লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
“কাদম্বরী কেন আত্মহত্যা করলেন এ প্রশ্ন রবীন্দ্র জীবন জিজ্ঞাসায় অনিবার্য কৌতুহল।- সুমিত্রা দত্ত।
রবি ঠাকুরের বউঠান কাদম্বরী দেবী যখন আত্মহত্যা করেন, তখন তাকে বাঁচিয়ে তােলার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছিল। দুজন ডাক্তারকে বাড়িতে রেখে কাদম্বরী দেবীকে বাঁচিয়ে তোলার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন চেষ্টায় কাজে আসেনি। সব চেষ্টা বিফলে যায় এবং কাদম্বরী দেবী অকালে প্রয়াত হন। যদিও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি যে কিভাবে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন।
অবনীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা ভগিনী সুনয়না দেবী এবং ইন্দিরা দেবী বলেন যে কাদম্বরী দেবী আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বিশু নামে যে কাপড়উলী প্রায়ই কাপড় বেচতে ঠাকুরবাড়িতে আসত। তাকে টাকা দিয়ে কাদম্বরী লুকিয়ে আফিম আনান। কাদম্বরী দেবী সেই অফিম খেয়েই আত্মহত্যা করেন। সুতরাং বোঝায় যাচ্ছে যে কাদম্বরী অনেক দিন ধরেই আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এছাড়া অন্য কোন ভাবে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়না। পোষ্ট মর্টেম হয়নি তাই মৃত্যুর সঠিক কারণও জানা সম্ভব নয়।

তবে ঠিক কি কারণে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন? এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ও আত্মীয়স্বজন একমত নন। প্রত্যেকেই একেক রকম তথ্য দিয়েছেন। তবুও যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে পরিস্থিতি বিচার ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার আসল কারণ কি।
১। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে প্রথমেই যেটা মনে আসে তা হল কাদম্বরী দেবী ছিলেন মানসিক অবসাদের রুগী এবং এর আগেই তিনি একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। মনরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণতঃ যে ব্যক্তি একবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, সে বার বার আত্মহত্যা করতে চায়। সেটাই হয়েছে কাদম্বরী দেবীর ক্ষেত্রেও। প্রথম চেষ্টাতে তিনি ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় চেষ্টায় তিনি সফল হন। মনে রাখতে হবে, সুনয়না দেবী ও ইন্দিরাদেবী উভয়েই বলেছেন, মৃত্যু হয়েছিল আফিম খেয়ে—যে আফিম জুগিয়েছিল বিশু নামের এক কাপড়উলি, ঠাকুর বাড়িতে আসত তার প্রায়ই আনাগোনা ছিল।
২। কাদম্বরী দেবী ছিলেন নিঃসন্তান। সন্তান না হওয়াটাই তাঁর অন্যতম মানসিক অবসাদের একটা কারণ ছিল। প্রথম দিকে সন্তান হবার আশায় দিন গুনতেন। কাদম্বরী দেবী স্বর্ণময়ীদেবীর ছােট মেয়ে ঊর্মিলার দেখাশোনার দায়িত্ব নিলেন কাদম্বরী দেবী। নিঃসঙ্গতা খানিকটা কাটল, উর্মিলাকে আঁকড়ে ধরলেন। এক বছর যেতে না যেতেই উর্মিলা তেতলার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে মারা যায়। এবার নিঃসঙ্গতা এবং অবসাদের সঙ্গে এল এবং এই মৃত্যুর জন্য কাদম্বরী দেবী নিজেকে অপরাধী মনে করেত লাগলেন। রবীন্দ্রনাথ যখন পড়াশুনা করার জন্য বিলেত রওয়ানা হবার কয়েকদিন আগে আবার নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বেন, এই ভয়ে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
এর পর ঘটনাক্রমে বোম্বাই-এর কাছে কোন শৈল শহর বাদ দিলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং কাদম্বরী দেবী যখন যেখানে বাস করেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সাথে যেতে শুরু করেন। কাদম্বরী দেবীর অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সাধনায় সাহিত্য সাধানা তখন তুঙ্গে। কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে একটার পর একটা অমর সাহিত্য রচনা করেন রবী ঠাকুর। একে অপরে প্রতি চরম দুর্বল হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরীর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না।
তারপর রবীন্দ্রনাথের বিয়ে ঠিক হয়। কন্যা নির্বাচন হয়ে গেলে বিয়ের আগে কাদম্বরী দেবী চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হয় ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে। আবার নিঃসঙ্গ হবার ভয়ে অবসাদে ভুগতে থাকেন কাদম্বরী দেবী। আবারও তিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। এই ঘটনা ঘটে রবীন্দ্রনাথের বিয়ের ঠিক চার মাসের মধ্যে।
৩। ইন্দিরা দেবীর অপ্রকাশিত স্মৃতিকথায় বিষয়টি এই ভাবে বর্ণিত হয়েছে “নতুন কাকিমার মৃত্যু আমাদের জোড়াসাঁকোর বাল্যজীবনে প্রথম শােকের ছায়া ফেলে বলে মনে হয়। তখন আমরা ত’ বিশেষ কিছু বুঝতুম না। তবে রবিকাকাকে খুব বিমর্ষ হয়ে বসে থাকতে দেখতুম। আর শুনেছিলুম যে তিনি আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। কেন, তা পরে অনুসন্ধান করেও পরিস্কার করে জানতে পারিনি। তবে একবার শুনেছিলুম যে, জাহাজে যাওয়া নিয়ে কি একটা মনােমালিন্য ঘটেছিল। জ্যোতিকাকামশাই যে জাহাজের ব্যবসা ধরেছিলেন, সেই জাহাজে একদিন গান বাজনা আমােদ প্রমােদ কি হবে। তাই নতুন কাকিমাকে পরে নিয়ে যাবার কথা ছিল; কিন্তু ভাটা পড়ে যাওয়াতে জ্যোতিকাকামশায় বুঝি নিতে আসতে পারেন নি। শুধু এই টুকুর জন্য অমন প্রচণ্ড আঘাত ও অভিমান ত’ আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। তবে ভিতরে আরাে কিছু ছিল যা এখন জানবার সম্ভাবনাও নেই, প্রয়ােজনও নেই। যদিও অনেকের দেখি এ বিষয়ে বিশেষ কৌতুহল আছে।” (ইন্দিরা দেবীর অপ্রকাশিত স্মৃতিকথা)।
৪। অনেকে ভাবেন কাদম্বরী দেবীর স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবৈধ সম্পর্কই নাকি কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার সব থেকে বড় কারণ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জোব্বার পকেটে পাওয়া যায় সেই সময়কার একজন বিখ্যাত অভিনেত্রীর চিঠি। সেই চিঠিতে জ্যোতরিন্দ্রনাথের সঙ্গে অভিনেত্রীর অন্তরঙ্গতার কথা লেখা ছিল। ঐ চিঠিগুলাে পেয়ে কাদম্বরী দেবী বেশ কিছুদিন মানসিক অবসাদে দিন কাটান। তাই অনেকের ধারণা সেই চিঠিগুলােই তাঁর আত্মহত্যার অন্যতম কারণ, কাদম্বরী দেবী নাকি এই কথা সুসাইড নোটে লিখে গিয়েছিলেন। সবই মহর্ষির আদেশে তার সেই লেখাটি এবং চিঠিগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়। যাতে ঠাকুরবাড়ির অপকর্ম ফাঁস না হয়ে যায়। কাজী আবদুল ওদুদ ঘটনার বিবরণ দিয়ে পাদটিকায় লেখেন, “ঠাকুর বাড়ির একজন খ্যাতনামা ব্যক্তির মুখে শুনেছি, যে মহিলার সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গতা জন্মেছিল তিনি অভিনেতৃ ছিলেন না, এবং তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতার জন্য কাদম্বরী দেবী আরো একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
অবনীন্দ্রনাথের বোন সুনয়না দেবীর একটি বক্তৃতার অংশ বিশেষ উদ্ধৃতি দিয়েছেন জগদীশ ভট্টাচার্য তার কবিমানসীতে। তিনি বলেছেন “আরেক দিনের কথা মনে আছে। যেদিন জ্যোতিকাকার স্ত্রী কাদম্বরী দেবী। মারা যান। আপনারা জানেন, তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। কারণটা আমরা ঠিক জানিনে। তবে শুনেছি জ্যোতিকাকার সঙ্গে তার কি নিয়ে মনােমালিন্য হয়েছিল। সেই সময় আমাদের বাড়িতে এক কাপড়উলী প্রায়ই কাপড় বেচতে আসত। তার নাম ছিল বিশু। তাকে টাকা দিয়ে তিনি লুকিয়ে আফিম আনান—তাই খেয়ে আত্মহত্যা করেন। আমরা এ বাড়ির জানালা থেকে দেখেছি, ঘরে তার মৃতদেহ পড়ে আছে। সারা বাড়িতে শোকের ছায়া। পরে পুলিশ এসে সেই মৃতদেহ নিয়ে যায় এবং ময়নাতদন্তে পাকস্থলীতে আফিম পাওয়া যায়।”
৫। “That in course of time he and wife of his brother Jyotirndranath fell desparately in love with each other and did not mend matters at all, and when the family married him off presumably to prevent scandal had gone worse until his sister-inlaw killed herself.” – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
৬। যেহেতু কাদম্বরী দেবী নিঃসন্তান ছিলেন তাই তাঁকে মহিলা মহলের অনেকেই নিশ্চয়ই অনেক কটু কথা শোনাতেন। কাদম্বরীর সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে অনেক রসালো গল্প প্রচলিত ছিল মহিলা মহলে। সেটা নিয়েও কাদম্বরী দেবীকে অপ্রিয় সব কথা শুনতে হত। রবীন্দ্রনাথ যখন বিয়ে করলেন, অন্তর্মুখী কাদম্বরী দেবী আবার নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, একাকীত্বে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এরই ফল আত্মহত্যা।
৭। নীরদ সি চৌধুরীর মতে, “কাদম্বরী আত্মহত্যা করিলেন কেন? প্রথম উত্তর সহজ—প্রেমে নিরাশ হইয়া। দ্বিতীয় উত্তর, স্বামীর মনের অবস্থা দেখিয়া। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনােভাব যদি ভূপতির মত হইয়া থাকে তাহা হইলে উহা দেখিবার পর অনুতপ্ত হইয়া এবং পূর্ব-সম্বন্ধ কোন ভাবে ফিরাইয়া আনিবার পথ না দেখিয়া কাদম্বরীর পক্ষে জীবনের অবসান করা সম্ভব ছিল। তৃতীয় অনুমান ও করা যাইতে পারে। উহা একটা দুরপনেয় ও অসহনীয় কলঙ্কের অনুভূতি। এটা রবীন্দ্রনাথের বিয়ের সহিত যুক্ত হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু আরেকটি সম্ভাবনার কথাও বিবেচনা করিতে হইবে। কেহ কি দেবেন্দ্রনাথের কানে রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর মধ্যে অবৈধ প্রণয়ের কথা তুলিয়াছিলেন? …সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ বিরক্ত হইয়া তখনই রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহ পাঠাইয়া এইরূপ বিবাহ দিলেন। শ্বশুর তাহাকে কলঙ্কিনী ভাবিলেন, এই ধারনার বশে আত্মহত্যা করা তাহার পক্ষে সম্ভব। …তাই অভাগিনী কাদম্বরীর নামের পাশে কলঙ্ক (অবৈধ প্রণয়) ছায়ার মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।”
৮। অনেকের মতে ঠাকুর বাড়ির মহিলা মহলের অন্তর্দ্বন্দ্বের পরিণাম কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা।
এই সম্ভাব্যগ কারণগুলির মধ্যে নিরোদ সি চৌধুরীর সিদ্ধান্তগুলো অনেকের মতে যুক্তিযুক্ত নয় কারণ ছেলেবেলা শোনা গল্প বা নষ্টনীড় গল্প থেকে নেওয়া। যাইহোক নীরদ সি চৌধুরীর মন্তব্য যখন ‘দেশ’-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তখন বিভিন্ন বুদ্ধিজীবি মহল থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তাঁদের মধ্যে শান্তিদেব ঘোষ, শঙ্খ ঘোষ থেকে শুরু করে বহু পাঠক প্রতিবাদ পত্র লিখে পাঠান। নীরদ সি চৌধুরির নিজের বক্তব্যের সমর্থনে যে যুক্তি দিয়েছিলেন তা হল, “রবীন্দ্রনাথের উপর যে সব আক্রমণ হইত তাহার কোন উত্তর রবীন্দ্রভক্তরা দিয়াছেন বলিয়া আমি পড়ি নাই।”
শঙ্খ ঘোষ এর উত্তরে লিখেছেন, “তিনি পড়েন নি, সে তার অজ্ঞতা, তাই বলে মিথ্যে হয়ে যাবে সত্যেন্দ্রনাথ, অজিতকুমার যতীন্দ্রনাথের বা প্রিয়নাথ সেন, প্রমথ চৌধুরীর প্রতিবাদ?”
তবে এটা হয়ত ঠিক যে রবীন্দ্রনাথ কখনাে প্রতিবাদ করেন নি।
৫নং কারণটি উল্লেখ করেছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষে অর্থাৎ ১৯৬১ সালে। সুধীন্দ্রনাথও এ ধরনের মারাত্মক মন্তব্য করার সময় কোথায় তিনি এই তথ্য পেয়েছেন তা উল্লেখ করেন নি।
তবে এ প্রসঙ্গে সুমিত্রা দত্ত তার ‘নতুন বৌঠান’-এ যা লিখেছেন সেটি পড়লে মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়। এ ধরনের মন্তব্যের পেছনে কি কারণ ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছেন : “ইনিই সেই স্নেহধন্য সুধীন্দ্রনাথ যাঁকে কবি তার একান্ত ইচ্ছাক্রমে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন তাঁর ১৯২৯-এ কানাডায় শিক্ষা সম্মেলনে যােগদানের যাত্রায়। …বুদ্ধদেব বসুকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—সুধীন্দ্র দত্তের কবিতার সঙ্গে প্রথম থেকেই আমার পরিচয় আছে এবং তার প্রতি আমার পক্ষপাত জন্মে গেছে। …১৯৩৯ সালে আকাশ প্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থটি সুধীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করে কবি লেখেন—বয়েসে তােমাকে অনেক দূরে পেরিয়ে এসেছি। তবু তােমাদের কালের সঙ্গে আমার যােগ লুপ্তপ্রায় হয়ে এসেছে এমনতর অস্বীকৃতির সংশয় বাক্য তােমার কাছ থেকে শুনিনি। তাই আমার রচনা তােমাদের কালকে স্পর্শ করবে বলে আশা করে এই বই তােমার হাতের কাছে এগিয়ে দিলুম। তুমি আধুনিক সাহিত্যের সাধনক্ষেত্র থেকে একে গ্রহণ কোর। বই পেয়ে অভিভূত আপ্লুত সুধীন্দ্রনাথ ১৯৩৯ সালের ২৫শে এপ্রিল পত্র দিলেন রবীন্দ্রনাথকে—“বহুদিন যাবৎ আমাকে অহেতুক প্রশ্রয় দিয়ে আপনি আমার স্বভাব এতখানি নষ্ট করেছেন যে ভেবেছিলুম আপনার অপরিমিত দাক্ষিণ্য আজীবন প্রাপ্য বলেই কুড়িয়ে নেবাে। কিন্তু আকাশ প্রদীপে’র উৎসর্গপত্র দেখে বুঝলুম আমার আত্মম্ভরিতারও সীমা আছে। এ সম্মানের যােগ্যতা আমার কোথা? এখন তাে নেইই কোন জন্মে হবে—এমন বিশ্বাস শুদ্ধ হাস্যকর।”
পিনাকী ঠাকুরের লেখা থেকে জানতে পারা যায় সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের আদানপ্রদান চললেও কিংবা পারস্পরিক বই উৎসর্গের ঘটনা থাকলেও রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত বাংলা কাব্য পরিচয় কবিতা সংকলনে অনেকের মত সুধীন্দ্রনাথের স্থান হয় নি। ফলে বুদ্ধদেব উত্তেজিত, দিলীপ দুঃখিত, সুধীন ‘খ্যাপা’ হয়ে ওঠেন। একি তারই প্রতিক্রিয়া?
রবীন্দ্রবিরোধী গোষ্ঠীর অকারণ বিদ্বেষ বিষে জর্জরিত হয়ে ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ একবার মন্তব্য করেছিলেন, “খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে যে গ্লানি এসে পড়ে আমার ভাগ্যে অন্যদের চেয়ে তা অনেক বেশি আবিল হয়ে উঠেছিল। এমন অনবরত, এমন অকুণ্ঠিত, এমন অকরুণ, এমন অপ্রতিহত অসম্মাননা আমার মত আর কোন সাহিত্যিককেই সইতে হয় নি। …এ সব আমাকে লাঞ্ছিত করেছে, কিন্তু পরাভবের গৌরবে লজ্জিত করেনি।” (প্রতিভাষণ, ১৮৯১)
উপরিউল্লিখিত যে কারণগুলোর কথা বলা হয়েছে, আমাদের মনে হয় তার কোন একটি মাত্র নির্দিষ্ট কারণে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেননি। কিন্তু আত্মহত্যার পেছনে সবগুলো কারণের কিছু অংশ দায়ী ছিল।
পুলক চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “কাদম্বরী দেবী নিঃসন্তান ছিলেন, তিনি অবসাদগ্রস্ত ছিলেন, উর্মিলার হঠাৎ মৃত্যুর জন্য অপরাধবোধে ভুগতেন, রবীন্দ্রনাথের বিলেত যাওয়াতে তার মধ্যে একটা শূন্যতা নেমে আসে, যেহেতু ঐ সময়টায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর জাহাজ তৈরি সহ অন্যান্য কাজে অনেক ব্যস্ত ছিলেন, স্ত্রীকে সময় দিতে পারেন নি—যা হয়ত দেওয়া উচিত ছিল অন্ততঃ একথা ভেবে যে কাদম্বরী দেবী অবসাদগ্রস্ত রোগী। অন্তর্মুখী কাদম্বরী দেবী যেহেতু ভারতীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং সাহিত্যে বিশেষ রুচি রাখতেন এবং অংশ নিতেন, নারী হিসেবে এতটাই সাহসিনী ছিলেন যে স্বামীর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে গড়ের মাঠে যেতে ভয় পেতেন না, অন্দর মহলে অর্থাৎ মহিলা মহলে তিনি ঈর্ষার পাত্রী ছিলেন। এই সব ঘটনা ও পরিস্থিতির চাপে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। এবং আফিম খেয়েই আত্মহত্যা করেছিলেন, অন্য কোন কিছুর উল্লেখ আমরা পাইনি।” [রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী, পৃষ্ঠা – ৬২]
তিনি আরও লিখেছেন, “তবে অভিযোগের আঙ্গুল কিন্তু বার বার উঠেছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দিকে। জ্যোতিরিন্দ্র ছিলেন ঠাকুর পরিবারের সর্বশ্রেষ্ঠ পুত্র, কর্মবীর, ন্যায়নিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ তবু তার শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রতি দেবেন্দ্রনাথের আচরণ প্রায় ত্যাজ্য পুত্র সুলভ। শেষ বয়সে Last will and Testament স্বাক্ষর করেন দেবেন্দ্রনাথ। তাতে দেখা যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে জমিদারীর কোন সত্ব দেওয়া হয় নি। তার জন্য কেবল বরাদ্দ ছিল ১২৫০ টাকার আমরণ মাসিক বৃত্তি।
কেন এই বৈষম্য? তবে কি মহর্ষিও এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, জ্যোতিই দায়ী কাদম্বরীর আত্মহত্যার জন্য? নাকি সেই কথাটাই সত্যি যে, কাদম্বরী যে সুইসাইড নােট লিখেছিলেন—যা মহর্ষি নষ্ট করে ফেলেছিলেন সেখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকেই দায়ী করে গেছেন?
কিন্তু আমরা জানি, কাদম্বরীর মৃত্যুর পরও ৪০ বছরের ওপর বেঁচেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। শত অনুরােধেও বিয়ে করতে চান নি কারণ, তাকে ভালবাসি। আমরা জানি কাদম্বরীর মৃত্যুর পর জ্যোতিরিন্দ্র রাঁচীতে চলে গিয়েছিলেন। রাঁচীর নিঃসঙ্গ পাহাড়ে বসে মগ্নতার কথা ভেবে আমরা যেমন দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে পারি, তেমনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি এই কথা ভেবে যে অন্ততঃ কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর জন্য রবীন্দ্রনাথকে কেউ দোষী সাব্যস্ত করেন নি।” [রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী, পৃষ্ঠা – ৬২/৬৩]
জগদীশ ভট্টাচার্য লিখেছেন, একটি দেশে, একটি যুগে রবীন্দ্রনাথের মত প্রতিভা নিয়ে একটিমাত্র কবির যেমন আবির্ভাব হয়, তেমনি সেই প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের প্রেরণার জন্য যে জ্যোতির্ময়ী দিব্য শক্তির প্রয়োজন হয় তিনিও অনন্যা অদ্বিতীয়া। সেই বিখ্যাত কথাটাই এখানে স্মরণ করা যায়, ‘Behind every successful man there stands a woman.
রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীকে একবার বলেছিলেন, মৃতের বয়স বাড়ে না, চেহারা। পাল্টয় না, চরিত্র বদলায় না, তাই আত্মীয়দের অনুভবও পাল্টয় না। ..ভালই হয়েছে নতুন বৌঠান চলে গেছেন তার অবিনশ্বর মধুর ছায়া রেখে, তাই আজও তাকে নিয়ে, কবিতা লিখছি। নতুন বৌঠান যেমনটি ছিলেন, তেমনটিই আছেন, “বেঁচে থাকলে হয়ত মামলা মকদ্দমা হত।” (রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বেমৈত্রেয়ী দেবী)।
এসব কথা শুনেই হয়ত মৈত্রেয়ী দেবী ভাবতেন, “বিস্মিত হয়ে তাই ভাবি, এত দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের পর যে স্নেহের স্মৃতি এমন ওতঃপ্রােতভাবে তার জীবনে জড়িয়ে ছিল। তার কল্পনায় মাধুর্য বিস্তার করত। অসংখ্য কবিত্বের কেন্দ্র হত, সে জানি কী প্রভাবমণ্ডিত ছিল। এমন অভূতপূর্ব বিরাট প্রতিভার মধ্যে এত গভীর দীর্ঘকাল স্থায়ী প্রভাব যিনি বিস্তার করতে পারেন, তিনি কম প্রতিভাশালী নন। (মংপুতে রবীন্দ্রনাথ—মৈত্রেয়ী দেবী।)।
এই প্রসঙ্গ শেষ করব শরকুমারীর একটি কথাকে স্মরণ করে, “..ফুলের তােড়ার ফুলগুলিই সবাই দেখিতে পায়, যে বাঁধনে তাহা বাঁধা থাকে তাহার অস্তিত্বও কেহ জানিতে পারে না। মহর্ষি পরিবারের গৃহলক্ষ্মী শ্রীযুক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী ছিলেন এই বাঁধন। বাঁধন যখন ছিড়িল ভারতী’র সেবকরা আর ফুল তােলেন না, মালা গাঁথেন না, ভারতী ধূলায় মলিন।” [তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী, পৃষ্ঠা – ৬৩/৬৪]
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।