হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে পাশাপাশি বসবাসের ফলে ভারতে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ভাবুকতার এবং সামাজিক আদান-প্রদানের সম্পর্ক আপনা হতেই গড়ে উঠেছে। এই ভাব আদান-প্রদানের পাশাপাশি মাঝে মাঝে হিন্দুমুসলিম সহাবস্থানে ব্যাঘাত ঘটেছে বিরােধ কখনও কখনও সমুচ্চও হয়ে উঠেছে এবং যার ফলে একদিন অপ্রত্যাশিত দেশবিভাগ দুই সম্প্রদায়কেই মেনে নিতে হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, ভারতবর্ষের ইতিহাস বিরােধ-দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের কথা যত বলে তার থেকে অনেক বেশি করে বলে সম্প্রীতির কথা, পারস্পরিক সহমর্মিতার কথা। ভারতে মুসলিম আগমনের সময়কাল থেকে যদি আমরা এর ইতিহাস খুঁজি তবে দেখব যে, বৈষয়িক জীবনের প্রতি স্তরে সমঝােতা ও সম্প্রীতির উজ্জ্বল দিকগুলির উপস্থিতি।
পবিত্র কোরআন সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। কোরআনে বলা হয়েছে তােমার জন্য তােমার ধর্ম আর আমার জন্য আমার ধর্ম। কোরআনে আরও বলা হয়েছে ‘ধর্মে কোনাে বাধ্যবাধকতা নেই।”—এটাই হল কোরআনের চিরন্তন অনুশাসন। আর এই অনুশাসনের কারণ দেওয়া হয়েছে চমৎকারভাবে, “কিন্তু নিশ্চয়ই আমার প্রভু যদি ইচ্ছা করতেন জগতে যারা আছে তারা সবাই এক সঙ্গে বিবাাস করত, তুমি কি তাহলে মানুষকে বিবাসী হতে বাধ্য করবে?’ কোরআনে পরিষ্কার বলা হয়েছে এবং তারা (পৌত্তলিকেরা) আল্লার পার্কে যে সমস্ত দেবতাদেরকে স্থাপন করে পূজা করে তাদের গালাগালি দিও না।” মক্কা থেকে হিজরৎ (আত্মরক্ষার জন্য নিরাপদ বাসস্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা) করে হযরত মােহাম্মদ (সঃ) যখন মদিনায় যান তখন তিনি মদিনার ইহুদি ও পৌত্তলিকদের সঙ্গে ‘মদিনা সনদ’ বা সন্ধি করে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন। এ বিষয়ে যে সন্ধিপত্র রচিত হয় তাতে বলা হয়েছিল মদিনার ইহুদি, পৌত্তলিক এবং মুসলমান সকলেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউই কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। অন্য এক বক্তব্যে হযরত মােহাম্মদ (সঃ) বলেছিলেন ‘অমুসলমানদের উত্যক্ত করবে না, তারা তাদের বিশ্বাস মত চলুন।’
(১)
ইসলামের এই ধর্মীয় সহনশীলতার একটা বিস্তৃত রূপ ধরা পড়ে হযরত মােহাম্মদের (সঃ) প্রয়াণের (৭ জুন ৬৩২) মাত্র একশ বছরের মধ্যে যখন ৭১২ সালে ইরাকের গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের (৬৯৪-৭১৪) ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিম (৭১২-১৫) সেনাপতি হিসেবে আরব থেকে এসে ভারতের সিন্ধুপ্রদেশ জয় করলেন। হিন্দুরা বিন কাসিমের কাছে আবেদন জানাল, তাদের ধর্মীয় নিরাপত্তা নিয়ে। মুহাম্মদ বিন কাসিম হযরত মােহাম্মদকে (সঃ) অনুসরণ করে হিন্দু, বৌদ্ধদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা প্রদান করলেন।১ মুলতানে তিনি ঘােষণা করলেন,
“খ্রষ্টানদের গীর্জা, ইহুদিদের ধর্মসভা ও পারসিক পুরােহিতদের পূজাবেদীর মত হিন্দুদের মন্দিরও পবিত্র থাকবে।”
মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুর অধিবাসীদেরকে মন্দির মেরামত করার অনুমতিও দেন২ এবং তাদের মন্দির ও উপাসনাগার যাতে কোনাে কারণে শত্রু দ্বারা আক্রান্ত না হতে পারে সেব্যবস্থা অবলম্বন করেন।
উইলিয়াম মুর-এর মতে, এই ধর্মীয় সহনশীলতা ছিল ইসলামের শাসননীতির এক উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। উইলিয়াম মুরের ধারণা, মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রবর্তিত বিধর্মী অথবা পৌত্তলিকদের সঙ্গে সমঝােতা পরবর্তীকালে মুসলমান শাসকদের পথ দেখিয়েছে। তিনি হিন্দুদের ‘জিম্মি’ বা ‘সুরক্ষিত’ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে (মুসলমান আইনবিদগণ জিম্মিদের যে সমস্ত সুযােগ-সুবিধা দানের পক্ষপাতী ছিলেন বিন কাসিম সিন্ধুবাসীদেরকে তার চেয়েও বেশি সুযােগ-সুবিধা দেন৩)। হিন্দুদের একটা বড় অংশের সক্রিয় সহযােগিতা লাভ করলেন। এর ফলে তিনি অতি সহজে বামনাবাদ, অরাের (সিন্ধুর রাজধানী) এবং মুলতান দখল করতে সমর্থ হন। মুলতানের জনগণ বিশেষভাবে বণিক সম্প্রদায়, জাঠ ও মেধ প্রভৃতিরা সিন্ধুর ব্রাহ্মণ রাজা দাহিরের অত্যাচারে এত বেশি অত্যাচারিত হয়েছিল যে, তারা খুশী মনে বিন কাসিমকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। পূর্বে অবশ্য বৌদ্ধরা হিন্দু শাসন-কর্তৃত্বকে সুনজরে দেখেনি। হিন্দু রাজারা নিজ রাজত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বৌদ্ধদের উপর নানাভাবে অত্যাচার করত। ফলে বৌদ্ধ অধিবাসীরা হিন্দু রাজত্ব ধ্বংসের সুযােগের অপেক্ষায় ছিল। রাজা দাহিরের রাজত্ব প্রাপ্তির পরও বৌদ্ধদের অবস্থার কোনাে পরিবর্তন হয়নি। এই অবস্থায় বিন কাসিমের অভিযানে তারা কিছু হলেও স্বস্তি বােধ করে। এমনকি স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকেই বিন কাসিমের সৈন্যদলে যােগদান করে। দাহিরের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ স্বীকার করেন যে, দাহিরের সমরনীতি ছিল ভুলে ভরা। শুধু তাই নয়, প্রজাদের একটা বড় অংশ দাহিরেরই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে বিন কাসিমের পক্ষাবলম্বন করে। তাছাড়া দেশে তখন এমন এক ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, শীঘ্রই দেশ মুসলিম শাসকদের করতলগত হবে, সুতরাং যুদ্ধ বা প্রতিরােধ গড়ে তােলা অর্থহীন। দাহিরের প্রতি বিরুদ্ধ মনােভাব এই ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে বিন কাসিম অনায়াসে সিন্ধুপ্রদেশ দখল করতে সক্ষম হয়।৪
সিন্ধু বিজয়ের পর এখানে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু শাসনব্যবস্থার প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি দেশীয় হিন্দুদের ও স্থানীয় জনগণের উপরই ন্যস্ত করেছিলেন। সিন্ধুর চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী তিনি ব্রাহ্মণদের অতিরিক্ত সুযােগ-সুবিধা দান করেন। পূর্বকাল হতে ব্রাহ্মণগণ যেসব পদে চাকরি করতেন, সেইসব পদে তাদের বহাল করা হয়। এমনকি যেসব উচ্চপদস্থ কর্মচারী ভয়ে আত্মগােপন করেছিল, তিনি তাদের ডেকে এনে নিজ নিজ পদে বহাল করেন। রাজা দাহিরের সময়ে ব্রাহ্মণগণ শতকরা তিন ভাগ রাজস্ব ভােগ করত, বিন কাসিম তাদের সেই সুবিধা ভােগ করার অধিকারও দেন।৫ রাজস্ব আদায়ের জন্য তিনি গ্রাম ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিযুক্ত করেন এবং নির্দিষ্ট হারে খাজনা আদায়ের আদেশ দেন। এই নীতি অনুসরণের ফলে স্থানীয় জনগণের মনে সাহস ও নিরাপত্তার ভাব সঞ্চারিত হয়। তিনি কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে রাজস্ব আদায়ের নামে জনগণের প্রতি অত্যাচার ও উৎপীড়ন করা না হয়। এই নীতির ফলে প্রজারা শাসকগােষ্ঠীর অত্যাচার-উৎপীড়ন হতে রক্ষা পেয়েছিল। যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও মুহাম্মদ বিন কাসিম করেছিলেন। এই সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের ফলে বিন কাসিমের শাসনবিধি স্থানীয় জনসাধারণের কাছে বিশেষ জনপ্রিয় ও গ্রহণীয় হয়েছিল।৬
স্থানীয় জনগণের ধর্মের উপর মুহাম্মদ বিন কাসিম কোনও হস্তপে করেননি। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে এক পত্রে জানালেন “তারা (হিন্দুরা) যখন আনুগত্য স্বীকার করেছে এবং খলিফাকে কর দিতে রাজী হয়েছে, তখন তাদের কাছ থেকে ন্যায্যত আর কিছু নেবার দরকার নেই।…দেব-দেবীর উপাসনা করার জন্য তাদের অনুমতি দেওয়া গেল। স্বধর্ম পালনে কাউকে নিষেধ করা বা বাধা দেওয়া হবে না। তারা তাদের খুশি মতাে নিজ নিজ বাড়িতে বাস করতে পারে।”৭ এহেন ঘােষণা কার্যকরী হওয়ায় সিন্ধু অঞ্চলে সামাজিক ও মানসিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় ছিল।৮ আরবরা সেখানে গােজবেহ নিষিদ্ধ করেছিল, হয়তাে সংখ্যাগুরু অমুসলমানদের কথা মাথায় রেখে এই নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। গাে-সম্পদ সংরক্ষণ করার তাগিদে গাে-জবেহ বা গাে-হত্যার উপর নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সিন্ধুর অমুসলমান সর্দাররা বা দলপতিরাও ইসলাম ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি উদার মনােভাব পােষণ করতেন। এক তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, পার্ববর্তী একজন হিন্দু রাজা কোনাে এক আরবীয় পণ্ডিতের দ্বারা কোরআন শরীফের তর্জমা করান।৯ সিন্ধুর অমুসলমানরা আরবদের প্রতি এত অনুরক্ত হইয়া পড়ে যে, তাহারা আরবদের পক্ষে সুদূর রােম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও যুদ্ধযাত্রা করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই।১০
(২)
ভারতীয়দের বৌদ্ধিক বিকাশের ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির মতাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আরবদের ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আরবরা ভারতীয়দের দ্বারা জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। নতুন শাসনব্যবস্থা চালু করার সময় তারা এ কারণে ব্রাহ্মণদের অগ্রাধিকার দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসার ও আহরণের জন্য তারা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের বলতে গেলে প্রায় শিষ্যত্বই গ্রহণ করে ফেলে এবং ভারতীয় দর্শন, জ্যোতিষ, চিকিৎসা, রসায়ন প্রভৃতি শাস্ত্রে তারা দক্ষতা অর্জন করে।১১ বি এন পাণ্ডে যথার্থই বলেছেন যে,
“আরবরা ভারতীয়দের কাছ থেকে প্রশাসনের ব্যবহারিক কৃৎ-কৌশল প্রচুর পরিমাণে শিখে নেয়। ব্যাপকহারে ব্রাহ্মণ কর্মচারী নিয়ােগের কারণ ছিল তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব পালন করার উপযুক্ততা। আরবীয় সংস্কৃতির বহু বৈশিষ্ট্য যা পরবর্তীকালে ইউরােপীয় সভ্যতার ওপর চমৎকার প্রভাব ফেলে তা ধার করা হয় ভারত থেকে।”১২
বিখ্যাত ঐতিহাসিক পর্যটক ইবন বতুতা যখন ভারতে এসেছিলেন তখন তিনি ভারতের পশ্চিম উপকূলের মালাবার অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, সমকালে হােনাভার অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন একজন মুসলিম, জামালউদ্দিন মহম্মদ। কিন্তু তিনি এক হিন্দু রাজার (হয়সালা রাজ্যের রাজা) কেন্দ্রীয় শাসন ও অধীনতাকে সানন্দ চিত্তে মেনে নিয়েছিলেন। ইবন বতুতা আরও লক্ষ্য করেন যে, এই অঞ্চলে কম করে বারােটি হিন্দু রাজ্য ছিল এবং এখানে প্রচুর মুসলিম বসবাস করত। যদিও তারা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করত তথাপি তাদের মধ্যে একটা সখ্যতা এবং বন্ধুত্বের ভাব বজায় ছিল।
এই সময় দেবল, সােমনাথ, ব্রোচ, ক্যাম্বে, সিন্দন, চেউল, চাইমুর, থানে, ভারুচ, সান্দান, সােপারা প্রভৃতি হিন্দুরাজ্যগুলিতে (১০ শতকে) বহু মসজিদ নির্মিত হয়।১৩ বেশিরভাগ হিন্দু শাসক তাদের রাজ্যে মুসলিমদের স্বাগত জানান ও তাদের প্রতি উষ্ণ আতিথেয়তা প্রদর্শন করেন। মুসলিমদের প্রতি গুজরাটের বলহারা রাজ্যের বলভী শাসক যে সৌহার্দ্য প্রদর্শন করেন। তার জন্য সুলাইমান, মাসুদী, ইবনে হওকাল, আবু জায়েদ প্রমুখ ঐতিহাসিক সকলেই তার প্রশংসা করেছেন।১৪ মাসুদী তার সহকর্মীদের সর্বত্রই মুক্ত পরিবেশে তাদের ধর্মপালন করতে দেখেন। তিনি গুজরাটের হিন্দু রাজা সম্পর্কে বলেন তার রাজ্যে ইসলামকে শ্রদ্ধা ও রক্ষা করা হয়, রাজ্যের সর্বত্রই চমৎকার উপাসনালয় ও মসজিদ নির্মিত হয়, যেখানে মুসলমানগণ দৈনিক পাঁচবার নামাজ পড়ে থাকেন।১৫ আল ইসতাখরী বলেন, মুসলমানেরাই হিন্দুরাজ্য বলহারার শাসন পরিচালনা করেন।১৬ শুধু তাই নয়, হিন্দু শাসকদের আনুকূল্য লাভ করে মুসলিমরা তাদের ধর্ম প্রচারে উৎসাহিত হয়। ক্যাম্বের হিন্দুরা মুসলিম বণিকদের আক্রমণ করলে সিন্ধুরাজ (১০৯৪-১১৪৩) সমগ্র ঘটনার তদন্তের ব্যবস্থা করেন, আক্রমণকারীদের শাস্তি দেন ও একটি নতুন মসজিদ নির্মাণের জন্য মুসলিমদের অর্থ প্রদান করেন। কোনও কোনও হিন্দু রাজা যেমন-সােমনাথের রাজা, বেতনভােগী মুসলিম সৈনিক ও বেশ কিছু মুসলিম কর্মকর্তা নিয়ােগ করেন।১৭
ভারতীয় রাজা-মহারাজা এবং সাধারণ হিন্দুদের ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি আস্থা ও অসাম্প্রদায়িকতার অবস্থা এমন পর্যায়ে ছিল যে, তারা প্রাচীন প্রথা ও ধর্মীয় রীতি অনুসারে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুসলিম বিজয়ী ও তাদের মহান ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতি ও পাথরের প্রতিমূর্তি স্থাপন করে তাদের স্মৃতি স্মরণে রেখেছিল। সিন্ধুতে মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতিমূর্তি স্থাপন করা হয়, ভারুচে রাজা দাহির ও তার হত্যাকারী, (যিনি বনু কিলাবের ব্যক্তি ছিলেন) উভয়ের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। আরও একজন মুসলিম বিজয়ী হযরত বুদায়েলের প্রতিমূর্তি ‘ক’ নামক স্থানে নির্মাণ করা হয়। অনুরূপভাবে দশম শতকে এক বিখ্যাত ও দক্ষ জাহাজ চালক মুহাম্মদ বিন বাইশাদের মূর্তি একজন ভারতীয় রাজা এইজন্য নির্মাণ করেছিলেন যে, তিনি নৌবিদ্যায় তার যুগের এক মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। প্রকৃত বিষয় হল যে, আধ্যাত্মবাদ ও শক্তির পূজারী জাতি এবং তাদের নেতৃবৃন্দ-শাসকবর্গ ইসলাম ও মুসলমানদের অতি শ্রদ্ধাভরে অভিবাদন ও অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
হিন্দু শাসকরা হিন্দু ধর্মের প্রতি যে ধরণের তদারকীর ভূমিকা পালন করতেন, ভারতীয় ইসলামের প্রতিও অনুরূপ ভূমিকা পালন করার প্রবণতা দেখান। এই প্রবণতার একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হল শাহরুখ মীর্জার প্রতি কালিকটের রাজার পত্র, যাতে তিনি কালিকটের মসজিদগুলির শুক্রবারের ধর্মোপদেশে তার নাম উল্লিখিত হওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন।১৮
এইসব বিবরণ থেকে একটা কথা খুব ভালােভাবে আন্দাজ করা যায় যে, প্রথম যুগের ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিমদের সম্পর্ক কত সুন্দর ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। একে অন্যের জন্য কেমন সহমর্মী ছিলেন। যেখানে মুসলমানদের শাসন ছিল সেখানে নিজেদের অমুসলিম প্রজাদের সর্বপ্রকার ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল। একইভাবে যেখানে অমুসলিমদের শাসন ছিল, সেখানেও মুসলমানরা সর্বপ্রকার স্বাধীনতা ও সাম্য ভােগ করত। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতির অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পুস্তকে সংরক্ষিত রয়েছে।
(৩)
রমেশচন্দ্র মজুমদার কোনাে তথ্যের পরােয়া না করে লিখেছেন যে, মধ্যযুগে মুসলিম শাসিত রাষ্ট্রে হিন্দুরা প্রশাসনের উচ্চপদ পেত না।১৯ রমেশচন্দ্রের সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন এ এল শ্রীবাস্তব। তিনি ঘােষণা করেন, তুর্কি বিজয় বহু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দুদের সামরিক-অসামরিক উচ্চ পদ থেকে বিচ্যুত করে ভারতের বহু পরিবারের আর্থিক দুর্দশার কারণ হয়।২০ কিন্তু যুক্তি দিয়ে বিচার করলে বােঝা যাবে যে, বিখ্যাত এই দুই ঐতিহাসিকের বক্তব্য সঠিক নয়। তুর্কিরা তাদের সামরিক সংগঠন ও কৌশল দ্বারা দ্বাদশ থেকে ত্রয়ােদশ শতকে ভারতের বিভিন্ন অংশ জয় করে। তারা উপলব্ধি করে যে, যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে পরাজিত করা অপেক্ষাকৃত সহজ, কিন্তু যদি তারা কেন্দ্র থেকে গ্রামস্তরের প্রচলিত প্রশাসন ব্যবস্থাকে বদল করতে চায়, তাহলে তাদের ব্যাপক অসন্তোষ ও বাধার সম্মুখীন হতে হবে—যার মােকাবিলা করা কষ্টকর। তাই তারা বড় শাসকদের পরাজিত করে নিচুস্তরের হিন্দু প্রশাসকদের যথা-রাজা, রানা, জমিদার, চৌধুরীর সঙ্গে সমঝােতা করে। তাদের এই সমঝােতার শর্ত ছিল সুলতানকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ট্যাক্স নিয়মিতভাবে প্রদান করলেই এই সমস্ত হিন্দু শাসকশ্রেণি তাদের জমি, অবস্থা, সুযােগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে না। সুতরাং তুর্কি আমলে মুসলিম প্রশাসনের নিম্ন পদগুলি হিন্দুদের হাতে ছিল। হিন্দুরা তুর্কিদের ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।২১
কুতুবউদ্দিন আইবক (১২০৬-১২১০) যখন হিন্দুস্তানে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বেসামরিক প্রশাসনে অভিজ্ঞ হিন্দু কর্মচারীদের বহাল রাখা ছাড়া তার কোনাে উপায় ছিল না। কারণ রাজস্ব সংগ্রহসহ প্রশাসনের সব কিছুতেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হত। মুসলমানগণ ভারতীয় সীমান্তের বাইরে থেকে কারিগর, হিসাবরক্ষক বা করণিক নিয়ে আসেননি। হিন্দুরা তাদের দালানকোঠা নির্মাণ করতেন, প্রাচীন নিয়মগুলােকে তারা নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেন। হিন্দু স্বর্ণকারগণ তাঁদের মুদ্রা তৈরি করতেন, হিন্দু কর্মচারীগণ তাদের হিসাব রক্ষা করতেন। হিন্দু আইন পরিচালনার ব্যাপারে ব্রাহ্মণ আইনবিদগণ রাজাকে উপদেশ দিতেন ও ব্রাহ্মণ জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ তাদের সাধারণ কাজকর্ম পরিচালনায় সাহায্য করতেন। অন্যদিকে ভারতে আগত মুসলমানগণ ভারতকেই তাদের বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করেন। তারা হিন্দু পরিবেষ্টিত হয়ে বসবাস শুরু করেন এবং সেজন্যই হিন্দুদের সঙ্গে স্থায়ী অমিত্রতা অসম্ভব ছিল। পারস্পরিক লেনদেন পারস্পরিক সমঝােতা সৃষ্টি করে।
পঞ্চদশ শতকের প্রথম ভাগে কামেীরের শাসনকর্তা শাহী খান যিনি পরবর্তীকালে জয়নুল আবেদিন (১৪২০-১৪৭০) নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তিনি তার অসাম্প্রদায়িক মনােভাব এবং হিন্দু প্রীতির জন্য ইতিহাসে তাে মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে, তুলনীয় ‘He is the greatest Sultana of Kashmir and some have even compared him to Akbar.’ তাঁর উদার মানসিকতা এতই প্রবল ছিল যে, তিনি নিজে ফারসি ভাষায় জ্ঞান আহরণ করার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত ভাষায়ও ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। তিনি সব রকম সংকীর্ণ মনােভাব পরিত্যাগ করে রাজতরঙ্গিনী ও মহাভারত ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। তিনি হিন্দু উৎসবে নিজে যােগ দিতেন এবং গাে-হত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।২২
বাংলার ইলিয়াস শাহী ও হুসেন শাহী বংশের শাসনের প্রধান কৃতিত্বই হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা।২৩ ইলিয়াস শাহী বংশের শাসকগণ স্থানীয় ধর্মনিরপেক্ষ তার পরিচয় রাখেন। এই বিষয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, ইলিয়াস শাহীরা দেশবাসীর প্রতি খুব ভালাে ব্যবহার করিতেন। এমনকি তাহাদের হিন্দু ও বৌদ্ধ বড়লােকদের সাহায্য না লইলে চলিত না। তাহাদের রাজত্বে অনেক জায়গায় বড় বড় হিন্দু ও বৌদ্ধ জায়গীরদার ছিল।২৪ এর ফলে হিন্দু-বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলিমদের সখ্যতা বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারণি জানিয়েছেন যে, ইলিয়াস শাহের সেনাপতি ছিলেন হিন্দু সহদেব। হিন্দু রাজারাও তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। তার সামরিক শক্তির প্রধান উৎস ছিল পাইকরা। এই পাইকদের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু। বলা যায় যে, হিন্দুদের সাহায্যে তিনি তাঁর স্বাধীনতা রক্ষা করেছিলেন। অধ্যাপক সুখময় মুখােপাধ্যায় ‘বাংলার ইতিহাসের দু’শাে বছর’ গ্রন্থে বলেছেন,
“বাংলার স্বাধীন সুলতানদের হিন্দুর সহায়তা গ্রহণের প্রথম ঐতিহাসিক নিদর্শন এখানেই পাওয়া গেল।”
মুসলমান রাজার আদেশে কৃত্তিবাস বাংলা ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ করেন। ইতিপূর্বে সেন আমলে রামায়ণ-মহাভারত প্রভৃতি হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থাদি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা মহা অপরাধরূপে গণ্য হত। অজিতকুমার ঘােষ ‘বাংলা নাটকের ইতিহাস’ গ্রন্থে তাই যথার্থই বলেন,
“মুসলমানদের আগমনে বাংলা সাহিত্যের অশেষ উপকার সাধিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই। তাহারা বাংলা ভাষা চর্চার এবং বাংলা সাহিত্য প্রণয়নে অশেষ উৎসাহ দিয়াছিল।”
বিশিষ্ট গবেষক সুখময় মুখােপাধ্যায়ও স্বাধীন সুলতানি আমলের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন,
“এই পর্বে বাংলা সাহিত্যের লক্ষণীয় বিকাশ ঘটে। কয়েকজন দিকপাল কবি এই পর্বেই আবির্ভূত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে সুগঠিত ও সমৃদ্ধিসম্পন্ন করেন, তাঁদের অনেকেই বাংলার রাজা ও রাজ-কর্মচারীদের কাছে। পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছিলেন। কাজেই বাংলার ইতিহাসের আলােচ্য এই পর্বটি সব দিক দিয়েই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এই পর্বে যেসব সুলতান বাংলাদেশ শাসন করেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই অসাধারণ ছিলেন।”
এন এন ল তার গ্রন্থে২৫ সমগ্র উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের যে সার্বিক সুফলের বর্ণনা দিয়েছেন বাংলায় মুসলিম শাসন সম্পর্কে তা সমভাবে প্রযােজ্য। তিনি বলেন,
‘…that the Mohammedan invasion of India marked the begining of momentous changes not only in the social and political spheres, but also in the domain of education and bearing.’
(৪)
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রোপট কি? রাজশক্তির পক্ষে থেকে এই সমন্বয়মূলক তত্ত্ব সচেতনভাবে প্রয়ােগ করা হয়েছিল কিনা তা বিবেচ্য। অধ্যাপক ইকতিদার আলম তার ‘Medieval Indian Notions of Statecraft in Retrospect’ প্রবন্ধে২৬ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। যদিও ভারতের প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্যের মধ্যে সমন্বয় ভাবনার বহু উপাদান পাওয়া যায়, কিন্তু আধুনিক ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রেক্ষাপট হিসেবে বেশি প্রাসঙ্গিক বলেই মধ্যযুগীয় শাসকদের বিশেষ করে সুলতানি ও মুঘল শাসকদের রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজশক্তির ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রবণতাকে ইকতিদার আলম বেশি করে গুরুত্ব দিয়েছেন।
মধ্যযুগের ভারতে মুসলিম বিজয় ছিল খুবই মন্থর। উত্তর ভারতে পৌঁছতে মুসলিমদের সময় লাগে প্রায় ৫০০ বছর। শুরুর দিকে বলা হয়েছে, সিন্ধুতে প্রথম অভিযান হয় ৭১২ সালে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে। দ্বিতীয় অভিযান হয় সুবক্তগীন ও সুলতান মাহমুদের (৯৯৭-১০৩০) নেতৃত্বে, দশম শতকের শেষ দিকে ও একাদশ শতকের শুরুতে। এর প্রায় ২০০ বছর পরে তৃতীয় অর্থাৎ শেষ যে দফায় ভারতে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়, তা ছিল শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘােরির (১১৭৫-১১৯২) অভিযান। বিন কাসিম হিন্দুদের মর্যাদা অগ্ন রাখেন। ‘পক্ষপাতশূন্য’ সুলতান মাহমুদের ভারতে ইসলাম প্রচারের কোনাে উদ্দেশ্য ছিল না। মাহমুদের পর মুহাম্মদ ঘােরির আগমন। পারসিক কাহিনিকাররা মুহাম্মদ ঘােরির বিজয়কে ইসলামের বিজয় বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রকৃত তথ্য বিশ্লেষণ করলে, “এমন অভিযােগ করা চলে না যে, শাহাবুদ্দিন ও তার মুসলিম অনুচরদের প্রেরণামূলক ধর্মীয় উদ্দীপনা রাজপুতদের প্রেরণদায়ী উৎসাহ উদ্দীপনা থেকে জোরালাে ছিল। পূর্বোক্ত ব্যক্তি ধর্মযুদ্ধ করেন বলে মুসলিম ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করলেও, শাহাবুদ্দিন কিন্তু যুদ্ধ করছিলেন রাজ্য জয়ের জন্য, ধর্ম প্রসারের উদ্দেশ্য নয়। আসলে আমরা দেখি, উত্তর ভারত জয় করে মানুষকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার কোনাে প্রবৃত্তি তার ছিল না।”২৭ শাহাবুদ্দিন ঘােরির পর কুতুবউদ্দিন আইবক ও ইলতুৎমিসের (১২১১-১২৩৬) অভিযানকে অবিকল একই ভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু আমরা যখন অতিরঞ্জিত উপকরণমালাকে ছাঁটকাট করি, তখন দেখি “কুতুবউদ্দিন ও ইলতুৎমিস ধর্মোন্মাদ মুসলিম ছিলেন না, ছিলেন বিজ্ঞ শাসক যাঁরা ন্যায়বিচার, এমনকি জনগণের ধর্মে হস্তক্ষপ না করার জ্ঞান উপলব্ধি করেন।”২৮
মধ্যযুগে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিম হলেও, রাষ্ট্র কিন্তু ইসলামি ছিল না। রাষ্ট্র কখনই ইসলামের চার মযহাবের বিধিবদ্ধ বিধান অনুসরণ করেনি। বিখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মদ হাবিব তাই বলেছেন,
“বিদেশাগত হলেও মুসলিম বাদশাহরা যে ৬০০/৭০০ বছর হিন্দুস্তানের মসনদে গদিয়ান থাকতে পেরেছিলেন, তার কারণ তাদের শাসন কোনওভাবেই ইসলামি ছিল না। থাকলে এক প্রজন্মও তারা টিকতে পারতেন না।”২৯
বস্তুতপক্ষে তথাকথিত মুসলিম যুগে ভারতে গােটা শাসকশ্রেণি কখনও মুসলিম ছিল না। বাদশাহ বা সুলতান মুসলমান হলেও দেশের শাসকগােষ্ঠী আমির-ওমরাহ-ফৌজদার-মনসবদার ও অভিজাততন্ত্রের গরিষ্ঠ অংশই ছিল হিন্দু, এছাড়া কোনও উপায় ছিল না। মুসলিম শাসকরা দেশের প্রথা, পদ্ধতি, ব্যবস্থা কোনও কিছুতেই জোর করে পরিবর্তন আনতে চাননি। হিন্দু রাজা ও ভূস্বামীদের সঙ্গে বােঝাপড়া করেই যে তাদের পক্ষে গদিতে থাকা সম্ভব, তা তারা বিলক্ষণ জানতেন। মনসবদারী প্রথা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুঘল প্রশাসক শ্রেণির কাঠামােগত পরিবর্তন সূচিত হয়। বিভিন্ন শ্রেণি ও জাতি, বিদেশি ও ভারতীয়দের মধ্য থেকে মনসবদররা নিযুক্ত হতেন। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’তে৩০ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মনসবদারদের যে তালিকা তুলে ধরা হয়েছে তাতে যেমন আফগানি, সৈয়দ, শেখ, শেখজাদা জমিদারগণ রয়েছেন, তেমন ব্রাহ্মণ ও রাজপুত জমিদারগণও আছেন। মুঘল আমলে সহকারী দিওয়ান বা অর্থমন্ত্রীর পদের ক্ষেত্রে সাধারণত হিন্দুরাই নিযুক্ত হতেন। শাসকরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন বলে অনিবার্যভাবে তাদের হিন্দুবিরােধী হতে হবে, এরকম ধারণা যে কত ভুল রমিলা থাপার ও হরবংশ মুখিয়া তা দেখিয়েছেন তাদের রচনায়।৩১ এ ক্ষেত্রে তারা মুসলিম দরবারি কলমচিদের রচনার সাক্ষ্য মেনেছেন।
ত্রয়ােদশ শতাব্দী থেকেই একের পর এক সুলতান শরিয়তকে শিরােধার্য করার অবাস্তবতা স্বীকার করে নেন। সমসাময়িক ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারণি লেখেন, ‘পয়গম্বরের অনুশাসন মেনে রাজ্য চালানাে সম্ভব ছিল না, এ ব্যাপারে বরং খুসরু পারভেজ বা ইরানের নৃপতিদের নীতি বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়। মুহাম্মদ হাবিব বলেছেন, কোনাে সংঘর্ষের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন শরিয়তের চেয়ে বড় হত।৩২ ‘তবকৎ-ই-আকবরি’ গ্রন্থে৩৩ নিজামউদ্দিন লিখেছেন, সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন রাষ্ট্র-ব্যাপারকে ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দিতেন। জিয়াউদ্দিন বারণির মতে, একই কথা প্রযােজ্য ফিরােজ শাহ তুঘলক সম্পর্কেও। ‘তারিখ-ই-ফিরােজশাহী’ গ্রন্থে বারণি লেখেন, ‘অপরাধীদের শাস্তিবিধান কিংবা রাজকীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তুঘলক ঈশ্বর-ভীতির দ্বারা পরিচালিত হতেন না। রাজকার্যের স্বার্থে, রাষ্ট্রের স্বার্থে, তিনি যা ভাল মনে করতেন তা-ই প্রয়ােগ করতেন। অথচ তার প্রতি কিছু সঙ্কীর্ণ মনােভাবাপন্ন ঐতিহাসিকগণ অসিহষ্ণুতার অভিযােগ আরােপ করেন। অথচ মূল সত্য তার বিপরীত। এই যুগের ঐতিহাসিক আফীফ বলেন যে, ফিরােজ শাহ তুঘলক (১৩৫১-১৩৮৮) নিজে দেশের জনগণের প্রতি সেইভাবে লক্ষ্য রাখতেন, যেমন কোন জননী তার সন্তানদের প্রতি লক্ষ্য রাখেন। তিনি জনগণের বহু অপরাধ ক্ষমা করে দিতেন, কিন্তু চুরি ও হত্যার অপরাধ ক্ষমা করতেন না কারণ সেক্ষেত্রে অন্যের অধিকার হরণ করা হত। তিনি সিংহাসনে আরােহন করা মাত্রই কৃষকদের উপর আরােপিত করের বােঝা মাফ করে দেন, যাতে জনগণের মধ্যে অশান্তির ও দুশ্চিন্তার পরিবর্তে স্বাচ্ছন্দভাব তৈরি হয়। তিনি শরিয়ত বিরােধী সকল কর মকুব করে দেন। যদি কোনাে কর্মচারী নির্ধারিত করের চেয়ে বেশি আদায় করত, তাহলে সেটা সংশােধন করা হত। তাঁর সময়ে সকল অমুসলিম প্রজারা স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন করত।৩৪
ফিরােজ শাহ তুঘলকের শিক্ষা বিষয়ক সম্প্রীতির কথা অধিকাংশ ইতিহাসবিদগণ স্বীকার করেছেন। এটাও সত্য যে, তিনি হিন্দুদের শিক্ষা বিষয়ক যেসব গ্রন্থ পেয়েছেন, সে সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞান লাভ করে সন্তুষ্ট হয়েছেন। ১৩৬২ সালে সুলতান ফিরােজ নগরকোট জয়ের পর জ্বালামুখী মন্দির থেকে ১৩০০ সংস্কৃত বই নিয়ে আসেন এবং সংস্কৃত পণ্ডিতদের এই বইগুলাে ফারসি ভাষায় অনুবাদের কাজে নিযুক্ত করেন। একটা গ্রন্থে হিন্দুদের দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা ও আধ্যাত্মবিদ্যা বিষয়ে অতি মূল্যবান জ্ঞানের কথা ছিল, ফিরােজ শাহ তুঘলক সেটা ফারসি ভাষায় অনুবাদ করার নির্দেশ দেন।৩৫ এছাড়া হিন্দু ধর্মবিষয়ক অনেক পুস্তক তিনি অনুবাদ করিয়েছিলেন। হিন্দু রাজা, মহারাজা ও আমিরদের সাথে তার সুসম্পর্ক বজায় ছিল। বারণি বর্ণনা করেন যে, এক সফরকালে ফিরােজ শাহ যখন গােরখপুর ও কহরুসাহ পৌঁছান, তখন সেখানকার রায়তগণ তাদের মুকাদ্দম ও রানাদের সঙ্গে নিয়ে তাঁর দরবারে হাজির হয়, এবং ফিরােজ শাহ তাদেরকে রাজকীয় উপঢৌকন দ্বারা সম্মানিত করেন।৩৬ ফিরােজ শাহ শাসনক্ষেত্রে অশােকের নীতিসমূহ গ্রহণ করেছিলেন, যাতে রাজনীতির কুপ্রভাব দুরীভূত হয় এবং সাধারণ লােকের মঙ্গল ও কল্যাণের ক্ষেত্রে এক নতুন আর্থিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
কাজি মুগিসউদ্দিনের সঙ্গে আলাউদ্দিন খলজির কথােপকথন আজ সুবিদিত। হরবংশ মুখিয়া ‘তারিখ-ই-ফিরােজশাহী’ থেকে দেখিয়েছেন যে, মুগিসউদ্দিন যখন শরিয়তের দোহাই দিয়ে সুলতান আলাউদ্দিনকে জিজিয়া আদায় করার সময় হিন্দু মন্দির ধ্বংস করতে বলেন তখন সুলতান নির্দ্বিধায় জবাব দেন ‘আমি জানি না রােজ কেয়ামতের দিনে মহামহিম আল্লাহ আমার জন্যে কী রেখে দিয়েছেন, তবে সরকারের স্বার্থে আমি যা সঠিক মনে করেছি, তাই করে গেছি।৩৭ আসলে ইসলামি অর্থাৎ শরিয়তি শাসন কায়েম করার কোনও অভিপ্রায় ছিল না বলেই মুসলিম শাসকদের যেমন জোর করে কোটি কোটি হিন্দুকে গণ-ধর্মান্তরিত করার প্রয়ােজন হয়নি, তেমনই তারা হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণ করার অর্থাৎ পাইকারি হারে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করার কোনও তাগিদও অনুভব করেননি। বরং একের পর এক মুসলিম বাদশাহ হিন্দু মনসবদারদের আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে জায়গীর দান করেছেন।
বলপূর্বক ধর্মান্তরের ঘটনা যে একেবারে ঘটত না তা নয়, তবে সুলতানরা যে ব্যাপকভাবে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সার্বিক কোনও রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করেছিলেন, সে-তথ্য পাওয়া যায় না। তুর্কি বীর বখতিয়ার খলজির হাতে একজন ‘মেচ সামন্ত ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ‘আলি মেচ’ নাম গ্রহণ করেছিলেন বলে সমসাময়িক ইতিহাসে দেখা যায়।৩৮ বখতিয়ার আর কোনাে অমুসলিমকে ধর্মান্তরিত করেছিলেন বলে কোনাে প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর আলি মেচকেও যে জোর করে মুসলমান করা হয়নি, সে বিষয়েও নির্ভরযােগ্য প্রমাণের অভাব নেই।৩৯ তিব্বত অভিযানে কামরূপ বাহিনীর কাছে প্রায় পুরাে বাহিনী হারিয়ে, মাত্র শ’খানেক সৈন্যসহ মােহাম্মদ বখতিয়ার যখন আলি মেচের এলাকায় কোনাে রকমে প্রাণ নিয়ে পৌঁছেছিলেন, তখন তার সেই চরম দুর্দিনে আলি মেচের লােকেরাই তাকে সব ধরণের সাহায্য করে নিরাপদে দেবকোটে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ তারা ইচ্ছা করলে সহজেই তাকে হত্যা করতে পারত। এতে ধারণা করা যায়, আলি মেচের ইসলাম গ্রহণের পিছনে আর যাই থাক না কেন, অন্তত কোনাে জোর-জবরদস্তি ছিল না।৪০
রাজা গণেশের পুত্র যদু রাজনৈতিক চাপে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং জালালউদ্দিন মােহাম্মদ শাহ (১৪১৭-৩২) নাম ধারণ করে গৌড়ের অধিপতি হয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণের সময় জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কি, গৌড়ের পির নুরকুতুব আলম বা সেখানকার আমির-ওমরাহ যদুকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেছেন, এমন প্রমাণ কোথাও নেই। এই ধর্মান্তরিত জালালউদ্দিন অনেক ব্রাহ্মণকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু তিনি তা করেছিলেন ব্যক্তিগত আক্রোশে। কারণ, তাঁর পিতার প্ররােচনায় এসব ব্রাহ্মণ ইতিপূর্বে তাকে হেনস্তামূলক প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে হিন্দু করিয়েছিলেন।৪১ ইসলামে ধর্মান্তর সুলতানরা পরিহার করেই চলতেন। সুবেদার ইসলাম খান এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিজে ছিলেন ধর্মভীরু মুসলমান। ইসলাম অনুমােদিত না হওয়ায় বিশেষ উৎসবেও তিনি তার আমিরদের মদ্যপান অনুমােদন করতেন না। তাই কোনাে উৎসবে তার উপস্থিতির কথা থাকলেও তার পৌঁছানাের আগেই আমির-ওমরারা মদ্যপান বন্ধ করে আতর ছিটিয়ে দিতেন। রাষ্ট্রের অন্য কর্মকর্তাগণও সাধারণভাবে ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপমুক্ত নীতি অনুসরণ করতেন। শাহজাদপুরের জমিদার রাজা রায়কে পরাজিত করার পর তার পুত্র। রঘু রায় সেনাপতি তুমাক খানের নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। তুকমাক খান তাকে ব্যক্তিগত ভৃত্যরূপে নিয়ােজিত করেন। এতে ধর্মভীরু মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম খান ও অন্য শাহী কর্মকর্তাগণ বিরক্ত হন। ইসলাম খান তুমাক খানকে ভৎর্সনা করে চিঠি লেখেন এবং তাঁকে জায়গির থেকে সরিয়ে শাস্তি দেবার সুযােগের অপেক্ষায় থাকেন।৪২
(৫)
ধর্মের কথা মাথায় না রেখে মুঘলরা বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ষােলাে শতকে তারিখ-সম্বলিত ৭৩টি মসজিদ নির্মিত হলেও সতেরাে শতকে এ রকমের নতুন মসজিদের সংখ্যা কমে যায়। তখন নির্মিত হয় মাত্র ২৪টি মসজিদ। পরের অর্ধ শতকে নির্মিত হয় আরও কম, মাত্র ৮টি মসজিদ। অপরদিকে, এ সময়ে নতুন ইটের মন্দির নির্মাণে বিপুল উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। আর এম প্রদত্ত তথ্য৪২ক হতে জানা যায় যে, ষােলাে শতকে তারিখ সম্বলিত মাত্র সাতটি মন্দির তৈরি হলেও সতেরাে শতকে (১৬০১-১৭০০) তৈরি হয় ৭৪টি। আঠারাে শতকে ইংরেজ রাজত্ব স্থাপনের আগে পর্যন্ত ছয় দশকে (১৭০১-১৭৬০) নির্মিত হয় আরও ১৩৮টি। বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের শাসনকালেও (১৬৫৮-১৭০৭) শুধু বঙ্গদেশেই ইটের মন্দির নির্মিত হয়েছিল ৫০টিরও বেশি। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, বঙ্গদেশে হিন্দু-মুসলমানের ক্রমবর্ধমান সম্প্রীতি ও মিলনের তথ্য এখানে খুবই স্পষ্ট। কেননা, মন্দির নির্মাণের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা তার ইঙ্গিত বহন করে। আসলে, যতই দিন যাচ্ছিল ততই বঙ্গদেশের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সমন্বয় ও সহাবস্থানের মানসিকতা আর বােঝাপড়ার কামনাও বেড়ে উঠছিল। অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বঙ্গদেশের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সামঞ্জস্যের কাজটি প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছিল।
অন্যদিকে মন্দিরাদি ধ্বংসের ব্যাপারগুলি ছিল লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যপ্রণােদিত এবং অনেক সময় সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসাবে মন্দির ধ্বংস হয়েছে। হিন্দু সাধু-সন্তদের প্রতি সুলতানরা যে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তারও প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রণ তুলেছেন যে, এটা আমাদের বুদ্ধির অগম্য, সুলতান মাহমুদের সােমনাথ লুণ্ঠনের পর আবার সেখানে কেন ধনরত্ন মজুত করা হয়েছিল ? যার জন্য গুজরাটের মুজাফফর শাহ দ্বিতীয়বার সােমনাথের মন্দির লুণ্ঠনের সুযােগ পেয়েছিলেন। তখনকার সব মন্দিরের পুরােহিতশ্রেণির প্রতি সাধারণ মানুষের মনােভাব যে ভাল ছিল না তা রামাই পন্ডিত রচিত ‘শূন্যপুরাণ’ থেকে জানা যায়। জাজপুর শহরে মুসলমান কর্তৃক মন্দির ধ্বংস হলে সেখানকার নিম্নশ্রেণির লােকেরা দুঃখিত না হয়ে আনন্দিতই হয়েছিল।৪৩ আবার এই গ্রন্থেই ব্রাহ্মণদের দ্বারা বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণির লােকদের ওপর চরম অত্যাচারের কথা বর্ণিত আছে। এই তথ্য থেকে আর একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সুলতানি রাষ্ট্রকে যে-সব আধুনিক ঐতিহাসিক ‘ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র’ বলে চিহ্নিত করতে গিয়ে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করার তত্ত্ব উল্লেখ করেছেন, সে-যুক্তিরও সারবত্তা নেই। এই জন্য ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র বলেছেন, সুলতানি যুগে তরবারির সাহায্যে ভয় দেখিয়ে কাউকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়নি। যদি তাই হত, দিল্লি অঞ্চলের হিন্দুদের সর্ব প্রথমেই ধর্মান্তরিত করা হত। দিল্লিতে তাহলে একজনও হিন্দু থাকত না। বারণিও হিন্দুদের উপর বল প্রয়ােগের কথা উল্লেখ করেননি। বল প্রয়ােগের চেয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযােগ-সুবিধা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যই সমাজের নীচুতলার মানুষ ইসলামের সাম্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।৪৪
অধিকাংশ মুসলমান রাষ্ট্র-কর্ণধার, এমনকি ঔরঙ্গজেব ধর্মের ব্যাপারে উদারনৈতিক ধারণা পােষণ করেছেন এবং তার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন।৪৫ গজনীর সুলতান মাহমুদ হিন্দু মন্দির লুণ্ঠন করলেও (সােমনাথ) পারস্যের নবজাগরণের অন্যতম প্রতিনিধির মর্যাদাতেই তিনিই আবার হিন্দু পণ্ডিতদের বসবাসের জন্য এক আবাসকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাঞ্জাবকে মাহমুদ আফগান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, কিন্তু তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অফুরন্ত সম্পদের অধীর হওয়া। এই সম্পদ ব্যয়িত হত তার যুদ্ধ অভিযান সংগঠিত করতে ও শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপােষকতায়। মজুমদার, রায়চৌধুরি ও দত্ত তাদের ‘অ্যান অ্যাডভান্সড হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থেমাহমুদ প্রসঙ্গে বলেছেন, “তার প্রশান্ত সাহসিকতা, বিজ্ঞতা, উদ্ভাবনীশক্তি ও অন্যান্য গুণাবলী তাঁকে এশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম প্রধান বৈচিত্রময় ব্যক্তিত্বের মর্যাদা দিয়েছে।…শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক সুলতান, শিল্পের বােদ্ধা ও পৃষ্ঠপােষক এবং বিদ্যোৎসাহী ছিলেন…ধর্মপ্রচার বা রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি এদেশে আসেননি।” ঐতিহাসিক ঈধুরীপ্রসাদ বলেন, “নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের চোখে মাহমুদ একজন শ্রেষ্ঠ জননেতা।…তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজাদের একাসনে বসার জন্য সমকক্ষ।”৪৬
মাহমুদের ছিল বিশাল হিন্দুবাহিনী যারা মধ্য এশিয়ায় তার হয়ে লড়াই করেছে। শুধু তাই নয়, মাহমুদ তার হিন্দু সেনাপতি তিলকের হাত দিয়ে দমন করিয়েছিলেন তাঁরই মুসলমান সেনাপতি নিয়ালতিগিনের বিদ্রোহ।৪৭ সেই সঙ্গে মাহমুদের ১২ জন সেনাধ্যক্ষ ছিলেন হিন্দু, এর মধ্যে ২ জন ছিলেন ব্রাহ্মণ। সর্বোপরি তার সেনাবাহিনীর ৫০ শতাংশ ছিল হিন্দু। শুধু সেনাবিভাগ নয়, ব্রাহ্মণ হিন্দুদের তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করতেন। তিনি হিন্দুদের বিচার হিন্দু আইনমত করবার ব্যবস্থা মেনে চলতেন।৪৮ হিন্দুদের উপর ইসলাম চাপিয়ে দেবার জন্য উলেমাদের পরামর্শ ইলতুৎমিস গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। তঁার সময় থেকে শুরু করে বলবন (১২৬৬-১২৮৬), আলাউদ্দিন খলজি (১২৯৬-১৩১৬), মহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১) ও শের শাহ (১৫৪০-১৫৪৫) পর্যন্ত এই অভিমত পােষণ করতেন যে, ধর্ম প্রচারক ও শাসক—এই দুই ভূমিকার একীকরণ অসম্ভব। কামীর, বাংলা ও দাক্ষিণাত্যের প্রাদেশিক সুলতানদের মধ্যেও অনুরূপ অভিমত প্রচলিত ছিল।৪৯
মুঘল সম্রাট বাবর (১৫২৬-১৫৩০) পুত্র হুমায়ুনের (১৫৩০-৪০ ও ১৫৪৫-১৫৫৬) উদ্দেশ্যে রেখে যাওয়া ‘ইচ্ছাপত্র’-এ সারা জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ যে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার কথা লিখে গেছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম, “হে আমার পুত্র, ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্মের লােক বাস করে। তাই ঈরকে ধন্যবাদ যে, নৃপতিদেরও যিনি নৃপতি তিনিই তােমার ওপর এই দেশ শাসনের ভার ন্যস্ত করেছেন, সুতরাং তােমার কাছ থেকে আশা করা যাচ্ছে যে—তুমি ধর্মীয় কুসংস্কার দিয়ে তােমার মনকে প্রভাবিত হতে দিবে না, এবং সকল সম্প্রদায়ের লােকদের ধর্মবিাস ও ধর্মীয় আচরণের প্রতি যােগ্য সম্মান প্রদর্শন করে নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করবে।” বাবর তার ইচ্ছাপত্র’-এ হিন্দুদের জন্য গাে-বধে বিরত থাকার উপদেশও দিয়েছেন।৫০
শাসন ব্যবস্থায় যুগােপযােগী সংস্কারের ক্ষেত্রে শের শাহের কৃতিত্ব চির অম্লান।৫০ক তিনিই ভারতে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ প্রশাসনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। ভারতে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত যে রাজস্ব ব্যবস্থা ও মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা শের শাহের কীর্তি। উদারতা ও সহিষ্ণুতা ছিল তার ধর্মনীতির মূলভিত্তি এবং ধর্মীয় নিরপেক্ষ তার ফলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সমঝােতা গড়ে ওঠে। তিনি হিন্দুদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা দেন। তিনি হিন্দুদের শিক্ষা পদ্ধতিতে হস্তক্ষেপ করেননি। তারা সংস্কৃত ভাষায় সনাতনী পদ্ধতিতে তাদের সম্প্রদায়ের শিশুদের শিক্ষা দান করতে পারত। শের শাহের শাসন ব্যবস্থায় বহু হিন্দু উচ্চ রাজকর্মচারীরূপে নিযুক্ত ছিলেন। ব্রহ্মজিৎ গৌড় ছিলেন তার অন্যতম প্রধান সেনাপতি। হিন্দু ও মুসলিম প্রজাদের মধ্যে কোনােরকম বৈষম্যমূলক ব্যবহার তার আমলে ছিল না। শের শাহের সময়ে হিন্দুধর্ম যথাযথ স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এ ব্যাপারে আকবরের (১৫৫৬ – ১৬০৫) সাহসী প্রয়াস সর্বজনবিদিত।৫১
আকবর শিক্ষার ক্ষেত্রে আমূল, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কার করেন। তিনি মক্তব ও মাদ্রাসা শিক্ষায় ব্যাকরণ, ন্যায়, বেদান্ত ও পতঞ্জলির টীকা পাঠকে বাধ্যতামূলকভাবে চালু করেন। এই ব্যবস্থার দ্বারা মুসলমান ও হিন্দু ছাত্র পারস্পরিক ঐতিহ্য ও ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করত। আসলে আকবর একটি বলিষ্ঠ নীতি রূপায়ণের সূত্রপাত ঘটান, যার ফলে তার যুগে ‘অন্ধ অনুসরণে’র স্তম্ভ ভেঙে পড়ে আর ধর্মবিষয়ে গবেষণা ও জিজ্ঞাসার নব অধ্যায় সূচিত হয়।৫২ আকবরের সময়ে অনূদিত সংস্কৃত গ্রন্থগুলিকে তার দরবারের শিল্পীরা চিত্রায়িত করেন। দরবারের পাঠাগারের জন্য রচিত মহাভারতের একটি কপি জয়পুরের মহারাজের হস্তগত হয়।৫৩
মুসলমানদের হিন্দুধর্ম সম্পর্কে গভীরভাবে জ্ঞাত করাতে দারাশুকো (-১৬৫৯) হিন্দুদের বেশ কয়েকটি দার্শনিক গ্রন্থের ফারসি অনুবাদ করান। ৫২টি উপনিষদ ফারসিতে অনুবাদ করানাে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ১৬৫৭ সালে এই অনুবাদ শেষ হয়েছিল। তার এই অনুবাদ থেকে পাশ্চাত্য জগতে উপনিষদের প্রথম পরিচয় ঘটে। কারণ দারার অনুবাদ থেকে উপনিষদের ফরাসি অনুবাদও প্রকাশিত হয়। দারার অনুপ্রেরণায় রচিত হয় ‘মাজমাউল বাহরাইন’ বা ‘দুই সমুদ্রের মিলন’ অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলমানের মিলন। তাছাড়া দারাশুকো নিজে রচনা করেন ‘তরিকত-উল-হকিকত’ এবং অনুদিত যােগবশিষ্ট রামায়ণের ভূমিকা লিখে দেন। প্রথম পুস্তকটি মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা দারাশুকোর সমালােচনার জবাব, দ্বিতীয়টি আধ্যাত্মিক পথের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে। দারাশুকো তার ধর্মীয় দার্শনিকতায় শেষ পর্যন্ত অদ্বৈত বেদান্তবাদের সন্নিকটবর্তী হয়েছিলেন।৫৪ জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭), শাহজাহান (১৬২৭-১৬৫৮) ও ঔরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭) সময়ে দারাশুকোর রচনা ছাড়াও অন্যান্য সংস্কৃত গ্রন্থের স্বচ্ছন্দ অনুবাদ হয়।৫৫ আবদুর রহমান চিস্তি (-১৬৮৩) তার ‘মিরাত-উল-হকিকত’-এ ভাগবৎ গীতার একটি ইসলামি ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করেন।৫৬
হিন্দুদের ললিতকলা, বিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ে কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থও রচিত হয় এ সময়। সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হল, ঔরঙ্গজেবের আমলে মীর্জা মুহাম্মদ রচিত সংগীত বিষয়ক গ্রন্থ ‘তুহফাতুল হিন্দ’। জাহাঙ্গীর পিতার সহনশীল পথ থেকে সরে আসেননি। আর শাহজাহান কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার পর সহনশীল পথে চলতে থাকেন। এমনকি ঔরঙ্গজেবও ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার অকার্যকারিতা উপলব্ধি করেন। ঔরঙ্গজেবের আমলে হামিদউদ্দিন খান সংকলিত ‘আখাম-ই-আলমগিরি’তে এই অনুচ্ছেদগুলি আছে ‘জাগতিক ব্যাপারে ধর্মের কী করার আছে? আর ধর্মের ব্যাপারে গোঁড়ামির অনুপ্রবেশ ঘটবে কেন?’, “তােমার ধর্ম তােমার জন্য, আমার ধর্ম আমার জন্য” (কোরআন)। আইন যদি অনুসরণ করা হত, তাহলে সব রাজা ও প্রজাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার প্রয়ােজন দেখা দিত। তার অন্য একটি অনুশাসন ছিল ‘কারাে ধর্ম নিয়ে আমাদের কী যায় আসে? যীশু তাঁর ধর্ম পালন করুন, আর মুসা করুন তাঁর।৫৭
সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ঔরঙ্গজেব তার শিক্ষাগুরু মােল্লা সালেহ-র ওপর দোষারােপ করেন।৫৮ ঔরঙ্গজেব জৈন ও শৈব্য সম্প্রদায়ের জন্য বহু নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। বিহার থেকে পাওয়া অনেক সনদের সাক্ষ থেকে হিন্দু মন্দিরের জন্য ঔরঙ্গজেবের নিষ্কর জমি দানের কথাও জানা যায়।৫৯ রেখা যােশীর ‘ঔরঙ্গজেব—অ্যাটিটুডস অ্যান্ড ইনক্লিনেসন্স’-গ্রন্থে জানা যায় যে, কাশীর বাঙালিটোলায় রথিত ঔরঙ্গজেবের আরও তিনটি ফরমানের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই ফরমান থেকে জানা যায়, তিনি ওই মঠের জন্য তিনবার অর্থদান, ভূমিদান ও আগেকার তিনটি অনুদানকে পুনরায় কার্যকরী করেন।
কেবল ধর্মীয় স্তরেই নয়, ধর্মের নামে অসামাজিক রীতির বিরুদ্ধেও মুসলমান সম্রাটরা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। আলাউদ্দিন খলজি দেশে মদ, আফিম ও ভাঙের নেশা নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি জুয়া খেলা বন্ধ করেন ও জুয়াড়ীদের দিল্লি থেকে বিতাড়িত করেন। স্ত্রী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রে চরিত্রহীনতার জন্য তার সময়ে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল। আকবর হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ করে বিবাহের বয়স সীমা পুরুষদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১৬ বছর এবং নারীদের (ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১৪ বছর নির্ধারণ করে দেন। এই নির্দেশ কঠোরভাবে পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য আলাদা ‘দারােগার পদ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। উলেমাদের তীব্র বিরােধিতা সত্বেও নিঃসন্তান ছাড়া অন্য কারও একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ করেন সম্পত্তির লােভে বয়স্ক নারীকে অল্প বয়সী মুসলমানের বিবাহরীতিকে রদ করেন আকবর।
হিন্দু-মুসলমান সমাজে পণপ্রথার প্রকাশ্যে বিরােধিতা করেন আকবর। তিনি ছিলেন জুয়া ও পতিতাবৃত্তির বিরােধী। নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সতীদাহের চেষ্টা তিনিও বন্ধ করেন। জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের সময়েও এই ব্যবস্থা বহাল ছিল। ঔরঙ্গজেব ১৬৬৪ সালে ফরমান জারি করে তাঁর রাজত্বে সতীদাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন।৬০ এক্ষেত্রে কোনাে এক অভিযােগে ঔরঙ্গজেবের প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের ঘটনার কথাও জানা যায়।৬১ আজকের ‘হিন্দু কোড বিল’-এর অগ্রদূত ‘জাভাবিৎ-ইআলমগিরি’ ঔরঙ্গজেবের আমলেই সূত্রবদ্ধ করা হয়। তিনি সারা দেশ থেকে হিন্দু পণ্ডিতদের সমবেত করে মনুসংহিতা, অর্থশাস্ত্র। ও অন্যান্য হিন্দুশাস্ত্রের ভিত্তিতে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাগুলির অপসারণ করে হিন্দুদের জন্য ধর্মীয় সামাজিক নিয়ম চালু করার উদ্যোগ নেন।
(৬)
ছত্রপতি শিবাজী (১৬৪৭-৮০) ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বহু দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। কিন্তু বর্তমানে দুর্বল হিন্দুদের বাহুবলের প্রেরণা জোগাতেই অনেকে ‘উগ্র হিন্দুরূপে’ শিবাজীকে ব্যবহার করতে চাইছেন। যেটা শুধু কাল্পনিক নয়, ইতিহাস বর্জিতও বটে। কেননা আঞ্চলিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য হােক বা অর্থনৈতিক দাবি আদায়ের জন্য হােক, শিবাজীর যে সংগ্রামগুলি স্বভাবত রাজনৈতিক, সেগুলিকে রূপান্তরিত করা হয়েছে ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে।
তবে এটা স্বীকৃত যে, হিন্দুধর্মের সামরিক পুনর্জাগরণ সত্য সত্যই শুরু হয়েছিল শিবাজীর নেতৃত্বে। তিরিশের দশকের শেষভাগে ভি ডি সাভারকর শিবাজীর স্থান নির্ণয় করেছিলেন হিন্দু মহাসভার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে। এই ভাষণে তিনি বলেছিলেন,
“সহস্র সহস্র কৃষকের সঙ্গে নৃপতিরাও জেগে উঠলেন হিন্দু হয়ে, সমবেত হলেন হিন্দু পতাকার তলে, বিদ্রোহ করলেন, যুদ্ধ করলেন এবং অহিন্দু শত্রুদের হাতে মৃত্যুবরণ করলেন। অবশেষে জন্মগ্রহণ করলেন শিবাজী। হিন্দু জাগরণের ঘন্টাধ্বনি হল, অবসান হল মুসলিম প্রভুত্বের।”
এটা নিখাদ সত্য যে, ১৬৭৪-র ১৬ জুন ‘হিন্দু পাদশাহী’ ঘােষণা করেছিলেন শিবাজী এবং ছত্রপতি খেতাব তুলে নিয়েছিলেন তাঁর মাথায়। কিন্তু এমন কোনও প্রমাণ নেই যে, মুসলিমদের বিদেশী উৎপীড়ক মনে করে তিনি তাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন। মুঘলের বিরুদ্ধে শিবাজীর সংগ্রামকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রূপান্তরিত করেছিলেন কিছু কুচত্রী ভাষ্যকারেরা। কিন্তু ঘটনা এই যে, প্রায়ই মুসলিম সামন্ত রাজাদের সঙ্গে জোট বেঁধে যুদ্ধ করে গেছেন শিবাজী। জীবনের শেষলগ্নে, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন প্রতিবেশী রাজ্য গােলকুণ্ডার সুলতান। দু’জনে যুদ্ধ করে গেছেন সাধারণ শত্ৰু ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে। ঔরঙ্গজেব তার শক্তি ও অর্থের একটা বড় অংশ ব্যয় করে গেছেন। বিজাপুর ও গােলকুণ্ডার মুসলিম সুলতানদের বিরুদ্ধে। সেই তুলনায় সামান্য ব্যয়িত হয়েছিল মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে।
তাছাড়া ঔরঙ্গজেবপুত্র রাজপুত্র আকবর যখন বিদ্রোহী হলেন, তখন তার প্রধান বন্ধু শিবাজী-পুত্র শম্ভুজী। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তখন ঔরঙ্গজেবের রাজপরিষদে অতি সম্মানিত রাজপুরুষরূপে স্বীকৃত হয়েছিলেন শিবাজী। এই সময় ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে ‘রাজা’ খেতাবে ভূষিত করে বেরারের এক ‘জায়গির’ দান করেছিলেন। পাঁচ হাজার অারােহীর পরিচালন ভার ন্যস্ত করে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেন তাকে। পূর্বে অবশ্য শিবাজীকে দমন করার জন্য ঔরঙ্গজেব তার শ্রেষ্ঠ সৈন্যাধ্যক্ষ রাজপুত জয়সিংহকে পাঠিয়েছিলেন। ১৬৬৫ সালের ২২ জুন শিবাজীর ৩৫ দুর্গের মধ্যে ২৩টি দখল করল মুঘল। পরে অবশ্য শিবাজী আদায় করেছিলেন মুঘল বাহিনীতে ৫,০০০ অর্থারােহী প্রদানের প্রতিশ্রুতি—আসলে বিজাপুরের বিরুদ্ধে পরবর্তী যুদ্ধে মুঘলকে সমর্থন জানিয়েছিলেন শিবাজী।
জয়সিংহের মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে শিবাজীকে সাহায্য করেছিল পাঠান মুসলিমরা—যারা শিবাজীর সেনাবাহিনীতে খুব উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শিবাজীর সেক্রেটারি ছিলেন মৌলবি হায়দার খান। শিবাজীর নৌবাহিনীতে দু’জন মুসলমান নায়ক ছিল—দৌলত খান ও সিদ্দি মিশরী। আসলে অহিন্দু সম্পর্কে শিবাজীর কোনও বিদ্বেষ ছিল না। মুসলিম ধর্মস্থানের জন্য অর্থের ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। কাফী খান তার অনুরক্ত ছিলেন না, কিন্তু তিনিও লিখেছেন,
“অনুচরেরা যেখানে লুটপাট করত সেখানেই শিবাজী নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে মসজিদ, কোরআন ও মেয়েদের অপমান যেন না ঘটে। যখনই তার হাতে এক খণ্ড কোরআন এসেছে তখনই শ্রদ্ধার সঙ্গে রেখে দিয়ে পরে কোনও মুসলমান অনুচরকে তিনি দিয়ে দিতেন। হিন্দু বা মুসলমান মেয়েরা যুদ্ধকালে বন্দী হলে তাদের আত্মীয়স্বজন এসে যথাযােগ্য মূল্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তিনি নিজে তাদের দেখাশুনা করতেন।”৬২
শিবাজীর রাজ্যাভিষেকে তাই কেবল হিন্দু ও বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের ভিড় হয়নি মুসলমান ও খ্রীষ্টানরাও উপস্থিত ছিল, তাদের জন্য আলাদা রান্নারও ব্যবস্থা হয়েছিল।
শুধু তাই নয়, মসজিদ ও অন্যান্য মুসলিম প্রতিষ্ঠান যেগুলি স্বরাজ এলাকার মধ্যে পড়ত সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণ করাও মারাঠা রাষ্ট্রনীতির অঙ্গ ছিল। ১৭৪৬-৪৭ সালের একটি সনদ থেকে জানা যায়, কসবা থানার মহাগিরি পাখাড়ি গ্রামে সদ্য নির্মিত একটি মসজিদের প্রদীপ ও অন্যান্য কাজের ব্যয় নির্বাহের জন্য দেড় বিঘা জমি দান করা হয়।৬৩ এধরণের অনেক অনুদান ছিল।
বিজয়নগরের রাজারাও অপর ধর্মের মানুষের প্রতি সহনশীল ছিলেন। এমনকি বিদেশিদের সঙ্গেও তারা সদয় ব্যবহার করতেন। সব বিদেশী পর্যটকই এ কথা অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেছেন। এখানে সব ধর্মের মানুষই বাস করতেন। সব ধর্মের উপাসনা সমগ্র বিজয়নগর সাম্রাজ্যে বিনা বাধায় প্রচলিত ছিল। বিজয়নগর সাম্রাজ্য হিন্দু সাম্রাজ্য বলে বিবেচিত হলেও মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা থেকে তারা মুক্ত ছিলেন। ঐতিহাসিক ফিরিস্তার বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বিজয়নগরের শাসকগণ বুঝেছিলেন যে, শক্তিশালী ঘােড়া ও তীরন্দাজ বাহিনীর জন্যই বাহমনী রাজা সামরিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল। দ্বিতীয় দেব রায় (১৪২৫-৪৬) প্রায় ২০০০ মুসলিম সৈন্যকে জায়গির দান করেন এবং হিন্দু আধিকারিক ও সেনাদের মুসলিমদের কাছ। থেকে তিরন্দাজী শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।৬৪ তিনি শহরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন আর তার সিংহাসনের সামনে চমৎকার খােদাই করা একটি বেদীর উপরে পবিত্র কোরআন রাখার ব্যবস্থা করলেন যাতে রাজার উপস্থিতিতে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক অভিবাদন জানাবার সময় মুসলিমরা তাদের ধর্মগ্রন্থকেও শ্রদ্ধায় চুম্বন করতে পারে।৬৫ ফিরিস্তার বিবরণে আরও জানা যায় যে, প্রথম দেব রায়ের (১৪০৪ – ১৪২২) সেনাবাহিনীতে দশ হাজার মুসলিম সেনা ছিল।৬৬
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের রচনায়ও এই উদারতার প্রমাণ মেলে।৬৭ সংস্কৃতির দিক থেকে মধ্যযুগের ভারতবর্ষে বিজয়নগরের শাসকদের এই উদারতা কম গৌরবের নয়। এ প্রসঙ্গে বিদেশি পর্যটক বারবােসার মন্তব্য বিশেষ উল্লেখ্যযােগ্য। তিনি বিজয়নগরের শ্রেষ্ঠতম রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের (১৫০৯-২৯) শাসনকাল সম্বন্ধে তাঁর বিবরণে বলেছেন,
“Every may come and go to live according to his own creed, without suffering annoyances and without enquiry, whether he is a Christian, Jew, Moor or Hindu.”৬৮
তিনি আরও বলেছেন ‘পক্ষপাতশূন্য ন্যায়বিচার পেতে পারে এখানে প্রতিটি মানুষ।…এখানকার মানুষ পরস্পরের সম্বন্ধে কোনাে ভেদাভেদ অন্তরে পােষণ করে না।৬৯ তাই বারবােসার এই মন্তব্য থেকে বলা যায়, বিজয়নগরের শাসকগণ পর-ধর্মমতসহিষ্ণু ছিলেন।
মহারাজা রণজিৎ সিংহের (১৭৯২-১৮৩৯) ক্ষেত্রে দেখা যায়, তার রাজ্যে হিন্দু শিখ ও মুসলমান সবাই ছিলেন সমান। তার কর্মচারীদের মধ্যে অ-শিখের প্রাধান্য ছিল লক্ষণীয়। শিবাজীর মত তারও প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন একজন মুসলিম— আজিজউদ্দিন। তার রাজস্ব মন্ত্রী শিখ ছিলেন না, ছিলেন একজন হিন্দু রাজা দীননাথ। তার সেনাবাহিনীতে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সেনারাও কাজ করত। সর্বোপরি তিনি সর্বধর্ম সহাবস্থান নীতিতে বিধাসী ছিলেন।৭০ খুশবন্ত সিং তঁার ‘এ হিস্টরি অফ শিখস’-এ (দুই খণ্ড, প্রিন্সটন, ১৯৬৩) রণজিৎ সিংহের ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মসহিষ্ণুতার উল্লেখ করে বলেছেন রণজিৎ ধর্মভিত্তিক শিখ রাজ্য গঠন অপেক্ষা ভূমিভিত্তিক পাঞ্জাব রাজ্য গঠনে বেশি আগ্রহী ছিলেন।
সাধারণভাবে একথা স্বীকৃত হয় যে একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রকে ধরে রাখার জন্য শরিয়ত একটি কার্যকরী আইনি ভিত্তি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য যে মুঘল সাম্রাজ্যের অ-মুসলিম উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রগুলির কয়েকটিতেও শরিয়ত সাধারণ আইন সংহিতারূপে ব্যবহৃত হত। উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানি যে পাঞ্জাবে রণজিৎ সিং প্রতিষ্ঠিত রাজ্যটিতে কাজীর আদালত ছিল, এবং ওই আদালত কেবল মুসলিমদের নয়, অ-মুসলিমদের মামলারও বিচার করত। শুধু তাই নয় রণজিৎ সিংহ জেনারেল আবু তালিবকে লাহােরের কাজী ও প্রশাসকরূপে নিয়ােগ করেছিলেন।৭১ এ থেকে মনে করা যেতে পারে যে, হয়ত মধ্যযুগীয় ভারতীয় রাষ্ট্রগুলির আপাতভাবে ধর্মীয় শাসন’ সংক্রান্তি বৈচিত্র্যগুলিও ভারতীয় ঐতিহ্যের থেকে ততটা দূরবর্তী ছিল না, যতটা অনেক সময়ে মনে করা হয়।
(৭)
মূলকথায় আসা যাক, মধ্যযুগে ভাবনা বা বিবাসের জগতে উভয় সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন সুসম্পর্ক ছিল, অনুরূপ ঐক্যেরই পরিচয় আমরা পাই উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বসবাস করা ও জীবনযাত্রার মধ্যেও। মুহাম্মদ শাহনুরুর রহমানের ‘Hindu-Muslim Relations in Mughal Bengal’ গ্রন্থটির৭২ মূল উপজীব্য বিষয় হল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যা প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য হতে পারে। লেখক মুঘল শাসনাধীন বাংলায় ১৫৭৬-১৭৫৭ পর্যন্ত সময়সীমায় সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিকাঠামােয় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, মুঘল যুগে বাংলায় এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় ছিল। দু’টি সম্প্রদায় দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসবাস করেছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মনােভাব নিয়ে। রাজায়-রাজায় দ্বন্দ্ব এমনকি সমাজের উপর তলায় কিছু কলহ থাকলেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এতে ব্যাহত হয়নি। ধর্ম-কর্ম, আচার-আচরণের ক্ষেত্রে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্যজনিত কারণে বিরােধের সম্ভাবনা থাকলেও একটা প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সমঝােতার প্রয়াস দেখা দিয়েছিল। তবে এ সময়ে সমাজের সাধারণ স্তরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিরােধ ছিল না তা অস্বীকারের উপায় নেই। কিছু উদাহরণ আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি—
- ১. পঞ্চদশ শতকের মৈথিলি কবি বিদ্যাপতির ‘কীর্তিলতা’ কাব্যের উল্লেখ করা যায়, যেখানে কবি লিখেছেন—“হিন্দু-তুরকে মিলল বাস/ একক ধম্মে অও কো উপহাস।৭৩
- ২. পঞ্চদশ শতকের কবি বিজয় গুপ্ত তার ‘পদ্মপুরাণ’-এ লিখেছেন যে, তুলসী পাতা নিয়ে মুসলমানরা অত্যাচার করে হিন্দুদের ওপর।৭৪
- ৩. মধ্যযুগ তথা ষােড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ডিহিদার মাহমুদ শরিফের অত্যাচারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন তার কাব্যে।৭৫
- ৪. পূর্ববঙ্গ গীতিকায় (১৭-১৮ শতকে) হিন্দু নারীদের ওপর মুসলমানদের নিপীড়নের কথা উল্লেখ আছে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে এই সমস্ত সাময়িক বিদ্বেষ বা অসহিষ্ণুতা অনেকাংশে ছিল প্রতিবেশীসুলভ সাধারণ ঝগড়াবিবাদ। এক্ষেত্রে অত্যাচারী মুসলিম শাসকের ভূমিকা থাকলেও কখনও সেটা মধ্যযুগের বাংলার সার্বিক চিত্র ছিল না। বরং বেঁচে থাকার তাগিদে পারস্পরিক নির্ভরতা ও সহযােগিতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এম এ রহিম বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের সম্প্রীতিমূলক সম্পর্কের উন্নয়নের যে কয়েকটি কারণ দেখিয়েছেন তা সাধারণভাবে মধ্যযুগে সারা ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি গড়ে ওঠার কারণ। তিনি লিখেছেন,
“প্রথমত, ঐতিহ্যগত ভাবে মুসলিম শাসনকর্তাদের রাষ্ট্রনীতিতে একটি মৌলিক আদর্শ ছিল সহিষ্ণুতা। দ্বিতীয়ত, মুসলমান শাসনকর্তাদের রাজনৈতিক উপযােগিতার প্রয়ােজনে হিন্দুদের সঙ্গে একটি সহযােগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থ সমসূত্রে বাঁধা ছিল। চতুর্থত, হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানরা সৎপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। পঞ্চমত, বহু শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক ও সামাজিক আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে উভয় জাতি একে অন্যের সংস্কৃতি ও মতবাদগুলাে বুঝতে সক্ষম হয় এবং এভাবে একে অন্যের সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা জন্মায়।”৭৬
সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য সাক্ষ দেয় যে, মধ্যযুগের বাংলা ছিল সমন্বয়ের যুগ। মুঘল শাসননীতি সমসাময়িক হিন্দু বৌদ্ধিকদের প্রশংসা আদায় করেছে। প্রজাহিতৈষী শাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্য তারা মুঘল সম্রাটদের গুণকীর্তনও করেছেন।
সুলতানি ও মুঘল আমলে সেনা বিভাগে তুর্কি, আফগান, মােঙ্গল, চাঘতাই, পারসিক ও ভারতীয় হিন্দু সৈন্যরা একই পতাকাতলে যুদ্ধ করত। রমিলা থাপার বলেন যে, সুলতানি আমলে সেনাবাহিনীতে হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য ছিল। কারণ ইকতাদারদের সৈন্য সরবরাহ করা বাধ্যতামূলক ছিল এবং তারা যে সৈন্য সরবরাহ করত তার বেশিরভাগ ছিল ভারতীয় অর্থাৎ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত।৭৭ আবার অন্যদিকে হিন্দু রাজা বা জমিদারদের অধীনে মুসলমান কর্মচারীরা কাজ করতেন এমন প্রমাণ আছে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন,
“কালকেতুর সেনাবাহিনীতে দক্ষ ও শক্তিশালী মুসলিম সৈন্যরা নিযুক্ত হতেন।”৭৮
অষ্টাদশ শতকের কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর তঁার ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে উল্লেখ করেছেন যে, নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় কিছু মুসলমান সামরিক ও বেসামরিক পদে কাজ করতেন। তিনি হাবেলি পরগণার সিগদারপুর গ্রামে মসজিদ নির্মাণের জন্য ২ বিঘা এবং বাগেয়ান পরগণার চড়কপােতা গ্রামে ফকিরদের আখড়া নির্মাণের জন্য ৫৫ বিঘা জমি দান করেন।৭৯ এ থেকে বােঝা যায় যে, সে যুগে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় ছিল।
শুধু তাই নয়, এ-সময়ে মুঘল শাসন বিভাগের বিভিন্ন স্তরে হিন্দু প্রতিনিধিত্ব যথেষ্টই বেড়ে গিয়েছিল। আকবরের সময় আমরা লক্ষ করি উচ্চ মনসবদারদের মধ্যে রাজপুত দলপতিরাই অধিকার করেছিলেন ২২.৫ শতাংশ স্থান। আর ঔরঙ্গজেবের সময় তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১.৬ শতাংশ।৮০ প্রকৃতপক্ষে মুঘল যুগে সরকারী কর্মচারী হিসাবে যােগ দিতে গেলে কোনও ধর্মীয় পরীক্ষায় পাশ করতে হত না। আকবরের সময়তেই আমরা লক্ষ করি ‘State employment was open to all people irrespective of their race caste or religious belief.’ আকবর রাজপুত তথা হিন্দুদের প্রতি যে মনােভাব তা ইতিহাস প্রসিদ্ধ। প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি রাজপুত ও হিন্দুদের নিয়ােগ করেছিলেন। রাজা টোডরমলের নাম এ বিষয়ে সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। এছাড়া মানসিংহ, ভগবান দাস, রায়সিংহ প্রমুখের নামও উল্লেখযােগ্য। ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে হিন্দুদের অংশগ্রহণের কথা তাে আগেই বলা হয়েছে। জাহাঙ্গীরের সময় অন্তত তিনটি অঞ্চলের রাজ্যপাল ছিলেন অমুসলমান—বাংলায় মানসিংহ, ওড়িশায় রাজা কল্যাণ ও গুজরাটে রাজা বিক্রমজিৎ।
হিন্দু সাধু, সন্ন্যাসী ও যােগীদের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তিনি অত্যন্ত আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। সেইসব সাক্ষাতের বর্ণনা তিনি অতি সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। জাহাঙ্গীর তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। উল্লেখ্য যে, আকবরের দরবারে বহু সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসিতে অনুদিত হবার ফলে মুসলিমরা হিন্দুদের বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন। সুফিবাদের উচ্চতম রূপকে বেদান্তের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করতেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। তাঁর মতে, বাবা কিঘানির (-১৫১৯) এই পংক্তিদ্বয়ে ধরা পড়েছে সুফিবাদ ও বেদান্তের মূলমন্ত্রটি একটি শুধু প্রদীপ আছে এই ভবনে, আলােতে তার/ যেদিকে চাই দুচোখে পাই বহুর সমাবেশ।৮১ বাদশাহ জাহাঙ্গীর হিন্দুদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছিলেন, যার ফলে সাধারণ মুসলমানরাও সেদিকে আকৃষ্ট হন। বেণীপ্রসাদ তার গ্রন্থে৮২ জাহাঙ্গীরের শাসনকাল সম্পর্কে গবেষণামূলক আলােকপাত করতে গিয়ে তাকেই সমর্থন করেছেন এবং সঙ্কীর্ণ মনােভাবাপন্ন ইংরেজ ঐতিহাসিকদের সকল অভিযােগ খণ্ডন করেছেন এবং উত্তরের সপক্ষে বহু প্রমাণ উল্লেখ করেছেন।৮৩
শাহজাহানের সময়ে কাশীদাস, বাহারমল, চন্দ্রভান, মুকুন্দদাস, বেণীদাস, দয়ানাথ, শােভাচঁাদ প্রমুখরা খুবই উচ্চপদে আসীন ছিলেন। রঘুনাথ রাই তার আমলে কয়েক বছর ধরে ‘দিওয়ান-ই-খালসা’র (সরকারি খাস ভূ-ভাগের পরিচালক) প্রধান ছিলেন। এছাড়া ‘দিওয়ানি’ বিভাগের অপোকৃত নিম্নস্তরের পদগুলিতে যেমন আমিন, কানুনগাে প্রভৃতি পদে প্রায়ই হিন্দুদেরই নিয়ােগ করা হত।৮৪ মুঘল রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিভিন্ন পদে শুধু অসংখ্য হিন্দু নিযুক্ত ছিল না, কর্মরত হিন্দু-মুসলমান রাজ-কর্মচারীদের মধ্যে পারস্পরিক প্রীতির সম্পর্কও বজায় ছিল।
সুলতানি আমলেও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এই সমন্বয়ের ধারা বজায় ছিল। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের আমলে প্রশাসন ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে গণতন্ত্রীকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার রাজত্বকালে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে ইবন বতুতা সুলতানের রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে ও উলেমাদের সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির উপর আলােকপাত করেছেন। ইবন বতুতা বলেছেন যে, জলসেচের জন্য ও দুর্ভিক্ষর সময় প্রজাদের সাহায্যের জন্য সুলতান রাজধানী দিল্লির বহির্ভাগে কতকগুলি কূপ খনন করেছিলেন। আফিফউদ্দিন নামে একজন উলেমা এ ধরণের কার্যকলাপের কোনাে সার্থকতা নেই বলে অভিমত প্রকাশ করেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক অফিফউদ্দিনের মন্তব্য শুনে তাকে ডেকে পাঠান ও জিজ্ঞাসা করেন আপনি কেন রাষ্ট্রের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছেন? রাষ্ট্রের কার্যকলাপে সুলতান উলেমাদের হস্তক্ষেপের বিরােধী ছিলেন এবং সেই কারণে আফিফউদ্দিনকে অবশেষে কারাগারে প্রেরণ করেছিলেন।৮৫ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সঙ্গে বিতর্কে উলেমারাও পেরে উঠতেন না। তার উদার মনােভাবের জন্য গোঁড়া ও রক্ষণশীল উলেমা শ্রেণি সুলতানের প্রতি বিরূপ ছিলেন। রাষ্ট্রের ব্যাপারে তিনি কোনাে উলেমার মতামত গ্রহণ করতেন না। ফলে যখন সুলতান তার বিভিন্ন পরিকল্পনা রূপায়নে ব্যর্থ হন তখন এই উলেমা শ্রেণির লেখকরা তার ব্যর্থতা সম্পর্কে অতিরঞ্জিত বিবরণ দিয়ে সুলতানকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা করেছিলেন।
আতাহার আলি উপযুক্ত দলিলের সাহায্যে মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে হিন্দু উচ্চপদস্থ কর্মচারীর কথা উল্লেখ করেছেন।৮৬ চুনারের এক শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, মুহাম্মদ বিন তুঘলকের একজন হিন্দু মন্ত্রী ছিলেন, যার নাম ‘সালেরাজ’ ছিল। জিয়াউদ্দিন বারণির বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সুলতান দেবগিরির মন্ত্রী নিযুক্ত করেন ইমাদুল মুলককে এবং তার নায়েব নিযুক্ত করেন ধারা’ নামক এক ব্যক্তিকে।৮৭ বারণির বিবরণ থেকে জানা যায় যে, পিরামলীকে দেওয়ান। পদে নিযুক্তি করা হয়।৮৮ প্রফেসর কে এ নিজামি তার পুস্তকে লিখেছেন যে, জৈনদের সুত্র অনুসারে জানা যায় যে, সুলতান জৈনধর্মের পণ্ডিতদের সাথে যােগাযােগ রাখতেন। সুলতান হিন্দুদের হােলি উৎসব উপভােগ করতেন।৮৯ ‘তারিখ-ইমুবারকশাহী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক তার রাজপ্রাসাদে চারজন মুফতী নিযুক্ত করে রেখেছিলেন। যখনই কোনাে ফরিয়াদী আসত, সুলতান তখন সেই মুফতীগণের সাথে পরামর্শ করতেন। সুলতান তাদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করে রেখেছিলেন যে, তাদের ফয়সালার (বিচারের) জন্য যদি কোনাে নিরাপরাধ ব্যক্তির প্রাণদণ্ড হয়, তাহলে অন্যায় অপরাধের বােঝা তাদের উপরেই চাপানাে হবে। সেজন্য মুফতীদের দ্বারা কোনাে ত্রুটি হতে পারত না।৯০
উপরােক্ত আলােচনা থেকে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসন পরিচালনা বিষয়ে অনুমান করা যায়। তিনি নিজে বিদ্বান ছিলেন এবং জ্ঞানী-বিদ্বজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, সেই জ্ঞান ও বিদ্বজন যে ধর্মেরই লােক হােক না কেন। এটা তার সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির পরিচয় যে, তিনি হিন্দু ও জৈন ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে আরম্ভ করেছিলেন। সেই ধর্মের পণ্ডিতদের নিজ মজলিশে আহ্বান করতেন। পঞ্চদশ শতকে এক পর্তুগীজ লেখক নওনেস লিখেছেন যে, সুলতান গুজরাত অভিযানের সময় একটা শিবমন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন।৯১ ঈশ্বরী প্রসাদ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের যুগ সম্পর্কে পর্যালােচনা করতে গিয়ে লিখেছেন যে, তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে কোনাে অশােভনীয় আচরণ করেননি। মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন প্রথম দিল্লির সম্রাট যিনি তাঁর রাজত্বে সতীদাহ প্রথম রদ করার জন্য ফরমান জারি করেছিলেন। সিকান্দার লােদি যিনি ধর্মান্ধতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন, তিনি হিন্দুদের ফারসি ভাষা শিখে রাষ্ট্রীয় কার্যে বিশেষ করে রাজস্ব বিভাগে চাকরি গ্রহণে উৎসাহিত করেন।৯২
(৮)
মধ্যযুগের সাম্রাজ্যের বিভিন্ন উচ্চপদগুলিতে গুণ অনুযায়ী অমুসলিমদের নিয়ােগের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মুঘল আমলে এত বেশি হিন্দু সরকারি দপ্তরে চাকরি করত এবং উচ্চ পদ লাভ করত যে, ১৯৪৭ সালের পূর্বে ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে হিন্দুদের অবস্থা মুঘল আমলের মতাে ছিল না। মুঘল আমলে রাজস্ব বিভাগের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছাড়া আর সকলেই ছিলেন হিন্দু। ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক লেন-দেনের ক্ষেত্রে হিন্দুদের একচেটিয়া প্রভাব ছিল সেকালে। সপ্তদশ শতকে সকল শিল্পের কারিগরেরা ছিল হিন্দু।৯৩ আসলে এই বিরাট ভারত ভূখণ্ডে রাষ্ট্রশাসন পরিচালনা হিন্দুদের সাহায্য ছাড়া চলতে পারে —এই বাস্তব উপলব্ধি থেকেই সুলতানরা শাসন ব্যাপারে অসংখ্য হিন্দুকে শাসন যন্ত্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করেছিলেন। মালবে মেদিনী রায়, বাংলায় হুসেন শাহের অধীনে রূপ গােস্বামী ও সনাতন গােস্বামীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এছাড়া বিজাপুর ও গােলকুণ্ডার সুলতানের অধীনে বহু হিন্দু রাজকর্মচারী বিশেষ প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন।
বিচার ব্যবস্থায় মুসলিম আইন অমুসলিমদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। সুলতানি বা মুঘল আমলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হিন্দুদের বিচারকার্য সমাধা করতেন হিন্দু আইন অনুসারে। ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের রচনায়ও এর সমর্থন মেলে,
“মুসলমান যুগে হিন্দুর দায়াধিকার ও সিভিল আইন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দ্বারা সম্পাদিত হত। ফৌজদারি মকদ্দমা কাজীর দ্বারা বিচার করা হত। ব্রাহ্মণ জজ পণ্ডিতরা এই সুবিধা পাইয়া যাহাকে তাহাকে জাতিচ্যুত করিবার ফতােয়া দিত।”৯৪
মুঘল দরবারে বহু হিন্দু রীতি-নীতি বা অনুষ্ঠানের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। Dr. PN Chopra-র ‘Some aspects of society and culture during the Mughal age’ নামক গ্রন্থে৯৫ হতে জানা যায়,
‘The Mughal could not escape the reaction of Hindu culture. Under its domination influence, coupled with a keen desire to bring the two communities nearer, they adopted some of the Hindu festivals and gave them a place in their court calender.’
দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসবাস করার ফলে উভয় ধর্মাবলম্বীর মধ্যে এক প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একে অপরের উৎসবে যােগদান করতেন এবং তা ভাল লাগলে নিজের করে নিতে কোনও রকম দ্বিধা বা সংকোচ করতেন না। ধর্মীয় সংস্কার বা বাধা তেমন কোনও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারত না। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় ইতিহাস অনুসন্ধান পরিষদের সহযােগিতায় প্রকাশিত এন এ সিদ্দিকির ‘ল্যান্ড রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আন্ডার দ্য মুঘলস’ নামক গ্রন্থে৯৬ বলা হয়েছে,
“…মুসলমান সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন হইতে গ্রামের সরল হিন্দু অধিবাসীগণ মুসলিম সংস্কৃতি-ধর্ম সম্পর্কে অনেক কিছুই জানিতে পারিতেন। ক্রমশ মুসলিম সম্পর্কে পূর্ব-পুরুষগণের যাহারা মুসলিম বলিতে তুর্কি, ম্লেচ্ছ, অত্যাচারী ও অপবিত্র মনে করিতেন, তাহাদের নিকট হইতে আহূত সেই ভ্রান্ত ধারণা বর্জন করিয়া তাহারা উপলব্ধি করিতে লাগিলেন যে মুসলমানদিগকে অধার্মিক বলা চলে না। মুসলিমদের সহিত ঘনিষ্ঠ ও নিয়মিত যােগাযােগ স্থাপিত হওয়ায় বহু অবজ্ঞাত তুর্কির প্রতি হিন্দুদের উদার মনােভাব গড়িয়া উঠিল।”
বেণী প্রসাদ তার অপর গ্রন্থে৯৭ ওই অভিমত প্রসঙ্গে বলেছেন
‘It was only natural that Hindus and Muslims should join one another festivals.’
মুঘল আমলে ভূমি ব্যবস্থা ও বিলি-বন্টন নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে তেমন কোনও গােলমাল হয়নি বলেই জানা যায়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট গবেষক ইরফান হাবিব ‘The Village Community’ প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন,
‘No evidence exists for communal ownership of land or even a periodic ditribution and redistribution of land among peasants.’৯৮
ইদানীংকালে জমি-জমা সংত্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে মানুষে-মানুষে যে হানাহানি, রক্তারক্তির সংবাদ খবরের কাগজের পাতায় দেখা যায়, ঐ জাতীয় বিরােধ মধ্যযুগে ছিল না। গ্রামীণ হিন্দু-মুসলমান সাধারণ প্রজারা পাশাপাশি চাষ করত।
(৯)
এবার দেখা যাক সমাজচিত্র কেমন ছিল। সমসাময়িক তথ্য থেকে জানা যায় যে, তুর্কো-আফগান যুগে হিন্দুদের উপর কোথাও কোথাও নির্যাতন হয়েছে। নারী অপহরণ, ধর্ষণের মতাে কিছু ঘটনা সুলতানি আমলের প্রথম দিকে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক তিক্ত করেছিল। কিন্তু মুঘল আমলের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। মুঘল আমলে বাংলায় বহু হিন্দু-মুসলিম বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাজের সকল স্তরে এ ধরণের বিবাহ হয়েছে। সপ্তদশ শতকের বাংলা সাহিত্যে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে।
বাংলায় ইসলামের বিস্তারের ফলে ধর্মান্তরিত মুসলিমদের সমন্বয়ে যে মুসলিম সমাজ গড়ে উঠল সেখানে মুসলিমদের সকলেই জীবনের সর্বক্ষেত্রে সব রকমের ইসলামি বিধি-বিধান যে মেনে চলেছিল তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে ইসলাম বহির্ভূত রীতিনীতি অনুসৃত হত। দেশজ মুসলিমদের বেশিরভাগই সুফি সাধকদের দ্বারা ধর্মান্তরিত হওয়ায় এবং সুফিরা ধর্মীয় বিধিবিধানের উপরে ততটা গুরুত্ব না দেওয়ায় ধর্মান্তরিত দেশজ মুসলিমরা তাদের পুর্বের আচার-সংস্কার যেমন-জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানা রীতিনীতি পালন, তিথি-নক্ষত্র-জ্যোতিষে বিধাস, মনসা-শীতলা পূজা, দেবস্থানে মানত, পিরপূজা প্রভৃতি ইসলাম ধর্মে স্বীকৃত না হলেও পালন করত। ইসলাম ধর্মে এই সমস্ত অ-ইসলামিক রীতিনীতি প্রশয় পাওয়ার ফলে বা কোরআনে-পুরাণে ঝগড়া না হওয়ায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইসলামে জাতিভেদ প্রথা স্বীকৃত না হলেও, হিন্দুদের প্রভাবে মুসলিমদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথার সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামের উদার ভ্রাতৃত্ব চেতনা উভয় সমাজকে জাতিভেদ-মুক্ত করতে পারেনি, উন্নত সমাজ গঠনের পথে যা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমানদের অবাধ মেলামেশা ও সমঝােতার ফলে ভারতবর্ষে একটি নতুন সাংস্কৃতিক ধারা প্রবর্তিত হয়। একাদশ শতকের শুর দিকে সুলতান মাহমুদের সময়ে আলবেরুনীর মতাে মুসলিম মনীষী সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করে হিন্দু ভারত সম্বন্ধে তথ্যবহুল ইতিহাস রচনা করেন। অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ আরবিতে অনূদিত হলে হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্র প্রভৃতি সম্বন্ধে মুসলমানগণ জ্ঞান-লাভ করেন। হিন্দু ও মুসলিম সাংস্কৃতিক মিলনের অন্যতম প্রধান ফলাফল ছিল ‘ভক্তি’ আন্দোলন। রামানুজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ভক্তি আন্দোলনের মূল কথা ছিল অনুরাগ ও প্রেম। ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ রামানন্দ সুফি মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হন। এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি এবং এই কারণে হিন্দু সম্প্রদায় মুসলিম সাধককে এবং মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দু সন্ন্যাসীদের ও ধর্ম সংস্কারকদের ভক্তি করতেন। ভক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ছিলেন কবীর, শ্রীচৈতন্য ও নানক প্রকাশ্যে জাতিভেদকে নিন্দা করেন এবং একেরবাদে আস্থা স্থাপন করেন।
তাছাড়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবেগ, বিশ্বাস, আকাঙ্খর প্রকাশ ঘটে স্থাপত্য, শিল্পকলা ও চিত্রকলায়। সেজন্য এগুলি ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসাবে বিবেচিত হয়। সমসাময়িক স্থাপত্য-শিল্প মুঘল আমলের হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে। মুঘল আমলের মন্দির, মসজিদ, সমাধি, কাটরা, দুর্গ, সেতু প্রভৃতি স্থাপত্যে সমন্বয়ের এক অপূর্ব নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। সে যুগের কয়েকটি মন্দির—যেমন মুর্শিদাবাদ জেলার গােকর্ণ (১৫৮০), যশােহরের রামনগর (১৫৮০) এবং পাবনার তারাস (১৬৩৫) মন্দিরে পরিলক্ষিত হয় ইসলামী স্থাপত্যের ধরন ও বৈশিষ্ট্য। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের পাঞ্চরত্ন শ্যামরায় মন্দিরে (১৬৪৩) দুই স্থাপত্য সংস্কৃতির অপূর্ব মিলন ঘটেছে। মুসলিম জ্যামিতিক নকশা হিন্দু পৌরাণিক মূর্তিতে ব্যবহৃত হয়েছে। মন্দিরের উত্তর দেওয়াল বিমূর্ত ইসলামী ঐতিহ্যের জ্যামিতিক রূপকল্পে আচ্ছাদিত। বীরভূম জেলার রাজনগরের মতিচূড়া মসজিদ হিন্দু-মুসলিম মিশ্র স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত হয়েছিল। মসজিদের খিলান সম্পূর্ণভাবে মন্দিরের অনুকরণে তৈরি হয়েছিল। ময়মনসিংহ জেলার আতিয়া মসজিদ এবং এগার সিন্দুর মসজিদের মিহরাব হিন্দু মন্দিরের প্রভাবে প্রভাবিত। ঢাকায় বিবি মরিয়মের কবর শিখ মন্দিরের প্রভাবে প্রভাবিত। এছাড়া ষােড়শ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত যে সমস্ত মুঘল চিত্রশিল্প দেখা যায় তা হিন্দু-মুসলমান যুক্ত সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে গভীর সম্প্রীতি না থাকলে কখনওই মুঘল আমলের বাংলায় স্থাপত্য ও চিত্রশিল্পের রূপকল্পে হিন্দুমুসলিম সংস্কৃতির এত ব্যাপক সংমিশ্রণ দেখা যেত না, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এই মিশ্রিত শিল্পরীতি গড়ে ওঠার বিভিন্ন কারণ ছিল। শাসনকর্তারা হিন্দু স্থপতি নিয়ােগ করার ফলে শিল্পীদের অজান্তে তাদের রীতির প্রভাব পড়ে এইসব শিল্পগুলির উপর। এই মিশ্রিত শিল্পকীর্তিগুলির মধ্যে কুতুবমিনার, পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ, গৌড়ের বড় ও ছােট সােনা মসজিদ, গুজরাটের জামে মসজিদ, মালবের হিন্দোনা মহল, জাহান মহল প্রভৃতি বিখ্যাত। মুঘল যুগ ছিল এই সমন্বয়ের এক উজ্জ্বল যুগ। প্রকৃতপথে এই সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রেই উভয় সম্প্রদায়ের পারস্পরিক প্রভাবের ফলে এক সমজাতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।৯৯ চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে মুঘল যুগে হিন্দু শিল্পীরা স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্র পেয়েছিলেন এবং বিখ্যাত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে কেশব ভ্রাতৃদ্বয়, বিশনাস, তুলসী প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। আকবর একটি জাতীয় চিত্রকলার বিদ্যালয় প্রবর্তন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়ে জাত-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকেই অংশগ্রহণ করতে পারত। ঐতিহাসিক এ এল শ্রীবাস্তব তাঁর গ্রন্থে১০০ বলেন,
‘Akbar’s interest and patronage led to the establishment of a school of painting which may be called the National Indian School of Painting. It members were drawn from all parts of India and even from outside. They belonged to various castes and religion.’
বস্তুত যারা মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসে শুধু বিচ্ছিন্নতা ও সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পান—তাদের উদ্দেশ্য দূরভিসন্ধিমূলক। এখানে সহিষ্ণুতা, সমন্বয় ও সম্প্রীতির ধারা সমানভাবে প্রবহমান। আধুনিক ভারতের যে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান আমরা পেয়েছি তা আলােচিত সমন্বয় ধারারই ঐতিহাসিক ফলশ্রুতি বললে বােধ হয় অত্যুক্তি হয় না। ঐতিহাসিক ইকতিদার আলম খানের মতে, আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য সমূহের উৎস প্রাক-আধুনিক যুগের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার মধ্যে পাওয়া যাবে।১০১
তথ্যসূত্রঃ
- ১. অজ্ঞাতনামা চাচনামা, অন্তর্ভুক্ত-এইচ এম ইলিয়ট ও ডওসন সম্পাদিত, দ্য হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইটস্ ওন হিস্টরিয়ানস, খণ্ড-১, লন্ডন, ১৮৬৭, পৃ. ১৮৫-৮৬। মুহাম্মদ বিন কাসিম এক ঘােষণায় বলেন “তিনি (মুহাম্মদ বিন কাসিম) সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, মুখ্য অধিবাসী ও ব্রাহ্মণদের মন্দির নির্মাণ, মুসলিমদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্ভয়ে বসবাস ও আত্মােন্নতির জন্য প্রতিযােগিতা করার নির্দেশ দিলেন। তিনি সদয়ভাবে দরিদ্র ব্রাহ্মণের রক্ষণাবেক্ষণ, পূর্বপুরুষদের আচার অনুষ্ঠান পালন এবং পূর্ব প্রথামত ব্রাহ্মণদের নৈবেদ্য প্রদান ও দান-ধ্যান করারও আদেশ দিলেন।” (ইলিয়ট ও ডওসন, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৬)। সিন্ধু প্রদেশে বিন কাসিম কর্তৃক অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানের কথা ঐতিহাসিক ঈর্বরীপ্রসাদও উল্লেখ করেছেন। (দেখুন-ঈরীপ্রসাদ, এ শর্ট হিস্টরি অফ মুসলিম ল ইন ইন্ডিয়া, দ্য ইন্ডিয়ান প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড, এলাহাবাদ, ১৯৬২, পৃ. ৩৬)।
- ২. এস এম ইকরাম, হিস্টরি অফ মুসলিম সিভিলাইজেশন ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান, লাহাের, ১৯৬২, পৃ. ৯, আবদুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৭।
- ৩. এস এম ইকরাম, হিস্টরি অফ মুসলিম সিভিলাইজেশন ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান, লাহাের, ১৯৬২, পৃ. ৮।
- ৪. মজুমদার দত্ত ও রায়চৌধুরী, অ্যান অ্যাডভান্সড হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, ম্যাকমিলন, লন্ডন, ১৯৬০, পৃ. ১৮২।।
- ৫. ইলিয়ট ও ডওসন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৩, এস এ এ রিজভি, দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া, খণ্ড-২, অনুবাদ-অংশুপতি দাশগুপ্ত, অতীতের উজ্জ্বল ভারত, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, পুনর্মুদ্রণ, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ৬৩।
- ৬. এস এম ইকরাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮-১০।
- ৭. ইলিয়ট ও ডওসন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৫-১৮।
- ৮. ইরফান হাবিব, মধ্যযুগের ভারত একটি সভ্যতার পাঠ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, দিল্লি, ২০১১, পৃ. ৩০।
- ৯. ইলিয়ট ও ডওসন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৫।
- ১০. আবদুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০।
- ১১. এ কে এম আলিম, ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস, মাওলা ব্রাদার্স, অষ্টম মুদ্রণ, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ১৬।
- ১২. বি এন পাণ্ডে, ইসলাম ও ভারতীয় সংস্কৃতি, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃ. ৫।
- ১৩. আবদুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০।
- ১৪. তারাচাঁদ, ইনফ্লুয়েন্স অফ ইসলাম অন ইন্ডিয়ান কালচার, অনুবাদ-করুণাময় গােস্বামী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ. ৩৬।
- ১৫. ইলিয়ট ও ডওসন সম্পাদিত, হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টরিয়ান, খণ্ড-১, লন্ডন, ১৮৬৭, পৃ. ২৭।
- ১৬. ইসতাখরী, মাসালিকুল মামালিক, পৃ. ১৭৩, অন্তর্ভুক্ত, ইলিয়ট ও ডওসন সম্পাদিত, খণ্ড-১, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭।
- ১৭. তারাচাঁদ, ইনফ্লুয়েন্স অফ ইসলাম অন ইন্ডিয়ান কালচার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬-৩৭।
- ১৮. কামালউদ্দিন আব্দুর রাজ্জাক, ব্রিটিশ লাইব্রেরী, ১২৯১, এফ, ২০৪ বি, আজিজ আহমদ, স্টাডিজ ইন ইসলামিক কালচার ইন দ্য ইন্ডিয়ান এনভায়রনমেন্ট, অক্সফোর্ড, ১৯৬৪, পৃ. ২০।
- ১৯. Ramesh Chandra Majumder, The History and Culture of the Indian People, Voll-5 (The Delhi Sultanate), 1980, Mumbai, P.- 622.
- ২০. AL Shrivastava, The Delhi Sultanate, Agra, 1972, P.-322.
- ২১. হরবংশ মুখিয়া, মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়ান হিস্টরি অ্যান্ড দ্য কমিউনাল অ্যাপ্রােচ, অন্তর্ভুক্ত রমিলা থাপার হরবংশ মুখিয়া ও বিপানচন্দ্র সম্পাদিত, কমিউনালিজম অ্যান্ড দ্য রাইটিংস অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি, বাংলা অনুবাদ-তনিকা সরকার, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, দ্বিতীয় মুদ্রণ, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃ. ৩১।
- ২২. আবুল ফজল, আইন-ই-আকবরী, খণ্ড-২, নাভাল কিশাের, পৃ. ১৮৫। ইকতিদার আলম খান, মধ্যযুগের ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতি, অন্তর্ভুক্ত, গৌতম চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, ইতিহাস চর্চা জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতা, সেতু প্রকাশনী সংস্করণ, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৩।
- ২৩. বিস্তারিত দেখুন-মমতাজুর রহমান তরফদার, হােসেন শাহী আমলে বাংলা ১৪৯৪-১৫৩৮, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০১। আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৭। সুখময় মুখােপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ৫ম পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা, ২০১৫। আর এম ইটন, দ্য রাইজ অফ ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার ১২০৪-১৭৬০, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নয়াদিল্লি, ২০০২। এম এ রহিম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, খণ্ড-১, বাংলা একাডেমি, ২য় পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ২৭।
- ২৪. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, হরপ্রসাদ রচনাবলী, দ্বিতীয় সম্ভার, কলকাতা, ১৯৬৬, পৃ. ৮২।
- ২৫. Narendra Nath Law, Promotion of Learing in India during Mohammedan Rule, London, 1916.
- ২৬. ইকতিদার আলম খান, ‘Medieval Indian Notions of Statecraft in Retrospect, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে পঠিত তঁার প্রধান অতিথির ভাষণ, কলকাতা, ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪।
- ২৭. ঈধরীপ্রসাদ, দ্য হিস্টরি অফ মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া, এলাহাবাদ, ১৯৪০, পৃ. ৯১।
- ২৮ ঈরীপ্রসাদ, দ্য হিস্টরি অফ মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১০-১১১।
- ২৯. জিয়াউদ্দিন বারণি ফতােয়া-ই-জাহান্দারি, মুহাম্মদ হাবিব ও আফসার বেগম অনূদিত, মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া কোয়ার্টারলি, খণ্ড-৩, সংখ্যা-১ ও ২, জুলাই-অক্টোবর, ১৯৫৭, পৃ. ৮২।
- ৩০. আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী, খণ্ড -১, ব্লক ম্যান অনূদিত, খণ্ড -২, জেরেট অনূদিত এবং যদুনাথ সরকার কর্তৃক সংশােধিত, কলকাতা, ১৯৪৯।
- ৩১. রমিলা থাপার হরবংশ মুখিয়া ও বিপানচন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, দ্বিতীয় মুদ্রণ, কলকাতা, ১৯৮৯।
- ৩২. দেখুনঃ- Mohammad Habib, The Political Theory of the Delhi Sultanate, Kitab Mahal,
- Allahabad, 1961, Preface, P. 6.
- ৩৩. নিজামউদ্দিন আহমদ তবকৎ-ই-আকবরি, বি কে দে সম্পাদিত, এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল, কলকাতা, ১৯২৭ – ৩৫, ইলিয়ট ও ডওসন সম্পাদিত, খণ্ড-৫ দেখুন।
- ৩৪. সৈয়দ সাবাহুদ্দিন আবদুর রহমান, মাজহাবি রওয়াদারি, খণ্ড-১, ১৯৫৭, পৃ. ৯৩।
- ৩৫. আবুল কাসিম ফিরিস্তা দ্য হিস্টরি অফ মহামেডান পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া, খণ্ড-১, জে ব্রিগস্ সম্পাদিত, কলকাতা, ১৯০৮, পৃ. ১৪৮।
- ৩৬. জিয়াউদ্দিন বারণি তারিখ-ই-ফিরােজশাহী, সৈয়দ আহমদ খান সম্পাদিত, বিবলিওথেকা ইন্ডিকা, কলকাতা, ১৮৬২, ঢাকা, বাংলা সংস্করণ, ১৯৮২, পৃ. ৫৮৭।
- ৩৭. জিয়াউদ্দিন বারণি তারিখ-ই-ফিরােজশাহী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৫-৯৬ হরবংশ মুখিয়া, ডিবেট অফ হিস্টরি, দ্য ইন্ডিয়ান ম্যাসেঞ্জার, ২১ মে ১৯৮৭।
- ৩৮. মিনহাজউদ্দিন সিরাজী তবকাৎ-ই-নাসিরি, এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল, কলকাতা, ১৮৬৪ মেজর এইচ জি র্যাভার্টিকৃত ইংরেজি অনুবাদ, এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল, কলকাতা, ১৮৮০ পুনর্মুদ্রিত, দিল্লি, ১৯৭০ এ কে এম যাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃ. ৩১।
- ৩৯. মিনহাজউদ্দিন সিরাজী, প্রাগুক্ত, পুনর্মুদ্রিত, দিল্লি, ১৯৭০, পৃ. ৪১।
- ৪০. দেখুন-আমিনুল ইসলাম, বখতিয়ার খলজির বাংলা অভিযান নতুন ভাবনা, নতুন গতি, ঈদ সংখ্যা ২০১৬, কলকাতা।
- ৪১. এ কে এম যাকারিয়া, বাংলা সাহিত্যে গাজী কালু ও চম্পাবতী উপাখ্যান, দিব্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ১৩১৪।
- ৪২. মির্জা নাথান, বাহারিস্তান-ই-গায়বী, খালেকদাদ চৌধুরি অনুদিত, খণ্ড-১, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৮, পৃ. ২৭।
- ৪২ক. আর এম ইটন, দ্য রাইজ অফ ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার ১২০৪-১৭৬০, বাংলা অনুবাদ- হাসান শরীফ, ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ২২৭।
- ৪৩. দেখুন-রামাই পণ্ডিত, শূন্যপুরাণ, ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, কলকাতা, ১৯৭৭।
- ৪৪. দেখুন-আর এম ইটন, প্রাগুক্ত, নয়াদিল্লি, ২০০২।
- ৪৫. পরমতসহিষ্ণুতা ও অসংখ্য মন্দির নির্মাণসহ ঔরঙ্গজেবের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বহু দৃষ্টান্তের জন্য দেখুন-বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮-৪৮ জ্ঞানচন্দ্রের বিভিন্ন প্রবন্ধ, দ্য জার্নাল অফ দ্য পাকিস্তান হিস্টরিক্যাল সােসাইটি, ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৫৯। আরও দেখুন- আতাহার আলি, মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, বাংলা অনুবাদ-ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল অভিজাত শ্রেণি, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৭৮।
- ৪৬. ঈধরীপ্রসাদ, দ্য হিস্টরি অফ দ্য মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯১।
- ৪৭. তারাচঁাদ, ইনফ্লুয়েন্স অফ ইসলাম অন ইন্ডিয়ান কালচার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৬।
- ৪৮. আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ার, পড়তে না দেওয়া ইতিহাস, বি-বী জনমত, সাম্প্রদায়িকতাবিরােধী সংখ্যা, ২০০২, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর।
- ৪৯. তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরী, এ রজার্স ও বেভারিজকৃত অনুদিত, খণ্ড-২, লন্ডন, ১৯২১, পৃ. ১৮১।
- ৫০. দ্য ইন্ডিয়ান রিভিউ, আগস্ট ১৯২৯, পৃ. ৪৯৯। S A Rahaman, Ramjanmabhumi-Babri Masjid Historical Facts and Figures, Aligarh Shibli Academy; ১৯৮৯, দেখুন-দুর্গাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ ও ভারতবর্ষ, সােশিও-ইকনমিক রিসার্চ ইনসটিটিউট, ১ম প্রকাশ, ১৩৯৮, ২য় সংস্করণ, ১৪০০, কলকাতা, পৃ. ৪৭।
- ৫০ক. শেরশাহের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে আব্বাস শেরওয়ানির ‘তারিখ-ই-শেরশাহী’তে। পিতার জায়গীরে কি করে শান্তি-শৃঙ্খলা এনেছিলেন ফরিদ খান হিসেবে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে এই গ্রন্থে। মনে হবে শের শাহ বহু জায়গায় মুঘল শাসকদের অগ্রগণ্য ছিলেন। বাদশাহ আকবরের নির্দেশেই শেরওয়ানি মুঘল দরবারের আনুকুল্যে শের শাহের ওপর লেখেন এবং মুঘল শাসন ব্যবস্থার ধারাবাহিক ইতিহাসের (তুহুফাৎ-ই-আকবরশাহী) প্রথমাংশই হচ্ছে জীবনী। এই অংশে পরগণা স্তরে শাসন ও শােষণের আদর্শ স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। কিছু অংশ উল্লেখ করা হল “আমি (ফরিদ খান) চেষ্টা করব কৃষির উন্নতি করতে ও পরগণাকে জনবহুল করতে। জমি পরিমাপের সময় কৃষকের প্রতি নরম ব্যবহার করা উচিত এবং তার প্রকৃত উৎপাদনের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। কিন্তু কর সংগ্রহের সময় কৃষকের প্রতি কোনাে দয়া দেখানাে উচিত নয়, বরং নগদ বা জিনিসে কর কঠোরভাবে সংগ্রহ করা উচিত। যদি কোনাে কৃষক কর দিতে দ্বিধা করে তবে তাকে এমন শাস্তি দেওয়া উচিত যে অন্যরা তার থেকে শিক্ষা নেয় এবং এরকম কাজ একদম না করতে পারে।…কৃষকদের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন তােমাদের কিছু বলার থাকলে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে দরবার করাে। তােমাদের ওপর অত্যাচার করতে আমি কাউকে সুযােগ দেব না।” এইভাবে তাদের বলে বিদায় করলেন, ‘চাষের কাজ কর এবং রাজস্ব বৃদ্ধির জন্যে পরিশ্রম কর। (আব্বাস শেরওয়ানি তারিখ-ই-শেরশাহী, এস এম ইমাম উদ্দিন অনূদিত, ঢাকা, ১৯৬৪, পৃ. ১৪-১৭ এবং পৃ. ২৫-২৬। আরও দেখুন- সৈয়দ নুরুল হাসান, রেভেনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ দ্য জাগির অফ সাসারাম বাই ফরিদ, প্রসিডিংস অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি কংগ্রেস, রাঁচি, ১৯৬৪)। ঐতিহাসিক শ্রীরাম শর্মা তাঁর ‘দ্য রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার’ গ্রন্থে (এশিয়া পাবলিশিং হাউস, বম্বে, ১৯৬২, দ্বিতীয় সংস্করণ) তিনি দেখিয়েছেন, শের শাহ ইতিবাচক সহিষ্ণুতার নীতি অনুসরণ করেননি। এই প্রসঙ্গে তিনি অধ্যপক কানুনগাের সঙ্গে তর্কে অবতীর্ণ হয়েছেন (পৃ. ১০-১)। আশ্চর্যের বিষয় যে, তিনি শের শাহর সমসাময়িক হাসান আলি খানের লেখা ‘তওয়ারিখ-ই-দৌলত-ই-শেরশাহী’-র তথ্যসাবুদ লক্ষ্য করেননি। ওই লেখা থেকে জানা যায়, শের শাহ একটি ফরমান জারি করে তাঁর কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন হিন্দুদের মন্দির ও পবিত্রস্থানগুলি’ সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে, এবং শুধু তাই নয়, তাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ঐ আদেশ অগ্রাহ্য করলে শাস্তি পেতে হবে (মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া কোয়ার্টারলি, খণ্ড-১, সংখ্যা ১, পৃ. ৬০)।
- ৫১. উদ্ধৃত-জি এস সারদেশাই, নিউ হিস্টরি অফ দ্য মারাঠাজ, খণ্ড-২, বম্বে, ১৯৫৩, পৃ. ১১৮। ৫২. তারাচাঁদ, সােসাইটি অ্যান্ড স্টেট ইন দ্য মুঘল পিরিয়ড, দিল্লি, ১৯৬১, পৃ. ৫৮।
- ৫৩. তারাচঁাদ, সােসাইটি অ্যান্ড স্টেট ইন দ্য মুঘল পিরিয়ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯।
- ৫৪. দারাশুকো সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে হলে দেখুন- কালিকারঞ্জন কানুনগাে, দারাশুকো, মিত্র ও ঘােষ, কলকাতা, ১৯৮৬ অমিয়কুমার মজুমদার, দারাশুকোহ জীবন ও সাধনা, বি এন জি, কলকাতা, ১৯৮৫।
- ৫৫. মহাভারত, ফারসি অনুবাদ, লখনউ সংস্করণ, ১৯৫৭, আবুল ফজলের মুখবন্ধ, পৃ. ১৫।
- ৫৬. মহাভারত, ফারসি অনুবাদ, লখনউ সংস্করণ, ১৯৫৭, আবুল ফজলের মুখবন্ধ, পৃ. ৪।
- ৫৭. দেখুন- বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১।
- ৫৮. দেখুন- বি এন পাণ্ডে, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১-২২।
- ৫৯. কালীকিঙ্কর দত্ত, সাম ফরমানস, সনদস অ্যান্ড পরােয়ানাজ ১৫৭৮-১৮০২, খণ্ড-২, পাটনা, ১৯৬২। জৈনদের জন্য দেখুন- জ্ঞানচন্দ্র, আলমগীরস টলারেন্স ইন দ্য লাইট অফ কনটেম্পরারি জৈন লিটারেচার, জার্নাল অফ পাকিস্তান হিস্টরিক্যাল সােসাইটি, অক্টোবর ১৯৫৭, পৃ. ২৪৭-৫৪। গৌতম ভদ্র, মুঘল যুগের কৃষি, অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ, সুবর্ণরেখা, কলকাতা, ১৪২০, পৃ. ৩০।
- ৬০. আবদুল কাদের বাদাউনি, মুন্তাখাবাত-উত-তারিখ, খণ্ড-২, কলকাতা, ১৯৬৫, পৃ. ৩১৬।
- ৬১. ইকতিদার আলম খান, মধ্যযুগের ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯।
- ৬২. হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ১৪০।
- ৬৩. দ্য পেশওয়াস ডায়েরি, খণ্ড-২, দলিল নং- ১৭১, পৃ. ১০১।
- ৬৪. সতীশচন্দ্র, মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া, অনুবাদ-মুজিবর রহমান ও সাবির আলি, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-১ (১২০৬-১৫২৬), বুক পােষ্ট পাবলিকেশন, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ১৫৯।
- ৬৫. আবুল কাসিম ফিরিস্তা তারিখ-ই-ফিরিস্তা, প্রাগুক্ত, খণ্ড-২, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৬৬, পৃ. ২৬৫-৬৬। দেখুন-এস এ এ রিজভি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৬।
- ৬৬. সতীশচন্দ্র, মিডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া, অনুবাদ-মুজিবর রহমান ও সাবির আলি, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-১ (১২০৬-১৫২৬), প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৯।
- ৬৭. ইরফান হাবিব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭।
- ৬৮. ডি বারবােসা, দ্য বুক অফ ডুয়ার্টে বারবােসা, খণ্ড-২, এম এল ডেমস কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ, হ্যাকলুইট সােসাইটি, লন্ডন, ১৯১৮ ও ১৯১৯।
- ৬৯. আর সিওয়েন, ফরগটন এম্পায়ার, মাদ্রাজ, ১৯৩২, পৃ. ২৩৬-৯০।
- ৭০. হীরেন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯৯।
- ৭১. ব্যারণ চার্লস হুগেল, ট্রাভেলস ইন কারি অ্যান্ড দ্য পাঞ্জাব, ১৯৭০, পৃ. ৩১৭।
- ৭২. শাহনুরুর রহমান, হিন্দু-মুসলিম রিলেশনস ইন মুঘল বেঙ্গল, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০২।
- ৭৩. সুকুমার সেন, মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালি, বির্বভারতী, কলকাতা, ১৩৯২, পৃ. ৭।
- ৭৪. বিজয় গুপ্ত পদ্মপুরাণ, প্যারীমােহন দাশগুপ্ত সংগৃহীত, কলকাতা, ১৩১৪, পৃ. ৫৫।
- ৭৫. মুকুন্দরাম চক্রবর্তী কবিকঙ্কন চণ্ডী, বসুমতী, কলকাতা, তারিখহীন, পৃ. ৩-৪।
- ৭৬. এম এ রহিম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, খণ্ড-১, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণ, ২০০৮, পৃ. ২৪৫।।
- ৭৭. রমিলা থাপার, এ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-১, পেঙ্গুইন বুকস, মিডিলসেক্স, ১৯৭৯, পৃ. ২৭২। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সেনাবাহিনীতে হিন্দু অারােহী সৈন্য এত বেশি ছিল যে, তার সামরিক বিভাগের প্রধান ‘আরিজ-ই-মুমালিক’ সাধারণত ‘রাওয়াত আরজ’ নামে অভিহিত ছিলেন। রাওয়াত শব্দের অর্থ হিন্দু অর্বারােহী সৈন্য।
- ৭৮. মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭।
- ৭৯. মােহিত রায়, সম্প্রীতির দলিল, যুবমানস, শারদীয় ১৪০০, কলকাতা।
- ৮০. এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন-আতাহার আলি, মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, প্রাগুক্ত, কে পি বাগচী, কলকাতা, ১৯৭৮।
- ৮১. তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরী, খণ্ড-১, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫৯।
- ৮২. বেণীপ্রসাদ, হিস্টরি অফ জাহাঙ্গীর, এলাহাবাদ, পঞ্চম সংস্করণ, ১৯৬২।
- ৮৩. জাহাঙ্গীরের সময়ে সহিষ্ণুতার আরও বহু দৃষ্টান্ত আমরা তুলে ধরতে পারি— ১. সিংহাসনে বসে জাহাঙ্গীর বৃহস্পতিবার ও রবিবার পশু হত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং বলপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের আইন তুলে নেওয়া হয়েছিল। ২. সকল ধর্মের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল। শিয়া ও সুন্নিরা এক মসজিদে এবং খ্রীষ্টান ও ইহুদিরা এক গীর্জায় মিলিত হয়ে নিজেদের মতাে করে ঈথরের উপাসনা করত। ৩. জাহাঙ্গীর তার শিষ্যদের সবরকম সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিবাদ থেকে দূরে থাকার ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সার্বজনীন শান্তি বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ৪. জাহাঙ্গীর তার দরবারে হােলি, রাখি ইত্যাদি উৎসবের পাশাপাশি দেওয়ালি, দশেরা, শিবরাত্রি প্রভৃতি হিন্দু উৎসব পালন করতেন এবং বহু অভিজাতদের আমন্ত্রণও জানাতেন। খ্রীষ্টানদের জন্যও সে সময় উৎসব পালিত হত। ৫. তিনি পাঞ্জাবে গাে-হত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং গুজরাটেও এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। ৬. তার সময়ে হিন্দুরা তাদের নির্ধারিত ধর্মীয় আচার ও রীতিনীতি নির্বিঘ্নে পালন করত। ধর্মীয় নিপীড়নের উপরে তিনি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। ৭. হিন্দুদের নতুন মন্দির নির্মাণে কোনাে নিষেধাজ্ঞা ছিল না। শুধু মথুরা নয়, বেনারসেও এ সময়ে বহু নতুন মন্দির গড়ে উঠেছিল। গীর্জা নির্মাণের জন্যও প্রয়ােজনীয় অনুমতি ও জমি দান করা হত। ৮. তিনি ব্রাহ্মণদের জমিদান করতেন। খােরাসান অভিযানের সময় তিনি প্রচুর অর্থ ব্রাহ্মণ ও ফকিরদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। বৈষ্ণবদের মন্দিরের জন্যও তিনি অতিরিক্ত জমিদান করেছিলেন। ১৬১২-১৫ এই কালপর্বে তিনি বৃন্দাবনে বৈষ(বদের অন্তত পাঁচবার জমিদান করেছিলেন। ৯. আজমিরে জাহাঙ্গীর সমগ্র পুস্কর গ্রামকে ‘মদদ-ই-মাস’ (নিষ্কর জমি) হিসেবে সেখানকার ব্রাহ্মণদের দান করেছিলেন। ১০. গুজরাট থেকে পাওয়া লেখমালার দৃষ্টান্ত তথা জৈন গ্রন্থ থেকে। জানা যায় যে, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে জৈন সাধকদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। এবং জৈন মঠ প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্ত হস্তে তিনি জমিও দান করেছিলেন। ১১. ১৬২১ সালে কাংড়া অভিযান পরিচালিত হয়েছিল হিন্দু রাজা বিক্রমজিতের নেতৃত্বে।
- ৮৪. আব্দুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯০। আরও দেখুন- এস এ এ রিজভি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৮।
- ৮৫. ইবন বতুতা কিতাবুর রাহিলা, এইচ এ আর গিব কৃত ইংরেজি অনুবাদ, লন্ডন, ১৯২৯, আই আমিন সম্পাদিত, ট্রাভেলস্ অফ ইবন বতুতা, ঐতিহ্য, ঢাকা ২০০৪, দ্য রেহেলা অফ ইবন বতুতা, আগা মাহদি হুসেইনকৃত ইংরেজি অনুবাদ, ১৯৫৯, পৃ. ৮৮-৮৯।
- ৮৬. আতাহার আলি, এনকাউন্টার অ্যান্ড ইফ্লোরিসসেন্স জেনেসিস অফ দ্য মিডিয়াভ্যাল সিভিলাইজেশন, প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাড্রেসেস টু ইন্ডিয়ান হিস্টরি কংগ্রেস, গােরক্ষপুর, ১৯৮৯, দেখুন-সােস্যাল সায়েন্টিস্ট, নং- ২০০-২0১, জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি ১৯৯০, পৃ. ১৯।
- ৮৭. জিয়াউদ্দিন বারণি তারিখ-ই-ফিরােজশাহী, প্রাগুক্ত, বাংলা সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৮২, পৃ. ৫০১।
- ৮৮. জিয়াউদ্দিন বারণি তারিখ-ই-ফিরােজশাহী, প্রাগুক্ত, বাংলা সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৮২, পৃ. ৫০৫।
- ৮৯. কে এ নিজামি ও এম হাবিব, এ কম্প্রিহানসিভ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-৫ (দিল্লি সুলতানেট), পিপল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৭০, পৃ. ৪৯৪।
- ৯০. ইয়াহিয়া বিন আহমদ সিরহিন্দ তারিখ-ই-মুবারকশাহী, ই ডি রস সম্পাদিত, লন্ডন, ১৯২৭, মুহাম্মদ হিদায়েত হুসেইন সম্পাদিত, বিবলিওথেকা ইন্ডিকা, কলকাতা, ১৯৩১,পৃ ১১৫।
- ৯১. কে এ নিজামি ও এম হাবিব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৬।
- ৯২. এম আলম, মধ্যযুগে উত্তর ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, অনুষ্টুপ, সপ্তবিংশ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, ১৯৯৩, কলকাতা।
- ৯৩. আবদুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৪-০৫।
- ৯৪. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ভারতীয় সমাজ পদ্ধতি, খণ্ড-২, নবভারত, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ. ১৪৪।
- ৯৫. পি এন চোপড়া, সাম অ্যাসপেক্টস অফ সােসাইটি অ্যান্ড কালচার ডিউরিং দ্য মুঘল এজ ১৫২৬-১৭০৭, জয়পুর, ১৯৬৩।
- ৯৬. এন এ সিদ্দিকি, ল্যান্ড রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আন্ডার দ্য মুঘলস, বম্বে, ১৯৭০।
- ৯৭. বেণীপ্রসাদ, দ্য হিন্দু-মুসলিম কোয়েশ্চেনস, এলাহাবাদ, ১৯৪১।
- ৯৮. ইরফান হাবিব, অ্যাগরেরিয়ান সিস্টেম অফ মুঘল ইন্ডিয়া, ১৫৫৬-১৭০৭, দ্বিতীয় সংস্করণ, দিল্লি, ১৯৯৯, দেখুন-‘দ্য ভিলেজ কমিউনিটি’ প্রবন্ধ।
- ৯৯. S M Zafar, The cultural aspects of Muslim rule in India, Delhi, 1984, P. 286. ১০০. এ এল শ্রীবাস্তব, আকবর দ্য গ্রেট, খণ্ড-১ ও ২, আগ্রা, ১৯৬২ ও ১৯৬৭।
- ১০১. ইকতিদার আলম খান, মধ্যযুগের ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১।।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।