১৭৫৭-র পলাশী প্রহসনের পরও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভাবতে পারেনি তারা কোন কালে সমগ্র ভারতের অধিপতি হয়ে বসবে। এরপরও মীর কাসিম, বীরভূমের খাঁ রাজারা অক্ষম হলেও একটি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ইংরেজ চুপচাপ বসে থাকেনি, তারা মীরজাফরের সেনা দলকে বরখাস্ত করে। ১৭৬৫-তে দেওয়ানি লাভ ইংরেজদের আর্থিক সঙ্কট ঘুচিয়ে দেয় এবং ক্রমে শিল্পোন্নত ধনী দেশে পরিণত হতে থাকে। তবুও ওয়ারেন হেস্টিংসের কোলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা এবং কোম্পানির কর্মচারীদের উর্দু আরবি শেখানোর মধ্যে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপনে একটু কিন্তু কিন্তু ছিল। তবে ১৭৯৯-এ টিপু সুলতানের পরাজয় এবং ১৮০২-এ ইংরেজ-মারাঠা বেসিনের সন্ধির পর সমস্ত ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে অগ্রসর হয়। আরবি-ফারসি হটিয়ে ইংরেজি ভাষাকে রাজভাষা ঘোষণার মাধ্যমে ইংরেজ মুসলিমদের সমস্ত আশা ভরসার উপর পানি ছড়িয়ে দেয়। আলীগড় আন্দোলন
অষ্টাদশ শতকে কোম্পানি যে কটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যেমন জমিদারী সংস্কার, সান্ধ্য আইন, নিষ্কর জমির বিলোপ, সেনা ও কর্মচারীদের বরখাস্ত তা একদা শাসক মুসলিমবিরোধী হওয়ায় মুসলিমরা দলিত হিন্দু কৃষক, তাঁতি, শ্রমিক ইত্যাদিদের নিয়ে আন্দোলনের ঢেউ তুলে। যা কিছু ইংরেজ তাই বর্জনীয় হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজদের বর্ণ হিন্দু তোষণ কলকাতা কেন্দ্রিক একটি ইংরেজি শিক্ষিত সমাজ তৈরি করে। তারা সরকারি চাকরি, ব্যবসা সবকিছুই কুক্ষিগত করে নেয়। সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ থেকে ওয়াহাবি অন্দোলন, ফারায়েজী আন্দোলনের পর ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের জন্যেও ইংরেজরা মুসলিমদের দায়ী করে। যদিও সমস্ত আন্দোলনগুলিতেই হিন্দু মুসলিম যৌথ অংশীদারিত্ব ছিল।
ইংরেজ সম্পর্কিত সব কিছু বর্জনীয় হয়ে যাওয়ায় মুসলিমদের পিছিয়ে পড়া অবধারিত ছিল। সৈয়দ আমীর আলী, আব্দুল লতিফ, ফজলে রাব্বী প্রমুখ সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের চিন্তা ভাবনা করেন। ইংরেজদের রাজনৈতিক আগ্রাসন প্রথম শুরু হয়েছিল বাংলা থেকে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনেরও শুরু হয় বাংলা থেকে। তাই উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার মুসলমানদের ভাগ্যেও ইংরেজি শিক্ষার ছিটেফোঁটা পড়তে থাকে। কিন্তু সমগ্র ভারতের ক্ষেত্রে চিত্রটি আলাদা ছিল।
উত্তর ভারতে মুসলিমদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয় তার পোশাকি নাম হল আলীগড় আন্দোলন । এই আন্দোলনের ফসল হল যুক্তপ্রদেশে, বর্তমান উত্তরপ্রদেশের আলীগড় শহরে ১৮৭৫-এ ইংরেজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ’ স্থাপন। এই প্রতিষ্ঠানই পরবর্তীতে ১৯২০ নাগাদ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শিক্ষিত মুসলিম মানসে বিশাল আলোড়ন তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়টি কেন্দ্র করে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির উদাহরণ টেনে শুধুমাত্র অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই প্রতিষ্ঠিত হয়নি মুসলিমদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক চেতনাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় ও পাকিস্তান আন্দোলন সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উর্দু সাহিত্যও নব্য আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়। উর্দু সাহিত্য ও লিখনপদ্ধতি এতো দিন তাত্ত্বিক ও পুঁথিসর্বস্ব ছিল। নব্য আন্দোলনে তা আরও ব্যবহারিক ও বিজ্ঞানমুখী হয়।
প্রায় একই সময়ে কংগ্রেস দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস দলটি ছিল ধনী ভূস্বামী, সমাজের উচ্চ স্তরের মানুষ ও ব্যবসায়ীদের দল। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও সমাজের এই স্তর থেকে এসেছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই কংগ্রেস দলটি আলিগড় আন্দোলনকে তাদের চিন্তার পরিপন্থী বলে ভেবেছিল। আলীগড়ের ছাত্ররাই মুসলিম লিগকে পরিপুষ্ট করেছিল। ফলে দুই দলের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিদ্বন্দিতায় দেশভাগের সময় দেশের সাধারণ মানুষ বলি প্রদত্ত হয়েছিল।
ইংরেজরা তাদের শাসনকালের প্রথম দিকে বর্নহিন্দু তোষণের যে নীতি নিয়েছিল তা শাসনের শেষ পর্যায়ে স্বাধীনতার সময়ও কাজে লাগায়। এই শ্রেণিটি আত্মসুখ ও কায়েমী স্বার্থ ছাড়া সাধারণ মানুষের কথা ভাবেনি। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও মুসলিম লীগ ইসলামী সাম্যবাদী নীতি (সকলকে নিয়ে চলার নীতি) কতটা কার্যকর করেছিল তা নিয়েও ভাবার অবকাশ আছে।
বর্তমানে ১১৫৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত, ৩০০০০ শিক্ষার্থী ও ২০০০ শিক্ষক নিয়ে ভারতের অন্যতম প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়। ‘মানুষ জানত না তা মানুষকে শিখিয়েছেন’- কোরআনের এই আয়াত বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল নীতিবাক্য।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, সৈয়দ মুজতবা আলী, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান, কাশ্মীরের শেখ আব্দুল্লাহ, বাংলার রাজনীতিবিদ খাজা নাজিমুদ্দিন, মালিক গোলাম মোহাম্মদ, বাংলাদেশের জেনারেল ওসমানী, নুরুজ্জামান ভুঁইয়া, নাসিরুদ্দিন শাহ ইত্যাদি। বর্তমান উপাচার্য লেফটেন্যান্ট জেনারাল জমিরউদ্দিন শাহ।