লিখেছেনঃ সােমেন ঘােষ
চলচ্চিত্রের নন্দনতাত্ত্বিক আন্দ্রে বাজা তার সাড়া জাগানাে গ্রন্থে বলেছিলেন “All the arts depend on the presence of man; only photography lets us delight in his absence”১ চলচ্চিত্র যা কিনা যন্ত্রের মাধ্যমে আলােকচিত্রের প্রকৃতির স্বীকরণ ও প্রসারণ ঘটিয়ে সময়ের প্রতিভাস গড়ে তােলে, তার নান্দনিক আবেদনের শিকড়টিও নিহিত ঐ একই উৎসে বাস্তবের প্রকাশ।
অপর বিখ্যাত চলচ্চিত্রবিদ সিনেমার আলােকচিত্র সম্পর্কে বলেছিলেন “Film is essentially an extension of photography and therefore shares with this medium a mark of affinity for the visible world around us.”২ আমাদের চারপাশের বস্তুবিশ্বের ফোটোগ্রাফিক প্রতিফলন সিনেমার মূল বাসনা হলেও এই প্রতিফলনের ভঙ্গি ও অভিপ্রায় থেকেই বিশ্বের নানা দেশের চলচ্চিত্রের রূপ ও নন্দন স্ব স্ব রীতিতে বিবর্তিত হয়েছে। চলচ্চিত্র মাধ্যমের জন্মের পরবর্তী প্রথম পনের বিশ বছর সিনেমার নির্মাণপদ্ধতির প্রাথমিক পর্যায়গুলাে সমধর্মী ছিল। পরে ক্যামেরা ও তার আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের নিত্যনােতুন আবিষ্কারের ফলে চলচ্চিত্রের ক্যামেরা, তার প্রয়ােগ পদ্ধতি, নিয়ন্ত্রণ ও স্রষ্টার দৃষ্টিভঙ্গির অভিনবত্বে সিনেমার ক্যামেরা সঞ্চালন রূপে স্বতন্ত্রভাবে শিল্পরূপ নিল। তখন ফোটোগ্রাফি কেবল বস্তুবিশ্বের হুবহু প্রতিফলনেই সীমাবদ্ধ রইল না, তা স্রষ্টার অন্তর্মুখী ভাবনার অভিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করল। তখন থেকেই সিনে-ফোটোগ্রাফির স্বতন্ত্র চরিত্র গড়ে উঠল।
আর একটু এগিয়ে তাত্ত্বিক বাজাঁ ক্যামেরার মৌল উপকরণের ব্যাখ্যা করে সিনেমার প্রাণের সন্ধান দিলেন—
“Only the impartiality of the lens can clear the object of habit and prejudice, of all mental fog with which our perception blurs it, and present it afresh for our attention ano thereby for our affection. In a photograph, the natural image of a world we do not know how to see, nature finally imitates not just art, but the artist himself.”৩
ফরাসী সমালােচক লুই ডেলুক বলেছিলেন ‘Cinema is the painting in motion.’ পাশাপাশি বিখ্যাত চলচ্চিত্ৰষ্টা আবেল গাঁসের দৃষ্টিতে ‘Cinema is the music of light.’ আসলে এ মাধ্যমটির জন্মলগ্ন থেকেই ক্যামেরার মৌলিক চরিত্র, তার প্রয়ােগ পরিকল্পনা এবং সর্বোপরি স্রষ্টার মানসিকতা ঘিরে চলচ্চিত্রের ক্যামেরার নন্দনতত্ত্ব কাল থেকে কালে নােতুন চেহারা নিয়েছে।
মনে রাখতে হবে, সিনেমার আদিতে ক্যামেরার নানা ধরনের লেন্স ছিল না, স্বাভাবিকভাবে যে গুটিকয়েক লেন্স প্রাপ্তিসাধ্য ছিল, তাদের গভীর ডেপথ অফ ফোকাসের জন্য সম্পাদনার ক্ষেত্রে মানিয়ে গিয়েছিল কিংবা বলা যেতে পারে ন্যুনতম সম্পাদনা উপযােগী ছিল। সেকালের ছবিগুলাে দেখলেই বিষয়টি বােঝা যায়। ধীরে ধীরে আলােকবিজ্ঞান তথা লেন্সগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পাদনা পদ্ধতির যেমন ঐতিহাসিক বিবর্তন ঘটে তেমনি এর কার্যকারণ ও প্রভাবও চলচ্চিত্রের শিল্পশরীরে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হতে শুরু করে।
সিনেমার ক্যামেরার চরিত্র ও মৌল উদ্দেশ্য সম্পর্কে চমৎকার মন্তব্য করেছেন সমালােচক,
“Since the camera has no brain, it has the vision but not perception. It is the film maker’s task to restore selectivity of the cinematic eye. In this process he may control our perception so that his vision and emphases dominate our response to the created world.”৪
চলচ্চিত্র যেহেতু প্রাথমিক শর্তে একটি দৃশ্যগ্রাহ্য শিল্প তাই দৃশ্যের স্থান কাল ও বস্তুর প্রতিভাস সম্পর্কিত চেতনা ও ব্যবহারগত পরীক্ষা নিরীক্ষাই এই মাধ্যমের শিল্পসম্ভাবনাকে বিভিন্ন যুগে প্রসারিত করে দিয়েছে। সিনেমায় শব্দ যুক্ত হবার আগে পর্যন্ত কেবল দৃশ্যশিল্পের অনুষঙ্গে চলচ্চিত্র দর্শকের চিত্তবিনােদন করেছে। যদিও সেই আদিতে নির্বাক ছবি প্রদর্শনের অনেক সময়ে ছবি চলাকালীন যন্ত্রশিল্পীরা পর্দায় প্রতিফলিত দৃশ্যসজ্জার অনুকূলে শব্দ সঙ্গীত গড়ে তুলতেন বাস্তব অনুভূতির আবেদন দিতে। সেইদিনই বােঝা গিয়েছিল যে নির্বাক চলচ্চিত্র সবাক হবে একদিন। সিনেমার নিজস্ব তাগিদেই চলচ্চিত্রে শব্দযােজনা, পুনর্যোজনা, স্থানিক শব্দ ও কৃত্রিমভাবে তৈরি শব্দ ও নেপথ্য সংগীত যুক্ত হয়ে আধুনিক সিনেমার শিল্পশরীর পুষ্ট হয়েছে। প্রত্যেকটি দৃশ্যশিল্পের দুটি উৎস। তার একদিকে রয়েছে বস্তুবিশ্বের প্রতিফলন ঘটানাের ইচ্ছা, অপরটি হল দৃশ্যকল্পকে সুন্দর ও সুশােভিত করা। চলচ্চিত্র মাধ্যম প্রকৃতির সঙ্গে তার সাদৃশ্যের সাহায্যে প্রথম ইচ্ছা পূরণ করেছিল। তাই চলচ্চিত্রকারের আবিষ্কার প্রকৃতিগত সাদৃশ্যের ক্ষমতায় দর্শককুলকে বিমূঢ় করেছিল। প্রথমদিকে চলচ্চিত্র নির্মাতার ক্ষমতা কেবল প্রতিকৃত বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ক্রমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতারা এই মাধ্যমের যান্ত্রিক ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করার পরবর্তী পর্যায়ে, একে নানা শৈল্পিক দৃশ্য ও ভাবগত ব্যঞ্জনার সমন্বয়ে তাঁদের স্বকীয় শিল্পচিন্তার অনুকুলে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের প্রকরণ কৌশলের ক্রমবিবর্তনই এই মাধ্যমের প্রযুক্তিবিদ্যার নােতুন নােতুন দিক খুলে দিয়েছে। আর সেই সংস্থান থেকেই বিভিন্ন স্রষ্টারা এর শরীর সত্তা নিয়ে নিজেদের মতাে ভাবনা চিন্তা করেছেন, যার প্রথম ও প্রধান হাতিয়ারই হ’ল ক্যামেরা। বেলা বালাজ তাই সঙ্গত কারণেই বলেছিলেন—
“Technique is the most fertile source of inspiration; the muse is the camera.”
যান্ত্রিক প্রয়ােগ পদ্ধতির ক্ষেত্রে চিত্রগ্রহণের রীতিও বিবর্তিত হয়েছে আশ্চর্যভাবে। সিনেমার আদিযুগে চলচ্চিত্রের ক্যামেরা ছিল অনেকাংশে অনড়, স্থানু একটা অস্বস্তিকর ভারী যন্ত্রবিশেষ, একে স্বচ্ছন্দভাবে নানা স্থানে বিচরণ করানাে প্রায় দুরূহ ছিল। ফলে তখনকার ক্যামেরার গতিময়তা একেবারেই ছিল না। সেটা ছিল সিনেমার ‘ফোটোগ্রাফ’ থিয়েটার পর্ব। আরভিং পিচেল ক্যামেরার দিব্যদৃষ্টির কথা বলেছিলেন। চলচ্চিত্র হ’ল গতির শিল্প। এই গতি ক্যামেরায় গৃহীত বস্তুবিশ্বের বাস্তব অধ্যাস পর্দায় গড়ে তুলতে পারে। চলচ্চিত্রের উন্নতির ধাপে ধাপে এই গতির নানা রূপান্তর ঘটতে শুরু করে; যেমন সংক্ষিপ্ত গতি, অর্থাৎ লঙ থেকে মিডিয়াম এবং তারপরে আরাে কাছে–ক্লোজ শট; আবার কোনাে বিশেষ চরিত্র বা বস্তুর সংস্থান থেকে অন্য কোনাে ব্যক্তি বা বস্তুতে কিংবা দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ছবির দৃষ্টিকোণ (Point of view) সরিয়ে নেওয়া। ক্যামেরা মূলতঃ একটা চোখ। অণুবীক্ষণ বা দুরবীণ যন্ত্রের মতাে তা মানুষের দৃষ্টির পরিধিকে বাড়িয়ে দেয়। এ চোখের ব্যবহার বিশেষ উদ্দেশ্যে এবং বিশেষ ভাবে ঘটে।
সিনেমায় ক্যামেরার নান্দনিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যার আগে প্রাসঙ্গিকভাবে প্রথম যুগের ও পরবর্তীকালের কয়েকটি বিখ্যাত ক্যামেরার কথা বলা যেতে পারে যেগুলি সারা বিশ্ব চলচ্চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। ১৯২৩ সালে ইষ্টম্যান কোডাক কোম্পানি ১৬ মিলিমিটারের ক্যামেরা বাজারে ছেড়েছিলেন। বেল ও হাওয়েল কোম্পানির উদ্যোগে বেরুল ‘ফিল্ম’ ক্যামেরা। এরই অনুষঙ্গে বেরুল ইয়ামাে ক্যামেরা। খুব অল্প সময়ে ইয়ামাে ক্যামেরা জনপ্রিয় হয়ে উঠল। যুদ্ধক্ষেত্রে শু্যটিংয়ের জন্য এটা অপরিহার্য হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। ইয়ােরিস ইভান্স গৃহযুদ্ধের ওপর তার বিখ্যাত Spanish Earth তােলেন এই ক্যামেরা দিয়ে। এই শতকের প্রথম পঁচিশ বছর সিনেমার আলােকচিত্রীদের যন্ত্র উপযােগিতা দেবার জন্য ফ্রান্সের দুটি প্রতিষ্ঠানের অবদান অনেকটা। প্রথমটা হ’ল এক্লেয়ার ক্যামেরা। ১৯২৮ সালে ‘এল’ মডেল ‘ডেবার পারভে ক্যামেরা জনপ্রিয় হয়। ফরাসীদের আবিষ্কার স্বরূপ ‘পারভাে’ বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আমেরিকা ছাড়াও ইওরােপের নানা দেশে, জাপান ও দক্ষিণ আমেরিকার চলচ্চিত্র নির্মাণে এই ক্যামেরা বহুল ব্যবহৃত হয়। চলচ্চিত্রের বিশ্ববরেণ্য স্রষ্টা রাশিয়ার আচার্য আইজেনস্টাইন তাঁর প্রধানতম ছবিগুলাে তুলেছিলেন এই ক্যামেরাতেই। ইটালীয়ান পরিচালকেরা তাঁদের বিখ্যাত ছবিগুলাের চিত্রায়ণে এই ক্যামেরার কুশলতাকে দক্ষতার সঙ্গে প্রয়ােগ করেছিলেন। আজও সমানভাবে ছবির টাইটেল দৃশ্যায়ণে এবং ট্রিক ফোটোগ্রাফির জন্য এই ক্যামেরার ব্যবহার হচ্ছে। এর পাশাপাশি পারভে ইওরােপীয় ফিল্ম প্রতিষ্ঠানগুলােকে এই ধরনের ক্যামেরা উদ্ভাবনে উৎসাহ দিয়েছিল। ফলস্বরূপ ইটালীতে ‘প্রিভেস্ট ক্যামেরা, জার্মানীতে এনারমেন ক্যামেরা’র আগমন ঘটে।
একটা ক্যামেরা তৈরি হয়ে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, কয়েকবছরের মধ্যেই আবার একটা নতুন ক্যামেরা নবসংস্করণে হাজির হচ্ছে। কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রয়ােগবিদরা সিনে-ক্যামেরার আরাে স্বচ্ছন্দ গতিভঙ্গির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকছেন। মিচেল ক্যামেরা যখন তৈরি হ’ল তখন চলচ্চিত্র নির্মাণের আধুনিকীকরণ ঘটলাে আর এক বিন্যাসে। যদিও এই ক্যামেরার প্রথম প্রচলন ঘটে ১৯২২-২৩ নাগাদ। কিন্তু এতে আরাে কিছু সংস্কার ঘটিয়ে ১৯৩৪ সালে এর ‘বি.এন.সি মডেল’ বেরুল। এতে ক্যামেরা চলাকালীন অবাঞ্ছিত শব্দ বন্ধ করার সমস্ত ব্যবস্থা ছিল। এরপরে মিচেল কোম্পানি আর একটি ৩৫ মি. মিটার মডেল বার করে। এতে অনেক আধুনিকীকরণ। ঘটেছিল যা এর ব্যবহারিক দিকটাকে আরাে সহজ ও স্বচ্ছন্দ করে দেয়। ডকুমেন্টারী অর্থাৎ প্রামাণিক চিত্র নির্মাণে ‘নিউম্যান সিনক্লেয়ার অটোজাইন’ ক্যামেরা অসীম গুরুত্ব পেল। বেসিল রাইট এবং ফ্লাহাটি তাদের দুটি অনবদ্য ছবি ‘সঙ অফ সিলােন’ (১৯৩৫) আর ম্যান অফ আরান’ (১৯৩৩) নির্মাণ করেন এই ক্যামেরায়। সেদিনই এই ক্যামেরা প্রযুক্তিগত কুশলতায় তথ্যচিত্র নির্মাণে একটা রীতির জন্ম দিয়েছিল। পরবর্তীকালে ব্রিটেনের তথ্যচিত্র নির্মাতারা এই ক্যামেরাকে তাদের কাজে লাগিয়েছিলেন।
জার্মানী বহুদিন ধরেই ক্যামেরা তৈরির কেন্দ্রভূমি ছিল। ১৯৩৩ সালে জার্মানী একটা আধুনিক ক্যামেরা তৈরি করে এ্যারিফ্লেক্স’ নামে। স্মরণ রাখা যেতে পারে যে ১৯৪৫ সালে হলিউডে এই ক্যামেরার সাহায্যে প্রথম কাহিনীচিত্র তৈরি হয়েছিল। ১৯৪৮-এ তৈরি ফ্লার্টির অনবদ্য ছবি ‘লুসিয়ানা স্টোরী’ তৈরি হয় এই ক্যামেরাতেই।
সে সময়ে ফ্রান্সও ক্যামেরা নির্মাণে পিছিয়ে থাকে নি। চলচ্চিত্রে শব্দ আসার আগে এক্লেয়ার কোম্পানি একটা ক্যামেরা বের করেছিল ক্যামেরা এক্লেয়ার নাম দিয়ে। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় মহাসমরের সময় জার্মান অধিকৃত প্যারিসে গােপনে একটা নতুন মডেল তৈরি করতে শুরু করে এক্লেয়ার কোম্পানি। এর দুই ইঞ্জিনীয়ার আন্দ্রে কোটেন্ট এবং চার্লস মেনটর-এর অবদানে নােতুন মডেলের ক্যামেরায় যুগান্ত সৃষ্টি হ’ল। ১৯৪৮-এ বেরুল এক নােতুন মডেল ক্যামেফ্লেক্স’। এই ক্যামেরাতে প্রায় কুড়ি রকমের যন্ত্রপাতি বদলানাে হয়েছিল যা অন্যান্য ক্যামেরার পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এর অগ্রগণ্যতা প্রতিষ্ঠা করলাে। অ্যারিফ্লেক্সের পাশাপাশি এই ক্যামেরা অতি উচ্চমানের ক্যামেরা। কিছুদিন পরে এর আর একটা মডেল বেরুল যাতে ১৬ এবং ৩৫ মি. মিটার দু’রকমের কাজই করা যায়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ফরাসী ‘নুভেল ভাগের বেশিরভাগ ছবিই এই ক্যামেরায় সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যেতে পারে যে, প্রযুক্তিবিদ্যার নিত্য নােতুন কৌশলের ফলে সিনেক্যামেরার ক্রমাগত আধুনিকীকরণ ঘটলেও চলচ্চিত্রায়ণের মূল ব্যাপারটা নিহিত থাকে পরিচালকের বােধ, মনন ও সামগ্রিক শিল্প অভিপ্রায়ের মধ্যে। বিষয়বস্তু নির্বাচনে, তার সিনেম্যাটিক বিন্যাসে ক্যামেরার গতিময়তা কোন পারম্পর্যে ব্যবহৃত হবে সেটা নিরূপণ করবেন স্বয়ং চলচ্চিত্রষ্টা। ছবির ক্যামেরাম্যান সেক্ষেত্রে তাকে চিত্র পরিস্ফুটনে সাহায্য করবেন। বর্তমান বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রথম সারির ক্যামেরাম্যান একটি ছবির স্টাইল গঠনে চিত্রপরিচালকের পাশাপাশি একজন আলােকচিত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য কতােটা সে বিষয়ে সুন্দর কথা বলেছিলেন—
“Though the cinematographer may pride himself on having his own style, he must not try to impose it. He must do his best to understand the director’s style, see as many of the director’s films as possible (if there are any), and immerse himself in the director’s manner’. It is not our’ film but ‘his’ film”.৫
বস্তুতঃ চিত্রপরিচালকের শিল্পশৈলীর সঙ্গে এই গভীর সম্পৃক্তিই একটা ছবির সার্বিক স্টাইলে ক্যামেরাম্যানের নৈপুণ্যকে স্মরণীয় করে তােলে। গ্রেগ টোল্যাণ্ড, জেমস ওয়াং হাে, নিভিস্ট, রাউল কুতার প্রমুখ ডাকসাইটে ক্যামেরাম্যানদের সৃজনশীলতাও আবর্তিত হয়েছিল এই অবধারণা থেকেই।
নানা ক্যামেরার আবিষ্কার, চলচ্চিত্রের গতিময়তা, এ শিল্পের উদ্দেশ্য ও প্রয়ােজন, এ মাধ্যমের শরীর ও আত্মার এবম্বিধ প্রস্তাবনার পরে আমরা নিবন্ধের কেন্দ্রীয় বিষয়টিতে আসতে পারি। এখানে প্রথমেই যেটা উল্লেখ্য, তা হ’ল চলচ্চিত্র নির্মাণের সেই আদি থেকেই হলিউড সিনেমা বহু বছর ধরে গােটা বিশ্বের দর্শককে আপ্লুত করে রেখেছিল। মূলতঃ আবেগময় এবং জাঁকজমকপূর্ণ কাহিনীচিত্রের নানামুখী বিন্যাসে হলিউডের ছবি গােটা পৃথিবীতে আদৃত ছিল। এটাও মনে রাখা কর্তব্য যে, চলচ্চিত্র মাধ্যমের ভাষা ও ব্যাকরণের সৃষ্টি হয়েছিল আমেরিকাতেই, গ্রিফিথের অমর সৃষ্টি বার্থ অফ এ নেশন’ এবং ইনটলারেন্স’ ছবি দুটির মাধ্যমে। গ্রিফিথের সবচেয়ে বড় অবদান তার ছবির মহত্ত্বে যতােটা, তার থেকে অনেক বেশি তার আবিষ্কৃত এবং প্রযুক্ত সিনেমার টেকনিক সংক্রান্ত মহনীয়তায়। হিচকক একবার একটা অমােঘ উক্তি করেছিলেন ‘Everytime you see a film today there’s something in it that began with Griffith.’ গ্রিফিথের সিনেমার কাটিং পদ্ধতি, প্যারালাল কাটিং এবং ক্রস কাটিং, মন্তাজ ইত্যাদি টেকনিকগুলােই পরবর্তীকালে দেশে বিদেশে বিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু চলচ্চিত্রভাষার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন তিনিই। সিনেমার বিখ্যাত তাত্ত্বিকেরা গ্রিফিথের চলচ্চিত্র ভাষা ও ব্যাকরণের নানা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সিনেমা নির্মাণে তার রীতিকে নতুন ব্যঞ্জনায় প্রয়ােগের ক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে রুশ চলচ্চিত্র অষ্টা আইজেনস্টাইনের নাম সর্বাগ্রগণ্য। গ্রিফিথের ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ নির্বাচন, ক্লোজআপ, মন্তাজ পদ্ধতিকে সিনেমার নতুন মাত্রায় দৃশ্যাবিভাজনে গ্রহণ করেন আইজেনষ্টাইন। হলিউড সিনেমা তথা তাবৎ মার্কিন চলচ্চিত্রের নির্মাণ কৌশলে গ্রিফিথের প্রভাব অসামান্য। কিন্তু রুশ ও ইওরােপের অন্যান্য দেশের সৃজনশীল চলচ্চিত্রকারেরাও গ্রিফিথের দৃশ্যগ্রহণ টেকনিক, চলচ্চিত্র বিন্যাসের পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু অন্য ব্যঞ্জনায়। গ্রিফিথের শট বিভাজন, কাটিং, মন্তাজ ইত্যাদিকে আইজেনস্টাইন প্রাপ্য মূল্য দিয়েও অন্য এক বৈপরীত্যে মহনীয় করে তুলেছিলেন তার ছবিতে।
এমন কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, গােটা বিশ্বের চলচ্চিত্রায়ণের যদি কোনাে বিশেষ স্টাইল থাকে, তা বিবর্তিত হয়েছে সিনেমার দুই মহারথীর টেকনিকের ক্রমবিবর্তনে। একজন হলেন লুমিয়ের, অপরজন মেলিস। লুমিয়েরের লক্ষ্য ছিল চোখের বস্তুসত্যে উদ্ভাসিত বাস্তবতার
বহু প্রতিকৃতি পর্দায় গড়ে তােলা, তিনি লেন্সের কারিকুরিতে ততােটা নির্ভরশীল ছিলেন না। বিপরীতে মেলিস ক্যামেরার আশ্চর্য গুণপনাকে পর্দায় মায়াসৃষ্টির কাজে লাগিয়েছিলেন, যেখানে ফ্যান্টাসি ও কাহিনীবর্ণনার কৌশলের প্রতি তার আগ্রহ চলচ্চিত্রের সম্ভাবনায় নন্দনতাত্ত্বিক দিক উন্মােচিত করেছিল।
অন্যান্য দেশের মতাে নির্বাকযুগের জার্মান চলচ্চিত্রের স্টাইলেও এক স্বাতন্ত্র্য চোখে পড়ার মতাে। ১৯১৫-২০-র মধ্যে তৈরি থ্রিলার ও সিরিয়াল দেখলে স্পষ্ট বােঝা যায় যে, ক্যামেরা রীতি, দৃশ্যগঠন এবং সামগ্রিক কম্পােজিশনে জার্মান ছবি বিশ্বের অপরাপর দেশের চলচ্চিত্র শৈলী থেকে কতটা আলাদা। ইওরােপীয় চলচ্চিত্র জার্মান ছবির দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিল। কিন্তু জার্মান সিনেমারও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের কলাকৌশল থেকে দূরে সরে থাকা সম্ভব হয়নি। এই প্রসঙ্গে জার্মান সিনেমার স্মরণীয় স্রষ্টা সম্পর্কে চমৎকার মন্তব্য করেছিলেন চলচ্চিত্র ঐতিহাসিক,
“Murnau had hoped to save it thanks to immunizing injections from the mobile and subjective camera. And just as Hollywood cinema itself was capitulating before it, German cinema itself capitulated to naturalism.”৬
চলচ্চিত্রে বাস্তবতা প্রতিফলনের নান্দনিক সূত্র ধরেই মূলতঃ ইওরােপীয় সিনেমার শিল্পাঙ্গিক, যা কিনা ক্যামেরা স্টাইলের রূপান্তর, তা বিবর্তিত হয়। হলিউডী প্রথার বাইরে বেরিয়ে এসে ইওরােপীয় চলচ্চিত্র স্রষ্টারা ক্যামেরার নতুন গতিময়তার সন্ধান করেছিলেন। তাদের অভিপ্রায় ছিল ক্যামেরা কেবল বস্তুবিশ্বের তথাকথিত বাস্তব অধ্যাসই রচনা করবে না, ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ নির্বাচন, দৃশ্যবিভাজন রীতি, সম্পাদনা, দৃশ্যের গতিময়তা বস্তুবিশ্বের ভেতরকার চরিত্র উন্মােচিত করবে। সেই সঙ্গে স্রষ্টার শিল্পমানসিকতাও ধরা দেবে ছবির ক্যামেরা স্টাইলকে আশ্রয় করে। এই উপলক্ষে ইওরােপীয় চলচ্চিত্রে, মূলতঃ ফ্রান্সে জন্ম নিয়েছিল কয়েকটি শিল্পতত্ত্ব যা সিনেমার আধুনিক আঙ্গিকের জন্ম দেয়। এ ছাড়াও, প্রাসঙ্গিকভাবে আমরা দেখব যে, জার্মানী, হাঙ্গেরী, ইটালীয় চলচ্চিত্রে সেই নির্বাক যুগ থেকেই ক্যামেরা স্টাইলে হলিউডী স্টাইলের বিপরীত লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। এখানে জার্মান এক্সপ্রেসনিস্ট সিনেমা, ইটালীয় নিওরিয়ালিজম ও ফ্রান্সের সিনেমা ভেরিতে, নুভেল ভাগ ইত্যাদি পর্যায়ের ছবির কথা এসে পড়ে। এ কথা অবিসংবাদী যে, ফরাসী শিল্পতাত্ত্বিক ও চলচ্চিত্র স্রষ্টা আন্দ্রে বাজাঁর শিল্পে বাস্তবতার তত্তই তার মূল আলােচ্য বিষয় ছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইওরােপীয় চলচ্চিত্র চর্চায় বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। সেই সঙ্গে ফরাসী নবতরঙ্গের উদগাতাও ছিলেন তিনি। তিনি নানা শ্রেণীর চলচ্চিত্রকারদের ছবির আঙ্গিক থেকে আলােচনার উপাদান সংগ্রহ করলেও ক্যামেরার বাস্তবতার দার্শনিক দিক ব্যাখ্যায় নির্ভর করেছিলেন বিশেষ ভাবে যুদ্ধোত্তর ইটালীয় নিওরিয়ালিজম গােত্রের দাবির ওপর। এই নিওরিয়ালিজম বা নয়াবাস্তবধর্মী ছবির শিল্পধারাতেই ইওরােপীয় চলচ্চিত্র নির্মাণ রীতির অতীত ও ভবিষ্যৎ একীভূত হয় এবং এখান থেকেই তাদের স্টাইলের পৃথকীকরণ ঘটে। ইটালীর নয়াবাস্তবধর্মী যেকোনাে প্রতিনিধি স্থানীয় ছবিতে দৃশ্যগ্রাহ্য স্টাইলের স্বাতন্ত্র্য সহজেই লক্ষণীয়। ফোটোগ্রাফির রুক্ষ ধূসরতা, শহরের পরিত্যক্ত পাংশুবর্ণের অঞ্চলের মধ্যে ভ্রাম্যমাণ চরিত্রদের ফ্রেমিং, ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতবাড়ী বা শহরের জনহীন পার্কে, ভাঙাচোরা দেওয়ালের প্রান্ত ধরে চরিত্রদের ভ্রাম্যমাণতা। ক্যামেরা কখনাে স্থির কখনাে তির্যক ভঙ্গিতে ট্রাকিং শটে চরিত্র ও পটভূমিকে মূর্ত করছে—এমনতর নানা দৃশ্য সংকেত অন্য সবকিছু ছাড়িয়ে নয়াবাস্তবধর্মী ছবির শরীর ও আত্মার সন্ধান দেয়। এক নতুন দৃশ্যকল্প নির্মাণ তথা কাহিনীবর্ণনায় শিল্পচেতনার জন্ম সূচিত হল।
নিওরিয়ালিস্ট পরিচালকেরা ক্যামেরাকে জনতার মিছিলে উন্মুক্ত রাস্তায় বিচরণের ছাড়পত্র দেওয়ার পাশাপাশি অপেশাদার অভিনেতা আর শ্রমজীবী ও কৃষকশ্রেণীর মানুষদের জীবন জীবিকা ও প্রাত্যহিক বেঁচেবর্তে থাকার কাহিনী বিবৃত করতে গিয়ে, তাদের জাতীয় সিনেমার ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে বিরূপ মনােভাব জ্ঞাপন করেছিলেন। গােটা পশ্চিমী সিনেমার শিল্প ঐতিহ্য যা হলিউডের মাটিতে পূর্ণতা পায় তার বিরুদ্ধে তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছিল। ইটালীয় নয়াবাস্তবতার বিশিষ্ট প্রতিভূ জাভাৰ্ত্তিনী লিখেছিলেন—
“The Americans continue to satisfy themselves with a sweetened version of truth produced through transposition.”৭
হলিউডী চিত্রনির্মাতারা বস্তুসত্যের এই রূপান্তরিত সৌন্দর্যেই তৃপ্ত ছিলেন। আর। বিদ্যমান সত্যের কতােটা সিনেমার রূপাঙ্গিকে বিধৃত হবে এবং স্রষ্টার কোন্ শিল্প অভিপ্রায়ে, সেই সমস্যা মােকাবিলা থেকেই ইটালীয় নয়াবাস্তবধর্মী ছবির ক্যামেরা রীতির জন্ম হয়। বস্তুসত্যের সঠিক বিন্যাসের একান্ত চাওয়ায় যুদ্ধপরবর্তী ইটালীয়ান চলচ্চিত্রকারেরা স্বদেশের তিরিশ পূর্ববর্তী দশকের ছবিতে, যেখানে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনবৃত্তান্ত অস্বীকৃত এবং উপেক্ষিত ছিল, সেখানে নয়াবাস্তববাদী পরিচালকেরা তাকেই ছবির মূল বিষয় ও বিন্যাস। রীতির প্রধান অবলম্বন করে তুললেন। ফলে তাদের ছবির ক্যামেরার গতিময়তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হ’ল। সিনেমার দৃশ্যগ্রহণের খুব সাধারণ প্রচলিত রীতিগুলাে যেমন ‘ওভার দ্য শােল্ডার শট, সংলাপ দৃশ্য গঠনের তথাকথিত ‘পিংপং’ পদ্ধতি ইত্যাদির কোনটাই ইওরােপীয় সিনেমায় অনুসৃত হয়নি। আইজেনষ্টাইনের চলচ্চিত্রকর্ম এবং নন্দনতাত্ত্বিক সমালােচনাই প্রথম এবং প্রধান এক বিকল্প চলচ্চিত্র রীতির প্রবর্তন করেছিল, যা ইওরােপীয় চলচ্চিত্র নির্মাণে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। অতি আধুনিক ইওরােপীয় চলচ্চিত্রের ক্যামেরা স্টাইলে কিছু কিছু ভিন্ন আঙ্গিক আমরা লক্ষ্য করি তা সেসব ছবির সৃজনশীল পরিচালকদের বিষয়বস্তু নির্বাচন ও বিন্যাসের ক্ষেত্রে নব নিরীক্ষার প্রয়াসেই সাধিত হয়েছে।
সিনেমার উষালগ্নে লুমিয়ের ও মেলিসের উদ্ভাবিত ও প্রবর্তিত রীতি এই মাধ্যমের ভবিষ্যৎ জনপ্রিয়তা সুদৃঢ় করেছিল। এঁদের দু’জনের শিল্প উৎস থেকে জন্ম নিয়েছিল সিনেমার দুটি ধারাতথ্যচিত্র ও কাহিনীচিত্র। পরে চলচ্চিত্রের স্বকীয় ধারায় বিবর্তিত হয়েছে নানা আঙ্গিক। মার্কিন চলচ্চিত্রকার পাের্টার কাহিনীচিত্রের শিল্পশর্তকে আরাে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন একাধিক দৃশ্যক্রম বিভাজনের রীতিতে। গ্রিফিথ এনে দিয়েছিলেন ক্লোজ-আপের নতুন মাত্রা, প্যারালাল কাটিং ও মতাজ। ওয়েমারের সময়কার জার্মানীতে বিশেষ শৈলীর কৃত্রিম সেটে তৈরি এক্সপ্রেসনিস্ট সিনেমার গঠন ছবির চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক পরিমণ্ডল ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে সূত্রবদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধোত্তর রাশিয়াতে কুলেশভ, আইজেনষ্টাইন, পুদভকিন, গ্রিফিথের মন্তাজ রীতির শক্তিকে সম্প্রসারিত করেন। যদিও, এঁদের বাইরে বিদেশের অন্য ভূখণ্ডে বেশ কিছু অগ্রগণ্য স্রষ্টা যেমন, রেনােয়ার মত উল্লেখযােগ্য চলচ্চিত্রকার থাকা সত্ত্বেও, তিরিশ দশকের ইওরােপীয় সিনেমার ঔজ্জ্বল্য খানিকটা ম্লান হয়ে পড়ে। ফ্যাসিবাদ এবং দ্বিতীয় মহাসমর সেখানকার সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণে চল্লিশ দশকের মধ্যবর্তী সময়ের নিওরিয়ালিজম আসার আগে পর্যন্ত বাধার সৃষ্টি করে রেখেছিল। পঞ্চাশ দশকে মার্কিন স্টুডিওগুলাের প্রভুত্ব কমতে থাকে এবং পাশাপাশি প্রধান কয়েকজন ইওরােপীয় চলচিত্রকারের উত্থান লক্ষিত হয়, যাঁদের মধ্যে বার্গম্যান ও ফেলিনির নাম বিশেষ স্মরণযােগ্য। ফ্রান্স ও অন্যত্র নবতরঙ্গ রীতির চলচ্চিত্র আবির্ভাবের সঙ্গে ইওরােপীয় সিনেমা তাদের তিরিশ ও চল্লিশ দশকে হারিয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠা আবার পুনরুদ্ধার করে। সেইসঙ্গে তাদের নব্যধর্মী চলচ্চিত্র মার্কিন শিল্পরীতির বিকল্প স্বরূপ এক গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক হিসেবে প্রভাবশীল হয়ে ওঠে।
শিল্প অভিপ্রায় ও চিত্রনির্মাণের ক্ষেত্রে জার্মান এক্সপ্রেসনিজম আপাত দৃষ্টিতে ইটালীয় নয়াবাস্তবধর্মী ছবির একেবারে ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হলেও তা ছিল উল্লেখযােগ্য শিল্পরূপ। আইজেনস্টাইন রীতির বিপরীত স্টাইল হিসেবে এক্সপ্রেসনিস্ট চলচ্চিত্রে Mise-en-Scene-এর অতিরঞ্জিত রূপ প্রকাশ পায়। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক স্তরের নিবিড় ও বিমূর্ত রূপ তুলে ধরায় এক্সপ্রেসনিস্ট চলচ্চিত্রকারেরা আগ্রহী ছিলেন।
“To the growing strength of Hollywood melodrama and its obsessive continuity, to Eisenstein’s clash of image’s history, Expressionism opposed a cinema legend and myth, presenting cultural archetypes and psychic struggle in the form of tabreaux”.
রবার্ট ওয়াইনের ‘দ্য ক্যাবিনেট অফ ডক্টর ক্যালিগরি’, ডক্টর গােলেম’, ফ্রিৎস্ ল্যাঙের নরডিক উপকথার চিত্রিতরূপ ‘সিগফ্রেড এবং ক্রিয়েমহিল্ডস্ রিভেঞ্জ, ফ্যাসিবাদী ভবিষ্যতের মীপের রূপকে তৈরি তাঁর ‘মেট্রোপলিস’, মুরনাের ‘ফাউস্ট’ এবং চলচ্চিত্রের প্রথম ড্রাকুলা ছবি ‘নসফেরাতু’—এ সব ছবিতেই পাত্র পাত্রীদের শারীরিক গতিবিধি, কার্যকারণ ও সেটের রূপসজ্জা, আমাদের পরিচিত চিন্তাচেতনা রীতি থেকে বিচ্ছিন্ন, যার প্রতিরূপ জন্ম নিয়েছিল পরিচালকদের মনস্তাত্ত্বিক ব্যঞ্জনা ব্যঞ্জনা থেকে “The declared aim of the Expressionists was to eliminate nature and attain absolute abstraction.”৯ এই রীতি বিশেষ ভাবেই মার্কিনী ভঙ্গি ও আইজেনষ্টাইন পদ্ধতি-উভয় রীতি থেকেই আলদা। কৌতূহলােদ্দীপক ব্যাপার যে জার্মান এক্সপ্রেসনিজম পক্ষান্তরে হলিউড ছবি তৈরিতেও প্রভাব ফেলেছিল। এক্সপ্রেসনিস্ট চলচ্চিত্রকারদের অনেকেই পরবর্তীকালে হলিউডে গিয়ে ছবি করেন। ইউনিভার্সাল কোম্পানির তিরিশ দশকের ভৌতিক ছবিতে (Horror film) এর ছাপ খুব স্পষ্ট। এই স্টাইলাইজেশনকে ওরসন ওয়েলস্ নিজস্ব ঢঙে তার ‘Citizen Kane’ ছবিতে প্রয়ােগ করেন, যা চল্লিশ দশকের film noir-কে প্রভাবিত করে। সত্তর দশকের জার্মান চলচ্চিত্র যখন অন্য ভাবনাচিন্তার অনুষঙ্গে পুনরুজ্জীবিত হয় তখন। এক্সপ্রেসনিস্ট রীতির আধুনিকীকরণ সমস্যা সৃষ্টি করে। ওয়ার্নার হারজোগ মুৱনাের নসফেরাতু ছবির নােতুন সংস্করণ চিত্রায়িত করেন যেখানে পূর্বতন ছবির কিছু ঙ অনুসরণ করেও মুরনাের অনেক প্রয়ােজনীয় প্রাকরণিক রীতি থেকে তিনি সরে এসেছিলেন। ফ্যাসলিণ্ডার এক্সপ্রেসনিস্ট আন্দোলনের তাগিদ অনুভব করেছিলেন কিন্তু তার স্টাইলকে অনুসরণ করেননি। অপর সমসাময়িক জার্মান পরিচালক উইম ওয়েণ্ডারের মতাে ফ্যাসবিণ্ডারের মধ্যে যে পরিমাণে আমেরিকান ফিল্ম ‘নােয়া’ ও এক্সপ্রেসনিস্ট প্রবণতা ছিল, ঠিক সমপরিমাণেই তাঁর স্বদেশী সিনেমার ঐতিহ্যের শিকড়ও তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল।
ইওরােপীয় ফিল্মে ভিন্নতর ক্যামেরার স্টাইল অর্থাৎ ভিস্যুয়ালের নবীকরণে ফরাসী চলচ্চিত্রস্রষ্টা জঁ রেনােয়ার অবদান অসামান্য। ইটালীয় নয়াবাস্তবতা, ফরাসী নবতরঙ্গ ও সমধর্মী চলচ্চিত্র আন্দোলন দানা বাঁধবার আগেই তিনি মার্কিন স্টাইলের সম্পূর্ণ বিপরীত এক রীতির জন্ম দিয়েছিলেন। বস্তুতঃ তার ক্যামেরার গতি এবং কাটিং পদ্ধতি পাত্র পাত্রীদের ক্রিয়াকলাপের সুযােগ বাড়িয়ে দেয়, অভিনেতা অভিনেত্রীদের চলাফেরা, মুখমণ্ডলের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, সর্বোপরি প্রাকৃতিক দৃশ্যগত সাযুজ্যকে সম্পৃক্ত করে ও বাড়িয়ে দেয়। রেনােয়ার ছবির এই ধরনের প্রকরণের ব্যাখ্যায় আন্দ্রে বাজাঁ লিখেছিলেন—
“Renoir…understands that the screen is not simple rectangle. …It is very opposite of a frame. The screen is a mask whose function is no less to hide reality than it is to reveal it. The significance of what the camera discloses is relative to what it leaves hidden.”১০
একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, রেনােয়াই প্রথম অগ্রগণ্য চলচ্চিত্র স্রষ্টা যিনি চলচ্চিত্রের পর্দায় কাহিনী বিন্যাসের জন্য অনেকটা জায়গা খােলা রাখেন, যাতে দর্শকেরা কাহিনীবিন্যাসের প্রবহমানতায় সক্রিয় অংশ নিতে পারেন। দৃশ্যগত ও আখ্যানগত স্থানের মহত্ত্ব যাট দশকের নব্যধর্মী ছবির প্রধান উপকরণ হয়ে উঠেছিল আর এই প্রসঙ্গে রেনােয়া নেতৃস্থানীয় শিল্পব্যক্তিত্বে বিরাজ করেছেন। ত্রুফো প্রত্যক্ষভাবে রীতির দিক থেকে তাঁকে অতিক্রমের চেষ্টা করেছেন, গােদার রেনােয়ার অবাধ গতিময়তাকে গ্রহণ করেছিলেন। ষাট দশকের প্রায় সব উল্লেখযােগ্য চলচ্চিত্রকারের ক্যামেরার ভাযা ও দৃশ্যপরম্পরার গতির জন্য অল্প বিস্তর রেনােয়ার কাছে ঋণী। ইটালীর নয়াবাস্তবতার পরিচালকেরা রেনােয়া ও তাদের মধ্যে একটা শিল্পসেতু আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে তৈরি রেনােয়ার Toni ছবিটাকে ইটালীয় চলচ্চিত্রকারেরা তাদের শিল্পদর্শনের সমধর্মী হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন। এবছর পরে, যুদ্ধোত্তর ইটালীর প্রেক্ষাপটে যে নয়াবাস্তব রীতির সিনেমা সম্ভাবিত হয়, রেনােয়ার এই ছবিতে তার বীজ নিহিত ছিল। ছবিটি তৈরি হবার বিশ বছর পরে ‘টোনি’ ছবির নির্মাণশৈলীর ব্যাখ্যায় রেনােয়ার স্বগত সংলাপে নিওরিয়ালিস্ট পরিচালকদের কথা ধ্বনিত হয়েছিল,
—“Good photography…sees the world as it is, selects it, determines what merits being seen and seizes it as if by surprise, without change. … At the time of Toni…my ambition was to integrate the nonnatural elements of my film, the elements not dependent on chance encounter, into a style as close as possible to everyday life. The same thing for the sets. There is no studio used in Toni. The landscape, the houses are those we found. …Our ambition was that the public would be able to imagine that an invisible camera had filmed the phases of a conflict without the characters unconsciously swept along by it being aware of its presence.”১১
সিনেমা মাধ্যমের জন্মের অর্ধশতাব্দী পরে আগত নয়াবাস্তবধর্মী ছবির মৌলিক শিল্পতত্ত্বই মুখ্যতঃ বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাণ পদ্ধতির বিপরীত এক স্বকীয় স্টাইলের সূচনা করে। গােটা ইওরােপীয় সিনেমায় এর প্রভাব বাস্তবধর্মী ছবি তৈরির অনুষঙ্গে আলােচিত হয়ে থাকে। ইটালীয় ক্যাথলিক সমালােচক ব্যাখ্যা করেছিলেন—
“The Italian neo-realist school is based on a single thesis dramatically opposed to that thesis which regards the cinema only in terms of lighting effects, worlds and purely imaginary situations. Neo-realism thesis is that the screen is a magic window which opens out into the ‘real’; that cinematic art is the art of recreating, through the exercise of free choice upon material world, the most intense vision possible of the invisible reality inherent in the movement of the mind.”১২
ডি সিকার বিশ্ববিখ্যাত ছবি ‘বাইসাইকেল থীভস’ আলােচনা প্রসঙ্গে বাজাঁ বলেছিলেন যে এটাই ‘বিশুদ্ধ’ সিনেমার প্রথম নিদর্শন। এখানে অভিনেতা নেই, গল্প নেই, সিনেমার তথাকথিত সেট নেই। নিখুঁত নান্দনিক দৃশ্যমায়ায় তৈরি সিনেমা সেক্ষেত্রে চলচ্চিত্রই নয়। বাজাঁ এবং তার গুণগ্রাহী নয়াবাস্তবধর্মী পরিচালকেরা এমন এক আঙ্গিকের সন্ধান করেছিলেন যেখানে ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ দৃশ্যগ্রহণ পদ্ধতি বস্তুবিশ্বকে মধ্যস্থতা ছাড়াই আমাদের সামনে হাজির করবে। এই রীতিতে তৈরি ছবির কাটিং পদ্ধতি দৃশ্যের অতিরিক্ত কিছু জোগায় না, কেবল প্রয়ােজনীয় তথ্য দেওয়া ছাড়া। দর্শকদের আকর্ষণ যতটুকু আদায় করা দরকার দৃশ্যের কাটিং ততােটুকুই দেয়, ক্লোজ আপ এবং দৃষ্টিকোণ নির্বাচিত শটগুলােতে আমরা চরিত্রকে দেখি এবং সে কি দেখছে তা লক্ষ্য করি, প্রায় সব ক্ষেত্রেই দৃশ্যগত পরিবেশ প্রাধান্য পায় যার মধ্যে ছবির চরিত্র জড়িয়ে রয়েছে। ছবির দৃশ্যকল্প যাবতীয় অর্থ দ্যোতনা করছে যার মধ্যে ছবির প্রতিপাদ্যও স্বয়ং বিদ্যমান।
তিরিশ দশকের হলিউডী ক্যামেরা স্টাইল দৃশ্যকল্পে ততােটা মনােযােগী ছিল না, পরিবর্তে যেভাবে দৃশ্যকল্প নিদারুণ পরিবেশে প্রথাগতভাবে ব্যবহারযােগ্য চরিত্রদের হাজির করতে পারে, তারই ক্রমবিন্যাসে গড়ে তােলা কাহিনীধারার দিকেই বেশি লক্ষ্য দিত। নয়াবাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রকারেরা এই কাহিনী প্রবহমানতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেননি, কিন্তু আবার এই রীতির স্বার্থে তাদের স্বকীয় দৃশ্যকল্পের মৌলিকতাকে ত্যাগ করেননি। তারা সিনেমার ইমেজকে নিজস্ব জগৎ তৈরির ছাড়পত্র দিয়েছিলেন যেখানে ক্যামেরায় গৃহীত দৃশ্যসজ্জা সহজ স্বাভাবিকভাবে প্রার্থিত পরিমণ্ডল গড়ে তুলবে, যতােটা কম অলংকৃত হয় সেইভাবে।
রােজালিনীর ‘Paisa’ ছবির শেষ দৃশ্যক্রম স্মরণ করা যেতে পারে। সেই ছােট্ট বালকটি যার সঙ্গে মার্কিন নিগ্রো লােকটির একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ছবির শেষে বালকটির Close up যেখানে ছেলেটির ভীত মুখমণ্ডল আমরা দেখি, সেই সঙ্গে সংলগ্ন দূরবর্তী শটে মার্কিন নিগ্রো সৈনিকটি জীপ গাড়ী চালিয়ে দূরে মিলিয়ে যায়। এখানে রােজালিনী দর্শকের আবেগ জোর করে আদায় করে নেন না, কিন্তু শহরের দারিদ্র্যপীড়িত হতাশ্বাস অবস্থার সঙ্গে আমরা একাত্মতা লাভ করি যা নিগ্রো সৈনিকটির তার নিজের অবস্থার ভেতর দিয়ে শ্লেষাত্মকভাবে প্রতিফলিত হয়। পরিচালক এখানে কেবল সামান্য ইঙ্গিত দিয়েই ছবি শেষ করেছেন। কোনাে অতিরিক্ত দৃশ্যকল্প জুড়ে দেন নি। যুদ্ধোত্তর ইটালীর তদানীন্তন পরিস্থিতির সংকটময় দুরবস্থা এবং মর্মান্তিক পরিস্থিতির কারুণ্য দৃশ্যের স্বাভাবিকতায় ছবির পর্দা থেকে দর্শকদের মনে সঞ্চারিত হয়ে যায়। পরিচালক বালকটির চেয়ে থাকা আর দূরে মিলিয়ে যাওয়া জীপগাড়ীর সৈনিকের দৃশ্যের মধ্যে দর্শকদের ছেড়ে দেন।
ডি সিকার ‘বাইসাইকেল থীভস’ ছবির শেষ দৃশ্যক্রমেও অনুরূপ ব্যঞ্জনা মূর্ত হয়েছে। ছবির নায়ক রিক্তি নিজের সাইকেল চুরি হওয়ায় বহুকষ্টে জোগাড় করা চাকরিস্থলে পৌছতে পারে না । সে গােটা শহর হন্যে হয়ে তার সাইকেল খুঁজে বেড়ায়। অগত্যা মরিয়া হয়ে অপরের একটা সাইকেল চুরি করে পালাতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়ে এবং চরম লাঞ্ছিত হয়। তার ছােট্ট ছেলে ব্রুনাে বাবার লাঞ্ছনার সাক্ষী হয়। এক নিদারুণ মর্মস্পর্শী দৃশ্যে ডি সিকা লাঞ্ছিত, অপদস্থ রিক্তিকে জনতার হাত থেকে রেহাই দেন। তখন অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের ভীড়ে বাবা ও ছেলে হাত ধরাধরি করে মিলিয়ে যায়। নয়াবাস্তববাদী চলচ্চিত্রকারেরা সেই জগৎ জীবনের ইমেজ পর্দায় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন যা প্রথাগত সিনেমা ঐতিহ্যে উপেক্ষিত ছিল। তারা সিনেমার ক্যামেরা নির্মাণ কৌশলের ওপর নির্ভর করে সেই কৌশলকে বাস্তবের নবতর রূপের মধ্যে উত্তীর্ণ করেছিলেন। মার্কিন চলচ্চিত্র ও মার্কিন সিনেমাঅনুসারী ও প্রভাবিত যাবতীয় চলচ্চিত্র কর্মের অলীক বাস্তবতার বিরুদ্ধে তারা প্রশ্ন তুলেছিলেন।
সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বিশ্বের যাবতীয় শিল্পশাখায় রূপাঙ্গিকের বিবর্তন ঘটতে শুরু করে। ব্রেখটু বলেছিলেন—’Reality changes; in order to represent it, modes of representaticn change’। ইম্প্রেসনিস্ট পরবর্তী আন্দোলনের যুগে তথাকথিত নিসর্গচিত্র ও মানুষের শরীরী সংস্থান চিত্রকলা থেকে অপসৃত হতে শুরু করে। বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ায় চিত্রকর, নাট্যকার, কবি, চলচ্চিত্রকারেরা তাদের শিল্পের ক্ষেত্রে বৃহত্তর দর্শকগােষ্ঠীর উন্মুখ হয়ে ওঠেন। দুটি যুদ্ধের মধ্যবর্তী পর্বে ঔপন্যাসিকেরা কেবল তাদের ভাষার রচনা কৌশল নিয়েই নয়, কি বলা হচ্ছে তা নিয়েও ভাবিত ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় যে, আধুনিক সাহিত্য ও চিত্রকলার আঙ্গিকে চলচ্চিত্রের বিবর্তমান টেকনিকের প্রভাব পড়েছিল। সময় ও সময়হীনতা, বাস্তবিক সময় ও মনস্তাত্ত্বিক সময় প্রবাহের চিত্রণ বর্ণনায় মার্সেল প্রস্ত, জেমস্ জয়েস, ডস প্যাসােস, ভার্জিনিয়া উল প্রমুখ লেখকেরা সিনেমার কাটিং, ডিজলভ, মন্তাজ রীতির অনুবর্তনে নােতুন সাহিত্য স্টাইল তুলে ধরেন। রাশিয়ার আভাগা আন্দোলনের পুরােধা আইজেনস্টাইন, ফ্রান্সের বিশ ও তিরিশ দশকের আভাগা আন্দোলনের শরিক আবেল গাঁস, জাঁ আপা , লুই ডেলুক, মার্সেল লে হারবিয়ের, রেনে ক্লেয়ার, হল্যাণ্ডের ইয়ােরিস ইভান্স, জার্মানীর ওয়াল্টার রুটমান প্রমুখের ঐকত্রিক প্রচেষ্টায় ইওরােপীয় চলচ্চিত্রের নির্মাণ শৈলী আপন স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি সিনেমার গঠনতন্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে বুয়েলের নিরন্তর চিন্তাও ইওরােপীয় সিনেমার ক্যামেরা বিন্যাসকে নােতুন মাত্রা দেয়।
কিছু ভিন্নগােত্রের ইওরােপীয় ছবি বিষয়ের মনস্তাত্ত্বিক উন্মােচনে ক্যামেরার গতিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ্য হয়ে আছে। যেমন রােজালিনীর ‘Voyage in Italy’ ছবিটি। কেবল কাহিনীর সিদ্ধান্তেই নয়, এ ছবির দৃশ্যক্রম যেভাবে চরিত্রদের অন্তর বাহির তল্লাশ করেছে তাতে ছবির দৃষ্টিকোণের উপস্থাপনায় দর্শকও চরিত্রদের পারস্পরিক আদান-প্রদানের শরিক হয়ে পড়েন। ব্যক্তি চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক স্তর উন্মােচিত হয় এখানে। ক্যামেরায় বিধৃত দৃশ্যকল্পের। বস্তুসত্য সরাসরি প্রতিফলিত হয়েও তন্ময় ও মন্ময় চেতনার স্তরে পৌঁছয়। নয়া বাস্তবধর্মী ছবির কঠোর বাস্তবতার ভূমি ছেড়ে এ ছবি নােতুন রীতির সিনেমার আগমন সূচিত করে, যেখানে বস্তুবিশ্ব কেবল ক্যামেরায় ধরা থাকবে না, চরিত্র ও দর্শকের চেতনার অপরিহার্য অংশ হিসেবে পরিগণিত হবে। এরম্যান্নো ওমি তার ‘The Tree of Wooden Clog’ ছবিতে নয়াবাস্তবধর্মী ছবির অনুষঙ্গ গ্রহণ করেও ক্যামেরা রীতিতে নিজস্ব চিন্তা আরােপ করেছেন। তিনি দৃশ্যের মধ্যে অবিরামভাবে কাট ব্যবহার করেন এবং তার খণ্ড দৃশ্যগুলােও খুব ছােট ছােট। তিনি যতটুকু দেখাতে চান দর্শক ততােটুকুই দেখার সুযােগ পায়, তার দৃশ্যক্রমের টুকরাে টুকরাে অংশগুলাে পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে, প্রতিটি টুকরাে দৃশ্যই আমাদের পর্যবেক্ষণকে পাল্টে দেয় এবং প্রসারিত করে, যা একাধিক সুরের মিশ্রণে তৈরি এক সাংগীতিকমূৰ্ছনার মতাে বহুলােকের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকলাপকে বিধৃত করে, যার মধ্যে এক ও বহুর একাধিক নাট্যসংঘাত সংলগ্ন থাকে। এর মধ্যে সবকটি শটই পরস্পর সম্পৃক্ত হয়ে প্রত্যেকটি পর্বকে এগিয়ে দেয়।
অন্যান্য সমসাময়িক ইওরােপীয় চলচ্চিত্রকারদের মতাে ইটালীয় পরিচালক আন্তনিওনি ক্লোজ-আপ-এর ব্যবহারে ততােটা উৎসাহী ছিলেন না। যদিও তার ছবির অপরিহার্য অংশে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে তিনি ক্লোজ-আপ ব্যবহার করেছেন। তার ছবিতে যে পারিপার্শ্বিকতা ছবির ক্যামেরার গতিময়তায় ধরা দেয় তা চরিত্রের প্রাতিস্বিকতা থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তিরিশ দশকের গােড়া থেকেই রেনােয়া ও অপরাপর সৃজনশীল ইওরােপীয় পরিচালকেরা আইজেনটাইন ও মার্কিন কাটিং রীতির বিপরীত এক পদ্ধতিতে কাজ করছিলেন। আন্তনিওনি মূলতঃ ছবিতে লঙ টেক ব্যবহার করেন যেখানে অবিচ্ছিন্ন, অনির্দেশিত দৃষ্টিপাতের মধ্যে মানুষ এবং বস্তু দর্শকের গােচরে আসে। দৃশ্যের মধ্যে তিনি ডীপ ফোকাস-এর পক্ষপাতী যাতে নিকট। ও দূর দর্শকের দৃষ্টিতে সমান উজ্জ্বলতায় প্রতীয়মান হয়। তার ক্যামেরার দীর্ঘ বিলম্বিত টেকিং কেবল বস্তুজগতের বাস্তব প্রতিফলনই ঘটায় না, তিনি তার ভেতর দিয়ে ব্যক্তিবিশেষের মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক অবস্থা, সেইসঙ্গে সমকালীন ইওরােপীয় মানুষের বিশেষ শ্রেণীচরিত্রের অনুভূতির স্তরটিকে উন্মােচিত করেন।
ফরাসী ‘নুভেল ভাগ’ বা ‘নবতরঙ্গ’ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা জঁ লুক গােদার ১৯৫৯এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ফোর ‘Four Hundred Blows’ ছবির নির্বাচন উপলক্ষে এক ইস্তেহারে ফ্রান্সের একাধিক সনাতনপন্থী পরিচালকদের সম্পর্কে খােলাখুলিভাবে লেখেন,
“Your camera movements are ugly because your subjects are bad, your casts act badly because your dialogue is worthless; in a word you don’t know how to create cinema because you no longer even know what it is…. It is our films which will go to Cannes to show that France is looking good, cinematographically speaking.”১৩
গােদারের এই ঘােষণায় এটুকু প্রতীয়মান হয় যে, ফরাসী নবতরঙ্গের হাত ধরে ইওরােপীয় চলচ্চিত্রে নােতুন স্টাইলের আগমন ঘটলাে।
নবতরঙ্গের জন্ম যাট দশকে হলেও এর বীজ নিহিত ছিল দশ বছর আগের এক বৈপ্লবিক চিন্তাধারার মধ্যে। ১৯৪৮ সালে ঔপন্যাসিক, সমালােচক, চলচ্চিত্রকার আলেকজান্দার আব্রুক সিনেমা নির্মাণ বিষয়ে তার ঐতিহাসিক তত্ত্ব ‘La Camera Stylo’-র কথা ব্যক্ত করেন। তার। মতে চলচ্চিত্রকারও ঔপন্যাসিকের কলমের মতােই তাঁর বক্তব্য ও ঘটনাকে ক্যামেরার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলবেন। নবতরঙ্গের পরিচালকেরা আসকের সেই কথাকেই এক দশক পরে তাদের ছবিতে সার্থক করে তােলেন। “Director is no longer a means of illustrating or presenting a scene, but a true act of writing. The film maker/author writes with his camera as a writer writes with his pen.”১৪ এরই সঙ্গে তৈরি হ’ল আরাে কয়েকটি নন্দনতত্ত্ব—Mise-en-scene এবং Politique des auteurs.’। ক্যামেরাকে আরাে যুক্তি শৃঙ্খলার পারম্পর্যে ব্যবহার করে মানুষের জীবনকে বহুধা বিচ্ছিন্ন স্তর থেকে একেবারে চলচ্চিত্রের পর্দায় মেলে ধরলেন তাঁরা। চল্লিশ দশকের নয়াবাস্তববাদী আন্দোলন ছিল মূলতঃ একটা দর্শনকেন্দ্রিক যেখানে things as they are ছিল সেইসব স্রষ্টাদের লক্ষ্য। নভেলভাগ মূলতঃ ক্যামেরা তথা সিনেমার সার্বিক আঙ্গিক প্রকরণের আন্দোলন। things as they are শুধু নয়, সেইসঙ্গে things as they ought to be-কে চিত্রিত করা হয়ে উঠল তাদের প্রধান অভিপ্রায়। ছবিতে সাধারণ cut-এর পাশাপাশি Jump cut, জুম-এর স্বকীয় ব্যবহার, হ্যাণ্ডহেল্ড ক্যামেরার যথেচ্ছ ব্যবহার, ফ্রীজ শট, স্নোমােশন, ফ্ল্যাশব্যাকের নােতুন ব্যঞ্জনা ইত্যাদি নানা প্রক্রিয়া আধুনিক ইওরােপীয় চলচ্চিত্রে ক্যামেরার ভাষায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করলাে।
আলা রেনের ক্যামেরা মুভমেন্ট প্রবহমান সময়ের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা সাহিত্যের মগ্ন চৈতন্যের সমকক্ষতায় নিজস্ব কাটিংয়ে চলচ্চিত্রের পর্দায় অদ্ভুত নৈপুণ্যে চিত্রিত হ’ল। ছবির পর্দায় Time ও Space এক অনন্য বিরল দার্শনিক প্রজ্ঞা অর্জন করলাে। তার ‘হিরােশিমা মন আমুর’, ‘লাস্ট ইয়ার এ্যাট মারিয়েনবাদ’ ও আরাে অনেক ছবি সিনেমার পর্দায় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের কালচিহ্নে একাকার হয়ে এক মন্ময় প্রতিভাস গড়ে তুলেছিল, যার বিকল্প চিত্ররূপ আজও ইওরােপীয় চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি।
ফরাসী নবতরঙ্গের গােদারই প্রধান ব্যক্তি যার ক্যামেরা স্টাইল, জাম্প কাট পদ্ধতি, মন্তাজ রীতি, কাহিনী ভাঙার নিজস্বতা অব্যবহিত পরবর্তী ফরাসী সিনেমা তথা গােটা ইওরােপের নােতুন প্রজন্মের চিত্রপরিচালকদের ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। এমনকি কানাডা, ব্রাজিল ও লাতিন আমেরিকার আধুনিক চলচ্চিত্র গােদারের সিনেমাতত্ত্ব ও ক্যামেরা প্রয়ােগ পদ্ধতির দ্বারা অসীম প্রভাবিত। গােদারের প্রথম কাহিনীচিত্র ‘Breathless’ থেকেই তিনি ক্যামেরা রীতি তথা সিনেমার প্রথাসিদ্ধ ফর্ম ভাঙলেন। এ ছবির প্রথম দৃশ্য শুরু একটি খবরের কাগজ-এর শট থেকে। খবরের কাগজের একটি বিজ্ঞাপনের close up-এ নারীর অন্তর্বাসের পােশাকে একটি মেয়ের শরীর মার্কিন ছবিতে এমত শুরু থাকে না। সেখানে আগে থাকে একটি লঙ শট যা স্থানের পরিচয় দেয় যা পরবর্তী কাটিংয়ের মাধ্যমে দর্শকের কাছে প্রতিভাত হয়। এর পরবর্তী বেশ কয়েকটি দ্রুত কাটিংয়ে আমরা দেখি খবরের কাগজটি মাটিতে পড়ে যায়। খবরের কাগজ ধরে থাকা লােকটির মুখে সিগারেট, মাথার টুপিটা চোখ পর্যন্ত ঝুঁকে রয়েছে, লােকটি মুখ থেকে সিগারেট সরিয়ে ঠোট দুটো রগড়ে নেয়, লােকটি রাস্তার একটি মেয়ের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে, মেয়েটি লােকটিকে একটি মােটর গাড়ীর প্রতি ইঙ্গিত করে, লােকটি সবেগে গাড়ীতে ঢুকে সেটি চালিয়ে উধাও হয়ে যায়। এখানে ধ্রুপদী ছবির dissolve ব্যবহার করে গােদার সময় ও স্থানের ইঙ্গিত দেন, দ্রুত কয়েকটি কাটিংয়ে রাস্তা পার হয়ে যাওয়া দৃশ্যমান হয়, অস্থির গতির কিছু cut প্রযুক্ত হয়, অপ্রত্যাশিতভাবে দৃশ্যের গতি পরিবর্তিত হয়। পরপর বেশকিছু শটে গাড়ীর ভেতর ও বাহির দৃশ্যমান হয়, লােকটি নিজের মনে গুনগুন করে গান করে এবং নিজের মনেই কথা বলে যায়, এবং দর্শকদের উদ্দেশ্য করেও কথা বলে, জনৈক পুলিশ গাড়ীটিকে থামায়। লােকটি পুলিশকে গুলি করে, কিন্তু এই গুলি ছোঁড়া অতি সংক্ষিপ্তভাবে দেখি আমরা, ক্যামেরা লােকটির হাতের অংশে pan করে, আবার কাটিংয়ের মাধ্যমে লােকটির হাতে ধরা পিস্তল। দৃশ্যমান, আর একটি শটে পিস্তলের নলটিকে দেখা যায়, অন্য শটে পুলিশটি গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং পিস্তলের শব্দ শােনা যায়। পরের শটে লােকটি একটি মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে পালাতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অসংখ্য খণ্ড দৃশ্যের সমাহারে গােদার তথাকথিত ganster ছবির প্রত্যাশাকে ভেঙে চুরমার করে দেন। কেবল গােদারই নন, নবতরঙ্গের অন্যান্য চলচ্চিত্রকারেরাও ছবির ফ্রেম ও দৃশ্যক্রমের প্রতি দর্শকের দৃষ্টিপাতের ভাবনাটাকে পাল্টে দিয়েছিলেন। গােদারের চলচ্চিত্রে টেকনিকের প্রভাব যেমন দেখি মারি স্ট্রাউব, ড্যানিয়েটের ছবিতে, তেমনি দেখি বার্তোলুচি, প্যাসােলিনী, মিকলােস ইয়ানচো, ষাট দশকের বার্গম্যানের ছবিতে, বুনুয়েলের শেষ দিকের ছবিতে, লাতিন আমেরিকার সব প্রধান রাজনৈতিক চিত্র পরিচালক ও নােতুন জার্মান চলচ্চিত্রকার উইম ওয়েণ্ডার, ফ্যাসবিণ্ডার প্রমুখের সৃষ্টিতে।
গােদার বুঝেছিলেন যে সিনেমার ক্যামেরাই ব্রেষ্টীয় প্রয়ােগবিধি কাজে লাগানাের প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র। সেই সঙ্গে মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রতি আগ্রহ বশত তিনি দৃশ্যবিভাজনের মন্তাজ রীতিতে ক্যামেরার গতিময়তায় তার স্বীকরণ করেছিলেন নিজের ভাবনা চিন্তা অনুযায়ী। এক অনন্য শিল্পভাষা হিসেবে চলচ্চিত্র মানুষের অস্তিত্ব সংকটের চেহারা নিয়ে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখে। এই সার্বিক মনােভঙ্গিই গােদারের চলচ্চিত্র স্টাইলের মধ্য দিয়ে সমগ্র ইওরােপীয় সিনেমার নির্মাণ প্রকরণে সঞ্চারিত হয়। পরবর্তীকালে ইওরোপের অন্যান্য সৃজনশীল চলচ্চিত্রকারেরা যখন সিনেমার ক্যামেরাকে জীবন সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, তাঁদের স্টাইল ও প্রত্যয়ে গােদারীয় সিনেমা অভিজ্ঞান গভীরভাবে প্রােথিত ছিল। ষাট দশকের পরবর্তী পর্যায়ে সারা বিশ্বের বাণিজ্যিক ছবির নির্মাণশৈলী-লােকেশনের ব্যবহার, রঙের প্রয়ােগ, কাটিং ও শট কম্পােজিশনের ভঙ্গি গােদারীয় শিল্প প্রবর্তনার চিহ্ন মনে পড়িয়ে দেয়।
নব্য জার্মান সিনেমার ক্যামেরা আঙ্গিকে ফরাসী নবতরঙ্গের প্রভাব ঈষৎ দেরীতে পৌছলেও সেখানকার উল্লেখযােগ্য পরিচালক আলেকজান্দার ক্লগ, উইম ওয়েণ্ডার, ফ্যাসবিণ্ডার, ওয়ার্নার হারজোগ নবতরঙ্গের আদলে সিনেমাকে নােতুন করে আবিষ্কার করেন। ক্লগের ক্যামেরায় কাহিনীর প্রবহমানতা ছিন্ন হ’ল অনেকটা ব্রেষ্টীয় ও গােদারীয় স্টাইলে, যাকে বলা যেতে পারে ‘narrative deconstruction’। ফ্যাসবিণ্ডার দর্শকের দৃষ্টি সেইসব বস্তুর ওপর আকৃষ্ট করলেন যা সাধারণ দেখার অভিজ্ঞতায়, আকর্ষণহীন, অতি সাদামাটা, তার ক্যামেরা একান্তভাবেই সামনা সামনি ও নিশ্চল, পাত্র পাত্রীরা সংলাপ বলা ছাড়া বিশেষ কিছু করে না। তার ছবিতে অভিনয় করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানিক ব্যবধান অল্প এবং একঘেয়েমি শ্লথ গতিতে পর্যবসিত।
ওয়ার্নার হারজেগের সিনে ক্যামেরায় ধরা পড়ে এক অধিবিদ্যাসজ্ঞাত (metaphysical) জগতের অধ্যাস। তার বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য না থাকলেও ছবির ফ্রেম, দৃষ্টিকোণ নির্বাচন তথা ক্যামেরার গতিময়তায় এক ধরনের অতীন্দ্রিয় ব্যঞ্জনার আভাস থাকে, ব্রিটেনের নিকোলাস রােয়েগের দৃশ্যসজ্জায় যা অন্যভাবে প্রতিফলিত।
“Of all major contemporary European film makers, Herzog is most willing to allow his images to stand uninterrogated; to allow them, and the carefully selected music he insinuates under them, to generate–amazement, promote reverie, and frustrate analysis. His films, like his characters, are without shadows and, like the landscape of ‘Fata Morgana’ without deeper meaning. His images are astounding, but his discourse it attenuated. The films are more incantations than narratives.”১৫
ক্যামেরা স্টাইলের বৈচিত্র্যে জার্মানীর উইম ওয়েণ্ডার ষাট দশকের চলচ্চিত্রায়ণ রীতির এক ব্যতিক্রমী নাম। তার রীতি গােদারের সিনে-টেকনিকের অনুসারী, কাহিনীগত ঘটনাসংস্থান থেকে দর্শকদের বিচ্ছিন্ন বা দূরে সরিয়ে রাখার ব্যাপারে তিনি ভূক্ষেপ করেন না, কিন্তু ছবির চরিত্রদের প্রতি তাঁর মমত্ব নিবিড় হয়ে থাকে। তার ছবির চরিত্রেরা সব সময়েই এমন সব জিনিসপত্রের দ্বারা পরিবৃত থাকে যা সহজেই তাদের জীবিকা ও মানসিক পর্যায়টিকে ফুটিয়ে তােলে।
ইওরােপীয় চলচ্চিত্রে ক্যামেরা স্টাইলে যিনি আধুনিককালে অনন্য রীতির প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি হলেন হাঙ্গেরীয় চিত্রপরিচালক মিল্লােস ইয়ানচো। ইয়ানচো বিশেষ অর্থেই দায়বদ্ধ বিপ্লবী চলচ্চিত্রকার। তাঁর ছবির বিষয়বস্তুতে বিপ্লব পর্ব ও বিপ্লব পরবর্তী হাঙ্গেরীর বিশেষ বিশেষ পর্বের ঘটনাক্রম চিত্রিত হয়। এই ঘটনাচিত্রণে তিনি মন্তাজ রীতি পরিহার করেন, ছবির দৃশ্যের কাটিং ব্যবহৃত হয় তখনই যখন তা ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন একান্ত অপরিহার্য হয়ে ওঠে, যখন অন্য দৃশ্যে পরিচালক যেতে চান কিংবা ক্যামেরায় নােতুন ফিল্মের রীল ভরার প্রয়ােজন হয়। তার কাছে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া হ’ল অত্যন্ত প্রবহমান রীতি এবং ছবির ফ্রেমে তাকে সেই ভাবেই বিধৃত করতে হয়। দৃশ্যক্রমের মধ্যে একাধিক শটের সংঘাত সৃষ্টি না করে তিনি দৃশ্যক্রমকে এক নিরবচ্ছিন্ন ক্রমবহমান গতিময়তায় রূপ দেন। তারই মধ্যে সুচিন্তিত কোরিওগ্রাফিসুলভ ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় ছবির চরিত্রেরা ব্যালে নৃত্যের ছন্দভঙ্গিমায় ছবির ঘটনা ও সংলাপকে মূর্ত করে তােলে। এদিক থেকে ইয়ানচো ইওরােপীয় চলচ্চিত্রভাষায় আইজেনস্টাইনের বিপরীত আঙ্গিকের প্রবর্তক। ইয়ানচোর দীর্ঘ সময়ের এক একটি দৃশ্যে রৌদ্রকরােজ্জ্বল বিস্তীর্ণ মাঠ, দলবদ্ধ মানুষের অবিরাম গতি, হতাশা ও নিষ্ঠুরতা, জয় ও বিজয়ের উদ্যাপন পর্ব বর্ণময় হয়ে ওঠে। ইওরােপীয় তথা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে তাঁর মতাে এত দীর্ঘ সময়ের এক একটি দৃশ্য আর কেউ ক্যামেরায় ধরেন না। তাঁর ছবির এই রীতি চলচ্চিত্রের পর্দায় এক অনবদ্য ছন্দ সৃষ্টি করে যা তার পূর্বাপর কোনাে চিত্রপরিচালকের মধ্যে নেই। সাধারণতঃ সিনেমায় দৃশ্য বিন্যাসে একটি গোটা ছবি জুড়ে ৫০০ থেকে ১০০০ খণ্ড খণ্ড শট থাকে। সেক্ষেত্রে ইয়ানচোর এক একটি দৃশ্যক্রমের স্থিতিকাল (duration) কাট ব্যবহার না করে নিরবচ্ছিন্নভাবে কমপক্ষে ১০ মিনিট ধরে সিনেমার পর্দায় বিরাজ করে। তার সব ছবিই ১০ থেকে ১৩টি দৃশ্য পর্যায়ে বিভক্ত থাকে। এ এক আশ্চর্য ক্যামেরা গতি। সিনেমার স্টাইল গড়ে ওঠার নেপথ্যে নানা প্রযুক্তিগত বিবর্তনের একটা বড় ভূমিকা অনস্বীকার্য। গত ষাট বছরে নানা শ্রেণীর চলচ্চিত্রোপযােগী ক্যামেরার উদ্ভাবন ও গভীরতর লেন্সের বিবর্তনে ইওরােপীয় চলচ্চিত্রকারের। ছবির বিষয় বিন্যাসে ক্যামেরার বিবিধ উপকরণ ও বিবর্তনশীল পদ্ধতিকে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট করেছেন। তাদের একান্ত প্রয়াসে ইওরােপীয় সিনেমার চলচ্চিত্ররীতি নােতুন সংজ্ঞায় চিহ্নিত হয়েছে। পাশাপাশি ছবির জন্য ব্যবহৃত কাঁচা ফিল্মের তারতম্যও চলচ্চিত্রে ফোটোগ্রাফির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনে প্রভাবশীল হয়েছে। বােজালিনী তার নিজের ছবির জন্য Pancinor লেন্সের কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করেছিলেন। ১৯৬০-এর শেষ দিকে তিনি এই লেসের আরাে খানিকটা উন্নতি ঘটিয়েছিলেন যাতে প্যানিং ও জুমিংয়ের ফল পাওয়া যায় একই সঙ্গে। রােজালিনী ফরাসী টেলিভিশনের জন্য একটি ছবি করেন The Rise of Louise XIV, যেখানে এই নােতুন ধরনের Moving lens-এ চিত্রগ্রহণ করেন। অন্য আর একটি ক্যামেরা কৌশল ‘Sequence shot’ যা বাস্তবকে আরাে গােচরীভূত করে, তার উদ্ভব ঘটেছিল ফরাসী Plan-Sequence থেকে। অর্থাৎ একক একটি দৃশ্য-স্থির কিংবা সচল। ইটালীয়ান চিহ্নবিজ্ঞানী (Semiotician) গিয়ান ফ্রাঙ্কো বেত্তেতিনি এর কতকগুলাে বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তার মতে এই কৌশল কৃত্রিম শিল্প প্রকরণে পরিচালককে, ছবির বিন্যাস রীতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দে বিচরণের সুযােগ দেয়, অথচ যেখানে দীর্ঘ সময়ের তথ্যচিত্রসুলভ বৈশিষ্ট্য হারায় না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গােদার, আন্তনিওনি, ফ্রান্সিসকো রােসি, জোসেফ ললাসে, বার্তোটি প্রমুখের ‘সিকোয়েন্স শট কোনােভাবেই দৃশ্যকল্পের প্রতিরূপ ক্ষমতাকে তার দৃষ্টিকোণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় না।
‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জাঁ লুই কোমােল্লির প্রশ্নের উত্তরে এরিক রােমার সুন্দর মন্তব্য করেছিলেন–
‘The greatest danger to the cinema is the pride of the filmmaker who says: I have a style, and I want to draw people’s attention to it.”১৬
আসলে চলচ্চিত্র স্টাইলের বিবর্তন, যা মূলতঃ ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ নির্বাচন ও গতিময়তায় গড়ে ওঠে, তা হ’ল সিনেমা মাধ্যমের টেকনিকগুলাের সুসম্বদ্ধ ও বৈশিষ্ট্যমূলক। ব্যবহার। মনে রাখা দরকার যে, সিনেম্যাটিক উপকরণ যেমন ক্লোজআপ, দৃষ্টিকোণ, বস্তুর প্রত্যক্ষতা সব সময়েই চলচ্চিত্রে বিদ্যমান ছিল, কেবল তার নানা রকমের প্রকরণগত ব্যবহারের রীতি যুগ থেকে যুগে পাল্টেছে। আর তার থেকেই এক একটা স্বতন্ত্র স্টাইলের জন্ম। হলিউডের নির্বাক ছবি ছিল গতিসম্পৃক্ত ছবি, সে সব ছবিতে দৃশ্যের গতিই সময়কে চিহ্নিত করত, বিপরীতে চল্লিশ দশকের নিওরিযালিস্ট ছবি ও অন্যান্য ইওরােপীয় ছবিতে সময়ই গতির ব্যঞ্জনা দিয়েছে। নানা দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল স্টাইল বিবর্তনে রসদ জুগিয়েছে। এক্ষেত্রে স্টাইলগত ও আঙ্গিকগত সমস্যা নানা প্রদেশের সাংস্কৃতিক ও ভাবাদর্শের পারস্পরিক আদান প্রদানে নিজের পথ বেছে নিয়েছে। ডীপ ফোকাস ও তদানুষঙ্গিক প্রকরণ এবং সম্পাদনা মার্কিন ও ইওরােপীয় উভয় দেশের চলচ্চিত্রে উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচ্য ছিল, কেবল তার ধারণা বিবর্তিত হয়েছে।
মার্কিন ও ইওরােপীয় চলচ্চিত্রে পরিচালকের পাশাপাশি ক্যামেরাম্যানের কৃতিত্বকেও গভীর মূল্য দেওয়া হয়। ছবির পরিচয় লিপিতে ‘ডিরেক্টর অফ ফোটোগ্রাফি’ শিরােনামে ক্যামেরাম্যানের দায়িত্ব ও শিল্পনৈপুণ্য সেখানে আলাদা মর্যাদায় চিহ্নিত। চলচ্চিত্র ক্যামেরার নান্দনিক বিবর্তনে তাই ছবির পরিচালকের মতােই বহু ক্যামেরাম্যানের অবদান স্বীকৃত হয়েছে। একটি ছবির ক্যামেরা স্টাইলে পরিচালকের সঙ্গে যুগপৎভাবে ক্যামেরাম্যানও স্বকীয় শিল্প অনুধ্যান মেলে ধরেন। আন্তর্জাতিক সিনেমার এমন বেশকিছু ক্যামেরাম্যান তাদের চিত্রগ্রহণের দক্ষতায় আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। রুশ চলচ্চিত্রকার আইজেনস্টাইনের আলােকচিত্রী এডওয়ার্ড টিসে, ত্রুফোর ক্যামেরাম্যান নেস্টর এ্যালমেড্রস, বার্গম্যানের ক্যামেরাম্যান গুণার ফিশার ও সভেন নিভিস্ট, ভিসকস্তির রঙীন ছবির ক্যামেরাম্যান পি. ডি. স্যান্টিস, গােদারের ক্যামেরাম্যান রাউল কুতার, মার্কিন সিনেমার জেমস ওয়াং হাে, গ্রেগ টোল্যাণ্ড প্রমুখের অসংখ্য ক্যামেরা নিদর্শন, আলাের অভিনব বিন্যাস, গভীরতা ও মায়ামুগ্ধতায় ছবির স্বকীয় স্টাইলকে আমাদের দৃষ্টির কাছে নােতুন চেতনায় প্রতিভাত করেছে। একটি ছবির ফ্রেম নির্বাচন, দৃষ্টিকোণের পারম্পর্য, গতিময়তা সহ ছবির mise-en-scene অর্থাৎ সার্বিক মুড তৈরি করতে তাদেব শিল্পবােধ, পরাদৃষ্টি এবং সিনেম্যাটিক দক্ষতা পরিচালকের প্রাতিস্বিকতা প্রতিপাদনে বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করে।
বার্গম্যানের সাদা কালােয় তােলা ছবি ‘স্মাইলস্ অফ এ সামার নাইট, ‘দ্য সেভেন্থ সীল’, ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরীজ’ ছবির টোনাল টেক্সচার, বিন্যাস, দৃশ্যগঠনের গভীরতা যেমন গুণার ফিশারের ক্যামেরা আঙ্গিকে এক রূপ নেয়, তেমনি বার্গম্যানের ‘দ্য সাইলেন্স’ (সাদাকালাে), ‘ভার্জিন স্প্রিং’ (সাদাকালাে) এবং রঙে তৈরি ‘অটাম সােনাটা’, ‘ক্রাইজ এ্যাণ্ড হুইসপার’, ‘ফ্যানি এ্যাণ্ড আলেকজান্দার’ ইত্যাদি ছবির আলােক নিয়ন্ত্রণ, দৃশ্যক্রমের গভীরতা তথা সামগ্রিক কম্পােজিশনে নিভিস্টের আবেগময় মুড, ব্যাকগ্রাউণ্ড ও ফোরগ্রাউণ্ডের পারম্পর্য, অমােঘ Close-up-এর অভিঘাত, রঙের সংবেদনশীলতা নিভিস্টকে বিরল ক্যামেরাম্যান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। একই পরিচালকের সঙ্গে কাজ করলেও দুই আলােকচিত্রীর তৈরি দৃশ্যসজ্জার মুড ও গঠনশৈলী কতাে ভিন্ন মেজাজ বহন করছে। বার্গম্যানের ‘ক্রাইজ এ্যাণ্ড হুইসপার’ ছবিতে ব্যবহৃত রঙের সুষমতা, ব্যঞ্জনা ও আলােকনিয়ন্ত্রণের বিস্ময়কর নৈপুণ্যে নিভিস্টের দক্ষতা পরিচালককে ছবির গূঢ়ার্থ প্রতিপাদনে অনেক্টা সমর্থ করেছে। রেমব্রান্টের পেন্টিংসুলভ আলাে আঁধারির ঈর্ষণীয় ভারসাম্যতায় তৈরি দৃশ্যকল্পে বার্গম্যান ফ্রেমের আঁধারকেও আলাের অধিক গভীরতা দিতে পেরেছেন। এখানেই ক্যামেরা স্টাইলের সার্থকতা যুগপৎ পরিচালক ও আলােকচিত্রীর ঘনিষ্ঠ বােঝাপড়ায় মহৎ শিল্পে উত্তীর্ণ হয়েছে। ১৯৭১-এ তৈরি ভিত্তির ‘ডেথ ইন ভেনিস’ ছবিতে Zoom lens-এর ব্যবহার অমােঘতা পেয়েছে। ছবির কাহিনীকেন্দ্রিক বিষন্নতা, আসন্ন মৃত্যুর দিকে অপ্রতিরােধ্য তাড়নায় ছবির নায়কের ভ্রাম্যমাণতাকে মহামারী আক্রান্ত শহরের বীভৎসতা ও কারুণ্যের প্রেক্ষাপটে চিত্রিত করেছেন পরিচালক জুম-এর অনবদ্য ব্যঞ্জনাময় প্রয়োগে—
“to a series of zoom shots among decaying characters and situations, zooms that neither select nor reveal, but only pile on non-signifying details inoperatic proportions.”১৭
এর ভেতর দিয়েই বেরিয়ে আসে ভিসকন্তির দেখা ও দেখানাের শিল্পপ্রবণতা, তার স্টাইল, যা ক্যামেরাম্যানের অন্তরঙ্গ সাহচর্যে শিল্পরূপ পায়।।
একালের আন্তর্জাতিক সিনেমার প্রথম সারির ক্যামেরাম্যান নেস্টর এ্যালমেন্ড্রস সিনেমার অধীত শিক্ষা ও তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কেন্দ্রিক অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছেন চমৎকারভাবে।
“We learn about eras before the twentieth century through painting, that is, through colours. We know the first third of this century through black and white cinema more than anything else. I admit I have a conditioned reflex. As a spectator of director of photography, I ‘see’ periods before our own in colour. However, in the case of the film that reconstructs the decade of twenties, thities or forties, I feel that colour is an anachronism.”১৮
প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যেতে পারে যে, রেনােয়াও জানিয়েছিলেন–বিশ্বচলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মগুলাে তৈরি হয়েছিল সাদাকালাের প্যানক্রোমাটিক ফিল্মে। আসলে সাদা কালােয় তৈরি ছবি সিনেমার মানচিত্র থেকে এখন নির্বাসিত-প্রায়। কুরােসাওয়া, ওয়াইলার, হিচকক, ড্রেয়ার, ওরসন ওয়েলস্, আন্তনিওনি, বার্গম্যান, নিওরিয়ালিস্ট যুগের সহজ অথচ গভীর হৃদয়গ্রাহী সাদাকালােয় তৈরি একাধিক ছবির বিস্ময়কর চিত্রবিন্যাস আমাদের আজও মুগ্ধ করে। রঙের আবির্ভাব, রঙীন ফিল্মের নিত্যনতুন আবিষ্কার, চল্লিশ দশকের টেকনিকালার থেকে ১৯৪৯-এর ইস্টম্যানকালার নেগেটিভের প্রচলন, নানা ক্ষমতা সম্পন্ন ফিলটার ইত্যাদি বিভিন্ন রূপান্তরে জাত রঙীন ফোটোগ্রাফি আধুনিক চলচ্চিত্রে নােতুন ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়েছে। পুরােনাে কালের পরিচালক এবং একালের আধুনিক চলচ্চিত্রকারের। রঙীন আলােকচিত্রের মায়ায় তাদের উৎকৃষ্ট কিছু শিল্প ফসল উপহার দিয়েছেন। যেটা মনে রাখা দরকার সেটা হ’ল, ছবির ফ্রেম নির্বাচনে, স্থান ও কালের বস্তুতান্ত্রিকতা ও মন্ময় বাস্তবতা প্রকৃত সত্যে অবলােকন করার ক্ষেত্রে সেই মানুষটির দিব্যদৃষ্টির প্রয়ােজন, যিনি ক্যামেরার লেন্সের মাধ্যমে ফ্রেম, দৃশ্যক্রম, গতিময়তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে দেখবেন ও আবিষ্কার করবেন।
এটা লক্ষণীয় যে, গত চল্লিশ বছরে ক্যামেরার যান্ত্রিক পদ্ধতির খুব একটা রূপান্তর হয়নি। কেবল বিগত যুগের ক্যামেরার তুলনায় একালের ক্যামেরা অনেক হাল্কা এবং বহনযােগ্য হয়ে উঠেছে। যার ফলে হ্যাণ্ড হেল্ড ক্যামেরার সহজ স্বচ্ছন্দ ব্যবহার ইওরােপীয় ছবির নান্দনিক রীতিতে অন্য এক মাত্রা দিয়েছে। যতটুকু নবরূপায়ণ ঘটেছে, তা সাধিত হয়েছে লেন্সের ক্ষেত্রে। আজকের আধুনিক সিনেমায় ব্যবহৃত অতি উজ্জ্বল ও অতি সংবেদনশীল লেন্সের তারতম্যই ছবির দৃষ্টিকোণ কেন্দ্রিক শৈলীর সূত্রপাত ঘটিয়েছে। নেস্টর এ্যালমেড্রস ফরাসী সিনেমার দৃশ্যের উজ্জ্বলতা গড়ে তুলতে আয়নার ব্যবহার প্রথম প্রচলন করেন। এটা রাউল কুতারের ‘ফোটোফ্লাড’ প্রথার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। কুতার সিলিংয়ের ওপর থেকে ফ্লাড লাইট ঝুলিয়ে রেখে দৃশ্যের আলোেক নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষপাতী ছিলেন যেখানে আলো বিচ্ছুরিত হলেও কোননা প্রতিচ্ছায়া থাকবে না। সৃজনশীল চলচ্চিত্রকারের পর্যবেক্ষণ রীতিকে সুষম ভঙ্গিতে ছবির ফ্রেম রূপায়িত করার ক্ষেত্রে ক্যামেরাম্যানকেও অনেকক্ষেত্রে নােতুন উদ্ভাবনের পথে যেতে হয়। ক্যামেরাম্যানের তন্নিষ্ঠ বােধ ও শিল্প এযণা সেক্ষেত্রে স্রষ্টার স্টাইলকে আরাে বিশিষ্ট করে তােলে। এ্যালমেড্রস ফোর সঙ্গে কাজ করার প্রসঙ্গে লিখেছেন—
Truffaut’s ‘calligraphic work, which Adele H, The Green Room and Last Metro continued. This elaborated, stylized film making allowed me to introduce refinements of lighting and framing that had never used before.”১৯
ফোর ‘Two English Girls’ ছবিতেও অনুরূপভাবে এ্যালমেড্রস পীরিয়ড লাইটিংয়ের প্রতিভাস গড়ে তােলার জন্য প্রথম অয়েল ল্যাম্পের আলাের সাহায্য নিয়েছিলেন।
স্ট্যানলি কুব্রিক ১৯৭৫ সালে যখন থ্যাকারের উপন্যাস নিয়ে তাঁর ‘ব্যারী লিণ্ডন’ ছবি তােলেন, তখন তিনি পীরিয়ড পীস নির্মাণের স্বার্থে দৃশ্যগত আলাের জন্য একই ধরনের পরীক্ষা চালিয়েছিলেন এবং চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছিলেন। কাহিনীকেন্দ্রিক আঠারাে শতকের পরিমণ্ডল গড়ে তােলার জন্য তিনি ছবির অন্তদৃশ্য গ্রহণে আঠারাে শতকের মােমবাতিদানের আলাের ব্যবহার করেছিলেন। সেইসঙ্গে ছবির আলােকনিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ লেন্সের প্রয়ােজন হয়েছিল। এক্ষেত্রে Zeiss Company নাসার মহাকাশ ফোটোগ্রাফির জন্য ব্যবহৃত লেন্সের আরাে উন্নয়ন ঘটিয়েছিল যা ছবিতে চূড়ান্ত সাফল্যে কাজে লাগানাে হয়। এই লেন্সটির অনুপাত ছিল f0.9, যেক্ষেত্রে সিনেমায় সাধারণভাবে গভীরতম লেন্সের অনুপাত হ’ল {1.25; কুব্রিকের এই নাসা লেন্স প্রায় সাধারণ f1.2 লেন্সের আলােকধারণের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ। আলােকধারণের ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল।
যেকালে আধুনিক সিনেমায় ফোকাল লেংথ অনুসারে ৩৫ থেকে ৫০-এর সাধারণ নর্মাল। লেন্স থেকে শুরু করে ১৮ ও ২৫-এর ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স, ১০০, ১৫০ মিলি মিটার ছাড়িয়ে ১০০০ মিলি মিটারের টেলিফোটো লেন্সের আশ্চর্য ব্যবহার ঘটেছে, সেখানে বিশ্বের অন্যতম পরিচালক রােবের ব্রেসঁ তাঁর ছবির ঘটনাক্রম ও স্থানকালের পারম্পর্য তুলে ধরার জন্য প্রায় ক্ষেত্রেই গ্রহণ করেন তার প্রিয় ৫০ মিলি মিটারের লেন্স। তাতেই তার ছবির প্রার্থিত শিল্পরূপ গড়ে ওঠে। সিনেমার জন্মলগ্ন থেকে ৩৫ মিলি মিটারের ফিল্মই প্রচলিত মাপ ছিল। পঞ্চাশ দশকের শেষে আবির্ভূত হয় ৭০ মিলি মিটারের ফিল্ম ফরম্যাট। South Pacific, Cleopatra, Lawrance of Arabia, DR Zivago, Gran Prix, 2001 : A Space Odyssey-র মতো বিপুল জনপ্রিয় ছবির বর্ণাঢ্যতায় এই ফরম্যাট বাণিজ্যিকভাবে বহুল প্রচলিত। এখন আবার এর থেকেও আরাে ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন প্রসারিত মাপের Imax ফিল্ম ফরম্যাট এসে গেছে। এর আগে চলচ্চিত্রের ক্যামেরা টেকনিকের প্রাথমিক উপাদান হিসেবে সিনেমাস্কোপের প্রচলন হয়েছিল। এখানে তদনুযায়ী লেন্সও তৈরি করতে হয়েছিল। এই রীতির মধ্যে খানিকটা খােলামেলা মুক্ত শিল্প স্বভাব ছিল। ওয়েলস্, ওয়াইলার, আন্তনিওনির মতাে চলচ্চিত্রস্রষ্টারা এই রীতির প্রতীক্ষায় ছিলেন। আন্তনিওনি তাঁর Le Amiche ছবিতে চওড়া পর্দার অনুযায়ী দৃশ্যগ্রহণের ব্যাপকতায়, দীর্ঘ সময়ের ট্রাকিং শটে পরিবেশ ও চরিত্রদের অবস্থানকে আরাে সম্পৃক্ত করে তােলেন। লাভেন্তুরা’ ছবির চওড়া পাও তাকে হতাশা, বিচ্ছিন্নতা ও পরিবেশের মুডকে বিষয় অনুযায়ী আরাে অব্যর্থ দৃশ্যময়তায় উপনীত হবার সুযােগ দেয়। সিনেমাস্কোপআধুনিক ইওরােপীয় চলচ্চিত্রকারদের কাছে দৃশ্যগ্রাহ্যতার নিরিখে আরাে এক মাত্রা যােগ করে। সিনেমাস্কোপের পর্দায় পরিচালক তার দরকার মতাে, বিষয়ানুগ দ্রুত এবং ক্রস কাটিং, এমনকি বড় ক্লোজ-আপের ব্যবহারও শৃংখলার সঙ্গে করতে পারেন। এর নিদর্শন ত্রুফো, রােসি, আন্তনিওনি প্রমুখের ছবিতে ছড়িয়ে আছে।
আদিতে চলচ্চিত্রের পর্দার অনুপাত ছিল ১:১.৩৩। পৃথিবীর বহু অসাধারণ ছবি এই ফরম্যাট অনুযায়ী তৈরি হয়েছিল। পরে লেন্সের ও ফিল্মের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পর্দাও ক্রমপ্রসারিত হতে থাকে। পরে পর্দার অনুপাত হয় ১:১.৮৫ ফরম্যাটের, যা সিনেমাস্কোপ ও ১ : ১.৬৬ ফরম্যাটের মধ্যবর্তী একটা অনুপাত। মার্কিন মুলুকে এটা বহুল প্রচলিত।
এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি, চলচ্চিত্রের প্রথম তাত্ত্বিকদের মধ্যে ভ্যাকেল লিণ্ডসের ব্যাখ্যা ও দার্শনিক হুগাে মুন্সটারবার্গের আলােচনায় শিল্প হিসেবে সিনেমাকে চিহ্নিত করার প্রাথমিক প্রয়াস দেখা গিয়েছিল। সেই থেকে শুরু করে ষাট দশকের শেষ পর্বে প্রকাশিত খ্রশ্চিয়ান মেজের সিনেমার গঠনতান্ত্রিক তাত্ত্বিক আলােচনা ও একালের অন্যতম চিহ্নবিজ্ঞানী উমবার্তো ইকোর আধুনিক বিশ্লেষণ চলচ্চিত্রের বিন্যাস রীতি, প্রকরণ ও দৃশ্য নির্মিতির সার্বিক স্টাইলের নানা রন্ধ্রে ছায়া ফেলেছে। তারই মধ্যবর্তী সময়ে নানা পর্বে এসেছে কুলেশভ, আইজেনস্টাইন, পুদভকিন, বেলা বালাজ, আর্নহাইম, আন্দ্রে বাজ প্রমুখ প্রবাদপ্রতিম শিল্পতাত্ত্বিকদের চলচ্চিত্র নন্দন ব্যাখ্যার বিপুল সম্ভার। স্বকীয় ভাষা ও ব্যাকরণে গভীর সম্পৃক্ত হয়ে চলচ্চিত্র আধুনিক বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশক্তিশালী শিল্প মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। তারই পাশে গত আশি বছরে এক্সপ্রেসনিজম, সিনেমা ভেরিতে, নিওরিয়ালিজম, পরাবাস্তবতা, মন্তাজ প্রক্রিয়া, ডাইরেক্ট সিনেমা, ফ্রী সিনেমা, নবতরঙ্গ, সিনেমা নােভ ইত্যাদি নানা অভিধা ও ব্যঞ্জনায় চলচ্চিত্রের শরীর ও আত্মার মূর্ত ও বিমূর্ত রূপ আমরা দেখেছি।
এক প্রজন্মের শিল্পী পূর্বতন যুগের স্রষ্টার অভিজ্ঞানকে নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রায়ােগিক দক্ষতায় নােতুন করে পরখ করতে চেয়েছেন। তেমনি প্রবহমান পরবর্তী সময়ের আধুনিক স্রষ্টারাও তাবৎ অতীতের শিল্পবিন্যাস-লব্ধ চেতনায় আজকের সময়টাকে তাদের শিল্পনির্মিতিতে ধরার নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। স্টাইল তাই যুগ থেকে যুগে বিবর্তনশীল। বিভিন্ন দেশের স্টাইলের ক্ষেত্রে যেমন সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি প্রভাব ফেলেছে তেমনি দেশজ রাজনৈতিক আবর্ত ও আন্তর্জাতিক শিল্পমননও স্টাইল পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। কেবল দৃষ্টিনন্দন উপভােগের মানদণ্ডে নয়, চলচ্চিত্রের প্রসারিত পর্দায় ক্যামেরা মানুষের হৃদয় ও মানস, চিন্তাচেতনা ও সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক স্তরের গভীরে ডুব দিয়ে এক একটি মূল্যবান হীরকখণ্ড আহরণ করে আনছে। শিল্পীর প্রাতিস্বিকতার স্বাতন্ত্রে সেখানে আপন স্বভাবেই গড়ে উঠেছে নবনব স্টাইল। হলিউড সিনেমার প্রবণতা ও অভিপ্রায় থেকে মৌলিক ভিন্নতাতেই গড়ে উঠেছিল ইওরােপীয় চলচ্চিত্রের অভিনব শিল্প আঙ্গিক, যাকে আমরা বলতে পারি-ক্যামেরার দিব্যদৃষ্টি। চলচ্চিত্রের বিবিধ উপকরণ ও প্রয়ােগ কৌশলকে অবজ্ঞা না করেও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, চলচ্চিত্র শিল্পের প্রধান ও সর্বব্যাপী হাতিয়ার হ’ল ক্যামেরা। ক্যামেরার চলনভঙ্গিই এক একজন চলচ্চিত্র স্রষ্টার স্টাইলের ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে। সিনে দর্শকের অভ্যস্ত চোখ সঠিকভাবে চিনে নেয় ছবির জনককে। ফ্রান্সের ‘অথর থিয়ােরী’র সুচনাই হয়েছিল সেই দার্শনিক ভায্য থেকে। পশ্চিমী ফিল্ম কালচারে হলিউডের দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর বিপুল আধিপত্যের সমান্তরালে ইওরােপীয় সিনেমার নব্য রীতির ক্যামেরা আঙ্গিক চলচ্চিত্রের দৃষ্টিগ্রাহ্য নন্দনে নতুন ভাষ্য রচনা করেছিল। নিজের ছবির ক্যামেরাম্যানের লেখা গ্রন্থের ভূমিকায় ত্রুফো শ্রদ্ধা সহকারে সিনেমার স্টাইল গঠনে আলােকচিত্রীদের অবদান স্মরণ করেছিলেন। তাঁর মতে ক্যামেরাম্যানই জানেন—
“How to prevent ugliness on the screen. How to purify the image in order to increase its emotional force. How to render plausibly stories that take place before the twentieth century. How to reconcile elements both natural and artificial, timeless and dated, in the same frame. How to give homogeneity to disparate material. How to struggle against the sun, or bend to its will. How to interpret the desires of a director who knows exactly what he does not want but can’t explain what he does want?”২০
চলচ্চিত্র পরিচালকের ইত্যাকার সব চাওয়াকে ও অপুর্ণতাকে পরিপূর্ণতা দেন একজন সুযােগ্য ক্যামেরাম্যান। আর ইওরােপীয় চলচ্চিত্র ভিস্যুয়ালের নান্দনিক পরিকাঠামােয় পরিচালক ও ক্যামেরাম্যানের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতাই সেখানকার চলচ্চিত্রের স্বাতন্ত্র উজ্জ্বলতর করেছে।
উল্লেখপঞ্জীঃ
- Andre Bazin—What is Cinema-Les Edition du Cerf, 1958-VOL-1 Page – 15 *.
- Siegfried Kracaur-Theory of Film-Oxford University Press-New York-1965– Page-IX
- Andre Bazin—What is Cinema-VOL-1 Page -18
- Realism in Cinema: A Reader (Edited Christopher Williams/Routledge & Kegan Paul) London, 1980-Page-71-72
- Nestor Almendros—A Man with a Camera (Faber & Faber) London, 1980/Page-4
- Henri Langlois-Translated by Tom Milne-Reprint in Cinema : A Critical Dictionary [Edited : Richard Roud) The Viking Press/N. York, 1980/VOL-1, Page-428-429]
- A Thesis on Neo-Realism : in Overbey, Springtime, Page-69 Quoted in ‘The Altering Eye’-Robert Phillip Kolker (Oxford University Press/1983/Page-26)
- The Altering Eye : Robert Phillip Kolker Page-33
- The Haunted Screen–Lotte Eisner (Barkley and Los Angeles : University of California Press. 1973/Page-151)
- Jean Renoir–Andre Bazin-Translated by W. W. Halsey II and William H Simon (N. York, Simor & Schuster 1973/Page-87)
- Quoted in ‘Dictionary of Films’- Translated and Edited by Peter Morris (Barkley & Los Angeles, University of California Press, 1972) Page-379-380
- The Philosophical Basis of Neo-Realism–Felix A-Morlion Overbey, Springtime, Page 121 (Quoted in ‘The Altering Eye’-Robert Phillip Kolker-Page-45)
- Godard on Godard : Edited Jean Narboni & Tom Milne, Translated by Tom Milne (N. York : Viking Press/1972) Page-146-147
- The Birth of a New Avant-Garde · La Camera Stylo published in ‘The New Movie’, Edited by Peter Graham (Garden City/N. York, Doubleday, 1968)-Page-22
- The Altering Eye : Robert Phillip Kolker_Page-265
- 16 Quoted in ‘The Altering Eye’.-Page-250
- The Altering Eye-Page-81
- Nestor Almendros-A Man with a Camera. (Faber & Faber; 1980) Page-15
- Ibid – Page-104
- Francois Truffaut-‘The tights of Nestor Almendros’ in ‘A Man with a Camera’- Nestor Almendros (Faber & Faber, London, 1980)–Page-VI.