লিখেছেনঃ শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি চাকরিতে ১৯৪৭-এর অব্যাহতি পরে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব ছিল শতকরা ১৭ ভাগ। সিদ্ধার্থ রায় মন্ত্রিসভার আমলেও এই সংখ্যা ছিল শতকরা ৯ ভাগ। তারপর থেকে এই সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে সিপিআই (এম) শাসনে নেমে এসেছে শতকরা ২ ভাগেরও কম। অথচ সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে (মাদ্রাসা বা মিশনারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে) দলীয় আধিপত্য বিস্তারের অপচেষ্টা চলছে লাগাতারভাবে।
আমাদের রাজ্যে বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সংখ্যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী এই রাজ্যের সিপিএম শাসিত বামফ্রন্ট সংখ্যালঘুদের মাননান্নয়নের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। সংখ্যালঘুরা এই রাজ্যে দেশের অন্য রাজ্যের তুলনায় আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষা প্রায় সব ক্ষেত্রেই বঞ্চিতদের দলে, একথার স্বীকৃতিও মেলে মানব উন্নয়ন রিপোর্টে, সাচার কমিটির রিপোর্টে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের এই অবহেলা দূরীকরণে বিশেষ আর্থিক তহবিল গঠন করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে সাচার কমিটি সহ অন্যান্য কমিটি কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করতে তফসিলি জাতি জনজাতি আদিবাসী ও অনগ্রসর শ্রেণির; মানুষের প্রকৃত উন্নয়নে সরকারকে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে হবে।
পশ্চিমবাংলায় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ২৭ শতাংশ হলেও সংখ্যালঘুদের সরকারি চাকরির সুযোগ শুধুমাত্র দু’শতাংশের কাছাকাছি। সংখ্যালঘুদের জীবনে ৩৫ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের রাজত্বে চলেছে শুধু বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা। তাই এক্ষেত্রে বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের, মেয়েদের ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের অগ্রাধিকার বিশেষ গুরুত্ব পাবে ও কর্মসংস্থানও সুনিশ্চিত করতে হবে।
মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন, আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাতেও সরকারি অনুদান, উর্দু স্কুল ও উর্দু কলেজ তৈরি করবার ব্যবস্থা ও উর্দু ভাষার মানোন্নয়ন করতে হবে।
উর্দুভাষী মানুষ যে সমস্ত অঞ্চলে সংখ্যাধিক্য (অন্তত ১০ শতাংশ) সেই সব অঞ্চলে উর্দু ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে গণ্য করতে হবে। ওয়াকফ সম্পত্তি বেআইনি দখলের কাজ হয়েছে। তার তদন্ত করা ও ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।
বেরিয়াল গ্রাউন্ড বা কবর স্থানের সংস্কার করা দরকার।
নতুন মাদ্রাসা চালু করা দরকার। সংগঠিত মাদ্রাসার স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। মুসলিমদের জন্য আলিগড় ইউনিভার্সিটির অনুকরণে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত। মুসলিমদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি মুসলিম মেয়েদের হোস্টেল/বোর্ডিং চালু করা দরকার।
সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করা উচিত। তাদের সোসাল সিকিওরিটির ব্যবস্থা করা দরকার। সংখ্যালঘুদের চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দাবি রাখছে তৃণমূল কংগ্রেস।
সংবিধান গ্রহণের প্রায় ছয় দশক কাটতে চলল। অথচ, সমাজের সর্ব নিম্নস্তরে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক তফসিলি জাতি, আদিবাসী ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) মানুষের জীবন মানের কোনো উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার সর্বশেষে মাননান্নয়ন রিপোর্টে বাধ্য হয়ে বলেছে – সবচেয়ে বড় প্রতিফলন ঘটেছে গ্রামীণ ভূমিহীনতার ক্ষেত্রে। যদিও সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ বাসীর মধ্যে তফসিলি জাতি-জনজাতির মানুষ হচ্ছেন ২৮.৫ শতাংশ, কিন্তু গ্রাম বাংলার প্রায় ৭৩.৬৩ লক্ষ ভূমিহীন খেতমজুরের ৫২.৪৬ শতাংশ বা ৩৮ লক্ষ ৬৩ হাজার ৯৫০ জনই হচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বী, আবার ভূমিহীন খেতমজুরের ২৪ শতাংশ। বা ১৭ লক্ষ ৭০ হাজার ১২৩ জনই তারাই! অর্থাৎ দুবেলা দুমুঠো খাবার না পাওয়া এবং নামমাত্র মজুরিতে অন্যের জমিতে খাটা ভূমিহীন খেতমজুরের ৭৬ শতাংশই হচ্ছে এসসি-এসটি ও মুসলমান। কিন্তু সামগ্রিক জনসংখ্যার যারা ৪৬.৩ শতাংশ সেই অন্যরা ভূমিহীনদের মাত্র ২৩.৫৪ শতাংশ! নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তফসিলি আদিবাসী ও ওবিসিদের সার্টিফিকেট দিতে হবে।
প্রথমে আদিবাসীদের দুঃসহ অবস্থার কথা বলা যাক। ২০০১ জনগণনা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে আদিবাসী ৫.৫০ শতাংশ বা ৪৪,০৬,৭৯৪ জন। পশ্চিমবঙ্গে সাক্ষরতার হার ২০০১ সালে ৬৯ শতাংশ, কিন্তু আদিবাসীদের মাত্র ৪৩ শতাংশ সাক্ষর। ২০০৩ – ০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করতেন ৭.৩৬ লক্ষ ছাত্রছাত্রী, এদের মধ্যে আদিবাসী ২.১০ শতাংশ মাত্র। ওই বছরই ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভে পাঠরত ১ কোটি ৬৩ লক্ষ ৮১ হাজার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আদিবাসীরা ছিলেন ৪.৮৭ শতাংশ যা তাদের জন-অনুপাতের চেয়ে কম! অথচ জনসংখ্যার ৫.৫০ শতাংশ আদিবাসী হলেও পশ্চিমবঙ্গে ভূমিহীন খেতমজুরের মধ্যে আদিবাসীদের হার ১৫.৫৩ শতাংশ। এরপরেও লালগড় ঘটবে না?
তফসিলি জাতি ও আদিবাসী জনগণ এ রাজ্যে চরম বৈষম্যের শিকার। রাজ্যে ২৮ শতাংশ সংরক্ষণ ঘোষিত হলেও সরকারি ক্ষেত্রে তফসিলিরা মাত্র ১২ শতাংশ চাকরিতে নিযুক্ত। যার বেশির ভাগটাই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে তফসিলিদের প্রতিনিধিত্ব ৫ শতাংশের কম। এই বর্গের মধ্যে আদিবাসী মানুষের বঞ্চনা আরও বেশী। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল, চা-বাগানের শ্রমিক অব্যুষিত অঞ্চলগুলির পশ্চাদপদতা লজ্জাজনক। আদিবাসী সমাজ খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য কর্মসংস্থান-ভাষা-স্বীকৃতি সহ নানা দিক থেকেই বঞ্চিত। আদিবাসী সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি ধ্বংসের মুখে। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের তালিকায় এরাজ্যে রয়েছে ৬৬টি ছোট ছোট বর্ণ সম্প্রদায়। ওবিসি-র অন্তর্গত মানুষের জন্য ২৭ শতাংশের বদলে ৭ শতাংশ সংরক্ষণ চালু করা হয়েছে।
এককথায় বলা যায়, এ রাজ্যে সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের সমান অধিকার ও সম-উন্নয়ন সুনিশ্চিত করা যায়নি। বিভিন্ন সরকারি ও সংসদীয় রিপোর্ট তার সাক্ষী দেবে।
পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ২৯ শতাংশ তফসিলি জাতি ও জনজাতি ভুক্ত। ২৮.৬ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তার মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যাধিক্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তিনটি সম্প্রদায় মিলে হয়ে দাঁড়ায় জনসংখ্যার ষাট শতাংশ। এই তথ্য যথেষ্ট ইঙ্গিতবহনকারী। দারিদ্র ঘিরে রেখেছে এই সম্প্রদায়ের সিংহভাগ অংশকে। বিশেষত গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্রের এই প্রসার তিরিশ বছরের বাম রাজত্বে লজ্জা। বাম শাসনে এই তিনটি সম্প্রদায় সহ অনগ্রসর শ্রেণির মানুষরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বেঁচে থাকার ন্যুনতম শর্তগুলো থেকে এতটাই বঞ্চিত এবং সারা ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলো থেকে এতখানি পিছিয়ে আছে যা তা বাম অপশাসনের নির্লজ্জতাকেই চিহ্নিত করে।
ভারতবর্ষের প্ল্যানিং কমিশন তফসিলি ও জনজাতি উন্নয়নের জন্য রাজ্য বাজেটের আনুপাতিক হার নির্দিষ্ট করেছে। এর রূপায়ণে এই রাজ্যের সরকার যে ব্যর্থ বর্তমান দর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকেই টের পাওয়া যায়। বাজেটের মাত্র ৭ শতাংশ রাজ্য সরকার তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের জন্য ব্যয় করেছে। মুসলিম সম্প্রদায় ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রাজ্য সরকার তিনটি সম্প্রদায় ও অনগ্রসর শেণির উন্নয়নের ক্ষেত্রে এতখানিই উদাসীনতা দেখিয়েছে এই তিরিশ বছরে যা তাদের স্বৈরাচারের অন্যতম চিহ্ন হিসাবে পেশ করা যায়। সমস্ত দিক থেকে যা বামফ্রন্ট সরকারের ব্যর্থতাকে আরও বেশি প্রমাণ করে। এদের উন্নয়নের জন্য এতগুলো বছরে এই সরকার কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এমতাবস্থায় আগামী দিনগুলোতে এদের উন্নয়নের জন্য কতকগুলি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তৃণমূল কংগ্রেস সংখ্যালঘু, তফসিলি জাতি ও জনজাতি এবং অনগ্রসর শ্রেণির উন্নয়নে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেবে।
রাজ্যের অন্য অংশের তুলনায় পশ্চিমাঞ্চল আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। এই অঞ্চল (বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমানের কিয়দংশ এবং বীরভূম) যেখানে মোট অঞ্চলের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ হচ্ছে তফসিলি, উপজাতি সম্প্রদায়-আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। এই অঞ্চলের মানুষদের আর্থিক/সামাজিক উন্নয়নে বহুমুখী আর্থিক প্যাকেজের ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে। সিপিএম শাসিত সরকার এদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল, চিকিৎসা, সেচযুক্ত কৃষিজমি ব্যবহার, রাস্তাঘাট উন্নয়ন, বিদ্যালয় স্থাপন কোনো ক্ষেত্রেই কাজ না করার ফলে জমা ক্ষোভ আজ আন্দোলনে পর্যবসিত হয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষদের মানবিক শর্তে আর্থিক সহায়তায় সমস্যার দ্রুত সমধান করতে হবে।
মতুয়া, নমঃশুদ্র, রাজবংশী সহ জাতিগতভাবে পিছিয়েপড়া মানুষদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তফসিলি জাতি, জনজাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অঞ্চলে বিশেষ, উন্নয়ন বোর্ড গঠন করতে হবে। বাংলাভাষার উন্নয়ন সহ উর্দু, অলচিকি, সাঁওতালি, মৈথিলি, ভোজপুরি, গুরুমুখি, হিন্দি সব সমস্ত প্রাদেশিক ভাষার উন্নয়নের লক্ষ্যে ভাষা অ্যাকাডেমি ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। ভারত সরকারের আইনকে সঠিকভাবে রূপায়ণ করা হবে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প এদের জনসংখ্যার সঙ্গে যাতে সঙ্গতিপূর্ণ হয় সে ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হবে।
সৌজন্যে : জাগো বাংলা, সংখ্যা – ২২৩, ৩ এপ্রিল – ২০০৯