ম্যাঙ্গালোর সেন্ট্রাল স্টেশনে পৌঁছেছিলাম সকাল প্রায় আটটা সাড়ে আটটায়। প্রায় মাঝ রাতে গোয়ার মারগাও স্টেশন থেকে মৎস্যগন্ধা এক্সপ্রেস ধরেছিলাম। ম্যাঙ্গালোর সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে প্রিপেড অটো ফালনির প্যালেস হোটেলে নামিয়ে দিল। হোটেলের রিসেপশন থেকে দেওয়া হল সরকারি বাস এক ঘন্টার জার্মানিতে কেরালার কাসারগড়ে পৌঁছে দেবে। সেখান থেকে মালিক বিন দিনার (র.) মাজার মসজিদ প্রাঙ্গণে পৌঁছে দেবে।
দ্বিতীয় দিন ম্যাঙ্গালোর ভ্রমণ স্থির করলাম। হোটেলের রুমে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে কাসারগড় যাওয়া মনস্থ করলাম। তাই কাসারগড়ের বাস ধরার জন্য ম্যাঙ্গালোরের জ্যোতি এলাকা পৌঁছলাম।
সমস্ত পদটি কর্নাটক ও কেরালার মালাবার উপকূলের সবুজ গাছপালা, সবুজে ঢাকা পাহাড়, হঠাৎ হঠাৎ আরব সাগরের পাহাড় দিয়ে ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে আসা, মন্দির মসজিদ গির্জার উঁকিঝুঁকি, কর্ণাটক ও কেরালার সাজানো- গোছানো জনপদ সমূহের দৃশ্যাবলী অতি মনোরম। কাসারগড় বাসস্টপে নেমে শহরের অপরপ্রান্তে থালাঙ্গারা যাওয়ার অটো ধরলাম। সামান্য দূরত্ব। দূর থেকেই সবুজ গম্বুজ ও মিনার শোভিত তোরণটি দেখে বুঝলাম আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। আমি
অটো যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকেই প্রশস্ত ও আমার একটু ঘুরে যাচ্ছে ছড়ানো-ছিটানো ইমারতগুলি দেখা যায়। তবে দূর থেকে দেখে বোঝা যায় না কোনটা মসজিদ এবং কোনটা মাজার? কারণ গেটের গম্বুজটি ছাড়া আর কোন গম্বুজ দেখা যায় না। বামপ্রান্তে মহিলাদের নামাজ পড়ার স্থান, তার পাশে মালিক বিন দিনার একাডেমি নামক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সামনে ডানদিকে টানা বারান্দা ওয়ালা অনেকটাই অফিস বাড়ির মত দেখতে অপেক্ষাকৃত নবীন একটি ইমারত। বস্তুত সম্মুখবর্তী একমাত্র ইমারত ছাড়া গম্বুজ সহ তোরন এবং অন্যান্য ইমারত গুলি অপেক্ষাকৃত নবীন।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম, সামনেই দেখতে পেলাম বেশ কিছু সমাধি। আরও এগিয়ে গেলে আরও বেশ কিছু সমাধি। এখানে পুরুষ প্রবেশ নিষেধ। স্ত্রীর হাতে ক্যামেরা মোবাইল ইত্যাদি সমর্পন করে একটু ডান দিকে ঘুরে মূল মসজিদে পৌছালাম। মসজিদের অভ্যন্তরেই ছোট পাড় বাঁধানো অজু করোর স্থান। অজু করে মসজিদের কয়েকটি কক্ষ পার হয়ে প্রাচীন মসজিদটিতে পৌছালাম।
কাষ্ঠ নির্মিত সিলিং। মিম্বার, মেহরাব সবই কাষ্ঠ নির্মিত। মূল মসজিদের মেঝেতে কার্পেট বিছানো। নিচে থেকে সিলিং দেখলেই বোঝা যায় এর উপর কংক্রিটের কোন স্বাদ নেই মালাবার উপকূলের পরিচিত টালি নির্মিত আচ্ছাদন রয়েছে। সামনে থেকে নির্মিত ও অর্ধনির্মিত কংক্রিটের নির্মাণ গুলির মধ্যে এই অংশটি দেখেই বোঝা যায় অপেক্ষাকৃত প্রাচীন। পরে বার হয়ে গিয়ে সুদৃশ্য প্রাচীন গম্বুজ বিহীন লাল টালির আটচালা নির্মাণ টির ছবি নিয়েছিলাম। প্রাচীন সুদৃশ্য মসজিদটির পাশেই রয়েছে একটি মাজার। মাজার দেখিয়ে লোকমুখে প্রচার মালিক বিন দিনার (র.) এখানেই শুয়ে আছেন।
ঘুরেফিরে দেখে নেওয়ার পর প্রায় ২৫ টি সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এমন একটি স্থানে এলাম যেখানে বিস্তীর্ণ জলরাশি স্থির এবং তার পাড়ে সার সার নারকেল গাছ। বইয়ে ছাপানো বা হাতে আঁকা নয়নলোভন দৃশ্য। এরই এক পাশে রয়েছে লাল টালিতে বাঁধানো একটি জলাধার। সম্ভবত সারা বছর জল সরবরাহের ব্যবস্থা। মসজিদ,-মাদ্রাসা, অফিস, মাজার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ উপরে অবস্থিত হওয়ায় পানির অভাব হতে পারে। তবে সেই সময় এই জলাধার থেকে পানি পাওয়া যেতে পারে। কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠ ও জলাধার একই তলে অবস্থিত। সামনে পশ্চিম দিকে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল স্থির জলরাশি। মাঝখানে বালিয়াড়ি। প্রকৃতপক্ষে হলুদ বালিতে পরিপূর্ণ একটি সৈকত। এর ওপারে বিশাল জলরাশি যা আরব সাগর ছাড়া আর কিছু নয়। আমি যে মুহূর্তে জলাধারটির নিকট পৌছালাম, দেখলাম মোটর বোট আওয়াজ করে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্রবেশ পথেই পাথরের উপর খোদিত ইংরেজি একটি প্রতিবেদন লেখা রয়েছে। সেই প্রতিবেদনটি হল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সোয়াল্লাল্লাহু আলাইহিসসলাম) -এর কয়েকজন অনুগামী মক্কা থেকে ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে ধর্ম প্রচারের জন্য এলে তাঁরা মোট ১০ টি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদটি মালিক বিন দিনার-এর তত্ত্বাবধানে ১২-ই রজব ২২ হিজরীতে নির্মিত হয় পাশেই রয়েছে তাঁর সমাধিস্থল। ২২ হিজরিকে খ্রিস্টান্দে পরিণত করতে গিয়ে এই বোর্ডে একটি মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। লেখা রয়েছে ইংরেজি ৬০৩ খ্রিষ্টাব্দ। ৬০৩ খ্রিস্টাব্দে নবী করীম (সা.) এর বয়স হয় মাত্র ৩২-৩৩ বছর, নব্যুয়তই পাননি। উক্ত তারিখে মুসলিমরা কেরালার উপকূলের এলেনই বা কি করে? এই খটকা থেকেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে প্রকৃত তথ্যটা কি?২২ হিজরিতে যদি মসজিদটি তৈরি হয় তাহলে খ্রিস্টাব্দের হিসাবে তা হয় ৩৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দ। ততদিনে আমাদের প্রিয় নবীঃ (স.) ২-৩ (৬৩২-৩৩ খ্রি.) বছর আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মালিক বিন দিনার (র.) নবী করিম (দ.)-এর জীবনকালেই বা অব্যবহিত পরেই ভারতবর্ষে এসেছিলেন। অর্থাৎ তিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে গণ্য হতে পারেন নয়তো তাবেঈ ছিলেন। এ সব নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। তবে ভারতবর্ষে প্রাথমিক দিনের ইসলাম এঁদের হাত ধরেই আসে এবং ছড়িয়ে পড়ে এ ব্যাপারে নিশ্চিত বলা যায়। আরব উপদ্বীপ ও কেরালার অবস্থান দেখে একই কথা বলা যেতে পারে।
এই বিষয়ে বেশ কয়েকটি মতামত রয়েছে। ইসলাম পূর্বনকাল থেকেই ভারতের পশ্চিমতট ও আরবের যোগাযোগ ছিল। বিশেষ করে বাণিজ্যিক। ওমানের সোহর বন্দর থেকে তরিগুলি ভাসানো হত গন্তব্য স্থল ছিল কেরালার বন্দরগুলি, প্রসিদ্ধ ছিল ক্রাঙ্গানোর বা কোদাঙ্গালুর। ক্রাঙ্গানোরের রাজা ছিলেন চেরামন পেরুমল। হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মোজেযা সাক্কে কমর বা চন্দ্র দ্বিখন্ডন সুদূর কেরালা থেকে দেখে ইসলাম সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে পড়েন। ঠিক এই জায়গাতেই একটি সংশয় তৈরি হয়। সংশয়টি হল তিনি চন্দ্র দ্বিখন্ডন স্বচক্ষে দেখে ছিলেন না এক দুই শতাব্দী পর লোকমুখে শুনে ইসলাম সম্বন্ধে আগ্রহী হয়েছিলেন?
তবে তিনি স্বচক্ষে দেখুন বা লোকমুখে কাহিনী শুনে ইসলাম সম্বন্ধে আগ্রহী যাইই হন কেরালার স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্রচলিত আছে তিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে একজন ছিলেন। অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর হাতে বাইয়াত হন। কাহিনী আছে একদল আরব মুসলিম শ্রীলংকার আদম পাহাড়ে আদম (আ.)-এর পদচিহ্ন জিয়ারতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণের জন্য ক্রাঙ্গানোর আসেন। চেরামন এঁদের মধ্যে এক সাধু প্রকৃতির ব্যক্তিকে চন্দ্র দ্বিখন্ডন সম্পর্কে প্রশ্ন করে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। উক্ত তীর্থযাত্রীদের ফেরার পথে তিনি মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন এবং ইসলাম কবুল করেন। ভারতে ফেরার পথে তিনি ওমানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং সেখানেই সমাধিস্থ হন। তিনি মালিক বিন দিনার ( র.) তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও লোকজনদের কেরালায় গিয়ে ইসলাম প্রচার ও মসজিদ নির্মাণে উৎসাহিত করেছিলেন।
মালাবারের বাসিন্দা মইনুদ্দিন আব্দুল আজিজ মা’বারি ৯৯৩ হিজরি (১৬০৫ খ্রি.) তার বইয়ে সামরি ( লপেরুমলের আরবি নাম) বা পেরুমলের ইসলাম গ্রহণ কেরলের মুসলিমদের সম্পর্কে এক বর্ণনা দেন। আল্লামা মা’বারি এই সমস্ত ঘটনার সময় কাল নির্ণয় করেছেন হিজরী দ্বিতীয় শতকের পর। অর্থাৎ পেরুমল সাহাবা হতে পারেন না। মোইপিলাহ, মোপলা বা মোপিল্লা কেরালার মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য। কিছু কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন মোপিল্লাহ কথাটি এসেছে আরব পুরুষ ও রোলার স্থানীয় নারীর বিবাহের ফল সন্তানাদি বোঝাতে। দেয়ির মতে না নানে মাতৃদেবি এনং পিল্লা মানে তাঁর সন্তান। বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই ধরনের আন্তর্জাতিক বিবাহের সময় তাঁদের সন্তানেরা শ্মাতৃদেবীর সঙ্গেই অধিক যুক্ত থাকেন। ব্রাউনের মতে মাপিল্লা কথাটি এসেছে মা’বার থেকে যার মানে উপকূল। কেরালার সঙ্গে আরবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বোঝাতে উপকূলবর্তী এলাকার পুরুষের সন্তানাদি কে মাপিল্লা বলা হত যা পরে মোপলা হয়েছে।
বর্তমান ক্রাঙ্গানোর বন্দর খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতেও তামিল চের রাজাদের বন্দর ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোমক বর্ণনায় মুসিরিস ক্রাঙ্গানোর বন্দরের বিবরণ রয়েছে। সপ্তম শতাব্দীতে কুইলন ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তামিল চের সাম্রাজ্য কৃষিকার্যে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ব্রাহ্মণদের জমি দান করছে এবং একই সময়ে ক্রাঙ্গানোর বন্দর থেকে বহির্বাণিজ্যের জন্য ইহুদি ও আরব বণিকদের উপর নির্ভর করছে। ক্রাঙ্গানোর বহির্বাণিজ্যের প্রধান পথ ছিল।। এক রোমক ইতিহাসবিদ বলছেন,” মুসিরিস হল ধনীদের বন্দর; স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিলাসী ও উন্নত। প্রায়ই মিশরীয় জাহাজগুলি এই বন্দরে দেখা যায়। আব্দুল আজিজ মা বারির যুক্তি মেনে নিলে চেরামান পেরুমল ও মালিক বিন দিনার (র.) আরও ২০০ বছর পরের ব্যক্তিত্ব। অথচ ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদ হল ক্রাঙ্গালোর বা কোদাঙ্গালুরের মসজিদটি এবং কাসাড়গড় ইত্যাদি স্থানের ১০ টি মসজিদও সমসাময়িক যা তৈরি করেন চেরামন পেরুমাল ও মালিক বিন দিনার (র.)-এর মতো ব্যক্তিত্ব। পূর্ব ও পরবর্তী আরবরা প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করছে। অথচ প্রাথমিক যুগের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা মসজিদে নামাজ পড়ার জন্যে নবম শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করছে! আমার আপনার ভাবনা ও ব্যবহারিক দিক দিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি?
এমনিতেই প্রবাদ বাক্য বলে-
গুটিকয়েক মুসলিম একত্রিত হলে,
প্রথমেই একটি মসজিদ গড়ে তোলে।
তাই কেমন হয় এই সিদ্ধান্তে এলে,
পেরুমল-দিনার সাহাবা না হোক, ডাকি তাবেঈ বলে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।