৭১২ সালে মুসলিম দের স্পেন বিজয় ছিল বিশ্ব ইতিহাসের একটি গৌরবােজ্জ্বল ঘটনা। গথিক রাজা রডারিকের কুশাসনে সমগ্র স্পেনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থায় এক চরম অরাজকতা দেখা দেয়। এমনই এক সংকটময় পরিস্থিতিতে রাজা রডারিক সিউটার অধিপতি কাউন্ট জুলিয়ানের অপরূপ সুন্দরী কন্যা ফ্লোরিডার শ্লীলতাহানি করলে কাউন্ট জুলিয়ান এর প্রতিশােধ গ্রহণ করার জন্য উত্তর আফ্রিকার উমাইয়া প্রাদেশিক শাসনকর্তা মুসা বিন নুসাইরকে স্পেন আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। মুসলমানরা বহুদিন ধরে ইউরােপ জয়ের আশা করত। খলিফা মুয়াবিয়ার শাসনামলে (৬৬১-৮০) ভূমধ্যসাগরের তিনটি দ্বীপ মুসলমানদের দখলে আসে এবং সেখানে নৌ তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। কাউন্ট জুলিয়ানের সে আহ্বান মুসলিম দের সামনে ইউরােপ জয়ের চরম সুযােগ এনে দেয়। মুসা এ সুযােগ কাজে লাগানাের জন্য উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের (৭০৫-৭১৫) কাছে স্পেন জয়ের অনুমতি চান। খলিফার অনুমতি পেয়ে মুসা বিন নুসাইর ৭১১ সালে তারিকের নেতৃত্বে স্পেনের দিকে অভিযান প্রেরণ করেন এবং এক বছরের মধ্যে স্পেন মুসলিমদের করতলগত হয়। স্পেনের ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
এই বিজয় সমগ্র ইউরােপে এক আলােড়ন সৃষ্টি করে। ইউরােপ তথা মানব সভ্যতার বিকাশের জন্য স্পেন বিজয় ছিল সুদুরপ্রসারী। মুসলিম স্পেনের রাজধানী কর্ডোভাসহ টলেডাে, গ্রানাডা, সেভিল প্রভৃতি নগরী সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। স্থাপত্য, শিল্পকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে স্পেনীয় মুসলিম বা মূরগণ অসামান্য অবদান রাখেন। ফিলিপ কে হিট্টি বলেন,
‘মধ্যযুগীয় ইউরােপের বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাসে স্পেন একটি গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে।’
দীর্ঘ প্রায় সাড়ে সাতশ (৭১২-১৪৯২) বছরেরও বেশী সময় ধরে স্পেন মুসলিম শাসনাধীনে ছিল। ইউরােপের বুকে জ্ঞানবিজ্ঞানে সমৃদ্ধ একমাত্র ভূখণ্ড ছিল বলে স্পেন সমকালীন ইউরােপকে পথ দেখিয়েছে। স্পেন যখন সভ্যতা ও সংস্কৃতিচর্চায় নিমগ্ন তখন ইউরােপ অজ্ঞতা-বর্বরতায় প্রযুক্ত। লেনপুল উল্লেখ করেছেন তখন গােটা ইউরােপ বর্বর অজ্ঞতা ও বুনাে ব্যবহারে নিমজ্জিত ছিল। মুসলিম শাসনামলে স্পেন ব্যাপক উন্নতি করে। স্পেনীয় মুসলিম দের মাধ্যমে সর্বপ্রথম কাগজ ইউরােপে প্রসার লাভ করে। যখন লণ্ডন শহরে লােকসংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ, তখন কর্ডোভা নগরীর লােকসংখ্যা ছিল দশ লক্ষ। আসলে স্পেন বিজয়ের ফলে শুধু স্পেনেই নয়, সমগ্র ইউরােপে এক নবজীবনের সূচনা করে, যা পরে ইউরােপে নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটায়। ফলে সংঘটিত হয় বিজাগরণ। স্মর্তব্য যে, অষ্টম শতকের মধ্যভাগ হতে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরবীয়রাই ছিল বিশ্ব সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রধান মশাল বাহক। তাদের মাধ্যমেই প্রাচীন বিজ্ঞান-দর্শনের পুনরুদ্ধার হল, নব নব আবিষ্কারও হল, সারা বিধে তার প্রচারও হল। ফলে বিজ্ঞান আজও পৃথিবীতে বেঁচে আছে। আর এই সমস্ত কর্মকাণ্ডে মুসলিম স্পেন অগ্রদূত্রে ভূমিকা পালন করেছিল। অনেকক্ষেত্রে তারাই আবার ছিলেন পথিকৃৎ।
ইসলাম ও বিজ্ঞান
মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও তার বাহক নবী হজরত মােহাম্মদের (সঃ) শিক্ষা আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিম দুনিয়া সর্ব ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। পন্ডিত আর ম্যারগােলিউথ বলেন, কুরআনের স্বাতন্ত্র নতুন সাহিত্য এবং দর্শনের বীজ বপন করেছিল। ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের মেধা অন্বেষী মনকে কর্ষণ করে মধ্যযুগে প্রবলভাবে তাদের প্রভাবিত করেছিল পবিত্র কুরআন। মুসলিম বিশ্বের অগ্রগতি ছিল বাধাপ্রাপ্ত কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় যে, ইউরােপীয়রা যখন বর্বরতার পর্যায়ে, তখন মুসলমানদের দর্শন, অংকবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যা ইউরােপীয়দের নতুন আলাে দেখায় যা তারা কয়েক শতাব্দী চেষ্টা করেও নাগাল পায়নি। ল্যাটিন মূলত আরবীর কাছেই ঋণী এবং কুরআনের শিক্ষা পরােক্ষ ভাবে আরববাসী এবং তাদের প্রতিবেশীগণ গ্রহণ করে। পবিত্র কুরআনের শব্দ-ব্যঞ্জনা, কবিতা অথবা সাহিত্যের যে কোনও ক্ষেত্রে কুরআনের পরােক্ষ প্রভাব ও প্রতাপ তাদেরকে সত্যিকার জ্ঞানী এবং শিক্ষিত করে তুলেছিল। বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ ইমানুয়েল ডােটস্ এর মতে, একটি গ্রন্থ দিয়ে আরবরা সমস্ত বিজয় করেছিলেন, যা ছিল মহান আলেকজান্ডারের বিজয়ের চেয়েও মহান রােম বিজয়ের চেয়েও বিস্ময়কর।
অথচ এ যুগের কিছু মন-মানসিকতায় এ-কথা আবর্তিত যে, বিজ্ঞান এমন একটা বিষয় যার সঙ্গে ইসলাম ও কুরআনের কোনও সম্পর্ক নেই। ইসলাম বিজ্ঞানের বিরােধিতা করে। বিজ্ঞানের গবেষণা-আবিষ্কার ইসলামি দর্শন ও চিন্তাধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল নয়। অভিযােগকারীরা ইসলামের বিরুদ্ধে এই ধরনের ধারণা প্রচার করতে থাকে অহরহ। বিষােদগার পূর্ণ কথাবার্তায় সর্বদা আহত করতে থাকে ইসলামের অনুসারীদের। সাথে সাথে ইসলাম-বিরােধীদের এই ধরনের প্রােপাগাণ্ডা ও প্রচারে মুসলমানরা হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকে এবং নিজেদেরকে অনগ্রসর ও পশ্চাৎপদ সম্প্রদায় হিসাবে মনে করতে থাকে।
তাহলে যে কুরআনের বিরুদ্ধে তাদের এত অভিযােগ সেই কুরআন এবার খতিয়ে দেখা যাক। বস্তুত গােটা কুরআনে এমন একটি বাক্যও নেই যা বিজ্ঞানী-বিরােধী। বরং কুরআনে এমন অসংখ্য বাক্য রয়েছে যেসবে এই বিশ্বব্যবস্থাকে উপলব্ধি করার, তা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করার এবং প্রাকৃতিক ঘটনাবলী ও দৃশ্যাবলী পর্যবেক্ষণ করার আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছে। কুরআনই প্রথম গ্রন্থ যাতে দৃশ্যমান প্রকৃতি সম্বন্ধেগভীর গবেষণা করার ও তা থেকে উপকৃত হওয়ার এবং এর উদ্দেশ্য-লক্ষকে উপলব্ধি করে এ থেকে ফায়দা অর্জন করার হুকুম দেওয়া হয়েছে।
নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মানবজাতি যখন ইতিহাসের পথ পরিক্রম করছিল, জ্ঞান-বিজ্ঞান যখন অবহেলিত ছিল, বিদ্যাচর্চা যখন অন্যায় বা পাপ বলে বিবেচিত হত, পৃথিবীকে গােলাকার বলা যখন অপরাধ ছিল, জ্ঞানচর্চার অপরাধে হিপাসিয়াএর দেহকে আলেকজান্দ্রিয়ার গীর্জায় খন্ড-বিখন্ড করা হয়েছিল, গ্যালিলিওকে আত্মহুতি দিতে হয়েছিল রােমের গীর্জায়, বিবর্তনবাদে বিশ্বাসের জন্য বিজ্ঞানী ভেনিনি-এর জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল ও আগুনে জীবন্ত পুড়ে হত্যা করা হয়েছিল, যখন মহান গ্রেগরি রােম হতে সকল শিক্ষিত লােককে বহিষ্কৃত করেছিলেন, অগাষ্টাসের বিখ্যাত দর্শনশাস্ত্রের পাঠাগারে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং গ্রীক-রােমান গ্রন্থপাঠ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিল, সেই অন্ধকার ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগ-সন্ধিক্ষণে ইসলাম শান্তি, শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার আলােকবর্তিকা নিয়ে পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয় এবং কুসংস্কার ভেঙে চুরমার করে প্রতিষ্ঠিত করে জ্ঞানের মহাসমুদ্র। আবহমানকাল ধরে মানুষের একটা ধারণা ছিল যে, বিজ্ঞান ধর্ম থেকে পৃথক বিষয়। কিন্তু ইসলাম সে ধারণাকে পদাঘাত করে বিজ্ঞানকে ধর্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশের স্থান দিয়েছে। তাই ফরাসী বিজ্ঞানী মরিস বুকাইলী অকুণ্ঠচিত্তে বলেন, ইসলামে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে যমজ বােন হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি আরও বলেন, কুরআনে অগ্রহণযােগ্য, অ-বৈজ্ঞানিক বিবৃতি পাওয়া যায় না।
কুরআনের বাক্যসমূহ লক্ষ করলে দেখা যায় আকাশ, চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র, গ্রহ, পাহাড়, সমুদ্র, নদনদী, জীবজন্তু এমনকী আকাশ ও পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রতিটি বস্তু ও বিষয়ের প্রতি ভাবনাচিন্তা ও গবেষণা করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বার বার কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে তবে কি তারা উটের প্রতি লক্ষ করে না, কিভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছে? আর লক্ষ করে না কি আসমানের দিকে, কিভাবে তা উর্ধ্বে স্থাপন করা হয়েছে? এবং পর্বতমালার দিকে, কিভাবে তা শক্ত করে দাঁড় করানাে হয়েছে এবং স্থলভাগের দিকে, কিভাবে তা সমতলে বিছানাে হয়েছে?’ (সূরা গাশিয়া ১৭-২০)
কুরআনে বলা হয়েছে ‘আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত্রি-দিনের পরিবর্তনে, মানুষের উপকারে যা লাগে তা দিয়ে জাহাজের সমুদ্রযাত্রায়, সেই বৃষ্টি যা আল্লাহ্ আকাশ থেকে বর্ষণ করেন, যার দ্বারা মৃত পৃথিবীকে পুনরুজ্জীবিত করেন ও সেখানে যাবতীয় জীবজন্তুর বিস্তার ঘটান, সেই বায়ুপ্রবাহের পরিবর্তনে এবং আকাশ ও পৃথিবীর সেবায় নিয়ােজিত সেই মেঘমালায়—জ্ঞানী লােকদের জন্য তাে বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা বাক্রা ১৬৪) ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তােমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। এখন তােমরা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছ।…চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম নিদর্শন, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তােমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা রূম ২০-২২) ‘দিন ও রাত্রির পরিবর্তনে এবং আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীতে যা সৃষ্টি করেছেন তাতে সাবধানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা ইউসূফ ৬)।
কুরআন থেকে মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হল এখানে। কিন্তু কুরআনে রয়েছে আরও এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত। এসব বাক্যে একথা স্পষ্টায়িত হয়েছে যে, এই বিজগতে রয়েছে আল্লাহর অগণিত নিদর্শন। এসব নিদর্শন জ্ঞানী ব্যক্তিদের সােজা-সরল পথ প্রদর্শন করে। এসব নিদর্শন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে কুরআনে। নােবেল জয়ী বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম বলছেন,
“কুরআনে প্রাকৃতিক নিয়মাবলীর উপর জোর দেওয়া হয়েছে। কাজেই আমার বিজ্ঞান সংক্রান্ত ধারণায় ইসলামের এক মস্ত অবদান রয়েছে।”
আব্দুস সালাম জোর দিয়ে আরও বলেন,
“৭৫০ থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানচর্চার প্রায় পুরােটাই হয়েছিল ইসলামী ছত্রছায়ায়, আমি সেই পতাকারই বাহক মাত্র।”
উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে আব্দুস সালাম ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণ শেষে কেউ তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, এখন তিনি কি নিয়ে কাজ করছেন? উত্তরে তিনি দুটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন। এক হচ্ছে—বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশকে কাজে লাগিয়ে তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলিকে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নত করার পরিকল্পনা রচনা এবং দুই হচ্ছে—কুরআনে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ইঙ্গিত বহনকারী যে সব বাক্যগুলি আছে ব্যাখ্যাসহ তার সংকলন বের করা। আব্দুস সালামের সেই ধরনের কোনও সংকলন বের হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সায়েন্টিফিক ইন্ডিকেশনস ইন দ্য হলি কুরআন’ আমরা সংগ্রহ করতে পারি। এসব অধ্যয়ন করার পর কি বলা যেতে পারে যে ইসলাম বিজ্ঞান-বিরােধী। বরং ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিমরাই বিজ্ঞানের শাখাগুলিকে নানাভাবে পুষ্ট করেছে।
জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র : কর্ডোভা গ্রানাডা টলেডাে সেভিল
গ্রিস ও রােমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলতে আমরা যা পেয়েছি, তা ছিল রাজনৈতিক সংগঠন এবং অন্যদিকে ছিল নাটকের মহা সমারােহ। সেখানে স্পেনীয় মুসলিম মূরবাসীদের আমরা কী বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলাম। তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল জ্ঞানচর্চা। এই জ্ঞানচর্চাকে পরিপুষ্টতা দান করতে তারা নেমে পড়েছিলেন পুস্তক সংগ্রহে। দেশ-বিদেশ হতে পুস্তক সংগ্রহ করাটা তাঁদের জীবনের পেশা ছাড়িয়ে যেন নেশাতে পরিণত হয়েছিল। সারা বিশ্ব ইতিহাসে এ চিত্র সত্যিই বিরল। খলিফাগণ কোন গুণে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই পিপাসাকে এত তীব্রভাবে জাগিয়ে তুলেছিলেন, যা চিন্তা করা যায় না। ফলে বাগদাদ, কনস্টান্টিনােপল, কর্ডোভায় মুসলিম উৎকর্ষতা চরম বিকাশ লাভ করে। তবে স্পেনের রাজধানী কর্ডোভা ছিল স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী। কর্ডোভার সভ্যতা আর জ্ঞানশিক্ষা সমগ্র ইউরােপে রবিরমির ন্যায় বিকীর্ণ হত। যখন কর্ডোভার ঘরে ঘরে মানুষ লিখতে ও পড়তে পারে, তখন ইউরােপে শিক্ষার জন্য সবে মাত্র আলােচনা শুরুর যুগ। তাও আবার কয়েকজন যাজকমাত্রই ওই সুযােগ পেয়েছিলেন। তদানীন্তন বিশ্বে বাগদাদ, কনস্টান্টিনােপল ও কর্ডোভাই ছিল বিধের সভ্যতার পীঠস্থান। কিন্তু কর্ডোভার সভ্যতা যেন সবাইকে অতিক্রম করেছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে কর্ডোভার খ্যাতি ছিল বিশ্ববিখ্যাত। মনে হয় এর মূলে ছিল মহানবী হজরত মােহাম্মদের (সঃ) একটি বাণী—প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য জ্ঞানার্জন ফরজ বা অবশ্যই কর্তব্য।
ইউসুফ আল হাজ্জাজ গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন (১৩৩৩-১৩৪৪) করেন। প্রথম উপাচার্যরূপে যােগদান করেন একজন বড় কবি ও ঐতিহাসিক ইবনুল খাতিব (১৩১৩-১৩৭৪)। এর পাঠ্যক্রম জ্ঞানচর্চার সকল দিককে পরিব্যাপ্ত করেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে যে জিনিসটি লেখা ছিল—“বিশ্ব যে চারটি জিনিসের ভিত্তিতে চিরদিন দাঁড়িয়ে আছে ও থাকবে—শিক্ষা, ন্যায়বিচার, প্রার্থনা ও বীরত্ব। প্রথম মহম্মদ (৮৫২-৫৬) কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ করেন এবং তৃতীয় আব্দুর রহমান (৯২১-৯৬১) তা সমাপ্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গ্রন্থাগার ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় হাকাম (৯৬১-৯৭৬) যখন তার নিজস্ব বিশাল গ্রন্থাগার বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন, তখন কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটি বিধের সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থাগারে পরিণত হয়। এটা ছিল স্পেনের মূল সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। শাহী গ্রন্থাগার ছাড়াও কর্ডোভায় ৭০টি বড় বড় লাইব্রেরী ছিল। এছাড়া স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদে ছিল লাইব্রেরী। ব্যক্তিগত ও গণ-গ্রন্থাগার, প্রাদেশিক গ্রন্থাগার সব মিলিয়ে গােটা স্পেন ছিল একটা বইয়ের বাজার। স্পেনে বই সংগ্রহের বিষয়টি মােটামুটিভাবে জাতীয় ‘হবি’ হিসেবে বিস্তার লাভ করেছিল। কর্ডোভায় তা সামাজিক কর্তব্য হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল। ইতিহাসবেত্তা ইবনে সাঈদ তাঁর পিতাকে বলতে শুনেছিলেন যে, কর্ডোভা ছিল বইয়ের বাজারের সেরা শহর, কারণ এখানকার অধিবাসীরা গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে খুবই ভালবাসতেন। এই সকল প্রামাণ্য হতে আঁচ করা যায়, মুসলিম স্পেন সংস্কৃতিতে কতটুকু উন্নতি লাভ করেছিল। এখানে জ্ঞানচর্চা এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, প্রসিদ্ধ ওলন্দাজ ঐতিহাসিক ডােজি তার বিখ্যাত ‘স্পাইনিস ইসলাম’ গ্রন্থে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন যে, স্পেনের প্রতিটি নাগরিক লেখাপড়া জানত।।
ঐতিহাসিক আল-মাককারি বর্ণনা করেছেন যে, ১১৩০০০টি গৃহাবাস, ২১টি শহরতলি, বহু গ্রন্থাগার, বহু গ্রন্থ-বিপনি, মসজিদ ও প্রাসাদে সুশােভিত হয়ে ‘কর্ডোভা’ শহরটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল ও পর্যটকদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা-প্রশংসার উদ্রেক করেছিল। সূর্যাস্তের পর একজন ব্যক্তি সরকারি দীপালােকে এর মজবুত বাঁধানাে রাস্তায় সরলরেখার দশ মাইল পথও হেঁটে যেতে পারত। ঐতিহাসিক জন ডব্লিউ ড্রেপার তার ‘A History of Intellectual Development of Europe’ গ্রন্থে (Vol.-2, London) স্বীকার করেছেন এই সময়ের সাতশ বছর পর লন্ডন শহরে সে রকম একটিও দীপালােক ছিল না এবং পরবর্তী বহু শতাব্দীর পর প্যারিসে বর্ষার দিনে যে তার বাড়ির দ্বার থেকে বাইরে পা বাড়াত তার পায়ের গুলফ পর্যন্ত কাদায় ডুবে যেত। অন্যান্য শহর যেমন গ্রানাডা, সেভিল ও টলেডাে নিজেদের কর্ডোভার প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করত।
কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা লাভের এক বিরাট উৎস ছিল এবং এখানে হাজার হাজার ছাত্র তাদের জ্ঞান-পিপাসা নিবৃত্ত করার জন্যে দলে দলে ধাবমান হত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কিছু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যুক্ত থাকত। শিক্ষা ছিল প্রায় আবশ্যিক ও সার্বজনীন। ৮০০ সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থী মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টান সকলে পড়াশােনা করত।
এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরােপের পণ্ডিত ব্যক্তিগণ গ্রানাডা, সেভিল ও কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় সমূহকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। পাঠক্রমের মধ্যে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা, যথার্থ বিজ্ঞানসমূহ, চিকিৎসা, সঙ্গীত, কাব্য ও কলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান নির্বিশেষে বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয়ের বিভাগীয় প্রধানের পদ অলংকৃত করতেন। বিভিন্ন পাঠক্রমের অধ্যয়নের সফল সমাপ্তির পর শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি প্রদান করা হত। চিকিৎসা বিভাগে শিক্ষার্থীদের মেধা পরীক্ষার জন্য কঠিন ও প্রলম্বিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হত। পরীক্ষায় সফল শিক্ষার্থীদের পেশাগত অনুশীলনের জন্যে ডিগ্রি প্রদান করা হত। যাঁরা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হত তারা অযােগ্য বলে ঘােষিত হত। শল্য চিকিৎসা ও ঔষধপত্রের উপর শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতগণ বিশালাকারের গবেষণাধর্মী নিবন্ধাদি রচনা করতেন।
কর্ডোভা সম্পর্কে লেনপুল লিখেছেন, কর্ডোভা নগরী যেমন সুন্দর ছিল, দেহের মত তার মনটিও ছিল সুন্দর। তার অধ্যাপক শিক্ষকগণ তাকে ইউরােপীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। ইউরােপের সকল অংশ থেকে শিক্ষার্থীরা সেখানে তার প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞদের অধীনে থেকে অধ্যয়ন করতে আসত। একটি অবিশ্বাস্য বিষয় এই যে, যখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নান করাটাকে ধর্মহীনতা ও অসভ্যতা বলে গণ্য করা হচ্ছে, তখন কর্ডোভার বিজ্ঞানীরা বিলাসবহুল স্নানাগারে স্নান করছেন। বার্সিলােনার শাসকগণ যখনই তাদের প্রয়ােজন পড়ত কোনাে শল্যবিদ, স্থপতি, সংগীত শিল্পী বা পােষাক ডিজাইনার, তখনই কর্ডোভার শরণাপন্ন হতেন। সমগ্র ইউরােপকে এরা আলাে দান করত। কর্ডোভার যশােগাঁথা দেখে সুদূর জার্মানীর এক মঠবাসী সন্নাসিনী মুগ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘Cordova : The Jewel of the World.’ সেখানে বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখায় গভীরভাবে। পড়াশােনার কাজ চলত। গ্যালেনার যুগ থেকে পরবর্তী কয়েকশ বছরে চিকিৎসাশাস্ত্রে যা সংযােজিত হয়েছে স্পেনের চিকিৎসক ও সার্জেনদের আবিষ্কারের ফলে তার থেকে অধিকতর ও বৃহত্তর সংযােজন হয়েছিল। কর্ডোভায় জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগােল, রসায়নবিদ্যা, প্রাকৃতিক ইতিহাস—সকল বিষয় উদ্দীপনার সঙ্গে অধ্যয়নের কাজ চলত।
সমগ্র আরব জগতের জ্ঞান ভাণ্ডারকে পশ্চিম দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার মূলে টলেডাের অবদান চিরস্মরণীয়। যখনই মুসলিম স্পেনে দুর্বল রাজন্য যুগ আরম্ভ হল (১০০২-১২৩৮), তখন হতে খ্রিস্টান শক্তি মাথাচাড়া দিতে আরম্ভ করে। এই সময় টলেডাে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি বিশেষ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে খ্রিস্টান অনুবাদকেরা রীতিমতাে ভীড় জমাতেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতেই তারা আসতেন। বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জ হতে মাইকেল স্কট (১২৩৬) ও চেস্টার থেকে রবার্ট এখানে এসেছিলেন। ১১৪৩ সালে রবার্ট ল্যাটিন ভাষাতে কুরআনের অনুবাদ করেন। সমগ্র ইউরােপের মধ্যে ১২৫০ সালে টলেডােতেই সর্বপ্রথম অনুবাদ করার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
১২২৬ সালে অ্যাডেলার্ড আল মাজরিতির জ্যোতির্বিদ্যার সারণিটি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যার আরও কিছু বই অনুবাদ করেছিলেন। অনুবাদকদের দীর্ঘ সারিতে তিনিই ছিলেন প্রথম। মাইকেল স্কট ছিলেন ল্যাটিন অ্যাভােরােইজমের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ইবনে রুশদের বহু গ্রন্থ অনুবাদ করেন। এককথায় অনুবাদ জগতে তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। অনুবাদ জগতে আরও একটি নক্ষত্র পাই, যার নাম জেরার্ড (১১৮৭)। তিনি ৭১টি আরবি পুস্তক ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। অনুবাদ সাহিত্যে যাঁরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ইহুদিগণ ছিলেন অগ্রগণ্য, যেমন টলেডাের আব্রাহাম বেন এজরা (১১৬৯), একজন ক্ষণজন্মা অনুবাদক। তিনি পাটিগণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, দর্শন, চিকিৎসা প্রভৃতি নানা বিষয়ে নানা পুস্তক অনুবাদ করে টলেডাের অনুবাদ জগৎকে সমৃদ্ধি দান করেছিলেন।
টলেডাের অনুবাদ সমগ্র ইউরােপকে, প্লাবিত করেছিল। এটা ছিল ত্রয়ােদশ শতকের শেষদিক। এই ধারা প্রবাহিত হয়েছিল টলেডাে হতে পিরেনিজ, আলপাইন হতে লােরেন, জার্মানি, মধ্য ইউরােপ ও ইংল্যাণ্ড দক্ষিণ ফ্রান্সের মার্সেই, যেখানে বসে। রেমণ্ড ১১৪০ খ্রিস্টাব্দে টলেডাের সারণির উপর ভিত্তি করেই গ্রহ-নক্ষত্রের তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। ১১৬০তে আব্রাহাম বেন এজরা আলবেরুনীর ভাষ্যের অনুবাদ করেছিলেন। ১১৪১-৪৩-এর মধ্যে পিটার দ্য ভেনারেবল ইসলাম বিরােধী বহু অকথ্য বই প্রণয়ন করার সঙ্গে ল্যাটিনে কুরআনের অনুবাদও বের করেন। দশম শতাব্দীতে লােরেন শহরে আরবি বিজ্ঞানের প্রচলন হয়, এ কাজ দুশাে বছর ধরে চলতে থাকে। লােরেনের পাশাপাশি লিজ, জর্জ ও কোলনও হয়ে ওঠে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রভূমি। পরে লােরেন থেকে জার্মানির সকল শহরে এ দ্বীপশিখা জ্বলে উঠেছিল। এই জ্ঞানচর্চা পরে নানাদিকে বিস্তারিত হতে থাকে। মুসলিম স্পেনের সঙ্গে বহু দেশের দূত বিনিময়ও হয়েছিল। ওই সমস্ত দূতগণ কেবল রাজনৈতিক কচকচানি নিয়েই মেতে থাকতেন না, তাঁরা জ্ঞানচর্চাও করতেন।
নব সংস্কৃতির জন্ম
ফরাসী চিন্তানায়ক রেনান তার পছন্দের কথা নিজ গ্রন্থ ‘Averroes at Averroism’-এ বলেছেন এভাবে,
“পৃথিবীর এই বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অঞ্চলে দশম শতকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ এমন এক সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠিত করেছিল যা আধুনিককালে কদাচিৎ তার উদাহরণ মেলে। খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলমানরা একই ভাষায় কথা বলত, একই গান গাইত এবং সাহিত্য-বিজ্ঞান বিষয়ক পড়াশােনায় অংশগ্রহণ করত। যে সকল বাধা বিভিন্ন জনগােষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করে—সেগুলি মুছে দিয়েছিল এবং সকলে মিলে মিশে এক সাধারণ সভ্যতার বিকাশে আত্মনিয়ােগ করেছিল। যেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ভিড় জমত কর্ডোভার সেই মসজিদগুলি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার সক্রিয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।”
মুসলিম স্পেনের প্রভাব ইউরােপের সাহিত্যে, দর্শনশাস্ত্রে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে ছিল ব্যাপক। কর্ডোভার সুমার্জিত সমাজ এই উজ্জ্বল সংস্কৃতি লালন করে আত্মগৌরব অনুভব করত। এর প্রভাবমূর-ভূখণ্ড অতিক্রম করে পাবর্ত্য সীমানার বাইরের ভূখণ্ডসমূহে বিস্তৃত হয়েছিল। ফ্রান্সের দক্ষিণ অঞ্চল মূর সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের সুরে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠত। এমনকি ইতালি ও সিসিলিতে প্রেম-সঙ্গ শীত রচনা একটি প্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছিল এবং এরকম আনন্দময় ও অ-ধর্মান্ধ সূচনাসমূহের ভিত্তি করে আধুনিক ইউরােপে রােমান্স সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছিল। মুসলিম স্পেন বীরপনা বা শিভালরি যুগের উদ্বোধন ঘটিয়েছিল এবং এর প্রভাব ইউরােপের অন্যান্য ভূখণ্ডসমূহে বিস্তৃত হয়ে কাব্যের এক নতুন রীতি ও নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল।
ইউরােপে মুসলিম সভ্যতা প্রবেশের প্রধান প্রধান মাধ্যম ছিল স্পেনীয় শিক্ষক ও ব্যবসায়ীগণ এবং সিসিলি ও আফ্রিকার মুসলমান। ইউরােপে মুসলিম প্রভাবের অনুপ্রবেশের অন্যান্য মাধ্যমও ছিল। মুসলমানরা যে বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছিল তা স্পেনের সুখ-শান্তি ও কল্যাণের জন্য অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় ছিল। খ্রিস্টানরা একদিন তাদের ভূখণ্ডটিকে পুনরাধিকার করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত ইউরােপ থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করেছিল, কিন্তু মুসলিম সংস্কৃতি-সভ্যতা ইউরােপীয় জীবনের প্রত্যেকটি দিককে প্রভাবিত করেছিল। কেবল সান্নিধ্যে বসবাসের জন্যে নয়, এই প্রভাব খ্রিস্টান ও মুসলমানদের সাধারণ স্বার্থের পরিপােষণের জন্যেও ছিল। বিশেষ করে খ্রিস্টান দাসেরা যারা পালিয়ে স্বগৃহে ফিরে গিয়েছিল তারা প্রায় সর্বদা তাদের আরবীয় নাম ও সংস্কৃতি বহাল রেখেছিল। খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাতের কাজ চলত এবং গৃহযুদ্ধের সময় পরস্পর পরস্পরের সাহায্য করত। শেষের যুদ্ধ বিগ্রহগুলিতে সবসময় উভয়পথের যােদ্ধাদের মধ্যে আপাতত খ্রিস্টান ও মুসলমানের সংমিশ্রণ ছিল। ইউরােপীয় মুসলমানরা খ্রিস্টান দেশগুলির সঙ্গে স্থলপথে জলপথে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। ইউরােপের বড় বড় প্রত্যেকটি শহরে খ্রিস্টান ক্রেতারা তাদের পণ্যদ্রব্য খরিদ করত। মুসলমান ও ইহুদি বণিকগণ দৈনিক যােগাযােগের মাধ্যমে তাদের খ্রিস্টান ক্রেতাদের আরবীয় আচারআচরণ ও রীতিনীতি শিক্ষা দিত। সমাজের কেবল নীচুস্তরে নয়, উঁচুস্তরেও অসবর্ণ বিবাহ প্রচলিত ছিল। আমির আলি তার ‘The Spirit of Islam’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘উচ্চতম শ্রেণির স্পেনীয় রমনীরা যাঁদের মধ্যে পিলাজিয়াসের ভগ্নি এবং রডারিকের কন্যা। ছিল, তারা অবিশ্বাসীদের সঙ্গে বিবাহ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল, গোঁড়া ধর্মবিধাসী জীন মারিয়ানা এভাবে মুসলমানদের অভিহিত করতেন।’
মুসলমানরা তাদের অধীনস্থ প্রজাদের ঘৃণা করা তাে দূরের কথা, তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির শুরুতে তারা বিজিত জাতিকে তাদের বৌদ্ধিক গুরু বলে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে স্পেনে এবং অন্যান্য দেশেও সম্পর্কটি একেবারে বিপরীত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু স্পেনের মুসলমানদের অধীনে ইহুদিদের জ্ঞানচর্চার প্রভূত সুযােগ-সুবিধা ছিল। বেন এজরা, জোনাহ বেন গান্নাক, মাইমােনীয় বেচাল ও ডেভিড কুইনচির মত বিদগ্ধ ইহুদিগণ ইউরােপের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করতেন এবং তাঁরা যেখানেই যেতেন মুসলমান সভ্যতার মশাল বহন করে নিয়ে যেতেন।
আরবি ভাষার মাধুর্য ইহুদিদের এমনভাবে আকৃষ্ট করেছিল যে, তাঁরা আরবি ভাষাকে উদ্দীপনার সঙ্গে শিখেছিল এবং তাদের নিজেদের ভাষা ল্যাটিন ও রােমানকে ভুলেই গিয়েছিল। ১০৪৯-এ সেভিলে বাইবেলের আরবি অনুবাদ হয়েছিল। মুর সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ ধর্মযাজক ও পাদরীদের বিশেষ করে বিশপ জন দানিয়েলের ব্যবহারের জন্য আরবি ভাষায় ‘ক্যাননস অব দ্য কাউনসিল অব স্পেন’ গ্রন্থটি অনূদিত হয়েছিল। বহু খ্রিস্টান যুবক রােমান ভাষার থেকেও আরবিতে তাদের মতামত অধিকতর সুচারুরূপে শুদ্ধতরভাবে প্রকাশ করতে পারত। প্রচুর অর্থ ব্যয় করে তাঁরা আরবি গ্রন্থসমূহ নিয়ে বিশাল বিশাল গ্রন্থাগার নির্মান করেছিল। কর্ডোভার আলভারাে মুসলিম শিক্ষাদীক্ষার প্রতি খ্রিস্টানদের ঝেকের বিরুদ্ধে তীব্র অভিযােগ আনেন। হেইসটারব্যাকের ক্যাসার খ্রিস্টান যুবকদের প্রসঙ্গে বলেছেন, তারা জ্যোতির্বিজ্ঞান অধ্যয়ন করার জন্যে টলেডােতে গমন করত।
জ্ঞানচর্চার অগ্রনায়ক ও পৃষ্ঠপােষক
স্পেনের এই সােনালী অধ্যায় সৃষ্টিতে যাঁরা অগ্রণী ছিলেন তারা হলেন বিজ্ঞানী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীগণ। গােটা স্পেনই ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার এক আদর্শভূমি। প্রত্যেক শাসকই ছিলেন জ্ঞানানুরাগী ও বিদ্যোৎসাহী। সাহিত্যসংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে স্পেন এমন এক স্বর্ণদ্বারে পরিণত হয়েছিল যে, বিভিন্ন দেশ থেকে পঙ্গপালের মতাে ছুটে আসতেন বিদ্বানমণ্ডলী। ফ্রান্স, ইটালি, এশিয়া, আফ্রিকা, সিরিয়া, মিশর, ইরাক, পারস্য প্রভৃতি দূরদেশ হতে ছুটে আসতেন বিদ্যাভূষণ পণ্ডিত প্রবর কবি-সাহিত্যিকগণ। তারা সকলেই এখানে সমাদরে অভ্যর্থিত এবং সরকারি বৃত্তিপ্রাপ্ত হতেন। এভাবে প্রতিভা স্ফুরণের সুযােগ পেয়ে বিখ্যাত কবি, বৈয়াকরণিক, এবং ঐতিহাসিকরা কর্ডোভায় বসতি স্থাপন করলেন।
স্পেনের শাসকদের মধ্যে তৃতীয় আবদুর রহমান, হাকাম (২য়) এবং আল মনসুরের নাম বিশিষ্টতার দাবীদার। এঁরা ছিলেন মূলত মুসলিম স্পেনের স্বর্ণযুগের পৃষ্ঠপােষক বােদ্ধা শাসক। তৃতীয় আবদুর রহমানের (৯২১-৯৬১) সময় বিধের বিভিন্ন স্থান হতে ছাত্র এবং বিদ্বান ব্যক্তিবর্গ কর্ডোভায় সমবেত হতেন। তাই তখন কর্ডোভাকে বলা হত ‘পণ্ডিতপ্রসূ’। বিশিষ্টদের মধ্যে দার্শনিক ইবনে মাসারাহ (৯৩১), ঐতিহাসিক ইবনুল আহমর (৯৬৯), জ্যোতির্বিদ আহমদ বিন নসর (৯৪৪), মাসলামাহ বিন কাসিম (৯৬৪), চিকিৎসক আরিব বিন সাঈদ, ইয়াহিয়া বিন ইসহাক অন্যতম। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল জ্ঞানীরাই উপযুক্ত মর্যাদা পেতেন। গ্রীক পণ্ডিত নিকোলাস, ইহুদি পণ্ডিত হাসদাই তৃতীয় আবদুর রহমানের দরবারে সম্মানীত হন।
স্পেনে উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম আবদুর রহমান নিজেই একজন কবি ও সাহিত্য-বােদ্ধা ছিলেন। তাঁর আসরে সাহিত্য পিপাসুদের মধ্যে কবি আবুল আল মুতাহাশা, শাস্ত্রবিদ শেখ গাজী বিন কাসেম, আবু মুসা হাওয়ারী উল্লেখযােগ্য।
প্রথম আবদুর রহমানের পুত্র হিশামও কাব্যানুরাগী ছিলেন। যে সকল পণ্ডিত হিশামের পৃষ্ঠপােষকতা পেয়েছিলেন তারা হলেন ঈসা বিন দীনার, আবদুল মালিক বিন হাবীব, ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া, সাঈদ বিন হাসান এবং ইবন আবু হিন্দ অন্যতম। প্রথম হাকাম, দ্বিতীয় আব্দুর রহমান গ্রন্থাগার সংগঠনে বিশেষভাবে উৎসাহী ছিলেন।
তৃতীয় আবদুর রহমানের পুত্র দ্বিতীয় হাকাম নিঃসন্দেহে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপােষকতায় স্পেনের সর্বশ্রেষ্ঠ খলিফা ছিলেন। স্পেনের সিংহাসনে এতবড় পণ্ডিত ও জ্ঞানানুরাগী আর কেউ আরােহণ করেননি। ইবনে খালদুন লিখেছেন,
‘দ্বিতীয় হাকাম সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা করতে অত্যন্ত ভালবাসতেন। পণ্ডিত ব্যক্তিদের প্রতি ছিল তার অপরিসীম বদান্যতা।’
জোসেফ ম্যাকেভ বলে,
‘দ্বিতীয় হাকাম আন্দালুসীয় সভ্যতার পরিপূর্ণতা এনে কর্ডোভা নগরীকে ইউরােপের বুকে একটি বাতিঘরে পরিণত করেন।’
দুর্লভ পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণে দ্বিতীয় হাকাম অগ্রাধিকার দিতেন। গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই তিনি তা ক্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। কেউ কোনও গ্রন্থ রচনার সংকল্প করেছে একথা শুনলেই তিনি তার জন্য মূল্যবান উপহার পাঠিয়ে দিতেন এবং তার অনুরােধও থাকত যে, পুস্তকের প্রথম কপিটিই যেন কর্ডোভায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাকাম কর্তৃক কতাে গ্রন্থকার যে পুরস্কৃত ও সমাদৃত হয়েছিলেন তা সত্যিই গৌরবের বিষয়। এভাবে তিনি চার লক্ষ গ্রন্থ সংগ্রহ করেন। দ্বিতীয় হাকামের বিশাল লাইব্রেরীতে লক্ষ গ্রন্থরাজি সংরক্ষিত ছিল। শুধু গ্রন্থের তালিকার জন্য প্রয়ােজন হয়েছিল ৫০খণ্ড পুস্তিকা। দ্বিতীয় হাকাম সংগৃহীত প্রত্যেক গ্রন্থই পাঠ করতেন এবং অনেক গ্রন্থের পাশে নিজস্ব টীকা ভাষ্য লিখতেন। তার পরবর্তীকালের মনীষীরা এসকল ভাষ্য খুবই মূল্যবান বলে বিবেচনা করতেন।
দ্বিতীয় হাকাম গ্রন্থাগার আন্দোলনের একজন পুরােধা ছিলেন। তাঁর মত বই পাগল নৃপতি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ছিল। তার নামে অসংখ্য গ্রন্থ উৎসর্গীত হয়েছিল। তার গ্রন্থাগারের বর্ণনা দিতে গিয়ে ইবনে খালদুন লিখেছেন, আব্বাসীয় খলিফা আল্ নাসিরের গ্রন্থাগার ব্যতীত কোনও গ্রন্থাগারের সাথে এর তুলনা হয় না। সমসাময়িক আরব পণ্ডিতরা এই দুর্লভ ও মূল্যবান সংগ্রহ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। প্রচুর কর্মচারী নিযুক্ত থাকা সত্ত্বেও এর বিপুল সংগ্রহ স্থানান্তর করতে দীর্ঘ ৬ মাস লেগেছিল।
খলিফা দ্বিতীয় হাকামের পর খলিফা আল মনসুর (৯৭৬-১০০২) শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতার জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি যুদ্ধে যাবার সময়ও গ্রন্থাগার সাথে নিয়ে যেতেন। সাথে থাকতাে কবিকুল। তার দরবারে রীতিমত পণ্ডিতদের আসর বসত। তার বাসভবনে এত বিদ্বানমণ্ডলীর সমাবেশ ঘটতাে যে, একে বিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করা হতাে। আল মনসুরের দরবারে। জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন কবি ওবাদা বিন আবদুল্লাহ মাসুমী, আবদুল ওয়ারিস বিন সুফিয়ান, সাঈদ বিন উসমানসহ আরাে অনেকে। তবে মনসুরের সাথে কিছু বিশিষ্ট আলেমের মতবিরােধ হয় এবং ওলামাদের সমর্থন লাভের আশায় দ্বিতীয় হাকাম সংগৃহীত কিছু মূল্যবান দর্শনগ্রন্থ তিনি পুড়ে ফেলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
সাহিত্যচর্চা
কবি ও কবিতা মুসলিম স্পেনের অত্যন্ত সমাদরের বস্তু ছিল। রাজদরবার হতে শুরু করে সাধারণ নাগরিকরা পর্যন্ত যত্রতত্র কবিতা ব্যবহার করত। ঐতিহাসিক লিখেছেন,
“কবিতা লােকের কথ্যভাষা হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। সর্বশ্রেণির লােকই আরবিতে কবিতা রচনা করিত…এই সকল কবিতার আদর্শেই স্পেন, প্রােভেন্স ও ইতালির চারণদের গীতিকাব্য অনুপ্রাণিত হয়। উপস্থিত ক্ষেত্রে রচিত বা কোনও বিখ্যাত কবির কাব্য হইতে কণ্ঠস্থ কবিতাংশ উদ্ধৃত করিতে না পারিলে কোনও বক্তৃতা বা অভিনন্দনপত্রই পূর্ণাঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হইত না…। খলিফা হইতে আরম্ভ করিয়া কৃষক-মাঝি মাল্লা পর্যন্ত সকলেই কবিতা রচনা করিত।”
আন্দালুসিয়ার নগরাবলীর সৌন্দর্য, নদীর কল্ শব্দ, নিস্তব্ধ নক্ষত্র শােভিত সুন্দর রজনী, প্রেমের আনন্দ, প্রিয়জনের সঙ্গসুখ প্রভৃতিই ছিল তাদের আলােচ্য বিষয়…আন্দালুসিয়ায় কবির সংখ্যা এত অধিক ছিল যে, কেবল তাদের নাম লিখতে গেলেই একখানা বিরাট গ্রন্থের প্রয়ােজন।
রাজ দরবারের একটা অনুপম বিশেষত্ব ছিল যে, কাব্য ও সঙ্গীতের মূচ্ছনায় তা মুখরিত থাকত। গ্রন্থ রচয়িতা, সংকলক ও অনুবাদদকরা আকর্ষণীয় সম্মানী পেতেন। আবুল ফারাজ ইস্পাহানী তার বিখ্যাত ‘কিতাবুল আগানী’ রচনা করে দ্বিতীয় হাকাম কর্তৃক ১০০০ স্বর্ণ মুদ্রায় বিভূষিত হন। তৎকালীন স্পেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক উবায়দা বিন আবদুল্লাহ স্পেনীয় কবিদের নিয়ে একটি ইতিহাস গ্রন্থ লিখেছিলেন। এই গ্রন্থের জন্য খলিফা আল মনসুর তাকে ১০০ স্বর্ণমুদ্রায় পুরস্কৃত করেন। তাছাড়া কবিদের জন্য তিনি তার গৃহের দ্বার সবসময় খােলা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সৈয়দ বিন ওসমান খলিফার বিজয়াভিযানের প্রশংসাসূচক ১০০ ছত্রের একটি কবিতা তাঁকে উপহার দেন। আল মনসুর পরদিন কবিকে স্বর্ণসূত্র বিজড়িত ৩০০ দীনার পুরস্কার পাঠিয়ে দেন।
বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ছিলেন অধ্যাপক আল কালি (৯০১-৯৬৭), জন্ম আর্মেনিয়ায়, শিক্ষা বাগদাদে। তার প্রধান শিষ্য ছিলেন মহম্মদ ইবনে আল হাসান আল জুবাইদী (৯২৮-৮৯), ইনি সেভিলে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে খলিফা দ্বিতীয় হাকাম তাকে তার কিশাের পুত্র হিশামের গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত করেন। আল জুবাইদীর প্রধান কাজ বলতে, তার সময়কাল পর্যন্ত যে সমস্ত পণ্ডিত ব্যক্তি ভাষাতত্ত্বের ওপর কলম ধরেছিলেন, তিনি তাদের একটি সংক্ষিপ্ত কার্য তালিকা প্রস্তুত করেন। আল সূয়ুতিও ভাষাবিজ্ঞানের একজন খ্যাতনামা ব্যক্তি ছিলেন। হিব্রু ব্যাকরণ আরবি ব্যাকরণকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। আবু জাকারিয়া ইয়াহিয়া ইবনে দাউদ ছিলেন হিব্রু ব্যাকরণের জনক। তার কর্মজীবন ছিল কর্ডোভাতে।
কর্ডোভার স্বনামধন্য সাহিত্যিক ছিলেন ইবনে আবদ্ রাব্বি (৮৬০-৯৪০), তিনি তৃতীয় আব্দুর রহমানের সভাকবি ছিলেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল ইক আল ফরিদ’ (‘সুন্দরহার’)। আরবদের সাহিত্য-ইতিহাস রচনার (ক্ষেত্রে ‘আল আগানি’র পর এইটিই ছিল শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থ। ইসলামের প্রথম শ্রেণির যে কয়েকজন মনীষী স্পেনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইবনে হাজম (৯৯৪১০৬৪) তাদের অন্যতম। তিনি একাধারে ইতিহাস-ধর্ম-তর্কবিদ্যা-সাহিত্য-কাব্য ইত্যাদি বিষয়ে বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ইবনে খাল্লিকান ও আল কিতিও ছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক। সে যুগেও তারা উপন্যাস, তুলনামূলক ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। সেযুগের কালজয়ী বিখ্যাত গ্রন্থ ছিল ‘তাও আল হামামা’ ও ‘আল ফামান ফী আলমিলাল-অআয়-আহওয়া-অ-আল নিহাল’।
স্পেনীয় ভাষাতে বহু আরবি গ্রন্থ অনুদিত হয়। ‘কালিলা ওয়া দিমনা’ তাদেরই একটি। পরে এই গ্রন্থগুলাে ফরাসি ভাষাতেও অনুদিত হতে থাকে। মধ্যযুগীয় ইউরােপীয় সাহিত্যে পরিকাঠামােও বহুলভাবে আরবি সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই ব্যাপারে স্পেন-সাহিত্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কর্ডোভার রাজদরবারে যে কয়েকজন বিশেষ কবিকে আমরা পাই, তাদের মধ্যে ছিলেন ইবনে আবদ রাব্বি, ইবনে হাজম, ইবনুল খাতিব। এছাড়াও স্পেনের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন ইবনে জায়দুন (১০০৩-৭১)। ইনি কর্ডোভার রাজদরবারে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। ইবনে জায়দুন, ইবনে আহনাফ ও সাঈদ বিন হাসান ছিলেন রােমান্টিক কবি। ইবনে যায়দুনকে ইটালির সনেট প্রবক্তা পেত্রাক-এর সাথে তুলনা করা হয়। ইবনে আহনাফের সময়সঙ্গীত স্পেনীয় মুসলমানদের হাজার বছরের সংগ্রামে প্রেরণা দেয়। ইবনে সাঈদের কবিতা বিলাসী ও উচ্চুঙ্খলদের মন্ত্রস্বরূপ ছিল। ইবনে আম্মারের কবিতায় মুগ্ধ হয়ে সুলতান মুতামিদ তাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।
কর্ডোভার মহিলা-কবিদের মধ্যে ছিলেন পরমা সুন্দরী চরম প্রতিভাময়ী ওয়াল্লাদা। ঐতিহাসিক আল মাককারি তার বিখ্যাত গ্রন্থের একটি গােটা অধ্যায় এই প্রতিভাময়ী মহিলা-কবিকে নিয়ে লিখেন। ছন্দ-অলংকার শাস্ত্রে তিনি এতই বুৎপত্তিসম্পন্না ছিলেন যে, সারা বিশ্বে তিনি ‘সাফো অফ আরবস্’ নামে পরিচিত ছিলেন। সাহিত্য, ধর্ম ও দর্শনে বিখ্যাত বক্তা ছিলেন কর্ডোভার রাজপুত্র আহমদের কন্যা আয়েশা। তার বক্তৃতামালা কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানাে হতাে। দার্শনিক লাবানা ছিলেন একজন। স্পেনীয় রাজকন্যা। যােগ্যতা বলে তিনি খলিফা দ্বিতীয় হাকামের ব্যক্তিগত সচিব হয়েছিলেন। আল ঘাসানিয়াহ ও সফিয়া উভয়ে সেভিলের অধিবাসী ছিলেন এবং তারা কাব্য প্রতিভা ও বাগ্মিতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। সফিয়া হস্তলিপি কলাতেও পারদর্শী ছিলেন। কর্ডোভার উসমান আল হিমইয়ারির কন্যা উম্মুল সাদ একজন বিখ্যাত মহিলা কবি ছিলেন। হাদীস-জ্ঞানের জন্য তার সুখ্যাতি ছিল। আবুল হুসাইনের কন্যা আল তামিমিয়াহ ও ইউসুফের কন্যা উম্মুল উলাহ বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ, ব্যাকরণবিদ ও ছন্দ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। হামদুনের কন্যা হাফসা ছিলেন বিখ্যাত মহিলা কবি। ইবাদিয়া ছিলেন হস্তলিপিবিদ, কবি ও ভাষাবিদ। সেভিলের আসমাও ছিলেন বিখ্যাত কবি। কাজী আবদুল হকের কন্যা উম্মুল হিনা ছিলেন কবি ও আইনবিদ। গ্রানাডার আবুবকরের কন্যা নাজহুল ছিলেন ইতিহাস ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত। খলিফা আল মুতামিদের স্ত্রী ও কন্যা ইতিমাদ ও বাসিনা উভয়েই পণ্ডিত ছিলেন। কর্ডোভার বাহজা ছিলেন কবি। পুস্তক বিক্রেতা জিয়াদের কন্যাদ্বয় জয়নব ও হামিদা ছিলেন কবি, শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী। আবু ইয়াকুবের কন্যা মারিয়া তার পাণ্ডিত্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। সেভিলের ইয়াকুব আল আনসারীর দুহিতা মরিয়ম, ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি ও শাস্ত্রবিদ। এছাড়াও ভ্যালেনসিয়ার দক্ষিণে একটি অখ্যাত পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন কবি আবু ইসহাক ইবনে খাফাজার (-১১৩৯)। কবি ইবনে হানি গ্রিক দর্শনের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। ইংল্যাণ্ডের দ্বিতীয় চার্লসের সময়ে মাত্র কয়েকজন নারী লিখতে ও পড়তে পারত, সেখানে তার ৮০০ বছর পূর্বে স্পেনের এই সমস্ত নারীরা যেভাবে সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখিয়েছে তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
কর্ডোভার বিখ্যাত যাযাবর চারণ কবি ছিলেন আবুবকর ইবনে কুজমান (১১৬০)। তিনি বাউল ফকিরের ন্যায় শহরে শহরে ঘুরে বেড়িয়ে গান করতেন। তাঁর সর্বাপেক্ষা বড়াে অবদান, তিনি বহু চারণ কবির তাৎক্ষণিক সঙ্গীতগুলাে একত্রিত করেছিলেন। এই অধ্যায়ে যাঁরা বিখ্যাত ছিলেন—টলেডাের অন্ধকবি আবু আল আব্বাস, আল তিউতিলি, ইব্রাহিম ইবনে সাহল প্রমুখ কবিগণ। এছাড়াও পাই গ্রানাডার অধিবাসী মহম্মদ ইবনে ইউসুফ আবু হায়্যানি (১২৫৬-১৩৪৪), ইনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত। তার রচিত ব্যাকরণ গ্রন্থ আজও তুর্কি ভাষায় অক্ষত অবস্থায় বর্তমান।
মুসলিম স্পেনের কবি-কবিতা সম্পর্কে এখনাে অনেক কিছুই অজানা, বর্তমানে কিছু কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হচ্ছে। এরকম অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে ইউনেস্কোর ‘ক্যাটালােনিয়া’ পত্রিকায় (জানুয়ারী ১৯৯৫) একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। জোসেফ পিয়ারাে ‘The Arab Poets of Valencia’ শিরােনামে এ-প্রবন্ধ লিখেন। এই প্রবন্ধ অবলম্বনে লিখিত এক পর্যালােচনায় সৈয়দ আলি আহসান লিখেছেন মুসলমানদের সময়কালে আরবি কবিতা লিখিত হয়েছে, বিচিত্র আরবি ছন্দে লােকগীতি রচিত হয়েছে, চারণ কবিরা অঞ্চলে অঞ্চলে ঘুরে কাসিদা গেয়ে ফিরেছে। এগুলাের প্রভাব এতাে প্রবল ছিল যে, আধুনিক কবিরা আরবি ছন্দের ব্যঞ্জনায় এবং আরবি কাব্য-কৌশলে কাসিদা রচনা করেছেন। শুধুমাত্র তাই নয়, মুসলমানদের জীবন থেকে উদাহরণ গ্রহণ করে তারা কবিতায় নতুন উপমা এবং উৎপ্রেক্ষা সৃষ্টি করেছেন। চাঁদের উপমা এসেছে কবিতায়, রমযানের জন্য অপেক্ষায় মুসলমানদের জীবনে যে অসম্ভব আগ্রহ, সে আগ্রহকে তুলনা করেছেন প্রিয়ার আগমনের অপেক্ষার সঙ্গে।
স্পেনের কবিদের কবিতা নিয়ে তখন অনেক সংকলন হয়েছিল। আহমদ বিন ফররাজ ‘বাগান’ নামক এরকম একটি পুস্তিকা সংকলন করেন। এটা ১০০ অধ্যায় বিভক্ত এবং প্রত্যেক অধ্যায়ে ১০০টি কবিতা ছিল। আবুবকর বিন দায়দ আল ইস্পাহানীর। ‘পুষ্প’ ছিল এই ধরণের আর একটি সংকলন। তবে প্রাচ্য-প্রতীচ্য সর্বত্র ‘বাগান’ ছিল অধিক সমাদৃত। স্পেনের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিসঙ্গীতজ্ঞ আবু হাসান বিন নাফে ওরফে জিরাব ছিলেন সঙ্গীতশিল্পের অমর ব্যক্তিত্ব। ঐতিহাসিক লেনপুল ও ডােজি তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জিরাব প্রথম জীবনে বাগদাদে ছিলেন এবং ৮২২ সালে কর্ডোভাতে আসেন এবং স্পেনে সংগীতচর্চা শুরু করেন। দ্বিতীয় আবদুর রহমানের পৃষ্ঠপােষকতায় তিনি কর্ডোভাতে একটি সংগীত প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সেভিল, টলেডাে, ভ্যালেনসিয়া ও গ্রানাডায় আরাে বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। জিরাবের পূর্বে ঈগলের বাঁকা নখের মত বীণার সাহায্যে ‘তাল’ তােলার গজদন্ত নির্মিত যন্ত্র ব্যবহার করা হত। তিনি ওটাকে কাঠের যন্ত্রে রূপান্তরিত করেন। বীণার পঞ্চম তারটি তারই প্রতিভাপ্রসূত নতুন সংযােজন। এই জগতে জীরাবের পর আরাে দু’জন বিখ্যাত ব্যক্তিকে আমরা পাই। আবুল কাসিম ও আব্বাস ইবনে ফিরনাস। জিরাব সংগীতের শক্ত ভিত্তিমূল তৈরি করেছিলেন, যার উপর দাঁড়িয়ে তার দুই শিষ্য প্রাচ্যের সংগীতকে পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় করে তুললেন। আব্বাসীয় খলিফা আল মুতামিদ (১০৬৮-৯১) কেবল একজন বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ছিলেন না, ছিলেন বিখ্যাত বীণাবাদকও। কবি হিসাবেও তিনি খ্যাতনামা ছিলেন। তখন স্পেনের বাদ্যযন্ত্র এতখানি সুখ্যাতি অর্জন করেছে যে, তা দেশে বিদেশে রপ্তানি হতে থাকে। মুয়াবিয়া যুগে সেভিল ও ফ্রান্সের স্বনামধন্য দার্শনিক ইবনে বাজ্জা সংগীতের উপর একটি বিখ্যাত পুস্তক রচনা করেন। বইটি ইউরােপে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছিল। বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে ফারাবিও সংগীতের উপর একটি বিখ্যাত বই লিখেন। বইটি প্রাচ্যে খুবই প্রচলিত হয়েছিল। স্পেনের অন্য একজন দার্শনিক ইবনে সাবাইনও (১২৬৯) সংগীতের উপর একটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। বইটির নাম ‘আল আদোয়ার আল মানসুর’। এখনও পর্যন্ত বইটিকে কায়রােতে লক্ষ করা যায়।
দর্শনচর্চা
জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতদর্শনে মুহাম্মদ বিন আহমদ ইবনে রুশদ (পাশ্চাত্যে Averroes নামে পরিচিত), ইবনে জিব্রাইল, ইবনে বাজ্জা, ইবনে জোহর, ইবনে তােফায়েল অগ্রগণ্য ছিলেন। মুসলিম দুনিয়ার জ্ঞানীদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের একাধিক বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। স্পেনের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযােজ্য। ইবনে বাজ্জার (১১৩৮) পুরাে নাম আবুবকর মুহম্মদ বিন ইয়াহিয়া, মুসলিম স্পেনের একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ছিলেন। তিনি চিকিৎসক, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন একইসাথে। ইবনে সীনার (৯৮০-১০৩৭) মৃত্যুর পর দর্শনচর্চা প্রায় বিলুপ্ত হলে তিনি ফারাবির (৮৭০-৯৫০) শিষ্য হিসেবে দর্শনশাস্ত্রের উন্নতি বিধানে মনােনিবেশ করেন এবং রক্ষণশীল ধারায় অ্যারিষ্টটলের নিও-প্লেটোনিক ব্যাখ্যা শুরু করেন।
মুহাম্মদ বিন আবদুল মালিক বিন ইবনে তােফায়েল (১১২০) গ্রানাডায় জন্মগ্রহণ করেন। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন তােফায়েল তার দর্শনচর্চা ছিল ইবনে বাজ্জার সমপর্যায়ের। তার মতে, জিকরে-মওতা (মৃত্যু চিন্তা) হল শ্রেষ্ঠ ও সত্যজ্ঞান লাভের একটি উপায়। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘হাই-বিন ইয়াকজান’। মুসলিম স্পেনের দার্শনিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ছিলেন ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮)। অসাধারণ বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন শতাধিক গ্রন্থ প্রণেতা ইবনে রুশদ, আইনজ্ঞ-ধর্মতত্ত্ববিদ-চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে পারদর্শী ছিলেন। তার প্রতিভা অন্যান্য প্রতিভাকে ম্লান করে দিয়েছিল। তিনি অ্যারিষ্টটলের কাজের উপর যে বিশাল ভাষ্য লিখেন তা ইউরােপের কাছে আজও বিস্ময়কর।
মধ্যযুগের ইউরােপে ইবনে রুশদ কয়েক শতাব্দী ধরে আলােকরমি বিকিরণ করেন। কমিউনিষ্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ এবং পরে র্যাডিক্যাল হিউম্যানিষ্ট আন্দোলনের পুরােধা এম এন রায় (১৮৮৭-১৯৫৪) তার ‘The Historical Role of Islam’ গ্রন্থে লিখেছেন,
“…আধুনিক সভ্যতার অগ্রদূতদের অ্যারিষ্টটলের প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত করে যিনি ইউরােপীয় মানবতাকে অনুর্বর পাণ্ডিত্যাভিমান এবং ধর্মতত্ত্বের গােড়ামীর পক্ষাঘাতদুষ্ট প্রভাব থেকে মুক্তি সংগ্রামে অপরিমিত প্রেরণা ও উৎসাহ দিয়েছিলেন সেই সুধী শ্রেষ্ঠ অ্যাভেরােস-এর (ইবনে রুশদ) কীর্তিও অমর হয়ে রয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে আন্দালুসীয় সুলতানের গৌরবােজ্জল পৃষ্ঠপােষকতায় আরবের যে প্রধান যুক্তিবাদী বেড়ে উঠেছিলেন তার যুগান্তকারী ভূমিকা রজার বেকনের বহু পরিচিত এই উক্তিতে সরবে বিঘােষিত হচ্ছে প্রকৃতির দ্বার উদ্ঘাটন করেছেন ইবনে রুশদ।”
ইবনে রুশদের কিছু মতবাদ ধর্মবেত্তা ও সাধারণ মুসলমানের সাথে বিরােধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখনকার যুগে তাকে ধর্মবিরােধী, নাস্তিক, শয়তান বলা হয়েছে। ইসলাম ও দর্শনের সমন্বয়কারী হিসাবে তার ভূমিকা থাকলেও তাকে ধর্মবিরােধী চিন্তানায়ক বলা হয়। এ কারণে তিনি জীবৎকালে নিগৃহীত হন এবং সর্বশেষে আফ্রিকায় পালিয়ে যান। দর্শনশাস্ত্রে তার বিখ্যাত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে ইমাম আল গাজ্জালীর (১০৫৮-১১১১) ‘তুহফাতুল ফালাসিফা’র জবাবে রচিত ‘তুহফাতুত্ তাহফুত’, ‘কিতাবুল ফালাসিফা’ এবং ‘ফাসলুল আকালী ফি মুয়াফিকাতিল হিকমাত ওয়া শারীয়াহ’ উল্লেখযােগ্য।
ইতিহাসচর্চা
স্পেনে মুসলিম শাসনামলে জন্মগ্রহণ করেছেন পৃথিবীখ্যাত অনেক ঐতিহাসিক। এমনিতেই আরব শাসকরা ইতিহাস লিখনকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিতেন। প্রকৃতপথে মুসলমানরাই প্রথম ধারাবাহিক ইতিহাস লেখা শুরু করেন, সেই সূত্রে তারাই হলেন যথার্থ ইতিহাস রচনার পথিকৃৎ। স্পেনের প্রত্যেক খলিফাই রাজ্যের বিভিন্ন ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য ঐতিহাসিক নিযুক্ত করতেন। প্রত্যেক শহরে-প্রদেশে ঐতিহাসিক নিযুক্ত থাকতেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিকদের মধ্যে ছিলেন খাজরাজী, আল হিজারী, আল মাককারি, ইবনুল আরাবী, ইবনুল আফতাশ, ইবনুল আহমদ, আল্ আব্বার (১১৯৯-১২৬০), ইবনুল খাতিব (১৩১৩-১৩৭৪), ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬), মুহাম্মদ বিন ইউসুফ, ওয়াহিদ বিন সামার, ইবনে কুতিয়া প্রমুখ। তবে মুসলিম স্পেনের ঐতিহাসিকদের মধ্যে যিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত এবং খ্যাতিমান তিনি হলেন ইবনে খালদুন। তিনি ছিলেন আধুনিক ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানের পথিকৃৎ। তিনি সর্বপ্রথম আধুনিক পদ্ধতিতে ইতিহাস লেখেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘মুকাদ্দামা’ (৩ খণ্ডে) বিখ্যাত। ‘মুকাদ্দামা’য় ইবনে খালদুন তার এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন যে, মানব ইতিহাসের ক্রমবিকাশের ধারায় পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব রয়েছে এবং তিনি রাজ্যের উত্থান-পতনের মূলে প্রধান কার্যকর কারণগুলাে বিশ্লেষণ করেন। ইতিহাসের এই তত্ত্ব তার জন্য বয়ে আনে আন্তর্জাতিক খ্যাতি। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি রাষ্ট্র ও সমাজের একটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দিতে সচেষ্ট হন। ইবনে খালদুন তার যুগের চেয়ে অনেক বেশী অগ্রগামী ছিলেন। মধ্যযুগীয় ও আধুনিক ইউরােপীয় ঐতিহাসিক ম্যাকিয়াভেলি, ভিকো এবং এডওয়ার্ড গীবন ছিলেন তাঁর অনুসারীদের মধ্যে অন্যতম। ফিলিপ কে হিট্টি বলেন, ইবনে খালদুন ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক দার্শনিক ছিলেন। মরক্কোর সুখ্যাত গণিতবিদ ও ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে যিনি অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন—তার নাম আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে মহম্মদ। তিনি প্রায় ৭৪টি গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন, যার অধিকাংশই ছিল গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর। তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থের নাম ছিল ‘আলতালখিস্ আন-আল-হিসাব’, যা প্রায় দুই শতাব্দী যাবৎ ইউরােপেপঠিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের উপর বহু কমেন্টারীও রচিত হয়েছিল। কমেন্টেটরদের মধ্যে ইবনে খালদুনও ছিলেন।
ভূগােলচর্চা
স্পেনে বেশ কয়জন অসাধারণ প্রতিভাপন্ন ভূগােলবিদ জন্মগ্রহণ করেন। কর্ডোভার আলবাকরী (১০৪০-১০৯৪) একটি ভৌগােলিক অভিধান রচনা করেন। তার বিখ্যাত কালজয়ী গ্রন্থ ‘আল মাসালিক ওয়া আল মামালিক’ আজও সমাদৃত। মুহম্মদ বিন আবুবকর যুহরী ও আল মাজিনী (১০৮০-১১৭০) ছিলেন গ্রানাডার দু’জন বিখ্যাত ভূগােলবিদ। আল মাজিনী রাশিয়াভলগা প্রভৃতি অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছিলেন। ওখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে তিনি চমৎকার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। স্পেনের রাজ পরিবারের আরবীয় সন্তান আল ইদ্রিসী (১১৪০-১২০৫) সম্ভবত পাশ্চাত্যের সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত ভূগােলবিদ। মুসলিম স্পেনের ভূগােলবিদদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। আল ইদ্রিসী একটি ‘খ-গােলক’ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি একটি গােলকে জ্ঞাত জগতের অবস্থান নির্দেশ করেছেন। এটা তাকে মানচিত্র প্রস্তুতকারীদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান দান করেছে। ইদ্রিসী নিঃসন্দেহে একজন শ্রেষ্ঠ মানচিত্র-নির্মাতা। তিনি প্রায় ৭০টি মানচিত্র প্রস্তুত করেন। এতে তিনি পৃথিবীর অক্ষাংশ পরম্পরায় ৭টি আবহাওয়া বিভাগ দেখিয়েছেন। রৌপ্যপাত্রেও তিনি পৃথিবীর একটি মানচিত্র প্রস্তুত করেছেন। সাড়ে চারহাত ব্যাস এবং সাড়ে পাঁচমন ওজন বিশিষ্ট রূপার একটি ভূ-গােলক তৈরী করেন। এতে রাশিচক্রের অবস্থান, বিভিন্ন দেশ, জল-স্থল, পাহাড়পর্বত অত্যন্ত নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করেন। বিখ্যাত এই মানচিত্রের পুরস্কার স্বরূপ তিনি ১ লক্ষ রৌপ্যমুদ্রা এবং পণ্য বােঝাই একটি বাণিজ্য জাহাজ লাভ করেন। তিনি সমগ্র এশিয়া ও ইউরােপ ভ্রমণ করেন।
দীর্ঘ পনের বছরে আল ইদ্রিসীর ভূগােল লেখা শেষ হয়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা এক নবযুগ এনে দেয়। ৩০০ বছর পর্যন্ত ভৌগােলিকেরা একটুও না বদলিয়ে আল ইদ্রিসীর মানচিত্র নকল করে যান। স্টেনলি ও বেকারের ৭০০ বছর পূর্বে আল ইদ্রিসী বলে যান পাঁচটি হ্রদ হতে নীল নদের উৎপত্তি। তাঁর প্রদত্ত বহু বিবরণ আজও নির্ভুল বলে গৃহীত হয়ে থাকে।
রােম ও কনস্টানটিনােপলের পণ্ডিতরা যখন পৃথিবী সমতল বলে ঘােষণা করেছিলেন, স্পেনের মুরেরা তখন তাদের মক্তব ও মাদ্রাসায় গ্লোবের সাহায্যে ভূগােল শিক্ষা দিচ্ছিল এবং তারও অনেক পূর্বে বাগদাদে পৃথিবীর পরিধি নির্ণীত হচ্ছিল। মুর লেখকদের পুস্তক পাঠ করেই কলম্বাস আমেরিকার অস্তিত্ব জানতে পারেন। আরবেরা যে আমেরিকায় বসতি স্থাপন করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে ইউরােপীয়দের ৪০০ বছর পূর্বে মুরেরা ক্যানারি, ম্যাকিরাও আজোর্স দ্বীপপুঞ্জ আবিস্কার করে।
চিকিৎসাবিদ্যা
স্পেনের শল্য চিকিৎসক আবুল কাসেম জাহরাবি ৯৩৬-১০১৩) ল্যাটিনে আল বুকাসিস্ নামে পরিচিত। তাঁর রচিত ‘মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া’ গ্রন্থটি ল্যাটিন ও হিব্রু ভাষায় অনুদিত হয়ে বহু শতাব্দী ধরে ইউরােপে সমাদৃত ছিল। ইউরােপে অস্ত্রোপচার প্রবর্তনে এই গ্রন্থের ভূমিকা অপরিসীম। শল্যবিদ্যা সংক্রান্ত যাবতীয় আলােচনা এই গ্রন্থে স্থানলাভ করেছে। ক্ষতস্থান পােড়ানাে, মুত্রাশয়ের পাথর নষ্ট হতে যাবতীয় শল্যবিদ্যা এখানে আলােচিত হয়েছে। এমনকি জীবজন্তু, পশুপীর জন্যও বিস্তারিত আলােচনা করেছেন তিনি এখানে। এককথায় তার পুস্তকটি ইউরােপে শল্য চিকিৎসার ভিত্তিভূমি স্থাপন করে। আবুল কাসেম জাহরাবি শল্যচিকিৎসার উপর তার ৩০তম গ্রন্থ ‘ফিল আমাল বি-আল-ইয়াদ’-এর জন্যে প্রধানত আরাে স্মরণীয় হয়ে আছেন। এই গ্রন্থটি লুসিয়েন লেক লার্ক কর্তৃক ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল প্যারিস থেকে ১৮৬১ সালে। এই গ্রন্থে লেখক হাড়ের মজ্জায় আঘাত পাওয়ার কারণে মেরুদণ্ডের যে পক্ষাঘাত আসে তার উল্লেখ করেছেন। এই গ্রন্থে গর্ভাবস্থায় জরায়ুর মধ্যে একাধিক ভ্রণ ও রয়ে যাওয়া ভ্রুণের বর্ণনা দক্ষতার সঙ্গে করা হয়েছে। এবং ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির উদাহরণসহ ভ্রণের উপর ‘ক্রোনিয়াে-সটি’ অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়া দেখানাে হয়েছে। এছাড়া ধাত্রী বিদ্যায় পর্যবেক্ষকের অবস্থান ও প্রসবের সময় যন্ত্র সহযােগে প্রসব করানাের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই গ্রন্থের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ হল অস্ত্রোপচারের ও দন্ত চিকিৎসার জন্যে ২০০টি উদাহরণ বা চিত্র সহযােগে উদাহরণ সন্নিবেশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন প্রথম বিদগ্ধ চিকিৎসক যিনি হিমােফিলিয়া রােগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এটি এমন একটি রােগ যা প্রসুতির কেবলমাত্র শিশুপুত্রের মধ্যে প্রেরণ করে। সেভিলে জন্মগ্রহণকারী ইবনে যুহর (১০৯০-১১৬২) ছিলেন স্পেনের কৃতি ও নামজাদা চিকিৎসক। তাঁর পরিবারের ছয় পুরুষ স্পেনের চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রভুত্ব করেন। তাঁর রচিত ছয়টি গ্রন্থের মধ্যে ৩টি এখনাে পাওয়া যায়। তারমধ্যে ‘আত তাদবীর ফিল মুদাওয়াত আত্ তাদবীর’ সর্বাপেক্ষা মূল্যবান। মানুষের হাড় ও খােশ-পাঁচড়া সম্বন্ধে বিশদ আলােচনা তিনি এখানে করেছেন। ইবনে রুশদ তার বন্ধু ছিলেন। ইবনে রুশদ তাকে গ্যালেনের পর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক বলে অভিনন্দিত করেন। ইবনে রুশদ নিজেও একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর বড় অবদান একটি জ্ঞানকোষ, যার নাম ‘তাফসীর ওয়া কুল্লীয়াত ফিতীব’—চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে সবর্জনীন সত্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থে বহু তথ্য আছে। তিনি বলেছেন, একজন মানুষ দু’বার গুটি বসন্তে আক্রান্ত হবে না। তাকে আধুনিক সার্জারির জনক বলা হয়। একথা সত্য যে, দার্শনিক রুশদকে চিকিৎসক রুশদ অতিক্রম করেছেন। মুসা বিন মায়মুন (১১৪৫-১২০৪) আরব আমলের বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। ‘আল ফুসুল ফিত্তীব’ তার জনপ্রিয় চিকিৎসা গ্রন্থ। আরাে একজন খ্যাতনামা চিকিৎসককে আমরা পাই। তিনি হলেন আল বাহানি (খ্রীঃ ১১৫৪)। ওই সময়ে আমরা ভ্রাম্যমান চিকিৎসার ব্যবস্থা লক্ষ করেছি। চল্লিশটি উটের পিঠে চলমান হাসপাতাল ছিল। আল বাহানি ছিলেন তার প্রধান পরিচালক। স্পেনের ঔষধ প্রস্তুতকারী ইবন আল ওয়াফিদ তার ‘কিতাব-আল-আদ্বিয়া-ওয়াল মাফরিদা’ গ্রন্থে রােগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে পথ্যের ব্যবহার করে নিরাময়ের পক্ষে সমর্থন করেছেন এবং ঔষধ যদি একেবারেই প্রয়ােজন হয়ে পড়ে তাহলে সহজ ঔষধ প্রয়ােগের পথে তিনি মত দিয়েছেন। ঔষধের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া অনুসন্ধানের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবনের কৃতিত্ব তাকে দেওয়া হয়। তিনি ‘ব্যালনিওথেরাপি’ বা ‘স্নানের মাধ্যমে রােগ চিকিৎসা’র উপরও আলােকপাত করেছিলেন। গ্রানাডার ইবনুল খাতিব বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। উল্লেখযােগ্য ‘অন প্লেগ’ গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য তিনি উচ্চমর্যাদা লাভ করেছিলেন। এই গ্রন্থের মধ্যে চতুর্দশ শতকের ভয়াবহ প্লেগ রােগের বর্ণনাও ছিল। এই গ্রন্থে তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, এই ব্যাধি সংক্রামক। এছাড়া বিন সাইদুল খাবির, ইবনে ওয়াকিদ, দাউদ আল আগরিবী, সালাহুদ্দিন বিন ইউসুফ, আবুবকর বিন বাজ্জা, ইবনে আল বাইতার, আবুবকর মুহম্মদ (১১১১-১১৯৯), আবু মুহম্মদ আবদুল্লাহ (১১৮২-১২০৬), মুজফ্ফর আল হাবেলী (১১৫৪), ইয়াহিয়া বিন ইসহাক, ইসহাক বিন হায়সাম প্রমুখ চিকিৎসাবিদদের নামও উল্লেখযােগ্য। সেই অন্ধকার যুগে এই সমস্ত অমর চিকিৎসকবৃন্দ যা করে গেছেন, তার জন্য আধুনিক জগৎ আজও তাদের কাছে ঋণী। জ্যোতির্বিজ্ঞান জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্পেনীয় মুসলমানদের অবদান চিরস্মরণীয়। তারাই ১১৯৬ সালে প্রথম সেভিলে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের সুবিধার্থে মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইউরােপ হতে স্পেনীয় মুসলমানদের নির্বাসনের (১৬০০ শতকে) পরে অজ্ঞ খ্রিষ্টানেরা একে গির্জার ঘন্টা-ঘরে পরিবর্তিত করে। মুরদের দৃষ্টান্তেই ইউরােপীয়রা জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যার চর্চায় অনুপ্রাণিত হয়। স্পেনীয় জ্যোতির্বিদদের মধ্যে জাবির ইবনে আফনাহ (১১৫০), আল মাজরিতি (১০০৭), আল জারকালি (১০২৯-৮৭), আবু ইসহাক আল বিতরুজি (১২০৪), আহমদ বিন নসর, ইব্রাহিম আবু আহসান, হাসান আল মারাকুশী, ইবনে হেজরা জ্যোতির্বিদ্যার উন্নয়নে কাজ করেছেন। তবে দুর্ভাগ্য, তাদের গ্রন্থাদি অনেকাংশে ধংস করে দেওয়া হয়েছে।
তাঁদের আবিষ্কারের ফলে জ্যোতির্বিদ্যার অনেক উন্নতি হয়। জাবির ইবনে আফনাহ ঘােষণা করেন যে, বুধ ও শুক্র গ্রহের মধ্যে কোনও দৃশ্যমান স্থিতি বৈষম্য নেই। টলেডাের আল জারকালি (পাশ্চাত্যে আরজাচেল নামে পরিচিত) ছিলেন সেই যুগের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ, যিনি ত্রিকোণমিতির ছকের গঠনের উপর বিশেষ তথ্য পরিবেশন করেছিলেন। কোপার্নিকাস ও কেপলারের বহু পূর্বে তিনি টলেমীর ভ্রম সংশােধনের জন্য অন্ধকার কক্ষ স্থাপনের প্রস্তাব দেন। কেবল সৌরকরে গতি নির্ধারণের জন্যই তিনি ৪০২টি পর্যবেক্ষণ গ্রহণ করেন, বর্তমানে যা সঠিক বলে গৃহীত। তিনি ভূমধ্যসাগরের যে দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করেন, তা মােটামুটি ঠিক। জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপরে লিখিত তাঁর গ্রহের ‘সারণি’ সুবিখ্যাত ছিল। এবং এটির ব্যবহার করাও হত। তার সূর্যের পরিত্র মণপথের তীর্যকতা নির্ধারণ বৃত্তচাপ এক মিনিটের মধ্যেই বিশুদ্ধ। কোপার্নিকাস তাকে অনুসরণ করেছিলেন। এম রেমণ্ডের জ্যোতির্বিদ্যা-গ্রন্থ অনেকটা আল জারকালির গ্রন্থাবলম্বনে লিখিত। ইবনে রুশদ একজন বড় জ্যোতির্বিদও ছিলেন। গণনা দ্বারা বুধ গ্রহের গতি নির্ধারণকালে তিনি সূর্যের কলংক আবিষ্কার করেন। তিনিই প্রথম সূর্যের আড়াআড়িভাবে বুধ গ্রহের পথ দেখতে পান। আল মাজরিতি খােয়ারিজমীর ‘গ্রহের সারণি’ সংশােধন করে বিখ্যাত হয়ে আছেন।
মূরদের নির্মিত জ্যোতির্বিদ্যার নানা যন্ত্রপাতি ইউরােপের বিভিন্ন যাদুঘরে আজও বর্তমান, এদের নির্মাণ প্রণালী এত উৎকৃষ্ট ও ব্যবস্থাপিত করানাের কায়দা এত নিখুঁত যে আধুনিক বৈজ্ঞানিক শত চেষ্টা করেও তার চেয়ে উৎকৃষ্ট যন্ত্র নির্মাণ করতে পারছেন না। তাদের নির্মিত অনেক যন্ত্রপাতি আজও ব্যবহৃত হচ্ছে। নিউটনের বহুকাল পুর্বেই মূরেরা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্ব অবগত হন, তাঁরা এমনকি এর ফলাফল পর্যন্ত পরীক্ষা করেন। তাঁরা আপেক্ষিক গুরুত্বের নির্ঘন্ট প্রস্তুত করেন। বিজ্ঞানের মতে বর্তমানে বস্তুর যে ঘনত্ব নির্ভুল বলে গৃহীত হয়, আরবদের ভ্রান্ত ফলের সাথে তার বিশেষ পার্থক্য নেই। আল বিতরুজির (পাশ্চাত্যে আল পিত্রাজিয়াস নামে পরিচিত) গৃহীত পর্যবেক্ষণই ছিল তথাকথিত ‘গ্রহের সারণি’র ভিত্তি। ১৩ শতকে দশম আলফান্সের ‘গ্রহের সারণি’ ছিল এগুলির সঙ্কলন ও পরিবর্ধন মাত্র। বিতরুজি টলেমির মতবাদ সম্পূর্ণরূপে খণ্ডণ করেন। তার মূল বক্তব্য হল ‘প্রত্যেক গ্রহের মেরুই নিজের পথে ভ্রান্তিবৃত্তের চারিদিকে ঘােরে। মূরেরা ছায়াঘড়ি, জলঘড়ি এবং বায়ুচালিত ও ভারচলিত ঘড়ি ব্যবহার করত। আল জারকালির জলঘড়ি টলেডাের দুইটি চৌবাচ্চা নিয়ে নির্মিত হয়। চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধি অনুযায়ী এর জল নিয়ন্ত্রিত হত। গ্যালিলিওর বহু পূর্বে মিশরের ইবনে ইউনুস দোলক ঘড়ি আবিষ্কার করেন। কিন্তু স্পেনে এর প্রচলন হয় বলে মনে হয় না।
টলেমীর পর হতে আলােক বিজ্ঞানে কারও কোনও স্থান ছিল না। এক হাজার বছর পরে ইবনুল হায়সাম (৯৬১), পাশ্চাত্যে যিনি আল হাজেন নামে পরিচিত আলােকের উপর গবেষণা করে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেন। তিনি আবিষ্কার করেন। বায়বীয় কারণে আলােকরমির দিক পরিবর্তন ঘটে, তারফলে মায়া বা দৃষ্টিভ্রমের সৃষ্টি হয়। এই যুক্তিতে তিনি একক দৃষ্টি তারকার ঝিকিমিকি এবং প্রদোষকাল ও গােধুলির কারণ প্রভৃতির নির্ভুল ব্যাখ্যা দান করেন। দুরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কার, নানাস্থানে গৃহীত পর্যবেক্ষণের তুলনা, বায়ুমণ্ডলের উপাদান রাশি পরীক্ষার জন্য নির্মিত বিবিধ যন্ত্রের পূর্ণর্তা বিধান—পদার্থবিজ্ঞানের নীতির সুনিপুণ প্রয়ােগ এবং পরবর্তী ৯০০ বছরের পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানও এই সকল সিদ্ধান্তের কোনও বৈজ্ঞানিক রদবদল করতে পারেনি। ড্রেপার বলেন, প্রায় হাজার বছর পূর্বের লােক হলেও তাকে আধুনিক বিদ্যোৎবিদের অন্যতম সহচর বলেই মনে হয়।
খলিফা আল মনসুরের রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন আবু ইসহাক আল ফাজারী (৭৭৭)। ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে তিনিই প্রথম বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্রে তার চিন্তাধারা ছিল খুব উচ্চাঙ্গের। জানা যায়, তিনিই সর্বপ্রথম সূর্য ও নক্ষত্রসমূহের উচ্চতা নির্ণায়ক যন্ত্র আস্তারলব নির্মাণ করেন এবং অংকশাস্ত্রের অন্যান্য যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে পুস্তক প্রণয়ন করেন। গণিত বিষয়ে তাঁর প্রণীত গ্রন্থ এখনও অনেক বিষয়ে প্রামাণ্য হিসাবে গৃহীত হয়ে থাকে। আল ফাজারী প্রথম আরব গণনা পদ্ধতি সুনিয়ন্ত্রিত করে আরব বর্ষগণনা ও দিনপঞ্জী প্রণয়ন করেন। ভারতের তৎকালীন বিজ্ঞানী কঙ্কায়ন বা মঙ্ককে ‘সিদ্ধান্ত’ নামক গ্রন্থসহ তিনি মনসুরের দরবারে আনেন। আল ফাজারীর পুত্র আবু আবদুল্লাহ মােহাম্মদ পিতার উত্তরাধিকারের অংশীদার হয়েছিলেন। তিনি উক্ত ‘সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থটি খলিফার আদেশে ৭৭২/৭৩ সালে আরবিতে অনুবাদ করেন। এ অনুবাদের উপর ভিত্তি করেই আল খােয়ারিজমী তাঁর বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞান তালিকা ‘ফিল-জিজ’ প্রণয়ন করেন।
গণিতশাস্ত্র
ভারত এবং গ্রীক বীজগণিতের সীমিত চর্চা বাদ দিলে বীজগণিতের যে অবস্থা ছিল তাতে বিশ্বের তেমন কোনও মনযােগ ছিল না। আল খােয়ারিজমীই সর্বপ্রথম বীজগণিতকে অঙ্কশাস্ত্রের মধ্যে মর্যাদাসম্পন্ন করে তােলেন। এ জন্য তাঁকে আধুনিক বীজগণিতের জনক বলা হয়। তার অসামান্য প্রতিভা সম্পর্কে জর্জ সারটন লিখেছেন,
‘The greatest Mathematician of the time, and if one takes all circumstance into account, one of the greatest of all time was Al-Khwarizami.’
আল খােয়ারিজমীর জীবনী সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তিনি খলিফা মামুনের লাইব্রেরীর প্রধান লাইব্রেরীয়ান ছিলেন। গণিতের প্রায় প্রত্যেকটি শাখায় খােয়ারিজমীর অবদান রয়েছে। তবে বীজগণিতই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ দান। Robert of Chester এবং Adelard এই দুই জন আল খােয়ারিজমীর গণিতবিষয়ক গ্রন্থগুলির ল্যাটিন অনুবাদক হিসাবে খ্যাতির অধিকারী হয়ে রয়েছেন। Robert of Chester খােয়ারিজমীর শ্রেষ্ঠ অবদান ‘আল হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবেলার’ (‘দ্য ক্যালকুলেশন অফ ইন্টিগ্রেসন অ্যান্ড ইকুয়েশান’) ল্যাটিন অনুবাদ (১১৪৫) করেন। ১৯১৫ সালে Karpinski নিউইয়র্ক থেকে তা পুনঃপ্রকাশ করেন। ১৮৫৭ সালে রােম থেকে Prince Boncompegni কর্তৃক ল্যাটিনে অনূদিত হয় তার অপর গণিত পুস্তক ‘আল জামওয়া তাফরিক’, যার নাম দাঁড়ায় ‘Algoritmi denumero Indorum’। ইউরােপীয় ভাষার কবলে পড়ে আরও অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীদের মতাে আল খােয়ারিজমীর নাম হয়ে দাঁড়ায় আলগরিদম। বীজগণিতের অন্যতম অংশ লগারিদম যে আজ আমরা দেখতে পাই তা আল খােয়ারিজমী নাম থেকেই উদ্ভূত।
বর্তমান যুগে বিশ্বের সর্বত্র যে অ্যালজেবরা-এর বই পঠিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে তা মূলত ‘আল হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবেলা’ গ্রন্থ থেকে এসেছে। খােয়ারিজমীর এই বইটি এত বিখ্যাত ছিল যে, ইউরােপের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গণিত বিভাগে বইটি গণিতের রূপরেখা ও সমাধান দিয়েছে। ফিলিপ কে হিট্টি তার ‘The History of Arabs’ গ্রন্থে বলেন,
“দ্বাদশ শতাব্দীতে ক্রেমােনার জেরার্ড ল্যাটিন ভাষায় এই বইটির অনুবাদ করেন। তখন থেকে ষােড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরােপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে এই বইটি গণিতশাস্ত্রের প্রধান পাঠ্যবইরূপে ব্যবহার করা হত। আল খােয়ারিজমীর লেখা এই বইটি ইউরােপে বীজগণিতের প্রচলন করে। এমনকি ‘বীজগণিত’ নামটি এই বইটির মাধ্যমেই চালু হয়।”
পাশ্চাত্যে ও সমগ্র পৃথিবীতে সংখ্যাসমূহের ব্যবহার ও প্রচলনের ক্ষেত্রে এবং সেগুলিতে মূল্য আরােপ করে বিরাট সম্ভাবনায় ফলপ্রসু করার বিষয়ে আরবীয় বৈজ্ঞানিকগণ যে প্রথম ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এইচ জি ওয়েলস তার ‘দ্য আউট লাইন অব হিস্ট্রি’ গ্রন্থে বলেছেন যে, আল খােয়ারিজমী সংখ্যাসমূহের উপর মূল্য আরােপ করেছিলেন। প্রখ্যাত পণ্ডিত জর্জ সারটন মনে করেন যে, ভারতীয় গ্রন্থ ‘সিদ্ধান্ত’-র অনুবাদই সম্ভবত ইসলামে ভারতীয় সংখ্যাসমূহের প্রচলন হওয়ার কারণ। কিন্তু একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, তখনও পর্যন্ত ওই সংখ্যাগুলি কেবল প্রতীক ছিল এবং সেগুলি প্রায় অব্যবহৃত ও সুপ্ত ছিল। নিঃসন্দেহে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে বিভিন্ন সাংখ্যমানের ব্যবহারিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে মুসলমানরা নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল। এবং সমগ্র পৃথিবীতে তারাই দশমিক পদ্ধতি চালু করেছিল।
স্পেনীয় মুসলমানদের যােগ্যতার অধিক পরিচয় মিলে অঙ্কশাস্ত্রের উন্নতি বিধানে। তারা ইউরােপকে গণনার বহু কৌশল ও নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেয়। তাদের আরবি ‘সংখ্যা’ কষ্টকর রােমান সংখ্যার স্থান দখল করে। আমরা জানি যে, সাংখ্যমান পদ্ধতির মধ্যে শূন্য সংখ্যাটি এক প্রধান গুরুত্ব বহন করে, কারণ এই শূন্যই সংখ্যাসমূহের দশ, দশের কোনও গুণিতক, শত ইত্যাদি শত্তিতে সাংখ্যমানটি নিয়ে যেতে পারে। শূন্য সংখ্যাটি যদি না থাকত তাহলে আমাদের একক, দশক, শতক ইত্যাদির স্তম্ভ দিয়ে সারণি। ব্যবহার করে প্রতিটি সংখ্যাকে তার স্থানে রাখতে হত। এই সারণিকে বলা হয় অ্যাবাকাস। আমরা দেখতে পাই যে, পাশ্চাত্যের জনগণের কাছে শূন্য পরিচিত হওয়ার অন্তত ২৫০ বছর পূর্বে আরবীয়রা শূন্য সম্পর্কে জ্ঞান রাখত। রােমে বুয়েথিয়াসের নিকট পঞ্চম শতকে প্রথম অ্যাবাকাস রীতি দেখা যায়, কিন্তু তখন এর ব্যবহার বিস্তৃত হয়নি। দশম শতকে জারবার্টের দ্বারা এই নীতির পুনরাবির্ভাব হয়। জারবার্ট স্পেনে ভ্রমণ করেছিলেন এবং মূরদের বিজ্ঞানসমূহ অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি অ্যাবাকাসের ব্যবহারকে প্রসারিত করেছিলেন, কিন্তু শূন্যের সঙ্গে তার পরিচিতি হয়নি। দ্বাদশ শতকে খ্রিস্টান পাটিগণিতবিদগণ স্তম্ভ ছাড়াই এবং শূন্য দিয়ে পরিপূরণ করে গণনারীতির উপর নিবন্ধাদি লিখতে শুরু করেন। এই রীতিটিকে ‘আলগরিদম’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল। আরবীয়দের মধ্যে প্রথম থেকেই শূন্য নিয়েই সংখ্যাসমূহ প্রকাশিত হয়।
পিসার অধিবাসী ফাইবােনাক্কি জনৈক মুসলিম ওস্তাদের নিকট শিক্ষালাভ করে তার পুস্তকে ‘আরবি সংখ্যা’ গ্রহণ করেন। ১২০২-এ ফাইবােনাক্কি তার বইতে প্রথম আরবীয় (‘হুরূফ আল গুবার’) সংখ্যার ব্যবহার শুরু করেন। পি কে হিট্টি বলেন,
“সত্যকথা বলতে কি লিওনার্ডো ফাইবােনাক্কির বইয়ের মধ্য দিয়েই ইউরােপে গণিতশাস্ত্রের প্রচলন হয়েছিল। পুরনাে ধরনের সংখ্যার সাহায্যে পাটিগণিতের অগ্রগতি অসম্ভব হয়ে পড়ত। আজ যে ধরনের গণনা প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমরা পরিচিত, তার মূলে রয়েছে শূন্য এবং আরবী সংখ্যাগুলাের উপস্থিতি।”
একথা থেকে বােঝা যায় যে, বর্তমানে আমরা যে শূন্য ব্যবহার করছি তা ভারতীয় শূন্য নয়, এটি আরবদের আবিষ্কৃত হুরূফ আল গুবার। পি কে হিট্টি এই ‘হুরূফ আল গুবার’ (আরবীয় সংখ্যাতত্ত্ব) প্রচলনকে মাইল ফলক বলেছেন। তাই আল খােয়ারিজমী থেকে বর্তমান ইউরােপ অ্যালজেবরা, আলগরিদম, সাইফার, সাইন শব্দগুলি অকুণ্ঠায় গ্রহণ করেছে। উত্তরকালে গণিতশাস্ত্রের উন্নতি ও গণিতের সাহায্যে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় যে সব আবিষ্কার আজ পর্যন্ত অব্যাহত ধারায় হয়ে আসছে, তার বেসিক টুল বা মৌলিক যন্ত্র হিসেবে এই গণনা নীতিগুলির যে ব্যাখ্যা ও ব্যবহার আল খােয়ারিজমী করেছেন, তার অসামান্য মূল্য আজ বৈজ্ঞানিক মাত্রেই অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেন। এইচ জি ওয়েলস বলেন,
“আল খােয়ারিজমীই শূন্যের আবিষ্কারক। যদিও ভারতীয়রাই শূন্যের আবিষ্কার করে এই মর্মে অনেকে দাবী করেন, কিন্তু এর সার্থক ও সফল প্রয়ােগের জন্যই আল খােয়ারিজমী শূন্যের আবিষ্কারক বলে নন্দিত হয়ে আছেন।”
জাবির ইবনে আফনাহ (১১৫০) ত্রিকোণমিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করে টলেমীর মতবাদকে প্রচন্ড ঝাঁকুনি দেন। তিনি টলেমী উদ্ভাবিত ‘rule of six quantities’-র বৈজ্ঞানিক শুদ্ধতার ত্রুটি ঘােষণা করেন এবং একে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির অন্তরায় হিসাবে চিহিত করেন। এর পরিবর্তে তিনি ‘rule of four quantities’ প্রচলন করেন। এ থেকেই তিনি গােলীয় সমকোণী ত্রিভূজের ত্রিকোণমিতিক সূত্রসমূহ আবিষ্কার করেন, যা তাকে গণিতে অমর করে রেখেছে। ইবনে আফনাহ জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যার নাম ছিল ‘কিতাবুল হায়্যা’ অথবা ‘ইসলাহ আলমাজিস্তি’। এতে তিনি ত্রিকোণমিতির উপর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লিখেছিলেন। ইবনে আফনাহই প্রথম কো-সাইন ব্যবহার করেন। মিশরের ইবনে ইউনুসের (১০০৯) পুস্তক হতে মূরেরা Sec ও Tangent-এর ব্যবহার শিখেন। ৩০০ বছর পরেও ইউরােপীয়রা এগুলির খবর রাখত না। রােজিমন্টেনাসই (১৪৩৬-৭৬) সর্বপ্রথম Tangent ব্যবহার করে উহার নির্ঘন্ট প্রস্তুত করেন।
স্পেনের গাণিতিক আলি বিন মুহাম্মদ আল কালাসাদী (১৪৮৬-১৫৮৬) গণিতে মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। অঙ্কশাস্ত্রের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ‘থিওরী অফ নাম্বার’ সম্বন্ধে তাঁর অবদান সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য। পরিমিতিসহ গণিতশাস্ত্রে গভীর জ্ঞানের জন্য আল মাজরিতি ‘আল হাসিবা’ (গণিতবিদ) উপাধি লাভ করেন। আবুস সালাত (১০৬৭-) গণিতে ‘রিসালা ফিল আমল বিল আস্তারলব’ গ্রন্থ রচনা করেন। এতে তিনি আস্তারলব ছাড়াও Mechanics এবং Hydrostatics নিয়েও আলােকপাত করেন। ইবনে হাতিম আল নাইরিজি (৯২২), পাশ্চাত্যে আনারিতিউস নামে পরিচিত, আল মুতামিদ-এর সময় টলেমী এবং ইউক্লিডের উপর কমেন্টারী রচনা করে খ্যাতিলাভ করেছিলেন যা পরবর্তীকালে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। তিনি স্পর্শককে প্রকৃত ত্রিকোণমিতির উপাদান হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। স্পেনবাসী ইবনুল মাসাহ (৯৭৯-১০৩৫) অঙ্ক, ক্যালকুলাস, সংখ্যার প্রকৃতি, জ্যামিতি, আস্তারলব প্রণয়ন সম্বন্ধে অনেক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তিনি আস্তারলবের সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন ফল পর্যালােচনা করে একটি তালিকা রচনা করেন। সেভিলের ইবনে বিদার বীজগণিতের সারমর্ম ‘ইখতিসার’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এতে দ্বিঘাত সমীকরণ, করণী, অনুপাতের আঙ্কিক থিওরী প্রভৃতি নানা বিষয়ে আলােকপাত করা হয়। সঙ্গীতজ্ঞ জিরাবের বিজ্ঞানচর্চার প্রতি অনুরাগ ছিল জন্ম হতেই। এই পথেই তিনি একদিন পাথর হতে কাঁচ তৈরীর পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। দ্বিতীয় আবদুর রহমানের সাহায্যে তিনি নিজ বাড়িতে ‘নেটারিয়াম’ বা তারামণ্ডল তৈরী করেছিলেন, যেখান থেকে আকাশ, তারা, এমনকি বিদ্যুৎও দেখা যেত। তার ছাত্র আব্বাস ইবনে ফিরনাসই প্রথম মানুষ যিনি মানুষের জন্য পালকের তৈরী ডানা প্রস্তুত করেন। এটার সাহায্যে কিছুদুর উড়ে যাওয়া যেত।
উদ্ভিদবিদ্যা
উদ্ভিদবিদ্যার মৌলিক গবেষণা দ্বারা স্পেনীয় আরব মুসলমানগণ সারা বিশ্বকে সমৃদ্ধি দান করে গেছেন। তাল ও শন জাতীয় গাছের মধ্যে যে যৌন পার্থক্য, এটা তাদের বিস্ময়কর আবিষ্কার। তারা গাছগুলােকে (যাদের কোনাে বীজ নেই, কলমও নেই— যেমন কলাগাছ, অনেক ফুলগাছ) তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছিলেন—বীজ হতে, কলম হতে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে ওঠা গাছ। যাঁরা এই কাজে জগৎ-জুড়ে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিলেন, তারা হলেন ইবনে আল বাইতার, আবু জাকারিয়া, ইবনে সাবইন, আল গাফিকি, আবু জাফর আহমদ ইবনে মহম্মদ প্রমুখ। তারা বহু দেশ হতে বহু গাছ সংগ্রহ করেছিলেন। আরবি-ল্যাটিন ও বার্বার ভাষায় প্রতিটি গাছের নামকরণও করেছিলেন এবং আরবি ভাষাতে তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণও লিপিবদ্ধ করেছিলেন। দ্বাদশ শতাব্দীর উদ্ভিদ বিশারদ আবু জাকারিয়া এই জগতের একজন দিকপাল। তার কর্মময় জীবন গড়ে ওঠেছিল সেভিলে। কৃষি সম্পর্কে তাঁর প্রধান বই ‘আল-ফিলাহ’, সমগ্র মধ্যযুগেরই উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থটিতে তিনি তিনদিক আলােচনা করেন— গ্রিক উৎস, আরবীয় উৎস ও স্পেনের মুসলিম কৃষককুলের অভিজ্ঞতা। এই গ্রন্থে তিনি ৫৮৫টি গাছ নিয়ে নিগুঢ় আলােচনা করেন, যেখানে ৫০টি ফলের গাছও আলােচিত হয়। গাছের মাটি, সার, আলাে, বাতাস, রােগ প্রভৃতি সম্পর্কেও তন্ন তন্নভাবে। আলােচনা করেন। ইবনে বাইতার (১২৪৮) ছিলেন উদ্ভিদ জগতের প্রবাদ পুরুষ, তিনিই বর্তমান উদ্ভিদবিদ্যার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি স্পেনের মালাগায় জন্মগ্রহণ করেন। বহু দেশ পরিভ্রমণ করেন। পরে আল কামিলের নিকট প্রধান উদ্ভিদবিদ হিসাবে চাকুরি গ্রহণ করেন। দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন— ‘আল্-মুগান ফী আল্-আদবিয়া আল মুদা’, এবং অন্যটি ছিল—‘আল-জামি ফী আল আদবিয়া আল মুদা’। ১৭৫৮ সালে ইবনে বাইতার রচিত বই দুটির ক্রিমােনাতে ল্যাটিন অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। গ্রন্থ দুটিকে উদ্ভিদ বা ভেষজবিদ্যার বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে। উদ্ভিদ জগতের উপর গ্রন্থ দুটোকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলা হয়ে থাকে। ২০০ গাছের ওপর ১৪০০ উপাদানসহ তিনি গবেষণা পরিচালনা করেন। এই উদ্ভিদ জগৎ হতেই জন্ম নিয়েছিল চিকিৎসা জগৎ। নানা প্রকারের গাছ-গাছড়া হতে তৈরি হতে থাকল নানা রােগের প্রতিষেধক। আমাদের দেশের হাকিম কবিরাজি আজও গাছ-গাছড়া নির্ভর। ইউরােপ সেখানে আধুনিকতার প্রলেপ দিয়েছে।
আল হামরা : স্থাপত্যের বিখ্যাত নিদর্শন
গ্রানাডার আল হামরা ছিল লাল চুনকামে গড়া বিশ্ববিখ্যাত প্রাসাদ। মূর স্থাপত্যের এটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আল হামরার স্থপতিদের দ্বারা নির্মিত চৌদ্দ শতকের সূক্ষ্ম জরির মত অলংকরণ গুঁড়া মার্বেল পাথর, চুন ও জিপসাম এবং তার সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে ডিমের শুভ্র অংশ মিশিয়ে প্রায় তরল অবস্থায় ছাঁচে ঢেলে প্রস্তুত করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। প্রাসাদের আসবাবপত্রগুলি চন্দন কাঠের নির্মিত ছিল এবং সেগুলি মুত্তা সৃজনকারী ঝিনুক, হস্তীদন্ত ও রৌপ্য খচিত ছিল কিংবা স্বর্ণ অলংকরণে শােভিত ছিল।
সমদূরত্বে ক্ষুদ্রাকৃতির স্তম্ভসমূহ যার মাথার উপর সূক্ষ্ম নকশা খােদাই করা খিলান, বৃহৎ বৃহৎ পদকসমূহ, পত্র-পুষ্পের মালা, বংশ-কুল-পরিচয়, সংক্ষিপ্ত নীতিবাক্য, আরবি পাঠও পুরাকথা যেগুলি ডানদিক থেকে সহজে পাঠ করা যায়, জ্যামিতিক নকশাসমূহ এগুলি ছিল আল হামরার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য। এগুলি যেমন আমাদের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে তেমন আমাদের কল্পনার কাছে আবেদন রাখে। মূর সভ্যতার সাত শতাব্দীর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দক্ষতা ও প্রতিভার ফসল এই আল হামরা ছিল সে যুগের চরম বিজয়ের নিদর্শন। এটির নির্মাণ শৈলীর নিঃসন্দেহে কোনও পূর্ব নজির ছিল না। এস পি স্কট তার ‘The Moorish Empire in Europe’ গ্রন্থে (Vol.-3, Chapter-29) লিখেছেন, এই অনিয়মতান্ত্রিকতা, কলাশিল্পের এই স্বেচ্ছাচারী অনমনীয় নীতিসমূহের স্বাধীনতা এটির সর্বোত্তম মনােহারিত্ব সৃষ্টি করেছে। এটি ছিল বিশটি প্রজন্মের শ্রমের উল্লেখযােগ্য কৃতিত্বপূর্ণ কীর্তি। এটি ছিল সেই মার্জিত যুগের কলা, শিল্প ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিকর শ্রেষ্ঠ কমনীয় ধারণার মূর্ত প্রতিরূপ।
১২৪৮ সালে রাজা প্রথম মহম্মদ প্রাসাদের কাজ আরম্ভ করেন। পরে ইউসুফ আল হাজ্জাজ ১৩৩৩-১৩৫৪ সাল পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যান। তারপর পঞ্চম মহম্মদ ১৩৫৯ খ্রীস্টাব্দে এই বিবিখ্যাত স্থাপত্য শিল্পের সর্বশেষ শৃঙ্গের ওপর তুলিকা বুলিয়ে দেওয়ার গৌরব অর্জন করেন। যখন এই অকল্পনীয় প্রাসাদ তৈরি হলাে, তখন স্পেনে মুসলমান বা মূরগণের পতনের যুগ (১২৩৮-১৪৯২) চলছিল। পতন যুগেও স্থাপত্য শিল্পের পিরামিড তৈরি হলাে ‘আল হামরা’।
আল হামরার উল্লেখযােগ্য অংশ রাজদরবার, যেটি সিংহমূর্তি দ্বারা অভাবনীয়ভাবে সাজান। কেন্দ্রস্থলে শ্বেত পাথরের ১২টি সিংহমূর্তি বৃত্তাকারে স্থাপিত। এদের প্রত্যেকের মুখ হতে দিবারাত্রি এক একটি জলপ্রপাত জলের ফোয়ারা আকারে নির্গত হচ্ছে। কোথাও কোনাে দরবারে দশ জন বিখ্যাত শাসকের ছবি। প্রতিটি দরবারে প্রধান প্রধান স্থানে পবিত্র কুরআনের শার্বত বাণীগুলাে অপূর্ব নকশাকারে দর্শকের চোখকে মুগ্ধ করে তুলেছে। প্রাসাদের গঠন বা আকৃতিগত প্রকৃতি চিন্তা করা যায় না।
এমন কতকগুলাে বস্তু ওর গঠন প্রণালীতে প্রয়ােগ করা হয়েছিল, যা বর্তমান জগতেও অসম্ভব। যেমন শব্দ ভাণ্ডার। যে কোনাে দরবার ঘরে আস্তে কথা বললেও সকলেই সমানভাবে সহজেই শােনতে পেতাে। আমাদের বহু প্রাচীন মসজিদে ওটা এখনাে লক্ষ করা যায়। হুগলি-পাণ্ডুয়ার হযরত শাহ সুলতানের (রহঃ) মাজারের সম্মুখে যে মসজিদটি আছে, সেখানে মসজিদের ইমামের কেরাত (নামায-ধ্বনি) বিনা মাইকে বাহির হতেও শােনা যায়। এইরূপ অসংখ্য গুণাবলিতে আল হামরা প্রাসাদ, দরবার, মসজিদ গুণান্বিত হয়ে ওঠেছিল। আল হামরার অসংখ্য গুণাবলির মধ্যে দুটো প্রধান, যা আজও বিশ্বকে ভাবিয়ে তােলে। ওই প্রাসাদে পৃথকভাবে আলাে ও বাতাসের কোনাে ব্যবস্থাপনার প্রয়ােজন ছিল না। ওখানে আপনা-আপনি আলােবাতাস দিবারাত্রি বইতে থাকত। ওখানকার খ্রিস্টানগণ ওর কিছু সংস্কার করতে যাওয়ায় সবকিছু রসাতলে গেছে। আজও ফিরে আসেনি। ওটাকে ফিরিয়ে আনতে বর্তমান বিধের বিজ্ঞানীদের আরও কত বছর লাগবে, তা কে বলতে পারে!
আরবীয়রা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যবহারিক অনুশীলনের উপর যে বিশাল গুরুত্ব আরােপ করত আল হামরার স্থাপত্যরীতি তারই ফলশ্রুতি। গণিতশাস্ত্রে তাদের নিঃস্বার্থ নিষ্ঠা, গবেষণা ও অধ্যয়ন তাদের বিজ্ঞতার শিখরে উন্নীত করেছিল এবং স্থাপত্যের উন্নয়ন ও পূর্ণাঙ্গতা সাধনে অধিক পরিমাণে অবদান যুগিয়েছিল। জ্যামিতিতেবীজগণিতের প্রয়ােগ যান্ত্রিক ও গাণিতিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল প্রত্যেকটি কলাশিল্পের উন্নয়নে অপরিমেয়ভাবে সাহায্য করেছিল এবং স্থাপত্য ছাড়া অন্য কোনও বিষয় এর কাছে অধিকতর ঋণী ছিল না। কর্ডোভা, সেভিল, ভ্যালেনসিয়া, মালাগা ও টলেডাের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে স্থাপত্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উন্নত ট্রেনিং প্রদান করা হত। শিক্ষার্থীদের জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, অঙ্কন ও স্থাপত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গাণিতিক বিজ্ঞানের শাখাসমূহ শিখতে হত। এ সকল বিষয়ের পাঠের সম্পূরক হিসাবে প্রতিভাবান শিক্ষকদের দ্বারা সেগুলি প্রয়ােগের ব্যবহারিক প্রদর্শনী পাঠদানের ব্যবস্থা ছিল। এ সকল প্রতিষ্ঠান স্থাপত্য ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিজ্ঞানের পথে ট্রেনিং দেওয়ার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং এভাবে পাশ্চাত্যের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্যে পথ সুগম করেছিল।
এইভাবে স্পেনের মূর সাম্রাজ্যের জ্ঞানচর্চা সমগ্র ইউরােপকে আঁধারে আলাে দান করেছিল। স্পেনে মুসলমানদের পতনপরবর্তী ধ্বংসযজ্ঞ বিশেষ করে মুসলিম জ্ঞানবত্তার পরিচয়বাহী লক্ষ লক্ষ পুস্তক পুড়িয়ে নদীতে ডুবিয়ে ধ্বংস করা না হলে, মােঙ্গলদের হাতে বাগদাদের লাইব্রেরীগুলি ধ্বংস না হলে হয়তাে মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। মূল জ্ঞানভান্ডার ধ্বংস সাধনের পরও বিক্ষিপ্তভাবে প্রাপ্ত গবেষণার পরিণতিতে মুসলমানদের যে বিশাল অবদান আজ পরিলক্ষিত হয় তা বহুগুণ বর্ধিত হত তা বলা নিষ্প্রয়ােজন। যেটুকু জানা যাচ্ছে, তাতে আজ কট্টর প্রাচ্যবিদরাও মুসলিম সভ্যতাকে প্রাপ্য সম্মান দিতে কসুর করছেন না, অথচ এক সময় তারা মুসলিম যুগকে অন্ধকার যুগ বলে নাক সিটকিয়ে নিজেদের হীনমন্যতাকে বার বার বাড়িয়ে তুলতেন। আজ ইউরােপ স্বীকার করতে বাধ্য যে, আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রকৃত নির্মাতা আরবরাই। আর এক্ষেত্রে মুসলিম স্পেনের অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। রােজার বেকন যথার্থই বলেছেন,
‘Spain set to all Europe the example of a civilized and shining empire.’
সহায়ক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ :
- জর্জ সারটন, ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য হিস্ট্রি অফ সায়েন্স, ৩ ভলিউম, কার্নেগী ইনস্টিটিউট অফ ওয়াশিংটন, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৫৩।
- জর্জ সারটন, এ হিস্ট্রি অফ সায়েন্স, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫৩।
- জন উইলিয়াম ড্রেপার, এ হিস্ট্রি অফ ইনটেলেকচুয়্যাল ডেভেলপমেন্ট অফ ইউরােপ, লন্ডন, ১৯১০।
- স্যার টমাস আরনল্ড ও আলফ্রেড গিলম সম্পাদিত, দ্য লিগ্যাসি অফ ইসলাম, অক্সফোর্ড, ১৯৭৪ অনুবাদ-নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশান, বাংলাদেশ, ২০০০।
- কারা ডি ভক্স, অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড ম্যাথমেটিক্স দেখুন-স্যার টমাস আরনল্ড ও আলফ্রেড গিলম সম্পাদিত, দ্য লিগ্যাসি অফ ইসলাম, অক্সফোর্ড, ১৯৭৪ অনুবাদ-নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশান, বাংলাদেশ, ২০০০।
- রবার্ট ব্রিফল্ট, দ্য মেকিং অফ হিউম্যানিটি, ইসলামিক বুক ফাউন্ডেশান, লাহাের, ১৯৮০।
- এম আকবর আলি, বিজ্ঞানে মুসলমানের অবদান, কলকাতা, ১৯৪৩।
- আব্দুর রহমান খান, মুসলিম কন্ট্রিবিউশান টু সায়েন্স অ্যান্ড কালচার, লাহাের, ১৯৪৬।
- সৈয়দ আমির আলি, দ্য স্পিরিট অফ ইসলাম অনুবাদ-এম দরবেশ আলি খান, ইসলামিক ফাউন্ডেশান, বাংলাদেশ, ১৯৯৩।
- পি কে হিট্টি, হিস্ট্রি অফ আরবস, লন্ডন, ১৯৭২ অনুবাদ-মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৯৬।
- কে আলি, মুসলিম সংস্কৃতির ইতিহাস, ঢাকা, ১৯৮১।
- এম আব্দুল কাদের, মুসলিম কীর্তি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৮
- এম এন রায়, দ্য হিস্টোরিক্যাল রােল অফ ইসলাম, বাংলা অনুবাদ-অধ্যাপক এম আবদুল হাই, রেনেসাঁস, কলকাতা, ২০০৪।
- মরিস বুকাইল, দ্য বাইবেল দ্য কুরআন অ্যান্ড সায়েন্স, ইউ এস এ, ১৯৭৮।
- আর এম সাভরি, ইনট্রোডাকশান টু ইসলামিক সিভিলাইজেশন, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৭।
- সমরেন্দ্রনাথ সেন, বিজ্ঞানের ইতিহাস, শৈবা প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৯৪।
- জিয়াউদ্দিন সরদার, সায়েন্স টেকনােলজি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড, লন্ডন, ১৯৭৭।
- এস লেনপুল, দ্য মুরস ইন স্পেন, ১৯৫৯।
- নুরুল হােসেন খন্দকার, বিশ্ব সভ্যতায় মুসলিম অবদান, ইসলামিক ফাউন্ডেশান, বাংলাদেশ, ১৯৮৮।
- জিয়াউদ্দিন আহমেদ, বিশ্বসভ্যতায় ইসলামের প্রভাব, লেখা প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০৩।
- মহম্মদ সাউদ, ইসলাম ও বিজ্ঞানের বিবর্তন, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৯৬।
- মুহাম্মদ নুরুল আমিন, বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, আহসান পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০০২।
- শরিফুল ইসলাম সরকার, মুসলিম স্পেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশান, বাংলাদেশ, ১৯৮৭।
- ওসমান গণী, স্পেনের মূর খেলাফৎ, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ২০০৫।
- এইচ আর টার্নার, সায়েন্স ইন মেডিয়াভ্যাল ইসলাম, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৭।
- ডি আর হিল, ইসলামিক সায়েন্স অ্যাণ্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৩।
- সি বি বয়ার, এ হিস্ট্রি অফ ম্যাথমেটিক্স, সেকেণ্ড এডিশন, জন ওয়াইলি অ্যাণ্ড সন্স, ১৯৬১।
- বার্নাড লুইস, ইসলাম ইন হিস্ট্রি, অ্যালকোভ প্রেস, লণ্ডন, ১৯৭৩।
- ম্যালিস থভেন, ইসলাম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড, পেঙ্গুইন বুকস্, ১৯৯১।
- পারভেজ হুডবয়, সায়েন্স অ্যাণ্ড ইসলাম, জেড বুকস্, লণ্ডন, ১৯৯১।
- টি ই হাফ, দ্য রাইজ অফ আর্লি মডার্ণ সায়েন্স, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৫।
- ড্যানিয়েল ব্রাউন, রিথিংকিং ট্রাডিশন ইন মডার্ন ইসলামিক থট, কেমব্রিজ প্রেস, ১৯৯৯।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।