লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
পর্ণোগ্রাফী এমন একটি ইন্ডাস্ট্রি যেখানে অধিকাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। অথচ এই তথ্য মানুষের কাছে গোপন করে রাখা হয়।
‘দি গার্ডিয়ান’ এর রিপোর্ট অনুযায়ী একজন সাবেক পর্ন অভিনেত্রী বলেছেন, “তারা আমার উপর শারীরিক নির্যাতন চালাত… প্রায় সব মেয়েরাই কান্নাকাটি করত, তারাও অস্বাভাবিক কষ্টের মধ্যে থাকত… আমি শ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারতাম না। তারা আমাকে মারধর করত, তারা আমার গলা টিপে ধরত। আমি প্রচুর কষ্ট পেতাম। তবুও তারা থামত না। ক্রমাগত শুটিং করে যেত। আমি তাদেরকে অনুরোধ করে বলতাম ক্যামেরা বন্ধ করতে, কিন্তু তারপরেও তারা শুটিং করেই যেতো…”
টানা ৩৫ মিনিট চাবুকের নির্যাতনে সহ্য করা একজন নারী পর্ন অভিনেত্রীর স্বীকার করেছেন, “এর আগে আমি কখনোই এত জঘন্য শারিরিক নির্যাতনের শিকার হইনি। আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে স্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছে। আমি কখনোই ভাবতে পারিনি যে, এই ধরনের নির্যাতনের শিকার আমাকে হতে হবে।”
মার্কিন পর্ন তারকা শেলি লুবেনের বলেছেন, “পর্ন আসলে ‘ফেইক সেক্স’। ভিডিওতে যৌনতার মুহূর্তগুলি ফ্রেমবন্দি করা ছাড়া আর কিছুই সেখানে নেই, আর এটাই সত্য।”
তিনি আরও বলেন, “পর্ন হল বিশ্বের সব থেকে বড় বিভ্রম”। (সূত্রঃ জি ২৪ ঘন্টা/ অনলাইন সংস্করণ, ১৭ নভেম্বর ২০১৭)
মনে করুন ২০০৪ সালের ঘটনা, ইরাক দখল করে আমেরিকান বর্বর সৈন্যরা আবু গারিবে বন্দীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন ও নিপীড়ন চালায়। বন্দীদের ওপর যৌন নির্যাতন করা ছিল আবু গারিব কারাগারের দৈনন্দিন ঘটনা। ২০০৯ সালে পৃথিবীবাসী জানতে পারে, আবু গারিবে বন্দীদের ওপর ভয়ঙ্কর সব যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এসবের প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন ছবি এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায়।
সেইসব প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়- ইরাকি বন্দীরা শরীরে শিকল এবং মাথায় আন্ডারওয়্যার পরিহিত অবস্থায় মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছে, আবার কেউ ক্যামেরার সামনে হস্তমৈথুন করছে। এ সব কাজই তারা করছে বাধ্য হয়ে। আবু গারিব কারাগারের একজন বন্দী তদন্তের সময় বলেন, আবু গারিবে বন্দি থাকার সময় তিনি একজন ইরাকি কিশোরকে ধর্ষণ করা হয়েছিল এমন একটি দৃশ্য দেখেছিলেন। তিনি সেই দৃশ্যটি বর্ণনা করেন, একজন আর্মি ট্রান্সলেটর সেই কিশোরটিকে ধর্ষণ করছে এবং একজন নারী সৈনিক সেই দৃশ্যের ছবি তুলছে। একটি ছবিতে দেখা যায় একজন আমেরিকান সৈনিক একজন নারী বন্দীকে ধর্ষণ করছে। অন্যান্য অনেক ছবিতে দেখা যায় থেকে বন্দীদের ওপর লাঠি, ইলেক্ট্রিক তার, টিউব লাইট, ইত্যাদি দ্বারা যৌন নির্যাতনের ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য। এসব ছবি প্রকাশিত হলে বিশ্বজুড়ে আমেরিকা-বিরোধী মনোভাব মাথা চাড়া দিতে পারে সেজন্য বারাক ওবামা প্রশাসন এসব ছবি জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি।
অনেক ছবিতেই দেখা যায় সেইসব বর্বর আমেরিকান সৈন্যরা বন্দীদের শরীরের উপর দাঁড়িয়ে, মুখে বিজয়ের হাসি নিয়ে ‘থাম্বস আপ’ সাইন দেখিয়েছে। তবে ঘটনার তদন্তের পর বেশ কিছু আমেরিকান সৈন্যকে অসম্মানজনকভাবে চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং অন্যদেরকে জেল খাটতে হয়।
সেই একই বছরে পর্নোগ্রাফাররা অনেকটা একইভাবে হাজার-হাজার নারীর উপর যে নির্যাতন করা হয় তার ভিডিও করে এবং ছবি তুলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয় এবং লাখ-লাখ পর্ন দর্শকের সামনে তাদের প্রতি নির্যাতনের কথা তুলে ধরে। অথচ কেউ এ নিয়ে সারা বিশ্বে কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়নি। অথচ ইন্ডাস্ট্রিতে যেভাবে নারী নির্যাতন করা হয়, তা ইরাকের আবু গারিবের সাথে তুলনায় কোন অংশে কম নয়। সেইসব নির্যাতনের দৃশ্য দেখলে শরীরের রোমকুপ খাড়া হয়ে যাবে। অথচ এইসব নরপশু জঘন্য পর্নোগ্রাফাররা বলে কিনা, সব নারীরা স্বেচ্ছায় এবং খুশি-মনে পর্নোগ্রাফীতে অভিনয় করে!
“সেক্স ট্রাফিকিং (sex trafficking) বা মানব পাচার” গরীব দেশগুলোর একটি প্রধান সমস্যা। জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি বা চাইল্ড পর্নোগ্রাফি অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই বেশি লক্ষ্য করা যায়। সেক্স ট্রাফিকিং (sex trafficking) হচ্ছে, “আধুনিক দাসপ্রথা, যা ইউনাইটেড স্টেট সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও সমানভাবে বিরাজমান। হুমকি, শারীরিক নির্যাতন, মিথ্যা এবং বিভিন্ন ধরনের লোভ দেখিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীদেরকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে যৌন ক্রিয়া করতে বাধ্য করাকে বলা হয় সেক্স ট্রাফিকিং।”
সুতরাং পর্ন ইন্ডাস্ট্রির আড়ালে কিভাবে জঘন্য নারী নির্যাতন চলছে তা একজন পর্ণোগ্রাফী ব্যবহারকারী আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারগুলো বুঝতেই পারে না।
সমীক্ষায় দেখা গেছে ২০০৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্যারন্যানদো ভ্যালিতে গড়া বিশাল পর্ণোগ্রাফী ইন্ডাস্ট্রির ১,৫০০ যৌনকর্মীর মধ্যে ২২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে এইডস, সুইসাইড এবং হত্যাতে। এদের অধিকাংশই অকাল মৃত্যু হয়েছে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৪০ বছর বয়সী জনপ্রিয় পর্ণ তারকা জেসিকা জেমস লস এঞ্জেলসে নিজের ঘরের গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁর ঘরের মধ্যেই ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তাঁর মৃতদেহ।
অন্য কোনো ইন্ডাস্ট্রিতে এমন দেখা যায়না। কয়েক বছরে ২২৮ জন পর্ন ইন্ডাস্ট্রির যৌনকর্মীর মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণা করা হয়। গবেষণায় দেখা যায় যে, ড্রাগ, সুইসাইড, মার্ডার এবং এইডস এর মতো রোগে একই ইন্ডাস্ট্রির এতোগুলো মানুষ মারা গেছে যা একেবারেই অস্বাভাবিক ব্যাপার। সেই গবেষণা থেকে সবচেয়ে রহস্যজনক যে সত্য বেরিয়ে আসে তা হল- একজন পর্ন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর আয়ুষ্কাল মাত্র ৩৬.২ বছর যেখানে একজন অ্যামেরিকানের আয়ুষ্কাল ৭৮.৬ বছর।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে নয়টি দেশের ৮৫৪ জন পতিতা নারীদের মধ্যে শতকরা ৪৯ ভাগ স্বীকার করেছে যে পতিতাবৃত্তির সময় ভিডিও করে পর্ন মুভি বানানো হয়েছে। শতকরা ৪৭ ভাগ স্বীকার করেছে যে, তাদের পুরুষ সঙ্গীরা তাদেরকে সেইসব যৌন দৃশ্যে কাজ করতে বাধ্য করেছে যা তা পর্ণোগ্রাফীতে দেখানো হয়।
পর্ণোগ্রাফী ইন্ডাস্ট্রির সবথেকে যেটা জঘন্য বিষয় সেটা হল গা ঘিনঘিনে বিভিন্ন যৌন রোগ। লস অ্যাঞ্জেলসের সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০-২৪ বছর বয়সীদের তুলনায় যৌনকর্মীদের ক্লামিডিয়া ও গনেরিয়া সংক্রমণ হওয়ার সম্ভবনা ১০ গুণ বেশি। তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে এই রোগগুলো সংক্রমণ সম্ভবনা যৌনকর্মীদের মাঝে অকল্পনীয় ভাবে বেশি। ডাক্তার শেরন মিশেল – সাবেক পর্ণ অভিনেত্রী ও AIM (Adult Industry Medical Healthcare Foundation) এর প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে এক সাক্ষাতকার দেওয়ার সময় যৌন রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা সুনিশ্চিত করেছেন । তিনি বলেছেন “৬৬% যৌনকর্মী হারপিস এ ভোগেন, ১২-২৮% এর রয়েছে যৌন রোগ, ৭% এর রয়েছে HIV”।
যৌন কর্মীদের মধ্যে কোন যৌন রোগ আছে কিনা সেটা পরীক্ষা পর্ণ ইন্ডাস্ট্রির দালালেরা করেনা। যৌনকর্মীরা তাদের নিজ খরচে যৌন পরীক্ষা করে। পর্ণ ভিডিওতে একজন নারী একাধিক পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ফলে পর্ণ ইন্ডাস্ট্রিতে যৌন রোগের প্রাদুর্ভাব সবথেকে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করছে।
পর্ণোগ্রাফী ইন্ডাস্ট্রির একটি মারাত্মক বিষয় প্রভাব হল পর্নোগ্রাফাররা চুড়ান্ত পর্যায়ে মাদকদ্রব্য সেবন করে। একজন পর্ণ অভিনেত্রী স্বীকার করেছেন “আমরা যেসব মাদকদ্রব্যগুলো সেবন করি সেগুলি হল এক্সটেসি, ভালিউম, মারিজুয়ানা (গাজা), কোকেইন, জানাক্স, ভিসোডিন আর এলকোহল।”
২০১২ সালে ১৭৭ জন পর্ণ অভিনেত্রীদের উপর একটা সমীক্ষা করা হচয়। সেখানে দেখা গেছে জীবনে একবার হলেও ৭৯% পর্ণ অভিনেত্রী মারিজুয়ানা (marijuana) ব্যবহার করেছেন, হ্যালুসিনোজেনস্ (hallucinogens) ব্যবহার করেছেন ৩৯%, এসটেসি (ecstasy) ব্যবহার করেছেন ৫০%, কোকেইন (cocaine) ব্যবহার করেছেন ৪৪%, মেথামফেটামিন (methamphetamine) ব্যবহার করেছেন ২৭%, ট্রাঙ্কুইলিজারস (tranquilizers) ব্যবহার করেছেন ২৬%, হেরোইন (heroine) ১০%।
জানুয়ারি ২৮,২০০৮ এ এক পুরুষ পর্ণ অভিনেতা তাঁর ব্লগে লিখেনঃ
“ড্রাগ আমাদের পর্ণোগ্রাফী ইন্ডাস্ট্রিতে একটি খুব বড় সমস্যা। কেউ যদি আপনাকে এর বিপরীত কিছু বলে থাকে তাহলে সে মিথ্যা কথা বলছে। শুধু এই ড্রাগের জন্য অসংখ্য মেয়ে বেচে থাকার উদ্যম সব হারিয়ে ফেলেছে। এইসব কথা ভাবলেই আমার খুবই কষ্ট হয় আর তাদের এই নৈতিক অধঃপতন আমার কাছে খুবই বেদনাদায়ক। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বেশিরভাগ ড্রাগে আসক্ত প্রফেশনাল সাহায্য ছাড়া তাদের অভিশপ্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। আমি শুটিং স্পট থেকে শুরু করে বিভিন্ন পার্টি এমনকি গাড়িতেও ড্রাগের যথেচ্ছ ব্যবহার দেখেছি।”
সুতরাং ভাবুন পর্ণোগ্রাফী সমাজে কতটা পরিমাণ ক্ষতিকর হলে এমনটা হয়। ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন।
পর্ণোগ্রাফী সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন,
১) পর্নগ্রাফি মানুষের মস্তিষ্কের উপর যেভাবে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে
২) পর্নোগ্রাফী মানুষের যৌন তৃপ্তি বাড়ায় না, বরং কমিয়ে দেয়