লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
ঢাকা। পঁচিশ মার্চ ২০১২। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় এক নতুন তৎপরতা, এক নতুন ব্যস্ততা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিদেশি অতিথিদের নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুটি বাস চলল ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মারক সংগ্রহশালাতে। প্রথমেই চোখে পড়ে সংগ্রহশালার বাইরের দেওয়ালে খোদাই করা আছে এই কয় পংক্তি;
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তােমার শেখ মুজিবর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান।
তবু নাই ভয় হবে হবে জয় জয় মুজিবর রহমান।
এই জয়ধ্বনি রচনা করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায় আর আমি তারই প্রতিনিধি হয়ে ঢাকাতে এসেছি তার হয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রদেয় এক ঐতিহাসিক সম্মাননা গ্রহণ করতে।
একা আমি নই। আরও অনেক এসেছেন। ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ-র হয়ে এসেছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল দীপেন্দর সিং, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী স্মরণ সিং-এর হয়ে তার জামাতা জিবিএস সিধু, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের হয়ে তাঁর ভাইপো সঞ্জিত রায়, মার্শাল জেসিপ ব্রোজ টিটোর হয়ে তার পুত্র আলেকসাণ্ডার ব্লোজ টিটো, রুশ কূটনীতিবিদ তথা রাষ্ট্রীয় প্রধান গ্রোমিকো, কোসিগিন, ব্লেজনেভ প্রমুখদের হয়ে বেশ কয়েকজনের রুশ প্রতিনিধিদল।
স্বাভাবিক কারণেই ১৯৭১ সালে মাত্র ন’মাসের রক্তগঙ্গা প্লাবিত ভীষণ ভীষণ যুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে এসে যাঁরা নানাভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, কেউ অস্ত্র দিয়ে কেউ অর্থ দিয়ে, কেউ রক্ত দিয়ে, কেউ প্রাণ বিপন্ন করে রণক্ষেত্র থেকে ছবি ও খবর। সংগ্রহ ও প্রচার করে বিশ্বব্যাপী এক আশ্চর্য আবেগ জাগিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধির পররাষ্ট্রীয় মন্ত্রণাদাত্রী অরুন্ধতী ঘোষ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাক ফ্রেডেরিক রালফ জ্যাকব (বয়স যাঁর উদ্দীপনাকে দমাতে পারেনি),
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রাক্তন সাংসদ মাইকেল বার্নেস ও ইংরেজ সাংবাদিক সাইমন ড্রিভ, বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকিটের রূপকার বিমান মল্লিক, আগরতলা হাসপাতালে বহু আহত যযাদ্ধার প্রাণরক্ষাকারী শল্য চিকিৎসক রথীন দত্ত, জার্মানি থেকে অর্থ সংগ্রহে, জনমত সংগঠনে ও বহু বিপন্ন বাঙালির আশ্রয়দানে উদার বারবারা ও সুনীল দাশগুপ্ত প্রমুখ একুশ-বাইশ জন এসেছিলেন যাঁরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজেরাই গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েছিলেন।
ঢাকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দীপু মণি আয়োজিতদ্বিপ্রহরিক আহার সভাতে অতিথিদের পক্ষে অন্যতম বক্তা ইন্দিরা গান্ধির পরামর্শদাতা পি এন হাকসারের কন্যা নন্দিতা হাকসার এই কথাটাই বললেন অনেক দেশই স্বাধীনতার সংগ্রামে বিদেশের থেকে নানারকমভাবে সাহায্য পেয়ে থাকে, কিন্তু সেই সংগ্রামে বিজয় লাভের পর কার কাছ থেকে কী পেয়েছে তা আর কারও মনে থাকে না, অথচ বাংলাদেশ সংগ্রামে স্বাধীনতা লাভের পরে তার কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য এত বড় একটা আয়োজন করেছে এবং ঋণ স্বীকারে এই অভিনব আয়োজন বিশ্ববাসীর সামনে এক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। বাংলাদেশকে স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রেরণা ও সাহায্য দেওয়ার জন্য এমন অভিনবভাবে ধন্যবাদ জানাবার কাজ শুরু হয় গত বছর। এজন্য প্রথম যাঁকে সম্মান জানানো হয় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে গত বছর ইন্দিরা গান্ধির হয়ে তার সম্মাননা গ্রহণ করেন তার পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধি। সেই শুরু। প্রথমবার শুধু ইন্দিরা গান্ধিকে, আর এবার মোট প্রায় আশিজনকে বিশেষ সম্মাননা জানাল বাংলাদেশ।
সম্মাননা জানাবার পদ্ধতি ও ভঙ্গিও বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক হৃদয় থেকে বিকশিত। যাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো বিশেষ জরুরি মনে হয়েছে প্রথমে তেমন প্রায় চারশো জনকে চিহ্নিত করা হয়। এখন সমস্যা হল বিগত চল্লিশ বছরে তাদের অনেকেই ইহলোক ছেড়ে গিয়েছেন এবং যারা বেঁচে আছেন তাদের অনেকেই তাদের ঠিকানা বদল করেছেন। জীবিতদের নতুন ঠিকানা খুঁজে বার করাও এক দারুণ কঠিন কাজ।
পররাষ্ট্র দফতরের নবীন প্রজন্মের কর্মীদের পক্ষে ১৩০ জনের বেশি মিত্রবর্গের নতুন ঠিকানা জোগাড় করা ও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা আর এক কঠিন যুদ্ধ জয়ের শামিল। জাপান, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি সারা পৃথিবীতে প্রবীণ বিদেশি বন্ধুদের নির্দিষ্ট দিনে ঢাকাতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা শুধু খরচ সাপেক্ষ নয়, তার জন্যে চাই কর্তব্যের তথা জটিল কার্যক্রমের প্রতি একান্ত আত্মনিবেদন এবং কল্পনা, পরিকল্পনা ও বিপুল পরিশ্রম। আমি যে অন্নদাশঙ্করের হয়ে সম্মাননা গ্রহণ করতে গেলাম এর পিছনের কাহিনিও যথেষ্ট নাটকীয়। যেহেতু অন্নদাশঙ্কর ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রথম সভাপতি তাই বাংলাদেশ পররাষ্ট্র দফতর প্রথমে বাংলা আকাদেমির সঙ্গে যোগাযোগ করে।
এদিকে ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সচিব বদল হয়ে গিয়েছেন, এবং পরিবর্তনের পরে যিনি ভারপ্রাপ্ত সচিব হন তিনিও বদলি হয়ে যান মহাকরণে, ফলে খোঁজখবর করতে করতে বাংলাদেশের কলকাতাস্থ উপরাষ্ট্রদূত আমার নাম ঠিকানা পেয়ে আমার কাছে অন্নদাশঙ্করের কলকাতাস্থ পরিবার সম্বন্ধে খবর জানতে চান। সৌভাগ্যবশত অন্নদাশঙ্করের ছোটো ছেলে তখন কলকাতাতে ছিলেন। তার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যোগাযোগ করলে তিনি বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধিকে আমার নাম ঠিকানা দিয়ে জানান যে অন্নদাশঙ্করের হয়ে আমি বাংলাদেশে যাব। এ ছাড়াও অন্নদাশঙ্করকে খুঁজে পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। কারণ বাংলাদেশ থেকে অন্নদাশঙ্করের নিজের লেখা ও তার উপরে অনেকগুলো বই বেরিয়েছে। কিন্তু এখনও কয়েকশো নাম আছে। যাঁদের কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি।
হদিশ পাওয়ার পরেও পদে পদে দুস্তর বাধা। প্রধান বাধা হল সফরসূচি তৈরি করা। ধরা যাক, ঢাকার সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর কলকাতার কথা। কলকাতা থেকে প্রায় সকলেই চব্বিশে মার্চ সকালে গেলেও ত্রিপুরার রাজমাতা বিভুকুমারী দেবী ওইদিন যেতে পারবেন না, তিনি আসবেন পরদিন। কিংবা জামানি থেকে হুইল চেয়ারে আসবেন সুনীল দাশগুপ্ত এবং তাঁর জন্য চাই এমন প্লেন যা সোজা আসবে বার্লিন থেকে টাকা আর তেমন প্লেন একটাই সপ্তাহে মাত্র একবার আসে, ফলে তার জন্য স্বতন্ত্র ভ্রমণক্রম।
ইয়ান্ মিরডাল আসবেন সুইডেন থেকে, ডেনমার্ক থেকে, আসবেন কিসটেন সেস্টেগার্ড যিনি এখনও ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারেন। এক বাংলাদেশে এখনও তঁর পরিচিতদের সংখ্যা যথেষ্ট। জাপান থেকে এসেছেন চারজন, তাদের মধ্যে তাকাইয়েশি সুজুকি নিজেই রণক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে ফটো তুলেছেন ও জাপানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠন করেছেন। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের বন্ধুরা এসেছেন বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে ও ব্যবস্থাপনায়। সবার মিলনে স্বাভাবিকভাবেই জেগে উঠল অনেক পুরনো কথা, অনেক পুরনো আবেগ, অনেক পুরনো প্রেরণা।
বিশেষত, পঁচিশে মার্চ সন্ধেবেলা সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। পঁচিশে মার্চের জঘন্য গণহত্যার ও উদ্দীপক মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহশালা। উনিশশো একাত্তরে যেমন বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশের মহিমান্বিত প্রবেশ তেমন উনিশশো পঁচাত্তরে তার কলঙ্কিত প্রস্থান। পরবর্তী বিশ বছর বিস্মৃতির আলোঅন্ধকারের বিভ্রান্তি। অকৃতজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আবার আলোর পথে যাত্রা শুরু হয় উনিশশো ছিয়ানব্বই সাল থেকে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর হয়ে উঠল যেন এক তীর্থক্ষেত্র। যেমন শান্তিনিকেতনে গেলেই যেতে হয় ছাতিমতলায় তেমনই ঢাকায় এলেই আসতে হয় এই জাদুঘরে। আর এবার আসা তো একেবারে অন্যরকম।
অনেকেই আছেন যাঁরা কোনও-না-কোনওভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, অনেক ছবিই এখনও তাদের মনে জ্বলজ্বলে। দেখলাম ত্রিপুরার রাজমাতা ওই ভিড়ের মধ্যে নোটবইয়ে কী-সব টুকছেন। জাদুঘর থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম সুরাবর্দি উদ্যানে যার আগে নাম ছিল রেসকোর্স ময়দান। এখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান ভারতীয় সেনাপ্রধানের কাছে আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করেন। এখন এখানে সারাক্ষণ জ্বলছে শহিদদের উদ্দেশে এক চিরন্তনী অগ্নিশিখা। সেখানে একজন সেনাধ্যক্ষর মতোই শ্রদ্ধার স্যালিউট জানালেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জ্যাকব। মুহূর্তে প্রদীপ্ত হয়ে উঠলেন তিনি যৌবনের বীরত্বে। এই অগ্নিশিখা তো সর্বকালের সমগ্র বিশ্ববাসীর সম্প্রীতি ও স্বাধীনতার প্রদীপ্ত প্রতীক।
পরদিন ছাব্বিশে মার্চ ভোরে সাভারে জাতীয় শহিদ স্মারক স্তম্ভে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী প্রমুখ সব বিদেশি বন্ধুবর্গের পুস্পার্ঘ্য নিবেদন। বিকেলে বঙ্গভবনে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান সূচিত হল ‘আমার সোনার বাংলা’র সুরে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের অভিবাদন গ্রহণে। তারপরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির আযয়োজন। পাশেই আর-একটা বিশাল তাঁবুর নীচে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক বিদেশি বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করলেন। আমি অন্নদাশঙ্করের পক্ষ থেকে এসেছি শুনে শেখ হাসিনা বললেন, ‘খুব খুশি হয়েছি আপনি এসেছেন বলে। আরও খুশি হতাম আগেই ওঁর হাতে সম্মাননা তুলে দিতে পারলে।’
পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারের হল অব্ ফে-এ মূল অনুষ্ঠান। বিশাল মঞ্চের উপর দুটো দলে ভাগ করে নাম-লেখা চেয়ারে চেয়ারে বসানো হল বিদেশি বন্ধুদের। মাঝখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রমুখের অবস্থান। এক-একজন বিদেশি বন্ধুর নাম উচ্চারণ করা হচ্ছিল, অমনই তিনি বা তার প্রতিনিধি উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন, তখন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের সংক্ষিপ্ত শংসাকথা পাঠ করা হচ্ছিল। এইভাবে একে একে সবার নাম ও তাঁর শংসাকথা ঘোষণার পরে শুরু হল সম্মাননার অভিজ্ঞান হাতে হাতে তুলে দেওয়ার পালা। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে স্মারকটি অভিবাদনপূর্বক নেওয়ার আগে আমি বললাম, ‘কিছু নাই ভয় হবে হবে। জয় জয় মুক্তিবুর রহমান’, আর তখনই রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পাশ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেসে বললেন, ‘জি—জয় মুজিবুর রহমান’।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।