লিখেছেনঃ বীরেন দাশশর্মা
হেনরি ফক্স ট্যালবট, ফোটোগ্রাফির অন্যতম স্রষ্টা, আঠারােশাে ঊনচল্লিশ সালে তাঁর নােটবুকে বাস্তবের প্রতিচ্ছবি গ্রহণের এই অসাধারণ প্রযুক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ফোটোগ্রাফিকে ‘words of light’ বলে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে ফোটোগ্রাফি আসলে আলাের সাহায্যে লেখাআর ক্যামেরা ‘pencil of nature’ মাত্র। ট্যালবটের নােটবুক প্রমাণ করে যে ফোটোগ্রাফি নামক নতুন মাধ্যমটি নিছক কারিগরি প্রযুক্তি নয়, ক্যামেরা শুধুমাত্র এক ‘বিশেষ যত্ন’ নয়— এখানে প্রযুক্তি, ছবি, ভাষা ও মানুষের সহজাত প্রকাশভঙ্গির এক অনন্যসাধারণ সমন্বয় ঘটেছে। পরবর্তীকালে, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ফোটোগ্রাফিকে যখন ‘first truly revolutionary means of reproduction’ বলেন, তখন তিনিও ফোটোগ্রাফির ভাষাগত বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করে নেন। ক্যামেরার মধ্যে দিয়ে শুধু চিত্রগ্রহণ নয়, ‘রচনা’ করার বিষয়টিকে বেঞ্জামিন যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দেখান যে চিত্রভাষার সঙ্গে মতাদর্শের এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। একথা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে ফোটোগ্রাফি থেকে সিনেমাটোগ্রাফি, অর্থাৎ চিত্র থেকে চলচ্চিত্রের বিবর্তন একভাবে দেখলে। বস্তুত আলাের বর্ণমালা থেকে আলাের চিত্রনাট্যেরও বিবর্তনের ইতিহাস। এই বিবর্তনের ইতিহাসে হলিউড এক বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছে সন্দেহ নেই। নির্বাক যুগের অসংগঠিত চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাসকে যদি আমরা মূলতঃ মাধ্যমটির প্রকরণগত ও প্রযুক্তিগত পরীক্ষা নিরীক্ষার সাহায্যে এই দৃশ্য-ভাষা সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে সবাক যুগে সেই ভাষা যে এক সংগঠিত রূপ পেয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ক্যামেরা নামক ‘প্রকৃতির পেনসিল’ হলিউডের ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে এক নিজস্ব ধারায়, সৃষ্টি করেছে এক নিজস্ব বাচনভঙ্গি এবং এক নিজস্ব ভাষা।
চলচ্চিত্র ভাষার অন্যতম স্রষ্টা ডি. ডাব্লিউ. গ্রিফিথ তাঁর নিজস্ব বাচনভঙ্গি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন যে তিনি শুধু মাত্র দেখাতে চেয়েছেন এখানে ‘দেখানাে’ অর্থে গ্রিফিথ চলচ্চিত্র-ভাষাকে ব্যবহার করার কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিকে, ক্যামেরাকে অভিনবভাবে প্রয়ােগ করার যথার্থতাকে বােঝাতে চেয়েছিলেন। প্রাত্যহিক জীবনের ‘দেখা’ এবং চলচ্চিত্রায়িত জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখার মধ্যে যে গুণগত, প্রকরণগত, ভাষাগত পার্থক্য রয়েছে গ্রিফিথ নানাভাবে তা তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন বারংবার। গ্রিফিথের হাত ধরেই হলিউডের চিত্রভাষার সৃষ্টি, দৃশ্য রচনার নির্দিষ্ট ব্যাকরণের উদ্ভব।
চিত্রগ্রহণের ক্ষেত্রে চিত্রগ্রাহক কিভাবে কাজ করবেন, কিভাবে দৃশ্য রচনা করবেন, আলাে এবং রঙের ব্যবহার করবেন, শট ও কম্পােজিশন সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত নেবেন তা অনেকটাই কারিগরি প্রকরণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ক্যামেরার মডেল, ব্যবহৃত ফিল্মের মান, প্রাপ্তব্য লেন্স, আলােইত্যাদি নানা প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা অথবা সম্ভাবনা চিত্রগ্রাহককে প্রভাবিত করে একটি। ছবির নান্দনিক রূপ ঠিক করতে সাহায্য করে। চলচ্চিত্র প্রযুক্তির সঙ্গে চিত্রায়িত ছবির নান্দনিক রূপের সম্পর্কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাক যুগের গােড়া থেকে যদি ধারাবাহিক ভাবে দৃশ্যগ্রহণের কৌশল এবং শিল্পী হিসাবে ক্যামেরাম্যানদের বিশিষ্ট হয়ে ওঠার বিবর্তনকে পর্যালােচনা করা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাব কিভাবে চিত্রগ্রাহকরা প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছবির পর ছবিতে নান্দনিক মাত্রা যুক্ত করবার ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন। নির্বাক যুগের হাতে ঘােরানাে ক্যামেরা ছিল হালকা এবং বহনযােগ্য। ব্যবহৃত ফিল্মের দৈর্ঘ্য ছিল ছােট, এবং ফিল্ম যথেষ্ট আলােক-সংবেদনশীল ছিল না। এর ফলে ক্যামেরা ছিল প্রচণ্ড রকমের সর্বত্রগামী, প্রতিটি শটের দৈর্ঘ্য হত ছােট, হাতে ঘােরানাের ফলে এক্সপােজারের তারতম্য হতাে এবং চলমান বস্তু বা মানুষের গতি বাস্তবানুগ হত না। কাঁচা ফিল্মের গুণগত মান উন্নত না হওয়ায় সমস্ত রঙ ঠিকভাবে ধরা পড়তাে না সাদা কালাে ছবিতে। এর ফলে প্রায়ই দরকার হতে চড়া মেক-আপের। সব মিলিয়ে গৃহীত ছবি যথার্থ বাস্তবানুগ হয়ে উঠতে পারতাে না। নির্বাক যুগের কমেডি ছবিতে দেখা যায় কিভাবে সমকালীন ক্যামেরাম্যান এবং পরিচালকরা ক্যামেরার প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাকে ব্যবহার করে এক অসাধারণ চলচ্চিত্র ধারার (Genre) সৃষ্টি করেছেন। নির্বাক যুগের কমেডি ছবির প্রচণ্ড গতিশীল, ঘটনাবহুল, ‘নৈরাজ্যময় জগৎ’ যেখানে আধুনিক, সভ্য সমাজকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের কঠোর শরাঘাতে জর্জরিত করা হচ্ছে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার মধ্যেই একটি বিশিষ্ট চলচ্চিত্র-ভাষা তৈরি করার প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে। একই প্রকরণগত, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করে গ্রিফিথ ও তাঁর ক্যামেরাম্যান বিলি বিঞ্জার চলে গেছেন কমেডি ছবির সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। গ্রিফিথের সুচারু শট-ডিভিশন এক অর্থে পাশ্চাত্যের সামাজিক জীবনের মধ্যে থেকেই উঠে আসা, পাশ্চাত্য সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্রের ধারণার মধ্যে মিডশট, ক্লোজ-আপ ও বিগ ক্লোজ-আপের অদৃশ্য বিভাজন সামাজিকভাবে স্বীকৃত। শট ডিভিশন বস্তুত দূরত্ব ও নৈকট্যকে চিহ্নিত করে ব্যক্তির (দর্শক) সঙ্গে ব্যক্তির (ছবির চরিত্র)সম্পর্ক তৈরি করে। গ্রিফিথ যে ভাবে মেরি পিকফোর্ডের বিগ ক্লোজ-আপ ব্যবহার করেন ‘ব্রোকেন ব্লসমস্’ ছবিতে সেখানে দর্শক সামাজিকতার দূরত্ব ঘুচিয়ে মেরি পিকফোর্ডের অত্যন্ত কাছে চলে আসেন, তাঁর যন্ত্রণার শরিক হয়ে যান। দৃশ্য বিন্যাসের নন্দনতত্ত্বের মধ্যে নিহিত এই সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ চলচ্চিত্রের আলােচনায় এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
চলচ্চিত্রে প্রযুক্তির সঙ্গে নান্দনিকতার যােগসূত্র নিয়ে অসাধারণ মন্তব্য রয়েছে বাস্টার কিটনের নির্বাক ছবি ‘দ্য ক্যামেরাম্যান’-এ। এ ছবির নায়ক কিটন এক অশিক্ষিত ক্যামেরাম্যান যে এই বিশেষ প্রযুক্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছাড়াই ছবি তােলার কাজে নিযুক্ত হয়। কিটন চমৎকার হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে দেখান যে কিভাবে এক অনভিজ্ঞ ক্যামেরাম্যান ঘটনাক্রমে নিজের অজান্তেই, কোনাে তাত্ত্বিক ধারণা ব্যতিরেকে জিগা ভের্তভের সমতুল্য হয়ে ওঠেন। ছবিতে একই ফিল্মে একাধিক দৃশ্যধারণের দুর্ঘটনা থেকে উদ্ভূত যে নান্দনিক সম্ভাবনাকে স্টুডিওর কতারা ‘অপচয়’ বলে বাতিল করে দেন, অন্য দেশে, অন্য সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা এক বিশিষ্ট নান্দনিক আন্দোলনের সূচনা করে। কমেডি ছবির ক্ষেত্রে ক্যামেরাম্যানের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যামেরার ফোকাস হওয়া দরকার প্রচণ্ড । নখুঁত- কেননা অভিনেতাদের আচরণের খুঁটিনাটি পর্যন্ত দর্শকের কাছে পরিষ্কার করে তুলে ধরা ছিল প্রাথমিক দায়িত্ব। ফ্রেম সম্পর্কে ক্যামেরাম্যানকে অত্যন্ত সজাগ থাকতে হতাে—কেননা ফ্রেমের ভেতরে ও বাইরের স্থান কমেডির অভিনয় ও নির্দেশনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সর্বোপরি, ক্যামেরাম্যানদের সর্বদাই ক্যামেরার বিশেষ কলাকৌশল সম্পর্কে অবহিত থাকতে হতাে কেননা ক্যামেরা ট্রিকস এবং কমিক অভিনয় ও স্টান্ট-এর মেলবন্ধন ঘটেছিল কমেডি ছবিতে। কিটনের ক্যামেরাম্যান এলগিন লেসলি হাতে ঘােরানাে ক্যামেরায় অবিশ্বাস্য নৈপুণ্যে বাস্টার কিটনের একই সঙ্গে নটি চরিত্র সেজে অভিনয় করাকে ধরেন ‘প্লে হাউস’ ছবিতে যা সকলকে অবাক করে দিয়েছিল। শার্লক জুনিয়র’ ছবিতে লেসলি চলচ্চিত্র-স্বপ্ন-বাস্তবকে যেভাবে রূপ দিয়েছিলেন তা এক কথায় ছিল অবিশ্বাস্য। কমেডি ছবির ক্যামেরাম্যানদের উদ্ভাবনী শক্তি, ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল সম্পর্কে চমৎকার ধারণা, ‘ট্রিক শট’ তৈরির ক্ষমতা কমেডি ছবিকে এক নতুন ভাষা দিয়েছিল সন্দেহ নেই। পরিচালক ও অভিনেতা বিশেষে বিভিন্ন ঘরানাও তৈরি হয়েছিল।
অন্যদিকে, কাহিনীচিত্রের ক্ষেত্রে গ্রিফিথের অনুপ্রেরণায় হলিউড চলচ্চিত্রভাষাকে এক সার্বজনীন ভাষা হিশেবে তৈরির ক্ষেত্রে ক্যামেরার নিজস্বতাকে ব্যবহার করেছিল। শট ডিভিশনের, ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের, আলাের প্রয়ােগের এবং সম্পাদনার প্রাথমিক শর্তগুলাে, প্রাথমিক নিয়মগুলাে স্বীকৃত হয়ে যায় নির্বাক যুগেই। কাহিনীর প্রেক্ষিত, বিষয়বস্তু, চরিত্রের মানসিকতা, নাটকীয়তা তৈরির ক্ষেত্রে কতগুলাে সুনির্দিষ্ট প্রথা বা রীতির প্রায়ােগিক সাফল্য এক ধরনের অনুকরণপ্রিয়তার জন্ম দিল। এরই ফলে দেখা গেল চলচ্চিত্র কাহিনীর নির্বাচনে এবং তার চলচ্চিত্রায়ণে এক ধরনের ফমূলা নির্ভরতা। প্রতিটি নির্দিষ্ট ধারার (genre) ছবি নির্দিষ্ট দৃশ্যকলার নিয়ম মেনেই তৈরি হতে শুরু করে। কমেডি ছবি, সামাজিক ছবি, অপরাধমূলক ছবি, ওয়েস্টার্ণ বা হরর ছবির নিজস্ব চিত্র-ভাষা (Visual Language) এবং ভাষা-রীতি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের হাতে ক্রমেই পরিশীলিত হয়ে উঠতে থাকে। সুচারু কাহিনী বিন্যাসের দাবিতেই ক্যামেরাম্যানদের পরিচালকের দাবি মতাে প্রতিটি দৃশ্যকে একাধিক শটে বিভাজিত করে পৃথক পৃথক ভাবে রচনা করতে হয়। একটি শটের সঙ্গে অন্য শটের সম্পর্ক, এক দৃষ্টিকোণ থেকে অন্য দৃষ্টিকোণে ক্যামেরার অবস্থান পরিবর্তন, সহজ থেকে জটিলতম গতিমান শট-ইত্যাদির সাহায্যে চিত্রভাষাকে আরাে সমৃদ্ধ করে তােলা, ফোটোগ্রাফিক কম্পােজিশনে সাধারণ নিয়মগুলােকে সৃজন মূলক ভাবে চলচ্চিত্রে প্রয়ােগ, আলাে ও রং-এর নানা প্রয়ােগ রীতি—সবই ধীরে ধীরে হলিউডের চিত্রভাষায় এক সুনির্দিষ্ট রূপ পেতে থাকে।
উনিশশাে কুড়ি সালের পূর্ব পর্যন্ত ফোটোগ্রাফির সীমাবদ্ধতার প্রধান কারণ ছিল প্রযুক্তিগত। অনুন্নত যন্ত্রপাতির পাশাপাশি ব্যবহৃত হত ‘অর্থক্রোম্যাটিক ফিল্ম’ যা সমস্ত রং-এর বিভাজনকে সঠিকভাবে এবং সম্পূর্ণ রূপে ধরতে পারত না। এরই সঙ্গে ছিল আলাে ব্যবহারের কৌশল সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাব। চলচ্চিত্রের প্রথম যুগে ক্যামেরাম্যানদের প্রধান কাজ ছিল মােটামুটি উজ্জ্বল ভাবে ক্যামেরার সামনে ঘটমান দৃশ্যকে রেকর্ড করা। এজন্য বিষয়বস্তুর উপরে সরাসরি আলােকপাত করা হত এবং শুধুমাত্র যথেষ্ট আলােকিত ব্যক্তি ও বস্তুই দৃশ্যমান হত। আধাে আলাে আধাে অন্ধকার বা অন্ধকারের ধারণাকে ফুটিয়ে তােলা ছিল অত্যন্ত কঠিন। বহিদৃশ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আলােকে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। এ সমস্ত কারণেই সে যুগের ছবি ছিল অনিবার্যভাবেই সাদামাটা। আলাে এবং অন্ধকারের বৈপরীত্য ছাড়া সে যুগের ছবিতে সাদা-কালাের অন্য কোনাে ক্রমপর্যায় ধরা পড়ত না। এই প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার সঙ্গে কিছুটা যেন খাপ খাইয়েই সে যুগের ছবি হত সহজ সরল।
১৯২০ সালের পর থেকে অপেক্ষাকৃত উন্নততর ফিল্ম এবং ক্যামেরা আসার পরে আমেরিকা ও ইউরােপের ছবিতে পােষাক পরিচ্ছদ, সেট এবং নাটকীয়তার উপর ঝোক বাড়তে থাকে। এই সময়ের ছবিতে শরীর এবং মুখাবয়ব, চরিত্রের আবেগ, অনুভূতি ফুটিয়ে তােলার জন্য আলাের নাটকীয় ব্যবহার লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। যদিও রূপসজ্জা ছিল অপেক্ষাকৃত চড়া মাত্রার এবং অর্থক্রোম্যাটিক ফিল্ম’ যদিও লাল রং-কে কালাে করে ফেলত তবু ফোটোগ্রাফি যে এক বিশেষ ভাষা তৈরি করতে পারে তা এই সময়েই সর্বজনস্বীকৃত হয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্রে শব্দ যােগ হবার আগে থেকেই চলচ্চিত্রের এক সার্বজনীন ভাষা এবং ব্যাকরণ তৈরি করার স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। চলচ্চিত্র নির্মাণ সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখায় এবং বইপত্রে কিভাবে ছবি তুলতে হয়, কিভাবে শট ডিভিশন করতে হয়, সম্পাদনার কলাকৌশল এবং আলাের ব্যবহার সম্পর্কে নানা পাঠ দেওয়া হতে থাকে। চলচ্চিত্র নির্মাণ কর্মের সঙ্গে যুক্ত মানুষরাও নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বিনিময় করতে থাকেন। ভাষা হিশাবে এই মাধ্যমটি এক ধরনের স্বীকৃতি পেলেও এর ব্যাকরণ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। হলিউড এবং ইউরােপের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে সুচারুভাবে গল্প বলাই ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। হলিউড ও ইউরােপে ধারাবাহিক ভাবে চলচ্চিত্র চর্চার মধ্য দিয়ে চিত্রভাযা-র বেশ কিছু রীতি নীতি সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। দেখা যায় যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় সকলেই গল্প বলার ক্ষেত্রে সচেতন বা অসচেতন ভাবে এই রীতি নীতিকে অনুকরণ করতে শুরু করেছে। চলচ্চিত্রের অন্য বিভাগের মতই চিত্রগ্রহণের ক্ষেত্রে, দৃশ্যকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে একইভাবে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রথা তৈরি হয়ে গেল। শট ডিভিশনের ক্ষেত্রে ছবির শুরুতে এবং নতুন দৃশ্যের শুরুতে কাহিনীর কাল্পনিক জগতে দর্শককে প্রবেশ করতে সাহায্য করার জন্য বিশেষ শট (establishing shot) ব্যবহার করা নিয়ম মাফিক হয়ে ওঠে। লং শট, মিডিয়ম শট, ক্লোজ আপের ব্যবহারের ক্ষেত্রে তৈরি হলাে নির্দিষ্ট প্রথা। ক্লোজ আপের ব্যবহার প্রচলিত হলাে ছবিতে বিশেষ নাটকীয় মাত্রা যােগ করার জন্যে। ক্যামেরার বিশেষ বিশেষ কৌণিক অবস্থান (high angle, low angle) অথবা ক্যামেরার গতিময়তা কাহিনী বিন্যাসে এবং চরিত্র চিত্রণে যে অতিরিক্ত মাত্রা যােগ করতে পারে সে সম্পর্কেও চলচ্চিত্রকার এবং চিত্রগ্রাহকেরা বিশেষ রকম সচেতন হয়ে ওঠেন। এরই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের লেন্স এবং তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতনতাও চিত্রগ্রহণের ক্ষেত্রে এক বিশেষ মর্যাদা পায়। ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধারার কাহিনীচিত্রের জন্য নির্দিষ্ট রচনাশৈলী সংগঠিত হতে থাকে। ওয়েস্টার্ন, মিউজিক্যাল, ফিল্ম নােয়া (Noir), হরর ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ ধারা (genre)-র ছবি দৃশ্যগতভাবে পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক। হরর ছবির আধিভৌতিক, অলৌকিক জগৎ যে ধরনের চিত্রভাষা এবং দৃশ্য রচনা শৈলী তৈরি করে তা অন্য সকলের থেকে আলাদা। একইভাবে ফিল্ম নােয়া (Noir)-তে আলাে এবং ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রচনাশৈলীর ছাপ পাওয়া যায়। হরর, ওয়েস্টার্ন এবং ফিল্ম নােয়া-র মতাে ধারাগুলি আলাে ও ক্যামেরার ব্যবহারের ক্ষেত্রে হলিউডের পরিকাঠামাের মধ্যেই এক নিজস্বতা সৃষ্টি করে।
ফিল্ম নােয়া-র “লাে কি” (Low-Key) এবং “হাই-কি”(High-Key) আলো, লম্বা ছায়া, সিলুয়েট ইত্যাদি অজানা, বিপদসঙ্কুল, অপরাধ জগতের ছবি ফুটিয়ে তােলে। এই জগৎ দৃশ্যতই সভ্য, সামাজিক জগৎ থেকে আলাদা। এজন্য এ ধরনের ছবিতে চরিত্রদের মুখ স্বল্পালাকিত, ক্যামেরার অস্বাভাবিক অবস্থানের কারণে চরিত্রদের অন্তর্নিহিত অন্ধকার দিকটি বিশেষভাবে চিত্রিত হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে লেন্সের সাহায্যে দৃশ্য বিকৃতি (image distortion) অনেক সময়েই অপরাধী চরিত্রের আসল রূপটিকে ফুটিয়ে তোলে। ডিস্ ফোকাস ব্যবহার করার ফলে অন্ধকারময় অপরাধ জগতে আটকে পড়া সাধারণ মানুষের অসহায়তা যেন অনেক তীব্র হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ওয়েস্টার্ন ছবিতে রুক্ষ, বিপদসঙ্কুল, বিস্তীর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে সভ্যতার বিকাশ এবং আইনের প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নায়কের অসাধারণ পৌরুযের “মিথ তৈরির জন্য চিত্রভাষা হয়ে ওঠে ভিন্ন ধরনের। উন্মুক্ত পরিবেশে নায়কের একাকিত্ব, স্বাধীনতা এবং মুক্তি ওয়েস্টার্ন ছবিতে বিশেষ মাত্রা লাভ করেছে। ন্যায় অন্যায়, শুভ অশুভের দ্বন্দে ভরা ওয়েস্টার্ন ছবিতে চলচ্চিত্রের সমস্ত প্রকরণই ব্যবহৃত হয় এই দ্বন্দ্বকে চিত্রভাষায় রূপান্তরিত করতে।
মিউজিক্যাল ছবিতে গ্ল্যামার, রঙ ও বৈভবের ছড়াছড়ি। সঙ্গীতের ছন্দ, নৃত্যের লাস্য এবং কাহিনীর রােমান্টিকতার জন্য এই ধারার ছবিতে কোরিওগ্রাফি এবং ক্যামেরার কাজের বিশেষ মেলবন্ধন অনিবার্য হয়ে ওঠে। হরর সহ অন্য সমস্ত ধারার ছবির জন্যই হলিউড এবং হলিউডঅনুসারী ইউরােপের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার স্বীকৃত রচনাশৈলী রয়েছে। এই রচনাশৈলী বা স্টাইল এমনই বিশিষ্ট যে একে আলাদা করে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। অন্যদিকে আধুনিক জীবনের জটিলতার ছায়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর হলিউডেও পড়েছিল। এর অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ হলিউডেও অন্যধারার, অন্য দর্শনের ছবি তৈরি শুরু হয়। অরসন ওয়েলস্-এর ‘সিটিজেন কেন্ প্রথাগত চলচ্চিত্রায়ণের সমস্ত রীতিনীতিকে ভেঙে এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। চিত্রভাষা এবং দৃশ্য রচনার ক্ষেত্রে অসামান্য অভিনবত্বের প্রমাণ এ ছবির প্রতিটি ফ্রেমে।
ওয়েলস ‘কে’ নামক একজন ধনী সংবাদপত্র ব্যবসায়ীর জীবনকে ব্যবচ্ছেদ করেন চলচ্চিত্রের ভাষায়। ‘কে’-এর জীবনের অকথিত দিকগুলাে চিত্রিত করতে ওয়েলস আলাে ও অন্ধকারের বৈপরীত্যকে ব্যবহার করেন চরিত্রটিকে ঘিরে যে রহস্যময়তা রয়েছে সেদিকে ইঙ্গিত করতে। ডিপ-ফোকাস’ অনেক দৃশ্যেই বিভিন্ন চরিত্রদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্বকে এমনভাবে সূচিত করে যা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রয়ােগরীতির দিক থেকে অনন্য। কম্পােজিশন এবং ক্যামেরার ব্যবহারও এ ছবির কাহিনী বিন্যাসকে বিশেষভাবে সাহায্য করে। সর্বোপরি কেন্দ্রীয় চরিত্রের মানসিক অবস্থাকে প্রকাশ করবার জন্য বিশেষ বিশেষ দৃশ্যে ওয়েলস শব্দ ও ছবির প্রকাশভঙ্গি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
‘সিটিজেন কেন’-এর পর হলিউডের চিত্রভাষা স্টুডিও-নির্দিষ্ট ভাষারীতি থেকে ক্রমশঃ স্বাধীন হয়ে উঠতে থাকে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন—ইতালির নববাস্তবতা, ফরাসী নবতরঙ্গ এবং ডাইরেক্ট সিনেমা’-হলিউডের চিত্রভাষাকেও প্রভাবিত করতে থাকে। স্টুডিও প্রথার অবসানের পর চলচ্চিত্র পরিচালকের স্বাধীনতা ও শিল্পী হিশাবে পরিচালকের স্থান তর্কাতীত হয়ে ওঠে। হলিউডের ক্যামেরাম্যানরাও তাদের নিজস্বতার জন্য চিহ্নিত হতে থাকেন। একই সঙ্গে ক্যামেরা প্রযুক্তি ও কঁচা ফিল্ম বিশেষভাবে উন্নত হয়ে ওঠার ফলে পঞ্চাশের দশকের পর থেকে ক্যামেরাম্যানরা আলাের ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিরায়ত প্রতিবন্ধকতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। ইতালির নববাস্তবতা আন্দোলনটি হলিউডের ক্যামেরাম্যান এবং পরিচালকদের বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং চলচ্চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে বাস্তবতার ধারণা ফুটিয়ে তুলতে ক্রমশঃ ক্যামেরাকে বাস্তব জীবনের কাছাকাছি আনতে থাকে। অন্যদিকে ‘ডাইরেক্ট সিনেমা’ নামক তথ্যচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ ধারাটি হাতে ধরা ক্যামেরার সাহায্যে আপাত-অমসৃণ বাস্তব জীবনের সাবলীল ছবির মধ্যেও জীবনের সুষমা আবিষ্কার করে। আবার, জটিল ‘টেকনিকালার’ পদ্ধতির বদলে আধুনিক রঙীন নেগেটিভ ক্যামেরাম্যানকে ‘টেকনিকালার’ পদ্ধতির যাবতীয় বিধিনিষেধ থেকে মুক্তি দেয়—রঙের বাস্তবানুগ প্রয়ােগের পাশাপাশি রঙের মনস্তত্ত্ব নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু করেন হলিউডের ক্যামেরাম্যানরা। ত্রি-মাত্রিক ছবি, সিনেমাস্কোপ ও সত্তর মিলিমিটার ছবি পরিচালক ও ক্যামেরাম্যানকে সাহায্য করে চিত্রভাষাকে আরাে সমৃদ্ধ করতে। তবে, আধুনিক চিত্রভাষায় সত্যিকারের বিপ্লব এনেছে সাম্প্রতিক ‘ডিজিটাল টেকনােলজি। চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস একশাে বছর অতিক্রান্ত করার সময়ে হলিউডের ক্যামেরাম্যানরা তাই সদম্ভে ঘােষণা করেন, ‘কল্পনা যতােই অসম্ভব হােক না কেন, আমরা তাকে রূপ দিতে পারি। যা কল্পনা করা সম্ভব—তা চলচ্চিত্রায়িত করাও সম্ভব। আজকের হলিউডের ক্যামেরাশৈলী তাই রুক্ষ, কঠোর বাস্তবকে যেমন রূপ দিতে পারে তেমনই পারে মানুষের অসম্ভব কল্পনাকেও দৃশ্যমান করে তুলতে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।