আবু রায়হান মুহাম্মদ ইবন আহমদ আল-বিরুনী জন্মান মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তানের খোয়ারিজমে ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে এবং দেহত্যাগ করেন ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্থানের গজনীতে। তিনি বিশেষভাবে পরিচিত গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, পদার্থ বিজ্ঞানী, ভূগোলবিদ ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী রূপে। জীববিদ্যায় তাঁর অবদান খুব বেশি আলোচিত হয় না।
আল-বেরুনী এর লেখা পান্ডুলিপি হিসাবে পাওয়া, ‘কিতাব আস সাইয়াদানাহ ফি আত তিব’ (রোগ নিরাময়ে ঔষধবিদ্যার বই)। এই বইয়ে উদ্ভিদের নামের তালিকা রয়েছে যা বিভিন্ন ভাষায় কি নামে ডাকা হয় তারও তালিকা রয়েছে। যে যে ভাষার উদ্ভিদের নাম স্থান পেয়েছে তা হল; গ্রিক, সিরীয় হিন্দি, ফার্সি, সিন্ধি, সিগজি, জাবাহ, তিরমিজি, খাওয়ারিজমী এবং আরও কয়েকটি ভাষা যা এখন অবলুপ্ত। সাজারাৎ আল বাক (Gnat tree) গাছের ফার্সি নাম দার্দার, তুর্কি নাম দিশ বুদাক, গ্রিক নাম মাইয়া বলে আল-বিরুনী লিপিবদ্ধ করেন। প্রতিটি উদ্ভিদের সঙ্গে যুক্ত গল্প কাহিনী এবং তাদের উপশম ক্ষমতা নিয়ে লিখেছেন। এই বইটি তাঁর লিখিত শেষ বই। শেষ বয়সে প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তাই অন্যের সাহায্য নিতে হয়েছিল। পানীয় হিসাবে চা-এর ব্যবহার মূল আরবি বইয়ে হয়ে গেলেও ফারসি অনুবাদে পাওয়া যায়।
উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার মরুপ্রায় অঞ্চলের উটের কাঁটা বা Alhagi mourorum নামক উদ্ভিদের ক্ষেত্রে তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বোঝা যায় এই বর্ণনায়, ‘এর পাতায় বিশেষত্ব রয়েছে। পাতাগুলি সংকুচিত হয়ে একটি ছিদ্র তৈরি করে যার ভেতর দিয়ে প্রশস্ত মাথার পতঙ্গ মাথাটি বার করতে পারে। যখন পাতা খুলে যায় তখন পতঙ্গটি লাফিয়ে বের হয়ে আসে। আমি জানি না এটি কোন প্রজাতির মধ্যে পড়ে। এটি হল সেই সৃষ্টি যা কয়েকটি দেশে মান্না (তারানজুবিন) উৎপন্ন করে।’ মান্না হলো এক রকম মিষ্ট নিঃসরণ যার উল্লেখ কুরআন শরীফে বনি ইসরাইলিের খাদ্য হিসাবেও আছে। আল-বিরুনী বর্ণিত ক্যামেল থর্ন নামক উদ্ভিদটিও অন্যান্য বহু প্রজাতির মান্না উৎপাদনকারী উদ্ভিদ এর একটি। বহু পরে বাকহার্ট ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে লেখেন তিন ধরনের পতঙ্গ মান্না প্রস্তুতিতে অংশগ্রহণ করে।
উদ্ভিদ সংক্রান্ত তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হল, তিনি বলে গিয়েছিলেন ফুলের পাপড়ি সংখ্যা ৩,৪,৫,৬ অথবা ৮ টি হতে পারে কিন্তু কখনোই ৭ বা ৯ হতে পারে না। আল বিরুনীর ভাষায়, ” উদ্ভিদ বৈচিত্রের মধ্যে আশ্চর্যজনক বাস্তব ঘটনা হলো; তাদের পাপড়ির সংখ্যা, যখন তারা ফুটতে থাকে তখন জ্যামিতির নিয়ম অনুযায়ী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপরের অংশটি একটি বৃত্তাকার গঠন করে… আপনি খুবই কম খুঁজে পাবেন যে কোন ফুলের পাপড়ি ৭ কিম্বা ৯ টা রয়েছে। কারণ আপনি কখনোই তাদের সুষম বৃত্তীয় জ্যামিতির সূত্র অনুযায়ী সজ্জিত করতে পারবে না। তাদের পাপড়ির সংখ্যা হতে পারে, ৩,৪,৫,৬ এমনকি ১৮-টি পর্যন্ত”।
জীব বিবর্তন সম্পর্কিত তার লেখনি বহু শতক পর ডারউইনের লেখায় অনুরণিত হয়। তাঁর বিখ্যাত পুস্তক ‘কিতাব আল হিন্দ’-এর ৪৭ তম পরিচ্ছেদে বলেছেন,’পৃথিবীর জীবন বপন এবং সন্তান উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। সময়ের সাথে সাথে এই দুই প্রক্রিয়ায় বাড়তে বাড়তে হয়ে ওঠে অপরিমিত অথচ আমাদের এই পৃথিবী হল সীমিত।
যখন কোন উদ্ভিদ বা প্রাণী উৎপাদনের শেষ সীমায় পৌঁছে যায় তখন তার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় এবং বিশেষ প্রজাতি বা বর্গ বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন সেই বর্গের প্রতিটি প্রাণী জন্ম ও মৃত্যু ছাড়াও আপন বর্গের আরও বহু প্রাণী সৃষ্টি করে যার ফলে সেই প্রাণী বা উদ্ভিদবর্গ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে আর যেখানে যতখানি জায়গা পায় জুড়ে বসে।
কৃষিবিদরা নিজের শষ্য নির্বাচন করে, প্রয়োজনমতো উৎপাদন করে এবং যা উদ্বৃত্ত তা উৎপাটন করে ফেলে দেয়। বনকর্মী সাধারণত বৃক্ষের যে শাখা-প্রশাখাকে ভালো মনে করে সেগুলোকে রেখে অন্যগুলোকে ছেঁটে ফেলে। মৌমাছিরা আপন বর্গের সেইসব মৌমাছিদের মেরে ফেলে যারা শুধুই খায় কোন কাজ করে না।
প্রকৃতিও পারতপক্ষে তাই করে, তবে কোনরকম বাছ বিচার করে না কারন সব পরিবেশেই তার কার্যক্রম অভিন্ন। সুষমতা বজায় রাখার জন্য প্রকৃতি অপ্রয়োজনীয় গাছের পাতা এবং ফল নষ্ট করে, নতুন বর্গ সৃষ্টির স্থান করে দেয়। এই ভাবেই জন আধিক্যের কারণে পৃথিবী যখন ধ্বংসোন্মুখ হয় তখন শাসক যিনি আছেন এবং যাঁর সর্বতোভদ্র দৃষ্টি প্রতি কণায় স্পষ্ট প্রতীয়মান- বার্তাবাহক পাঠিয়ে দেন সংখ্যালঘু করা এবং যা কিছু অসৎ তা বিনষ্ট করার নির্দেশ দিয়ে’।
জীব বিবর্তন সম্পর্কিত উল্লেখিত আলোচনাটি ডারউইন ১) অধিক সন্তান সন্ততি উৎপাদন ২) প্রাকৃতিক নির্বাচন ৩) নতুন প্রজাতির উদ্ভব শিরোনামে ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রকাশ করেন।
লিখেছেনঃ চৌধুরী আতিকুর রহমান