লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
সারা বিশ্ববাসীর কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, কিন্তু বাংলাদেশবাসীর কাছে আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ।
দু’বছর আগে ২০০৯-এ এ সময় ছিলাম ঢাকাতে। কয়েকদিন আগে থেকেই শহিদবেদির চারপাশে যান চলাচল বন্ধ করে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যাঁরা আসবেন তাদের জন্য বাঁশ বেঁধে-বেঁধে গোলকধাঁধার মতো ঘুরে ঘুরে পায়ে চলার পথ নির্দিষ্ট করার কাজ শুরু হয় আর আগের দিন দুপুর থেকেই, শুরু হয় শ্রদ্ধাবানদের জায়গা নেওয়ার ভিড়। অবশ্য আমাদের বয়সীদের জন্য হয়তো দূরদর্শনের সামনে জায়গা নেওয়াটাই সংগত। মাঝরাত্তিরে একুশে ফ্রেব্রুয়ারির সূচনালগ্নে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি এসে অনেক রঙের ফুল দিয়ে বিশাল আলপনা সাজানো শহিদবেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাদের পরে আর সকলে একে একে। একুশে ফেব্রুয়ারির সারা দিন সকালে বিকেলে সন্ধ্যে ধরে চলে শ্রদ্ধার্পণের পালা। এ আবেগের, এ দৃশ্যের এ পরম্পরার কোনও তুলনা নেই।
মন ফিরে চলে ফেলে আসা দিনগুলোর পথচিহ্নের খোঁজে। দু বছর ধরে বাংলার কৃষকদের ওপর হামলা চালিয়ে ১৯৫২-র ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে মুসলিম লিগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে তখনকার পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন হামলা চালান বাংলা ভাষার ওপরে, ঘোষণা করেন যে পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা উর্দু। এই ঘোষণাকে পূর্ববাংলার জনগণ একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। প্রতিবাদ জানায় স্ট্রাইক ডেকে। সর্বদলীয় সমিতি গঠিত হয় ৩১ জানুয়ারি, ঘোষিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি সমাবেশ ও হরতাল। সরকার একুশের মুখের ওপর চাপিয়ে দিল ১৪৪, ধারা। ছাত্র সমাজ অনড়, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মিছিলের ওপর চলল গুলি। শহিদ হলেন বরকতসালাম-রফিক-জব্বর। রক্তের অক্ষরে লেখা হল ইতিহাস।
তিন মাস পরে শান্তিনিকেতন থেকে অন্নদাশঙ্কর রায় এসেছেন দার্জিলিঙে। কথায় কথায় একুশে ফেব্রুয়ারির কথা উঠতেই উদ্দীপ্ত হয়ে বললেন, এই একুশে ফেব্রুয়ারির সুদূরপ্রসারী পরিণাম হবে। পরের বছর একুশে ফেব্রুয়ারির এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে তিনি সাহিত্যমেলার আয়োজন করেন। পূর্বপাকিস্তান থেকে এলেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, কাজী মোতাহার হোসেন, শামসুর রাহমান, কায়সুল প্রমুখ প্রবীণনবীন সাহিত্যিকদের একটি দল। এবং পশ্চিমবাংলা থেকে বুদ্ধদেব বসু, শচীন সেনগুপ্ত, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নরেশ গুহ প্রমুখ জনা বারো। ভাষা শহিদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পরে বিগত পাঁচ বছরে দুই বাংলার অখণ্ড বাংলাভাষা ও সাহিত্য কীভাবে কোথায় পৌঁছেছে তা পর্যালোচনার পাশাপাশি বাসন্তী জ্যোৎস্নায় আড্ডা গল্প, গান আর গান, আর হইহই। পূর্ববঙ্গের বাইরে সেই প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন।
পুরো বৃত্তান্তের শুরু ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে করাচিতে পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের ভাষা করার সিদ্ধান্তে। আড়াই মাস পরে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ববঙ্গের সাংসদ ধীরেন্দ্রনাথ দও ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব দেন। ১৯৪৮-এর ২১ মার্চ। | ঢাকায় এসে মোহম্মদ আলি জিন্নাহ বললেন, যাঁরা বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলেন তাঁরা পাকিস্তানের দুশমন। এর উত্তর দিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত ড. মোহম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯৪৮- এর ৩১ ডিসেম্বর পূর্বপাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে তিনি বললেন, “আমরা হিন্দু মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। … মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো’টি নেই।”
এই প্রবীণ-মুখ থেকে নির্গত ক্ষীণ ঘটনাস্রোত প্রবল-নবীনসম রূপ নিল একুশে ফেব্রুয়ারিতে। সমতলে নেমে এই স্রোত আরও প্রবল হয়ে পৌছল ১৯৭১-এর ২৬ মার্চে। বিক্ষুদ্ধ-তরঙ্গ-সংকুল মোহনার বিস্তার। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর উড়ল বাংলাদেশের বিজয় পতাকা। বাংলাদেশের রফিকুল ইসলাম প্রথম ১৯৯৮-এ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদককে অনুরোধ জানালেন। উত্তরে পেয়ে যান পথের নিশানা। তখন রফিকুল ও তার কানাডা প্রবাসী বন্ধু আবদুস সালাম মিলে প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে এক সমিতি গঠন করে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে দ্বারস্থ হলেন ইউনেসকোর। ফলে ১৯৯৯-এর ১৭ নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে। প্রথম আন্তর্জাতিক দিবস উদ্যাপিত হয় ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।