লিখেছেঃ রাধাপ্রসাদ গুপ্ত
গত দু বছরে যখন বহু, কারবারেই ভাটা পড়ে আসছে তখন অন্তত গজ ফুট ও টাকা আনার দিক থেকেও যে চলচ্চিত্র-ব্যবসা এগিয়ে গেছে এটা কম আশ্চর্যের নয়। সংখ্যার কথাটা প্রথমে ধরা যাক। ১৯৪৮ সালে তেতাল্লিশখানি বাংলা ছবি নিয়ে মােট একশাে চুরাশিটি নতুন ছবি কলকাতায় দেখানাে হয়। গত বছর সেই জায়গায় দেখানাে হয়েছিল একশাে তিরানব্বইটি, তার মধ্যে বাংলা ছবি ছিল ছাপান্নখানি। আর ১৯৪৮ সালে যেখানে মাত্র ছয়খানি নতুন ছবি পানাভাবে দেখানাে সম্ভব হয়নি গত বছর তার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে সাতচল্লিশে। দর্শক সংখ্যা কিম্বা ছবি দেখাও যে বেড়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে গত বছরের আমােদকরের হিসাব থেকে। এ কথা সত্যি যে ১৩৫৬ সালে বিভিন্ন প্রদেশে আমােদকরের হার বাড়ানাে হয়েছে। কিন্তু এই উঁচু হার দিয়েই এই খাতে প্রায় দেড়গুণ রাজস্ব বৃদ্ধি সম্ভব নয়।
উপরের এই হিসাবগুলি নিয়ে কোনাে তর্কের সুযোেগ নেই, গত বছরে ভারতীয় চলচ্চিত্র ব্যবসায়ের দৈহিক স্ফীতি নিঃসন্দেহ। কিন্তু গুণাগুণের দিক থেকে দেখলে ভারতীয় ছবি কি অবস্থায় আছে তার উত্তর এত সহজে দেওয়া যায় না। অনেকে বলেন যে দেশী ছবি আগের চেয়ে খারাপ না হলেও উন্নতির কোনাে লক্ষণ নেই। আবার অনেকের ধারণা আজকালকার ছবি আগেকার চেয়েও খারাপ হয়ে গেছে। ছবির উৎকর্ষতা নিয়ে এই মতভেদ অবশ্যম্ভাবী। দর্শকদের মাথাগুনতি করে। ছবির গুণাগুণ নিরূপণ করা যায় না। আমাদের দেশে তাে নিশ্চয়ই, পথিবীর অন্যান্য দেশেও, সাধারণ দর্শক ছবি দেখতে গিয়ে ভালােমন্দ বিচার করেন না, কারণ তাঁর সে মনই তৈরি হয়নি। দর্শকের দিক থেকে ভালাে ছবির কড়া তাগিদ না থাকার ফলে অধিকাংশ চলচ্চিত্র-ব্যবসায়ীই সাধারণত সােজা পথটা ধরেন। আগে যে ছবিগুলি অর্থকরী হয়েছে, লােকে যা দেখতে ভিড় করেছে, সেই ধরনের ছবিকে দৃষ্টান্ত ধরেই তারা নতুন ছবি তােলেন। কাঠামােটি মােটামুটি একই থাকে, গল্পের বিস্তারে একটু অদল-বদল, একটু রঙের ফেরফার। পুরানাের এই পুনরাবৃত্তি অনেক সমালােচকের মতে হলিউডের ছবির একটা বড় সমস্যা। দর্শকদের মধ্যে যারা খতিয়ে ছবি দেখেন ভারতীয় ছবি সম্বন্ধেও ঐ একই অভিযােগ আনেন। কথাটা সত্যি। তাই ১৯৪৯ সালের বহু ছবি দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে এ যেন আগে দেখেছি এবং ভয় হয় পরেও দেখব। বাঙলার চেয়ে বােম্বাইয়ের ছবিগুলি সম্বন্ধে এই কথাটা হয়তাে আরাে বেশি খাটে।
অন্যান্য মামুলী ছবির কথা ছেড়ে গত বছরের একটি সেরা হিন্দী ছবি ‘আন্দাজ’এর কথাই ধরা যাক। গত কয়েক বছরের আরাে অনেক ছবির মতাে দর্শকরা এই ছবিটিতে পর্দার উপর যে ধরনের কাহিনী দেখেন তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনের কোনাে যােগাযােগ নেই। গল্পের মূল ভিত্তি হল প্রেম। নায়কের জীবিকা রােজগারের তাগিদ নেই। তবে যে অফিসে তাকে দু’একবার বসে থাকতে দেখা গেছে সে অফিসের প্রতিরুপ পাবেন আপনি মার্কিনী কাগজের পাতায়। নায়িকার একমাত্র কাজ থেকে থেকে সাজ-বদলানাে, প্রেম আর গান। প্রাসাদোপম সাত-মহলা বাড়ি, লেটেস্ট মডেলের চকচকে গাড়ি, ল্যাপেল-হীন কোট আর সিফনের শাড়ি, মামুলী সবই আছে।
‘আন্দাজ’-এ কাহিনীর এই ছক বহুদিনের পুরনাে। যুবক-যুবতীর প্রেম, কতকগুলি গান, প্রেমে বিপত্তি, অবশেষে হাজার হাজার ফুট বাদে সেই পরম মহতপ্রেমের জয়। এই নিয়ে বােম্বাইয়ের সামাজিক ছবি। এ ছাড়াও আর এক জাতের ছবি সব স্টুডিওতেই প্রতি বছরে অনেকগুলি করে তৈরি হয়। আর সেগুলিকে খবরের কাগজের পাতায় পাতায়, শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে প্রচার করা হয় নত্যগীতমুখর বাণীচিত্র বলে। খৃষ্টান পাদরী না হয়েও এগুলিকে ‘পবিত্ৰ আমােদ’ বলা শােভন হবে না, কারণ অর্ধ-নগ্ন যুবতীর ভিড়ই হচ্ছে এগুলির প্রধান আকর্ষণ।
যেসব সমালােচক ভারতীয় ছবির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ঘােরর নিরাশা পােষণ করেন তাদের দৃষ্টি হয়তাে এই জাতীয় ছবিগুলিতেই নিবদ্ধ থাকে। কিন্তু এসব ছবি ছাড়াও গত বছর এমন আরাে কতকগুলি ছবি তৈরি হয়েছে যা দেখে মনে আনন্দ হয়, আশা হয়। এই ছবিগুলির অধিকাংশই বাঙলা দেশে তৈরি। এর কারণ কি?
বেশ কিছুদিন আগে ‘লাইফ অ্যান্ড লেটার্স অভ টুডে’ পত্রিকায় কোনাে সমালােচক ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে একটা দামী কথা বলেছিলেন। মার্জিত রুচিবােধই, তাঁর মতে, ভারতীয় অন্যান্য ছবির থেকে বাংলা ছবিকে স্বাতন্য দেয়, সেইটাই তার বৈশিষ্ট্য। উদাহরণ স্বরুপ তিনি ‘দেবদাস’-এর উল্লেখ করেছিলেন। বয়স্ক যুবক-যুবতীর বিবাহ-ব্যাপারে পিতামাতার অযথা হস্তক্ষেপে অনেকসময় কি ভয়ানক পরিণতি হতে পারে তা দেখানাে হল দুটো জীবনের ট্র্যাজেডি দিয়ে। এই ট্র্যাজেডি দর্শকমনকে আলােড়িত করে, ভাবায়, কাঁদায়। সেই বছরই বােম্বাইয়ের একটি হিন্দী ছবিতেও এই সমস্যার অবতারণা করা হয়েছিল এবং চিত্র পরিচালক তাঁর সমাধান দিয়েছিলেন বিবাহ বাসর থেকে কন্যাকে পালিয়ে যেতে দিয়ে। এত গুল, সােজা পষ্ট সমাধান কিন্তু দর্শকমনে ‘দেবদাস’-এর অনতিব্যস্ত বেদনার মতাে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়নি। আর্ট-এর দিক থেকে এই দুই ছবিতে তাে কোনাে তুলনাই চলে না।
আমাদেরও মনে হয় বাংলা ছবির আনুপাতিক উৎকর্ষতার মূলে রয়েছে বাঙালী মন। শিল্প-সাহিত্যে, কাব্যে, গানে, দৈনন্দিন আচার-ব্যবহারে যে বাঙালী মনের পরিচয় মেলে তা হচ্ছে একাধারে গম্ভীর অথচ সরস, অনুসন্ধিৎস, ভাবপ্রবণ, আর সক্ষরচিজ্ঞানসম্পন্ন। বাংলা চলচ্চিত্রেও তা অন্তত কিছু কিছু ফুটে উঠেছে। ভালাে বাংলা ছবিগুলিতে তাই শুধ, নিছক গল্প নেই, আছে প্রশ্ন, সমস্যা, আছে তার বিশ্লেষণের প্রয়াস, সমাধানের চেষ্টা। ছবিগুলিতে হয়তাে চমকে দেওয়ার মতাে কিছু নেই, যেমন নেই অহেতুক বাহাদুরির প্রচেষ্টা, রুচির অশােভন বিকার। বাংলা ভালাে ছবিতে এই সহজ, সুন্দর, সরল ভাবই সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
১৯৪৯ সালের ভালাে বাংলা ছবির মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে পরিবর্তন। ছেলেমেয়েদের গড়েপিটে মানুষ করে তুলতে হলে মলটেড দুধ আর বেতই যে সব নয় এই কথাটাই বলবার চেষ্টা করা হয়েছে এই ছবিতে। প্রত্যেক সভ্য দেশেরই জ্ঞানীগুণী, লেখক-শিল্পী, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র-নির্মাতারা তাঁদের দৃষ্টি দিয়েছেন দেশের ছেলেমেয়েদের দিকে, বােঝবার ও বােঝাবার চেষ্টা করেছেন তাদের সমস্যা, তাদের মন, যাতে তাদের সুস্থ সবল মানুষ করে গড়ে তােলা যায়। চলচ্চিত্রে আমাদের দেশে এই সমস্যাটাকে তুলে ধরবার প্রথম চেষ্টা হল ‘পরিবর্তন’এ। এদিক থেকে ছবিটির গুরত্ব কম নয়। তার চেয়ে বড় কথা হল ছবিটি উপভােগ্য হয়েছে। গল্পের পরিণতিতে একটা বড় দোষ চোখে পড়ে। দুষ্ট ছেলে অজয়ের হদয়ে পরিবর্তন আনতে মাস্টারমশাই শিশিরবাবুর স্নেহ ও সহানুভূতিপর্ণে ব্যবহারের চেয়ে তার বধু শক্তির অপমৃত্যুকে দায়ী করা হয়েছে। অথচ ব্যাপারটা ঠিক উল্টো হওয়াই উচিত ছিল, শক্তির মৃত্যুর প্রয়ােজন ছিল না। পরিবর্তন’এ সবচেয়ে বিস্ময়কর জিনিস হল ছােট ছােট ছেলের দলের অপব অভিনয়। এমন সুন্দর, সাবলীল, অকৃত্রিম অভিনয় বিদেশী ভালাে ছবিতেও কদাচিৎ দেখা যায়। পরিচালক নবাগত। তবুও তাঁর প্রথম ছবিতে যে সংযম, সুচি ও বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন তাতে তাঁকে অভিনন্দন না জানিয়ে পারা যায় না। ‘পরিবর্তন’-এর পরই যে ছবিটির নাম করতে হয়, তা হচ্ছে নিউ থিয়েটার্সের ছবির প্রতীক্ষায়। মাঝে নিউ থিয়েটার্স এর সুনাম প্রায় হারাতে বসেছিল। ‘ছােটা ভাই’ নিউ থেয়েটার্সের সেই মর্যাদা আবার ফিরিয়ে দিতে অনেকখানি সাহায্য করেছে। সেখানে ছোট ভাই দেখানো হয়েছে দর্শকেরা দিয়েছে সাদর অভ্যর্থনা, সমালোচকেরা দিয়েছে বরমাল্য।
‘ছােটা ভাই’-এর সাফল্যের প্রধান কারণ এর কাহিনী। শরৎচন্দ্র ‘রামের সুমতি’তে যে অন্তষ্টি ও যাদুকরী ক্ষমতা দিয়ে দুরন্ত রামের চরিত্র ও স্নেহময়ী বৌদির ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা নেই। ছবিতে এই দুটি প্রধান চরিত্র ও রামের পরিবর্তন এমন সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে দর্শকের মন গভীরভাবে অভিভূত না হয়ে পারে না। এই সাফল্যের জন্য কৃতিত্ব পরিচালক ও অভিনেতা অভিনেত্রীর। পরিচালক কার্তিকচন্দ্র দাসের এই প্রথম ছবি। তার সন্ধির সবচেয়ে বড় পরিচয় হল যে তিনি চিত্রনাট্যে মূল গল্প থেকে নিজেকে বিচ্যুত হতে দেননি এ গল্পে ঠিক এই জিনিসটিরই দরকার ছিল। ফলে ছবিতে কাহিনী সহজ ও অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে গেছে। অভিনয়ে প্রথমেই নবাগত বালক শকুর আর বৌদির ভূমিকায় শ্রীমতী মলিনার নাম মনে আসে। রামের দুরন্তপনা আর বৌদির প্রতি স্নেহ শকুরের অভিনয়ে এমন অপৰ্বভাবে ফুটে উঠেছে যে বিস্ময়াতে নয়নে তাকিয়ে দেখতে হয়। ভারতীয় ছবির ইতিহাসে এমন অভিনয় বিরল।
‘ছােটা ভাই’-এর মতাে আর একটি বাংলাদেশের ছবি যা গত বছর সারা ভারতব্যাপী সমাদর পেয়েছে তা হল ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্ট পিকচার্সের হিন্দী ‘স্বয়ংসিদ্ধা’। সাহিত্যিক মনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কাহিনীটি ভিত্তি করে তিন বছর আগে এর যে বাংলা সংস্করণ তৈরি হয়েছিল তা সব দিক দিয়েই হতাশজনক। উন্নত পরিচালনা, সুষ্ঠু অভিনয় আর চিত্তাকর্ষক কাহিনী সমন্বয়ে হিন্দী ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ প্রকৃতই উপভােগ্য হয়ে উঠেছে। অভিনয়ে শান্তা আপ্তে আর বিপিন গুপ্ত যে শক্তির পরিচয় দিয়েছেন, দর্শক তা সহজে ভুলতে পারবে না। ‘ছােটা ভাই’ ও হিন্দী ‘স্বয়ংসিদ্ধ’র সাফল্য দেখে সেই সময়ের কথাই মনে পড়ে যখন বাঙলায় তৈরি হিন্দী ছবি ভারতের সমস্ত জায়গাতেই লক্ষ লক্ষ দর্শককে আকর্ষণ করেছে। বাংলা ছবির সঙ্গে সঙ্গে সেগুলির হিন্দী সংস্করণ এখন আর তৈরি হয় না কেন ভেবে অবাক লাগে। ছবি তােলার খরচ এতে অর্ধেক কমে যায় এবং সে ছবি সব জায়গাতেই দেখানাে চলে। আর্থিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেই বাঙলার চিত্র ব্যবসায়ীদের এদিকে নজর দেওয়া উচিত।
শরৎচন্দ্রের গল্পের উপর ভিত্তি করে গত বছর আর একটি ভালাে ছবি হয়েছিল ‘অনুরাধা’। ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল টকিজের তরফ থেকে প্রণব রায় এই ছবি পরিচালনা করেছেন। পরিচালনায় প্রণব রায়ের মৌলিকত্ব প্রকাশ না পেলেও মােটামুটি ভালােই হয়েছে এবং এর জন্যও দায়ী প্রধানত শরৎচন্দ্রের কাহিনী। ‘অনুরাধা’র আর একটি বৈশিষ্ট্য হল যে, অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেত্রী শ্রীমতী কানন দেবী শরৎচন্দ্রের কাহিনীতে এই প্রথম অভিনয় করলেন।
গত বছরই শ্রীমতী কানন দেবীর নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের প্রথম ছবি ‘অনন্যা’ মুক্তি পেয়েছে। ছবিটি সমস্যামুলক। অপাত্রে অর্পিত হলে নারীর জীবন যে কি ভাবে ব্যর্থ হয়ে যায় পর্দায় তার প্রতিফলনের চেষ্টা আগেও হয়েছে। ‘অনন্যা’র বৈশিষ্ট্য এই যে, এতেই প্রথম দেখানাে হল কেমন করে একটি মেয়ে বশুরবাড়ির অন্যায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহকে জয়যুক্ত করল।
এ ছবিতে ‘সব্যসাচী’র পরিচালনা চলনসই। ছবিটির প্রধান আকর্ষণ এর অভিনয় কুশলতা। বিদ্রোহী বধু ও মায়ের ভূমিকায় কানন দেবীর অভিনয় চিত্তাকর্ষক। সবচেয়ে অনবদ্য অভিনয় করেছেন পুর্ণেন্দ, মখখাপাধ্যায়, জড়বুদ্ধি স্বামীর চরিত্রে। এই নবাগত অভিনেতার ভবিষ্যৎ আশাপ্রদ। ভাশুরের ভূমিকায় কমল মিত্রও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। অনুভা গুপ্তা বা বিকাশ রায় যে দুটি চরিত্র অভিনয় করেছেন তাতে তেমন সুযোেগ না থাকায় অভিনয়ে উল্লেখযােগ্য কিছু ছিল না।
একদিক দিয়ে গত বছরের সব চেয়ে উল্লেখযােগ্য প্রচেষ্টা হচ্ছে অন্যতম প্রধান চিত্রপরিচালক শ্রীদেবকীকুমার বসুর ‘কবি’। তারাশঙ্করের ‘কবি’ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। কবি’ নিছক প্রেম কাহিনী নয়, লেখকের প্রচেষ্টা ছিল বাঙলার এক লপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটানাে। বাঙলার হাটে, মাঠে, ঘাটে, গ্রামে গ্রামে আজও যে বাউল, বৈরাগী ও কবিয়ালদের দেখতে পাওয়া যায় বাঙলার নরনারীর মনে এদের স্থান ছিল প্রেমের সিংহাসনে। ‘কবি’ এই কবিয়াল জীবনের আলেখ্য। একটু এদিক ওদিক হলেই এটা একটা স্কুল প্রেম কাহিনীতে পরিণত হতে পারত কিন্তু লিপিকৌশল ও সক্ষম মননশীলতায় সেই বিপদ ঘটতে পারেনি এটাই উপন্যাস লেখকের কৃতিত্ব।
দুঃখের বিষয় উপন্যাসের চিত্ররপে এই বিপদটিই ঘটেছে। তাই এতে আমরা পাইনি বাঙলার গৌরবময় কবিসংস্কৃতির বিচিত্র কবিয়াল জীবনের পরিচয়। গল্পের মল সুরটি হারিয়ে গেছে, দাঁড়িয়েছে নিছক প্রেম কাহিনীতে। ‘কবি’ চিত্রটিতে অনুভা গুপ্তর অভিনয়ই সব চেয়ে উল্লেখযােগ্য। এর আগেও তিনি দু’একটি ছবিতে নেবেছিলেন কিন্তু এই ছবিতেই তাঁর প্রথম অভিনয় প্রতিভার প্রকাশ হল। ঠাকুরঝির ভূমিকায় তাঁর অভিনয় আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্র জগতের স্মরণীয় কীর্তি।
এগলি ছাড়াও গত বছর যে ছবিগলি উতরে গেছে তার মধ্যে তারাশঙ্করের সন্দীপন পাঠশালা’, তা ছাড়া সঙ্কল্প’ ও ‘অভিমান’ উল্লেখযােগ্য।
উপরােক্ত এই ছবিগলির টেকনিক বা আঙ্গিকের দিক সম্বন্ধে আমরা বিশেষ কিছু বলিনি। বলা প্রয়ােজন এই ছবিগুলিতে চিত্রগ্রহণ সময় সময় অত্যন্ত খারাপ, মােটামুটি চলনসই বলা যেতে পারে। রেকর্ডিং ও সম্পাদনাও তাই। পরিচালনার খুটিনাটিতে অজ গলদ আছে; বেশভূষায়, আচারে-ব্যবহারে, দশ্য পরিবেশে নানা , রকমের বৈষম্য চোখে পড়ে। এ সব সত্ত্বেও ছবিগলি যে চিত্তাকর্ষক হয়েছে তার কারণ পরিচালক একটা নিম্নতম মান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
অপটু পরিচালনা, অক্ষম চিত্রগ্রহণ ও অভিনয়ের দোষে গত বছর যে ছবিগুলি একেবারে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে তার মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। এমন শক্তিশালী প্রতিভাদীপ্ত উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে বিরল। ছবিটির দুর্ভাগ্য আশা করি বাংলা লেখক ও বাংলা চিত্রজগতে সকলেই স্মরণ রাখবেন। এ ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’, শরৎচন্দ্রের ‘বামনের মেয়ে’ ও ‘স্বামী’, বাঙলার বিপ্লবী আন্দোলনের ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ কাহিনী, আর ‘স্বামীজী’–এ ছবি কয়টি অত্যন্ত হতাশজনক হয়েছে। হাসির ছবি ‘উল্টো রথে’র ব্যর্থতাও উল্লেখযােগ্য। চলচ্চিত্রের গােড়ার কথা হচ্ছে কাহিনীকে এমনভাবে ফলানাে যাতে লােকের মনে তা সত্যিকারের বলে ভ্রম হয়। এজন্য এমন কতকগুলি জিনিসের দরকার যা না হলে ভালাে ছবি তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। প্রত্যেক শিল্পেরই একটা নিজস্ব ভাষা আছে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও তা সত্য। পরিচালকের পক্ষে সেই ভাষা আয়ত্তে থাকা দরকার, তার ওপর পুরাে দখল থাকা চাই, তবে তিনি ছবি তৈরির নিজস্ব বাধা-বিপত্তিগুলাে কাটিয়ে ঝরঝরে ভাবে গল্প বলতে পারবেন। তা ছাড়া প্রত্যেক দেশেরই জাতীয় জীবনের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। সেগুলিকে যথাযথ ফুটিয়ে তুলতে হলে ছবি তৈরির একটা দিশি ঢঙ বা স্টাইলের প্রয়ােজন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে এমন বহু পরিচালক রয়েছেন চলচ্চিত্র বিষয়ে যাঁদের অক্ষরজ্ঞান নেই। আমাদের দেশের বেশির ভাগ ছবিতে ব্যর্থতার সেটাই সব চেয়ে বড় কারণ। এদিকে দেশের যারা ভালাে পরিচালক বলে খ্যাতিলাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই গল্পবিন্যাসের দিক থেকে বড্ড বেশি বিদেশী ঢঙের পক্ষপাতী। এদিক থেকে বাঙলার চেয়ে অধিকতর দোষী বােবাই।
দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্র হচ্ছে চোখে দেখার জিনিস সুতরাং চিত্রনির্মাতার কর্তব্য ছবিকে দর্শনযােগ্য করা। আমাদের দেশের, বিশেষত বাংলা ছবিগুলির অধিকাংশেরই চিত্রগ্রহণ এত খারাপ যে তাতে পরিচালনার কৃতিত্ব ও শিল্পীদের অভিনয় কুশলতা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। ছবি তােলার যান্ত্রিক দিকটা আমাদের দেশে আজও কি করে এত কাঁচা রয়ে গেছে ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। ভালাে ক্যামেরা আর আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব —এই অজুহাত দিয়ে অনেকে এই দোষ ঢাকার চেষ্টা করেন। ভালাে ছবি তুলতে ভালাে যন্ত্রপাতির যে বিশেষ প্রয়ােজন তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু একজন জগদ্বিখ্যাত ফরাসী চিত্রপরিচালক নিজে চোখে দেখে সম্প্রতি এই অভিমত প্রকাশ করে গেছেন যে প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি সবই আমাদের দেশের স্টুডিওগুলিতে রয়েছে। আসল কথা হচ্ছে যন্ত্রপাতিই সব নয়। তার চেয়ে বড় কথা হল ক্যামেরার পিছনে মানুষটির চোখ আর মন। যন্ত্রটাকে তিনিই ব্যবহার করবেন, যেমন করে চিত্রী তাঁর তুলি বশ রঙ ব্যবহার করেন। সাধারণ যন্ত্রপাতি দিয়েও যে কত উৎকৃষ্ট ছবি তােলা যায় তার প্রমাণ দিয়েছেন যুদ্ধােত্তর ইতালীয় ও ইউরােপীয় চলচ্চিত্রশিল্পীরা। আমাদের দেশের চিত্রশিল্পীদের প্রথম প্রয়ােজন আরাে অনুশীলন, তার পর চাই সৃজনী দৃষ্টি, সৃজনী মন।।
চিত্রগ্রহণ সম্বন্ধে এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা প্রয়ােজন। পথিবীর প্রত্যেক দেশেই আজ দেখা যাচ্ছে চিত্র-নির্মাতারা তাদের ছবিকে প্রাণবন্ত করে তােলার জন্য স্টুডিওর বাইরে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। হলিউড কিংবা ইংলণ্ডে স্টুডিওর মধ্যেই সাধারণত ছবি তােলার রেওয়াজ সত্ত্বেও ক্যামেরা আজ বহির্মুখী। ইতালির বরেণ্য পরিচালকেরা তাদের জগদ্বিখ্যাত ছবিগুলি তুলেছেন নােম আর ইতালির এখানে সেখানে পথে ঘাটে। আমাদের দেশে কিন্তু এ পরিবর্তনের কোনাে চিহ্ন নেই। ক্যামেরাকে এদেশে এখনাে বেনেবাড়ির কনে বৌয়ের মত অসুর্যসম্পশ্যা করে রাখা হয়েছে।
গত বছরের কত ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়েছে কি নিষ্প্রাণ, কি অবাস্তব। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজারের দৃশ্য সমস্ত কিছুই ভােলা হয় স্টুডিওর মধ্যে। অতি কুশলী চলচ্চিত্রশিল্পীর পক্ষেও এগুলিকে জীবন্ত করে তােলা সহজে সম্ভব নয়। তাই আমাদের চিত্র-নির্মাতাদের কর্তব্য যেখানে দরকার সেখানে স্টুডিওর বাইরে বাস্তব পরিবেশের মধ্যে ছবি তােলা। এর ফলে ছবিতে আজ যা বিবর্ণ, মেকী বলে মনে হয়, তা সুন্দর হয়ে, জীবন্ত হয়ে উঠবে।
সবশেষে বলা দরকার যে আমাদের দেশী ছবির দৈঘ্য সম্বন্ধে একটু সচেতন হওয়া দরকার। গত বছরের ছবিগুলি গড়ে দশ থেকে বারাে হাজার ফুট দীর্ঘ হয়েছিল। পথিবীর সব দেশেই দু’একটা বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া সাধারণত ছবির দৈর্ঘ্য আট হাজার ফুটের সীমায় থাকে। এই প্রসঙ্গে গত বছরে ‘দি পারল’ এবং ‘দি পােট্রেট অব মরিয়া’ নামে যে দুটি মেক্সিকান ছবি কলকাতায় দেখানাে হয়েছিল তাদের উল্লেখ করা যেতে পারে। এই দুই ছবির কাহিনীতে বর্ণিত জীবনের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ জীবনের অনেক মিল আছে। অথচ এদের দৈর্ঘ্য ছিল সাত হাজার ফিটের নিচে। পরিচালনা ও সম্পাদনার কৃতিত্বেই এটা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের এই ছবির দীর্ঘতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনাবশ্যক। আর একট, গুছিয়ে বলতে পারলেই এই দীর্ঘতা কমিয়ে আনা যায়। এ কথাটা বােঝা দরকার যে একটা জিনিস দেখাতে হলে হিজিবিজি না কেটে একটি সুনিপুণ তুলির টানেও দেখানাে যেতে পারে, বােঝানাে যেতে পারে ধীরে সুস্থে, না চেঁচিয়ে, হাত-পা না ছড়ে ইশারায়, ঠাট্টায়। শিল্প হতে হলে এই সংযম চাই। আমাদের ছবির দৈঘাের আর একটা কারণ বােধ হয় প্রত্যেক ছবিতেই অতিরিক্ত গান-সংযােজনা। পরিচালকেরা বলেন গান না থাকলে ছবি চলবে না। নজির হিসেবে ‘দেবদাস’ ‘ভাগ্যচক্র’ ‘অচ্ছুত কন্যা’ ‘বন্ধন’ ‘প্রেসিডেন্ট কিসমত’ ইত্যাদি ছবির উল্লেখ করেন। গত বছরের ‘ছােটা ভাই’, স্বয়ংসিদ্ধ’, ‘পরিবর্তন’ ইত্যাদি ছবি প্রমাণ করেছে যে গান না থাকলেও ছবি জনপ্রিয় হতে পারে। এই দুষ্টান্ত থেকে দেশী ফিল্মে একটা বড় পরিবর্তন আসা উচিত।
যন্ত্রপাতি যা আছে তাই নিয়েই ছবি তােলার টেকনিকের দিকে মনােনিবেশ করলে বাংলা ছবিগুলি অন্তত বােম্বাইয়ের ‘আন্দাজ’-এর মতাে নয়ন-মনােরম হতে পারে। অন্যপক্ষে বােম্বাই ও অন্যান্য হিন্দী চিত্রনির্মাতাদের উচিত বাংলা ছবির মতাে বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আর একটু যত্নবান হওয়া। বিদেশী ছবির থেকে অন্তত এটকু আমরা শিখতে পারি যে আরাে অনেক কম কথা বলে কি করে পর্দায় সরস গল্প বলা যায়। তার উপরেই নির্ভর করছে ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ।
আধুনিক-শ্রীরাম ভক্তি
বােম্বাই প্রকাশ পিকচার্স-এর প্রযােজনায় প্রায় প্রতি বছর পরিচালক বিজয় ভাট শ্রীরামচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে একটি করে ছবি তৈরি করেন। তাঁর পরিচালনায় ভােলা ‘ভারত মিলাপ’, ‘রামরাজ্য’, ‘রামবাণ’ প্রভৃতি ছবি ভারতীয় দর্শকের কাছে আশ্চর্য সমাদর পেয়েছে। প্রত্যেকটি ছবিতেই প্রেম আদিব সাজেন শ্রীরামচন্দ্র, আর শােভনা সমর্থ – সীতা। আধুনিক ভাষায় এরা দুজন হচ্ছেন রামসীতায় ‘স্পেশালিস্ট’।
রামায়ণের, তথা সীতারাম ভক্তের দেশ ভারতবর্ষ। কাজেই চলচ্চিত্রের আধুনিক সীতারামকে ধড়াচড়া পরে শুধু অভিনয় করলেই চলে না, পণ্যলােভাতুর ভক্তবন্দকে সামাজিকভাবে দর্শন দিতে হয়। একবার দক্ষিণ ভারতের এক ভদ্রলােক রীতিমতাে সেট-এর মধ্যে ঢুকে শ্রীরামচন্দ্র ওরফে প্রেম আদিবকে দণ্ডবৎ করে ভক্তি নিবেদন করে গিয়েছিলেন। আর একবার একটি ছবি শেষ করে প্রেম আদিব ছুটিতে চলে যাচ্ছেন, এমন সময় কাকুতি মিনতি করে এক মারাঠী ভদ্রলােক এসে ধরে বসলেন শ্রীরামচন্দ্রকে একটিবার তাঁর গৃহে গমন করতেই হবে। কিছুতেই এড়াতে না পেরে শ্রীরামচন্দ্র আবার স্টুডিওর সাজঘরে ঢুকলেন। পরিপাটি রামচন্দ্র সেজে গেলেন সেই ভদ্রলােকের বাড়ি। সেখানে গৃহকর্ত্রী ধুপদীপ জেলে তাঁর আরতি সমাপন করে পদধুলি নিয়ে কৃতার্থ হওয়ার পর প্রেম আদিব ছাড়া পেলেন।