দেশ এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন। আক্রান্ত কৃষি, বিপন্ন কৃষক। আমাদের দেশ এখনও কৃষি নির্ভর। কৃষিতে সঙ্কট বাড়লে দেশের অর্থনীতিও সঙ্কটাপন্ন হবে। ভারতবর্ষের কৃষি সঙ্কট ক্রমবর্ধমান। সাম্প্রতিক লাগু হওয়া কৃষির তিনটি আইনে। বিপদ আরও বাড়াবে। যদিও কৃষক বিরােধী, কৃষি বিরােধী ও দেশ বিরােধী তিনটি কৃষি আইনের পক্ষে নির্লজ্জ, মিথ্যা, বিকৃত প্রচার বিজেপি করে চলেছে। অবশ্য বিজেপি বিরােধী ক্ষোভের মাত্রা বাড়ছে। গত আড়াই মাস ধরে গােটা দেশে কৃষক বিক্ষোভ সামিল হয়েছেন অসংখ্য কৃষক। কৃষকদের আন্দোলনের সংহতিতে অন্যান্য অংশের মানুষও সামিল হয়েছেন। দু-শতাধিক কৃষক সংগঠন গড়ে তুলেছে সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে। কেবল প্রতিরােধ নয়, গড়ে উঠছে প্রতিরােধ। তীব্র প্রতিরােধের মধ্য দিয়েই কৃষি আইন অর্থাৎ কৃষির তিনটি আইনকে প্রত্যাহারে বাধ্য করাতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। এ লড়াই দেশ বাঁচানাের লড়াই।
লক ডাউনের আগে কি কৃষির অবস্থা ভালাে ছিল?
করােনা উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ঢাল করে কেন্দ্রীয় সরকার বলছে— কোভিড১৯-এর ফলে অর্থনীতি বিপদে পড়েছে। ভাবখানা এমন যাতে মনে হতে পারে কোভিড-১৯-এর আগে দেশের অর্থনীতি সবল ছিল। কোভিড-১৯-এর আগেও দেশের অর্থনীতি, কৃষির অবস্থা ভালাে ছিল না। লকডাউনের আগেই কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটছিল। কৃষকের আত্মহত্যা বাড়ছিল। ঋণগ্রস্ত কৃষি পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ২০১৪-র নির্বাচনী ইশতেহারে বিজেপি বলেছিল-স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে কৃষকের ফসলের উৎপাদন ব্যায়ের ৫০% লাভ রেখে সহায়ক মূল্য দেবে। বিজেপি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যােজনায় চাষির লাভ হয়নি। লাভ হয়েছে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলির। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পকে গত কয়েক বছরে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়েছে। লকডাউনের আগেই কৃষক ও খেতমজুররা খুবই শােচনীয় দুরবস্থার মধ্যে ছিলেন।
নয়া উদারবাদী আর্থিক নীতির ফলে কৃষিতে সঙ্কট বেড়েছে। বিজেপি প্রবলভাবেই নয়া উদারবাদের সমর্থক। নরেন্দ্র মােদির দায়বদ্ধতা কর্পোরেটদের কাছে। এই সময়কালে মূল্য নিয়ন্ত্রণ বা নির্ধারনে সরকারি ভূমিকা কমেছে, কৃষিতে ভরতুকি কমানাে হয়েছে। ১৯৯৪-তে মারাকাসে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ‘এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর কৃষি উৎপাদন ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে ‘গ্যাট’র অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৫ সালে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার শর্ত মেনে কৃষিজ আমদানির উপর থেকে পরিমাণগত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়। বিশ্ব বাজারে ভারত আমদানি বাণিজ্যের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হল। অলাভজনক হতে শুরু করল কৃষি ক্ষেত্র। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের নীতিতে ভারতের মতাে উন্নয়নশীল দেশগুলির গােটা কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
নয়া উদারবাদী অর্থনীতির হাত ধরে অতিবৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলি আর্থিক সহায়তা নিয়ে চাল, গম, ভােজ্য তেল নিয়ে এদেশের মতাে বিশাল বাজারে ইতিমধ্যেই প্রবেশাধিকার লাভ করেছে। চাষের উপকরণের ক্ষেত্রে কৃষকরা এতদিন দেশে যে সুরক্ষার সুবিধা পেয়ে আসত তা ক্রমান্বয়ে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। কৃষকদের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুযোেগ কার্যত শূন্যে নামিয়ে আনা হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)-র নির্দেশে খাদ্য বাণিজ্যের ওপর থেকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনা হয়েছে। কীটনাশকের উপর বহুজাতিকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কৃষক বীজের অধিকার হারাচ্ছে। জমির কেন্দ্রীভবন বাড়ছে। নির্বিচার আমদানি নীতির কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সার শিল্পের সর্বনাশ হয়েছে। বিগত কয়েক বছর সেচে কোনাে বরাদ্দ বাড়েনি।
মােদি জামানায় কৃষক আত্মহত্যা বেড়ে চলেছে। ঋণগ্রস্ত কৃষি পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। কিষান ক্রেডিট কার্ড কৃষকদের মেয়াদী ঋণের চাহিদা পূরনে ব্যর্থ। বাজারে বৃহৎ পুঁজির দাপট বাড়ছে। কৃষি পণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের হাতে। এরা নিজেদের স্বার্থে ফসলের মরশুমে দাম কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেয়। ফলে কৃষকরা বাধ্য হন কম দামে ফসল বিক্রয় করতে।
গত কয়েক বছরে গ্রামীণ ক্ষেত্রে বৃহৎ পুঁজির দাপট বেড়েছে। নয়া উদারবাদীনীতিকে দ্রুততার সঙ্গে কার্যকরী করার মধ্যে দিয়ে কৃষি থেকে ছােটো ও মাঝারি কৃষককে উচ্ছেদ করে বড়াে কৃষকদের হাতে তুলে দিয়ে কর্পোরেট কৃষি ব্যবস্থার পথ সুগম করেছে বিজেপি। ইতিমধ্যেই জমি হাঙ্গররা দুঃস্থ, ঋণগ্রস্ত কৃষকদের অনেক জমি হাতিয়ে নিয়েছে। ছােটো কৃষক ও মাঝারি কৃষকও জমি হারিয়ে অকৃষি মজুরে পরিণত হচ্ছে। দলে দলে কৃষক কৃষি কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। খেতমজুরের সংখ্যা বাড়ছে।
অর্থাৎ লকডাউনের আগে থেকেই কৃষির অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটছিল। মােদির কর্পোরেট বান্ধবনীতি কৃষি সংকটকে আরও ভয়াবহ করে তুলবে। সাম্প্রতিক কৃষির তিনটি আইনের মধ্যে দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে মৃত্যুঘণ্টা বাজানাে হয়েছে। আবার কি আমরা ১৯৪৩-র দুর্ভিক্ষের মতাে পরিস্থিতির মুখােমুখি হব?
অপরিকল্পিত লকডাউনে চাষির ক্ষতি
লকডাউন ছিল অপরিকল্পিত। লকডাউনে সৃষ্ট নানা বাধার কারণে কৃষকের উপর বাড়তি অর্থনৈতিক বােঝা চেপেছে। বিপুল খরচ, দেনার বােঝা বৃদ্ধি, গণ পরিবহনের সমস্যা, মান্ডি বন্ধ, নির্দিষ্ট দামে পণ্য বিক্রি করতে না পারা, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি প্রভৃতি কারণে চাষির জীবনে সর্বনাশ নেমে এসেছে। বিরাট সংখ্যক চাষি বাজারের কার্যকারীতা নষ্ট হওয়ার কারণে অভাবি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছেন।
আমাদের দেশের যখন লকডাউন ঘােষণা করা হল তার তিন মাস আগেই কোভিড মহামারীর বিপদের কথা জানা গিয়েছিল। কিন্তু তাতে মােদি-শাহ অ্যান্ড কোম্পানির কী আসে যায়? দেশের আসন্ন বিপদের মুখেও কোনাে ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করেনি। হৃদয়হীন, অমানবিক বিজেপি সরকারের কাছে তখন রাজনীতিই প্রধান ছিল। ভারত সরকার এই সঙ্কটকে লঘু করে দেখলাে। সর্বোপরি কোনােরকম প্রস্তুতি ছাড়াই দেশের উপর লকডাউন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অপরিকল্পিত লকডাউনে চাষি বিপদে পড়ল। গম, কিছু এলাকায় ধান, লঙ্কা, বরবটি, ছােলা, সরষে, নানা ধরনের ডাল, তুলাে ভুট্টার মতাে নানা রবি শস্য এবং তার সাথেই সবজি ও ফল চাষের মরসুমও লকডাউনের প্রথম পর্যায়ের মধ্যে পড়ে গেলাে। এই অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে চাষবাস ও তা বাজারজাত করার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হল, আর যে কৃষকরা আগে থেকেই সঙ্কটের মধ্যে ছিলেন তাদেরকেও আরও চরম দুর্দশার মধ্যে ফেলে দেওয়া হল। দুধ, মাছ, সবজি, ফল ও ফুলের মতাে সহজে নষ্ট হয়ে যায় এমন জিনিসেরও বিকিকিনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আসলে এই লকডাউন কৃষক-সহ শ্রমজীবী মানুষের রুটিরুজি, বছরভরের শ্রম ও বিনিয়ােগ, খেতের ফসল ও কাজ কেড়ে নিয়েছে, আয় নষ্ট করেছে এবং বিশাল সংখ্যক মানুষকে অনাহারের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
কৃষকরা তাদের জন্য লকডাউনে ছাড় দিতে এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য সাজসরঞ্জাম ইত্যাদি দিতে সরকারের কাছে অনুরােধ করেছিল। সিপিআই (এম) -র নেতৃত্বাধীন কেরলের বাম সরকার ধানচাষকে জরুরি পরিষেবা বলে ঘােষণা করেছিল এবং চাষের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল। নষ্ট হয়ে যাবে এমন আরও কিছু শস্য চাষে সেচ দিতে মজুরদের কাজে লাগানাের জন্যও তারা অনুমতি দিয়েছিল। অতি সম্প্রতি কৃষকের স্বার্থে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেরালার বাম গনতান্ত্রিক মাের্চা সরকার। সারা দেশে এই প্রথম কেরালায় সবজি, ফল, কন্দ জাতীয় ফসল-সহ ১৬টি কৃষি পণ্যের ন্যূনতম দাম ঘােষণা করেছে রাজ্য সরকার। দেশের আর কোনাে রাজ্যেই এই ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে, এমন কিছু সুযােগ দেওয়ার প্রশ্নে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রচুর সময় নষ্ট করেছিল, ফলে তা কার্যক্ষেত্রে আর ফলপ্রসূ হয়নি। এ লকডাউনে বিপন্ন অন্নদাতাদের পাশে দুটি সরকারই দাঁড়ায়নি। আমাদের দেশের প্রধান মন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজ্ঞাপন প্রিয়। মিথ্যাভাষণে এঁরা বিশেষজ্ঞ। অর্থনৈতিক মন্দা ও লাগাতার কৃষি সঙ্কটের সময়ে দীর্ঘ মেয়াদী লকডাউন কৃষক, খেতমজুর ও মেহনতি মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বৃদ্ধি করেছে।
অপরিকল্পিত লকডাউনে চাষি বিপদে পড়ল। গম, কিছু এলাকায় ধান, লঙ্কা, বরবটি, ছােলা, সরষে, নানা ধরনের ডাল, তুলাে ভুট্টার মতাে নানা রবি শস্য এবং তার সাথেই সবজি ও ফল চাষের মরসুমও লকডাউনের প্রথম পর্যায়ের মধ্যে পড়ে গেলাে। এই অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে চাষবাস ও তা বাজারজাত করার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হল, আর যে কৃষকরা আগে থেকেই সঙ্কটের মধ্যে ছিলেন তাদেরকেও আরও চরম দুর্দশার মধ্যে ফেলে দেওয়া হল। দুধ, মাছ, সবজি, ফল ও ফুলের মতাে সহজে নষ্ট হয়ে যায় এমন জিনিসেরও বিকিকিনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আসলে এই লকডাউন কৃষক-সহ শ্রমজীবী মানুষের রুটিরুজি, বছরভরের শ্রম ও বিনিয়ােগ, খেতের ফসল ও কাজ কেড়ে নিয়েছে, আয় নষ্ট করেছে এবং বিশাল সংখ্যক মানুষকে অনাহারের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
কৃষকরা তাদের জন্য লকডাউনে ছাড় দিতে এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য সাজসরঞ্জাম ইত্যাদি দিতে সরকারের কাছে অনুরােধ করেছিল। সিপিআই(এম)-র নেতৃত্বাধীন কেরলের বাম সরকার ধানচাষকে জরুরি পরিষেবা বলে ঘােষণা করেছিল এবং চাষের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল। নষ্ট হয়ে যাবে এমন আরও কিছু শস্য চাষে সেচ দিতে মজুরদের কাজে লাগানাের জন্যও তারা অনুমতি দিয়েছিল। অতি সম্প্রতি কৃষকের স্বার্থে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেরালার বাম গনতান্ত্রিক মাের্চা সরকার। সারা দেশে এই প্রথম কেরালায় সবজি, ফল, কন্দ জাতীয় ফসল-সহ ১৬টি কৃষি পণ্যের ন্যূনতম দাম ঘােষণা করেছে রাজ্য সরকার। দেশের আর কোনাে রাজ্যেই এই ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে, এমন কিছু সুযােগ দেওয়ার প্রশ্নে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রচুর সময় নষ্ট করেছিল, ফলে তা কার্যক্ষেত্রে আর ফলপ্রসূ হয়নি।
লকডাউনে বিপন্ন অন্নদাতাদের পাশে দুটি সরকারই দাঁড়ায়নি
আমাদের দেশের প্রধান মন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজ্ঞাপন প্রিয়। মিথ্যাভাষণে এঁরা বিশেষজ্ঞ। অর্থনৈতিক মন্দা ও লাগাতার কৃষি সঙ্কটের সময়ে দীর্ঘ মেয়াদী লকডাউন কৃষক, খেতমজুর ও মেহনতি মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বৃদ্ধি করেছে। দারিদ্র, বেকারি, অপুষ্টি এবং ক্ষুধা আরও বিস্তৃত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমজনতাকে রক্ষা করার নীতির বদলে কর্পোরেট সেবাতে ব্যস্ত নরেন্দ্র মােদি। মমতা ব্যানার্জিও কর্পোরেট বান্ধব নীতির সমর্থক। কর্পোরেটদের সুযােগ সুবিধা দিয়ে জনগণকে যে রক্ষা করা যায় না—তা স্পষ্ট।
বিজেপি বলছে, স্বাধীনতার পর চাষিদের স্বার্থে মােদি সরকার সবচেয়ে ভালাে কাজ করেছে। নির্জলা মিথ্যা কথা। লকডাউনের জন্য শস্য এবং আয়ের যে ক্ষতি অন্নদাতাদের হয়েছে তা সরকার মেটায়নি। কৃষক ও মেহনতি মানুষের আয়ের যে ক্ষতি হয়েছে তা বিবেচনা করে যাঁরা কর দেন না, আমাদের দেশের যত গরিব মানুষ তাদের সবাইকে মাসে কমপক্ষে ৭৫০০ টাকা করে দেওয়ার যে দাবি বামপন্থীরা করেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার তাতে কর্ণপাত করেননি। বামপন্থীরা দাবি করেছিলেন—ভূমিহীন, ছােটো ও মাঝারি কৃষিজীবী, ভাগচাষি ও খেতমজুরদের ধারবাকি অবিলম্বে মকুব করতে হবে এবং তাদের আর কোনাে ঋণ শােধ করতে হবে না বলে ঘােষণা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার মৌন ছিলেন।
সহজে নষ্ট হয় এমন ফসল-সহ সমস্ত ফসল এবং দুধ, ডিম, মাংসের মতাে খামারজাত পণ্যগুলির জন্য সি২ (কমপ্রিহেনসিভ কস্ট বা মােট খরচ) + ৫০% সূত্র অনুসারে লাভজনক দাম দিতে হবে—এ দাবিও গ্রাহ্য করা হয় নি। পরবর্তী মরসুমের জন্য বিনামূল্যে বীজ, সামর্থ থাকবে এমন দামে চাষের প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের বিষয়টিও উপেক্ষিত থেকেছে।
প্রধানমন্ত্রী কিষাণ যােজনার মূল্য বৃদ্ধি করে ১৮ হাজার করার দাবি মানা হয়নি এবং সমস্ত ভাগ চাষি এবং আদিবাসী কৃষককে এর আওতায় আনা হয়নি। লকডাউনের ফলে বিক্রি করতে দেরি হওয়ার কারণে এবং রবি চাষে যে ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতি পূরণ দেওয়া হয়নি। ঋণগ্রস্ত কৃষকের কোনাে ঋণই মকুব করা হয়নি। পৃথিবীর বাজারে যখন পেট্রোপণ্যের দাম কমেছে সেখানে লকডাউনের সময়ও ভারতে মােদি সরকার ডিজেল, পেট্রোলের উপর অন্তঃশুল্ক বাড়িয়েছে। যখন চাষের খরচ বাড়ছে তখন সারেও ভরতুকি ছাঁটাই করা হয়েছে। সঙ্কটের সময় অন্নদাতাদের পাশে দাঁড়ানাের বদলে বিপদে ফেলেছে মােদি সরকার। বিপদের সময় চরম ঔদাসীন্য দেখানােটাই বিজেপি-র অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
অন্নদাতাদের সঙ্গে নির্মম রসিকতা
গত লােকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান যােজনায় ১৪ কোটি ৫০ লক্ষ কৃষক উপকৃত হবেন বলে বিজেপি প্রচার চালিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৭০ লক্ষ। তাহলে প্রায় ৬ কোটি কৃষক কোথায় গেলেন? যাঁরা এই তালিকায় ঢুকতেই পারেননি সেই ভূমিহীন কৃষক, বর্গাদার, ভাগচাষীদেরই বা কী হবে? পিএম কিষান প্রকল্পে পূর্ব ঘােষিত ২০০০ টাকা প্রদানের ঘােষণায় এই সংকটের সময় সরকার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যােজনায় ২০ কোটির বেশি রেশন কার্ডের গ্রাহক কোনাে রেশনই পাননি। গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে যে নতুন ঘােষণাগুলি করেছিলেন তা আসলে ভাঁওতা। আকস্মিকভাবে লকডাউনের কারণে কৃষিক্ষেত্রে সংকট ও দুর্দশা মােকাবিলায় মােদি সরকার কৃষকদের জন্য কোনােও অতিরিক্ত সহায়তা করেনি। কোভিড-১৯-এর ফলে অর্থনৈতিক মন্দা ও দুর্দশায় জর্জরিত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে নরেন্দ্র মােদি সরকারের ‘আত্মনির্ভর প্যাকেজ’ আসলে জনগণের সঙ্গে ধােকাবাজী। ওই প্যাকেজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে কৃষিক্ষেত্রের জন্য সরকারের আর্থিক সহায়তার কোনাে আগ্রহ নেই। তথাকথিত আত্মনির্ভর প্যাকেজের মধ্যে দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়েছে, সরকার বিত্তশালী কর্পোরেট সংস্থা ও বড়াে কোম্পানিগুলিকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে শ্রমিক ও কৃষকের উপর সংকটের বােঝা স্থানান্তর করতে সক্রিয়।
কেন্দ্রীয় সরকার যখন ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘােষনা করেছিলেন, তখন দেশের কৃষকরা অশা করেছিলেন কৃষি ও গ্রামীণ ক্ষেত্রে হয়তাে একটি বড় অংশের আর্থিক বণ্টন হতে পারে। অন্নদাতারা আশা করেছিলেন, সরকার তাদেরকে প্রধানমন্ত্রী কিষান প্রকল্পের আওতায় অর্থ প্রদান বৃদ্ধি বা কমপক্ষে ২০২০ সালের মে মাসে এপ্রিল-জুনের প্রথম কিস্তির পাশাপাশি দ্বিতীয় কিস্তিও জোগান দেবে। তারা আশা করেছিলেন যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বৃদ্ধির ও কিছু ঋণ মকুবের ঘােষণার। কিন্তু কোনাে আশা পূরন হয়নি আত্মনির্ভর প্যাকেজের ঘােষণায়। বেশ কিছু প্রকল্পের ঘােষনা এই সময় হয়েছে। এগুলি বিদ্যমান প্রকল্পের পুনঃস্থাপন ছাড়া কিছুই নয়। বাস্তবে কৃষকরা মােদি সরকারের হাতে প্রতারিত হচ্ছেন।
অতিমারি জনিত পরিস্থিতিতে কৃষিক্ষেত্রে যখন কাজ সংকুচিত হচ্ছে তখন ‘মনরেগা’র মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারত। দেশবাসীকে অপ্রস্তুতে রেখে লকডাউন ঘােষণার ফলে মনরেগার কাজ স্থগিত হয়ে যায়। ২০ এপ্রিল কেন্দ্রীয় সরকার ‘মনরেগা’র কাজকে লকডাউনের নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় দেয়। গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রকের দেয় তথ্য অনুসারে দেখা যাচ্ছে, এই প্রকল্পে এপ্রিল মাসে যে কর্মসংস্থান হয়েছে তা গত দশ বছরে যেকোনাে এক মাসে কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেয়ে সবচেয়ে কম।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী গত ১৭ মে ঘােষণা করেছিলেন, ‘মনরেগা’-তে অতিরিক্ত ৪০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে। চলতি বাজেটে ৬১,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে যার মধ্যে ১১,৫০০ কোটি টাকা অতীতের বকেয়া পরিশােধের জন্য। সুতরাং ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে আসলে মাত্র ৫০,০০০ কোটি টাকা এক্ষেত্রে বরাদ্দ হয়েছে। অতিরিক্ত বরাদ্দের সাথে এবারের বাজেটে প্রাপ্ত অর্থ মিলে ৯০,০০০ কোটি টাকা। এটি খুবই অপ্রতুল।
এটা পরিষ্কার এই গভীর বিপর্যয়ের সময়েও যাঁরা দেশের অন্নদাতা সেই কৃষকদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে খরচ করতে মােদি সরকার চান না। কৃষি ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের আত্মনির্ভর প্যাকেজ আসলে অন্তঃসার শূন্য ছাড়া কিছুই নয়। বর্তমান সংকটের সময় কৃষকদের ত্রান হিসাবে কিছুই দেওয়া হয়নি। তাদের দাবিগুলিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বলা বাহুল্য গত তিন দশকের নয়া উদারবাদী নীতি কৃষি সংকটকে গভীরতর করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোভিড সংকটের সময় মােদি সরকারের দেউলিয়া ও হৃদয়হীন নীতি। সামগ্রিক পরিস্থিতি কৃষকদের অসহনীয় করে তুলছে।
করােনার সুযােগে কৃষিতে নয়া উদারবাদী সংস্কার করােনা উদ্ভূত সঙ্কটের সময় নয়া উদারবাদী সংস্কারগুলিকে আরও আগ্রাসীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সেরা সময় বলে মনে করছেন মােদি সরকার। এই সময় শ্রম বাজারের সংস্কার, অনেকগুলি আইন স্থগিত করে দেওয়া, শিল্পগুলির সামনে লাগামহীন নমনীয়তা ও বাজার সংস্কারের সুযােগ করে দেওয়া এবং কৃষি ব্যবস্থাকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছেন নরেন্দ্র মােদি। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নয়া উদারবাদী সংস্কারগুলি আরও আগ্রাসীভাবে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছেন।
গত ১২ মে লকডাউনে বিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে আত্মনির্ভর ভারত গঠনের পক্ষে জিডিপি-র ১০ শতাংশ বা ২০ লক্ষ কোটি টাকার এক বিপুল প্যাকেজ ঘােষণা করেন মােদি। ওই প্যাকেজের দফাওয়ারি বরাদ্দের ক্ষতিপূরণে দেখা গেল বাজেটে ঘােষিত বরাদ্দের তুলনায় নতুন বরাদ্দ মাত্র ২ লক্ষ কোটি টাকা যা মেরে কেটে জিডিপি-র ১ শতাংশ। প্যাকেজের ঘােষণা করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন—শিল্পে গতি আনতে প্রয়ােজন শ্রম আইন প্রদত্ত ও শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রামে অর্জিত অধিকার হরন। আত্মনির্ভরতা অর্জনের প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলােপ সাধন প্রয়ােজন। কৃষিতে নিযুক্ত দেশের অধিকাংশ শ্রমজীবীর আয় দ্বিগুন করার প্রধান অন্তরায় নিয়ন্ত্রিত বাজার। প্রয়ােজন এই বাজার ব্যবস্থাকে কর্পোরেট ও দেশীয় বৃহৎ ব্যবসাদারদের কাছে পুরােপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া। কৃষির তিনটি আইনের মধ্যে দিয়ে সেই কাজই করা হয়েছে।
সম্পূর্ণ অগনতান্ত্রিক উপায়ে কৃষিতে তিনটি আইন আনা হল
নরেন্দ্র মােদির হাতে দেশের গনতন্ত্র বিপন্ন। কার্যত ভারতবর্ষে চলছে অঘােষিত জরুরি অবস্থা। প্রধানমন্ত্রীর ট্রাম্প তােষণ, অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মধ্যপ্রদেশের ক্ষমতা দখলের ছক ইত্যাদির জন্য লকডাউন ঘােষণায় অহেতুক বিলম্ব এবং বিলম্বের কারণে যে সময় পাওয়া গেল তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি রাজ্যের সঙ্গে আলােচনা করে পরিযায়ী শ্রমিকদের উদ্দিষ্ট রাজ্যগুলিতে পাঠানাের ব্যবস্থা না করে বা সহায়তা না দিয়ে কোনাে রাজ্যের সঙ্গে কোনাে প্রকার আলােচনা ছাড়াই আচমকা লকডাউন ঘােষণা করা হয়। এর মধ্যে দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং সেই সঙ্গে করােনা সংক্রমন দেশকে এপিডেমিক থেকে প্যানডেমিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
অযােধ্যায় রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানের লােকসমাগম সংক্রমনকে আরও ব্যাপকতর করার পথে এগিয়ে দিয়েছে। করােনা সংক্রমণে ভারতবর্ষ আজ দ্বিতীয় স্থানে। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে মানুষ বঞ্চিত। প্রাক-করােনা অবনমন আরও গভীর সংকট সৃষ্টি করে দেশের সাধারণমধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সকলকেই বিপর্যস্ত করেছে। কর্মচ্যুতি, কর্মসংকোচন চলছে। কিন্তু মােদি বলছেন-দেশ এগিয়ে চলেছে। এই অবস্থায় গরিব-মধ্যবিত্ত- নিম্নবিত্ত মানুষের পকেট ফাকা হলেও আদানি-আম্বানিদের সম্পত্তি বেড়েছে। দেশের এই কঠিন অবস্থার মধ্যেও নরেন্দ্র মােদি শ্রমিক-কৃষকবিরােধী, জনবিরােধী নীতি নিয়ে চলেছেন। কোভিড-১৯ জনিত প্যানডেমিক এর স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার জন্য সামাজিক দুরত্বের সুযােগ নিয়ে সংসদীয় গনতন্ত্রের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা দেখিয়ে যেমন খুশি আইন পাশ করিয়ে নিচ্ছেন।
কৃষি ও কৃষকের দুর্ভোগ মােদিকে এতটাই পীড়িত করে যে তিনি এ বিষয়ে আইনি প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সংসদে আইন প্রনয়নে বা রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের সাংবিধানিক বাধা অতিক্রম করতে জরুরি ভিত্তিতে ৩ জুন কৃষি ক্ষেত্রে তিনটি অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) জারির প্রস্তাব ক্যাবিনেটে অনুমােদন করান। কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত, রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যাদেশ গত ৫ জুন ‘দ্য গেজেট অফ ইন্ডিয়া’র মাধ্যমে দেশে জারি ও প্রকাশিত হল। এক, কৃষকের উৎপন্ন কারবার ও বাণিজ্য (উন্নয়ন ও সুবিধা) অধ্যাদেশ। দুই, কৃষক (ক্ষমতায়তন ও সুরক্ষা) দামের আশ্বাস ও খামার পরিষেবা চুক্তি অধ্যাদেশ। তিন, অত্যাবশকীয় পণ্য (সংশােধনী) অধ্যাদেশ।
অধ্যাদেশ জারিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে লঙ্ঘন করা হয়েছিল এবং সংসদীয় রীতিনীতিকেও পদদলিত করা হয়েছিল। লকডাউন পর্যায়ে কৃষকের রবি ফসল খামারজাত করা ও ন্যায্যমূল্যে বিপননের সমস্যার দিকে লক্ষ্য দেওয়ার প্রয়ােজন নরেন্দ্র মােদি করেননি। একবারও ভাবেননি কৃষি ও কৃষি বিপননের বাজার অনেকদিন ধরেই বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ মুক্ত। তিনটি অধ্যাদেশ আজ আইনে পরিণত হয়েছে। এই তিনটি আইন খাদ্য নিরাপত্তা ধ্বংস করবে। শিল্পের বিকাশের সঙ্গে কৃষির ভারসাম্য রক্ষিত না হলে শিল্পের বিকাশও বাধাপ্রাপ্ত হবে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিনষ্ট হবে।
যে কায়দায় কৃষির তিনটি বিলকে আইনে পরিণত করা হয়েছে তা একটি স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে ও সংসদীয় রীতির পরিপন্থী। সংবিধানের ২৪৬ ধারা ও সপ্তম তফশিলে সংসদ ও রাজ্য আইনসভা কোন কোন বিষয়ে আইন প্রনয়ন করতে পারে তা নির্দিষ্ট করা আছে। কৃষি হল রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয় এবং এ বিষয়ে রাজ্য আইন সভাই আইন প্রনয়ন করার অধিকারী। এই অধিকার বলে প্রতিটি রাজ্যই এগ্রিকালচারাল প্রােডিউস মার্কেটিং কমিটি অ্যাক্ট (এপিএমসি) প্রণয়ন করেছে। এই আইনের বিধানে মার্কেটিং কমিটির লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছেই কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারেন। কমিটির আধিপত্যে আঘাত হানার প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করা না গেলেও রাজ্য আইন সভাই এ বিষয়ে প্রয়ােজনীয় সংশােধনী আনার অধিকারী। সরাসরি এপিএমসি অ্যাক্ট পরিবর্তন করতে পারে না বলেই ২০০৩ সালে একটি মডেল আইনের আদলে রাজ্যস্তরে আইন প্রনয়নের সুপারিশ করেছিল কেন্দ্র।
এবার করােনার সুযােগে আইন প্রনয়নের অধিকার না থাকা সত্ত্বেও একতরফাভাবে সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে কেন্দ্র ‘ফার্মারস প্রােডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স ও ফার্মারস প্রাইস অ্যাসিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিস’ অর্ডিন্যান্স জারি করে ও পরে তা আইনে পরিণত করে।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনটি যুগ্ম তালিকার বিষয়—এই বিষয়ে কেন্দ্র অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারে। কিন্তু যেহেতু বিষয়গুলি রাজ্যগুলিকেই নিশ্চিত করতে হয় তাই রাজ্যগুলির মতামত না নিয়ে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা থেকে খাদ্যশস্য, ডালশস্য, ভােজ্য তেল, পেঁয়াজ ও আলুর মতাে বিষয়গুলিকে বাদ দেওয়া স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামােয় হস্তক্ষেপ। আসলে এটি রাজ্য সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার নামান্তর। এটা স্বৈরতন্ত্র ও সংবিধান বিরােধী পদক্ষেপ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতীয় সংবিধানের সপ্তম তফসিল তথা ২৪৬তম ধারার দ্বিতীয় তালিকা অর্থাৎ রাজ্য তালিকার ১৪তম উপধারায় বলা আছে, কৃষি, কৃষি শিক্ষা ও গবেষণা, কিট দমন ও চারাগাছের রােগ প্রতিরােধ অর্থাৎ কৃষি সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় এই তালিকার অন্তর্ভূক্ত। ৩০তম উপধারায় বলা হয়েছে মহাজনি কারবার, মহাজন এবং কৃষিঋণ সহায়তা এগুলি রাজ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। ৩২তম উপধারা অনুযায়ী, প্রথম অর্থাৎ কেন্দ্রীয় তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয় এমন ক্ষেত্রে সংস্থার নিগমভুক্তি নিগমবদ্ধ সংস্থার নিয়ন্ত্রণ, সংস্থা বন্ধ হওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়; নিগমবদ্ধ নয় এমন বাণিজ্যিক, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, ধর্মীয় এবং অন্যান্য সমিতি ও সংগঠন; সমবায় সমিতি, এই সমস্তই রাজ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
অতএব কৃষিক্ষেত্রের বাণিজ্যিকীকরণ, বাজার, বাজারের নিয়মাবলী প্রণয়ন এবং এই ক্ষেত্রে নিগমবদ্ধ অর্থাৎ কর্পোরেট সংস্থার পত্তন করা বা না করা এবং সেগুলির নিয়ন্ত্রণ রাজ্যের এক্তিয়ারে পড়ে। সেক্ষেত্রে রাজ্যগুলির সঙ্গে পরামর্শ না করা, তাদের প্রস্তাব ও প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে কৃষিক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রনয়ন আসলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের উপর আঘাত।
লকডাউন পর্বে বিজেপি সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মকানুনগুলিকে পদদলিত করে চলেছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর কার্যত গায়ের জোরে, সংসদীয় গনতন্ত্রকে হত্যা করে অকৃষক বড়াে ব্যবসায়ীদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য তিনটি বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ অগনতান্ত্রিক উপায়ে কৃষকের স্বার্থ বিরােধী যে তিনটি বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে সেগুলি হল—
- (1) The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill, 2020
- (2) The Farmers’ (Empowermentand protection) Agreement on price Assurance and Farm Services Bill, 2020
- (3) The Essential Commodities (Amendment) Ordinance, 2020,
সংসদের দুই কক্ষেই বামপন্থীরা এবং সংসদের বাইরে বিভিন্ন রাজ্যের কৃষক সংগঠনগুলি তীব্র বিরােধীতা করেছে। লােকসভায় বিলগুলি তড়িঘড়ি পাশ করানাে হয়েছে সংখ্যার জোরে। কিন্তু রাজ্যসভায় সংখ্যার জোর না থাকাতে এবং বিল-এ কৃষক স্বার্থ বিরােধী বহু ধারা থাকার ফলে বিজেপি ঝুঁকি নিতে চায়নি। বিলের ধারাগুলি ভালােভাবে বিস্তৃত আলােচনা করার সুযােগ দিলে প্রবল প্রতিবাদের সম্ভবনা ছিল, যেমন শিরােমণি আকালি দলের মন্ত্রী বিলের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। তাই রাজ্যসভায় সংসদীয় নিয়মকানুনের তােয়াক্কা না করে পেশি বলে ধ্বনিভােটে বিল পাশ করানাে হয়। বিলগুলির উপর বিশদ আলােচনার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানাের বিরােধীদের দাবি মানা হয়নি। বিরােধীদের ডিভিসন-এর দাবি অগ্রাহ্য করে বেনজির পদ্ধতিতে ধ্বনিভােটে পাশ ঘােষণা করেন ডেপুটি চেয়ারম্যান। বিরােধী ৮ সাংসদকে বরখাস্ত করা হয়। চরম স্বৈরাচারী পদক্ষেপের নজির গড়লেন মােদি। কৃষি বিলগুলিতে রাষ্ট্রপতিকে স্বাক্ষর না করার আর্জি জানিয়েছিলেন ১৮টি বিরােধী দলের নেতৃত্ব। কিন্তু রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেছেন।
কৃষি আইন গুলির স্বপক্ষে বিজেপি-র বক্তব্য
বিজেপি ইতিমধ্যে সর্বনাশা কৃষি আইন গুলির পক্ষে প্রচারে নেমেছে। বিজেপি-র বক্তব্য কি?
- এক ভারত, এক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তােলা,
- নিয়ন্ত্রিত মান্ডির বাইরে কৃষকদের ফসল বিক্রির স্বাধীনতা,
- আন্তঃরাজ্য ও অভ্যন্তরীন নিষেধাজ্ঞার অবলুপ্তি,
- খাদ্য প্রক্রিয়াকরণকারী, পাইকারি ও খুচরাে খাদ্য ব্যবসায়ী এবং রপ্তানিকারকদের সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য পূর্ব নির্ধারিত দামে কৃষকের চুক্তির স্বাধীনতা,
- কৃষি বাণিজ্যে মধ্যস্বত্বভােগীদের বিলােপ সাধন,
- পণ্য মজুত, সরবরাহ, চলাচল, ও বণ্টনের স্বাধীনতা,
- দেশি ও বিদেশি লগ্নিকারীদের কৃষিক্ষেত্রে আকৃষ্ট করা,
- এক দেশ, এক বাজার।
এ এই তিনটি আইনের বিরােধিতা কেন?
যদি এই তিনটি আইন ভালােই হয় তাহলে এত তাড়াতাড়ি কেন? কিসের এত গােপনীয়তা? কোন সময় বিলগুলিকে পাশ করিয়ে আইনে পরিণত করা হল? যখন সারা দেশ করােনায় বিধ্বস্ত, শ্রমিকরা কর্মহীন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঠিক তখনই এটি করা হল।
বলা বাহুল্য তিনটি আইন আলাদা আলাদাভাবে বলবৎ হলেও তিনটি আইন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত। এই তিনটি আইন কৃষকের স্বার্থে নয়। এমনকী, কৃষি উৎপাদনের যাঁরা চূড়ান্ত ভােক্তা, তাদের স্বার্থেও নয়। আইনগুলি খােলা মনে পর্যালােচনা করলেই ধরা পড়ে এই সত্য। তিনটি আইনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি—
- ১। কৃষকের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের প্রতিশ্রুতি কোথাও নেই।।
- ২। মজুতদারি আর বেআইনি বলে গণ্য হবে না।
- ৩। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তৈলবীজ, খাদ্যযােগ্য তেল ইত্যাদি পণ্যগুলির মজুতদারি ও দামে সরকারি তরফে নিয়ন্ত্রণ হবে কেবলমাত্র যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অনন্য সাধারণ দাম বৃদ্ধি এবং মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি অনন্য সাধারণ পরিস্থিতিতে।
- ৪। সেক্ষেত্রেও সবজি ও ফল ইত্যাদির ক্ষেত্রে ১০০% ও অপচনশীল কৃষিজ পণ্য অর্থাৎ তেল, চা, চিনি ইত্যাদির ক্ষেত্রে ৫০% দাম বৃদ্ধি ঘটলে তবেই সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
- ৫। সেক্ষেত্রেও মূল্য সংযােগশৃঙ্খলে উৎপাদনের মধ্যবর্তী স্তরে কোনাে কারবার বা কারবারির উপর সেই নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্ত হবে না। উদাহরণ, কোনাে আলুভাজা প্রস্তুতকারক সংস্থা বাজারে আলুর দাম আগুন হলেও যথেচ্ছ আলু মজুত রাখতে পারবে কিংবা, চিনির দর আকাশ ছুঁলেও চিনি কল আখ মজুত করে চলবে।
- ৬। রাজ্যের হাত থেকে কৃষি ব্যবস্থা পুরােপুরি কেন্দ্রের অধিকারে চলে যাবে।
- ৭। রাজ্যের হাতে মান্ডির বাইরে কৃষি থেকে আয়ের কোনাে উপায় থাকবে না।
- ৮। কৃষি পণ্যের কারবারিরা নিজেদের স্বার্থে মান্ডির কমিশন এজেন্ট বা – ফড়েদের মাধ্যমে কৃষকের পণ্য মাঠ থেকে সরাসরি হাতিয়ে নেবার উদ্যোগ নেবেন।
- ৯। এমএসপি নির্ধারিত দাম মান্ডির বাইরে আদায় হওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকায় জবরদস্তি করার সুযােগ থাকবে।
- ১০। অত্যাবশ্যক নিত্য প্রয়ােজনীয় চাল, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ আর আলু অত্যাবশ্যক থাকবে না। রাজ্যের হাতেও বাজারের দাম নিয়ন্ত্রকের কোনাে অধিকার থাকবে না। ফলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সঙ্কটের সম্মুখীন হতে বাধ্য।
- ১১। বর্তমানে নানান আইন সত্ত্বেও ছােটো কৃষকেরা ফড়েদের হাতের শিকার। যেটুকু আইনি ব্যবস্থা ছিল কৃষক স্বার্থ রক্ষায় তাও তুলে নেওয়া হবে নতুন ব্যবস্থায়। কৃষি পণ্য লেনদেনে কৃষক স্বার্থ দেখার খাতাকলমের ব্যবস্থাটুকুও তুলে নেওয়া হবে এই নতুন ব্যবস্থায়।
- ১২। তৈরি হবে তিন ধরনের বাজার। মান্ডি, চুক্তি চাষ, মান্ডির বাইরের বাজার। মান্ডি তৈরি হয়েছিল ফড়েরা যাতে কৃষকদের জমি থেকে পণ্য তুলে তাদের অত্যাচার না করতে পারে। নতুন ব্যবস্থায় কৃষকের বাড়ি পর্যন্ত ফড়েদের যাওয়ার রাস্তা আরও প্রশস্ত হবে।
- ১৩। চুক্তি চাষ হবে। চুক্তি হবে কৃষক ও বাণিজ্য সংস্থার মধ্যে। চুক্তিতে ফসলের পরিমাণ, গুনগত মান, দাম ইত্যাদি সমস্তই আগাম নির্ধারিত থাকবে।
- ১৪। চুক্তিভঙ্গে সরকার সাধারন কৃষকের পাশে কীভাবে থাকবে অথবা থাকবে কিনা তা অনুচ্চারিত।
- ১৫। এই চুক্তি সম্পাদিত হবে মহকুমাশাসকের কতৃত্বের এক্তিয়ারে।
- ১৬। এই চুক্তির উপর রাজ্যের নিজস্ব আইন বা আদেশের কোনাে প্রভাব থাকবে না।
- ১৭। চুক্তি খেলাপ করার অভিযােগ উঠলে, তার বিচার দেশের দেওয়ানি আদালতে হবে না।
- ১৮। চুক্তি সংক্রান্ত যাবতীয় বিবাদের বিচার করবেন মহকুমা শাসক। তাঁর বিচারে সন্তুষ্ট না হলে আপিল করতে হবে জেলা শাসক বা অতিরিক্ত জেলা শাসকের অধীন উত্তর-বিচার কর্তৃপক্ষের কাছে। এক্ষেত্রে মহকুমাশাসক, জেলা শাসক তথা উত্তর-বিচার কর্তৃপক্ষের রায় দেশের দেওয়ানি আদালতের রায়ের সমান মান্যতা পাবে।
- ১৯। সরকারি তরফে কৃষির বাজার ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্র সমস্তটাই কুক্ষিগত থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। রাজ্যের আইন এক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। দেশের আদালত তথা মূল বিচার ব্যবস্থার কোনও ভূমিকাই নেই। কেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি প্রশাসনিক যােগাযােগ থাকবে জেলা শাসক ও মহকুমা শাসকের। রাজ্য প্রশাসন থাকবে নীরব দর্শক। আসলে এই তিনটি কৃষি আইন ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, স্বেচ্ছাচার, একনায়কতন্ত্র ও কর্পোরেট আনুগত্যের দলিল।
এক দেশ, এক বাজার শ্লোগানকে সামনে রেখে অবাধ বাণিজ্যের বিষয়টিকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। কৃষকের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে কর্পোরেটরা-এর ফলে সুবিধা ভােগ করবে। সহায়ক মূল্য ও মূল্য স্থিতিশীল রাখার কোনাে ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক সমাজকে সার্বিকভাবেই কৃষি ব্যবসার কর্পোরেটদের দয়া দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করতে হবে। এই তিনটি আইন আগ্রাসী নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। অনাহার, দুর্দশা, অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকা কৃষক সমাজ ও গ্রামের গরিব মানুষের উপর তীব্র অর্থনৈতিক আক্রমণ নেমে আসবে।
কৃষি পণ্য আইন সরকারি দাবি ও বাস্তবতা
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত লকডাউন কৃষিজাত খাদ্য পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলকে অবিন্যস্ত করেছে। এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিপণ্য বাণিজ্য ও বাণিজ্য (প্রসার ও সুবিধার্থ) বিল ২০২০-কে আইনে পরিণত করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি এর ফলে অন্তঃরাজ্য ও আন্তঃরাজ্য ব্যবসা বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করবে। রাজ্য কৃষি উৎপাদন বিপণন আইনের আওতাভুক্ত ফসলের বাস্তবিক বাজারগুলাের বাইরে ও ই-কমার্সের দ্বারা উপকৃত হবে বলেও প্রচার করা হচ্ছে। দাবি করা হচ্ছে যে এই প্রথম কৃষকেরা যেখানে ইচ্ছা সেখানে তাদের ফসল বিক্রির স্বাধীনতা পেতে চলেছে। উল্লেখিত আইনটির মাধ্যমে Agricultural Produce Market Committee (APMC) বাজারকে পাশ কাটিয়ে কৃষক সরাসরি তাদের উৎপন্ন কৃষি পণ্য যেখানে খুশি, যার কাছে খুশি বিক্রি করতে পারবে। তাই বলা হচ্ছে যে এই আইনের মাধ্যমে কৃষকদের ফসল যেমন খুশি বেচার স্বাধীনতা দেওয়া হল।
এপিএমসি আইন ভারতের স্বাধীনতার আগে থেকে বলবত আছে। মহাজন, জমিদার, ফড়েদের শােষণের হাত থেকে কৃষকদের বাঁচানাের উদ্দেশ্যে এপিএমসি আইন ১৯২৯ সালে বলবত করা হয়। চাষিদের বিপুল দেনা, কৃষকদের দর কষাকষি করার ক্ষমতা না থাকার সুযােগ নিয়ে মহাজন, জমিদার ও ফড়েরা কৃষকদের ফসল অত্যন্ত কম দামে তাদের থেকে সংগ্রহ করত। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার এপিএমসি বাজারের বাইরে কৃষি পণ্য ক্রয়কে বেআইনি ঘােষণা করে। এই এপিএমসি বাজার এপিএমসি আইন দ্বারা পরিচালিত। দেশের স্বাধীনতার পরেও এই আইন বলবত ছিল ও সবুজ বিপ্লবের সময় যখন সরকার ঘােষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে (এমএসপি) কৃষি পণ্য সরকার সংগ্রহ করত, তখন এই এপিএমসি বাজার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসাবে তার ভূমিকা পালন করে।
১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে এপিএমসি আইনগুলাে চালু করা হয়েছিল বড়াে ব্যবসাদার ও বড়াে ক্রেতাদের এক চেটিয়া ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। অর্থাৎ এপিএমসি-র মান্ডিগুলি ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে অবস্থান করছে। এই বাজারগুলি মূলত ১৯৬০ ও ১৯৭০-র দশকে কৃষকদের যাতে ব্যবসায়ীদের হাতে বৈষম্যের স্বীকার হতে না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই ব্যবস্থার মধ্যে গলদ থাকলেও এপিএমসি আইনগুলাের ফলে নিলামের মাধ্যমে ফসল বিক্রির একটি পদ্ধতি শুরু হয় যেখানে প্রতিযােগিতার একটা পরিবেশ ছিল।
নতুন আইনে বড়ো ব্যবসায়ী ও বড় ক্রেতাদের সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে নথিভুক্ত বাজারের বাইরে পণ্য কেনার অনুমতি দেওয়ার অর্থ এই যে পণ্যটি কেনা হবে নিলাম ছাড়াই ও বড়াে ব্যবসায়ী এবং দরিদ্র কৃষকের মধ্যে দ্বিপাক্ষীয় আলােচনার মাধ্যমে। বাস্তবিকভাবে এটি কৃষক স্বার্থের বিরুদ্ধে ও তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন। কৃষকেরা অনেক সময়েই অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হন—ধার শােধ করার জন্য সহ নানা আর্থিক কারণে। তারা এখন একটা অসম ব্যবস্থার মুখখামুখি হবেন যখন কোনাে ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপ থাকবে না ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে তারা বৃহৎ পুঁজির সামনে পড়বেন। এপিএমসিকে দুর্বল করা গণসংগ্রহ ব্যবস্থা ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দুর্বল করার প্রথম পদক্ষেপ। এক দেশ এক বাজার এর শ্লোগান আসলে কৃষি উৎপাদকদের অবস্থা আরও সঙ্গীন করে তুলবে।
আসলে কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি কাজ করতে চাইছেন—
- (১) চুক্তি চাষের বৈধ করন,
- (২) নিয়মিত বাজারগুলি ছাড়া বিশ্ব রিটেল চেন দ্বারা কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কৃষি পণ্য ক্রয়ের বৈধ করন
- (৩) বহুজাতিকদের নতুন কৃষি বাজার খােলা ও নিয়ন্ত্রণের অনুমতি।
যুক্তি হিসাবে বলা হচ্ছে কৃষকরা স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন ও আগের তুলনায় উচ্চহারে মূল্য পাবেন। এটার কোনাে প্রমাণ নেই যে এপিএমসি আইন সংশােধনে নিজেই কৃষকদের মূল্য আদায় উন্নতি করবে। এই বাজারগুলি সহজেই প্রতিস্থাপনযােগ্য হয় না। এপিএমসি বাজারগুলির অনুপস্থিতি কৃষি বিপণন ক্ষেত্রকে একটি বিশাল শূন্যতার দিকে পরিচালিত করতে পারে যা কৃষকদের তীব্র শােষণ ও হয়রানির ক্ষেত্র উন্মােচন করবে।
আইনে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের উল্লেখ নেই। এযাবৎকালের কৃষি উৎপাদন বাজার সমিতি অর্থাৎ কিষান মান্ডি ইত্যাদিকে একেবারে কোনঠাসা করে দেওয়া হল। আইনে পরিষ্কার বলা আছে কৃষক ও স্পনসর অর্থাৎ বাণিজ্যিক ক্রেতাসংস্থার মধ্যে যাবতীয় চুক্তি, লেনদেন ইত্যাদি এপিএমসি ইয়ার্ড অর্থাৎ বাজার সমিতি তথা কিষান মান্ডির চৌহদ্দির মধ্যে হতে পারবে না এবং এসবের মধ্যে বাজার সমিতি ও মান্ডির কোনাে ভূমিকা, কোনও হস্তক্ষেপ চলবে না। এর অর্থ হল, ভারতীয় কৃষক কৃষিপণ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে বরাবর যে মূলত সামাজিক সাংগঠনিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে এসেছে এবং রাজ্যগুলি গত ষাট-সত্তরের দশক থেকে যে ব্যবস্থাকে আরও সহায়তা দান ও সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে তা গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আর্থিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর থেকে কৃষি পণ্যের বিক্রয় ও প্রক্রিয়াকরণ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০০৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার একটি মডেল এপিএমসি আইনের খসড়া উপস্থিত করে। ২০০৩-এ ভারত সরকারের তৈরি মডেল এপিএমসি আইনে রাজ্যগুলিকে কৃষি বিপননের জন্য পাইকারি বাজারের পরিকাঠামাে তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এই আইনের ফলে দেশে এই মুহূর্তে প্রায় ৬,৯০০ মান্ডি সক্রিয়। উত্তর প্রদেশে ২০১৮-১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী ৭৫টি জেলার ২৫১টি মান্ডিতে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার ব্যাবসা হয়েছে। সেস ও কর মিলিয়ে মােট ১, ৮২৩ কোটি টাকার উপর আয় করেছে উত্তরপ্রদেশ সরকার। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে এপিএমসি বাজার পণ্যের বিপননে কাজ করছে। দেশের পেঁয়াজ উৎপাদন ও বিপননে মহারাষ্ট্রের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ওখানে ৩০৭টি এপিএমসি বাজার কাজ করছে। লসলগাঁও-এর পেঁয়াজ বাজারের ভূমিকা কে না জানে? তামিলনাড়ুতে এ ধরনের বাজারের সংখ্যা ২৭৭। অর্থাৎ প্রায় সব রাজ্যেই চলছে এই বাজার।
বিহারের অভিজ্ঞতা কী? ২০০৬ সালে বিহারে এপিএমসি আইন বাতিল করা হয়। অতএব বিহারের অভিজ্ঞতার দিকে তাকালে আমরা কিছুটা আন্দাজ পাব কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের অভিখাতে কৃষি ক্ষেত্রের কী হতে চলেছে। বিহারে বিগত ১৪ বছরে সংগঠিত বেসরকারি পাইকারি বাজার তৈরি হতে দেখা যায়নি, কোনাে সংগঠিত পুঁজি সরবরাহ শৃঙ্খলে বিনিয়ােগের মাধ্যমে ভঙ্গুর বাজার পরিকাঠামাের উন্নতি সাধন করেছে বলেও জানা নেই। বেসরকারি ব্যবসায়িদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বিহার। তারা কৃষকদের কাছ থেকে গম কেনে সরকার ঘােষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ৩০% কম দামে। তারপরে তারা সেই গম পাঞ্জাব হরিয়ানায় বিক্রি করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দরে। এই অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয় সার্বজনীন পরিকাঠামাে গড়ে তােলার গুরুত্ব। ফসলের কম দাম লাগাতার পেতে পেতে বিহারের কৃষি অর্থনীতি লাভজনক অবস্থায় নেই। তাই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে বিহার থেকে সর্বাধিক সংখ্যক শ্রমিক দেশের শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে জীবিকার সন্ধানে।
চুক্তি চাষের প্রসার ও বিপদ
তিনটি কষি আইনের দ্বিতীয় আইনটি হল ‘দ্য ফারমার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রটেকশন) এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাসিওরান্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল, ২০২০’। দ্বিতীয় আইনটি হল প্রথমটির সঙ্গে উৎপন্ন ফসলের দাম, উৎপাদনের কাজে প্রয়ােজনীয় মালপত্রের জোগান ইত্যাদি সম্পর্কিত চুক্তি। এই আইনে চুক্তি চাষের কথা বলা হয়েছে। আইনে কীভাবে কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে চুক্তি হবে তার একটা রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। লিখিত চুক্তিতে ফসলের দামের সঙ্গে গুনমান ইত্যাদি উল্লেখিত থাকবে।
এই কৃষি আইন অনুযায়ী কৃষকেরা চুক্তি মেনে চাষ শুরুর আগেই ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে দাম নির্ধারণ করবে। স্বাভাবিকভাবে কোনাে ফসলের জন্য কতদিনের মেয়াদী চুক্তি হচ্ছে তা বীজ বপনের আগেই স্থির হয়ে যাবে। প্রয়ােজনে বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদি ক্রেতা কীভাবে সরবরাহ করবে, পণ্যের গুনমান ইত্যাদি থাকবে সেই সেই চুক্তিতে। ওই চুক্তির ভিত্তিতেই দু-পক্ষ লেনদেন করতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু আইনে কোথাও বলা নেই দাম নির্ধারনের ভিত্তি কী হবে? চুক্তির মেয়াদ শেষে সেই জমি অন্য ফসল উৎপাদনের যােগ্যতা হারিয়ে ফেললে কী হবে? বলা নেই। এটি আসলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাদন প্রথার আদর্শ উত্তরণ। একই মডেল অনুসরণ করে এদেশে কৃষক শােষণের নৃশংসতম নজির কিন্তু রেখে গিয়েছে নীলকররা। নীলচাষও ছিল এইরকম চুক্তি ভিত্তিক। ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবার হবে না—এরকম কোনাে গ্যারান্টি নতুন কৃষি আইন এ নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনাে কৃষকের বিরুদ্ধে চুক্তি ভাঙার অভিযােগ নিয়ে ক্রেতা আদালতে অভিযােগ আনলে কৃষককে তাে ঘটি-বাটি-মাটি বিক্রি করে দায় মুক্ত হতে হবে। পিছনের দিকে এগিয়ে চলার আদর্শ দৃষ্টান্ত।
আসলে চুক্তির বিনিময়ে দাম কী হবে সেটা অবশ্যই নির্ভর করবে চাষির দর কষাকষির ক্ষমতার উপর। ভারতের অধিকাংশ চাষির এই ক্ষমতা কতটুকু? ২০১৫-১৬ সালে ৬৮% কৃষক প্রান্তিক চাষি যাদের জমির পরিমাণ গড়ে ০.৩৮ হেক্টর এবং ১৮% ক্ষদ্র চাষি যাদের জমির পরিমাণ গড়ে ১.৪০ হেক্টর। চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সময়ে এরা কি বড়াে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠবে? বিশেষ করে যেখানে এমএসপি অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যের বিষয়টি তুলে দেওয়া হচ্ছে, কেননা কোনাে আইনেই এর উল্লেখমাত্র নেই।
চাষিকে মুনাফার যে প্রলােভন দেখানাে হচ্ছে তার কোনাে ভিত্তি নেই। এই প্রথায় চাষি শুধু নিজের খাদ্য নিরাপত্তাই হারাবে না, দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও দারুণভাবে বিঘ্নিত হবে। বলা হচ্ছে অনিশ্চিত দামের ঝুঁকি কমানাের ব্যবস্থা আছে এই আইনটিতে। চাষি বাজারের অনিশ্চয়তা কাটাতে ‘চুক্তি চাষ’ করতে পারে, ফসলের দাম আগেই যেখানে নির্দিষ্ট করা আছে। চুক্তির সমস্যা হল, চুক্তি এক পক্ষ হবে পেপসিকো কিংবা রিয়ায়েন্স ফ্রেশ-এর মতাে ক্ষমতাধর ক্রেতা, অন্য পক্ষে থাকবে দুর্বল চাষি। যাকে আইনি পথে বেকায়দায় ফেলা যাবে। যে চাষি বাজারি দামের অনিশ্চয়তা এড়াতে এই চুক্তি চাষে রাজি হবে, অচিরেই দেখা যাবে চাষি তার নিজের জমিতেই কৃষি মজুরে পরিণত হবেন। বীজ থেকে সেচ, সার-সব আসবে কোম্পানি থেকে। ফসল নির্দিষ্ট দামে নিয়ে যাবে কোম্পানি, জমার ঘরে যা আসবে তা খরচ বাদে মজুরির বেশি নয়।
কৃষি পরিষেবা ও মূল্য নিশ্চয়তার জন্য কৃষকদের (ক্ষমতায়ন এবং সুরক্ষা) ‘চুক্তি বিল ২০২০’ উত্থাপন করে বলা হয়েছিল—কৃষকরা তাদের পণ্য যেখানেই চাইবে গ্যারান্টি যুক্ত মূল্যে বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু এ দাবি অন্তঃসারশূন্য। কারণ দামের মধ্যে মূল্য নিশ্চয়তার কথা বলা আছে কিন্তু কোথাও কৃষি বিপণন সংস্থা বা ব্যবসাদার এমএসপি-এর কম দামে ফসল কিনতে পারবে না এমন কথা উল্লেখ করা নেই। আসলে এটি চাষিদের ক্ষমতায়ন করার বদলে এটি তাদের নির্মূল করার বিনিময়ে সহায়তা করবে বড়াে বড়াে জমিদার, বড়াে পুঁজিপতি কৃষক ও কৃষি ব্যবসায়ীদের। চুক্তি চাষে জোর দেওয়ার ফলে কৃষি ব্যবসাগুলির চাহিদা ও প্রয়ােজনীয়তা অনুযায়ী কৃষককে চাষ করতে হবে এবং আজীবন দাসত্ব করতে হবে। এই আইনের উদ্দেশ্য যদি প্রকৃত পক্ষে যদি চাষির ক্ষমতায়তন, সুরক্ষা ও দামের নিশ্চয়তা প্রদান হয় তাহলে বিলে কেন মূল্য নিশ্চয়তার উল্লেখ নেই?
নয়া উদার অর্থনৈতিক নীতির পথে এদেশের কৃষিক্ষেত্রে মুনাফাখখার কর্পোরেটের আধিপত্বই আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে নরেন্দ্র মােদি সরকার। কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটের গ্রাসে সঁপে দিতে চাইছে বিজেপি। চুক্তি চাষের মধ্য দিয়ে কৃষক জমি হারাবেন। দৈত্যকার কর্পোরেটদের অধীনে এদেশে কৃষকরা নিতান্তই চুক্তি ভিত্তিক এজেন্টে পরিণত হবেন। চুক্তি চাষের মধ্য দিয়ে পাট্টাদার ও বর্গাদার তাদের অধিকার হারাবেন।
মজুতদার ও কালােবাজারীদের পৌষমাস- আমজনতার সর্বনাশ
তৃতীয় আইনটি ভয়ঙ্কর। ‘এসেনশিয়াল কমােডিটিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল’ বা ‘অত্যাবশ্যক পণ্য আইন’। খাদ্যশস্য, ডাল, তৈলবীজ, ভােজ্য তেল, পেঁয়াজ ও আলুকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে অপসারিত করা হয়েছে। দেশে অত্যাবশকীয় পণ্য আইন প্রনয়নে মূল উদ্দেশ্য ছিল মজুতদারি ও কালােবাজারী বন্ধ করে দেশের মানুষদের জন্য ভােগ্যপণ্য সরবরাহ অটুট রাখা। এই আইন কার্যত বাতিল হওয়ার ফলে কালােবাজারী ফিরে আসবে। দেশের পর্যাপ্ত মজুত খাদ্য গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে সব মানুষের কাছে পৌছােনাের ব্যবস্থা না করে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলিকে বাতিল করে দেওয়ার ফলে কৃষক ও উপভােক্তা কোনাে পক্ষেরই স্বার্থ রক্ষিত হবে না।
১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন লঘু করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে গণবণ্টন ব্যবস্থাটিকে তুলে দেওয়ার ইঙ্গিত মিলছে। ১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের দামের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল সরকারের। মজুতদার ও কালােবাজারীদের পকেট ভরাতে বাজপেয়ী সরকার (যে মন্ত্রীসভায় মমতা ব্যানার্জি মন্ত্রী ছিলেন) অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনকে লঘু করেছিলেন। ২০০২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার এক নির্দেশ জারি করে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে লাইসেন্সিং, বিশেষত খাদ্য সামগ্রীর চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও মজুতসীমা ইত্যাদি ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নেয়। ২০০৩ সালে ভারত সরকার বনস্পতি, ডাল, আটা, ময়দা, গুড় প্রভৃতির উপর থেকে নিয়ন্ত্রণবিধি তুলে নেয়। সাম্প্রতিক কৃষি আইন এ মােদি এই আইন সংশােধনের নামে কার্যত তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আরও জিনিসের দাম বাড়বে।
অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশােধনের ফলে নিত্য প্রয়ােজনীয় পণ্যের উৎপাদন, গুদামজাত করা বা বিক্রি করার উপর আর কোনাে নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। শুধু তাই নয়, রাজ্যের হাতে আপৎকালীন বণ্টন বা রাশ টানার অধিকারও আর থাকবে না। কেন্দ্রের হাতে চলে যাবে এ সম্পর্কিত যাবতীয় সিদ্ধান্ত, কতটা কেন্দ্রের গুদামে রাখা হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে দামের ওঠা পড়া দেখে। পচনশীল পণ্যের দাম যদি ৫০% আর অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে ১০০% বাড়ে তাহলে সরকার মাঠে নামবেন অন্যথায় নয়। মজুতদারির ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়ার ফলে মজুতদার যেমন খুশি মজুত করতে পারবে, বাজারে এই পণ্যগুলির কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধি পাবে। ৪৩-এর মন্বন্তরের অন্যতম একটি কারণ ছিল মজুতদারি। ফলাফল কী হয়েছিল, কত মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিলেন বা সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন সেগুলাে নতুন করে বলার প্রয়ােজন নেই।
কৃষিক্ষেত্রে আরও বেসরকারি বিনিয়ােগের সুযােগ করে দিতে ব্যাবসার জন্য মজুতের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দিয়ে ১৯৫৫ সালের নিত্য প্রয়ােজনীয় পণ্য আইন সংশােধনের ঘােষণা করতে গিয়ে সরকার বলেছে-এর ফলে কৃষকরা আগের চেয়ে বেশি দাম পাবেন। কিন্তু আদতে এর ফলে জাতীয় বিপর্যয় নেমে আসবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর জন্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় খাদ্যের আকাল দেখা দেবে এবং কৃষকরাও কোনাে সুবিধা পাবেন না। এর ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার সাথেও আপস করা হবে।
সরকার ব্যবসায়ীদের খাদ্য মজুতের সীমা অপসারণের জন্য প্রয়ােজনীয় পণ্য আইন (ইসিএ) সংশােধন করেছে। এর ফলে ন্যায্য মূল্যে প্রয়ােজনীয় পণ্যগুলির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারি দায়বদ্ধতা আর থাকবে না। প্রয়ােজনীয় পণ্য আইনের অপসারণ মােটেও কৃশকদের সাহায্য করবে না। ইসিএ বাতিলের ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের দর কষাকষির ক্ষমতাই দুর্বল করে দেবে এবং কৃষি। বিপণনে বৃহত্তর কৃষি ব্যবসাই কঠোরভাবে দমন করবে। ১০০% প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়ােগ-সহ কর্পোরেট সংস্থাও কৃষি বিপণন সংস্থাগুলাের কৃষিক্ষেত্রে দখলদারি নিশ্চিত করতেই ইসিএ আইনের বদল আনা হয়েছে।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশােধনের মধ্য দিয়ে সরকার তার দায় থেকে মুক্ত হচ্ছে। এর ফলে আগামী দিনে শ্রমিক-কর্মচারীদের ডিএ নির্ধারণের ভিত্তি আঘাত প্রাপ্ত হবে।
ই-মার্কেট নিয়ে আষাঢ়ে গল্প
খুবই উচ্চ কণ্ঠে বিজেপি নেতারা বলছেন—আন্তঃ রাজ্য কৃষি পণ্য চলাচলে রাষ্ট্র আরােপিত বাধা এখন অনেকটাই অপসারিত হয়েছে এদেশে। মান্ডিগুলির মধ্যে দামের তফাত দূর করার জন্য চালু করা হয়েছে ই-নাম। এতে নাকি চাষির খুব লাভ হবে। স্মরন করা প্রয়ােজন – ২০১৬-র পরে এই মান্ডিগুলি নিজেদের মধ্যে ই-নাম ব্যবহার করে পণ্য লেনদেনও করে। ই-নাম মানে ইনাম বা পুরস্কার নয়। গােটা দেশের কৃষি বাজারগুলাের মধ্যে লেনদেনের অনলাইন বাজারের ইংরেজি নাম (ন্যাশনাল এগ্রিকালচার মার্কেট বা ENAM)। বাংলায় রাষ্ট্রীয় কৃষি অনলাইন বাজার বলা যায়। ২০১৬-র এপ্রিল যখন এটা চালু হয়, তখন অবশ্য এই ব্যবস্থাকে কৃষক পুরস্কার বা উপহার হিসাবেই প্রচার করা হয়েছিল।
অর্থাৎ বর্তমানে কৃষির তিনটি আইন লাগু হওয়ায় বহু আগেই ই-জাতীয় বাজার (ENAM) কাজ শুরু করেছে। কিন্তু এই বাজারে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা সরাসরি যুক্ত হতে পারেননি। ২০১৮ সালের সরকারি তথ্যে প্রকাশিত, নথিভুক্ত ৮৯,৯৩৪ জন ব্যবসায়ী, ৪৬,৪১১ জন কমিশন এজেন্ট ও কতিপয় ধনী কৃষকই এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
বহুকথিত এই ই-বাজারে ন্যুনতম সহায়ক মূল্যও পাওয়া যায় না। মধ্যপ্রদেশের মন্দাসরে উত্তাল কৃষক বিক্ষোভের সময় মধ্যপ্রদেশের সরকার এই সত্যটি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নীচে ফসল বিক্রিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে ঘােষণা করে।
মধ্যস্বত্ত্বভােগীদের দাপট কমানোের মিথ্যা ভাষণ
বিজেপি নেতারা বলছেন, নতুন তিনটি কৃষি আইন এর ফলে ফসল জমি থেকে বাজারে আসার পথে মধ্যবর্তী দালালতন্ত্র তথা ফড়েরাজ নির্মূল হবে। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। কারণ যে সংস্থাগুলাে চাষির সঙ্গে চুক্তি করতে আসবে, তাদের নিযুক্ত প্রতিনিধিরা থাকবেন। তাদের বেতন বাবদ ব্যয় থাকবে, বিজ্ঞাপনের ব্যয় থাকবে। চাষিকেও পছন্দ মতাে ক্রেতার খোঁজ পেতে হবে।
তাকে কোনােভাবে যােগাযােগ বা বিজ্ঞাপনের দারস্থ হতে হবে। নিরক্ষর, প্রায় নিরক্ষর, স্বল্প শিক্ষিত কৃষকের পক্ষে তাে বটেই, উচ্চ শিক্ষিত কিন্তু আইনজ্ঞ নন এমন মানুষের পক্ষেও চুক্তির শর্তাবলী বুঝে ওঠা মুশকিল। ফলে সংস্থার পক্ষে যেমন, তেমনিই চাষির পক্ষেও আইনজ্ঞের সাহায্য প্রয়ােজন হবে। আমাদের দেশের কৃষি এখনও বহুলাংশে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। খরা, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে চাষি এবং ক্রেতা সংস্থা উভয়েরই বিমা প্রয়ােজন হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক আইন অনুসারে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রাজ্য সরকার সরাসরি সহায়তা নিয়ে এক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারবে না। এসব বাবদ ব্যয় হবে যেমন স্পনসর তথা বাণিজ্যিক ক্রেতার, তেমনি চাষির। এই ব্যয় অবশ্যই ফসলের দামে যােগ হবে এবং বাজারে ফসলের দাম বাড়বে। এরপর চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযােগ উঠলে এবং তার বিচার চাইতে মহকুমা শাসক ও জেলা শাসকের কাছে দরবার করতে যেতে হলে, বিচারের যা নিয়ম সেই সওয়াল-জবাবের জন্য আইনজ্ঞদের সাহায্য সেখানেও লাগবে। এরপর অর্থবলে বলীয়ান বাণিজ্যিক সংস্থা যে মহকুমা বা জেলা কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করবে না তারও নিশ্চয়তা নেই। তা হলে, মধ্যবর্তীরা কখনই হটে যাবে না।
বর্তমান আইনে মধ্যস্বত্ত্বভােগীরা আদৌ বিদায় নেবে না, তারা হয়ে উঠবে কর্পোরেটের স্থানীয় এজেন্ট। যে গ্রামীণ নয়া ভূস্বামী কৃষির গ্রামীণ বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করত, তারা অবশ্য ক্ষমতা হারাবে। কর্পোরেট ও তার এজেন্টরা দখল নেবে ভারতীয় কৃষির বাজারটির।
বলা হচ্ছে মান্ডির আধিপত্য খর্ব হলেই মধ্যস্বত্ত্বভােগীদের রমরমা অবসান ঘটবে। কিন্তু এটি ঠিক নয়। বিজেপি নেতৃত্ব নিশ্চয় জানেন পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে এপিএমসি অ্যাক্ট আগেই সংশােধিত হয়েছে এবং কৃষি পণ্য বিপণনে মান্ডির প্রাধান্য হ্রাস করা হয়েছে। কৃষকরা এখন আইনত খােলাবাজারে কৃষি পণ্য বিক্রি করার অধিকারী। বেসরকারি পাইকারি বাজারে বৃহৎ পুঁজির প্রবেশের বিধান সংশােধিত বিধিতে আছে। এতদসত্ত্বেও লাভজনক দামে ফসল বিক্রি প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের কাছে অধরাই থেকেছে।
এবং তৃণমূল
কৃষি আইন গুলি সম্পর্কে তৃণমূলের দ্বিচারিতা আবার প্রমাণিত হয়ে গেল। সাম্প্রতিক কৃষি আইন গুলি সম্পর্কে তৃণমূলের বিরােধিতা করার নৈতিক অধিকার নেই। নিয়ন্ত্রিত বাজার আইন আগেই শিথিল করা হয়েছে পশ্চিমবাংলায়। বেসরকারি বাজার খােলার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। ২০১৪-তে পাশ হওয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইন অনুসারে মাঠে ফসল থাকাকালীনই বেসরকারি সংস্থা কৃষকদের কাছ থেকে তা কিনে নিতে পারে। রীতিমতাে আইন পাশ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষিপণ্যের বাজারে বৃহৎ পুঁজি প্রবেশের পথ খুলে দিয়েছিল। ২০১৭-র একটি সংশােধনী এনে কৃষি পণ্যের ই-ট্রেডিং বা অনলাইন বাণিজ্য এবং বিপণনও বৈধ করা হয়। বাজার থেকে সেস বা কর বসিয়ে আয়ও করেছে নিজেদের মতাে করে। সেই সরকারের প্রধান এখন কেন্দ্রীয় আইনের বিরােধিতায় মুখর। রাজ্যে বৃহৎ পুঁজিকে কৃষিপণ্যের বাজারে ঢালাও অনুমােদন দিয়ে এখন কেন্দ্রীয় আইনের বিরােধিতা করা দ্বিচারিতার পরিচয়।
তৃণমূলের নীতির জন্যই ২০১১ সালের পর থেকে রাজ্যে কৃষকের জীবনে সঙ্কট নেমে এসেছে। তৃণমূলের আমলে প্রায় আড়াই শতাধিক কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। ঋণভারে জর্জরিত কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছেনা। কৃষক ধানের দাম পান না। সবজি চাষেও চাষি মার খাচ্ছেন। আলু চাষিরাও সঙ্কটে বিগত কয়েক বছর ধরে। বিপর্যস্ত বাংলার কৃষকের জীবনে চরম হতাশা। ফড়েদের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছেন চাষি। গত কয়েকবছর ধরে চাষিদের নাম করে ফড়েদের কাছ থেকে সরকার ধান কিনেছে। ফড়ে রাজ, ফসল কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি এসবই এই রাজ্য সরকারের অঙ্গের ভূষণ। বর্তমানে কৃষকের জীবন হয়েছে শাঁখের করাতের মতাে। কাটছে যেতে এবং আসতে। ফসল ফলানাের বিভিন্ন সামগ্রী কেনার সময়ে চড়া দামের কারণে একবার ঠকছেন ক্রেতা হিসাবে। আবার উৎপাদিত ফসলের দাম না পাওয়ায় দ্বিতীয়বার ঠকছেন বিক্রেতা হিসেবে। একের পর এক উৎপাদিত ফসলের দাম পেয়ে কৃষকের জীবনে নেমে এসেছে চরম সংকট। তৃণমুলের জামানায় ধান কাটার পর অভাবী কৃষক মহাজন আর রাইসমিল মালিকদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। আমফানের টাকা লুঠ করেছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত নিয়ে কার্যত লুঠ চলছে। রেগা-র কাজও নেই। রেগায় দেদার অনিয়ম চলছে রাজ্যে।
পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকার ছিল কৃষকদের বন্ধু
এরাজ্যে তৃণমূলের আমলে কৃষি ও কৃষকের জীবনে সর্বনাশ নেমে এসেছে। কিন্তু ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপের ফলে গ্রাম জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে এই রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার গড়ে ওঠার পরই ভূমি সংস্কার সংশােধনী আইন জারি করেই তার দ্রুত রূপায়ণে আন্তরিক উদ্যোগ নেয়। চাষির উৎপাদিত ফসলের দামে যাতে নিশ্চয়তা থাকে সেদিকও নজর ছিল বামফ্রন্ট সরকারের বামফ্রন্ট সরকারের ভূমি সংস্কারের উদ্যোগের তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য ছিল—
- (এক) বেনামি ও সীমাবহির্ভূত জমি উদ্ধার,
- (দুই) দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্ধার জমি বন্টন,
- (তিন) অপারেশন বর্গা কর্মসূচির মাধ্যমে বর্গাদারদের মেয়াদি স্বত্ব সুনিশ্চিত করা। ১৯৭৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ওয়েস্ট বেঙ্গল ল্যান্ড (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল বিধানসভায় গৃহীত হয়েছিল।
তৎকালীন বিদ্যমান ভূমির সীমা সংক্রান্ত আইন কড়াভাবে প্রয়ােগ, উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন মানুষের মধ্যে বণতটন, বর্গাদারকে নিরাপত্তা দেওয়া ও ভাগচাষিদের ভাগ বাড়ানাের লক্ষ্যে নতুন প্রণীত আইনের প্রয়ােগ ও স্থানীয় পঞ্চায়েতকে পুনরুজ্জীবিত করা ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমেই বামফ্রন্ট সরকার যাত্রা শুরু করে। গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত পঞ্চায়েতগুলিকে গ্রামের দরিদ্র জনগণের জন্য নেওয়া উন্নয়ন কর্মসূচিগুলির রূপায়ণে প্রধান ভূমিকা দেওয়া হয়। নিচু স্তর থেকে যােজনা ধাঁচে, ভূমিসংস্কার ও সেচ-সহ বিভিন্ন বিষয়ের দায়িত্ব ও রাজ্য বাজেট থেকে নির্ধারিত অর্থও তুলে দেওয়া হয় পঞ্চায়েতের হাতে। বর্গা আইন সংস্কারের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য আসে। গরিব ও প্রান্তিক কৃষক উপকৃত হন। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিনীতির ফলেই দারিদ্রতা কমতে থাকে।
বিপুল পরিমাণ জমি খাস জমি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গরিব, ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছিল। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে আমাদের রাজ্য দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছে ছিল। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে খাদ্যের উৎপাদন দ্বিগুন হয়। ১৯৭৭-র পূর্বে আমাদের রাজ্য খাদ্যে ঘাটতি ছিল। বাম আমলে গ্রামের মানুষের ক্রয় ও জীবনযাত্রার মানের বৃদ্ধি ঘটেছিল। খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধি পায়। দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা কমে। গ্রামের পদানত মানুষদের অধিকার ও আত্মমর্যাদাবােধ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেই বিরাট আকারে অপারেশন বর্গার কর্মসূচি নেওয়া হয়। লক্ষ্য ছিল বর্গাদারকে উচ্ছেদ করা যাবে না। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে জমির বণ্টন ও বর্গাদারের অধিকারের সংস্কার ও মজুরির অধিক হার এবং ঋণের সুযােগের কারণে পশ্চিমবাংলার দরিদ্রদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৮১ ও ১৯৮৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ ভূমিসংস্কার নীতির ফলে পশ্চিমবঙ্গের জমির মালিকানার চরিত্রে গুরত্বপূর্ণ রদবদল ঘটে।
চাষের উপকরণ যেমন সেচ, ঋণ, উন্নত বীজ, সার, কৃষি সহায়তা কৃষকের কাছে সুলভে বামফ্রন্ট সরকারগুলি পৌঁছে দিয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি পায়। বামফ্রন্ট সরকারের গরিব বান্ধব নীতির ফলেই কৃষিক্ষেত্রে সমবায় ঋণের দুই-তৃতীয়াংশই পেয়েছেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা। ১৯৭৭ সালের পরবর্তী সময়ে ছােটো জোতের উৎকৃষ্ঠতর উৎপাদন সাফল্যের ভিত্তিতে কৃষিতে দীর্ঘস্থায়ী বিকাশের হার উঁচু মাত্রায় থেকেছে। গ্রামীণ কৃষি মজুরের বৃদ্ধির হার উল্লেখযােগ্যভাবে হ্রাস পায়। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে মাথাপিছু দানাশস্য গ্রহণে পশ্চিমবাংলা সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণে পশ্চিমবঙ্গ কেরালার পরেই স্থান দখল করেছিল।
১৯৭৭ সাল থেকেই ভূমি সংস্কারের তিনটি দিকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল— জমিবণ্টন ও বর্গা আইন সংস্কার, কৃষির জন্য প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় নয়া কাঠামাে। বামফ্রন্ট সরকার তিনটি মূল বিষয়ের উপর জোর দেন— উৎপাদিকা শক্তির উন্নতি, উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন এবং ক্ষমতার সম্পর্কের পরিবর্তন।
সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে দরিদ্র কৃষকদের জমি প্রদানের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রকল্প নেওয়া হয়। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে সম্পন্ন ও ইচ্ছুক কৃষকদের কাছ থেকে রাজ্য সরকার বাজার দরের থেকে ২৫% বেশি দাম দিয়ে ৭৩৯৪ একর জমি ক্রয় করে এবং সেই জমি বিনামূল্যে দরিদ্র কৃষকদের চাষ ও বসবাসের জন্য বণ্টন করে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে ভূমিসংস্কারের প্রত্যেকটি পদক্ষেপকে একত্রিত করে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে উপকৃত হয়েছেন ৪৯ লক্ষ দরিদ্র কৃষক পরিবার। যা কৃষি নির্ভর পরিবারের প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কার কর্মসূচি গ্রামের গরিব মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে বাড়াতে সাহায্য করেছে।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে রাজ্যে সমবায় আন্দোলন একটি নির্দিষ্ট দিশা পেয়েছিল। ফলে জেলায় জেলায় অসংখ্য সমবায় সমিতি গড়ে উঠেছিল। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সাত হাজার সমবায় কৃষি উন্নয়ন গঠিত হয়েছিল। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে এ রাজ্যে কৃষি বিপণন পরিকাঠামাে গড়ে তােলার ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য সাফল্য এসেছিল। উল্লেখ্য, ভারতের মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে সবজি-ফল সংরক্ষণের জন্য ৩৭টি বহুমুখী হিমঘর গড়ে তােলার কাজ করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। পশ্চিমবঙ্গ একমাত্র রাজ্য যেখানে রাজ্যের উদ্যোগেই কৃষি বিপণনের মতাে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের জন্য নেতাজি সুভাষ কৃষি বিপণন কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল বামফ্রন্ট সরকার। কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন ও উৎপাদনের ধারাকে অব্যাহত রেখে রাজ্যে উন্নত কৃষি বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়েছিল। অর্থাৎ চাষি ফসল বিক্ৰেয়ে যাতে ঠকে না যান এবং ফড়েদের হাতে যাতে শােষিত না হন তা সুনিশ্চিত করেছিলেন বামফ্রন্ট সরকার।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশােধন করার ফলে জিনিসের দাম বাড়বে। ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি—বাজপেয়ী সরকারের সময় এই আইন লঘু করা হয়েছিল। পশ্চিমবাংলায় সে সময়ে বামফ্রন্ট সরকারের নীতির ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রােধ করা গিয়েছিল। রাজ্যের মানুষকে মুল্যবৃদ্ধির বােঝা থেকে কিছুটা রেহাই দেওয়ার জন্য ন্যায্য দামে কৃষকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করে তা রেশন দোকানগুলির মাধ্যমে বাজারের দামের থেকে অনেকটাই কম দামে বিক্রির ব্যবস্থা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমবায় প্রতিষ্ঠান, স্বনির্ভর গােষ্ঠীগুলির ভূমিকা ছিল। আবার রাজ্য সরকারও সরাসরি চাল সংগ্রহ করত। তৃণমূল সরকারে আসার পর গােটা ব্যবস্থাকেই অকেজো করে দিয়েছে।
২০০৯ সালের ১ মার্চ থেকে ২ টাকা কেজি দরে চাল বিপিএল ভূক্তদের জন্য রেশন দোকানের মাধ্যমে সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। এক্ষেত্রে রাজ্য সরকার ভরতুকি দিয়েছিল ৪৫০ কোটি টাকা। বামফ্রন্ট সরকার ২০০৮ সালে লিটার প্রতি পেট্রোলে ২ টাকা ১২ পয়সা এবং ডিজেলে লিটার প্রতি ১ টাকা ৩৮ পয়সা মকুব করেছিল। কেরােসিনে ভরতুকি দিত। পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাসভাড়া যাতে বৃদ্ধি না হয় তার জন্য বামফ্রন্ট সরকার ভরতুকি দিত। এমনকী আলুর মূল্যবৃদ্ধি রােধ করতে বামফ্রন্ট সরকার ভরতুকিতে কম দামে আলু বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল।
বিকল্প পথে কেরালা
কেরালার কৃষকরা অনেক বেশি সরকারি সুবিধা পায়, কৃষকদের আয়ও অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বেশি। এ রাজ্যে জমি কম, চাষ উন্নত। ২০০৮ সালে কেরালা সরকার একটা আইন তৈরি করেছিল খাদ্যশস্য উৎপাদনের নিরাপত্তার জন্য, যা কোনাে রাজ্যে নেই। এই আইনে ধান চাষের জমি অন্য কোনােভাবে ব্যবহার করা যাবে না, এমনকী নির্মাণ কাজেও ব্যবহার করা যাবে না। কেরালার রেশন ব্যবস্থাও সারা দেশে মডেল। কোনাে কালেই কেরালায় কৃষি ফসলের বাজার কমিটির আইনও নেই, কারণ তার প্রয়ােজনীয়তা হয়নি। রাজ্যের ছ-টি বৃহৎ পাইকারি বাজার সরকারের কৃষি দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে চলে। পঞ্চায়েত, পৌরসভার বাজারগুলির ওপর সরকারি বিধি রয়েছে। কৃষি ফসলের সঙ্গে মুল্যযুক্ত প্রক্রিয়াও কেরালায় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আম বা আনারশ অন্য চাষিরাও দামে উপকৃত। কৃষি যেহেতু রাজ্য সরকারের বিষয়, কেন্দ্রীয় কৃষি বিলে এই অধিকারের ওপর কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কেরলের রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে।
দড়ি ধরে মারাে টান…
নরেন্দ্র মােদি ক্ষমতায় আসার পর ধারাবাহিক আক্রমন চলছে কৃষি ও কৃষকের উপর। আবার এই আক্রমণের বিরূদ্ধে দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন লড়াই চলছে। কৃষকদের মৌল দাবিগুলি ১৭ নভেম্বর ২০১৭-তে দিল্লির বিশাল কিষান সংসদে এবং নাসিক থেকে মুম্বাই দীর্ঘ ১৮০ কিমি লং মার্চে বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে ফসলের দাম, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ, জমির অধিকার, পেনশন, সুনিশ্চিত ফসল বিমা ও ঋণ মকুবের মতাে দাবিগুলি পেশ করা হয়েছিল। আন্দোলন চলছে।
বলা হচ্ছে এই তিনটি আইনের মধ্যে দিয়ে নাকি কৃষি সংস্কার করা হল। কিন্তু বড়াে প্রশ্ন হল সংস্কারগুলির সময় নির্বাচন। এসময়ে দেশের মানুষের জীবন করােনা সংক্রমণে বিপন্ন। লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন। কৃষকেরা সার, বীজ, জল ইত্যাদি কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি ও সহায়ক মূল্য না পেয়ে ঋণভারে আত্মঘাতী হচ্ছেন। চাষের জন্য বীজ, সার সংগ্রহ করতে তারা নাজেহাল হচ্ছেন। এই সব আশু সমস্যার মােকাবিলা করা মােদিজির অগ্রাধিকার নয়।
আসলে মােদিজি কর্পোরেটের ওপর কৃষকের ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়ে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি কৃষককে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিতে চান। ওঁর দায়বদ্ধতা কর্পোরেটদের কাছে। স্মরণ করা যেতে পারে মােদিজি ক্ষমতায় এসেই ২০১৩ সালের সংশােধিত ভূমি অধিগ্রহণ আইনটি ফের একদফা সংশােধন করে জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার জোর করে কর্পোরেট ও বড়াে শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। সংসদের অনুমােদন পেতে ব্যর্থ হয়ে তিন তিনবার অর্ডিন্যান্স জারি করেছিলেন।
কর্পোরেট ও বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা করা ছাড়া কৃষকদের স্বার্থরক্ষার কোনাে উদ্দেশ্যই মােদির নেই। তাদেরই মুনাফা নিশ্চিত করতে কৃষকের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে কৃষির তিনটি আইন লাগু করা হল। এই তিনটি আইনের মধ্যে দিয়ে কেবলমাত্র কৃষকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন গােটা দেশের মানুষ। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কৃষির তিনটি আইন প্রত্যাহার করাতেই হবে। সেই লক্ষ্যেই আগামী ২৬ নভেম্বর সর্বভারতীয় ধর্মঘট আহুত হয়েছে।
প্রতিরােধের দিকেই দেশ এগুচ্ছে। এ লড়াই শুধু কৃষকরাই লড়ছেন না। কৃষকের পাশে শ্রমিকরা দৃঢ় সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। গড়ে উঠছে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য। হিন্দুত্ববাদের ধ্বজা সামনে এনে অথবা উগ্র জাতীয়তাবাদী শ্লোগান দিয়ে রাজনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে পারবেন না নরেন্দ্র দামােদর মােদি। দেশ বিরােধী তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারে বাধ্য হবে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার।
আমাদের প্রধান দাবি
- ১. কৃষি ও কৃষকবিরােধী আইনগুলি অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
- ২. মনরেগা প্রকল্পে ২০০ দিন কাজ ও দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে।
- ৩. রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে বিধানসভার অধিবেশন ডেকে এই কৃষি ও কৃষক বিরােধী আইন বাতিলের প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে।
- ৪. আয়করদাতা নয় এরূপ প্রতিটি পরিবারকে মাথাপিছু মাসে ১০ কেজি খাদ্য শস্য এবং পরিবার প্রতি ৭,৫০০ টাকা নগদ দিতে হবে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।