লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
আমরা কাজী নজরুল ইসলামকে একজন ‘বিদ্রোহী কবি’ ও যুগশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবেই বেশী চিনি। অথচ আমরা অনেকেই জানি না তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক, সঙ্গীতকার, সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা, গায়ক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, পৃষ্ঠপোষক, প্রযোজক ও সংগঠক হিসেবে অর্থাৎ তিনি চলচ্চিত্রের মানুষ হিসেবে পেয়েছেন অভুতপূর্ব সাফল্য।
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, নাটক, বেতার, গ্রামোফোন ও চলচ্চিত্র প্রভৃতিতে তিনি সমানভাবে কাজ করেছেন এবং তাঁর প্রতিভার দানে সব ক্ষেত্রই সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি নিজেই নিজের জন্য লিখেছেন ‘বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর’।
নজরুল ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা একটা চিঠিতে ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্র দেখার আগ্রহ জানিয়েছিলেন। ‘দেবদাস’ ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিত সেকালের তরুণ- তরুণীদের অতি প্রিয় উপন্যাস। ওই উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রের রূপ দেন নরেশ মিত্র। দেবদাস মুক্তি পায় ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। নির্বাক দেবদাস দেখার জন্য নজরুলের মধ্যেও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল নিশ্চয়ই। সে কারণেই নজরুল দেবদাস দেখার তথ্যটি তার প্রিয় বন্ধু কাজী মোতাহারকে চিঠি লিখে জানাতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। আবার দেবদাস নির্মিত হয় ১৯৩৫ সালে প্রমথেশ বড়ুয়ার পরিচালনায়। তখন তিনি সবাক দেবদাস দেখেছিলেন কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি।
নিতাই ঘটকের স্মৃতি থেকে জানা যায়, ১৯৩০-এর দশকে নজরুল সেকালের বিখ্যাত ইংরেজি চিত্র ‘পেগান লাব সং’ দেখতে গিয়ে এর নায়ক র্যামন নোভারোর কণ্ঠে ‘কাম টু মি হোয়ার দি মুনস বিমস’ গান শুনে মুগ্ধ হন এবং বাড়ি ফেরার পথেই মুখে মুখে তিনি রচনা করেন সেই বিখ্যাত গান ‘দূর দ্বীপবাসিনী চিনি তোমারে চিনি’র প্রথম পর্ব। এতে বোঝা যায় চলচ্চিত্রের প্রতি নজরুলের ছিল তীব্র আকর্ষণ।
কাজী নজরুল ইসলাম মোট কতগুলো চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তা এখনো পুরোপুরি বলা সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে ভিত্তিতে দেখা যায় যে কাজী নজরুল ইসলাম ২০টি সিনেমায় প্রত্যক্ষ ও ২১ টি সিনেমায় পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন।
সাধারণত বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যিকের রচনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু কবি কাজী নজরুল ইসলামের গল্প ও উপন্যাস নিয়ে যেমন বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তেমনি তিনি নিজেও সরাসরি যুক্ত ছিলেন অনেক চলচ্চিত্রের সঙ্গে। শুধু তাই নয়, তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছেন। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের নাম ‘ধূপছায়া’। এই ‘ধূপছায়া’তে দেবতা বিষ্ণুর চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছেন।
ত্রিশ দশকের শুরুতে কাজী নজরুল ইসলাম নিজের গাওয়া ও সুরারোপিত গানের জন্য বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সে সময় চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন এবং যেসব শিল্পীরা সিনেমায় গান গাইবেন তাদের গান শেখানো এবং যেসব অভিনেতা ও শিল্পী অভিনয় করবেন ও গান গাইবেন তাঁদের শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানোর দায়িত্ব পালন করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ত্রিশের দশকে নজরুল পার্শি মালিকানাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাডান থিয়েটার্স প্রযোজনা সংস্থার ‘সুর ভাণ্ডারী’ পদে নিযুক্ত হন। এই পদটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, গান লেখা ও সুর করারও দায়িত্ব পালন করতে হত। ‘ম্যাডান থিয়েটার’সে ‘সুর ভাণ্ডারি’ হিসেবে নজরুলের যোগদানের পরই পরীক্ষামূলকভাবে ৩০-৪০টি সবাক ও খণ্ডচিত্র নির্মিত হয়। ১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’তে সুর ভান্ডারীর কাজ করেন নজরুল। নজরুলের সুরভাণ্ডারি নিযুক্ত হওয়ার সংবাদটি কলকাতার দৈনিক ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় ১৯৩১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ছাপা হয়। তাতে লেখা হয়,
“ম্যাডান থিয়েটারস লিমিটেড বাঙ্গালা গানের টকি নির্মাণ করিতেছেন। প্রসিদ্ধ কবি ও সঙ্গীতকার নজরুল ইসলামকে সুর ভাণ্ডারী নিযুক্ত করিয়াছেন। তাহাদের এ মনোনয়ন যথার্থ হইয়াছে, কারণ অধুনা বাংলার তরুন কবিদের মধ্যে নজরুল ইসলাম রচয়িতা ও সুরকার হিসেবে শ্রেষ্ঠ। বর্তমানে কিছুকাল ম্যাডান কোম্পানী নট নটীদের স্বর পরীক্ষার জন্য কেবল গান আবৃত্তির সবাক চিত্রই নির্মাণ করিবে।”
ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির আরও যেসব চলচ্চিত্রের সঙ্গে নজরুল যুক্ত ছিলেন সেই ছবিগুলো হল, ‘জ্যোৎস্নার রাত’ (১৯৩১), ‘প্রহল্লাদ’ (১৯৩১), ‘ঋষির প্রেম’ (১৯৩১), ‘বিষ্ণুমায়া’ (১৯৩২), ‘চিরকুমারী’ (১৯৩২), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৯৩২), ‘কলঙ্ক ভঞ্জন’ (১৯৩১), ‘রাধাকৃষ্ণ’ (১৯৩৩) এবং ‘জয়দেব’ (১৯৩৩) প্রভৃতি।
১৯৩১ সালে মুম্বাই ও কলকাতায় সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। মুম্বাইয়ে নির্মিত হয় উপমহাদেশের প্রথম সবাক কাহিনীচিত্র ‘আলম আরা’ ও কলকাতায় ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির উদ্যোগে নির্মিত হয় প্রথম সবাক বাংলা কাহিনীচিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’। ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির উদ্যোগে কলকাতায় প্রথম নির্বাক বাংলা ছবি ‘বিল্বমঙ্গল’ নির্মিত হয় ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে। ম্যাডান থিয়েটারসই ১৯৩০-৩১ সালে প্রথম সবাক বাংলা সিনেমা নির্মানের উদ্যোগ নেয় বাণিজ্যিক কারণে। তখন সুর ভান্ডারীর কাজ করেন নজরুল। ১৯৩১ সালে বাংলা সবাক চিত্র ‘জলসা’য় নজরুল নিজের একটি গান গেয়েছিলেন এবং ‘নারী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন। ১৯৩৩ সালে নির্মিত ‘কপাল কুণ্ডলা’র যুক্ত ছিলেন গীতিকার হিসেবে।
ম্যাডান থিয়েটার্সের অন্যতম অংশীদার ছিলেন মিসেস পিরোজ ম্যাডান। তিনি পায়োনিয়ার ফিল্মস প্রযোজনা সংস্থা স্থাপন করেন ১৯৩৩ সালে। এই প্রযোজনা সংস্থা থেকে ১৯৩৪ সালে ‘ধ্রুব’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘ধ্রুব চরিত’ অবলম্বনে নির্মাণ করা হয় ‘ধ্রুব’ সিনেমাটি। সঙ্গীতবহুল মেলোড্রামা ‘ধ্রুব’ সিনেমাটিতে ১৮টি গানের মধ্যে ১৭টি গান ছিল নজরুলের লেখা এবং তিনি এর সঙ্গীত পরিচালনাও করেন। তিনি দেবর্ষি নারদের চরিত্রে অভিনয় করেন এবং একটি গানে কণ্ঠও দেন। এই ছবিটি সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনাও করেন নজরুল।
স্বর্গের সংবাদবাহক এবং দেবর্ষি নারদের কথা ভাবলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে জটাধারী, লম্বা দাড়ি বিশিষ্ট বৃদ্ধ একজনের চেহারা। আমরা বিভিন্ন সিনেমা বা নাটকে দেবর্ষি নারদকে এই চেহরাতে দেখেই অভ্যস্ত। সেই ইমেজ সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে দেখা গেল এক সুদর্শন যুবককে। চুড়ো করে বাঁধা ঝাকড়া চুল, তাতে ফুলের মালা, ক্লিন শেভড, পরনে সিল্কের লম্বা কুর্তা, গলায় মালা, হাসি হাসি মুখ। চলচ্চিত্রের পর্দায় এভাবেই নারদরূপে আবির্ভূত হলেন নজরুল। সেখানে অনবদ্য অভিনয় করেন কাজী নজরুল। একজন পোড় খাওয়া অভিনেতার থেকে কোন অংশে কম যাননি তিনি। অসাধরণ চোখ মুখের অভিব্যক্তি (এক্সপ্রেশন) দিয়ে অভিনয় করেন নজরুল। ‘ধ্রুব’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি মাসে।
নারদ চরিত্রের পৌরাণিক ইমেজ ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছিলেন নজরুল। ফলে নজরুলের সাজসজ্জা নিয়ে পত্রিকায় সমালোচনা হয়।
‘ধ্রুব’ সিনেমাটির নজরুলের মেকআপ ও কস্টিউমের ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন সেই সিনেমার সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ও অভিনেতা নিত্যানন্দ ঘটক ওরফে নিতাই ঘটক। তিনি বলেছেন,
“বিদ্রোহী কবি এই চিরাচরিত প্রথার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করলেন। তিনি এই অশীতিপর নারদকে আটাশে নামিয়ে আনলেন। এতোদিনের বার্ধক্যপীড়িত নারদ এবার হলেন তরুন যুবক। পরনে তার সিল্কের পাড়ওয়ালা গুটানো ধুতি, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবী, মাথায় সুদৃশ্য চুড়া, তাতে ফুলের মালা জড়ানো, হাতে একতারা, পায়ে খড়ম – এ এক অপূর্ব নয়ন মনোহারী নারদ; দেখলে আর চোখ ফেরানো যায়না। বইখানি মুক্তি পাবার পর কাগজে আলোচনার ধুম পড়ে গেল।… এ কীরকম নারদ! এ যে দেখি ফিটফাট জামাইবাবু।” (নিতাই ঘটক, চলচ্চিত্রে নজরুলঃ স্মৃতির আলোয়, নজরুল একাডেমি পত্রিকা, হেমন্ত সংখ্যা, ১৯৯৩ ঢাকা)
একজন মুসলমান যুবক নারদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলে সেসময় বেশ বিতর্কও হয়েছিল। তার উপর বৃদ্ধ নারদের চিরাচরিত বেশ ভুষা পরিবর্তন করে দেওয়া। অনেকটা আগুনে ঘি ঢেকে দেওয়ার মত অবস্থা হয়েছিল। তবে নজরুল এইসব উটকো সমালোচনাকে পাত্তা দেননি। নজরুল জবাবে বলেন,
“আমার নতুন সাজে অনেকেই আতঙ্কিত হয়েছেন কিন্তু নারদের বয়সের উল্লেখ কোথাও কি আছে? তাঁকে বৃদ্ধ বৈরাগী বেশে দেখানো হয়েছে কোন প্রমাণের উপর নির্ভর করে? বরং তাঁকে চিরতরুণ রূপেই সকলের জানা আছে। আমি চিরতরুণ ও চির সুন্দর সকলের প্রিয় নারদেরই রূপ দেবার চেষ্টা করেছি।”
‘ধ্রুব’ সিনেমাটির চিত্রনাট্য যাত্রা বা থিয়েটারের ভঙ্গিতে লেখা হয়েছিল। এবং সেই ভঙ্গিমাতেই অভিনয় করা হয়। নজরুল নারদের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সেটাই ছিল সিনেমাটির মূল আকর্ষণ। সিনেমাটি বহুদিন হাউস ফুল ছিল। আর সারওয়ার হোসেন লিখেছেন,
“১৯৩৩ সাল। কলকাতার বড় দিনের আসর মাতিয়ে তুলেছে দেবকী বাবুর ‘চণ্ডীদাস’। দেখতে ছুটে গেলাম দেশ থেকে, পথে দেখলাম বড় একটা প্রচারপত্র তাতে সে যুগের বাংলা ছবি পায়োনিয়ার ফিল্মস-এর ‘ধ্রুব’এর বিজ্ঞাপন দেওয়া। ভুমিকায় কারা ছিলেন ঠিক মনে নেই, যুগ্ম পরিচালক ও নারদের ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলামের নাম কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে। সে যুগে ফিল্মে-রেডিওতে দুরের কথা রেকর্ডেও বাঙ্গালী মুসলমান বলতে করোর নাম ছিল না। দু-একজন যারা ছিলেন তারাও আত্মগোপন করেছিলেন ছদ্মনামে। সুতরাং মুসলমানের সঠিক নাম দেখেই আমার কৌতূহল হল। ‘ধ্রুব’ দেখলাম এবং কাজী সাহেবকেও দেখলাম চিরকুমার নারদ রূপে, মানে ‘ক্লীন সেভড’ নারদ। সে যুগে এ কথাই শুধু মনে হত বাঙ্গালী মুসলমান হয়ে কাজী সাহেব কি করে এতটা সাহস পেলেন।” (চিত্র শিল্পে নজরুল, সিনেমা, মে, ১৯৫৩, ঢাকা।)
সিনেমাটির সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ও অভিনেতা নিতাই ঘটক বলেছেন,
“দুটি চুক্তি পত্রই (ধ্রুব ছবির) পড়ে দেখলাম, কবির পত্রে লেখা আছে, যতদিন ছবির মিউজিক গ্রহণের কাজ চলবে তিনি মাসিক ৫০০ টাকা করে পাবেন, আর আমার মাত্র চুক্তি মাসিক ৫০ টাকা মাত্র একই সময়ের জন্য। এরপর এক অদ্ভুত অনুরোধ এল ম্যাডান কোম্পনীর প্রোপাইটার ফ্রামজী ম্যাডান সাহেবের কাছ থেকে; তিনি কবিকে এই ছবিতে ‘নারদ’ এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বললেন, তার ধারণা এতে বক্স অফিসের আকর্ষণ বাড়বে।”
ম্যাডান থিয়েটার্স প্রযোজনা সংস্থা বিভিন্নভাবে নজরুলের সাথে প্রাপ্য পারিশ্রমিক নিয়ে প্রতারণা করে। ফলে নজরুল ১৯৩৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। এরপর নজরুল আর নির্দিষ্ট প্রযোজনা সংস্থায় আবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা ও গান লেখার কাজে জড়িত হয়ে পড়েন।
ম্যাডান থিয়েটার্স ছাড়াও নজরুল জড়িত হন নিউ থিয়েটার, পাইওনিয়ার ফিল্মস, কালী ফিল্মস, দেবদত্ত ফিল্মস, ফজলী ব্রাদার্স প্রযোজিত বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে তিনি অবতীর্ণ হন বিভিন্ন ভূমিকায়।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাতালপুরী’ সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনা করেন। পরিচালক ছিলেন তাঁরই বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। শৈলজা ও নজরুল উভয়েই ছিলেন এই ছবির গীতিকার। ‘পাতালপুরী’ সিনেমাটি কয়লাখনির শ্রমিক ও সেই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রাম নিয়ে নির্মিত হয়েছিল। এ ছবির জন্য ‘ঝুমুর’ সুরে গান রচনা করেন নজরুল। সিনেমাটিকে আরও বাস্তবধর্মী করে তোলার জন্য নজরুল কয়লাখনি অঞ্চল সম্পর্কে জানার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন।
রহস্য কাহিনিভিত্তিক থ্রিলার চলচ্চিত্র ‘গ্রহের ফের’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার ছিলেন নজরুল। ছবিটি ১৯৩৭ সালে মুক্তি পায়। এই ছবির সংলাপ লেখেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ও কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং ছবিটি পরিচালনা করেন চারু রায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘গৃহদাহ’ সিনেমার সুরকার ছিলেন নজরুল। এ ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। ১৯৩৬ সালে ছবিটি মুক্তি পায়।
১৯৩৭ সালে নির্মিত শ্রেষ্ঠ ছবি ছিল ‘বিদ্যাপতি’। কবি বিদ্যাপতির জীবনী নিয়ে সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়। এই ছবির মূল কাহিনীটি লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। যদিও সিনেমাটির চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনায় ছিলেন দেবকী বসু। ছবিটিতে সুর দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ও রাইচাঁদ বড়াল। ‘বিদ্যাপতি’ সিনেমাটি লাহোর-মুম্বাই-কলকাতা হয়ে সিলেট-ঢাকা-বরিশাল এবং রেঙ্গুনের বিভিন্ন সিনেমা হল পর্যন্ত প্রদর্শিত হয়েছে।
মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির বিভিন্ন কবিতায় নজরুলের সুর দিয়েছিলেন কাজী নজরুল। তাঁর দেওয়া সুরগুলি ছিল অসাধারণ। বাংলায় ‘বিদ্যাপতি’ সিনেমাটি চরম সাফল্য পায় ফলে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দিতে নির্মিত হয় ‘বিদ্যাপতি’। হিন্দিতেও সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়। হিন্দি সিনেমাটির সঙ্গেও কাজী নজরুল যুক্ত ছিলেন।
১৯৩৮ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় ‘গোরা’ সিনেমাটি। ছবিটির সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন নজরুল। বিশ্বভারতীর আপত্তি ছিল যে সিনেমাটিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিকৃত করা হচ্ছে অর্থাৎ সঠিকভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে না। নজরুল সোজা চলে যান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।
এই প্রসঙ্গে বাঁধন সেনগুপ্ত ‘রবীন্দ্রনাথের চোখে নজরুল’ (১৯৯৮) গ্রন্থে লিখেছেন,
“নজরুল সঙ্গে সঙ্গে একটি মোটর গাড়িতে ‘গোরা ফিল্মের প্রিন্ট আর একটি ছোট প্রোজেকশন মেশিনসহ দেবদত্ত ফিল্মসের … মানু গাঙ্গুলীকে নিয়ে সোজা শান্তিনিকেতনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে হাজির হলেন। গুরুদেব হঠাৎ নজরুলকে দেখতে পেয়ে বিস্মিত। আনন্দিত হয়ে নজরলের কুশলাদি জেনে নেবার পর কবি বলেছিলেন, এসেছোই যখন কয়েকদিন তাহলে আমার কাছে থেকে যাও। নজরুল আশ্বস্ত হয়ে উত্তর দিলেন, সে তো আমার সৌভাগ্য কিন্তু এখন যে এক ভীষণ বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে আপনার কাছে ছুটে এসেছি। এরপর কাজী সাহেব ‘গোরা’ ছবির গানের অনুমতি না নেওয়াজনিত সঙ্কটের কথা রবীন্দ্রনাথের সামনে খোলাখুলি স্বীকার করে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বকবিকে অবহিত করলেন। … গুরুদেব সব কিছু শুনে খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন – কি কাণ্ড বলত? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরেন? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে! আমার গানের মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে? নজরুল সঙ্গে সঙ্গে বললেন, কিন্তু লিখিত অনুমতি না পেলে সামনের ঘোষিত তারিখে ছবিটার মুক্তি – দেওয়া যাবে না। আপনি দয়া করে আজ একসময় ছবিটা দেখুন- আমি প্রোজেক্টর ও ফিল্ম সঙ্গে করে এনেছি। তারপর অনুমতি পত্রে একটা সই করে দিন।
বিশ্বকবি বললেন,
“ছবি দেখাতে চাও সকলকেই দেখাও, সবাই আনন্দ পাবে। আপাতত দাও, কিসে সই করতে হবে। এই বলে নজরুলের হাত থেকে আগে থেকেই লিখে রাখা অনুমতি পত্র নিয়ে তাতে সই ও তারিখ দিয়েছিলেন। নির্দিষ্ট দিনেই ছবিখানি যথারীতি মুক্তি পেল।”
কবিগুরু নজরুল ইসলামকে তাঁর লেখা গান নিজের খুশিমতো গাইবার ও ব্যবহারের অনুমতিপত্র দিয়ে দেন। ফলে নজরুল ‘গোরা’ সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও নিজের লেখা একটি গান এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম’ গানটি ব্যবহার করেন। গোরাতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার হয় নজরুলের নিজস্ব শৈলীতে। নজরুলের এই নিজস্ব শৈলী শ্রোতারা চরম প্রশংসা করে এবং গানগুলিও খুব জনপ্রিয় হয়।
সে সময় ‘হাল বাংলা’ নামে আরেকটি বাংলা সিনেমা মুক্তি পায়। এই সিনেমার গানেও সুর দিয়েছিলেন কাজী নজরুল। ‘হাল বাংলা’ একটি সিনেমায় কমেডি চরিত্রে অভিনয়ও করেন নজরুল।
১৯৩৯ সালে মুক্তি পায় ‘সাপুড়ে’ ছবিটির কাহিনী রচনা করেন নজরুল। এতে তিনি সুরও দিয়েছিলেন। পরিচালক ছিলেন দেবকী বসু। বেদে সম্প্রদায়ের জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছিল সিমেনাটি। এবং সিনেমাটি দারুণ ব্যবসাসফল হয়েছিল। বেদে জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য কাজী নজরুল বেশ কিছুদিন বেদে দলের সঙ্গে ছিলেন যাতে সিনেমাটি আরও বাস্তবধর্মী করে ফুটিয়ে তোলা যায় সেজন্য। সিমেনাটি এতটাই ব্যবসাসফল হয়েছিল যে ‘সাপেড়া’ নামে সিনেমাটির হিন্দি রিমেকও করা হয়েছিল। হিন্দি সিনেমাটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন কাজী নজরুল।
‘রজত জয়ন্তী’ (১৯৩৯) ‘নন্দিনী’ (১৯৪১) ‘অভিনয়’ (১৯৪১) ‘দিকশূল’ (১৯৪১) নামে বেশ কয়েকটি সিনেমার জন্য গান রচনা করেছিলেন কাজী নজরুল। গানগুলো এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল সে সময় লোকের মুখে মুখে ফিরত। ‘নন্দিনী’ সিনেমাটির ৯টি গানের মধ্যে ১ টি গানের রচয়িতা নজরুল হলেও বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। নজরুলের লেখা ‘চোখ গেল চোখ গেল’ গানটি আবহসঙ্গীতরূপে ব্যবহার করা হয়। এই গানে কণ্ঠ দেন কিংবদন্তী সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব সচীন দেব বর্মন। সিনেমাটির সঙ্গীত পরিচালক না হয়েও সিনেমার গল্পের মুড বুঝে সচীন দেব বর্মনের কণ্ঠে গানটি সহজসাধ্য করে তোলার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেন।
‘চৌরঙ্গী’ (১৯৪২) সিনেমাটির গীতিকার সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। ছবিটি নিউ সিনেমায় হিন্দি ভার্সন মুক্তি পায় ১৯৪২ সালের ৪ জুলাই। এর ৫ দিন পর নজরুল ৯ জুলাই কলকাতায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাংলা ‘চৌরঙ্গী’ মুক্তি পায় কলকাতার রূপবাণীতে ১৯৪২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। এই ছবির ৯টি গানের মধ্যে ৮টি গান লেখেন এবং সুর দেন। সংলাপ রচনা করেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, পরিচালনা করেন নবেন্দু সুন্দর, এ ফজলী ছিলেন ছবিটির প্রযোজক, কাহিনীকার ও চিত্রনাট্যকার। সিনেমাটি হিন্দিতে রিমেক হলে এস ফজলী নিজেই পরিচালনা করেন। এবং ছবিটির সহকারী পরিচালক হিসেবে থাকেন নবেন্দু সুন্দর। হিন্দী চৌরঙ্গীর ১৩ টি গানের মধ্যে ৭টি গান নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন। নজরুলের লেখা হিন্দী গানগুলো ছিল যথাক্রমে, ১. চৌরঙ্গী হ্যায় ইয়ে চৌরঙ্গী ২. সারাদিন ছাদ পিটি ৩. আ-জারি নিদিয়া ৪. উহ্ করকে হায় ৫. ক্যায়সে মিলান ৬. হাম ইসকে মারোকা। গানের সুরও দিয়েছিলেন নজরুল।
একই বছর মুক্তি পায় ‘দিলরুবা’ নামের সিনেমা। তাতেও গীতিকার ও সুরকার ছিলেন নজরুল। চৌরঙ্গী হিন্দিতে রিমেক হলে সে ছবির জন্য তিনি ৭টি হিন্দি গান রচনা করেন।
১৯৩২ সালে কলকাতার নয়টি বাংলা, আটটি হিন্দি ও সাতটি উর্দু চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এর মধ্যে একটির পরিচালক ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। এই চলচ্চিত্রের ১৯৩২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম প্রদর্শনী হয় কলকাতার রূপবাণী প্রেক্ষাগ্রহে। এ উপলক্ষে নজরুল একটি কবিতা রচনা করেছিলেন বলে রবি বসু সূত্রে জানা যায়। উল্লেখ্য, এর সপ্তাহখানেক আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেক্ষাগৃহটি উদ্বোধন করেছিলেন, এর ‘রূপবাণী’ নামটিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া। তিনিও এ উপলক্ষে ‘রূপবাণী’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। কিন্তু নজরুলের কবিতাটির কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না।
কাজী নজরুল ‘রূপবাণী’ প্রেক্ষাগৃহে একটি নতুন চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী ‘ট্রেড শো’ দেখতে গিয়েছিলেন। পরে তিনি ‘ট্রেড শো’ নামে ৩৭ লাইনের একটি কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি নজরুল রচনাবলির পঞ্চম খণ্ডভুক্ত হয়। এই কবিতায় কবি রবীন্দ্রনাথ, রাজনীতিবিদ গান্ধী, নেতাজী সুভাস বসু, জহরলালের নামের সঙ্গে সেকালের বিখ্যাত চিত্রতারকা পাহাড়ি স্যানাল, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কে এল সায়গল, প্রমথেশ বড়ুয়া, অশোক কুমার, সংগীতকার পংকজ মল্লিক, পরিচালক দেবকী কুমার বসু, চলচ্চিত্রকার ভাগ্যচক্র (১৯৩৫), অচ্ছুৎ কন্যা (১৯৩৫), চিত্র প্রতিষ্ঠান এনটি (নিউ থিয়েটার্স), দর্শকদের ওপর চিত্রতারকাদের প্রভাব, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সেকালের জনপ্রিয় হিন্দি গান ‘বন কি চিড়িয়া’র প্রসঙ্গ রয়েছে। ‘বন কি চিড়িয়া’ গানটি ফ্রেন্জ অস্টেন পরিচালিত ‘অচ্ছুৎ কন্যা’ ছবির। বম্বে টকিজ প্রযোজিত অশোক কুমার এবং দেবিকা রানী অভিনীত এ ছবির সংগীত পরিচালনা করেন পার্শিসম্প্রদায়ভুক্ত খুরশিদ মিনোচের হোম। কিন্তু ধর্মীয় রক্ষণশীলদের আক্রমণের আশঙ্কায় তিনি তার প্রকৃত নাম ব্যবহার করেননি, সরস্বতী দেবী ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা সংগীত পরিচালক। কবিতাটিতে নজরুল ‘বাণীচিত্র’ অর্থাৎ চলচ্চিত্রকে ‘মরীচিকা মায়া’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি।
ট্রেড শো কবিতাটি হলঃ
‘ট্রেড শো’ দেখিতে গেছিনু সেদিন সকালে রূপবাণীতে
সাত শ’ তরুণ ‘সরুন সরুন’ চিৎকারি’ চারিভিতে
হুটাপুটি করে লুটাপুটি খেয়ে ছুটাছুটি করে সবে;
একটেরে রহি চাহি’_ মহাত্দা গান্ধী কি এল তবে?
এল রবীন্দ্রনাথ কি, এল কি সুভাষ, জহরলাল?
গুঁতোগুঁতি করে সাত শ’ তরুণ
জুতি ধুতি ছেঁড়া অতি সকরুণ
খুন চ’ড়ে গিয়ে নয়ন অরুণ যেন মদ-মাতোয়াল।
এল কি সুভাষ, এল কি জহরলাল?
কোথায় সুভাষ। সুবাস ছড়ায়ে আসে ছায়ানট-নটী
হীরা জহরৎ শাড়ি প’রে লাল বেগুনী ও বরবটি,
হিন্দু-মুসলমানের এমন মিলন দেখিনি আর,
বিড়িওলা আর অফিসের বাবু হ’য়ে গেছে একাকার।
টিকিতে দাঁড়িতে জড়াজড়ি হয়, ছড়াছড়ি পান-বিড়ি,
কোট-প্যান্ট-লুঙ্গি-ধুতি ঠাসাঠাসি সারা ফুটপাত সিঁড়ি।
কেহ বলে, ‘খ্যাঁদা দ্যাখ্ দ্যাখ্ ওই অনুরাধা টিপ-পরা;
ওই যে কি বলে, উনি এন-টি-র নয়াতারা আন্কোরা।
ভাগ্যচক্র শাড়ি বিজড়িত ওই যে অমুক দেবী_
অ্যালবামে রাখি’ উহারি প্রতিমা আমি দিবানিশি সেবি।’
কর্দম-অনুলিপ্ত ভূষণ ভিড় চাপে ঘামে চুবা
অভিনয়-হিরো-মার্কা পিরান-পরা কয়জন যুবা
বলে, ‘ওই ওই পাহাড়ি, দুর্গাদাস, সাইগল ওই,
ওই পঙ্কজ, অমর বড়ুয়া_ দেবকীকুমার কই?’
কেহ বলে, ‘বীতশোক হইয়াছি অশোককুমারে দেখে,
মনে হয় যাই দূর বোম্বাই অঙ্গে ভস্ম মেখে।”
‘বন্কি চিড়িয়া’ কোরাসে গাহিয়া একদল যুবা কহে,
হায় রে বিংশ-শতাব্দী, হায় বাঙালীর যৌবন।
নিপট কপট ছায়াপট প্রেম পড়িয়াছে জনগণ।
বলতে পার কি দাদা অচ্ছুৎ কন্যা কোথায় রহে?
বাণীচিত্রে যা ফুটে ওঠে তা কি এই জীবনের ছায়া?
এই বিকৃতি-কাগজের ফুল এই মরীচিকা মায়া?
পর্দায় দেখি যে সব পুরুষ নারী মোরা দিবানিশি
বলিতে পার কি চিনিতে পার কি এরা সব কোন দেশি?
ইহাদের বলা, ইহাদের চলা, ইহাদের হাবভাব
দেখেছ কি কেহ- দেখেছ ফলেছে ওক-গাছে যেন ডাব।
পাইন-শাখায় ওল ঝুলিতেছে, আমগাছে পিচ ঝুলে,
ট্যাস্ ফিরিঙ্গি বাজাইবে বাঁশি কবে যমুনার কূলে?
১৯৪৫ সালে নির্মিত ‘অভিনয় নয়’ ছবিতে গিরিন চক্রবর্তীর সুরে নজরুলের লেখা একটি গান ব্যবহৃত হয়। ‘দিকশূল’ ছবিতে পঙ্কজ মল্লিকের সুরে নজরুলের দুটি গান ব্যবহৃত হয়েছিল। ‘শহর থেকে দূরে’ ছবির অন্যতম গীতিকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া অনেক চলচ্চিত্রের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। সব মিলিয়েই বাংলা চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি।
১৯৪১ সালে কাজী নজরুল ‘বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স’ নামে একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান (Film production house) গঠন করেন। এই প্রযোজনা সংস্থার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, হুমায়ূন কবীর, এস ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আজিজুল ইসলাম, সারওয়ার হোসেন, আজিজুল হক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ।
১৯৪১ – ৪২ সালে ‘বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স’ এর ব্যানারে নজরুল নিজের গীতি আলেখ্য ‘মদীনা’ নামে একটি সিনেমার নির্মাণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ‘মদিনা’ সিনেমার চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। ‘মদিনা’ নাটকে ছিল মোট ৪৩টি গান কিন্তু ‘মদিনা’ সিনেমাটির জন্য নজরুল ১৫টি গান রচনা করেন। কিন্তু ১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়ায় সিনেমাটি আর মুক্তি পায়নি। পরে মদীনা নাটকটি বিশিষ্ট গবেষক ও সুসাহিত্যিক আব্দুল আজীজ আল আমান উদ্ধার করেন।
১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে ‘বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স’ নামক উক্ত প্রযোজনা সংস্থাটি একেবারে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি দীর্ঘ ৩৪ বছর বাকরুদ্ধ ছিলেন। ১৯৭৬ সালে নজরুলের মৃত্যু হয়। নজরুল অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর ‘বেঙ্গল টাইগার্স পিকচার্স’ ফিল্ম প্রোডাকশন হাউসটি বন্ধ হয়ে যায়, সুতরাং স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে হাউসটির মূল কর্ণধার ছিলেন কাজী নজরুল। নজরুলের অসুস্থতার সময় এবং মৃত্যুর পর অনেক সিনেমায় তাঁর লেখা গান ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ সিনেমাতে নজরুল সঙ্গীতের ব্যবহার দর্শকের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।
‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ (১৯৬৭) সিনেমাতে নজরুলের লেখা ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফেরে একা’ গানটির সার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। অনুরূপ ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটির অসাধারণভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ‘লায়লা-মজনু’ (১৯৮৩) সিনেমায় ‘লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া, মজনু গো আঁখি খোলো’ গানটির সার্থক ব্যবহার দর্শকের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। নজরুলের গান সিনেমায় ব্যবহার করা নিয়ে এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। এছাড়াও পরবর্তীকালে নজরুলের গল্প ও উপন্যাস নিয়ে সিনেমা, টিভি নাটক ও টেলিফিল্ম নির্মান করা হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে আশির দশকে ধারাবাহিক হয়েছে নজরুলের বিখ্যাত ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস অবলম্বন করে। নজরুলের ‘মেহের নেগার’ গল্প অবলম্বনে ২০০৬ সালে একটি সিনেমা নির্মিত হয়। নজরুলের ‘রাক্ষুসী’ গল্প অবলম্বন করে আরেকটি সিনেমা নির্মিত হয়। সিনেমাটির পরিচালক ছিলেন মতিন রহমান। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ থেকে শুরু করে হুমায়ুন আহমেদের ‘চন্দ্রকথা’সহ বাংলাদেশী অনেক চলচ্চিত্রে নজরুলের গান ব্যবহৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সিনেমায় নজরুল ইসলামের কাহিনী বা বিষয়বস্ত, গান ও সুরের ব্যবহার করা হয়েছে। নজরুলের গল্প ‘জ্বিনের বাদশাহ’ (১৯৯০) অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র নির্মান হয়। নজরুলের উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ এবং গল্প ‘ব্যথার দান’ ও ‘পদ্মগোখরা’ অবলম্বনেও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে কাজী নজরুলের ‘পদ্মগোখরা’ গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র ‘সুখ দুঃখ’ নির্মাণ করেন খান আতাউর রহমান। একই কাহিনী নিয়ে ১৯৭৬ সালে মুস্তাফিজ নির্মাণ করেন ‘মায়ার বাঁধন’। ২০০৫ সালে ‘মেহের নেগার’ পরিচালনা করেন মৌসুমী ও গুলজার। ২০০৬ ‘রাক্ষুসী’ পরিচালনা করেন মতিন রহমান। ২০১৪ সালে ‘প্রিয়া তুমি সুখি হও’ পরিচালনা করেন গীতালী হাসান।
এছাড়াও পরশমণি (১৯৬৮), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), কোথায় যেন দেখেছি (১৯৭০), মুক্তির গান (১৯৭১-১৯৯৫), সোনালী আকাশ (১৯৮৫), চন্দ্রকথা (২০০৩) নন্দিত নরকে (২০০৬) দারুচিনি দ্বীপ (২০০৭), বধূ বিদায় (১৯৭৮) প্রভৃতি সিনেমায় নজরুলের লেখা গানের ব্যাবহার করা হয়েছে।
তাঁর দুটি কবিতা ‘লিচুচোর’ (১৯৯৯) এবং ‘খুকি ও কাঠবিড়ালি’ (১৯৯৯) অবলম্বনে শিশুদের জন্য দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে। তবে সে তুলনায় নজরুল সাহিত্য নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে সেভাবে চলচ্চিত্রে কাজ হয়নি।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে কবি নজরুলের জীবনীভিত্তিক কয়েকটি তথ্যচিত্র (Documentry) নির্মিত হয়েছে। সেগুলোর নাম যথাক্রমে ‘বিদ্রোহী কবি’ (১৯৭০), ‘কবি নজরুল’ (১৯৮০-৮১), ‘মুক্তির গান’ (১৯৯৫), বিবিসি টিভি চ্যানেল ফোর থেকে নির্মিত হয় ‘কাজী নজরুল ইসলাম’, কানাডার চলচ্চিত্র পরিচালক ফিলিপ স্পারেল নির্মাণ করেন তথ্যচিত্র ‘নজরুল’, ‘বাংলার দামাল ছেলে’ প্রভৃতি।
[সৌজন্যেঃ পুবের কলম, ২৭ মার্চ ২০২২, সাহিত্যের পাতা]
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।