লিখেছেনঃ ডঃ সুরেন্দ্র কুমার শর্মা
ভারতে কয়েকদিন পর পরই গােহত্যা নিয়ে সংহিসতা (দাঙ্গা) দেখা দেয়। গােহত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকিও দেয়া হয় এবং এর বিরুদ্ধে নানা বিলও পাশ করানাে হয় কিন্তু ভারতে সবসময়ই যে গরু পূজ্য এবং অবধ্য ছিল, এমন নয়। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে এমন অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়, যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে গরুকে শুধু যে যজ্ঞে বলি হিসাবে হত্যা করা হত তাই নয় বরং বিশেষ অতিথি, বেদজ্ঞ প্রভৃতিকে আপ্যায়ণ করারও জন্যও গােমাংসের ব্যবস্থা করা হত।
হয়তাে এজন্যই আধুনিকালের প্রসিদ্ধ হিন্দু ধর্মপ্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন,
“আপনারা শুনে অবাক হবেন, প্রাচীন রীতি অনুযায়ী গরু না খেলে ভালাে হিন্দু হওয়া যেত না। হিন্দুদের কিছু অনুষ্ঠানে অবশ্যই বৃষ বলি দিয়ে তার মাংস খেতে হত।” [দেখুন, দা কমপ্লিট ওয়ার্কস অফ স্বামী বিবেকানন্দ, ভাগ ৩, পৃষ্ঠা ৫৩৬।]
এছাড়াও বিবেকানন্দ বলেছেন, “ভারতে এমন এক সময় ছিল, যখন গােমাংস না খেয়ে কোনাে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ থাকতে পারতেন না।” [উক্ত পুস্তকের ১৭৪ পৃষ্ঠা]
প্রাচীন সাহিত্যে গােমেধ নামে এক যজ্ঞের বিবরণ পাওয়া যায়, যেখানে গরু বলি দেওয়া হত। প্রসিদ্ধ বিশ্বকোষ শব্দকল্পদ্রুমে এই যজ্ঞের বিবরণে বলা হয়েছেঃ
গােমেধঃ যজ্ঞবিশেষঃ, অত্র স্ত্রীগােপঃ মন্ত্রে স্ত্রীলিংগপাঠাত্ তস্য লক্ষণ-সপ্তশফত্ব-নবশত্বফভগ্নশৃংগত্ব-কাণত্ব-ছিন্নকর্ণত্বা-দিদোষরাহিত্যম্। তস্য প্রয়ােগঃ সর্বোঅপি ছাগপশুব। যজমানস্য স্বর্গঃ ফলম, গােশ্চ গােলােকপ্রাপ্তিঃ।
অর্থাৎ গােমেধ এক বিশেষ ধরণের যজ্ঞ। এখানে ‘গাে’ শব্দ দ্বারা স্ত্রী গােপশু অর্থাৎ গাভীকে বােঝানাে হয়েছে, ষাঁড়, বৃষ বা বাছুর বােঝানাে হয়নি, কেননা মন্ত্রে স্ত্রীলিঙ্গের নির্দেশ আছে। সেই গরুর যে লক্ষণ থাকা উচিতঃ সে সাত বা নয় খুর যুক্ত হবে না, তার শিং ভাঙ্গা হবে না, সে অন্ধ হবে না, তার কান ছিন্ন হবে না। ছাগলের মত তার সর্বোচ্চ প্রয়ােগ হওয়া উচিত অর্থাৎ গরুর সাথেও তাই করা উচিত যা ছাগলের সাথে করা হয়ে থাকে। গােমেধের ফলে যজমান স্বর্গ এবং গরু গােলােক প্রাপ্ত হয়।
যজ্ঞে পশুদের সাথে যেমন আচরণ করা হত
যজ্ঞে ছাগল, ঘােড়া এবং গরু প্রভৃতি পশুদের সাথে যেমন আচরণ করার নির্দেশ ঐতরেয় ব্রাহ্মণে দেওয়া হয়েছেঃ
উদীচীনাং অস্য পদো নিধত্তাত সূর্যং চক্ষুর্গময়তাদ বাতং প্রাণমন্ববসৃজদন্তরিক্ষমসুং দিশঃ শ্ৰোত্রং পৃথিবীং শরীরমিত্যেষ্বেবৈনং তল্লোকেম্বাদধাতি ইতি। একধাঅস্য বৃচমাচ্ছতাত পুরা নাভ্যা অপি শসাে বপামুৎখিদতাদন্তরেবােষ্মণং বারয়ধ্বাদিতি পশুম্বেব তত প্রাণান্দধাতি ইতি। শ্যেনমস্য বক্ষঃ কৃণুতা প্রশসা বাহু শলা দোষণী কশ্যপেবাংসাহচ্ছিদ্রে শ্রোণী কবষােরু দ্ৰেকপর্ণাঅষ্ঠীবন্তা ষড়বিংশতিরস্য বঙ্ক্রয়স্তা অনুষ্ঠ্যোচ্চ্যাবয়তাদ গাত্রং গাত্রমস্যায়ূনং কৃণুতাদ ইতি অংগান্যেবাস্য তদ্ গাত্রাণি প্রণাতি ইতি। … উবধ্যগােহং পার্থিবং খনতাদিতি… অম্ল রক্ষঃ সংসৃজতাদিতি। (৬/৬-৭)
অর্থাৎ, ইহার পা উত্তরদিক আশ্রয় করুক, চক্ষু সূর্যকে প্রাপ্ত হউক, প্রাণ বায়ুকে, জীবন অন্তরিক্ষকে, শ্ৰোত্র দিকসমূহকে ও শরীর পৃথিবীকে আশ্রয় করুক- এই বাক্যে ইহাকে ঐ সকল লােকে স্থাপন করা হয়। ইহার ত্বক একভাবে (অবিছিন্নভাবে) ছিন্ন কর। ছেদনের পূর্বে নাভি হইতে বপা (মেদ) পৃথক কর, প্রশ্বাসকে ভিতরেই নিবারণ কর (শ্বাসরােধ করিয়া বধ কর) – এই বাক্যে পশুসমূহেই প্রাণসকলের স্থাপনা হয়। ইহার বক্ষ শ্যেনের (পক্ষীর) আকৃতিযুক্ত কর (সেইরূপে ছিন্ন কর), বাহুদ্বয় উত্তমরূপে ছিন্ন কর, শ্রোণিদ্বয় অচ্ছিদ্র কর, উরুদ্বয় কবষের (ঢালের) মত ও উরুমূল করবীর পাত্রের মত কর; ইহার পার্শ্বাস্থি ছাব্বিশখানি , সেগুলি পরপর পৃথক কর; সমস্ত গাত্র অবিকল (ছিন্ন) কর – এই বাক্যে ইহার সমস্ত অঙ্গ ও গাত্রকে প্রীত করা হয়। ইহার পুরীষ গােপনের জন্য স্থান (গর্ত) পৃথিবীতে (ভূমিতে) খনন কর।… রুধিরের সহিত রাক্ষসগণের যােজনা কর। [অনুবাদকঃ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী]
পশুদের অঙ্গের বিভাগ
এরপর সেই ব্রাহ্মণগ্রন্থ বলির পশুর অঙ্গের বিভাগের বিধান সম্বন্ধে বলছেঃ
অর্থাৎ পশােবিভক্তিস্তস্য বিভাগং বক্ষ্যামঃ, ইতি। হনু সজিহ্বে প্ৰস্তোতুঃ শ্যেনং বক্ষ উদ্গাতুঃ কণ্ঠঃ কাকুদ্রঃ প্রতিহর্তুর্দক্ষিণা শ্রোণির্হোতুঃ সব্যা ব্ৰহ্মণাে দক্ষিণং সকথি মৈত্রাবরুণস্য সব্যং ব্রাহ্মণাচ্ছংসিনাে দক্ষিণং পার্শ্বং সাংসমধ্বরযােঃ সব্যমুপগাতৃণাং সব্যোংঅসঃ প্রতিস্থাতুর্দক্ষিণং দোর্নেষ্টুঃ সব্যং পােতুর্দক্ষিণ ঊরুরচ্ছাবাকস্য সব্য আগ্নীপ্রস্য দক্ষিণাে বাহুরাত্রেয়স্য সব্যঃ সদস্যস্য সদং চানুকং চ গৃহপতেদক্ষিণৌ পাদৌ গৃহপতেব্রতপ্ৰদস্য সব্যৌ পাদৌ গৃহপতের্ভার্যায়ৈ ব্রতপ্রদস্যৌষ্ঠ এনয়ােঃ সাধারণাে ভবতি তং গৃহপতিরেব প্রশিংষ্যাজ্জাঘনীং পত্নীভ্যো হরন্তি তাং ব্রাহ্মণায় দদয়ুঃ স্কন্ধ্যাশ্চ মণিকাস্তিস্রশ্চ কীকসা গ্রাবস্তুতস্তিস্রশ্চৈব কীকসা অর্ধং চ বৈকর্তস্যোন্নেতুর্ধং চৈব বৈকর্তস্য ক্লোমা চ শামিতুস্তদ্ৰাহ্মণায় দদ্যাদ যদ্যব্রাহ্মণঃ স্যাচ্ছিরঃ সুব্রহ্মণ্যায়ৈ যঃ শ্বঃসুত্যাং প্রাহ তস্যাজিনমিড়া সর্বেষাং হােতুর্বা ইতি। তা বা এতাঃ ষটিত্রংশত্মেকপদা যজ্ঞং বহন্তি ষটিত্রংশদক্ষরা বৈ বৃহতী। বাহর্তাঃ স্বর্গা লােকাঃ প্রাণাংশ্চৈব তৎস্বর্গাংশ্চ লােকানাপ্লবন্তি প্রাণেষু চৈব তৎস্বর্গেষু চ লােকেষু প্রতিতিষ্ঠন্তো যন্তি ইতি। স এভ স্বর্গঃ পশুর এনমেবং বিভজন্তি, ইতি। অথ যেঅতােঅন্যথা তদ যথা সেলগা বা পাপকৃতাে বা পশুং বিমথনীরংস্তাদৃক্ত ইতি। তাং বা এতাং পশােবিভক্তিং শ্রৌত ঋষিদেবভাগাে বিদাংচকার তামু হা প্রােচ্যৈবাস্মাল্লোকাদুচ্চক্রাম ইতি। তামুহ গিরিজায় বাভ্রব্যায়ামনুষ্যঃ প্রােবাচ ততাে হৈনামেতদাঙ মনুষ্যা অধীয়তেহধীয়তে… ইতি। (অধ্যায় ৩১)
অর্থাৎ, অনন্তর পশুবিভাগ, পশুর বিভাগের বিষয় বলিব। জিহ্বাসহিত হনুদ্বয় প্রস্তোতার ভাগ; শ্যেনাকৃতি বক্ষ উগাতার; কণ্ঠ ও কাকুদ্র প্রতিহর্দার; দক্ষিণ শ্রোণি হােতার; বাম শ্রোণি ব্রহ্মার; দক্ষিণ সস্থি মৈত্রাবরুণের; বাম সস্থি ব্ৰহ্মণাচ্ছংসীর; অংশসহিত দক্ষিণ পার্শ্ব অধ্বর্য্যর; বাম পার্শ্ব উগাতাদিগের; বাম অংস প্রতিস্থাতার; দক্ষিণ দোঃ নেষ্টার; বাম দোঃ পােতার; দক্ষিণ উরু অচ্ছাবাকের; বাম উরু অগ্নাথ্রেয়ের; দক্ষিণ বাহু আত্রেয়ের; বামবাহু সদস্যের; সদ ও অনূক গৃহপতির; দক্ষিণ পদদ্বয় গৃহপতির ব্রতদাতার। ওষ্ঠ উভয় ব্রতদাতার সাধারণ ভাগ; গৃহপতি উহা [দুইজনকে] বিভাগ করিয়া দিবেন। জঘনী পত্নীদিগকে দেওয়া হয়; পত্নীরা তাহা কোনাে ব্রাহ্মণকে দান করিবেন। স্কন্ধস্থিত মণিকা ও তিনখানি কীকস গ্রাবস্তুতের; [অন্য পার্শ্বের আর] তিন খানি কীকস ও বৈকৰ্ত্তের; অর্ধেক উন্নেতার; বৈকৰ্ত্তের অপরাধ ও ক্লোম শমিতার। শমিতা অব্রাহ্মণ হইলে ঐ ভাগ কোনাে ব্রাহ্মণকে দান করিবে। মস্তক সুব্রহ্মণ্যাকে দিবে। “শ্ব সুত্যাং” এই নিগদ যিনি পাঠ করেন, সেই আগ্নীর্ধের ভাগ অজিন। আর সবনীয় পশুর যে ইড়াভাগ হইবে, তাহা সর্ব সাধারণের বা একাকী হােতার।
এক এক পদে অভিহিত ঐ অবয়বগুলি এইরূপে ছত্রিশটি ভাগে পরিণত হইয়া যজ্ঞ নির্বাহ করে। বৃহতীর ছত্রিশ অক্ষর; স্বর্গলােক বৃহতীর সম্বন্ধযুক্ত, এতদ্বারা প্রাণ ও স্বর্গলােক লাভ করা যায় এবং এতদ্বারা প্রাণে ও স্বর্গালােকে প্রতিষ্ঠিত হইয়া যজ্ঞানুষ্ঠান হয়। যাহারা পশুকে এইরূপে বিভাগ করেন তাহাদের পক্ষে সেই পশু স্বর্গের অনুকূল হয়। যাহারা অন্য কোনােরূপে পশুবিভাগ করেন, তাহারা অন্ন কামুক (উদরপরায়ণ) পাপকারীর মত কেবল পশুহত্যা করে।
পশুবিভাগের এই বিধি শুতের পুত্র দেবভাগ নামক ঋষি জানিতেন; তিনি কাহারাে নিকট ইহা প্রকাশ না করিয়াই ইহলােক হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন। কোনাে অমনুষ্য উহা বর পুত্র গিরিজকে বলিয়াছিলেন, তাহার পরবর্তী মনুষ্যেরা তদবধি উহা জানিয়া আসিতেছে। [অনুবাদকঃ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী।]
গােপথ ব্রাহ্মণ ৩/১৮ তে প্রায় একই কথা বলা হয়েছে।
ঋগবেদ ১০/৮৬/১৪ এ ইন্দ্রদেব গােবধের কথা বলেছেনঃ
উহ্মো হি মে পঞ্চদশ সাকং পচন্তি বিংশতিম।
উতাহমদ্মি পীব ইদুভা কুক্ষী পৃণন্তি মে বিশ্বম্মাদিন্দ্র উত্তরঃ।।
অর্থাৎ, আমার জন্য পঞ্চদশ এমন কি বিংশ বৃষ পাক করিয়া দেয়। আমি খাইয়া শরীরের স্থূলতা সম্পাদন করি, আমার উদরের দু’পার্শ্ব পূর্ণ হয়, ইন্দ্র সকলের শ্রেষ্ঠ।
ঋগবেদ ১০ম মণ্ডলের ৮৯ সুক্তের ১৪ ঋক থেকে স্পষ্টভাবেই বােঝা যায়, গােহত্যা এতই সাধারণ একটি ব্যাপার ছিল যে কথাবার্তার সময় উপমা হিসেবে এটি ব্যবহৃত হত। দেখুনঃ
মিত্রবাে যচ্ছসনে ন গাবঃ পৃথিব্যা আপৃগমুয়া শয়ন্তে।।
অর্থাৎ, হে ইন্দ্র! যেমনি গােহত্যাস্থানে গাভীরা হত হয়, তেমনি তােমার ওই অস্ত্র দ্বারা নিহত হয়ে বন্ধুদ্বেষী রাক্ষসগণ পৃথিবীতে পতিত হয়ে শয়ণ করে।
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী তার সত্যার্থ প্রকাশে এই গােমেধ সম্বন্ধে লিখেছিলেন,
“যেখানে গােমেধ যজ্ঞের কথা লেখা হয়েছে, সেখানে পুরুষ পশুদের হত্যা করার কথা লেখা হয়েছে। কেননা যেমন পুষ্ট বৃষ প্রভৃতি পুরুষদের মধ্যে থাকে, তেমন স্ত্রীদের মধ্যে থাকে না। বন্ধ্যা গাভীদেরও গােমেধ যজ্ঞে হত্যা করার কথা বলা হয়েছে।” [দেখুন, সত্যার্থ প্রকাশ, ১৮৭৫ সাল, পৃষ্ঠা ৩০৩, দয়ানন্দ ভাব চিত্রাবলী, পৃষ্ঠা ২৮ এ উদ্ধৃত]
ভারতীয় বিদ্যা ভবন, মুম্বাই এর তত্ত্বাবধানে ছাপা ‘দ্যা বৈদিক এজ’ এর ৩৮৭ পৃষ্ঠায় ডা. বি. এম. আপ্তে লিখেছেন, “ঋগবেদের একটি সুক্ত (১০/৮৫) যাকে বিবাহ সুক্ত বলা হয়, তার থেকে বিবাহ সংস্কারের প্রাচীনতম রূপ সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায়। বর এবং বরযাত্রী কনের বাড়িতে যেত (১০/১৭/১)। এখানে কনে বরযাত্রীদের সাথে খাবার খেত। সেই অনুষ্ঠানে অতিথিদের গরুর মাংস পরিবেশন করা হত।“ (১০/৮৫/১৩)
‘বৈদিক ইন্ডেক্স’ (খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৪৫) এ বলা হয়েছে, “বিবাহ সংস্কারকালে ভােজনের সময় গােহত্যা করা হত।”
এই কথাই বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা প্রকাশিত ‘বৈদিক কোশ’ (পৃষ্ঠা ৩৭৪) এ বলা হয়েছে এবং তথ্যসূত্র হিসেবে ঋগবেদের দশম মণ্ডলের ৮৫ তম সুক্তের ১৩ নং ঋকের উল্লেখ করা হয়েছে।
ঋগ্বেদ ১০/১৬/৭ এ পাওয়া যায় শবদাহ কালে গােহত্যা করা হতঃ
অগ্নেবর্ম পরি গােভিয়স্ব সং প্রােধ পীবসা মেদসা চ ।
অর্থাৎ, হে মৃত! তুমি গােচর্মের সাথে অগ্নি শিখা স্বরূপ কবচ ধারণ কর, তােমার প্রচুর মেদের দ্বারা তুমি আচ্ছাদিত হও।
‘বৈদিক কোশ’ এর ৩৭৫ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, “অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় গােবধ আবশ্যক ছিল বলে জানা যায়। গরুর মাংস দিয়ে শবকে ঢাকার উল্লেখ পাওয়া যায়।” (ঋগ্বেদ ১০/১৬/৭)
গােহত্যা শুভ
শ্রী মুকন্দীলাল তার পুস্তক ‘cow slaughter- honors of a dillema’ এর ১৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
“প্রাচীন ভারতে কোনাে অনুষ্ঠানে গােহত্যা করা শুভ বলে মনে করা হত। বর-কনে বেদির সামনে বৃষের কাঁচা চামড়ার উপর বসতাে। ওই চামড়া বিবাহ অনুষ্ঠান উপলক্ষে হত্যা করা গরুরই হয়ে থাকবে, যে গরুটি ঐ অনুষ্ঠানে খাওয়ার জন্য হত্যা করা হয়েছিল। একইভাবে রাজ্যাভিষেকের সময় ভাবী রাজাকে লাল বৃষের চামড়ায় বসানাে হত।”
অন্ন প্রাপ্তির কামনায় যে যজ্ঞ করা হত, সেখানে ইন্দ্রের জন্য বৃষ রান্না করা হত, ঋগ্বেদ ১০/২৮/৩ থেকে এমনটাই জানা যায়ঃ
অদ্রিণা তে মন্দিন ইন্দ্র তৃযান্যাৎসুম্বন্তি সােমানিপবসি ত্বমেষাম।
পচন্তি তে বৃষভাং অৎসি তেষাং পৃক্ষেণ যন্মঘব হূযমানঃ।।
অর্থাৎ, “হে ইন্দ্র! যখন অন্ন কামনাতে তােমার উদ্দেশ্যে হােম করা হয়, তখন তারা শীঘ্র শীঘ্র প্রস্তরফলক সহযােগে মাদকতাশক্তিযুক্ত সােমরস প্রস্তুত করে, তুমি তা পান কর। তারা বৃষভ সমূহ পাক করে, তুমি তাহা ভােজন কর।”
ঋগ্বেদ ৭/১৯/৮ এ দিবােদাস নামক এক বৈদিক রাজার উল্লেখ মেলে। তার নামের সাথে ‘অতিথিগ্ধ’ বিশেষণ রয়েছে। ‘অতিথিগ্ন’ এর অর্থ অনেকে ‘অতিথির জন্য গােহত্যাকারী’ করেন। (বৈদিক কোশ, পৃষ্ঠা ৩৭৪)।
যজুর্বেদে গরুর চর্বি দিয়ে পিতৃদের তৃপ্ত করার কথা পাওয়া যায়ঃ
বহ বপাং জাতবেদঃ পিতৃভ্যো যত্রৈনান্বেস্থ নিহিতানপরাকে,
মেদসঃ কুল্যা উপ তানস্রবন্তু সত্যা এষামাশিষঃ সন্নমন্তাং স্বাহা।
-যজুর্বেদ ৩৫/২০
মহীধর ভাষ্যঃ
হে জাতবেদঃ, জাতং বেদো ধনং যস্মাত স জাতবেদাঃ তৎসংবােধনে হে জাতবেদঃ, পিতৃভ্যোর্থায় ত্বং বপাং ধেনুসংবন্ধি চর্মবিশেষং ত্বং বহ প্রাপয়। পরাকে পরাক্রান্তে দুরেঅপি যত্র যস্মিন্দেশে নিহিতানস্থাপিতানেনাপ্নিতৃন্ ত্বং বেত্থ জানাসি তত্র বহেত্যৰ্থঃ। তস্যাঃ বপায়াঃ নিঃসৃত্য মেদসঃ ধাতুবিশেষস্য কুল্যাঃ নদ্যঃ তান্ পিতৃন্ প্রতি উপস্রবংতু প্ৰসরংতু, কিংচ এষাং দাতৃণামাশিষঃ মনােরথাঃ সত্যাঃ অবিতথাঃ সন্নমংতাং প্রীভবন্তু স্বাহা, সুহুতমস্তু।
অর্থাৎ, হে জাতবেদ, পিতৃদের জন্য তুমি গােচর্ম বিশেষ নিয়ে যাও। তুমি দূরে স্থিত পিতৃদের চেনাে। ওই চর্মবিশেষ হতে বের হওয়া মজ্জার (চর্বি) নদী, পিতৃ, তার জন্য দানকারীর সকল কামনা পূর্ণ হােক।
ঋগ্বেদ ৯/8/১ এর ভাষ্যের ভূমিকায় চার বেদের ভাষ্যকার সায়ণ লিখেছেনঃ
ব্রাহ্মণাে বৃষভং হত্বা তন্মাংসং ভিন্ন-ভিন্নদেবতাভ্যো জুহােতি। তত্র বৃষভস্য প্রশংসা তদংগাতাং চ কমানি কতমদেবেভ্যঃ প্রিয়াণি ভবন্তি তদ্ বিবেচন। বৃষভবলিহবনস্য মহত্ত্বং চ বর্ণতে। তদুৎপন্নং শ্ৰেয়শ্চ স্তয়তে।
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ বৃষভকে হত্যা করে তার মাংসকে ভিন্ন ভিন্ন দেবতাদের উদ্দেশ্যে আহুতি দেয়। এতে বৃষভের প্রশংসা এবং তার কোন কোন অঙ্গ কোন কোন দেবতার প্রিয় – তা বিবেচনা করা হয়েছে এবং বৃষভের বলি দিয়ে হবন করার মাহাত্ম এবং তার ফলে লাভ করা শ্রেয়ের বর্ণনা করা হয়েছে।
বৃষের বলি
শতপথ ব্রাহ্মণ ৩/৪/১/২ এ লেখা আছে আছে অতিথির জন্য মহােক্ষ (বড় বৃষ) হত্যা করা উচিত। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ২/৭/১১/১ থেকে জানা যায় যে অগস্ত নামের এক যজ্ঞকর্তা ১০০ বৃষের বলি দিয়েছলেন। এই কথাই পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ ২১/১৪/৫ এ বলা শতপথব্রাহ্মণ ৩/১/২/২১ এ পুরােহিতেরা পরস্পরের সাথে এ বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন যে বৃষের মাংস খাওয়া উচিত নাকি গাভীর! যাজ্ঞবল্ক্য বললেনঃ
অশ্যাম্যেব অহং অংসলং চেদ ভবতীতি।
অর্থাৎ ‘দুটোর মধ্যে যার মাংস নরম, আমি তাই খাই’।
গৃহ্যসূত্রগুলােতে শূলগব নামক এক যজ্ঞের বিধান দেওয়া হয়েছে। কাঠক গৃহ্যসূত্রের ব্যাখ্যাকার দেবপালের মত অনুসারে, শূলগবকে শূলগব বলার কারণ হল এতে গরুর অঙ্গ শূলে পাকানাে হয়। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের ব্যাখ্যাকার নারায়ণের মতে রূদ্রের সাথে এই কর্মের সম্পর্ক থাকায় একে শূলগব বলা হয়। এতে ষাঁড়ের সংজ্ঞপন করে রুদ্রের জন্য যজন করা হয়। পশুর লেজ, চামড়া, মাথা এবং পা অগ্নিতে হােম করা হয়। পশুর রক্ত সর্পদের উৎসর্গ করা হয়। এর পরে একটি বাছুর পরবর্তী শূলগবের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়।
বৌধায়ণ গৃহ্যসূত্র অনুসারে অরণ্যে স্থাপন করা অগ্নিতে গরুর চর্বি ও মাংসখন্ডকে। শূলে গেঁথে ঝলসিয়ে এক পাত্রে রান্না করা হয় এবং অগ্নির ভিন্ন ভিন্ন ভাগে ভিন্ন ভিন্ন দেবতাদের উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়া হয়। বৌধায়ণ গৃহ্য সূত্র ২/৭ এ শূলগবের সময় গােবলির বিধান দেওয়া হয়েছে।
কিছু লােক বলেন গােমেধের অর্থ গরুকে হত্যা করা নয় বরং গরুকে পালন করা। প্রাচীন প্রমাণগুলাের নিরিখে দেখলে একথা কপােলকল্পনার অতিরিক্ত গুরুত্ব রাখে না। যখন শতপথব্রাহ্মণে স্পষ্টভাবে পশুর ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গকে কেটে পুরােহিত ও যজমানের মধ্যে ভাগাভাগির কথা পাওয়া যায় তখন একে গােবধ না বলে আর কি বলা যায়?
কিছু লােক বেদের এমন কিছু অংশকে প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃত করে যেখানে গরুর সাথে ‘অগ্ন্যা’ (হত্যার অযােগ্য) বিশেষণ যুক্ত আছে। এই বিশেষণ থেকে তারা এটা প্রমাণ করতে চায় যে গাে হত্যা করা হত না। কিন্তু তাদের এই মত স্বীকার করা যায় না, কারণ এমন জায়গাতে শুধুমাত্র গাভী বিশেষের হত্যায় নিষেধ করা হয়েছে, সকল প্রকার গােবধের নিষেধ করা হয় নি। উদাহরণ হিসেবে নিম্নলিখিত মন্ত্র দেখা যেতে পারেঃ
দুহামশ্বিভ্যাং পয়াে অঘ্ন্যেয়ং সা বর্ধতাং মহতে সৌভগায়। (ঋগবেদ ১/১৬৪/২৭)
অর্থাৎ, “এই গাভী অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে দুধ প্রদান করে। এ আমাদের সৌভাগ্য বৃদ্ধি করুক। এ বধের যােগ্য নয়।”
এখানে ‘ইমং’ (এই) শব্দ দ্বারা গাভী বিশেষকে বােঝানাে হয়েছে। বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘বৈদিক কোশ’ এ বলা হয়েছে, ‘অগ্ন্যা’ বলার পরেও গাভীদের হত্যা করা হত। ধর্মশাস্ত্রের পণ্ডিত ড. পি. ভি. কানে লিখেছেন,
“এমন নয় যে বৈদিকযুগে গরু পবিত্র ছিল না। এর পবিত্রতার কারণেই বাজসনেয়ী সংহিতায় গােমাংস খাওয়ার বিধান দেওয়া হয়েছিল।” (ধর্মশাস্ত্র বিচার, মারাঠী, পৃষ্ঠা ১৮০)।
বৈদিক যুগে গােমাংসাহার
বৈদিক যুগে গােমাংস ভক্ষণ হত বলেই স্বামী বিবেকানন্দ বৈদিক যুগকে স্বর্ণযুগ বলেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনিকার স্বামী নিখিলানন্দ লিখেছেন, “স্বামী বিবেকানন্দ প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মণদের সাহসের সাথে বলেছিলেন যে বৈদিক যুগে গােমাংস ভক্ষণ প্রচলিত ছিল। যখন একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ভারতের ইতিহাসের কোন সময়টি স্বর্ণযুগ ছিল তখন তিনি বৈদিকযুগকে স্বর্ণযুগ বলেছিলেন, যখন পাঁচজন ব্রাহ্মণ মিলে একটা গরু কেটে খেয়ে ফেলতাে।” [স্বামী নিখিলানন্দের লিখিত ‘বিবেকানন্দ এ বায়োগ্রাফী, পৃষ্ঠা – ৯৬]
উপনিষদেও গােমাংস খাওয়ার বিধান পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬/৪/১৮ এ লেখা আছেঃ
অথ য ইচ্ছেৎপুত্রো মে পন্ডিতাে বিগীতঃ সমতিংগমঃ সুশ্ৰুষিতাং বাচং ভষিতা জায়েত সর্বাম্বেদাননুব্রবীত্ সর্বমায়ুরিয়াদিতি মাংসৌদনং পাচয়িত্বা সর্পিষ্মন্তমশ্নীয়াতামীশ্বরৌ জনয়িতবা ঔক্ষেণ বার্ষভেণ বা।
অর্থাৎ যিনি চান তার পুত্র সভায় বাগ্মী, সর্ববেদে পারঙ্গম, শতবর্ষজীবি হােক, তার এবং তার স্ত্রীর বৃষ বা ষাঁড়ের মাংস রান্না করে ভাত এবং ঘি এর সাথে মিশিয়ে খাওয়া উচিত।
কিছু লােক উপনিষদের বৃষ এবং ষাঁড় বাচক শব্দ- ঔক্ষ, আর্ষভ এর অর্থ বদলানাের চেষ্টা করে থাকে। অনেক পুরাণপন্থী পণ্ডিতেরা এই শব্দগুলাের অর্থ ভেষজ উদ্ভিদ করেছেন কিন্তু তাদের এই ধরণের অর্থ শুধু প্রাচীন টীকাকার এবং ভাষ্যকারদের বিপরীতই নয়, হাস্যকরও বটে।
খুশির কথা হল বৃহদারণ্যক উপনিষদের উপর এমন এক বিদ্বানের ভাষ্য পাওয়া যায়, যিনি ১২ থেকে ১৩ শত বৎসর পূর্বে ভারত থেকে বেদবিরােধী বুদ্ধমতকে ‘সমূলে নষ্ট করার জন্য এবং হিন্দু ধর্মকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রসিদ্ধ। তার প্রতিনিধিরা আজও ভারতের চারিদিকে হিন্দু ধর্মের সর্বোচ্চ অধিকারী রূপে বিদ্যমান। তিনি হলেন আদি শঙ্করাচার্য। তার করা অর্থ আজ অবধি সর্বজনগ্রাহ্য। সেই অর্থের ভিত্তিতে ‘ঔক্ষ’ এবং ‘আৰ্ষভ’ শব্দের অর্থ নিয়ে যে প্রতারণা চলছে তা আপনা আপনিই ফাঁস হয়ে যায়। শঙ্করাচার্য বৃহদারণ্যক উপনিষদের এই বিবাদিত অংশের ভাষ্যে বলেছেনঃ
মাংসমিশ্ৰমােদনং মাংসৌদন, তত্সংসনিয়মাৰ্থমাহ- ঔক্ষেণ বা মাংসেন। উক্ষা সেচনসমর্থঃ পুংগবস্তদীয়ং মাংসম, ঋষভস্ততােঅপ্যধিকবয়াস্তদীয়মাৰ্ষভং মাংস। [বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৬/৪/১৮ এর শঙ্করভাষ্য]
অর্থাৎ, মাংসমিশ্রিত ওদন বা ভাতকে মাংসৌদন বলে। সেই মাংস কিসের হওয়া উচিত, এ বিষয়ে বলা হয়েছে। উক্ষা এর। উক্ষা এর অর্থ বীর্য সেচনে সমর্থ বৃষ। এর মাংস অথবা ঋষভের মাংস হওয়া উচিত। ঋষভ হল উক্ষার চাইতে অধিক বয়স্ক বৃষ।
শঙ্করাচার্যের ভাষ্য অর্থবদলকারীদের অর্থ বদলানাের কোনাে সুযােগ অবশিষ্ট রাখে না। উপনিষদে যে বেদজ্ঞ, দীর্ঘায়ু এবং বাকপটু পুত্র আকাক্ষাকারীদের গােমাংস খাওয়ার বিধান দেওয়া হয়েছে তাতে কোনাে সন্দেহ থাকে না।।
গৃহ্যসূত্রগুলােতে মধুপর্কের বিধান পাওয়া যায়। গৃহ্যসূত্রে উল্লেখিত মধুপর্কে গােহত্যা ও গােমাংস ভক্ষণের উল্লেখ মেলে। গৃহ্যসূত্রগুলােতে মধুপর্ক সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা একে একে উল্লখ করা হচ্ছে।
আশ্বলায়ন গৃহ্য সূত্রে লেখা আছে, “যখন আচার্য, বেদজ্ঞ বা স্নাতক ঘরে আসবে, তাকে মধুপর্ক দিয়ে সম্মানিত করবেন। যদি তিনি অনুমতি দেন তাহলে, ‘গৌরস্যপহতপা..” ইত্যাদি মন্ত্র পড়ে তাকে হত্যা করে অতিথিকে দেবেন।” (১৩/৫/১৫-১৭)।
পারস্কর গৃহ্যসূত্রে লেখা আছে,
“আচার্য, ঋত্বিক, বৈবাহ্য, রাজা, প্রিয়জন এবং স্নাতক প্রভৃতি উৎকৃষ্ট জাতির হােক বা সমান জাতির হােক তারা অর্ঘ্য (পূজ্য)। এদের মধ্যে কেউ বাড়িতে এলে গৃহপতির উচিত তাদের মধুপর্ক প্রভৃতি দ্বারা সংস্কার করা। সৎকার মাংস ছাড়া করা যাবে না। এজন্য গােহত্যা করার কথা বলা হয়েছে। পূজ্য ব্যক্তির সামনে খড়্গ এবং গরু আনা হবে। অর্ঘ্য (অতিথি) যদি মাংস খান তবে হত্যা করার আজ্ঞা দেবেন। যদি তিনি নিরামিষাশী হন, তাহলে ছেড়ে দেওয়ার আজ্ঞা দেবেন। যজ্ঞ এবং বিবাহকালে ছেড়ে দেওয়ার আজ্ঞা দেওয়া উচিত নয়। …” [দেখুন উত্তররামচরিত, চৌখম্বা প্রকাশনী, বারাণসী, ১৯৯৬ এর সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৪০৬ এ হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত অধ্যাপক কান্তানাথ শাস্ত্রী তৈলঙ্গ এর টিপ্পনী]
তিন অথবা চার অষ্টকাশ্রাদ্ধের কোনােটিতে গােহত্যার ব্যবস্থা ছিল। [খদির গৃহ্যসূত্র ৩/৪/১, গােভিল গৃহ্যসূত্র ৩৩/১০/১৬]
কিছু লােকেরা বলে, মধুপর্কে মধু, দধি প্রভৃতি দেওয়া হত কিন্তু মাংস দেওয়া হত না, গােমাংস দেওয়া তাে দূরের কথা। এ কথা গৃহ্যসূত্রে বলা কথার সম্পূর্ণ বিপরীত, কেননা মানব গৃহ্য সূত্র ১/৯/২২ এ স্পষ্ট লেখা আছে , “নামাংসাে মধুপর্ক ইতি শ্রুতিঃ।” অর্থাৎ মধুপর্ক মাংস ছাড়া হতে পারে না, এমন মত বেদের।
দ্বিতীয়ত, আমাদের কাছে একটি প্রমাণ আছে, যাতে সন্দেহের কোনাে অবকাশ থাকে না। সেই প্রমাণ এমন এক ব্যক্তির রচনা যিনি শঙ্করাচার্যেরও আগে বা তার সময়কালে বৈদিক কর্মকাণ্ডকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা কুমারিল ভট্টের শিষ্য। তিনি হলেন ভবভূতি। ভবভূতি তার বিখ্যাত সংস্কৃত নাটক ‘উত্তররামচরিতম্ এর চতুর্থ অঙ্কে বিষ্কম্ভকে লিখেছেন। যে, বাল্মীকির আশ্রমে যখন বশিষ্ঠ এসে উপস্থিত হন, তখন তার সৎকার দুই বৎসরের বাছুরের মাংস দ্বারা করা হয়েছিল।
এর ফলে বাল্মীকির এক শিষ্য সৌধাতকী ভীষণ রেগে যান। তিনি নিজের সহপাঠী ভান্ডায়ন কে বলেন,
“এই বশিষ্ঠ কোনাে বাঘ বা নেকড়েই হবেন, কারণ তিনি এসেই বেচারী কল্যাণীকে (বাছুরের নাম) চেটে খেয়ে ফেললেন।”
একথা শুনে তার সহপাঠী শাস্ত্রসম্মমত উত্তর দিয়ে বলেনঃ
সমাংসাে মধুপর্ক ইত্যাম্নয়ং বহুমন্যমানাঃ শ্ৰোত্ৰিয়াভ্যাগতায় বৎসরীং মহােক্ষং মহাজং বা নির্বপন্তি গৃহমেধিনঃ, তং হি ধর্মসূত্রকারাঃ সমামনংতি।
অর্থাৎ, মধুপর্ক মাংস দিতে হবে, এই বেদবচনকে ভীষণ শ্রদ্ধা জানিয়ে গৃহে আগত বেদজ্ঞ অতিথির জন্য বাছুর অথবা বড় বৃষ অথবা বড় ছাগল হত্যা করা হয়। এই বেদবচনকে ধর্মসূত্র রচনাকারীরাও ভীষণ মান্য করেন।
এর ব্যাখ্যায় চন্দ্রকলা নামক সংস্কৃত ব্যাখ্যাগ্রন্থে যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির এক শ্লোকার্ধ উল্লেখ করা হয়েছে-
‘মহােক্ষং ব মহাজং বা শ্রোত্রিয়ায়ােপকল্পয়েত।‘
অর্থাৎ বড় বৃষ বা বড় ছাগল বেদের বিদ্বানের খাওয়ার জন্য যােগাড় করবেন।” [দেখুন, ‘উত্তররামচরিতম্ চন্দ্রকলা ব্যাখ্যা সহিত, চৌখম্বা প্রকাশন বারাণসী, পঞ্চম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২০৭]
এই কথাকে আরও স্পষ্ট ভাবে বশিষ্ঠ স্মৃতিতে (অধ্যায় ৪) বলা হয়েছেঃ
অথাপি ব্রাহ্মণায় বা রাজন্যায় বা অভ্যাগতায় বা,
মহােক্ষং বা মহাজং বা পচে এবমস্যাতিথ্যং কুবন্তীতি।
অর্থাৎ, কারাে গৃহে যদি ব্রাহ্মণ অথবা রাজা অতিথি হয়ে আসেন তবে তার জন্য একটি বড় বৃষ অথবা বড় ছাগল রান্না করা উচিত। এভাবে অতিথির সৎকার করা হয়।
মিথ্যা প্রমাণ করার অসফল প্রচেষ্টা
কিছু লােক স্মৃতিতে উল্লেখিত ‘মহােক্ষ’ অথবা ‘মহাজং’ শব্দের অর্থ ভেষজ উদ্ভিদ করেন। এর ফলে তাদের নিজের পূর্বপুরুষদের গােহত্যার ‘পাপ’ হতে মুক্ত করার বৃথা প্রচেষ্টায় মিথ্যা বলার ‘পাপ’ ছাড়া অপর কিছু হয় না, কেননা ‘বৎসরী (বাছুর), মহােক্ষ (বড় বৃষ) বা মহাজং (বড় ছাগল) শব্দগুলাের অর্থ যদি ভবভূতি ঔষধি মনে করতেন, তাহলে তা খাওয়ার ফলে বশিষ্ঠকে বাঘ বলা হত না। বাঘ কি ভেষজ উদ্ভিদ খায়?
দ্বিতীয়ত, ‘বশিষ্ঠস্মৃতি’ এর যে উদ্ধৃতি আগে দেওয়া হয়েছে তার পূর্ববর্তী শ্লোক থেকে স্পষ্ট হয় যে স্মৃতিকার ‘মহােক্ষ’ অথবা ‘মহাজ’ শব্দগুলাের অর্থ পশুবিশেষ বলে মনে করেন, ঔষধি বিশেষ বলে মনে করেন না। পূর্ববর্তী শ্লোকটি নিচে দেখুনঃ
পিতৃদেবাতিথিপূজায়াং পশুং হিংস্যাত।
মধুপর্কে চ যজ্ঞে চ পিতৃদৈবতকর্মণি। যজ্ঞে বধােঅবধঃ।
অর্থাৎ, পিতৃ, দেব এবং অতিথি পূজার সময়, মধুপর্ক, যজ্ঞ, পিতৃকর্ম (শ্রাদ্ধ) এবং দেবকর্মে পশুহিংসা করবেন। যজ্ঞে করা বধ, বধ নয়।
অতএব, এই শ্লোকের পরের শ্লোকে যে ‘মহাজ’, ‘মহােক্ষ’ শব্দ এসেছে, এগুলাে দ্বারা নিঃসন্দেহে বড় ছাগল এবং বড় বৃষই বােঝায়।
আর একটি কথা, প্রাচীনকালে সংস্কৃতে অতিথি বােঝাতে গােঘ্ন শব্দ ব্যবহার করা হত। গােঘ্ন এর অর্থ- গাে হত্যাকারী। কিন্তু এর পারিভাষিক অর্থ হল, যার জন্য গাে হত্যা করা হয়। এই শব্দ হতে এটাই প্রকাশ পায় যে, অতিথির জন্য গাে হত্যা করা হত। অতিথির সাথে গােবধের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সরাসরি সম্পর্ক থাকার জন্য, অতিথির জন্য গােঘ্ন শব্দ প্রচলিত হয়ে পড়েছিল।
আপস্তম্ভ ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে, শ্রাদ্ধে গােমাংস দেওয়া হলে পিতৃরা এক বছর অবধি তৃপ্ত থাকেন। বিভিন্ন মাংসে পিতৃদের বিভিন্ন সময় তৃপ্ত থাকার প্রসঙ্গে আপস্তম্ভ লিখেছেনঃ
“সংবৎসরং গব্যেত প্ৰীতিঃ, ভুয়াংসমতাে মাহিষেণ, এতেন গ্রাম্যারণ্যানাং পশুনাং মাংসং মেধ্যং ব্যাখ্যাত। খড়্গোপস্তরণে খড়্গমাংসেনানন্ত্যং কাল। তথা শতবলেমৎস্যস্য মাংসেন বার্ধীণসস্য চ।“ (আপস্তম্ভ ধর্ম সূত্র ২/৭/১৬/২৫ এবং ২/৭/১৭/৩)
অর্থাৎ, শ্রাদ্ধে গােমাংস খাওয়ালে পিতৃরা এক বর্ষ অবধি সন্তুষ্ট থাকেন। মহিষের মাংস খাওয়ালে তার অধিক সময় সন্তুষ্ট থাকেন। এই নিয়মই খরগােশ প্রভৃতি বন্য পশু এবং ছাগল প্রভৃতি গ্রামীণ পশুর মাংসের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। যদি গণ্ডারের চামড়ায় ব্রাহ্মণদের বসিয়ে গণ্ডারের মাংস খাওয়ানাে হয় , তাহলে পিতৃরা অনন্তকাল সন্তুষ্ট থাকেন। শতবলি নামক মাছের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযােজ্য।
অনেকটা একইধরণের কথা মহাভারতে (অনুশাসন পর্ব ৮৮/৫) পাওয়া যায়ঃ
গব্যেত দন্তং শ্রাদ্ধে তু সংবৎসরমিহােব্যতে।।
অর্থাৎ, গােমাংস দ্বারা শ্রাদ্ধ করলে পিতৃরা এক বৎসর অবধি তৃপ্ত থাকেন।
পুরাণ এবং স্মৃতিতে লেখা আছে শ্রাদ্ধে দেওয়া মাংস যে না খায়, সে নরকে গমন করে।
মনু (৫/৩৫) লিখেছেনঃ
নিযুক্তস্তু যথান্যায়ং যাে মাংসং নান্তি মানবঃ।
স প্ৰেত্য পশুনাং যাতি সংভবানেকবিংশতিম্।।
অর্থাৎ, যে শ্রাদ্ধ এবং মধুপর্কে পরিবেশিত মাংস খায় না, সে মৃত্যুর পর একুশ জন্ম অবধি পশু হয়ে জন্মায়। যজ্ঞ এবং শ্রাদ্ধে যে দ্বিজ মাংস খায় না, সে পতিত হয়।
এমন কথা কৃর্ম পুরাণেও (২/১৭/৪০) বলা হয়েছে। বিষ্ণুধর্মোত্তরপুরাণ (১/৪০/৪৯৫০) এ বলা হয়েছে যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধে খেতে বসে পক্তিতে পরিবেশন করা মাংস খায় না, সে নরকে যায়। [দেখুন, ধর্মশাস্ত্রো কি ইতিহাস, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ১২৪৪]
মহাভারতে গােমাংস দিয়ে হবন করে রাজ্য নষ্ট করার কথা বলা আছে। দাল্ভ্যের কাহিনীতে আছেঃ
যদৃচ্ছয়া মৃতা দৃষ্ট গাস্তদা নৃপসত্তমঃ।৮
এতান্ পশুন নয় ক্ষিপ্রং ব্রহ্মবংধৌ যদীচ্ছসি।৯
স তুৎকৃত্য মৃতানাং বৈ মাংসানি মুনিসত্তমঃ।১১
জুহাব ধৃতরাষ্ট্রস্য রাষ্ট্রং নরপতেঃ পুরা।
অবকীর্ণে সরস্বত্যাস্তীর্থ প্রজ্বাল্য পাবকম্।১২
বকো দাল্ভো মহারাজ নিয়মং পরমং স্থিতঃ।
স তৈরেব জুহাবাস্য রাষ্ট্রং মাংসৈর্মহাতপাঃ।।১৩
তস্মিংস্তু বিধিবত সত্রে সংপ্রবৃত্তে সুদারুণে।
অক্ষীয়ত ততাে রাষ্ট্রং ধৃতরাষ্ট্রস্য পার্থিব।।১৪
অর্থাৎ, এই মৃত গরুগুলােকে যদি নিয়ে যেতে চাও, তবে নিয়ে যাও। দাল্ভ এই মৃত গরুদের মাংস কেটে সরস্বতীর তীরে অবকীর্ণ নামক তীর্থস্থলে অগ্নি জ্বালিয়ে হবন করেছিলেন। বিধিপূর্বক যজ্ঞ সম্পন্ন হলে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্য ক্ষীণ হয়েছিল।
শান্তিপর্বে আছে, ছিন্ন বৃক্ষের মত ছিন্ন বৃষদের যজ্ঞে দেখে এবং গরুদের বিলাপ শুনে রাজা বিচুখ্য বিচলিত হয়েছিলেন এবং তাদের প্রতি দয়া দেখিয়ে বলেছিলেন- তাদের কল্যাণ হােক।
ছিন্নস্থূণং বৃষং দৃষ্ট্বা বিলাপং চ গং ভৃশম্।
গােগ্রহে যজ্ঞবাটস্য প্রেক্ষমাণঃ স পার্থিবঃ।।২
স্বস্তি গােভ্যোঅস্তু লােকে ততাে নির্বচনং কৃতম্।৩
-অধ্যায় ২৬৫
মহাভারতে রন্তিদেব নামে এক রাজার কথা পাওয়া যায়। তিনি গােমাংস পরিবেশন করে যশস্বী হয়েছিলেন। মহাভারতের বনপর্বে (অধ্যায় ২০৮ অথবা ১৯৯) আছেঃ
রাজ্ঞাে মহানসে পূর্বং রন্তিদেবস্য বৈ দ্বিজ।
দে সহস্রে তু বধ্যেতে পশুনামম্বহং তদা।
অহন্যহনি বধ্যেতে দ্বে সহস্রে গবাং তথা…
সমাংসং দদতাে হ্যন্নং রন্তিদেবস্য নিত্যশঃ।
অতুলা কীর্তরভবন্নৃপস্য দ্বিজসত্তম।
-মহাভারত , বনপর্ব, ২০৮, ১৯৯/৮-১০
অর্থাৎ, রাজা রন্তিদেবের রান্নাঘরের জন্য প্রতিদিন দুই হাজার পশু হত্যা করা হত। মাংসসহ অন্ন দান করে রন্তিদেব অতুল কীর্তি লাভ করেছিলেন।
এই বর্ণনা পড়ে যেকোনাে ব্যক্তি বুঝতে পারেন, গােমাংস দান করার ফলে রন্তিদেবের যেহেতু অতুল কীর্তি হয়েছিল সুতরাং গােহত্যা প্রশংসনীয় কার্য হিসেবে বিবেচিত হত, নিন্দনীয় কার্য হিসেবে নয়।
আরও এক কৌশল
যেসব লােকেরা আজ ধর্মগ্রন্থের অনেক স্থানের অর্থ কোনাে না কোনাে ভাবে বদলাতে চেষ্টা করছেন, তারা পূর্বোক্ত শ্লোকের অর্থ বদলাতে সক্ষম হন না। এই কারণেই তারা এই স্থানের বিরােধীতা করার জন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করেছেন। তারা বলেন, এই শ্লোক সব প্রতিলিপিতে নেই, সুতরাং বিধর্মীরা এটাকে প্রক্ষিপ্ত করেছে। কিন্তু তাদের এই কথা সঠিক নয়, কারণ এই শ্লোকগুলাে ক্রিটিকাল এডিশনেও আছে। উদাহরণস্বরূপ, উপরােক্ত শ্লোকটি চিত্রকলা সংস্করণ এর ২০৮ তম অধ্যায়ে আছে এবং ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর সংস্করণের ১৯৯ তম অধ্যায়ে আছে, ভারতীয় বিদ্যা ভবন মুম্বাই এর প্রসিদ্ধ প্রকাশন ‘দ্যা হিস্ট্রি এন্ড কালচার অফ দি ইন্ডিয়ান পীপল’ এও আছে, যার মুখ্য সম্পাদক ছিলেন আর. সি. মজুমাদার এবং এতে এই শ্লোকগুলাের বৈধতা স্বীকার করা হয়েছে। এই পুস্তকের দ্বিতীয় খণ্ডে লেখা আছেঃ “মহাভারতে আছে। রাজা রন্তিদেব লােকজনকে মাংস দান করার জন্য প্রতিদিন দুই হাজার সাধারণ পশু হত্যা করতেন এবং দুই হাজার গরু হত্যা করতেন।” (পৃষ্ঠা ৫৭৯)
দ্বিতীয়ত, রন্তিদেবের উল্লেখ মহাভারতের অন্যত্রও রয়েছে। শান্তি পর্বের ২৯ তম অধ্যায়ের ১২৩ তম শ্লোকে আছে, রাজা রন্তিদেব যে গরুদের বলি দিয়েছিলেন তাদের রক্তে এক মহানদীর উৎপত্তি হয়েছিল। সেই নদীর নাম হয়েছিল চর্মগ্বতী।
মহানদী চর্মরাশােরুক্লেদা সংসজে যতঃ।
ততশ্চর্মগ্বতীত্যেবং বিখ্যাতা সা মহানদী।।
কিছু লােক এই সহজ সরল শ্লোকের অর্থও বদলানাের চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেন,
“জীবিত গরু দান করার সময় তাদের গায়ে ছেটানাে জল থেকে চর্মগ্বতী নদীর উৎপত্তি হয়েছিল।”
এই কপােলকল্পিত অর্থকে হয়তােবা কেউ স্বীকার করে নিত যদি না কালিদাসের প্রসিদ্ধ ‘মেঘদূত’ আমাদের কাছে থাকতাে। মেঘদূতের এক স্থানে কালিদাস লিখেছেনঃ
ব্যালংবেথাঃ সুরভিতনয়াঅঅলম্ভজাং মানয়িষ্যন।
স্রোতােমূর্তো ভুবি পরিণতাং রন্তিদেবস্য কীর্তিম্।।
এই পদ্যটি পূর্বমেঘে রয়েছে। অনেক সংস্করণে এটা ৪৫ নং শ্লোকে এবং অনেক সংস্করণে ৪৮ বা ৪৯ নং শ্লোকে আছে। এর অর্থ হল, “হে মেঘ, তুমি গরুদের আলম্ভনের (হত্যার) ফলে পৃথিবীতে নদীরূপে বয়ে চলা রন্তিদেবের কীর্তিতে অবশ্যই ঝুঁকো।
এখানে স্পষ্টভাবে গরুদের আলম্ভনের (হত্যার) ফলে নদীর প্রবাহিত হওয়ার উল্লেখ আছে। কিছু লােকেরা এখানেও বলতে পারে, আলম্ভনের অর্থ হত্যা করা নয়। তাদের ‘মেঘদূত’ এর প্রাচীন টীকাকার মল্লিনাথের এই স্থানের টীকা দেখা উচিত। মল্লিনাথ লিখেছেন,
“পুরা কিল রাজ্ঞাে রন্তিদেবস্য গবালম্ভভেম্বেকত্র সস্তৃতা রক্তনিষ্যংদাচ্চর্মরাশােঃ কাচিন্নদী সস্যন্দে। সা চর্মতীত্যাখ্যায়ত ইতি।”
অর্থাৎ, প্রাচীন কালে রাজা রন্তিদেব গরুদের আলম্ভ (হত্যা) করেছিলেন। তার ফলে একত্র করা চামড়া থেকে প্রবাহিত হওয়া রক্ত নদীর মত বয়ে চলেছিল। সেই রক্তের নদী চর্ম থেকে প্রবাহিত হয়েছিল, তাই তার নাম চর্মগ্বতী হয়েছিল।
মহাভারতের অন্যত্রও রন্তিদেবের প্রসঙ্গে ‘আলম্ভ’ শব্দের প্রয়ােগ পাওয়া যায়। সেখানে আছে, এক দিন রাজা রন্তিদেবের গৃহে অনেক অতিথি এলে তিনি ২০১০০ গরু হত্যা করেছিলেনঃ
সাংকৃতে রন্তিদেবস্য যাং রাত্রিমবসন গৃহে।
আলভ্যংত শতং গবাং সহস্রাণি চৈক বিংশতিঃ।।
-শান্তি পর্ব ২৯/১২৭
কিন্তু অর্থ বদলানােয় তৎপর ধর্মরক্ষকেরা ‘আলম্ভ’ শব্দের অর্থ বদলিয়ে বলেন, আলম্ভ শব্দের অর্থ- “হাত দিয়ে ছুয়ে দান করা, হত্যা করা নয়”। এই অর্থ স্বীকার করা যেত, যদি না ধর্মশাস্ত্রে একটি বিশেষ শ্লোক পাওয়া যেত। যেহেতু সেই শ্লোকটি পাওয়া যায় এবং এর অর্থ সকলেই একই রকম করেন, তাই কোনাে বুদ্ধিমান ব্যক্তিই ‘ছুঁয়ে দান করা এই অর্থ স্বীকার করতে পারেন না। পরবর্তী কালে রচিত স্মৃতিতে সেই শ্লোক পাওয়া যায়। এগুলােতে অনেক আচার অনুষ্ঠানকে কলিযুগে নিষিদ্ধ বলে ঘােষণা করা হয়েছে। আপস্তম্ভ কল্পসূত্র পুরাণে বলা হয়েছেঃ
অশ্বালম্ভং গবালম্ভং সন্ন্যাংসং পলপৈতৃকম্।
দেবরাচ্চ সূতােৎপত্তিঃ কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েত।।
অর্থাৎ, “অশ্বের আলম্ভ, গরুর আলম্ভ, সন্ন্যাস, শ্রাদ্ধে মাংস পরিবেশন, দেবর এর নিয়ােগ দ্বারা পুত্র উৎপাদন – এই পাঁচটি কলিযুগে করবেন না।”
এই শ্লোকটি ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডেও (অধ্যায় ১১৫/১১২-১৩) পাওয়া যায়।
ধর্মগ্রন্থে হত্যা প্রসঙ্গে
এই শ্লোকটি সংস্কৃতের এক প্রাচীন শব্দকোষ ‘শব্দকল্পদ্রুম’ এ উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং ‘আলম্ভ’ শব্দের অর্থ ‘হত্যা করা’ বলা হয়েছে এবং তার সাথে আর এক প্রাচীন কোশ ‘অমর কোশ’ এর তথ্যসূত্র দেওয়া হয়েছে।
কলিযুগে এই পাঁচটি নিষিদ্ধ করার কারণ হল, পরবর্তীকালে এদের আপত্তিজনক বলে মনে করা হত। যদি এখানে ‘গবালম্ভ’ এর অর্থ ‘গরুকে হত্যা’ করা না হয়ে ‘ছুঁয়ে দান করা হত’ তাহলে একে কলিযুগে নিষিদ্ধ করা হত না, কেননা গােদানের বিধান তাে ধর্মগ্রন্থে অহরহ পাওয়া যায় এবং সেই দান তাে নিজের হাতেই করা হয়। গরু দানকারী নিজের হাত দিয়ে ব্রাহ্মণকে গরু দান করেন।
অন্য একটি গ্রন্থ, ‘বৃহন্নারদীয়’ তে লেখা আছেঃ
… মধুপর্কে পশােবধঃ মাংসৌদনং তথা শ্রাদ্ধে।
নরমেধাশ্বমেধকৌ… গােমেধং মখং তথা।
ইমান্ ধৰ্ম্মান্ কলিযুগে বর্জ্যানাহুঃ মনীষিণঃ।।
অর্থাৎ, মধুপর্কে পশুহত্যা, শ্রাদ্ধে মাংস এবং ভাত দেওয়া, নরমেধ, অশ্বমেধ এবং গােমেধ মখ (যজ্ঞ) করা- এগুলাে কলিযুগে বর্জন করা উচিত।
এখানে ‘গােমেধ’ মখকে কলিযুগে বর্জন করতে লেখা হয়েছে। মেধ’ এর অর্থ- হিংসা বা বধ। এটা হিংসাবাচক মেধ ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। গােমেধ এর অর্থ হল গরু হত্যা। ‘গােমেধ মখ’ : এর অর্থ হল- এমন যজ্ঞ যেখানে গরুকে হত্যা করা হয়। স্পষ্টতই; ‘গবালম্ভ’ এর অর্থ হল – গরুদের হত্যা করা। এই গােহত্যার কারণেই কলিযুগে গবালম্ভ বা গােমেধ যজ্ঞ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
হিন্দু গ্রন্থে যেমন গােহত্যার কথা পাওয়া যায়, তেমনি বৌদ্ধ গ্রন্থেও তা পাওয়া যায়। বৌদ্ধ গ্রন্থের এমন স্থানের কথা নিচে বলা হচ্ছেঃ
এক নিগ্রন্থ (জৈন) সাধু হয়েছিলেন। সেই সাধু গরু, বাছুর এবং গাভীকে হত্যা করে খেয়ে ফেলেছিলেন। (তিত্তিরজাতক, পৃষ্ঠা ৪৩৮)
জাতক যুগের হত্যাকারী
বৃষের হত্যা করে যজ্ঞ করার উল্লেখ বৌদ্ধ সাহিত্যেও পাওয়া যায়। বেদের পরম বিদ্বান এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি বনে এক কুটীর নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে অগ্নি স্থাপন করে, বৃষ হত্যা করে তার মাংসে আহুতি দেবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিছু শিকারী এসে ব্রাহ্মণের অনুপস্থিতে বৃষটিকে হত্যা করে খেয়ে ফেললাে। ব্রাহ্মণটি লবণ আনার জন্য গ্রামের দিকে গিয়েছিলেন। বৃষ হত্যা করে খাওয়ার জন্য তার লবণ জোগাড় করা প্রয়ােজনীয় বলে মনে হয়েছিল। তার এই ইচ্ছাও পূর্ণ হল না। (নটজুটঠজাতক, পৃষ্ঠা ১৪৪)
বৃষের হত্যা করে অগ্নির পূজা করা কোনাে বিচিত্র ব্যাপার ছিল না। যেখানে ফল, মূল, অন্নের চাইতেও মাংস সস্তা এবং সবাই মাংস আহার করে, সেখানে বৃষ, গাভী, শুকর প্রভৃতির বিশেষ কোনাে মাহাত্ম্য থাকে না।
‘জাতক কালীন ভারতীয় সংস্কৃতি’র লেখকের মত হল,
“জাতক কথায় বৃষ, গাভী হত্যাকারীরা ব্রাহ্মণই ছিলেন। একজন ক্ষত্রিয়ও পূজার জন্য বা খাওয়ার জন্য বৃষ বা গাভীকে হত্যা করেননি, বৈশ্যরাও নয়, শূদ্র অথবা চণ্ডালেরাও নয়। ব্রাহ্মণ বর্ণই ছিল জাতকযুগের গােহত্যাকারী।” (পৃষ্ঠা ২১৬)।
বেদ, ব্রাহ্মণগ্রন্থ, উপনিষদ, গৃহ্যসূত্র, ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি থেকে উপরে যে প্রমাণগুলাে দেওয়া হয়েছে তা থেকে এই ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় যে, প্রাচীন ভারতে গােহত্যা এবং গােমাংসাহার প্রচলিত ছিল।।
কিন্তু হিন্দু ধর্মে আজ এই দুটিকে মহাপাপ বলে মনে করা হয়। এমনটা কেন হল এবং কবে থেকে হল, মনে এই প্রশ্ন জাগা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর এর উত্তরও খুবই সরল। ড. ভীমরাও আম্বেদকর তার গবেষণাগ্রন্থ “The Untouchables’ (পৃষ্ঠা ১৪৮-১৫৪) এ বিষদে এই প্রশ্নের বিচার করেছেন। তিনি লিখেছেন, এটা ব্রাহ্মণদের যুদ্ধনীতির একটা কৌশল ছিল যার মাধ্যমে তারা গােহত্যাকারী থেকে গােপূজক হয়ে গিয়েছিল। গােহত্যা বন্ধের রহস্যের সমাধান ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধদের মধ্যে চলা ৪০০ বছরের সংঘর্ষ এবং কৌশলে খুঁজতে হবে, যা ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধদের পরাজিত করার জন্য অবলম্বন করেছিল। যজ্ঞে গােহত্যার বিরােধীতা করে বৌদ্ধরা জনসাধারণের মনে স্থান করে নিয়েছিল। তাদের পরাজিত করার একটাই উপায় ছিল, তা হল তাদের চাইতে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে নিরামিষাশী হয়ে যাওয়া। ব্রাহ্মণেরা নিরামিষাশী হয়েছিল এবং জিতেছিল। এর প্রমাণ হল, গােহত্যা গুপ্ত রাজাদের আমলে অপরাধ বলে ঘােষণা করা হয়েছিল।
শ্রী ভাণ্ডারকর বলেছেন,
“আমাদের কাছে এই কথার শিলালেখ হতে প্রাপ্ত অকাট্য প্রমাণ রয়েছে যে, পঞ্চম শতাব্দীতে গােহত্যা ভয়ানক পাপ বলে ঘােষিত হয়েছিল। এর সর্বপ্রথম উল্লেখ গুপ্তরাজা স্কন্দগুপ্তের ৪৬৫ খ্রিস্টাব্দের তাম্রপত্রে রয়েছে। এই সময়ের আগের ধর্মশাস্ত্রে গােহত্যা অপরাধ ছিল না। এজন্য বশিষ্ঠ বলেছিলেনঃ ধেন্বনড্রাহৌ মেধ্যৌ বাজসনেয়নে। অর্থাৎ, বাজসনেয়ের (যজুর্বেদীদের) মতে বৃষ এবং গাভী মেধ্য অর্থাৎ ভক্ষণযােগ্য।
একইভাবে, মনুসংহিতা ৫/১৮ এ এক পাটি দাঁত বিশিষ্ট প্রাণীদের মধ্যে কেবল উটকে অভক্ষ্য বলা হয়েছে- উষ্ট্রোংশ্চৈকতােদতঃ। এখানে গরুকে অভক্ষণযােগ্য বলা হয়নি বরং মনুস্মৃতির অনেক প্রাচীন ব্যাখ্যাকার স্পষ্টভাবেই গরুকে ভক্ষণযােগ্য বলেছেন। মনুসংহিতার প্রাপ্ত ভাষ্যগুলাের মধ্যে মেধাতিথির ভাষ্য প্রাচীনতম। তিনি লিখেছেনঃ উষ্ট্রবর্জিতা একতাে দতাে গােঅব্যজমৃগা ভক্ষ্যাঃ। অর্থাৎ, উটকে ছেড়ে এক পাটি দাঁত বিশিষ্ট প্রাণীদের মধ্যে গরু, ভেড়া, ছাগল এবং মৃগ ভক্ষণযােগ্য। আরও এক ব্যাখ্যাকার রাঘবানন্দ লিখেছেনঃ একতাে দতঃ একপংক্তিদন্তযুক্তা গবাদী। অর্থাৎ এক পাটি দাঁত বিশিষ্টদের মধ্যে গরু প্রভৃতি খাওয়া যায়। মনুস্মৃতি ৩/৩ এ গরু দিয়ে তৈরি মধুপর্ক দ্বারা পূজন করার কথা বলা হয়েছেঃ তং.. অহঁয়েৎপ্রথমং গবা অর্থাৎ গরু দ্বারা প্রথমে তার পূজা করবেন। এর ভাষ্যে প্রাচীন ভাষ্যকার কুল্লুকভট্ট [১১০০-১৫০০] লিখেছেনঃ গােসাধনমধুপর্কেণ পূজয়ে। অর্থাৎ, গরু দিয়ে তৈরি মধুপর্ক দ্বারা তার পূজা করবেন।
পণ্ডিতেরা দ্বিতীয় শতাব্দীর কাছাকাছি সময়কে মনুস্মৃতির রচনাকাল বলে মনে করেন। এর পর ধীরে ধীরে গােহত্যায় পাপের ধারণা তৈরি হয়। এর প্রমাণ হল মনুসংহিতায় যে ছােটোখাটো অপরাধের সূচি দেওয়া হয়েছে, তাতে গােহত্যাও রয়েছে। এই শ্লোক অকারণে করা গােহত্যা সম্বন্ধে প্রযােজ্য হবে কারণ মনু একপাটি দাঁতযুক্ত পশুদের মধ্যে কেবল উটকে ভােজনের অযােগ্য বলে ঘােষণা করেছেন এবং অন্যান্য বাকি পশুদের ভক্ষণের যােগ্য বলেছেন।
পঞ্চম শতাব্দীর আগে
এখানে উল্লেখ করা উচিত হবে যে মনু (১১/৫৪) বড় পাপের তালিকাও দিয়েছেন কিন্তু সেই তালিকায় গােহত্যা নেই। মনু ছাড়াও আপস্তম্ভ, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি স্মৃতিকারেরাও গােহত্যাকে উপপাতক বলেছেন। প্রায় পঞ্চম শতাব্দী থেকে গুরুহত্যা এবং ব্রাহ্মণহত্যার মত গােহত্যাকে মহাপাপ বানানাে হয়েছিল।
এখানে একটি মজাদার বিষয় উল্লেখ করা যাক, পঞ্চম শতাব্দীর কাছাকাছি গােহত্যাকে মহাপাপ বানানাে হলেও, এই সময়ের পরে রচিত পুরাণে গােহত্যা এবং গােমাংসভক্ষণের উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ এই লেখকেরা বেদ থেকে শুরু পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বে রচিত গ্রন্থসমূহ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, অথবা বর্ণিত কাহিনী বা বিধানগুলাে পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বের হওয়ার কারণে তারা তার বর্ণনা করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বিষ্ণু পুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের নিম্নলিখিত স্থানগুলাে দেখা যেতে পারেঃ
হবিষ্যমৎস্যমাংসস্তু শশস্য নকুলস্য চ।।
সৌকরচ্ছাগলৈণেয়রৌরবৈর্গব্যতে চ।
ঔরভ্রগবৈশ্চ তথা মাংসবৃদ্ধৃয়া পিতামহাঃ।।
প্রয়ান্তি তৃপ্তিং মাংসৈস্তু নিত্যং বার্ধীণসামিষৈঃ।।
-বিষ্ণুপুরাণ ৩/১৬/১-২
অর্থাৎ, হবি (মহাপাতক), মৎস্য, শশক (খরগোস), নকুল, শুকর, ছাগল, কস্তুরী মৃগ, কৃষ্ণ মৃগ, গবয় (বন গরু), এবং গরুর মাংসে পিতৃরা ক্রমান্বয়ে এক এক মাস অধিক সন্তুষ্ট থাকেন এবং গণ্ডারের মাংসে পিতৃরা চিরকাল সন্তুষ্ট থাকেন।
পঞ্চকোটি গবাং মাংসং সাপূপং স্বান্নমেব চ।
এতেষাং চ নদী রাশি ভুঞ্জতে ব্রাহ্মণান্মুনে।।
– ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, প্রকৃতি খণ্ড, ৬১
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণেরা পাঁচ কোটি গরুর মাংস এবং মালপুয়া খেয়ে ফেললেন।
প্রকৃতি খণ্ডে মহাদেব সুযজ্ঞ নামের এক রাজার বর্ণনা করেন যার রাজ্যে ব্রাহ্মণদের নিত্য সুপক্ক মাংস প্রদান করা হতঃ সুপক্কানি চ মাংসানি ব্রাহ্মণেভ্যশ্চ পার্বতি। (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ৫০/১৩)
রুক্মিণীর ভাই রুক্মী তার বােনের বিবাহের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
গবাং লক্ষং ছেদনং চ হরিণানাং দ্বিলক্ষকম্।
চতুরলক্ষম্ শশানাং চ কৃর্মাণাং চ তথা কুরু।। (৬১)
দশলক্ষং ছাগলাতাং ভেটানাং তজ্জতুগুণম্।। (৬২)
এতেষাং পং মাংসং চ ভােজনার্থ চ কারয়।। (৬৩)
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড, উত্তরার্ধ, অধ্যায় ১০৫
অর্থাৎ, এক লাখ গরু, দুই লাখ হরিণ, চার লাখ খরগােশ এবং চার লাখ কচ্ছপ, দশ লাখ ছাগল এবং তার চারগুণ ভেড়া এইসব পশুদের মাংস রান্না করে ভােজন তৈরি করান।।
আদিমনুর এক যজ্ঞের বর্ণনা দিতে দিয়ে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ লিখেছেঃ
ব্রাহ্মণানাং ত্রিকোটীংশ্চ ভােজয়ামাস নিত্যশঃ।
পঞ্চলক্ষগবাং মাংসৈঃ সুপমৃৈতসংস্কৃতৈঃ।
চর্বৈশ্চৌষৌর্লেহ্যপেয়ৌর্মিষ্টদ্রব্যৈঃ সুদুর্লভৈঃ।
-প্রকৃতি খণ্ড, ৫৪/৪৮-৪৯
অর্থাৎ, মনু যজ্ঞে তিন কোটি ব্রাহ্মণদের ভােজন করাতেন। তাদের ঘিয়ে রান্না করা এবং ভালাে ভাবে রান্না করা পাঁচ লাখ গরুর মাংস এবং অন্যান্য চৰ্য, চূষ্য, লেহ্য, পেয় দুর্লভ খাদ্য পরিবেশন করা হত।
অনেক লােক বলেন, আপনি যেসব প্রমাণ দেখিয়েছেন, তার সবই ঠিকই আছে, আমাদের গ্রন্থের সাথেও মেলে, কিন্তু বামমার্গীরা পরবর্তীকালে এসব মিশিয়েছিল।
এই কথাকে সঠিক বলে মানা যায় না, কারণ শুধুমাত্র প্রাচীন ভারতেই নয় বরং কয়েক শতাব্দী আগেও পরম্পরাগত ভাবে গুরুমুখেই শিক্ষা লাভ করতাে মানুষেরা, ছাপাখানা ছিল না তখন। আর গ্রন্থগুলাে গুরুদের আশ্রমে বা রাজাদের পুস্তকালয়ে থাকতাে। কোনাে পুস্তকের একটি প্রতিলিপি পেতেও অনেক কষ্ট করতে হত। এমতাবস্থায় কোনাে গ্রন্থের প্রতিটি প্রতিলিপিতে তথাকথিত বামমার্গীরা কিভাবে গােহত্যা এবং গােমাংসভক্ষণের শ্লোক, কাহিনী এবং অধ্যায় মেশালাে?
দ্বিতীয়ত, প্রাচীন টীকাকার ও ভাষ্যকারেরা তাে নির্বিকারচিত্তে এই সকল স্থানের উপর তাদের ব্যাখ্যা লিখেছেন এবং এগুলােকে কেউই প্ৰক্ষীপ্ত বা ধর্মবিরুদ্ধ বলেননি। এর বিপরীতে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ অবধি স্বামী বিবেকানন্দের মত প্রবল হিন্দু ধর্ম প্রচারকেরা এর সমর্থন করে গিয়েছেন। তাহলে হয় এটা মনে করতে হবে যে, কোনাে কালে ভারতের সকলেই বামমার্গী হয়ে গিয়েছিল এবং আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিজেরাই নিজেদের গ্রন্থে পরিবর্তন করেছিলেন অথবা এটা মানতে হবে যে, স্বামী বিবেকানন্দ সহ অন্যান্য অনেক টীকাকার এবং ভাষ্যকার ধর্মগুরু এবং ধর্মপ্রবর্তকেরা বামমার্গী ছিলেন।
যদি প্রথম বিকল্পকে মানা হয়, তাহলে স্বীকার করা হয় যে, আমাদের বর্তমান হিন্দু ধর্ম আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মের বিরােধী। এমনটি হলে আমাদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ত্যাগ করতে হবে। যদি দ্বিতীয় বিকল্প মানা হয়, তাহলে আমাদের শংকরাচার্য, বিবেকানন্দ প্রভৃতি ধর্মাচার্য এবং তাদের রচনাবলিকে অস্বীকার করতে হবে। কিন্তু তখন কি হিন্দু ধর্ম নামে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে?
তৃতীয় বিকল্পটি অধিক যৌক্তিক। সেটি হল, গােহত্যা এবং গােমাংসভক্ষণ ঐতিহাসিক ভাবে সত্য এবং বৌদ্ধদের সাথে সংঘর্ষের সময় সামরিক নীতি হিসাবে ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ে এতে নিষেধাজ্ঞা আরােপ করা হয়েছিল এটা মেনে নেওয়া। তখন তাে ব্রাহ্মণ্যবাদ জিতে গিয়েছিল। কিন্তু যখন গরুকে সামরিক নীতি হিসাবে আক্রমণকারীরা (মুসলমানেরা) ব্যবহার করেছিল, যেমনটা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, তখন দেশ পরাধীন হয়ে গিয়েছিল এবং গােহত্যায় নিষেধাজ্ঞা দেশের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে গােহত্যার প্রচলন করা উচিত নাকি নিষিদ্ধ করা উচিত, বর্তমান পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে এর পুনর্বিচার হওয়া উচিত। এই সমস্যাটি নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা যাতে রাজনীতি না করতে পারে, সাম্প্রদায়িকতার আগুন না জ্বালাতে পারে সেই দিকে আমাদের খেয়াল রাখা উচিত।
আলােচনা এবং আপত্তির উত্তর
‘প্রাচীন ভারতে গােহত্যা এবং গােমাংসাহার’ শীর্ষক লেখায় পাঠকেরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। একজন আলােচক, যার নাম দেখে স্বামী বলে মনে হয়, তিনি এই লেখাটিকে ‘নিরাধার, অনর্থক এবং অমান্য’ বলেছেন। তার বিচারে গবেষকের দৃষ্টিতে এটা খুবই নিম্নমানের লেখা।
এক জায়গায় উনি লিখেছেনঃ ঋগ্বেদ/ যজুর্বেদ/ অধ্যায় ৭, সুক্ত, ১০৪, মন্ত্র ২ এ তিনি। (বেদ) স্বয়ং মাংসভক্ষণকারীদের কিভাবে শত্রু মেনেছেন দেখুন
“ইন্দসােমা সমধশস্যদ্যং তপুর্যমস্ত চরুরগ্নিবাং ইব।
ব্ৰহ্মদ্বিষে ক্রুবাদে ঘােরচক্ষসে দ্বেষাে ধমনবায়ং কিমীদিনে।
অর্থাৎ, হে ইন্দ্র, তুমি রাক্ষসদের বশীভূত করাে। তুমি অগ্নিতে পড়া চরুর মত ভস্ম করে দাও। তুমি এমন করাে যাতে ব্রাহ্মণদ্বেষী, মাংসাহারী, কটু ভাষী, বক্রদৃষ্টি সম্পন্ন রাক্ষসদের সাথে সবসময় শত্রুতা থাকে।
এটা পড়ে বােঝা যায় যে পত্রলেখক এই মন্ত্রটি অন্যান্য পরান্নভােজী এবং আধ্যাত্মবাদের নামে ধর্মভীরুদের শােষণ করা কিছু স্বামীদের মত কারাে লেখা থেকে টুকেছেন, তিনি বেদ পড়েননি। যদি তিনি নিজে বেদ পড়তেন তবে তিনি জানতেন যে, যজুর্বেদে অধ্যায়, সুক্ত এবং মন্ত্র হয় না। যদি ঋগ্বেদের কথা বলা হয়, তাতে অষ্টক (মণ্ডল), সুক্ত এবং মন্ত্র আছে, আর ঋগ্বেদের ৭ম অষ্টকে উপরােক্ত মন্ত্রটি নেই। এই মন্ত্রটি ৭ম মণ্ডলে রয়েছে।
যে ব্যক্তি জানে না যে কোনাে মন্ত্র ঋগ্বেদের নাকি যজুর্বেদের, যে বেদের ঠিকভাবে তথ্যসূত্রও দিতে পারে না, সে কিভাবে বেদ জ্ঞাতা হতে পারে? কিছু মুখস্ত মন্ত্র বা শ্লোক বেদশাস্ত্রে অনভিজ্ঞ ধর্মভীরু জনতার সামনে বলে নিজেকে অথবা ধর্মভীরুদের ধোঁকা দেওয়া যায়, কিন্তু বিদ্বানদের দেওয়া যায় না।
উপরােল্লিখিত মন্ত্রের অর্থ লেখার পর সমালােচক জিজ্ঞেস করেছেন,
“এই মন্ত্র থেকে মাংস ভক্ষণকারীদের প্রতি নিন্দা কি স্পষ্ট নয়?”
এই মহাশয় আমাকে বলেছেন, আমি যাতে এর সঠিক অনুবাদ করি। এর সঠিক অনুবাদ করার আগে এই নিবেদন করছি, আগে বেদমন্ত্র শুদ্ধভাবে লিখতে শেখা উচিত, তখন শুদ্ধ অর্থ করা যেতে পারে। ইনি যে বেদমন্ত্র লিখেছেন তার প্রথম পঙক্তিতে অনেকগুলাে ভুল রয়েছে। প্রথম পঙক্তিটি হলঃ “ইন্দ্রাসােমা সমধশংসমভ্যধং তপর্যস্তু চরুরগ্নিবাং ইব” ইনি লিখেছেন এরকমঃ “ইন্দসােমা সমধশস্যদ্যং তপুর্যমস্তু চরুগ্নিবাং ইব।” এক পঙক্তিতে এতগুলাে ভুল করা লােক বেদের সঠিক অর্থ কিভাবে জানতে পারেন?
এই মন্ত্রে একা ইন্দ্রের স্তুতি করা হয় নি, তার সাথে সােম দেবতারও স্তুতি করা হয়েছে, এখানে ‘ক্রব্যাদ’ এর নিন্দা করা হয়েছে, মাংসাহারীর নয়। ‘ক্রব্যাদ’ এর অর্থ- যে কাঁচা মাংস খায়। ‘ক্রব্য’ এর অর্থ কাঁচা মাংস।[দেখুন, আপ্তে কর্তৃক সম্পাদিত, প্র্যাকটিক্যাল সংস্কৃত-ইংলিশ ডিকশনারী]
এই মন্ত্রে ব্রাহ্মণবিদ্বেষী এবং কাঁচা মাংস খেকো রাক্ষসদের নিন্দা করা হয়েছে, অন্য সামান্য ব্যক্তির নিন্দা করা হয়নি। সাধারণ ব্যক্তির মাংসভক্ষণ সিদ্ধ করার জন্য আমি মূল লেখায় অনেক বেদমন্ত্র দিয়েছি, যার মধ্যে একটি নিয়েও তিনি কথা বলেননি, সেগুলাে খণ্ডন করা তাে দূরের কথা। নিজের পক্ষ অবলম্বন করার জন্য তিনি যে বেদমন্ত্রটির উপর নির্ভর করেছিলেন, তাতে পাঁচটি ভুল, তথ্যসূত্র অশুদ্ধ এবং অর্থের অনর্থ করা হয়েছে।
পূর্বাগ্রহ দ্বারা প্রভাবিত
পাঁচ ব্রাহ্মণের একটা গরু কেটে খাওয়ার যে কথাটি, এটি আমার কথা নয়, স্বামী বিবেকানন্দের ইংরেজি কথার অনুবাদ। এর দায়ও বিবেকানন্দেরই।
প্রাচীন ভারতে গােহত্যা হত না, এটা একেবারেই ভ্রান্ত, ভুল কথা। আশ্বলায়ন গৃহ্য সূত্রে ‘শূলগব’ প্রকরণে ভিন্ন ভিন্ন রঙের গরু হত্যা করার বিধান রয়েছে, যাকে গবাময়ন (একাষ্টকা) বলা হত, যেটা মাঘ মাসে চার দিন পালন করা হত। কাত্যায়ন অতিরাত্রে (১৪/২/১১) এ বিষয়টিকে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছেন।
প্রাচীন ভারতে গােহত্যার উল্লেখ ধর্মীয় এবং অন্যান্য সাহিত্য ছাড়াও আয়ুর্বেদের পুস্তকেও পাওয়া যায়। চরকসংহিতায় (চিকিৎসাস্থান, ১৯/৪) লেখা আছেঃ
ততাে দক্ষযজ্ঞপ্রত্যবরকালং মনােঃ পুত্ৰাণাং তরিষ্যন্নাভাগেক্ষাকুনৃগশাৰ্যাত্যাদীনাং চ তুষু ‘পশুনামেবাভ্যনুজ্ঞানাত’ পশাবঃ প্রােক্ষণমাপুঃ… অতশ্চ প্রত্যবরকালং পৃষম্ব্রেণ দীর্ঘসত্রেণ যজতা পশুনামভাবাদ গবালম্ভঃ প্রবর্তিতঃ।
অর্থাৎ, দক্ষযজ্ঞের পর, মনুর নরিষ্য, নাভাগ, ইক্ষাকু, শর্যাতি প্রভৃতি পুত্রেরা ‘বেদে পশু হত্যা করার আদেশ আছে’ এমন মনে করে যজ্ঞে পশুদের প্রােক্ষণ এবং হত্যা করা শুরু করলেন। এর পর দীর্ঘকাল যজ্ঞ করার ফলে পৃষধ্ন অন্য পশুর অভাবে গরু হত্যা করা শুরু করে দিয়েছিলেন।
পারস্কর গৃহ্যসূত্রে (৩/১/২৬, ৩১) অতিথিকে গােঘ্ন (গােহত্যাকারী) বলা হয়েছে। এই শব্দটি সংস্কৃতের প্রাচীন ব্যাকরণ গ্রন্থ অষ্টাধ্যায়ীতেও পাওয়া যায়। পাণিনি একটি বিশেষ সুত্রে লিখেছেনঃ
দাশগােগ্লৌ সম্প্রদানে (অষ্টাধ্যায়ী ৩/8/৭৩)। এর তাৎপর্য হল দাতার্থক দাশ ধাতু থেকে সম্প্রদান অর্থে অচ্ প্রত্যয় হয় এবং কর্মসংজ্ঞক গাে উপপদের সাথে হিংসার্থক হন্ ধাতু থেকে সম্প্রদান অর্থে ক প্রত্যয় হয়।
৬ষ্ঠ অথবা ৭ম শতাব্দীর কাশিকাবৃত্তির লেখক এই সূত্রের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
আগতায় তস্মৈ দাতুং গাং ঘৃন্তীতি গােঘ্নেঅতিথিঃ, নিপাতনসামর্থ্যাদেব গােঘ্ন ঋত্বিগাদিরুচ্যতে, ন তু চাণ্ডালাদি। অসত্যপি চ গােহননে তস্য যােগ্যতয়া গােঘ্নঃ ইত্যভিধীয়তে। [কাশিকাবৃত্তি, প্রথম ভাগ, পৃষ্ঠা ২৭৩-২৭৪, চৌখম্বা সংস্কৃত সিরিজ প্রকাশন, বারাণসী]
অর্থাৎ, ‘গােঘ্ন’ শব্দ এভাবে তৈরি হয়ঃ আগত অতিথিকে দেওয়ার জন্য যেহেতু গাে হত্যা করা হয়, তাই অতিথিকে গােঘ্ন (গাে হত্যাকারী) বলা হয়। পুরােহিতদের আগমনেও গাে হত্যা করা হয়, সুতরাং তাদেরও গােঘ্ন বলা হয়, চণ্ডাল প্রভৃতিকে নয়। গরু যখন হত্যা করা হয় না, তখনও গােঘ্ন বলা হয়, কেননা সে গাে হত্যা করানাের যােগ্য অধিকারী।
পাণিনীর অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের ভাষ্যকার পতঞ্জলির সমকালীন ভারতের অধ্যয়ণ করতে গিয়ে ড. প্রভুদয়াল অগ্নিহােত্রী তার গবেষণাগ্রন্থ ‘পতঞ্জলিকালীন ভারত’ এর ৫৯২ পৃষ্ঠায় গােঘ্ন শব্দের আলােচনা করতে গিয়ে লিখেছেনঃ
‘সমাংস মধুপর্কের অধিকারী প্রায়শই শ্রোত্রিয় (বেদজ্ঞ) বা ঋত্বিক (পুরােহিত) ই হতেন। এদের আগমনে বিশেষত গাভী বা বৃষ হত্যা করা হত এবং এই মাংস দ্বারা তৈরি খাদ্য তাদের দেওয়া হত, এজন্য এই অতিথিদের ‘গােঘ্ন’ বলা হত।… গােহত্যার অধিকারী হওয়ার কারণে শ্ৰোত্রিয়কে ‘গােঘ্ন’ বলা হত।”
চতুর্দশ শতাব্দীর ভট্টোজি দীক্ষিত ‘বৈয়াকরণ সিদ্ধান্ত কৌমুদী’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যা ভারতের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের ছাত্রদের ব্যাকরণের গ্রন্থ হিসাবে পড়ানাে হয়। এর ‘উত্তর কৃদন্ত’ প্রকরণে ‘দাশগােগ্নৌ সম্প্রদানে’ সূত্রটির ব্যাখ্যায় লেখা হয়েছেঃ ‘গাং হন্তি তস্মৈ গৌঘ্নেঅতিথিঃ’ অর্থাৎ, তার জন্য গরুকে হত্যা করা হয়, তাই অতিথিকে গােঘ্ন বলা হয়। প্রায় এই কথাই চার বেদের ভাষ্যকার সায়ণাচার্য তার ‘মাধবীয়া ধাতুবৃত্তিঃ’ তে লিখেছেনঃ
‘গৌর্যস্মৈ দান্ত হন্যতে স গােঘ্নঃ অতিথিঃ’
অর্থাৎ, যাকে দেওয়ার জন্য গাে হত্যা করা হয়, তাকে গােঘ্ন অথবা অতিথি বলা হয়।
স্পষ্টতই, প্রাচীন ভারতে অতিথির জন্য গাে হত্যা করা হত। কিছু লােকেরা এই তিক্ত সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা করে বলে থাকেন, ‘গােঘ্ন’ শব্দের ‘হন’ ধাতুর অর্থ হত্যা করা নয় বরং প্রাপ্ত করা। একথা সমস্ত প্রাচীন পরম্পরা এবং প্রাচীন ব্যাখ্যার বিপরীত তাে বটেই, একথা অযৌক্তিক এবং অনর্থকও। প্রাপ্ত করা মনে করে যদি ‘গােঘ্ন’ শব্দের অর্থ করা হয় তবে তা এমন হবে, যার জন্য গরু প্রাপ্ত করা হয়।
এখন এখানে প্রশ্ন ওঠেঃ কি প্রাপ্ত করা হয়? কার কাছ থেকে প্রাপ্ত করা হয়? কিভাবে প্রাপ্ত করা হয়? অতিথির আগমনে কি মানুষেরা গরু কিনতে চলে যেত? ঘরে প্রথম থেকে থাকা গরুর দুধ দিয়ে কি অতিথি সৎকার করা যেত না? যদি অতিথির জন্য গরুর দুধের ব্যবস্থা করার জন্য গরু প্রাপ্ত করা হত, তাহলে কি প্রাচীন ভারতে সবার কাছে গরু থাকতাে না, যেহেতু অতিথির আগমনে সবার অন্য কারাে কাছ থেকে গরু প্রাপ্ত করার প্রয়ােজন হত? অতিথি না এলেও তাে মানুষেরা গরু আনতাে, গরু প্রাপ্ত করতাে। তখন তাদের কেন ‘গােঘ্ন’ বলা হত না, যদি ‘ঘ’ (হ) এর অর্থ বাস্তবে প্রাপ্ত করা’ ই হত? শুধুমাত্র অতিথিকে কেন গােঘ্ন বলা হত?
‘গােঘ্ন’ এর অর্থ গােহত্যাকারী
দ্বিতীয়ত, অতিথিকে যদি গরুর দুধ দেওয়ার অভিপ্রায়ই থাকতাে, তাহলে তার জন্য বিশেষ করে ‘গােঘ্ন’ শব্দ ব্যবহার করার কি প্রয়ােজন ছিল? যেমনি অতিথিকে জল, খাদ্য, বিছানা এবং অন্যান্য বস্তু দেওয়া হত, তেমনি গরুর দুধ দেওয়াই যদি অভিষ্ট হত তাহলে তার জন্য বিশেষ শব্দ তৈরি হত না, কারণ অন্যান্য জিনিস অতিথিকে দেওয়া হলেও তার বিশেষ কোনাে নাম দেওয়া হয়নি। যদি জলঘু, বিষ্টরঘু, ভােজঘু এমন শব্দ থাকতাে, তাহলে হয়তােবা ‘গােঘ্ন’ শব্দের হন্ ধাতুর অর্থ ‘প্রাপ্ত করা’ এটা আমরা মেনে নিতাম।
এই অবস্থায় এবং প্রাচীন ব্যাখ্যার উপস্থিতিতে ‘গােঘ্ন’ শব্দের অর্থ গােহত্যাকারীই মানা যায়, যার জন্য গরু প্রাপ্ত করা হয় এই অর্থ মানা যায় না।
আলােচক মহােদয় প্রাচীন ভারতে গরুর প্রতি সদ্ভাব প্রমাণ করার জন্য বৌদ্ধ গ্রন্থের ‘সুত্তনিপাতের’ দুটি গাঁথা (স্বামীজী এদের শ্লোক বলেন না) দিয়েছেন এবং বলেছেন, হিন্দু এবং ব্রাহ্মণেরা কখনাে গােহত্যা করেনি।
উপদেশের প্রয়ােজন কেন?
তার দাবী একদমই ভুল। বুদ্ধবচন থেকে এর বিপরীত কথাই জানা যায়। বুদ্ধ গরুকে ভালােবাসতে এবং তাকে না মারতে উপদেশ দিয়েছেন। যদি সেই সময়ে গরুকে আজকের মত সম্মান দেওয়া হত এবং একে হত্যা না করা হত, তাহলে বুদ্ধের এমন উপদেশ দেওয়ার প্রয়ােজন কি ছিল?
দ্বিতীয়ত, বুদ্ধের অহিংসার আদর্শকে নিয়ে হিন্দু এবং ব্রাহ্মণ ধর্মশাস্ত্রকারেরা প্রাণভরে তামাশা করেছিলেন। শঙ্করাচার্য বুদ্ধকে ‘উল্টোপাল্টা কথা বলা পৃথিবীর শত্রু’ বলেছিলেনঃ
সুগতেন স্পষ্টীকৃতমাত্মনােঅসম্বদ্ধপ্রলাপিত্বং প্রদ্বেষাে বা প্রজাসু। (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২/২/৩২)
আরেক হিন্দু ধর্মের উদ্ধারকারী কুমারিল ভট্ট বুদ্ধের অহিংসার উপদেশকে ‘কুকুরের চামড়ায় পড়া দুধের মত ব্যর্থ’ বলেছিলেনঃ
সন্মুলমপি অহিংসাদি শ্বদতিনিক্ষিপ্তক্ষীরবদনুপযােগি। (তন্ত্রবার্তিক)
এখানে এটা বলার আর প্রয়ােজন নেই বুদ্ধের গােহত্যা না করার উপদেশের কেমন গুরুত্ব ধার্মিক হিন্দুরা দিয়েছিলেন!
বুদ্ধের সময় গরুর সাথে কেমন আচরণ করা হত এ সম্বন্ধে নিজে কিছু না বলে বিহার হিন্দি গ্রন্থ একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বুদ্ধকালীন সমাজ অউর ধর্ম’ থেকে উদাহরণ দেওয়া উচিত বলে মনে করছি। এতে লেখা আছে, “যজ্ঞাগ্নিতে অশ্ব, বৃষভ, ষাঁড়, গাভী, ভেড়া প্রভৃতি বিভিন্ন পশুদের আহুতি দেওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় … ‘পালিনিকায়’ এ গােঘাতক, মেষঘাতক, অজঘাতক, শুকরঘাতক, মৃগলুব্ধক, শাকুনিক এবং হত্যাগৃহের উল্লেখ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌছাই যে, সমাজে ব্যাপক হারে মাংসাহারের ফলে সমাজে এমন অনেক পেশার উদ্ভব হয়, যাতে পশুপাখি ধরা, মারা এবং মাংস বিক্রয় করা হত। বৌদ্ধ লেখকেরা তাদের ব্রাহ্মণ বিরােধের কারণ হিসাবে ব্রাহ্মণদের গােহত্যা এবং গােমাংসভক্ষণের অতিরঞ্জিত বিবরণ দিয়েছেন। “পালিনিকায়’ এ গােঘাতক এবং তার শিষ্য, গােহত্যাস্থল এবং গােহত্যায় ব্যবহৃত ছুরির উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যে গােমাংস খাওয়া হত।” [দেখুন, ডা. মদনমােহন রচিত বুদ্ধিকালীন সমাজ অউর ধর্ম, পৃষ্ঠা ৬৮,৭০]
বৌদ্ধ সাহিত্যে এমন অনেক কথা পাওয়া যায় যা থেকে প্রমাণ হয়, প্রাচীন ভারতে শুধু যে গােহত্যা হত তাই নয়, বরং গােমাংসও ভক্ষণ করা হত। ‘মহাবগ্ন’ (৪) এ উল্লেখ আছে, ষড়বর্গীয় ভিক্ষু গােমাংস খেতেন, ‘তিত্তিরজাতক’ (৪৩৮) এ উল্লেখ আছে, এক নিগ্রন্থ (জৈন) সাধু হয়েছিলেন। সেই সাধু গরু, বাছুর এবং গাভী হত্যা করে খেয়েছিলেন। [দেখুন জাতক কালীন ভারতীয় সংস্কৃতি পৃষ্ঠা ২১৫]
নডগুটঠ জাতক (১৪৪) এ ষাঁড় হত্যা করে যজ্ঞ করার কথা পাওয়া যায়।
পণ্ডীত মােহনলাল মহতাে ‘বিয়ােগী’ রচিত ‘জাতককালীন ভারতীয় সংস্কৃতি’ এ উল্লেখ আছে,
“এক ব্রাহ্মণ ছিলেন, যিনি বেদের পরম বিদ্বান ছিলেন। তিনি বনে কুটির বানিয়েছিলেন। সেখানে তিনি অগ্নি স্থাপন করে তাতে হত্যা করা ষাঁড়ের মাংস আহুতি দেওয়ার ইচ্ছা পােষণ করেছিলেন। কিছু শিকারী ব্রাহ্মণের অনুপস্থিতে সেই ষাঁড়কে হত্যা করে খেয়ে ফেলেছিল। ব্রাহ্মণ লবণ আনার জন্য গ্রামের দিকে গিয়েছিলেন। ষাঁড়কে হত্যা করে খাওয়ার জন্য তিনি লবণের ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলেন। অভাগা ব্রাহ্মণের সেই ইচ্ছাও পূর্ণ হল না। ষাঁড়ের হত্যা করে অগ্নি দেবের পূজা করার ইচ্ছা কোনাে বিচিত্র ব্যাপার ছিল না। যেখানে ফল, ফুল, অন্নের চাইতেও মাংস সস্তা হয় এবং সকলেই মাংস খায়, সেখানে ষাঁড়, গাভী, শুকর প্রভৃতির কোনাে মাহাত্ম্য থাকে না।” (পৃষ্ঠা ২১৫)।
পণ্ডিত মহােদয় উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, জাতক কথায় ষাঁড়, গাভী এসব ব্রাহ্মণেরাই হত্যা করতেন। একজন ক্ষত্রিয়ও ষাঁড় অথবা গাভীর হত্যা পূজা অথবা ভােজনের জন্য করেননি, বৈশ্যও করেননি, শূদ্র, চণ্ডালও করেননি। ব্রাহ্মণই ছিলেন জাতক যুগের গােহত্যাকারী বর্ণ। (ঐ, পৃষ্ঠা ২১৬)
মজাদার তথ্য
এই বক্তব্য অনেকটাই সত্য বলে মনে হয়, কেননা গােমেধ যজ্ঞে ব্রাহ্মণরাই পুরােহিতের কাজ করতেন এবং বলির জন্য গরুকে তারাই সংজ্ঞপন [অস্ত্রের আঘাত ছাড়াই পশুর নাক মুখ বন্ধ করে শ্বাস রােধ করে তাকে হত্যা করা] করতেন।
একটি ব্যাপার খুব মজাদার যে, বেদ মান্যকারীরা এবং বেদ অনুসরণ করে গরু প্রভৃতি পশুর বলি প্রদানকারীরা এই হিংসার কাজকে সবসময় অহিংসাই বলে এসেছেন এবং বলিতে পশুহত্যা করে যে পশুর উপর কৃপা করা হয় এমনটাই বলে এসেছেন। বেদের এক। প্রাচীন ভাষ্যকার স্কন্দস্বামী ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রের (১/১/৪) ভাষ্যে লিখেছেনঃ
“যজ্ঞে হি সর্বস্যানুগ্রহাে, ন হিংসা, যেঅপি হি তত্র পশ্বাদয়াে হিংস্যতে তেষামপ্যনুগ্রহমেব শিষ্টা স্মরন্তি- ওষধ্যঃ পশবাে বৃক্ষাস্তিংচঃ পক্ষিণস্তথা। যজ্ঞার্থ নিধনং প্রাপ্তাঃ প্রাপ্নুবংত্যুচ্ছিতীঃ পুনঃ … তস্মাদুপপন্নং হিংসাবর্জিতত্বম্।”
অর্থাৎ, যজ্ঞের দ্বারা সকলেরই মঙ্গল হয়, কারাের হিংসা হয় না। যেসব পশুদের হত্যা করা হয়, তাদেরও মঙ্গলই হয়ে থাকে। পূর্বপুরুষেরা বলেছেন, “যেসব ঔষধি, পশু, বৃক্ষ, পক্ষী প্রভৃতি যজ্ঞে মারা যায়, তারা উচ্চগতি লাভ করে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যজ্ঞে করা হিংসা হল অহিংসা।
মনুও এই কথাই বলেছিলেনঃ
বৈদিকী হিংসা, হিংসা ন ভবতি। অর্থাৎ বেদ অনুসারে যে হিংসা করা হয়, তাকে হিংসা বলা হয় না।
স্বামী করপাত্রী তার বিশালকায় গ্রন্থ ‘বেদার্থ পরিজ্ঞাত’ এ লিখেছেনঃ
যাজ্ঞিকপশুবধােঅপি পশুনাং স্বর্গপ্রাপকত্বান পশুযােনিনিবারণপূর্বকহিরণ্যশরীরপ্রাপ্তিহেতুত্বান্ পশুপরকারক এব। (…) যজ্ঞে পশুনামুপযােগস্তু পশুকল্যাণায় ভবতি (…) যস্মাত্ পশুরপকৃষ্টযােনেৰ্বিমুক্তো দেবযােনৌ জায়তে। [বেদার্থপারিজাত, ভাগ ২, পৃষ্ঠা ১৯৭৭-১৯৭৮]
অর্থাৎ, যজ্ঞে করা পশুবধ পশুদের জন্য স্বর্গপ্রদায়ী এবং পশুরা পশুযােনি নিবারণ করে দিব্যশরীর লাভ করার ফলে এতে পশুদের উপকারই হয়। যজ্ঞীয় পশু অপকৃষ্ট যােনি থেকে মুক্ত হয়ে দেবযােনি লাভ করে।
শঙ্করাচার্য জয়েন্দ্র সরস্বতী এবং স্বামী করপাত্রী যজ্ঞীয়পশু সম্বন্ধে যা কিছু বলেছেন, তা শাস্ত্র অনুসরণ করেই বলেছেন, এসব কথা কপােলকল্পিত নয়। মনু বলেছেনঃ
ওষধ্যঃ পশবাে বৃক্ষাস্তির্যংচঃ পক্ষিণস্তথা। যজ্ঞার্থ নিধনং প্রাপ্তাঃ প্রাপ্নবসৃতীঃ পুনঃ।।
মনুস্মৃতি ৫/৪০
অর্থাৎ যজ্ঞের জন্য মৃত্যুবরণ করা ঔষধী (ব্রিহী প্রভৃতি), পশু (ছাগ প্রভৃতি), বৃক্ষ, তির্যক (কচ্ছপ প্রভৃতি) এবং পক্ষী পরবর্তী জন্মে উচ্চ যােনি লাভ করে।
শুধু তাই নয়, মনুর আদেশ অনুসারে মধুপর্ক, যজ্ঞ, শ্রাদ্ধ এবং দেবকার্যে পশু বধ করা উচিতঃ
মধুপর্কে চ যজ্ঞে চ পিতৃদৈবতকর্মণি,
অত্রৈব… পশবাে হিংস্যা…
মনুস্মৃতি ৫/৪১
অর্থাৎ, মধুপর্ক, যজ্ঞ, পিতৃকার্য (শ্রাদ্ধ) এবং দেবকার্য এর জন্য পশু বধ করা উচিত।
অনেক লােক বলেন যে, যজ্ঞের জন্য ব্যবহৃত শব্দ ‘অধ্বর’ এর অর্থ যেহেতু হিংসারহিত সুতরাং যজ্ঞে কিভাবে গরু প্রভৃতি পশুকে হিংসা করা হয়ে থাকতে পারে?
এই কথাটি সত্য নয়। ‘অধ্বর’ শব্দের যে ব্যুৎপত্তি তারা প্রায়শই সামনে এনে থাকেন তা নিরুক্তকার যাস্ক শতপথব্রাহ্মণ হতে অসম্পূর্ণ ভাবে তার নিরুক্তে উদ্ধৃত করেছেন। তাই এই ব্যুৎপত্তি ভ্রমাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যজ্ঞে হিংসা হত না। কিন্তু যখন আমরা শতপথ ব্রাহ্মণে দেওয়া সম্পূর্ণ ব্যুৎপত্তি দেখি তখন স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে ‘অধ্বর’ শব্দের ব্যুৎপত্তিতে প্রযুক্ত হিংসার সাথে যজ্ঞে হওয়া হিংসার কোনাে সম্পর্ক নেই বরং যজ্ঞকর্তাদের উপর করা হিংসার সাথে এর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণে ‘অধ্বর’ শব্দের ব্যুৎপত্তি দিয়ে বলা হয়েছেঃ দেবানহ বৈ যজ্ঞেন যজমানাৎসপত্না অসুরা দুধূর্ষাংচক্রুঃ। তে দুধূর্ষন্ত এব ন শেকুষ্ঠুর্বিতুং তে পরাবভূবুস্তস্মাদ্ যজ্ঞােঅধ্বরাে নাম। (শতপথ ব্রাহ্মণ ১/৪/১/৪০)
অর্থাৎ, যখন দেবতারা যজ্ঞ করছিলেন তখন তাদের শত্রু অসুরেরা সেই যজ্ঞকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল কিন্তু ধ্বংস করার ইচ্ছা করেও তারা ধ্বংস করতে পারেনি। তারা হেরে গিয়েছিল, তাই যজ্ঞের নাম অধ্বর হল।
এখান থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, অধ্বরকে যে কারণে অধ্বর বলা হত তা হল, যজ্ঞকর্তাদের হিংসা করা সম্ভব হয়নি। এর সাথে যজ্ঞে করা হিংসার (পশুহত্যা প্রভৃতির) কোনাে সম্পর্ক নেই।
সপ্তম শতাব্দীর ভাষ্যকার স্কন্দস্বামী বলেন, অধ্বরকে অধ্বর বলার কারণ হল, যজ্ঞে করা হিংসা আসলে হল যজ্ঞে মৃত পশুদের প্রতি অনুগ্রহ। তাই এটা হিংসা নয় বরং অহিংসাঃ
ধ্বরণং ধ্বরাে হিংসা যস্মিন্নাস্তি সােঅধ্বরঃ। যেঅপি হি তত্র পশবাদয়াে হিংস্যংতে তেষামণ্যনুগ্রহমেব শিষ্টাঃ স্মরন্তি। তস্মাদুপপন্নং হিংসাবর্জিতত্বম।
অর্থাৎ ধ্বরণ বা ধ্বর এর অর্থ হল- হিংসা, যজ্ঞে তা হয় না বলে, তাকে অধ্বর বলা হয়। যজ্ঞে যে সকল পশুকে হত্যা করা হয় শিষ্ট লােকেরা তাদের মৃত্যুকে তাদের প্রতি অনুগ্রহ বলে থাকেন। এভাবে হিংসার অভাবের কারণে যজ্ঞকে অধ্বর (হিংসারহিত) বলা হয়। (ঋগ্বেদ ১/১/৪ এর স্কন্দভাষ্য)
এখানে হিংসাকে অনুগ্রহ বলে ভাষ্যকার অত্যন্ত নিষ্ঠুর তামাশা করেছেন। তিনি পশুর হত্যাকে (হিংসাকে) অহিংসা বানিয়ে যজ্ঞকে অধ্বর (হিংসারহিত) সিদ্ধ করে দিয়েছেন। তাই তাে বলেছেনঃ
তস্মাদুপপন্নং (এভাবে সিদ্ধ হয়ে গেল) হিংসাবর্জিতত্বম (তার হিংসারহিত হওয়া) !
চার বেদের ভাষ্যকার সায়ণাচার্যও অধ্বর এর ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, যজ্ঞকে অধ্বর বলার কারণ হল রাক্ষস প্রভৃতিরা একে হিংসা করতে পারে না, অর্থাৎ তাকে নষ্ট করতে পারে নাঃ অধ্বরং হিংসারহিত। ন হ্যগ্নিনা সর্বতঃ পালিতং যজ্ঞং রাক্ষসাদয়াে হিংসিতুং প্রভবংতি। (ঋগ্বেদ ১/১/৪ এর সায়ণভাষ্য)
অর্থাৎ অধ্বর বা যজ্ঞকে হিংসারহিত বলার কারণ হল সর্বদিক থেকে অগ্নি দ্বারা সুরক্ষিত যজ্ঞকে রাক্ষস প্রভৃতিরা হিংসা করতে সমর্থ হয় না।
এভাবে আমরা দেখতে পাই ‘অধ্বর’ শব্দের তিনটি ব্যুৎপত্তির দুটিতে এতে হওয়া হিংসার সাথে কোনাে সম্পর্ক পাওয়া যায় না। একটি ব্যুৎপত্তিতে যেখানে যজ্ঞে হওয়া হিংসার কথা বলা হয়েছে সেখানে সেই হিংসাকে অহিংসা বলে যজ্ঞের অধ্বর নাম সিদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং নিরুক্তে উল্লেখিত “অধ্বর” শব্দের অসম্পূর্ণ অর্থ দিয়ে যজ্ঞে যে হিংসা হত না তা প্রমাণ করা যায় না, যজ্ঞে হওয়া মূক পশুদের হত্যাকে অস্বীকার করা যায় না। হাজার বছর ধরে যজ্ঞের বলিবেদীতে এসবই করা হয়েছে।
কিছু লােক বলেন যে, বেদ স্পষ্ট শব্দে আদেশ দিচ্ছেনঃ
স্বধিতে মৈনং হিংসীঃ। অর্থাৎ হিংসা করাে না। এমতাবস্থায় যজ্ঞে কিভাবে হিংসা হতে পারে?
এই কথাটি সঠিক নয়। বেদের ব্যাখ্যাকার যাস্ক পর্যন্ত এই কথার খণ্ডন করেছেন, যা এরা এখন বলছেন। তিনি বলেছেন, উক্ত মন্ত্রের প্রয়ােগ কুঠার চালানাের সময়, হিংসা করার সময় করা হয়। যখন হিংসা করার জন্য হাতে কুঠার নিয়ে কারাে উপর চালানাে হয়, তখন এই মন্ত্র পাঠ করা হয়। কিন্তু আমরা একে হিংসা বলতে পারি না, কারণ বেদের দৃষ্টিতে এটা অহিংসাঃ আয়বচনাদহিংসা প্রতীয়েত। (নিরুক্ত ১/১৬)
এমনই আরেকটি মন্ত্র আছে, যেটা হিংসা করার সময় পাঠ করা হত, কিন্তু তার অর্থ কৃতকর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত। সেটি হলঃ ওষধে ব্রায়স্বৈনম্। (দেখুন তৈত্তিরীয়সংহিতা ১/২/১, ১/৩/৫, ৬/৩/৩, ৬/৩/৯ ; মৈত্রায়ণীসংহিতা ১/২/১, ৩/৬/২, ১/২/১৪, ৩/৯/২, ১/২/১৬, ৩/১০/১; শুক্ল যজুর্বেদ ৪/১, ৫/৪২, ৬/১৫) এর অর্থ, “হে কুশা ঘাসের খড়, একে রক্ষা করাে।” কিন্তু এই মন্ত্রটি কেশ কর্তন করার সময় পাঠ করা হয়। যজ্ঞে বলির পশুকে বাধার জন্য যুপ তৈরির বৃক্ষকে কাটার সময়, পশুর পেট চিরে ফেলার সময় এই মন্ত্রটি পাঠ করা হয়। এই বিষয়ে আপস্তম্ভ প্রভৃতি শ্ৰৌতসূত্র দেখা যেতে পারে। মীমাংসা-শাবরভাষ্যম এর যুধিষ্ঠির মীমাংসক কৃত হিন্দি ব্যাখ্যার ১৮৯ পৃষ্ঠায়ও দেখা যেতে পারে।
কিছু লােক বলেন, ‘আলম্ভ’ শব্দের অর্থ হত্যা করা নয়, বরং স্পর্শ করা। সুতরাং গবালম্ভ যজ্ঞে গরুর হত্যা করা হত না বরং তাকে কেবল ছোঁয়া হত। এ কথাটি ভুল। চরক সংহিতায় (১৯/৪) ‘আলম্ভ’ শব্দটি পাওয়া যায় এবং সেই শব্দটিও পাওয়া যায়, যার অর্থ স্পর্শ করা। এই দুটো শব্দকে একই স্থানে পাওয়া যায় বলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে যায়ঃ আদিকালে খলু যজ্ঞেষু পশাবঃ সমালভনীয়া বভূবুঃ, নালস্তায় প্রক্রিয়ন্তে স্ম। অর্থাৎ, আদিকালে যজ্ঞে নিশ্চয় পশুদের সমালভন (স্পর্শ) করা হত। তা আলস্তনের (হিংসা বা হত্যার) জন্য আসলে করা হত না।
এখান থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ‘আলভ এবং ‘আলম্ভন’ দুটো ভিন্ন শব্দ। প্রথমটির অর্থ স্পর্শ করা, দ্বিতীয়টির অর্থ হত্যা করা। কিন্তু শীঘ্রই আলভ শব্দ এবং আলস্তু শব্দের অর্থ মিলেমিশে গিয়েছিল। তাই ব্যাখ্যাকারেরা আলভ এবং আলম্ভ শব্দের একই অর্থ (হত্যা অথবা) হিংসা করেছিলেন।
প্রসিদ্ধ আর্যসমাজী পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক লিখেছেন,
“উত্তরকালে যখন লম্ভ এর অধিকাংশ প্রয়ােগ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তখন পাণিনি প্রভৃতি ব্যাকরণবিদেরা লম্ভ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ভাষায় অল্পাবশিষ্ট প্রয়ােগের লভ ধাতুতে তুম প্রত্যয়ের আগম করে ব্যাখা করে দিয়েছিলেন। এই ধাতু-এক্যকল্পনার কারণে আলম্ভ ধাতুর যে অর্থ ছিল, সেটা আলভের মনে হওয়া শুরু হয়েছিল। আর এই কারণে উত্তরকালে ‘আলভতে’ (স্পর্শ করে থাকে), ‘আলভেত’ (স্পর্শ করে) পদের অর্থ ‘আলতং কুর্যাত’ (হিংসা করে) করা শুরু হয়েছিল।“ (শ্রৌতযজ্ঞমীমাংসা, পৃষ্ঠা ১৮৩)।
এই আলােচনা থেকে বােঝা যায় , ‘আলম্ভ’ এর অর্থ কেবলই যে হিংসা (হত্যা) ছিল তাই নয়, বরং এর অর্থ অতি প্রাচীন কাল থেকেই ‘স্পর্শ করা’ অর্থবাচক আলভ শব্দের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিল। সুতরাং আলম্ভ শব্দের অর্থ যে স্পর্শ করা তা একেবারেই তথ্যনিষ্ঠ নয়।
কিছু লােকের কথা হল, গাভীর জন্য ‘অগ্ন্যা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। ‘অগ্ন্যা’ শব্দের অর্থ হল হত্যার অযােগ্য। সুতরাং যজ্ঞ প্রভৃতিতে গরুর বলি দেওয়া হত না।
তথ্যের আলােকে এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্য বলে প্রমাণিত হয় না। এটা সত্য যে গাভী বােঝাতে ‘অগ্ন্যা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। ‘অগ্ন্যা’ শব্দের একটি অর্থ হত্যা করার অযােগ্য। কিন্তু এটাই সম্পূর্ণ সত্য নয়। নিরুক্তে (১১/৪৩)‘অগ্ন্যা’ শব্দের অর্থ পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে ‘অগ্ন্যা’ শব্দের একটি নয় বরং দুটি অর্থ পাওয়া যায়ঃ অগ্ন্যাঅহন্তব্যা ভবত্যঘষ্ণীতি বা। অর্থাৎ অগ্ন্যা এর অর্থ- হত্যা করার অযােগ্য অথবা পাপনাশিনী।।
স্পষ্টতই, অগ্ন্যা শব্দের অর্থ প্রদানকারী যাস্ক এর কেবল একটি অর্থকেই মানতেন না। তিনি অনুমান করে এর দুটি অর্থ দিয়েছেন। সুতরাং তার অহন্তব্যা (হত্যার অযােগ্য) অর্থকেই সামনে আনা এবং দ্বিতীয় অর্থ – পাপনাশিনীকে লুকানাে কি বৌদ্ধিক ছলনা নয়?
ঋগ্বেদ (১/১৬৪/৪০) এ কয়েকজায়গায় গাভীর স্থলে ‘অগ্ন্যা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও যজ্ঞে বা যজ্ঞের বাইরে এর হিংসায় নিষেধ করা হয়নি। এক স্থানে বলা হয়েছেঃ অদ্ধি তৃণমঘ্নে বিশ্বদানীং পব শুদ্ধমুদমাচরন্তী। অর্থাৎ, হে অঘ্নে (গাভী) , ঘােরার সময় তুমি সদা ঘাস এবং শুদ্ধ জল খেয়াে।
এখানে গরুকে ঘাস খাওয়ার এবং শুদ্ধ জল পান করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। তাকে হত্যা এবং তাকে হিংসা না করার কথা এখানে বলা হয়নি।
দুহামশ্বিভ্যাং পয়াে অস্ন্যেয়ং (ঋগ্বেদ ১/১৬৪/২৭) অর্থাৎ, এই অদ্মা (গাভী) অশ্বিনীদের জন্য দুধ দিক। এখানে গাভীকে দুধ দিতে প্রার্থনা করা হয়েছে। এখানেও তার হিংসায় নিষেধ করা হয়নি।
কিছু লােকেরা যজুর্বেদ এর ১৩ অধ্যায় এর ৪৩ তম মন্ত্র দেখিয়ে বলে যে, এখানে গরুকে হিংসা করতে নিষেধ করা হয়েছে।
তাদের এই দাবী সম্পূর্ণ ভুল, কারণ এখানে মানুষদের করা গােহত্যায় নিষেধ করা হয়নি। এখানে তাে কেবল অগ্নি দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে যে তিনি যাতে গাভীকে গ্রাস না করেন, তাকে না পােড়ান, তার হত্যা না করেনঃ
অগ্নিমীডে পূর্বচিত্তিং নমােভিঃ…
… গাং মা হিংসীরদিতিং বিরাজম্।
-যজুর্বেদ ১৩/৪৩
অর্থাৎ, হে অগ্নি, আমি বার বার মনের দ্বারা পূজা করছি। তুমি বিরাজ (দুধ রূপ প্রকাশ দানকারী) গাভীকে হিংসা করাে না।
একই ধরণের কথা এই অধ্যায়ের ৪৯ তম মন্ত্রেও বলা হয়েছেঃ
ঘৃতং দুহানামদিতিং জনায়াগ্নে মা হিংসী…
-যজুর্বেদ ১৩/৪৯
অর্থাৎ, হে অগ্নি মানুষের জন্য ঘৃতের দোহনকারী অদিতিকে (গাভীকে) আপনি হিংসা করবেন না।
এই ধরণের প্রার্থনাকে গােবধের নিষেধাজ্ঞা বলা যায় না। তাই এসবের উপর ভিত্তি করে এটা বলা যায় না যে, বেদ গােবধে নিষেধ করে। এর বিপরীতে ঋগ্বেদের নিম্নলিখিত মন্ত্রে গােবধকে শত্রুবধের উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যার দ্বারা বােঝা যায় গােবধ কতটা প্রচলিত ছিল! কারণ সকারাত্মক উপমা প্রসিদ্ধ, সর্বজ্ঞাত এবং প্রচলিত প্রথাসমূহ থেকেই দেওয়া হয়ে থাকে, প্রতিবন্ধিত এবং নিন্দনীয় জিনিস থেকে নয়।
ঋগ্বেদ বলছেঃ
মিত্রক্রুবাে যচ্ছসনে ন গাবঃ পৃথিব্যা আপৃগমুয়া শয়ন্তে।।
-ঋগ্বেদ ১০/৮৯/১৪।
অর্থাৎ যেমন গােহত্যা স্থানে গাভীদের কাটা হয়, তেমনি তােমার এই অস্ত্র দ্বারা নিহত হয়ে মিত্রদ্বেষী রাক্ষসেরা পৃথিবীতে পড়ে অনন্ত নিদ্রায় শয়ন করে।
স্পষ্টতই, এখানে কোনাে নায়ক অথবা বীরের সম্বন্ধে প্রশংসামূলক কথা বলা হয়েছে। এখানে লােকপ্রচলিত এবং লােক অনুমােদিত কাজেরই উপমা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বােঝা যায়, গােবধ একটি সামান্য এবং সর্ববিদিত বিষয় ছিল।
কিছু লােক অথর্ববেদের তথ্যসূত্র দিয়ে বলেন এতে গােবধকারীকে সীসার গুলি দ্বারা বিদ্ধ করতে বলা হয়েছে।
কিন্তু তথ্যের সাথে তাদের দাবী সঙ্গতিপূর্ণ নয় কারণ ওই মন্ত্রে কেবল গাভীর কথা বলা হয়নি বরং ঘােড়া এবং পুরুষের কথাও বলা হয়েছে। সেখানে এটাও বলা হয়েছে, যে ‘আমাদের’ গাভী, ‘আমাদের’ ঘােড়া এবং আমাদের লােককে হত্যা করে তাকে সীসার গুলি দিয়ে বিদ্ধ করবােঃ
যদি নাে গাং হংসি যদ্যশ্চং যদি বা পুরুষম
তং ত্বা সীসেন বিধ্যামাে যথা নােহসাে অবীরহা।
-অথর্ববেদ ১/১৬/৪
অর্থাৎ, যদি তুমি আমাদের গাভী, ‘আমাদের’ ঘােড়া, আমাদের লােকেদের মারাে, তাহলে তােমাকে সীসার গুলি দিয়ে বিদ্ধ করবাে, যাতে তুমি আমাদের বীরদের নষ্ট করতে না পারাে।
এটা আসলে গােবধের নিষেধ নয়, বরং নিজের সম্পত্তি বাঁচানাের জন্য হুমকিমাত্র। এর দ্বারা গােহত্যাকারীদের সীসার গুলি দ্বারা বিদ্ধ করে হত্যা করার কথা প্রমাণিত হয় না; বরং এটা প্রমাণিত হয় যে, যারা আমাদের গাভীকে হত্যা করবে, ‘আমাদের’ ঘােড়াকে হত্যা করবে, আমাদের মানুষদের হত্যা করবে, তাদের আমরা সীসার গুলি দ্বারা বিদ্ধ করবাে। যদি কেউ ‘আমাদের’ গাভীকে, ‘আমাদের’ ঘােড়াকে , আমাদের মানুষদের মেরে অন্য কারাে গাভী, ঘােড়া ও মানুষকে হত্যা করে তাহলে? তখন স্পষ্টতই কিছু করার আদেশ দেওয়া হয় নি। বেদে কেবল কারাে নিজের সম্পত্তির ক্ষতি হওয়ার ফলে তার ক্রোধের অভিব্যক্তি রয়েছে। এর দ্বারা না প্রমাণ হয় তখন গােহত্যা হত না, না প্রমাণ হয় তখন গােহত্যায় নিষেধাজ্ঞা ছিল।
যদি এটা বলা হয়, গাভী অবধ্যা (অহন্তব্যা) হওয়ার কারণে তাকে হত্যাকারীকে গুলি দ্বারা বিদ্ধ করার হুমকি দেওয়া হয়েছে, তবুও লাভ হবে না। এখানে তাে আমাদের ঘােড়াকে হত্যাকারীকেও গুলি দ্বারা বিদ্ধ করতে বলা হয়েছে। তাহলে কি ঘােড়া আর গরু এক সমান? তাহলে কি ঘােড়া দেবতা?
আসলে উপরে যে ক্রোধ প্রকাশিত হয়েছে, তা তখনও দেখা যায় যখন এমন কিছুর ক্ষতি করা হয় যা অবধ্য (অহন্তব্যা) নয়। মুরগীপালকেরা মুরগী পালন করে থাকেন যাতে মানুষেরা মুরগীকে কিনে কেটে খেতে পারে। তারা প্রথম দিন থেকেই ব্যাপারটি জানেন যে, মুরগীকে হত্যা করানাের জন্যই আমরা তার উৎপাদন করছি। কিন্তু যদি
কোনাে চোর সেই মুরগি চুরি করে, যদি কেউ অকারণে সেই মুরগিকে হত্যা করে, যদি কোনাে কুকুর মুরগিকে মেরে খেয়ে ফেলে, তাহলে তার মালিক চোর, হত্যাকারী অথবা কুকুরকে গুলি মারার জন্য প্রস্তুত হয়ে যেতে পারেন এবং তার মুখ থেকে অথর্ববেদের উক্তির মতই কথা বের হতে পারে। কিন্তু তার এই কথা শুনে কি এটা মনে করার কোনাে প্রয়ােজন আছে যে, তার ক্রুদ্ধ হওয়ার কারণ হল মুরগি অষ্যা (অহন্তব্যা হত্যার অযােগ্য)?
মুরগি বধের অযােগ্য, না তার হত্যায় কোনাে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বরং বিক্রি হওয়ার পর তার মৃত্যু একপ্রকার সুনিশ্চিত। কিন্তু তারপরেও মালিকের অনুপস্থিতিতে যদি মুরগিকে অন্য কেউ হত্যা করে, তাহলে তার মালিক ক্রুদ্ধ হন, যেহেতু তার সম্পত্তি এর ফলে নষ্ট হয়েছে। পূর্বে উদ্ধৃত অথর্ববেদের মন্ত্রে একই ধরণের বিষয়ে বলা হয়েছে। সুতরাং এর দ্বারা কোনােভাবেই গােবধের নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত হয় না।
কিছু লােক বলেন যে, বেদে সকল প্রকারের হিংসায় নিষেধ করা হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে তারা নিচে উদ্ধৃত মন্ত্রাংশগুলাে দিয়ে থাকেনঃ
১) ইমং মা হিংসীৰ্দিপাদং পশু। (যজুর্বেদ ১৩/৪৭)।
অর্থাৎ দ্বিপদযুক্ত পশুদের প্রতি হিংসা করাে না।
২) ইমং মা হিংসীরেকশফং পশুম্। (যজুর্বেদ ১৩/৪৮)
অর্থাৎ, এক ক্ষুরযুক্তকে (ঘােড়াকে) হিংসা করাে না।
৩) ঘৃতং দুহানামদিতিং জনায়াগ্নে মা হিংসীঃ … (যজুর্বেদ ১৩/৪৯)
অর্থাৎ, ঘৃত দোহন করা গরুর প্রতি হিংসা করাে না।
৪) মা হিংসীঃ উষ্ট্রমারণ্যম (যজুর্বেদ ১৩/৫০)
অর্থাৎ, বন্য উটেদের হিংসা করাে না।
এই চারটি মন্ত্রকে অসম্পূর্ণ ভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য। যদি সম্পূর্ণ মন্ত্রকে পড়া হয় তাহলে বােঝা যায়, বাস্তবে এখানে পক্ষপাতদুষ্ট কথা বলা হচ্ছে। এখানে যদি একজনের প্রতি হিংসা না করতে বলা হয়ে থাকে তাহলে, অন্যের প্রতি হিংসা করার প্রার্থনাও এখানে করা হয়েছে এবং এ কাজের প্রেরণাও এখানে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এখানে মানুষের দ্বারা করা হিংসার কথা বলা হয় নি বরং অগ্নির দ্বারা করা হিংসা থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। এখানে দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে, কোনাে বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা এখানে আরােপ করা হয়নি।
প্রথম মন্ত্রটি দেখুনঃ
ইমং মা হিংসীর্দ্বিপাদং পশুং সহস্রাক্ষো মেধায় চীয়মানঃ,
ময়ুং পশুং মেধ্যমগ্নে জুষস্ব তেন চিদানস্তম্বাে নিষীদ,
ময়ুং তে শুগৃচ্ছতু যং দ্বিম্মস্তং তে শুগৃচ্ছতু।
-যজুর্বেদ ১৩/৪৭।
অর্থাৎ, হে অগ্নি আপনি দ্বিপদী এবং পশুদের প্রতি হিংসা করবেন না। আপনি সহস্র চক্ষু সম্পন্ন। আপনাকে যজ্ঞে আহ্বান করছি। আপনি অন্নের বৃদ্ধি করুন। পশুদের বৃদ্ধি করুন। আপনি আমাদের বৈভব প্রদান করুন, আমরা যাতে সুখী জীবনযাপন করতে পারি। আপনার ক্রোধ সেই মানুষকে ধ্বংস করুক, যে আমাদের দ্বেষ করে।
এখানে দুটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমটি হল, এখানে অগ্নি দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে যাতে তিনি ‘ইমং’ (আমাদের এই) দ্বিপদী এবং পশুদের রক্ষা করেন। এখানে নিজেদের মানুষদের এবং পশুদের বাঁচানাের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে, সকল মানুষ এবং সকল পশুদের জন্য এখানে প্রার্থনা করা হয়নি। আর এখানে নিষেধাজ্ঞা আরােপ করা হয়নি, বরং প্রার্থনা করা হয়েছে। তাই একে বিধানমূলক বলে মনে করা যায় না।
দ্বিতীয়ত, এই মন্ত্রটি অহিংসাবাদী নয়, বরং হিংসাবাদী; কারণ শেষ অংশে তাদের নষ্ট করতে প্রার্থনা করা হয়েছে যারা ‘আমাদের’ দ্বেষ করে, সে মানুষ হােক বা পশু। সুতরাং এই মন্ত্রে হিংসার নিষেধ প্রমাণিত হয় না।
দ্বিতীয় মন্ত্র দেখুনঃ
ইমং মা হিংসীরেকশফং পশুং কনিক্ৰদং বাজিনং বাজিনেষু,
গৌরমারণ্যমনু তে দিশামি তে দিশামি তেন চিন্বানস্তম্বাে নিষীদ,
গৌরং তে শুগৃচ্ছতু যং দ্বিম্মস্তং শুগৃচ্ছতু।
-যজুর্বেদ ১৩/৪৮
অর্থাৎ, হে অগ্নি, আপনার ঘােড়া অত্যন্ত গতিশীল। সে হিনহিনিয়ে নিজের স্ফূর্তি প্রদর্শন করে। আপনি আমাদের এই ঘােড়ার প্রতি হিংসা করবেন না, আপনি বন্য পশুদের উত্যক্ত করুন। আপনি নিজের জ্বালায় শরীরকে বর্ধিত করুন। আমরা যাদের দ্বেষ করি, আপনার ক্রোধ তাকে পীড়িত করুক।
এখানেও নিজের ঘােড়াকে বাঁচানাের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে, সব পশুদের বাঁচানাের জন্য প্রার্থনা করা হয়নি। এখানে তাে অন্য পশুদের প্রতি অগ্নি দেবতাকে হিংসক হতে বলা হয়েছে। এখানে তাে পুরােপুরি হিংসার কথাই বলা হয়েছে।
এখানে নিজের পশুদের রক্ষা করার কথা বলা, প্রাণী বা পশুদের প্রতি দয়া বলে বিবেচিত হতে পারে না, বরং স্বার্থবশতঃ নিজের সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য এখানে প্রার্থনা করা হয়েছে।
শেষে আবার তাদের বিনষ্ট করতে বলা হয়েছে, যাদের সাথে বিরােধ আছে, যাদের প্রতি দ্বেষ আছে। এটা এক সঙ্কীর্ণ ব্যক্তির প্রার্থনা, যে স্বার্থের বাইরে না দেখতে পারে, না ভাবতে পারে। এসব কথা ‘সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ’ হতে শত ক্রোশ দূরে। সুতরাং এই মন্ত্রটি হিংসায় নিষেধ করে না এবং অহিংসার প্রচার করে না।
এখন তৃতীয় মন্ত্রটি দেখা যাকঃ
ইমং সহস্রং শতধারমুৎসং ব্যচ্যমানং সরিরস্য মধ্যে,
ঘৃতং দুহানামদিতিং মা হিংসীঃ পরমে ব্যোমন,
গবয়মারণ্যমনু তে দিশামি তেন চিন্বানস্তম্বাে নিষীদ,
গবয়ন্তে শুগৃচ্ছতু যং দ্বিম্মস্তং তে শুগৃচ্ছতু।
-যজুর্বেদ ১৩/৪৯।
অর্থাৎ, হে অগ্নি, আমাদের এই গাভী সহস্র ধারার মূল স্রোত। সে শরীরের মধ্যে ঘি নিঃসরণ করে। পরম ব্যোমে অবস্থান করে। আপনি এই গাভীর প্রতি হিংসা করবেন না, বন্য বৃষ, নীলগাই প্রভৃতি অন্য পশুদের প্রতি আপনি হিংসা করুন। আপনি নিজের শরীরকে বৃদ্ধি করে পশুদের (গবয়= নীল গাই) সাথে বিরাজ করুন, যাদের আমরা দ্বেষ করি। তাদের প্রতি আপনি আপনার ক্রোধ প্রকট করুন।
এখানে নিজেদের গাভীকে বাঁচানাের জন্য অগ্নির কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। শেষে উল্লেখিত পশু কিংবা গরুদের প্রতি এখানে কোনাে সদ্ভাব দেখা যায় না। উল্টোদিকে বন্য পশুদের- গবয়দের (নীল গাই প্রভৃতির) প্রতি অগ্নিকে উস্কে দেওয়া হয়েছে, যাতে অগ্নি তাদের ধ্বংস করেন। একইভাবে তাদেরও ধ্বংস করতে বলা হয়েছে যাদের সাথে বিরােধ রয়েছে।
চতুর্থ এবং শেষ মন্ত্রটি হলঃ
ত্বষ্ট্রঃ প্রজানাং প্রথমং জনিমগ্নে মা হিংসীঃ পরমে ব্যোমন,
উষ্ট্রমারণ্যমনু তে দিশামি তেন চিদানস্তম্বাে নিষীদ,
উষ্ট্রং ত্ব শুগৃচ্ছতু যং দ্বিম্মস্তং তে শুগৃচ্ছতু।
-যজুর্বেদ ১৩/৫০।
অর্থাৎ, হে অগ্নি, আপনি সর্বপ্রথম উৎপন্ন হয়েছেন। আপনি পরম ব্যোমে অবস্থান করেন। আপনি আমাদের হিংসা করবেন না। বন্য উটেদের নির্দেশ করছি, আপনি তাদের দ্বারা নিজের শরীরের বর্ধিত করুন। আপনি সেই উট এবং মানুষদের প্রতি ক্রোধ করুন, যাদের আমরা দ্বেষ করি।
যা দাবী করা হয়েছে, এই মন্ত্রে এর সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলা হয়েছে। দাবী করা হয়েছে যে, এখানে বন্য উটকে হিংসা না করতে বলা হয়েছে কিন্তু বন্য উটদের হিংসা করার কথা এখানে পাওয়া যাচ্ছে। এ দাবী হয় অজ্ঞানতাবশত করা হয়েছে, নতুবা নিজের কথাকে প্রমাণ করার জন্য জেনে শুনে মিথ্যা বলা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই বিষয়টি নিন্দনীয়।
আমরা দেখলাম চারটি মন্ত্রের কোনােটিতে সকল প্রাণীদের প্রতি হিংসা না করার কথা বলা হয়নি, কোনাে বিশেষ প্রাণি হত্যায় নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়নি। এখানে যদি কোনাে পশুকে (গাভী, ঘােড়া প্রভৃতিকে) রক্ষা করার কথা বলা হয়ে থাকে, তার কারণ হল এরা বক্তার নিজস্ব সম্পত্তি। সুতরাং এর উপর ভিত্তি করে বলা যায় না যে, গােবধে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এখানে বরং নিজের সম্পত্তির আওতাভুক্ত পশুদের ছেড়ে অন্যান্য পশুদের হত্যা করার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
কিছু লােক বলেন, জৈমিনি রচিত মীমাংসা দর্শন যাকে পূর্বমীমাংসাও বলা হয়ে থাকে, তাতে যজ্ঞে হিংসা, বলি ইত্যাদি সম্বন্ধে সকল সন্দেহ দূর করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আমার তা পড়া উচিত।
এ বিষয়ে আমি বলবাে, মীমাংসা দর্শনের উপলব্ধ প্রাচীনতম ভাষ্য শাবরভাষ্যে শবর লিখেছেন, যজ্ঞে যে পশু বিহিত অর্থাৎ যে পশুর যজ্ঞে বিধান আছে, তার সাথে যা করা হয়, তাকে পশুধর্ম বলেঃ
সন্তি চ পশুধর্মাঃ- উপকরণং, উপানয়নং ম অক্ষয়া বন্ধ, কূপে নিয়ােজন, সংজ্ঞপনং, বিশাসনমিত্যেমাদয়ঃ।
অর্থাৎ, পশুধর্ম হল- উপকরণ (মন্ত্রপূর্বক পশুকে ছোঁয়া), উপানয়ং (পশুকে শূপের কাছে নিয়ে যাওয়া), অক্ষয়া বন্ধঃ (পশুর সামনের ডান পায়ে আর মাথার অর্ধেক স্থানে রশি বাঁধা), কূপে নিয়ােজনং (রশি দিয়ে পশুকে শূপের সাথে বাঁধা), সংজ্ঞপনং (মুখ, নাক প্রভৃতি বন্ধ করে পশুকে হত্যা করা), বিশসনং (মৃত পশুকে কাটা)।
এই পশুধর্মের বিধান সবনীয় পশু প্রকরণের চতুর্থ দিনে দেওয়া হয়েছে।
প্রসিদ্ধ আর্যসমাজী বিদ্বান পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক তার ‘মীমাংসা শাবরভাষ্যম’ এ লিখেছেন- জৈমিনি সূত্রের এই প্রকরণে এবং অন্যত্রও এমন ঝলক পাওয়া যায় (ভাষ্যতে তাে স্পষ্ট বােঝা যায়) যেখানে যজ্ঞে পশুকে হত্যা করে তার অঙ্গের আহুতি দেওয়ার কথা রয়েছে। মীমাংসাসূত্রের আধারভূত গ্রন্থ শাখাপ্রভৃতি এবং ব্রাহ্মণগ্রন্থের কিছু স্থলে এর স্পষ্ট বিধান পাওয়া যায়। [মীমাংসা শাবরভাষ্য, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১০১৪]
মীমাংসা দর্শনের সূত্র, শমিতা চ শব্দভেদাত (৩/৭/২৮) এর ব্যাখ্যার বিবরণে পণ্ডিত যুধিষ্ঠীর মীমাংসক ‘কুতুহলবৃত্তি’ পুস্তকের আধারে লিখেছেন –
শমিতা তাকে বলা হয় যে ঋত্বিক (যজ্ঞের পুরােহিত) পশুর মুখ নাক প্রভৃতি বন্ধ করে তাকে হত্যা করে। শমিতা দুই প্রকারের হয়। এক সংজ্ঞপনকর্তা অর্থাৎ মুখ নাক প্রভৃতি বন্ধ করে যে পশুকে হত্যা করে, দুই বিশসিতা অর্থাৎ যে পশুকে কাটে। [মীমাংসা শাবরভাষ্য, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১০৭৭]
এই সূত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে শাবরভাষ্যে বলা হয়েছে, “ক্লোমা চাৰ্দ্ধং বৈকর্তেনং চ শমিতুঃ। ত ব্রাহ্মণায় দদ্যাত।” অর্থাৎ ক্লোমা (পশুর অঙ্গবিশেষের নাম) এবং অর্ধেক বৈকর্তন (পশুর অঙ্গ বিশেষের নাম) শমিতার ভাগে পড়ে। তা ব্রাহ্মণকে দিয়ে দাও।
প্রায় একই কথা প্রাচীন গ্রন্থ ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (৭/১) বলা হয়েছে। এর বিবরণে পণ্ডিত যুধিষ্ঠির মীমাংসক লিখেছেন, “ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৭/১ এ জ্যোতিষ্টোম প্রভৃতিতে মৃত পশুর কোন অংশ কোন ঋত্বিক পাবে, এ বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। তাতে এই বচনও কিঞ্চিত পূর্বাপর পাঠভেদে পাওয়া যায়। সায়ণের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ক্লোমা শব্দ দ্বারা হৃদয়ের পার্শ্ববর্তী মাংসখণ্ড বােঝায় আর বৈকর্তন দ্বারা অন্য (বাম) স্কন্ধে স্থিত প্রৌঢ় মাংস বােঝায়।”
এর পরে টিপ্পনী করে মীমাংসক মহাশয় লিখেছেন, এটা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং ভ্রান্তি দূরকারী। তিনি লিখেছেন,
“ঐতরেয় ব্রাহ্মণের এই মৃত পশুর মাংসখণ্ড বন্টন স্পষ্টভাবে ঘােষণা করে যে, ঐতরেয়ের মূল প্রবচন কালে (অর্থাৎ যখন এটা প্রথম লেখা হয়েছিল) অথবা শৌনক দ্বারা এর পুনঃসংস্কারের কালে ব্রাহ্মণেরা যজ্ঞে পশুর বলি দিতেন এবং যজ্ঞশিষ্ট (যজ্ঞের অবশিষ্ট পদার্থ) ভক্ষণ করতেন।”
কেউ একে প্রক্ষেপ বলতে পারেন কিন্তু মীমাংসক মহাশয় একে প্রক্ষেপ (পরবর্তীতে কারাে দ্বারা মেশানাে) বলে মানেননি। তিনি পুরােপুরি অস্বীকার করে লিখেছেন, “অথবা এই পশুবলি এবং যজ্ঞীয়মাংসশেষ (যজ্ঞের অবশিষ্ট মাংস) ভক্ষণ পরবর্তীকালে প্রক্ষেপ করা হয়ে থাকবে। কিন্তু প্রক্ষেপ মনে করার জন্য কোনাে সুদৃঢ় প্রমাণ নেই।”
মীমাংসা দর্শনের সূত্র, মাংসং তু সবনীয়ানাং চোদনাবিশেষাত্ (৩/৮/৪৩) এ বলা হয়েছে। সবনীয় (যজ্ঞীয়) পুরােডাশ (আহুতির সামগ্রী) মাংসময় হওয়া উচিত।
কাত্যায়ণ শ্রৌতসূত্র (২৪/৫/২০) এবং আপস্তম্ভশ্রৌতসূত্র (২৩/১১/১১) তেও মাংসময় পুরােডাশের বিবরণ মেলে। বস্তুত তাণ্ড্যব্রাহ্মণ নামক এর চাইতে প্রাচীন গ্রন্থে এই ৩৬ বর্ষীয় যজ্ঞের (স) এরকম উল্লেখ আছেঃ এতেন গৌরবীতি শাক্তস্তরসপুরােশাে যব্যাবত্যাং সর্বামৃদ্ধিমার্ধীত। (তাণ্ডব্রাহ্মণ ২৫/৭/১) অর্থাৎ, তরসময় (মাংসময়) পুরােডাশযুক্ত ‘গৌরবীতি’ নামক শাক্ত যব্যাবতী নামক নদীর তটে সত্র সম্পন্ন করে সব প্রকারের সমৃদ্ধি লাভ করেছিল।
আপস্তম্ভশ্রৌতসূত্রে (২৩/১১/১২ এবং ১৩) লেখা আছেঃ
সংস্থিতে সংস্থিতেঅহনি গৃহপতিমৃগয়াং যাতি।
স যান মৃগান্ হন্তি তেষাং তরসাঃ পুরােডাশাঃ ভবন্তি।
অর্থাৎ, ৩৬ বর্ষ পর্যন্ত প্রতিদিন যজ্ঞের পরে দিনশেষে যজমান শিকারে যান এবং সে। যেসব মৃগকে বধ করেন, তাদের মাংসে পুরােডাশ হয়।
অন্য কথায় এই সত্রে যজমান ৩৬ বছর ধরে মৃগ হত্যা তাদের মাংসকে অগ্নিতে ঝলসিয়ে যান।
উপরে আমরা যজ্ঞের জন্য দুই ধরণের পশুবধ দেখেছি। একটি সংজ্ঞপন, অপরটি শিকারে মৃগ প্রভৃতিকে হত্যা করে যজ্ঞের জন্য আনা। কিন্তু তৈত্তিরীয় সংহিতায় তৃতীয় প্রকারের কথা পাওয়া যায়ঃ হৃদয়স্যাগ্রেঅবদ্যতি অথ জিহবায়া অথ বক্ষসঃ। অর্থাৎ, যজ্ঞে ওই পশুর হৃদয় প্রথমে, তারপর মাথা, তারপর জিভ এবং তারপর বক্ষস্থল ছেদন করবেন।
এখানে পশুকে হত্যা করার তৃতীয় বিধি বর্ণনা করা হয়েছে।
আদিশঙ্করাচার্য তার ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যের শুরুতে অর্থাৎ (১/১/১) প্রথম সূত্রের ভাষ্যে লিখেছেনঃ
যথা চ হৃদয়বদ্যবানানামান্নতর্যনিয়মঃ।
অর্থাৎ, যেভাবে যজ্ঞে প্রথমের হৃদয়ের ছেদন করা হয়, পরে জিভ প্রভৃতির ছেদন করার নিয়ম আছে..
এখানে উপমা দেওয়ার মাধ্যমে শঙ্করাচার্য উক্ত নিয়মের এক প্রকার সমর্থনই করেছেন। স্পষ্টতই গােহত্যা করার পরে সেই গরুর প্রতি হওয়া হিংসাকে অহিংসাই বলা হয়েছিল। এটা সীমাহীন মিথ্যা এবং নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমার উপর অভিযােগ করা হয়েছে যে আমি নাকি আমার লেখাতে গােমাংস খাওয়ার প্রচার করেছি! একথা সঠিক নয়। আমি আমার লেখার কোথাও গােমাংস খাওয়ার প্রচার করিনি। আমি কেবল লিখেছি যে প্রাচীন ভারতে একসময় গােহত্যা হত এবং আমাদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে গােহত্যা এবং গােমাংসাহারের বিধানও রয়েছে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানাের জন্য গােবধ বিষয়টিকে তুলে ধরা উচিত নয় এবং তা দেশের জন্য অহিতকর। আমার এই কথার সাথে প্রত্যেক দেশপ্রেমী বুদ্ধিজীবিরা একমত হবেন।
আমি নিজের লেখায় কোথাও বলিনি যে ইতিহাসের কোনাে এক বিশেষ সময়ে হওয়া গােমাংসাহার অথবা গােমেধ (গােবধ) এর প্রথাকে অবশ্যই পুনরুজ্জীবিত করা উচিত। কোনাে ঐতিহাসিক সময়ের আলােচনাত্মক অধ্যয়ণ করা এক কথা, আর তার পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রচার করা অন্য কথা, দ্বিতীয়টির সাথে আমার কোনাে সম্পর্ক নেই।
[অনুবাদক- অজিত কেশকম্বলী]