লিখেছেনঃ হিমাংশু কর
বিভিন্ন দেশে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত রূপকথার গল্পে সময় ভ্রমণের উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি জাপানি রূপকথায় ‘উরাশিমা তারো’ নামে এক ব্যক্তির সময় ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সুন্দর একটি গল্প আছে। গবেষকদের তথ্য মতে, উরাশিমা তারোর গল্পটি ৮ম শতকের গোড়ার দিকে (জাপানি নারা যুগে) লেখা হয়। সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। জাপানের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে এক গরিব জেলে বাস করত। লোকে তাকে উরাশিমা তারো বলেই ডাকত। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে নৌকা নিয়ে মাছ ধরার জন্য বের হতো। সমুদ্রে মাছ ধরার ব্যাপারে আগে থেকেই কিছু বলা যায় না। যেদিন ভাগ্য ভালো, সেদিন তারো অনেক মাছ পেত। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে কোলো কোনোদিন একটি মাছও জুটত না। একদিন সকালের কথা। উরাশিমা তারো মাছ ধরতে যাচ্ছে। সে দেখতে পেল সমুদ্রের ধারে কিছু দুষ্টু ছেলেমেয়ে মিলে একটি কচ্ছপকে নিয়ে খেলা করছে। কিন্তু এতে কচ্ছপটার খুব কষ্ট হচ্ছে। এসব দেখে কচ্ছপটির প্রতি উরাশিমার খুব মায়া হল। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে দুষ্টু ছেলেদের হাত থেকে কচ্ছপটিকে রক্ষা করল, আর গভীর পানিতে ছেড়ে দিল। এরপর আরেক দিনের কথা। অনেক চেষ্টা করেও সেদিন কোনো মাছ পাওয়া যায়নি। মনের দুঃখে সে সমুদ্রের পার দিয়ে হাঁটছে। এমন সময় তার মনে হলো, কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে। তাড়াতাড়ি সে পেছনে ফিরে দেখল। কিন্তু একি? কেউই তো নেই! উরাশিমা ভাবল হয়তো মনের ভুল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবারও সেই ডাক শোনা গেল। এবার সে বুঝতে পারল এটি মনের ভুল হতে পারে না। নিশ্চয় কেউ তাকে ডাকছে। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর সে হঠাৎ খেয়াল করল, ঐ দিনের সেই কচ্ছপটি পানির ওপর ভাসছে। আশেপাশে তাকিয়ে আর কাউকে পাওয়া গেল না। এবার কচ্ছপের দিকে তাকাতেই কচ্ছপটি কথা বলে উঠল- “সেদিন তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে, তোমাকে সেদিন একটা ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি।”
কচ্ছপকে কথা বলতে দেখে উরাশিমা খুব অবাক হলো। কিন্তু কচ্ছপটির সেদিকে খেয়াল নেই, সে তার ভালোমন্দ এসব খবর জানতে চাইল। উরাশিমা তাকে বলল, আমি একজন জেলে। সমুদ্রে মাছ ধরে আমার জীবিকা চলে। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার এমন হয় যে আমি কনো মাছই পাই না। সেদিন আমার খুব কষ্ট হয়। যেমন আজ এত কষ্ট করেও কোনো মাছ জালে তুলতে পারি নি।
এসব কথা শুনে কচ্ছপটি উরাশিমাকে তার পিঠে চড়ে বসতে বলল। উরাশিমা তো অবাক। উরাশিমা ভেবেছিল কচ্ছপটি বুঝি মজা করছে। তাই সে বলল, আমি কী করে তোমার পিঠে বসব? এসব শুনে কচ্ছপটি হাসতে হাসতে বলল, কোনো চিন্তা কোরো না। তুমি শুধু আমার পিঠে চড়ে বসো। আমি তোমাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব, যেখানে সবকিছুই আশ্চর্য রকম সুন্দর। তোমার অনেক ভালো লাগবে। আর তোমার কোনো অসুবিধাও হবে না। কচ্ছপের কথামতো সে তার পিঠে চড়ে বসল। তাকে পিঠে নিয়ে কচ্ছপটি সমুদ্রের গভীরে চলে যেতে লাগল। উরাশিমা অবাক হয়ে লক্ষ করল, তার নিশ্বাস নিতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর সমুদ্রের নিচে তারা একটি বিশাল প্রাসাদের সামনে এসে থামল। চকচক করছে চারদিক। সুন্দর মণিমুক্তা দিয়ে সাজানো সেই প্রাসাদ। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে আর কচ্ছপটি খুঁজে পেল না। কোথায় চলে গেল সেই কচ্ছপ?
প্রাসাদের সামনে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তার সামনে খুব সুন্দর একটি মেয়েকে দেখা গেল। উরাশিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেয়েটিই কথা বলা শুরু করল “আমি সমুদ্র দেবতার মেয়ে। তুমি যে কচ্ছপকে খুঁজছ আমিই সে। আমি মানুষের রূপ ধারণ করতে পারি, আবার কচ্ছপের রূপও ধারণ করতে পারি। সেদিন কচ্ছপের রূপে সাগরের পাড়ে খেলা করার সময় কিছু ছেলেমেয়ে আমাকে ধরে ফেলে। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমাকে বিয়ে করলে তুমি এখানে থাকতে পারবে। তোমার আর কোনো সমস্যাই থাকবে না।”
কীসব ভেবে উরাশিমা সমুদ্র দেবতার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল। পরদিন বিশাল আয়োজন করে তাদের বিয়ে হয়ে হলো। বিয়ের পর তাকে একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সে তখন এই নতুন জগতের সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। সত্যি সত্যি এখানের সবকিছুই ছিল অন্য রকম। ঘরের চারদিকে চারটি জানালা ছিল। উরাশিমা প্রথমে পূর্ব দিকে জানালাটি খুলল। বাইরে বসন্ত ঋতু চলছে। চেরি গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। গাছের পাতার আড়ালে কোকিল গান গাইছে। এবার সে উত্তরের জানালাটি খুলল। বাইরে গ্রীষ্মকাল। পাখিরা কিচিরমিচির করছে, বাগানে নানা রঙের ফুল। এরপর সে পশ্চিমের জানালা খুলে দেখল। বাইরে শরৎ কাল। গাছের পাতার রঙ বদলাচ্ছে। হরিণের ডাক শোনা যাচ্ছে। সবশেষে সে দক্ষিণের জানালাটি খুলল। সেখানে তখন শীতকাল। ঝাপসা কুয়াশা। শীতল বাতাস বইছে। একি! এইতো তার গ্রামের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। পাশে নীল সমুদ্র। এই সমুদ্রের পারেই তো সে মাছ ধরত। এই নতুন জগৎ দেখতে দেখতে তার তিন দিন কেটে গেল। এবার তার বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। দক্ষিণের জানালা দিয়ে নিজের গ্রাম দেখার সময় তার খুব নিজের গ্রামে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। বাবা-মার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করে। সে তার মনের কথা সমুদ্র দেবতার মেয়েকে খুলে বলল। কিন্তু সে তো কিছুতেই রাজি হবে না। সমুদ্র দেবের কন্যা তাকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করল, এটি কিছুতেই সম্ভব না। তুমি এই জগত থেকে ফিরে গেলে আমি আর কখনো তোমাকে দেখতে পাব না। এছাড়াও এমন কিছু সমস্যা আছে যা তোমাকে বলা সম্ভব না।
কিন্তু উরাশিমা কিছুতেই তার কথা মানতে চাইল না। খুব বেশি জেদ করায় মেয়েটি তখন তাকে নিয়ে যেতে রাজি হলো আর তার হাতে একটি রুপার বাক্স দিল। বাক্সটি একটি লাল সুতা দিয়ে বাঁধা ছিল। মেয়েটি তাকে স বার করে সতর্ক করে দিল- ‘তুমি কোনোভাবেই এই বাক্স খুলবে না।’
এবার মেয়েটি কচ্ছপের রূপ ধারণ করে তাকে তার পিঠে চড়ে বসনে বলল। ধীরে ধীরে তারা পানির উপরে চলে যাচ্ছে। সেই পাতালপুরী পার হয়ে মেয়েটি তাকে তার গ্রামের ধারে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিল। বিদায় নেবার আগে সে আরেকবার তাকে সতর্ক করে দিল, সে যেন কোনোভাবেই ঐ বাক্সটি না খোলে। পাশাপাশি বাক্সটিকে সব সময় তার সাথে রাখার জন্য অনুরোধ করল। উরাশিমা তার গ্রামের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। কিন্তু একি? তার গ্রাম কোথায়? সে তো তার গ্রামের কোনো কিছুই চিনতে পারছে না। গ্রামের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেও তারা কিছুই বলতে পারল না। কেউ কেউ বলল উরাশিমা নামে কোনো লোককে তারা চেনে না; এখানে এই নামে কেউ থাকতও না। অনেক খোঁজার পর সে এক বৃদ্ধের সন্ধান পেল। বৃদ্ধ তাকে জানাল- প্রায় ৩০০ বছর আগে উরাশিমা নামে এক লোক ছিল। একদিন সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে সে আর গ্রামে ফিরে আসেনি। ধীরে ধীরে উরাশিমা সব বুঝতে শুরু করল। সেই পাতালপুরীতে তিন দিন থাকার সময়ে এখানে প্রায় তিনশ বছর চলে গিয়েছে। সে আরও দু একদিন থেকে এলে এখানে আরও কয়েক শত বছর পার হয়ে যেত। কী আশ্চর্য ব্যাপার! ঐ পাতালপুরীতে তাহলে সময় থমকে গিয়েছিল! বাবা-মাকে দেখতে না পেয়ে উরাশিমার খুব দুঃখ হলো। কিন্তু খারাপ লাগলেও তার কিছু করার নেই। তার পরিচিত সবাই অনেক বছর আগেই মারা গিয়েছে। অচেনা পাতালপুরীতে গিয়ে সে ভবিষ্যতে ভ্রমণ করে ফেলেছে।
উপায় না দেখে সে এবার মেয়েটির সাথে দেখা করার জন্য সমুদ্রের পারে ঘুরে বেরাতে লাগল। কিন্তু কয়েক দিন পার হয়ে গেলেও কারও দেখা পাওয়া গেল না। অবশেষে রেগে গিয়ে সে ঐ বাক্সটি খুলে ফেলল। কিন্তু বাক্সটি খোলার সাথে সাথেই সে খুব অসুস্থ বোধ করতে থাকে। তার হাতপা অবশ হয়ে যেতে থাকে। এবার বাক্সটি থেকে এক ধরনের ধোঁয়া বেশ হয়ে তাকে ঘিরে ধরল। ধীরে ধীরে তার চুলগুলো সাদা হয়ে গেল। ‘চামড়া’ কুঁচকে গেল। এরপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে একজন বৃদ্ধে পার হয়ে যায়। শক্তি শেষ হয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
এটি একটি জাপানি রূপকথার গল্প, পাশাপাশি লোককাহিনী। তাই বিভিন্ন জায়গায় একে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা আছে। কিছু কিছু বর্ণনা মতে উরাশিমা এভাবেই মারা যায়। আবার কিছু বর্ণনা মতে সে প্রথমে একটি সারস পাখিতে ও পরে দেবতায় পরিণত হয়। এবং আবার তার সাথে সেই মেয়েটির দেখা হয়। গল্পটির সাথে উরাশিমার নাম যুক্ত হয় ১৫০০ সালের দিকে। কিন্তু মূল গল্পটি সেই ৮০০ সালের দিকে লেখা। ১৯১০ সালে এটি জাপানি পাঠ্যবইতে স্থান পাবার পর থেকে এটি একটি আদর্শ জাপানি লোককাহিনীর মর্যাদা পেয়ে আসছে। এসব জাপানি রূপকথার গল্প ছাড়াও বিভিন্ন মধ্যযুগীয় সাহিত্যে সময় ভ্রমণের হদিস পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন,
হিন্দু পুরানে টাইম ট্র্যাভেলের একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা