লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
২০১১ সালের গত ৬ জানুয়ারিতে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের সম্পূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ে গাের্খাল্যাণ্ড গঠনের আন্দোলন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এই তো সেদিন, বড়দিন-নববর্ষের মরশুমে ঘুরে এলাম পাহাড়ে। মরশুমের পর মরশুমে অবরোধ ও অনিশ্চয়তার পরে একটা নিশ্চিন্ত ও প্রশান্ত মরশুম। সমতল থেকে জোয়ারের ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে ট্যুরিস্ট এসেছে। কেভেন্টার্স থেকে ম্যাল পর্যন্ত মানুষের ভিড়ে হাঁটা দায়। না আছে ম্যালে, না আছে গ্লেনারিজে, না আছে কেভেন্টার্সের ছাদে কোথাও একটা বসার জায়গা। সেই ১৯৪০ থেকে দার্জিলিঙে কতবার এসেছি ও কতদিন থেকেছি তার হিসেব করতে হলে কাগজ কলম চাই। কখনও এত ভিড় দেখিনি। কিন্তু আবার গোর্খাল্যাণ্ডের জন্য আন্দোলন শুরু হলে দার্জিলিঙে আসার এই উৎসাহ কি থাকবে? অবশ্য যে কারণে গোর্খাল্যাণ্ড দাবি করা হচ্ছে সেসব কারণের তালিকায় পর্যটন শিল্পের স্থান অনেক নীচে।
তবে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সঙ্গে গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলনের সম্পর্ক যে কী তা বোধগম্য নয়। তেলেঙ্গানার অস্তিত্ব মধ্যযুগেও ছিল, প্রাচীন যুগেও ছিল। তেলেঙ্গানার গৌরবের পর্ব শুরু হয়: দ্বাদশ শতাব্দীতে কাকতীয়দের কালে। আলাউদ্দিন খিলজি তেলেঙ্গানা দখল করেন, কিন্তু ১৩৪০-এ তেলেঙ্গানা আবার স্বাধীন। কুতবশাহিরা ১৫১২ সালে আবার তেলেঙ্গানা জয় করে, তাদের কাছ থেকে ঔরঙ্গজেব ১৬৮৭ সালে জয় করেন, তাঁর মৃত্যুর পর ফারুখশিয়ার এক মুঘল সেনাপতি চিন কিলিচ খানকে নিজাম-উল-মুলক খেতাব দিয়ে তেলেঙ্গানার শাসনকর্তা করেন।
তেলেঙ্গানার রাজধানী আগে ছিল ওয়ারাঙ্গল, ১৫৮৯ সালে ইব্রাহিম কুতব শাহ হায়দরাবাদ শহরে রাজধানী স্থাপন করেন। নিজামের হাত থেকে স্বাধীন ভারত জয় করে নেয় হায়দরাবাদ ১৯৪৮এর সেপ্টেম্বরে এবং ১৯৫৬-তে অন্ধ্রপ্রদেশ গঠন করার সময় হায়দরাবাদকে করে অন্ধপ্রদেশের রাজধানী আর অন্ধ্রপ্রদেশের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় তেলেঙ্গানার স্বতন্ত্র সত্তা।
এই তেলেঙ্গানার স্বতন্ত্র সত্তাকে পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের সঙ্গে গোর্খাল্যান্ড গঠনের জন্য দাবির কোনও সম্পর্ক নেই। একটা ইতিহাসের সত্য, অন্যটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন। গোর্খাল্যান্ডের কোনও সতন্ত্র সত্তা ইতিহাসে ছিল না, ভবিষ্যতে থাকবে কি না সেটাও অজানা। যে-ক্ষেত্রটাকে গোর্খাল্যান্ড নাম দেওয়ার জন্য প্রায় তিরিশ বছর ধরে আন্দোলন চলছে সেই ক্ষেত্রটা আসলে ছিল সিকিমের অন্তর্ভুক্ত। পাশেই ছিল নেপাল। দুটি দেশের দু’রকম ধর্ম। নেপালের ধর্ম হিন্দু, সিকিমের ধর্ম বৌদ্ধ।
ধর্ম নিয়ে নয়, নানারকম আর্থনীতিক ও রাজনীতিক বিষয় নিয়ে নেপাল ও সিকিমের ঝগড়া-লড়াই লেগেই থাকত। দু-রাজ্যের মধ্যে ১৭৮০ থেকে যে যুদ্ধ শুরু হয় তা চলে ত্রিশ বছর ধরে। আগে ১৮১৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নেপালের সঙ্গে সুগাউলির চুক্তিতে ভারত নেপালের সীমানা স্থির করেছিল। এবারে ১৮২৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সালিশিতে দু’পক্ষের মধ্যে তেঁতুলিয়ার সন্ধি হয়। সন্ধির বাস্তবায়নের কাজে ক্যাপ্টেন লয়েড সিকিমের অন্তর্গত দার্জিলিঙে এসে দেখেন জায়গাটা ইংরেজদের বিশ্রাম করা ও স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করার জন্য বিশেষ অনুকূল। গ্রীষ্মকালে ইংল্যান্ডে না গিয়ে এখানে এলেও হয়।
১৮৩৫ সালে সিকিমের মহারাজার সঙ্গে কথা বলে ক্যাপ্টেন লয়েড এখানে একটা স্বাস্থ্যনিবাস বানালেন। এতজন সাহেব থাকবে এখানে। তাদের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী তৈরি করা হল, আর তাদের জন্য বানানো হল সেনাবাস। অতঃপর ১৮৪৬ সালে মহারাজার সঙ্গে ইংরেজদের বন্দোবস্ত হল— বছরে ছ’হাজার টাকা শুল্ক বা ভাড়া দেবে মহারাজকে। ১৮৫২-র বর্মা যুদ্ধে এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহি অভ্যুত্থান দখলে এই গােখা বাহিনী ছিল ইংরেজদের বিপুল সহায়।
উনবিংশ শতাব্দীর যখন শেষ সূযাস্ত হল লেপচা জগতে তখন ইংরেজদের স্বার্থে দার্জিলিং পাহাড়ের জনবিন্যাস পাল্টে গেছে— বৌদ্ধ লেপচারা সংখ্যালঘু আর হিন্দু নেপালিরা সংখ্যাগুরু হয়ে গিয়েছে। কীভাবে ব্রিটিশরা নেপাল থেকে হিন্দু সেনাদের তথা গোর্খাদের আমদানি করে সিকিম ও তারপরে তিব্বত দখলের পরিকল্পনা করেছিল তা নিয়ে ‘বেয়নেট টু লাসা’ নামে এক চমৎকার উপন্যাস লিখেছেন পিটার ফ্লেমিং। মোদ্দা ব্যাপারটা এই হল, যে দার্জিলিং ছিল সিকিমের লেপচাদের সেই দার্জিলিং ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে হল নেপালি ও বাঙালিদের এবং প্রশাসনিক কারণে হল বাংলার একটা জেলা। ব্রিটিশদের চলে যাওয়া ও দেশভাগে দার্জিলিং জেলা হল পশ্চিমবাংলার অন্তর্গত।
১৯৫০-এ ভারত ও নেপালের মধ্যে একটা চুক্তি হয়। এই চুক্তির ৭নং ধারা অনুসারে নেপালিরা অবাধে ভারতে আসতে, রোজগার ও বসবাস করতে পারবে, আবার ভারতীয়রাও নেপালে গিয়ে রোজগার ও বসবাস করতে পারবে। যেখানে রোজগারের সুযোগ ও বসবাসের আরাম বেশি সেখানেই মানুষ বেশি যায়, যেমন গ্রামের মানুষ আসে শহরে। এই সহজ কারণে যে হারে ভারতীয়রা নেপালে যেতে লাগল তার চেয়ে অনেক বেশি হারে নেপালিরা ভারতে এবং বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবাংলায় ও অসমে আসতে লাগল। এবং পঞ্চাশের দশকে যারা এসেছিল তাদের সন্তানসন্ততিরা সত্তরের দশকে হয়ে গেল নেপালি তথা গোর্খালিভাষী এক বিপুল জনসমষ্টি।
এখানে বলে রাখি যে ১৯৫০-এর চুক্তির আট নং ধারাতে ১৮৯৬-র সুগাউলি চুক্তি খারিজের ব্যবস্থা আছে, অর্থাৎ ভারত-নেপাল সীমানা নতুন করে নির্ধারণের দাবি যে কোনও দিন উঠতে পারে। তখন নেপাল অনায়াসে দাবি করতে পারে যে ইউপি ও বিহারের উত্তরাংশ আসলে নেপালের অংশ।
ইতিমধ্যেই দার্জিলিং পাহাড়ের পাদদেশের তথা ডুয়ার্সের যেসব স্থানে পঞ্চাশ বছর আগেও রাজবংশী ও অন্যান্য আদিবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল সেসব স্থানে নেপালিদের সংখ্যা বিপুল বৃদ্ধি পেয়েছে, কোথাও কোথাও তো তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। যেমন হয়েছে সিকিমে। একদা সিকিমে লেপচা-ভুটিয়ারাই ছিল প্রধান বাসিন্দা। সিকিমকে ভারতভুক্ত করার জন্য ষাটের দশকের মাঝামাঝি দলে দলে নেপালিদের সিকিমে প্রবেশ ঘটল, আন্দোলন শুরু হল মহারাজকে হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। সত্যি-মিথ্যে জানিনে, শুনেছি কোম্পানি মানে ভারত সরকার নাকি যথেষ্ট টাকা দিয়ে নেপালিদের পাঠিয়েছিল সিকিমে আর তখন নেপাল থেকেও বহু নেপালি দার্জিলিঙের ভিতর দিয়ে সিকিমে গিয়ে সেখানকার জনবিন্যাসকে পাল্টে দেয়। তার ফলে ১৯৭৫এর মে মাসে সিকিম হল ভারতের একটি রাজ্য। এ জন্যই সত্যজিৎ রায়ের সিকিম’ ছবির উপরে নিষেধাজ্ঞা ছিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে দার্জিলিং ও ডুয়ার্সের কতকাংশে যদি নেপালিরা বা গোর্খালিভাষীরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে থাকে আর তারা যদি স্বতন্ত্র একটা রাজ্য চায়, তা হলে তাদের দাবি মানা হবে কি না। স্থানীয় বাসিন্দাদের এরকম দাবি মেনে ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড প্রভৃতি রাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে। গণতন্ত্রের শর্ত অনুসারে স্থানীয় অধিবাসীদের আবেগ ও আন্দোলনের দাবি কি মেনে নেওয়া উচিত নয়? কিন্তু যেভাবে উত্তরবাংলার বহুস্থানে নেপালিদের সম্প্রসারণ ঘটেছে এবং ঘটছে তাতে প্রস্তাবিত গোর্খাল্যাণ্ডের সীমানা কী হবে? ১৯৫০-এর চুক্তি অনুসারে নেপালিদের অবাধে ভারতে প্রবেশের অধিকার বহাল থাকলে নেপালিরা অদূর ভবিষ্যতে জলপাইগুড়ির বহুস্থানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে। শুনেছি ইতিমধ্যে নেপালের সীমানা সম্প্রসারণের আন্দোলন শুরু হয়েছে নেপালে। গোর্খাল্যাণ্ড গঠন ও নেপাল সম্প্রসারণ এই দুটোর মধ্যে কোনও সম্পর্ক থাক বা না থাক, নেপাল ও নেপালিদের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত সমস্যাগুলোকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা না করে আশু সমাধান করা প্রয়োজন। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?
ভাষা মানে জনগোষ্ঠীর আবেগ ও আত্মা