লিখেছেনঃ গোবিন্দ নিহালনী
উনিশ শতকের শেষ ভাগে পাশ্চাত্যে সিনেমার উদ্ভব হয়েছিল আমাদের দর্শনশক্তির বিশেষ একটা ক্ষমতা, পারসিটেন্স অব ভিশন বিষয়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে। ইউরােপ ও আমেরিকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতির দরুন এই কলাকৌশলগত আবিষ্কার কিছুদিনের মধ্যেই এক চিত্তাকর্ষক শিল্পমাধ্যমের রূপ পেল। সিনেমার বিকাশ হয়েছিল মূলত একটা চাক্ষুষ মাধ্যম বা দৃশ্যশিল্প রূপে। তাই আদি সিনেমার চিত্রগত নান্দনিকতার মূল উৎস ছিল ইউরােপিয়ান দৃশ্যশিল্পের ঐতিহ্য। চিত্রকলার রেনেসাঁসীয় ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল সিনেমার দৃশ্যগত পরিপ্রেক্ষিত, আলােকসম্পাত ও কম্পােজিশনের বিভিন্ন উপাদান। নির্বাক যুগের ছবিতে, বিশেষত যুবােপিআন ছবিতে, প্রভাব পড়েছিল এক্সপ্রেশনিস্ট আলােকচিত্র ও চিত্রকলায় সংঘটিত বিভিন্ন আঙ্গিকগত পরীক্ষা-নিরীক্ষারও।
ইউরােপে বিনােদনের মাধ্যম হিশেবে জন্মলাভ করার কয়েক বছরের মধ্যেই সিনেমার পদার্পণ ঘটল ভারতে। দর্শক হলে গিয়ে পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে সিনেমা দেখতে শুরু করল। যদিও ভারতের প্রারম্ভিক চলচ্চিত্রকাররা গল্পাংশ ও কাহিনী বাছতেন ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস ও লােকসাহিত্য থেকে, তবু এই সব ছবির কাহিনী-বর্ণ-রীতি এবং চিত্রগত প্রতিন্যাস ছিল ইউরােপ ও আমেরিকায় অনুসৃত রীতিনীতির অনুরূপ। এই প্রবণতার আডও, মােটের উপর, তেমন কোনাে পরিবর্তন হয়নি।
সারা পৃথিবী জুড়েই মুভি ফোটোগ্রাফির নান্দনিকতার ওপর প্রাযুক্তিক সমৃদ্ধির গভীর প্রভাব পড়েছে। ভারতও এর কোনাে ব্যতিক্রম নয়। উনিশ শতকের মধ্য ভাগ পর্যন্ত ভারতীয় চিত্রকলার। ঐতিহ্য ছিল মিনিয়েচার-এর ঐতিহ্য। এই চিত্রকলার শৈলী ছিল ঘাতহীন সমতল আলােকসম্পাত এবং সম্পূর্ণ-বাস্তববাদী-নয় এমন এক পরিপ্রেক্ষিত নির্ভর। কিন্তু য়ুরােপিয় ক্যামেরাম্যানরা, যাদের দৃশ্যচেতনা গড়ে উঠেছিল ভের্নিয়ে, গােয়া ও রেমব্রা-র মতাে শিল্পীদের শিল্পকর্ম থেকে, চিত্রপ্রতিমা গড়তেন আলাে-ছায়ার এবং ঔজ্জ্বল্য-তানৌজ্জ্বল্যের স্থানিক বিন্যাস ও বিভাজনের ভিত্তিতে।
আলােকচিত্রের ক্ষেত্রে কলাকৌশলগত নানান উন্নতির ফলে স্বাভাবিক আলােয় তােলা চিত্রপ্রতিমার দেখা মিলল, এমন চিত্রপ্রতিমা যা দেখতে ‘আসল’-এর মতাে। চলচ্চিত্রগ্রাহকরাও তাদের চিত্রপ্রতিমায় ‘বাস্তবতার’-সঙ্গে-সাদৃশ্যের এই ধারণা সঞ্চারিত করতে চাইলেন। যে-কাজে আলােকসম্পাত একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। যদিও বাস্তবতা সঞ্চারের এই চেষ্টা সহজে সফল হয়নি। বহু বছরের চেষ্টায় ফিল্ম নেগেটিভের দ্রুতি ও কণাময়তার ক্ষেত্রে যখন যথেষ্ট উন্নতি ঘটল একমাত্র তখনই চলচ্চিত্রপ্রতিমা বাস্তববাদী বা স্বাভাবিকবাদী হয়ে উঠল। কিন্তু তার আগে, বিশেষত আমেরিকায়, একটি চিত্তাকর্ষক ব্যাপার ঘটেছিল। ফিল্ম নেগেটিভের নিম্ন দ্রুতির দরুন ছবি তােলার জন্য অতি উজ্জ্বল ল্যাম্প ব্যবহার করার প্রয়ােজন হত, এই ল্যাম্পে ‘ফ্রেন্যাল লেন্স’ লাগানাে থাকত এবং সেটে ঘন গাঢ় ছায়া পড়ত। শাদা-কালাে ফিল্ম নেগেটিভের সংবেদনশীলতার ব্যাপক বৈচিত্র্যের জন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে বিশেষ এক ধরনের মেক-আপ ব্যবহার করতে হত। জোরালাে উজ্জ্বল আলাের উৎস এবং ভারী মেকআপ দুয়ে মিলে আলােকচিত্রিত প্রতিমায় অত্যন্ত কর্কশ একটা টেক্সচারের সৃষ্টি হত। দৃবৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞরা তখন ‘ডিফিউজার’ নামে কাচে-তৈরি একটা সরল যন্ত্রাংশ উপহার দিলেন। এটাকে লেন্সের সামনে ধরে ছবি ভােলা হত, যার ফলে ক্যামেরায় প্রবিষ্ট আলাের তেজ কমত এবং আলােকচিত্রিত প্রতিমাকে কোমল দেখাত। কমনীয়তার মান নির্ভর করত ব্যবহৃত ডিফিউশনের হারের উপর। এইভাবে মেক-আপের কর্কশতা ও ছায়ারেখার তীক্ষ্ণতা হ্রাস পেল, চলচ্চিত্রপ্রতিমায় এল এমন এক টেক্সচার যা শুধুই দৃষ্টিনন্দন নয়, গভীরভাবে গ্ল্যামারাসও।
হলিউডে আলােকসম্পাতের বিশেষ একটা রীতির প্রচলন হল, যা জোরালাে ব্যাক-লাইটিং ও ডিফিউজারের সম্মিলিত ব্যবহারের মধ্য দিয়ে গ্লামার ফোটোগ্রাফির এমন এক ধারার জন্ম দিল যেটি সারা পৃথিবী জুড়ে চলচ্চিত্রের ক্যামেরাম্যানদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
ফোটোগ্রাফির এই ধরনটি পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতীয় ক্যামেরাম্যানদের মধ্যেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। বস্তুত আজও কিছু কিছু পরিবর্তন-পরিমার্জন সহ এই রীতিই ভারতীয় সিনেমায় বজায় আছে। পঞ্চাশের ও যাটের দশকে ভারতে শাদা-কালাে সিনেমাটোগ্রাফির মান কেমন ছিল তার কিছু অনবদ্য উদাহরণ মেলে বিখ্যাত ভারতীয় ক্যামেরাম্যান ফারদুন ইরানি, ফলি মিস্ত্রি, জাল মিস্ত্রি, রাধু কর্মকার, ভি, কে, মূর্তি, আর, ডি, মাথুর, ভি, অবধূত, ভি, এন. রেড্ডি, ভি রাটরা, নরিমান ইরানি এবং জি. সিং-য়ের কাজে।
ক্যামেরাম্যানদের দার্শন সংবেদনশীলতার ক্ষেত্রে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ঘটে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে। যুদ্ধচিত্রের ক্যামেরাম্যানেরা সিনেমার পর্দায় নিয়ে এলেন কঠোর নিখাদ বাস্তবতা। যুদ্ধের বাস্তবতাকে তৎক্ষণাৎ সঠিক ও যথাযথ ভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে লাইটিং ও কম্পােজিশনের প্রথাগত নিয়মকানুন অবান্তর বােধ হল। পশ্চিমি চিত্রপরিচালকেরা অধিকাংশই ছিলেন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী এবং/অথবা যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতির ফলভােগকারী। সমসাময়িক কালচেতনাকে তুলে ধরার জন্য তারা প্রত্যক্ষ কঠোর নির্জলা প্রতিমার প্রয়ােজন বােধ করলেন। উন্নত কঁচা মাল (ফিল্ম স্টক) ও নানান সুযােগ-সুবিধা যুক্ত ক্যামেরায় সজ্জিত হয়ে ক্যামেরাম্যানরা এগিয়ে এলেন ওই চ্যালেঞ্জের মােকাবিলায়।
‘দ্য বাইসাইকেল থিভস’-এর মতাে ছবি ইউরােপে নিও-রিয়ালিজমের প্রবর্তন করল, এই আন্দোলন ভারতীয় চলচ্চিত্রকার ও চিত্রগ্রাহকদের চলচ্চিত্রশৈলী ও চিত্রশৈলীকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতীয় সিনেমায় চলচ্চিত্রপ্রতিমার নান্দনিকতার ক্ষেত্রে দুজন সিনেমাটোগ্রাফারের ভূমিকা অবিস্মরণীয়—এঁরা হলেন বম্বের ভি. কে. মূর্তি ও বাংলার সুব্রত মিত্র। দুজনেই পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে সিনেমার জগতে পদার্পণ করেন।
মূর্তি বাঙ্গালােরের এস. জে. পলিটেকনিক থেকে শিক্ষা লাভ করে ফলি মিস্ত্রি ও জাল মিস্ত্রির সহকারী রূপে কাজ করেন। ভারতে পঞ্চাশের হলিউড সিনেমাটোগ্রাফির সবচেয়ে সৃজনশীল প্রতিনিধি ছিলেন ফলি ও জাল। মূর্তি এরপর পরিচালক গুরু দত্তের সঙ্গে যুক্ত হন। গুরু দত্ত নিজেও তখন নতুন এক চলচ্চিত্রীয় প্রকাশভঙ্গির সন্ধানে ছিলেন। দুজনে মিলে এমন এক চিত্রশৈলীর সৃষ্টি করলেন যাতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকবাদী লাইটিংয়ের সঙ্গে মৌলিক ক্যামেরা মুভমেন্টের মিলন ঘটল। মূর্তির সিনেমাটোগ্রাফির সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ মেলে ‘প্যাসা’, ‘কাগজ কে ফুল’ এবং ‘সাহিব, বিবি আউর গুলাম’ ছবিতে। শাদা-কালােয় চিত্রিত এই তিনটি ছবি শেয়ােক্ত ছবিটি সিনেমাস্কোপে) ভারতীয় সিনেমায় শাদা-কালাে চলচ্চিত্র-প্রতিমার বিবর্তনের ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
মূর্তির কল্পমূর্তিগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অত্যন্ত নিখুঁত ফ্রেমিং এবং লাইটিংয়ে বৈষম্য ও বুনটের ক্ষেত্রে চমৎকার নিয়ন্ত্রণ। কাগজ কে ফুল ছবিতে তিনি দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাবার সময় চমৎকার কাব্যিক ট্র্যাজিশন বা রূপান্তর সৃষ্টি করেছিলেন। যা ছিল তার নিজস্ব পরিকল্পনা। কিছুটা শৈলীকৃত আলােকসম্পাত ও ক্যামেরা মুভমেন্টের মধ্য দিয়ে ওই ইফেক্ট সৃষ্টি হয়েছিল। ছবিটির নায়ক ছিল একজন চিত্রপরিচালক। ছবির অনেক দৃশ্য স্টুডিও ও ফিল্ম সেটে তােলা হয়েছিল। মূর্তির অনবদ্য শাদা-কালাে আলােকচিত্রণে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ভারতীয় ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির পরিবেশ ও পটভূমি তুলনারহিত ভাবে ফুটে উঠেছে। ছবিটি সেইদিক থেকে অদ্বিতীয়। তার ফোটোগ্রাফির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে চলচ্চিত্র-প্রতিমার ক্ষেত্রে ক্ল্যাসিকাল অ্যাপ্রােচের বদলে এক সদর্থক ও মৌলিক নতুনত্ব। মূর্তি পরবর্তী প্রজন্মের একসারি ক্যামেরাম্যানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন। আমি বহুবছর তাঁর সহকারী হিশেবে কাজ করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ভারতীয় সিনেমায় নব্য চিত্রপ্রতিমার আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক তিনি।
সিনেমাটোগ্রাফার হিশেবে সুব্রত মিত্রের কর্মজীবনের সূচনা হয় সত্যজিৎ রায়ের ছবি দিয়ে। ফিল্ম সােসাইটি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার এবং চলচ্চিত্র বিষয়ে ব্যাপক পড়াশুননা করার সুবাদে সমসাময়িক আন্তর্জাতিক সিনেমা সম্পর্কে সত্যজিৎ সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। বাংলার তৎকালীন জনপ্রিয় সিনেমার রীতিনীতি থেকে সত্যজিতের ফিল্ম-অ্যাপ্রােচ ছিল একেবারে মূলগতভাবে আলাদা। বিজ্ঞাপন সংস্থায় আর্ট ডিরেক্টরের কাজ করেছিলেন বলে তার দৃশ্যচেতনা ছিল খুবই পরিণত। এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি চিত্রনির্মাণে এলেন। সুব্রত-সত্যজিৎ-জুটি ভারতীয় সিনেমাটোগ্রাফির ক্ষেত্রে বিপ্লব এনে দিলেন। সত্যজিৎ যদিও হলিউডের কাহিনীবর্ণন রীতির দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন, নিজের ছবিতে তার বর্ণনারীতি হলিউডের চাইতে য়ুরােপিয় নিওরিয়ালিস্ট সিনেমার বেশি কাছাকাছি। তাঁর ছবির আঙ্গিকে সুব্রত মিত্রের শাদা-কালাে-আলােকচিত্র একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিশেবে কাজ করেছে। চলচ্চিত্র-প্রতিমায় বাস্তববাদের সবচেয়ে স্মরণীয় কিছু উদাহরণ মেলে পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার ও চারুলতার মতাে ছবিতে।
সুব্রত মিত্রের আলােকচিত্রণের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত স্বাভাবিকবাদী আলােকসম্পাত, অত্যন্ত সংবেদনশীল কম্পােজিশন ও খুবই সুষমামণ্ডিত ক্যামেরা মুভমেন্ট। তার চিত্রগ্রহণ পদ্ধতি য়ুরােপিয় ক্যামেরাম্যানদেরও অনুপ্রাণিত করেছে।
১৯৮০-৮১ সনে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়ম অব মডার্ন আর্টে অনেকগুলি ভারতীয় ছবি একসঙ্গে দেখানাে হয়েছিল। সেই সময় আমি নিউ ইয়র্ক গেছিলাম। সেখানে বিখ্যাত ক্য মরাম্যান নেস্টর অ্যালমেড্রস-এর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে বলেন, প্যারিসের ফিল্ম স্কুলে সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশুনাে করার সময় উনি চারুলতা ছবিটি দেখেন। ছবিটির চিত্রপ্রতিমার অতি উন্নত মান তাকে একেবারে বিমুগ্ধ করে দেয়। তাকে বিশেষ করে আবিষ্ট করেছিল সুব্রত এসেছিল গদারের ছবির চিত্রগ্রাহক রাউল কুতারের সিনেমাটোগ্রাফি এবং তৎকালীন চেকোশ্লোভাক ছবি থেকে। এই বৈশিষ্ট্যটি কয়েকটা বছর শুধু ইনস্টিটিউটের স্নাতক ক্যামেরাম্যানদের কাজে নয়, ইণ্ডাস্ট্রির কোনাে-কোনাে সিনেমাটোগ্রাফারের ছবিতেও প্রাধান্য বিস্তার করেছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নরম সুষম আলােয় তােলা এইসব প্রতিমা একঘেয়ে মনে হতে লাগল, যার মূল কারণ ক্যামেরাম্যানদের অভিজ্ঞতা ও মৌলিকতার অভাব।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে পশ্চিমি জগতে সিনেমা ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনচিত্রের এক ব্যাপক বিস্ফোরণ দেখা দিল। বিজ্ঞাপনচিত্রের মূল উপকরণগুলি হল চাকচিক্য, জাঁকজমক এবং নতুন ধরনের ক্যামেরা মুভমেন্ট, এক কথায় চিত্রপ্রতিমার মধ্যে প্রচণ্ড এক উত্তেজনার ভাব। প্রথম দিককার পণ্যপ্রতিমা কাহিনীচিত্রপ্রতিমাকে তাদের আদর্শ হিশেবে নিয়েছিল। শেষ সত্তর আর আশির দশকে প্রবণতাটা একেবারে উল্টে গেল। পণ্য প্রতিমা থেকে তরুণ চিত্রপরিচালক ও চিত্রগ্রাহকরা অনুপ্রেরণা পেতে লাগলেন, এঁদের অনেকেই বিজ্ঞাপন-জগতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন। ভারতেও তরুণ ক্যামেরাম্যানরা বিজ্ঞাপনচিত্রের কাজে খুবই সৃজনশীল ও আকর্ষণীয় অবদান রেখেছেন। আমি নিজে অসংখ্য বিজ্ঞাপনচিত্র ও তথ্যচিত্রে ক্যামেরা চালিয়েছি। সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই বিভাগে সর্বসেরা ক্যামেরাম্যানদের মধ্যে আছেন আর.এম.রাও, বরুণ মুখার্জী, চ্যাং, বিকাশ শিবরমন, কিরণ দেব হংস, মহেশ আর এবং রাজীব মেনন। সত্তরের দশকে অনেক তরুণ ভারতীয় ক্যামেরাম্যানের। চিত্রকর্মকে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করেছে যে-ছবির সিনেমাটোগ্রাফি ও ক্যামেরার কাজ তা হল। ফ্রান্সিস ফোর্ড কপােলা পরিচালিত হলিউডচিত্র দ্য গডফাদার। এই ছবিতে কপােলা নরম টপ লাইটিংয়ের যে-পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, তা সম্ভব করার জন্য সিনেমাটোগ্রাফার গর্ডন উইলিস, প্রথাগত চলচ্চিত্রীয় আলােকসম্পাত পদ্ধতি যে-সমস্ত নিয়মকান অনুসরণ করে চলে, তার অনেকগুলিকে অস্বীকার করেন। এর ফলে একটা দৃশ্যগত ‘ফিলিং’-এর সৃষ্টি হয়, সিনেমাটোগ্রাফির ইতিহাসে এই ইফেক্টটি একদিক থেকে অতুলনীয়।
ভারতে যে-দুই সিনেমাটোগ্রাফার এই শৈলীর অন্তর্গত উপাদানকে ওঁদেব চিত্রকর্মে ব্যবহার করে কিছু অনবদ্য চলচ্চিত্র-প্রতিমার সৃষ্টি করেন তারা হলেন পি.সি. শ্রীরাম ও সন্তোষ শিবন। শ্রীরাম চিত্রিত নয়াকন ও শিবন-চিত্রিত রােজা সমসামযিক ভারতীয় সিনেমায় সিনেমাটোগ্রাফির দুটি মাইলস্টোন।
ইউরােপের আর যে ক্যামেরাম্যান তরুণ ভারতীয় ক্যামেরাম্যানদের কল্পনাশক্তিকে উদ্দীপিত করেছেন তিনি হলেন স্বেন নিভিষ্ট। ইঙ্গমার বার্গম্যানের ছবিতে তার সিনেমাটোগ্রাফি বস্তুত সমস্ত পৃথিবী জুড়েই তরুণ ক্যামেরাম্যানদের গভীর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
চিত্রগ্রাহক প্রধানত চিত্রপরিচালকের চক্ষু হিশেবে কাজ করেন। কোনাে ছবির পরিচালকের পক্ষে এটা খুব জরুরি যে তার যেমন খুব স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট দৃশ্যচেতনা ও দৃশ্যশৈলী থাকবে, তেমনি ছবির দৃশ্যগত ঐক্য অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি ক্যামেরাম্যানকে ক্রমাগত উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবেন। চিত্রপরিচালক ও চিত্রগ্রাহকের ছবির স্থানচেতনা নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার আগ্রহও থাকা দরকার। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চিত্রপরিচালক ও চিত্রগ্রাহকের মধ্যে মনােগ্রাহী সৃজনশীল সমন্বয়ের বহু উদাহরণ মেলে। তার মধ্যে আইজেনস্টাইন-এডওয়র্ড টিশে, অরসন ওয়েলস-গ্রেগ টোলা, বার্গম্যান-নিভিষ্ট, কপােলা-উইলিস, গদার কুতার প্রভৃতি জুটি হল সর্বাগ্রে উল্লেখ্য।
ভারতে অনুরূপ উল্লেখযােগ্য জুটির মধ্যে আছে গুরু দত্ত-ভি. কে. মূর্তি, বিমল রায়-দিলীপ বােস, রাজ কাপুর-রাধু কর্মকার, সত্যজিৎ রায়-সুব্রত মিত্র, মৃণাল সেন-কে. কে. মহাজন, শ্যাম বেনেগল-গােবিন্দ নিহালনী এবং বিনােদ চোপরা-বিনােদ প্রধান জুটি।
শ্যাম বেনেগল হলেন এমন একজন পরিচালক যার সঙ্গে কাজ করার স্বপ্ন সমস্ত ক্যামেরাম্যানই দেখবেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দৃশ্যশিল্পের বিভিন্ন আন্দোলন সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ও সচেতন তিনি। তার প্রতিটি ছবির মধ্য দিয়েই একটা অত্যন্ত স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট দার্শন ব্যক্তিত্ব বেরিয়ে আসে। তার বারােটির অধিক কাহিনীচিত্রে এবং বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্রে ক্যামেরা চালাবার সুযােগ আমার ঘটেছে। প্রতিটি ছবির জন্যই স্বতন্ত্র ও নির্দিষ্ট একটা দৃশ্যশৈলী তৈরির চেষ্টা আমরা করেছি। দুজনের নিখুঁত যােগাযােগের মধ্য থেকেই সৃষ্ট হয়েছে অঙ্কুর, নিশান্ত, ভূমিকা, কলযুগ, কোভুরা এবং জুনুন-এর মতাে ছবির চিত্রপ্রতিমাগুলি। যেমন ভূমিকা ছবিটি ভারতীয় সিনেমার তিনটি পর্বকে তুলে ধরেছে। যার মধ্যে নির্বাক যুগটিও আছে। আমরা পুনের ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভে গিয়ে নির্বাক যুগের এবং চল্লিশ ও পঞ্চাশ-এর দশকের বিভিন্ন ছবির আলােকসম্পাত রীতি অনুশীলন করি। আমরা ছবিতে বিভিন্ন পর্বের বিভিন্নতা প্রকাশ করেছিলাম বিভিন্ন মাত্রা ও বৈষম্যের ফিল্ম নেগেটিভ ব্যবহার করে।
সাম্প্রতিক জনপ্রিয় ভারতীয় সিনেমায় যে দৃশ্যশৈলীর সাধারণত দেখা মেলে তা হল অত্যন্ত চাকচিক্যময় বা শৈলীকৃত বাস্তববাদ। আশির দশকের শুরু থেকে নতুন একদল ক্যামেরাম্যানের দেখা মিলল যারা ছবির দৃশ্যাভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে সিনেমাটোগ্রাফারের সুনির্দিষ্ট অবদান সম্পর্কে মৌলিক ভাবে সচেতন। এই নতুন দৃশ্যচেতনা প্রতিফলিত হয়েছে যেসব বিখ্যাত ক্যামেরাম্যানের চিত্রকর্মে তারা হলেন সন্তোষ শিবন, পি. সি. শ্রীরাম, অশােক মেহতা, বিনোেদ প্রধান, মধু আমবট, রাজীব মেনন, ইউ. বি. রাও, বাবা আজমী, ফ্রান্সিস জেভিয়ার, প্রমুখ।
জনপ্রিয় সিনেমার পাশাপাশি ভারতে আছে সমান্তরাল সিনেমা নামে পরিচিত সংখ্যালঘু পরীক্ষামূলক সিরিয়স আঞ্চলিক চলচ্চিত্রও। বিষয় ও আঙ্গিকের দিক দিয়ে নিরীক্ষামূলক এইসব ছবির গুরুত্ব এইখানে যে, বিনােদনমূলক ঘরানার প্রলােভন ও চাপ এরা অস্বীকার করার চেষ্টা করে। বাণিজ্যিক সিনেমার বিপরীতে এই সমস্ত ছবি কাহিনীবর্ণনের বিভিন্ন রীতি অনুসরণ করে এবং তার ফলে ক্যামেরাম্যানদের কাছ থেকেও বিভিন্ন ও বিবিধ দৃশ্যশৈলী ও দৃশ্যগত প্রতিন্যাস দাবি করে। কে. কে. মহাজন, এ. কে. বীর, বেণু, কুমার, শাজী করুন, জাহাঙ্গীর চৌধুরী, বীরেন্দ্র সাইনি, পীযূষ শাহ ও অনুপ জোতওয়ানি-র চিত্রকর্মে ধরা পড়েছে সম্পূর্ণ নিরলংকার চিত্রপ্রতিমা থেকে অত্যন্ত সংরক্ত চিত্রপ্রতিমা পর্যন্ত প্রতিমার বিবিধ বৈচিত্র্য।
প্রযুক্তির ক্রমাগত সমৃদ্ধির ফলে, ভারতীয় সিনেমায় সিনেমাটোগ্রাফারদের সামনে আজ এই চ্যালেঞ্জ উপস্থিত যে চলচ্চিত্র মাধ্যমের নতুন নতুন সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত করে তারা চলচ্চিত্রপ্রতিমার অপার রহস্য ও গভীর কাব্যগুণকে সিনেমার পর্দায় সৃজনশীল ভাবে তুলে ধরতে পারবেন তাে!
স্বীকৃতি : দীনেশ লখনপাল
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।