লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
বিগ ব্যাং থিওরী আবিষ্কারের ফলে মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব থাকা একটা চুড়ান্ত সত্য বলে প্রমাণিত হয় এবং নাস্তিক্যবাদীরা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। বিগ ব্যাং থিওরী বর্তমান বিজ্ঞানের চুড়ান্ত সত্য আবিস্কার। এই আবিস্কারের ফলে ১৯৭৩ সালে জোড়া বিজ্ঞানীকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
এই বিগ ব্যাং থিওরীর আবিস্কার করেছিলেন আমেরিকার জ্যাতির্বিদ এডউইন হাবল (Edwin Hubble) । তিনি ১৯২৯ সালে লক্ষ্য করেন যে বিশ্বজগতের গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমশ দুরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ তিনি আবিস্কার করেন বিশ্বজগৎ সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে কোন এক সময় এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছে একটি পয়েন্ট থেকে (Single Point)।
এরপর বিজ্ঞানীরা এডউইন হাবলের আবিস্কারের উপর যখন গবেষনা করতে লাগলেন তখন বিজ্ঞানীরা আরও একটি জিনিস লক্ষ্য করলেন যে, বিশ্বজগৎ একক পয়েন্ট বা বিন্দু থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং সেটির মধ্যে চরম ক্ষমতা সম্পন্ন মাধ্যকর্ষন শক্তি ছিল এবং তার ভর ছিল (Mass) শুন্য। আর এই ভরহীন পয়েন্টে এক প্রচন্ড বিস্ফোরণের ফলেই বস্তু ও সময়ের অস্তিত্বলাভ হয় এরপর এই বিশ্বজগতের সম্প্রসারন শুরু হয়। অর্থাৎ এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে শূন্য (Nothing) থেকে।
এই বিগ ব্যাং থিওরী আবিস্কারের ফলে নাস্তিক্যবাদীদের চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায় এবং তাঁরা ছলে বলে কৌশলে বিজ্ঞানীদের এই আবিস্করকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেন। নাস্তিক ও বস্তুবাদী বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন বলেন,
“বর্তমানে আমরা যে প্রকৃতি দেখছি, সেটি একসময় আকস্মিকভাবে অস্তিত্বলাভ করেছিল (অর্থাৎ বিগ ব্যাং থিওরী) আমার কাছে ফিলসফিক্যালি অগ্রহণযোগ্য।”
তাঁর কাছে বিগ ব্যাং থিওরী অগ্রহণযোগ্য হলেও সময় সেটা বলে দিয়েছে যে বিগ ব্যাং থিওরী একটি নির্ভূল বৈজ্ঞানিক সত্য। পরবর্তীকালে বিভিন্ন আবিস্কারের ফলে আজ প্রমাণিত সত্য যে বিগ ব্যাং থিওরী বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পূর্ণ নির্ভুল সত্য। উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে যখন আরনো পেনজিয়াস (Arno Penzias) ও রবার্ট উইলসন (Robert Wilson) নামক দুইজন বিজ্ঞানী যখন মহাবিস্ফোরণের অর্থাৎ বিগ ব্যাং থিওরীর তেজস্ক্রিয় অবশেষ চিহ্নিত করেন এবং নব্বই-এর দশকে যখন বিজ্ঞানী কোবে (COBE/Cosmic Bacground Explorer) স্যাটালাইট দ্বারা যখন পর্যবেক্ষণ করেন তখন সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয় যে বিগ ব্যাং থিওরী আগের শতাব্দীর এক বিস্ময়কর ও চুড়ান্ত সত্য আবিস্কার।
এরপর শুরু হয় নাস্তিক্যবাদের আত্মহননের পালা। বিগ ব্যাং থিওরী আবিস্কারের পর নাস্তিক্যবাদীরা বিলে যেমন ইদুর ঢুকে পড়ে সেইভাবে তাঁরা তাঁদের যে যার বিলে ঢুকে পড়েন। নাস্তিক্যবাদীদের যুক্তির জাল সব ছিন্ন হয়ে যায়। তাঁরা দিশেহারা হয়ে পাগলের মতো ঘুরতে থাকেন। এই প্রসঙ্গে ‘Atheistic Humanism’ এর লেখক ও ‘Anthony Flew’ এর দর্শনের নাস্তিক অধ্যাপক এন্থনি ফ্লিউ (Anthony Flew) স্বীকার করে বলেন, “স্বীকারোক্তি আত্মার জন্য ভালো বলে কুখ্যাতি আছে। আমি স্বীকার করছি যে, সৃষ্টি সংক্রান্ত সমকালীন সর্বসম্মত মত নাস্তিকদের ভালোরকম বিব্রত করবে। কারণ, বিশ্বজগতের একটা শুরু ছিল – এ কথাটা St Thomas- এর মতে ফিলসফিক্যালি প্রমাণ করা সম্ভব না হলেও, দেখা যাচ্ছে, সৃষ্টতত্ত্ববিদরা এর স্বপক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ঠিকই হাজির করেছেন।.. (বিশ্বজগতের কোন শুরু বা শেষ নেই – এ ধারণাটা) যদিও আমি এখনো সঠিক বলেই বিশ্বাস করি, তথাপি বলতেই হচ্ছে যে বিগ ব্যাং তত্ত্বের উপস্থিতি ওই বিশ্বাসের উপর স্থির থাকা মোটেই সহজ ও স্বস্তিদায়ক ব্যাপার নয়।”
বস্তুবাদী পদার্থবিজ্ঞানী এইচ পি লিপসনও (H. P Lipson) অনিচ্ছা সত্যেও বিগ ব্যাং থিওরীকে বৈজ্ঞানিক সত্য বলে মেনে নিয়েছেন এবং তিনি বলেছেন, “আমি মনে করি আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, সৃষ্টির ধারণা এ ক্ষেত্রে একমাত্র ধারণা যা গ্রহণ করা যেতে পারে। এটা মেনে নেওয়া আমার মতো অন্য পদার্থবিদদের জন্যও কঠিন। কিন্তু গবেষনালব্ধ প্রমাণাদি যখন একে সমর্থন করে, তখন তা স্বীকার না করে উপাই বা কি?” (A Physicist Looks at Evolution”, Physics Bulletin, Vol. 138, 1980, p. 241/H.P. Lipson)
মোদ্দাকথা বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাং থিওরীর বর্তমানে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে বিশ্বজগৎ সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছে একটি পয়েন্ট থেকে। বিশ্বজগৎ একক পয়েন্ট বা বিন্দু থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং সেটির মধ্যে চরম ক্ষমতা সম্পন্ন মাধ্যকর্ষন শক্তি ছিল এবং তার ভর ছিল শূন্য। আর এই ভরহীন পয়েন্টে এক প্রচন্ড বিস্ফোরণের ফলেই বস্তু ও সময়ের অস্তিত্বলাভ হয় এরপর এই বিশ্বজগতের সম্প্রসারন শুরু হয়। অর্থাৎ এই বিশ্ব ব্রম্ভান্ড সৃষ্টি হয়েছে শূন্য থেকে।
কুরআনে বিগ ব্যাং‘ তত্ত্বের প্রমাণ
বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী ও বস্তুবাদী দার্শনিকরা যে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বিশ্বজগৎ একসময় একটি পয়েন্টে সংলগ (যুক্ত) অবস্থায় ছিল এবং পরে তা সম্প্রসারিত হয়। এই চুড়ান্ত সত্য বিজ্ঞানীরা নব্বই – এর দশকে স্যাটালাইটের মাধ্যমে প্রমাণ করল। কিন্তু মহান আল্লাহ কুরআন শরীফে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে বিগ ব্যাং থিওরীর কথা বলেছেন। যেমন আল্লাহ বলেছেন,
“খোদাদ্রোহীরা কি একথা জানে না যে, আকাশ ও পৃথিবী পরস্পর সংলগ্ন অবস্থায় ছিল, তারপর আমরা তাকে আলাদা আলাদা (পৃথক) করে দিয়েছি এবং আমরা পানি থেকে সমস্ত প্রাণী সৃষ্টি করেছি । তবুও তারা বিশ্বাস করবে না?” (সুরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৩০)
আল্লামা ইবনে কাসীর এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, প্রথমে আসমান ও জমীন পরস্পর মিলিতভাবে ছিল। একটি অপরটি হতে পৃথক ছিল না। আল্লাহ তাআলা পরে ওগুলিকে পৃথক পৃথক করে দিয়েছেন। জমীনকে নীচে ও আসমানকে উপরে রেখে উভয়ের মধ্যে বিরাট ব্যাবধান সৃষ্ট করতঃ অত্যান্ত কৌশলের সাথে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।…
হযরত ইকরিমা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনু আব্বাসকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “পূর্বে রাত ছিল না দিন ?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “প্রথমে যমীন ও আসমান মিলিত ও সংযুক্ত ছিল । তাহলে এটাতো প্রকাশমান যে, তাতে অন্ধকার ছিল । আর অন্ধকারের নামই তো রাত । সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, পূর্বে রাতই ছিল।” (তফসীরে ইবনে কাসীর, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩২৬)
এই মহাবিশ্ব যে সম্প্রসারিত হচ্ছে সে সম্পর্কে ফরাসী বিজ্ঞানী ড. মরিস বুকাইলি তাঁর ‘দি বাইবেল দি কুরআন এ্যান্ড সায়েন্স’ নামক গ্রন্থে যা লিখেছেন তা হল,
“মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার। অধুনা এটি সুপ্রতিষ্ঠিত মতবাদ। তবে কিভাবে যে মহাবিশ্বের এই সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া চলছে, তা নিয়ে এখনো ইতস্তত কিছু মতভেদ রয়ে গেছে।
মহাবিশ্বের এই সম্প্রসারণের বিষয়টি সর্বজন পরিচিত আপেক্ষিক থিওরীতে প্রথম উল্লেখিত হয়। যেসব পদার্থবিজ্ঞানী ছায়াপথের আলোকরশ্মির বর্ণালীবিভা সম্পর্কে নানা পরীক্ষা-রিরীক্ষা ও গবেষনায় নিরত ছিলেন, পরবর্তী পর্যায়ে তাঁরাও মহাবিশ্বের এই সম্প্রসারণের বিষয়টা সমর্থন করেছেন। কেননা, তাঁরা দেখতে পান যে, বিভিন্ন ছায়াপথের বর্ণালীবিভা ক্রমান্বয়ে লাল বর্ণের রুপ ধারণ করছে। এর থেকে তাঁরা এই ধারণায় পৌঁছান যে, একটা ছায়াপথ থেকে আরেকটা ছায়াপথ ক্রমশ দুরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের পরিমন্ডল ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে।
এখন কথা হচ্ছে, ছায়াপথসমুহ আমাদের নিকট থেকে যত দুরে সরে যাবে, মহাবিশ্বের পরিমন্ডলের পরিধি সম্ভবত বিস্তৃত লাভ করবে ততটাই । তবে, কি রকম গতিতে মহাবিশ্বের এই সম্প্রসারণ-প্রক্রিয়া কাজ চলছে অর্থাৎ মহাশূন্যের ওইসব বস্তু কতটা দ্রুত আমাদের নিকট থেকে দুরে সরে যাচ্ছে, তা একটা প্রশ্ন বটে । মনে হয়, তাদের এই দুরে সরে যাওয়ার গতিটা আলোর গতির কোনো – এক ভগ্নাংশ থেকে শুরু করে আরো দ্রুততর হওয়াটা মোটেই বিচিত্র নয়।
কোরআনের একটি আয়াতে যে বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে (সূরা ৫১, আয়াত ৪৭) তার সাথে অনায়াসেই আধুনিক বিজ্ঞান-সমর্থিত মহাবিশ্বের এই সম্প্রসারণ-মতবাদের তুলনা করা চলে। উক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
‘আকাশমন্ডলী, আমরা উহাকে সৃষ্টি করিয়াছি ক্ষমতার বলে। নিশ্চয়ই আমরা উহাকে সম্প্রসারিত করিয়াছি।’
এখানে যাকে আকাশমন্ডলী বলা হয়েছে-তা আরবী ‘সামাআ’ শব্দের অনুবাদ। এর দ্বারা সন্দেহাতীত ভাবেই পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্য জগতের কথাই বোঝানো হয়েছে। ‘আমরা উহাকে সম্প্রসারিত করিয়াছি’ এই বাক্যটি হচ্ছে বর্তমান কাল – বাচক ও বহুবচনসূচক আরবী শব্দ ‘মুসিউনা’র অনুবাদ। এর মূল ক্রিয়াবাচক শব্দ হচ্ছে ‘আউসাআ’। এর অর্থ সম্প্রসারিত করা, আরো বেশী প্রশস্ত করা, বৃদ্ধি করা, বিস্তৃত করা।” (দি বাইবেল দি কুরআন এ্যান্ড সায়েন্স/ড. মরিস বুকাইলি)।
সুতরাং জগৎ সৃষ্টি সম্পর্কে যে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানীরা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে দিয়েছেন তা মহান আল্লাহ পাক আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে বলে দিয়েছেন। বিজ্ঞান আজ বলছে ‘এই মহা বিশ্ব সম্প্রসারণশীল’ এই কথা আল্লাহ আগেই বলে দিয়েছেন যখন মানুষ বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানত না।
এই বিশ্বকে পরিকল্পনার মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।