মুঘল সাম্রাজ্যের স্থপতি জহিরুদ্দিন মােহাম্মদ বাবরের (১৫২৬-৩০) আত্মজীবনী পড়লে দেখা যায় তিনি ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ। বাবার মৃত্যুর পূর্বে পুত্র হুমায়ুনকে এক ‘গােপন ইচ্ছাপত্রে’ রাজ্যশাসন সম্পর্কে কিছু মুল্যবান নির্দেশ দিয়ে যান। এই ‘গােপন ইচ্ছাপত্রে’ বাবর বলেছেন—“তােমার কর্তব্য হল, সব রকমের সংকীর্ণতা থেকে অন্তরকে মুক্ত রাখা সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক স্পর্শকাতরতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা সকল সম্প্রদায়ের উপাসনার পবিত্র স্থানগুলি রক্ষণাবেক্ষণ করা।”১ বাবরের এই নির্দেশ যেন আধুনিক ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। হুমায়ুন এ নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করেন কিন্তু সময় পাননি। তবে বাবরের পৌত্র আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) এই নির্দেশ পালন করে ভারতবর্ষের মধ্যযুগের ইতিহাসে এক জাতীয় নীতির প্রবর্তন করেন। প্রকৃতপক্ষ সম্রাট আকবরের হিন্দুস্থান জনসাধারণের শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি ভারতবর্ষে জাতীয়তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতির সূচনা করেন। রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থায় প্রকৃতপক্ষে তিনি মৌর্য, গুপ্ত ও হর্ষবর্ধনের সময়কার রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শকে গ্রহণ করেন।
প্রজাদের সদিচ্ছার উপরই যে মুঘল সদস্যদের ভবিষ্যৎ স্থায়িত্ব নির্ভরশীল—এই চরম সত্য আকবর উপলব্ধি করতে ভুল করেননি। জাতীয় ঐক্যনীতির ভিত্তিতে আকবরই প্রথম সমগ্র ভারতবর্ষকে একটি সার্বভৌম ক্ষমতার অধীনে আনেন এবং সমগ্র দেশে একই রকম প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও একই রকম আইন প্রচলিত করে আধুনিকতার গােড়াপত্তন করেন। কাশ্মীরকে তিনিই প্রথম ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ভেবেছিলেন। এমনকি প্রাচীন ভারতবর্ষে চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলি সুগঠিত ছিল না। শুধুমাত্র সম্রাটকে আনুগত্য দান করে নিশ্চিন্তে প্রাদেশিক শাসকরা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। দিল্লি সুলতানি আমলে আলাউদ্দিন খলজি (১২৯৬-১৩১৬) ও মহম্মদ বিন তুঘলকের (১৩২৫-১৩৫১) সময় প্রকৃতিগত কিছু পরিবর্তন ঘটলেও, অনুরূপ ব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল। কিন্তু আকবরই প্রথম প্রদেশগুলিকে কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে একইরকম শাসনব্যবস্থা, একই রকম রাজস্ব-ব্যবস্থা ও একই রকম মুদ্রা-ব্যবস্থার প্রবর্তন করে অভূতপূর্ব ভারতীয় ঐক্যের সূচনা করেন।
(১)
সম্রাট আকবরের ধর্মনীতির মধ্যেও জাতীয় নীতি প্রবর্তনের উদ্দেশ্যই প্রধান ছিল। তিনি ভারতীয় জনসাধারণের সকলের জন্য একটি গ্রহণযােগ্য ধর্মনীতি প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। স্বভাবতই সম্রাট সম্রাট আকবরের ধর্মনীতির পর্যালােচনা মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয়। সম্রাট আকবরের কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি সে যুগের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একটি উদার ও পরমতসহিষ্ণু ধর্মীয় দর্শন।
আত্মকলহে লিপ্ত উপদলসমূহকে একীভূত করে একটি বিশাল সাম্রাজ্যের সংহতি বিধানের জন্য আকবর তার ধর্মীয় চিন্তা ও নীতিকে যতটা সম্ভব স্থিতিস্থাপক করে তুলেছিলেন। তবে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই একমাত্র কারণ ছিল না। ধর্মচিন্তাবিদের দৃষ্টিতে তিনি সত্য অনুসন্ধানেরও চেষ্টা করেন। সম্রাট আকবরের কঠোর সমালােচক ছিলেন আবদুল কাদের বাদাউনি। তথাপি সম্রাট আকবরের ধর্মচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তিনি উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, প্রায় প্রতি ভােরেই সম্রাট একা ফতেপুর সিত্রীর প্রাসাদের নিকট একটি ঘরের ভেতর এক বড় পাথরখণ্ডের ওপর বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকতেন। তাঁর মাথা বুকের কাছে ঝুঁকে আসত। তিনি জন্ম-মৃত্যু রহস্য চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন। ধর্মে-ধর্মে হানাহানি তাকে ব্যথিত করে তুলত। তাই সকল ধর্মকে এক সূত্রে গাঁথা আপন কর্তব্য বিবেচনা করলেন। সম্রাট আকবরের ধর্মচিন্তা ছিল বেশ কিছু প্রভাব প্রতিফলনের ফল। যেমন,
১. আকবর চিঙ্গিজ খানের উদার, সর্বদর্শী আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। চিঙ্গিজ খানের জীবনীকার জুবাইনি জানিয়েছেন
যে, তিনি ধর্মান্ধতা ত্যাগ করে সব ধর্মকে সম্মান করতেন। তৈমুর ও তার বংশধররা ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করেন, শিয়াদের ওপর নিপীড়ন হয়নি। খ্রিস্টান ও পৌত্তলিকরা তাদের শাসন ও সৈন্যবাহিনীতে স্থান পেয়েছিল।
২. সম্রাট আকবরের পারিবারিক পরিবেশ ছিল ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। পিতা হুমায়ুন সুফি মতবাদে আকৃষ্ট ছিলেন। সম্রাট আকবরের মাতা হামিদা বানু বেগম ছিলেন ধর্মপ্রাণা। ধর্মান্ধতা প্রশ্রয় পায়নি তাঁর কাছে। পিতামাতার এই ধর্মীয় উদার দৃষ্টিভঙ্গি আকবরকে আকৃষ্ট করত। বাল্যকাল থেকেই সম্রাট আকবরের পরিচিত জগৎ ছিল বেশ প্রশস্ত। তুর্কি, মুঘল, আফগান, পারসিক নানা জাতির মানুষের সঙ্গে মিশে তার মধ্যে এক উদার মানবিক চিন্তার জন্ম হয়েছিল।
৩. ধর্ম ও দর্শন আলােচনা ছেলেবেলা থেকেই আকবরকে আকৃষ্ট করত। বৈরাম খানের অভিভাবকত্বের সময় তিনি অনেক
সাধু ও ফকিরের সঙ্গে মেলামেশার সুযােগ পেয়েছিলেন। রাজদণ্ড হাতে নেওয়ার পরও এই প্রভাব সমানভাবে তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, সাফল্যলাভের আশায় তিনি ছুটে যেতেন পির-ফকিরের আস্তানায়।
৪. সম্রাট আকবরের শিক্ষাগুরুদের প্রভাবও তাঁর ধর্মনীতি গ্রহণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। তার অন্যতম শিক্ষক আবদুল লতিফ আকবরকে মরমী সাধনার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলেছিলেন।
৫. উপরােল্লিখিত বিষয়সমূহ ছাড়াও সম্রাট আকবরের নিজস্ব অন্তর্মুখী অনুসন্ধিৎসু মনের প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। অধ্যাপক আতাহার আলি জানিয়েছেন, আকবর প্রথাগত ধারায় ছিলেন নিরক্ষর, কিন্তু উচ্চতর চিন্তা, নীতি ও শিল্প-সাহিত্যের রসাস্বাদনে তার কোনাে ঘাটতি ছিল না।
ধর্মীয় চিন্তা যে সম্রাটের মনে নতুন আলােড়নের সৃষ্টি করেছিল তার বড় প্রমাণ তিনি উদার মনােভাবাপন্ন অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিকে তার দরবারে উচ্চাসন দিয়েছিলেন। ১৫৬২তে তীর্থযাত্রা কর রদ ও ১৫৬৪তে জিজিয়া কর রদের মধ্য দিয়ে তিনি অবশ্য পূর্ববর্তী সম্রাটদের চেয়ে নিজেকে ব্যতিক্রমী আসনে বসাতে সমর্থ হয়েছিলেন বলে কোনাে কোনাে সমালােচক মনে করেন। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে গোঁড়া উলেমাদের কোপানলে পতিত পণ্ডিত ফৈজী ও তাঁর কনিষ্ঠ ভাই আবুল ফজলকে উচ্চ মর্যাদা দিয়েছিলেন আকবর। রাজা বীরবল নামে খ্যাত মহেশ দাস ছিলেন সম্রাটের একান্ত সহচর।
সম্রাট আকবরের ধর্মীয় চেতনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলা হয় তিনি মানবতাবাদী শেখ মােবারক এবং তার দুই পুত্র ফৈজী ও আবুল ফজলের সংস্পর্শে এসে যুক্তিবাদী মুসলমানে পরিণত হন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফতেপুর সিত্রীতে প্রার্থনা করার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা ইবাদতখানা’২ নামে পরিচিত হয়। এখানে ধর্মীয় দর্শনের নানা প্রণ নিয়ে আলােচনা করা হত। তাছাড়া এখানে তিনি বিভিন্ন ধর্মের অভিজ্ঞ পণ্ডিতদের আহ্বানও জানান। এভাবে ইবাদতখানায় এসে জড়াে হন ব্রাহ্মণ, জৈন, খ্রিষ্টান, পার্শী, জরথুস্ট্রবাদী, মুসলমান প্রভৃতি ধর্মের ব্যক্তিত্বগণ। তিনি সকল ধর্মের বাণী গভীর মনােযােগে শুনতেন। এভাবেই তার মনে একটি সমন্বিত ধর্মের বিষয়ে আগ্রহ জন্মে।
(২)
আকবর তাঁর ধর্মচিন্তার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছেছিলেন ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে। এ সময় তিনি ‘দীন-ই-ইলাহী’৩ নামে একটি নতুন ধর্মমতের প্রবর্তন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছিলেন। এই উদ্দেশ্যে বিদ্বান ব্যক্তিবর্গ ও সেনাধ্যক্ষদের নিয়ে এক সভা ডাকা হয়। এই সভা থেকে—যেখানে “বিশিষ্ট এই মানুষগুলাে বিশেষ করে উপস্থিত সেনাধ্যক্ষরা—যাদের কাছে রাজাই ঈশ্বর এবং রাজার ইচ্ছার চেয়ে বড় আইন কিছু নেই” সাগ্রহে মেনে নিলেন আকবরকে নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। শেখ মােবারককে দায়িত্ব দেওয়া হল বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে ঘােষণা করে দিতে যে, অচিরেই “যে ধর্মীয় বিধি সারা মুঘল সাম্রাজ্য জুড়ে সবাইকে মানতে হবে তা প্রচারিত হবে রাজসভা থেকে। সবাই প্রস্তুত থােক তাকে সর্বোত্তম বলে স্বীকার করতে এবং তাকে সশ্রদ্ধভাবে গ্রহণ করতে। তার রূপ যেমনই হােক।”৪ এই সভার অনুষ্ঠানকেই আধুনিক যুগের পণ্ডিতেরা সম্রাট আকবরের তথাকথিত নতুন ধর্ম ‘দীন-ই-ইলাহী’-র উদ্বোধন বলে মনে করেন। সকল ধর্মের নির্যাস নিয়ে আকবর তার এই ধর্মমতের কাঠামাে তৈরি করেন “বহু উপাদানের মিশ্রণ। উপাদানগুলির কিছু সংগৃহীত হয়েছিল মহম্মদ-উচ্চারিত কোরানের বাণী থেকে, কিছু বা ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রাদি থেকে আর কিছুটা যীশুর বাণী থেকে, অবশ্য ততটুকুই যা সম্রাট আকবরের উদ্দেশ্যের সঙ্গে খাপ খায়।” এভাবে সকল ধর্মের ভালাে দিকগুলাে একত্রিত করতে গিয়ে তিনি সর্বেরবাদকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন। তার এই নতুন ধর্মমত অতীন্দ্রিয়বাদ, দর্শন ও প্রকৃতিপূজার মিশ্রণ ছিল। সকল চিন্তার ভিত্তি ছিল কঠোর যুক্তিবাদ। এই ধর্মদর্শনে কোনাে নবী বা দেবদেবীর স্থান নেই। জাগতিক বিষয় সম্পর্কে উদারতা এবং ব্যক্তিগত জীবনের পবিত্রতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছিল এই ধর্মে। ‘দীন-ই-ইলাহী’তে প্রবেশ করার জন্য একখানি প্রতিজ্ঞাপত্র লিখতে হত, তার কয়েকটি বাক্য ছিল এইরূপ “আমি অমুকের পুত্র অমুক, নিজের ইচ্ছায় ও আন্তরিকতার সঙ্গে ইসলাম ও গতানুগতিক ধর্ম—যা আমি পিতা-পিতামহের কাল থেকে দেখেশুনে আসছি—তাকে অস্বীকার করছি এবং দীন-ইলাহী আকবরশাহীতে প্রবেশ করছি, সেই সঙ্গে চার প্রকার আচার-সম্পর্কিত বিষয় ধন-প্রাণ-সম্মান-ধর্ম ত্যাগ স্বীকার করছি।”৫
সম্রাট আকবর নতুন ধর্মমত প্রবর্তন করলেও অনুসারীর সংখ্যা বাড়ানাের দিকে কোনাে মনােযােগ দেননি। ব্লকম্যান নামে উনিশ শতকের এক বিখ্যাত পণ্ডিত এই ধর্মে দীক্ষিত মানুষদের এক তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। এই তালিকাতে ১৮ জনের বেশি নাম নেই। কোনাে নতুন ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা এমন নগণ্য সংখ্যক শিষ্য নিয়ে গর্ববােধ করবেন না আর সম্রাট আকবরের মতাে প্রভাবশালী সম্রাটের ক্ষেত্রে তাে কথাই নেই। যাইহােক ‘দীন-ই-ইলাহী’র সদস্যসংখ্যা যে কুড়িজনের বেশি ছিল না তা বলা যায়।৬ আর এদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সকলেই ছিলেন মুসলমান। হিন্দুদের মধ্যে থেকে দীন-ই-ইলাহী’র দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন বীরবল। দীক্ষা গ্রহণে জবরদস্তি ছিল না বলেই আকবর-ঘনিষ্ঠ মানসিংহ, ভগবান দাস, টোডরমল প্রমুখ ব্যক্তিত্ব দীন-ই-ইলাহী’র দীক্ষা গ্রহণ করেননি।
‘দীন-ই-ইলাহী’র ধারণা আকবর কেন প্রচার করেছিলেন এ নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। অনেকের মতে, সম্রাট হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের জন্যই এই মতবাদ প্রচার করেছিলেন। বাদাউনির মতে, আবুল ফজলের মত স্তাবকদের প্ররােচনাতেই সম্রাট এই মতবাদ প্রচলন করেন। সম্রাট আকবরের জীবদ্দশাতেই এই মতবাদ টিকে ছিল। অনুসারীদের মধ্যে সাধারণভাবে আন্তরিকতার টান ছিল না।
সম্রাট আকবরের উত্তরসূরি হিসাবে সম্রাট জাহাঙ্গীর ‘দীন-ই-ইলাহী’র ব্যাপারে নিস্পৃহ ছিলেন। সমস্ত ধর্মের সারবস্তু নিয়ে আকবর সাম্রাজ্যের সংহতি বিধানের জন্যই এই ধর্মমত প্রচার করতে চেয়েছিলেন—এই বিষয়টি বিবেচনা করাই অধিক যৌক্তিক। যদিও সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর ‘দীন-ই-ইলাহী’ অনুসারী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আর ছিল না, তবুও ইতিহাসে এই মতবাদের গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। প্রথমত, মধ্যযুগব্যাপী ইউরােপে রাজধর্ম প্রজাধর্ম এই রীতি কার্যকর ছিল। ‘দীন-ই-ইলাহী’ গ্রহণকারী ব্যক্তিগণ সম্রাট আকবরের রাজনৈতিক জীবনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এই মতবাদে দীক্ষিত হওয়ায় তারা আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে রাজনীতিকে একীভূত করতে পেরেছিলেন। ফলে সম্রাট আকবরের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকলেও দীক্ষা লাভকারীরা সম্রাট আকবরের একান্ত অনুগত হয়ে পড়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, এই মতবাদ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এই ধারণা জন্মাতে সক্ষম হয়েছিল যে, সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভেদ থাকার পরও ঈর ও সম্রাটের স্বার্থে মানুষে মানুষে নৈকট্য সৃষ্টি করা প্রয়ােজন। তৃতীয়ত, যদিও সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর ‘দীন-ই-ইলাহী’র কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তথাপি জাহাঙ্গীর তার ধর্মচিন্তায় পরােক্ষ ভাবে এর প্রভাব এড়াতে পারেননি। তাই উত্তরকালে শাহজাহনের পুত্র খসরু ও দারাশিকোর মধ্যে এই আদর্শের প্রভাব লক্ষ করা যায়।
(৩)
ইসলাম ধর্মের বিধব্যাপী রাজনৈতিক বিজয়াভিযানের অংশ হল ভারতে মুসলিম রাজ্যপ্রতিষ্ঠা। এই রাজ্যই ক্রমে সালতানাত ও পরে মুঘলদের সময় তা সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। তাই প্রধানত সুন্নি মতবাদের ধারক মুঘল সম্রাটদের সফল পুরুষ আকবর ‘দীন-ই-ইলাহী’ নামের ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন। তাই প্রশ্ন উঠেছে ইসলামি আদর্শ থেকে কি আকবর দূরে সরে গিয়েছিলেন? অথবা বিভিন্ন ধর্মমতের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তার সম্পর্ক কতটুকু ছিল?
বাদাউনি ও জেসুইট পাদ্রীদের অভিযােগ, সম্রাট আকবরের নতুন ধর্মচিন্তা প্রমাণ করে সম্রাট ইসলাম ধর্মপরিত্যাগ করেছিলেন। এই অভিযােগ ভিনসেন্ট স্মিথ সহ অনেক ঐতিহাসিক মেনেও নিয়েছেন।৭ স্মিথ মন্তব্য করেছেন, সম্রাট আকবরের নতুন ধর্মমতের পরিকল্পনা ছিল হাস্যকর, অহংকারের স্বাভাবিক ফল এবং অসংযত স্বৈরাচারের বীভৎস প্রকাশ। এটা ছিল সম্রাট আকবরের বুদ্ধিহীনতার প্রধান স্তম্ভ, তার জ্ঞানের নয়।৮ স্মিথ আরও বলেন, ১৫৫৬-১৫৭৪ সাল পর্যন্ত আকবর ছিলেন একজন আগ্রহশীল সুন্নী মুসলমান ১৫৭৪-৮২ সালের মধ্যে তার ভাবপ্রবণ মনে ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে পরিবর্তনের সূচনা হয় এবং তখন তাকে একজন সন্দেহবাদী, প্রত্যাদেশে অবিধাসী, যুক্রিবাদী মুসলিম বলে আখ্যা দেওয়া যায় এবং অবশেষে ১৫৮২-১৬০৫ সালের মধ্যে ইসলাম ধর্মকে পুরােপুরি তিনি ত্যাগ করেন।৯ ব্লকম্যান বলেন যে, নতুন ধর্মমত প্রচার করে আকবর ইসলামধর্ম সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন।১০ ১৫৮২ সালের প্রারম্ভে সম্রাট আকবরের সঙ্গে মনসারেটের আলাপের মাধ্যমে মনসারেট উপলব্ধি করেন যে, আকবর ইসলাম ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন। এবং সম্রাট ইসলামের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন না।১১ পেরুচি মন্তব্য করেন যে, সম্রাট ইসলামের অনুরাগী ছিলেন না।১২
সম্রাট আকবরের ওপর মসজিদ ধ্বংসের অভিযােগ আরােপ করেছেন জেসুইট পাদ্রীরা। তাদের বক্তব্য, আকবর তার পিতৃপুরুষদের ধর্মীয় বিধাস তথা ইসলামকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন।১৩ জেসুইট পিনহেরাে গির্জার জন্য প্রাসাদের নিকটে একটি সুন্দর জায়গা পাওয়ার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, “এই বাদশাহ মুহম্মদের অলীক ধর্মকে নষ্ট করে দিয়েছেন, তার একদম বদনাম করে ছেড়েছেন। এই শহরে না কোনাে মসজিদ আছে, না কুরান। আগে যে মসজিদগুলি ছিল, সেগুলােকে হয় ঘােড়ার আস্তাবল, না-হয় গুদামঘর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুসলমানদের অত্যন্ত লজ্জিত করার জন্য প্রত্যেক শুক্রবার সাতচল্লিশটি কিংবা পঞ্চাশটি শূকর এনে তাদের লড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি তাদের দাঁতগুলাে সােনায় মুড়ে রাখেন। বাদশাহ নিজে একটি ধর্ম প্রবর্তন করেছেন, তিনি নিজে তার পয়গম্বর। তার অনেক অনুগামী আছে, তবে পয়সার জন্য। তিনি ভগবান ও সূর্যের পূজা করেন। তিনি হিন্দু ও জৈন সম্প্রদায়ের অনুসরণ করেন। আমাদের পাঠশালায় খুব উচ্চ মনসবপ্রাপ্ত আমিরের পুত্র, তৎসহ বাদশাহের তিন পুত্র পড়াশােনা করে, দুই শাহজাদা খ্রিস্টান হতে চায়।”
তৃতীয় জেসুইট মিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন ফাদার জেরােম জেভিয়ার। তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে, আকবর মুসলমান ছিলেন না। ছিলেন বহু দেবতাবাদী ও কুসস্কারাচ্ছন্ন। ফাদার জেভিয়ার বলেছেন, আকবর “চান নতুন ধর্ম তৈরি করতে যার মাথা হবেন তিনি নিজে। শােনা যায় যে, তার ধর্ম ইতিমধ্যে বহুলােক অনুকরণ করতে শুরু করেছে। কিন্তু আসলে এরা অধিকাংশই তােষামােদকারী এবং এমন লােক যাদের অর্থ দিয়ে কেনা হয়েছে।”১৪ এ থেকে বােঝা যায়, অন্তত ১৫৯৪ সালের আগে নতুন কোনাে ধর্মের বাণী সূত্রাকারে ব্যক্ত হয়নি। পাদ্রী জেভিয়ার আরও বলেছেন, “অল্পবিস্তর নিশ্চয়তার সঙ্গে একথা বলা যায় যে, সম্রাট আকবরের প্রবল ইচ্ছা লােকে তাকে দেখুক ও মান্য করুক দেবতা রূপে বা অন্তত একজন ধর্মগুরু হিসেবে। তিনি চান যে, লােকে বিশ্বাস করুক যে, তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এবং ব্যধিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম তার নিজের পা ধােয়ার জল দিয়ে।”১৫
পাদ্রী জেভিয়ার লাহাের থেকে ১৫৯৫-র আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নিজেদের চিঠিপত্রে উল্লেখ করেছেন যে, আকবর ইসলামবিরােধী। জেভিয়ার বলেছেন, “বাদশাহ তার মস্তিষ্ক থেকে মুহম্মদের ধর্মকে একেবারে দূর করে দিয়েছেন। তার আকর্ষণ হিন্দু ধর্মের দিকে। ভগবান ও সূর্যের পূজা করেন। এখন হিন্দুরা তাঁর অনুগ্রহভাজন। আমি জানিনে, মুসলমানরা এটাকে কি মনে করেন, বাদশাহ মুহম্মদের নামেও ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেন। এখানে খ্রিস্টান সাধুরা বহু বিষয়েই প্রচুর অতিশয়ােক্তির সাহায্য নিয়েছেন এবং বাদশাহের কঠোর ইসলাম-বিরােধিতাকে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করেছেন, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। সম্ভবত তাদের মনে ইসলামের প্রতি যে ঘৃণা, তা সম্রাট আকবরের নামে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন।১৬
এটা মনে রাখা জরুরি যে, সম্রাট আকবরের শাসনের অন্তিমপর্বে একটি ব্যবহারিক ধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্মের পতন যেন অনিবার্য হয়ে পড়ছিল। এহেন বক্তব্য শুধু বাদাউনি ও জেসুইট পাদ্রীদের গ্রন্থে সীমাবদ্ধ নয়। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭) রচিত নিয়ামতউল্লাহর ‘তারিখ-ই-খানজাহানি’ (১৬১৩) একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই গ্রন্থের বিশেষ অংশে সম্রাট আকবরের মৃত্যুর সময়ে (১৬০৫) বিদ্যমান ইসলামের দূরবস্থা সম্বন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল জাহাঙ্গীরের দিল্লির সিংহাসনে বসার পর “লাল ফুলের মতাে পয়গম্বরের ‘শরিয়ৎ হেমন্তের হাওয়ায় যেন উড়ে গিয়েছিল, আবারও তা নতুন করে ফুটে উঠতে শুরু করেছে ইসলামের রাজার (জাহাঙ্গীর) সিংহাসনে আরােহনের পর আর মজিদ, খানকহ ও মাদ্রাসা—গত তিরিশ বছরে যা হয়ে উঠেছিল পাখি আর জন্তুদের আবাসভূমি, তখন মুসলমানের আজানের ধ্বনি কেউ শুনতে পেত না, এখন সে দরজা খুলে গিয়ে আবার (তাদের কাছে) উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।”১৭ এখন কেউ বলতে পারেন যে, জেসুইটরা তাে কিছু ভুল বলেননি, যেখানে তারা মসজিদ অধিগ্রহণের কথা বলেছেন।
কিন্তু প্রর্ণ হল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে (১৫৫৬-১৬০৫) কিছু ইতিবাচক নিপীড়নের কারণে সত্যিই কি ইসলাম বিপন্ন হয়ে পড়ছিল? সমসাময়িক আর এক ধর্মীয় নেতা সৈয়দ আহমদ সিরহিন্দি জাহাঙ্গীরকে লিখিত একপত্রে সেরকম দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অমুসলিমদের পাশাপাশি মুসলমানদেরও ধর্মাচরণের অধিকারকে সংঙ্কুচিত করা হচ্ছিল। কিন্তু কিছুদিন পরে অমুসলিমরা প্রকাশ্যেই তাদের ধর্ম পালন করলেও মুসলমানদের সে েত্রে বাধা দেওয়া হত। এমনকি প্রকাশ্যে ধর্ম পালনের শাস্তি স্বরূপ তাদের হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে।১৮ তবে ধর্মীয় উৎপীড়নের এমন নজির সত্বেও ধর্মীয় নেতাদের উপর কঠিন শাস্তি প্রয়ােগের ঘটনা কিন্তু বিরলই বলা চলে।১৯
১৬৩৬-৩৭ সালে রচিত মহম্মদ সাদিকের গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, সম্রাট আকবর তার রাজত্বের শেষের দিকে ইসলামের প্রতি তার বিবাস হারিয়েছিলেন এবং দেশের বহু স্থান থেকে ধর্মীয় নেতাদের তলব করে দরবারে এনে তাদের শাস্তি দেন। কিন্তু তিনি একটি মাত্র হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেছেন—হিন্দুদের অভিযােগের ভিত্তিতে ১৬০০ সালে হাজি সুলতান নামে এক রাজস্ব সংগ্রাহককে হত্যা করা হয়। সম্ভবত এর সঙ্গে ধর্মীয় ব্যাপার জড়িত ছিল না। মহম্মদ সাদিক আর একটি কাহিনি নথিভুক্ত করেছেন। শেখ আবদুল ফতেহকে সম্রাট আকবরের দরবারে তলব করা হলে তিনি শাস্তির আশঙ্কা নিয়েই দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন, কিন্তু আকবর তাঁকে নিজগৃহে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন।২০ সুতরাং এ দুটি কাহিনির সঙ্গে ধর্মের সম্পৃক্ততা না থাকায় এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বক্তব্যকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি।২১
বাদাউনির সরাসরি মন্তব্য, ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের পর আকবর আর মুসলমান থাকেননি। তিনি তালিকা তৈরি করে দেখাতে চেয়েছেন ইসলাম থেকে সম্রাট আকবরের দূরত্ব কতটুকু। বাদাউনি নিজের চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক তথ্যেরও অবতারণা করেছেন। গবেষণার স্বার্থে সম্রাট আকবরের নতুন ধর্মে কি ছিল তা আমাদের জানা দরকার।
১. ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ ইসলামের মূলমন্ত্রের পরিবর্তে ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ আকবর খলিফাতুল্লাহ’ মূলমন্ত্র চালু করতে মনস্থ করা।
২. সুদ ও মদকে হালাল বা বৈধ বলে গণ্য করা।
৩. জুয়া খেলা বৈধ হওয়া।
৪. দাড়ি রাখা অবৈধ ঘােষণা করা।
৫. যৌন সংসর্গান্তে অবশ্য স্নানের পরিবর্তে পূর্বাহ্নে স্নানের ব্যবস্থা করে শরীয়ত প্রথা বাতিল করা।
৬. দু’চার দিনের জন্য অস্থায়ী বিবাহ করা ও তালাক দেওয়া।
৭. মেয়েদের মাথায় কাপড় না দেওয়া এবং পর্দা প্রথার বিলােপ সাধন করা।
৮. মুসলমান বালকদের খতনা বন্ধ করা।
৯. মৃতদেহকে জলে নিমজ্জিত করা অথবা কবর দিতে হলে মৃতের পা দুটি কাবা বা পশ্চিম দিকে দেওয়া।
১০. পুষদের জন্য রেশমী পােষাক বৈধ করা।
১১. কুকুর ও শূকর মাংস বৈধ বা হালাল করা।
১২. রাজপ্রাসাদে শূকর ও কুকুর প্রতিপালনে উৎসাহ দান। সম্রাট আকবর এও বলেন, প্রতি সকালে শূকর ও কুকুর দেখা পুণ্যের কাজ।
১৩. কোরআন মিথ্যা বলে প্রচার করা।
১৪. কোরআন ও হাদিস পাঠ বন্ধকরণ।
১৫. ঈদুল আজহায় গরু ব্যবহার বন্ধ করা।
১৬. কিয়ামত ও পরকাল প্রভৃতিতে বিবাস করতে নিষেধ করা।
১৭. রাজ দরবারে সিজদা বা প্রণিপাত বৈধ করা, ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলা বন্ধ করা।
১৮. হিজরী সন ব্যবহার বন্ধ করে নতুন সাল চালু করা।
১৯. অনেক মসজিদকে ক্লাব ও সরকারী গুদাম ঘর করা।
২০. মাদরাসায় ও মসজিদে উচ্চস্বরে আজান বন্ধ করা ইত্যাদি।
২১. আরবি ভাষা শিক্ষা গর্হিত অন্যায় বলে মনে করা হয়।
এ প্রসঙ্গে রাহুল সাংকৃত্যায়ন তার গ্রন্থে লিখেছেন, “আকবর গাে-হত্যা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং সেই অপরাধের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। ১৫৮৩-র হুকুম অনুযায়ী বছরে একশত দিনের বেশি মাংস-ভক্ষণ বর্জিত ছিল। এই হুকুম কেবল রাজধানীতেই নয়, এমনকি সারা রাজ্যে চালু ছিল। ‘দীন-ই-ইলাহী’র অনুগামীদের জন্য গোঁফ-মুণ্ডন আবশ্যক ছিল। তাদের জন্য শুধু গাে-মাংসই নয়, রসুন-পিয়াজও পরিত্যাজ্য ছিল। বাদশাহের সম্মুখে সিজদা (দণ্ডবৎ) করা আবশ্যক ছিল। এই ধর্মের বাইরের লােকদের কাছেও তা বাধ্যতামূলক ছিল। ইসলামে সােনা ও জরির বস্ত্র পরিধান নিষিদ্ধ, কিন্তু দীন-ইইলাহী’তে সর্বজনীন প্রার্থনা ও অন্যান্য সময়ে সে-সব ধারণ করা আবশ্যক বলে গণ্য হতাে। দরসনিয়াদের (‘দীন-ই-ইলাহী’র অনুগামীদের) জন্য রমজান মাসের রােজা ও হজ মানা করে দেওয়া হয়েছিল। আরবি, ইসলামী শরীয়ত, কোরআনের ব্যাখ্যাও পাঠ করা নিষিদ্ধ ছিল। ৯৮৯ হিজরীতে (১৫৮১-৮২) বহু রক্ষণশীল শেখ ও ফকিরকে কান্দাহারের দিকে নির্বাসিত করে দেওয়া হয়—পূর্ব থেকেই বসবাসকারী ইলাহী নামক সম্প্রদায়ের শেখদের ও তাদের শিষ্যদের সিন্ধু-কান্দাহারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খৎনা করাও নিষিদ্ধ ছিল।
প্রাতঃকাল, সায়ংকাল, মধ্যাহ্ন ও মধ্যরাত্রি—চারবার পূর্বদিকে মুখ করে পূজা করা হত। সূর্যের সহস্র নাম জপ করা হত। আকবর স্বয়ং দু’কান ধরে পরিক্রমা করতেন। সূর্যোদয় ও মধ্যরাত্রির প্রার্থনার জন্য নাকাড়া বাজানাে হতাে।”২২ এছাড়া কোনাে শিশুপুত্রের নাম মুহম্মদ রাখতে দেওয়া হত না, আর যাদের নামের সঙ্গে মুহম্মদ ছিল, দীক্ষার সময় তা বদলে। দেওয়া হত। নতুন মসজিদ নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং পুরনাে মসজিদের সংস্কারেরও অনুমতি ছিল না।২৩
অন্য সূত্র থেকেও আমরা এই সমস্ত দুর্লভ তথ্যের সন্ধান পেতে পারি, ‘The Emperor (Akbar) had ceased to believe in the Quran, he did not believe in life after death, nor in the Day of Judgement. He had gone further. He had determined publicly to use the new formula : ‘there is no god but Allah and Akbar is God’s Representative’. But as this led to commotions, he thought it wiser to restrict the use of this formula to a few people within the precincts of the Haram. Sajdah or the form of prostration reserved by Islam for God alone, was made compulsory before the Emperor.
Wine was declared lawful, and bacon was made an ingredient of wine; Jizyah or the military tax was abolished and beef was declared unlawful. Pigs and dogs were specially reared and regarded as manifestations of God. The Salat or the prescribed prayers, the Saum or the prescribed fasts and the Hajj or pilgrimage to Mecca were abolished. The Islamic calender was replaced by the new-fangled Ilahi months and years. Indeed Islam after a thousand years was considered to have played itself out; the study of Arabic was looked upon as if it were something unlawful; the Law of
Islam or Figh, Tafsir or the exegesis of the Quran and Hadith or the traditions of the Prophet were ridiculed; and those who prosecuted these studies were looked down as deserving of contempt.
The ‘Ajan’ or call to the prayers, and the Namaz-l-Jamat or congregational prayers which used to be, as prescribed by Islam, offered five times a day in the state hall were stopped. Such names as Ahmad, Muhammad and Mustafa, the various names of the Prophet of God, had become offensive to the Emperor, and to utter them was a crime. Mosques and prayer rooms were changed into store-rooms and into Hindu guardrooms.
Islam was in great distress. Unbelievers could openly ridicule and condemn Islam and the Muslims. The rites of Hinduism were clebrated in every street and corner, while Muslims were not permitted to carry out the injunctions of Islam. The Hindus when they observed fast could compel the Muslims not to eat and drink in public, while they themselves could eat and drink publicly during Ramajan. At several places Muslims had to pay with their lives for sacrificing the cow on ‘Id-ulAdha’. A number of mosques were destroyed by Hindus and temples erected in their place.’২৪
সুতরাং ‘দীন-ই-ইলাহী’ প্রতিষ্ঠা করা ইসলাম বিরােধী মতবাদ ছাড়া কিছুই নয়। অন্যপথে র মত, ‘দীন-ই-ইলাহী’ প্রধানত একটি ধর্মনৈতিক দার্শনিক মতবাদ। যদিও আকবর যুক্তি ও সময়ের প্রয়ােজনে কিছু ইসলামি আচার-আচরণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তথাপি বলা যাবে না ইসলামবিরােধী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি তা করেছিলেন। আকবর ইসলামের উপসম্প্রদায়ের সীমাবদ্ধতাকে প্রশ্রয় দেননি। এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের সর্বজনীনতার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ। হযরত মােহাম্মদের (সঃ) পদচিহ্ন বলে চিহ্নিত পাথর সংরক্ষিত করে ‘কদম রসুল’ সৌধ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। আকবর কোরআন শরিফকে অশ্রদ্ধা করেছেন অথবা মসজিদে আরবি ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। যে সমস্ত মাদ্রাসায় সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধবাদীরা সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উস্কে দিচ্ছিলেন আকবর কেবলমাত্র সেসব মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি ভক্তিভরে সুফি-সাধকদের সমাধিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। সম্রাট ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা ও হজযাত্রীদের জন্য নানা সুবিধার ব্যবস্থা করেছিলেন।
আতাহার আলি বলেছেন, “এই মত ব্যাখ্যা করা যায় না যে, সম্রাট আকবরের আমলের শেষ বছরগুলিতে সামগ্রিকভাবে ইসলামের ক্ষতি হয়েছিল।”২৫ তবু এ কথা স্বীকার্য যে, আকবর তার শেষ জীবনে ইসলামের উপর ভক্তি-শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং তার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে ইসলামবিরােধিতা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছিল।
সম্রাট আকবর কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলেও তার বিরুদ্ধে এই অভিযােগ অসংগত যে, তিনি ইসলাম ত্যাগ করেছিলেন। বরং এ কথা বলাই যথার্থ যে, যা আগেও বলা হয়েছে, তিনি কখনােই আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামের বিরােধিতা করেননি এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে একজন মুসলিম বলেই মনে করতেন। জাহাঙ্গীর বলেন যে, তার পিতা এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহকে ভুলে যাননি।২৬ জাহাঙ্গীরের অভিমতকে সমর্থন করে আবুল ফজল বলেন যে, আকবর আত্মপরীক্ষা অথবা আল্লার উপাসনায় তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত করতেন। এছাড়া সমসাময়িক লেখক নুল হক এর মতে, ১৫৭৮ সাল পর্যন্ত সম্রাট আকবর রীতিমতাে ইসলাম ধর্মের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন।২৭ আতাহার আলি বলেছেন, সম্রাট আকবরের রাজত্বের শেষের দিকের বছরেও নিয়মিত মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। গােহত্যা নিষিদ্ধ হলেও এর অর্থ কোনাে ইসলামীয় প্রথাকে কোনােভাবে খর্ব করা নয়।২৮ অন্যদিকে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে আকবর যথেষ্ট গোঁড়ামি ও ইসলাম অনুরাগের প্রমাণও দিয়েছেন। ১৫৯২ সালে রাজা মান সিংহ যখন রাজমহলে একটি হিন্দু মন্দির নির্মাণে উদোগী হয়েছিলেন, তখন সম্রাটের ইচ্ছায় ও চাপে তা শেষ পর্যন্ত মন্দিরের পরিবর্তে একটি মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। ১৫৮২ সালের কিছু আগে মক্কার শরিফদের কাছে লেখা চিঠিতে এবং ১৫৮৬ সালে বুখারার শাসক আবদুল্লাহ খানকে লেখা দুটি চিঠিতে সম্রাট আকবর স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন যে, তিনি একজন একনিষ্ঠ মুসলিম এবং ইসলামের পৃষ্ঠপােষক। স্যার টমাস রাে-র ভাষ্য থেকে জানা যায়, আকবর একজন মুসলিম হিসাবেই শেষ নিঃাস পরিত্যাগ করেন। ডু-বােরিক বলেন, ‘১৬০৪ সালে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তবে পরধর্মসহিষ্ণু আকবর অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং তাদের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাই যাবতীয় দিক বিবেচনা করলে সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে ইসলাম বিচ্যুতির অভিযােগ গ্রহণ করা যায় না বলে কিছু সমালােচক মনে করেন।
(৪)
প্রথম দিকে জেসুইট পাদ্রীরা সম্রাট আকবরের নীতিতে উৎসাহিত হলেও পরে হতাশ হয়ে পড়েন। ধর্ম সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু মনের কারণেই আকবর গােয়ায় অবস্থানকারী পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষকে অনুরােধ করেছিলেন তারা যেন মুঘল দরবারে খ্রিস্টান ধর্মজ্ঞ পাদ্রী প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল তাদের কাছ থেকে সম্রাট খ্রিস্টধর্মের দর্শন সম্পর্কে জানবেন। এই সূত্রে বিভিন্ন সময়ে জেসুইট পাদ্রীদের তিনটি দল মুঘল দরবারে আসে। একোয়াভিভ, মনসারেট ও এনরিকেজকে নিয়ে গঠিত প্রথম মিশন ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি ফতেপুর সিত্ৰীতে পৌছায়। তারা ১৫৮২-র এপ্রিল পর্যন্ত সম্রাটের সাহচর্যে ছিলেন। দ্বিতীয় মিশনটি মুঘল দরবারে অবস্থান গ্রহণ করে ১৫৯১ থেকে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই দলে ছিলেন এডােয়ার্ড লিওন ও খ্রিস্টোফার দ্য ভেগা। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাটের সঙ্গে লাহােরে সাক্ষাৎ করেন তৃতীয় মিশনের পাদ্রী জেভিয়ার, পিনহেরাে এবং বেনেডিক্ট দ্য গােয়েস। মিশনপ্রধান ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাটের মৃত্যু পর্যন্ত রাজদরবারে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। আকবর মিশনের পাদ্রীদের যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে রাজদরবারে অবস্থানের ব্যবস্থা করেন। তিনি ‘ইবাদতখানা’য় তাদের সঙ্গে ধর্ম বিষয়ে আলােচনা করতেন। সম্রাট খ্রিস্টানদের গির্জায় যেতেন ও তাদের নানা উৎসবে যােগ দিতেন। তিনি যিশু, মেরী ও অন্যান্য দেবদূতদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। সম্রাটের আদেশবলে খ্রিস্টানরা লাহােরে গির্জা নির্মাণ ও প্রকাশ্য উপসনার সুযােগ লাভ করে। সম্রাট আকবরের এ সমস্ত আচরণে খ্রিস্টানদের ধারণা হয়েছিল সম্রাট বােধহয় মানসিকভাবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার চিন্তা করছেন।
আকবরকে খ্রিস্টধর্মে দীতি করার জন্য মিশনারিরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে থাকেন। কিন্তু যখন তারা দেখলেন একজন। উদার মুসলমানের দৃষ্টিতেই আকবর খ্রিস্টধর্মের ব্যাপারে তার কৌতূহল দেখাচ্ছেন ও আনুকূল্য দিচ্ছেন তখন তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকলেন। তাই তাদের বর্ণনায় সম্রাটকে মূর্তিপূজার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সূর্যের পূজারী হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। এসব প্রচারণায় ভি এ স্মিথের মতাে ইউরােপীয় ঐতিহাসিকগণও আস্থা রেখেছিলেন। তাই তারা বলতে চেয়েছেন মানসিক প্রস্তুতি থাকলেও কেবলমাত্র রাজনৈতিক সমস্যার কথা ভেবে আকবর খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেননি। এ ধরনের সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দিয়েছেন ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ। তিনি খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে সম্রাটের জানার আগ্রহকে ধর্মান্তরিত হওয়ার ইঙ্গিত বিবেচনা করার মতাে ইতিহাসভিত্তিক কোনাে যুক্তি খুঁজে পাননি। তাঁর মতে, খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে সম্রাট যে কৌতূহল দেখিয়েছেন তা তার ধর্ম সম্পর্কিত উদার চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ।
জৈন ধর্মের জীবপ্রেমের দর্শন আকবরকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই তিনি এই ধর্ম-দর্শনকে গভীরভাবে জানতে আগ্রহী হয়ে পড়েন। তােম্বর সম্প্রদায়ের জৈন ধর্মগুরু প্রায়ই সম্রাটের দরবারে আসতেন। এঁরা হচ্ছেন হীরাবিজয় সূরী, শান্তিচন্দ্র, বিজয় সেন সুরী ও ভানুচন্দ্র। এছাড়াও জৈনগুরু জিনচন্দ্র সূরীও সম্রাট আকবরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। সম্রাটের জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এঁদের কেউ কেউ দরবারে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এ এল শ্রীবাস্তব মনে করেন, শৈশব থেকেই আকবর জৈন প্রচারকদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। জৈনদের মূল অবস্থান ছিল রাজস্থান। এঁদের সাহচর্যে এসে আকবর মাংসভােজন প্রায় বন্ধ করে দেন। খাঁচায় বন্দি পাখি ও জেলে বন্দি কয়েদিদের মুক্ত করে দেন। সম্রাট জৈনদের ‘পর্যসনা’ উৎসবের দিন প্রাণী হত্যা বন্ধের নির্দেশ দেন। এছাড়াও আকবর ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর এক আদেশ জারির মাধ্যমে গুজরাটের শাসনকর্তাকে নির্দেশ দেন যাতে জৈনরা নির্বিঘ্নে তাদের ধর্ম পালন করতে পারে। আকবর হীরা বিজয় সুরীকে রাজদরবারে বিশেষ সম্মানের আসন দিয়েছিলেন। জৈনগুরু শান্তিচন্দ্র ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুঘল দরবারে অবস্থান করেছিলেন। ভানুচন্দ্র সম্রাটকে সূর্যোপাসনার মন্ত্রপাঠ শিখিয়েছিলেন।
এই আলােচনা থেকে প্রতিভাত হয় যে, আকবর জৈন শিক্ষায় বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু এতে করে আকবর জৈন ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন এ ধরনের ধারণা করা অনৈতিহাসিক সিদ্ধান্ত হবে। তবে এ এল শ্রীবাস্তবের এই সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করা যায় যে, খ্রিস্টধর্মের চেয়ে জৈন ধর্ম আকবরকে বেশি আলােড়িত করেছিল।
সুরাটে অবস্থানকারী জরথুস্ট্র ধর্মগুরুর ধর্মও সম্রাট আকবরের মনে রেখাপাথ করেছিল। স্মিথেরও ধারণা, জরথুস্ট্রবাদীদের অগ্নি উপাসনা আকবরকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। সুরাটে অবস্থানকারী জরথুস্ত্র ধর্মগুরু দস্তর পাইরজী রাণার সঙ্গে সম্রাট আকবরের পরিচয় ঘটেছিল। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট তাঁকে দরবারে আমন্ত্রণ জানান। তিনি সম্রাটকে জরথুস্ত্র ধর্মের কিছু আচার পালন করতে নিদের্শ করেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে সূর্যেপাসনা করতেন। এমনকি সম্রাট ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে সূর্য ও অগ্নিদেবতার সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার রীতি গ্রহণ করেন। পারসীয় রীতি অনুযায়ী প্রাসাদে তিনি যজ্ঞাগ্নি প্রজ্বলনের ব্যবস্থা করেন। সান্ধ্যপ্রদীপ জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে দরবারে উপস্থিত সকলকে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হতাে। পারসীয় পঞ্জিকা অনুসারে তিনি কিছু পারসীয় উৎসব পালনেরও ব্যবস্থা করেন। এ সময় জরথুস্ত্র প্রভাবিত সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে একটি অনৈসলামিক আচরণের অভিযােগ এনেছিলেন বাদাউনি। তিনি বলেন, সম্রাটের আদেশক্রমে মৃতদেহকে পূর্বদিকে অর্থাৎ সূর্যোদয়ের দিকে মাথা রেখে কবর দিতে হতাে। সম্রাট নিজেও এভাবে শয়ন করতেন।
জরথুস্ট্রবাদের প্রতি সম্রাট আকবরের অনুরক্তি কিংবা খ্রিস্টধর্ম বা জৈনধর্মের প্রতি অনুরক্তি বিচ্ছিন্ন কোনাে ঘটনা নয়। তাই এসব উদাহরণে মনে করার কারণ নেই যে, তিনি পৈতৃক ধর্ম থেকে সরে এসেছিলেন। এগুলি ছিল তাঁর উদার ধর্মচিন্তারই প্রতিফলন।
শিখ ধর্মের প্রতিও সম্রাট আকবরের অনুরক্তি লক্ষ করা যায়। সম্রাট শিখ ধর্মগুরু অমরদাসের (১৫৫২-১৫৭৪) সাক্ষাৎ গ্রহণ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, এই ধর্মগুর অনুরােধেই আকবর ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তীর্থকর রহিত করেছিলেন। পরবর্তী শিখ ধর্মগুরু রামদাসও সম্রাটের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তারা সম্রাটের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। আকবর রামদাসকে একটি জায়গীর দান করেন। এখানে তিনি একটি সরােবর খনন করেন। এর নাম দেন অমৃতসর। এই অমৃতসরই কালক্রমে শিখধর্মের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরবর্তী ধর্মগুরু অর্জুন (১৫৮১-১৬০৬) শিখ ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহিব সম্পাদনা করেন। আকবর এই গ্রন্থকে শ্রদ্ধার সঙ্গে সংরক্ষণ করেছিলেন।
(৫)
হিন্দুদের প্রতি সম্রাট আকবরের উদারনীতিকে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক সম্রাটের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণােদিত বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু সম্রাট আকবরের চরিত্র ও আদর্শ বিশ্লেষণ করলে এরূপ মন্তব্য গ্রহণ করা যায় না। বিভিন্ন ধর্মের প্রতি সম্রাটের কৌতূহল দেখে অনুমান করা সহজ যে, তিনি জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে থেকে মানবতার ধর্মকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। সম্রাট আকবরের জীবনচরিতকার আবুল ফজলও অসংকোচেই সম্রাট আকবরের ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের প্রশংসা করেছেন। আকবর বিশ্বাস করতেন চারটি গুণের সমাবেশ না ঘটলে প্রকৃত শাসক হওয়া যায় না। এই গুণ চারটি হচ্ছে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রজার প্রতি অভিভাবকের আচরণ করা, ছােট-বড় সকলের আকাঙ্খা চরিতার্থ করতে হবে অন্তরের বিশালতা দ্বারা, নিয়মিত প্রার্থনা ও ভক্তি দ্বারা জগদীধরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে একজন নৃপতিকে। এই সব নীতি ও আদর্শ নিয়েই সম্রাট আকবরের পরমত সহিষ্ণুতার (‘সুল-ই-কুল’) নীতি গড়ে উঠেছিল। আর এই নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল আকবর হিন্দুদের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
এই ‘সুল-ই-কুল’ নীতির অনুসারী হিসাবে আকবর হিন্দু-মুসলমান, বিজিত-বিজেতাদের মধ্যে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। ১০০০ হিজরীতে (১৫৯১-৯২) পয়গম্বর হজরত মােহাম্মদের (সঃ) মক্কা থেকে মদীনা যাত্রা এক হাজার বছর পূর্ণ হচ্ছিল। এই উপলক্ষে আকবর এক ‘সহস্র বর্ষের ইতিহাস’ (তারিখ আলফি) প্রণয়নের ব্যবস্থা করেন। ১৫৯২-র ১১ মার্চ সম্রাট আকবরের ৩৭তম রাজ্যবর্ষ শুরু হয়। সেই বছর সহস্রাব্দ উপলক্ষে নতুন মুদ্রা চালু হয়। ১০০২ হিজরীতে (১৫৯৩-৯৪) আকবর কয়েকটি আদেশ জারি করেন, তা থেকে বােঝা যায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা তিনি কতখানি স্মরণে রাখতেন—
১. শৈশবে অথবা অন্য কোনােভাবে কোনাে হিন্দুকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুসলমান করা হলে, যদি সে তার পিতা-পিতামহের ধর্মে প্রত্যাবৃত্ত হতে চায়, তাহলে তা অনুমােদনগ্রাহ্য।
২. ধর্মের কারণে কোনাে ব্যক্তির প্রতিবন্ধকতা করা যাবে না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার ইচ্ছানুসারে যে কোনাে ধর্ম অবলম্বন করতে পারে।
৩. যদি কোনাে হিন্দু মহিলা কোনাে মুসলমানকে ভালােবাসে মুসলমান হয়ে যায়, তাহলে তাকে তার পতির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে।
৪. যদি কোনাে অ-মুসলিম নিজের গির্জা, ইহুদি ধর্ম-মন্দির, দেবালয় কিংবা পারসি সমাধি নির্মাণ করতে চায়, তাহলে তাতে কেউ বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না।২৯
পাশাপাশি আকবর হিন্দু যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাসে পরিণত করার প্রথা বন্ধ করে দেন। হিন্দু যুদ্ধবন্দীদের বলপ্রয়ােগে ধর্মান্তরিত করার বিরুদ্ধেও তিনি সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। হিন্দুদের প্রতি সম্রাট আকবরের এই উদার চিন্তা সাম্রাজ্যকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
আকবর হিন্দু রমণী বিয়ে করে ভারতে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। তিনি বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট রাজপুতকে সাম্রাজ্যের উচ্চপদ দান করেন। হিন্দুদের সংস্পর্শে এসে আকবর হিন্দু ধর্মের তত্ত্ব ও শাস্ত্র সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করতে পেরেছিলেন। হিন্দু ধর্মগুরু পুরুষােত্তম ও দেবী তাকে হিন্দু ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দিয়েছিলেন। সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা পােষণকারী আকবর বিষু, ইন্দ্র, মহাদেব প্রমুখ দেবতার প্রতি প্রণতি জানাতেন। তিনি হিন্দুদের কর্মবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। সম্রাটের দৈনন্দিন জীবনাচরণে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। তিনি রাখীবন্ধন, দশহরা, দীপাবলী ও বসন্তোৎসব পালন করতেন। হিন্দুদের মতাে তিনি কপালে তিলক চিহ্ন আঁকতেন বলেও জানা যায়। শিবরাত্রিতে তিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের নিমন্ত্রণ করতেন। তিনি সংস্কৃত ভাষা থেকে সূর্যের এক হাজার এক নাম সংগ্রহ করে প্রতি প্রত্যুষে সূর্যের দিকে তাকিয়ে তা যপ করতেন। বিভিন্ন সময় তিনি হিন্দু পােশাক পরতেন। গাে-হত্যাকেও তিনি নিরুৎসাহিত করেছিলেন। সমালােচনার দৃষ্টিতে বাদাউনি উল্লেখ করেছেন, হারেমে হিন্দু বেগম ও বাইরে হিন্দু বন্ধুদের খুশি করার জন্য আকবর পিঁয়াজ ও রসুন খাওয়া পরিত্যাগ করেছিলেন। হিন্দুদের মতাে সম্রাট গঙ্গাজলকে পবিত্র জ্ঞান করতেন। হিন্দু স্ত্রীদের সঙ্গে তিনি হােম ও যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতেন বলে জানা যায়। মায়ের মৃত্যুর পর তিনি মস্তক মুণ্ডন করেছিলেন এবং শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলেন। এসব কারণে অনেক ব্রাহ্মণ আকবরকে ‘জগদ্গুরু’ এবং রাম-কৃষ্ণের অবতার বলে বর্ণনা করেছেন।
(৬)
১৫৭৯-র ২ সেপ্টেম্বর আবুল ফজলের পিতা শেখ মােবারক রচিত বহু বিতর্কিত ‘মহজরনামা’ নামক ঘােষণাপত্র৩০ জারি করে আকবর উলেমাদের ধর্মনৈতিক অধিকার সম্পূর্ণ খর্ব করেন এবং তিনি নিজে রাষ্ট্র ও ধর্মের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার চূড়ান্ত (মতা অর্জন করেন। আকবর সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ ভি এ স্মিথ দাবি করেছেন যে, ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া এই দলিল ছিল ‘চির অভ্রান্ত বলে স্বীকৃতি দেওয়ার বিধান। কিন্তু একথা ঠিক নয় বলে মনে করেন ঐতিহাসিক স্মিথ।৩১ ঐতিহাসিক এ এল শ্রীবাস্তব তাঁর গ্রন্থে৩২ সম্রাট আকবরের ‘মহজরনামা’কে ‘অভ্রান্ত কর্তৃত্বের দলিল’ বলে মনে করেন না। এর দ্বারা আকবরকে ‘সম্রাট’ ও ‘পােপ’ বলাও যুক্তিহীন। এ এল শ্রীবাস্তবের মতে, এর দ্বারা আকবর শুধুমাত্র উলেমাদের সংকীর্ণতাকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন। এসব বিবেচনা করেই অধ্যাপক শ্রীরাম শর্মা বলেছেন যে, সম্রাট আকবরের ক্ষমতা প্রকৃতপথে ইংল্যান্ডের প্রিভি-কাউন্সিলের মতাে ছিল। এই ঘােষণার দ্বারা আকবর একমাত্র ইসলাম ধর্মের উপরই কর্তৃত্বের অধিকারী হয়েছিলেন।৩৩ অন্য কোনাে ধর্মের উপর সম্রাট আকবরের এই কর্তৃত্ব ছিল না। উপরন্তু আকবর কখনও নিজেকে ‘প্রফেট’ বলে দাবি করেননি। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, ইসলাম ধর্মের মধ্যে যে অনৈক্য বিরাজ করছিল, তা দূর করে জাতীয় সংহতির ভিত মজবুত করা। আর পি ত্রিপাঠী তার গ্রন্থে৩৪ লিখেছেন, শিয়া সুন্নী ও মাহদী প্রভৃতি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সূচনা হয়েছিল, তাতে রাষ্ট্রের সংহতি বিপন্ন হতে চলেছিল। এই অবস্থায় সম্রাট আকবরের মতাে বিচক্ষণ রাষ্ট্রনীতিক এই ধর্মীয় বিরােধ থেকে দূরে থাকতে পারেননি। তাই ধর্মীয় ক্ষেত্রে নিজে ক্ষমতা গ্রহণ করে ধর্মীয় অনৈক্য দূরীভূত করে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের ভিত্তি রচনা করতে চেয়েছিলেন। ‘মহজর’ ঘােষণার দ্বারা আকবর খলিফার কর্তৃত্ব অস্বীকার করে জাতীয় রাষ্ট্রের সূচনা করেছিলেন বলা যায়। কিন্তু এম মুজিব মনে করেন, যেহেতু আকবর ধর্মীয় ব্যাপারে সুশিক্ষিত ছিলেন না, সেহেতু ধর্মীয় ব্যাপারে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিজহাতে গ্রহণ করে ভুল সিদ্ধান্ত নেন।
‘তবকত-ই-আকবরী’ও ‘মুন্তাখাব-উৎ-তারিখ’ গ্রন্থ দুটির পাঠ বিশ্লেষণ করে খ্যাতিমান গবেষক ইকতিদার আলম দেখিয়েছেন যে, ভারতের গোঁড়া মুসলমানদের একমাত্র প্রধান হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার যে অভিলাষ আকবর পােষণ করতেন, তারই বহিঃপ্রকাশ ‘মহজরনামা।৩৫ সার্বভৌম রাজধর্মের যে তত্ত্বটি পরবর্তীকালে সরকারী অনুমােদন পেয়েছিল, তার সঙ্গে এর কোনাে সম্পর্কই নেই। আবুল ফজলের মতে, ‘মহজর’-এর ঘােষণা অনুযায়ী রাজা হলেন একজন বিচারকমাত্র—শুধু ইসলাম ধর্মে নয়, অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রেও। প্রকৃতপক্ষ আবুল ফজল ‘মহজর’ নিয়ে আলােচনা করতে অস্বস্তিবােধ করেছেন অথচ এটাই ছিল মুসলমান অভিমতকে শান্ত রাখা ও স্বপথে আনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সুতরাং ভারতীয় মুসলমানদের উন্নতি ও মৈত্রী সম্পর্কে সম্রাট আকবরের সাধারণ মনােভাবের প্রেক্ষাপট দেখলে তবেই ‘মহজর’-এর তাৎপর্য বুঝতে পারা যাবে। আকবর দেখাতে চেয়েছিলেন যে, মুসলমান প্রজাদের সুখ ও দুঃখের তিনিও একজন অংশীদার। আজমীর শরিফ-এ খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি (রহঃ) এর মাজারে ভক্তি নিবেদন, সেলিম চিস্তির সঙ্গে তার সম্বন্ধ, সনাতনপন্থীদের যারা কুনজরে ছিল তাদের প্রতি শত্রুতা পােষণ—এসবই সম্রাট আকবরের মুসলমান সনাতন পন্থায় আস্থাভাজন হওয়ার তীব্র বাসনা বলা যায়। অবশ্য সম্রাট আকবরের শাসনের এই পর্বটি শেষ হয়েছিল ১৫৮০ খ্রীস্টাব্দে। ১৫৮০ খ্রীস্টাব্দের বিদ্রোহ সম্রাট আকবরের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এই নীতি তুরানি ও পার্শী অভিজাতদের প্রভাবিত করতে পারেনি, তারাই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল। কারণ, ‘দাগ’ নামক রাজস্ব আদায়ের নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন ও অন্যান্য প্রশাসনিক সংস্কার তাদেরই স্বার্থে আঘাত দিয়েছিল। তাছাড়া উদ্বেগজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৫৮০ খ্রীস্টাব্দে দ্বিতীয়বার ‘জিজিয়া’ রদ করতে হয়েছিল।৩৬ পূর্ব-ভারতের অনেক ঘটনা থেকেও এটা স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আগের ১৩ বছরের অনমনীয়ভাবে অনুসৃত নীতি ব্যর্থ। আসলে এভাবে ‘বাদশা-ই-ইসলাম’ হিসেবে সম্রাট আকবরের ভাবমূর্তি গড়ে তােলার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ইকতিদার আলম খান লিখেছেন, “এটি (মহজর) সম্রাট আকবরের হাত শক্ত করতে তাে পারেই নি, উপরন্তু সার্বভৌমত্বের ধর্মশাস্ত্রীয় অনুমােদন খুঁজতে গিয়ে একটি অতীব সংবেদনশীল বিষয়কে পুনরুস্থাপন করেছে। এটা উল্লেখযােগ্য যে, সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে কুফর-এর ফতােয়া জারি হয়েছিল মহজর স্বাক্ষরিত হবার পরেই। বােঝা যায় যে, আকবর অল্পদিনের মধ্যেই বুঝেছিলেন ‘মহজর’ জারি করে কী ভুল করেছেন।৩৭ তাই তিনি নিঃশব্দে ‘মহজর’ ঘােষণাকে বাতিল করে দিয়েছিলেন। ‘মহজর’ ঘােষণা ব্যর্থ হলেও, এই বিপর্যয়ই আকবরকে ইসলামের নীতি প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত করেছে এবং এরপরই ধীরে ধীরে রচিত হয়েছিল ‘সুল-ই-কুল’ নামক দর্শনাশ্রয়ী এক উদার ধর্মনীতি।
(৭)
ইকতিদার আলম খান সম্রাট আকবরের ধর্মনৈতিক জীবনের বিবর্তন পর্যালােচনা করে বলেছেন, সম্রাট আকবরের ধর্মনীতির পশ্চাতে এমনকি তীর্থকর রদ বা জিজিয়া কর রদ করার মধ্যেও উদারনৈতিক মনােভাব বা বৌদ্ধিক কোনাে প্রভাব ছিল না।৩৮ তিনি যা করেছেন, রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়ােজনে করেছেন। ইকতিদার আলমের মতে, মুঘল-দরবারে রাজপুতদের যে সম্মানিত সদস্য হিসেবে আকবর প্রথম স্থান দিয়েছেন, তাও কোনাে ধর্মীয় উদারতা বা কোনাে বৌদ্ধিক প্রভাবে নয়। পুরনাে অভিজাতদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে তিনি রাজপুতদের রাজকার্যে নিয়ােগের মাধ্যমে অভিজাতদের মধ্যে একটা ভারসাম্য আনতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই আকবর রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। সম্রাট আকবরের উদারতার দৃষ্টান্ত হিসেবে আবুল ফজল বলেছেন যে, ১৫৬৪ সালে আকবর কর্তৃক জিজিয়া রদ করা হয়, অথচ বাদাউনির মতে, জিজিয়া রদ৩৯ করা হয়েছিল ১৫৭৯ সালে।৪০ তার মতে, উজবেক বিদ্রোহ দমনের পরই আকবর রাজপুতদের বলপূর্বক বশে রাখার নীতি গ্রহণ করেন। এরই সঙ্গে তার ধর্মনীতিতেও পরিবর্তন দেখা যায়। তখন থেকেই তিনি গোঁড়া মুসলমান মানসিকতাকে খুশি করার চেষ্টা করতে থাকেন। কারণ, ১৫৬৮ খ্রীস্টাব্দের ৯ মার্চ চিতাের দখলের সময় আকবর প্রকাশ্যে চিতােরের পতনকে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে ইসলামের জয় বলে ঘােষণা করেন।৪১ ইতিদার আলম এও উল্লেখ করেছেন যে, চিতাের জয়ের খবর দিয়ে পাঞ্জাবের অফিসারদের কাছে যে ফতেনামা’ পাঠানাে হয়েছিল, তা কোনাে একজন গোঁড়া মুসলমান শাসকের অসহনশীল ধর্মবির্বাস ও ভাবাবেগপূর্ণ আদেশনামার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।৪২ এমনকি সম্রাট আকবরের এক ফরমান আছে— ‘বিলগ্রামের মুহতাসিব’ কাজি আবদুস সামাদকে ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, সেখানকার হিন্দুদের মূর্তিপূজা থেকে বিরত রাখতে। এই নীতিরই চূড়ান্ত পরিণতি ১৫৭৫ খ্রীস্টাব্দে “জিজিয়া’র পুনর্বহাল।৪৩
যাই হােক, ‘দীন-ই-ইলাহী’ প্রবর্তনের পেছনে সম্রাট আকবরের কেবলমাত্র সর্বধর্মসমন্বয়ের তাগিদই ছিল না। এর একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। আকবর চেয়েছিলেন ভারতের মতাে একটি দেশেই যেখানে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শাসকশ্রেণি মুসলিম এবং যেখানে উভয় ধর্মের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষের সম্ভাবনা প্রজাগণের ঐক্য বিপন্ন করতে পারে, তার শাসন যাতে সর্বজনগ্রাহ্য হয়, তার ব্যবস্থা করতে। “এই সময়ের ভারতবর্ষে বিরাজমান বহু সাংস্কৃতিক ও অগণিত ধর্মবিধাসকে আকবর চেষ্টা করেছিলেন একটি সংঘবদ্ধ শাসক শ্রেণির নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসতে।”৪৪ এই প্রচেষ্টায় তিনি কতদূর সফল হয়েছিলেন, সেই প্রশ্ন স্বতন্ত্র। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য যে মহৎ ছিল, এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। এই দৃষ্টিকোণে বিচার করলে ‘দীন-ই-ইলাহী’কে ‘সম্রাট আকবরের বুদ্ধিহীনতার প্রধান স্তম্ভ’ বলে অভিহিত করা অযৌক্তিক। আকবর নিজেকে কেবলমাত্র জনগণের রাজনৈতিক নেতা বলেই মনে করতেন না তিনি তার প্রজাদের পুত্রবৎ বলে মনে করতেন। তাই তিনি তাদের ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনেরও অভিভাবকত্ব দাবি করতেন। ‘দীন-ই-ইলাহী’ ছিল বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক। সম্রাট আকবরের উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হয়নি। জনসাধারণের মনে কোনাে আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি বলে সম্রাট আকবরের নতুন ধর্মমত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তিনি বুঝতে পারেননি যে, ধর্মীয় সংকীর্ণতার মূল এত গভীরভাবে প্রােথিত। এই দিক দিয়ে বিচার করলে বােধহয় ‘দীন-ই-ইলাহী’ তার বিজ্ঞতার পরিচায়ক ছিল না।
সম্রাট আকবরের লক্ষ ছিল ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও জাতিগােষ্ঠীর অভিজাতদের মধ্য থেকে সমসত্ত্ব একটি শ্রেণির উদ্ভব। সম্রাট আকবরের ধর্মনীতির পিছনে এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কতটুকু কার্যকরী ছিল, তা নিয়ে অবশ্য প্রগ্ন তােলা যেতে পারে। ১৫৯৫ সালে সম্রাটের পুত্র ও পৌত্র ছাড়া মােট মনসবদারের সংখ্যা ২৮০ জন, যার মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৬ জন। ৫,০০০ ও তার বেশি ৮ জন মনসবদারের মধ্যে হিন্দু ছিল মাত্র একজন।৪৫ আসলে সম্রাট আকবরের ধর্মনীতির পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের চেয়ে তার নিজস্ব ধর্মচিন্তা অধিকতর সক্রিয় ছিল বলে মনে হয়। তাই আতাহার আলি তাকে ধর্মনিরপেক্ষ তার অগ্রদূত হিসাবে স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক। তিনি লিখেছেন,
“মুঘল সাম্রাজ্যের জন্যে আকবর একটি ধর্মীয় নীতি নির্ধারণ করেছিলেন যেজন্য আধুনিক ভারতীয় সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ তার দিক থেকে কিছু অর্থে তাকে অগ্রদূত হিসেবে দাবি করা হয়—এই ধারণা প্রায় এক ঐতিহাসিক ‘ক্লিশে’। বিদ্যালয় পাঠ্যপুস্তকের এই যে আপ্তবাক্য তিনি একটি নতুন ধর্মের প্রবর্তক পণ্ডিতমন্য ঐতিহাসিকরা অনেকদিন ধরেই এই ভাবনার মূল-উচ্ছেদের চেষ্টা করেছেন কিন্তু খুব বেশি সফল হননি।”৪৬
তথ্যসূত্রঃ
- ১. দ্য ইন্ডিয়ান রিভিউ, আগস্ট ১৯২৯।
- ২. ইবাদতখানা’ সংক্রান্ত বিস্তারিত খবর ও আলােচনার জন্য দেখুন- নিজামউদ্দিন আহমদ তবকত-ই-আকবরী, ইলিয়ট ও ডওসন, হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া অ্যাজ টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টরিয়ান, খণ্ড-৫, পৃ. ৯০-৯১। আবদুল কাদের বাদাউনি মুনতাখাব-উৎ-তারিখ, ইলিয়ট ও ডওসন, প্রাগুক্ত, খণ্ড-৫, পৃ. ৫১৭-১৯। আবুল ফজল আকবরনামা, ইলিয়ট ও ডওসন, প্রাগুক্ত, খণ্ড-৬, পৃ. ৫৯-৬০।
- ৩. জেসুইট লেখক বারতুলি সম্রাট আকবরের রাজনৈতিক ধর্মমত ‘দীন-ই-ইলাহী’ ঘােষণার পূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন। (দেখুন-ভি এ স্মিথ, আকবর—দ্য গ্রেট মুঘল, পুনর্মুদ্রণ, দিল্লি, ১৯৫৮, পৃ. ২০৯)। শ্রীরাম শর্মা তার ‘দ্য রিলিজিয়াস পলিসি অফ দ্য মুঘল এম্পাররস’ গ্রন্থে (এশিয়া পাবলিশিং হাউস, বম্বে, ১৯৬২, ২য় সংস্করণ) আকবর ‘দীন-ই-ইলাহী’ নামে নতুন একটি ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বলে প্রচলিত তত্ত্বটিকে একেবারেই খারিজ করে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে এই ‘দীন-ই-ইলাহী’ শব্দটি বার বার ব্যবহার করেছেন। সেটি বিরক্তিকর, কারণ দীন-ই-ইলাহী’ শব্দটি পরবর্তীকালে উদ্ভাবিত হয়েছিল। আবদুল কাদের বাদাউনির লেখায় অস্পষ্টভাবে ছাড়া সম্রাট আকবরের সময়ের কোনাে গুরুত্বপূর্ণ রচনাতেই শব্দটির হদিস পাওয়া যায় না। সরকারি নাম ‘তওহিদ-ই-ইলাহী’ ছিল কিনা তারও কোনাে সন্ধান পাওয়া যায় না। সরকারি মুখপাত্র আবুল ফজলের কাছে শব্দ দুটিই অপরিচিত ছিল বলে মনে হয়। (আতাহার আলি, মুঘল সম্রাটদের ধর্মনীতি, অন্তর্ভুত- ইরফান হাবিব সম্পাদিত, মধ্যকালীন ভারত, খণ্ড-২, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ২০০৯, পৃ. ১৬১)। আসলে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সভাসদ ছাড়া অধিকাংশ মানুষই ‘দীন-ই-ইলাহী’র নামই শােনেননি। ভি এস স্মিথ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১০-১৫। আরও দেখুন- এস এ এ রিজভি, রিলিজিয়াস অ্যান্ড ইনটেলেকচুয়াল হিস্টরি অফ দ্য মুসলিমস ইন আকবরস রেন, দিল্লি, ১৯৭৫, পৃ. ৩৭৪-৪১৮।
- ৫. দেখুন-রাহুল সাংকৃত্যায়ন, আকবর, বাংলা অনুবাদ-আসরফ চৌধুরী, চিরায়ত প্রকাশন, দ্বিতীয় মুদ্রণ, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ২৬২। আরও দেখুন-আবদুল কাদের বাদাউনি, মুন্তাখাব-উত-তারিখ, খণ্ড-২, এইচ লােয়ে অনূদিত, কলকাতা, ১৯২৫, পৃ. ৩১৪।
- ৬. ‘দীন-ই-ইলাহী’ নামক এই নতুন ধর্মে যেসব আমির যােগ দিয়েছিলেন তাদের কয়েকজন হলেন—শেখ মােবারক (নাগৌরী), আবুল ফজল (খলিফা), ফৈজী (কবিরাজ), জাফর বেগ, আসফ খান (কবি), কাসিম কাবুলী (কবি), আব্দুস সামাদ (চিত্রকর, কবি), আজম খান, শাহ মুহম্মদ শাহাবাদী (ঐতিহাসিক), সুফি আহমদ, সদর জাহাঁ (মহা মুফতি), সদর জাহাঁর দুই পুত্র, মীর শরিফ আমলী, সুলতান খাজা সদর, মির্জা জানী (হাকিম ঠাট্ঠা), নকী সুস্তরী (কবি), শেখজাদা গােসালা (বানারসী), রাজা বীরবল।
- ৭. ভি এ স্মিথ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১।
- ৮. ভি এ স্মিথ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২১-২২।
- ৯. ভি এ স্মিথ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৮।
- ১০. আবুল ফজল, আকবরনামা, খণ্ড-১, হেনরি বেভারিজ অনূদিত, কলকাতা, ১৮২১, পৃ. ২০৯।
- ১১. ভি এ স্মিথ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৫-১৬।
- ১২. ভি এ স্মিথ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৬।
- ১৩. সি এইচ পেনে অনূদিত ও সম্পাদিত, আকবর অ্যান্ড দ্য জেসুইটস, লন্ডন, ১৯২৬, পৃ. ৬৭। আরও দেখুন-শ্রীরাম শর্মা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬।
- ১৪. সি এইচ পেনে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৮।
- ১৫. সি এইচ পেনে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৮।
- ১৬. দেখুন-রাহুল সাংকৃত্যায়ন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৬-৫৭
- ১৭. খাজা নিয়ামতউল্লাহ, তারিখ-ই-খানজাহানি, এস এম ইমামউদ্দিন সম্পাদিত, ঢাকা, ১৯৬০, পৃ. ৬৬৮।
- ১৮. সৈয়দ আহমদ সিরহিন্দি, মাকতুবাতে ইমাম রাব্বানি, খণ্ড-১, পত্র নং-৭৪।
- ১৯. দেখুন-আতাহার আলি, সুলহ-ই-কুল এবং সম্রাট আকবরের ধর্মীয় ভাবনা, অন্তর্ভুক্ত ইরফান হাবিব সম্পাদিত, মধ্যকালীন ভারত, খণ্ড-৩, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ৯২।
- ২০. মহম্মদ সাদিক, তবকৎ-ই-শাহজাহানী, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রহ, সংখ্যা-২২৬, পৃষ্ঠাঙ্ক-৪৫১ ও ৪২১।
- ২১. আতাহার আলি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৩।
- ২২. দেখুন- রাহুল সাংকৃত্যায়ন, আকবর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৪
- ২৩. দেখুন- রাহুল সাংকৃত্যায়ন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৪
- ২৪. Burhan Ahmad Faruqi, Mujaddid’s Conception of Tawhid, 2nd edition, Lahore, 1943, P. 12-14.
- ২৫. আতাহার আলি, সুলহ-ই-কুল এবং সম্রাট আকবরের ধর্মীয় ভাবনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯১
- ২৬. জাহাঙ্গীর তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী, এ রজার্স ও হেনরি বেভারিজ অনূদিত, খণ্ড-১, পৃ. ৩৭।
- ২৭. ইলিয়ট ও ডওসন, প্রাগুক্ত, খণ্ড-৬, পৃ. ৩৮৯। আরও দেখুন- এ কে এম আবদুল আলিম, ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস, মাওলা ব্রাদার্স, অষ্টম মুদ্রণ, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ২২৩, পাদটীকা।
- ২৮. আতাহার আলি, সুলহ-ই-কুল এবং সম্রাট আকবরের ধর্মীয় ভাবনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৩।
- ২৯. দেখুন-রাহুল সাংকৃত্যায়ন, প্রাগুক্ত, ২৫৫।
- ৩০. ‘মহজর নামা’ ঘােষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন শেখ মােবারক এবং তার পুত্রদের নির্দেশ ও পরিচালনাতে তখনকার প্রধান আলেমবৃন্দ। এই ঘােষণার মূল বক্তব্য ‘তবকত-ই-আকবরী’ ও ‘মুন্তাখাব-উৎ-তারিখ’ গ্রন্থে সংরথিত আছে। (দেখুন ভি এ স্মিথ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৮-৭৯)।
- ৩১. ভি এ স্মিথ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৮-৮১। আরও দেখুন- এস এ এ রিজভি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৪১-৬০।
- ৩২. এ এল শ্রীবাস্তব, দ্য মুঘল এম্পায়ার, দ্বিতীয় পরিমার্জিত সংস্করণ, আগ্রা, ১৯৫৭
- ৩৩. শ্রীরাম শর্মা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭।
- ৩৪. আর পি ত্রিপাঠি, রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার, এলাহাবাদ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৬০।
- ৩৫. দেখুন- নিজামউদ্দিন আহমদ তবকৎ-ই-আকবরী, বি কে দে সম্পাদিত, খণ্ড-২, বিবলিওথেকা ইন্ডিকা, কলকাতা, ১৯১৩, পৃ. ৩৪৫-৪৬। আবদুল কাদের বাদাউনি মুন্তাখাব-উৎ-তারিখ, আহমদ আলি ও লিজ সম্পাদিত, খণ্ড-২, বিবলিওথেকা ইন্ডিকা, কলকাতা, ১৮৬৪, পৃ. ২৭ ২। আরও দেখুন- সৈয়দ নুল হাসান, দ্য মহজর অফ আকবরস রেন, জার্নাল অফ উত্তরপ্রদেশ হিস্টরিক্যাল সােসাইটি, খণ্ড-১৬, প্রথম ভাগ, পৃ. ১২৬। আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন- ইকতিদার আলম খানের প্রবন্ধ- সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে অভিজাত শ্রেণি ও তার ধর্মনীতির পরিবর্তন, অন্তর্ভুক্ত- ইরফান হাবিব সম্পাদিত, মধ্যকালীন ভারত, খণ্ড-২, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা ২০০৯, পৃ. ৮০।
- ৩৬. আবুল ফজল আকবরনামা, খণ্ড-২, বিবলিওথেকা ইন্ডিকা, কলকাতা, পৃ. ২৭৮।
- ৩৭. ইকতিদার আলম খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮১।
- ৩৮. ইকতিদার আলম খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৮।
- ৩৯. উল্লেখ্য যে, আকবর প্রত্যেক অমুসলমানকেও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অস্ত্র ধারণে বাধ্যতামুলক আইন করেছিলেন। সুতরাং সেখানে জিজিয়া কর নেওয়া কোনােমতেই চলে না। জিজিয়া ছিল একটি সামরিক কর মাত্র। যে সমস্ত সবল অমুসলিম নাগরিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন না কেবলমাত্র তাদের এই কর দিতে হত।
- ৪০. দেখুন-আবদুল কাদের বাদাউনি, অন্তর্ভুক্ত-ইলিয়ট ও ডওসন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৬। আরও দেখুন-কেমব্রিজ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-৪, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯২৮, পৃ. ৮৭।
- ৪১. ইকতিদার আলম খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৯।
- ৪২. ইকতিদার আলম খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৯।
- ৪৩. আবদুল কাদের বাদাউনি মুন্তাখাব-উৎ-তারিখ, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১০। বাদাউনি লিখেছেন, “ঐ সময়ে (৯৮৩ হিজরি) শেখ আবদুন নবী ও মখদুম-উল-মুলককে (সম্রাট) নির্দেশ দেন তদন্ত করতে করতে এবং হিন্দুদের ওপর জিজিয়া বসাতে। সর্বত্র এই মর্মে ফরমান পাঠানাে হল। কিন্তু জলের ওপর চিত্রাঙ্কন যেমন অতি দ্রুত অদৃশ্য হয়, ঐ আদেশও সেভাবে বিস্মৃত হয়েছিল।” স্তবকটির লােয়ে-কৃত অনুবাদ (খণ্ড-২, পৃ. ২১৩) ত্রুটিযুক্ত। তিনি “জিজিয়া’ শব্দটি বাদ দিয়েছেন।
- ৪৪. আতাহার আলি, সুলহ-ই-কুল এবং সম্রাট আকবরের ধর্মীয় ভাবনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৫।
- ৪৫. আতাহার আলি, সুলহ-ই-কুল এবং সম্রাট আকবরের ধর্মীয় ভাবনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯০।
- ৪৬. আতাহার আলি, সুলহ-ই-কুল এবং সম্রাট আকবরের ধর্মীয় ভাবনা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮২।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।