লিখেছেনঃ মনীষা বন্দোপাধ্যায়
উচ্চপর্যায়ের এই কমিটিতে কোন মহিলা সদস্য ছিলেন না। এই বাদ-পড়াটা রাষ্ট্রীয় বিবেচনার একটি সাধারণ রূপ, বেশিরভাগ কমিটিতেই এটা ঘটে যায়। কিন্তু কমিটির চেয়ারপার্সন রাজিন্দার সাজার রিপাের্টের ভূমিকাতেই.এই বাদ পড়া সম্বন্ধে সচেতন থেকেছেন। তিনি জানিয়েচেন বিভিন্ন মহিলা সংগঠন তাদের কাছে এই অভিযােগ করেছেন। কমিটি এই ঘাটতি পুরণে প্রয়াসী হয়ে বিভিন্ন রাজ্যে তাদের পরিব্রমণের সময় বিভিন্ন মহিলা সংগঠনের সাথে কথা বলেছেন। সেখানে মহিলা সামাজিক কর্মীরা খােলাখুলি তাদের বক্তব্য জানিয়েছেন। এছাড়া ২০০৬ সালের জুলাইতে সারা দেশ থেকে আগত-মহিলাদের সাথে কমিটি একদিনের একটি বৈঠক করেছেন।
রিপাের্টের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের পরিচয় ও লিঙ্গ (Identity and Gender). শীর্ষক অনুচ্ছেদে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু অবলােকন আছে। সাধারণভাবে যে কোনাে পশ্চাদপদ গােষ্ঠীর মেয়েদের আরাে বেশি পশ্চাদপদতার জন্য সেই গােষ্ঠীকেই দায়ী করা হয়। মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই দোষারােপটি ভয়হকর মাত্রায়। কমিটি লক্ষ্য করেছেন মুসলমান মহিলা সংক্রান্ত কিছু কিছু ঘটনা বার বার সংবাদ মাধ্যম এমনভাবে আলােচনায় আনছে যে এই ধারণা তৈরি হচেছে যেন এই সম্প্রদায়ের লিঙ্গ-বৈষম্যের মূল কারণ তাদের ধর্মমত। ফলে নাগরিক সমাজ এবং রাষ্ট্র উভয়েই বঞ্চনার মূলে যে সামাজিক বৈষম্য এবং ত্রুটিপূর্ণ উন্নয়ন নীতি সেদিকে নজর না দিয়ে কারণগুলি ধর্মীয়-গােষ্ঠীগত পরিসরেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। এখানেই রাষ্ট্রের দায় শেষ- সম্প্রদায়কে দায়ী করেই সে খালাস।’
কমিটির কথায় যে কোন সম্প্রদায়ে মহিলারাই পরিচয়ের মশাল বহন করেন। ফলে সম্প্রদায় গত পরিচয় বিপন্ন হলে মেয়েরাই স্বচেয়ে পীড়িত হয়ে পড়েন। এমনিতেই স্বেচ্ছায় বা সামাজিক চাপে মহিলারাই সম্প্রদায় সূচক রীতিনীতি বেশি। মেনে চলেন। বহির্জগতে তাদের জীবন, নৈতিকতা চলাফেলা অনেকটাই এর দ্বারা। নিয়ন্ত্রিত হয়। পাশাপাশি সম্প্রদায় হিসাবে নিরাপত্তাহীনতার ভয়ও তাদের বেশি। ফলে তাদের কাছে নিরাপদ এবং অ-নিরাপদ স্থানের সীমাটাও সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়।
আজকের ভারতে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এমন যে বহু মুসলমান নারীদের কাছে নিরাপদ স্থান হল তার ঘর এবং গােষ্ঠীর সীমানা। বাইরের সবকিছুই বাজার, রাস্তা, গলি বা সাধারণের যানবাহন, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, থানা, সরকারি দপ্তর সমস্তই বিপজ্জনক। যদিও বিভিন্ন আলােচনায় মেয়েরা কমিটিকে জানিয়েছেন শিক্ষা ও কাজের উপযুক্ত সুযােগ পেলে তারা এই সমস্যাগুলাে নিজেরাই কাটিয়ে উঠবেন।
মুসলমান মহিলাদের সামগ্রিক শিক্ষাগত অবস্থানটি সমস্যাসঙ্কুল। দারিদ্র্য, দূরের স্কুলে পাঠানাের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, গ্রামীণ পশ্চাদপদ অংশে স্কুলের দুর্দশা, মেয়েদের পৃথক স্কুল না থাকা, মহিলা শিক্ষিকার অভাব, শিক্ষান্তে পেশা প্রবেশের সম্ভাবনা কম থাকা—ইত্যাদি বহু কিছু এর জন্য দায়ী। তবু কমিটি আশ্চর্য হয়ে দেখেছেন— এই বিবর্ণ দৃশ্যপটে একটি উজ্জ্বল আশার কিরণ– শিক্ষা ব্যবস্থা যখন আপাতভাবে মুসলমান মেয়েদের ব্যাপারটা ছেড়েই দিয়েছে, তখন মেয়েরা কিন্তু লেখাপড়া ছাড়েনি। রাজ্যে রাজ্যে মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার আগ্রহের প্রমাণ পেয়েছেন কমিটি। দেখা যাচ্ছে মুসলমান মহিলাদের ক্ষেত্রে সাক্ষরতার হার (৫০ শতাংশ) তপশীলী জাতি-জনজাতিদের চেয়ে অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গে আবার দেখা গেল মুসলমান পুরুষ ও নারীদের মধ্যে সাক্ষরতা ফাঁকটি (১৫ শতাংশ বিন্দু) রাজ্যের সামগ্রিক ফারাক (১৭ শতাংশ বিন্দু) থেকে কম। অর্থাৎ শিক্ষায় সামগ্রিক পশ্চাদপদতা থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে মেয়েদের প্রতি বিশেষ বঞ্চনা এই সমাজে তুলনামূলকভাবে কম। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে পাঠক্রমেও মুসলমান মেয়েদের জন্য প্রেরণাদায়ী কিছু থাকে না। সামগ্রিক ভাবেই পশ্চিমবঙ্গের সরকারি পাঠক্রমে কৃতী ব্যক্তিত্ব হিসাবে বর্ণহিন্দু পুরুষের ভিড়। অথচ বেগম রােকেয়ার মত একজন নারীর কথা স্নাতক স্তরে না রেখে প্রাথমিক বা মাধ্যমিকে রাখা যেত।
সাধারণভাবে এটাই ধরে নেওয়া হয় যে বাল্যবিবাহের কারণেই মুসলমান নারীদের পড়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তথ্য দেখিয়েছে যে সাধারণভাবে বিবাহের যে . গড় বয়স, মুসলমানদের তার চেয়ে কম বয়সে বিবাহ হয় এমন নয়। এই প্রসঙ্গে এসে যায় জনসংখ্যা বৃদ্ধিৰ কথা। একটা কথা বলা হয় যে মুসলমান বিধবাদের। পুনর্বিবাহের প্রথা সমাজে থাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। কিন্তু ২০০১ জনসংখ্যা তথ্যে দেখা যাচ্ছে বৈবাহিক অবস্থান মুসলমান মেয়েদের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে খুব বেশি পৃথক নয়। অন্য বিষয়গুলাে দেখা দরকার। ভারতীয় সমাজে স্ত্রী পুরুষ অনুপাত (১০০০ পুরুষে নারীর সংখ্যা) এমনিতেই খারাপ, ২০০১- এ পাওয়া গেছে ৯৩৩। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে এটি তুলনামূলক ভালাে, ৯৩৬। আরাে গুরুত্বপূর্ণ এই যে ৬ বছরের কম বয়েসী শিশুদের ক্ষেত্রে সকলের জন্য স্ত্রী পুরুষ অনুপাত যেখানে ৯২৭, সেখানে মুসলমানদের ক্ষেত্রে ৯৫০। অর্থাৎ শিশু কন্যা মেরে ফেলার প্রবণতা এখানে অনেক কম।
এর পরেই আসে কর্মে নিয়ােজনের কথা। ভারতে ১৫-৬৪ এই বয়সসীমার মধ্যে ৪৫ শতাংশ মহিলা কর্মে নিযুক্ত থাকেন, পুরুষ থাকেন ৮৫ শতাংশ। কম অর্থাৎ যে কাজ সরাসরি অর্থ মূল্যে বিবেচিত হয়। মহিলাদের সাংসারিক কর্মের তাে সাধারণত কোন আর্থিক মূল্যায়ন হয় না। মুসলমান মহিলাদের ক্ষেত্রে কমে নিয়ােজন মাত্র ২৫ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে হিন্দু মহিলাদের ক্ষেত্রে যখন এটি ৭০ শতাংশ মুসলমানদের ক্ষেত্রে সেটি মাত্র ২৯ শতাংশ। কৃষিক্ষেত্রে মুসলমান। মহিলাদের অংশগ্রহণ কম, গৃহভিত্তিক শিল্পেই তাদের যােগদান বেশি। চাকরিতে সাধারণভাবেই মুসলমানদের অংশ কম নানান কারণে, মহিলাদের আরােই কম। কমিটি আরএকটি বিষয় দেখছেন, মােট জনসংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কমবয়েসী। অংশ। মােট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ যখন দশ বছরের কম বয়েসী, মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটি ২৭ শতাংশ। এদের দেখাশােনার জন্য মহিলাদের একটা বড় অংশকে ঘরেই থাকতে হয়।
স্ব-নিযুক্তি ক্ষেত্রে কিন্তু এঁদের উল্লেখ্য যােগান দেখা যায়। কর্মে নিযুক্ত মুসলমান নারীদের ক্ষেত্রে এটি ৭৩ শতাংশ, হিন্দুদের ক্ষেত্রে এটি ৬০ শতাংশ। মুসলমানদের ক্ষেত্রে কৃষি অপেক্ষা অ-কৃষি ক্ষেত্রেই যােগদান বেশি। মহিলামালিকানাধীন উদ্যোগে মহিলাদের যােগদান চোখে পড়ার মত। অবস্য এগুলি মূলত গৃহ ভিত্তিক ফলে দালালদের উপর নির্ভরশীল, রােজগার কম। যে সমস্ত অকৃষি উদ্যোগে মুসলমান মহিলাদের প্রাধান্য তার মধ্যে আছে শহরাঞ্চলে দর্জির কাজ, পােশাক তৈরি এবং সমজাতীয় কাজ, বিড়ি বাঁধা, ইত্যাদি। এখানে রােজগার কম, কাজের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর এবং কোনাে সামাজিক সুরক্ষা নেই। মুসলমান মহিলাদের ক্ষুদ্র ঋণ দিতে ব্যঙ্ক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের অনীহা আছে। এঁদের কাজ মূলতঃ অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং সেখানে এঁরা চূড়ান্ত শােষণের শিকার। কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত বাথরুম বা শিশুদের জন্য ক্রেসের ব্যবস্থা নেই। এর প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যের উপর। যাঁরা বিপিএল তালিকাভুক্ত তাঁরাও সহজে জওহর রােজগার যােজনার ঋণ পান না, সেখানে সম্প্রদায়গত ভাবেই তারা বৈষম্যের শিকার।