বনলতা সেনের স্রষ্টা জীবনানন্দ দাশের জীবন ছিল সর্বতোভাবে সাহিত্যে শ্লিষ্ট ও নিবেদিত। ১৯১৯ সালে তাঁর ২০ বছর বয়সে প্রথম মুদ্রিত কবিতা প্রকাশিত হয়। ‘বর্ষ-আবাহন’ নামে কবিতাটি তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশ সম্পাদিত ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দ প্রথম পর্যায়ে তাঁর নামের পদবিতে লিখতেন ‘দাশগুপ্ত’। তাঁর কবি জীবনের একেবারে প্রথম পর্যায়ের কিছু কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ‘জীবনানন্দ দাশগুপ্ত’ স্বাক্ষরে। পরে তিনি ‘দাশ’ লেখা শুরু করেন।
পত্র-পত্রিকায় জীবনানন্দের কবিতা চর্চার পর্যায়কাল পরম্পরায় সাজালে মোটামুটি কবির ধারাবাহিকতা এভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে—
প্রথম কবিতা প্রকাশের কাল মোট কবিতার সংখ্যা | পত্র-পত্রিকার নাম |
ক) ব্রহ্মবাদী-১৩২৬ (১), বঙ্গবাণী-১৩৩২ (৮), কল্লোল-১৩৩২ (১২), কালিকলম-১৩৩৩ (১২), ঊষা-১৩৩৩ (৭), প্রগতি-১৩৩৪ (১৩), ধূপছায়া – ১৩৩৫ (৩)। | ব্রহ্মবাদী-বঙ্গবাণী-কল্লোল- কালিকলম-উষা-প্রগতি-ধূপছায়া ৷
|
খ) পরিচয়-১৩৩৮ (৯),দেশ-১৩৩৯ (২৮), পূর্বাশা- ১৩৪০ (১৪), কবিতা-১৩৪২ (১০৫)। | পরিচয় – দেশ – পূর্বাশা – কবিতা
|
গ) আনন্দবাজার পত্রিকা-১৩৪৬ (১৫), চতুরঙ্গ- ১৩৪৫ (২০), পত্রিকা-১৩৪৬ (৪), নিরুক্ত-১৩৪৭ (১৫), বৈশাখী-১৩৪৮ (৫)। | আনন্দবাজার পত্রিকা-চতুরঙ্গ-পত্রিকা নিরুক্ত-বৈশাখী।
|
ঘ) মাসিক বসুমতী-১৩৫২ (১৪), ক্রান্তি-১৩৫৩ মাসিক বসুমতী-ক্রান্তি-একক-(৭) একক-১৩৫১ (১২), যুগান্তর-১৩৫৩ (৯)। | মাসিক বসুমতী – ক্রান্তি একক – যুগান্তর।
|
ঙ) উত্তরসূরী-১৩৫৯(১২), শতভিষা-১৩৫৯ (৫) উত্তরসূরী-শতভিষা–ময়ূখ-অনুক্ত ময়ূখ-১৩৬০ (৬), অনুক্ত-১৩৬২ (৬)। | উত্তরসূরী – শতভিষা – ময়ুখ – অনুক্ত। |
জীবনানন্দের জীবদ্দশায় সাতটি ঝরা পালক – ১৯২৭ (৩৫), ধূসর পাণ্ডুলিপি- ১৯৩৬ (১৭), বনলতা সেন- ১৯৪২/৫২ (১২+১৮=৩০), মহাপৃথিবী – ১৯৪৪ (১২+২২=৩৪), সাতটি তারার তিমির – ১৯৪৮ (৪০), জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪) : অতিরিক্ত ১৮। কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। আর এই সাতটি কাব্যগ্রন্থে মোট ১৬২টি কবিতা স্থান পেয়েছিল মাত্র। প্রগতি (১৩), বৈশাখী (৫) এবং বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় জীবদ্দশায় ৭৬টি এবং মৃত্যুর পর ২৯টি, মোট ১০৫টি। তিনটি পত্রিকায় ১২৩টি কবিতা প্রকাশিত হয়।
১৯৩৫ সালে কবিতা’র প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় (পৌষ, ১৩৪২) সংখ্যায় প্রকাশিত হয় জীবনানন্দের বহু বিখ্যাত ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি—
আত্মপরিচয়/ পথিকচিত্ততা
- হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে;
- সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
- অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
- সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
- আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
- আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
দয়িতা পরিচয়/ পথিকচিত্ততা
- চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
- মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের ‘পর
- হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
- সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
- তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’?
- পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
যাত্রাশেষের পরিণাম /হৃদয় চিত্ততা
- সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
- সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
- পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
- তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
- সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী – ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
- থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন৷
জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতায় বানান ও যতিচিহ্ন বিষয়ে বেশ জটিলতা আছে। তিনি নিজে এক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম বা শৃঙ্খলা অনুসরণ করেননি। আবার তিনি যেহেতু নিজের কবিতার বারবার পরিমার্জন বা কাটাকুটি করতেন, সেজন্য তাঁর একই কবিতার নানা রকম পাঠ দেখা যায়, সঙ্গে বানানেও। আবার বিভিন্ন পত্রিকা বা সম্পাদক- সংকলকের নিজস্ব বানান-রীতি, ব্যক্তিগত রুচিও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে হয়তো। তার ওপর আছে ছাপাখানার ভূত। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটাই এর উজ্জ্বল উদাহরণ।
আমরা এখানে জীবনানন্দের তিনটি কাব্যসমগ্র (দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়-১৯৯৬, আবদুল মান্নান সৈয়দ-১৯৯৪, আবু হাসান শাহরিয়ার-২০০৩ সম্পাদিত) মিলিয়ে দেখতে গিয়ে তিনরকম বানান ও যতিচিহ্নের ব্যবহার দেখতে পাচ্ছি। তবে এক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আবু হাসান শাহরিয়ারের মধ্যে নৈকট্য বেশি। কাজেই এই দুটোর ওপর ভিত্তি করে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি গ্রন্থিত। তবে বিকল্প যা পাওয়া গেছে তার নিচে রেখা দিয়ে উল্লেখ করা হলঃ প্রথম লাইনে ধ’রে-তে ঊর্ধ্বকমা (‘) নেই; দ্বিতীয় লাইনে সিংহল সমুদ্র-এর মাঝখানে হাইফেন (-) নেই; পঞ্চম লাইনে চারিদিকে আলাদা (চারি দিকে); ষষ্ঠ লাইনে দু-দণ্ড (কোথাও দুদণ্ড আবার কোথাও দু’দণ্ড); অষ্টম লাইনে ‘পর-এ ঊর্ধ্ব কমা নেই (পর); সপ্তদশ লাইনে নদী-র পরে ড্যাশ (—) নেই।
‘বনলতা সেন’ কবিতাটি মোট তিনটি স্তবকে রচিত। প্রতিটি স্তবক নির্মিত হয়েছে ছয়টি পংক্তি দিয়ে। প্রথম স্তবকে আত্মপরিচয়/পথিকচিত্ততা, দ্বিতীয় স্তবকে দয়িতা পরিচয়/পথিকচিত্ততা এবং তৃতীয় স্তবকে যাত্রাশেষের পরিণাম/হৃদয়চিত্ততা। মূলত তিনটি স্তরে বিভক্ত এই কবিতাটি ধ্বনি আর অর্থের আবর্তে দ্ব্যর্থকতার পর্যায়ে উন্নীত। ‘বনলতা সেন’ কবিতার দ্ব্যর্থকতা বোধকে চিত্রের সাহায্যে দেখানো যাক :
প্রকাশ |
প্রকাশ | প্রকাশ | সঙ্গীত |
অনুষঙ্গ-৩ | |||
অনুষঙ্গ-২ | |||
অনুষঙ্গ-১ |
→ দ্ব্যর্থকতা
অর্থাৎ ধ্বনির প্রকাশ আর অর্থের আবর্তে সঙ্গীতময়তায় দ্ব্যর্থকতার উন্মোচনই হচ্ছে ‘বনলতা সেন’ কবিতার অন্তর্গত প্যাটার্ন, নান্দনিক বিভা।
যে কোনো কবিতাকেই গ্রাফে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। কবিতার শরীরকে উল্লম্ব ও আনুভূমিক অবস্থানে ফেলে—সারি (row) এবং কলাম অনুসারে অক্ষরগুলি বর্ণনা করে গ্রাফের নিয়ম (column) অনুসারে X অক্ষ এবং Y অক্ষে বিন্দু স্থাপন করলে কবিতার অনুভূতির গতি, প্রকৃতি বোঝা যেতে পারে। কবি, তার সত্য অনুভূতিজাত বোধের গভীরতা কতটা তীব্র এবং অনুভূতিকে শব্দশিল্পে রূপান্তরে কতটা সফল—তার একটি ছবি গ্রাফ থেকে বোঝা যেতে পারে। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিকে গ্রাফে স্থাপন করলে একটি ‘সরলরেখা’ পাওয়া যায়। এতে কবির বোধের সাথে কবিতার শরীরগত অনুভূতির Permutation ও Combination -এর সাদৃশ্য রয়েছে। আবার ‘বনলতা সেন’ কবিতার বিষয়বস্তু অর্থাৎ যাযাবর জীবন যে কেবল পথে পথে ভ্রমণের নেশায় ঘুরে বেড়ায়, সরল সে পথ, সরল সে জীবন (ইতিহাসের চেতনায় স্পষ্ট) তার ইঙ্গিতও গ্রাফে পাওয়া যাচ্ছে। সরল ভালোবাসাকাতর দীর্ঘ সরল পথের ক্লান্ত যাত্রী—সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন নিশ্চুপ সন্ধ্যা নেমে এলে, নাটোরের সরলবর্তী বনলতা সেন কেবলই মন্ত্রমুগ্ধ চোখে ক্লান্ত যাত্রীর মুখোমুখি বসে থাকে। জীবনানন্দ দাশের স্নিগ্ধ কাব্যমেজাজ, কাব্যবিষয়—সবকিছুই যেন তাকে আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত করে তোলে বোধের অনুভূতির সাথে। শব্দচয়ন বিন্যাস-সমাবেশ আর কবিতার শরীরের কাঠামোয়। দৃশ্য মেজাজ, বিষয়বস্তু, মস্তিষ্কের বিন্যাস সমাবেশ — তার শব্দে রূপান্তরের শরীর; সবকিছুই পেয়ে যায় সরলমাত্রিক ব্যঞ্জনা। দৃশ্য, চিত্তা ও প্রকাশের সাথে মিল খুঁজে পায় কবিতা। সবকিছু লুকিয়ে কবির বোধ সঞ্চারণ সঞ্চায়িত হয়ে ওঠে পাঠক-হৃদয়ে।
এখানে ‘বনলতা সেন’ কবিতার একটি মান স্তবক দেখানো হলো। এর ফলে একটি সরলরেখার নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ কবিতাটির মধ্যে গভীরতল (deep-struc ture) এবং অধিতলের (surface-structure)-এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত সাঙ্গীতিক কাব্যতত্ত্বের ভাষার সংবর্তনকেই অর্থের শক্তি দিয়ে ‘কবিতা’র কবিতা হয়ে ওঠার মৌল-চিহ্ন প্রকাশ করে ৷
‘বনলতা সেন’ পাঠকের সমষ্টিক চেতনায় এক অনপনেয় প্রতীক। ধ্বনি আর অর্থের ব্যঞ্জনায় কবিতাটি ‘ইন্টিগ্রেশন কনস্ট্যান্ট’ হিসেবে পাঠক-হৃদয়ে জেগে আছে, জেগে থাকবে। ‘বনলতা সেন’ কোনো স্বপ্ন কিংবা বাস্তবতাকে প্রতিভাসিত করে না; বরঞ্চ বলা যায়, এ এক মুদ্রার নির্মাণ, যার এক পিঠে বাস্তবতা, অন্য পিঠে স্বপ্নময়তা।
বহির্বয়বে এই কবিতায় তেমন চমক নেই। তিনটি স্তবকে বিভক্ত। প্রতিটি স্তবক ছয় পংক্তির। প্রতি স্তবকে প্রথম ও তৃতীয় এবং দ্বিতীয় ও চতুর্থ পংক্তিতে অন্ত্যমিল, যেমন অন্ত্যমিল পঞ্চম ও ষষ্ঠ পংক্তিতে।
গোটা কবিতা প্রথাগত পয়ারে, অক্ষরবৃত্তের নিয়ম মেনে। প্রথম স্তবকে প্রতিটি পংক্তি বাইশ মাত্রার। দ্বিতীয় স্তবকে শৃঙ্খলাহীনতা। পংক্তিগুলো যথাক্রমে- আঠারো, বাইশ, চোদ্দ, ছাব্বিশ, ছাব্বিশ, বাইশ। তৃতীয় স্তবকেও এই শৃঙ্খলাহীনতা অব্যাহত : পংক্তিগুলো যথাক্রমে—আঠারো, আঠারো, বাইশ, আঠারো, ছাব্বিশ, বাইশ।
বনলতা সেন কবিতাটির ছত্র সংখ্যা ১৮। তিনটি স্তবক—প্রতি স্তবকে শব্দ সংখ্যা প্রায় একই—৪৫, ৪৬, ৪৬। কমা-সেমিকোলনের বিরতিসহ বাক্য তিনটি। অর্থাৎ বাক্য- শেষের পূর্ণচ্ছেদ তিনটিই আছে। এই তিনটি বাক্য কবিতার টেক্সটের বৃহৎ বাক্যটিকে গঠন করেছে। প্রতিটি বাক্যে যেমন একটি ‘ফর্ম’ ও একটি ‘কনটেন্ট’ থাকে, কবিতার বাক্যতেও তাই থাকে। চমস্কিয় ‘সারফেস স্ট্রাকচার’ হচ্ছে লক্ষ্য-যোগ্য বা প্রকাশিত ‘expressive’ স্তর বাক্যের; আর স্পষ্ট করে বলা যায় ধ্বনি বা লিখিত প্রতীক বিমূর্তভাবে বললে অন্বয়, শব্দ ও শব্দাংশের সাজানোটি। কবিতার একটি যুক্তি-শৃঙ্খলা, গঠন-শৃঙ্খলা থাকে, উপরিতলের গঠনে সেটিই ধরা পড়ে—প্রথমে যেটা জানানো হল তার পটে বা প্রতি- তুলনায় নতুন ‘সংবাদ’ এই তলে আসে—জটিল গঠনের পার্থক্য ‘differentials -টি স্পষ্ট করে। বিশেষভাবে নির্বাচিত (সর্বদা যে সচেতনভাবে হয় তা নয়) প্রকাশ পদ্ধতি পাঠকের অভিজ্ঞতার ওপর নানা প্রভাব ফেলে। এই প্রকাশের গঠন থেকেই সে অর্থ নিষ্কাশিত করে। বলা যায় এই ‘Structure of the Syntatic Surface’-ই কবিতা- পাঠের কর্মটির ওপর সরাসরি অভিঘাত আনে: বাঁদিকে থেকে ডানদিকে পড়ায় ছত্রের হ্রস্বতা-দীর্ঘতা, এর পুনরাবৃত্তি এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশের পদ্ধতিতেই কবির সম্পর্কেও ধারণা তৈরি করে— প্রচ্ছন্ন কবিকে আবিষ্কার করা যায়, সর্বনাম-বিশেষ্য হয়ে ওঠে বিশেষ্য- সর্বনাম বনলতা সেন কবিতাটিতে প্রথম ছত্রের সর্বনাম ‘আমি’ কবিতার বাক্যে কবি, পরিশেষে মানুষে রূপান্তরিত— অর্থাৎ বিশেষ্যে তার উত্তরণ ঘটে। ‘হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’— একেবারে গদ্যের বাক্য-গঠন অনুযায়ী যাকে বলা যায় ‘গ্রামাটিক্যাল’। ‘হাজার বছর’ অর্থাৎ হিসাব মতো চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে, আবার ‘হাজার’ অর্থে দীর্ঘ সময়কেও দ্যোতনা করা হয়ে থাকতে পারে। ‘পথ’ শব্দটি দু’বার ব্যবহৃত—’হাঁটিতেছি’, এই সাধু-ক্রিয়ায় সময়ের দূরত্ব প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু সময়ের জায়গায় কবি যখনই ‘স্পেস’ বা দেশ-এর প্রসঙ্গ এনেছেন, তখনই ক্রিয়ার রূপও পাল্টেছে—’অনেক ঘুরেছি আমি’। সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে—এই পরিক্রমা খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর আগে বস্তুত কোনো ভারতবাসীর পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই তো হাজার বছরের উল্লেখ করেন কবি। এই চক্রমণ ‘নিশীথের অন্ধকারে’, এরও আগে তিনি ছিলেন, ‘বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে’—’ধূসর’ বিশেষণটি লক্ষণীয়, আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভনগরে। অন্ধকার ও ধূসর — এই দুটি রং এখানে আছে। সময়ের দীর্ঘ দীর্ঘ পথে এই একাকী পরিক্রমা, অন্ধকারে ও ধূসর জগতে। ‘অন্ধকার’ শব্দটি কবিতায় পাঁচবার ব্যবহৃত অন্ধকারের এই পুনরাবৃত্তি পাঠকের মনে একটি নির্জন ক্লান্তির চেতনা আনে। ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’— কবি নিজের পরিচয় এভাবেই দেন। ইতিমধ্যে দীর্ঘ লাইনের ছন্দে ও আ-কারের ব্যবহারে এই ক্লান্তি ও সময়ের দূরত্ব দুই-ই ধরা পড়ে। আর এর মধ্যেই কবি জানিয়ে দেন, ‘চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’— শেষ দুটি শব্দে ‘স’ পর-পর থাকায় জীবনের চঞ্চলতা আভাসিত হয়, কিন্তু ঐ ক্লান্তিকে না ভেঙেই।
কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকে বনলতা সেন সম্পর্কে বলা হয়। প্রথম স্তবকে ‘আমি’ বা কবি স্বয়ং প্রতিষ্ঠিত, দ্বিতীয়টিতে বনলতা সেন। বনলতা নামটিও তাৎপর্যপূর্ণ : ইতিহাস অতিক্রমকারী প্রকৃতিরই অনুষঙ্গ জড়িয়ে। বিদিশার নিশা ও শ্রাবস্তীর কারুকার্য বনলতার চুল ও মুখের উপমা-চিত্রকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই দুটি নগরীই রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, বৌদ্ধগ্রন্থে উল্লিখিত। দুটিই বণিকদের কেন্দ্রস্থল, বৌদ্ধ পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ বনলতা ইতিহাসের পর্যায়ে প্রসারিত—সময়ের উৎক্ষেপ তার চুলে ও মুখে। লক্ষণীয় হল— সিংহল, সমুদ্র, মালয় সাগর, বিদিশা, শ্রাবস্তীর উল্লেখে ‘আমি’ বা কবিকে শুধু ক্লান্ত পথিক মনে হয় না, মনে হয় সমুদ্র যাত্রী বণিক। আর প্রচ্ছন্ন উপমাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই চিত্রকল্পে—’হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা’।
নাবিকের এই উপমাটি, দারুচিনি-দ্বীপের উল্লেখে সমুদ্র-অভিযানকারী প্রাকৃতিক দুর্যোগ- বিপর্যস্ত এক বণিকের চিত্রকল্পই নিয়ে আসে। সার্বিক এক সর্বনাশের ইঙ্গিত : সর্বনাশের হতাশা ক্লান্তির, অন্তহীন ক্রুদ্ধ জলরাশির পর সবুজ ঘাসের মতো বনলতা সেনকে মনে হয়েছিল। প্রকৃতির উপমা আবার। আর চোখের উপমা তাই হয় ‘পাখির নীড়’। বিপর্যস্ত অভিযানকারীর কাছে ‘নীড়’–আশ্রয়, শান্তিও ইপ্সিত। সেই নারী প্রশ্ন করে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?” “ছিলেন’ শব্দটিতে এ সময়ের ধ্বনিই উচ্চারিত। সে অপেক্ষা করে আছে, আসতে এত দেরি কেন? ‘এতদিন’ শব্দবন্ধটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ‘কোথায়’ প্রশ্নবোধক এই শব্দটি কবিতার বাক্যের প্রথমাংশে দেখা যায়—কোথায় এর উত্তর দুরূহ- কারণ পথিকের ঠিকানা পরিক্রমায় পাল্টায়।
কবিতাটির তৃতীয় স্তবকে কবি ও বনলতা সেনের পরিচয়ের পর নতুন একটি ‘সংবাদ’ আসে। জানা হয়ে গেছে, বনলতা নাটোরের—একটি বিশেষ স্থানের। যদিও সময়ের উড়ালে সে কবেকার বিদিশার, শ্রাবস্তীর। দেশ-কালের এস ‘টেনশন’ কবিতাটির টেক্সটের, বাক্যের তৃতীয় অংশ নিয়ে আসে। এই অংশে প্রকৃতিঃ শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে। ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল। এই অংশে রৌদ্র ও জোনাকির রঙে ঝিলমিলের মতো শব্দ, শব্দসমষ্টি ব্যবহৃত হয়েছে ধূসর—অন্ধকারের প্রায় প্রতিপক্ষকেই। শুধু তা-ই নয়, চিত্রময়তা শ্রাব্য চিত্রকল্পে আশ্রয় নেয় ‘শিশিরের শব্দের মতন’। কিন্তু ‘রৌদ্রের গন্ধ’র মতো চিত্রকল্পে, যা চিত্রময় নয় প্রত্যক্ষত। এই অংশে, পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলেও ধূসর অন্ধকার থাকে না; বরং পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন। পাণ্ডুলিপি—যে লিপিতে কারুর হস্তক্ষেপ ঘটেনি, যে লিপি ব্যক্তির নিজ জগতের একটি অকুণ্ঠ প্ৰয়াসঃ গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল। এগারো লাইনের ‘দেখেছি তারে অন্ধকারে’ আর ষোলো লাইনের ‘গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল’ পৃথক, কবিতার গঠনের ‘dif- ferential’ টি স্পষ্ট। সতেরো লাইনে আবার ব্যবসার উপমা ‘ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন’। সব পাখি, নদী ঘরে আসে। সময়-ইতিহাস যেন এক নটরাজ-মুহূর্তে স্থির- থাকে শুধু অন্ধকার, এ অন্ধকার প্রথম দুটি স্তরকের ধূসর দূর অতীতের অন্ধকার নয়, এ অন্ধকার বর্ণময়, নিজেকে পাবার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন, নিজ প্রেম অভিজ্ঞানকে আবিষ্কারের।
বনলতা সেন। নামের সঙ্গে পদবি যুক্ত করে পাঠকদের গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিলেন জীবনানন্দ। কবিতার নারীরা বাস্তবের মূর্তিতে খুব বেশি ধরা দেয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের নামও থাকে না; থাকলেও সে নাম হয় রোমান্টিক কল্পনার স্পর্শমাখা; প্রকৃত নাম নয়। তিনি এই ট্র্যাডিশনকে অনায়াসে অস্বীকার করলেন। কবিতার নায়িকার নাম দিলেন ‘বনলতা সেন’ এবং তার একটা ঠিকানাও দিলেন – নাটোর। নাটোরের বনলতা সেন।
পদবি জিনিসটা একেবারেই রোমান্টিক নয়। বিশেষ করে ভারতে। ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় পদবি প্রবলভাবেই সামাজিক শ্রেণী দ্যোতক একটি ব্যাপার। পদবি থেকে জাতি- ধর্ম-বর্ণ অনেকটাই নির্দিষ্ট হয়ে যায়। আবার এক-একটি অঞ্চলে এবং এক একটি সামাজিক গোষ্ঠীতে দেখা যায় এক এক ধরনের পদবির প্রাধান্য। যে নারীর নামের সঙ্গে একটা পদবি আছে, তার সামাজিক বাস্তবতা যেন কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। জীবনানন্দ যখন বনলতার সঙ্গে ‘সেন’ পদবিটি জুড়ে দিলেন, তখন অনেকেই এই নামের আড়ালে বাস্তব কোনো একটি নারীর অস্তিত্ব অনুমান করেছিলেন।
সমগ্র কবিতায় দুটি বনলতার আবির্ভাব-সম্ভাবনায় টান টান হয়ে উঠতে হয়। প্রথম বনলতা অবশ্যই চেনা এবং সে কেবলমাত্র নাটোরের-ই। কিন্তু দ্বিতীয় বনলতা? তার রূপ এবং স্বরূপ তো অচেনা। দীর্ঘ অদর্শনের কারণেই অচেনা। এই দ্বিতীয় বনলতাকে নিয়েই কিন্তু কবিতা। জীবনানন্দ দেখিয়ে দিলেন তার দেহী রূপ : পুরুষপ্রেমিকের চোখের মধ্য দিয়ে সেই বনলতাকে, তাঁর—
চোখ
চুল মুখ কণ্ঠ সত্তা |
… পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে
… চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা … মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য … এতদিন কোথায় ছিলেন … থাকে শুধু অন্ধকার |
অন্ধকার দিয়ে তৈরি সত্তা, অন্ধকারেই তাকে দেখতে হয় এবং সেই অন্ধকারেই বোঝা যায় আবহমানকালের ইতিহাস তার শরীরের ভূষণ। ইতিহাসের অলঙ্কার দিয়ে সাজানো এই বনলতা সৌন্দর্য-রূপের চমৎকার উদ্ভাসে আর যে সেই নাটোরের বনলতা নেই, তা অনুমান ক’রে নিতে অসুবিধা হবার কথা নয়। দু-দণ্ডের শান্তি পুরুষপ্রেমিককে যে ইচ্ছাপূরণের গতিশীল যাত্রীতে পরিণত করেছে, সেই কামনাসৃষ্ট ইচ্ছাপূরণ আর কি সম্ভব?
বনলতা সেন কব্যের নির্মিতি
১. উপমা+তুলনা
পাখির নীড়ের মতো চোখ; শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা; প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির ভেজা চোখের মতো ঝলমল করছিল সমস্ত নক্ষত্রেরা; বেবিলনের রানির ঘাড়ের উপর উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ; আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানা; পৃথিবী কীটের মতো; বাতাস এসেছে … সিংহের হুংকারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো; আমার হৃদয় নীল হাওয়ার সমুদ্র স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো; নক্ষত্রের মাস্তুল; আকাশের রূপালি শস্য; নীল আকাশে খই খেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা; সোনার ডিমের মতো ফাল্গুনের চাঁদ; পাখার পিস্টনের উল্লাস; কচি লেবু পাতার মতো নরম সবুজ আলোয়; কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস; বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত দুই চোখ; ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন; আকাশের রঙ ঘাস ফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল; পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ; একটি তারা পাড়াগাঁয়ের বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলিমদির মেয়েটির মতো; মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন; আগুন … রোগা শালিখের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো; মেহগনির মতো অন্ধকার; কচি বাতাবি লেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস; সূর্যের সোনার বর্শা; নদীর জল মচকা ফুলের পাপড়ির মতো লাল; হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে; বিচূর্ণ থামের মতো দ্বারকার; ভালো পরিচিত রোদের মতন তোমার শরীর; পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়; তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল; দুধের মতন শাদা নারী।
২ বিশেষণ
সবুজ ঘাসের দেশ; সোনালি সোনালি চিল; গভীর হাওয়ার রাত; বিস্তীর্ণ হাওয়া; নীল হাওয়ার সমুদ্রে; ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখ; মৃত আকাশ; জীবনের গভীর জয়; প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ; প্রবল নীল অত্যাচার; উত্তুঙ্গ বাতাস; বিস্তীর্ণ ফেল্ট; বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে মিলনোন্মত্ত বাঘিনী; অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়; শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে, নিবিড় ঘাস-মাতার শরীরের সুস্বাদু অন্ধকার; সোনালি শব্দহীন জ্যোৎস্না; ধূসর পেঁচা; সোনার সিঁড়ি; বিমর্ষ পাখির রঙ; নীল চাঁদ; শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার; করুণ শঙ্খ; আলোর রহস্যময়ী সহোদর; বিলুপ্ত নগরী; ধূসর প্রাসাদ; বিলুপ্ত হৃদয়; মৃত চোখ; বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা; কমলা রঙের রোদ; লুপ্ত নাসপাতির গন্ধ; অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি; আয়ুহীন স্তব্ধতা; রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ; রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ; নীল মদের গেলাসে; ময়ূরের সবুজ নীল ডানা; সুন্দর বাদামি হরিণ; অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু; বিস্তীর্ণ উল্লাস; একটি অদ্ভুত শব্দ; পুরানো শিশিরভেজা গল্প; নিরপরাধ ঘুম; বিলুপ্ত ধূসর কোনো পৃথিবীর শেফালিকা আহা; অমৃত সূর্য; পরিচিত রোদ; পাণ্ডুর চাঁদ; মূর্খ উচ্ছ্বাস; করুণ মাংস; সেকালের শক্তির মতন; রূঢ় রৌদ্র; গভীর বাতাস; অকূল সুপুরিবন; এক মাইল শান্তি কল্যাণ; তিলোত্তমা নগরী; গভীর হৃদয়; বিহ্বল বাতাস; নিবিড় মেরুন আলো; জনবিরল গভীর বাতাস; অনন্ত রৌদ্র; শাশ্বত রাত্রি; অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন।
৩. ঐতিহাসিক + ভৌগোলিক
সিংহল সমুদ্র; মালয় সাগর; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগত; বিদর্ভ নগর; নাটোরের বনলতা সেন; বিদিশার নিশা; শ্রাবস্তীর কারুকার্য; দারুচিনি দ্বীপের ভিতর; মনিয়ার ঘরে রাত; বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের উপর; এশিরিয়া মিশরে বিদিশায়; রাঙা রাজকন্যাদের মতো; কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ; কবেকার শঙ্খিনীমালার; বিলুপ্ত নগরী; ধূসর প্রাসাদ; ভারত সাগর; ভূমধ্যসাগর; টায়ার সিন্ধু; পারস্য গালিচা; কাশ্মিরী শাল; বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল; অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা; লুপ্ত নাসপাতির গন্ধ; মিশরের মানুষী; বৈতরণী; কীর্তিনাশা; দ্রাক্ষা; দুধ; ময়ূর শয্যার কথা; গ্রীক হিন্দু ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন; তিলোত্তমা নগরী; ভূমধ্যসাগর লীন দূর এক সভ্যতার থেকে; ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে; তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতর কবেকার সমুদ্রের নুন; কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে।
৪. নৈসর্গিক জ্যোৎস্নারাশি
সবুজ ঘাসের দেশ; পাখির নীড়ের মতো; শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে; জোনাকির ঝিলমিল; ধানের ছড়ার পাশে; কার্তিকের ঘাসে; সন্ধ্যার কাক; হলুদ নদী; শর কাশ হোগলায়; হাঁসের নীড়ের থেকে খড়; শীত; শিশিরের জল; শিরীষ; জাম; ঝাউ; আম; বাবলার গলির অন্ধকারে; অশ্বত্থের জানালার ফাঁকে; চিলের ডানা; শিশির; বনহংস; বনহংসী; দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে; ধানখেতের কাছে ছিপছিপে শরের ভিতর এক নিরালা নীড়ে; ঝাউয়ের শাখা; শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে; কচি লেবুপাতা; কাঁচা বাতাবি; হরিণেরা; ঘাস-মাতা; পেঁচার ধূসর পাখা; জলা মাঠ; হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ; কল্পনার হাঁস; কাত্তারের পথ; বেতের ফলের মতো; ধূসর পেঁচা; সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে; শিরীষের ডালে; হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে; কাকাতুয়া পায়রা; মেহগনির ছায়াঘন পল্লব; অজস্র হরিণ ও সিংহের ছাগের ধূসর পাণ্ডুলিপি; ময়ূরের পেখম; আকাশের রঙ ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল; পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ; মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন; রোগা শালিক; ময়ূরের সবুজ নীল ডানা, চিতাবাঘিনী; সুন্দীর বন থেকে অর্জুনের বন; সুন্দর বাদামি হরিণ; কচি বাতাবি লেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস; নদীর জল মচকা ফুলের পাপড়ির মতো লাল; রূপালি চাঁদের হাত; শিশিরের পাতায়; বাতাস ঝাড়িছে ডানা; হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে; বাদামি পাতার ভিড়ে; হেমন্তের সন্ধ্যা; আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি; পরিচিত রোদ; নদীর চ্ছলচ্ছল শব্দ; পাণ্ডুর চাদ; ধানসিড়ি নদী; নীল কস্তুরী আভার চাঁদ; হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি; হে হিম হাওয়া; হে কমলালেবুর করুণ মাংস; নক্ষত্রের নীচে; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে হেমন্ত আসিয়া গেছে; চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি, ঘুঘু, শালিক; শিশিরের জল; অঘ্রাণের খড়; হরিনীর ভিড়; মস্ত বড় ময়দান— দেবদারু পামের নিবিড় মাথা; নীল গাই; চিতল-হরিণ; কাঁচপোকা গঙ্গাফড়িং; আম নিম হিজলের ব্যাপ্তি; দারুচিনি বনানী; লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে।
৫. ইন্দ্রিয়ের প্রসারণ
সবুজ ঘাসের গন্ধ; রৌদ্রের আঘ্রাণ; জলের গন্ধ; ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে গেলাসে পান করি; ঘাসের পাখনায় আমার পালক ; সুস্বাদু অন্ধকার; হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ; কুয়াশার পাখনা; সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে; কমলা রঙের রোদ; ঘিয়ের ঘ্রাণ; শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ।
৬. বিবিধ
বিছানা ছিঁড়ে; ঘেঁষে; নক্ষত্রে মাস্তুল; পাখার পিস্টনের উল্লাস; ঘাসের শরীর ছানি— চোখে চোখ ঘষি; হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে; এঞ্জিনের মতো শব্দে; উম; তোমার মতন এক মহিলা; দাঁড়ায়ে রহিলো হাঁটুভর; ভোটের ব্যালট; মানুষের তরে এক মানুষীর হৃদয়; ট্রাম-বাস; গ্যাসলাইট; ইট বাড়ি সাইনবোর্ড; মনুমেন্ট মিনারের মাথা।
জীবনানন্দের উপমা মুখ্যত ইন্দ্রিয়স্বাদের বিস্তৃতি সাধনের জন্য রচিত। এ প্রচেষ্টায় তিনি কখনো উপমেয়-উপমানের মধ্যে যোগাযোগ রেখেছেন এবং অধিকাংশ সময়ই রাখেননি; বারবার ব্যবহার করেছেন সাদৃশ্যবোধক শব্দ ‘মতো’ মতন—একমাত্র রাইনের মারিয়া রিলকে ছাড়া এ-ক্ষেত্রে তাঁর তুলনা পাওয়া দুঃসাধ্য। উপমার মধ্যে যে-দুটি অংশ থাকে, উপমেয় এবং উপমান, তার মধ্যে তিনি জোর দিয়েছেন উপমানের ওপরে অধিকতর। উপমান পদটিকে তিনি সৃষ্টি করেছেন কল্পনা, বোধ, আবেগ, চিন্তার সংযোগে; তাকে সুদূর করেছেন, জটিল করেছেন, বহু বিশেষণে তার আয়তনের মধ্যে বিস্তৃতি এনেছেন, তারপরে সৃষ্টি হয়েছে উপমানটি। উপমেয় নিয়ে তিনি বেশি চিন্তিত নন, কোনো কবিই নন, তাকে সাধারণত সহজ রেখেছেন, মাঝেমধ্যে বিশেষণ বসিয়েছেন তারও আগে, কিন্তু তাঁর অপরিসীম যত্ন উপমানের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। যেমন :
উপমান | উপমেয় |
১. পাখির নীড়ের মতো
২. প্রেমিক চিল পুরুষের শিশিরভেজা চোখের মতো ৩. বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের উপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো ৪. সিংহের হুংকারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র ৫. নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো ৬. নীল আকাশে খই খেতের সোনালি ফুলের মতো ৭. বেতের ফলের মতো ৮. রাঙা রাজকন্যাদের মতো ৯. পাড়াগাঁয়ের বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলিমদির মেয়েটির মতো ১০. রোগা শালিখের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো ১১. বিচূর্ণ থামের মতো ১২. ভালো পরিচিত রোদের মতন ১৩. সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল |
১. চোখ
২. ঝলমল করছিল সমস্ত নক্ষত্রেরা ৩. জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ ৪. বাতাস এসেছে জেব্রার মতো ৫. আমার হৃদয় ৬. অজস্র তারা ৭. তার ম্লানচোখ ৮. সে ৯. একটি তারা ১০. আগুন ১১. দ্বারকার ১২. তোমার শরীর ১৩. তুমি |
‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় (আশ্বিন) ১, দ্বিতীয় সংখ্যায় (পৌষ) ৪, তৃতীয় সংখ্যায় (চৈত্র) ৩, চতুর্থ সংখ্যায় (আষাঢ়) ২টি কবিতা প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যায় (আশ্বিন) ৫, দ্বিতীয় সংখ্যায় (পৌষ) ৪, তৃতীয় সংখ্যায় (চৈত্র) ২, চতুর্থ সংখ্যায় (আষাঢ়) ২টি কবিতা প্রকাশিত হয় ।
বনলতা সেনঃ এক পয়সায় একটি গ্রন্থমালা
১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেরোল ‘এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থমালার প্রথম বই। বুদ্ধদেব বসুর পুস্তিকা ‘এক পয়সায় একটি’। ষোল পৃষ্ঠার বই, ষোলটি কবিতা, দাম ষোল পয়সা অর্থাৎ চার আনা। যামিনী রায়ের করা প্রচ্ছদ। ‘কবিতা’র ১৩৪৮ সনের চৈত্র সংখ্যায় লেখা (জানানো) হল—’সম্প্রতি আমরা কবিতার একটি সুলভ গ্রন্থমালা প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছি। এই গ্রন্থমালার নাম এক পয়সায় একটি। এই নামটিতে কিছু বিদ্রূপ, হয়তো কিছু ঔদ্ধত্য আছে— তা থাক। কিন্তু নামটির সার্থকতা এইখানে যে ষোল পৃষ্ঠার এক একটি কবিতার বই চার আনা মূল্যে যে-কোনো শ্রেণীর পাঠকই অনায়াসে কিনতে পারবেন—একথা মনে রেখেই আমাদের উদ্যম’।
‘এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থমালার প্রথম দুখানি বই প্রকাশিত হলে ‘প্রবাসী’ চৈত্র ১৩৪৮ সনের সংখ্যার ‘পুস্তক পরিচয়’ বিভাগে বিজ্ঞপ্তি ছিল— ‘এক পয়সায় একটি’
এটি একটি নতুন কবিতা-পুস্তকাবলীর নাম। এই পুস্তিকাগুলির প্রত্যেকটিতে ১৬টি করে এক-এক পয়সা দামের কবিতা আছে। প্রত্যেক পুস্তিকার দাম ১৬ পয়সা অর্থাৎ চার আনা। আপাততঃ বুদ্ধদেব বসু ও অমিয় চক্রবর্তীর বই দুটি ছাপা হয়েছে। কবিতাগুলি হালকা ধরনের ও সুখপাঠ্য। অমিয়বাবুর বইটি হাতের তৈরি কাগজে ছাপা। মলাটটি সুন্দর। পরে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অজিত দত্ত, অন্নদাশঙ্কর রায়, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, সমর সেন, জীবনানন্দ দাশ, হুমায়ুন কবীর, বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা বেরুবে। ২০২,রাসবিহারী এভিনিউ, কলিকাতা ঠিকানায় কবিতা ভবনে পাওয়া যাবে।’
‘কবিতা’য় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, এই সিরিজে আঠারোটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসু একে আর জীবনানন্দ দাশ এগারোয়
১. বুদ্ধদেব বসু — এক পয়সায় একটি
২. অমিয় চক্রবর্তী — মাটির দেয়াল
৩. কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় — সোনার কপাট
৪. অন্নদাশঙ্কর রায় — উড়কি ধানের মুড়কি
৫. বুদ্ধদেব বসু — ২২শে শ্রাবণ
৬. অশোকবিজয় রাহা — ভানুমতীর মাঠ
৭. সুধীরচন্দ্র কর — ওপারেতে কালো রং
৮. মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় — মন-পবন
৯. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় — কয়েকটি নায়ক
১০. বিমলচন্দ্র ঘোষ — উলুখড়
১১. জীবনানন্দ দাশ — বনলতা সেন
১২. বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় — চন্দ্রবালা
১৩. সমর সেন — খোলা চিঠি
১৪. অমল ঘোষ — কালো হরফ
১৫. হরপ্রসাদ মিত্র — ভ্রমণ
১৬. কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় — রাজধানীর তন্দ্রা
১৭. তড়িৎকুমার সরকার — ঘুমোও নগর
১৮. অনিলরঞ্জন বিশ্বাস — গৈরিক
‘বুদ্ধদেব বসুর কবিতা সংগ্রহে’র (২য় খণ্ড) গ্রন্থপরিচয়ে নরেশ গুহ লিখেছেন—অতি প্রতিকূল পরিবেশেও কবিতার চর্চা যে সমানই জরুরি, তার একটি চমকপ্রদ প্রমাণ দেখতে পাওয়া গিয়েছিলো রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে, অন্ধকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অকালে, তুমুল অগাস্ট আন্দোলনের টালমাটাল বছরে। কবিতাভবন থেকে এইসময় মাঝে-মাঝে ক্ষুদ্রকার অথচ অভিনব, সস্তা অথচ মূল্যবান, একটি করে কবিতার পুস্তিকা বেরুতে থাকে যার নাম এক পয়সায় একটি। সিরিজের প্রথম পুস্তিকার ঐ একই নাম’।
কবিতা ভবনের ‘এক পয়সায় একটি’ গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত হলো জীবনানন্দের ১৬ পৃষ্ঠার পেপারব্যাক পুস্তিকা। জীবনানন্দের নিজের টাকায় পুস্তিকাটি বেরিয়েছিল। প্রকাশক হিসেবে নাম লেখা ছিল জীবনানন্দ দাশ/বরিশাল। প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন শম্ভু সাহা। প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ১৯৪২, পৌষ ১৩৪৯। কবি তখন বরিশাল বি.এম (ব্রজমোহন কলেজের অধ্যাপক। কবিতা ভবনের প্রতিষ্ঠাতা বুদ্ধদেব বসু বইয়ের প্রুফ দেখে দিয়েছিলেন। ‘বনলতা সেন’ কবিতাভবন সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ১২টি কবিতা—
১. বনলতা সেন/ ‘কবিতা’, পৌষ ১৩৪২/১:২।
২. কুড়ি বছর পরে / ‘কবিতা’, পৌষ ১৩৪২/১:২।
৩. ঘাস / ‘কবিতা’, পৌষ ১৩৪২/১:২।
৪. হাওয়ার রাত/ ‘কবিতা’, চৈত্র ১৩৪২/১:৩।
৫. আমি যদি হতাম / ‘কবিতা’, চৈত্র ১৩৪২/১:৩।
৬. হায়, চিল/ ‘কবিতা’, চৈত্র ১৩৪২/১:৩।
৭. বুনো হাঁস/ ‘কবিতা’, আষাঢ় ১৩৪২/১:৪।
৮. শঙ্খমালা/ ‘কবিতা’, আষাঢ় ১৩৪২/১:৪।
৯. নগ্ন নির্জন হাত / ‘কবিতা’, আশ্বিন ১৩৪৩/২:১।
১০. শিকার / ‘কবিতা’, আশ্বিন ১৩৪৩/২:১।
১১. হরিণেরা/ ‘কবিতা’, পৌষ ১৩৪৩/২:২ ।
১২. বিড়াল / ‘কবিতা’, চৈত্র ১৩৪৩/২:৩।
১৩৫০ সনে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (দ্বিতীয় বৰ্ষ, তৃতীয় সংখ্যা) সংখ্যার ‘একক’ (সম্পাদক: শুদ্ধসত্ত্ব বসু) কাব্যপত্রে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ‘কয়েকটি নায়ক’, বিমলচন্দ্র ঘোষ ‘উলুখড়’ আলোচিত হয়। ‘এক পয়সায় একটি’ সিরিজ সম্পর্কে ‘একক’ লেখে— ‘আমরা এ ধরনের পুস্তক প্রকাশের প্রয়োজনীয়তার কথা আগেও বলেছি এবং এখনও বলছি— সস্তা অথচ শোভন পুস্তিকার মধ্যে কবিতার সুধীজনোচিত পরিবেশন সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। এ ধরনের পুস্তিকার বহুল প্রচার আমরা কামনা করি’।
‘বনলতা সেন’ কবিতা পুস্তিকার প্রথম আলোচনা করলেন ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু। ১৩৪৯ সনের চৈত্র সংখ্যায় তিনি লিখলেন—
‘আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে নির্জন সবচেয়ে স্বতন্ত্র। বাংলা কাব্যের প্রধান ঐতিহ্য থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন এবং গেলো দশ বছরে যে সব আন্দোলনের ভাঙা-গড়া আমাদের কাব্যজগতে চলেছে তাতেও কোনো অংশে তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি শুধু কবিতা লেখেন, গল্প কিংবা প্রবন্ধ লেখেন না; তিনি একে স্বভাব-লাজুকতায় মফঃস্বলবাসী—এইসব কারণে আমাদের সাহিত্য রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপ থেকে তিনি সম্প্রতি যেন খানিকটা দূরে সরে গিয়েছেন। আধুনিক বাংলা কাব্যের অনেক আলোচনা আমার চোখে পড়েছে যাতে জীবনানন্দ দাশের উল্লেখ মাত্র নেই। অথচ তাঁকে বাদ দিয়ে ১৯৩০ পরবর্তী বাংলা কাব্যের কোনো সম্পূর্ণ আলোচনা হ’তেই পারে না; এই সময়কার তিনি একজন প্রধান কবিকর্মী, আমাদের পরিপূর্ণ অভিনিবেশ তাঁর প্রাপ্য। জীবনানন্দর কবিতার যেটি সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য বলে আমার মনে হয় সেটি—একটি সুর। … জীবনানন্দর কবিতার সুর একবার কানে লাগলে তাকে যে ভোলা শক্ত তার প্রমাণ এই যে সাধারণ পাঠক সমাজে তাঁর খ্যাতি যে অনুপাতে অল্প, সে অনুপাতে তাঁর অনুকারকের সংখ্যা আশ্চর্যরকম বেশি। … জীবনানন্দর সমগ্র রচনায় একটি বিষণ্ণ গাম্ভীর্য পরিব্যাপ্ত। … তিনি আমাদের নির্জনতম কবি। আমাদের সকলের মধ্যেই সেই যে একজন চিরকালের কবিকে মাঝে মাঝে দেখতে পাই যার দেশ নেই, কাল নেই, জাতি নেই, গোত্র নেই, মানুষের সমস্ত সুখ-দুঃখ, সভ্যতার সমস্ত উত্থান-পতন পার হ’য়ে যার সুর আজকের মতো কোনো এক বসন্ত-প্রভাতে হঠাৎ আমাদের মনে এসে ঘা দেয়, আর মুহূর্তে উচ্চনিনাদী প্রকাণ্ড বর্তমান সমগ্র অতীত-ভবিষ্যতের মধ্যে বিলীন হ’য়ে যায়—সেই নামহারা ক্ষণস্থায়ীকে কিছু সময়ের জন্য যেন কাছে পেলুম বনলতা সেন বইটিতে’।
‘কবিতা’ অথবা বুদ্ধদেব বসুর পর বনলতা সেন আলোচিত হল ১৩৪৯ সনের চৈত্র সংখ্যার চতুরঙ্গে (পঞ্চম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা), আবুল হোসেন লিখেছেন –
‘আধুনিক বাঙালী কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশই প্রধান ব্যক্তি যার সম্পর্কে সাহিত্যিক অসাহিত্যিক সব মহলেই অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। … একজন সমালোচক একবার লিখেছিলেন যে জীবনানন্দই বাংলার সেরা প্রতীকী কবি এবং প্রতীকীবাদ বলতে মোটামুটি যদি এই বুঝায় যে তা উপমা তুলনা অলঙ্কার অনুষঙ্গের আবর্তে পাঠকের মনে এমন এক রকমের মোহ সৃষ্টির প্রচেষ্টা যার প্রধানতম গুণ কেবল একটি সুর, তাহলে একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ কবির কাব্যের প্রাণ হ’ল তার অদ্ভূত মিশ্রণে: অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, পুরানোর সঙ্গে নতুনের, অসম্ভবে- সম্ভর্বে, অবিশ্বাসে বিশ্বাসে, গ্রামের সঙ্গে নগরের অপূর্ব সংযোজনে। বিদিশা, শ্রাবস্তী আর সিংহল সমুদ্রতীর ছেড়ে যেই এসে দেখি নাটোরের বনলতা সেন তার পাখীর নীড়ের মতো চোখ মেলে বলে এতদিন কোথায় ছিলেন, আকস্মিক বিস্ময়ের বিদ্যুৎস্পর্শে আমরাও শিহরিত হই। এত দূর আর এত কাছে, এই মিলিয়ে জীবনানন্দের টেকনিক’।
শুদ্ধসত্ত্ব বসু ১৩৫০ সনের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ‘একক’ পত্রিকায় লিখেছেন—
কবিতা ভবন থেকে প্রকাশিত এক পয়সার একটি সিরিজের গ্রন্থমালা। বনলতা সেন কবিতাটি আমাদের খুবই ভালো লেগেছে—’এমন স্বচ্ছ অথচ স্নিগ্ধ রোমান্টিক কবিতা বাংলা সাহিত্যে অল্পই আছে। মনোরম চিত্রের পটভূমিকার ওপর দিয়ে কবিতার নিখুঁত পরিবেশন; ভাববিলাসের সম্পদ সেখানে প্রচুর, কথার বুনুনি অপূর্ব, শব্দচয়নের জহুরিপনা চমৎকার। বনলতা সেন বাংলা সাহিত্যে নিঃসন্দেহে অমর সৃষ্টি এবং রবীন্দ্রনাথের পর এত সুন্দর ও সার্থক রোমান্টিক কবিতা আর সৃষ্টি হয়নি বললেই হয়’।
‘বনলতা সেন’ প্রথম থেকেই জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৫১ সালের ১৭ মার্চ সিগনেট প্রেসের কর্ণধার দিলীপকুমার গুপ্তকে এক চিঠিতে জীবনানন্দ লেখেন ‘বনলতা সেন আর নেই। বনলতা সেনের প্রথম সংস্করণ ৪/৫ বছর আগে ফুরিয়ে গেছে, কেবলমাত্র আমার কাছে পনেরো কপি ছিল, বিক্রি করব না ভাবছিলাম; কিন্তু বই বিক্রির জন্যেই; আপনাদের আগ্রহ আমার খুব ভালো লেগেছে; বারো কপি পাঠিয়ে দিলাম তাই’।
‘বনলতা সেন’ কবিতা ভবন সংস্করণ বেরিয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর উদ্যোগে আর জীবনানন্দের নিজের টাকায়। জীবনানন্দ রুচিবান ও পেশাদার প্রকাশক পেলেন দশ বছর পরে। ১৯৫২ সালে সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত হল বনলতা সেনের বৃহত্তর সংস্করণ। এই সংস্করণের প্রচ্ছদ আঁকলেন সত্যজিৎ রায়। বনলতা সেনের কবিতাভবন সংস্করণের ১২টি কবিতার সঙ্গে এই সংস্করণে যুক্ত হল আরও ১৮টি নতুন (প্রকাশিত) কবিতা সর্বমোট কবিতার সংখ্যা দাঁড়ালো ৩০টি। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুচ্ছের প্রথম প্রকাশের কাল (কয়েকটির কবিতার প্রকাশের স্থান-কাল পাওয়া যায়নি) —
১. বনলতা সেন/ ‘কবিতা’, পৌষ ১৩৪২/১:২ ।
২. কুড়ি বছর পরে / ‘কবিতা’, পৌষ ১৩৪২/১:২।
৩. হাওয়ার রাত/ ‘কবিতা’, চৈত্র ১৩৪২/১:৩।
৪. আমি যদি হতাম / ‘কবিতা’, চৈত্র ১৩৪২/১:৩।
৫. ঘাস/ ‘কবিতা’, পৌষ ১৩৪২/১:২।
৬. হায়, চিল / ‘কবিতা’, চৈত্র ১৩৪২/১:৩।
৭. বুনো হাঁস/ ‘কবিতা’, আষাঢ় ১৩৪২/১:৪।
৮. শঙ্খমালা/ ‘কবিতা’, আষাঢ় ১৩৪২/১:৪।
৯. নগ্ন নির্জন হাত / ‘কবিতা’, আশ্বিন ১৩৪৩/ ২:১।
১০. শিকার/ ‘কবিতা’, আশ্বিন ১৩৪৩/ ২:১।
১১. হরিণেরা/ ‘কবিতা’, পৌষ ১৩৪৩/২:২ ।
১২. বেড়াল/’কবিতা’, চৈত্র ১৩৪৩/২:৩।
১৩. সুদর্শনা/ ‘কবিতা’, আষাঢ় ১৩৫৮/ ১৬:১।
১৪. অন্ধকার/’কবিতা’, চৈত্র ১৩৫৬/১৫:৩।
১৫. কমলালেবু/ ‘কবিতা’, পৌষ ১৩৪৪/৩:২।
১৬. শ্যামলী/’দেশ’, শারদীয় সংখ্যা ১৩৫৬ ৷
১৭. দুজন/’কবিতা’, বৈশাখ ১৩৫৭/১৫:৩ ।
১৮. অবশেষে/ ‘বৈশাখী’, ১৩৪৮/ বর্ষ-১।
১৯. স্বপ্নের ধ্বনিরা/’কবিতা’, পৌষ ১৩৪৪/৩:২।
২০. আমাকে তুমি / পাণ্ডুলিপি: খাতা ৬, মার্চ ১৯৩৪।
২১. তুমি / ‘কবিতা’, আমার ১৩৫৮/১৬:৩ ।
২২. ধান কাটা হ’য়ে গেছে / ‘কবিতা’, আশ্বিন ১৩৫৮/ ১৬:৪ ।
২৩. শিরীষের ডালপালা/ ‘কবিতা’, আষাঢ় ১৩৫৮/১৬:৩।
২৪. হাজার বছর শুধু খেলা করে/ ‘কবিতা’, আশ্বিন ১৩৪৩/২:১।
২৫. সুরঞ্জনা/ ‘যুগান্তর’, শারদীয়া সংখ্যা/১৩৫৪।
২৬. মিতভাষণ/ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, শারদীয়া সংখ্যা/১৩৫৫।
২৭. সবিতা/ ‘অভ্যুদয়’ শারদীয়া সংখ্যা/ ১৩৫৪।
২৮. সুচেতনা/ পাণ্ডুলিপি: খাতা ৬, মার্চ ১৯৩৪।
২৯. অঘ্রাণ প্রান্তরে/ ‘কবিতা’, আশ্বিন ১৩৫৮/ ১৬:৪।
৩০. পথ হাঁটা/পাণ্ডুলিপি : খাতা ৬, মার্চ ১৯৩৪।
১৩৫৯ সালে পুজোর পূর্বে সিগনেট প্রেসের বিজ্ঞাপনপত্রী ‘টুকরো কথা’ ১৮, তারপর ১৯ এ: ‘নতুন বই, নতুন সংস্করণ মিলিয়ে সিগনেট প্রেস থেকে এবার পুজোয় আটখানা বই প্রকাশিত হচ্ছে’ বলে যে বিজ্ঞপ্তি বেরোয়, তার শেষদিকে সাতখানা গ্রন্থনামের পর দেখা যায় পরিবর্ধিত ‘বনলতা সেন’ বইয়ের বিবরণ :
‘…এবং শেষ বই : জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’। আধুনিক বিখ্যাতদের মধ্যে নির্জনতম কবি জীবনানন্দ দাশ, এবং ‘বনলতা সেন’ই তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন। প্রায় দশ বছর আগে বারোটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত এই বই বৃহত্তর পাঠকমহলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাঁকে। এখন তিরিশটি কবিতা নিয়ে বর্ধিত কলেবরে সিগনেট সংস্করণ ছাপা হল’।
মুদ্রণ-বিবরণ স্থলে শ্রাবণ ১৩৫৯ ছাপা হলেও ‘বনলতা সেন’ বোধহয় পুজোর কাছাকাছি প্রকাশিত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫২ সালে জীবনানন্দ সিগনেট প্রেসের মালিক (প্রকাশক) দিলীপকুমার গুপ্তকে বই পেয়ে ধন্যবাদ জানান।
দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সিগনেট প্রেস ‘বনলতা সেন’ বের হবার পর ‘জীবনানন্দ দাশ, তাঁর কবিতা’ রচনায় লিখেছেন— ‘আমার বনলতা সেন দেখে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি। এর পরে কবিতার বই বার করলে আমি নিজে আগাগোড়া সব দেখে শুনে ঠিক করব।’ আসলে, বই ঠিকঠাক ছাপা হলেও বইয়ের প্রচ্ছদ পছন্দ হয়নি জীবনানন্দের। যদিও সিগনেট সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী সত্যজিৎ রায়।
কবির জীবদ্দশায় যে গ্রন্থটি তাঁকে সর্বাধিক খ্যাতি দান করে, তা এই বনলতা সেন। ১৯৫৩ সালে ‘নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোক্তারা (সম্পাদক : অরুণকুমার সরকার) প্রথমবারের মতো জীবনানন্দকে ‘নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার’ (পরে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী) দেয়। পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০১ টাকা; সঙ্গে একটি উত্তরীয় ও একটি নারকেল। ১৯৫৪ সালের সেনেট হলে দু’দিন ব্যাপী (২৮-২৯ জানুয়ারি) যে বিরাট কবি সম্মেলন হয়েছিল, তার প্রথমদিনের সর্বশেষ কবি ছিলেন জীবনানন্দ। গোপালচন্দ্র রায় লিখেছেন, ‘বনলতা সেন সহ তিন-চারটি কবিতাটি পড়েছিলেন’। প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত লিখেছেন, প্রথম তিনটি কবিতা আশ্চর্য সুন্দর পড়েছিলেন। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি কিন্তু এক বারে লেখা হয়নি। বিখ্যাত এই কবিতার তিনটি খাড়া পাওয়া গেছে—
খসড়া-১
শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন
বনলতা সেন।
কোথায় নিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
মাছরাঙা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা
শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা
উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন
তুমি নাই বনলতা সেন।
তোমার মতন কেউ ছিল কি কোথাও?
কেন যে সবের আগে তুমি চলে যাও
কেন যে সবের আগে তুমি
পৃথিবীকে করে গেলে শূন্য মরুভূমি
(কেন যে সবার আগে তুমি)
ছিঁড়ে গেলে কুহকের ঝিলমিল টানা ও পোড়েন
কবেকার বনলতা সেন।
কত যে আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে
কত যে ঘুমিয়ে রব বস্তির পাশে
কত যে চমকে জেগে উঠব বাতাসে
হিজল জামের বনে থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রি
খসড়া-২ (একটি পুরোনো কবিতা)
আমরা মৃত্যুর থেকে জেগে উঠে দেখি
চারিদিকে ছায়াভরা ভিড়
কুলোর বাতাসে উড়ে ক্ষুদের মতন
পেয়ে যায় – পেয়ে যায় – অণু-পরমাণুর শরীর
একটি কি দুটো মুখ—তাদের ভিতরে
যদিও দেখিনি আমি কোনোদিন—তবুও বাতাসে
প্রথম গার্গীর মতো—জানকীর মতো হয়ে ক্ৰমে
অবশেষে বনলতা সেন হয়ে আসে।
খসড়া-৩ (আনুষঙ্গিক কবিতা)
বাঙালি পাঞ্জাবি মারাঠি গুজরাটি বেহারি উৎকলি – আর সব
সাগরপারের দেশের মানুষ
এই কলকাতায় আমরা লক্ষ লক্ষ লোক, কোটি কোটি প্রাণ -রোজ
ভোরে জাগি, অন্ধকারে ঘুমাই
এই কি শুধু? এর প্রচণ্ড রহস্যের কথা তোমাদের মনে জাগে না?
এক মুহূর্তের জন্যও কি মনে হয় না
যেন সেই অতীতের এসিরিয়া মিশর আবার তাদের গল্প বলে যাচ্ছে
এই কলকাতায়
মনুমেন্টের দিকে তাকিয়ে বেবিলনের সেই বিরাট স্তম্ভের কথা
মনে হয় না কি যার উপরে সিংহের মূর্তি ছিল?
এই শহরটাকে বেবিলন বলে মনে হয় না? মিশর বলে?
আমার কাছে এই শহরের ধুলো হাজার হাজার বছরের
পুরোনো বলে মনে হয়
জানালায় এর নারী, দিঘির জলে এর মাছ, আলিসায় এর পাখি,
দেয়ালে এর কীট
এক-এক সময় হেঁয়ালির মতো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বনলতা সেন, তুমি যখন নদীর ঘাটে স্নান করে ফিরে এলে
মাথার উপরে জ্বলন্ত সূর্য তোমার
অসংখ্য চিল, বেগুনের ফুলের মতো রঙিন আকাশের পর আকাশ
তখন থেকেই বুঝেছি আমরা মরি না কোনোদিন
কোনো প্রেম কোনো স্বপ্ন কোনোদিন মৃত হয় না
আমরা পথ থেকে পথে চলি শুধু — ধূসর বছর থেকে ধূসর বছরে—
আমরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকি শুধু, মুখোমুখি দাঁড়াই:
তুমি আর আমি
কখনো বা বেবিলনের সিংহের মূর্তির কাছে
কখনো বা পিরামিডের নিস্তব্ধতায়
কাঁখে তোমার মাদকতাময় মিশরীয় কলসী
নীল জলের গহন রহস্যে ভয়াবহ
মাথার উপর সকালের জ্বলন্ত সূর্য তোমার, অসংখ্য চিল
বেগুন ফুলের মতো রঙিন আকাশের পর আকাশ।
বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থেই দেখা গেছে আরেক বনলতা সেন’কে। এই কবিতাটি শরীরে- অন্তরে ‘বনলতা সেন’ কবিতারই সম্প্রসার মনে হয়—কিন্তু শেষপর্যন্ত সেটি একটি (‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’) স্বতন্ত্র কবিতাই—
দ্বিতীয় লেখন :
হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:
চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নির্বাণ
বালির উপরে জ্যোৎস্না—দেবদারু ছায়া ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো: দ্বারকার—দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত ম্লান
শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের—ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন
মনে আছে? শুধাল সে—শুধালাম আমি শুধু ‘বনলতা সেন’?
‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ কবিতার দ্বিতীয় লেখন বনলতা সেন গ্রন্থভুক্ত। এই কবিতার প্রথম লেখন ছিল এইরকম—
প্রথম লেখনঃ
হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো
চারিদিকে পিরামিড—কাফনের ঘ্রাণ
বালির উপরে জ্যোৎস্না—খেজুর ছায়ারা ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো। মিশিরিয় : দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত ম্লান
শরীরে মমির ঘ্রাণ আমাদের—ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন
‘মনে আছে’? শুধালো সে—শুধালাম আমি শুধু ‘বনলতা সেন’।
‘বনলতা সেন’ কবিতাটি লেখার আগে ১৯৩৩ সালে লেখা ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে প্রথম দেখা দেয় বনলতা সেন। আর সেই বনলতাকে নিয়ে হৃদয়ের আঙিনায় এঁকেছিল ভালবাসার আল্পনা; এবং ধীরে ধীরে এক সময়ে অভিষিক্ত হয় মানসসুন্দরীর প্রতীকী মর্যাদায়। সাধারণ অর্জন করে অসাধারণত্ব। সামান্যের উত্তরণ ঘটে অসমান্যে। কারুবাসনার নায়ক জানায়ঃ ‘চারদিকে তাকিয়ে দেখি মৌসুমির কাজলচাকা ছায়া। কিশোরবেলায় যে-কালো মেয়েটিকে ভালবেসেছিলাম কোন এক বসন্তের ভোরে, বিশ বছর আগে যে আমাদেরই আঙিনার নিকটবর্তিনী ছিল, বহু দিন যাকে হারিয়েছি—আজ, সেই যেন, পূর্ণ যৌবনে উত্তর আকাশের দিগঙ্গনা সেজে এসেছে। দক্ষিণ আকাশে সেই যেন দিগবালিকা, পশ্চিম আকাশেও সে-ই বিগত জীবনের কৃষ্ণামণি, পুব আকাশ ঘিরে তারই নিটোল কাল মুখ। নক্ষত্রমাখা রাত্রির কাল দিঘির জলে চিতল হরিণীর প্রতিবিম্বের মত রূপ তার প্রিয় পরিত্যক্ত মৌনমুখী চমরীর মত অপরূপ রূপ। মিষ্টি ক্লান্ত অশ্রুমাখা চোখ, নগ্ন শীতল নিরাবরণ দু’খানা হাত, ম্লান ঠোঁট, পৃথিবীর নবীন জীবন ও নবলোকের হাতে প্রেম, বিচ্ছেদ ও বেদনার সেই পুরান পল্লীর দিনগুলোর সমর্পণ করে কোন দূর নিঃস্বাদ নিঃসূর্য অভিমানহীন মৃত্যুর উদ্দেশ্যে তার যাত্রা।…
—’বহুদিন কলকাতা দেখি না, সে কোথায় বলতে পারো?’
—’না তো’
—আর বনলতার বাবা সেই কেদারবাবু— আচ্ছা এমন বন্ধু কি মানুষের এক জীবনের তপস্যায় জোটে? চল্লিশটা বছর পাশাপাশি আমরা কাটালাম। লম্বা-চওড়া চেহারা, মাটির মত মন, কত ক্ষণে-অক্ষণে আমার কাছে এসে বসেছেন। এমনি বৃষ্টির রাতেও কত গভীর রাত পর্যন্ত মুখোমুখি বসে আমরা আলাপ করেছি কিংবা চুপচাপ বসে রয়েছি।’
একটু চুপ থেকে — ‘আর বনলতা?’ আমার দিকে তাকিয়ে, ‘মনে হয় তার কথা তোমার?’ কোনো উত্তর দিলাম না।
— ‘না। ভুলেই গেছ হয়ত।’
খানিক্ষণ নিস্তব্ধতার পর বললেন, ‘কিন্তু’। কিন্তু, এই বলেই চুপ করলেন— কথাটা বাবা আর শেষ করলেন না ।
বনলতার কথা মনে হয়— এমনি শান্ত ধূসর শ্রাবণের শেষ রাতে সেই কি কোনো দূর দেশে তার স্বামীর ঘরের জানলার ভিতর দিয়ে কোনো প্রান্তরের চিতনার দিকে তাকিয়ে আমার কথা ভাবছে এমন করে?
দেখা যাচ্ছে, ‘বনলতা’ নামটির সঙ্গে জীবনানন্দের নিবিড় পরিচয় ছিল। তাঁর উপন্যাসের নায়ক বনলতাকে ‘কোন এক বসন্তের ভোরে’ ভালবেসেছিল। বনলতার বাবা এবং তাদের ঘরবাড়ির চিত্রল বর্ণনা থেকে মনে হয় কবি এসব নিয়ে বেশ ভেবেছেন বনলতার রূপের হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা থেকে মনে হয় কবি এসব নিয়ে বেশ ভাবছেন। বনলতার রূপের হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা থেকে মনে হয় কবি এসব নিয়ে বেশ ভেবেছেন। বনলতার বাবা এবং তাদের ঘরবাড়ির চিত্রল বর্ণনা থেকে মনে হয় কবি এসব নিয়ে বেশ ভেবেছেন। বনলতার রূপের হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা থেকে এ ধারণা করা যায় যে শুধু উপন্যাসের নায়কই নন, কবি নিজেও বনলতার রূপমুগ্ধ হয়েছিলেন। বনলতা সেনের রূপের বর্ণনার সঙ্গে মিল না থাকলেও বনলতার রূপের বর্ণনাও শৈল্পিক সৌকর্যে ভাস্বর, বৈচিত্র্যমণ্ডিত উপমার ব্যবহারে অনন্য এবং জীবনানন্দের চিত্ররূপময় চেতনার স্পষ্টতায় মনোমুগ্ধকরঃ ‘নক্ষত্রমাখা রাত্রির কাল দিঘির জলে চিল হরিণীর প্রতিবিম্বের মত রূপ তার—প্রিয় পরিত্যক্ত মৌনমুখী চমরীর মত অপরূপ রূপ।’ বনলতা ‘বিগত জীবনের কৃষ্ণামণি’। ‘বিশ বছর’ ও ‘কুড়ি-বাইশ’ বছর ‘বনলতা সেন’ কবিতায় হয়েছে ‘হাজার বছর।’ বনলতা যে শুধু কালো তা-ই নয়, বনলতার যাত্রা অন্ধকারে ‘অভিমানহীন মৃত্যুর উদ্দেশ্যে’; ‘সময়ান্তর, নিরবচ্ছিন্ন, অন্ধকারে তার যাত্রা।’ বনলতা সেন কবিতার বনলতা সেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অন্ধকারেই থেকে যায়, কারুবাসনার বনলতার মতো তাকে কখনো আলোতে দেখা যায় না। ‘কাব্যভূবনে’ কবি বনলতার ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী শৈল্পিক রূপান্তর ঘটান : উপন্যাসের বনলতাকে অভিষিক্ত করেন ‘সেন’ পদবির মর্যাদায় : অবচেতনের রহস্যালোকের অন্ধকারে প্রতিষ্ঠিত করে তাকে অনন্ত কৌতূহলের বিষয় করে তোলেন। নাটোরে ঠিকানা নির্ধারিত করে তাকে নিয়ে আসেন চেনা ভুবনের নিবিড় অন্তরঙ্গতায়। কিন্তু তাকে আলোকরশ্মিপাতে উদ্ভাসিত করা থেকে বিরত থাকেন যাতে পাঠকেরা কল্পনার তুলি দিয়ে নিজের মতো করে বনলতা সেনের ছবি আঁকতে পারে। ‘কারুাসনা’র বনলতার বর্ণনা প্রায় পুঙ্খানুপুঙ্খ, কিন্তু বনলতা সেনের বর্ণনা বাস্তবরূপ এবং পরাবাস্তবরূপ তথা সাবলাইম-তুলির কয়েকটি উদ্দীপক ভাবের অস্পষ্ট টানে সমৃদ্ধ। সে যা-ই হোক, বনলতা সেনকে প্রায় দ্বিধাহীনচিত্তেই বনলতার উত্তরসূরি হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। কবির আপন ভুবন থেকেই যেন তার অভ্যুদয় এবং অন্তর্জগতের অমেয় তিমিরে তার অধিষ্ঠান।
সেই বনলতা—আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত সে। কুড়ি-বাইশ বছরের আগের সে এক পৃথিবীতে; … বছর আষ্টেক আগে বনলতা একবার এসেছিল। দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চালের বাতায় হাত দিয়ে মা ও পিসিমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললে সে। তার পর আঁচলে ঠোঁট ঢেকে আমার ঘরের দিকেই আসছিল। কিন্তু কেন যেন অন্যমনস্ক নত মুখে মাঝ পথে গেল থেমে, তার পর খিড়কির পুকুরের কিনারা দিয়ে শামুক-গুগলি পায়ে মাড়িয়ে, বাঁশের জঙ্গলের ছায়ার ভিতর দিয়ে চলে গেলে সে। নিবিড় জামরুল গাছটার নিচে একবার দাঁড়াল, তারপর পৌষের অন্ধকারের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল৷
তারপর তাকে আর আমি দেখিনি। অনেকদিন পরে আজ আবার সে এল; মনপবনের নৌকায় চড়ে, নীলাম্বরী শাড়ি পরে, চিকন চুল ঝাড়তে-ঝাড়তে আবার সে এসে দাঁড়িয়েছে; মিষ্টি অশ্রুমাখা চোখ, ঠাণ্ডা নির্জন দু’খানা হাত, ম্লান ঠোঁট, শাড়ির ম্লানিমা। সময় থেকে সময়ান্তরে নিরবচ্ছিন্ন, হায় প্রকৃতি, অন্ধকারে তার যাত্রা’—
বনলতা সেন : পাঠ প্রতিক্রিয়া
বনলতা সেন। এই একটিমাত্র কবিতাকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যে আলোচনা- সমালোচনা তা হয়তো বিশ্বের ইতিহাসেও নেই। এই কবিতার ভাগ্যে সুনাম-দুর্নাম দু’টিই অনিবার্য হয়েছে—
১.
‘বনলতা সেন’ এর কবিতাগুলির রচনাকাল ১৩৩২-৪৬ সন। নাম কবিতাটি জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ রচনার অন্যতম। যুগযুগান্তের পথচারীর শ্রান্তি ক্লান্তি ও ক্ষুধাতৃষ্ণা বিনোদনের নীড়বিধায়িনীর সিম্বল বনলতা সেন। আরও একটি ছোট কবিতায় দেখা দিয়েছে (হাজার বছর শুধু খেলা করে)।
সুকুমার সেন
২.
কবিতা’র প্রথম বছরের দ্বিতীয়, পৌষ—সংখ্যাটি হাতে পেয়েই সেই সংখ্যায় প্রকাশিত একটি বিশেষ কবিতায় অবগাহিত হয়ে পাঠক সম্প্রদায় মেনে নিলেন—হ্যাঁ, যুগান্ত ঘটেছে, বাংলা কবিতা অবশেষে উত্তর রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতায় উপনীত। বুদ্ধদেব বসুর রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ফ্ল্যাটে চোখে-মুখে বুদ্ধি তথা চতুরালির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়া যে-কবিরা প্রতি সন্ধ্যায় আড্ডায় মশগুল হতেন, ওই কবিতাটি অথচ তাঁদের কারও রচনা নয়। কবিতাটি ‘বনলতা সেন’, জীবনানন্দ দাশ নিকষ নির্জন মফস্সল থেকে লিখে পাঠিয়েছেন।
—অশোক মিত্র
৩.
‘বনলতা সেন’ কবিতাটির আকর্ষণ তরুণ পাঠক ও কবির চিত্তে এতো ব্যাপক হয়েছিল, যাতে কবি নিজে বিস্মিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ‘দুর্বোধ্য কবি’ হিসেবে চিহ্নিত হলেন বটে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে’র মতো, কিন্তু তাঁর ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি সম্পর্কে সে অভিযোগ কারো ছিল না।
—সঞ্জয় ভট্টাচার্য
৪.
ইতিহাস চেতনার কবিতাগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য ‘বনলতা সেন’। Time less এবং Temporal -এর এমন সমন্বয় বাংলা সাহিত্যে ইতিপূর্বে হয়নি। বর্তমানযুগে প্রেমের অচরিতার্থ রূপ দেখে কবি ব্যথিত, সৌন্দর্যহীনতায় পীড়িত। তাই তিনি প্রেমের ও সৌন্দর্যের প্রকৃত স্বরূপকে খুঁজেছেন ভূগোল ও ইতিহাসের বৃহত্তর পটে। দেশকালে সীমাবদ্ধ নাটোরের বনলতা সেনের পশ্চাতে রয়েছে ভূগোলের বিস্তৃতি ও ইতিহাসের বোধ (Depth) । এই দুই আয়তনের যোগে একটি ক্ষুদ্র লিরিক কবিতা মহাকাব্যের ব্যপ্তি পেয়েছে।
—দীপ্তি ত্রিপাঠী
৫.
‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ আর কোনো বাঙালি কবি বলেননি—চণ্ডীদাস নয়, আলাওল নয়, মধুসূদন নয়, রবীন্দ্রনাথ নয়: এইটুকুই শেষ স্বীকার্য আনন্দ।
—হরপ্রসাদ মিত্র
৬.
‘বনলতা সেন’ কবিতার শেষ স্তবকে বনলতা যে কবির অন্তর্মানসের এক প্রেরণা ও পরিতৃপ্তির উৎস, তা বোঝা যায় দুদিক থেকে। প্রথমতঃ এই সত্ত্বাকে একান্তে পাবার জন্য কবির বিশেষ করে প্রয়োজন হয়েছে পার্থিব অন্ধকার রাত্রির যেখানে তার মগ্নচৈতন্যের নিবিড়তা মুক্তি পায়। দ্বিতীয়তঃ তিনি জীবনের সব লেনদেনের শেষে একেবারে একান্ত হৃদয়ে এই সত্ত্বার মুখোমুখি হতে চেয়েছেন : থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
- সুচেতা মিত্ৰ
৭.
তাঁর অতিবিখ্যাত ও অতিজনপ্রিয় ‘বনলতা সেন’- এ যে বস্তুত রবীন্দ্রনাথের ‘স্বপ্ন’ কবিতার ও সৌন্দর্য প্রেম কল্পনার অনুরণন ব্যঞ্জিত হয়েছে, একথা অতি সহজেই প্রতিভাত হয়। জীবনানন্দের বৈশিষ্ট্য এই যে, রূপকল্পনা তাঁর অন্তর্লোকে এমন একটি চিত্রময় জগৎ সৃষ্টি করেছিল, যা তাঁর একান্ত স্বকীয় এবং পূর্ববর্তী বা সমসাময়িক সকল কবির মননাশ্রিত জগৎ থেকে রূপে ও প্রকৃতিতে পৃথক। তাঁর কবিতার বিরতি, ঝংকার, শব্দচয়ন, উপমা, চিত্রকল্প—সবই একটু আলাদা ধরনের। এই অভিনবত্বের জন্যই তাঁর ‘বনলতা সেন’ এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘স্বপ্ন’ কবিতার আত্মীয়তা সহজেই প্রতীয়মান হয় না ।
—অজিত দত্ত
৮.
জীবনানন্দের কাব্যের চাবিকাঠি ‘বনলতা সেন’। তাঁর আর কোনো কাব্য বা কাব্যগ্রন্থ এমনভাবে কবিকে ধরতে বা প্রকাশ করতে পারেনি। এর চেয়ে উৎকৃষ্টতর কাব্য তিনি লেখেননি। অন্য যত কবিতা লিখেছেন, সবই কোনো না কোনোভাবে এই কবিতার পরিপূরক বা আংশিক ভাষ্য। … অতীন্দ্রিয় বা সুপার ন্যাচারাল কথাটি তাঁর কবিতায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে তিনি কোলরিজ বা ওয়ালটর ডিলা মেয়রের সগোত্র। ‘বনলতা সেন’ একটি উৎকৃষ্ট ‘সুপার ন্যাচারাল’ কবিতা; এটি ভৌতিক অশরীরী কবিতা।
—জগন্নাথ চক্রবর্তী
৯.
‘বনলতা সেন’ জীবনানন্দের চূড়ান্ত সার্থক কবিতা তো বটেই, বিশ্বসাহিত্যে কয়েকটি শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে নিঃসন্দেহে একটি বলে আমার ধারণা। প্রবন্ধকার জগন্নাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে একমত হতে বাধা নেই যে, জীবনানন্দের কল্পনারাজ্যে অশরীরী ছায়ার বিশেষ আনাগোনা রয়েছে, এবং সেই অর্থে নিশ্চয়ই সিউপ্যা (র) ন্যাচারাল কথাটি তাঁর কবিতায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু তাই বলে তাঁকে কোলরিজ বা ওয়ালটর ডিলা মেয়রের সগোত্র বলে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। … বনলতা সেন সবাক-ভৌতিক অস্তিত্বমাত্র নয়।
—দিলীপকুমার চক্রবর্তী
১০.
‘বনলতা সেন’ বর্তমান ও অতীতের সমস্ত প্রিয়তমাদের মুখ। আবার ইতিহাসচেতনা এর কেন্দ্রভূমিতে বিরাজ করেছে বলে এর মাধুর্য আরো গভীর। এতে ব্যবহৃত নামগুলো কবির ঐতিহ্যবাহী মানসিকতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করেছে। তবে এ সত্ত্বেও নামগুলোর ব্যবহার আকস্মিক। পৃথিবীতে কত প্রেমিক এসেছে আর ভালোবেসেছে। সিংহল সমুদ্রে, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে অথবা বিদর্ভ নগরে। কবিতাটি সাময়িকতা কাটিয়ে বিশ্বজনীনতার অমৃত স্পর্শ লাভ করেছে।
—আবদুল হাফিজ
১১.
কথাটা এক— ‘সৌন্দর্য’, কিন্তু অর্থ অনেক। এই সত্যটুকু অনুভব ও বিশ্বাস না করে বোধ করি কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্যসংকলনটি বিচার করা দুরূহ, নিরর্থক। … বর্তমান থেকেই অতীত। অতীতকে বলতে পারি আয়ওতীত ব্যবহৃত অগণিত বর্তমানের সমাবেশ। তবু, বর্তমান হচ্ছে স্বাভাবিক, বাস্তব; আর অতীতের মধ্যে রয়েছে একটা অবাস্তবতা ঠিক যেমন একটা বিজ্ঞানাতীত রহস্য ও দূরত্ব ঘিরে থাকে একটু আগে বেঁচে ছিল মানুষটির মৃত শরীরকে; অথবা, বহু আলোকবর্ষপারে অবস্থিত তারকাপুঞ্জ দূর থেকে আমাদের চোখে দেখা দেয় কম্পমান ধোঁয়াটে নীহারিকা হয়ে। তেমনি, ‘বনলতা সেন’ এর কবিতাচয়নের মধ্যে রয়েছে মোটামুটি এই ধরনের এক বিশেষ রহস্যময়ত্ব-ব্যথা-বিরাটত্ব-সূচক সৌন্দর্যানুভূতি।
— অরুণকুমার দত্তগুপ্ত
১২.
‘বনলতা সেন’। জীবনানন্দের কবিতা-সম্ভারের এবং বাংলা কাব্যজগতের একটি অসামান্য সৃষ্টি হয়ে আছে। এই কবিতায় একত্রে সম্মিলিত জীবনানন্দের একাধিক প্রতীকী চিত্রকল্প— পথহাঁটা, হাজার বছর, নাবিক, রাত্রি, চিল, নদী এবং সর্বোপরি নারী – এখানে ‘বনলতা সেন’। ‘বনলতা সেন’ প্রেমের কবিতা বলেই প্রধানত পরিচিত। প্রেমের জন্য, শান্তির জন্য মানুষের মনে জমতে থাকে এক আকাঙক্ষা। সেই প্রেম-প্রশান্তির প্রতিমা হয়ে ‘নাটোরের বনলতা সেন’-এর অবিস্মরণীয় আবির্ভাব।
বনলতা সেনের নামে এবং মূর্তিতে জীবনানন্দের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় স্মৃতি এবং বাস্তবের কোনো নারীর অবয়বও মিশে আছে। কল্পনা-লোকচারিণী নারী অচিরেই হয়ে উঠল জীবন-প্রতিমা ‘বনলতা সেন’। ‘নাটোরের’ বনলতা সেন বলাতে চিত্রকল্পটি আরো ব্যঞ্জনা পেয়েছে। প্রথমত, তার স্থানিক পরিসর হয়েছে প্রত্যক্ষ। দ্বিতীয়ত, ‘নাটোর’ নামটির সঙ্গে এক সময়ের বৈষ্ণব প্রভাব সিঞ্চিত। প্রেম মানুষকে, সাময়িক হলেও, শান্তি দেয়, শান্তি দেয় প্রকৃতির শুদ্ধতাও। এই স্তবকে বাস্তবের নারী আর নিসর্গ-প্রতিমা মিলেমিশে প্রতীকী নারী ‘বনলতা সেন’কে রচনা করেছে।
—সুমিতা চক্রবর্তী
১৩.
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘শেষ লেখা’ নামক গল্পে পুরুষচোখের মধ্য দিয়ে নারীরূপ (নন্দর চোখ দিয়ে ভদ্রাদর্শন) দেখাতে গিয়ে লিখেছিলেন—ওই একখানি রূপের মধ্যে সারা পৃথিবীর রূপের মঞ্জুষা’। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের নামকবিতার নারী বনলতাকেও বলা যায় : সারা পৃথিবীর রূপের মঞ্জুষা। বিভূতিভূষণের গল্পে রাজকুমার নন্দ গার্হস্থ্যপ্রেমের সুষমা থেকে ধর্মীয় অনুশাসনের দিকে চলে গিয়েছিল বুদ্ধের প্রেরণা ও প্ররোচনায়। প্রিয় নারী ভদ্রার কাছে ফেরার তীব্র ইচ্ছা ছিল তার; কিন্তু বাসনাদমনের আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্যের কারণে আর ফিরতে পারেনি। জীবনানন্দের কবিতাটিতে, আমরা পুরুষপ্রেমিককে ফিরে আসতে দেখি প্রেম-অন্বেষণের মধ্য দিয়ে, বনলতার কাছে। কিন্তু বনলতাকে কি সে পায়? বনলতা কি তার হয়? এই তীক্ষ্ণ প্রশ্নের মধ্যেই ‘বনলতা সেন’ কবিতার স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে যায় ।
—জহর সেন মজুমদার
১৪.
বুদ্ধদেব বসু ‘কবিতা’ পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু কবিতার বইও প্রকাশ করতেন তাঁর সমসাময়িক কবিদের। মাত্র ষোলো পৃষ্ঠার চটি বই, দাম চার আনা বা ষোলো পয়সা। অর্থাৎ এক পাতার দাম এক পয়সা, সেইজন্যই সিরিজটির নাম ‘এক পয়সায় একটি’। সেইভাবে বেরিয়েছিল জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’। ছিল মাত্ৰ ১২টি কবিতা। ছাপাবাঁধাই কিছুই ভালো নয়। যথারীতি কিছুদিনের মধ্যেই সে বই অবলুপ্ত হয়ে যায়। ডি-কে সেই বইটি খুঁজে বার করে। তার সঙ্গে আরও ১৮টি কবিতা জুড়ে, অসাধারণ মুদ্রণ-সৌকর্যে, সত্যজিৎ রায়-কৃত প্রচ্ছদপটে প্রকাশ করলেন ‘বনলতা সেন’- এর নতুন সংস্করণ। দাম দু-টাকা। পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিলেন পত্রপত্রিকায়। অনেকেই জীবনানন্দ দাশকে সেই প্রথম চিনল। এই বইয়ের বিজ্ঞাপনের কপিতে এই কবির কবিতাকে যে রবীন্দ্রনাথ চিত্ররূপময় বলেছিলেন, সেই সার্টিফিকেট জুড়তে হয়েছিল। তখনো পর্যন্ত, কল্লোলের কবিদের বিরোধিতা সত্ত্বেও, রবীন্দ্র-প্লাবনে আচ্ছন্ন ছিল বাংলা সাহিত্য। তার মধ্য থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো ছিল কোনো কবির পক্ষে দুঃসাধ্য!
— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৫.
জীবনানন্দের প্রবাদপ্রতিম ‘বনলতা সেন’ কবিতায় প্রত্যাবর্তনের এই অসহায় মহিমা ‘প্রকৃতিস্থ প্রকৃতি’ ও প্রেমে সমাহিত হয়েছে। কিন্তু বনলতা সেনও অপরিবর্তনে চিরায়ত কোনো প্রতিমা নয়; তাকেও সময়, অভিজ্ঞতা ক্লান্ত করে, ক্লান্ত, ক্লান্ত করে ৷ তা সত্ত্বেও ব্যক্তির সর্বশেষ আশ্রয় ব্যক্তিহৃদয়—নির্বিকল্প হৃদয়। নির্বিকল্প হৃদয়। নির্বিকল্প হৃদয়ের নিদর্শন জীবনানন্দের নানা কবিতায় দেখতে পাই। কিন্তু এই দুটি কবিতায় (বনলতা সেন, হাজার বছর শুধু খেলা করে) ঐ বোধ বিশেষ প্রবল। প্রথমে ব্যাখ্যাত কবিতাটির পরিবেশ প্রাচীন ভারতবর্ষ। অন্য কবিতাটিতে পটভূমি সেমিটিক আবহ পর্যন্ত প্রসারিত। পটভূমিকা যতোই প্রসারিত হচ্ছে কবির মনে ততোই গৃহনিহিত সনাতন শরণের অনিবার্যতা দেখা দিচ্ছে। অন্ধকারে এই শরণাগতি, দেশগত ও কালগত পরিব্রজনের শেষে গচ্ছিত, অথচ ঈষৎ ক্ষয়প্রাপ্ত পরমতার আছে প্রত্যাগমন, দুটি কবিতায় তারি অণিমাসিদ্ধি।
—অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
১৬.
নারীর সান্নিধ্যে শান্তি। নায়কের পথ চলার সমস্ত ক্লান্তি, জীবনের নিঃসঙ্গতা, সমুদ্রে হাল ভেঙ্গে দিশাহীন হওয়ার মত অসহায়তার কথা সব ভুলিয়ে দিয়ে তাকে ‘দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’। বনলতা সেনের রূপ বর্ণনায় তার পূর্ণ অবয়বের চিত্র আঁকেননি কবি। আমরা জানি না তার হাত, নখ, স্তন, কোমর, পা ইত্যাদির কোন বিবরণ। কিন্তু নারীর সৌন্দর্যের আরো মাপকাঠি আছে—তার চুল, নখ, চোখ । জীবনানন্দ তার চুল, মুখ ও চোখের বর্ণনা দিয়েই তাকে অপরূপা করে তুলেছেন। ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’, ‘মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’, ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ তার। বিদিশা, শ্রাবস্তী ও পাখির অনুষঙ্গে এসেছে তার চুলের ঘন কৃষ্ণত্ব, মুখের শিল্পসুষমা ও চোখের আশ্রয়ময়তা। সেই কবেকার বিদিশার হারানো ইতিহাস, শ্রাবস্তীর শিল্প-গৌরব, আর প্রকৃতির আশ্রয়ের প্রশান্তি দিয়ে কি এক আশ্চর্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করলেন জীবনানন্দ! যা বাংলা সাহিত্যে তাঁর আগে আর কেউ করতে পারেননি।
—অনিলকুমার রায়
১৭.
‘বনলতা সেন’ কবিতায় কবির এই অবিনাশী সত্তাই হাজার বছর ধরে সঞ্চরণশীল। ইতিহাসের তীরে তীরে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে, বিদর্ভে, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত সেই প্রাণ আজকের সভ্যতার তটে এসে পৌঁছেছে। আর পৃথিবীর বয়সিনী সেই নারী—যার চুলে বিদিশার অন্ধকার, মুখে শ্রাবস্তীর তক্ষিত রূপ সেও ইতিহাস বিস্তারের স্তরে স্তরে কবির সমযোনি। জীবনের ব্যথা বেদনার সাগর পেরিয়ে সভ্যতার নগরে বন্দরে দেখা, চেনা, কথা বলা; এবং এই প্রেমিক যুগলের পরিণামী ভবিষ্যৎও জীবনানন্দের কাছে স্পষ্ট।
—অম্বুজ বসু
১৮.
একেকটি কবিতা খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়। সেটিই যে একজন কবির উৎকৃষ্টতম কবিতা, এমন নাও হতে পারে। অথবা কারো কারো কাছে তা অবশ্যই শ্রেষ্ঠতম। নজরুল একটি কবিতা লিখেই রাতারাতি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় হয়ে যান। সেটি যে ‘বিদ্রোহী’ কাউকেই বলে দিতে হয় না। সে ছিল ১৯২১ সাল। তার প্রায় দেড় দশক পরে প্রকাশিত জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’। অন্য আরো তিনটি কবিতার সঙ্গে ‘বনলতা সেন’ ‘কবিতা’ পত্রিকার পৌষ ১৩৪২ সংখ্যায় বেরোয়। এই একটি কবিতা জীবনানন্দকেও জনপ্রিয় করে তোলে, যদিও অভ্যস্ত রুচির কাছে কবিতাটি তেমন সমাদৃত হয়নি। অন্তত প্রাথমিকভাবে তো বটেই। পরবর্তীকালে এই কবিতাটি আলোচিত ও ব্যবহৃত হতে হতে অবিস্মরণের গৌরব লাভ করেছে।
— মঞ্জুষ দাশগুপ্ত
১৯.
‘বনলতা সেন’ কবিতার রচনাকাল আনুমানিক ১৯৩৪। অর্থাৎ ইয়েটসের ‘সেলিং টু বাইজেনটিয়াম’ কবিতার প্রায় কুড়ি বছর পর কবিতাটি লেখা। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক জীবনানন্দ যে ইয়েটসের এই বিখ্যাত কবিতার সঙ্গে পরিচিত হননি, এমন মেনে নেওয়া কঠিন (যেহেতু তিনি নিজেও একজন কবি; তাই জীবনদর্শন ভিন্ন হলেও, ‘বনলতা সেন’- এর অন্বেষণের এই ব্যাপারটির ভেতর ইয়েটসের ‘সেলিং টু বাইজেনটিয়াম’ কবিতার অন্বেষণের প্রভাব থাকা স্বাভাবিক)। দুটি কবিতার বিষয়বস্তু যেহেতু অন্বেষণ, ইয়েটসের ‘বাইজেনটিয়ামের’ অন্বেষণের স্পৃহা জীবনানন্দকেও প্রভাবিত করেছিল এবং ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিও ‘সেলিং টু বাইজেনটিয়াম’-এর মতোই তাই হয়ে উঠেছে যথার্থ একটি অন্বেষণের কবিতা।
—বিনয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২০.
আমার জীবনে বনলতা সেন যোল গ্রীষ্মের দান। দার্জিলিঙের হিল কার্ট রোডে ছিল একটা বইয়ের দোকান। সেখানে পাই ‘আঠারো বসন্ত’ নামে একটি বই। তাতে সংকলিত হয়েছিল কিছু প্রেমের গল্প ও কবিতা। ওই সংকলনেরই একটি কবিতা ছিল ‘বনলতা সেন’, কবির নাম জীবনানন্দ দাশ।
—সুরজিৎ দাশগুপ্ত
২১.
জীবনানন্দ তাঁর ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির নাম নিয়েই বইটির নামকরণ করেছিলেন—বনলতা সেন। বনলতা সেন তাঁর একটি অতি বিখ্যাত কবিতা। এই কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়—’কবিতা’ পত্রিকার ১ম বর্ষের ২য় সংখ্যায় অর্থাৎ ১৩৪২ সালের পৌষ মাসে ৷ কবিতা ভবন থেকে প্রকাশিত ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থের ১২টি কবিতাই ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। জীবনানন্দ তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কা’কে ও কা’কেও উৎসর্গ করলেও এই বইটি কিন্তু কাকেও উৎসর্গ করেননি।
—গোপালচন্দ্র রায়
২২.
রবীন্দ্রনাথের গানে যেমন ফুল, জীবনানন্দের কবিতায় তেমনি পাখি। অনেক গোপন কথা, আপন কথা, জটিল কথার নির্ভরশীল বাহক তারা। সহৃদয় শ্রোতাও। বনলতা সেন যেদিন পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকালেন, সেই দিন থেকে আমাদের কবিতায়, আমাদের আধুনিক মননের যাবতীয় আলো-আঁধার, রোদ-কুয়াশার সঙ্গী হয়ে পাখিরা আকাশ ছেড়ে নেমে এল একেবারে ধরা-ছোঁয়ার, চেনা-জানার কাছাকাছি!
—পূর্ণেন্দু পত্রী
২৩.
‘বনলতা সেন’-এই জীবনানন্দ দাশ মাধ্যন্দিন দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠলেন। বনের হীরামন নয়, অকুল সমুদ্রে সন্তরণক্লান্ত প্রাণই তাঁর কবিচিত্তের সার্থক উপমান হয়ে উঠল আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন। তাছাড়া ‘বনলতা সেন’-এ প্রমাণিত হল যে, জীবনানন্দ ‘রূপসী বাংলা’র কবি হয়েও ‘মহাপৃথিবী’র কবি। তাই ‘বনলতা সেন’ আর ‘মহাপৃথিবী’তে – জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিকল্পনার তুঙ্গশিখরে আরোহণ করেছেন ।
কোনো একটি কবিতা দিয়ে জীবনানন্দ দাশের সমগ্র কবিসত্তাটিকে যদি চিনতে হয় তাহলে সে কবিতার নাম ‘বনলতা সেন’। তিনটি স্তবক দিয়ে গড়া এই কবিতার মধ্যে কবির স্বপ্নবৃত্তটি পূর্ণ হয়েছে। কবি বলেছেন : হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।
—জগদীশ ভট্টাচার্য
২৪.
‘বনলতা সেন’ সিগনেট-সংস্করণ বেরোবার পরে ‘মহাপৃথিবী’ সম্বন্ধে পাঠক কতক পরিমাণে অনিশ্চয় হয়ে উঠলেন সন্দেহ নেই। তা হলে ‘বনলতা সেনে’র নকশাটুকুই কবির শেষপর্যন্ত অভিপ্রায়? ‘মহাপৃথিবী’র তিক্ত বিস্তারটুকু তিনি সচেতনে বর্জন করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন? ততদিনে স্বতন্ত্র বই হিসেবে বিলুপ্ত হয়ে এসেছে ‘মহাপৃথিবী’। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’তে মূল ‘মহাপৃথিবী’র মোটে চারটি লেখা, তার প্রথমটি : ‘হাজার বছর শুধু …’ অব্যবহিত পূর্বে ‘বনলতা সেন’-এ সরে গেছে, অর্থাৎ তিনটি—তিনটিতেই সানন্দ নিসর্গ আর অপঘাত মানুষের বৈপরীত্যের বোনা, কিন্তু আদি ‘বনলতা সেনে’র (যা আদি ও মূল ‘বনলতা সেন’) প্রায়ভাগ কেন ফিরে এল ফের মহাপৃথিবীতে?
—দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৫.
শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্যি যে, বনলতা সেন কবিতাটির মধ্যেই এমন কথা রয়েছে যা সম্পূর্ণ করে বুঝতে পারি না আমি। সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন। বেশ, সব পাখি ঘরে আসে, বুঝলাম, কিন্তু সব নদী? ঘরে আসবে কী করে? —একজন বলল, ‘এটা তো প্রতীক। নারীর প্রতীক।’ হবে হয়তো। তবু নারী তো একজন রয়েইছে এ কবিতায়—বনলতা সেন। আবারও প্রতীক? হবে হয়তো।
—জয় গোস্বামী
২৬.
১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হল জীবনানন্দের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’। বুদ্ধদেব বসুর উদ্যোগে ‘কবিতা ভবন’ থেকে এক পয়সায় একটি সিরিজে-১- ফর্মার কবিতা বই প্রকাশের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, ‘বনলতা সেন’ তার অন্যতম সার্থক ফসল। কবিতার সংখ্যা ছিল ১২টি এবং সমস্ত কবিতাই প্রকাশিত হয়েছিল ‘কবিতা পত্রিকায়। এই বইটির সূত্রেই বাংলার পাঠকসমাজে জীবনানন্দ হয়ে উঠলেন জনপ্রিয়। বিশেষ করে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি অসাধারণ জনপ্রিয়তা পেল।
—তপন গোস্বামী
২৭.
‘বনলতা সেন’ একাধারে আনন্দ ও বেদনার কবিতা, বিরোধ ও নিষ্পত্তির কবিতা। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় রঙ আর রেখার সমন্বয়ের যে চিত্র ফুটে তা ওঠে পাঠকের মনে চিরমায়ার সৃষ্টি করে, পাঠক এমন এক শিল্পসৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে পড়ে যার ব্যাখ্যা নেই তার কাছে, শুধু গভীর বোধে আচ্ছন্ন থাকে। আর পুরো কবিতাটি প্রাগ্রসর হয় বিরোধপূর্ণ ইমেজে—পাঠককে সীমাহীন অনুভব, ব্যাখ্যাতীত উপলব্ধি ও দার্শনিকতায় উপনীত করে। ‘বনলতা সেন’র কালহীন উপস্থাপনা, নিরবধি সময়চেতনায় সৌন্দর্যবোধের ও প্রশান্তির যে বিস্তার, তা দ্বন্দ্ব ও বিরোধকে নিষ্পত্তি করে দেয়। কেননা সকল ক্লান্তি ও বিষাদ নিঃশেষিত হয় বনলতা সেনের আশ্রয়ে। আর এ আশ্রয় অনন্তের, এ আশ্রয় কেবল কবির নয়, পৃথিবীর সকল ক্লান্ত ও বিষাদক্লিষ্ট মানবের।
—আহমেদ স্বপন মাহমুদ
২৮.
জীবনানন্দ দাশের কবিতা চিরকাল পড়ার মতো, ঘুরে ফিরে পড়ে পড়ে নিজের মধ্যে ধারণ করার মতো সম্পদ। তাঁর বহু কবিতা আমার প্রিয়। একটির কথা উল্লেখ করলে বাকিগুলোর প্রতি অবিচার করা হবে। তবু শেষপর্যন্ত যদি জীবনানন্দের একটি কবিতাকেই প্রিয় বলে বেছে নিতে হয়, তাহলে আমি ‘বনলতা সেন’কেই পছন্দ করব। এই কবিতার প্রথম পক্তি থেকে শেষ পঙ্ক্তি পর্যন্ত যে ব্যঞ্জনা রয়েছে তার আবেদন কখনও ফিকে হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷
‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’ – উচ্চারণ করেই কবি পাঠকদের স্থাপন করেন সময়হীনতায়। কবিতায় যে ক্লান্তপ্রাণ পথিকের কথা বলা হয়েছে সে কোনো বিশেষ কালের নয়, সে সর্বকালের। এই পথিকটি বিম্বিসার, অশোকের ধূসর জগতে এবং আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে পথ হেঁটেছে। কিন্তু তাকে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন। নাটোর এবং বনলতা সেনের উল্লেখ করে পর্যটক আমাদের নিয়ে আসে প্রাচীনকাল থেকে হাল আমলে, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর ঊষাকালে। পথচারী পরিশ্রান্ত, অশান্ত। তার অশান্তির দহনে নাটোরের একটি নারী, অনামা কেউ নয়, শান্তির দুফোঁটা শিশির ঝরিয়ে দিলো। নাটোরের নারী এই বনলতা সেন, যে আমাদের কাছেই অবাস্তব কেউ নয়৷
আমি ভাল করেই জানি ‘বনলতা সেন’ একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা। কেউ কেউ জনপ্রিয় কবিতাকে সন্দেহের চোখে দেখেন। কেউ কেউ জীবনানন্দ দাশের এই কালজয়ী কবিতায় এডগার অ্যালেন পো’র ‘To Helen’ কবিতার অনুকরণ সন্ধান করেছেন। অত্যন্ত ক্ষীণ ছায়া হয়ত আছে, কিন্তু সব দিক থেকে ‘বনলতা সেন’ অনেক বেশি উঁচুদরের কবিতা।
—শামসুর রাহমান
২৯.
জীবনানন্দ দাশ তাঁর ইতিহাস-বিহারী চেতনার আলোয় ‘বনলতা সেন’ নাম্নী এমন এক নায়িকার রূপচিত্র এঁকে তুলেছেন, যা রমনীয়তা ও মাধুর্যে অসামান্য। আকর্ষণীয় এ নায়িকার বাস্তবভিত্তি হয়তো তাঁর আরেক নায়িকা ‘শঙ্খমালা কিশোরী’র স্মৃতিচিত্রণে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। নাটোরের ঠিকানা সেক্ষেত্রে অনাবশ্যক হয়ে যায়। পরে লেখা বনলতাবিষয়ক একাধিক এবং শঙ্খমালাবিষয়ক একাধিক রচনার সঙ্গে কবির ব্যক্তিগত ডায়েরির কিছু বক্তব্যের তুলনামূলক বিচার তা স্পষ্ট করে তোলে৷
ইতিহাস-চেতনা ও চিত্রসৃষ্টির প্রতি প্রবল অনুরাগের কারণেই হয়তো জীবনানন্দ দাশ তাঁর নায়িকা-প্রধান কবিতার চরিত্র চিত্রণে চিত্রশিল্পীসুলভ প্রবণতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন শব্দচিত্র এঁকে তুলে। ‘বনলতা সেন’-এ এমন প্রকরণিক সৌকর্য সুস্পষ্ট। সেখানে ঠিকই মোনালিজার রহস্যময় হাসি নেই, কিন্তু আছে ইতিকথার প্রেক্ষাপটে বিদিশা নগরীর অন্ধকার রাত্রির নিবিড়রূপ নিয়ে আকর্ষণীয় কালো চুল, ইতিহাসখ্যাত শ্রাবস্তীর স্থাপত্য-ভাস্কর্যের কারুকার্যে রমণীয় ও শ্রীময়ী মুখের রূপময়তা, আছে পাখির নীড়ের মতো প্রাকৃত রূপের চোখ, যা আয়ত বা দীঘল না হয়েও বুঝি সৌন্দর্যমণ্ডিত হতে পারে। এ সবই ঐতিহ্যনির্ভর সুষমায় আঁকা, ইতিহাসভিত্তিক বাস্তবতায় ঋদ্ধ৷
বনলতা সেন এভাবে এমন এক শ্রীময়ী নায়িকা হয়ে ওঠে যার জন্য হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা যায়। বলা যায় ‘যাত্রী আমি ওরে’, ‘সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে’ কিংবা ‘আরো দূর বিদর্ভ নগরে’। দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তি, অন্বেষার মানসিক অবসাদভার সম্বল করে ইতিহাসনিষ্ঠ প্রেমিকের পক্ষেই ‘জীবনের সফেন সমুদ্রের’ পাশে দাঁড়িয়ে বলা চলে – ‘আমি ক্লান্তপ্রাণ এক’ এবং প্রেমিকার স্বল্পকালীন সান্নিধ্য পরম পাওয়া রূপে বিবেচনা করে বলা চলে ‘আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের ‘বনলতা সেন’।
—আহমদ রফিক
৩০.
তিনটি স্তবকে সমাপ্ত এই কবিতাটি, ‘বনলতা সেন’, যেন এক অনিঃশেষ ফোয়ারা— অনন্ত কাব্যোৎসারের। কবিতার–হয়তো যে-কোনো শিল্পেরই – প্রসঙ্গ থেকে প্রকরণকে বিচ্ছিন্ন ক’রে ফেলা সমীচীন নয়; আমাদের যাত্রা প্রকরণের পরিচয় দিতে দিতে প্রসঙ্গের প্রতিভাস রচনা করায়।
সমান ওজনের—ছয় লাইনের তিনটি স্তবক। কবিতা জ্যামিতি নয়; কিন্তু কবিতায় থাকে এক ভিতর-জ্যামিতি। সেই ভিতর-জ্যামিতির গোপন কাজ চলেছে এখানে তিনটি স্তবকের ত্রিলোক বিহারে। প্রথম স্তবকে কবির আত্মপরিচয়; দ্বিতীয় স্তবকে দয়িতা-পরিচয়; তৃতীয় স্তবকে উভয়ের সংকটজনিত এক পরিণাম, এক স্বপ্নোচ্চারণ—স্বপ্নই এখানে সত্য।
—আবদুল মান্নান সৈয়দ
৩১.
‘বনলতা সেন’-এ নারী বিষয়ক কবিতাই প্রাধান্য পেয়েছে; তা হয়তো অস্বাভাবিকও নয়। তবে যথাযথ মনোনিবেশে বোঝা যায় এরা ঠিক ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র অশরীরী নারী নয়, যদিও কতিপয় কবিতায় (‘কুড়ি বছর পরে, দুজন’) অথবা কোনো কোনো বিখ্যাত পঙ্ক্তিতে (—অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;/সে সবের ঢের আগে আমাদের দু’জনের মনে/হেমন্ত এসেছে তবু;) বিখ্যাত জীবনানন্দীয় আকাঙক্ষার অনুরণন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে সাধারণভাবে লক্ষণীয় যে ‘বনলতা সেন’ – এর নারীরা অনেক স্পষ্টতর; শুধু নাম শব্দের ব্যবহার (বনলতা সেন, সবিতা, সুরঞ্জনা, সুচেতনা) এর কারণ নয় ৷ তাদের প্রতি কবির অনুভবও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র তুলনায় স্পষ্টতর; ভৌত দূরত্বও কমে এসেছে।
—ফয়সাল শাহরিয়ার
৩২.
‘বনলতা সেন’ কবিতার উপর এডগার এলান পোর ‘টু হেলেন’ কবিতার প্রভাব আছে বলে বুদ্ধদেব বসু তার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন। অবশ্য পৃথিবীর সব মহৎ কবিতার পেছনেই একাধিক ভাল কবিতা কিংবা শিল্পমাধ্যমের প্রভাব থাকতে পারে, এটা দোষণীয় কিছু নয়। তবে আমি মনে করি, এডগার এলান পোর ‘টু হেলেন’-এর তুলনায় জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ অনেক বেশি সফল, শিল্পসমৃদ্ধ ও মহত্তর কবিতা। তাই আমার ধারণা,অনেক সাধারণ কবিতা কিংবা সাধারণ বিষয় কিংবা খুবই সাধারণ তুচ্ছ মানব-মানবীও একটি কালজয়ী কবিতার প্রেরণা হতে পারে। সৃষ্টির ক্ষেত্রে হয়ে ওঠাটাই বড় ব্যাপার, কীভাবে হলো বা কেন হলো তা চাপা পড়ে যায় মূল শিল্পসাফল্যের আড়ালে। ‘বনলতা সেন’ কবিতা সম্পর্কেও এটা একটি বড় সত্য।
— ইকবাল আজিজ
৩৩.
সমালোচকরা আধুনিক বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রভাব আবিষ্কার করলেও কার্যত আমরা দেখি, কেবল ‘বনলতা সেন’-এরই প্রভাব, যে-কারণে জীবনানন্দের কবিতায় যে বহুবিচিত্র ভাষা ও প্রকরণ-কৌশলের সন্ধান মেলে, বাংলা কবিতায় সে ধরনের বৈচিত্র্যও তেমন একটা দেখা যায় না। ফলে, আজও আমরা রচিত হতে দেখি একই ধরনের অসংখ্য কবিতা, যে-গুলিকে পৃথক করা যায় না কোন একজন কবির রচনা হিশেবে। সকলের কবিতা এইভাবে হয়ে উঠেছে একজনের কবিতা, যে-ভাষা বনলতা সেন-এরই অনুরূপ।
‘বনলতা সেন’-এর পাঠকপ্রিয়তা অর্জনের বড় কারণটি সম্ভবত এই যে, এই কবিতাটির মর্মকথা বুঝে ফেলতে দেরি হয় না আমাদের। ‘বনলতা সেন’জীবনানন্দের সেরা কবিতার একটি না হওয়া সত্ত্বেও আমরা দেখি, আম-পাঠক আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেছে বারবার, ‘জীবনানন্দ দাশ’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ‘আট বছর আগের একদিন’, ‘ঘোড়া’ বা ‘সপ্তক’- এর বদলে, এমনকি তাঁর আরো অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কবিতার বদলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখি ‘বনলতা সেন’- কেই!
—ফরিদ কবির
৩৪.
‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের পাঠে যে আনন্দ উপভোগ করেছিলাম সেই আনন্দ আরও গভীর ও পরিপূর্ণ। কবির রোমান্টিক স্মৃতিবিষণ্ণতা, তাঁর ভাষার সাবলীল মন্থরতা, তাঁর, ছন্দের স্বচ্ছ নূতন বিন্যাসনিপুণতা, তাঁর অসাধারণ উপমা ও ছায়াসংকেতের সৃষ্টিকৌশল আমার মনকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। ‘বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে’ কিংবা ‘দূর আকাশের পারে’, ‘ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে’ কিংবা ‘বড়ো সাগরের পথে’ নির্জনতাবিলাসী কবি যে স্বপ্নালোকে বিচরণ করতেন, আমিও তাঁর সঙ্গে ‘একা-একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব’। পল এলুয়ার-এর সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের সমধর্মিতার কথা উল্লেখ করেছি, কিন্তু ‘বনলতা সেন’-এর পাঠে আর একজন ফরাসী কবির কথা আপনাআপনি মনে আসে। বোদলের ফরাসী রোমান্টিক কবিদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং সংকেতধর্মী কবিদের অগ্রণী। সেই রোমান্টিক ভাবুকতাকে অপূর্ব ছায়া-সংকেতেরূপায়িত করে বোদলের যে বিষণ্ণ গাম্ভীর্য ও পূর্ণ পরিণত ভাষাভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিলেন, কবি জীবনানন্দের বহু কবিতার মধ্যে সেই একই বিষাদ, একই গম্ভীরতা এবং একই পরিপূর্ণ সাবলীল অভিব্যক্তির পরিচয় পেয়েছি।
—পিয়ের ফালোঁ এস জে
৩৫.
The poet states directly that Banalata Sen gave him a moment’s peace’ from the surrounding forthy water’s of life. The last two lines of the poem leave unresolved the ambiguity as to whether Banalata Sen symbolizes death-both comfort and a rest from tiring life. Certainly, Banalata Sen represents Solace, and Jibanananda conveys quality of hers by the famous image in the second stanza’s last line bird’s-nest-like eyes. Not an idiom or trite sinnile in Bengal, ‘bird’s-nest-like’ challenged the reader then-and still now-to syn- thesize given cause (The nest) and imagined effect (protection and rest).
—Clinton B. Seely
জীবদ্দশায় জীবনানন্দকে রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল—দুই মহল থেকেই বিপুল বিরুদ্ধতা সহ্য করতে হয়েছিল—এ কথা আজ ঐতিহাসিক সত্য, তবুও তিনি লিখে গেছেন জেদের বশে, লিখে গেছেন উত্তরকালের জন্য। জীবনানন্দের মৃত্যুর (১৯৫৪) অব্যবহিত পরে অন্তত সাতটি পত্রিকা—’ময়ূখ’ (কার্তিক-অগ্রহায়ণ, পৌষ-জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬১) সম্পাদক : জগদীন্দ্র মণ্ডল, সমর চক্রবর্তী; ‘কবিতা’ (পৌষ ১৩৬১) সম্পাদক : বুদ্ধদেব বসু; ‘উষা’ (কার্তিক ১৩৫১) আমন্ত্রিত সম্পাদক: বুদ্ধদেব বসু; ‘উত্তরসূরী’ (পৌষ-ফাল্গুন ১৩৬১) সম্পাদক : অরুণ ভট্টাচার্য; ‘জলার্ক’ (কার্তিক ১৩৫১) সম্পাদক : সুরজিৎ দাশগুপ্ত, ‘হাওড়া গার্লস কলেজ পত্রিকা’ (১৯৫৪-৫৫) সম্পাদক : অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘একক’ (১৯৫৪) সম্পাদক : শুদ্ধসত্ত্ব বসু—বিশেষ জীবনানন্দ সংখ্যার প্রকাশ প্রমাণ দেয় যে, ভেতরে ভেতরে তিনি কাব্যমোদী পাঠককে ক্রমাগত জয় করে চলেছেন। আর এই জয় যে দিনে-দিনে ক্রমবর্ধমান তা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্তিতেই পরিস্কার। শুধু এখানেই শেষ নয়, তার মৃত্যুর ষাট/পঁয়ষট্টি বছর পরেও তাকে নিয়ে সর্বাধিক গ্রন্থ ও লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয়েছে এবং যে কোনো পত্র-পত্রিকায় জায়গা পায় তাঁর সম্পর্কে লেখা ৷ এখানেই জীবনানন্দের জয় ।
তবে জীবদ্দশায় কবির অবস্থা ছিল ভিন্নতর এমনকি মৃত্যুর পরেও তিনি যে একেবারে আক্রান্ত হননি, তা নয়। ‘বনলতা সেনে’র মতো অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে ও বিরুদ্ধতা হয়েছে, এটাই বিস্ময়কর—
১.
জীবনানন্দের কবিতার দেশ কাল সংখ্যা বা নামের ব্যবহার কোনো কিছু নির্দিষ্ট করে বলার জন্যে নয় বিমূর্ত ভাবের তারা প্রতীক অলৌকিক জগৎ দেখা দেয় ভৌগোলিক নামে৷ নিরাকার প্রেমের প্রতিমা দেখা দেয় নাটোরের বনলতা সেন, পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যাল, বিলুপ্ত ধূসর কোনো পৃথিবীর শেফালিকা বোস। তুমুলভাবে আন্দোলিত জল যতটা যথার্থ্যের সঙ্গে তার সন্নিহিত গাছপালাকে প্রতিবিম্বিত করে, ঠিক ততটা যথার্থ্যের সঙ্গেই ‘বনলতা সেন’ এর কবি জীবনকে প্রতিফলিত করেন বস্তুকে তিনি একটি একটি করে বেছে নিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেন শূন্যতার অতল গহ্বরে। প্রত্যেকের মুখে তিনি এঁটে দেন কুয়াশার একই মুখোশ।
—সুভাষ মুখোপাধ্যায়
২.
‘ঝরা পালক’ থেকে শুরু করে একেবারে কবি জীবনের শেষ অবধি এই প্রেমই ছিল ধ্রুব নক্ষত্র। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিতান্ত ‘মুড’ নির্ভর হওয়ায় এই প্রেমের অভিব্যক্তি ফিকে হয়ে গেছে; শুধু ‘বনলতা সেন’ বা ‘নগ্ন নির্জন হাত’ ইত্যাদি কয়েকটি কবিতায় কল্পনার সৌন্দর্যে বক্তব্যহীনতা চাপা পড়েছে মাত্র। আর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রেম হয়েছে স্মৃতিনির্ভর, ভবিষ্যতের প্রেরণার উদ্দীপ্ত হতে পারেনি।
—মণীন্দ্র রায়
৩.
আত্মসচেতনার অভাববশত ক্লাসিসিজমের দু’একটি গুণ অল্পবিস্তর আয়ত্বে এনেও শেষপর্যন্ত জীবনানন্দ সত্যেন্দ্রনাথ বড়ো জোর প্রেমেন্দ্র মিত্র পর্যন্ত অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। ‘অবসরের গান’ বলুন আর ‘তিমিরহননের গান’ বলুন—এমনকি বিখ্যাত ‘বনলতা সেন’ কবিতার কথাই ধরা যাক, প্রত্যেকটি কবিতাই আলোচ্য মন্তব্যের উদাহরণ।
—রঞ্জিত সিংহ
৪.
অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিল পুরুষের শিশির-ভেজা চোখের/মতো ঝলমল করছিল সমস্ত নক্ষত্রেরা/জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উচ্ছল চামড়ার/শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ (হাওয়ার রাত) –এই অংশে কিছুটা কি কষ্টকল্পনা পাওয়া যায় না? কিংবা ‘নগ্ন নির্জন হাত’ এর শেষ অংশে অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা/ লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ / অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি/রামধনু রঙের কাচের জানালা/ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়; তার আগে—মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিল, ছিল অনেক/অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল; শেষে—’পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ’ প্রভৃতির বিস্তৃত আয়োজনে ছবির আবহাওয়াটি নষ্ট হয়ে গেছে, পাঠক একের পর এক কল্পনার চাপ অনুভব করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে বলে ঃ তোমার ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কোনো শিহরণই সৃষ্টি করে না।
— পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়
৫.
‘সাতটি তারার তিমির’ অসামান্য গ্রন্থ, তুলনায় ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থটি সামান্য রচনা। এ সিদ্ধান্ত আমার কাছে প্রশ্নাতীত।
—আলোক সরকার
৬.
প্রেমের কবিতা একেবারে নৈর্ব্যক্তিক হলে চলে না। তা হলে সেটা ‘মিষ্টিক’ কবিতার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ কবিতা এই শ্রেণীর। ‘মহুয়া’তেই পাই খাঁটি প্রেমের কবিতা। এই মাপকাঠিতে বিচার করলে রবীন্দ্রোত্তর যুগে প্রেমের কবিতা কিছু করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। কিন্তু ‘বনলতা সেন’ এর সেই অতলস্পর্শী গভীরতা তাতে নেই—তাতে মন ভেজে কিন্তু মজে না, ডোবে না। বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’/ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। এ আমাদের চেনা মেয়ে, মোটেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয় কিন্তু কবির সোনার কাঠির স্পর্শে এই সাধারণ মেয়েটি নিত্যকালের অসাধারণ মেয়ে হয়ে উঠেছে। একটি বিশেষ মেয়েই তাঁর কল্পনাকে আশ্রয় করে আছে।
—বরুণ ভৌমিক
৭.
জীবনানন্দের ইন্দ্রিয়রসের ঐশ্বর্য সত্ত্বেও তার মধ্যে কবি তৃপ্তি পেলেন না। রূপকথার রাজ্যেও তাঁর মন বসল না। এই মায়াপুরীর ঘেরাটোপের মধ্যে অধৈর্য হয়ে উঠেছে একটি আবেগ, একটি পিপাসা। কবির অন্তর থেকে উঠে এসেছে এক আকুতি, সর্বসমর্পণ করে ভালোবাসার, ভালোবাসা পাবার আকাঙক্ষা। নাম কবিতায় এই আকাঙক্ষাই খুঁজে নিতে চেয়েছে ‘মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’, কিন্তু তা যে হবার নয়, তাই প্রমাণ করেছে সমগ্র গ্রন্থটি।
— সুনীলচন্দ্র সরকার
জীবনানন্দের কতকগুলো কবিতা প্রচণ্ড ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের লক্ষ্য হয়েছিল। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সজনীকান্ত দাস। শনিবারের চিঠি’র ‘সংবাদ সাহিত্য’ বিভাগে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর লেখা হতো জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে। তিনি যেখানেই জীবনানন্দের নাম করতেন সেখানেই পাশে ব্র্যাকেটে (জীবনানন্দ নহে) কথা দুটি লিখে দিতেন। সুমিতা চক্রবর্তী ‘জীবনানন্দের কবি-সমালোচকেরা’ লেখায় লিখেছেন ‘বাংলা সাহিত্যের এই অদ্ভুত ধরনের মানুষটি দলবদ্ধভাবে আধুনিক সাহিত্যিকদের প্রায় সকলের প্রতিই কটূক্তি বর্ষণের কাজে কুশলতা দেখিয়েছিলেন। তাঁর অতিস্পষ্টবাদিতার একমুখী প্রবণতা ক্রমেই পরিণত হয়েছিল কটুকথা বলার নেশায়। অনেকের মতোই জীবনানন্দও ছিলেন তাঁর লক্ষ্য’। তাঁর সমালোচনায় সাহিত্যগুণ থাকতো কম, কুরুচি বা অশ্লীলতা থাকতো অনেক বেশি—
১.
এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল—কবিতা লিখিতে লিখিতে অকস্মাৎ অকারণে এক একজন ভদ্রলোকের মেয়ের নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক ও উৎসাহিত করিয়া তোলেন। ইকনমিক্স’ লিখিতে শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব বসু অকারণে ‘রানি’কে টানিয়া আনিয়াছেন। ‘জাতক’এ শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ‘সুরমা’ নামীয়া একটি ভদ্রমহিলাকে অত্যন্ত লজ্জা দিয়াছেন, এবং ‘বসন্তের গান’ এ শ্রী সমর সেন ‘মালতী রায়’ নামক কোনও কামিনীর নরম শরীর লইয়া যাহা করিবার নয় তাহাই করিয়াছেন। ইহার সূত্রপাত হইয়াছে নাটোরের ‘বনলতা সেন’ কে লইয়া।
২.
কবি জীবনানন্দ (জীবানন্দ নহে) দাশকে আর ঠেকাইয়া রাখা গেল না; রসের যে তূরীয়- লোকে তিনি উত্তরোত্তর উত্তীর্ণ হইতেছেন বুদ্ধদেব বসু অথবা সমর সেনের প্রশংসা সেখানে আর পৌঁছিবে না। জলসিঁড়ি নদীর ধারে যেখানে ধানসিঁড়ি ক্ষেত তাহারই পাশে জামহিজলের বনে তাঁহার মন এতকাল পড়িয়াছিল। নাটোরের বনলতা সেন সেখান হইতে তাঁহাকে উদ্ধার করিয়া কাঁচাগোল্লা খাওয়াইয়া অনেকটা দুরস্ত করিয়া আনিয়াছিলেন।
৩.
‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’ দেখিয়াছেন? চৈত্রের ‘পরিচয়ে’ দেখিতে পাইবেন। নাটোরের বনলতা সেনকে বিস্মৃত হইয়া কবি জীবনানন্দের (জিহ্বানন্দ নহে) এই টারানটোলা নাচ ! হায় রে, যদি নাচ না হইয়া সোয়ান সঙ হইত!
বনলতা সেন : উৎসে কে
‘মোনালিসা’ ছবিটি নিয়ে যত বিতর্ক ও মতপার্থক্য আছে; ঠিক তেমনই ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি নিয়ে। নাটোরের বনলতা সেনকে নিয়ে বহু গল্পকথা প্রচলিত আছে- হামিদা বেগম তাঁর শ্বশুরের (কফিলুদ্দিন আহমেদ) কাছ থেকে যে গল্পটা শুনেছেন, তারাপ্রসাদের (তারাপ্রসাদ ছিলেন সাহিত্যমোদী এবং সেই সময়কার জমিদারদের অন্য যে সব বিলাস ব্যসন ছিল তার সবেরই রসিক মানুষ) এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন জনৈক ভুবন সেন। আর নাটোরে এসে জীবনানন্দ তারাপ্রসাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে মধ্যাহ্নভোজনের সময়ে কবিকে খাওয়ার পরিবেশন করেছিলেন ভুবন সেনের বিধবা বোন। বনলতা। খাওয়ার টেবিলে সামান্য পরিচয়। দু’দণ্ডের আলাপ, একবার চোখ তুলে তাকানো, এটুকুই নাকি বাস্তব। কবির কল্পনার রঙে রঞ্জিত হয়ে সেটাই নাকি হয়েছে – ‘আমাকে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’।
আবার কেউ কেউ জীবনানন্দের ডায়রিতে প্রাপ্ত ওয়াই (y) চিহ্নিত কোনো এক নারীর মধ্যে বনলতা সেনের উৎস কল্পনা করেছেন। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘বিভাব’ (১৯৯৮) জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবর্ষ স্মরণ সংখ্যায় ১৯৩১ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে লিখিত জীবনানন্দের দিনলিপি (Literary Notes) মুদ্রিত হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩১ সালে লেখা নোটবই থেকে জীবনানন্দের হাতের লেখায় ডায়রি ধরনের ছোট ছোট কাব্যে গাঁথা চিন্তা-ভাবনা। এই নোটবই আর ডায়রির ‘ওয়াই’ সম্পর্কে টীকা দিয়েছেন আমন্ত্রিত সম্পাদক ভূমেন্দ্র গুহ। তাঁর তথ্য থেকে জানা যায়, জীবনানন্দের কাকা অতুলানন্দ দাশের তৃতীয় কন্যা কমলা (ভিন্নমতে শোভনা) দাশগুপ্ত, ডাকনাম বুলু, জীবনানন্দের খুড়তুতো বোন। কৈশোর অতিবাহিত করেছিলেন বরিশালে। সেখানে তাঁর বান্ধবী ছিলেন আর এক কিশোরী যাকে ‘ওয়াই’ সংকেতে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁর আসল নাম জানা (চিহ্নিত করা) যায়নি। জীবনানন্দের ডায়রিতে এবং নোটবইয়ে এই অনামিকা মেয়েটির সম্পর্কে তাঁর আগ্রহের এবং কিছুটা আকর্ষণের স্বীকৃতি আছে। যদিও সেই আগ্রহ কখনও শ্রুতিযোগ্য ভাষায় ব্যক্ত হয়নি, সম্ভবত কিছুটা আকর্ষণ থাকলেও জীবনানন্দের অন্তর্গত স্বভাবের জন্য ‘ওয়াই’ সম্পর্কে মন স্থির করতে পারেননি।
১৯৩০-৩১ সালে জীবনানন্দের মনে যে পরিচিত গ্রাম্য কিশোরীর রূপমূর্তি গড়ে উঠতে শুরু করেছিল তারই সঙ্গে জীবন-মৃত্যু, প্রেম-সৌন্দর্য চেতনা, ইতিহাস চেতনা, দার্শনিক উপলব্ধি, নিসর্গপ্রীতি—এই সবকিছু মিলে ১৯৩৬ সালে তিলোত্তমার মতো গড়ে উঠলো ‘বনলতা সেন’ নামের এক চিরন্তন প্রতিমা।
১৯৩১ সালে নোটবই এবং ডায়রিতে ‘ওয়াই’(y) লিখন—
23.7.31 A rural girl beloved who might flavour my life with love: Y makes that but Y is far from that. She might be that, but she is not that… Ah, where could one find it ! . . . if one could !
9.8.31 About Y’s জন্মদিন। Telephone & her silence.
15.8.31 Y : what of her ? . . . No letter, nothing . . . I can imagine her in 1 romantic setting : kissing & kind would be life & death to me even two years back : But now!
18.8.31 &
19.8.31 Y’s card…
Yesternight-Fresh breeze:cooling: Darkness : Rains: Dreams (Y & all that )
20.8.31 – Y: not today – nor nipen – ধাকুড়িয়া, কাকুড়িয়া & Kankulia
একটিমাত্র ডায়রি থেকে ‘ওয়াই’ সম্পর্কে জীবনানন্দের অনুভব। আরও ডায়রি পাওয়া গেলে জীবনানন্দের অনুভব নিবিড়ভাবে পাওয়া যেত৷
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনীক মাহমুদের লেখা ‘এক রহস্যময়ী নারীসত্তা : নাটোরের বনলতা সেন’ ভিন্ন একটি কাহিনি—জীবনানন্দ নাটোর রাজবাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন কয়েকদিন। যেখানে কয়েকজন মহিলার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। তাঁদের একজন কবিকে অনুরোধ করেন তাঁকে নিয়ে একটি কবিতা লিখে দেওয়ার জন্য। জীবনানন্দ তাঁকে নিয়েই নাকি একটি কবিতা লেখেন এবং মহিলার নামটি পাল্টে একটি কল্পিত নাম দিয়ে দেন যাতে রাজবাড়িতে তাঁর কোনও বদনাম না হয়।
ভিন্নতর আরও একটি গল্প জীবনানন্দ দার্জিলিং মেলে করে যাচ্ছিলেন। পথে নাটোর স্টেশন থেকে ভুবন সেন নামে এক বয়স্ক ভদ্রলোক তাঁর কন্যাকে নিয়ে ট্রেনে ওঠেন। ভদ্রলোক ঘুমিয়ে পড়ার পর তাঁর কন্যার সঙ্গে আলাপ করতে করতে কবি অনেকটা পথ যান। তাঁকে নিয়েই নাকি বনলতা সেন কবিতাটি, তাই নাকি কবিতাটিতে দীর্ঘ পথ পরিক্রমার অনুষঙ্গ।
আজকের নাটোর যে বনলতা সেন নামটির মধ্যে তার নিজের পরিচয় খুঁজে পেয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শহরের বঙ্গোজ্জ্বল এলাকায় রয়েছে বনলতা বালিকা বিদ্যালয়। বগুড়া রাজশাহী সড়কের উপর বনলতা ক্লিনিক নামক নার্সিং হোম। কাপুড়িয়াপট্টি বাজার এলাকায় বনলতা টেলারিং হাউস, বনলতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, হাইওয়ের উপর বনলতা পেট্রোল পাম্প। অর্ধ শতাব্দী প্রাচীন ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরীর দেওয়াল পত্রিকা বনলতা, মেয়েদের ক্লাব ‘বনলতা সেন মুক্ত রোভার দল’। নাটোর শহরে যে কোনো রিক্সাওয়ালা ও বনলতা সেন নামটির সঙ্গে পরিচিত। যেমন, লণ্ডনে ২২১ বি বেকার স্ট্রিট ঠিকানার সন্ধানে অজস্র পর্যটক যান। এই নম্বরে বেকার স্ট্রিটে কোনও বাড়ি নেই, আর কোনওদিন ছিলও না। তবু আর্থার কোনান ডয়েল শার্লক হোমসের বাড়ির যে কল্পিত ঠিকানা দিয়েছিলেন, তাই আজ বেকার স্ট্রিটের মুখ্য পরিচয়। এমনকি লণ্ডনের পাতাল রেলের বেকার স্ট্রিট স্টেশনটিও শার্লক হোমসের সেই প্রসিদ্ধ চুরুট মুখে দেওয়া প্রোফাইল এবং আরও নানা ধরনের ছবিতে শোভিত।
বনলতা সেন কি রূপসী বাংলার কয়েক কোটি মুখের মধ্যে একটি নাম মাত্র! আজও কেন বনলতা খুঁজে বের করার জন্য শত চেষ্টা! কবে কোন যুগে কবি একটি কবিতায় একটা নাম লিখে গিয়েছিলেন আর সেই নামটার পেছনে, তার সন্ধানে এখনও ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে!
জীবনানন্দের জন্ম শতবর্ষে (১৯৯৯) আনন্দবাজার পত্রিকা’য় সুদীপ্ত সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘সুচিত্রা সেনই নাটোরের বনলতা সেন’। সত্যি কি তাই? বনলতা সেন কবিতাটি জীবনানন্দ লিখেছিলেন আজ থেকে ৮০ বছর আগে অর্থাৎ ১৩৪২ সনে। সুচিত্রা সেন তো তখন নেহাতই বালিকা। টেনেটুনেও কিশোরী নন। আর বনলতা সেনকে তো ন্যূনতম এক নারী হতে হবে—তাই তো। সুতরাং এটা নেহাতই একটা বানানো গল্প ধরে নেওয়াই যেতে পারে।
অশোক মিত্র তাঁর ‘রাজশাহি জেলে বন্দি ছিলেন এক বনলতা সেন’ লেখায় জানাচ্ছেন – ‘এক নিভৃত সন্ধ্যায় জীবনানন্দের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, বনলতা সেন নামটি কবিতায় ব্যবহারের জন্য তাঁর কী করে মনে এল; সেই সঙ্গে এটা জিজ্ঞেস করছিলাম, কবিতাটির অন্ত:স্থিত অন্ধকারের প্রসঙ্গ তাঁর কি আগে থেকেই ভাবা ছিল, না কি বনলতা সেন নামটি বেছে নেওয়ার পর কবিতাটি নিজের নিয়তি নির্ধারণ করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের কোনও জবাব পাইনি। জীবনানন্দ শুধু জানিয়েছিলেন, সেই সময় আনন্দবাজার পত্রিকা’য় মাঝে মাঝে নিবর্তক আইনে বন্দিরা কে কোন কারাগারে আছেন, বা কোন জেল থেকে কোন জেলে স্থানান্তরিত হলেন, সে সমস্ত খবর বেরোত। হয়তো ১৯৩২ সাল হবে, নয়তো তার পরের বছর, বনলতা সেন নাম্নী এক রাজবন্দি রাজশাহি জেলে আছেন, খবরটা তাঁর চোখে পড়েছিল। রাজশাহি থেকে নাটোর তো এক চিলতে পথ। ইতিবৃত্তের এখানেই শেষ। প্রাক-স্বাধীনতা যুগে রাজবন্দিনী সেই মহিলা পরে গণিতের অধ্যাপিকা হয়েছিলেন, কলকাতার কলেজেও পড়িয়েছেন। বিবাহোত্তর পর্বে অন্য পদবি ব্যবহার করতেন, তার সঙ্গে সামান্য আলাপ হয়েছিল। ভব্যতাবশতই জিজ্ঞেস করা হয়নি তিনি কবিতাটির সঙ্গে আদৌ পরিচিত কি না। কিছু কিছু রহস্যকে অন্ধকারে ঢেকে রাখাই সম্ভবত শ্ৰেয়।’
আবার অনেকে এও প্রশ্ন তুলেছেন, জীবনানন্দ আদৌ নাটোর গিয়েছিলেন কিনা সন্দেহ আছে। আর নাটোরের এক প্রবীণ সাহিত্যোৎসাহী বলছেন, ভুবন সেন কিংবা সেন পদাধিকারী কোনও পরিবার এ শহরে ছিলেন বলে তাঁর মনে আসছে না। তাই মনে হতে পারে, নাটোরের বনলতা সেন পুরোটাই জীবনানন্দের কল্পনা। কেউ কেউ বলছেন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বিভিন্ন প্রেমিকাদের নিয়ে এক ধরনের কৌতূহল আছে—আর তার খানিকটা চরিতার্থও হয়, কিন্তু জীবনানন্দের জীবনে তাঁর বিবাহিতা স্ত্রী বাদে অন্য কোনো নারীর প্রসঙ্গ কারও জানা নেই। কিন্তু জীবনানন্দের প্রেমের অভিজ্ঞতা ও উচ্চারণ এমন ঘননিবিড় যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকে বনলতা সেনের চিত্রাঙ্কন অসম্ভব শুধু অসম্ভবই নয়, কল্পনাতীত।
আর নাটোরে কোনও বনলতা সেনের সঙ্গে জীবনানন্দের কখনও যদি আলাপ হয়েই ছিল, তাকে তিনি তাঁর গোপন হৃদয়ে রেখে দেবেন এটাই তো স্বাভাবিক। আরও স্বাভাবিক হল এই যে, অন্য কোথাও বনলতা সেন নাম্নী কোনও নারীকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি কবিতার স্বার্থে তাঁকে নাটোরের বনলতা সেন করে দিয়েছিলেন! একটি অবিস্মরণীয় কবিতায় বনলতা সেন নামটি চিরস্থায়ী করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বাস্তবের বনলতা সেনের পরিচয়!
‘বনলতা সেন ৭৫’ লেখায় সুমিতা চক্রবর্তী ব্যক্তিগত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযোগ তুলেছেন—’এই কবিতায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের মনের কথাই ধরা আছে। পথিক, তথা নাবিক, তথা জীবন-পথের যাত্রীর জন্য ক্লান্তি অপনোদনে শান্তির আশ্রয় নিয়ে দেখা দেবে কোনো নারী। সরাসরি বলা না হলেও সে নারী প্রেমিকারই কাছাকাছি। পুরুষ তাকে প্রণয়িনী রূপেই ভাবতে চায়। কিন্তু ক্লান্ত-প্রাণ নারীর জন্য নীড়ের আশ্রয় নিয়ে অপেক্ষা করবে কে! কোনোদিনই কেউ করবে কি না –এ প্রশ্নের উত্তর নেই এ-কবিতায় ৷
বনলতা সেন কবিতাটি অসাধারণ সুন্দর। কিন্তু কবিতাটি অনেকটাই প্রথানুসারি ট্র্যাডিশন্যাল। পুরুষকে শুশ্রূষা দেবে নারী, প্রেমও দেবে নারী; এবং সে নারী হবে স্বপ্নের সুন্দরী—এমনই তো কবিতাটির নির্যাস। পৃথিবীব্যাপী পুরুষ-পাঠকদের এবং পুরুষতন্ত্রের স্বাভাবিকতা নিয়ে কখনও প্রশ্ন মনে-না-আসা নারী পাঠকদের এই কবিতা ভালো লাগবেই। যে-সব কবিতায় জীবনানন্দ রূপ জ্বলে যাওয়া নারীদের দেখেছেন ‘ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল’ (শঙ্খমালা) কিংবা ‘প্রেম ঝরে যাওয়া নারী-পুরুষ যুগলের কথা’ (দুজন)— সে সব কবিতা একই রকম বা এর চেয়েও বেশি অসামান্য হলেও এই জনপ্রিয়তা পাবে না। মানুষ অভিনবত্ব ভালোবাসে; কিন্তু নতুনরূপে আবির্ভূত ট্র্যাডিশনকে ভালোবাসে আরও বেশি।’
বনলতা সেন কে? এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল স্বয়ং জীবনানন্দকেও, সম্ভবত একাধিকবার। তবে এটা ধরেই নেওয়া যেতে পারে, রচনা মাত্রেরই একটি কংক্রিট ভিত্তি আছে। বাঙালি পাঠকের কাছে বনলতা সেন আর পরম রোমান্টিক প্রেমিকা বহু যুগ হল একীভূত হয়ে গেছে। অনেক কবিই তাঁদের বিশেষ বিশেষ প্রেমিকাকে অমরত্ব দান করেছেন হয়তো, অথবা দান করার প্রয়াস করছেন; কিন্তু অন্য কেউই আগের প্রজন্মের অথবা এই প্রজন্মে বনলতা সেনে’র সমকক্ষ কোনও প্রেমিকার জন্ম দিতে পেরেছেন!
জীবনানন্দ দাশ যদি অন্য কোনও কবিতা নাও লিখতেন, তবুও শুধুমাত্র বনলতা সেনে’র জন্যেই বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকতেন।
‘বনলতা সেন’ সম্পর্কিত জীবনানন্দের চিঠিপত্র
১. নলিনী চক্রবর্তীকে / অক্টোবর ১৯৪২
খুকু আপনার কাছ থেকে যে ক’খানা বই এনেছে তা’ পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছি; ইচ্ছে ছিল বইগুলো আরো কয়েকদিন রাখি; কিন্তু খুকুর সঙ্গেই দিয়ে দেব। ‘My Best Play’ বইখানা হয়তো রাখতে পারি; যদি রাখি ক্রিসমাসের সময় ফিরিয়ে দেব; আশা করি কিছু মনে করবেন না। কলকাতায় গেলে আপনাদের Library দেখবার খুব ইচ্ছা; আমি বইয়ের খুব ভক্ত, অর্থাৎ মনের মতন বইয়ের; তা’ যে শুধু সাহিত্য হবে এমন কোনো কথা নেই।
কিন্তু When it comes to reading, প্রায়ই নেড়ে চেড়ে রেখে দেই; কাজেই জ্ঞানবিজ্ঞানে আপনাদের চেয়ে অনেক পিছে পড়ে আছি।
কিন্তু তবুও বইয়ের নেশা কাটানো মুস্কিল।
আপনাকে তো আমি বলেছি কবিতা পাঠাব। নানা রকমের শারদীয় সংখ্যায় লেখা ছড়িয়ে এখন একটু বীতশ্রদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আবার যখন লেখার দিকে টান ফিরে আসবে আপনাকে পাঠাব। কিন্তু তাই ব’লে লেখার ঝোঁক উৎকর্ষের দিকে সঞ্চারিত করতে পারব ব’লে মনে হচ্ছে না।
‘বনলতা সেন’ কবে বেরুবে এখনও ঠিক বলতে পারছি না। বুদ্ধদেবকে এখনও MSS পাঠাতে পারিনি। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র নতুন এডিশন এখন বের করা সম্ভব হবে না । এ দেশের প্রকাশকেরা কেউ নিজের খরচে বড় একটা কবিতার বই ছাপাতে চান না। আমাদের পক্ষেও ছাপানো কঠিন। যা হোক, আমার ইচ্ছা আছে পরিস্থিতির উন্নতি হ’লে এ সম্পর্কে একটা কিছু ব্যবস্থা করব ।
২. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে / আশ্বিন ১৩৪৯
আপনি রবিবারের মধ্যেই আমার কয়েকটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ চেয়েছেন আমি সব সময় তাড়াতাড়ি কবিতা লিখতে পারি না; লিখলেও ভেবেচিন্তে দাঁড় করাতে হয়। কবিতা অনুবাদের বেলায়ও তাই।
তাড়াহুড়ো করে তিন চারটে কবিতার তর্জমা পাঠাচ্ছি; শনিবার শেষ ডাকের আগে পাঠানো অসম্ভব; আপনি হয়তো সোমবার পাবেন। কিন্তু অত তাড়াতাড়ি কি ঠিক জিনিস হয়?
‘বনলতা সেন’, ‘বিড়াল’ ও ‘মনোবীজ’ (কয়েক বছর আগে ‘শারদীয়া আনন্দবাজারে বেরিয়েছিল) অনুবাদ করে পাঠালাম। ইংরেজি লেখার অভ্যাস নেই। হয়তো নানারকম ত্রুটি রয়ে গেছে। আপনি একটু দেখে দিলে ভালো হবে।
৩. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে / ফাল্গুন ১৩৫০
ইংরেজি তর্জমায় আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলন বার হলে আনন্দিত হব। প্রায় দু’বছর আগে বুদ্ধদেববাবুর অনুরোধে এরকম একটা সংকলনের জন্যে আমার কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করে তাঁকে পাঠিয়েছিলাম। শুনছি Harold Acton তা নিয়ে কোথায় গেছেন, খোঁজ নেই। সে সবের কপি আমার কাছে আছে কিনা,— কোথায় আছে, খুঁজে দেখতে হবে। কপি থাকলেও তা খসড়ার মতন—ঘষে-মেজে বুদ্ধদেববাবুর কাছে পাঠিয়েছিলাম।
সম্প্রতি University-র পরীক্ষার খাতা দেখতে বড়ো ব্যস্ত আছি। আপনাদেরও সময় অল্প। নতুন তর্জমার কিংবা পুরোনো অনুবাদ (যদি পাওয়া যায়) শোধরাবার সময় তো আমার হাতে এখন নেই। তর্জমায় ওস্তাদ অমিয়বাবু—এবং বুদ্ধদেববাবু। তাঁরা যদি আমার কোনো কোনো কবিতা—বনলতা সেন, নগ্ন নির্জন হাত, মাঠের গল্প, ক্যাম্পে, সহজ, পাখিরা, শকুন (এ কটির ভেতর থেকে তাঁদের রুচি অনুযায়ী কয়েকটি) এবং তাঁদের পছন্দমতো আমার আধুনিকতর ‘সমাজচেতন’ কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করেন তা হলে আনন্দিত হব।
৪. অরুণ ভট্টাচার্যকে / শ্রাবণ ১৩৫৭
আমার কবিতা সম্পর্কে আপনি যা লিখেছেন তা পড়ে আমি নিজেকে খুব কৃতার্থ বোধ করছি। আপনার মতন অল্প কয়েকজন পাঠক থাকলেও আমি নিজেকে সার্থক মনে করব। কাব্যপাঠ সম্পর্কে নিজের চেতনাকে শুদ্ধ ও সম্প্রসারিত ক’রে একটা পরিষ্কার মতামতে পৌঁছবার আগ্রহ রয়েছে আপনার অনুভব ক’রে ভরসা হল। আমার ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’— ‘বনলতা সেনে’র পরবর্তী কালের কাব্য এক আধজন ছাড়া এ দেশের বড় সমালোচকদের পছন্দ হয় না; সাধারণ পাঠক ও সমালোচকদের প্রায় সকলেই খুব সম্ভব আমার শেষের দিককার কবিতাগুলোকে দুরূহ— না কি দুর্বোধ্য? –ভেবে ছেড়ে দেয়। এ রকম ক্ষেত্রে আপনার approach এর বিশেষত্ব দেখে তৃপ্তি পেলাম।
৫. দিলীপকুমার গুপ্তকে / চৈত্র ১৩৫৭
এক সপ্তাহ হল আপনাকে আরো কয়েকখানা ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ ও কয়েক কপি ‘মহাপৃথিবী’, ‘বনলতা সেন’ ও ‘সাতটি তারার তিমির’ পাঠিয়ে আরো পাঁচখানা ধূঃপাঃ বিক্রির টাকার প্রাপ্তিসংবাদ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলাম।
আমাদের দেশে কবিতার বই প্রায়ই উপেক্ষিত হয়ে পড়ে থাকে। এ রকম অবস্থায় কাব্য সম্বন্ধে পাঠকদের ক্রমেই আরো সচেতন করে তোলবার ভার নিয়ে আপনি খুব ভালো কাজ করেছেন। আমার মনে হয় আপনার আগে অন্য কোনো প্রকাশক কাব্য ও কবিতার বই সম্বন্ধে এ রকম উৎসাহ ও আন্তরিকতা দেখাননি। বহু ধন্যবাদ ও প্রশংসা আপনার প্রাপ্য।
‘মহাপৃথিবী’ ও ‘সাতটি তারার তিমির’ আমার কাছে আর নেই। ‘বনলতা সেন’ও আর নেই; ‘বনলতা সেনে’র প্রথম সংস্করণ ৪/৫ বছর আগে ফুরিয়ে গেছে, কেবলমাত্র আমার কাছে পনেরো কপি ছিল, বিক্রি করব না ভাবছিলাম; কিন্তু বই বিক্রির জন্যেই; আপনাদের আগ্রহ আমার খুব ভালো লেগেছে; বারো কপি পাঠিয়ে দিলাম তাই।
৬. দিলীপকুমার গুপ্তকে / জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৮
আপনাকে ‘অবশেষে’ কবিতাটি সম্পর্কে লিখেছিলাম। কবিতাটির কপি আমার কাছে নেই; আপনাদের কাছেও নেই হয়তো। বুদ্ধদেবের কাছে আছে মনে হয়, তাকে আমি লিখতে পারি। ‘বনলতা সেন’-এ কবিতাটি দিলে ভালোই হয়। আরো কয়েকটি কবিতা পাঠাব।
সিগনেট বুকশপ আমার প্রেরিত ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ ইত্যাদি বইগুলো এত অল্প সময়ের মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছে জেনে খুব বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছি; ‘সিগনেট বুকশপে’র জয় হউক। আমার প্রেরিত সমস্ত বই (‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’ ও ‘সাতটি তারার তিমির’) বিক্রির সম্পূর্ণ টাকা (সিগনেট বুকশপের কমিশন বাদ দিয়ে) পেয়েছি; অনেক ধন্যবাদ ।
৭. সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে লেখা চিঠির খসড়া/তারিখ নেই
‘মহাপৃথিবী’তে ‘বনলতা সেন’-এর কবিতাগুলো নেই, ‘সুরঞ্জনা’, ‘সবিতা’ ইত্যাদিও রইল না। অন্য কিছু কবিতা দেব বলেছিলাম। আপনি এই চিঠি পেয়ে দয়া ক’রে কাউকে পাঠিয়ে দিলে কবিতাগুলো দিয়ে দিতে পারি; আপনি নির্বাচন ক’রে ‘মহাপৃথিবী’র জন্য রাখতে পারেন। কবিতাগুলো Post-এও পাঠাতে পারি; কিন্তু হারিয়ে গেলে মুস্কিল; আমার কাছে আর Copy নেই ধূ.পা. ও ব. সে.-র কবিতাগুলো বুদ্ধদেববাবুর ভালো লেগেছিল—এবং তিনি বহুবার মুখে মুখে ও পত্র-পত্রিকায় লিখে এ কাব্যের খুব আন্তরিক সমালোচনা করেছেন।
৮. সুরজিৎ দাশগুপ্তকে/ অক্টোবর ১৯৫২
তুমি কি অমলেন্দুবাবুকে ‘সাতটি তারার তিমির’ ও ‘বনলতা সেন’ পাঠিয়েছিলেন? আমি তাকে লিখেছিলাম যে তুমি পাঠাবে।
তুমি আমার একটি চটি কবিতার বই ছাপতে চাচ্ছ; কিন্তু আমি ভেবে দেখলাম যে এখন ও-ধরনের বই ছাপিয়ে কোন লাভ নেই। ওকাজে তুমি এখন আর হাত দিওনা। আমার ‘বনলতা সেন’ দেখে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি। এরপরে কবিতার বই বার করলে আমি নিজে আগাগোড়া সব দেখেশুনে ঠিক করব।
৯. সুরজিৎ দাশগুপ্তকে/ জানুয়ারি ১৯৫৩
আমার হাতে এখন কবিতা কিছুই প্রায় নেই— জলার্কে শীগগিরই দিতে পারব না। তুমি কলকাতায় এলে ‘বনলতা সেন’ হাতে হাতে একখানা দিতে পারি।
বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থে ব্যবহৃত ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও পুরাণ প্রসঙ্গ
অশোক : মৌর্যবংশের তৃতীয় সম্রাট। চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র ও বিন্দুসারের পুত্র অশোক খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩-২৩২ রাজত্ব করেন। প্রথম জীবনে নিষ্ঠুরতার জন্য ‘চণ্ডাশোক’ নাম ছিল। কলিঙ্গ দেশ জয়ের জন্য অজস্র সৈন্যক্ষয় দেখে অনুতপ্ত হয়ে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উপগুপ্তের কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন ও প্রজাকল্যাণ এবং ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। নানা দেশে ধর্মপ্রচারক পাঠান। এই উদ্দেশ্যে পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রাকেও শ্রীলঙ্কায় পাঠিয়েছিলেন। এজন্য তাঁকে পরে ‘ধর্মাশোক’ বলা হয়েছে।
কনফুশিয়স : চীন দেশীয় রাজনীতিক ও ধর্মসংস্কারক। খ্রি. পূর্ব ৫৫১-৪৪০। মাত্ৰ ১৫ বছর বয়সে বিভিন্ন চীনা ধর্মগ্রন্থ পড়ে তিনি ধর্মসংস্কারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। পরে চাং নগরের প্রশাসকের পদ লাভ করে তিনি সমাজ সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। পরে পদত্যাগ করে দেশে দেশে তার নীতি প্রচার করেন। তাঁর মতে সমাজ ও শাসনব্যবস্থার ত্রুটিই ব্যক্তিজীবনের দুঃখ কষ্টের হেতু। শিক্ষাকে তিনি সমাজ সংস্কারের কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তাঁর ধর্মচিন্তা মানবকেন্দ্রিক ও বাস্তবধর্মী। মানুষকে ভালোবাসাই পুণ্যধর্ম। মানুষকে জানাই জ্ঞান— এই সব শিক্ষা তিনি কথোপকথন ছলে দিতে চেষ্টা করেন।
কলকাতা : পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী ও বন্দর নগর। জব চার্নক প্রতিষ্ঠিত এই নগর এক সময়ে ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল। এটি ভারতের বৃহত্তম শহর।
কীর্তিনাশা : পদ্মা নদী। পদ্মার প্রবল ভাঙনে পাশের অট্টালিকা প্রভৃতি সব কীর্তি ধ্বংস হয় বলে পদ্মাকে কীর্তিনাশা বলে ৷
গ্রিস : ইউরোপের দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে এজিয়ান সাগর ও ভূমধ্যসাগর সন্নিহিত উপদ্বীপ স্বাধীন নগররাষ্ট্র ভিত্তিক গঠনতন্ত্র এখানেই প্রথম উদ্ভুত হয়। বিশিষ্ট সভ্যতা ও কৃষ্টিসম্পন্ন গ্রিসের ইতিহাস প্রতিটি নগর রাষ্ট্রের পৃথক পৃথক কাহিনীর সমষ্টি। এগুলির মধ্যে এথেন্স, স্পার্টা মাসিডন প্রভৃতি নগর রাষ্ট্রপ্রধান। খ্রিঃ পূর্ব ১০০০ সাল থেকে খ্রিঃ পূর্ব ৩০০ গ্রিস ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতার জ্ঞান দর্শন সাহিত্য ও শিল্পকলা সবই প্রাচীন গ্রিসের দান।
তিলোত্তমা : পরমা সুন্দরী দেবী বিশেষ। বিশ্বের রমণীয় পদার্থগুলির তিল তিল অংশ নিয়ে এঁকে সৃষ্টি করা হয় বলে এর নাম তিলোত্তমা। একে পাবার জন্য অচ্ছেদ্যবন্ধন দুর্ধর্ষ অসুর ভ্রাতৃযুগল সুন্দর ও উপসুন্দরের মধ্যে লড়াই বাধে, ফলে উভয়ের ধ্বংস ও মৃত্যু হয়।
দ্বারকা: গুজরাটের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে আরব সাগরতীরস্থিত বন্দর। প্রাচীন নাম দ্বারাবতী ও কুশস্থলী। খ্রিঃ পূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে বৈষ্ণব ও শৈবতীর্থ হিসাবে খ্যাত। দ্বারকার জ্যোতির্লিঙ্গ হলেন নাগেশ শিব। কুশস্থলী আনর্ত দেশের রাজধানী ছিল। পুণ্যজন রাক্ষস এটি অধিকার করায় শর্থাতির বংশধররা এ নগর ত্যাগ করেন। পরে জরাসন্ধের আক্রমণে বিব্রত কৃষ্ণ মথুরা ত্যাগ করে কুশস্থলীর জনহীন ভূখণ্ডে দ্বারকা পত্তন করেন। কৃষ্ণের মৃত্যুর পর দ্বারকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়। কারো মতে জুনাগড় বা গিরিনগর ই দ্বরকা, মতান্তরে বেট দ্বারকাই প্রাচীন দ্বারকা। কথিত আছে বেট দ্বীপে বিষ্ণু শঙ্খমূল দৈত্যকে নিহত করে তার পত্নী তুলসীকে চারাগাছে রূপান্তরিত করেন।
ধানসিড়ি : ধনশ্ৰী>ধনসিঁড়ি। আসামে এই নামে দুটি নদী আছে। নাগা পর্বতের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ডিমাপুরের কাছে শিবসাগর জেলা দিয়ে উত্তর ও উত্তর পূর্বে গোলাঘাট পর্যন্ত গিয়ে পশ্চিমে সরে ব্রহ্মপুত্রে পড়েছে।
নাটোর : বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার নগর বিশেষ। রাণী ভবানীর রাজত্বের রাজধানী ছিল।
বিদর্ভ: প্রাচীন রাজ্য বিশেষ। কুন্তিনগর। অধুনা এই স্থানের নাম বেরার প্রদেশ। দময়ন্তী, অগ্যস্ত-পত্নী লোপামুদ্রা ও রুক্মিনী বিদর্ভের কন্যা ছিলেন।
বিদিশা : প্রাচীন নগর। মালব রাজ্যের অন্তর্গত গোয়ালিয়রের নিকটে আধুনিক ‘ভিলসা’।
বিম্বিসার : প্রাচীন মগধের রাজা। খ্রিঃ পূর্ব ৫৩৭-৪৮৫ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। এর রাজধানী ছিল রাজগৃহ (রাজগীর)। বুদ্ধদেবের কাছে তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দেন। তিনি নিজপুত্র ‘অজাতশত্রু কর্তৃক নিহত হন।
বুদ্ধ : শাক্যসিংহ, গৌতম, সিদ্ধার্থ (খ্রি. ৫৫৬-৫৭৬) কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোধন ও রাণী মহামায়ার পুত্র সিদ্ধার্থ বিমাতা গৌতমী কর্তৃক পালিত হন। পরিণত বয়সে দণ্ডপানির কন্যা গোপার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর পুত্রের নাম রাহুল। জীবের দুঃখ মোচনকল্পে তিনি গৃহত্যাগ করে কঠোর তপশ্চর্যায় বোধিবৃক্ষতলে বুদ্ধত্ব অর্জন করেন ও অহিংসা এবং সর্বজীবে দয়াভিত্তিক নবধর্ম প্রচার করেন। ৮০ বছর বয়সে কুশীনগরে তাঁর মৃত্যু হয়৷
বেবিলন : মেসোপোটেমিয়ার প্রাচীনতম শহরগুলির অন্যতম ও সুমের সভ্যতার পীঠস্থান ও এককালীন রাজধানী বেবিলন আধুনিক বাগদাদ শহর থেকে ত্রিশ মাইল দক্ষিণে ইউফ্রেটিশ নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। সুমেরীয় সভ্যতা প্রায় ৪০০০ অব্দের হলেও এখানে সম্ভবত খ্রি. পূর্ব ২৩০০ অব্দে রাজধানী স্থাপিত হয়। খ্রি. পূর্ব ১৯০০ অব্দে সম্রাট হামুরাবি এবং আরও পরে সম্রাট নেবুকাডনেজারের ঝুলন্ত বাগান এবং হামুরাবির গ্রন্থাগার এই সভ্যতার চিহ্ন বহন করেছে।
বৈতরণী : মৃত্যুনদী। যমপুরীর প্রান্তে এই নদী প্রবাহিত। এই নদী পার না হয়ে কেউ যমালয়ে প্রবেশ করতে পারে না।
ভারত : ভারতবর্ষ। আর্যমতে পৃথিবী সপ্তদ্বীপা। জম্বু, প্রমা, কুথা, ক্রৌঞ্চ, শাক, পুষ্কর, শাল্মলী দ্বীপের অংশ বিশেষকে বর্ষ বলে। জম্বুদ্বীপের যে বর্ষে ভরত নামক রাজা রাজত্ব করতেন তাকে ভারতবর্ষ বলা হয়েছে। ভারতবর্ষ আধুনিক কালে তিনটি রাষ্ট্রে (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) বিভক্ত। ভারত বলতে বর্তমানে সাধারণত ভারত রাষ্ট্রকেই বোঝানো হয়। ভারতের দক্ষিণে অবস্থিত মহাসাগরকে ‘ভারত মহাসাগর’ বলা হয়েছে।
ভূমধ্যসাগর : ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যবর্তী প্রায় নিস্তরঙ্গ সমুদ্র। দার্পনেলিশ প্রণালীর মাধ্যমে কৃষ্ণসাগর এবং জিব্রাল্টার প্রণালীর মাধ্যমে আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত।
মহেন্দ্র : সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র, বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন। ভগিনী সঙ্ঘমিত্রাও তাঁর পরে একই উদ্দেশ্যে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন।
মিশর : আফ্রিকা মহাদেশের একটি সুপ্রাচীন দেশ। বর্তমান নাম সংযুক্ত আরব সাধারণতন্ত্র। নীলনদের তীরে উদ্ভূত মিশরীয় সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাসমূহের অন্যতম।
মালয় : দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি উপদ্বীপ। এখন সন্নিহিত রাষ্ট্রগুলি একত্র হয়ে মালয়েশিয়া রাষ্ট্র গঠন করেছে। মালয়ের সন্নিকটস্থ সাগরকে জীবনানন্দ মালয় সাগর নামে অভিহিত করেছেন।
রাধিকা : রাধা, রাই। কৃষ্ণের মাতুল অভিমন্যু বা আয়ান ঘোষের স্ত্রী রাধিকা কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠা অনুরাগিণী ছিলেন। তিনি বৃষভানুর কন্যা। শ্রীমদ্ভাগবতে রাধার উল্লেখ নেই। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ দেবী ভাগবত ও পদ্মপুরাণে রাধার উল্লেখ আছে। ‘রা’ অর্থে লাভ করা, মুক্তি পাওয়া। ‘ধা’ অর্থে ধাববান হওয়া। রাধিকা এবং কৃষ্ণ উভয়কে ভগবান হিসাবে গণ্য করা হয়।
শঙ্খমালা : রূপকথার নায়িকা ।
সিংহল : প্রাচীন লঙ্কা, সাম্প্রতিক নাম শ্রীলঙ্কা। ভারত মহাসাগরীয় একটি দ্বীপরাষ্ট্র। শোনা যায়, বিজয় সিংহ এই দ্বীপ জয় করে এর সিংহল নাম রাখেন। কথিত আছে, এখানে প্রাচীনকালে কুবেরের রাজধানী ছিল, রাবণ তাঁকে বিতাড়িত করে সিংহাসন আরোহণ করেন। পরে বিভীষণ রাজত্ব পান। এক সময়ে সিংহলের রাজধানী ছিল অনুরাধাপুর। সিংহলের সন্নিহিত সমুদ্রকে সিংহল সমুদ্র বলা হয়েছে।
তথ্যসূত্র :
- ১. দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়—জীবনানন্দ দাশ : বিকাশ-প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত, ১৯৮৫।
- ২ আব্দুল মান্নান সৈয়দ—বনলতা সেন, ১৯৯৮।
- ৩. প্রভাতকুমার দাস—জীবনানন্দ দাশ
- ৪. অম্বুজ বসু—একটি নক্ষত্র আসে
- ৫. দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত)—জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ, ১৯৯৩।
- ৬. আব্দুল মান্নান সৈয়দ (সম্পাদিত)—জীবনানন্দ, ১৯৮৪।
- ৭. দেবকুমার বসু (সম্পাদিত)—জীবনানন্দ স্মৃতি, ১৯৭১।
- ৮. আবদুল মান্নান সৈয়দ (অতিথি সম্পাদক)—কিছুধ্বনি, ১৯৯৩।
- ৯. রঞ্জনকুমার দাস (সংকলিত)—শনিবারের চিঠি (সংবাদ-সাহিত্য), ২০০১।
- ১০. সৈকত হাবিব (সম্পাদিত)—বনলতা সেন ষাট বছরের পাঠ, ২০০৪।
- ১১. Debiprasad Chatterjee (Edited)—Modern Bengali Poems, 1945.
- ১২. Sumita Chakraborti (Edited by)—Jibanananda, 2007.
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।