বিশ্ব ত্রাস চেঙ্গিজ খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন জচি খান। জচি খানের পুত্র ছিলেন বারকাহ খান । চেঙ্গিজের স্ত্রীর নাম ছিল বর্টে। চেঙ্গিজের সঙ্গে বিবাহের পরই বিরোধী গোত্রের জনৈক যোদ্ধা বোর্টেকে অপহরণ করেন। চেঙ্গিস তাকে উদ্ধার করার নয় মাস পর জোচির জন্ম হয়। যদিও তাঁর জন্ম নিয়ে একটা সন্দেহ থাকে তবুও চেঙ্গিস তাঁকে জ্যেষ্ঠ পুত্রের সম্মান দিয়েছিলেন। জচি ছিলেন দক্ষ সেনানায়ক এবং চেঙ্গিজ দ্বারা মধ্য এশিয়া জয়ের তিনিই ছিলেন মূল। জচির ৪ স্ত্রী ছিল এবং ১৪ পুত্র ও ২ কন্যা জন্মায়।
চেঙ্গিজ তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যকে কয়েকটি খানায়েটে ভাগ করে যান। চেঙ্গিজের মৃত্যুর ৬ মাস আগে জচি মৃত্যুবরণ করেন। তবুও পশ্চিমের খানায়েট যা জচির তত্ত্বাবধানে ছিল তা দেওয়া হয় জচির জ্যেষ্ঠ পুত্র বাটুকে।
ত্রয়োদশ শতকের কোন এক সময় বারকাহ খানের জন্ম হয়। বাটু খানের সাম্রাজ্যের নাম হয় গোল্ডেন হোর্ড। বাটুর মৃত্যুর পর বারকাহ খান হলেন এই গোল্ডেন হোর্ডের সর্বেসর্বা। তিনিই প্রথম মোঙ্গল শাসক যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ১২৬৬-তে বারকাহ খান মারা যান।
বর্তমান কাজাখস্তানের পশ্চিম প্রান্তীয় শহর সরাই যুক-এ তিনি বোখারা থেকে আগত একটি কারাভানের সঙ্গে মিলিত হন। বারকাহ খান তাঁদের ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে জানতে চাইলে তাঁরা বলেন তাঁরা মুসলিম এবং শায়খ সুফি নামক এক সুফি সাধক বারকাহ খানকে ইসলামে দীক্ষিত করেন। বারকাহর সঙ্গে তাঁর ভাই তুখ তাইমুরও ইসলামে দীক্ষিত হন।
বর্তমান পারস্যের উত্তর অংশে রাজত্ব করতেন বারকাহ খানের চাচাত ভাই হালাকু খান। তাঁর ভাই-মনকে খান তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, মিশর পর্যন্ত বিশেষত মুসলিম এলাকাগুলিকে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে। এই লক্ষ্যে ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে এলবুর্জ পর্বত শীর্ষে শিয়া ইসমাইলি দলছুট অ্যাসাসিনদের দুর্গে হামলা করে তাদের নেতা রুরুনুদ্দিন খুর শাহকে বন্দী করে পরে হত্যা করেন। এখানেই একপ্রকার বন্দি ছিলেন জ্যোতির্বিদ নাসিরুদ্দিন আততুসি। তিনি মুক্ত হয়ে হালাকুর অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি ইসমাইলি মতাবলম্বী ছিলেন সন্দেহ করা হয় পরবর্তীকালে ১২ ইমামি মতে দীক্ষিত হন।
এরপরই হালাকু বাগদাদে আব্বাসী খলিফা আল মুতাসিমবিল্লাহকে চিঠি পাঠালেন আত্মসমর্পণ করার জন্য। খলিফা যথারীতি তা নাকচ করে দেন। কিন্তু তাঁরই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত নজফ ও কারবালার শিয়ারা এবং মসুল খলিফার নির্দেশের বিপরীত হালাকুর হাতে তুলে দেয়। খলিফার প্রধান উজির শিয়া মতাবলম্বী আহমেদ আলকামি এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিলেন।
তিনি খলিফাকে বোঝান, বিপদ যতটা মনে করা হচ্ছে ততটা নয় বরং সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হোক। এদিকে আলকামি হালাকুর প্রধান উপদেষ্টা নাসিরুদ্দিন আততুসির সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। হালাকুর সভার মূল গণক হুসামুদ্দীন জানিয়ে দেন বাগদাদের খলিফার কোন ক্ষতি হলে ভূমিকম্প হবে। নাসিরউদ্দিন আততুসি পরামর্শ দেন,
“এর আগেই হুসাইন (রাজিয়াল্লাহু তা’আলাআনহু) নিহত হয়েছিলেন তখন যদি ভূমিকম্প না হয়ে থাকে তো কোন আব্বাসির মৃত্যুতে এখনও হবে না।”
জানুয়ারি ১২৫৮ নাগাদ হালাকু খান বাগদাদ ধবংস ও খলিফাকে হত্যা করলে বারকাহ খান হালাকুর শত্রুতে পরিণত হন। হালাকুর ১ লাখের উপর সৈন্য বাগদাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং খলিফা অসহায়ভাবে তাঁর শিয়া প্রধানমন্ত্রী এবং নাসির উদ্দিন আততুসির চক্রান্তের বলি হয়ে বন্দী হন। খলিফার রক্তপাত হলে ভূমিকম্প হতে পারে এই আপ্তবাক্যের উপর বিশ্বাস রেখে তাঁকে কার্পেটের ভিতরে ঢুকিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হালাকু কর্তৃক বাগদাদ দখলের অব্যবহিত পরই নাসিরুদ্দিন তুসি বাগদাদ ঘুরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর মূল্যবান কিছু বই সংগ্রহ করেন এবং পরবর্তীতে তা তাঁর গবেষণার কাজে লাগে। বিদগ্ধজন বলে থাকেন মারাগেহতে তিনি যে ‘তুসি জোড়া’ জ্যামিতিক নকশা প্রকাশ করেছিলেন তা এইসকল সংগৃহীত পুস্তক থেকেই নেওয়া হয়েছিল।
বাগদাদের আব্বাসি খলিফা মুতাসিমবিল্লাহ সুন্নি হানাফি ছিলেন। মুতাজিলা আন্দোলন নবম শতকেই শেষ হয়ে যায় আর রাফিজি, মোঙ্গল, ক্রুসেডার যোগসাজসে আব্বাসি খিলাফত ধবংস হয় ১২৫৮ নাগাদ। আব্বাসিরা ছিলেন হাসমি হুজুর আকরাম (সোয়াল্লালাহেআলায়হেসসালাম)-এর চাচা আব্বাস (রা.)- র বংশধর।
হালাকু একে একে সিরিয়ার সমস্ত মুসলিম রাজ্যগুলি বর্বরতার সঙ্গে দখল করলে তিনি বলে,
“যেভাবে একের পর এক মুসলিমদের শহরগুলি দখল করে মুসলিমদের উপর বর্বরতা দেখানো হচ্ছে। আল্লাহ চাহে তো এই বিপুল পরিমাণ নিরীহ মানুষের রক্তপাতের সমুচিত জবাব আমি দেব।”
মুসলিমদের শীর্ষস্থানীয় খলিফার অসহায় মৃত্যু ও বাগদাদ ধ্বংসের খবর পেয়ে সিরিয়ার শাসকরা, (এঁদের মধ্যে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বংশধররাও ছিলেন) কোন বাধা ছাড়াই একের পর এক আত্মসমর্পণ করতে থাকে। আত্মসমর্পণের পরও প্রায় প্রতিটি সিরীয় শহরে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট জোরকদমে চলতে থাকে।
বারকাহ খানের বিরোধিতার খবর পেয়ে হালাকু শঙ্কিত হন এবং সিরিয়ার দুর্গ গুলিতে সামান্য কিছু সৈন্য রেখে পারস্য ফিরে যান।
মামলুক সুলতান আল মুজাফ্ফর কুৎজ সেনাপতি রুকনুদ্দিন বাইবার্সের দক্ষ পরিচালনায় গাজার নিকট ‘আইন ই জালুত’ (কথিত আছে এই প্রান্তরেই দাউদ আলাইহিস সালাম ও গলিয়াথের লড়াই হয়েছিল) প্রান্তরে তৎকালীন সুপারপাওয়ার মোঙ্গলদের পরাজিত করেন। অতঃপর ফিলিস্তিনসহ সমস্ত সিরিয়া মোঙ্গল বর্বরতা থেকে মুক্ত হয়। হালাকুর বিরুদ্ধে বারকাহ মুসলিম পক্ষ নিয়ে হালাকুকে আমৃত্যু শান্তিতে থাকতে দেননি।
মোঙ্গলরা ছিল প্রকৃতিপূজক। তবে বারকাহ খানের আগেও সাধারণ মোঙ্গলদের কয়েকজন ইসলাম গ্রহণ করে। ‘আইন ই জালুত’ (১২৬০) যুদ্ধের পর পশ্চিম অংশের মোঙ্গলরা প্রায় সকলেই মুসলিম হয়ে যায় এবং পূর্বের মোঙ্গলরা বৌদ্ধ।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবির হাতে পরাজয়ের পর ক্রুসেডাররা সুযোগ খুজতে থাকে জেরুজালেম কি ভাবে মুক্ত করা যায়? প্রায় একইসময়ে চেঙ্গিজের উত্থানের পর নেস্টোরীয় খ্রিস্টানদের হাত করে ক্রুসেডাররা মোঙ্গলদের পরিবারে খ্রিস্টান বধূ ঢুকিয়ে দেয়। এইসময় অল্প কয়েকজন খ্রিস্টানও হয়। হালাকুর এক সেনাপতি কাতবুকা ছিল খ্রিস্টান। এই কাতবুকা, খ্রিস্টান বধূ ও শাম দেশের বাচাখুচা ক্রুসেডাররা মোঙ্গলদের উস্কানি দেয়। সঙ্গে সাথ দেয় রাফিজিরা। আইন ই জালুত প্রান্তরের যুদ্ধে খ্রিস্টান কাতবুকা ছিলেন মোঙ্গল সেনাপতি।
বাগদাদে মুসলিম সাধারন মানুষ ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে মানবসভ্যতার আদ্যিকাল থেকে অধিত জ্ঞান যা বাগদাদের বায়তুল হিকমায় রক্ষিত ছিল সেগুলিও ধ্বংস করে দেয়। বাগদাদ সেই মহান শহর যেখানে বিগত ৫, সাড়ে ৫ শত বছরের মানব সভ্যতার অধীত জ্ঞান সংগৃহীত ছিল। বাগদাদ ছিল বিশ্বের সংস্কৃতি কেন্দ্র। সাধারণ মানুষ ছাড়াও প্রচুর বুদ্ধিজীবী, আলেম-ওলামা, শিল্পী, লেখক, বিজ্ঞানী বাগদাদে বসবাস করতেন। বাগদাদের গ্রন্থাগার, বাগদাদের স্থাপত্য বাগদাদের সর্বস্তরের মানুষ অবলুপ্ত হয়ে যায়। সার্বিক ধ্বংস কোনদিনই সমর্থনযোগ্য নয়। তাহলে আমাদের মার্কিন আগ্রাসনের পর ইরাকের প্রত্নসামগ্রি লুঠও সমর্থন করতে হয়।
আজকে যেমন নিউইয়র্ক। বিশ্বের রাজনীতি, অর্থ, সংস্কৃতি ও সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। তেমনই বাগদাদও সেকালে বিশ্বের যাবতীয় সুকুমারচর্চা নিয়ন্ত্রণ করত। মার্কিনিরা বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে নিয়ে সাদ্দামের বাগদাদকে ধবংস করেছে তেমনই হালাকু বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে বাগদাদকে ধবংস করে মানুষের জীবনচর্চাকে কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে দেয়।
আইন জালুত প্রান্তরে পরাজয়ের পর মোঙ্গল বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যায়। মোঙ্গল সেনাপতি কাতবুকা বন্দি হয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হন। প্রায় অপরাজেয় মোঙ্গলবাহিনীর অগ্রগতি এরপর থেমে যায়।
মুসলিমদের হাতে এই পরাজয় হালাকু সহজে হজম করতে পারেননি। তিনি পুনরায় সিরিয়া দখলের চেষ্টা চালিয়ে যান। হালাকু সৈন্য সংগ্রহ করে যুদ্ধের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেও সিরিয়া পুনর্দখল করতে পারেননি। কারণ, ককেশাস অঞ্চলে হালাকুর সাম্রাজ্যে বারকাহ খান বারংবার আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। বাগদাদ ধ্বংসের প্রতিশোধ স্বরূপ বারকাহ ও হালাকুর মধ্যে বারবার যুদ্ধ হতে থাকে। পূর্ব মেঙ্গল সাম্রাজ্য চীন ও মঙ্গোলিয়ার শাসক কে হবেন তাই নিয়েও বারকাহ ও হালাকুর মধ্যে মত বিরোধ ছিল। হালাকু তাঁর ভাই কুবলাই খাঁকে চীনের শাসক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। বারকাহ চেয়েছিলেন এঁদের অপর ভাই আরিকবককে চীনের শাসক হিসাবে পেতে। কিন্তু আরিকবোক কুবলাই খানকে চীনের শাসক হিসেবে মেনে নিলে যুদ্ধ বন্ধ হয়। কিন্তু ততদিনে বারকাহ খানের আক্রমণে হালাকু খানের প্রচুর শক্তি ক্ষয় হয়। বারকাহর শক্তিও কিছুটা ক্ষয় হয়। কিন্তু ততদিনে হালাকুর মধ্যপ্রাচ্য জয়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় এবং তাদের দুজনের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালীন ১২৬৫ নাগাদ হালাকু মারা যান। ১ বছর পর ১২৬৬-তে বারকাহ খানও মারা যান।
হালাকু খান তাঁর সাম্রাজ্য পারস্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন। হালাকুর সাম্রাজ্যকে বলা হতো ইলখানি সাম্রাজ্যঃ। ইলখানিরা ১৩৩৫ পর্যন্ত পারস্যে রাজত্ব করেন। পরে এরা মুসলিম হয়ে যান। বারকাহ খানের গোল্ডেন হোর্ড সাম্রাজ্যে তাঁর আরও এক ভাইপো মঙ্গু তাইমুর খান রাজত্ব শুরু করেন।
বারকাহ খান মোঙ্গলদের পূর্ব সাম্রাজ্যে হালাকুকে এতটাই ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন যে হালাকু আর বাগদাদের পশ্চিম দিকের মধ্যপ্রাচ্যে দখলে অগ্রসর হতে পারেননি। ফলে বাগদাদের মত ব্যাপক নরসংহার সংঘটিত হয়নি। আল্লাহতা’আলা মোঙ্গল কাঁটা দিয়েই মোঙ্গলদের অগ্রগতি রোধ করেন। এইভাবে নতুন নতুন জাতিকে ইসলামে দীক্ষিত করে আল্লাহতা’আলা ইসলামকে রক্ষা করেছেন।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।