লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
‘মাওলানা আহমদ রেযা খান শিয়া ছিলেন’ নামটি শুনে অনেকে হয়তো চমকে উঠেছেন। যে ব্যাক্তিটিকে অনেকে ইমামে আহলে সুন্নত, মুজাদ্দিদে দ্বীন ও মিল্লাত হিসেবে জানে তিনি আবার কিভাবে শিয়া হতে পারেন?
হ্যাঁ, এটাই সত্য যে মাওলানা আহমদ রেযা খান একজন শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। তিনি সুন্নিয়াতের আড়ালে শিয়া মতবাদ প্রচার করে গেছেন। সেজন্য দেখা যায় শিয়াদের অধিকাংশ আকিদা, রীতি-রেওয়াজ এই রেযাখানী ধর্মাবলম্বীদের ফ্যাক্টেরীতেই পাওয়া যায়। মুহাররম মাসে শিয়াদের সব জঘন্য কার্যাবলী এই রেযাখানীরা পালন করে থাকে যার বৈ্ধতার লাইসেন্স দিয়েছেন শিয়াদের দ্বাদশ ইমাম মাওলানা আহমদ রেযা খান বেরেলবী। সেজন্য বহু রেযাখানী পীর ফকীরদের লেখনী থেকে হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ)কে গালিগালাজ করতে শোনা যায় এমনকি এদের মধ্যে অনেকে দাবী যে হযরত আলীকেই প্রথম খলিফা করা উচিৎ ছিল। এদের অনেকের মধ্যে বারো ইমামের সিলসিলাও সমর্থন করতে দেখা যায় যা আহলে সুন্নতের সিলসিলা নয়, এটা শিয়াদের সিলসিলা।
শিয়াদের বহু নাম রয়েছে এবং বহু দল ও উপদলও রয়েছে। এরা বিভিন্ন শাখা উপশাখায় বিভক্ত। শিয়াদেরকে রাফেযীও বলা হয়। বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জ্বিলানী (রহঃ) লিখেছেন,
“রাফেজীদের প্রধান শাখা তিনটি। যথা- গালিয়া, যায়েদিয়া এবং রাফেজিয়া। গালিয়ার শাখা বারোটি। যথা- বুনানিয়া, ত্বাইয়ারাহ, মানসুরিয়াহ, মাগিরিয়াহ, খাত্তাবিয়া, মুআম্মারিয়া, আবজালিয়া, মুতামানাসিখা, শারইয়াহ, খাবাতিয়া, মাফুজিয়াহ।
যায়েদিয়াদের ছ’টি শাখা – জারুদিয়া, সোলাইমানিয়াহ, বাতারিয়াহ, নে’মাতিয়াহ, ইয়াকুরিয়াহ, তানাসাখিয়াহ।
রাফেজিয়ার ষোলটি শাখা। যেমন-ফাতিয়াহ, কেসানিয়াহ, কারতিয়াহ, আমিরিয়াহ, মুহাম্মাদিয়াহ, হুসাইনিয়া, কাদসাইয়াহ, ইসমাইলিয়া, কারামাতিয়া, মুবারাকিয়া, শামীতিয়াহ, আসাদিয়াহ, মাত্বমুরিয়াহ, মাওসুরিয়াহ, ইমামিয়াহ ও খাবারিয়া।” (গুনিয়াতুত তালেবীন, পৃষ্ঠা-১২৮)
মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব মুলতঃ শিয়াদের গালিয়া দলের কোনও একটি শাখার অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। কারণ, গালিয়া দলের লোকেরা হযরত আলী (রাঃ)কে প্রভূ বলে মনে করে (নাউজুবিল্লাহ)। আর আহমদ রেযা খানও লিখেছেন,
বে সক আলি কা নাম নামে আল্লাহ
বাতেঁ আপকি কালামুল্লাহ।
(নাতে মাকবুলে খোদা, পৃষ্ঠা-৮২)
যাইহোক এই পুস্তকে এটাই প্রমান করা হয়েছে যে মাওলানা আহমদ রেযা খান একজন শিয়া ছিলেন। তাঁর পূর্ব পুরুষ শিয়া ছিল এবং ভারতে সুন্নী মুঘল সাম্রাজ্য পতনের যে অন্যতম কারন ছিল শিয়া শাসক নাদির শাহের ভারত আক্রমন তাতে সাহায্য করেছিল এই আলা হযরত মাওলানা আহমদ রেযা খানের খান্দান।
জন্ম
মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরেলী শহরে ১০ শাওয়াল ১২৭২ হিজরী সনে (ইংরেজী ১৪ জুন ১৮৫৬ সনে) হয়েছিল। (মালফুযাতে আলা হযরত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১২)
বংশ পরিচয়
মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের পুর্ব পুরুষরা ভারতের বাসিন্দা ছিলেন না। তাঁদের পুর্বপুরুষ বিদেশী ছিলেন। যাইহোক আহমদ রেযা খান সাহেবের খলিফা জাফরুদ্দীন বিহারী তাঁর সিলসিলা নসব (বংশপঞ্জী) বর্ননা করেছেন। তিনি লিখেছেন,
“আব্দুল মুস্তাফা আহমদ রেযা খান ইবনে মাওলানা নাকী আলি খান বিন হযরত মাওলানা রেযা আলি খান বিন হযরত মাওলানা হাফিয মুহাম্মাদ কাজেম আলি খান বিন হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মাদ আজম খান বিন মুহাম্মাদ সাদাত ইয়ার খান বিন হযরত মুহাম্মাদ সায়ীদুল্লাহ খান। হুজুরের (আহমদ রেযা খান) বাপ দাদারা কান্দাহারের মৌকির গোত্রের বঢ়িচের পাঠান ছিলেন।” (হায়াতের আলা হযরত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২)
আহমদ রেযা খানের পুর্ব পুরুষরা শিয়া ছিল
ইরানের নাদির শাহ (১১৬০ হিজরী/১৭৪৭ খ্রীষ্টাব্দ) একজন রাফেযী (শিয়া) বাদশাহ ছিল। সে ইসলামী শাসনতন্ত্রের পতন ঘটানোর জন্য এবং ইসলামী শাসনতন্ত্রের ভিত্তিকে টুকরো টুকরো করার জন্য পুরোপুরিভাবে চেষ্টা করে। সেজন্য প্রথমে সে আফগানের সুন্নী বাদশাহ আশরাফের শাসনক্ষতাকে ইরান থেকে বসে সমূলে মুলচ্ছেদ করে। সুন্নী বাদশাহ আশরাফ চার বছর ধরে পারস্যের সাম্রাজ্য চালাচ্ছিল। যেহেতু বাদশাহ আশরাফ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের (সুন্নী) সেজন্য শিয়া শাসক নাদির শাহ (১১৪২ হিজরী/১৭১৯ সালে) তার শাসনতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে তার স্থলে তাহামাসফ সাফাবী নামক শিয়াকে ক্ষমতায় বসায়।
নাদির শাহের গোঁড়ামী এখানেই সমাপ্ত হয়নি বরং সে আরও এগিয়ে আসে এবং যারা সুন্নী নয় তাদেরকে ইরান থেকে বের করে দেয় এবং কাবুল এবং কান্দাহার দখল করে নেয় এবং আমাদের লাহোর শহরেও আসে এবং তুফানগতিতে দিল্লী পৌঁছে। দিল্লীতে ১১৫০ হিজরী সনে সে প্রকাশ্য নরহত্যা করে রক্তপাত শুরু করে এবং ৩০ কোটি টাকার সম্পত্তি লুট করে ইরান পালিয়ে যায়।” (মুকাদ্দামা মুনাযারাহ মা বাইনা সুন্নী ও শিয়া, পৃষ্ঠা-৩)
যে সময় ইরানে শিয়া শাসক নাদির শাহ ভারতে সুন্নী শাসনতন্ত্রকে পতন ঘটায় এবং সুন্নী মুসলমানদেরকে শহীদ করার পুরো ষড়যন্ত্র করেছিল সেই সময় ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের সুন্নী শাসক রাওশান আখতার ওরফে মুহাম্মাদ শাহের (১১৬১ হিজরী/১৭৩৮ সন) রাজত্যকাল ছিল। নাদির শাহের সেই ইরানী শিয়ার সেনাবাহিনীতে দুই লাখ পদাতিক এবং সিপাহী এবং পাঁচ হাজার তোপ দিয়ে সাজানো ছিল। (ইসলামী তারিখ পাকিস্তান ও হিন্দ, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২০৬, হিদায়াতুল্লাহ খান চৌধুরী, হাওয়ালা- ফিরকা বেরেলবীয়াত কা তাহকিকী জায়যা, পৃষ্ঠা-৩১, মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস ঘুম্মান দাঃবা)
মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের পুর্ব পুরুষরা সেই শিয়া বা রাফেযী সেনাবাহিনীতে ছিল। তার প্রমান নিচে দেওয়া হল,
প্রথম প্রমানঃ
আবুল মনসুর হাফিয মুহাম্মাদ আনওয়ার কাদেরী (এম এ) লিখেছেন,
“তাছাড়াও আলা হযরত মুহাম্মাদ সায়ীদ খান কান্দাহারের বাওকারের বঢ়িচ গোত্রের পাঠান ছিলেন। নাদির শাহ যখন মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক মুহাম্মাদ শাহের উপর ১৭৩৯ সালে হামলা করে তখন তিনি (সায়ীদুল্লাহ খান) তাদের সঙ্গী ছিলেন। প্রথমে তাঁরা লাহোরে অবস্থান করেন। লাহোরের শিশমহল তাঁদেরই সম্পত্তি ছিল। পরে তাঁরা দিল্লী চলে আসেন।” (আলা হযরত আহমদ রেযা খান, পৃষ্ঠা-১২)
দ্বিতীয় প্রমানঃ
মাওলানা জাফরুদ্দীন বিহারী লিখেছেন,
“আলি জাহ সুজাআত জঙ্গ বাহাদুর শাহ সায়ীদুল্লাহ খান কান্দাহারী মুঘল সাম্রাজ্যের সুলতান মুহাম্মাদ শাহের সময়কালে নাদির শাহের সঙ্গে দিল্লী আসেন এবং (নাদির শাহের) ছয় হাজার সৈ্ন্যের সেনাপতি হন………তাঁর একটি শিশ মহল লাহোরে ছিল যার এখনও পর্যন্ত কিছু প্রভাব বাকি আছে।” (হায়াতে আলা হযরত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৩)
প্রিয় পাঠক! এই জ্বলন্ত প্রমান দ্বারা বোঝা গেল যে আলা হযরত মাওলানা আহমদ রেযা খান বেরেলীরর খান্দানের লোকেরা ইরানের শিয়া শাসক নাদির শাহের শিয়া সেনাপতিতে যোগদান করেছিল এবং সুন্নীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এসেছিল। তারা লাহোরে শিশ মহল জোরজবরদস্তি করে দখল করে নেয়। কিন্তু নাদির শাহ নিজের রাফেযী সৈন্যদের হুকুম দেন যে তারা যেন লাহোর ছেড়ে দিল্লীতে যাতে হামলা করে। তখন ইরানী সেনারা নিজেদের মাযহাবী শাসক (নাদির শাহের) হুকুম মান্য করে লাহোর ছেড়ে দিল্লীতে আসে।
যাইহোক আপনারা পড়লেন যে আলা হযরত আহমদ রেযা খানের খান্দান নাদির শাহের সাথে দিল্লী আসে এবং প্রকাশ্যে নরহত্যা শুরু করে ১১৫১ হিজরী ইংরেজী ১৭৩৮ খ্রীষ্টাব্দে এই পৈশাচিক কান্ড ঘটে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে পুরো দিল্লী শহর লাশের স্তুপ হয়ে যায়। নির্ভরযোগ্য সূত্র দ্বারা বোঝা যায় তখন মানুষ খুন করা হয়েছিল ৮ হাজার থেকে দেড় লাখ। বর্ননাকারী রাফেযী হওয়া সত্যেও লিখেছেন যে মৃত লাশের দুর্গন্ধে পুরো শহর ভরে গিয়েছিল এবং সড়কপথ লাশের স্তুপ হয়ে যাওয়াতে মুসলমান ও অমুসলমান সকলের লাশকে পুড়িয়ে দেওয়ার হুকুম দিয়েছিল রাফেযী শাসক নাদির শাহ ইরানী। নাদির শাহের এই হুকুমে মুসলমান ও অমুসলমানের লাশকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়। চিন্তা করুন কি পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড করেছিল নাদির শাহ ইরানী। আর এই রাফেযী বাদশাহ নাদির শাহের সহচর ছিলেন তথাকথিত সুন্নী ইমাম মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের খান্দান।
ঐতিহাসিক হিদায়াতুল্লাহ খান চৌধুরী লিখেছেন,
“চুক্তির মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত এটাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে সামর্থ্য অনুযায়ী ৫০ লাখ টাকা আদায় করে সঙ্গে সঙ্গে নাদির শাহ (দেশে) চলে যাবে এবং প্রয়োজনীয় টাকাটি কিস্তিতে কিস্তিতে মিটিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু নিযামুল মুলকের শত্রু সাদাত খান নাদির শাহের এই প্রয়োজনীয় টাকাকে বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনুমতি নেয়। তখন নাদির শাহ সেই টাকার বাড়িয়ে ২০ কোটি টাকা করে দেয় এবং নিযামুল মুলককে লিখে যে মুঘল বাদশাহ যেন দ্বিতীয়বার তার কাছে উপস্থিত হয়। মুঘল বাদশাহ ইরানী রাফেযী সৈন্যের কাছে পৌঁছাতেই তাকে বন্দী করা হয়। মুঘল বাদশাহর বন্দী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারা ভারতবর্ষের শাসনতন্ত্রের তালার চাবিকাঠি এখন নাদির শাহের হাতে চলে আসে।” (ইসলামী তারিখ পাকিস্তান ও হিন্দ, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২০৭)
প্রিয় পাঠক! রাফেযী শাসক নাদির শাহ ইরানী নিজ দেশে প্রত্যবর্তন করল কিন্তু আলা হযরত আহমদ রেযা খানের বংশের সপ্তম পুরুষ সায়ীদুল্লাহ খান কান্দাহারী নিজ জন্মভুমি দেশে আর প্রত্যাবর্তন করলেন না বরং তিনি ভারতবর্ষেই ঘাঁটি স্থাপন করলেন এবং মুঘল শাসক মুহাম্মাদ শাহের খাস অনুগত ব্যক্তি হিসেবে থেকে গেলেন। শুধু তাই নয় তিনি ছয় হাজার সৈন্যের সেনাপতিও হয়ে গেলেন। রামপুরের গ্রামাঞ্চলের সম্পত্তি তাঁকে একেবারেই দান করা হয়।
এরপর সায়ীদুল্লাহ খানের ছেলে সাদাত ইয়ার খানকে মুঘল বাদশাহ মুহাম্মাদ শাহের উজির করা হয়। বাদায়ুনে অনেক সম্পত্তি তাঁকে সম্রাটের তরফ থেকে দান করা হয়। এই সম্পত্তি তাঁরা বংশ পরম্পরাগতভাবে ভোগ করতে থাকেন। (হায়াতে আলা হযরত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৩-১৪)
লক্ষ্য করুন, একজন বিদেশী মুসাফির ব্যাক্তি কিভাবে মুঘল সম্রাট মুহাম্মাদ শাহের একান্ত অনুগত ব্যাক্তি হয়ে গেলেন? এর মধ্যে দুটির মধ্যে একটি অবশ্যই হবে।
১) যেহেতু সে শিয়া বাদশাহ নাদির শাহের সঙ্গী হয়ে এসেছিল তাই মুহাম্মাদ শাহকে (নাদির) বলেছিল যে এই ব্যাক্তি আমার একান্ত অনুচর। একে তাঁর সাম্রাজ্যে চুক্তি করে তাঁর কাছে রাখুক যাতে সে তোমার এবং আমার মধ্যেখানে এজেন্ট হয়ে থাকতে পারে।
২) এও হতে পারে যে নিজের যোগ্যতায় সে মুঘল বাদশাহ মুহাম্মাদ শাহের একান্ত অনুগত হয়ে গেছিল। আর মুহাম্মাদ শাহের মত সম্রাটের একান্ত খাস ব্যাক্তি সেই হতে পারে যে ছল চাতুরির আশ্রয় নেবে।
ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য ছিল সবথেকে দীর্ঘ ও বিরাট সুন্নী শাসনতন্ত্র। এই মুঘল সাম্রাজ্য পতনের বহু কারণ ছিল। তার মধ্যে অন্যতম কারণ বড় ছিল ১৭৩৮ খ্রীষ্টাব্দে নাদির শাহের ভারত আক্রমন। এই আক্রমনে সুন্নী শাসনতন্ত্রের ভিত্তিকে একেবারেই নড়বড়ে করে দেয় এবং ভারতে ব্রিটিশদের রাজ কায়েমের পথ সুগম করে দেয়।
সুন্নী মুঘল সাম্রাজ্যকে পতন ঘটিয়ে নাদির শাহ ইরানী নামক শিয়া (রাফেযী) শাসককে সার্বিকভাবে সাহায্য করেছিল আলা হযরত ওরফে মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের খান্দান। অর্থাৎ ভারতে সুন্নী শাসনতন্ত্রের পতনের অন্যতম দায়ী ছিল শিয়া মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের খান্দান। আমরা ভেবে পাই না যে ব্যাক্তির খান্দান শিয়াদের পক্ষ অবলম্বন করে ভারতে সুন্নী শাসনব্যাবস্থার পতন ঘটালো সেই বংশের লোক হয়ে মাওলানা মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব কিভাবে নিজের দলকে ‘সুন্নী’ নামে আখ্যায়িত করলেন এবং যাঁরা প্রকৃত ‘সুন্নী’ অর্থাৎ উলামায়ে দেওবন্দকে তিনি ‘ওহাবী’ ‘বেদ্বীন’, ‘কাফের’ ফতোয়ার মেশিনগান চালিয়ে সুন্নীদের বুককে ঝাঁঝরা করার চেষ্টা করলেন।
মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের পুর্ব পুরুষ সাদাত খানের ব্যাপারে আগেই বলেছি যে তিনি আফগানিস্তানের খোরাসানের বাসিন্দা ছিলেন। আর স্বাধীন অযোধ্যা রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এই সাদাত খান বুরহানুল মুলক। খোরাসানের অধিবাসী সাদাত খানের আসল নাম ছিল মীর মহম্মদ আমীন। জীবনের প্রথম কিছুকাল তিনি সারবুলান্দ খানের অধীনে কাজ করেন (১৭১০-১৭১২), পরে তিনি সম্রাট ফারুকশিয়ারের অধীনে হিন্দাওন ও বায়ানার গভর্নর হিসাবে কাজ করেন। ১৭২০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মুঘল অভিজাত হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন, আগ্রার গভর্নর নিযুক্ত হন। ১৭২২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি অযোধ্যার সুবাদার দায়িত্ব গ্রহন করে তিনি গাজিপুর, জৌনপুর ও চুনার অযোধ্যার সীমানাভুক্ত করে নেন। ক্রমশ তিনি শক্তি ও খ্যাতিলাভ করেন, এবং নাদির শাহের আক্রমনের সময় সম্রাটের আহ্বানে তিনি দিল্লীতে আসেন। আগেই বলা হয়েছে যে নাদির শাহের সাথে যে সন্ধীচুক্তি হয়েছিল তাতে সন্ধীচুক্তিতে সাক্ষর হয়েছিল যে কিস্তিতে কিস্তিতে মুঘল বাদশাহকে ৫০ লাখ টাকা দিতে হবে। কিন্তু সাদাত খান এই টাকাকে বাড়িয়ে ২০ কোটি টাকা করে দেন। এই অবাঞ্ছিত চুক্তি করে তিনি মর্মাহত হন, এরই পরিণতিতে ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে আত্মহত্যা করেন।
সাদাত খান ছিলেন সে যুগের একজন সফল অভিজাত, দক্ষ শাসক এবং যোগ্য সেনাপতি । (Sadat khan, a prominent Mughal noble, was a successful Soldier and a wise ruler.)
তাঁর এই দক্ষতা এবং যোগ্যতাকে আঁচ করতে পেরেই মনে হয় শিয়া শাসক নাদির শাহ তাঁকে সঙ্গী করেছিলেন এবং সুন্নী শাসনতন্ত্রকে খতম করার জন্য তাঁকে হাতিয়ার স্বরুপ ব্যাবহার করেছিলেন।
সাদাত খানের পুত্রঃ
মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের খলিফা মাওলানা জাফরুদ্দীন বিহারী সাদাত খানের ব্যাপারে লিখেছেন,
“তাঁর নিজের তিনটি পুত্র। তাদের মধ্যে বড় পুত্রের নাম ছিল কাজেম আলি খান। এবং তিনিই ছিলেন আলা হযরত ইমামে আহলে সুন্নত কুদ্দাসু সিররাহুল আজীজের পুর্বসূরী। তিনি উজির হওয়ার দাবী দাওয়া না করে আধ্যাত্মিক সাধনায় লিপ্ত হন এবং সংসারের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন।” (হায়াতে আলা হযরত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৩-১৪)
আজম খানের পুত্রঃ
মাওলানা জাফরুদ্দীন বিহারী লিখেছেন, “আজম খান দুটি বিবাহ করেছিলেন। প্রথমা স্ত্রী থেকে হাফিজ কাজেম আলি খান জন্মগ্রহন করে এবং দ্বিতীয় স্ত্রী থেকে চারজন কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। হাফিয কাজেম আলি খান আসফ উদ দৌল্লাহর উজির ছিলেন।” (হায়াতে আলা হযরত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৪)
প্রিয় পাঠক! এই হাফিয কাজেম আলি খান ছিলেন কথিত আলা হযরত মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের প্র-পিতামহ (পরদাদা/দাদার পিতা) । এই কাজেম আলি খানের ছেলে রেযা আলি খান। রেযা আলি খানের ছেলের নাম মাওলানা নাকী আলি খান। এবং এই নাকি আলি খানের ছেলে আলা হযরত মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেরব বেরেববী। তিনি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের ইমাম হওয়ার দাবীদার হন। তাঁরই প্র-পিতামহ হাফিয কাজেম আলি খান ছিলেন আসফ উদ দৌল্লাহর উজির।
কে এই আসফ উদ দৌল্লাহ?
এই নবাব আসফ উদ দৌল্লাহ ছিলেন আকজন কট্টরপন্থী শিয়া (রাফেযী)। তিনি অযোধ্যার নবাব ছিলেন। এই অযোধ্যার উপর নিয়ন্ত্রনকারী এবং স্বাধীম অযোধ্যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নবাব বুরহানুল মুলক সাদাত খান। তিনিও রাফেযী ছিলেন। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যকে পতন ঘটানোর জন্য ও এবং বেশী সুযোগ সুবিধা অর্জনের জন্য নাদির শাহকে উসকিয়ে ছিলেন যা এর আগে বর্ণনা করা হয়েছে।
স্বাধীন অযোধ্যায় যাঁরা নবাব হয়েছিলেন তাদের বর্ণনা নিচে দেওয়া হল,
১) নবাব বুরহানুল মুলক সাদাত খান নিশাপুরী। (১১৩৫ হিজর্ ১৭২৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১১৫১ হিজরী ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, ১৬ বছর)
২) নবাব সফদর জঙ্গ মনসুর আলি খান। (তিনি ছিলেন সাদাত খানের ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা। (১১৫১ হিজরী, ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১১৬৭ হিজরী ১৭৫৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, ১৬ বছর)
৩) নবাব সুজাউদ দৌল্লাহ। তিনি ছিলেন নবাব সফদর জঙ্গের পুত্র। (১১৬৭ হিজরী, ১৭৫৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১১৮৮ হিজরী ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, ২১ বছর)
৪) নবাব আসফ উদ দৌল্লাহ মির্যা ইয়াহইয়া আরিফ মির্যা ইরানী। (১১৮৮ হিজরী, ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১২১২ হিজরী ১৭৯৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, ২২ বছর)
৫) নবাব আমিনুদ দৌল্লাহ মির্যা সাদাত আলি খান। (১২১৩ হিজরী, ১৭৯৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১২২৯ হিজরী ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, ১৬ বছর)
৬) গাজিউদ্দিন। (১২২৯ হিজরী, ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১২৪৩ হিজরী ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, ১৩ বছর)
৭) নবাব বশীরুদ্দীন। (১২৪৩ হিজরী, ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১২৫৩ হিজরী ১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, ১০ বছর)
8) নবাব মুহাম্মাদ আলি শাহ। (১২৫৩ হিজরী, ১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১২৬৮ হিজরী ১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, ৫ বছর)
৯) নবাব আমজাদ আলি শাহ। (১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, ৫ বছর)
১০) নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। (১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, ৯ বছর)
(মুকাদ্দামা ওয়াকা দিল পজীর, পৃষ্ঠা-১২, হাওয়ালা- ফিরকা বেরেলবীয়াত কা তাহকিকী জায়যা, পৃষ্ঠা-৩৬-৩৭, মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস ঘুম্মান)
অযোধ্যা শহরের অবস্থাঃ
ভারতীয় উপমহাদেশে এই অযোধ্যা শহরে শিয়া মতবাদের প্রচারক সৈয়দ মুসা শিয়া সংস্কৃতির বুনিয়াদ রেখেছিলেন। অযোধ্যা শহরে শিয়া মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নবাব সুজাউদ দৌল্লাহ, নবাব আসফ উদ দৌল্লাহ, নবাব আমজাদ আলী শাহ, নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ প্রভৃতি শিয়া শাসকগন। তাঁদের প্রচেষ্ঠায় লক্ষ্ণৌ শহরে শিয়াদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সুলতানুল মাদারিস, মাদরাসাতুল ওয়াজীন, ইমাম বারগাহ আসফিয়া, ইমাম বারগাহ হুসাই আবাদ, দরগাহ ইমাম হুসাইন, দরগাহ হযরত আব্বাস আলী প্রভৃতি ইমারতের প্রতিষ্ঠা করা হয়। লক্ষ্ণৌ শহরে মাতমের এবং তাজিয়ার জুলুস এইসব শিয়া বাদশাহের পৃষ্ঠপোষতায় বের করা হত। ভারতবর্ষে মাতম এবং তাজিয়ার জুলুস তখন থেকেই শুরু হয় এবং আজ পর্যন্ত তা চালু আছে।
(তথ্যসূত্রঃ ফিরকা বেরেলবীয়াত কা তাহকীকি জায়যা, পৃষ্ঠা-৩৭)
শুধু তাই নয়, ভারতবর্ষে তাজিয়া পুজো এবং মুহাররমের জুলুসে তা তাওয়াফ করার সূচনাও নবাব আসফ উদ দৌল্লাহর সময়থেকেই শুরু হয়। (তথ্যসূত্রঃ বাদশাহ বেগম অযোধ্যা, পৃষ্ঠা-১২৩)
এই শিয়া নবাবেরা অযোধ্যার আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের (সুন্নী) মুসলমানদেরকে অত্যাচারের কাহিনী সকলেই জানত এবং তারা সুন্নী মুসলমানদেরকে জোর করে রাফেযী বা শিয়া বানাতে বেশ ভালভাবেই পটু ছিল।
অযোধ্যার এই শিয়া নবাবদের সাথে আলা হযরত মাওলানা আহমদ রেযা খানের খান্দানের সম্পর্ক ছিল মধুর ও গভীর। সেজন্যই ইমাম আহমদ রেযা খানের প্র-পিতামহ জনাব কাজেম আলী খান সাহেব রাফেযী শাসক নবাব আসফ উদ দৌল্লাহর উজির ছিলেন। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)
এই নবাব আসফ উদ দৌল্লাহ কট্টরপন্থী শিয়া ছিলেন। লক্ষ্ণৌ শহরে নবাব আসফ উদ দৌল্লাহর বিশাল ইমামবাড়া বানানো হয়েছে। এটা বানাতে দশ লাখ টাকা খরচা হয়েছে । (মুকাদ্দামা ফজিলতে সাহাবা ও আহলে বায়েত, পৃষ্ঠা-৪৬, ডাঃ আবু মুহাম্মাদ কাদেরী)
ডাঃ আবু মুহাম্মাদ কাদেরী আরও লিখেছেন, “নবাব আসফ উদ দৌল্লাহর যুগে এই শিয়া মতবাদের সব থেকে বেশী সম্প্রসারণ হয়। তাঁর সময়কালে নিজামুল মুলক একেবারেই ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। (ভারতে) ইংরেজদের দখলদারী মজবুত হতে থাকে। কিন্তু এই শিয়া মতবাদের সংগঠনগুলি খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠে।” (মুকাদ্দামা ফজিলতে সাহাবা ও আহলে বায়েত, পৃষ্ঠা-৪৮, ডাঃ আবু মুহাম্মাদ কাদেরী)
এইরকম ধরনের গোঁড়া ও কট্টরপন্থী শিয়া বা রাফেযী নবাবের উজির ছিলেন মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের প্র-পিতামহ মাওলানা কাজেম আলী খান। আমাদের প্রশ্ন একজন কট্টরপন্থী শিয়া যে সুন্নীদেরকে জোর করে রাফেযী বানাত তার উজির একজন সুন্নী মুসলমান কিভাবে হতে পারে?
মাওলানা আহমদ রেযা খানের পরিচয়
এই গেল মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের খান্দানের পরিচয়। এবার একটু আহমদ রেযা খান সাহেবের পরিচয়টুকু দেখা যাক।
নামঃ
মাওলানা সাবির নাসীম বাস্তুবী লিখেছেন, “হুজুরের জন্মগত নাম হল মুহাম্মাদ। তাঁর মাতা খুব সখ করে নাম রেখেছিলেন আম্মান মিঁয়া। তাঁর পিতা ও অন্য আত্মীয়স্বজনের নাম রেখেছিলেন আহমদ মিঁয়া। তাঁর দাদা তাঁর নাম রেখেছিলেন আহমদ রেযা। এবং তাঁর তারিখি নাম ছিল আল মুখতার। (১৩৭২ হিজরী)। তিনি নিজের নাম রেখেছিলেন আব্দুল মুস্তাফা এবং ইসলামী দুনিয়ায় আলা হযরত এবং ফাজিলে বেরেলবী নামে পরিচিতি লাভ করেন।” (আলা হযরত বেরেলবী, পৃষ্ঠা-২৫-২৬)
তাহলে দেখুন মাওলানা আহমদ রেযা খানে কারো রাখা নাম পছন্দ হয়নি তাই স্বয়ং তিনি নিজের নাম রাখেন আব্দুল মুস্তাফা।
সিলসিলা নসব বা বংশপঞ্জী
(আল মিযান, মুম্বাই)
প্রকৃতপক্ষে মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব শিয়া ছিলেন। এর আগে আমরা বিস্তারিত দলীল দিয়ে প্রমান করেছি যে খান সাহেবের খান্দানের সাথে শিয়া রাজা-বাদশাহের সাথে এক আঁতাত সম্পর্ক ছিল। এবং ভারতবর্ষের সুন্নী শাসনতন্ত্র পতনের জন্য অন্যতম দায়ী ছিল এই কথিত আলা হযরতের খান্দান। আহমদ রেযা খানের প্র-পিতামহ কাজেম আলী খান ছিলেন শিয়া নবাব আসফ উদ দৌল্লাহর উজির। তাই আহমদঃ রেযা খানের শিয়া হওয়াতে কোন সন্দেহ নেই।
অনেকে মনে করতে পারেন খান সাহেবের খান্দান শিয়া হলে কি হবে তিনি তো ইমামে আহলে সুন্নত ছিলেন।
আসলে আহমদ রেযা খান একজন ছুপা বা গুপ্ত শিয়া ছিলেন। তিনি সারা জীবন তাকিয়া করে নিজেকে সুন্নী হিসেবে প্রকাশ করেছেন। যাতে সুন্নীদের মধ্যে শিয়া মতবাদ স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রচার করা যেতে পারে। যদি শিয়া হয়ে এই মতবাদ প্রচার করতেন তাহলে সফলতা পেতেন না যা তিনি সুন্নীয়াতের লেবাস পরে করতে পেরেছেন। এর আগে প্রমান করা হয়েছে যে নবাব আসফ উদ দৌল্লাহর যুগে শিয়া মতবাদের বেশী সম্প্রসারণ বা প্রচার-প্রসার হয় এবং নবাব জোর করে সুন্নীদেরকে শিয়া বানাত আর সেই সেই নবাবের উজির ছিলেন মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের প্র-পিতামহ কাজেম আলী খান। তিনি কোন প্রতিবাদ করেন নি বা পদত্যাগ করেন নি। বোঝায় যায় তিনিও শিয়া মতবাদ প্রচারে নবাবের হাতে হাত মিলিয়েছিলেন।
কিন্তু আহমদ রেযা খান সাহেবের সময়টাই ছিল আলাদা। তখন আর নবাবদের যুগ ছিল না। ইংরেজরা ভারতবর্ষ পুরোপুরিভাবে দখল করে নিয়েছিল। আর সেই সময় সুন্নীদের (উলামায়ে দেওবন্দ) মুজাহিদীন গ্রুপগুলোও বেশ সক্রিয় ছিল। তাই প্রকাশ্যে সুন্নীদেরকে শিয়া বানানোর আন্দোলন চালালে প্রান পর্যন্ত যেতে পারে। সুতরাং খান সাহের তাঁর জামানায় ঠিকমত ফোঁড়ে আসরে পারেন নি। খান সাহেবের নিকট প্রকাশ্যে শিয়া মতবাদ প্রচারের কোন পথ খোলা ছিল না। একটাই পথ ছিল সেটা হল তাকিয়া নীতি অবলম্বন করা অর্থাৎ মনের গোপন অভিসন্ধী প্রকাশ না করে নিজেকে সুন্নী হিসেবে প্রকাশ করে শিয়া মতবাদ প্রচার করা।
আহমদ রেযা খান আগে থেকেই বুঝে গেছিলেন প্রকাশ্যে শিয়া হয়ে সুন্নীদের কাছে নিজের মতবাদ প্রচার করতে গেলে সুন্নীরা ‘রাফেযী’ বলে জুতোপেটা শুরু করবে। তাই তিনি এমন এক পন্থা অবলম্বন করেছিলেন যাতে তিনি ভেবেছিলেন সুন্নীদের জুতোপেটা থেকেও বেঁচে যাবেন এবং নিজের ভ্রান্ত মতাদর্শও প্রচার করে যাবেন। আর সেই পন্থাটি হল তাকিয়াবাজী বা নিজের গোপন অভিসন্ধী প্রকাশ না করে সুন্নী সেজে নিজের মতবাদ প্রচার করা। যাতে তাঁর এই চালবাজী কেউ ধরে ফেলতে না পারে সেজন্য তিনি শিয়াদের বিরুদ্ধে কিছু বই-পুস্তকও লিখে গেছেন। তিনি শিয়াদের বিরুদ্ধে প্রায় ১১ খানা পুস্তক রচনা করেছেন বলেতাঁর অনুসারীরা দাবী করেছে। তার মধ্যে (১) রদ্দুর রাফেযা, (২) লুমআতুস সামায়া লি হাদিয়ে শিয়াতিস সানায়া (১৩১৩ হিজরী), (৩) আল জুলালুল আনকা মিন বাহরে সঃবকাতিল আতকা, (প্রকাশ ১৩০০ হিজরী), (৪) গায়াতুত তাহকিক ফি ইমামাতিল আলী ও সিদ্দিক (প্রকাশ ১৩৩১ হিজরী)।
আহমদ রেযা খান শিয়াদের বিরুদ্ধে কেন লিখেছেন?
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে আহমদ রেযা খান যদি শিয়া বা রাফেযী হবেন তাহলে তিনি কেন এতগুলো বইপুস্তক শিয়াদের বিরুদ্ধে লিখলেন?
আসলে শিয়ারা বহু দলে ও উপদলে বিভক্ত। তাদের মধ্যে একটি হল কাফের শিয়া ও অন্যটি হল ফাসিক শিয়া। যেমন আল্লামা শামী লিখেছেন,
“যে শিয়া হযরত আলী (রাঃ)র খোদা হওয়ার আকিদা রাখে কিংবা এমন বিশ্বাস রাখে যে, জিব্রাইল (আঃ) ভূল করে হযরত আলীর জায়গায় মুহাম্মাদ (সাঃ)কে ‘ওহী’ (ঐশী বাণী) দিয়ে গেছেন, কিংব আ হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর সাহাবী হওয়ার অস্বীকার করে কিংবা হযরত আয়েশা (রাঃ)র উপর অপবাদ দেয়, এমন শিয়া দ্বীনের স্পষ্ট অকাট্য বিষয়ের বিরোধীতা করার কারনে কাফির। পক্ষান্তরে, যে শিয়া হযরত আলী (রাঃ) কে হযরত আবু বকর, উমার ও উসমান (রাঃ) প্রমুখ সাহাবাদের উপর প্রাধান্য দেয় কিংবা সাহাবাদের গালিগালাজ করে এমন শিয়া কাফের নয়, বিদআতী ও ফাসিক।” (ফাতাওয়া শামী, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৩৯৮)
সুতরাং মাওলানা আহমদ রেযা খান কাফির শিয়া ছিলেন না তবে ফাসিক শিয়া ছিলেন এটা একশ প্রতিশত সত্য। যদিও তাঁর অনেক কুফরী আকিদা ছিল তবুও উলামায়ে দেওবন্দ তাঁকে কাফের ফতোয়া দেন নি। আর আহমদ রেযা খান যা শিয়াদের বিরুদ্ধে শিয়াদের বিরুদ্ধে লিখেছেন তা কাফের শিয়াদের বিরুদ্ধে। যাঁদের সাথে খান সাহেবের মতের বিরোধীতা হয়েছে। যে শিয়া বা রাফেযীদের সাথে আহমদ রেযা খানের মতবিরোধ হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ১৫০ এর অধিক কিতাবের হাওয়ালা দিয়ে লিখেছেন,
১) রাফেযীগণ সাধারণতঃ কাফের ও মুরতাদ।
২) রাফেযীদের হাতের জবেহ করা পশু মৃত।
৩) রাফেযীদের সঙ্গে বিবাহ সাদী হারাম।
৪) রাফেযীদের সঙ্গে মেলামেশা করা, সালাম করা কবিরা গুনাহ এবং কঠিন হারাম।
৫) যে ব্যাক্তি রাফেযীদের ভ্রান্ত কুফরী আকিদা জানার পরেও তাদের মুসলমান মনে করবে তাদের কাফের হওয়াতে সন্দেহ করবে সমস্ত আয়েম্মাগণের নিকট সে ব্যাক্তিও কাফের ও বেদ্বীন হবে।
সুতরাং আহমদ রেযা খান সাহেব সেইসব কাফের শিয়াদের বিরুদ্ধেই কলম ধরেছেন যাদের সাথে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল। আর খান সাহেবের সব থেকে বড় বদ অভ্যাস ছিল যাঁর সাথেই তাঁর মতবিরোধ হত তাঁকেই কোন রকম দ্বিধা না করে কাফের ফতোয়া দিয়ে দিতেন। দেখতেন না তা মধ্যে কুফরী আকিদা আছে কিনা। এমনকি খান সাহেবের ফতোয়াতে তাঁর আব্বাজান নাকী আলী খান, আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীও কাফের ছিলেন। শুধু তাই নয় খান সাহেব স্বয়ং নিজের ফতোয়াতে নিজেই কাফের ছিলেন।
যাইহোক আহমদ রেযা খান সাহেব শিয়াদের বিরুদ্ধে বইপুস্তক লিখেছিলেন বলে এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে তিনি শিয়া বা রাফেযী ছিলেন না। যেমন ভারতবর্ষে হানাফীরা বহু দলে বিভক্ত। উদাহারণস্বরুপ- দেওবন্দী, বেরেলী, ফুরফুরা প্রভৃতি। এরা হানাফী হলেও একমাত্র দেওবন্দীরা ছাড়া কেউ প্রকৃ্ত হানাফী নয়। তবুও একে অপরের বিরুদ্ধে প্রচুর কিবাবপত্র লেখা হয়েছে এবং বাহাস মুনাযারাও হয়েছে। তবুও সকলেই হানাফী বলে দাবী করে। এমনকি তথাকথিত আহলে হাদীস নামধারী লা মাযহাবীরাও বহু দলে উপদলে বিভক্ত। এরা একটি দল অপর দলকে কাফের পর্যন্ত বলে থাকে তবুও তারা আহলে হাদীস। ঠিক সেই রকম আহমদ রেযা খান শিয়াদের বিরুদ্ধে কিতাব লিখলেও তিনি একজন গুপ্ত বা ছুপা শিয়া ছিলেন।
আহমদ রেযা খান শিয়াদের বিরুদ্ধে যা লেখালেখি করেছেন তাতে এও বলা যায় যে এটা ছিল তাঁর তাকিয়াবাজী। মানুষ যাতে তাঁকে শিয়া বলে ধরে ফেলতে না পারে সেজন্য তিনি শিয়াদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে ধরা খাওয়া থেকে কিছুটা হলেও বাঁচতে পেরেছেন। কিন্তু শরীয়াতের গোয়েন্দা উলামায়ে দেওবন্দের তদন্ত থেকে তিনি বাঁচতে পারেন নি। কারণ রাফেযী যে রুপ ধারণ করেই আসুক না কেন সুন্নীরা (দেওবন্দী) তাদেরকে চিনতে পেরে যায়। তাই খান সাহেবের শিয়াদের বিরুদ্ধে লেখালেখি দেখে এরকম মনে করার কোন কারণ নেই যে তিনি শিয়া ছিলেন না।
আহমদ রেযা খান সাহেব যে শিয়াদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন রাফেযীদের সঙ্গে মেলামেশা করা, সালাম করা কবীরা গুনাহ এবং কঠিন হারাম। তাহলে আহমদ রেযা খানের পুর্ব পুরুষ শিয়াদের সঙ্গে এত আঁতাত সম্পর্ক স্থাপন করল কেন? তাঁর পুর্ব পুরুষরা শিয়া বাদশাহ নাদির শাহের সাথে মিলিত হয়ে ভারতে সুন্নী মুঘল সাম্রাজ্য ধংস করল কেন? আর কেনই বা খান সাহেবের প্র-পিতামহ কাজেম আলী খান শিয়া নবাব আসফ উদ দৌল্লাহর উজির হয়ে সুন্নী মুসলমানদেরকে জোর করে শিয়া (রাফেযী) বানাতে সাহয্য করলেন? তাহলে আহমদ রেযা খান সাহেব নিজের পুর্ব পুরুষদের বিরুদ্ধে ফতোয়া লাগালেন না কেন যে তাঁর পুর্বপুরুষরা সকলেই কাফের ছিলেন এবং তাঁদের কারো বিবাহ শুদ্ধ হয়নি। তাঁর পুর্ব পুরুষরা সকলেই মুরতাদ ও কাফের ছিলেন। এরকম ধরনের কোন ফতোয়া খান সাহেব দিয়েছেন কি? দেন নি। বোঝা গেল তিনি নিকে একজন গুপ্ত বা ছুপা শিয়া ছিলেন।
আহমদ রেযা খানের শিয়া হবার প্রমাণ
১) এর আগে বিস্তারিত দলীল দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে যে মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের পুর্বপুরুষ শিয়া ছিল। ভারতে সুন্নী শাসনতন্ত্র পতনের অন্যতম কারণ ছিল এই তথাকথিত আলা হযরতের খান্দান। খান সাহেবের বংশপঞ্জী এরকম,
“আব্দুল মুস্তাফা আহমদ রেযা খান ইবনে মাওলানা নাকী আলি খান বিন হযরত মাওলানা রেযা আলি খান বিন হযরত মাওলানা হাফিয মুহাম্মাদ কাজেম আলি খান বিন হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মাদ আজম খান বিন মুহাম্মাদ সাদাত ইয়ার খান বিন হযরত মুহাম্মাদ সায়ীদুল্লাহ খান। হুজুরের (আহমদ রেযা খান) বাপ দাদারা কান্দাহারের মৌকির গোত্রের বঢ়িচের পাঠান ছিলেন।” (হায়াতের আলা হযরত, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২)
দেখুন আহমদ রেযা খানের বংশপঞ্জী শিয়া নামের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ। শিয়াদের বারো ইমামের নামের সাথে তাঁর বাপ-দাদার নামের সাথে অদ্ভুত মিল রয়েছে। শিয়ারা ইমামতের সিলসিলায় বিশ্বাস করে। শিয়াদের ৭ম ইমাম হল মুসা কাজেম আর আহমদ রেযা খানের প্র-পিতামহেরও নাম হল কাজেম আলী। শিয়াদের ৮ম ইমামের নাম আলী রেযা বা রেযা আলী আর আহমদ রেযা খানের পিতামহেরও (দাদাজান) নাম হল রেযা আলী। শিয়াদের ১০ম ইমামের নাম হল আলী নাকী বা নাকী আলী আর আহমদ রেযা খানের পিতার নামও নাকী আলী। এইসব নাম ইমামিয়া শিয়াদের মধ্যে প্রচলিত। সেই নাম গ্রহণ করেছেন আলা হযরতের খান্দানের লোকেরা। এইসব নাম আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের নয়। সুতরাং বোঝা যায় ইমাম আহমদ রেযা খান একজন শিয়া ছিলেন।
২) আহমদ রেযা খানের পুত্র ও পরবর্তী বংশধরদের নাম হল এই রকম, মুস্তাফা রেযা খান, হামিদ রেযা খান, আনওয়ার রেযা খান, ইবরাহীম রেযা খান, হাম্মাদ রেযা খান, আফান রেযা খান, কমর রেযা খান, আখতার রেযা খান, তানবীর রেযা খান, রিহান রেযা খান, আসজাদ রেযা খান, ফাইযান রেযা খান, উসমান রেযা খান, তাওকীর রেযা খান, তাওসীফ রেযা খান, তসলীম রেযা খান প্রভৃতি।
দেখুন, ‘রেযা’ নামটিও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের মধ্যে প্রচলিত নাম নয়। এটিও শিয়াদের প্রচলিত নাম। সুতরাং আহমদ রেযা খান ও তাঁর বংশধররা যে শিয়া এটা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
৩) মাওলানা আহমদ রেযা খানের বই পত্রে এমন হাদীস পাওয়া যায় যা শিয়াদের থেকে বর্ণিত। যা আহলে সুন্নতের সাথে দুরতম কোন সম্পর্ক নেই। যেমন,
(ক) হযরত আলী (রাঃ) কিয়ামতের দিন জাহান্নামের টিকিট বন্টন করবেন। (আল আমনু অল উলা, পৃষ্ঠা-৫৮)
(খ) ফাতেমা (রাঃ) এর নাম ফাতেমা এজন্য রাখা হয়েছে যে আল্লাহ তাআলা তাঁকে এবং তাঁর বংশধরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। (খতমে নবুওয়াত, পৃষ্ঠা-১৮)
(গ) শিয়া ইমামদের মর্যাদা দেবার জন্য তিনি এই আকিদা উদ্ভাবন করেছেন যে গাওসগন অর্থাৎ সৃষ্টিজগতের জন্য প্রার্থনাকারীগন হযরত আলী (রাঃ) থেকে হাসান আসকারী পর্যন্ত পৌঁছে যান। এ ব্যাপারে তিনি ঐ বিন্যাসই বজায় রেখেছেন যা শিয়া ইমামদের বিন্যাস। (মালফুযাত,পৃষ্ঠা-১১৫)
(ঘ)মাওলানা আহমদ রেযা খান শাহেব সমস্ত সাহাবাদের মধ্যে শুধুমাত্র হযরত আলী (রাঃ) কে মুশকিল কুশা অর্থাৎ বিপদ থেকে উদ্ভাবনকারী বলেছেন এবং লিখেছেন, যে ব্যাক্তি দুয়ায়ে সাইফী পড়ে তার বিপদ দুর হয়ে যায়। দুয়ায়ে সাইফী হল,
অনুবাদঃ- হযরত আলীকে ডাকো যাঁর দ্বারা আশ্চর্য বিষয় প্রকাশ পায় তুমি তাকে সাহায্যকারী পাবে। হে আলী! আপনার আল্লাহর নৈকট্যের দ্বারা সমস্ত দুঃখ কষ্ট দুর হয়ে যায়। (আল আমনু অল উলা, পৃষ্ঠা-১২-১৩)
(ঙ) এভাবে তিনি পাক পাঞ্জেতনের ধারণা জনমনে ছড়িয়ে দিয়েছেন যেটা প্রকৃতপক্ষে শিয়াদের আকিদা। তিনি লিখেছেন, পাঁচ বিশাল ব্যাক্তিত্ব্য এমনই যাঁরা নিজ বরকতের সাহায্যে আমার অসুখ দুর করে দেন। (এঁরা হলেন) মুহাম্মাদ (সাঃ), আলী (রাঃ) হাসান (রাঃ), হুসাইন (রাঃ) ও ফাতেমা (রাঃ)। (ফাতাওয়া রেযবীয়া, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা-১৭৮)
(চ) মাওলানা আহমদ রেযা খান তাঁর কিতাবে শিয়াদের বর্ণনা স্থান দিয়েছেন। বর্ণনাটি হল,
শিয়াদের অষ্টম ইমাম রেযাকে বলা হল, এমন কোনও দুয়া শিখিয়ে দিন যা আমরা আহলে বায়েতের কবরে জিয়ারতের সময় পড়ব। তিনি বললেন- কবরের নিকট গিয়ে ৪৫ বার আল্লাহু আকবার বলে বলো আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল বায়েত, হে আহলে বায়েত আমি আমার বিপদ আপদ দুঃখ কষ্ট নিরসনের জন্য আপনাকে আল্লাহর নিকট সুপারিশকারী হিসাবে পেশ করছি এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের বংশধরদের শত্রু থেকে আমি দুরত্ব প্রকাশ করছি। (ফাতাওয়া রেযবীয়া, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-২৯৯)
অর্থাৎ শিয়া ইমামগণকে মুসলমানদের নিকট পুন্যাত্মা এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ও আহলে সুন্নতের ইমামগণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করার জন্য তিনি এই ধরণের বর্ণনাকে প্রচার করেছেন। যা শিয়াদের আকিদা বিশ্বাস। এই আকিদার সাথে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের দূরতমও কোন সম্পর্ক নেই। এর দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় যে মাওলানা আহমদ রেযা খান শিয়া বা রাফেযী ছিলেন।
(ছ) মাওলানা আহমদ রেযা খান শিয়াদের ধর্মীয় গুম্বদ তাজিয়ার ব্যাপারে লিখেছেন – তাবাররুক কে লিয়ে হযরত হুসাইন রাজি আল্লাহু আনহু কে মাকবরে কা নমুনা বানা কর ঘর কে অন্দার রাখনে মে কোই হারয নেহী। অর্থাৎ বরকতের জন্য হযরত হুসাইন (রাঃ) এর কবরের নমূনা (মুর্তী) বাড়িতে রাখার মধ্যে কোনো অসুবিধা নেই। (রিসালা বদরুল আনওয়ার, পৃষ্ঠা-৫৭)
এই কথাগুলি মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব তাজিয়াকে গ্রহণযোগ্য করার জন্যই লিখেছেন। অথচ তাজিয়ার সাথে আহলে সুন্নতের কোণ সম্পর্ক নেই। এটা হল শিয়াদের ধর্মীয় মূর্তী। এর দ্বারা বোঝা যায় মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব শিয়া বা রাফেযী ছিলেন।
এধরণের বহু বর্ণনা ও মাসআলা মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবের কিতাবে পাওয়া যায় যার দ্বারা তাঁর শিয়া হওয়া পরিস্কার বোঝা যায়। সুতরাং মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব সুন্নীয়াতের আড়ালে শিয়া মতবাদ প্রচার করেছেন তা দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার। শিয়ারা তাদের বারো ইমাম সম্পর্কে সেই আকিদায় রাখে যা একজন সুন্নী মুসলমান আম্বিয়াদের ব্যাপারে রাখে। সুন্নীরা আম্বিয়া (আঃ) দেরকে মাসুম মনে করে এবং শিয়ারা তাদের বারো ইমামকে মাসুম মনে করে যা সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী আকিদা। আর এইসব শিয়া আকিদাই মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব তাঁর কিতাবে প্রচার করে গেছেন। খান সাহেবের শিয়া হওয়ার প্রমাণ তাঁর কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
উম্মাহাতুল মোমেনীনদের শানে মাওলানা আহমদ রেযা খানের গুস্তাখী
মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব উম্মাহাতুল মোমেনীনদের ব্যাপারে মারাত্মক গুস্তাখী করে লিখেছেন,
“আম্বিয়া (আঃ)দের কবরে তাঁদের স্ত্রীদের পেশ করা হয় এবং তাঁরা স্ত্রীদের সাথে (কবরে) সহবাস করেন।” (মালফুযাত, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-২৭)
অথচ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের এটা আকিদা নয় যে আম্বিয়াদের কবরে তাঁদের স্ত্রীদের পেশ করা হয়। এটা হল শিয়া বা রাফেযীদের আকিদা। যেহেতু খান সাহেব রাফেযী ছিলেন তাই তিনি এই আকিদা পোষন করতেন।
মাওলানা আহমদ রেযা খান মুহাম্মাদ বিন বাকীর উপর এই মিথ্যাচার করে এই কথা বলেছেন অথচ মুহাম্মাদ বিন বাকী একথা কোথাও বলেন নি। মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব এই কথার কোন হাওয়ালা দেননি, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে খান সাহেব তাঁর অভ্যাস অনুযায়ী আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের কোন বুযর্গের লেখনী থেকে একথা প্রমাণ করতে পারবেন না যে, “আম্বিয়া (আঃ)দের কবরে তাঁদের স্ত্রীদের পেশ করা হয় এবং তাঁরা স্ত্রীদের সাথে (কবরে) সহবাস করেন।”
এই বর্ণনা কোন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের কিতাবে নেই তবে শিয়াদের কিতাবে আছে। তাহলে দেখুন শিয়াদের বিখ্যাত কিতাব ‘উসুলে কাফী’ এর মধ্যে লেখা আছে,
আল্লামা কিলানী জাফর বিন আল মুসনাল খাতিব বর্ণনা করেছেন, আমি তখন মদীনায় ছিলাম যখন মসজিদের ছাতের সেই অংশ হুযুরে আকরাম (সাঃ) এর কবরের সংলগ্ন ছিল। কর্মীরা উপর নিচে উঠানামা করত। আমি আমার সাথীদের (শিয়া) বললাম, আজ রাত্রে কি তোমাদের মধ্যে কেউ ইমাম জাফর সাদিকের কাছে যাবে? মেহরান বিন আবী নসর ও ইসমাইল বিন আম্মার আল সিরনী দুজনেই বলল, হ্যাঁ। আমি তাদেরকে বললাম যে তারা যে ইমামকে (জাফর সাদিক) জিজ্ঞাসা করে যে নবী করীম (সাঃ) এর কবরে উঠা কি জায়েয?
তখন ইমাম জাফর সাদিক বললেন, “আমি পছন্দ করিনা যে কোন ব্যাক্তি তার উপর (রাসুলের রওজার উপর) উঠুক এবং এও চাই না যে কেউ নির্ভয়ে এমন কোন জিনিস দেখুক যা দেখতেই ইচ্ছা করে অথবা হুযুর (সাঃ) কে দাঁড়ানো অবস্থায় নামায পড়তে দেখুক অথবা হুযুর (সাঃ) কে তাঁর স্ত্রীদের সাথে (সহবাসে) লিপ্ত দেখুক এটা আমি চাই না।” (উসুলে কাফী, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৪৫২)
তাহলে শিয়াদের আকিদার সাথে মাওলানা আহমদ রেযা খানের আকিদার কি অদ্ভূত মিল দেখুন। খান সাহেবও লিখেছেন যে আম্বিয়াদের কবরে তাঁদের স্ত্রীদের পেশ করা হয় এবং তাঁরা সহবাস করেন আর শিয়ারাও ইমাম জাফর সাদিকের হাওয়ালা দিয়ে লিখেছে যে নবী (সাঃ) কবরে স্ত্রীদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হন। তাহলে কি প্রমাণ হয় না যে মাওলানা আহমদ রেযা খান একজন কট্টরপন্থী শিয়া বা রাফেযী ছিলেন?
এখানে শিয়ারা মিথ্যাচার করে তাদের এই জঘন্য আকিদা ইমাম জাফর সাদিকের নামে চাপিয়েছে, ইমাম সাহেব তো জাফর বিন আল মুসনাল খাতিবের যুগে জন্মগ্রহণই করেন নি তাহলে ইমাম জাফরের কাছে তাঁর প্রশ্ন করার ঘটনাটাই মিথ্যা।
অনুরুপ মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেবও মুহাম্মাদ বিন আব্দুল বাকী যুরকানীর নামে মিথ্যাচার করেছেন। আল্লামা যুরকানী (রহঃ) আকিদা হায়াতুন নবীর ব্যাপারে লিখেছেন,
“আম্বিয়াগণ এবং শহীদগণ (সেখানকার অবস্থা অনুযায়ী) খাদ্যগ্রহণ করেন এবং পানাহারও করেন। নামায, রোজা, হজ্বও করেন এবং মহিলাদের বিবাহ করার ব্যাপারে (শিয়াদের) মতভেদ আছে। তাঁরা নামায এবং হজ্বের সাওয়াবও পেয়ে থাকেন কিন্তু তাঁরা এসব কাজের জন্য বাধ্য নন।” (শারাহ মাওহাবে নাদুন্নিয়া লিয যুরকানী, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩৩৫)
এর এক পৃষ্ঠা আগে আল্লামা যুরকারী ওয়ারাশাতে আম্বিয়ার ব্যাপারে শিয়াদের সাথে মতভেদ করেছেন সুততাং এখানে মতভেদ বলতে শিয়াদের মতভেদকেই বুঝিয়েছেন। সুতরাং আহমদ রেযা খান যে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল বাকীর আকিদা বলে চালিয়েছেন তা পরিস্কার মিথ্যা। তিনি শিয়াদের থেকে এই আকিদা গ্রহণ করেছেন।
সুতরাং মাওলানা আহমদ রেযা খান একজন শিয়া বা রাফেযী ছিলেন তা তাঁর আকিদা থেকে পরিস্কার বোঝা যায়।
আহমদ রেযা খান হযরত আলী (রাঃ) কে আল্লাহর সাথে তুলনা করেছেন
শিয়ারা হযরত আলী (রাঃ) কে সমস্ত সাহাবীদের থেকে উপরে স্থান দেয় এবং শিয়াদের কোন কোন দল হযরত আলী (রাঃ) কে খোদায়ী বৈশিষ্ঠের অধিকারী বলে দাবী করে । বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জ্বিলানী (রহঃ) শিয়াদের আকিদা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন,
“(শিয়াদের) কেউ কেউ আবার বলে হযরত আলীই (রাঃ) ছিলেন প্রভূ (নাউজুবিল্লাহ)। এই ফেরকার লোকেরা এইসব কথা বার্তার জন্য ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে।” (গুনিয়াতুত তালেবীন, পৃষ্ঠা-১২৯)
এবার দেখুন হযরত আলী (রাঃ) এর ব্যাপারে মাওলানা আহমদ রেযা খানের আকিদা কি? তিনি হযরত আলী (রাঃ) কে সরাসরী খোদা বলেন নি তবে এমনভাবে তুলনা দিয়েছেন যা সম্পূর্ণ কুফরী। তিনি লিখেছেন,
বে সক আলী কা নাম নামে আল্লাহ
বাঁতে হ্যায় আপ কি কালামুল্লাহ।
(নাতে মাকবুলে খোদা, পৃষ্ঠা-৪২)
অর্থাৎ নিশ্চয় আলীর নামটাই হল আল্লাহর নাম। তাঁর কথাই হল কালামুল্লাহ বা আল্লাহর কালাম।
এবার বলুন মাওলানা আহমদ রেযা খানকে কি আর শিয়া হওয়াতে কোন সন্দেহ আছে? শিয়াদের মত তিনি স্পষ্ট আলীকে খোদার সাথে তুলনা করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ মিন যালিক)
সাহাবীকে কাফের ফতোয়া দিয়েছেন আহমদ রেযা খান
হযরত আব্দুর রহমান কারী একজন সাহাবী ছিলেন। রিজাল শাস্ত্রের বিখ্যাত কিতাব ‘তাহযীবুত তাহযীব’ এর মধ্যে লেখা আছে,
“বনী কারাহ গোত্রের হযরত আব্দুর রহমান কারী একজন সাহাবী ছিলেন।” (তাহযীব, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-২২৩)
এই বিখ্যাত সাহাবীর ব্যাপারে মাওলানা আহমদ রেযা খান কুফরের ফতোয়া লাগিয়েছেন। দেখুন ‘মালফুযাত’ কিতাবের তৃ্তীয় খণ্ড, ৮৮ পৃষ্ঠা)
হযরত আব্দুর রহমান কারী হযরত উমার (রাঃ) এর জামানায় বাইতুল মালে অবস্থান করেছিলেন। তিনি মদীনার আলেমদের মধ্যে একজন ছিলেন। মাওয়ালানা আহমদ রেযা খান সাহেব এমন একজন সাহাবীকে কাফের ফতোয়া দিয়ে চুড়ান্ত বেইমানীর পরিচয় দিয়েছেন। খান সাহেব বলেছেন যে হযরত আব্দুর রহমান কারীর মৃত্যু কাফের অবস্থায় হয়েছিল এবং তাঁকে নাকি হযরত আবু কাতাদাহ (রাঃ) হত্যা করেছিলেন। (আস্তাগফিরুল্লাহ হাযা বুহতানুল আযীম)
মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব লিখেছেন,
“মুহাম্মাদী শের (হযরত আবু কাতাদাহ রাজিআল্লাহু আনহু) এর শুয়োর ও শয়তানটাকে (আব্দুর রহমান কারী) হত্যা করে।” (মালফুযাত, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৬)
মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহাবী আব্দুর রহমান কারীকে কাফের বলেই ক্ষান্ত হলেন না। তিনি এই সাহাবীর জন্য ‘শুয়োর’ এর মত নাপাক শব্দও ব্যাবহার করলেন।
এটা অবশ্যই সত্য যে যাদের পাত্রে যা থাকে তাই বেরিয়ে আসে। যারা সাহাবীদেরকে গালিগালাজ করে তারা কোনদিন মুসলমান হতে পারে?
আসলে মাওলানা আহমদ রেযা খান একজন কট্টরপন্থী শিয়া ছিলেন কেননা শিয়ারাই সাহাবীদেরকে কাফির ও মুরতাদ ফতোয়া দেয়। যেমন শিয়াদের ইমাম বাকের বলেন, মাত্র তিনজন সাহআবা মুসলমান ছিলেন, (১) আবু যর, (২) মেকদাদ ও (৩) সালমান ফারসী। এই তিনজন ছাড়া সকলেই মুরতাদ অর্থাৎ ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছিলেন।” (তাফসীরে ছাফী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৮৯)
মাওলানা আহমদ রেযা খানও সাহাবী হযরত আব্দুর রহমান কারী (রাঃ)কে কাফের ফতোয়া দিয়ে প্রমাণ করে দিলেন যেঁ তিনি একজন শিয়া মতাবলম্বী। শিয়ারা ছাড়া আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের কেউ সাহাবীদেরকে কাফের ফতোয়া দেয় না। কিন্তু বদবখত আহমদ রেযা খান সাহাবী হযরত আব্দুর রহমান কারী (রাঃ)কে কাফের ফতোয়া দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি অশ্রাব্য ‘শুয়োর’ বলে গালি দিয়েছেন। (মাআজাল্লাহ)
যে ব্যাক্তি সাহাবীদেরকে কাফের ফতোয়া দিতে পারে সে যদি মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ), মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতুবী (রহঃ) মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহঃ), মাওলানা ইসমেইল শহীদ দেহলবী (রহঃ), মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী (রহঃ) প্রভৃতি বুযর্গদের কাফের ফতোয়া এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এইসব বুযর্গরা তো সাহাবীদের গোলাম ছিলেন।
তাহলে বলুন মাওলানা আহমদ রেযা খানের শিয়া হওয়াতে কোন সন্দেহ আছে ? কোন সন্দেহ নেই।
হযরত উসমান গনী জিন্নুরাইন (রাঃ) এর শানে গুস্তাখী
এটা সকলেই জানেন যে সাইয়েদেনা উসমান গনী (রাঃ) এর খেলাফতের যুগে জুমার দ্বিতীয় আযান মসজিদের ভিতর মিম্বরের সামনে দেওয়া হত এবং এর উপর সাহাবীদের ইজমা হয়েছিল। কেউ এটাকে অস্বীকার করেন নি। হযরত উসমান গনী (রাঃ) এর জামানা থেকে আজ পর্যন্ত এই সুন্নত মুসলমানদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে চালু আছে। মাওলানা আহমদ রেযা খান এই সুন্নতের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠান এবং ফতোয়া দেন যে জুমার দ্বিতীয় আযান মসজিদের বাইরে দেওয়া জরুরী।
বাদায়ুনের আলেমরা হযরত উসমান গনী (রাঃ) এর পক্ষাবলম্বন করেন। মাওলানা আহমদ রেযা খান তেদেরকে পিদর পরস্তী (পিতৃ পুজক) বলে কটাক্ষ করেন। মাওলানা আব্দুল কাদের বাদায়ুনী উসমানী ছিলেন। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের প্রতি মুহাব্বত থাকার কারণে তিনি খুলাফায়ে রাশেদীনদের ইত্তেবা থেকে বের হতে চাননি। তিনি আহমদ রেযা খানের অনুসারী হয়ে রাফেযী হতে চানন।
এবার দেখুন মাওলানা আহমদ রেযা খান কিরকম হযরত উসমা গনী (রাঃ) কে প্রিয়নবী (সাঃ) এর বিরোধী সাব্যস্ত করছেন। তিনি লিখেছেন,
“দরজার সামনে আযান দেওয়া সুন্নত এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর এটাই অনুসরণ। যদি সে সেখানকার ইমাম থাকে তবুও। যারা এর বিরোধীতা করে তারা মুর্খ, অভদ্র এবং তাদের হাজারটা গালি দেওয়ার যোগ্য। যে পিতৃপুজার জন্য নবী (সাঃ) এর সুন্নত এবং ফিকহী আদেশকে পিছনে ফেলে দেয় তারা মুর্খের চেয়েও অধম।” (ইজালা আনওয়ারে রেযা, পৃষ্ঠা-১৩)
দেখুন খান সাহেব হযরত উসমান গনী (রাঃ) এর সুন্নতের অনুসারীদেরকে কিরকম পিতৃপুজক, মুর্খ, অভদ্র, হাজারটা গালি দেওয়ার যোগ্য বলে গালিগালাজ করছেন। এটা কি হযরত উসমান গনী (রাঃ) ও তার জামানায় সব সাহাবীদের গালি দেওয়া হচ্ছে না যারা তাঁর জামায় এই সুন্নতের উপর আমল করেছিলেন।
আজমীর শরীফের বিখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা মইনুদ্দীন সাহেব যিনি উসমানিয়া মাদ্রাসার উস্তাদ ছিলেন, তিনি কোন দেওবন্দী ছিলেন না। তিনি আল্লামা ফজলে হক খয়রাবাদীর অনুসারীদের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি পীর কামরুদ্দীন সিয়ালবীর উস্তাদ ছিলেন। তিনি মাওলানা আহমদ রেযা খানে এই গুস্তাখী দেখে চুপ থাকপে পারেন নি। তিনি লিখেছেন,
“এটা পরিস্কার তৃ্তীয় খলিফা হযরত উসমা গনী জিন্নুরাইন (রাঃ) এর উপর অপবাদ যে তিনি মাআজাল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নতের খেলাফ ছিলেন এবং তাঁর এই সুন্নতের বিরোধী কাজে সমস্ত সাহাবীরা ছিলেন। এবং সুন্নতের অনুসরণ করার তওফিক লাভ করলেন সেই ব্যাক্তি যিনি ১৪ শত বছর পর বেরেলীর মাটি থেকে উঠলেন। (অর্থাৎ আহমদ রেযা খান)।” (তাজাল্লিয়াতে আনওয়ারে মাঈন, পৃষ্ঠা-৪৩)
শিয়ারাও হযরত উসমান গনী (রাঃ) কে গালিগালাজ করে এবং মাওলানা আহমদ রেযা খানও জুমার দ্বিতীয় আযানকে কেন্দ্র করে হযরত উসমান গনী (রাঃ)কে গালিগালাজ করলেন। এবার বলুন মাওলানা আহমদ রেযা খানের শিয়া বা রাফেযী হওয়াতে কোন সন্দেহ আছে?
পরিশিষ্ট
প্রিয় পাঠক! দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে এটা পরিস্কার হয়ে গেল যে মাওলানা আহমদ রেযা খান সাহেব ‘সুন্নী’ মুসলমান ছিলেন না। তিনি একজন শিয়া বা রাফেযী মতাবলম্বী ছিলেন যা তাঁ আকিদা বিশ্লেষন করলে ও তাঁর গ্রন্থাদি অধ্যায়ন করলেই পরিস্কার বোঝা যায়। তিনি তিনি এমন এক নিরালা শিয়া মুজাদ্দিদ ছিলেন যে তিনি সুন্নীয়াতের আড়ালে শিয়া মতবাদ প্রচার করে গেছেন। সারা জীবন তাকিয়া করে অর্থাৎ মনের গোপন অভিসন্ধী প্রকাশ না করে সুন্নী সেজে সুন্নীদের মাঝে শিয়া মতবাদ প্রচার করেছেন। কেউ যাতে তাঁকে শিয়া বলে ধরে না ফেলে সেজন্য তিনি বেশ কয়েকটি শিয়াদের বিরুদ্ধে পুস্তকও রচনা করেছেন।
রেযাখানীরা মাওলানা আহমদ রেযা খানকে এমনই নিরালা মুজাদ্দিদ বানিয়েছে যা কোন অতি বড় শিয়াও তাদের তথাকথিত ইমামদেরকে বানায়নি। শিয়ারা তাদের ইমামকে মাসুম বলেছে কিন্তু এই রেযাখানী ধর্মাবলম্বীরা মাওলানা আহমদ রেযা খানকে কখনো নবীর আসনে কখনো খোদার আসনে বসিয়ে ছেড়েছে। যেমন, আব্দুস সাত্তার রেযবী লিখেছে,
ইয়ে দুয়া হ্যায় ইয়ে দুয়া হ্যায় ইয়ে দুয়া
তেরা আউর সবকা খোদা আহমদ রেযা।
(নাগমাতুর রুহ, পৃষ্ঠা-৪)
অর্থাৎ এই দুয়া এই দুয়া এই দুয়া। তোমার এবং সকলের খোদা আহমদ রেযা। অর্থাৎ রেযাখানীদের খোদা আহমদ রেযা খান বেরেলবী। রেযাখানীরা এও বলেছে,
লা জাওয়ালে লাজ তেরে হাত হ্যায়
বান্দা হ্যায় বান্দা তেরা আহমদ রেযা।
(নাগমাতুর রুহ, পৃষ্ঠা-৮)
যে ব্যাক্তি একজন কট্টরপন্থী শিয়া তাকে রেযাখানীরা খোদা বানিয়ে ছেড়েছে। (নাউজুবিল্লাহে মিন যালিক)।
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) এর শানে আহমদ রেযা খান যে অবমাননা করেছেন তা জানতে পড়ুন,
মাওলানা আহমদ রেযা খান এর আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) এর শানে অবমাননা