লিখেছেনঃ ড. রামিজ রাজা
বাংলার প্রথম সাহিত্যকীর্তি চর্যাপদ পালযুগে রচিত হবার পর প্রধানত তিনজনকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। জন্মসূত্রে বাঙালি না হয়েও শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ তাঁদের মধ্যে একজন। অপর দুই জন হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। ইলিয়াস শাহকে মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসে প্রথম বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা বললে অত্যুক্তি হয় না। দিল্লির কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নিজের সালতানাতকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে তিনি একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দের নেসারি তাম্রশাসনে (খ্রি. ৮০৫) “ভাঙ্গালাদেসা/ভাঙ্গাদেসাম” (বঙ্গাল/বঙ্গল)-এর উল্লেখ পাওয়া গেছে। আবার মহাভারত নামের প্রাচীন পৌরাণিক গ্রন্থের ঐত্যরেয় আরণ্যক পর্বে বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে বলা হয়েছে যে, বলিরাজের স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে দীর্ঘতমা ঋষির ঔরসে পাঁচজন ক্ষেত্রজ পুরুষ জন্মলাভ করে। এই পঞ্চ পুত্রের মধ্যে অন্যতম ‘বঙ্গের’ অধিকারভুক্ত অঞ্চল বঙ্গ নামে পরিচিত হয়। অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বাস মতে, ‘মহাপ্লাবনের হাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার নায়ক পয়গম্বর নূহ এর পুত্র হামের পৌত্র ও হিন্দের দ্বিতীয় পুত্র বঙ্গ এই অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করলে এই অঞ্চলের নাম হয় বঙ্গ।’ এছাড়াও সাঁওতাল, কোল ও মুণ্ডা নামক বাংলার আদিমতম জনগোষ্ঠী গুলির দেবতার নাম ‘বোঙ্গ’। বোঙ্গ দেবতার নাম অনুসারে বঙ্গ নামের উৎপত্তি বলে একটা মত প্রচলিত। চর্যাচর্যবিনিশ্চয় গ্রন্থে ভুসুক পা’র একটি শ্লোকে (খ্রি. বারো/ তেরো শতক) ‘বঙ্গ’ এবং ‘বঙ্গালি’ উভয়েরই উল্লেখ পাওয়া যায়। বাঙ্গালা বা বাংলা শব্দটি এসেছে ফার্সী ভাষা থেকে। মুঘল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে বাঙ্গালা (বাংলা) শব্দ ব্যবহার করেছেন। গবেষক ডি. সি. সরকারের মতে প্রাচীন নাম বঙ্গের সাথে বাধ বা জমির সীমানাসূচক শব্দ ‘আল/আইল’ প্রত্যয়যোগে বাঙ্গালা শব্দ গঠিত হয়েছে। গ্রিয়ারসন মত প্রকাশ করেছেন যে, বঙ্গাল এসেছে ‘বঙ্গ+আলয়’ থেকে এবং বঙ্গদের বাসভূমি অর্থে। প্রাচীনকালে নদীমাতৃক বঙ্গীয় অঞ্চল একাধিক ভূ-রাজনৈতিক এককে বিভক্ত ছিল। যেমন দক্ষিণাঞ্চলের বঙ্গ, পশ্চিমাঞ্চলের রাঢ় ও সুহ্ম, উত্তরাঞ্চলের পুণ্ড্রবর্ধন ও বরেন্দ্র, এবং পূর্বাঞ্চলের সমতট ও হরিকেল। হাজি ইলিয়াস শাহ এই খণ্ডিত বাংলাকে একত্রিত করে বৃহত্তর বাংলা সালতানাতের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রাজত্বকালেই বাঙালিরা একটি জাতি হিসেবে বহিঃর্বিশ্বের কাছে রাজনৈতিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৩৪০-১৩৫০ সালের পরবর্তী সময় হতেই বাংলার সকল অঞ্চলের অধিবাসীরা ব্যাপকভাবে বাঙালী বলে পরিচিত হয়। ঐতিহাসিক শামস-ই-সিরাজ আফিফ ইলিয়াস শাহ কে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’ অর্থাৎ বাঙালীদের জাতীয় নেতা উপাধিতে অভিহিত করেছেন। ইলিয়াস শাহের একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে যা কলকাতার বেনিয়াপুকুরের একটি আধুনিক মসজিদে বসানো আছে।
১৩৫৩ সালের ৮ই নভেম্বরে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাংলা আক্রমণ করেন। প্রায় দুই বছর যুদ্ধের পর বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ এই আক্রমণ দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করতে সক্ষম হন। বাংলার সৈন্যদের বীরত্বপূর্ণ কঠোর প্রতিরোধ এবং বিরূপ ভৌগোলিক পরিস্থিতি বহিরাগত আক্রমণ থেকে বাংলার সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সহায়ক হয়। জলপূর্ণ পরিখা বেষ্টিত সুদৃঢ় একডালা দুর্গ ছিল মধ্যযুগের বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাটির দুর্গ। এই দুর্গ থেকেই দিল্লির আক্রমণ প্রতিরোধ করা হয়েছিল। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ২২ দিন ধরে অবরোধ করলেও একডালা দুর্গ অধিকার করতে ব্যর্থ হন। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলিম একত্রিত হয়ে হাজি ইলিয়াস শাহের বাঙালি সৈন্যরা অসীম দক্ষতার সাথে একডালার দুর্গ টিকিয়ে রেখেছিল। এই যুদ্ধে ইলিয়াস শাহের সেনাবাহিনীর হিন্দু সেনাপতি সহদেব বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে মাতৃভূমি রক্ষার্থে শহীদ হন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা কখনো ধর্মভিত্তিক বা ধর্মবিরোধী নয়৷ কিছু মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিতে চান ধর্মভিত্তিক স্বার্থ হাসিলের জন্য৷ এখানে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমান বা হিন্দুদের কথা বলা হচ্ছে না৷ তারা রাজনীতিটা বোঝেন না৷ তাদের ধর্মের প্রতি আনুগত্যকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করেন কিছু মানুষ৷ বাংলার মানুষ সাম্প্রদায়িক নন৷ বাংলার মানুষ আবেগী৷ সেই আবেগের জোরেই আজও বাংলার মাটিতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতা দখল করতে পারে নি। কিন্তু ধর্মের অপব্যাখ্যা ক্রমশই বাঙালিদের সেই আবেগকে পুঁজি করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ধর্মের ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক বিষয়৷ ইতিহাসে বারবার এর বড় বড় প্রমাণ পাওয়া গেছে, আজও তা ঘটছে৷ ভারত ভাগ হয়ে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের হাত ধরে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। পরে পাকিস্তান ভেঙে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সেই দেশকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে বলে ধুয়া উঠেছিল৷ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা অন্য ধর্মের বাঙালিরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেমন যুদ্ধ করেছিলেন, তেমনি ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা জায়নামাজ খুলে কিংবা হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহ, ভগবানের দিকে অকুতোভয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রার্থনার হাত তুলেছিলেন৷ তারা কিন্তু শুধু মুসলিম মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিংবা হিন্দু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রার্থনা করেন নি৷
বর্তমানে বাংলা জর্জরিত ধর্মীয় বিভেদ ও বহিরাগত ভাষাভিত্তিক আগ্রাসনের জাঁতাকলে। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ ও উর্দু আগ্রাসনের জোড়া ফলক থেকে বর্তমানে ধর্মীয় লড়াইয়ে জর্জরিত বাংলাকে বাঁচাতে পারে শুধুমাত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা। ১৯৪৭ এর বাংলা ভাগ পরবর্তী সময়ে ভারতে বাঙালি হিন্দুদের মূল সমস্যা উত্তর ভারতীয় হিন্দি ও হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন। নিজেদের হিন্দুত্বের প্রমাণ দিতে তাদের উত্তর ভারতীয় ধর্মীয় রীতি নীতি পালন করতে হচ্ছে, নিরামিষভোজী হতে হচ্ছে। তারপরেও তারা তথাকথিত সহি ভারতীয় হিন্দুর পরিচয় পাচ্ছে না। এন আর সি তে তাদের নাম বাদ যাচ্ছে। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর ভারত রাষ্ট্রে তারা ভাষিক সংখ্যালঘু। বাঙালি হিন্দুর উদ্বেগ এটাই যে বছর পঞ্চাশেক পরে হয়তো বাঙালি হিন্দু পরিচয়টাই আর থাকবে না। তাদের উত্তরভারতীয় হিন্দু হয়ে যেতে হবে। বাঙালি মুসলমানরা হয়তো একচেটিয়া বাঙালি পরিচয়ের দখল নেবে, এই উদ্বেগও বাংলার বাঙালি হিন্দু মননের একাংশে কাজ করছে। অপরদিকে ভারতের বাঙালি মুসলমানদের সমস্যা একটু ভিন্ন। দেশভাগ ও স্বাধীনতা লাভের ৭৫ বছর পরেও আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান এখনো পিছনের সারিতে। বাঙালি মুসলমানদের এই সঙ্কটমুহূর্তকে সাম্প্রদায়িক শক্তিরা কৌশলে ব্যবহার করছে। তারা বাঙালি মুসলমানদের মুসলমানিত্বকে হিন্দু বিদ্বেষী উগ্র রূপ প্রদান করতে চাইছে। আর বাঙালি মুসলমান তার বঞ্চনার ইতিহাস আওড়ে আরো দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
এখন বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক দিকগুলি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে বাঙালি জাতির এই দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর উদ্বেগের কারন ভিন্ন। বাঙালি হিন্দু তার বাঙালি হিন্দুত্ব পরিচয় বাঁচাতে মরিয়া ও বাঙালি মুসলমান তার মুসলমানিত্ব পরিচয় আঁকড়ে নিজের বঞ্চনা ঘোচাতে চাইছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে ধর্মনির্বিশেষে বাঙালির শত্রু হিন্দি/উর্দু আগ্রাসন। সেটা ভাষাগত ভাবে হোক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বর্তমানেও বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হবার মূলেও আছে এই বহিরাগত সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি। আর এই আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচতে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। বাঙালি হিন্দুকে যেমন বাঙালি মুসলমানদের বিভিন্ন বঞ্চনার বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে ও নিরসনে উদ্যোগী হতে হবে তথানুরূপ বাঙালি মুসলমানদেরও বাঙালি হিন্দুদের বাঙালিত্ব রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহন করতে হবে। বাঙালি হিন্দুদের বাঙালিত্ব রক্ষা না পেলে বাঙালি মুসলমানদেরও বাঙালিত্ব রক্ষা পাওয়া দূরূহ বিষয়। কারন বাঙালি মুসলমান ভারতে ভাষিক সংখ্যালঘুও বটে। বাঙালি মুসলমানদের আরো বেশি করে বাঙালি পরিচয় গ্রহণ করা উচিৎ। তবেই আপামর বাঙালির বাঙালিত্ব আরো পোক্ত হবে। পারস্পরিক চাওয়া পাওয়া ও উদ্বেগ কাটিয়ে যদি বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের ছায়াতলে এসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে বহিরাগত সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর সাথে লড়তে পারে তাহলে জয় বাঙালিরই হবে কারণ বাংলায় বাঙালি সংখ্যাগুরু।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্যান্য জাতীয়তাবাদের ন্যায় আগ্রাসন শেখায় না। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে শেখায়। হাজার বছর ধরে বাঙালি তার এই স্বাভাবিক স্বকীয় চরিত্র দিয়ে বাংলার পবিত্র মাটি রক্ষা করে এসেছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে বাঙালী হিন্দু ও মুসলমান। তাই বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানদের অবিলম্বে বহিরাগত সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসার সম্পর্ক দৃঢ় করা সময়ের দাবী, ইতিহাসের দাবী। সারাবিশ্বে যেভাবে বর্ণবাদ ও উগ্রবাদকে পুঁজি করে ‘আদর্শিক ঘৃণা’ ছড়ানো হচ্ছে, তার বিপরীতে সাধারণ মানুষকে দাঁড়াতে হবে৷ কারণ এটা বুঝতে হবে যে ধর্মের কারণে হোক, বর্ণের কারণে হোক, ঘৃণা কোনো আদর্শ হতে পারে না৷
তথ্যসূত্রঃ
- ১. বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবন, এ কে এম শাহনাওয়াজ ও ফাতেমা হেরেন
- ২. রিয়াজ-উস-সালাতিন, গোলাম হুসেন সলীম
- ৩. বঙ্গভূমি ও বাঙালির ইতিহাস, ড. নীতিশ সেনগুপ্ত
- ৪. বাংলার ইতিহাসের দুশো বছরঃ স্বাধীন সুলতানদের আমল, শ্রী সুখময় মুখোপাধ্যায়
- ৫. বাঙালীর জাতীয়তাবাদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।