• মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
Sunday, May 25, 2025
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi
No Result
View All Result
নবজাগরণ
No Result
View All Result

আধুনিক বাংলা কবিতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুপম নিদর্শন

আমিনুল ইসলাম by আমিনুল ইসলাম
November 5, 2024
in সাহিত্য আলোচনা
0
আধুনিক বাংলা কবিতা

Image by StockSnap from Pixabay

Share on FacebookShare on Twitter

সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, জাতীয়-আন্তর্জাতিক যে কোন দুর্বিপাকে বিবেকমান সামাজিক দায়বদ্ধ আধুনিক কবিগণ সংহতির মহান আদর্শের পতাকা স্পর্ধায় উত্তোলিত করেছেন সর্বকালে, সর্বদেশে। সংকটকে বড় করে দেখে নিজেদের গা বাঁচিয়ে দুরত্বে থেকে চৈতন্যকে বন্ধক রেখে কবিগণ কখনই সন্ধি করেননি। এই চিরকালীন সত্যই বাংলা আধুনিক কবিতায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে সর্বসময়েই। এভাবেই বাংলা কবিতার ধারা সেই চর্যাপদের কাল থেকে অনুশীলন করলে দেখা যাবে যে, কবিরা কবিই প্রথম ও শেষে—না হিন্দু, না মুসলমান, না বৌদ্ধ, না খ্রীষ্টান। কোনাে ধর্মীয় কিংবা ভৌগােলিক গণ্ডিতে তারা আবদ্ধ নন। কবিরা সবর্জাতিক, আন্তর্জাতিক। মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ সম্পর্ক স্থাপনে সামাজিকতায়, আচার-ব্যবহারে, বাঙালি কবিরা কখনই বিশুদ্ধ জাতিগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখাতে আদৌ আগ্রহী ছিলেন না।

আধুনিক বাংলা কবিতা
চিত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, Image Source: bbc

কবিতায় মানুষের প্রতি মানবিক প্রীতি-সম্প্রীতির বাণী যেমন ধ্বনিত হয়েছে সেই সাথে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী কায়েমী স্বার্থের প্রতিভু শােষক শ্রেণিকেও কবিরা চিনতে কোনদিন ভুল করেননি। মৌলবাদী শক্তি যতই অপকৌশলে মাতুক শুভবুদ্ধির কাছে তারা বারবার পিছু হটেছে। কবিদের কবিতায় রক্তাক্ষরে বারবার লিখিত হয়েছে সংহতির কথা, মানুষে মানুষে মানবিক বন্ধন দৃঢ় করার কথা। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, কায়কোবাদ, নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের ভূমিকা তাে ইতােপূর্বে আলােচিত হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা আরাে কয়েকজন কবিকে নিয়ে আলােচনা করব, যারা ঐক্যের সপথে তাদের কলম চালিয়ে গেছেন।

আধুনিক বাংলা কবিতা
চিত্রঃ কাজী নজরুল ইসলাম, Image Source: flickr

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কেবল প্রকৃতিপ্রেমে আবদ্ধ থাকেননি, প্রকৃতি তার কবিতার বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে স্থান পেলেও তিনি তার কাব্য ভাবনাকে নানা দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ক্লাসিক চেতনার গৌরব মহত্ত্ব থেকে, ইতিহাস রস নির্মাণ থেকে মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, সংগ্রামী মানুষের চিত্র, স্বদেশপ্রীতি ও জাতীয়তাবােধ সব দিকেই সমান দৃষ্টি রেখেছেন, পদচারণা করেছেন গুরুত্ব দিয়ে। এ কারণে ‘সহমরণ কবিতায় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে জীবধর্মের জয়গান করেছেন, আবার ‘বিশ্বকৰ্মা’, ‘মেথর’, ও শূদ্র’ প্রভৃতি কবিতায় শ্রমজীবী দুঃখী মানুষের অন্তরের ছবি এঁকেছেন সহমর্মিতায়।

সত্যেন্দ্রনাথ যে নিজেকে জাত-ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পেরেছিলেন, তা তার কাব্য ভাণ্ডারের দিকে তাকালে বােঝা যায়। দেশজ মাটিকে ভালােবেসে জাতীয়তাবাদীতে নিজেকে উৰ্ত্তীণ করে এ পথে তিনি চলতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার কবিআত্মার আপন শুদ্ধতায় তা সােচ্চারে বলা যায়। বিশেষ করে তিনি যখন আমাদের এ কথা বলেন—

‘মানি না গির্জা, মঠ, মন্দির, কল্কি পেগম্বর,

দেবতা মােদের সাম্য-দেবতা অন্তরে তার ঘর।’

প্রকৃত ভারতীয় সংস্কৃতির ঐক্যসন্ধানী ঐতিহ্যে বলীয়ান ছিলেন বলেই না তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ে মানুষের সাম্যতার বন্দরে দেবতার ঘর রয়েছে, এ ভাবনা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এখানেই কবি সত্যেন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন বিমানবাত্মার একনিষ্ঠ সাধক। তার কবি-জীবনের আসল সিদ্ধি এখানেই।

আন্তর্জাতিক চেতনাও সত্যেন্দ্রনাথের কবিতার আর একটি দিক। নিখিল প্রাণের সঙ্গে ঐক্য-সাধনার কথা তা না হলে তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হবে কেন—

‘নিখিল প্রাণের সঙ্গে মােদের ঐক্য সাধনা,

হিয়ার মাঝে বিথ হিয়ার অমৃতকণা।

‘বিশ্ব হিয়ার অমৃতকণা লাভই ছিল সত্যেন্দ্রনাথের একমাত্র ব্রত, এ জন্যই তাঁর কবিতা বেশিরভাগই ভাষায়-ছন্দে হয়ে উঠেছে। প্রকৃত মানব জীবন ও সমাজ জীবনের গান। কখনাে বা ছাই ছাপা আত্মবীক্ষণ অন্তরেরও। যে অন্তর কল্পনার ভেতরে রয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের লীলা-রহস্যের চিরায়ত ঐক্যতান! কবি সত্যেন্দ্রনাথের ‘প্রেম’ নামক বস্তুটি তাই একতারে বাঁধা না থেকে হয়ে ওঠে বিধমুখীনতার সন্ধানী। কবি-কথাতেই যার আভাস পাই ‘প্রিয়প্রদক্ষিণ’ কবিতায়, তিনি যখন আমাদের এ কথা বলেন—

‘ঘুরি গাে যাত্রী দিবস রাত্রি।

অনুপ দেউল ঘিরে,

নূতন প্রেমের নির্মল-করা

‘নির্মালি’ ধরি’ শিরে!

কত হাসি কত পুলক-অশ্রু

কবি গাে আবিষ্কার,

দৈব প্রসাদে খােলে দেউলের

নূতন নূতন দ্বার!

একান্ত পল্লিপ্রীতি, ভগবত-বিধাস সমকালের তরঙ্গ-বিক্ষোভের মধ্যে যেন এক ধ্যানগম্ভীর প্রশান্ত স্বপ্নমেদুর দ্বীপভূমি রচনা করেছিল, কিন্তু তা কুমুদরঞ্জন মল্লিকের পলায়নী মনােবৃত্তির পরিচায়ক, এমন ধারনা সমীচীন নয়। আসলে এই-ই তার নিজের জায়গা এবং তার এই প্রধান আশ্রয়কেই আমরা প্রধান সীমাবদ্ধতা বলে চিহ্নিত করেছি। কবি কিন্তু যাবতীয় প্রতিকূলতাকে গভীর বিশ্বাসের বর্মে প্রতিহত করে অন্তত ঘােষণার সুরেই বলেছেন—

“যুগ উপযােগী হতে কহ মােরে তাতে মাের রুচি নাই,

সব দেশ কাল জাতির আমি যে মর্যাদা পেতে চাই।

ধনিক বণিক শ্রমিক ক্ষণিক কারও প্রতিকামী নহি

আমি জগতের যজ্ঞের হবি, দেবতার তরে বহি।

আর কিছু নাহি পারি—

আমি তােমাদিকে করি আনন্দ —

অমৃতের অধিকারী।” (‘কবিতার দুঃখ’, শ্রেষ্ঠ কবিতা)

যখন দেশভাগ-লুণ্ঠন-হত্যার বিষবাষ্পে চারপাশেরপৃথিবী ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল। সেই রক্ত নদীর চেহারা দেখে শিউরে উঠে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক বলেছিলেন—

“এমন করে কে বাজালে

কে বাজালে বিষের বাঁশি?

বিষের হাওয়ার দেশ জ্বলে যায়

সকল মনই অবিধাসী।

পুণ্য এবং পবিত্রতা

কোথায় দয়া? কই মমতা?

মুখে বিষের বিষাণ বাজে

ছড়ায় কে এই বিশের রাশি

ও কি ভীষণ ভয়াল আওয়াজ?

শুনছে সরল পল্লীবাসী,

শান্তি প্রীতির শতেক বাঁধন।”

এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল সােনার বাংলা পত্রিকায়। এই ধরনের সাময়িক বিষয় নিয়ে লেখা বহু কবিতার একটি পান্ডুলিপি রক্ষিত আছে কুমুদরঞ্জনের পারিবারিক সংগ্রহে। কবিতাগুলি সেই সময়ে (১৯৪৬-৪৮) আনন্দবাজার পত্রিকা, মাসিক বসুমতী, দীপালি, হিন্দু বার্তাবহ, রামধনু, পূর্বাচল, শিশির, সােনার বাংলা, বঙ্গলী প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। চামড়া বাঁধানাে একটি খাতায় হাতে লেখা কবিতার ওপরেই পত্রিকা থেকে প্রকাশিত কবিতাটি কেটে কবি স্বয়ং সেঁটে রাখতেন।

সাম্প্রতিক বিষয়ভিত্তিক এই কবিতাগুলির পটভূমি কলকাতা, নােয়াখালি, বিহারের দাঙ্গাবিধস্ত অঞ্চল এবং আহত মানুষের দীর্ঘাস যেন কবিতাগুলির মূলসুর। দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে বঙ্গবিচ্ছেদ এবং বাস্তহারাদের দুর্গতি, স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা এবং আশ্রয়হীন অন্নহীন বিপন্ন মানুষের মাঝখানে ক্ষমতালােভী নেতাদের নির্লজ্জ আচরণ, লােভ আর হিংসার ক্রমপ্রসার কুমুদরঞ্জনকে পীড়িত করেছিল। ‘দুর্দিন’ কবিতায় ধরা পড়েছে সেই বিনষ্ট সময়ের ছবি–

“জাতির জীবনে চারিদিক দিয়া আসিয়াছে শিথিলতা,

গভীর ভয়ের কথা,

সাধুতা, সততা, সত্যনিষ্ঠা, কর্তব্যানুরাগ,

সবেতে লেগেছে দাগ,

নাই পবিত্র বিশুদ্ধ কিছু আমিষ গন্ধ সবে,

অশুচিতা-সৌরভে।

অবিশ্বাসের ভয়াল কুয়াশা ঢাকিয়াছে সারা দেশ,

ফেরে খেপা বিদ্বেষ।

বাক ও হৃদয় নাহিক সৌখ্য, খলতার শুধু জয়,

প্রতিপদ ভীতিময়।…”

সমকালীন কোনাে আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনাে যােগ ছিল না কুমুদরঞ্জনের। তিনি তার গ্রামে ভক্তিবিশ্বাস নিয়ে ছিলেন দূরে। আর এই দূরত্বের জন্যই সম্ভবত সময়ের এই অন্তঃসারশূণ্য ছবিটি তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আর বেদনার্ত কবির মর্মব্যাথা (শিশির পত্রিকায় প্রকাশিত) অভিব্যক্তি হল এইভাবে—

“গর্বিত ক্ষিপ্ত, জনতা নৃশংস

যে সব জীবন করে দিল ধ্বং,

যে সব নিরীহ হিন্দু-মুসলমান—

পথে ও স্বগৃহে হারালাে প্রাণ,

নারী ও পরের যাতনা অক্ষন্তুদ

করিছে কাতর—জানিনে জুড়াবাে কুতুঃ?

অতৃপ্ত ম্লান, দৃষ্টি মুমূর্যর —

বক্ষ আমার করিতেছে পরিপূর।…”

কেন এত হিংসা, কেন এত রক্তস্রোতে দেশ ভেসে যায়, তার উত্তর কবির অজানা, তাই সারাজীবনে যে দেবতায় তার অবিচল বিশ্বাস, তাকেই তিনি প্রর্ণ করেন—

“তুমি সব কর, তুমি বিশ্বের রাজা —

কাহার দোষেতে কারে দাও তুমি সাজা?

কোথাকার বাজ কোথায় আনিয়া হানাে

কর্তা তুমিই, কারণ ইহার জানাে।

ধ্বংসে কি প্রভু, তুমি আনন্দ পাও ?

দুবৃত্তকে কেন এ শক্তি দাও ?”

বােঝা যায়, কবির দীর্ঘলালিত স্থির নিশ্চিত প্রত্যয় এবার জিজ্ঞাসায় জর্জরিত হয়েছে। এখন পথে-ঘাটে নিত্য দেখা যাচ্ছে ‘নূতন মাসুরে’ (সােনার ফসল)—আগে ঠগীরা মাঠে-ঘাটে মানুষ মারত, এখন শহরেই চলছে হত্যালীলা—

“হত্যা, হরণ নিত্যই ঘেরি

যেন রাজ্যটা রাক্ষসদেরি,

শােলার মতন মানুষের শব

ভাসিয়া বেড়ায় লহরে।

নিত্য বাজার দরের মতন

খুনের খপর আসিছে,

যুগের যুগের যত বিভীষিকা

গােটা এ দেশকে গ্রাসিছে।..”

দেশের এই সার্বিক দুর্দিনে কুমুদরঞ্জন যথার্থ মানবিক দরদ নিয়ে বলেছেন মৃত হিন্দু-মুসলমানের স্মরণে একটি সৌধ নির্মাণের কথা। ‘সােনার বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পাছে ভুলে যাই’ নামাঙ্কিত কবিতাটিতে আত্মসমালােচনার ভঙ্গিটিও লক্ষণীয়—

“নিরীহত পথিক যত

নগরীতে হ’ল হত

ক্ষিপ্ত জনতার হাতে যারা দিল প্রাণ,

না জানি কিছুই যারা

হইল সর্বস্ব হারা,

হইল নিহত যত হিন্দু-মুসলমান,

যুক্ত এক স্মৃতি স্তম্ভ,

গঠনের শুভারম্ভ

শ্রদ্ধা প্রীতি অশ্রু দিয়ে অদ্য হাওয়া চাই।

দুয়ের রক্তের রাখী

মর্মর রাখুন ঢাকি

কলঙ্কের ইতিহাস পৃষ্ঠে সর্বদাই।…”

এমন একটা সময় ছিল যখন হিন্দু এবং মুসলমানের পৃথক পৃথক পাড়া থাকলেও উভয়েই ছিল উভয়ের প্রতি সদা সন্ত্রমশীল। সব হিতকর কাজে তারা একত্র হত এবং ‘বিপদে আপদে সৌভ্রাত্বের / পাওয়া যেত পরিচয়’। কিন্তু এখন ‘সাম্প্রদায়িক বিষে নিরবধি উভয়ের অভিষেক’, তীব্র শ্লেষে সমস্ত ভন্ডামিকে বিদ্ধ করে তাই কুমুদরঞ্জন বলেন—

“শব্দ দুটা নােংরা বড় লঘিষ্ঠ আর গরিষ্ঠ,

মিষ্ট যেমন কবিরাজের পাচন এবং অরিষ্ট।..

হিন্দু এবং মুসলমানের কথা বলতে গেলেই নিত্য

কাগজে ওই দুটোয় দেখে যায়—জ্বলে যায় পিত্ত।

বাঘ ও সাপের নাম করে না গ্রামবাসীরা রাত্রে,

‘লতা’ ‘পােকা’ সুন্দরবর’ বলে ও সব পাত্রে।

শুনতে নহে নেহাৎ খারাপ, যায়—করা যায় সহ্য,

গরিষ্ঠ ও লঘিষ্ট ভাই একেবারেই ত্যজ্য।

দেশে কি কাল-রাত্রি এলাে—ভাবতেও হয় কষ্ট,

হিন্দু এবং মুসলমানও যায় না বলা স্পষ্ট।

গােপন করে বলতে হবে কেবল শুধু নাম তাে —

ছােট করে বলুক তারা হামদো এবং মামদো।…” (‘গরিষ্ঠ ও লঘিষ্ট’)

তাই সমালােচক যখন বলেন, “কবি যে কখনাে সংশয়ের দ্বারা পীড়িত হননি, নৈরাশ্যের দ্বারা অভিভূত হননি, তা থেকে একথাই প্রমাণি হয় যে, হৃদয়ের অন্তঃস্থলে তিনি একটি শান্তির আশ্রয় পেয়েছিলেন, যা তাকে বাইরের সমস্ত বিক্ষোভ ও হতাশা থেকে রক্ষা করেছে।” তখন তা খন্ডিত, আংশিক বলে মনে হয়। একথা ঠিকই যে কুমুদরঞ্জনের কবিতায় গ্রামের প্রকৃতি এবং মানুষের ছবিই বেশি, কিন্তু তিনিও জীবনের মধ্যপর্ব ছাড়িয়ে এসে সাম্প্রতিক বিষয়কে অঙ্গীকার করেছিলেন। রবীন্দ্রযুগের কবিদের মধ্যে কালিদাস রায়ই সমসাময়িক বিবিধ বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন, পাশাপাশি করুণানিধি বন্দ্যোপাধ্যায় ও যতীন্দ্রনাথ বাগচী কালপ্রভাবে গ্রস্ত হয়েছেন তুলনামূলকভাবে কম। আর একসময় যে উচ্ছ্বাসে কুমুদরঞ্জন লিখেছেন—

“আমার গ্রামের পথে আমার ঘুরে বেড়ায় মন,

যেমন নদীর ঢেউয়ে নাচে প্রভাত-সমীরণ।”

(‘গ্রামের পথে’, শ্রেষ্ঠ কবিতা)

তিনিই ‘বেদনা’ (বার্তাবহ, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭) কবিতায় লিখলেন—

“রাত্রে আমার হয় নাকো ঘুম

ব্যাকুল করে প্রাণ,

হত এবং আহত সব

হিন্দু-মুসলমান।

মানুষে হায় করলে মানুষ

এতই হতমান!”

অপরিণামদর্শী অবিবেচক এইসব নেতারা ক্ষমতালােভে স্বার্থসিদ্ধির জন্য জাতিবিদ্বেষ প্রচার করছে, তাতে প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ মানুষের, প্রকৃত অপরাধীরা রয়ে যাচ্ছে আড়ালে। এই ‘ভ্রান্তিদশকে’ কুমুদরঞ্জনের রুব্ধ উচ্চারণ—

“জাতি বিদ্বেষ প্রচারেতে অপরাধ

জাতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করাও পাপ।

কিন্তু পড়িছে শুরু অপরাধী বাদ

এ বিষ ছড়ায়ে অনেকে করিছে লাভ।

না করি বন্ধ বিষের প্রস্রবণ

কি হবে রােধিয়া বহু দূরে এসে ধারা?” (‘জাতিবিদ্বেষ’)

‘পিঞ্জরের প্রীতি’ কবিতায় কপিঞ্জল ছদ্মনামে ব্যক্ত হল কুমুদরঞ্জনের তীব্র অসন্তোষ-

“মনুষ্যত্ব বিবর্তে যবে পশুত্বে এলাে নামি,

জাতিদের চাই পৃথক পিঁজরা, কথাটা নয় কি দামি?”

কুমুদরঞ্জন তখন অনুধাবন করছেন, এই জাতিবিদ্বেষ-বিষেই নােয়াখালি আজ শ্বশান—

“হত গাড়ি, হত বৎস, হত নারী নর,

পােড়া বাড়ি, পােড়া গ্রাম, অঙ্গারের স্তর,

আধপােড়া তরুলতা, অপহৃতা নারী,

ছন্নছাড়া সর্বহারা মানুষের সারি,

শঙ্কাহীন উদ্ধৃঙ্খল দম্ভী দস্যুদল,

ভস্মীভূত বিবেকের নিষ্প্রভ অনল,

জড়ীভূত রাজশ্রীর কৃত্রিম স্পন্দন,

বিষ-বিভূম্ভিত নষ্ট মানবের মন,

মৃত ও মেকির রাজ্য—কি দেখিবে আর?

বিষাণু দিতেছে বিষ্ণু-বায়ুতে সাঁতার।” (‘গান্ধী মহাত্মার নােয়াখালি দর্শনে’)

বােঝা যায়, সমকালীন ঘটনার অভিঘাতে কবিমানস কিভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে।

সমকালীন সমস্যা কুমুদরঞ্জনের লেখনীতে কখনাে তীব্র ক্রোধে, কখনাে তির্যক ব্যাঙ্গে, কখনাে বা প্রচ্ছন্ন কৌতুকে প্রকাশিত হয়েছে। ক্রোধের পাশাপাশি এই কৌতুকের একটি দৃষ্টান্ত উদ্ধার করা যেতে পারে—

“মনীষী জিন্নাজী

এতদিন পরে কি

তৃপ্ত হইলে ভারত বিভাগ করি?

জাগাইয়া বিদ্বেষ

ভাগাভাগি হলাে দেশ

এতে সুখী তুমি বিশ্বাস কিসে করি?

তুমি যে মহাপ্রাণ,

হিন্দু-মুসলমান

শত্রু হইবে—এটা কি আকাঙ্খিত?..

হেথা আর সবাকার

ঠাই হবে থাকিবার

মুসলমানির কৃষ্টি পাইবে লয়?

বহু শতাব্দী গেছে

বেশ এক হয়ে আছে

স্বাধীনতা এসে ঘটাবে বিপর্যয় ?..” (‘জিন্নাজীর প্রতি’)

স্বাধীনতা নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল মানুষের, কিন্তু স্বাধীনতা নিয়ে এসেছিল সেই স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা, আরাে অনেকের মতাে, স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে ভারতবর্ষের ক্রোমশ অধােগতি কুমুদরঞ্জন বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করেছিলেন এবং সেই হাহাকারকে হালকা চালে। ঢেকে রেখে বলেছিলেন—

“চালের বদলে কাকর আসিল

দুধের বদলে সুরা

হীরার বদলে জিরাই মিলিল

বুঝিতে পেরেছি খুড়া!

তােড়ার বদলে ছােরাই পেলাম

হাসির বদলে ঘুসি,

গুণীর বদলে খুনীই পেলাম

কামড় কুমুর পুষি।” (‘কি পেলাম’)

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্যে ১৯২৬-এর বিরােধের পটভূমিকায় আমরা যে সাম্প্রদায়িকতা বিরােধী মনােভাব দেখেছি, ১৯৪৬-এর তেভাগা আন্দোলন, কলকাতা-নােয়াখালির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় সেই একই মনােভাবকে পেয়েছি আধুনিক কবি বিষ্ণু দে-র কবিতায়। তার ‘সন্দীপের চর’ কাব্যগ্রন্থটি ১৯৪৬-এর রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত। এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘সন্দীপের চর’ হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য প্রয়াসে সন্দীপের চরে নিহত লালমােহন সেনের উদ্দেশে রচিত। হিন্দুমুসলমান মৈত্রীর দুঃসাধ্য প্রয়াসে কবি লক্ষ করেছেন, এ মরণে প্রাণ নেই, এ তাে নেশা উন্মাদের। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও কবি মানবিক শুভবােধে আস্থা হারাননি—

“আমরাই মরি আজ আপন পাশার ছকে

তবু স্থির জানি, তবু মন দৃঢ় সত্যে বাঁধি।”

এই কবিতায় দেখি নগর কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গার বর্ণনা —

“সচ্ছল ভূস্বর্গ সুখে—চুপে চুপে

হয়ে গেছে জীবনের হার—

আজকে সবাই প্রতিবেশী ভাই, হে প্রকৃতি ভুলে যাই

জীবনের মরণের হারে বাঁধা জীবনের ছবি

আজ শুধু মারি, মরি, পুড়ি ও পােড়াই, খেপি আর লুটি।” (সন্দীপের চর’)।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ‘সন্দীপের চর’ কাব্যে বিষ্ণু দে-র মানবিক স্বর আমরা দেখতে পাই। “সাত ভাই চম্পা’ কাব্য থেকেই তিনি সমকাল-সচেতন দেখি। কিছু দৃষ্টান্ত দিই —

১. “জলে স্থলে যুদ্ধ চলে, ভারতেরও ভিৎ টলে, প্রাণের নির্দেশে

কলকাতার পূর্ণিমাও জটায়ুর পাখা ঝাড়ে দূর দেশে দেশে।”

(২২ জুন ১৯৪১)

২. “মৃত্যুহীন সমাজের করি জয়গান।

উজবেক্‌, ভাজি, কাজাক—ও দূর হিন্দুস্থান।”

(২২ জুন ১৯৪২)

কলকাতা ও নােয়াখালিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলেও কুমিল্লার হাসনাবাদ গ্রামে অন্যচিত্র দেখা যায়। সেখানে কৃষকসভার নেতৃত্বে এগারােটি গ্রামের হিন্দু ও মুসলমান চাষিরা তিন হাজার বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করেন, আশ্রয় দেন। বিষ্ণু দে সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ‘হাসনাবাদেই’ কবিতায় লেখেন,

‘রাখী বেঁধে অতন্দ্র রাম ও রহিম’ এবং—

“জাগ্রত মুত্তির আভাস পেয়েই

রাক্ষসী রাণী বুঝি ভয়ে হলে হিম

মরণকাঠি যে তার হাসনাবাদেই

এক হাতে ভাঙে শত রাম ও রহিম।”

কৃষক আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে রূপকথার ছদে মিলিয়ে তিনি লেখেন,

‘নীল কমলের আগে দেখি লালকমল যে জাগে’ আর-

“যাত্রা তাদের কঠিন পথে রাখি বাঁধা কিশাের হাতে

রাক্ষসেরা বৃথাই রে নখ শানায়।”

(‘মৌভােগ’) অন্যদিকে দেখেন

“দীপ্ত বাহু, দৃপ্ত উরু, পূর্ণ সাধ মানুষ মানুষ সত্য সেই সবার উপরে।”

(‘সমুদ্র স্বাধীন’) কবি বিষ্ণু দে স্বপ্ন দেখেন স্বাধীন দেশের ও মানুষের। যেখানে ভেদাভেদ, হানাহানি, হিংসা আর নেই—

“লােক চলে, হাতে হাত, নিশানে নিশান,

গানে গান, কোলাকুলি, সেলাম হাসিতে

ট্রামে বাসে ট্রাকে ট্রাকে সৌজন্য অশেষ

হে আশ্চর্য শহর আমার এ আমার মৃত্যুঞ্জয় দেশ!” (১৫ই আগস্ট)

পঞ্চাশের মন্বন্তর, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বা বিশ্বযুদ্ধ সবই কবি অমিয় চক্রবর্তীর চোখে দেখা। এসবের বাস্তবিক ছবি তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অন্ধকার দিনগুলিতে অমিয় চক্রবর্তী বেদনার্ত হয়েছিলেন। গান্ধীজির পাশে পাশে কলকাতা ও নােয়াখালির উপদ্রুত অঞ্চলগুলি পরিক্রমা করে তিনি বুঝেছিলেন দেশব্যাপী এই মূঢ়তা ও ভ্রাতৃদ্রোহের কোনাে আশু সমাধান নেই। তার ‘সন্দ্বীপ’ ও ‘সত্যাগ্রহ’ কবিতা দুটিতে এই চরম সত্যের বেদনা প্রকাশিত হয়েছে। দুই বিবদমান সম্প্রদায় কেউহার স্বীকার করতে চায়নি বলেই এমন নারকীয় হত্যালীলা। কবি ‘সত্যাগ্রহ’ কবিতায় এমন সংঘর্ষের কথা বলেছেন “পাপের বিরুদ্ধে পাপী হয়ে, হত্যার বদলে হেনে হত্যা-শােক/মাথা নিচু করব না কোটি লােক। ‘পারাপার’ কাব্যগ্রন্থের ‘সাংঘাতিক’ কবিতায় মানুষের হৃদয়হীনতার পৈশাচিক রূপ তুলে ধরেছেন কবি,

“ভাইয়ে ভাইয়ে যে-ভারতী যুগে যুগে রচেন সংসার

অঁরি পুণ্য বঙ্গভূমে নরঘী জাগালাে হাহাকার—

উপদ্রুত অসহায় যত নাগরিক

চরম দুঃসহ দুঃখে হন্যতার সেজেছ সৈনিক,

রুধেছে বর্বর তেজে কৌশলে প্রস্তুত মৃত্যুবাণ—

পৈশাচিক ভ্রাতৃহত্যা, পথে পথে ছড়ালাে শ্বমশান।” (‘সাংঘাতিক’)

সমসাময়িক পৃথিবীর প্রতি অমিয় চক্রবর্তী কোনদিনই উদাসীন ছিলেন না। অথচ মন্বন্তর, দাঙ্গা, বিশ্বযুদ্ধ প্রভৃতি যুগান্তকারী ঘটনা কবিমনকে গভীরভাবেই আলােড়িত করেছিল—

“মানুষের তীব্রাঘাতে তারি কান্না জানে অনুক্ষণ।

জননী যে, ভাই সে যে, বােন গেছে শূন্যে ত্রস্ত চোখ,

সে যে ঐ অগণ্য গ্রাম্য লােক,

বাপ সে যে, পােড়া ভিটে দেখে একা ফিরে দলে দলে কেউ গেছে নিরন্নে ভিড়ে।” (‘সাংঘাতিক’)

এই বেদনার মধ্যেও মানুষের চৈতন্যের প্রতি, মানসিক বীর্যের প্রতি কবি বির্বাস হারাননি—

“সাড়া দাও, মন,

তার তীব্র দুঃখে হও একক চেতনা

বহু হাত এক বাহু হােক তবে বীর্যের উত্তরে

সংকীর্ণ গ্রামের সাঁকো তাই দিয়ে চলাে ঘরে-ঘরে।” (সাংঘাতিক)

প্রকৃত ভারতীয় ও খাঁটি মানবপ্রেমিকের কাছে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা যে রূপে প্রতিভাত হওয়া স্বাভাবিক, অমিয় চক্রবর্তী হুবহু সেই দৃষ্টিভঙ্গীতেই দেখছিলেন দাঙ্গাকে—

“নরমেধ যজ্ঞে ক্রুর শক্তিমত্ত রাষ্ট্রহন্তারক

সহসা ওড়ায় ধ্বজা বিভেদের বিদ্বেষস্মারক,

শান্তির শহর পল্লী ধ্বংস করে ঘৃণ্য শস্ত্রবলে

…সর্বনাশ দিকে-দিকে দিনরাত্রি ফেলে কালাে বাস।” (‘সাংঘাতিক’)

কবিতাটির ‘সাংঘাতিক’ নামকরণ থেকেই বােঝা যায়, দেশব্যাপী নারকীয় কাণ্ডকারখানায় এই মানবপ্রেমিক কবি হঠাৎ বিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। যা দেখেছেন, তাই লিখেছেন। নিছক বর্ণনাতেই কবিতাটি শেষ হয়েছে। এর ফলে চিন্তাজগতে কি প্রতিক্রিয়া হল, সে সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারা যাচ্ছে না। কিন্তু ধ্বংস-হত্যা-হিংসা এ সমস্ত দেখেও অমিয় চক্রবর্তী বলতে পারেন-

“ধ্বংবাহীকে করুক স্থির

প্রাণখড়গ।

গান ধরগাে

‘ঐ কালাে পন্থী কেউ টিকবে না, না না।’…

বর্বরের হাতে দুঃখ পেয়েও, নিভৃত করুণার জিৎ,

প্রত্যহ বীর্যেই ধ্যানের ভিৎ

ইতর ক্রুর কঠিনকে হাে হাে হাসির জোড়ে উড়ােনাে।”

গান্ধী-রবীন্দ্রনাথের চিরন্তন মানবতায় এই কবির বিশ্বাস এতই স্থির যে, হিংসা-বিদ্বেষ দেখে হতচকিত হলেও বিশ্বাসের শক্ত ভিত তার টাল খাবার নয়। মানবতার শত লাঞ্ছনাতেও যিনি শাত বলে একটি ভাব-চিত্তকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারেন, সেই মানুষই গান্ধীজির মৃত্যুতে সৃষ্টি লােপ পাবে না ভেবে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন,

“মহাত্মাজি যদি মারা যান।

আকাশ হবে খান্ খান

পৃথিবী ঘুরবে।”

মানবতার ওপরেও অমিয় চক্রবর্তীর কাছে আর এক ধর্ম রয়েছে, জীবের ধর্ম। মনের আনন্দে বেঁচে থাকাই মানুষের ধর্ম। এখানে। ধর্ম শব্দটি প্রায় ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যে অর্থে বস্তুর ধর্ম বলা হয়, সেই অর্থেই মানুষের ধর্মকে স্বীকার করেছেন অমিয় চক্রবর্তী,

“যৌথ পরিবার বিশ্বে জানি

মহাকাল প্রবাহিত সর্বাস্তির বহে গৃঢ় ধারা

ভাইবােন প্রতিবেশী বৃক্ষচ্ছায়া সূর্যের মুকুরে,

সঞ্জীবিত, মৃত্যুঞ্জয়ী, …

ধর্ম কি খ্রীষ্টান? প্রাণে বাঁচা সে কি হিন্দু? আয়ু বৌদ্ধ ?

নিঃর্বাস-প্রবাস মুসলমানী? রঙ-শিন্টো? জৈন? চৈন?

যে-ধর্ম আমরা জানি সে তাে উৎস, তারি লােকায়ত

কত ধারা উৎকর্ষের কালে কালে প্রবাহ কল্যাণী

নেমে এলাে জনচিত্তে যেখানেই করুণা আধার, মানুষের কোন ধর্ম সৃষ্টি তাে করেনি সৃষ্টিকে।”

সভ্যতার সংস্পর্শে এসে মানুষ আপন আপন পথের দিশারী হিসাবে যে মতবাদগুলিকে পৃথক পৃথকভাবে মেনে নিয়েছে, সেই সব মতবাদই ‘হিন্দু’, ‘খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্ম বলে পরিগণিত হয়েছে। কবি এই সমস্ত পৃথক মতবাদের মধ্য থেকেও প্রয়ােজনীয় আলাে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেন না, কিন্তু মানুষের যে প্রাণের ধর্ম, তাকেই সকলের শ্রেষ্ঠ বলে মানেন-

“… প্রেরণার বহু শিখা জ্বলে।

নেবাে কিছু সে-ধর্মকে,

কিন্তু জানবাে তারও চেয়ে বেশি,

এনেছেন মহাপ্রাণ যে পূণ্যের ধর্ম ধরণীতে।।”

মানুষের এই প্রাণধর্মই অমিয় চক্রবর্তীর কাছে সবচেয়ে মঙ্গলকর। তিনি এই স্বচ্ছন্দ প্রবহমান প্রাণধর্মকে কখনই অস্বীকার করেননি। যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাঙ্গা-মহামারীতে এই ধর্ম ক্ষণিকের জন্য ব্যাহত হলেও তা শাশ্বত, কবি তা মনেপ্রাণে স্বীকার করেন।

আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী মনােভাব ব্রিটিশ কর্তৃপথের সঙ্গে হিংসাশ্রয়ী রূপ নিয়েছিল ১৯৪৫-৪৬ সালে। অভ্যুত্থান ঘটেছিল তিনটি—কলকাতায় ১৯৪৫-এর ২১ নভেম্বর দ্বিতীয়টি ১৯৪৬-এর ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রতিবাদ জানান হয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার রসিদ আলীকে সাত বছর কারাদণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদে, আর তৃতীয়টি ১৯৪৬-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি বােম্বাইতে রয়াল ইন্ডিয়ান নেভির (আর আই এন) মাল্লারা ধর্মঘট করেন। এসব অভ্যুত্থানের ধরণ ছিল প্রায় একই রকমের। প্রথম পর্যায়ে (ছাত্র বা মাল্লাদের মত) একটা গােষ্ঠী ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে অমান্য করলে তাদের উপর দমন-পীড়ন চালান হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে শহরের মানুষ যােগ দিল অভ্যুত্থানে এবং তৃতীয় পর্যায়ে দেশের অন্যান্য অংশের মানুষ তাদের প্রতি জানাল সহানুভূতি।

১৯৪৫-এর ২১ নভেম্বর কলকাতায় বিক্ষোভ মিছিলে যৌথভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কংগ্রেস, কংগ্রেস সােসালিস্ট পার্টি, ফরােয়ার্ড ব্লক ও কমিউনিস্ট পার্টির অনুগামী ছাত্ররা। কংগ্রেস জনগণের মেজাজের প্রশংসা করেছিল, নিন্দা করেছিল সরকারি দমন-পীড়নের। তবে সরকারিভাবে তারা এসব সংগ্রামকে সমর্থন করেনি। কেননা কংগ্রেস মনে করেছিল, এগুলাের কৌশল ভুল এবং সংগ্রাম শুরু করাও হয়েছে ভুল সময়ে। কংগ্রেস নেতাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সরকার এসব সংগ্রাম দমন করতে। পারেন এবং তা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বােম্বাইতে দমন-পীড়ন চালানাের জন্যে ব্রিটিশরা যে শক্তি সমাবেশ ঘটিয়েছিল, তা দেখে বল্লভভাই প্যাটেল মাল্লাদের আত্মসমর্পণ করতে বলেছিলেন। ১৯৪৬-এর ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি নেহেরুকে লিখলেন ‘নৌ-বাহিনী ও সেনাবাহিনীর বিপুল শক্তি সমাবেশ এখানে করা হয়েছে। তা এত প্রবল যে, মাল্লারা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সেরকম ঘটনা ঘটানাের হুমকিও দেওয়া হয়েছে তাদের।

করাচিতে নৌ-বিদ্রোহের সময় কমিউনিস্ট ও কংগ্রেসীদের শান্তি-গাড়িগুলাে টহল দিয়েছে গােটা শহর জুড়ে। সমর সেন তাঁর কবিতায় লিখলেন –

“বােম্বাইতে দিন রেখে গেল বারুদের গন্ধ

রাস্তার রক্তের ছিটে বন্দুকের খাড়া শব্দ থামলে শহরে,

বিপ্লবী নেতারা

জমে বক্তৃতার মাঠে।

সর্দারের ধমকে পার্কের রেলিং কঁপে

হয়তাে কৃত পাপে লজ্জা লাগে

মর্গে জমা দু’শাে সত্তরটা লাশ।

ধােকায় জব্দ জাহাজেরা বন্দরে স্তব্ধ,

মাঝে মাঝে উদয়াত সঙ্গীন,

সাম্রাজ্যের উদ্ধত প্রতীক।

আমাদের স্বাধীনতা আসন্ন প্রায়

মন্ত্রী সভার বিলেতি দূতেরা আগত প্রায়,

জয় হিন্দ!”

সমর সেন কলকাতায় দেখেছেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব, অগণিত মানুষের মিছিল। তিনি বেদনার্ত হৃদয়ে কবিতার পংক্তিতে এঁকেছেন দাঙ্গা-বিধ্বস্ত ভারতবর্ষের মারণ-ছবি-

“বাঙলার বিহারে গড় মুক্তেরে

বিকলাঙ্গ লাশ কঁাধে

লােক চলে গােরস্থানে

কিম্বা পােড়াবার ঘাটে।

মৃত্যু হয়তাে মিতালি আনে

ভবলীলা সাঙ্গ হলে সবাই সমান—

বিহারের হিন্দু আর নােয়াখালির মুসলমান

নােয়াখালির হিন্দু আর বিহারের মুসলমান।”

১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখােমুখি হয়েও কবি সমর সেন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্য-অটুট রাখার কথা বলেন মানবিক মূল্যবােধের কথা মনে রেখে। তিনি বুঝেছিলেন মুষ্টিমেয় কতকগুলি মানুষের বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে সমগ্র মানবজাতির সর্বনাশ ডেকে আনা, বিশেষ করে ভারতবর্ষ নামক একটি অনুন্নত দেশে। কেননা, ভারতবর্ষের মুসলমান সম্প্রদায় একটি বৃহৎ সম্প্রদায়। তাই সাম্প্রদায়িক ঐক্য গড়ে তুলতে নিজের মানবিক বিশ্বাসকে তিনি তুলেন ধরেন ‘লােকের হাটে’ কবিতাটির পঞ্চম ভাগে—

“আশ্বিনের সােনালী রােদুর

সঞ্জীবনী আশীর্বাদ

বর্ষার স্তব্ধ ক্লান্তি ঝেড়ে

গাছেরা গাঢ় রঙ ধরে।

রমজানের শেষ দিন আজ

উৎসবের আগে যেন মনে রাখি

আমার মতাে সাধারণ লােক

আজ দেশে দেশে

মুষ্টিবদ্ধ প্রতিজ্ঞায়, আত্মদানে, আপনজনের ক্ষয়ে

জীবনের বনিয়াদ গড়ে।

যেন মনে রাখি

চল্লিশ কোটি আমরা, বিরাট এ দেশ,

এখানে নােকরশাহীর হবে শেষ

যদি রাজে রাম ও রহিমের কণ্ঠে আসমুদ্র হিমাচল গান

স্বাধীন হিন্দুস্থানে আজাদ পাকিস্তান।”

কিশাের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যও ব্যথিত চিত্তে ‘সেপ্টেম্বর ৪৬’ কবিতায় দাঙ্গাপীড়িত কলকাতার ভয়াবহ ইতিহাসের বিস্মৃতি প্রার্থনা করেছেন। তিনি দেখেছেন এক জাতির সঙ্গে আর এক জাতির মারমুখী লড়াই। শহর ছটপট করে সারারাত। সারি সারি বাড়িগুলি যেন কবরের মতাে দাঁড়িয়ে। মৃত মানুষের স্তুপ নিয়ে এ শহর যেন হানাবাড়ি। দিকে দিকে শুধু মানুষের মিছিলের হুঙ্কার। এ কলকাতা তার কাছে প্রার্থিত ছিল না, জাতীয় সত্তার বিসর্জন দিয়ে দ্বি-জাতিতত্বের নামে জাতি হত্যাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনি দেখেছেন—

“কলকাতায় শান্তি নেই রক্তের কলঙ্ক ডাকে মধ্যরাতে

প্রতিটি সন্ধ্যায়।”

অরুণ মিত্র
চিত্রঃ সুকান্ত ভট্টাচার্য, Image Source: thedailynewnation

সুকান্ত ভট্টাচার্য ভেবেছিলেন শ্রমজীবী মানুষের রুটি-রুজির ঐক্যবদ্ধ লড়াই আবার মানুষের মন থেকে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি দূর করে প্রকৃত অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে তাদের শামিল করবে। সুকান্ত হাসপাতালে ঐতিহাসিক শ্রমিক সংহতি ও ডাক, তার ধর্মঘটকে (জুলাই ৪৬) পুনর্বার স্মরণ করে রােগশয্যায় থেকে লিখেছিলেন—

“জুলাই! জুলাই! আবার আসুক ফিরে

আজকের কলকাতার এ প্রার্থনা,

দিকে দিকে শুধু মিছিলের কোলাহল

এখনাে পায়ের শব্দ যাচ্ছে শােনা।

অক্টোবরকে জুলাই হতেই হবে

আবার সবাই দাঁড়াব সবার পাশে,

আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাস

এবারের মতাে মুছে যাক ইতিহাসে।”

কবি হাতাশাগ্রস্ত, বিপন্ন বাংলার জীবনে হয়তাে আর জুটবে না প্রার্থিত স্বাধীনতা। ক্রমান্বয়ে রচিত হচ্ছে বিশৃঙ্খল অনৈক্য। ১৯৪৩-এ মৃত্যুকীর্ণ শবে ভরলাে বাংলা, আবার ১৯৪৬-এ তৈরি হল অগণিত মৃত্যুর স্তুপ। কবি বিষগ্ন হৃদয়ে নৈরাশ্যের কথা ব্যক্ত করেছেন ‘ঐতিহাসিক’ কবিতায়। হিন্দু-মুসলমানের লড়াই করার ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। তিনি আশাহত চিত্তে বলেছেন,

“একটি মাত্র লক্ষ্যের মুখােমুখি দাঁড়িয়ে

মারামারি করেছ পরস্পর

তােমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে

বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাপ।”

অথচ তিনি দেখেছেন পঞ্চাশের মন্বন্তরে যখন পেটে পড়েছিল টান, তখন কি ইতর, কি ভদ্র, কি হিন্দু, কি মুসলমান, সবাই একই জন্মভূমি মায়ের জল-হাওয়ায় বাঁচার রসদ খুঁজেছিল। কবি মনে করিয়ে দিয়েছেন সেই ইতিহাসের কথা-

“ক্ষুধার ক্ষমাহীন তাড়নায়

পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি সবাই দাঁড়ালে একই লাইনে

ইতর-ভদ্র, হিন্দু আর মুসলমান

একই বাতাসে নিলে নিঃস।”

সুকান্তের চোখে ছিল এক স্বপ্ন—শােষণহীন সুখী শান্তিপূর্ণ এক সমাজ। কারণ তিনি প্রত্যক্ষ্য অনুভব করেছিলেন বির্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদ আর স্বদেশের দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, কালােবাজারি, সবই একসূত্রে গ্রথিত। এদের বিরুদ্ধে ছিল সমাজতন্ত্রের শােষণহীন মুক্ত দুনিয়ার কারিগর সর্বহারা মানুষ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই সমাজতান্ত্রিক শােষণমুক্ত মানুষেরই জয়যাত্রা ঘােষিত হয়েছিল।

এখানেই সুকান্তের বৈশিষ্ট্য। শােষণ-নির্ভীক অর্থনীতির নিয়ত ছলাকলায় যারা গবীর ও মজুরের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে, তাদের বিদ্ধেই সুকান্তের বিদ্রোহ। গল্প, নাটক, কবিতা, ছড়ায় সেই বিদ্রোহ সুকান্ত ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন কিশােরদের মনে। অপার কৌতূহলী কিশাের চিত্তকে বিদ্রোহী করার জন্য জীবনের পথ এবং পথিক সম্পর্কে সুকান্ত নানাপ্রতুলে কিশাের দলকে আকৃষ্ট করে তুলে বাস্তবমুখী করে তুলেছেন। চাঁদ, পাখি আর আকাশের হাতছানি দিয়ে সেই মনকে সুকান্ত পলায়নী করে তুলতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন জীবনের কঠোর কঠিন সত্যকে তুলে ধরতে। সেজন্য প্রথমে এনেছেন প্রণ, তারপর তার উত্তরে কিছু বিদ্রোহী ঘটনা।

১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড এবং ১৯৪৭-এর খণ্ডিত স্বাধীনতা কবি দিনেশ দাসকে গভীরভাবে বিচলিত করেছিল। কিন্তু কবিরা আশাবাদী, স্বাপ্নিক, নবযুগের বার্তাবাহক, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মগ্ন। তাই কবি দীনেশ দাস পৈশাচিক মারণলীলার মধ্যেও মানবতার জয় প্রত্যাশা করেছেন, রচনা করতে চেয়েছেন ক্ষমার অনলে শুদ্ধ এক স্বপ্নের জগৎ-

“যখন অন্তিম গুলি হৃদপিণ্ডে বিঁধেছে সজোরে।

খুনীর নিকট হতে পৃথিবীর কাছ হতে অনন্ত নিখিলে

ক্ষমা চেয়ে নিলে।”

১৯৪৭-এর গােড়ার দিকে যখন দাঙ্গা পরিস্থিতি আরাে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন একদিকে ওয়াভেলের দেশে প্রত্যাবর্তন, অন্যদিকে ২২শে মার্চ লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বড়লাটরূপে যােগদানের ঘটনা আরাে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রত্যাশামত ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট দেশভাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আসে। কবি দীনেশ দাস মেনে নিতে পারেননি এমন হৃদয়বিদারক সিদ্ধান্ত। চোখের জলে অনুভব করেছেন মাতৃহৃদয় টুকরাে করার অসহনীয় যন্ত্রণা। তিনি বেদনায় অধীর হয়েছেন এই ভেবে যে, আর পদ্মার জলের স্পর্শ ও মেঘনার ডাক শােনা যাবে না। যেন শুকনাে পাতার মতাে উড়ে এল স্বাধীনতার সংবাদ। বুক ভরা বেদনা নিয়ে তিনি মাতা-পিতার বিচ্ছিন্ন হওয়া চিত্রে আঁকলেন খণ্ডিত স্বাধীনতার ব্যঞ্জনা-

“তবু এল স্বাধীনতা দিন উজ্জ্বল রঙিন।

প্রাণের অবেগে অস্থির

ডাক দেয় মাতা পদ্মা, পিতা সিন্ধু-তীর।”

সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শােষণে ভারতবর্ষের অবস্থা তখন মুমূর্ষ। হিটলার এবং মুসােলিনীর ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের ভয়ে পুরাে বিশ্ব অস্থির। ভারতে ফ্যাসিবাদ বিরােধী সংগঠন গড়ে উঠেছে। ১৯৩৯ সালে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানের চীন আক্রমণের প্রস্তুতি চলছে। জাপানি বােমার ভয়ে কম্পমান ভারত তথা কলকাতা শহর। কবির ভাষায়—

“কত বিষবাষ্পের সম্ভার

অগণিত বিস্ফোরণ

থেমে আসে পুরাতন এশিয়ার হৃদয়স্পন্দন

নিথর শীতের রাত্রি কাপে বারবার

প্রশান্ত সমুদ্রে ভাসে অশান্ত জাপান।”

দ্বিতীয় বিধাযুদ্ধের সময় বির্বব্যাপী যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তার আতঙ্ক, হতাশা, অমঙ্গলের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। উপযুক্ত উদ্ধৃতিতে। সাম্রাজ্যবাদবিরােধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এই পর্যায়ে গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯৪২ সালে শুরু হয় ভারত ছাড় আন্দোলন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হিটলার কর্তৃক রাশিয়া আক্রান্ত হলে নিষিদ্ধ ঘােষিত ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি এটিকে ‘জনযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্রিটিশকে মিত্র শক্তি হিসেবে সমর্থন দেয়। সাম্রাজ্যবাদী পন্থায় আকৃষ্ট তরুণেরা অনেকেই ধাক্কা খেলেন। বামপন্থী দলের ইংরেজ শাসকের পক্ষে সমর্থন তাদের আহত করলাে, বিভ্রান্ত করলাে। দিনেশ দাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ছিল আরাে গভীর। তিনি খুব বিচলিত হলেন এবং আবেগময় দেশপ্রেমে গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ভারত ছাড় ১৯৪২’, ‘শেষ ক্ষমা’ ‘স্বর্ণভস্ম’ ‘পুনর্জন্ম’, ‘গান্ধীজীর জন্মদিন’ ইত্যাদি কবিতা রচনা করেন। তবে রাজনৈতিক দলের মতের সঙ্গে তিনি নিজের মতামত মেলাতে চেষ্টা করেননি।

কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তও এই সময় লেখনী না ধরে পারেননি, হালকা ছন্দে, সহজ সরল ভাষায় চল্লিশের উত্তাল তরঙ্গে পিষ্ট জীবনের বেদনার, নৈরাশ্যের ছবি স্বাভাবিক হৃদয়াবেগে কবিতার অবয়বে ব্যঞ্জিত করলেন। এখানে তিনিও আশা-আকাঙ্খয় লিখলেন ‘তিমির হননের গান’ কবিতা

“সবাই আমরা দেশবাসী মারণমন্ত্রে উপবাসী।

আড়ালে শঠের হাসাহাসি,

মরিনি তাে তবু দেশবাসী।”

এই সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রবল সক্রিয়তায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ সৃষ্টির প্রয়াস চলছিল। কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় ছিলেন পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী, কর্ম প্রবাহই তাঁর দিনলিপি। কবিতার পাশাপাশি, আমার বাংলা গদ্য রচনাটিতে তুলে ধরেছেন ১৯৪৬-এর বিভীষিকাময় কলকাতার বিপন্ন চিত্র। আমাদের দেশে রাজনীতির মারপ্যাচে ধর্ম নিয়ে হচ্ছে দাঙ্গা। কবি চান এসব ত্যাগ করে সবাই চীৎকার করে বলুক—

“মানুষ আমার ভাই,

বন্ধ করাে ভ্রাতৃযুদ্ধ,

যেন কেউ মানুষ মারে না—

ঘরে না বাইরে না।”

কবি হত্যা চান না, দ্বন্দ্ব নয়, যুদ্ধ নয়, এ বিপ্ন হয়ে উঠুক ভালােবাসার মর্মর ভূমি। নিজের দেশকে ছাপিয়ে সমগ্র বিধের একজন হয়ে কবি বির্বজনীনতাকে ধরতে চেয়েছেন। ব্যক্তি গত মণীষায় জাতীয় মানসকে ফুটিয়ে তােলাই কবি-জীবনের পরম সাফল্য। কবি এখানে সেই সার্থকতায় উত্তীর্ণ। ‘বদলাচ্ছে দিন’ কবিতায় কবির বিশ্বাস যেন নতুন মাটি পেয়েছে। একসময় কবির মনে হয়েছিল বিনা বাধায় সমাজতন্ত্র পৃথিবীতে অধিকার কায়েম করবে। আজই সেই বােধে তাঁর উত্তরণ ঘটেছে। অবশ্য অনেক বাধা বিপত্তি তিনি পেরিয়ে এসেছেন। তিনি সবসময় প্রত্যয়ী। আজ তাঁর আশা ও প্রত্যয় গভীরতা লাভ করেছে—

“দুনিয়া ছিল কাল যেখানে,

আজ আর নেই—সেখানে নেই।”

নিষ্ঠুর স্মৃতিতে ভেসে গেছে রত্তের স্রোত। কিন্তু ‘খুলে যাচ্ছে দরজা জানালা/বন্ধ কপাট’ এবং সবার জন্যে রইল শুভেচ্ছা আর সম্প্রীতির ডাক। দূর পরিক্রমায় তিনি নিজেকে পাল্টেছেন, পাল্টাবার চেষ্টা করেছেন সমাজকে। স্থির বিশ্বাস তিনি বলেছেন—

“সবার ওপর আজ সত্য।

মনুষ্যত্ব।”

মনুষ্যত্বের জয়গান ধ্বনিত হবেই—এই আশা করে কবি লিখেছেন, ‘অনেকের গান’ কবিতাটি। নিরন্তর হতাশা ও নৈরাশ্যের মাঝে তিনি লক্ষ্য করেছেন,

‘পুব আকাশে রং ধরেছে

আলাে আসে, আঁধার যায়।’

এই আলােকিত প্রত্যাশায় স্বপ্নে আবিষ্ট মানবপ্রেমিক নিষ্কম্প কণ্ঠে ডাক দিয়েছেন—

“জাগাে, জাগাে, দেখ মা গাে

কলের মজুর ক্ষেতের কিষাণ

শিকল ভাঙে, ওড়ায় নিশান

জগৎ জুড়ে নতুন বিধান

কোটি কণ্ঠে জীবনের গান গায়।”

এখানে মানবপ্রেম মনুষত্বের মহিমায় মহিমান্বিত হয়েছে। কবি সুভাষ চেয়েছেন এমন এক মধুময় সমাজ গড়তে যেখানে সবাই সমান, সকলের সঙ্গে সকলের থাকবে মানবিক প্রেম ও সহানুভূতি। কবির সকাতর আবেদ—

“যেখানে হয় সবাই সমান

সবার জন্য সকলের টান

সেখানে হাত আপনি বাড়ান

আল্লা-হরি মারাংবুরু।”

মুসলমানের আল্লা, হিন্দুদের হরি-র সঙ্গে কবি মিলিয়ে দিয়েছেন আদিবাসী-জনের অধিদেবতা মারাংবুরুকে। কোনাে ভেদাভেদ নয়, আমরা সবাই মনুষ্যত্বে প্রতিষ্ঠিত সহৃদয় মানব। এই মানবিকতাবােধের জয় প্রতিষ্ঠা কবি মানসের অন্তিম ঈপ্সা।

‘সপ্তাহ’ পত্রিকা (বর্ষ ৩৬, সংখ্যা ৩৮-৪০, ৮ আগষ্ট ২০০৩) থেকে পাই, কবির শেষ জীবনের লেখা এক অনন্যসাধারণ কবিতা ‘দেয়ালে লেখার জন্যে’। বলা বাহুল্য এই নামে তিনি অনেকবার কবিতার নামকরণ করেছেন। আসলে তার প্রতিবাদকে বারে বারে লটকে দিতে চেয়েছেন দেওয়ালে। ২০০২ খ্রীস্টাব্দে গুজরাটে যে ভয়ংকর গণহত্যালীলা চলেছিল তার বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন। যৌবনের পদাতিকের তির্যকভঙ্গি আবার স্ব-মহিমায় প্রােজ্জ্বল। কবি-স্বভাবের উজ্জ্বল প্রতিমা এই কবিতাটি। যদিও এটি কোনাে গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তথাপি এর গুরুত্ব অপরিসীম। কবি সুভাষ মােদি সরকারের প্রতি বিদ্রুপ করেছেন, ব্যঙ্গ বাণে বিদ্ধ করেছেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের—

“এই যদি আসল চেহারা

রাষ্ট্রীয় হিন্দুত্বর

হেঁকে বলি পাজির পা ঝাড়া

যমে নিক তােকে, ধুত্তোর

সমানে গুঁতােয় ধর্মের ষাঁড়ে

ত্রাহিরব জাতি সত্ত্বায়

মহাভারতকে তুলে নিয়ে ঘাড়ে

হাঁকে ‘রাম নাম সত হ্যায়’।”

জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে এমন কবিতা যিনি নির্মাণ করেন, বলা যায় কি তার বিধাস ভঙ্গ ঘটেছে? তিনি যেখানেই গেছেন পথ হেঁটেছেন, সর্বত্র তাঁর আদর্শ, মানবধর্ম উজ্জ্বল আভায় প্রতিভাত হয়েছে। ক্লান্তি, বিষাদ, হতাশা তাকে আচ্ছন্ন করলেও কখনাে পরাস্ত করতে পারেনি। নিজস্ব ভঙ্গিতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন মনুষ্যত্বকে। আসলে কবি সুভাষ রাজনীতিকে ছাপিয়ে হয়েছেন মানবতাবাদী। অনেক মানুষ মুখে মানবতার বুলি আওড়ালেও ব্যক্তি জীবনে অনেকটা আত্মকেন্দ্রিক এবং সংকীর্ণচেতা থাকেন। কিন্তু কবি সুভাষ ব্যক্তি জীবনেও এই মানবতার পরিচয় রেখেছেন। তিনি নিঃসন্তান হলেও তিনটি কন্যা সন্তানকে নিজের ঔরসজাত সন্তানের মতাে লালন করেছেন, তাদের সামাজিক জীবনে বিবাহ দিয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বাৎসল্য ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।

মানব প্রেম ও মানবধর্ম প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভাের কবি সুভাষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রচনায়ও সচেতন ছিলেন। একাকার’ কবিতায় তাই বলেছেন—

“তােমার পানি আর আমার জল

জীবনের জন্যে

এক সঙ্গে একাকারে ভরে নিই।”

কবি সুভাষ যে রিক্ত, নিঃস্ব, দুর্বল পীড়িত মানুষের জন্যে কবিতা লেখেন—এই জীবনধর্ম পরম মমতায় প্রকাশিত হয়েছে ‘সেও ঠিক এমনি বৃষ্টি’ কবিতায়—

‘যার কথা বলব ব’লে এ কবিতা লেখা

তিনি কিন্তু এতক্ষণ একা

এককোণে

ফুটো ছাদ

উনুন নেভানাে।

শিকেয় মাটির হাঁড়ি কুঁড়িগুলাে খালি পেটে কেবলি দোল খায়

চাল বাড়ন্ত, কাছে পিঠে থাকে বেশ ক যজমানও।

উঠুক রােদুর।”

বিবের স্বপ্নে, প্রতিবাদ-প্রতিরােধে কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায়ই লিখতে পারেন—

“আমি আসছি—দু-হাতে অন্ধকার ঠেলে আমি আসছি

সঙ্গিন উদ্যত করেছে কে সরাও

বাধার দেওয়াল তুলেছে কে? ভাঙো

সমস্ত পৃথিবী জুড়ে আমি আসছি

দুরন্ত দুর্নিবার শান্তি।”

বিপ্লবী সেই কবিই জীবন-সায়াহ্নে মানবতার বিপর্যয়ে—বাবরি মসজিদ ধ্বংসে প্রতিবাদে সােচ্চার হন, তীব্র ব্যঙ্গ আর নিষ্করুণ ঘৃণায় লেখেন, ‘রাম নাম সত্ হ্যায়’ কবিতা,—

“মা লিখ সত্যং বদ

এঁটে নিয়ে মতলব

ভক্তিতে গদগদ

গদিতে বিরাট লােভ।

আওড়িয়ে ‘ত্যাক্তেন ভুঞ্জীথা

মসজিদ ভেঙে চায় মন্দির

চেক কাটা ভেক কেন বৃথা

ব্যাটা আছে শতপথ ফন্দির।

পুরােহিত সেজে আজ চটকায় পিণ্ডি –

রথ চড়ে, চোঙা ফোকে মতি নেই ধর্মেও

দেশটা ডুবিয়ে খায় বর্সির শিন্নি।…”

‘আরে ছাে’ কবিতায় কবি মনুষ্যত্ব হারিয়ে যাওয়ার বেদনাকে কাব্যময় করেছেন। কবি চন্ডীদাস বলেছিলেন—

“শুনহ মানুষ সত্য/ সবার উপরে।” কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন মনুষ্যত্বহীন মানুষদের পাশবরূপ— “দাঁড়াও, এখুনি পড়বে/এ রাস্তায় আরও একটা লাশ। ‘খুনে-মানুষদের রাজনীতিতে আবৃত এ বাংলা’। এমন ভূমিকার জন্য তারা অনুতপ্ত তাে নয় বরং ‘ফেটে পড়বে জয়গর্বে/উন্মত্ত জয়ােল্লাস’-এ, অথচ তাদের মুখে।

“জয়হিন্দু, জিন্দাবাদ যুগযুগজীও বন্দেমাতরম,

আর আল্লা হাে আকবর।”

এখানে কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় ‘শুনহ মানুষ সত্য’ কবি-কথিত কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে মনুষ্যত্বহীনতাকে কটাক্ষ করেছেন। তিনি যেন পরােক্ষ বলতে চেয়েছেন, এখন চাই মনুষ্যত্ব।

কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায়ের ভাবশিষ্য মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ও কালের আঘাতে বেদনাবিদ্ধ হয়েছিলেন। তিনিও কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে কৃষক-শ্রমিকের নানা অনুষঙ্গ উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়, উঠে এসেছে। কৃষক-শ্রমিকের জীবন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ। কিশােরদের জন্য তাঁর লেখা, ‘ঘুম তাড়ানির ছড়া’ (১৯৪৭), ‘তেলেঙ্গানা ও অন্যান্য কবিতা’ (১৯৪৮) এবং ‘মেঘবৃষ্টি’ (১৯৫১)। ‘ঘুমতাড়ানি ছড়া’ সংকলনের পাঁচটি কবিতাতেই মঙ্গলাচরণকে প্রথম পাওয়া গেল সংগ্রাম ও সাম্যবাদী ভাবাদর্শের কবিরূপে। তেভাগার অভিজ্ঞতাকে রূপ দিলেন তিনি, সাম্প্রদায়িকতাবিরােধী আদর্শকে স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করলেন তিনি, সাধারণ মানুষের জীবনের গল্পকে করে তুললেন কবিতার বিষয়। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, সংকট, সমস্যা মঙ্গলাচরণের কবিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে রূপায়িত হতে থাকে। কবিতার ছন্দ ও বাক্‌প্রতিমার নতুনত্ব, অভিজ্ঞতার দ্বিধাহীন প্রকাশ মঙ্গলাচরণকে অল্পদিনের মধ্যে সাম্যবাদী চেতনার কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলল।

ভয়াবহ দাঙ্গা যখন আঘাত করছে বাংলাকে, কমিউনিস্ট সদস্যরা তখন প্রাণপণে দাঙ্গা প্রতিরােধ করার চেষ্টায় মগ্ন। কবি মঙ্গলাচরণও এই কাজে ব্রতী ছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রচনাতে তিনি ছিলেন আন্তরিক। তার ‘ঘুম তাড়ানির ছড়া কবিতার পংক্তিতে ফুটে উঠল রাম-রহিমের মিলন চিত্র—

“আমরা ধান কাটার গান গাই।

আমরা লােহাপেটার গান গাই।….

আমরা রাম-রহিম সর্দার,

সারছি যার যা কাজ কারবার—

এমনি দিন ভাের।

হয়তাে সাঁঝবেলায় তারপর

জমছে আটচালায় মজলিশ,

কিংবা চুপচাপ ভাবছি বীজবােনার দিনকাল,

ভাবছি কারখানার রােশনাই আজ তাে ঝলঝল।

আমরা তাঁত চালাই, গান গাই।

আমার প্রাণ বাঁচাই বাঁচবার চেষ্টা করবই

ভাঙব এই শিকল গাঁয়ে গাঁয়ে, গড়ব নয় শহর।”

বিভিন্ন পেশার আর ধর্মের মানুষের কর্মমুখর দিন এবং স্পন্দিত জীবন এখানে উঠে এসেছে চমৎকারভাবে। ধানকাটা, ‘লােহাপেটার গানের মধ্যে যে প্রবহমান সুর সেখানে জাতপাত কিংবা ধর্মের কোনাে পার্থক্য নেই। ‘রাম-রহিম’ শব্দটি অসাম্প্রদায়িক, শ্রমজীবী মানুষের একাকার হয়ে যাওয়ার ইমেজ ধারণ করে আছে। শুধু তাই নয়, যখন শ্রমিক নিজের মুখে বলছে ‘আমরা’, তখন ধর্মবর্ণহীণ শ্রেণিচেতনার বিষয়টি উচ্চারিত হয়েছে। এই কবিতার শেষ পংক্তিতে কবি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রচনা করে দাঙ্গার অবসান ঘটাতে চেয়েছেন—

“..বাঁচবার চেষ্টা করবই।

কখন বােম্বাইয়ের পথঘাট,

কখন কলকাতার ময়দান রক্তে থই থই—

আজকের জোর কদম—

চল চল, অমনি হাত মেলাই ভাই-ভাই …।”

মঙ্গলাচরণের মতাে কবিরা বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামে চারণ কবির উত্তরীয় অর্জন করতে চেয়েছেন, যাঁরা রাম-রহিম সর্দারদের ধান কাটার গানে, লােহা পেটার গানে, তাঁত চালানাের গানের সারিতে দেখেছেন, দেখেছেন কঁাধে কাঁধ মিলিয়ে মিছিলে ও ময়দানে শয়তান দুশমন রুখতে, তাদের কাছে দাঙ্গা ও দেশভাগ শ্রেণিসংগ্রামের উপর দুঃসহ আঘাত। কলকাতার ময়দানে থই থই রক্তের বিনিময়ে হলেও সেই ‘বাঁচার মন্ত্র উচ্চারিত হয়, দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ঘােষিত হয়। এভাবে সাম্যবাদী-চেতনা রূপায়িত হয়েছে মঙ্গলাচরণের কবিতায়—

“সেই কবে দুই ভাই এই দেশে ঘর বেঁধে গড়লাম

মাঠভরা ধানসােনা-স্বপ্নের নবান্ন দূর গাঁয়ে

ভরলাম পাতাঝরা ঘরজ্বালা আকাশের ঘুরপথে

একসাথে চলে-চলে টলে-পড়া মন তবু আশাতেই

ফের পাশাপাশি ঘরে ভুলভাঙ্গার মন ঘরে তুললাম।

…তারপর কোথেকে দুশমন ফুসমন্তরে তার

লা-লা-ভাইভাই ঠাই ঠাঁই করে দিল তারপর।

লা- লা লেগে গেল-ভাইয়ে ভাইয়ে বেইমানি তারপর

ভাই তবু দুশমন হয় কি?

এ রক্তসমুদ্র পার হয়ে ঘরপােড়া-মম তাই বুক বাঁধে, চোখে জল।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ভারত বিভাগ—চল্লিশের দশকে এসব যুগচঞ্চল ঘটনা অনিবার্যভাবে ছায়া ফেলেছে সেই সময়ের প্রত্যেকটি কবির মন-মানসে। মঙ্গলাচরণের কবিতায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। উদ্ধৃত কবিতায় চল্লিশের সবচেয়ে ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। সেই কবে থেকে এই দেশে ‘হিন্দু-মুসলান দুই ভাই’ পাশাপাশি নবান্নের স্বপ্ন নিয়ে ‘দূর গাঁয়ে ঘর বেঁধেছিল। তারপর পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমান চলেছে অনেক বছর। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ দুশমন’ আমাদের মধ্যে ভেদচিহ্নের দেয়াল তুলে দেয়। ‘ভাই ভাই ঠাই ঠাই’ করে দিল আমাদের। পৃথক হলেও ভাই কি কখনাে ‘দুশমন হয়? অবশ্যই নয়। কিন্তু তা-ই হলাে, রত্তের সমুদ্র বয়ে গেল বাংলার মাটিতে। রক্ত-বন্যা যে কান্না তৈরি করলাে, সেই কান্নার মাধ্যমে বুঝতে পারলাে দুই ভাই আসল ‘পান্না। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শান্তি। মূল্যবান সম্পদ পান্না। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা সে সময় সাম্প্রদায়িক শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কান্নার বিন্দুকে ‘পান্না’ হিসেবে অভিহিত করেছেন কবি মঙ্গলাচরণ এবং এই পান্নার ওপর আলাে পড়লে বজ্রবিদ্যুতের মতাে চোখে ঠিকরে উঠবে সত্যের ঝলসানি-লাগা আলাে। সেই সময়ে সাম্যবাদী আন্দোলনের এক প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মঙ্গলাচরণ সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বিষয়টিকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কবিতায় রূপায়িত করেন এভাবে—

“এই বাংলাদেশ। এর স্বপ্ন শেষ।

এর প্রাণ জ্বালায় সব পঙ্গপাল।

ভাই ধান সামাল। ভাই মান সামাল

ঘুম আসছে না। ঘুম আসছে না।

ঘুমা তাই পালায়।”

এই বাংলাদেশের সমস্ত স্বপ্ন যেন শেষ হয়ে গেছে। মন্বন্তর এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপন্ন স্বদেশের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে মঙ্গলাচরণ গভীর হতাশায় বলছেন যেন সব শেষ। তাই ‘প্রাণ’ জ্বলে, পঙ্গপালের মতাে মানুষগুলাে যেন উদভ্রান্ত হয়ে গেছে, ‘ধান’ এবং ‘মান’ সামলানাের জন্য সতর্ক করে দিচ্ছেন কবি। ভয়ে-আতঙ্কে ‘ঘুম’ হারিয়ে গেছে চোখে, ‘ঘুম’ আসছেনা, ‘ঘুম’ যেন পালিয়ে গেছে। তাই গ্রন্থের শিরােনাম দেয়া হয় ‘ঘুমতাড়ানীর ছড়া’।

রবীন্দ্রনাথ-গান্ধীর আলােক উত্তরাধিকার থেকে পাওয়া মনুষত্বের অহংকারেই আমরা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি দুঃসাহসী প্রটো করতে পারি—‘কাদের এত অহংকার, সমস্ত আকাশটাকেই অন্ধকারে ঢেকে দেয়। দাঙ্গার এই ভয়ংকর প্রভাব থেকে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নিজেকে বিচ্যুত রাখতে পারেননি। তিনি কখনাে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না। তথাপি একজন মানবতাবাদী হয়ে কখনাে কখনাে সাম্প্রদায়িকতাবিরােধী মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন। রাজনৈতিক তত্ত্ব কখনােই তার মনে তেমন দাগ কাটতে পারেনি, কিন্তু তার মননে ছিল স্বদেশ ও মানুষ। পীড়িত মানুষের পক্ষে তার কলম বারে বারে গর্জে উঠেছে। প্রবল দাঙ্গার সময়ে তিনি জন্ম কবিতায় বিম্বিত করলেন কল্লোলিনী কলকাতার রক্তক্ষয়ের যন্ত্রণার ছবি, রক্ত মেঘে ঢাকা পড়া শতাব্দীর সূর্যের ছবি—

“মেঘে মেঘে রক্ত ঝরে, রক্ত ঝরে মাটিতে।

হাওয়ায় হাওয়ার মতাে হৃদয়ের ভাবনাগুলিতে রক্ত ঝরে।”

বিশ শতকের ভারতবর্ষের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসে বিভাজন ও দাঙ্গায় ‘রক্তের দাগ’ নতুন নয়, নতুন নয় শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যকে নস্যাৎ করার এই অভ্রান্ত ব্রহ্মাস্ত্র। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তাে এই অবিশ্বাসী-আঁধার ছাওয়া স্বদেশ দেখেছেন—

“কোথাও জানালা নেই

দরজার কথা ভাবা অসম্ভব,

কেন না বাতাস ঢুকলে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান হতে হবে।

কেন না ঘরের মধ্যে, ঘরের বাইরে

অন্তহীন দ্বেষের আগুন।”

রাজনৈতিক দাবাচালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত হল ভারত। অস্বীকার করবার উপায় নেই, বিশ শতকের তৃতীয় দশকের পূর্ব পর্যন্ত স্বাধীনতার স্বরূপ সম্পর্কে বা শ্রেণি চেতনা সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেসের কোন সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। মনে রাখতে হবে, শ্রেণি স্বার্থের চেতনাই সাম্প্রদায়িকতাকে পরাস্ত করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

অমিতাভ দাশগুপ্ত সমসাময়িক ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ২০০২ সালের গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কবি ব্যথিত হন। এই অমানবিক, বর্বরতার বিরুদ্ধে কবি ধিক্কারে সােচ্চার হয়েছেন—

“কন্টিকারি ছেয়েছে পথ,

দুর্ভে চেরা ঠোটে পাবে না তুমি

পাবে না কোনও তিমির বিনাশী গান,

বারুদে ঠাসা রিরংসার ছােবল ফুঁসে ওঠে,

হননমে জ্বালিয়ে শুধু সাপেরা যুযুধান।”

(হনন মেরু পেরিয়ে)

অন্যত্র, অন্যভাবে অমিতাভ দাশগুপ্ত বলেছেন যে, রাম তাে এদেশের মানুষকে ভালােভাবে রাখবার জন্য সুখ-সােয়াস্তির ব্যবস্থা করেছেন। কৃষিনির্ভর ভারতবর্ষে এখন বড়াে কলকারখানায় চিমনি দিয়ে ধােয়া বেরােয়। সমস্ত তরুণ-তরুণী থেকে বুড়ােবুড়ি পর্যন্ত সবার জন্য কাজ-কামের ব্যবস্থা হয়েছে মােটামুটি। সব মানুষের এখন দুবেলা পেট পুরে খাবারই কথা। মাঠে মাঠে ধান আর গমের পবন। তবুও কেন হরিজন পােড়ে। হরিজন পুড়লে কি গােলাপের গন্ধ বেরােয়?—এ কবির প্রগ্ন। সমস্ত সুস্থ মস্তিষ্ক মানুষের প্রশ্ন। অতি কষ্টের সঙ্গে কবিকে বলতে হয়েছে—

“রামরাজ্য কায়েম করতে গেলে

কোথায় দুটো বেজাত খেস্তানকে বাচ্চাসমেত পুড়িয়ে মারা হল,

কোথায় জ্বালানাে হল মােছলমান মেয়ে-মরদসমেত দু-চারটে বস্তি,

এসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামালে চলে?”

(‘শ্রীরামচন্দ্র উবাচ’)

রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল নেওয়ার জন্য এত চালাকি। এত লােভ লালসা। হায় রাম, হায় ভারতবর্ষ। হায় গান্ধীর দেশ, রবীন্দ্রনাথের দেশ।

প্রতিবাদ কবি রাম বসুর কবিতার একটি অন্যতম শর্ত। সামরিক ঘটনাকে তিনি শব্দ দিয়ে তৈরী করে শরীরী রূপ দেন কবিতার মধ্য দিয়ে। গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা ভেবে কবি বলেছেন নতুন অনুভবে—

“ওপাড়ায় খেলছিল রহিম, ফুটফুটে সােনা

লােকে বলতাে বেহেস্তের দোয়া না থাকলে

এমন হয় না।

রহিম গড়ছিল তারার মুকুট

ঈদের নামাজের পরে খাবে বলে।…

তারপর বিবেকহীন শ্বশান-স্তব্ধতা পড়ে আছে

ঝুপড়ির আধপােড়া বাঁশ, ওলটানাে ভ্যান, একপাটি চটি

তারপাশে অনাদি কালের সাপ ও সাপিনী অনায়াস মিথুনে মত্ত।

ভিখারী বুড়ির মতাে অনাথিনী রাত

লাঠিটায় থুতনি রেখে বােবা চোখে আকশে তাকিয়ে।” (‘রক্তের স্বাদ বড় ঝাল ও নােনতা’)

মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্প্রীতি কিভাবে একটি ঠুনকো ব্যাপারে নষ্ট হয়ে যায় এবং তা কত ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে, উপরিউক্ত কবিতাটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কবি রাম বসু অন্যভাবে অন্য একটি কবিতায় বলেছেন এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে—

“আবার পিশাচ এলাে।

মন্দির মসজিদ, আল্লা আর রাম, সাপ ও নেউল।..

প্রেস-নােট দেখিঃ কটা কেউ না,

আমিই আমাকে মারলাম।

অন্তর্গত অন্ধকার আলােকিত করা ছাড়া অন্যপথ নেই।

এবং সে তাে এই মানুষের নিরন্তর রক্তাক্ত সাধনা।” (আবার পিশাচ এলাে)

তাই রাম বসুর আকুল প্রার্থনা –

“আব্বাজান আমাকে বাঁচাও

যারা গিলে খাচ্ছে আগুন আমাকে

চাচা খুড়াে দোস্ত ভাই দুশমন শয়তান

যে যেখানে আছাে—বাঁচাও বাঁচাও।”

দিব্যেন্দু পালিত তার ‘ধর্ম ১৯৯২’-এ লেখেন

“মানুষই করে মানুষকে ক্ষমা—

এ কথা বলার আগে বাঘ বানরের মতাে

তারা জেনে গেছে।

ধর্ম জানে না কোনাে ক্ষমা।”

আসলে বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গৈরিক জঙ্গি শক্তির উত্থান, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা—সমস্ত দেশ জুড়ে বিভেদের রাজনীতির কালাে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ দেশ ও জাতির এই সঙ্কটে আর নীরব থাকতে পারলেন না। একাংশ সক্রিয়ভাবে জনমত গঠনে পথে নামলেন আর অন্যরা তাদের কলমে, তুলিতে, অভিনয়ে তা প্রকাশ করলেন। আর এ ক্ষেত্রে বাংলার বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের ভূমিকা ছিল ইতিমূলক।

ঠিক এক দশক বাদে, গেরুয়াধারীরা জোট বেঁধে কেন্দ্রে এসে বসতেই সাম্প্রদায়িক চেতনার মেরুকরণ ঘটে, এবং গুজরাতে মুসলিম নিধনের বর্বরতা, দানবিক নারী নির্যাতন সমস্ত ভারতবাসীর তথা বির্ণের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনে প্রবল আলােড়ন তােলা সাধারণ মানুষের পথে কবি কমলেশ সেন আবেদন রাখেন,

“সারা দেশের মানুষের কাছে আমি আর্জি করছি, আপনারা সবাই একটা কফিনের জন্য অর্থ তুলুন, মানুষের কাছে যান। বলুন, বলুন আমরা সবাই একসাথে একটি রাষ্ট্রকে কবর দিতে গােরস্তানে যাই।”

অনেকের মতােই দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি কবি সুনীলকুমার নন্দী। তার অজস্র কবিতায় ধরা পড়েছে সেই আক্ষেপ। এপার ওপার, সেই মুখ, ঝােপ, ভূমি, রূপসি রূপসা, চোখ বুজে আছি তবু, প্রতিটি বর্ষায়, দোয়েল-ফড়িংয়ের দিনগুলি, সল্ট লেকে ভাল্লুকের ডাক, ঢেউয়ে ঢেউয়ে এপার ওপার ইত্যাদি কবিতায় তাই তেমনই আকুতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কবিও তাই বারে বারে ছুটে গেছেন দুই কলজের মিলনে, সম্প্রীতির সুরটি খুঁজে নিয়ে—

“কেবা কাকে মনে রাখে, দুয়ার থেকে ফিরে আসি।

‘বাবুমশাই কখন এলে?’ আবছা আলােয় এগিয়ে দেখি করিমচাচা—

“আরে, আরে চাচা, তুমি কেমন আছ?

‘কেমন আছি? কলজেখানা দুভাগ করে ভালােই আছি।

মাঝে মধ্যে তােমার মতাে উড়াল-দেওয়া পাখির সঙ্গে দেখা হলে

কলজেখানায় কেমন যেন একটু খানি মােচড় লাগে, ‘ও কিছু না …

ভালােই আছি, ও কিছু নয় …

কান্নাভাঙা কণ্ঠ শেষে হোঁচট খেল চাপা হাওয়ায় —

একটু থেমে হাঁফ নিয়ে ফের বলল, “আচ্ছা বাবুমশাই

তুমিও কি সব ভুলে গেছ …

মাঝরাতে ওই ইছামতীর বুক রাঙানাে রক্তকমল,

বৃষ্টিসাঁঝে দাওয়ার পাশে আউশধানের গন্ধে-ভাসা

তেপান্তরের গল্পগুলাে …রাজকুমার পীরাজ আর দানববুড়াের চ তােলা …

এ-সব কথা কাকে বলি,

বলতে গেলেই রক্ত আসে, কলজে চাপি –

চারিদিকে গা ছমছম দানববুড়াের ছায়া নড়ে …

আর পারে না, করিমাচাচার কণ্ঠ কাড়ে শুকনাে কাশি

খাঁ খাঁ বুকের ইচ্ছাগুলি হলদে চোখে সলতে পােড়ায়

সবই আছে … তারই মধ্যে করিমচাচা পরবাসী।”

(‘এক আকাশের এপার ওপার’)

কতদিনের পুরনাে ভারতবর্ষ, আমাদের দেশ। তবুও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে প্রর্ণ জাগে—আমরা এ কোন্ ভারতবর্ষে আছি?—পরিসংখ্যান অনুযায়ী নাকি সকলের জন্য খাদ্য মজুত আছে। কাক্কুন সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বেশ গর্বের সঙ্গে বিবাসীকে বলেছিলেন যে, ভারত আর অন্ন ভিখারী নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, এদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ দু’বেলা খেতে পাওয়ার স্বপ্নও দেখে না। উপরন্তু-

“বাঁধের ওপর আমরা বসে থাকতে দেখেছি।

ক্ষুধার্ত শিশুর পিতাদের অসহায় আলগা শরীর

আমরা শহরের ফুটপাথ দেখেছি, গ্রামের গঞ্জ, বাজার

হাটখােলা দেখেছি

আমরা পার্কস্ট্রিট, বড়বাজার, ওয়াটগঞ্জ দেখেছি…

আমি দ্বিধাহীনভাবে …প্রতিবাদকারীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই

যে হিন্দু স্বার্থপরের মতাে রােজ পুজো আর্চায় মাতে

যে মুসলমান পারিপার্ষিকের প্রতি চোখ বন্ধ করে … নামাজ পড়ে

যে খ্রিষ্টান অন্য ধর্মের মানুষদের অধঃপতিত মনে করে।

যে শিখ শুধু ধর্মের দাবিতে রাজনৈতিক অধিকার চায়

তারা শুধু আত্মপ্রবঞ্চক নয়, তারা অধার্মিক, তারা খুনি

প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে তারা মাতৃহত্যা, শিশুহত্যার জন্য দায়ী।

তারা যে অপরের হাতে ত্রীড়নক সেটুকু বুঝবার

ক্ষমতাও তাদের নেই।

তারা মানুষের সাম্যের মাঝখানে কাটাতারের বেড়া তুলে দিচ্ছে

এ কোন ভারতবর্ষে আমরা …।”

(‘আমরা এ কোন্ ভারতবর্ষে’/‘সাদা পৃষ্ঠা, তােমার সঙ্গে’)

কবিতাটির প্রত্যেকটি শব্দ, প্রত্যেকটি লাইন যেন আমাদের পিঠে বেত মারে। সত্যিই তাে, বিবিধের মাঝে মিলন মহান ভারতবর্ষ-আর নেই। এই ভারতবর্ষকে দেখেই কি বিশ্বকবি বলেছিলেন যে, ‘মিলে সবে ভারতসন্তান’। বেঁচে থাকলে তিনিও আঁতকে উঠতেন। আজ ভারতবর্ষের এদিকে ওদিকে শুধু রক্ত বীজের ঝাড়। এরা ধেয়ে আসছে চতুর্দিক থেকে। পালিয়ে যাবার কোনাে মানে হয় না। মানুষ বলেই ‘প্রভূত অন্যায়ের মধ্য থেকে খুঁজে নাও তােমার আত্মজকে!’ (‘পালাতে পারবে না’ ‘সাদা পৃষ্ঠা, তােমার সঙ্গে’)।

কবি মধু গােস্বামী এই সময়ের একজন কবি। এই সময়ের নানা কথাই তিনি বলেন কবিতার মধ্য দিয়ে। মন্দির-মসজিদ আর ধর্ম ধর্ম করে কোন সমস্যার সমাধান হয় না—এ কথা অনেক প্রগতিশীল মানুষের মতই কবি মধু গােস্বামীও মনে করেন। তিনি স্পষ্টতই ব্যক্ত করেন—

“আমরা মঠের মানুষই নই, মাঠের মানুষ।

প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে আমরা মন্ত পাঠ নিই

ধুলােবালি মাখা জীবনের কাছ থেকে।

মন্দির-মসজিদ-গীর্জার পবিত্র চাতাল পেরিয়ে

বড় রাস্তাটায় পা দিলেই দুচোখ ভরে কি দেখেন

হে মুক্ত মানুষেরা?” (‘একটু কম কথা বলুন’)

ঘাম-রক্ত শ্রমের আর সংগ্রামের জীবন থেকে যে ইতিহাসের জন্ম হয়, তার বুকে কবি মন্দির-মসজিদকে কেন্দ্র করে কোন বিতর্কিত জমি সৃষ্টি করতে চান না। যারা এসব করে মানুষের মধ্যে মৈত্রীর ধ্যান ধারণাকে নস্যাৎ করে দিতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে মধু গােস্বামীর স্পষ্ট উচ্চারণ—

বন্ধ করুন আপনাদের সান্ত্বনার কীর্তন,

সস্তায় কেনা আপেল দিয়ে

আমাদের আর পথ্য যােগাতে হবে না,

ওর রসে আর শাঁসে আছে

বুনাে বিষফলের চক্রান্ত।

এবার একটু কম কথা বলুন। (‘একটু কম কথা বলুন’)

৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২-এ অযােধ্যায় যে কাণ্ড ঘটেছিল তাকে কোনাে প্রগতিশীল মানুষই মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু হিংস্র মানুষের হাতে সেদিন গম্বুজ খিলান সব খসে পড়েছিল। তারা ইতিহাস মুছে দিয়ে লিখতে চায় না পাণ্ডুলিপি। কবি কৃষ্ণ ধরের সাবধানবাণী তাই জগৎবাসীর প্রতি —

“চারপাশে ঘিরে আছে হিংস্র দন্ত শানিত ঘাতক

সংঘাতে ঝরায় রক্ত, নষ্ট ভ্রষ্ট মৈত্রী ও প্রীতি

সভ্যতাকে পিষ্ট করে দীর্ণ করে জীবন বন্ধন

নেকড়েরা দাপিয়ে বেড়ায় রক্ত আর অশ্রুমাখা মাটি।”

(‘নেকড়ে’)।

এই প্রেক্ষিতে কবি কৃষ্ণ ধর সম্প্রীতির ডাক শােনান এইভাবে—

“আমরা গাইছি একসাথে মৃত্যুহীন গান।

যেমন গেয়েছি আমরা লােকায়তেগাজনে পরবে

চেরাগ জ্বালিয়ে রেখে পীরের মাজারে

কিম্বা সারারাত জেগে মনসা ভাসানে।”

গােলাম কুদুস ‘গুজরাট ২০০২’-এ লেখেন-

“মর্মাহত ক্লান্ত আমি, অতিক্লান্ত

ভাবি তবু ভাবি

ভবিষ্যে কী গুপ্ত আছে অতঃপর

কানে আসে আর্তস্বর —

বাঁচাও বাঁচাও!”

গুজরাটের দাঙ্গাকে মনে রেখে কবি কৃষ্ণ বসু নির্দ্বিধায় বলেছেন—

“ধর্ম আদিম রাজনীতি গাে, এই কথাটা, সত্য—

তােমার শিরায় আমার শিরায় এক মানুষের রক্ত,

কাকে মারিস? কাকে ধরিস? গরীব ভারতবাসী?

এ কোন্ নরক জেগে উঠল, আজকে সর্বনাশী।” (‘কবির প্রস্তাব’)

সাম্প্রদায়িক মন্তরের ফুঁ। এবং তার পরিণাম হিসাবে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরের অযােধ্যায় মসজিদ ভাঙার পর যে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে দাঙ্গা দেখা দিয়েছিল, তারই একটি চালচিত্র এঁকেছেন কবি জলধি হালদার—

“ভয়, বিাসের প্রতি মারাত্মক ছুরিকাঘাত

ভয়, চব্বিশ ঘণ্টা কারফিউ-দীর্ণ দেশ, চূড়ান্ত সতর্কতামূলক

মিলিটারি ব্যবস্থা

ভয়, পুলিশের গাড়ির ব্যস্ত ছুটোছুটি, সবুট লাথি, লুঠতরাজ

ভয়, হাহাকার, কোলবাচ্চাদের খিদে

ভয়, গাছের পাতায় ঢাকা গ্রাম দাউ দাউ পুড়ছে

ভয়, সমস্ত জলচল অচল হয়ে যাচ্ছে

এবং আমার আরক্ত চোখ, অন্ধকার মুখমণ্ডল আর সর্বনাশের মতাে

ছড়িয়ে যাচ্ছে ঘরময় রাশি রাশি প্রাচীন সংঘবদ্ধ তুলাে।” (‘ডিসেম্বর বিরানব্বইয়ের দিনরাত্রি’/‘সম্পূর্ণ বৃক্ষের বাসনা’)

কবিতার স্বপ্ন দেখে যে কবিতা লেখা হয়, কবি অরুণ ভট্টাচার্য তার পান্ডুলিপি পুড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কবি পছন্দ করেন না। মানুষ অমৃতের সন্তান। তার মতে –

“মন্দিরের কাসর ঘন্টা আর।

মসজিদের আজানের সুর, মানুষেরই তাে কথা বলে।”

(ইনসান,/ পরাগত পরাগ’)।।

খুন, সন্ত্রাস, দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন কবি শ্যামলকান্তি দাশ—

“ছবিতে অগ্নিসংযােগ,

খুন, সন্ত্রাস, দাঙ্গা

ছবিতে চিরুনি-তল্লাশ

নগরকোটাল নাঙ্গা।

ছবিতে মৈত্রী মজবুত

মিলেজুলে আছে ভাইবােন

হাতে হাত ধরে হাঁটছে

ত্রিভূজ বৃত্ত সমকোণ।

ছবিতে আকাশ আয়না

দূষণমুক্ত পরিবেশ

বহুতল ভাঙে দুদ্দাড়

লেখা সমাপ্ত, ছবি শেষ।” (‘ছবিতে সত্যকাহিনী’)

২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার বিরুদ্ধে সংহতি তথা মৈত্রীর বাণী শুনিয়েছেন কবি তমালিকা পণ্ডাশেঠ —

“আজানের সুর নেই—বাতাসও বইছে না—

চোখ নয়—শরীর বইছে দু’টি ভারী পাথর

ঘর নেই—দাওয়া নেই—বাহু নেই আলিঙ্গনের…

পাথরার মন্দিরগুলি

ইয়াসীন পাঠানেরা আজও জেগে থাকে

জেগে থাকে কষ্টি পাথরে গড়া শিবলিঙ্গগুলি।

আমাকে মাফ করাে—

হে আমার লাঞ্ছিতা স্বদেশ প্রতিমা

ক্ষমার অযােগ্য জানি আমার এ ভুল

শিশুটি বসে আছে—

তাকে বুকে তুলে নিয়ে দিতে হবে একটি প্রিয় চুমা।” (ধুলি থেকে তুলে নাও পাপ’)।

ধর্মান্ধ একদল মানুষ আজ কেড়ে নিচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকবার অধিকার। তারা শুধু মানুষের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হরণ করছে তা নয়, তারা দেশের ঐতিহ্য ও সভ্যতাকেও কালিমালিপ্ত করছে। যুদ্ধ, সন্ত্রাস, রক্তপাত, ঘৃণা, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, বৈষম্য, হাহাকার আজ আমাদের নিত্য সঙ্গী। মানব সভ্যতার এই সঙ্কট বিচলিত করে আধুনিক কবিদেরও। বিবেকবান মানুষের মত তারাও যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। দেশের ঐক্য, সংহতি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার পরে তারা কবিতা লিখেছেন। জাগ্রত বিবেকের পরিচয় পূর্বোক্ত কবিকুল ছাড়াও আরও যাদের কবিতায় আকীর্ণ হয়ে আছে তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন অলােকরঞ্জন দাশগুপ্ত (এখন দক্ষিণে সুর্য অস্ত যায়), অজিত বাইরী (কসাই), অর্ধেন্দু চক্রবর্তী (জীবনের রঙ), অনীশ ঘােষ (ভারতবর্ষ-১), অমল সেনগুপ্ত (গুজরাতে অপচ্ছায়া), অরুণাংশু ভট্টাচার্য (ভারতবর্ষকে এক চিঠি), অলােককৃষ্ণ চক্রবর্তী (মানুষে মানুষে ভেদ আর না), আনন্দঘােষ হাজরা (তােলাে আবরণ), আব্দুস শুকুর খান, (একটি মােক্ষম শব্দ চাই ), আশিস সান্যাল (প্রেমহীন অন্ধকার), আশিস মিশ্র (কণা), ঈশিতা ভাদুড়ী (ধর্মের পােড়া মুখ), উজ্জ্বল সিংহ (অগ্নিদগ্ধ রবীন্দ্র সংগীত), কার্তিক মােদক (জামায় রক্তের দাগ), কালিদাস ভদ্র (সাজ), কালীকৃষ্ণ গুহ (এক অন্তহীন প্রতিক্ষার শুরু), গৌতম ঘােষদস্তিদার (অসময়), জয় গােস্বামী (আজ), দেবাঞ্জন চক্রবর্তী (বর্ণপরিচয় ২০০১), নবারুণ ভট্টাচাৰ্য্য (‘একগুচ্ছ বুলেট প্রুফ কবিতা ), নবনীতা দেবসেন (বারুদ ছড়া), নাসের হােসেন (ভারতবর্ষ), নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (সত্য সেলুকাস), প্রণব চট্টোপাধ্যায় (এখন যেমন ঘৃণা), প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় (নেপথ্যে) , প্রমােদ বসু (আক্রোশ), বিজয় সিংহ (গুজরাট থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ), বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় (ধর্ম), বিভাস রায়চৌধুরী (দাঙ্গা), বিজিৎ চক্রবর্তী (তােমরা কি চুপচাপ), মঞ্জুষ দাশগুপ্ত (ইতিহাস), মন্দাক্রান্তা সেন (যুদ্ধ পরবর্তী কবিতা), মনিকা রায় (কেন ভেঙে ফেলছ বার্বির্ডল), মিহির সরকার (কর্মসংস্কৃতি), মল্লিকা সেনগুপ্ত (শত্রু), মৃণাল বসু চৌধুরী (বন্ধ করাে অন্ধদের খেলা), মৃণালকান্তি দাশ (আলাের জন্য), রাণা চট্টোপাধ্যায় (হিংসার বাঘনখ), রূপক চক্রবর্তী (আমি বিশ্বাস করি), শঙ্খ ঘােষ (আয় আরাে বেঁধে বেঁধে থাকি), শিবাশিস মুখােপাধ্যায় (কালাে মেঘ কালে মেঘা পানি তাে বরসাও), সব্যসাচী দেব (আজ ধর্মের জয়), সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত (চাই), সুতপা সেনগুপ্ত (দাঙ্গা), সুবােধ সরকার (বাবা), সুস্নাত জানা (রােদের মতাে মেয়ে), সৈয়দ কওসর জামাল (মহান ভারতকথা), সৈয়দ হাসমত জালাল (আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে), সিদ্ধের সেন (তােমার দেশ নেই রাষ্ট্র নেই), কবিরুল ইসলাম (ভালবাসার গান), বিনয় মজুমদার (প্রতিদিন আসবে ওরা), দীপঙ্কর চক্রবর্তী (নেয়ামতকে বলেছিলাম), উৎপলকুমার বসু (দাঙ্গা), মনি মুখােপাধ্যায় (বিবেকের সঙ্গে সংলাপ), নবনীতা দেবসেন (নাজমা), হৃদয় ভদ্র (এ সময়ে কোনও শােক নয়), মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (আমার কবিতার বইয়ের ভূমিকা), শ্যামল সেন (কলজে-ফুলের গন্ধে), জিয়াদ আলি (অমল পৃথিবী), একরাম আলি (মৌলবাদ), মৃদুল দাশগুপ্ত (মুক্ত মানুষের পদ্য), এন জুলফিকার (‘গুজরাট ২০০২’ কিংবা ‘নিছকই প্রলাপ’) প্রমুখ।

‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।

‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।

‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।

Post Views: 8,751
Tags: Bangla KobitaBangla LiteretureBangla Sahityaআধুনিক বাংলা কবিতাকবিতাবাংলা কবিতাবাংলা সাহিত্য
ADVERTISEMENT

Related Posts

নজরুল ইসলামের উপন্যাসে মানবতাবাদ
সাহিত্য আলোচনা

নজরুল ইসলামের উপন্যাসে মানবতাবাদ

লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম মহৎ ঔপন্যাসিক মাত্রই মানবতার পথপ্রদর্শক। সাহিত্য মানেই মানুষের কথা, তার জীবনযাপন, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-সংঘর্ষ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক...

by মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
March 29, 2025
বনলতা সেন ও জীবনানন্দ দাশের নায়িকারা
সাহিত্য আলোচনা

বনলতা সেন ও জীবনানন্দ দাশের নায়িকারা

লিখেছেনঃ আহমদ রফিক শ-পাঁচেক বছর আগে চিত্রশিল্পের অন্যতম ‘গ্রেট মাস্টার’ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা আবক্ষ নারীপ্রতিকৃতি ‘মোনালিজা’কে নিয়ে ইতালি-প্যারিস...

by অতিথি লেখক
November 19, 2024
কাজি নজরুল ইসলাম ও আন্তর্জাতিকতা
সাহিত্য আলোচনা

কাজি নজরুল ইসলাম ও আন্তর্জাতিকতা

লিখেছেনঃ সুমিতা চক্রবর্তী কাজি নজরুল ইসলামকে অনেক ভাবেই আমরা চিনি। তিনি উৎপীড়িতের পক্ষে দাঁড়ানো একজন সাহিত্যিক; তিনি অসাম্প্রদায়িক মনের...

by অতিথি লেখক
November 5, 2024
জীবনানন্দ দাশের নারীপ্রেমঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা
সাহিত্য আলোচনা

জীবনানন্দ দাশের নারীপ্রেমঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

লিখেছেনঃ বাসন্তীকুমার মুখখাপাধ্যায় জীবনানন্দ যেমন প্রকৃতির বেদনার আঘাতের ও হিংস্রতার দিকটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন থেকেও প্রকৃতিলীন জীবনে আস্থা স্থাপন...

by নবজাগরণ
November 7, 2024

POPULAR POSTS

  • সুলতান মাহমুদ

    সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান ও সোমনাথ মন্দির প্রসঙ্গ (১ম পর্ব)

    181 shares
    Share 181 Tweet 0
  • বাউরী সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিহাস ও ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • আর্যদের ভারত আগমন, বিস্তার, সমাজ ও সভ্যতা: এক ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বৌদি কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক আদৌ কি প্রেমের ছিল?

    0 shares
    Share 0 Tweet 0
  • হিন্দু পদবীর উৎপত্তির ইতিহাস, বিবর্তন ও ক্রমবিকাশঃ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা

    0 shares
    Share 0 Tweet 0

Facebook Page

নবজাগরণ

ADVERTISEMENT
নবজাগরণ

'Nobojagaran' is a website of its kind where you can gather knowledge on all the unknown facts of the world. We human beings always have a thirst for knowledge. Nobojagaran takes its first steps to quench this thirst of ours. We are now in the era of digital world, where we get almost anything online. So how about a bit of knowlyfrom online?

Connect With Us

No Result
View All Result

Categories

  • English (9)
  • অন্যান্য (11)
  • ইসলাম (26)
  • ইসলামিক ইতিহাস (22)
  • ইহুদী (1)
  • কবিতা (37)
  • খ্রিস্টান (6)
  • ছোটগল্প (6)
  • নাস্তিকতা (18)
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (24)
  • বিশ্ব ইতিহাস (24)
  • ভারতবর্ষের ইতিহাস (194)
  • রাজনীতি (38)
  • সাহিত্য আলোচনা (68)
  • সিনেমা (17)
  • হিন্দু (16)

Pages

  • Cart
  • Checkout
  • Checkout
    • Confirmation
    • Order History
    • Receipt
    • Transaction Failed
  • Contact
  • Donation to Nobojagaran
  • Homepage
  • Order Confirmation
  • Order Failed
  • Privacy Policy
  • Purchases
  • Services
  • লেখা পাঠানোর নিয়ম
  • হোম
No Result
View All Result
  • মূলপাতা
  • ইতিহাস
    • ইসলামিক ইতিহাস
    • ভারতবর্ষের ইতিহাস
    • বিশ্ব ইতিহাস
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ধর্ম
    • ইসলাম
    • খ্রিস্টান
    • হিন্দু
    • ইহুদী
    • অন্যান্য ধর্ম
  • নাস্তিকতা
  • রাজনীতি
  • সিনেমা
  • সাহিত্য
    • কবিতা
    • ছোটগল্প
    • উপন্যাস
    • সাহিত্য আলোচনা
  • অন্যান্য
  • ই-ম্যাগাজিন
    • নবজাগরণ (ষাণ্মাসিক) – জীবনানন্দ ১২৫ তম জন্ম সংখ্যা – মননশীল সাহিত্য পত্রিকা
  • Others Language
    • English
    • Urdu
    • Hindi

©Nobojagaran 2020 | Designed & Developed with ❤️ by Adozeal

Login to your account below

Forgotten Password?

Fill the forms bellow to register

All fields are required. Log In

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In
Don't have an account yet? Register Now
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
| Reply
Open chat
1
Powered by Joinchat
Hi, how can I help you?