ইসলামী মুদ্রা ব্যবস্থা দিয়ে প্রমাণ করা যায় কিভাবে ইসলাম আরব উপদ্বীপ এবং অন্যত্র ছড়িয়েছিল। ১০০০ বছরেরও উপর সংরক্ষিত মুদ্রাগুলি ইসলামের প্রাথমিক অবস্থার মুদ্রাব্যবস্থা প্রমাণ করে। প্রমাণ করে কিভাবে তৎকালীন সভ্যতাগুলি ইসলামের মুদ্রা ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করেছিল এবং পরবর্তীকালে মুসলিমরা নিজস্ব মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।
হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও হযরত আবু বকর (রাঃ) এর আমলে রোমান ও পারসিক মুদ্রার পাশাপাশি পেঁচার অবয়ব খঁচিত হিময়ারি মুদ্রাও ব্যবহৃত হত। হযরত ওমর (রাঃ) এর সময়ে মুসলিম খিলাফতের সম্প্রসারণ ঘটে। তখনও রোমানদের স্বর্ণমুদ্রা ও সাসানীয়দের রৌপ্যমুদ্রা ব্যবহৃত হত। তবে এর পাশাপাশি প্রাদেশিক গভর্নরগণ নিজস্ব স্বাধীন টাঁকশালে প্রাচীন মুদ্রায় কুরআনের আয়াত খোদাই করে মুদ্রা তৈরি করতেন। মুদ্রার ওজন,ছাপ,মূল্য ও আকৃতি পুরো খিলাফত জুড়েই অনির্ধারিত ছিল।
মুয়াবিয়া রাঃ উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠা করলেও তিনিও মুদ্রা ব্যবস্থা সংস্কার করেননি। তিনিও প্রাচীন রোমান স্বর্ণমুদ্রা দিনারিয়াস ও সাসানীয় রৌপ্য মুদ্রা ড্রাকমা ব্যবহার করেন। তবে কখনও কখনও কিছু রদবদল আনা হয়।
এরপর খলিফা আব্দুল মালিক ই প্রথম আরবি মূদ্রার প্রচলন করেন ও জাতীয় টাঁকশাল নির্মাণ করেন। ৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে দামেস্ক কেন্দ্রীয় টাঁকশাল নির্মিত হয়। সেখান থেকে আরবী অক্ষরযুক্ত নির্দিষ্ট এবং সর্বজনস্বীকৃত একক মুদ্রামানের দিনার বা স্বর্ণমুদ্রা, দিরহাম বা রৌপ্য মুদ্রা ও ফালুস বা তাম্র মুদ্রার প্রচলন করা হয়। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট এর ‘ভারতের মুদ্রা’ বইয়ে পরমেশ্বরীলাল গুপ্তা বলেছেন, “খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে সিরিয়ার খলিফাদের ধর্মযুদ্ধ স্পৃহা এবং তার ফলশ্রুতি হিসাবে কালেমা পড়ার রীতি অর্থাৎ প্রকাশ্যে আল্লাহর বিশ্বাস ঘোষণা করার প্রথা অনুসারে মুদ্রা তে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ এই বাণী উৎকীর্ণ করা আরম্ভ হলো (এর অর্থ আল্লাহ বিনা আর কোনো ভগবান নেই এবং মোহাম্মদই আল্লাহর একমাত্র নবী অর্থাৎ আদিষ্ট মহাপুরুষ)। পরে মুসলমানদের সমস্ত মুসলমানি মুদ্রাতেই কলেমা উত্তীর্ণ করা হতে থাকলেও ভারতে কলেমা উৎকীর্ণ করার তত বেশি ঔৎসুক্য দেখানো হয়নি।”
উমাইয়াদের সময় কুফা বিজিত হয় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ দ্বারা। সেখান থেকেও দিরহাম তৈরি করা হত। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ইমাদউদ্দিন মোহাম্মদ বিন কাশেম আস সাকাফি দ্বারা ভারতবর্ষের সিন্ধু বিজিত হয়। পরমেশ্বরী লাল গুপ্তা বলেছেন, “তাঁর প্রাদেশিক শাসনকর্তারা খলিফাদের মুদ্রার অনুরূপ কিছু ক্ষুদ্র রুপোর মুদ্রা চালু করেন। সিন্ধুপ্রদেশ ও রাজস্থান থেকে এই ধরনের মুদ্রা এখনও পাওয়া যায়। কিন্তু তৎকালে এই মুদ্রা গুলির প্রভাব খুব একটা বেশি ছিল না”।
আরবি মুদ্রা দিনারের নাম এসেছে রোমান দিনারিরাস থেকে আর দিরহাম এসেছে সাসানীয় ড্রাকমা শব্দ থেকে। মুসলিম মুদ্রা প্রচলনে এই দুই সভ্যতার প্রভাব ছিল স্পষ্ট। প্রতিটি মুদ্রায় কালেমা, মুদ্রা অংকনের তারিখ ও টাকশালের নাম অংকিত থাকত। এর ফলে জাল মুদ্রার প্রচলন বন্ধ হয়, প্রশাসনে আরবীয়করণ প্রতিষ্ঠা পায় এবং ব্যবসা -বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। আরবি মুদ্রার প্রচলন ছিল খলিফা আব্দুল মালিক এর অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব।
২০২০-র এপ্রিলের প্রথমে লন্ডনের নিলাম ঘর মটন ও ইডেন ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুদ্রা ব্যবস্থার উপর একটি নিলামের ডাক দেন। যদিও করোনাকালীন লকডাউন এর জন্য নিলাম বন্ধ হয়ে যায়।
রাসূল (সা.) এর সমকালীন আরব ছিলো একটি গোত্রশাসিত জনবিরল ভূখন্ড। বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রের অধীন বিভক্ত ভূখন্ডে কোনপ্রকার রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিলো না। ফলে, রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভিন্ন কাঠামোর মতই আরবের নিজস্ব কোন মুদ্রা ব্যবস্থা ছিলো না। আরব ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্যের আদান প্রদানের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করত। তৎকালীন আরবে উৎপন্ন হত লোবান এবং মিররা’র মত বিভিন্ন সুগন্ধী, যা তখন একমাত্র আরবেই পাওয়া যেত। এছাড়া তাদের ছিলোল মসলা, মুক্তা, স্বর্ণ, গজদন্ত এবং বিভিন্ন মূল্যবান বিলাস দ্রব্যের ব্যবসা। এরকম বিনিময়ে নিত্যকার প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্য; পশুপাল, খাদ্যশস্য, পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি ক্রয়- বিক্রয় করা হত।
পণ্য বিনিময়ের এই পন্থায় আরবদের মুদ্রার কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না। কিন্তু রাসূল (সা.) এর পরবর্তীতে মুসলিম সাম্রাজ্য যখন রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে পূর্ব পশ্চিমে বিস্তার লাভ করে, তখন মুসলিম সভ্যতা প্রথমবারের মতো তাদের মুদ্রা ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয়। বর্তমান জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন মিশর থেকে প্রাপ্ত মুসলিমদের ব্যবহৃত বাইজান্টিয়াম মুদ্রাগুলি দেখা যায়।
রোমান ও পারস্য উভয় সাম্রাজ্যেই পণ্যের বিনিময়ে মুদ্রার বহুল ব্যবহার প্রচলিত ছিল। একইসঙ্গে রোমান বাইজন্টাইন সাম্রাজ্যে ব্যবহৃত হত স্বর্ণমুদ্রা সলিডাস (solidus) বা সলিডি। সলিডাস বা সলিডি আর কিছু নয় খৃষ্টানদের ব্যবহৃত ক্রস চিহ্ন যা অবিকৃত রেখে বা মুছে দিয়ে প্রাথমিক যুগের মুসলিমরা ব্যবহার করত। বিপরীতে পারস্য সাসানীয় সাম্রাজ্যে প্রচলিত ছিলো রৌপ্যমুদ্রা ‘দ্রাখম’ (drachm)।
প্রথমদিকে এই মুদ্রাগুলো গলিয়ে এর উপর কালেমা বা বিসমিল্লাহ প্রভৃতি লিখে ব্যবহার করা হতে থাকে। কিন্তু এটি খুব বেশী প্রচলিত ছিল না। এই ধরণের মুদ্রার বিপরীতে বাজারে চালু থাকা অধিকাংশ মুদ্রাই ছিলো প্রাচীন রোমান বা পারসিক মুদ্রা যার উপর প্রাচীন রোমান বা পারসিক রাজাদের প্রতিমূর্তি বা ক্রস/অগ্নিমন্দির প্রভৃতি অঙ্কিত ছিল।
মর্টন ও ইডেনের মুদ্রা বিশেষজ্ঞ স্টিফেন লয়েড বলেন, ইসলামী আরব মুদ্রা ব্যবস্থার প্রথম দিকে খ্রিস্টান চিহ্নগুলিকে খুব একটা আমল দেওয়া না গেলেও ক্রস চিহ্নগুলোকে মুছে ফেলা হয়েছিল। আরব সাসানীয় রৌপ্য মুদ্রাব্যবস্থায় দেখা যায়, ‘দাঁড়িয়ে থাকা খলিফা’র মূর্তি খোদিত যাঁর হাতে রয়েছে তরবারি। এর উল্টো পিঠেই রয়েছে সাসানীয় রাজ খসরু II-র (রাজত্বকাল ৫৯১-৬২৮ খ্রি.) মস্তকের ছবি (চিত্র ১)। এর মূল্যমান ছিল তৎকালীন দ্রাখমার সমান। আরও এক ধরনের মুদ্রা দেখা যায় যেগুলিতে মেহরাব খোদিত রয়েছে (চিত্র ২)। তবে এই ধরনের মুদ্রা গুলিকে বলা যেতে পারে সংকর জাতীয় মুদ্রা।
উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের শাসন কালে ৭৭ হিজরী, ৬৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সফলভাবে ইসলামী মুদ্রা ব্যবস্থায় স্বর্ণমুদ্রার নামকরণ করেন দিনার। লাতিন শব্দ দিনারিয়াস থেকে দিনার শব্দটির আগমন যার অর্থ স্বর্ণ। অপরদিকে রৌপ্যমুদ্রার নাম হয় দিরহাম যা পারসিক দ্রাখম থেকে নামকরণ করা হয়।
এই ইসলামী মুদ্রাগুলোর নকশায় ধর্মের সংযোগ ছিলো স্পষ্টতর। মুদ্রাগুলোর একপিঠে ছিলো কুফিক লিপিতে কালেমা তৈয়ব (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ) নকশা। এর অপরপিঠে ছিলো সূরা তওবার ৩৩ নং আয়াতের নকশা,
“তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে, যেন এ দ্বীনকে অপরাপর দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন”।
প্রাথমিক ইসলামী মুদ্রাসমূহের এই নকশা এবং মানদন্ড অব্যাহত থাকে পরবর্তী একহাজার বছর। পরবর্তী এক হাজার বছর একই মানদন্ড ও নকশায় ইসলামী মুদ্রা তৈরি হতে থাকে। ইসলামী মুদ্রা ব্যবস্থা মুসলিম সাম্রাজ্যের বাজার ব্যবস্থায় নিয়ে আসে এক নবতর পরিবর্তন।
ছবিতে দেখতে পাচ্ছি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা। স্বর্ণ মুদ্রাগুলি অধিকাংশই রোমক উৎস থেকে প্রাপ্ত আর রৌপ্য মুদ্রাগুলি পারস্য উৎস থেকে প্রাপ্ত। পরে সাসানীয়দের অনুরূপ দণ্ডায়মান খলিফা স্বর্ণমুদ্রাও প্রচলিত হয়। ইসলাম-পূর্ব ২ প্রধান শক্তি বাইজান্টিয়াম খ্রিস্টান ও পারসিক সাসানীয় শক্তি মুসলিমদের হাতে পরাজিত হলে পূর্ব ও পশ্চিম একটি শক্তিতে পরিণত হয়। ইসলামের ব্যবহারিক দিক যেমন মুদ্রাব্যবস্থা এই দুটি সভ্যতা থেকেই আহরিত হয়।
Download the Nobojagaran App