাচীন ভারতের সমস্ত শিলালিপি, তাম্রলিপি প্রত্নমুদ্রাই প্রতারণা। আর ওগুলো প্রতারণা বলেই বলতে হয় ঐসব কিছুর ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকেরা যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা’ নেহাৎই ভ্রান্তি। অন্য কিছু নয়।
দুই. দুনিয়ার প্রাচীন সব লিপিই জালিয়াতি। রোমক এবং গ্রীক লিপির সুপরিকল্পিত সামান্য কিছু বিকৃতিসুকৃতির মধ্য দিয়েই ঐসব তথাকথিত প্রাচীন লিপির রূপকল্পনার জন্ম হয়েছিল। জন্ম হয়েছিল আধুনিক কালেই। তথাকথিত হায়েরোগ্লিফিক বা কিউনিফর্ম (কীলকাকৃতি) লিপিতে গ্রীকো রোমক লিপির প্রভাবনিরপেক্ষ বেশ কিছু ‘মৌলিক’ চিহ্ন সৃষ্টির আয়োজন হলেও প্রথমোক্ত লিপিটিতে দু-একটা গ্রীকোরোমক লিপির অক্ষরের সন্ধান পেতে কোনও অসুবিধাই হয় না। H+XUV সবই আছে ঐ লিপিতে৷
তিন. ঐসব লিপিই আধুনিক ইউরোপের ভাড়াটে নেপথ্য পণ্ডিতদের তৈরী করে নেওয়া। ওসব যে আধুনিক- কালে বানিয়ে নেওয়া তার প্রমাণ হিসাবে শুধু এইটুকুই বলব প্রাচীন ইতিহাস লেখার পরিকল্পনার জন্মই হয়েছিল আধুনিক কালে। প্রাচীনকালে নয়।
চার. ধাতব, মৃন্ময় বা পাথুরে ‘লিখিত’ প্ৰমাণ রাখার দরকার পড়েছিল বানানো প্রাচীন ইতিহাস-এর তথ্যসমৃদ্ধ প্রত্ন-উপকরণ বানানোর তাগিদে।
পাঁচ. জাল লিপির মাধ্যম ব্যবহার করা শিলালিপি-তাম্রলিপি -চোঙালিপি (cylinder seal)- মৃন্ময়লিপি সবই জাল। ঐসব ‘প্রত্ন-উপকরণ’ যদি সত্যই প্রাচীনকালের হত তবে নিশ্চয় আধুনিককালে তৈরী করে নেওয়া জাল লিপিতে ওসব ‘লেখা’র দরকার পড়ত না। অজাত লিপিতে কিছু খোদাই করে রাখার তথ্যটাই আজগুবি।
ছয়. ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর অর্থানুকূল্য ছাড়া লিপিঘটিত মিথ্যাসৃষ্টির ব্যয়সাপেক্ষ কর্মকাণ্ড সম্ভবই হতনা। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকাকে একটু বড় করেই দেখার দরকার আছে। কারণ ঐসব রাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগেই ঐ ‘ইতিহাস’-টা বানানো হয়েছিল। ঐ ধরণের নেপথ্য কাজকর্মে—জাল লিপি এবং জাললিপির মাধ্যমে প্রকাশ করা বিপুল পরিমাণ প্রত্নউপকরণ বানিয়ে রাখার কর্মকাণ্ডে – খরচ কম হওয়ার কথা নয়।
সাত. ঐসব জাললিপির ‘উদ্ভাবকদের নামঠিকানা জানার উপায় না থাকলেও ঐসব লিপি সম্পর্কে রাজ্যের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার কর্মকাণ্ডে জড়িত পণ্ডিতদের নামধাম সবারই জানা। এঁদের সনাক্ত করে নিতে কোনও অসুবিধাই হয়না। বুঝতে কষ্ট হয়না এই সুমহান কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পণ্ডিতদের সকলেই ছিলেন রাষ্ট্রপোষ্য জীব। প্রচণ্ড পাণ্ডিত্যের ছদ্মবেশের আড়ালে ঐসব পণ্ডিত রাষ্ট্রের ইন্টেলেকচুয়াল প্রস্টিটিউট-এর ভূমিকা পালন করেছিলেন।
আট. ব্যক্তিবিশেষের কিংবা কয়েকজন পণ্ডিতের সত্যানুসন্ধিৎসার তাগিদে ভূতের বাবার শ্রাদ্ধ হয়না। নানান রাষ্ট্রের নীতিঘটিত এবং আর্থিক মদৎ না পেলে প্রাচীন ইতিহাস লেখার রাজসূয় কর্মকাণ্ড শুরুই হতনা।
মোট কথা প্রাচীন ইতিহাসের ধাতব বা পাথুরে ‘প্রমাণের অসারত্ব প্রমাণ করার জন্যই লিপিঘটিত আলোচনাটা রেখেছি। আলোচনাটা রেখেছি প্রাচীন লিপির বুজরুকিটা বোঝানোর জন্যই। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের অশোক-চন্দ্রগুপ্ত-কনিষ্কদের ঐতিহাসিকত্ব নির্ভর করছে ভূতুড়ে লিপিতে খোদাই করা ভূতুড়ে শিলালিপির ওপরেই। দারয়বৌস খারয়বৌসদের সম্পর্কেও ঐ একই কথা খাটে। একই কথা খাটে দুনিয়ার তাবৎ প্রাচীন ‘ঐতিহাসিক’ চরিত্রগুলোর সম্পর্কেই। এর পরেও যাঁরা বলবেন ওঁরা সব ঐতিহাসিক পুরুষ— ওঁরা সব প্রামাণ্য ব্যক্তিত্ব—তাঁরা নেহাৎই অনুকম্পার পাত্র৷
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।