হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্র যুগের পর রবীন্দ্র যুগ। সে এক যুগ সন্ধিক্ষণ। মুধুসূদন, দীনবন্ধু ও বঙ্কিমচন্দ্রের পর বাংলা ভাষায় এক কৃত্রিমতার যুগের আবির্ভাব ঘটে। হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র এই কৃত্রিম যুগের কবি। বিশ্বসাহিত্য আলােচনা করলে দেখতে পাই কাব্য-সমৃদ্ধ যুগের পরই আসে কৃত্রিমতার যুগ। ইংল্যান্ডের এলিজাবেথান যুগের পর এসেছিল পাে-ড্রাইডেনের কৃত্রিম যুগ। রােমান্টিক যুগের পর এসেছিল অর্ধ-কৃত্রিম ভিক্টোরিয়ান যুগ। ফ্রান্সেও Moliere, Corneille-র পর তেমন আর সাহিত্যিক দেখা দেয়নি। বহুদিন পরে আবার ভিক্টর হিউগাে, ডুমা প্রমুখ বিপুল প্রতিভাসম্পন্ন লেখক দেখা দেয়। স্পেনেও তাই Cervantes ও Lope De Vega-এর পর আসে অচল কৃত্রিমতার যুগ। সে যুগে Luis de Carrillo, Gongora Gomez প্রমুখ লেখকেরা তখনকার দিনে বেশ নাম করলেও এখন আর তাদের কোনাে সাহিত্য প্রতিষ্ঠা নেই। আমাদের বংলাসাহিত্যে বিহারীলালসহ অনেক কবি এক অভিনব সুর তুলে কাব্য মালঞ্চ ঝঙ্কৃত করে তুলেন। সেই যুগসন্ধিক্ষণের একজন কবি কামিনী রায়ও (১৮৬৪১৯৩৩)। এই যুগের প্রায় সব কবির কাব্য প্রতিভা রবীন্দ্র প্রভাবে অল্পবিস্তর চঞ্চল হয়েছে হয়নি শুধু কামিনী রায় এবং আর একজন কবির—তিনি স্বভাব কবি গােবিন্দচন্দ্র দাস। পাশ্চাত্য সাহিত্যের মতাে বাংলা সাহিত্যেও সে যুগে অনেক লেখক বেশ সুনাম করলেও এখন আর তাদের সাহিত্য সহজলভ্য নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ষােড়শ শতকের কবি চন্দ্রাবতী, অষ্টাদশ শতকের কবি রহিমুন্নেসার পরে উনিশ শতকে আমরা কামিনী রায়ের আগে উল্লেখযােগ্য নারী কবি হিসেবে পাই নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী (১৮৩৪-১৯০৩), স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২), করিমুন্নেসা খানম চৌধুরানী (১৮৫৫-১৯২৬), বেগম রােকেয়া সাখাওয়াৎ হােসেন (১৮৮০-১৯৩২) এবং মানকুমারী বসুকে (১৮৬৩-১৯৪৩)। কামিনী রায়ের সমকালীন আরেক কবি-অনুবাদকের নাম আজিজুন্নেসা খাতুন (১৮৬৪-১৯৪০)। এ তালিকা থেকে স্পষ্টতই ধারণা করা যায় যে, চন্দ্রাবতীর পরে প্রথম সার্থক কবির নাম কামিনী রায়।
কামিনী রায়ের অধিকাংশ কবিতা ভাবসম্পদে পূর্ণ। তাঁর কবিতায় বিশ্বসাহিত্যের অপূর্ব বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। বিষয় গৌরবের দিক দিয়ে তার কোনাে কোনাে কবিতা রবীন্দ্রনাথের পূর্বগামী বলে মনে হয়। এ প্রসঙ্গে যােগেন্দ্রনাথ গুপ্তকে লেখা কবির এক চিঠির উদ্ধৃত করা যেতে পার,
“আমার মনে হয় আমি কিছু অকালপক্ক ছিলাম। কতকগুলাে বিষয় আমি রবীন্দ্রনাথের পূর্বেই লিখিয়াছি। কিন্তু তিনি যখন লিখিয়াছেন অনেক সুন্দর করিয়া লিখিয়াছেন।”
একদিকে পুরনাে রীতি ভেঙ্গে যাচ্ছে, অন্যদিকে সৃষ্টি নব তরঙ্গের। এই সময়ে দাঁড়িয়ে কামিনী রায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে ততটা প্রভাবিত হননি যতটা হয়েছেন হেমচন্দ্র, বিহারীলাল ও মধুসূদন দ্বারা। আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও তার কবিতা পুরােপুরি আধুনিক নয়, আবার সেকেলে বলেও তার কবিতা পরিত্যাগ করা যাবে না। এ যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হয়েও কামিনী রায় তার কাব্যে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। তার কাব্যগুলি হল ‘আলাে ও ছায়া’ (১৮৮৯), নির্মাল্য (১৮৯১), পৌরাণিকী (১৮৯৭), গুঞ্জন (১৯০৫), অশােক-সঙ্গীত (১৯১৪), মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩), অম্বা (১৯১৫), ঠাকুরমার চিঠি (১৯২৪), দীপ ও ধূপ (১৯২৯), জীবনপথে (১৯৩০)। সনেট জাতীয় কবিতায়ও তাঁর দক্ষতা ছিল। এছাড়া গদ্যরচনায়ও তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
[২]
১৮৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কামিনী রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আলাে ও ছায়া’ প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের কবিতাগুলাে পাঠ করে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন,
“এ কবিতাগুলাে আমার বড়ই সুন্দর লাগিয়াছে, স্থানে স্থানে এমন মধুর ও গভীরভাবে পরিপূর্ণ যে পড়িতে পড়িতে হৃদয়মুগ্ধ হইয়া যায়। ফলত বাঙ্গালা ভাষায় এরূপ কবিতা আমি অল্প পাঠ করিয়াছি। কবিতাগুলাে আজকালের ছাঁচে ঢালা। বস্তুত কবিতাগুলাের ভাবের গভীরতা, ভাষার সরলতা, রুচির নির্মলতা এবং সবত্র হৃদয় গ্রহিতাগুণে আমি নিরতিশয় মােহিত হইয়াছি। পড়িতে পড়িতে গ্রন্থাকারকে মনে মনে কতই সাধুবাদ প্রদান করিয়াছি। আর, বলিতেইবা কি স্থলবিশেষ হিংসারও উদ্রেক হইয়াছে। …আমার প্রশংসাবাদ অত্যুক্তি হইল কিনা, সহৃদয় পাঠক-পাঠিকাগণ পুস্তকখানি একবার পাঠ করিলেই বুঝিতে পারিবেন। আমি কায়মনােবাক্যে আশীর্বাদ করি যে, এ নবীন কবি দীর্ঘজীবী হইয়া বঙ্গসাহিত্য সমাজের মুখােজ্জ্বল করুন।”
রবীন্দ্রনাথের আসন যখন বাংলায় পাকা হয়নি, ‘আলাে ও ছায়া’ তখন নতুন রস নতুন রুচি সৃষ্টি করেছিল। হেমচন্দ্র তাঁর কবিতায় আজকালের ছাঁচ ল্ক্ষ্য করেছিলেন। হেমচন্দ্রের যুগের কবিতায় একধরনের সরল সবলতা ছিল। সাহসী উচ্চারণের জন্য কামিনীকে কখনাে কখনাে আধুনিক মনে হয় কিন্তু তার উচ্চারণ দ্বিধাপীড়িত এবং বিচলিতও বটে। ব্যক্তিগত চিন্তার কবিতাতে তিনি সংবেদনের চেয়ে যুক্তিকে ভেবে ব্যথা পেয়েছিলেন। সাধারণ পীড়িত পরিত্যক্ত মানুষের জন্য সহানুভূতি তাঁর কবিতার একটি অসামান্য লক্ষণ।
কবি জীবনের সূচনাপর্বেই আলাে-অন্ধকারের ভাববিন্যাসে কামিনী রায় আত্মসচেতন। উনিশ শতকের শেষার্ধে জাতীয় জীবনে তখন প্রভাত চেতনার আলােই থাকার কথা, তখনাে দিনান্তের দীর্ঘ ছায়া অস্বীকার করা যায়নি। আলাে ঈশ্বর, আবার আলােই জীবন—আমরা যে আলােরই বহমান্তা সেই বােধও ধারণ করি। এ আলাে নক্রস্থির জীবন-ইতিবাচকতার প্রতীকী সত্য। আমাদের অনিঃশেষ আলােক যাত্রায় রােমান্টিক সংবেদনা বয়ে আনে কূটাভাস-
“আমরা তাে আলােকের শিশু
আলােকেতে কি অনন্ত মেলা!
আলােকেতে কি স্বপ্ন জাগরণ,
জীবন ও মরণের খেলা।”
বিশ্বাসের অতল গর্ভেসংগােপনে থাকে—বীজসত্যের মতাে-ব্যর্থতার দুঃসহ বেদনা। আলােক-ঈশ্বরের বিপরীতে আমাদের ব্যর্থতা কেবল আত্মসমর্পণের পিপাসা দিয়ে মুছে ফেলা যায় না। আমরা জানি আমরা অন্ধ, তবু আমরা আলােকেরই শিশু— ফিরে ফিরে আসি আলাের আকর্ষণে। দ্বৈতাদ্বৈত ও বিশিষ্টাদ্বৈতের পূর্বকথা কামিনী রায়ের ভাষায়-
“অসীম এ আলােক-সাগরে
ক্ষুদ্র দীপ নিভে যদি যায়,
নিবুক না কে বলিতে পারে
জ্বলিবে না সে পুনরায়?”
আমরা আশাপথে বাঁচি আমাদের ভবিষ্যতে। আবার জীবন নিয়ে আমাদের বিচিত্র জিজ্ঞাসা আছে—জিজ্ঞাসাই সৃষ্টি করে পথ। যেমন কামিনী রায়, তেমনই আমরা যেন চেষ্টা করি বিধাস আর জিজ্ঞাসার সমন্বয় করতে। আমরা অস্বীকার করতে পারছি না যুক্তি কিংবা বির্বাসকে আছে জীবনের সাথে মরণের খেলা। আবার আলােকের সন্ধানে আমরা অনেকে অন্ধের মতােই ঘুরে বেড়াই। এ আপাত উত্তরণহীন বাস্তবতা সৃষ্টি করে অসহায়তায় ও আত্মঘূর্ণন সম্ভবত উপনিবেশিত ভারতবর্ষে এ ক্রন্দন রােমান্টিক হিসেবে ভুলভাবে চিহ্নিত।
[৩]
বর্তমান যুগ নারী জাগরণের। বিভিন্নভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারী জাগরণের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। তবে কামিনী রায় যে সময় কাব্যচর্চা শুরু করেন সে সময় মেয়েরা ছিল অন্তঃপুরবাসিনী। গৃহস্থ কাজকর্মের মধ্য দিয়ে যেন তাদের জীবন অতিবাহিত হতাে। কিন্তু কামিনী রায় সে সময় অবস্থান করে অবলা নারীর সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্নার ও তাদের অধিকারের কথা নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন তার কাব্যে। বেগম রােকেয়ার মতাে কামিনী রায়ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, তাদের অধিকারের কথা নানাভাবে প্রচার করেছেন। কবিতাচর্চার পাশাপাশি কামিনী রায়ের জীবনের শেষ দিকে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখে নারীমুক্তির আকুতি প্রকাশ করেছেন। বার বার নারী নিগ্রহের সংবাদে সেদিন তিনি এভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন—
“হে বাক্য-বণিক ধিক্ শত ধিক্!
কি কর দেশের কাজ?
কাগজে কলমে, বক্তৃতায় গানে
দেশ-প্রেম তব মহা বন্যা আনে,
পাষণ্ডেরা যবে প্রবেশিয়া ঘরে।
স্বদেশী বধূরে অপমান করে,
তখন পাও না লাজ?
রমনীর মান—নারীর সন্তান,
এ কথা হৃদয়ে নাহি পায় স্থান?
গৃহের রমণী প্রেম-পূণ্য-খনি
সে কি রমণীয়া নয়?
হিন্দুর ধর্মের করিছ বড়াই,
হিন্দু সভ্যতার বল তুলা নাই
সতী অতুলনা ভারতের নারী
বলি গর্ব করি ছাড়ি অত্যাচারী
সে সতীরে শাস্তি দাও। …”
(নারী নিগ্রহ)
বাক্য-বণিকদের তিনি দুচোখে দেখতে পারতেন না। যারা কাগজে কলমে বক্তৃতায় কিংবা গানের মাধ্যে নারী নিগ্রহের প্রতীকার করতে চায় তাদের তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। লেখনী ও মসি দিয়ে প্রেয়সীকে বাঁচানাে যাবে না। তাদেরকে বাঁচাতে হলে বীর্য, অসি ও চরিত্রের তেজ চাই। এজন্য তাদের দিতে হবে জ্ঞানের আলাে দিতে হবে। ন্যায়বিচার, দেহপ্রাণ দৃঢ় করার সকল সুযােগ-সুবিধা। যাতে করে তারা চিরকাল যেন ভয়েই না মরে থাকে। নারী জাগরণে’ তাই তার মনে একটা উল্লাস জন্মেছিল এভাবে—
নারী-আত্মা এইবার জাগে,
প্রলয় আগুন বুঝি লাগে!
রেখেছিল যারে অন্ধকূপে,
জগদ্ধাত্রী জগন্মতা রূপে
দাঁড়াবে সে সন্তানের আগে,
এ বার নারী-আত্মা জাগে!
কঁদিবে কতই চুপে-চুপে
আপনার গৃহ অন্ধকূপে,
দীনা,হীনা,সর্বসত্ত্ব ত্যাগে?
আজ সে যে আপনারে মাগে।
দাসত্বের ভেঙে হাত কড়া
শাসনের ছিড়ে দড়িদড়া
ছুটিয়াছে মুক্তি-অনুরাগে
যজ্ঞের বেদির পুরােভাগে। ” (নারী-জাগরণ)
তার ‘নারীর দাবি’ কবিতায় নারীমুক্তির আকুতি প্রকাশ পেয়েছে এভাবে—
“নব শক্তি রথে জ্ঞান দীপ্ত পথে
তরুণ বাঙালি ভাই,
কে চলিছ আজ, উৎসাহে অধীর,
শত্রু দুর্নীতির, সত্য-যুদ্ধে বীর,
উদার হৃদয়, তােমাদের কাছে
দেশের নারীর দাবি যাহা আছে
আমি তাহা গেয়ে যাই —
তরুণ বাঙালি ভাই।
খুলিয়া শৃঙ্খল ভাঙিয়া পিঞ্জর,
শিখাও চলিতে ধরি তার কর
শুদ্ধি নাহি বাড়ে অন্ধ কারাগারে।
উন্মুক্ত বাতাসে আলােকমাঝারে
তাহারাে যে আছে ঠাই
বিধি ও স্বীয় ঠাই।…
জ্ঞানের আলােক, ন্যায়ের বিচার
মানবের জন্মগত অধিকার
তারে দিতে হবে ভাই।” (নারীর দাবি’)
এবার বুঝি নারী আত্মা জাগলাে। শাসনের দড়িদড়া, দাসত্বের হাতকড়া কিছুই তাহার গতিরােধ করতে পারলাে না। এ প্রসঙ্গে কামিনী রায়ের ‘ঠাকুরমার চিঠি’ কবিতাটি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। কবিতাটিতে তিনি নারীর কর্তব্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। ঠাকুরমা চেয়েছেন ফ্যাশনের বিষপানে মুগ্ধ না হয়ে নারী যেন দেখে, কি বিশাল কর্তব্য তার পড়ে রয়েছে। তার হাতে যে ছেলে মানুষ হবে, সে প্রকৃতই মানুষ হবে, নিজের বােনের নিষ্কলঙ্ক মুখ মনে করে অপরের বােনের গায়ে পঞ্চ দিতে সে সংকুচিত হবে। হাটেঘাটে জনপথে কাজকর্ম করলে ঘরে সে লক্ষ্মীহারা হবে। পারিবারিক বন্ধন যে শিথিল হবে। ঠাকুরমার এ কথার উত্তরে নাতিনীর জবাব নিম্নরূপ-
“বিনা পুত্র পতি।
ভাবিবার নাহি কিছু? নিজপুত্র হিতে
সহস্র পুত্রের কথা না হয় ভাবতে?
যে দেশ আমার দেশ, তাহার কল্যাণ
শুধু গৃহকোণে বসে যদি করি ধ্যান,
তাহাই যথেষ্ট হবে?
নবযুগের সূচনায় নারী বিভিন্ন দিক দিয়ে আত্মার বিকাশ চাইছেন, তাঁর দাবি-
“জায়া, মাতা হতে সবে পারি কি না পারি।
সর্বাগ্রে আমরা নারী, সর্বশেষে নারী।”
নাত-বৌ অন্য উত্তর দিয়েছেন— “আসল কথাটি এই—পুরুষ যা চায়/নারী তাই হতে পারে, তাই হয়ে যায়।”
কখনাে কখনাে তার কবিতায় পুরুষের ওপর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও লক্ষ্য করা যায়। তাঁর মতে পুরুষরাই নারীকে অবরূদ্ধ, অজ্ঞান ও দুর্বল করে রেখেছে। তাই তিনি পুষকে ধিক্কার দিয়েছেন। মানুষ হিসেবে নারীর কর্তব্য বুদ্ধির শুভউদ্বোধন গৃহকর্ম ও পারিবারিক কাজের মধ্য দিয়ে পুরুষের মনের অভাব দূর করাসহ নারীমুক্তির পথকে গতিশীল করার প্রয়াস চালিয়েছেন তার কবিতা-শিল্পে। কামিনী রায় তাঁর কবিতায় নারী আন্দোলনের বিভিন্ন দিক এভাবে তুলে ধরেছেন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে ব্যঙ্গ কৌতুক আর তীব্র শ্লেষের বাণে বিদ্ধ করেছেন কামিনী রায়। তাঁর গদ্যরচনাতেও আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলায় বিয়ের বাজারে বরের দাপটের কথা, জেনেছিলাম পণপ্রথার ভয়াবহতার কথা। কবিতাতেও তিনি বিষয়টিকে তীব্র ভাষায় ব্যঙ্গ করেছেন, তথাকথিত উচ্চশিথিত অথচ পণপ্রার্থী বরকে বরণ করেছেন এ শ্লেষের ফুলহারে—
“ওগাে আমার তিনটে পাশ, ওগাে আমার বি.এ.,
ওগাে আমার রক্তচক্ষু হরিৎ বরন টিয়ে,…
তােমায় ওরা সাধছে হাজার দশেক টাকা দিয়ে,
ওদের কন্যা উদ্ধার করবে খালি হাতে গিয়ে,
ওদের দেওয়া গােরা-বাজনা আলাের মিছিল নিয়ে,
ওগাে বিশ্ব-বিদ্যাজয়ী, বীর সিংহ বি.এ.
থাক বেঁচে জীয়ে।
ধরায় জন্ম পুরুষ হয়ে, লিখতে পড়তে শিখে
বিনা পয়সায় পুষবে কেন নিজের নারীটিকে?..
আদায় কর সােনা রূপা বস্ত্র অলংকার,
বাড়লে পাওনা হালকা হবে নূতন বধুর ভাব
বাপটি তােমার তীক্ষ্ণ চক্ষু, আনুন শানিয়ে
খুঁটে নিতে তাল, তিল, ওগাে সােনার টিয়ে,
তার যে ছেলের বিয়ে।” (বর-বরণের নূতন ছড়া)
কন্যার পিতার কাছ থেকে যা যা প্রয়ােজন সবই একে একে পণপ্রথার নামে আদায় করে নেয় বরপক্ষে। বরকে কিনতে হয়। পণ দিয়ে—এ অপমান পুরুষত্বের গায়ে লাগে না। উল্টে বিয়ের পর এম এ ডিগ্রি লাভের জন্য শ্বশুরের টাকার দিকে তাকিয়ে থাকে বর। এহেন পুরুষরাক্ষসের বিরুদ্ধে কামিনী রায় উচ্চারণ করেছেন তীর ব্যঙ্গাত্মক বচন –
“সে কালেতে কিনত লােকে দাসী ও গােলাম,
তােমরা চতুর বসে হাঁকবে পুরুষত্বের দাম।
এ নয় কেনা, এ নয় বেচা, এ যে, আহা বিয়ে,
তাজা মাছ ভাজা এ যে মাছের তেল দিয়ে!
এস আমার ননীগােপাল, থালখানি নিয়ে,
এস বিশ্ববিদ্যালয়ের তিলকধারী বি.এ.
হবে তােমার বিয়ে।
সুখে থাক ধনে-পুত্রে পুরুষ-রতন বি.এ.
থাক, থাক, জীয়ে।”
(‘বর-বরণের নূতন ছড়া’)
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মূলত লিঙ্গভিত্তিক সমাজ। কামিনী রায় শব্দের আয়ুধ দিয়ে এ লিঙ্গভিত্তিক সমাজকে আঘাত করতে চেয়েছেন। তিনি যখন কবিতা বা প্রবন্ধ লিখেছেন, বাঙালি সমাজে তখন জেন্ডার-সচেতনতা দেখা দেয়নি। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করতে হয়, কামিনী রায়ের কাছে শতবর্ষ পূর্বেই জেন্ডার প্রসঙ্গটি স্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছিল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বসবাস এবং শিক্ষা লাভ করেও নারীকে তিনি নারীর চোখ দিয়ে দেখেছেন, নারীর জন্য পুষের সমানাধিকার দাবি করেছেন।
[৪]
কবির স্বদেশ প্রেম— বর্ষার উচ্ছ্বসিত জলধারার মতাে প্রবাহিত। তাঁর ‘শুনে যা আমার আশার স্বপন কিংবা মা আমার’ কবিতা দুটি বিষয়-সম্বন্ধের চেতনায় বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে মা আমার কবিতাটি উদ্ধৃত করছি—
“যেই দিন ও চরণে ডালি দিনু এ জীবন,
হাসি অশ্রু সেই দিন করিয়াছি বিসর্জন।
হাসিবার কঁদিবার অবসর নাহি আর,
দুঃখিনী জন্মভূমি, মা আমার, মা আমার।
অনল পুষিতে চাহি আপনার হিয়া মাঝে,
আপনারে অপরেরে নিয়ােজিত তব কাজে
ছােটোখাটো সুখ-দুঃখ—কে হিসাব রাখে তার
তুমি যবে চাহ কাজ, মা আমার, মা আমার।
অতীতের কথা কহি বর্তমান যদি যায়,
সে কথাও কহিব না, হৃদয়ে জপিব তায়
গাহি যদি কোনাে গান, গাব তবে অনিবার,
মরিব তােমারি তরে, মা আমার, মা আমার।
মরিব তােমারি কাজে, বাঁচিব তােমারি তরে,
নহিলে বিষাদময় এ জীবন কেব ধরে?
যতদিন ঘুচিবে তােমার কলঙ্কভার,
থাক প্রাণ, যাক প্রাণ—মা আমার, মা আমার।”
উপেন্দ্রকিশাের রায় চৌধুরীর দেওয়া সুরে এ গান যিনি শুনেছেন, তিনি কখনাে বিস্মৃত হতে পারেননি এর গভীর আবেদন ও সন্মােহনী বার্তা। হয়তাে তার অনেক কবিতাতেই পাঠক হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অতুলপ্রসাদ সেন অথবা রবীন্দ্রনাথকে উপস্থিত থাকতে দেখবেন। কিন্তু যে আত্মমগ্ন সৌন্দর্য তিনি এখানে সৃষ্টি করেত সমর্থ হয়েছেন তার শিল্প-স্বভাব অবশ্যই স্বকীয়তায় স্বতন্ত্র। এ দেশ ভক্তি গভীর প্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ।
যােগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখেছেন,
“বিলাতে একটি ভদ্রলােক কামিনী রায়ের সহিত সাক্ষাৎ হইলে কথা প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন— ‘আপনার মা আমার, মা আমার’ গানটাই আমার জীবনের মূলমন্ত্র হইয়া আমাকে চালাইয়াছে। একদিন যে সংক্ষেপমন্ত্র কবির কবিতায় প্রথম প্রকাশ পাইয়াছিল সেই মন্ত্রগুলােই পরবর্তীকালে বির্বকবি রবীন্দ্রনাথের হাতে অপূর্ব সৌন্দর্য ও মাধুর্যমণ্ডিত হইয়া উচ্চ কবিতালােকে স্থান পাইয়াছে।”
‘মুক্তবন্দী’ কবিতাটি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও নেতাজী সুভাষ বসুকে কারাগারে দেখে রচিত—যেখানে শ্রদ্ধাবােধ কাজ করেছে নিজস্ব চিন্তা ও মতের বাইরে থেকে একাধিক ভূমিকায়। এটাকে ঘরের বাইরে এসে ঘর দেখার মতােই। যা মানুষের ঐকান্তিক প্রত্যাশাকে সমৃদ্ধ করেছে চেতনার উন্মুলে—
“লৌহদ্বার কারাগারে আজি অকস্মাৎ
মনে হয় ভবিষ্যের পেয়েছি সাক্ষাৎ
মনে হয় ভারতের ভাগ্য-লিপি-খানি
বিধাতার হস্ত হতে ক্ষুণতরে আনি
কে মােরে দেখায়ে গেল। এ কি দৃশ্য নব!
কল্পনা স্বপন সব মানে পরাভব।
…. …. ….
হে চিত্তরঞ্জন আজ, উদ্বেলিত চিতে
স্নেহ আর্শীবাদসহ আসিয়াছি দিতে
তােমারে আমার শ্রদ্ধা। মতে বা চিন্তায়
নাও যদি দিতে পারি পরিপূর্ণ সায়,
তবু তব হৃদয়ের মহত্ত্বের স্বাদ।
লভিয়াছি, অমৃত সে, করি ধন্যবাদ।
ভীতিহীন চিত্ত তব, বিত্ত তুচ্ছ করি
প্রীতি তব দারিদ্র্যেরে লইয়াছে বরি
কোনাে দিন ভােগে মুক্তি ভেবেছিলে মনে,
আজ তুমি ত্যাগে মুত্ত, বসি দেবাসনে।”
মাতৃভূমি সম্বন্ধে বিবিধ সাময়িক ঘটনার প্রতি লক্ষ্য করে তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। এছাড়া ‘যে দেশে আছিস তােরা’ কবিতায় সৌন্দর্যের সাথে নতুনের, নতুনের সাথে শিশুমন এবং আশার কথা ফুটিয়ে তুলেছেন গর্ব ও মুগ্ধচিত্তে –
“যে দেশে আছিস তােরা
সৌন্দর্যের শেষ নাই,
জরা সেথা শিশু-যৌবন।
পুরাতন নাহি সেথা,
নূতনের চিরলীলা,
জীবনের জনক মরণ।
সরিতে নূতন নীর,
ফুলবনে নব ফুল
ঘরে-ঘরে শিশুদের হাস,
মানবের হিয়া মাঝে,
উদিছে নূতন আশা
যেমন বরষ দিন মাস।”
আবার ‘দেশ-সেবকের প্রার্থনা’য় একান্ত চাওয়া-পাওয়া ও অতৃপ্তির ভাষা উঠে এসেছে অনেকটা মােনাজাতের ভঙ্গিতে। বাইকমে ও তারকেথরে সত্যাগ্রহ তার চিত্তকে বিচলিত করেছিল, আবার অসহযােগ প্রচারকের সত্যপথ হতে স্থলন দেখে তাকে তিরস্কার করতে ছাড়েননি, বলেছেন, একি করছ?
“বিদেশী দাসত্ব হতে উদ্ধারিত হায়
নূতন দাসত্ব রঞ্জু বাঁধিছ গলায়!”
(দীপ ও ধূপ)
দেশসেবককে বিপথে যেতে দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, বলেছেন,
দেশের কাজ করতে হলে সন্ন্যাসী চাই,
লােভীকে দিয়ে কাজ হবে না, কাজ করবে তারাই,
“দেশের মানুষে যারা ভালবাসে খাঁটি,
দেশ তাে মানুষ দিয়া, নহে দিয়া মাটি।”
(‘দীপ ও ধূপ’)
দেশের ভক্তি কিন্তু তাকে কখনও প্রেমের পথ হতে, শান্তির পথ হতে ভ্রষ্ট করেনি—
“নূতন যুগে প্রভাত নব।
আবার আমরা বাহির হব।
গেয়ে নূতন গান
দেশের সাথে মিলবে দেশ
কালের ঘুচবে কালাে বেশ
আলােয় করে ম্লান।”
(দীপ ও ধূপ)
পুনরায় বলেছেন—
“যুক্ত আছে সর্ব নর, দেশ দেশান্তরে,
যুক্ত আছে গত, বর্তমান
অন্ধ সে, যে এ বন্ধন
অস্বীকার করে,
আনে হিংসা, আনে অকল্যাণ।
স্বদেশীরে ভালবাসি, বিদেশীরে তাই
নাহি মাের অপ্রীতি, বিদ্বেষ
মানব সর্বত্র দুঃখী মানবের ভাই,
সর্বত্র দারিদ্র, পাপক্লেশ।” (দীপ ও ধূপ’)
কামিনী রায় বাংলা কবিতার সন্ধিযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী-কবি। ‘কবি’র পাশে ‘নারী’ কথাটি আজকাল আমরা কি বাদ দিতে পারছি? যদি পারি বা পেরে যাই তবে তিনি তার সময়ের নতুন ভাবনার অন্যতম একজন কবি ও কাব্যপ্রেমী। সাহিত্যমান ও শিল্পবিচার থেকে সাহিত্যগুণ ও নিবেদিত চিত্তের মুগ্ধতা নিশ্চয়ই কম নয়। যিনি বাঁধার ডিঙি শােকের ফিনকিতে বয়ে এনেছেন বহুদূর। সমাজ ও কাল বিবেচনায় তাঁর এ কীর্তি গৌরবের ও বিশেষ মর্যাদার। কামিনী রায়ের স্বদেশপ্রীতি একটু হলেও আমাদেরকে মুগ্ধ করে, প্রাণিত করে। এ মুগ্ধপ্রাণ আজ বড় বেশি প্রয়ােজন বাংলায়।
[৫]
কামিনী রায়ের কবিতায় গার্হস্থ্য বিষয়াবলী বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। জীবনগঠনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাপ্রসূত পরামর্শ ও উপদেশ তিনি বিতরণ করতে চেয়েছেন কবিতায়। বাংলাসাহিত্যের নীতিকবিতার ধারায় কামিনী রায় হয়ে উঠেছেন অনিবার্য নাম। তার প্রতিটি কবিতায় থাকে শিক্ষণীয় উপাদান। কিন্তু সেগুলাে যুক্তি কিংবা গদ্যের শাসনে উপস্থাপন না করে কবিতার পেলব ভাষায় প্রকাশ করেছেন। এর অবদান তাই দীর্ঘস্থায়ী, এবং কখনাে কখনাে চিরস্থায়ী।
‘পাছে লােকে কিছু বলে’ কবিতার মর্মবাণী বাঙালিমাত্রেরই অভিজ্ঞতার ফসল। পাছে লােকে কিছু বলার ভয়ে আমাদের সংকল্প স্থির থাকে না, সামনে অগ্রসর হতে পারি না, মহৎ উদ্দেশ্যেও একসাথে মিলিত হতে পারি না, ভয়ের কবলে আমাদের সকল শক্তিরই মৃত্যু ঘটে। এ শাৰত সত্য তিনি উদ্ধার করেছেন। এর মর্মকথা হল পাছে লােকে কিছু বলার ভয় এবং লজ্জা উপেক্ষা করতে পারলেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব। কবি চমৎকার ছন্দে ও অন্তমিলে বলেছেন—
“করিতে পারি না কাজ।
সাদা ভয়, সদা লাজ
সংশযে সংকল্প সদা টলে
— পাছে লােকে কিছু বলে।”
(পাছে লােকে কিছু বলে)
মানুষকে মহৎ কর্মে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য এ কবিতাটি হতে পারে উৎকৃষ্ট টনিক। আজকে যারা উন্নয়নে ‘অ্যাওয়ারনেস বিল্ডিং’-এর জন্য প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন, তারা এ কবিতাটিকেও ব্যবহার করতে পারেন। এ কবিতায় ব্যবহৃত দুটি চরণ প্রবাদের মতাে ব্যবহারযােগ্য—
“একটি স্নেহের কথা
প্রশমিতে পারে ব্যথা।”
(পাছে লােকে কিছু বলে)
কী চমৎকার অনুভূতি! স্নেহময় একটি কথাই কারাে মনের বেদনা ঘুচিয়ে দিতে পারে। স্নেহ এখানে আশ্রয়, অবলম্বন, সান্ত্বনা, ক্ষতস্থানের মলম। একই কবিতায় কবি বলেছেন, শক্তি মরে ভীতির কবলে। কী শক্তিশালী উচ্চারণ! মানুষকে ঘা মেরে জাগিয়ে তােলার মহামন্ত্র বিলিয়েছেন কবি কামিনী রায় এ কবিতার মাধ্যমে।
‘সুখ’ কবিতাটি কামিনী রায়ের অনুপম সৃষ্টি। দীর্ঘকবিতায় সুখ ও দুঃখের প্রকৃতি অনুসন্ধান করেছেন। সংসারনাট্যে যে সুখ ও দুঃখের দুই অঙ্ক সমানভাবে অভিনীত হয়, কবি বলতে চেয়েছেন। তবে কবি আশাবাদী যে, সংসার কেবলই বিষাদময় নয়, সুখের অস্তিত্বও সেখানে বিরাজমান। প্রর্ণের ভাষায় কবির উপলব্ধি-
“নাই কি রে সুখ! নাই কি রে সুখ?
এ ধরা কি শুধু বিষাদময়।
যাতনে জ্বলিয়া, কাদিয়া মরিতে
কেবলি কি নর জনম লয়?” – (‘সুখ’)
কবি বলেছেন, সুখ এ সংসারে আছে। কিন্তু তাকে পেতে সংসারক্ষেত্রেও যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধে যে জেতে, সে সুখ পায়। সংসারে সুখ পাওয়ার আরাে কিছু সূত্র তিনি আবিষ্কার করেছেন। একটি সূত্র মতে, পরের কারণে নিজ স্বার্থ বিসর্জন তাে বটেই, জীবন ও মন দান করলে সুখ পাওয়া যায়—
“পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ-জীবন মন সকলি দাও
তার মতাে সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।”
আরেকটি সূত্রে কবি বলেছেন যে, পরের কারণে যদি মৃত্যুও হয়, সেটিই সুখ। সুখ সুখ করে কাদলে কেবল হৃদয়ের ভার বৃদ্ধি পায়। তাই সুখের প্রত্যাশা না করে পরের মঙ্গলে জীবন উৎসর্গ করলে সুখ পাওয়া যায় —
“পরের কারণে মরণেও সুখ
‘সুখ’, ‘সুখ’ করি কেঁদ না আর,
যতই কঁদিবে, ততই ভাবিবে,
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।”
কবির জীবনােপলব্ধি এবং জীবনদর্শন ফুটে উঠেছে আরেকটি সূত্রে। ব্যাখ্যার আগে কবির বাণীময় চরণ দর্শন করা যেতে পারে –
“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী’ পরে।
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
এটি এমন এক দর্শন যা কেবল মনােজগতের সম্পদ নয়। একে সমাজ-উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে প্রয়ােগ করা হয়েছে। কামিনী রায়ের সমকালীন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পল্লী উন্নয়নের যে মডেল তৈরি করেছেন, তাতে সমবায়ের রীতিপদ্ধতি ছিল, সমিতি-গঠনের নিয়ম ছিল, কমিউনিটি স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল, সালিসপ্রথা ছিল, ঋণদান পদ্ধতি ছিল, ধর্মগােলা ছিল। রবীন্দ্রনাথের এই কর্মদর্শনের সাথে কবি কামিনী রায়ের চিন্তাদর্শনের মিল ছিল। আজকেরপল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের শ্লোগানেও সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ বাক্যবন্ধ ব্যবহৃত হতে পারে, কামিনী রায় যাকে সুখের মন্ত্র বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে প্রজাহিতৈষণা ভেবেছেন। আর দেশের এনজিওগুলােও উন্নয়নের লক্ষে পৌঁছতে একই বাণীর ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ ও কামিনী রায়ের স্বীকৃতি না থাকলেও সুখ-অন্বেষার এ পদ্ধতির প্রসার ঘটিয়েই ড. মুহাম্মদ ইউনুস ও গ্রামীণ ব্যাঙ্ক শান্তির জন্য নােবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক কাজ করে ব্যাঙ্কিং তথা অর্থনীতির সেক্টরে। কিন্তু ড.মুহাম্মদ ইউনুস নােবেল পুরস্কার পেলেন শান্তির জন্য। কামিনী রায় যাকে সুখ বলেছেন, তারই প্রতিশব্দ শান্তি। নােবেল কমিটি সেই শান্তির জন্যই নােবেল পুরস্কার দিল বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে। বাঙালির শান্তি-দর্শনের প্রথম সাহিত্যিক-প্রবক্তা ছিলেন কামিনী রায়, দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কার্যক্ষেত্রে তৃতীয় মুহাম্মদ ইউনূস। এমন একটি বাক্য রচনার জন্যই কামিনী রায় নােবেল পুরস্কার অর্জনের যােগ্য ছিলেন, তার স্বীকৃতি পাওয়া গেল ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নােবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। তবে নােবেল পাওয়া অনেক মানুষ ও তার কাজ হারিয়ে গেছে, কিন্তু কামিনী রায় এখনাে বেঁচে আছেন, এ তার যােগ্য পুরস্কার।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।