লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
কঙ্গনা রানাউত অভিযোগ তুলেছেন সুশান্ত সিং রাজপুত নাকি নেপোটিজম এর শিকার, আর বলিউডে কাস্টিং হয় শুধুমাত্র নেপোটিজমের ভিত্তিতে। অথচ আপনি কি জানেন এই কঙ্গনা রানাউত এক সময় সুশান্ত সিং রাজপুতের সাথে কাজ করতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি কোন নতুনের (স্ট্রাগলার) সাথে অভিনয় করতে চান না। সেই কঙ্গনা আজ অভিযোগ তুলেছেন যে সুশান্ত সিং নাকি নেপোটিজমের শিকার।
অপরদিকে কঙ্গনা প্রতিদিন নিত্য নতুন ভিডিও রিলিজ করে শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরেকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে হুমকি দিচ্ছেন অথচ ২০১৯ এর মহারাষ্ট্র ভোটে কঙ্গনা উদ্ধব ঠাকরেকেই ভোট দিয়ে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হতে সাহায্য করেছেন। একজন সাংবাদিক যখন কঙ্গনাকে প্রশ্ন করে, শিবসেনা যদি এতই খারাপ হয় তাহলে ২০১৯ এর ভোটে সে শিবসেনাকে ভোট দিল কেন? কঙ্গনা এর উত্তরে বলেন, বিজেপিকে ভোট দেবার কোন বটন সেই বুথে ছিল না। সেই সাংবাদিক যখন প্রমাণ করে দেন উক্ত বুথে বিজেপিকে ভোট দেবার বটন ছিল তখন প্রকাশ্যে নিজস্ব টুইটার হ্যাণ্ডেলে কঙ্গনা উক্ত সাংবাদিককে হুমকি দিয়ে বসেন এবং পরে ফেঁসে যাবার আশঙ্কায় টুইট ডিলিটও করে দেন। এই হল কঙ্গনা রানাউতের চরিত্র।
কঙ্গনা রানাউত তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে কিছুদিন আগে একটি টুইট করেছিলেন জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে অথচ তার ঠিক দুই তিন দিন পরেই নিজেকে ক্ষত্রিয় বলে গর্ব প্রকাশ করেছেন। কি চরম হিপোক্রেসি না?
এবার আসি নেপোটিজম প্রসঙ্গে। যে নেপোটিজমের ফেনা তুলে কঙ্গনা রানাউত সমগ্র বলিউড ইন্ডাস্ট্রীটাকেই কাটগড়ায় খাড়া করতে চাইছেন তা যে আদ্যোপান্তই মিথ্যা তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ কঙ্গনা রানাউতের চোদ্দ পুরুষের বলিউডের সঙ্গে যুক্ত নেই, তিনিও একজন সাধারণ বাড়ি থেকে উঠে এসে বলিউডে সফলতার মুখ দেখেছেন। তাঁর সফলতার জন্য আমির খান, সলমন খান, ঋত্বিক রোশন, রাকেশ রোশন, মহেশ ভট্ট, মুকেশ ভট্ট প্রভৃতিরা তাঁকে সাহায্য করেছেন। এই কথা অন্য কেউ নয় স্বয়ং কঙ্গনা নিজের মুখে স্বীকার করেছেন। বিশ্বাস না হলে ইন্টারনেটে তাঁর পুরোনো ভিডিও দেখুন অনায়াসে দেখতে পেয়ে যাবেন।
শুধু কঙ্গনা রানাউত নয় বলিউডের সিংহভাগ অভিনেতা – অভিনেত্রী কলাকুশলী ও ইন্ডাস্ট্রীর বাইরে থেকে এসে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে নিজের পরিচয় তৈরি করেছেন। যেমন নাওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি, রাজকুমার রাও, সিদ্ধার্থ মলহোত্রা, মনোজ বাজপেয়ী, নাসীরুদ্দিন শাহ, অমৃশ পুরী, ওম পুরী, দিলিপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, অক্ষয় কুমার, বিদ্যা বালান, আয়ুস্মান খুরানা, অনুস্কা শর্মা, দিপিকা পাদুকোন, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, ঐশ্বর্য রায়, জন আব্রাহাম, ইরফান খান, রনদ্বীপ হুডা, রনবীর সিং, বিদ্যুত জামওয়াল, বোমান ইরানী, রাধিকা আপ্তে, বিপাশা বাসু, জেনেলিয়া দেশমুখ, হুমা কুরেইশী, জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজ, জুহি চাওলা, ক্যাটরিনা কাইফ, মাধুরী দিক্ষিত, মোনিসা কৈরালা, নেহা ধুপিয়া, প্রীতি জিন্টা, রিচা চাড্ডা, উর্মিলা মাতোণ্ডকর, কৃতি স্যানন, তাপসী পান্নো, স্বরা ভাস্কর, মিঠুন চক্রবর্তী, সুনিল শেঠি, সোনালি বেন্দ্রে, মমতা কুলকার্ণি, শিল্পা শেঠি, সুস্মিতা সেন, অর্জুন রামপাল, লারা দত্ত, প্রাচী দেশাই, কার্তিক আরিয়ান, ভুমি পেডনেকর, ইয়ামি গৌতম প্রভৃতি। এঁদের ছাড়াও অসংখ্য এমন বলিউড অভিনেতা অভিনেত্রী রয়েছেন যাঁদের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কেউ বলিউডের সাথে যুক্ত নন। তাঁরা নিজেদের দক্ষতার মাধ্যমেই বলিউডে বিশেষ স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছেন।
অপরদিকে আমির খান, সলমন খান, অনিল কাপুর, ইমরান হাশমী, সানি দেওল, সঞ্জয় দত্ত, করিশ্মা কাপুর, কাজোল, অজয় দেবগন, ঋত্বিক রোশন প্রভৃতিরা যে বলিউডে সফলতা অর্জন করেছেন তা তাঁরা নিজেদের দক্ষতার মাধ্যমেই অর্জন করেছেন। পিতা মাতার পরিচয়ে সহজে বলিউডে পদার্পণ করলেও তাঁরা যে যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অন্যদিকে অনেক এমন অভিনেতা রয়েছেন যাঁরা আত্মীয় স্বজনের বদৌলতে সহজে বলিউডে পদার্পণ করলেও পরবর্তিকালে ইন্ডাস্ট্রী থেকে ছিটকে গেছেন। তাঁদের নাম নিতে চাইছি না একটু কষ্ট করে বলিউড সম্পর্কে খোঁজ নিলে সহজেই জানতে পারা যাবে যে তাঁরা কারা?
সুতরাং কঙ্গনা রানাউত যে বলেছেন, বলিউডে শুধুমাত্র নেপোটিজমের মাধ্যমেই কাস্টিং হয় তা আদ্যোপান্তই মিথ্যা।
তবে একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে বলিউড একেবারেই নেপোটিজম শূন্য। এরকম নেপোটিজম সব ক্ষেত্রেই রয়েছে। বাবা-মা যদি বড় ডাইরেক্টার বা প্রোডিউসার হন আর যদি তাঁদের ছেলে বা মেয়ে অভিনয়কে নিজেদের ক্যারিয়ার হিসাবে বেছে নিতে চান তাহলে বাবা মা নিজেদের ছেলে – মেয়েকে প্রোমোট করবেন এটাই স্বাভাবিক। এই নেপোটিজম কোন দিনই খতম করা সম্ভব নয়। তবে যদি সেইসব ছেলে মেয়েদের নিজস্ব দক্ষতা না থাকে তাহলে খুব তাড়াতাড়ি তাঁরা ইন্ডাস্ট্রী থেকে ছিটকে যাবেন এমন ইতিহাসও কিন্তু বলিউডে বিরল নয়।
পিকচার এখানেই শেষ নয়। আপনারা সকলেই জানেন কাদের খান বলিউডের একজন বর্ষীয়ান অভিনেতা চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা। কাদের খানের লেখা অসাধারণ সংলাপগুলি চলচ্চিত্রকে একটি অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। কাদের খানের লেখা সেই অসাধারণ সংলাপগুলি আউড়ে আমাদের শতাব্দীর মহানায়ক অমিতাভ বচ্চন তাঁর অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ইমেজটিকে ধরে রেখেছিলেন। সেই কাদের খানকেই শেষ দিকে অমিতাভ বচ্চন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি থেকে বাদ চলে যাওয়ার জন্য দায়ি ছিলেন।
কাদের খান অমিতাভ বচ্চনকে ‘অমিত’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, ‘স্যার’ বলেন নি তাই অহঙ্কারবশতঃ অমিতাভ বচ্চন তাঁকে বলিউড থেকে বিদায় করার চেষ্টা করেছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। অথচ কাদের খান অমিতাভ বচ্চনের থেকে ৫ বছরের বড় এবং একসময় তিনি অমিতাভ বচ্চন কাদের খানকে বন্ধু বলেই মনে করতেন। সুতরাং বন্ধু অমিতাভকে কাদের খান ‘স্যার’ না বলে ভালবেসে ‘অমিত’ বলাকেই স্বাচ্ছন্দবোধ করেছেন। অথচ বচ্চন সাহেবের এই সম্বোধন পছন্দ হয়নি। যাঁর অসাধারণ সংলাপ আউড়ে অমিতাভ বচ্চন একসময় বহু ব্লক বাস্টার হিট সিনেমা করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন তাঁর ক্যারিয়ারকেই শেষ পর্যন্ত বচ্চন সাহেব খতম করে দিয়েছেন। নিজের আত্মীয়স্বজনকে সিনেমায় আগে সুযোগ দেওয়া যদি নেপোটিজম হয় তাহলে রাজনীতি করে একজন সফল অভিনেতাকে ইন্ডাস্ট্রি থেকে বের করে দেওয়াকে কোন ‘ইজমের’ আওতায় ফেলবেন?
কঙ্গনা রানাউত যে নেপোটিজম নিয়ে বলিউডে হুলস্থুল ফেলে সস্তায় পাবলিশিটি অর্জনের চেষ্টায় মেতে রয়েছেন তাঁকে বলি নেপোটিজম কোথায় নেই বলুন তো? যুগযুগ ধরে যে ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থা অব্রাহ্মণদের পাঠশালায় এবং মন্দিরে ঢুকতে দেয় নি, সেটা কি নেপোটিজম নয়? যুগ যুগ ধরে শূদ্রদের ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করতে দেওয়া হয়নি এবং কেউ যদি স্পর্শ করেছে বা বেদ মন্ত্র উচ্চারণ করেছে বা শুনেছে তাদের কানে উত্তপ্ত সীসা ঢেলে দেওয়া হয়েছে সেটা কি নেপোটিজম নয়? পৃথিবীর ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে রাজার ছেলেই রাজা হয়েছে সেটা কি নেপোটিজম নয়? অস্পৃশ্য বলে দেশের ৩০% মানুষ কে গ্রামের পুকুরের জল মুখে দিতে দেওয়া হয় নি, সেটা কি নেপোটিজম নয়? কেবলমাত্র ব্রাহ্মণরাই মন্দিরের পুজারী নিযুক্ত হবে আর অব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণদের গোলামী করবে সেটা কি নেপোটিজম নয়? শ্রীরাম চন্দ্র শুধুমাত্র শিক্ষা অর্জন করার অপরাধে একজন শূদ্রের মুণ্ডচ্ছেদ করেছিলেন সেটা কি নেপোটিজম ছিল না? সৌদি আরবের কিং সলমানের ছেলে মুহাম্মাদ বিন সলমানকে সৌদি আরবের রাজা করা হল সেটা কি সেটা কি নেপোটিজম নয়? এইসব নেপোটিজমের বিরুদ্ধে কেই কি আওয়াজ তুলেছেন?
এবার ভারতীয় রাজনীতির দিকে লক্ষ্য করুন। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দোপাধ্যায় পার্টির সর্বময় কর্তা সেজে বসে আছেন সেটা কি নেপোটিজম নয়? গ্রামে গঞ্জে দেখা যায় তৃণমূল করলে সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামের বাসিন্দাকে বাড়ি দেওয়া হবে না করলে দেওয়া হবে না, এটা কি নেপোটিজম নয়? বর্তমান ভারতের গৃহমন্ত্রী তড়িপার অমিত শাহের ছেলে জয় শাহ Board of Control for Cricket in India এর সেক্রেটারী হয়ে বসে আছেন অথচ ক্রিকেট খেলার বিন্দুমাত্র জ্ঞান তাঁর মধ্যে নেই সেটা কি নেপোটিজম নয়? বিজেপির কপিল মিশ্রা, অনুরাগ ঠাকুর দিল্লিতে উস্কানীমূলক ভাষণ দিয়ে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা বাদিয়ে দিলেন অথচ তাঁদের নামে কোন চার্জশিট হল না সেটা কি নেপোটিজম নয়? মুকুল রায় সহ অনেক নেতা যখন তৃণমূলে ছিলেন তখন তাঁরা দুর্নীতিবাজ, চোর প্রভৃতি ছিলেন যেমনি তাঁরা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে চলে গেলেন তেমনি তাঁরা ধোয়া তুললী পাতা হয়ে গেলেন, এগুলো কি নেপোটিজম নয়?
সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর যিনি মালেগাঁও বোমা বিস্ফোরণ, সমঝোতা এক্সপ্রেসে বোমা বিস্ফোরণ, দিল্লি সিরিয়াল বোমা বিস্ফোরণ, নানদেড়ে বোমা বিস্ফোরণ প্রভৃতি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত ছিলেন, তার জন্য তিনি দীর্ঘদিন জেলও খেটেছেন। সুপ্রীম কোর্টে তাঁর জঙ্গীবাদকে তিনি স্বীকারও করেছেন। অথচ তিনি যখন জমিনে জেল থেকে বেরোলেন তখন তাঁকে লোকসভার টিকিট দিয়ে সাংসদ (এমপি) বানিয়ে দেওয়া হল, এটা কি নেপোটিজম নয়? স্বাধীনতার পর কংগ্রেসের উপর একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করেছে গান্ধী পরিবার। পরিবারতন্ত্র এতটাই প্রবল হয়ে পড়ে যে সোনিয়া গান্ধীর পর রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি হন। আচ্ছা এগুলো কি নেপোটিজম নয়?
‘পদ্মাবত’ সিনেমাটিতে অভিনয় করার জন্য দিপিকা পাদুকোনের নাক কেটে নেবার হুমকি দিয়েছিল কর্ণী সেনা। অথচ তখন তাঁকে কেন্দ্র সরকার সুরক্ষার কোন বন্দোবস্ত করেনি। কিন্তু বিজেপির পক্ষপাতি কঙ্গনা রানাউত শুধুমাত্র টুইটারে ভুয়া দাবী করলেন যে তাঁর নাকি প্রাণ নাশের আশঙ্কা রয়েছে তেমনি হোম মিনিস্ট্রি কঙ্গনাকে Y ক্যাটাগরির সুরক্ষার ব্যবস্থা করে দিল। এটা কি নেপোটিজম নয়? ৮ টা এয়ারপোর্ট ম্যানেজমেন্ট দেওয়া হবে, ৬ টা আদানি, ২ টো আম্বানি। নেপোটিজম নয়? একের পর এক সি পোর্ট চলে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বন্ধুস্থানীয় আদানিদের হাতে, এটা নেপোটিজম নয়? সরকারী সংস্থা বি এস এন এল কে কার্যত মেরে ফেলে মোদীজির প্রিয় বন্ধু মুকেশ আম্বানীর জিওর জায়গা তৈরি হচ্ছে, এগুলো কি নেপোটিজম নয়? নেপোটিজম কেবল মুম্বাই হলিউডে? এই প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?