নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের ভারত শাসন, ইতিমধ্যে তাঁর শাসনের উপর কৃষক বিরোধী ও পুঁজিবাদ বান্ধব তকমা পড়ে গেছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের একের পর এক অন্ধ হিন্দুত্ব প্রচারে তিনি আরও বেকায়দায়। এঁরা সন্তানসংখ্যা নির্ধারণ থেকে আধ্যাত্মিক জগতের ঘরওয়াপসি সবকিছু নিয়ে তাঁদের মূল্যবান মতামত দিচ্ছেন এবং বিজেপির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে মানুষ আরও সন্দিহান হয়ে পড়ছে। বিজেপি ক্ষমতায়, আবার লোকসভায় নিরঙ্কুশ এবং এই সুবর্ণ সুযোগে হিন্দুত্বের প্রচার হবে না! এসব আহাম্মকও ভাবে না। বরং মানুষ এসব বাই-পাশ করে ভেবেছিল কংগ্রেস তো অনেক হল, মোদির উন্নয়নকে একবার আঁচিয়ে দেখা যাক। দেখা যাক, কালো টাকা- সুইস ব্যাংকের টাকা ফিরিয়ে এনে প্রতিটি ভারতীয়র ব্যাংক একাউন্ট স্ফীত করতে পারে কিনা। ভেবেছিল যারা ডাস্টবিন খুঁজে পেট ভরায়, রিক্সা-ঠেলা চালায় সকলের জন্যই ‘আচ্ছে দিন’ আর বেশি দূর নয়। যদিও কিছু লোক মুচকি হেসেছিল। যত দিন যাচ্ছে ততই তাদের হাসি চওড়া হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বাজেট, সংস্কার গতি পাচ্ছে না বলে কোন কোন মহল থেকে সমালোচিত হচ্ছে। এদের কাছে সংস্কার মানে শুধুই পুঁজিবাদের তাঁবেদারি। পুঁজির অবাধ গতির জন্য কৃষকদের ভাতে মেরে জমি দখল, মধ্যবিত্তের উপরে করের বোঝা চাপানো এ সবই তারা মেনে নিতে পারে, শুধু পুঁজি ও পুঁজিপতিদের যতরকম সুবিধা কর ছাড় ইত্যাদি দেওয়া হোক। বড় শহরের পাশে জমি দিতে হবে, যেখান থেকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, জলবন্দর কাছে হবে। জমি দিতে হবে কম মূল্যে, জমিতে বিদ্যুৎ ও জলের অবাধ সরবরাহ থাকতে হবে তাও আবার স্বল্পমূল্য বা বিনামূল্যে, জমির পাশ দিয়ে কয়েক লেনের ঝাঁ-চকচকে রাস্তা হবে, জমির করও মকুব করতে হবে, আর শিল্প না হলে জমি ফেলে রাখার অধিকার দিতে হবে। এসব না হলে শিল্প হবেনা, বেকারদের কর্মসংস্থানও হবে না। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এর নাম ছিল বিশেষ অর্থনৈতিক তালুক-স্পেশাল ইকোনমিক জোন। এই সেজের বিরোধী শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, উড়িষ্যা ঝারখন্ড, ছত্তিশগড় সর্বত্রই আন্দোলন হয়েছে বা হচ্ছে। সরকারও পাল্টে যাচ্ছে। এমনকি বিদেশেও এর বিরুদ্ধে চলছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। ব্রাজিল, পেরু, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে জঙ্গল কেন্দ্র করে বসবাসরত আদিবাসীরা জীবনপণ করে তাদের অরন্যের অধিকার রক্ষার লড়াই লড়ছে। আমাজন অববাহিকার লক্ষ লক্ষ বছরের পুরানো বর্ষণ অরন্যের মহীরুহ কেটে শিল্পের জন্য জমি তৈরি করার বিরুদ্ধে আদিম জাতিগুলো লড়াই করে যাচ্ছে। প্রাক্তন বাম সরকার সেজ কেন্দ্র করে চীনের শিল্পবিপ্লব দেখে ভেবেছিল এখানেও তা করা সম্ভব। চিন এই সকল সেজ থেকে যেসকল উৎপাদিত দ্রব্য বাজারে ছাড়ছিল তা স্বস্তা হলেও গুণমানে এমনিতেই সন্দেহজনক ছিল। তাই বিশ্বের মানুষের ক্রমে মোহভঙ্গ হচ্ছে। তাছাড়াও চিনের আধা কমিউনিস্ট শাসনের বজ্রমুষ্টির ফাঁক দিয়ে যেটুকু খবর আসছে তা থেকে মনে হতে পারে চীনের প্রান্তিক মানুষ, কৃষক এই সর্বনাশা সেজের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ। ভারতের মতো বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকলে চিনও গণবিক্ষোভের সম্মুখিন হত। একদলীয় আধা কমিউনিস্ট শাসনে দেশটি গুমরে মরছে।
এত সব জেনেও, নরেন্দ্র মোদির সরকার, আব কি বার এমন এক ভূমিনীতি বাজারে আনার জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করল যা আদ্যোপান্ত জনবিরোধী। সংসদের উভয় কক্ষে এই অর্ডিন্যান্স বিলে পরিণত করার আগে যে চরম হাঙ্গামা হবে তা সরকারপক্ষ ভালোভাবেই জানত। দেখা যাক এই অর্ডিন্যান্সে কি আছে? অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছে শিল্পপতিরাও শিল্প স্থাপন, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল স্থাপনের জন্য নামমাত্র নোটিশে পছন্দসই জমি (বসত ভিটে, এক ফসলি, দু ফসলি, তিন ফসলি জমি যাইহোক) অধিগ্রহণ করতে পারবে তবে সরকার সাহায্য করবে। এর আগে শুধু পরিকাঠামো উন্নয়ন, যেমন- রাস্তা তৈরি, রেললাইন বিছানো ইত্যাদের জন্যই নরেন্দ্র মোদির জমি অধিগ্রহণ করতে পারত। অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিক একটি নামমাত্র সরকার নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ পাবে যা বাজারদরের অনুরূপ না হলেও চলবে। শিল্পের জন্য অধিগৃহীত জমি শিল্পপতি পূর্বনির্ধারিত ৫ বছরের পরিবর্তে ১০ বছর কোন শিল্প স্থাপনা ছাড়াই ফেলে রাখতে পারবে। আরও বহু জনবিরোধী বিষয় থাকলেও এই কয়েকটি দিয়ে বোঝা যায় রাজ্যসভায় পাশ করতে বিরোধীরা কেন বাধা দিচ্ছে? শুধু সংশোধন করে বিলটি পাশের চেষ্টা করা হচ্ছে। রেললাইন ও রাস্তার এক কিলোমিটারের এপার ওপারের জমি সরকার নামমাত্র নোটিশে অধিগ্রহণ করতে পারে এবং ক্ষতিপূরণ হিসাবে পরিবারের সদস্যের অন্তত একজনের চাকরির নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে। শিল্পায়ন ছাড়া স্কুল, কলেজ বা হাসপাতালের জন্য বেসরকারি সংস্থা পছন্দসই জমি উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ছাড়া নিতে পারবে না। পুরো ভূমিনীতিই তৈরি হয়েছে গুজরাটকে ভেবে। সেখানে প্রচুর অনাবাদী জমি পড়ে আছে তাই স্বল্প ক্ষতিপূরণে অধিগ্রহণ সম্ভব। পশ্চিমবাংলা, কেরলের মত ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্যে এই ভূমি নীতি চালু করতে গেলে আর একদফা নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের মত ঘটনা ঘটা অবধারিত।
সাম্প্রতিক জাতীয় বাজেটের ভালো মন্দ বিচারের আগে ভারতের কর কাঠামো নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। ভারতে কর দুই প্রকার প্রত্যক্ষ (Direct) ও পরোক্ষ (Indirect)। প্রত্যক্ষ করের বেশ কয়েকটি যেমন আয়কর, সম্পদ এবং আয়কর বাঁচানোর জন্য কেনা বন্ডের (এলআইসি ইত্যাদির জন্য ১.৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বন্ড কেনা যায়, স্বাস্থ্য বীমার জন্য আরও ২৫ হাজার) সমস্ত টাকাটা যায় কেন্দ্রীয় সরকারের খাতায়। বিক্রয়কর (Salers Tax) যায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়ের খাতে। পরোক্ষ করের মধ্যে চুঙ্গি কর (Octroi) পৌরসভা বা পঞ্চায়েতের হাতে যায়। আবগারি কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ের হাতে যায়। কাস্টমস (সীমান্ত পারাপারের পারানি) যায় কেন্দ্রীয় সরকারে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার পরিষেবা কর (Service Tax) বাড়িয়ে প্রতিটি মানুষের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হতে অতিরিক্ত কর দিতে হবে, ট্রেনে চড়লে দিতে হবে, স্বাস্থ্য বীমা করতে, শুধু বেসরকারি সরকারি ব্যাংকের পরিষেবা পেতে গেলেও অতিরিক্ত লাগবে। যুক্তমূল্য কর সংগ্রহ করে রাজ্য (বর্তমানে জি এস টি তে বিলুপ্ত)। কেন্দ্র, রাজ্য থেকে আয়ের উৎসের বেশিরভাগটাই সংগ্রহ করে। রাজ্য থেকে এই আয়ের পরিমাণ ৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪২ শতাংশ করে রাজ্যকে ফেরতের কথা বলা হয়েছে। বাকি টাকা কেন্দ্রীয় প্রকল্প যেমন- ১০০ দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনা, স্বাস্থ্য প্রকল্প, সর্বশিক্ষা ইত্যাদি খাতে রাজ্য গুলোকে দেওয়া হয় যার অধিকাংশই সরাসরি গ্রাহকের ব্যাংক একাউন্টে পৌঁছায়। এতসব সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আদায়কৃত পশ্চিমবঙ্গ মহারাষ্ট্র ইত্যাদি বড় রাজ্যগুলির কিছুটা অংশ ছোট রাজ্যগুলিকে দেওয়া হয়। এই সকল জনকল্যাণমূলক কাজে টাকা দিতে কেন্দ্র সরকার অস্বীকার করছে। যে সময় এই সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোল ছিল প্রায় ১৩৫ ডলার প্রতি ব্যারেল। এই ১০ মাসে সেই ব্যারেলের দাম কমে হয়েছে ৫০ ডলারেরও নিচে। সেই তুলনায় ভারতীয় বাজারে পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমানো হয়নি। উপরন্তু পরিষেবা কর বাড়ানো হয়েছে। পরিষেবা কর ধনী-নির্ধন সকলকে দিতে হবে।
ধ্বনি ও শিল্পপতিদের জন্য মোদীর সরকার ছাড়ের পর মাত্র ২% সারচার্জ বাড়ানো হয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে কর্পোরেট হাউসগুলি কর বাবদ কেন্দ্রীয় সরকারকে সর্বাপেক্ষা বেশি টাকা দেয়, অথচ তা ৩০% থেকে ৫ শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হল। সবথেকে করুন অবস্থা বেতনভুক মধ্যবিত্তদের। তাদের কর ফাঁকি দেওয়ার কোনও পথই নেই উপরন্তু নরেন্দ্র মোদির সরকার বর্তমান বাজেটে কর ছাড়ের কোন সুবিধা দেয়নি। এর উপর চাপিয়েছে বিভিন্ন পরিষেবা করের মত পরোক্ষ কর।
নরেন্দ্র মোদির রাজ্যের শিল্পায়ন নিয়ে বিভিন্ন বাজারি সংবাদ জগৎ একটা রূপকথার বিশ্ব তৈরি করেছে। এর আগে বলেছি র রাজ্য গুজরাটে জমি স্বল্পমূল্যে অনায়াসে পাওয়া যায়। এর উপর রয়েছে কম সুদে ঋণ, নানারকম কর ছাড় ইত্যাদি। তাই শিল্পের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে এবং আম্বানি, আদানিরা তার সদ্ব্যবহারে পিছিয়ে নেই। এহেন রাজ্যে এবং অন্যত্র শিল্পের রমরমার উদ্দেশ্য কর্মসংস্থান। কিন্তু ২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত গুজরাটে কর্মসংস্থান কমেছে ২.৮ শতাংশ, কৃষিতে কর্মসংস্থান কমেছে ১.৫৯ শতাংশ, শিল্পে উৎপাদন কমেছে ২.৬%, পরিবহন শিল্পে কমেছে ২.৮ শতাংশ, সমানুপাতে বেতন বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১.৫%, যেখানে সর্বভারতীয় গড় ৩.৭৫%। বহুজাতিক ও বিশুদ্ধ দেশীয় শিল্পে এখন ৩৭% অস্থায়ী শ্রমিক। কৃষি ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় জিডিপি ১৯৯১ থেকে ২০১০ হয়ে ২০১৫ তে কমে হয়েছে যথাক্রমে ৩১.৯ থেকে ১৪.২ ও ১৩ শতাংশে। তাই বলা যায় অন্তত গুজরাটের স্থানীয় দরিদ্র মানুষের কোন সুরাহা হয়নি। কারণ অটোমেশনের যুগে দক্ষ কর্মচারীর চাহিদা বেশি। চাহিদা মেটাতে উচ্চপদে শিক্ষিত, দক্ষ কর্মচারী সাধারণ কর্মচারীদের ঘটিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষ চাকরি পায় তবে তা অস্থায়ী পদে পায়। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও ধনী শিল্পপতি এবং চাকুরে উচ্চ শিক্ষিত মানুষের তেলা মাথায় তেল দেওয়া। মোদ্দা কথা দাঁড়ালো চিরকালীন উচ্চবর্গীয় ও মার্কিন ইউরোপীয় (বহুজাতিক কোম্পানি) শ্বেতকায় মানুষ সুবিধাভোগী শ্রেণিতে থাকল এবং বিপরীত প্রান্তে থাকল দলিত হিন্দু-মুসলিম সাধারণ খেটে খাওয়া জনতা।
কোসাম্বির মতে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের বহু আগে থেকেই ইউরোপের মত ভারতেও সামন্ততন্ত্রের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। বড় বড় শহরগুলি ক্রমে ধ্বংস হয়ে গিয়ে গ্রামকেন্দ্রিক জীবন শুরু হয়। কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবে স্থানীয় অভিজাত বর্গের সৃষ্টি হয়। এই পরিবর্তনের মূল কারণ গ্রামে গ্রামে হস্তশিল্পের প্রসার ও শহরের প্রতি নির্ভরশীলতা উত্তরোত্তর কম হতে থাকা। অচ্ছুৎ বা নিম্নবর্ণের মানুষজন ক্রমে ভূমিহীন সর্বহারায় পরিণত হচ্ছে। ইৎ সিং ৭০০ খ্রিস্টাব্দের বর্ণনায় বলেছেন, জমির মালিকরা তাদের জমি ভাড়া করা পরিচালক দ্বারা বা শ্রমিক দ্বারা কিংবা ভাগে চাষ করাত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফসল দিয়ে রাজস্ব আদায় হত। হিউ এন সাং ও ইৎ সিং যখন ভারতে আসেন তখন প্রচুর বৌদ্ধমঠ দেখেন এবং বৌদ্ধদের প্রভাবও তাঁদের চোখে পড়েছিল। এই সময়ই বানভট্ট সতী প্রথার প্রথম সমালোচনা করেছিলেন। যত দিন যাচ্ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পাল্লায় পড়ে বৌদ্ধরা ক্রমেই বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছিল।
বিভিন্ন শিলালিপি থেকে জানা যায় চাষীদের বোঝা বাড়া অর্থাৎ কর বাড়ার কথা এবং একই সময়ে ইউরোপের মতই রাজা, তার আত্মীয়-স্বজন ও উচ্চপদস্থদের মধ্যে নিষ্কর জমি দানও চালু হয়। এই ধরনের দান সম্পর্কে ইরফান হাবিবের মূল্যায়ন হল, দেবোত্তর নিষ্কর দানের পরিবর্তে প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ দান যদিও জমির প্রত্যক্ষ ব্যবহারকারী কৃষকদের জন্য নয়।
ভারতে ভূমিদাস বা বেগার প্রথার প্রচলন খুব বেশি ছিল না। স্পেনে অভিজাতদের নিষ্কর জমি এবং প্রত্যক্ষ ব্যবহারকারী চাষীদের উপর করের বোঝা বা ভূমিদাস (Serf) প্রথার আধিক্য সবার উপরে ভারতের বৌদ্ধদের মতোই ইউরোপে ইহুদিদের দুরাবস্থা মুসলিম শাসনকে প্রায় একই সময়ে (৭১১ খ্রি.) স্পেন ও ফ্রান্সে ডেকে নিয়ে আসে। ভারতেও এই প্রথাগুলি প্রবল থাকায় মুসলিমদের প্রবেশ আনুকূল্য পায়। বস্তুত আরবদেশে চাষের জমি না থাকায় সেই অঞ্চল ছাড়া কৃষিনির্ভর সমস্ত পৃথিবী একইরকম অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল। ভাষার ক্ষেত্রেও দেখা যায় প্রাকৃতের বিভিন্ন রূপ যা সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা ছিল সেগুলিকে হটিয়ে পুনরায় সংস্কৃত ফিরে আসছে। বাংলাতে এই প্রবণতা একটু পরে দ্বাদশ শতকে শুরু হয়। বৌদ্ধ পালদের সময় প্রচলিত চর্যার ভাষাকে হটিয়ে ব্রাহ্মণ্য শাসন সেনদের সময়। ইউরোপের ক্ষেত্রে দেখি, ল্যাটিনের অপভ্রংশ ভিসিগথিক ভাষার মিশ্রণ জনসাধারণের কথ্য রোমান্স ভাষাকে হটিয়ে পুনরায় ঠেঁট ল্যাটিনের উপদ্রব শুরু হয়েছে। এই অংশ থেকে ভারত তথা বিশ্বের সামন্ত প্রথা ও মধ্যযুগের প্রারম্ভ সম্বন্ধে জানা যায়। তখন বিশ্বকে উদ্ধার করতে এসেছিল ইসলাম। সামন্ত যুগ শেষ হয়ে বাণিজ্যের যুগ শুরু হয়।
বর্তমান অবস্থাও ১০০০-১২০০ বছর আগের অবস্থার সঙ্গে তুলনীয়। শুধু সামন্তপ্রথার যুগ পাল্টে বসাতে হবে পুঁজিবাদী শিল্পায়নের যুগ। শিল্পায়ন শহরে হয় বা শহরকেন্দ্রিক হয়, নতুন শহরের পত্তন করে (দুর্গাপুর, নয়দা)। কিন্তু সামন্তপ্রথা গ্রামকেন্দ্রিক ছিল। তখন ছিল একদিকে সরকার, বড় বড় ভূস্বামী, পুরোহিত দল। অন্যদিকে ভূমিহারা ভূমিদাস, কৃষক অথবা বেকার। বর্তমানে রয়েছে সরকার, কর্পোরেট জগৎ, ধর্মীয় মতবাদ। তবে প্রকৃত ধর্ম জানা পুরোহিতের বদলে তথাকথিত বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মুক্তমনা মতবাদের শিকার নাস্তিকের দল। অন্যদিকে অত্যাচারিত শ্রমিক, ভূমি হারাবার ভয়ে কৃষক ও বর্গাদার, কিছু মধ্যবিত্ত। এই হাজা বছরের কৃষকদের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি তা তুলনামূলক আলোচনায় জানা যায়। সে যুগে ইউরোপ-এশিয়ার ইহুদি, বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে খ্রিস্টান ও হিন্দুদের দলিত পিছিয়ে পড়া অংশ অত্যাচারিত হয়েছিল। এ যুগেও ইসলামকে প্রধান প্রতিপক্ষ ঠাউরে নিয়ে সমস্ত বিশ্বজুড়ে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর দলিত, সর্বহারা অংশকে নিপীড়িত করা হচ্ছে। সেই সময় গ্রিক, রোমকদের পর শক, হুন ইত্যাদি জাতিগুলি ভারতবর্ষ সহ সমস্ত পৃথিবীকে আক্রমণ করেছিল। বর্তমান বিশ্বও বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতিসমূহ তারা ঔপনিবেশিক শাসনের পর রাশিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত যুদ্ধবাজ সরকার দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে, দোসর ন্যাটো- সাংহাই চুক্তির দেশ। ভাষার দিক থেকেও পালি, প্রাকৃত, চর্যাপদের ভাষাকে হটিয়ে এবং ইউরোপেও বিভিন্ন জার্মান ভাষাকে ভারতে সংস্কৃত ও ইউরোপে ল্যাটিনভাষাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছিল। বর্তমানেও সংস্কৃত, হিব্রু ইত্যাদি প্রাচীন প্রায় অবলুপ্ত ভাষাসমূহকে পুরো বা আংশিক ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। যেখানে বাংলার মত একদা সমৃদ্ধ ভাষা ক্রমে করুন অবস্থায় পর্যবসিত হচ্ছে। যারা সামান্যতম চিন্তা করে বর্তমান বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। ধনী-দরিদ্রের লড়াই নতুন আঙ্গিকে ফিরে আসায় এবং মারণাস্ত্রের বিপুল সম্ভার দেখে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। তখন পৃথিবীতে নবীন ইসলামই ছিল বাঁচার উত্তর। এখন?
একটি রহস্য উন্মোচনঃ আরএসএস অযোধ্যায় রাম মন্দির হতে বাধা দিয়েছিল