লিখেছেনঃ আবুল হাসনাত
বল বীর,
বল, উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির।
– এইভাবে আজ থেকে একশো বৎসর পূর্বে বাংলা সাহিত্যের অবিসংবাদিত বীর কাজি নজরুল ইসলামের নিঃসংশয় দর্পিত আবির্ভাব – বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে একবিস্ময়কর ব্যক্তিত্বের পৌরুষদীপ্ত পদধ্বনি –বিদ্রোহের অবিচল বিগ্রহ। আমরা আমাদের জীবনের অনেক মূহুর্তে এই বিদ্রোহী আত্মার আর্তনাদ শুনতে পাই। তার সমস্ত বিদ্রোহ, ব্যথা, বেদনার উৎস ও তার বিকাশ নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, বেদনাই তাঁকেকে বিদ্রোহী করেছে। তার বিদ্রোহী সত্তা আত্মার কোন গভীর মহাদেশ স্পর্শ করতে পারে তার সেই কাব্যরূপটুকু আমরা দেখে নিতে পারি। তিনি ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতার কিছু প্রাসঙ্গিক উচ্চারণে বলেছিলেন : “ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর প্রলয় নূতন সৃজন বেদন”। পৃথিবীর বুকে যুগ যুগ ধরে এই খেলাই চলেছে, ভাঙার পরে গড়া, ধ্বংসের পরে সৃষ্টি, ঊষর মরুভূমিকে পরাস্ত করে শ্যামল ঐশ্বর্যের জয়ধ্বনি। এইভাবেই সে মৃত্যুকে অতিক্রম করে যায়। তাই ধ্বংস ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম উচ্চারণ হলেও শেষ কথা নয়। ধ্বংস ও সৃষ্টির যে যুগল সত্তা কবির সমগ্র জীবনব্যাপী জাগরুক ছিল তারই অপূর্ব কাব্যরূপ আমরা এই কবিতায় প্রত্যক্ষ করি। এরই একটি তাত্ত্বিক শিল্পরূপ পাই ‘ভাঙার গান’-এর মহার্ঘ উচ্চারণে : “ডাক ওরে ডাক, মৃত্যুকে ডাক জীবন-পানে”। মৃত্যুকে অবলুপ্ত করে জীবনের মহান ইতিবাচকতায় নিয়ে যাওয়া, এই ভাবটি দুটি কবিতারই অন্তর্বস্তু। শেলির ভাষায় : “destroyer and preserver” (ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইণ্ড)। ‘বিদ্রোহী’র একটি চরণে এই দ্বৈত পদচারণা অদ্ভুত শিল্প-নৈপুণ্যে ধরা পড়েছে :
“আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস,
আমি লোকালয়, আমি শ্মশান!”
![বিদ্রোহী কবিতা : শত বৎসরের আলোকে নজরুলের কবিতার মূল্যায়ন](https://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2022/10/1619541951_28nazrul_dc.jpg)
তারপর পরম সৃষ্টি-মন্ত্রে চঞ্চল ‘বিদ্রোহী’র সেই অদ্ভুত উক্তি! – “আমি অবসান, নিশাবসান”। এটি যেন এক গভীর কবিতার অন্তিম চরণে পরিণতি লাভ করেছে। Truth of Truth-কে ভারতীয় বেদান্তবাদীরা বলেন, ‘অবসান’ অর্থাৎ ultimate; অন্যত্র, ‘বিদ্রোহী’-র অনেক পরে একটি ফারসি গদ্যগ্রন্থের অনুবাদ প্রসঙ্গে নজরুল এর অর্থ করেছেন ‘পূর্ণ’। এই আলোকে ‘অবসান’, ‘নিশাবসান’ শব্দ দুটির অন্য একটি ভাষ্য রচনা করা যায়। এই কবিতা রচিত হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে। বিদ্রোহী বলছে, “আমি অবসান, নিশাবসান”। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, দুটিই তো ‘অবসান’ – তাহলে কি দ্বৈত্বদোষে দুষ্ট?নতুন অলোকে দেখা যায়, দুটি ‘অবসান’এক নয়। দ্বিতীয়টিতে রাত্রির অবসানে প্রভাতের ইঙ্গিত আছে; অন্ধকারের অবসানে আলোর প্রত্যাশা নিয়ে আসে বিদ্রোহী। কিছুদিন পরেই তিনি লিখেছেন : ‘আজি রক্তনিশি ভোরে’, সেই বিখ্যাত গান যা বাক্যসংমের চূড়ান্ত নিদর্শন :
“আজি রক্তনিশি ভোরে
এ কি এ শুনি ওরে!”
সে ভাবটি তো ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আছেই। আবার এই ছত্রটিতে অজ্ঞানতার অন্ধকারের অবসানও সূচিত হতে পারে। সুতরাং বিদ্রোহী একদিকে স্বাধীনতার অগ্নিদূত, আবার অন্যদিকে অজ্ঞানতাকে বিনাশ করে জ্ঞানের আবাহনও হতে পারে। কিন্তু ‘অবসান’ হলো পূর্ণতার প্রতীক। বিদ্রোহী যেন বলছে, আমি অবসান, অর্থাৎ Truth of Truth, পূর্ণ। এইভাবে দেখলে, সমগ্র চরণটি নজরুলের বিদ্রোহীকে এক অদ্ভুত ব্যাপ্তিও গভীরতা দান করেছে বলা যায়। আর একটি অসামান্য চরণে বিদ্রোহী বলছে, “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য”। এখানে আমরা এক মুহূর্তে নজরুলের কর্মযজ্ঞের দ্বৈত সত্তাকে অনুভব করতে পারি। তিনি রণতুর্যের কবি, অর্থাৎ যুদ্ধনিনাদের কবি – বীরভাবনার কবি; আবার অপরদিকে বাঁশরীর মধুর মূৰ্ছনাও তার বিদ্রোহীর অক্ষয় সঞ্চয়। প্রাচীন গ্রীসের সমাজ জীবনে আমরা একদিকে পাই স্পার্টান সংস্কৃতি – সেখানে পেশীশক্তির উদ্ধত, গম্ভীর আহ্বান; আর অপরদিকে এথেন্সীয় সংস্কৃতির কাব্য ও শিল্পসুষমায় মণ্ডিত সঙ্গীতধ্বনি। এই যুগল শক্তির সম্মিলনে গ্রিক সভ্যতার অবিনাশী মহিমা। নজরুলের বিদ্রোহীও এই শক্তির ধারক। তাঁর সমগ্র শিল্পজীবনকে প্রত্যক্ষ করতে হলে বাঁশরী আর রণতূর্যের যুগল অবদানকে উপলব্ধি করতে হবে।
আমরা আর একটি অপূর্ব চরণকে ধরতে চাই, যেখানে বিদ্রোহী বলছে, “আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি” – বিদ্রোহী বলছে, তার বীরসত্তা এমনই যে তাকে অগ্নিদগ্ধ করা যাবে না। এখানে কোরানে লিপিবদ্ধ নমরুদ কর্তৃক হজরত ইব্রাহিম-এর (ওল্ড টেস্টামেন্টে যাঁকে বলা হয় ‘আব্রাহাম’) অসফল মৃত্যু-পরিকল্পনার ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ইব্রাহিম এক ঈশ্বরের মহিমার কথা ঘোষণা করেছেন। অসীম ঐহিক শক্তির অধিকারী নমরুদ তাঁকে হত্যার পরিকল্পনায় একটি বিশাল অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত করলেন। তারপর সেখানে ইব্রাহিমকে নিক্ষেপ করা হল। উদ্দেশ্য, এইভাবে ইব্রাহিমের মৃত্যু হবে। আর তার এক ঈশ্বর তত্ত্বের অগ্নিসমাধি হবে। কিন্তু আগুন নির্বাপিত হতেই দেখা গেল, সেখানে ইব্রাহিম সুদৃশ্য পুষ্পরাজির মধ্যে উপবিষ্ট, মুখমণ্ডল আনন্দের হাসিতে উদ্ভাসিত। স্বৈরাচারী শাসক নরুদ পরাস্ত হলেন। তাই বিদ্রোহী বলছে, সেও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির সমস্তরকম নিপীড়ন ও নির্যাতনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নিজ শক্তিমত্তাকে তুলে ধরেছে। তারপর একদিন স্বীয় মহিমায়। পরাধীনতার গ্লানি মোচন করে এবং স্বাধীনতা অর্জন করে আনন্দ-উদ্ভাসিত জীবন উপভোগ করবে।
এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পর্যদুস্ত করে তার সুউচ্চ মহিমাকে ভূলুণ্ঠিত করার বাসনা বিদ্রোহী প্রথম স্তবকেই ঘোষণা করেছে :
বল বীর,
বল, উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির।
এখানে হিমাদ্রির শিখর হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অভ্রভেদী মহিমা – যে সাম্রাজ্যে সূর্য অন্ত যায় না। তাকেই আমুল নাড়া দিয়েছে বিদ্রোহী। সেখানেই সে থেমে থাকেনি, তার উদ্ধত উচ্চারণ ঈশ্বরের আসনকেও কম্পিত করেছে :
আমি ভূলোক দ্যুলোক গো গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর।
সেইসঙ্গে আমরা আরো একটা বিষয় অবশ্যই লক্ষ্য করতে পারি : মানুষের ব্যক্তি-আমিকে নজরুল সর্বশক্তিমান বলে চিত্রিত করেছেন এই কল্পনা ব্যাপ্তির মধ্য দিয়ে তিনি মানুষকে খুব বড় একটা আসন দান করলেন। রেনেসাঁ-ভাবনার একটি বড় বৈশিষ্ট্য এইভাবে বিদ্রোহের উদ্ধত উচ্চারণে বিধৃত হয়েছে। ইয়োরোপীয় রেনেসাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট এইভাবেই প্রথম মানবমহিমাকে স্পর্শ করেছে : What a piece of work is man! – মানুষ কী এক অদ্ভুত সৃষ্টি।
এখানে একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা প্রয়োজন। কেউ কেউ বলেন, নজরুল ‘বিদ্রোহী’ রচনার পূর্বে মোহিতলাল মজুমদারের ‘অভয়ের কথা’ শীর্ষক গদ্য রচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেখানেও সমগ্র রচনায় ‘আমি’র প্রাধান্য। এই মত কেউ সমর্থন করেছেন, কেউ দ্বিমত পোষণ করেন, যেমন নজরুল-ঘনিষ্ঠ মুজফফর আহমেদ। কিন্তু একথা ভাবতে দ্বিধা নেই যে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’তে মোহিতলাল এসে প্রবেশ করেছেন। তবে নজরুল সেটা সম্পূর্ণভাবে আত্মীকৃত করেছেন। আর যে প্রবল আমিত্বসচেতন আধুনিকরাজনীতিমনস্ক মানুষকে আমরা ‘বিদ্রোহী’তে পাই এবং যা আমাদের সৃষ্টির আবেগকে আলোড়িত করে, মোহিতলালের ‘অভয়ের কথা’ তা থেকে বহুদূরে অবস্থিত। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। জীবনানন্দ দাশ-এর ‘বনলতা সেন’, এডগার অ্যালান পো-র ‘টু হেলেন’কবিতাকে একইভাবে আত্মীকৃত করে একটা নতুনতর এবং সমৃদ্ধতর সৃষ্টি সম্ভব করেছিলেন।
![বিদ্রোহী কবিতা : শত বৎসরের আলোকে নজরুলের কবিতার মূল্যায়ন](https://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2022/07/bulbuli-nirob-nargis-bone.jpg)
এবার একটু অন্য কথায় যাই। ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাত্রিতে অর্থাৎ প্রবল শীতের মধ্যে নজরুল রচনা করলেন তাঁর ‘বিদ্রোহী’। এ এক অদ্ভুত ঘটনা। নজরুল সেদিন বুঝতে পারলেন না, বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সেটি হবে এক ‘Unconscious tool of history-ইতিহাসের এক অচেতন উপাদান। তিনি জানতেন না, তিনি বাংলার তথা ভারতের রাজনীতি ও সংস্কৃতির ইতিহাস-প্রবাহে প্রবেশ করলেন, আর নিজেও ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। তার অস্ত্র ছিল শীতের বিরুদ্ধে আগুনের, অর্থাৎ তাপের বিদ্রোহ – নির্জীবতার বিরুদ্ধে প্রাণ-স্পন্দনের বীর্যবান প্রতিশ্রুতি। আর ঘোষণা হল দেবত্বের উপর মানবত্বের শ্রেষ্ঠত্ব – যার প্রথম প্রতিফলন আমরা দেখেছি মধুসূদনের মেঘনাদবধকাব্য পরিকল্পনায়। বস্তুত মধুসূদনই বাংলা সাহিত্যে প্রথম বিদ্রোহী। নজরুলের বিদ্রোহী প্রখরভাবে ব্যক্তিসচেতন মানুষ এবং তার শেষ কথা ‘man’s unconquerable mind’ – মানুষের অপরাজেয় মন।।
অনেকে অভিযোগ করেন, ‘বিদ্রোহী’তে যুক্তির পারম্পর্য নেই, শব্দ ও চিত্রকল্পগুলি পরস্পরের সঙ্গে বা কেন্দ্রীয় ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা না করে লক্ষ্যহীনভাবে ছুটে চলেছে। এ অভিযোগ ঠিক নয়। ‘বিদ্রোহী’র লক্ষ্য অবশ্যই ছিল। সেটি হল সেই শক্তিকে আবিষ্কার করার লক্ষ্য যার সাহায্যে তিনি নানা প্রচলিত ভাবনার মূর্তিমান প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভেঙে চুরমার করতে পারেন; এই ভাঙার শক্তি যেন শেষ না হয় যতদিন পর্যন্ত উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল এবং অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণকে সে নিশ্চিহ্ন করতে না পারে। আর এর পশ্চাতে যে লক্ষ্যটি প্রবলভাবে উপস্থিত সেটি হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমূল বিনাশ। তাই বিদ্রোহীকে বলতে হয়েছে : “আমি দুর্বার/আমি ভেঙে সব করি চুরমার”। আর একটি অভিযোগ ওঠে, প্রবল পৌরুষের পরেই মাঝে মাঝে ছন্দপতন হয়েছে। যেমন বিদ্রোহীর এইরকম ঘোষণা : “আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল” এর কিছু পরেই পাই : “আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি” বা “আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-করে দেখা অনুখন”। এতে বক্তব্যের একমুখিতা বিঘ্নিত হয়েছে। আসলে হঠাৎ যাকে অন্য প্রসঙ্গ বলা হচ্ছে, তাকে আমরা বলতে পারি dramatic relief-নাটকের দুটি প্রবল দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দৃশ্যের মাঝখানে দর্শকদের একটু মানসিক স্বস্তি দেওয়ার মতো। বিদ্রোহী যেন একটু দম নিয়ে আবার নিজের গন্তব্যের দিকে ভীমগতিতে ছুটে চলেছে। তাছাড়া তখনকার বাংলা কবিতার সমতল, মসৃণ পরিপ্রেক্ষিতে নজরুলের এই ‘দুর্বিনীত’ আচরণকে অসহ্য মনে হয়েছিল। কিন্তু আসলে ঐ তথাকথিত যুক্তির পারম্পর্যহীনতার মধ্যেই ছিল বিদ্রোহীর বিজয় চিহ্ন। যে প্রবল বিদ্রোহী সে তো নিয়ম মেনে বিদ্রোহ করে না। আমরা বলতে পারি, There is method in his madness – তার উন্মত্ততার মধ্যেও একটা অলক্ষ্য যুক্তি-বিন্যাস ছিল।
আর একটা কথা। কবিতার ক্ষেত্রে যদি কোথাও কোনো অসঙ্গতি বা স্ববিরোধ আছে বলে মনে হয়, তাকে যুক্তি-নির্ভর গদ্যের সাহায্যে বিচার করা চলে না। কিট্স-এর ‘ওট টু এ নাইটিঙ্গেল’ কবিতায় কবি নাইটিঙ্গেলকে বলছেন, “Thou wast not born for death, immortal Bird”– হে বিহঙ্গ, মৃত্যুর জন্য তোমার জন্ম নয়। এখানে নাইটিঙ্গেলকে যে যুক্তিতে ‘অমর’ বলা হয়েছে, সেই যুক্তিতে মানুষও তো অমর। কিন্তু কিক্স নাইটিঙ্গেলের প্রতিতুলনায় মানুষকে মরণশীল বলেছেন। তা তো সম্ভব নয় – অর্থাৎ কিটস-এর যুক্তিনিষ্ঠা এখানে ভঙ্গুর মনে হয়েছে। কিন্তু তাতে সমগ্র নাইটিঙ্গেল কবিতার রস-উপলব্ধিতে আমাদের অসুবিধা হয়নি। এই যুক্তিহীনতা বা পারস্পর্যহীনতা একটি উন্মাদ – যার সব বাঁধ খুলে গেছে, তার বিচিত্র চরিত্র-পরিচয়কে চিহ্নিত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। তাছাড়া বিদ্রোহীর গতিপথ তো সরলমুখী নয়, বৃত্তাকার; তাই তাকে উপরেও উঠতে হয়েছে, আবার নিচেও নামতে হয়েছে। সে ঘূর্ণায়মান গতিতে দুরন্ত বেগে ছুটে চলেছে – একবার সে খোদার আসন ‘আরশ’কে স্পর্শ করেছে, আবার সে “পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কলকোলাহল”। কবিতার প্রথমেই আছে ‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া…উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর। আবার শেষ চরণে সে অদ্ভুতবাবে একই কথা বলেছে, “আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চিরবিদ্রোহী বীর”। অর্থাৎ, সে তার কর্মবৃত্ত সম্পূর্ণ করেছে।
তাই এক অনিবার্য পরিণতিতে আমরা পৌঁছতে পারি। নজরুলের এই কবিতা শুধু একজন বিদ্রোহীর কথা নয় – বিদ্রোহীর সমগ্র প্রবাহকে নজরুল গতিশীল করেছেন। সমগ্র ভারতবাসীর বহু ‘আমি’র মিলিত সংগ্রামই আমাদের পরম মুক্তির জন্য প্রয়োজন। সেই অর্থে তো শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর বুকে যুগে যুগে শোষণ ও অত্যাচারের যে পাহাড় জমে উঠেছে, নজরুলের বিদ্রোহী সেই অনাগত যুগের সকল কৃপাণকে স্তব্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ‘বিদ্রোহী’ তাই প্রখরভাবে রাজনৈতিকতার কবিতা – যা শুধু আজ নয়, বহুদূর ভবিষ্যতেও পৃথিবীর যে-কোনো বলয়ে প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। শত বৎসরের বৃদ্ধ বিদ্রোহী আজও যৌবনের অমিত গৌরবে বলীয়ান। তাই তো রবীন্দ্রনাথ এই কবিতা শোনামাত্র এর কবিত্বকে স্বীকৃতি জানিয়ে কবির শিরে শিরোপা পরিয়ে দিয়েছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ শুধু বাংলা সাহিত্যের গৌরব নয়, বিগত শতকে সারাবিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।
সংযোজন
এক অ-প্রতিশ্রুত বাঙালি পরিবারে কাজি নজরুল ইসলামের জন্ম। তারপর দীর্ঘ অনটনের ইতিহাস। চুরুলিয়ার এক শুষ্ক, ধুসর ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশ। সেখানে নজরুলের বাল্যকাল ছিল এলোমেলো, অগোছালো। কিন্তু, তার নিজেরই বাল্যরচনার ভাষায়, “নিরবধি স্বদেশ জাগিছে অন্তরে।” এই জাগ্রত স্বদেশকে বুকে নিয়ে বেড়িয়েছেন নজরুল। লেখায় লেখায় এক দহন-ধন্য ভাষায় এই পরাধীন, নিপীড়িত, নির্যাতিত স্বদেশ-মূর্তিকে তিনি রূপ দিয়েছেন। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ এবং সমগোত্রীয় আরো বহু অগ্নি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে নজরুল তার শৈশবের স্বদেশের স্তবগান গেয়েছেন। এক আত্মজৈবনিক জবানীতে (‘আমার কৈফিয়ৎ’) তিনি উচ্চকণ্ঠ, উলঙ্গ, উদ্ধত সাহস দেখিয়েছিলেন :
পরোয়া করি না বাঁচি বা না বাঁচি।
যুগের হুজুগ কেটে গেলে
কিন্তু তিল তিল আত্মগ্লানির মধ্যে যে বাঁচা, সে তো বাঁচা নয়। নিজের বাঁচা হোক সম্রাটের মতো – উন্নত, উচ্চশির, অগ্নিশুদ্ধ। তাই তিনি আপোষের দুশমন। ‘পদলালিত্য ঝংকার’-শোভিত কাব্য সুরভিদিতাঁর স্বদেশ-ধ্যানের পরিপন্থী হয়, তাহলেও তিনি শংকিত নন। কারণ তিনি ‘না-বাঁচার পরোয়া’ করেননি। আর সেই কারণেই তার দায়বদ্ধতা ছিল শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার পক্ষে। স্নিগ্ধ-কোমল কাব্য সাধনায় ‘মননের মধু’ সন্ধানের জন্য নয়। তিনি মনে করেছেন, বর্তমান মহার্ঘ, আর মহাকাল স্পর্শাতীত। তাই মহাকালকে তুষ্ট করতে গিয়ে তিনি বর্তমানকে তুচ্ছ করেননি। আর সেই জন্য তিনি ‘চিরকেলে বাণী’-র চর্চা করেননি বলে ঘোষণা করেছেন (কিন্তু তাঁর কাব্যে ও গানে সে বাণীও ছিল, তবে সপ্রেম আবিষ্কারের প্রতীক্ষায়)। একটি দৃষ্টান্ত : শেকসপিয়ারের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের একটি দৃশ্য। সিজারকে হত্যার পর, তাদের উদ্দেশ্য যে মহৎ, এটা বোঝানোর জন্য এক জনসভায় তাঁর মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে হত্যাকারী ব্রুটাস বলেছিলেন, “নট দ্যাট আই লাভ সিজার লেস বাট দ্যাট আই লাভ রোম মোর।” আমি সিজার কে কম ভালোবাসি তা নয় কিন্তু রোমকে বেশি ভালোবাসি। এই সুরে আমারও বলতে ইচ্ছা করে, শুদ্ধ কাব্যচর্চা কে নজরুল কম ভালোবেসেছেন তা নয়, কিন্তু দেশের স্বাধীনতা এবং তার প্রাপ্তির সাধনাকে তিনি বেশি ভালোবেসেছেন। সুতরাং নজরুল ‘মহৎ’ কাব্য-বিচারের মানদণ্ডে অসফল বলে বিবেচিত হলেন। এই হৃদয়ের ক্ষরণের খোঁজ কেউ নিলেন না। শুধু অহমিকার উদাসীন দূরত্বে বাস করে জনপ্রিয় শিল্পীরা বলে ওঠেন, নজরুলের গানের বা সমগ্র রচনার-ই বাজার নেই। এই ‘বাজার’ আধুনিক অর্থনৈতিক অস্থিরচিত্ততার এক বিকলাঙ্গ শাবক। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের ঐশ্বর্যময় ঐতিহ্য, রুচি, বিবেকবোধকে গ্রাস করে চলেছে।
রাজনৈতিকভাবে তিনি সরকারের শোষণ পীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন-তত্ত্বের ঘোর বিরোধী। তিনি বিদ্রোহী। তাঁর ক্ষুরধার লেখনী থেকে নির্গত হল অসামান্য রাজনৈতিক কবিতা “বিদ্রোহী”। শেলীর যেমন “ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড”– ফরাসি বিপ্লবোত্তর ইয়োরোপের রাজনৈতিক মন্ত্রবাণী।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থরথর কম্পিতরাজনৈতিক আকাশ। দেশীয় সংস্কৃতির অস্থির উত্তেজিত উচ্চারণ। এর মধ্যে নজরুলের আবির্ভাব। করাচির সেনানিবাস থেকে তিনি বাংলায় ফিরে এলেন। দেশে তখন অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাপ। রবীন্দ্রনাথ মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছেন। ‘বলাকা’-র কবিতা গুলিতে উত্তাপের স্পর্শ। কিন্তু ‘গীতাঞ্জলি’-র (আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে) ঘোর তখনো সম্পূর্ণ কাটেনি। এই সময় দেশের মানুষ আরো কিছু চাইছিল। যার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ-সঞ্চিত দুঃখ-যন্ত্রণা, ক্ষোভ, প্রতিবাদ অর্গলমুক্ত হতে পারে। এমন সময় বেরোলো ‘বিদ্রোহী’: বল বীর, বল উন্নত মম শির। এই উন্নতশির বীর্যবান ব্যক্তিত্বের আহ্বান ছিল তাদের কাঙ্ক্ষিত মন্ত্রধ্বনি। তাই চিত্তে চিত্তে আলোড়ন। এক পুলকিত বিস্ময়: এমন তো কখনো শুনিনি! তারপর নানা রচনায় বন্ধনমুক্তির মহার্ঘ প্রতিশ্রুতি: ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, – ‘আজি রক্ত নিশি ভোরে একি এ শুনি ওরে..। এগুলি কাব্য পদবাচ্য কিনা তার থেকেও বড় আর একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়, নজরুল দেশের ঘোর দুর্দিনে তার পাশে প্রবল বিক্রম নিয়ে দাঁড়ালেন। তাদের যন্ত্রণার কথা তার কলমে আগুন হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো। উন্নাসিক কবির দল সেকালে এবং একালেও-নজরুলের কবিতা ও গানের ত্রুটি অন্বেষণ করে বেড়ান। শব্দের পাহাড় নির্মাণ করে স্বার্থপর দূরত্ব তৈরি করেন। সবশেষে সরকারকে তুষ্ট করে পুরস্কার ও খেতাব লাভ করেন। এক বিখ্যাত লেখক হেনরি বাকলে-র [দার্শনিক বাকলে নন; এ বছর বাকলের জন্মের দুইশতবর্ষ পূর্ণ হলো (১৮২১-৬২)] ভাষায়: অ্যাজ অন দি ওয়ান হ্যান্ড গভর্নমেন্ট রিওয়ার্ডস লিটারেচার, সো অন দি আদার হ্যান্ড ডাজ লিটারেচার সাকাম টু গভর্নমেন্ট (‘হিস্ট্রি অফ সিভিলাইজেশন ইন ইংল্যান্ড’, পৃ. ৬৪৭) — একদিকে সরকার যেমন সাহিত্য কে পুরস্কৃত করে, তেমনি, অপরদিকে সাহিত্য সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। নজরুল তো তা করেননি। (রবীন্দ্রনাথ ও করেননি। নাইট উপাধি বর্জন তার দৃষ্টান্ত)। তাই তিনি বিদ্রোহী। তাই তাঁর কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’। এখানে এক অস্থিরচিত্ত বিক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী চরিত্রের গর্জন শোষণের শব্দপুঞ্জ ভেদ করে বারে বারে উঠে এসেছে। অনেকে বলেছেন, এ তো ক্ষণস্থায়ী। উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল থেমে গেলেই একবিতা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। কিন্তু নজরুলের বিদ্রোহী তো চিরকালীন। মানুষের জন্ম এবং সভ্যতার যাত্রা থেকেই তো শুরু হয়েছে উৎপীড়ক এবং উৎপীড়িতের সংগ্রাম, সংঘর্ষ, দ্বন্দ্ব (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়)।এখনো নানাভাবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে মৌলবাদের আগ্রাসন ও উৎপীড়ন। অতীত বহুবিস্তৃত, ভবিষ্যৎ ক্রমপ্রসরমান। মাঝখানে বিপুল কাল পরিসরে এই উৎপীড়নের শেষ নেই। সেই যুগ যুগ ব্যাপী নিপীড়ন শোষণের বিরুদ্ধে নজরুলের কবিতা এই বিদ্রোহের মহাকাব্য। মহাকাব্যকে বলা হয় ‘সোল অফ এ জেনারেশন’। একটা জাতির যুগ যুগ ব্যাপী অন্তর বাণী। ‘বিদ্রোহী’-র মধ্যে এই অন্তর বাণী বিপুলভাবে অনুরণিত।
যুগে যুগে বিদ্রোহীর আবির্ভাব আমরা লক্ষ্য করেছি। ইয়োরোপের মধ্যযুগে (সব দেশেরই মধ্যযুগ) শাস্ত্রের প্রাধান্য। দেবত্বের জয়জয়কার, মনুষ্যত্ব কুণ্ঠিত। তাকে অতিক্রম করল রেনেসাঁস। মানবতার জয়গান ঘোষিত হল। নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ বিস্ময় মাখা চোখে শাস্ত্রমগ্নতা থেকে মুক্ত সেকুলার মানুষকে দেখে বলে উঠেছিল: ‘হোয়াট এ পিস অফ ওয়ার্ক ইজ ম্যান!’ কী অদ্ভুত সৃষ্টি এই মানুষ (কী গভীর সেই উচ্চারণ)! অবশ্য তার অনেক আগেই আমরা দেখেছি গ্রিক নাটকে প্রমিথিউসের বিদ্রোহ। তার অনেক পরে শেলীর নব রূপায়ণ: ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’। তাদের সংগ্রাম ছিল মানবতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। নবজাগরণ কালে প্রচলিত ধর্মের যে সংস্কার শুরু হয়েছিল, তার রূপকার ছিলেন মার্টিন লুথার। তিনি ও তাঁর কালের প্রেক্ষিতে এক বড় বিদ্রোহী। মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এ শয়তানের কল্পনায় বিদ্রোহের বিপুল বিস্তার। তার উদ্ধত ঘোষণা: ‘ইট ইজ বেটার টু রেন ইন হেল দ্যান টু সার্ভইন হেভেন’- স্বর্গে দাসত্ব করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা শ্রেয়। বাইবেলের চিন্তা কাঠামোর বিরোধী। কোরানেও দেবদূতেরা সকলেই ঈশ্বরের আদেশে আদম (অর্থাৎ মানুষ)-কে সিজদা করলেন-প্রণত হলেন। শয়তানের জন্য বলা হল ‘ফাসাজাদু ইল্লাল ইবলিসা’ – সকলেই সিজদা করলেন, ইবলিস (অর্থাৎ শয়তান) ছাড়া। তাই কোরানের শয়তানও বিদ্রোহী। আনাল হক (আমিই সিত্য, আমিই ঈশ্বর) মন্ত্রের উদ্গাতা সুফি সাধক মসুর হাল্লাজ (মৃত্যু – ৯২১ খ্রি:); ফার্সি কবি হাফেজ (মৃত্যু : ১৩৮৯); রুমি (১২০৭-১২৭৩), আবার নজরুলের পরম প্রিয় কবি শেলি (১৭৯২-১৮২২)। এঁরা সবাই বিদ্রোহী। আমাদের দেশে বাংলা কাব্যজগতের প্রথম বিদ্রোহী মধুসূদন। এদেশে রেনেসাঁস ভাবনার মানসপুত্র। তাঁর রাবণ-পরিকল্পনায় এই বিদ্রোহিতা আভাসিত। (মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সওদাগর-এর চরিত্র-কল্পনায় বিদ্রোহের আভাস ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবি আর তা হতে দিলেন না। দেবী মনসার সঙ্গে আপোষের মধ্য দিয়েই বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি। তাই প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডির নায়ক হবার গৌরব থেকে চাঁদ সওদাগর বঞ্চিত হলেন। কারণ তাঁর মধ্যে পেলাম না ‘ম্যানস আনকঙ্কারেবল মাইন্ড’)। মধুসূদনের পরে এলেন রবীন্দ্রনাথ। রেনেসাঁস-ভাবনায় শ্রেষ্ঠ বিদ্রোহী। নানা দিকে নানাভাবে। আর দেশীয় সমাজ, ধর্মীয় অনুশাসন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিগড়, সব কিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন নজরুল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাই তাঁর বিদ্রোহ-ভাবনার ম্যানিফেস্টো।
এই ‘বিদ্রোহী’-র পটভূমি কী? অনেকে বলেন, ‘বিদ্রোহী’ আকস্মিক রচনা। কিন্তু তা নয়। পারিবারিক, ব্যক্তিগত জীবনের নানা কষ্ট ও যন্ত্রণা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিষ্পেষন। মুক্তশৃঙ্খল স্বদেশের খন্ডিত স্বপ্ন। বাল্যকালের স্বপ্নিল উচ্চারনে আভাসিত: ‘নিরবধি স্বদেশ জাগিছে অন্তরে।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, রাশিয়ান বিপ্লব, দেশে বিপ্লবী আন্দোলন, এবং তার নায়ক ক্ষুদিরাম, উল্লাসকর দত্ত (অভিরাম নামে পরিচিত: ‘অভিরামের দ্বীপ চালান মা, ক্ষুদিরামের ফাঁসি’, এই গানের বিখ্যাত অভিরাম-বৈদান্তিক দ্বিজদাস দত্তের পুত্র)। নজরুল এই দুজনের প্রতিই ছিলেন শ্রদ্ধাশীল (তাঁর গদ্য রচনা ‘ক্ষুদিরামের মা’ দ্রষ্টব্য: ‘রুদ্রমঙ্গল’, বর্মন পাবলিশিং হাউস,পৃ.২৭-৩৫, এবং ‘ধূমকেতু’, ২ আশ্বিন,১৩২৯) ‘ক্ষুদিরামের মা’ নিবন্ধের শেষের দিকে নজরুল আইরিশ বিদ্রোহী রবার্ট এমেটের (১৭৭৮-১৮০৩) সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন, পৃ-৩৪-৩৫। ‘বিদ্রোহী’-পরবর্তীকালে, ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় রবার্ট এমেট সম্পর্কে কলহন মিশ্রের ধারাবাহিক রচনায় তাঁরই আবেগ উৎসারিত (‘আইরিশ বিদ্রোহী রবার্ট এমেট’, কলহন মিশ্র ‘ধুমকেতু’, ৩ কার্তিক, ১৩২৯ – ১৪ কার্তিক ১৩২৯)। ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’ পর্বের আত্মমগ্নতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ঝড়ের খেয়ায় সেটি আভাসিত। বলাকার ‘সবুজের অভিযান’ কবিতায় (প্রমথ চৌধুরীর পত্রিকা ‘সবুজপত্র’-এর আবির্ভাব উপলক্ষে রচিত) বললেন, “আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। এই আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচাবার দায়িত্ব নিলেন নজরুল। ‘অগ্নিবীণা’-র কবিতা গুলিতে, ‘ধুমকেতু’-র বিজয় অভিযানে। নজরুল এই ‘অগ্নিবীণা’ শব্দ কি রবীন্দ্রনাথের একটি গানে প্রথম লক্ষ্য করেছিলেন? : ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে’ – নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের বেশ কয়েক বৎসর পূর্বেরচিত(১৩২১)। রবীন্দ্রনাথের বহু গান তো নজরুল আত্মস্থ করেছিলেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নিবীণা’-র ক্ষেত্র এবং প্রসঙ্গ পৃথক। আর ‘ধুমকেতু’র প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে আশীর্বাণী তা পাঠ করে মনে হয়, নজরুলের বিদ্রোহী-সত্তাকে তিনি ঠিক চিনতে পেরেছিলেন:
আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু।
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লিখা।
জাগিয়ে দে চমক মেরে আছে যারা অর্ধচেতন।।
সত্যিই ঐতিহাসিক তাঁর আবির্ভাব এবং তাঁর বিদ্রোহীর উন্নতশির দর্পিত পদক্ষেপ। তাই একথা বলা যায়, ‘বিদ্রোহী’-র আবির্ভাব আকস্মিক নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, ‘বিদ্রোহী’ রচনার কিছু পূর্বে ‘বাঁধনহারা’ পত্রপোন্যাসে ‘সাহসিকা’-র পত্রে এই বিদ্রোহ সম্পর্কে প্রথম আলোকপাত (গ্রন্থাকারে ১৩৩৪-এ বেরিয়েছে। তার পূর্বে ১৩২৭ সালের ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় বৈশাখ থেকে ধারাবাহিক প্রকাশিত)। সাহসিকা লিখেছেন: “এই বিদ্রোহীর মনে এমন কোন শক্তি মাথা তুলে প্রদীপ্ত হাওয়া চাইছে যার সংকেতে সেযুগ-যুগান্তরের সমাজ, ধর্ম, শৃঙ্খলা, সবকিছুকে গা-ধাক্কা দিয়ে নিজের জন্য আলাদা পথ তৈরি করে নিচ্ছে।”
ভাবনার এই অংকুর ‘বিদ্রোহী’-র মহীরুহ
‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রকৃতি কী? বিদ্রোহী কী বলতে চায়? ‘আমি’-র জয় ঘোষণা। আমিত্ব-সচেতনতা। একদিকে অন্ধ শাস্ত্রের শাসন, অপরদিকে রাজনৈতিক বন্ধন-এই উভয় নেতিবাচকতা থেকে মুক্তির কথা বলে বিদ্রোহী। শাসকের অত্যাচার, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, নজরুলকে ভেতরে ভেতরে অস্থির করে তুলেছিল। তারই বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহের বহিঃ প্রকাশ। সুতরাং ‘বিদ্রোহী’ একটি রাজনৈতিক কবিতা। শেলীর ‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’-এর মত যা ফরাসি বিপ্লবের দুকুলপ্লাবী ধ্বংস-প্রবাহের সংহত কাব্যিক রূপ। এই কবিতায় ঝড়ের প্রতি শেলীর বিখ্যাত সম্বোধন ডেস্ট্রয়ার এন্ড প্রিজারভার: নজরুলের ‘বিদ্রোহী’-র মর্মবাণী। কবিতার বহু চরণে এই ধ্বংস ও সৃষ্টির ইশারা। একটা দৃষ্টান্ত: ‘বিপুল ধ্বংস-ধন্যা’। বিদ্রোহী প্রথমে ধ্বংস করবে, তারপর সেখানে সৃষ্টির শ্যামল ঐশ্বর্য। সমগ্র অঞ্চল ধন্য হয়ে উঠবে। যেমন মিশরকে বলা হয় নীলনদের দান। নেতিবাচক আর ইতিবাচক শব্দের যৌথ ভূমিকায় এক নতুন ভাবনা জন্ম নেয় (এইরকম আরেকটি যৌথতার দৃষ্টান্ত: ব্যথার দান’-নজরুলের একটি প্রিয় শব্দবন্ধ)। শেলী-অনুরাগী নজরুল (তাঁর চিঠিপত্রে এই অনুরাগের কথা জানা যাবে) ওয়েস্ট উইন্ড এর এই দ্বৈত সত্তা কে কুর্নিশ জানিয়েছেন। ‘বিদ্রোহী’-র পরে পরেই লেখা ‘ভাঙার গান’ (কারার ঐ লৌহ কপাট)। আমরা বলতে পারি ‘বিদ্রোহী’-র ঝড়ে যে অগ্নি-উদগীরণ, ‘ভাঙার গান’ তার একটি তাত্ত্বিক নির্যাস। জীবন অনেক বড়, আর মৃত্যু তাকে মহৎকরে তোলে। ভাঙার গান’-এ নজরুল বললেন:
ডাক ওরে ডাক
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে।
সারা ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় এই মন্ত্রই ধ্বনিত। তবে সেটি শব্দে শব্দে অবগুণ্ঠিত – দরদী বিশ্লেষকের প্রতীক্ষায়। শেলীর ওয়েস্ট উইন্ডের আরেকটি উচ্চারণ নজরুলকে উদ্বুদ্ধ করেছিল: ইফ উইন্টার কামস, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড? — শীত যদি এসেই থাকে, বসন্ত কি বেশি দূরে পড়ে থাকবে? নজরুলের রচনা শীতের রাতে। বসন্তের স্বপ্ন তাঁর বিপুল চোখে। তাঁর চারপাশে তখন সবাই নিদ্রামগ্ন (সেসময় তালতলার একটি ভাড়া বাড়িতে মুজাফফর আহমদ এর সঙ্গে একই ঘরে তিনি থাকতেন), বিশ্ব চরাচর সুপ্তিতে আচ্ছন্ন, তাঁর ঝড়ের বন্ধু এবং সাথী মুজাফফর আহমদ নিদ্রায় অচেতন। এক অশান্ত বালক চরণের পর চরণ লিখে চলেছেন। প্রবহমান, অপ্রতিরোধ্য। সেইসব প্রতিশ্রুতিবান চরণে এক নতুন সৃষ্টির হাতছানি। নতুন ইতিহাস গড়ার অমোঘ আহ্বান। সে ইতিহাস গড়লেনও। ‘বিদ্রোহী’ শুধু হিস্টোরিক্যাল অর্থাৎ ইতিহাসের অন্তর্গত নয়, বরং হিস্টোরিক, ইতিহাসের স্রষ্টা। মুজাফফর আহমেদ এর সেই অপ্রশস্ত কক্ষে বসে তিনি জানতে পারলেন না, তিনি ইতিহাস নির্মাণ করছেন। ব্যঞ্জন ধ্বনিসমৃদ্ধ শব্দের গভীর আয়োজনে, আত্মচেতনার অসামান্য সম্প্রসারণে, ‘তন্দ্রাজড়িমা’ ঝেড়ে ফেলে পৌরুষের প্রবাহের পর প্রবাহে এক নতুন জাগরণ নির্মিত হচ্ছিল। এই প্রবাহে তাঁর কালের তো প্রয়োজন ছিলই। অনাগত কালকেও তিনি শাসন করতে পারলেন। সেইটা হল ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা (কল্লোল যুগের ঝোড়ো হাওয়ার ‘মন্ত্র-গুঞ্জরণে’ নজরুলের ভূমিকা নিয়ে একটি চমৎকার লেখা তৈরি করা যায়)।
![বিদ্রোহী কবিতা : শত বৎসরের আলোকে নজরুলের কবিতার মূল্যায়ন](https://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2022/07/দেওবন্দ-আন্দোলন-1.jpg)
এই উল্লিখিত জাগরণ মন্ত্র ধ্বংস ও সৃষ্টির নানান প্রতিমায় আধারিত। বিভিন্ন পুরাণ-প্রসঙ্গের আশ্রয় নিয়ে নজরুল এই প্রতিমাগুলোকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন। তাই পুরাণের (হিন্দু, ইসলামি এবং গ্রিক) ইঙ্গিতময় প্রয়োগে ‘বিদ্রোহী’ ঐশ্বর্যময়। শুধু এই বিষয়েই একটি প্রবন্ধ নির্মাণ করা যায়। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পুরান-প্রতিমা নিয়ে এখানে দু-চার কথা বলা যাক। তাঁর লক্ষ্যভেদের কুশলতায় উন্মুখ পাঠক বিস্ময়-বিমুগ্ধ। সেই লক্ষ্যটি হল বিদ্রোহীর চরিত্র-বিচার: ধ্বংস ও সৃষ্টিতে (এককভাবে বা যুগ্মভাবে) তার স্বাস্থ্যবান পদচারণা।
নজরুলের ভাবনা ও কল্পনায় একক নায়ক শিব। বহু স্থানে, বিভিন্ন রূপে আমরা শিবের ধ্বংস ও সৃষ্টির যুগল প্রতিমা লক্ষ্য করি। ‘বিদ্রোহী’তে শিবের অপ্রতিহত মহিমা বিদ্রোহী-র বীর প্রতিমাকে স্পষ্ট করে তোলে। বিদ্রোহী বলছে:
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর,
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর
আমি পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল…..
এলোকেশে ঝড় ছুটে চলেছে। দুরন্ত মেঘেরা তার এলায়িত কেশ- যেন শিবের ধূম্রবর্ণ জটা চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত। এখানে তুলনায় রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষশেষ’ কবিতার একটি চরণ:
ঝঞার মঞ্জীর বাঁধি উন্মাদিনী কালবৈশাখীর নৃত্য হোক তবে
আর শেলি ওয়েস্ট উইন্ড কবিতায় ‘ফিয়ার্স মিনাড’-এর সঙ্গে নৃত্যচঞ্চল ঝড়ের তুলনা করেছেন। গ্রিক পুরাণে মিনাডমদের দেবতা বেকাস-এর শিষ্যা। সে বেকাসের বেদির চারপাশে সুরাহস্তে নৃত্যরতা – উদ্দাম, উন্মত্ত। তার আলুলায়িত কেশরাশি চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত। আবার ভারতীয় পুরাণে শিবকে বলা হয় ব্যোমকেশ। তিনি যখন গঙ্গাকে (বন্ধনহারা ধারা গঙ্গোত্রীর) ধারণ করেছিলেন, তখন তাঁর কেশ বা জটাগুলি ব্যোম, অর্থাৎ আকাশময় ছড়িয়ে পড়েছিল। সাড়ে একুশ বছরের এক তরুণ কবি নৃত্য চপল ঝড়ের কল্পনায় পৃথিবীর দুজন বড় কবির ইমেজকে স্পর্শ করেছেন!
এবার আরেকটি ইমেজে যাই :
আমি ইসরাফিলের শিঙার মহা হুঙ্কার।
মুসলিমদের বিশ্বাসমতে চারজন ফেরেশতা বা দেবদূত আল্লাহর নির্দেশে আকাশ, পৃথিবী, অন্তরীক্ষ, মানুষ, জীবকুল, জীবন, মৃত্যু সবকিছু দেখাশোনা করেন। এদের মধ্যে ইস্রাফিলের উপর এক কঠিন দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে। তিনি এক বিশাল শিঙা হাতে প্রতীক্ষারত। কেয়ামত বা মহাপ্রলয়ের ঠিক পূর্বে তিনি আল্লাহর নির্দেশে যেই শিঙা বাজাবেন, অমনি সমগ্র বিশ্বের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে। বিদ্রোহী বলছে, তার প্রকৃতিও ইসরাফিলের শিঙার প্রাক-প্রলয় গম্ভীর নিনাদের মতো – ধ্বংসের ভয়াল রূপের দ্যোতনা।
এবার আরেকটি পুরাণ-প্রতিমা :
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা
বিষ্ণু সৃষ্টির পালনকর্তা। ইনি দেবকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত। সর্বলোকের কল্যাণই বিষ্ণুর সকল কর্মকাণ্ডের মূলে। এখানে তাঁর ‘যুগল কন্যা’ অর্থে তাঁর দুই স্ত্রী : লক্ষ্মী ও সরস্বতী। অর্থাৎ বিদ্রোহী সম্পদ (লক্ষ্মী) এবং প্রজ্ঞার (সরস্বতী) আকাঙ্ক্ষায় উন্মাদ, আচরণে চঞ্চল। ‘ছিনিয়া’ শব্দটিলক্ষ্য করার মতো। এটি বিদ্রোহীর প্রকৃতির সঙ্গে অন্বয়যুক্ত। পৌরুষের লক্ষণাক্রান্ত অর্জন হবে দুর্বার, গ্রহণের আত্মসমর্পিত দুর্বলতায় তা আচ্ছন্ন নয়।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ স্পর্শ করে এই পুরাণ-আলোচনা শেষ করব:
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।
এই উক্তিই নজরুলের প্রথম যৌবনের সামূহিক ‘সর্বনাশ’-এর মূলে, – এক দুর্ভাগ্যজনক ফতোয়া ‘কাফের কাজী’-র উৎস। কবির ব্যবহৃত শব্দ ও শব্দগুচ্ছের অন্তরালে যে ইঙ্গিত থাকে, সেটিকে খুঁজে বের করতে একটু পরিশ্রমের প্রয়োজন। ভারতীয় পুরাণে ভৃগু বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মীর পিতা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব এঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে, তা জানার জন্য মুনি-ঋষিরা ভূগুকে তাঁদের কাছে যেতে বলেন। ভৃগু প্রথমে ব্রহ্মা, পরে শিব-এর কাছে যান। এঁরা ভৃগুর আচরণে ক্ষুব্ধ হন। তাঁদেরকে সন্তুষ্টকরে বিষ্ণুর কাছে যান। বিষ্ণু তখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কিছুতেই নিদ্রা ভাঙ্গে না দেখে ভৃগু বিষ্ণুর বুকে পদাঘাত করেন। এরপর তাঁর নিদ্রা ভঙ্গ হয়। কিন্তু এই পদাঘাতে বিষ্ণু রাগ তো করলেনইনা, উপরন্তু ভৃগুর পায়ে লেগেছে কিনা জানতে চাইলেন। একথা শুনে ভৃগু স্তম্ভিত। তখন তাঁর প্রতীতি হল, বিষ্ণুই শ্রেষ্ঠ। এই রূপকের অন্তরালে যে ইঙ্গিত আছে, নজরুল সেটাকেই ব্যবহার করেছেন। বিষ্ণুর বুকে পদচিহ্ন এঁকে ভৃগু বিদ্রোহীর মুকুট ধারণ করেছেন। যুগযুগব্যাপী আচ্ছন্ন, অচলায়তন ও প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ব্যবস্থাকে পদাঘাত করে, সচেতন করে নিজেদের পুঞ্জিভূত ব্যথা-বেদনা শোষণ-পীড়নের প্রতিকার চায় বিদ্রোহী! কবিতায় ব্যবহৃত বহু ‘আমি’-র মত, এখানেও ‘আমি’ অর্থে বিদ্রোহী। (এই সমগ্র পুরাণ-প্রসঙ্গ আলোচনার জন্য আমি বিশিষ্ট নজরুল-গবেষক আব্দুল মান্নান সৈয়দের ‘০নজরুল ইসলাম: কালজ কালোত্তর’ গ্রন্থের নিকট কৃতজ্ঞ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৮)।
এর পর দু-একটি ইমেজ নিয়ে কিছু আলোচনা করা যায়। আমরা আলোচনার প্রথম অংশে দেখিয়েছি:
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য
এর অন্তর্নিহিত যুগল রূপ নজরুলের কাব্যে প্রতিফলিত। এখানে আর একটু আলোচনা করা যাক। ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী’-র মধ্যে আরো একটি ভাবনার চকিত বিচ্ছুরণ কি লক্ষ্য করা যায়? করাচির সেনানিবাসে থাকাকালে আরবি-ফারসি কাব্য জগতের নানা বর্ণবিলাস এবং গীতধ্বনি তাঁর সৃষ্টি-বিশ্বে একটি নিঃশব্দ বিপ্লবের সূচনা করেছিল। তার চকিত চাহনি শুধু ‘শাতিল আরব’ (১৯২০) বা ‘কামাল পাশা’ (১৯২০)-তেই নয়, ‘বিদ্রোহী’-তেও নতুন নতুন ইশারার ঝলক আমাদের উপহার দিয়েছে। সেইরকম একটি ভাবনা ‘বাঁশের বাঁশরী’। বিশ্ববিখ্যাত মরমী কবি জালালুদ্দিন রুমির ‘মসনভি’-র পাঠকমাত্রই এই প্রতীকের সঙ্গে পরিচিত। নজরুল এই মসনভি-র প্রথম কয়েক ছত্রের বাংলা অনুবাদের নাম দিয়েছিলেন ‘বাঁশির ব্যথা’ (বঙ্গনুর, কার্তিক, ১৩২৭, অর্থাৎ ‘বিদ্রোহী’র পূর্বে)। রুমির কল্পনায় বাঁশির সুর বা সঙ্গীতযুগ যুগ ধরে এক অনন্ত বিরহের ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে। বাঁশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে যে বাঁশির জন্ম দেওয়া হয়েছে তার সুরে সেই অনন্ত বিচ্ছেদের স্পর্শ-বাঁশের সঙ্গে, অর্থাৎ উৎসের সঙ্গে মিলিত হবার অতৃপ্ত কামনা। আর এই বিরহই তাঁকে মহৎ করেছে। এই ইমেজ ব্যবহার করে বিদ্রোহী যেন বলতে চাইছে, তার স্বরূপের সন্ধানে শুধু বিদ্রোহ-বিপ্লবকে খুঁজলেই হবে না, সেখানে বিশ্বব্যাপী অনন্ত বিরহের সুরও তরঙ্গায়িত। নজরুলের ব্যবহৃত ইমেজ এখানে সুপ্ত রুমি-অনুষঙ্গে আভাসিত।
বিদ্রোহীর আরেকটি উচ্চারণে ফারসি কাব্যের চকিত সুবাস পাই। এই কবিতায় রুমির মত হাফেজেরও ছায়াপাত ঘটেছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। বিদ্রোহী তার পরিপূর্ণ প্রাণশক্তির উত্তাপ আর উত্তেজনা প্রকাশ করার জন্য বলছে :
আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ
মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্ হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ‘দীওয়ান-ই-হাফেজ’-এর প্রথম গজল শুরু হচ্ছে এই ভাবে:
আলা ইয়া আইয়োহাস সাকি আদির কাসা ওয়া নাবিলহা
নজরুল প্রাক-’বিদ্রোহী’ কালে এর ভাব অনুবাদ করেছিলেন এইভাবে:
হ্যাঁ অ্যায় সাকি, শারাব ভর দাও, বোলাও পেয়ালি চালাও হরদম
(এখানে একটি মজার তথ্য পেশ করতে লোভ হচ্ছে, প্রাসঙ্গিক নয় জেনেও। হাফেজের গজলের যে পংক্তির অনুবাদ এটি, সেই পঙক্তি তিনি ইমাম হোসেনের হত্যাকারী কবি এজিদের রচনা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু ভাবের দিক দিয়ে হাফেজকী বিপুল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন!)।
হে সাকি, পেয়ালা শারাবে পূর্ণ করো, সেই শারাব জনে জনে বারে বারে বিতরণ করো। নজরুলের অনুবাদ ‘বিদ্রোহী’ রচনার পূর্ববর্তী প্রয়াস। কারণ তাঁর হাফেজ-পাঠ প্রাক- ‘বিদ্রোহী’ অভিনিবেশ। যা তাঁর জীবন-যৌবনের পাত্র উজাড় করে দিয়েছিল। তবে এই গজলের শারাব-সাকির অন্তরালে এক অন্যতর ভাবনার ভুবন ছিল। তার ইঙ্গিত ‘বিদ্রোহী’র ব্যবহৃত চরণে ছন্দিত হয়নি। সেটি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অন্তিম ইচ্ছায় প্রতিফলিত। তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। স্তিমিতকণ্ঠ। তাঁর প্রিয় এই গজলটি শোনানোর জন্য মৃদু অনুরোধ জানালেন। সতীশচন্দ্র এই গজলটি পাঠ করতে থাকলেন। সেটি শুনতে শুনতে মহর্ষি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। এই তথ্যটুকু অবশ্য ‘বিদ্রোহী’-র মর্মবাণী উপলব্ধি করার জন্য জরুরী নয়। কিন্তু এই দুটি পঙক্তি রচনাকালে তাঁর অন্তর্জগতে হাফেজ তাঁর সারা জীবনের আচার-বিরোধী বিদ্রোহ নিয়ে চুপিসারে প্রবেশ করেছেন, এটা জানানো জরুরি বলে মনে হয়। কারণ নজরুল এক বিখ্যাতপত্রে (প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ কে লেখা, ১৯২৭) বলেছিলেন, আমি তো হাফেজ-রুমিকে আমার চেয়েও বিদ্রোহী বলে মনে করি। তাই হাফেজ-রুমির আত্মা তাঁর নানা রচনায় উপস্থিত থাকে। ‘বিদ্রোহী’-তেও।
‘বিদ্রোহী’-র আঙ্গিক নিয়ে, এর ছন্দ, চরণ-বিন্যাস, শব্দ, ইমেজ – এসব নিয়ে আলোচনা করা দরকার। কিন্তু লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে। সত্বর থামতে হবে। ছোট পত্রিকার (শুধু কলেবরে, গুরুত্বে নয়) ক্ষীণাঙ্গ পরিসরে, বিশদ আলোচনা সম্ভবও নয়, উচিতও নয়। তাই এগুলো নিয়ে আলোচনায় আপাতত ইতি। আঙ্গিকের একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে কিছুটা আলোকপাত থাকলো। শুরুতেই একটি অদ্ভুত সম্বোধন:
বল বীর,
বল, উন্নত মম শির,
শির নেহারি আমারই নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির।
এখানে কবি বীরকে, অর্থাৎ বিদ্রোহীকে সম্বোধন করে বলেছেন, হে বীর, তুমি বলো, তুমি ঘোষণা করো, তোমার শির উন্নত। সম্বোধনের এই প্রকৃতি কি কোরানের একটি পরিচিত সম্বোধনের পদ্ধতির কথা স্মরণ করায় না? সমগ্র কোরানব্যাপী হজরত মুহম্মদের সঙ্গে আল্লাহর সম্বোধন। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক:
কুল, আনা বাশারুম মিসলুকুম ইউহা এলাইয়া
অর্থাৎ, (হে মুহম্মদ) বল, আমি তোমাদেরই মতো মানুষ- (শুধু) আমার উপর প্রত্যাদেশ এসেছে। এখানে সম্বোধনকারী, অর্থাৎ আল্লাহ, নেপথ্যে রয়েছেন (এই বাক্যের মধ্যে)। আর আরবি শব্দ ‘আনা’ হচ্ছে ‘আমি’, অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ-নজরুল-কবিতার বীর বিদ্রোহীর (‘আমি’) মতো। হজরত মুহম্মদও তো একজন বড়ো বিদ্রোহী (মহান ধর্ম-বাণীর সব বড়ো উদ্গাতারাই বিদ্রোহী)। “আমি তোমাদেরই মতো মানুষ’, অর্থাৎ দেবতা নই, উপাস্য নই, এ তো বিদ্রোহের বাণী। মক্কার শ্রেষ্ঠী সম্প্রদায়ের কৌলিন্য, বিশ্বাস, আচরণের তীব্র প্রতিবাদ। তাঁর কালের সমস্ত ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা, সামাজিক অনাচার, শোষণ, পীড়ন, অত্যাচার তাঁর শক্তিশালী আমিত্বের (কিন্তু নেতিবাচক অহং নয়) আঘাতে চূর্ণ হলো।ন্যায় এবং শান্তির জয় প্রতিষ্ঠিত। সেই ‘প্রবল প্রাণ’-কে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে, তুমি একথা ঘোষণা করে দাও যে তুমি মানুষ। যেমন নজরুল বীরকে বলেছেন, তুমি বল, তোমার শির উন্নত। এই সাদৃশ্যটুকু পর্যবেক্ষণ করতে অনুরোধ করি। নজরুল ‘দেবী-স্তুতি’ লিখেছেন, তেমনি ‘মরু-ভাস্কর’ও (হজরত মুহাম্মদ)। যুবরাজ দারাশিকোহর ‘মাজমাউল বাহরায়েন’ (দুই সমুদ্রের মিলন) – বেদান্ত ও সুফি ভাবনা — তাঁর প্রিয়তম আদর্শ।
‘বিদ্রোহী’র নেতিবাচক দিক নিয়ে অনেকে আলোচনা করেছেন। উভয় প্রান্তেই কিছু না কিছু সত্য আছে। কিছু না কিছু ভ্রান্তিও। প্রাজ্ঞ সমালোচক কোনোটাই উপেক্ষা করেন না। বিচার করেন। এই পথই শ্রেষ্ঠ পথ। আমাদের তাই অনুসরণ করা উচিত। স্থানের অভাবে একটু ছুঁয়ে যাই। একটা ক্ষেত্র শব্দচয়ন ও প্রয়োগ। কোথাও কোথাও হয়তো অমসৃণ হয়েছে, কিন্তু অমার্জিত হয়নি। হয়ত শব্দ কোথাও কোথাও ব্যাকরণসম্মত নয়, কিন্তু তার মাথায় কাব্যের আশীর্বাদ আছে। শেলীর ‘ওয়েস্ট উইন্ড’ কবিতায় কোনো একটি শব্দ প্রয়োগে ব্যাকরন বিচ্যুতির অভিযোগের উত্তরে সহানুভূতিশীল সমালোচক বলছেন:
ইট ইজ বেটার টু বি আনগ্রামাটিক্যাল দ্যান টু বি আনপোয়েটিক
অকাব্যিক হওয়ার চেয়ে ব্যাকরণ বিচ্যুতি ভালো। তবে এসব কথা এখন থাক। একটু অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। অনেকে বলে থাকেন, ‘বিদ্রোহী’-তে ঊৰ্ধায়ন নেই। না ভাবে, না ভাষায়। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানেই থাকি। মর্ত্য থেকে দূরে অমর্ত্যলোকে যাবার হাতছানি নেই। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়, তবে কিছুটা সত্য, ভিন্ন অর্থে। সম্পূর্ণ সত্য এই কারণে নয় যে বিদ্রোহীর উদ্ধায়ন তো কবি দেখিয়েছেন। প্রচন্ড মানসিক বিক্ষোভ এবং আলোড়নের শেষে, স্বর্গমর্ত্য পাতাল স্পর্শ করে একেবারে শেষ পঙক্তিতে বিদ্রোহী বলছে, ধীরোদাত্ত উচ্চারণে,
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি, একা, চির-বিদ্রোহী বীর।
এই শেষ চরণে আবেগ অদ্ভুতভাবে শান্ত, – যেন নীরবের পদতলেন নিবেদন। বিদ্রোহী তার শেষ লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছে। দেশ,কাল, মানুষ, প্রকৃতি, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, সমস্ত নিগড়, সমস্ত শিকল, সবকে ছাপিয়ে, সবকে অতিক্রম করে একজন বিদ্রোহী তার শেষ লক্ষ্যে পৌঁছে গেল। আর ঐ পঙক্তির মধ্যে একা’শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আবৃত্তি করার সময় ‘একা’র আগে এবং পরে একটু দম নিয়ে উচ্চারণ করতে হবে, কমা-চিহ্ন থাক বা না থাক। এইটা জানানো খুব জরুরী যে তার সঙ্গে আর কেউ নেই, আর কেউ থাকতে পারে না। এটা ঠিকই যে পৃথিবীর সকল দেশের নির্যাতিত সংগ্রামী মানুষ এ-কবিতায় শেষ পর্যন্ত ‘আমরা’-য় রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে তাদের দায়িত্ব শেষ। দাঁড়িয়ে শুধু বিদ্রোহী, এবং একা। সেখানে আর কারো যাবার ক্ষমতা নেই। আর সব কিছু, আর সবাই ‘চির-বিদ্রোহী’-র প্রবল একক ব্যক্তিত্বে তুচ্ছ হয়ে যায়।
কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন, বিদ্রোহী তো ‘রণক্লান্ত’। তার সংগ্রামের নিণাদিত ঘোষণা এখানে ক্ষুন্ন, তার বিপুল মহিমা খর্ব, সূচনার ব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গতীহীন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তার ক্লান্তি সাময়িক, সংগ্রামের সঙ্গে এ-ক্লান্তির অবিচ্ছেদ্য স্বাভাবিক সম্পর্ক নিয়তি-নির্দিষ্ট। এবং পরের পঙক্তিতেই সে ঘোষণা করছে, তার মহাদায়িত্ব সম্পর্কে সে সচেতন। যতদিন “উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল” আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হবে, ততদিন সে শান্ত হবে না। এক সংগ্রামের পর নতুনতর সংগ্রামে হবে তার উদ্বোধন। যুগ যুগ ধরে “অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ” তো রক্ত-রঙীন। আজও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অত্যাচারী, মদমত্ত, রক্তচক্ষু শোষকের আগ্রাসী চরণপাত – আজও তো ‘বিদ্রোহী’ প্রাসঙ্গিক। সেখান থেকে এই মুহূর্তেও আমরা নানা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ গ্রহণ করে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ধত উচ্চারণের প্রতিপক্ষ হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। আমরা কোনোভাবেই বলতে পারি না, বিদ্রোহীর দায়িত্ব শেষ। সেই অনাগত যুগের সকল সংগ্রামের বিপুল নেতৃত্বে এই বিদ্রোহী, —একা, কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন নয়। সংগ্রামের এইমহৎ একাকীত্ব বিদ্রোহীকে বিপুল উচ্চতায়। নিয়ে গেছে। এখানেই দ্য হুইল কাম ফুল সার্কল – বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। পূর্ণ হয়েছে। কাব্যশিল্পের শর্ত ও তত্ত্ব : টু ট্রানসপোর্ট দ্য রিডার্স – পাঠকদের এক অন্য উচ্চতায় উত্তীর্ণ করা।
তবে ‘বিদ্রোহী’-তে যে উর্পায়ন নেই, সেটি ভিন্ন অর্থে সত্য। এবং সেটি এই কবিতার গৌরবের অঙ্গ। এখানে দর্শনের এলাকা থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। দুটি শব্দের সাহায্যে ইশ্বরের স্বরূপ আলোচনা করা হয় : ট্রানসেনডেন্ট (দুরাভিসারী) এবং ইমানেন্ট (মর্ত্যমুখী)। উপনিষদের ঈশ্বর প্রধানত ট্রানসেনডেন্ট, আর সুফিদের ঈশ্বর প্রধানত ইমানেন্ট। (মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ট্রানসেনডেন্ট ঈশ্বরে পূর্ণ তৃপ্তি পাননি। তাই ইমানেন্ট ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের আকাঙ্ক্ষায় সুফি কাব্যে নিমগ্ন ছিলেন)। এই শব্দদুটিকে কাব্যমহিমা বিচারের মানদণ্ড হিসাবেও দেখা হয়। প্রথমটি আমাদের কল্পনাকে অনেক দূর নিয়ে যায়; নতুন আলোয়, মহত্তর আশ্বাসে আমাদের স্থিত করে। একটি ভিন্নতর ভুবনে প্রতিষ্ঠিত করাই তার দায়িত্ব। আর দ্বিতীয়টি আমাদেরকে ভূমিলগ্ন করে রাখে। তার প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আলো-অন্ধকার, তার সংগ্রাম ও সাফল্য, এই নিয়ে তার ভুবনমুখী সার্থকতা। নজরুলের কাব্য-প্রতিভা প্রিডমিন্যান্টলি ইমানেন্ট – প্রধানত মর্ত্যমুখী। ব্যতিক্রমের মহত্ত্বকে স্বীকার করেই একথা বলা যায়। তাদের প্রতিদিনের পরিচিত অনুভূতিকে গায়ে মেখে, নিজের দোসর করে তাদের সঙ্গে বাস করেছেন। মহত্ত্বর ভুবনের অনিশ্চিত প্রতিশ্রুতির আশ্বাসে তিনি দৈনন্দিনের বেদনার বর্ণমালাকে উপেক্ষা করেননি। ‘বিদ্রোহী’-র উপহার এই বেদনার বর্ণমালা। তাই বড়ো প্রিয়, বড়ো আপন। ট্রানসেনডেন্টের দূরত্ব বিষয়ের সঙ্গে এক নিরাবেগ সম্পর্ক তৈরি করে। প্রতিদিনের পরিচিত বিনিময় বাধাপ্রাপ্ত হয়। আর ইমানেন্ট আমাদের একান্ত আপন জগতে আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে বাস করে। তাই তাকে আমরা ভালোবাসতে পারি। সে আমাদের সুখে সুখী, আমাদের দুঃখে কষ্ট পায়। আমাদের জীবন-সংগ্রামে পাশে দাঁড়ায়। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ তাই ইমানেন্টের গৌরবে সংরক্ত। আর ট্রানসেনডেন্ট বড়ো, নাইমানেন্ট বড়ো, কাব্যের বিচারে এগুলি খুব প্রাসঙ্গিকনয়। ঠিক যেমন অপটিমিজম (আশাবাদ), না পেসিমিম (নৈরাশ্যবাদ) কোনটা আমাদের পছন্দের, কাব্যের মানদণ্ড বিচারে সেটি গ্রাহ্য নয়। ‘ওথেলো’ নাটকে ইয়াগো শেকসপিয়ারের একটি অন্ধকার চরিত্র – আমাদের পছন্দের তালিকাভুক্ত নয়। কিন্তু শিল্পের বিচারে শেকসপিয়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আমরা ‘বিদ্রোহী’-কে কাব্যের নিরিখে বিচার করব। কখনোই বলতে পারব না :ইট ইজ ওয়েড এণ্ড ফাউন্ড ওয়ান্টিং – একে ওজন করা হলো এবং দেখা গেল, এতে অভাব আছে – এর মধ্যে কিছু নেই।
![বিদ্রোহী কবিতা : শত বৎসরের আলোকে নজরুলের কবিতার মূল্যায়ন](https://nobojagaran.com/wp-content/uploads/2022/07/bulbuli-nirob-nargis-bone.jpg)
বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক দীপ্তি ত্রিপাঠি পাঁচজন আধুনিক কবিকে নিয়ে আলোচনা করেছেন : ‘আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়’ (দে’জ পাবলিশিং, কোলকাতা, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৮৮)। তার আলোচনার অসাধারণ পাণ্ডিত্য অনস্বীকার্য। তবে সেখানে নজরুলের জন্য অনাদরের স্থান বরাদ্দ হয়েছে সামান্য, কৃপণ কলমের কয়েকটি আঁচড়। শুধু ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবির্ভাব লগ্নে বুদ্ধদেব বসুর (লেখিকার অন্যতম আলোচ্য কবি) বিস্ময় ও মুগ্ধতার চকিত রেখাপাত লেখিকা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে নজরুল সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর পরবর্তীকালের অপ্রীতিকর দৃষ্টিভঙ্গির কথাও (পৃ. ৪০-৪১)। আওয়াজ উঠেছে, সামগ্রিকভাবে নজরুলের কবিতা, এবং বিশেষকরে ‘বিদ্রোহী’-র চড়া সুর নিয়ে। আবেগ তার দুর্বিনীত সন্তান। এখানে একটা কথা স্মরণ করা যায়। তার কালের কোনো কবির চিত্ত তো শোষণে-নিপীড়নে এভাবে ক্ষুব্ধ, আন্দোলিত হয়নি! আর কাউকে বলতে হয়নি, “দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।” হৃদয়ের তারে তারে এভাবে রুদ্রবীণা বেজে ওঠেনি। এ এক স্বতঃস্ফুর্ত, পবিত্র আবেগ অনেস্ট অ্যাঙ্গার —মহৎ ক্রোধ। হ্যাঁ, কোথাও কোথাও, অসতর্ক উচ্চারণে, তার কিছু স্থলন ছিল, কিন্তু পতন ছিল না। তবে তার সঙ্গীতময় যুগের আত্মশাসন নিয়েও গবেষণা দরকার। একটা কথা মনে রাখা সৎ আলোচনার অঙ্গ : বাংলা কাব্যের মেজাজে নজরুল আধুনিকতার জনক, এবং সেই শিরোপা তাঁর ‘বিদ্রোহী’-র প্রাপ্য। একে আমরা বলতে পারি ‘প্রাইম মুভার’ – প্রথম সঞ্চালক। ‘বিদ্রোহী’র আবির্ভাব ১৯২১। তার পরে পরেই আমরা নানা আন্দোলনে তাকে দেখেছি, অর্থাৎ তার আত্মার জয়ধ্বনি শুনতে পেয়েছি। অসহযোগ পরবর্তী ধূমকেতুর (১৯২২) রক্ত অভিষেক, তারপর ‘কল্লোল’-এর কাল, ঢাকার শিখা (বুদ্ধির মুক্তি) আন্দোলন (১৯২৬), পূর্ব বাংলার মাতৃভাষা আন্দোলন (১৯৫২), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা (১৯৭১), উপমহাদেশের স্বাধীন চিন্তার জাগরণ, আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলার শ্বেতাঙ্গ-বিরোধী আপোষহীন সংগ্রাম, সর্বক্ষেত্রে স্পর্শ রেখে গেছে ‘বিদ্রোহী’-র ‘চির-উন্নত শির’। তারই অভিষেক হয়েছে কখনো মুখর বিপ্লবে, কখনো নীরব রক্তবীজের প্রতিশ্রুতিতে। ‘বিদ্রোহী’ শতবর্ষ স্পর্শ করল (১৯২১-২০২১)। নিরবধিকালে তার অনাগত অভ্যর্থনার জন্য প্রহর গোনা শুরু হোক।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।