লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমন মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। মহান আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলামের আবির্ভাবের আগে আরবসহ সারা সমগ্র বিশ্ব ছিল জাহিলিয়ার (অজ্ঞতার) ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সেজন্য এই যুগটিকে বলা হয় আইয়ামে জাহিলিয়াত। সে যুগে আরবে আইন-কানুন, নীতি নৈতিকতা, ধার্মিকতা, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষাসংস্কৃতি, মানবতাবােধ, শুদ্ধতা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোনাে সুষ্ঠু নিয়ম-নীতি ছিল না। সব জায়গাতেই বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য বিরাজ করছিল। ইসলামের আবির্ভাবে এ বিশ্বজুড়ে অন্ধকারের অবসান ঘটে এবং সত্যিকার সুন্দর প্রভাতের আলোকচ্ছটায় আরবসহ বিশ্বজাহান উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
আরবের অবস্থান ও আয়তন
ইসলামের জন্মভূমি আরব দেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম উপদ্বীপ। এটি এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে – অবস্থিত। আরবের উত্তরে সিরিয়ার মরুভূমি, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পূর্বে পারস্য উপসাগর এবং পশ্চিমে লােহিত সাগর রয়েছে। ভৌগােলিক অবস্থানের দিক দিয়ে এটি এশিয়া, ইউরােপ ও আফ্রিকা মহাদেশের সংযােগস্থলে অবস্থিত। এদেশের মাটি পৃথিবীর প্রাচীনতম শিলা। তাই আরবের মক্কা নগরীকে ‘উম্মুল কুরা’ বা আদি নগরী বলা হয়েছে। তদানিন্তন আরবের আয়তন ছিল ১০,২৭,০০০ বর্গমাইল। আয়তনে এটি ইউরােপের একচতুর্থাংশ এবং আমেরিকার একতৃতীয়াংশ। উত্তর আরবের সামান্য কিছু স্থানে মরূদ্যান আছে, সেখানে লােকবসতি গড়ে ওঠে। এছাড়া প্রায় সমগ্র আরব অঞ্চল মরুময়। হিজায, নজু এবং আল্-হাস্সা প্রদেশ নিয়ে আরব দেশ গঠিত। হামাউত, ইয়েমেন ও ওমান নিয়ে দক্ষিণ আরব গঠিত। এ এলাকা উর্বর এবং প্রাচীনকালে এটিকে Arabia Felix বা সৌভাগ্য আরব বলা হতাে।
আরবের নামকরণ
আরবকে কেন আরব নামকরণ করা হয়েছে সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। প্রসিদ্ধ কয়েকটি মতামত নিম্নে বর্ণনা করা হলাে-
১. আরব শব্দটির অর্থ হলাে ‘পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও সুন্দর ভাষায় কথা বলা’। যেহেতু আরবের অধিবাসীরা নিজেদের ভাষা ও পাণ্ডিত্যের সম্মুখে সমগ্র পৃথিবীর লােককে ‘আজমী’ (মূক, বােবা) বলে ভাবতে, এজন্য তারা নিজেদের আরব বা আরবি এবং পৃথিবীর অন্যান্য জাতিসমূহকে আজম বা আজমি অর্থাৎ কথা বলতে অক্ষম বলে মনে করতাে। ধীরে ধীরে পৃথিবীর অন্যান্য জাতি তাদের আরব বা আরবি নাম ডাকতে শুরু করে। ফলে তারা ‘আরব’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
২. ‘আরব’ শব্দটি ‘আল-আরবাতু’ থেকে নির্গত হয়েছে যার অর্থ হলাে ‘লতাগুল্মহীন মরুভূমি’। যেহেতু এ অঞ্চল বৃক্ষলতাহীন মরুভূমি। তাই এ অঞ্চলটিকে আরব নামকরণ করা হয়েছে।
আইয়ামে জাহিলিয়া বা অন্ধকার যুগ
আইয়ামে জাহিলিয়া দুটি আরবী শব্দের সমষ্টি হলাে- ১. আইয়াম ও ২. জাহিলিয়া। আইয়াম শব্দটির আরবি অর্থ হল ইয়াওমুন শব্দের বহুবন। অর্থ হলাে- দিন, যা লাইলুন বা রাতের বিপরীত অর্থে ব্যবহার হয়। তবে ইয়াওমুন শব্দের ব্যবহার সময়, কাল, যুগ, time, period, age ইত্যাদি অর্থেও হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে ঘােষণা করেন- “আমি মানুষের পরস্পর উন্নতি ও অবনতির যুগ পরিবর্তন করে থাকি।” এখানে আইয়াম দিয়ে যুগ বুঝানাে হয়েছে।
আর জাহিলিয়া শব্দটি আরবি জাহলুন শব্দ থেকে উৎলিত। অর্থ হলাে- বর্বরতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অন্ধকার, Ignorace, darkness. তাই আইয়ামে জাহিলিয়া অর্থ অন্ধকার যুগ। ইংরেজিতে বলা হয় The age of Ignorance. ইসলামের ইতিহাসে এ শব্দটি মহানবী হজরত (সাঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বেকার আরবদের অবস্থা সম্পর্কে ব্যবহার হয়। কেননা এ যুগে আরবরা সাধারণত স্বভাব-চরিত্রের দিক থেকে অজ্ঞতা ও মূর্খতার চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। যদিও কোনাে ঐতিহাসিক ‘আইয়ামে জাহিলিয়া’ বলতে হযরত ঈসা (আ.) এবং হজরত (সাঃ) -এর মধ্যকার ‘ফাতরাতে অহী’ তথা অহী মুলতবির সময়কে উদ্দেশ্য করেছেন, কিন্তু ঐতিহাসিকদের অধিকাংশের মতে, হযরত ঈসা (আ.)-এর পরবর্তী কালের কোনাে উল্লেখ নেই। কেননা হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর পর থেকেই ক্রমান্বয়ে সমগ্র আরবে মূর্খতাজনিত অন্ধকার ও পথভ্রষ্টতার অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করতে থাকে, যা পরবর্তীকালে শেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) -এর আবির্ভাবকাল পর্যন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়।
আইয়ামে জাহিলিয়ার সময় ও ব্যাপ্তি
আইয়ামে জাহিলিয়ার সময়সীমা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানাবিধ মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। বহুলালােচিত সেসব মতভেদ হচ্ছে –
- ক. অধিকাংশ মুসলিম ঐতিহাসিকের মতে, হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত সময়কে আইয়ামে জাহিলিয়া বলা হয়, কিন্তু এ মতবাদ গ্রহণযােগ্য নয়। কেননা এর অন্তর্বর্তীকালে মানুষকে হেদায়াত করার জন্য পৃথিবীতে অসংখ্য নবী রাসূলের আগমন ঘটেছিল। তাছাড়া পবিত্র কুরআনুল কারীমে ২৫ জন নবীর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
- খ. কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকের মতে, “হযরত ঈসা (আ.) ও হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মধ্যবর্তী সময়কালই আইয়ামে জাহিলিয়া।”
- গ. ঐতিহাসিক ড. নিকোলসন ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী এক শতাব্দীকালকে আইয়ামে জাহিলিয়া বলে অভিহিত করেছেন। পি.কে.হিট্টি এ মত সমর্থন করেছেন।
- ঘ. প্রফেসর পি.কে.হিট্টি তাঁর প্রণীত ‘হিস্ট্রি অব দা আরবস’ গ্রন্থে আইয়ামে জাহিলিয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন- The term Jahiliyah, usually rendered time of ignorance or barbarism in reality means the period in which Arabia had no dispensation, no inspired prophet, no revealed book.
- ঙ. ঐতিহাসিক মুইর বলেন, “হযরত ঈসা (আ.) ও হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মধ্যবর্তী সময়কেই আইয়ামে জাহিলিয়া বলে।”
- চ. ড. এস এম ইমামুদ্দিনের মতে, “হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মের পূর্বে ৬১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এক শতাব্দীকালকে আইয়ামে জাহিলিয়া বলে বােঝানাে হয়েছে।”
- ছ. কুরআন মাজীদে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী সময়কে জাহিলিয়া যুগ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহর বাণী- “হে নারী সম্প্রদায়! তােমরা জাহিলী যুগের ন্যায় ইসলামের আগমনের পরও বাইরে অবাধে বের হয়াে না।”
- জ. পবিত্র হাদীসে নববীর ভাষ্যমতে, মহানবী (সা.)-এর অহীপ্রাপ্তির পূর্ববর্তী সময়কেই আইয়ামে জাহিলিয়া হিসেবে বােঝানাে হয়েছে। নবী করীম (সা.) এক হাদীসে হযরত আবু যর (রা)-কে লক্ষ্য করে বলেন- হে আবু যর! তুমি এমন ব্যক্তি যার মধ্যে জাহিলিয়া রয়ে গেছে।
অতএব আইয়ামে জাহিলিয়া বলতে আরবের অন্ধকার যুগকে বােঝানাে হয়েছে, যা ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে অতিবাহিত হয়ে গেছে। উপরিউক্ত আলােচনায় আইয়ামে জাহিলিয়ার যে চিত্রাঙ্কন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে ইতিহাস বিশ্লেষকগণ ভিন্ন মত পােষণ করেন। তারা বলেন, যে সময়কে অন্ধকারাচ্ছন্ন বা অজ্ঞতার যুগ বলা হয়, সে সময় দক্ষিণ আরব জ্ঞানগরিমায় উন্নত এবং আরববাসী সাহিত্য সংস্কৃতি, ঐতিহ্য চেতনাসহ নানা সৎ গুণাবলিতে ভূষিত ছিল। তাই জাহিলী যুগের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, যে যুগে কোনাে নবী রাসূল, ঐশী কিতাব না থাকায় আরববাসী নানা প্রকার অন্যায়-অনাচার, সামাজিক বিশৃংখলা, কুসংস্কার, ব্যভিচার ও মানবতাবােধের অধঃপতন, সর্বোপরি ধর্মীয় অবক্ষয়ের চরম সীমায় উপনীত হয়। জাহিলিয়া যুগে সমগ্র পৃথিবীই অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। পৃথিবীর সর্বত্র মানব সমাজ ছিল পথভ্রষ্ট। কোনাে জাতিই আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল না। তারা নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত পথ ও শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। স্রষ্টার পরিবর্তে সৃষ্টিরই তারা উপাসনা করতাে।
প্রায় সকল সমাজেই দাসপ্রথা বিদ্যমান ছিল। দাস-দাসীকে পণ্য দ্রব্যের ন্যয় হাট বাজারে বেচা-কেনা করা হতাে। তাদের রাজনৈতিক অবস্থাও ছিল শােচনীয়। শাসকরা প্রজাদের মৌলিক অধিকার হরণ করতাে। শাসক কর্তৃক প্রজাদের ওপর নির্যাতন চালানাে হতাে। উত্তর-দিকে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে মধ্য ইউরােপ পর্যন্ত তাতারীদের দাপট ছিল। তারা ভারত, ইরান ও ইউরােপে লুটতরাজ করতাে। পারস্য ও রােম সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ-সংঘাত লেগে থাকত। কোনাে দেশেই শান্তি শৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল না।
আইয়ামে জাহিলিয়া ও বর্তমান সমাজ
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জাহিলী যুগের সমাজ দর্শন, রাজনৈতিক চিন্তন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামাে সর্বোতভাবেই মানব জাতির স্বাভাবিক চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিপরীত পথে চলছিল। শুধু আরব নয়; সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থাই মানবাধিকারের ব্যাপক অবমূল্যায়ন পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এমতবস্থায় শান্তির বার্তা নিয়ে ইসলামের আবির্ভাব ছিল অনিবার্য। কিন্তু দুখের বিষয় হচ্ছে, জাহিলী সমাজের বিচিত্র ঘৃণিত প্রথা ও কর্মসমূহ আধুনিক সমাজে আবারাে দেখা দিচ্ছে। জীবিত কন্যা সন্তানের হত্যার ধরণ পাল্টেছে মাত্র। আল্টা সনােগ্রাফির মাধ্যমে কন্যা সন্তানের জন্ম নিশ্চিত হয়ে প্রতিনিয়ত কন্যা সন্তানকে হত্যা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জাহিলী সমাজের চেয়েও ঘৃন্য কায়দায় প্রকাশ্যে দিবালােকে হত্যা করা হচ্ছে। খুন, জখম, গুম যেন নতুন বর্বর সংস্কৃতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। দারুন নদওয়া যেখানে আরব সমাজের সর্বদলীয় সংসদ ছিল, সেরকম কোন ধারণা এ সভ্য সমাজে খুঁজে পাওয়া যাবে কী? নারীকে পণ্যের মডেল বানিয়ে ভােগের বস্তুতে পরিণত করার এক জাহিলী উম্মাদনায় বিশ্ব আজ সয়লাব।
জাহেলি যুগে আরবের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থা
ধর্মীয় অবস্থা
ধর্মীয় পাপাচার আর সামাজিক অনাচারের মিশ্রণে আরবে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। একত্ববাদের স্থলে বহু ঈশ্বরবাদ আরব সমাজকে চরম অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেয়। এ সময় আরবে মােটামুটি চার ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাসসম্পন্ন লােকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যথা- ইহুদি, খ্রিস্টান, মূর্তিপূজক ও হানিফ সম্প্রদায়।
ইহুদিবাদ : ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে হিমারীয় রাজা আবু কাদির আসাদ দক্ষিণ আরবে ইহুদি ধর্ম প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে রাজা যুনাওয়াস শক্তি প্রয়ােগে ইহুদি মতবাদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালান। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আবির্ভাবের প্রাক্কালে উত্তর আরবের বিভিন্ন এলাকায় বনু নযির, বনু কোরায় এবং মদিনার উপকণ্ঠে বনু কায়নুকা প্রভৃতি ইহুদি উপনিবেশ ওঠে। ইহুদিরা অজ্ঞতাবশত জাহহাবাকে বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা মনে করতাে। তারা হযরত মুসা (আ.)-এর শিক্ষা ভুলে গিয়ে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। খােদায়ী বিধানের সাথে তারা নিজেদের মনগড়া বিধান যুক্ত করে।
খ্রিস্ট্রবাদ : হযরত ঈসা (আ.) ছিলেন আল্লাহর রাসূল। তিনি তাঁর উম্মতকে এক আল্লাহর দিকে আহবান জানিয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ঈসা (আ.)-কে উঠিয়ে নেয়ার পর তাঁর উম্মত অজ্ঞতাবশত একত্ববাদের পরিবর্তে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। তারা হযরত মরিয়ম (আ.)-কে আল্লাহর স্ত্রী, ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র এবং আল্লাহসহ তিন স্রষ্টায় বিশ্বাস শুরু করে (নাউযু বিল্লাহি-মিন-যালিক)। ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় দু’জন নবীর উম্মত হয়েও তারা নবীর বিশ্বাস রদপূর্বক নতুন মতবাদ চালুর মাধ্যমে ধর্মীয় বিশ্বাসে অনাচারের সৃষ্টি করে। শেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমনের পূর্বে তারা প্রত্যেকেই দাবি করতাে, সর্বশেষ নবী তাদের গােত্র থেকে আগমন করবেন। ইহুদি খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ই একে অন্যের বিরুদ্ধে সর্বদা বিদ্বেষ ছড়াতাে। আল কুরআনে তাদের বিবাদের বর্ণনা এসেছে এভাবে- “ইহুদিরা বলত নাসারারা (খ্রিস্টান) সত্যের ওপর নেই; অন্যদিকে নাসারারা বলত ইহুদিরা সত্যের ওপর নেই, অথচ তারা উভয় সম্প্রদায়ই কিতাব অধ্যয়ন করতাে।
পৌত্তলিকতা বা মূর্তিপূজা : ইহুদি-খ্রিস্টানদের ছাড়া আরব দেশে ব্যাপকভাবে মূর্তিপূজক সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। প্রাচীনকাল থেকেই কাবা গৃহকে পবিত্র স্থান মনে করা হতাে। বিশ্বের বিভিন্ন জনপদ থেকে লােকেরা কাবায় হজ্জ করতে আসত। আরবরা কাবা গৃহে বিভিন্ন গােত্রের পূজ্য ৩৬০টি মূর্তির অবয়ব স্থাপন করে সেগুলাের পূজা করতাে। এমনকি খ্রিষ্টানরাও কাবার স্তম্ভ ও দেয়ালসমূহে হযরত মরিয়ম ও হযরত ঈসা (আ.)-এর চিত্র, ফেরেশতাদের ছবি এবং হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর কাহিনী চিত্রিত করে রেখেছিল। এছাড়া লাত, মানাত, ইয়াগুস, নাসরও ছিল অন্যতম প্রধান প্রধান মূর্তি। মনুষ্যাকৃতির হােবল ছিল কাবাঘরে স্থাপিত প্রধান বিগ্রহ।
পৌত্তলিক আরবদের প্রধান দেবতা ছিল হুবাল, যাকে আমদানি করা হয়েছিল সিরিয়ার চন্দ্রদেবতা থেকে। তার তিন মেয়ে ছিল নেতৃস্থানীয় দেবী:
- আল-লাত (Al-lāt), যাকে মনে করা হয় পাতালের দেবী। উত্তর আরবে তার প্রচুর অনুসারী ছিল। সেখানকার নাবাতিয়ান এবং কেদার জাতিগোষ্ঠীর কাছেও আলাত অত্যন্ত পবিত্র ছিল।
- আল-উজ্জা (Al-‘Uzzá), যাকে মনে করা হয় শক্তি আর উর্বরতার দেবী। যুদ্ধের আগে বিজয়ের জন্য তার কাছে প্রার্থনা করা আরবদের রীতি ছিল।
- মানাত (Manāt), ভাগ্যদেবী।
মূর্তিপূজা সমগ্র আরবে প্রচলিত হয়ে পড়েছিল। বিভিন্নরূপে তাদের মাঝে এ মূর্তিপূজা অনুপ্রবেশ করেছিল। পবিত্র কাবা জাহেলী আরবদের পূজ্য প্রতিমা ও বিগ্রহের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছিল। প্রতিটি গোত্রেরই সেখানে একটি করে মূর্তি ছিল। কা’বাঘরে বিভিন্ন আকার-আকৃতির ৩৬০টির বেশি মূর্তি ছিল, লাত, মানাত ও উয্যা-এ তিন প্রতিমাকে কুরাইশরা আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করত। কুরাইশরা বিশেষভাবে এ তিন প্রতিমার পূজা করত। লাত দেবতাদের মা হিসাবে গণ্য হতো। লাতের মন্দির তায়েফে অবস্থিত ছিল। লাত ছিল সাদা পাথরের মতো। মানাতকে ভাগ্যদেবী ও মৃত্যুর প্রভু বলে বিশ্বাস করা হতো। মানাতের মন্দির মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী একটি স্থানে অবস্থিত ছিল।
কোনাে আরব অনারব নয়, কোনাে স্থানকালের জন্য নয়; বরং কুসংস্কারের সব জাল ছিন্ন করে তাওহীদের বাণী প্রচার করার জন্যই মহানবী (সা.) মক্কানগরীতে আবির্ভূত হন। তিনি অনন্ত কল্যাণ ও আপসহীন তাওহীদের প্রতীক। ঐতিহাসিক পিকে হিট্টি যথার্থই বলেছেন- The stage was set the moment was psychological, for the rise of a great religious and national leader. এ সময় মহান ধর্মীয় ও জাতীয় নেতার আবির্ভাবের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত হয়েছিল এবং সময়ও ছিল মনস্তাত্ত্বিকতাপূর্ণ।
আবু সুফিয়ান উহুদের যুদ্ধের দিবসে লাত ও উয্যার মূর্তি সাথে নিয়ে এসেছিল এবং এগুলোর কাছে সাহায্য চেয়েছিল। কথিত আছে যে, আবু আহীহাহ্ সাঈদ বিন আস নামের এক উমাইয়্যা বংশীয় ব্যক্তি মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় কাঁদছিল। আবু জাহল তাকে দেখতে গেল। আবু জাহল তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “এ কান্না কিসের জন্য? মৃত্যুকে ভয় করছ, অথচ এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কি কোন উপায় নেই?” সে বলল, “মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি না; বরং আমি ভয় পাচ্ছি যে, আমার মৃত্যুর পর জনগণ উয্যার পূজা করবে না।” তখন আবু জাহল বলল, “তোমার কারণে জনগণ উয্যার পূজা করেনি যে, তোমার মৃত্যুতেও তারা উয্যার পূজা করা থেকে বিরত থাকবে।”
এ সব মূর্তি ছাড়াও অন্যান্য দেবতার পূজা আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। যেমন কুরাইশরা পবিত্র কাবার ভিতরে হুবাল (هبل) নামের একটি মূর্তি রেখেছিল। প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব বিশেষ মূর্তিই ছিল না, বরং প্রতিটি পরিবারেরও গোত্রীয় প্রতিমার পূজা করা ছাড়াও নিজস্ব পারিবারিক প্রতিমা থাকত। নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য, পাথর, কাঠ, মাটি, খেজুর এবং বিভিন্ন ধরনের মূর্তি প্রতিটি গোত্রের কাছে আরাধ্য ও পূজনীয় ছিল। পবিত্র কাবা ও অন্যান্য মন্দিরে রক্ষিত এ সব প্রতিমা বা মূর্তি কুরাইশ ও সকল আরব গোত্রের নিকট পরম শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ছিল। এগুলোর চারদিকে তারা তাওয়াফ (প্রদক্ষিণ) করত এবং এগুলোর নামে পশু কোরবানী করত। প্রত্যেক গোত্র প্রতি বছর কোন না কোন ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকতার দ্বারা নির্বাচিত করে তাদের দেবদেবী ও প্রতিমাসমূহের বেদীমূলে কোরবানী করত এবং তার রক্তাক্ত মৃতদেহ বলিদানের স্থানের নিকটেই দাফন করা হতো।
সংক্ষিপ্ত এ বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সমগ্র জাযিরাতুল আরবের (আরব উপদ্বীপের) প্রতিটি গৃহ ও প্রান্তর, এমনকি বাইতুল্লাহ্ অর্থাৎ পবিত্র কাবাও সে যুগে দেবদেবী দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল।
কবির ভাষায় :
“উপাসনাস্থলসমূহ বিরান ধ্বংসপ্রাপ্ত, কাবার পবিত্র অঙ্গন হয়ে গিয়েছিল প্রতিমালয়,
তখন জনগণ ছিল মহান স্রষ্টা থেকে বিমুখ-কি সুখে কি দুঃখে সর্বাবস্থায়।”
এ সব অর্থহীন প্রতিমা ও দেবদেবীর পূজা করার ফলে আরবে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মতভেদ, হানাহানি ও হত্যাকাণ্ড বিরাজ করত। আর এর ফলে অসভ্য-বর্বর মরুচারী আরবদের জীবনে নেমে এসেছিল ভয়ঙ্কর দুর্ভাগ্য ও দুর্দশা এবং চরম পার্থিব ও আত্মিক ক্ষতি।
হযরত আলী (রা.) তাঁর এক ভাষণে ইসলামপূর্ব আরব জাতির অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন :
“মহান আল্লাহ্ হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে রিসালাতের দায়িত্বসহকারে জগদ্বাসীকে ভয় প্রদর্শন করার জন্য প্রেরণ এবং তাঁকে তাঁর ঐশী বিধি-বিধান ও নির্দেশাবলীর বিশ্বস্ত সংরক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। হে আরব জাতি! তখন তোমরা নিকৃষ্টতম ধর্মের অনুসারী ছিলে; তোমরা সর্পকুলের মাঝে শয়ন করতে, ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানি পান করতে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ও বন্ধন ছিন্ন করতে, তখন তোমাদের মধ্যে প্রতিমা ও মূর্তিসমূহ প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তোমাদের আপদমস্তক জুড়ে ছিল পাপ, অন্যায় ও অপরাধ।”
জাহিলিয়া যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ করে বলা যায়, তারা অধঃপতনের সর্বনিম্ন স্তরে উপনীত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- “তােমরা অগ্নির অতল গহবরে নিমজ্জিত ছিলে।” পরিবেশপরিস্থিতি একজন মহান পুরুষের আবির্ভাবের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিল, সময়টাও ছিল মনস্তাত্ত্বিকতাপূর্ণ। অবশেষে আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মহাপুরুষ হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এই ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়ে আরবগণকে এক মহান ধর্মের ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেন।
হানিফ সম্প্রদায় : এমন ঘাের অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগেও আরবের কতিপয় লােক আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা স্বতন্ত্র দ্বীন পালন করতেন এবং কোনাে প্রকার মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন না। পৌত্তলিক আরবে তারা ‘হানিফ’ নামে পরিচিত ছিলেন। বিবি খাদিজার চাচাতাে ভাই ওরাকা বিন নওফল, উমাইয়া বিন আবিস সালত, আওস বিন সাওদা, কবি যুহায়র প্রমুখ বিশিষ্ট আরববাসী ছিলেন একমাত্র সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী হানিফ সম্প্রদাভুক্ত। আরব তথা সমগ্র বিশ্বের নৈরাশ্যজনক ধর্মীয় কোনাে এক ঐশ্বরিক ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের পূর্বাভাস সূচনা করেছিল। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন- Never in the history of the world was need so great, the time so ripe for the appearance of a deliverer. অর্থাৎ “পৃথিবীর ইতিহাসে এ পরিপক্ব সময়ের মতাে কোনাে কালেই একজন উদ্ধারকারীর প্রয়ােজনীয়তা এত বেশি অনুভূত হয়নি।”
জাহিলিয়া যুগে আরবদের প্রশংসনীয় দিকসমূহ
প্রাক-ইসলামী যুগের আরবগণের একটি প্রশংসনীয় গুণ ছিল অতিথিপরায়ণতা। তাছাড়া তাদের সরলতা এবং উদারতাও বিশেষ প্রশংসাযােগ্য ছিল। অতিথির থাকা-খাওয়া এবং মর্যাদা রক্ষার জন্য তারা সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও কুষ্ঠিত হত না। ইসলাম-পূর্ব যুগে একমাত্র আরবদের উদ্যোগে এশিয়ার সঙ্গে ইউরােপের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য শুধুমাত্র উৎপন্ন পণ্যদ্রব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা নিজেদের পণ্যদ্রব্য আফ্রিকা ও ভারতে রপ্তানি করত। সেখান থেকেও অনেক পণ্যদ্রব্য তারা আমদানি করত।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবগণ কবিতা রচনা ও বক্তৃতায় বিশেষ পারদর্শী ছিল। কবিতার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য প্রতিভার প্রকাশ পেত। সে যুগে কবির মর্যাদা ছিল অসাধারণ। অধ্যাপক নিকলসন বলেন, কবিতা কেবল সে যুগের কিছু সংখ্যক লােকের কাছে বিলাসিতার বস্তুই ছিল না, বরং তা ছিল তাদের সাহিত্য প্রতিভা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম’। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, “কাব্যপ্রীতিই ছিল বেদুঈনদের সাংস্কৃতিক সম্পদ”। তাদের কবিতাগুলাে ‘কাসিদা’ নামে খ্যাত ছিল। তিনি আরাে বলেন, এ কাসিদাগুলাে ছন্দ এবং বিশদ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ‘ইলিয়ড’ ও ‘অডিসি’কেও অতিক্রম করেছিল।
আরবের অধিকাংশ লােক যদিও নিরক্ষর ও মূর্খ ছিল, তবুও তাদের স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। এ গুণের মাধ্যমে তারা প্রাচীন যুগের লােকগাঁথা, প্রবাদ, লােকশ্রুতি ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের পূর্বপুরুষদের নাম তথা বংশ বৃত্তান্ত তারা বিশেষভাবে স্মরণ রাখত। এছাড়া তারা অনায়াসে অসংখ্য কবিতা কণ্ঠস্থ করে রাখতে পারত।
প্রাক-ইসলামী যুগে প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে মক্কার অদূরে উকায নামক স্থানে একটি বাৎসরিক মেলা বসত। এখানে খ্যাতনামা আরব কবিদের মধ্যে কবিতা পাঠের আসর বসত। বিজয়ী কবিদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হত। ঐতিহাসিক হিট্টি, উকাযের মেলাকে প্রাচীন আরবের ‘একাডেমিক ফেঞ্চাজ’ বলে অভিহিত করেছেন।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রাক-ইসলামী যুগের আরবদের আগ্রহ ছিল সীমাহীন, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। সাহিত্যিকগণ প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সাহিত্য আসরের আয়ােজন করতেন। হিট্টির মতে, পৃথিবীতে সম্ভবত অন্য কোন জাতি আরবদের ন্যায় সাহিত্য চর্চায় এত বেশি প্রাণঢালা আগ্রহ প্রকাশ করেনি এবং কথিত বা লিখিত শব্দ দ্বারা এত আবেগাপ্লুত হয়নি’। প্রাক-ইসলামী যুগে আরবগণ তাদের আবাস শিল্প ও মুদ্রাকে যথেষ্ট উন্নত করেছিল। আবাস গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে সে যুগে কিছু কিছু গ্রানাইট ও মারবেলের ব্যবহারও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সানার মুসকানের ২০ তলা দুর্গ এবং দক্ষিণ আরবে অবস্থিত বিশাল বাঁধ আরবদের স্থাপত্য শিল্পের পরিচয় বহন করে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।