রিচার্ড এম ইটন প্রধানত গ্রাম বাংলার বদ্বীপ এলাকায় ইসলাম কি রূপে ছড়িয়ে পড়েছিল তার একটা রূপ রেখা দেন। তাঁর মতে মুঘল আমলে, যে কোন কারণেই হোক, কোনসময়ই ধর্মপ্রচারে উৎসাহ দেওয়া হয়নি। ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল মুঘলদের ভূমিনীতির ফলে। বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তখনও ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রবেশ করেনি। শিথিল অন্ত্যজ ধর্মীয় পরিমন্ডলে বিদেশাগত পীর, ফকির, দরবেশদের জায়গীর দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এঁরাই অন্ত্যজ মানুষ-জনদের নিয়ে জঙ্গল কাটিয়ে বসত স্থাপন করে চাষাবাদ শুরু করতেন। এঁরাই ছিলেন শিক্ষক, চিকিৎসক, আধ্যাত্মিক গুরু। এঁরাই সেবা ও সহমর্মিতা দিয়ে মানবতার নতুন সংজ্ঞা নিরূপণ করেন; অস্ত্রের ঝনঝনানি দূর অস্ত, চোখ রাঙানিও এঁদের অভিধানে ছিল না। এঁদেরই বংশধরেরা পরবর্তীতে বাংলার মুসলিম বনেদি, অভিজাতগোষ্ঠী তৈরী করে।
এই অভিজাতগোষ্ঠীই দেশভাগের সময় পশ্চিমবাংলা ছেড়ে পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশ চলে যায় । আমি এমন কয়েকটি পরিবারের কথা বলব যাঁদের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। এমন কয়েকটি এলাকাও দেখেছি যেখানে পীরের মাযার রয়েছে এক্কেবারে জঙ্গলের সন্নিকটে এবং এখনও পর্যন্ত মাযার কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিমের মহা মিলন হয়। যে সকল পরিবারের কথা বলব তাদের এক অংশ বা বৃহদংশ বাংলাদেশ চলে গেছে এবং এখানে রয়ে গেছে তাদের আত্মীয়স্বজন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রখ্যাত পীর পরিবার, এক বাঙালি মুসলিম বৈজ্ঞানিক ও বাংলাদেশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের এপারে পড়ে থাকা নিকট আত্মীয়রা। অবশ্যই বাংলাদেশ চলে যাওয়া আত্মীয়স্বজন বহু বেশি স্বচ্ছল, শিক্ষায় অগ্রসর ও ইসলাম সচেতন। এঁরা কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আওড়ান..হুমায়ুন আহমেদ ও সুনিল গঙ্গোপাধ্যায়ের পার্থক্য করেন না। বাংলাদেশের নাটক নিয়ে গর্ববোধ করেন। অর্থনৈতিক অধঃপতনের ফলে পশ্চিমবঙ্গীয় অংশের মানুষগুলির সংস্কৃতি, পরিবেশ, গাত্রবর্ণ সবকিছুর পরিবর্তন বেশ চোখে পড়ার মত। দেখেছি এঁদেরই প. বঙ্গের বুকে বেঁচে-বর্তে থাকা আত্মীয়স্বজনেরা অধিকাংশই জীবনযুদ্ধে এতটাই লিপ্ত যে সংস্কৃতি বলতে বোঝেন স্বস্তার চটুল হিন্দি-বাংলা গান। নাটক, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বহু দূরের মানুষ। অবশ্য বাংলাদেশের নব্য প্রজন্ম হিন্দি-বাংলা সিনেমা, সিরিয়ালের ভক্ত।
পশ্চিমবাংলার মুসলিম অভিজাতগোষ্ঠীটির সঙ্কট তৈরীর মূল কারণটি অবশ্য রুটি-রুজির সঙ্গে যুক্ত এবং এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে এই বনেদি অভিজাতগোষ্ঠীটির নৈতিক অধঃপতনও। নৈতিক অধঃপতন একটি ধারাবাহিক পদ্ধতি যা প্রথম যে ব্যক্তিটি ইসলামের মানবিকতা নিয়ে মুসলিম শাসনকালে বাংলার বুকে এসেছিলেন তাঁর সাক্ষাত বংশধর না হোক নিকট দূরত্বের বংশধরদের মধ্যেই শুরু হয়েছিল বলে মনে হয়। সাধু পুরুষটি শিক্ষার প্রসার, দাতব্য চিকিৎসা ও আধ্যাত্মিক বলে বলিয়ান হয়ে বাংলায় এসেছিলেন বলে তাঁর অনুসারীও তৈরী হয়েছিল। এই অনুসারীরা স্বাভাবিকভাবেই, তাঁর বংশধরেরা যোগ্য হোন বা না হোন, ভালবাসতো, শ্রদ্ধা করত। অনেকসময় তা তোষামোদ-তোয়াজের পর্যায়ে চলে যেত। এমন অবস্থা তৈরী হয়েছিল যা দেখে মনে হতে পারে একদল মানুষ শুধুমাত্র তোষামোদ-তোয়াজের অধিকারী, শুধুই সেবা নেবে আর একদল মানুষ শুধুই দেবে এবং ক্রিতদাসের মত আচরণ করবে। এই অবস্থা চলেছিল যতদিন পর্যন্ত এই গোষ্ঠীটি আভিজাত্যের মূল হাতিয়ার আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি ছিল।
এই আর্থিক বনিয়াদে প্রথম ধাক্কা আসে ইংরেজ শাসনের প্রারম্ভে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সান্ধ্য আইনের মাধ্যমে। জঙ্গল কেটে বসত এলাকার অধিকাংশেরই প্রকৃত দলিল-দস্তাবেজ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। এই দুটি আইনের ফাঁদে পড়ে কত যে মক্তব-মাদ্রাসা, টোল-পাঠশালা, দাতব্য চিকিতসালয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার গোণা গুনতি নেই। একইসঙ্গে বহু মানুষ রাতারাতি কপর্দকহীন হয়ে সাধারণ মানুষে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, এক ঝটকায় মহল থেকে রাস্তায় চলে এসেছিল। এদের মধ্যেও কিছু মানুষ বেঁচে-বর্তে গিযে স্বাধীনতা পর্যন্ত টিকে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর কিছু মানুষ ওপারে চলে গেলেও কিছু মানুষ জমি-জায়গা আঁকড়ে বেঁচে ছিল। এই বেঁচে-বর্তে থাকা মুষ্টিমেয় বনেদি পরিবারগুলির উপর শেষ কোপটি পড়ে বাম সরকারের ভূমি নীতির ফলে। মুসলিমদের মধ্যে জমি-জায়গা কেনার প্রবণতাটি তুলনামূলক ভাবে বেশি। বহু মুসলিম ব্যাঙ্কে টাকা রেখে সুদের খপ্পরে পড়ার থেকে জমি কেনার দিকেই বেশি ঝোঁকে।
বাম সরকারের ভূমিনীতি সাধারণ মানুষের মুখ চেয়েই তৈরী হয়েছিল। এই সংস্কার কার্যটি সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারত গ্রামের মধ্যে একটি সাধারণ নীতি ছিল বাবু বা জোতদাররা জমি চাষ না করলেও যে চাষি জমি চাষ করত সে কিন্তু চাষের বিনিময়ে বাবুর কাছ থেকে ভরণ-পোষণ পেত। ভরণ-পোষণ না পেলে গ্রামের সামাজিক স্তর বা পারস্পরিক নির্ভরশীলতাটাই ভেঙে পড়ত। ফল হত গ্রামের জৈব বাস্তুতন্ত্রটাই ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। তা কিন্তু হয়নি। হয়তো আইনের অভাবে কিছু অবিচার-অনাচার হত তা বলে জোতদার-জমিদার কিংবা কংগ্রেসিদের অত্যাচার বলে যে রকম ভয়াবহ প্রচার এখনও শোনা যায় তা কিন্তু অতিরঞ্জিত। বরং বর্তমানে গ্রামে গ্রামে রাজনীতির নামে এবং পঞ্চায়েতের অনুদানের টাকায় ভাগ বসাবার জন্যে যে লড়াই তার থেকে খারাপ অবস্থা কংগ্রেস আমলে ছিল বলে মনে হয় না। এই অবস্থা একমাত্র ইংরেজ আমল ছাড়া আর কোন সময় হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের মুসলিম অভিজাত পরিবারটি জমি-জায়গা হারিয়ে সংগঠিত বিরোধিতার কাছে হার মেনে মরমে মরেছে নয়তো গ্রাম ছাড়া হয়েছে।
[২]
বাম সরকার দলতন্ত্র কায়েমের উদগ্র বাসনা পরিত্যাগ করে সত্যই ভূমি সংস্কারের দিকে নজর দিলে গ্রামবাংলা অশান্ত হত না। কিন্তু অসম্ভব কল্পনা করে এরা ভেবেছিল চিরস্থায়ী ক্ষমতা ভোগ করবে, যার কুফল ফলতে দেরি হয়নি, গদিও হারাতে হল। কিছুটা সাধারণ মানুষের ক্ষমাতায়ণ হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভূমি সংস্কার মানবাধিকারের চরম অবমাননা করেছিল। এর উপর গ্রামের কম-বেশি লেখা-পড়া জানা গোষ্ঠীটিকে চরম বঞ্চনার শিকার হতে হয়। এতদিন তাদেরই পূর্বপুরুষের দান করা জমিতে গড়ে ওঠা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্কুল-মাদ্রাসাগুলিতে গ্রামের মানুষ যেমন চাকরি পেত তেমনই এরাও চাকরি পেত। বিচিত্র নিয়োগ পদ্ধতিতে দেখা গেল অসম প্রতযোগিতার ফল্ তাদেরই পূর্বপুরুষের দান করা স্কুল, মক্তব-মাদ্রাসায় অগ্রসর শ্রেণির কোন মানুষ চাকরি করছে। অর্থনৈতিক বঞ্চনার শেষ পেরেকটি মেরেছিল বাম শাসন। স্বাধীনতার সময় যে জনগোষ্ঠীর চাকরির হার ছিল ১৯ শতাংশের মত ১৯৭৭ নাগাদ কংগ্রেস শাসনের অন্তিম দিনে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ৮ শতাংশে। ২০১১ নাগাদ বহু কসরত করে বামেরা তা নামিয়ে আনে ২ শতাংশে..যদিও মেডিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মত কঠিন পরীক্ষায় মুসলিম ছাত্রের সংখ্যা ১০-১৫ শতাংশ রয়েছে এবং এদের প্রায় সকলেই বিভিন্ন মুসলিম মিশণ স্কুলের দান। ভেবে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করে মুসলিম মিশণ স্কুল থেকে পাশ সকল ছাত্রই তো মেডিক্যাল-ই়্জিনিয়ারিং পড়ার মত মেধাবি নয়, কিছু ছেলে তো অনার্স-পোস্ট গ্র্যাজুয়েটে ভর্তি হত তারা কোথায় যেত? তারা কেন স্কুলে ও সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারে নি ? ঠিক এই জায়গায় এসে মনে হত বাম সরকারের মুসলিম তথা গ্রাম বাংলার প্রতি বঞ্চনা ছিল পরিকল্পিত, শহুরে এক বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার চক্রান্ত। আমার আশ পাশে বিভিন্ন মেসে গ্রাম বাংলার প্রচুর মুসলিম ছেলে বাস করে এবং লেখা-পড়া করে..মিশণ থেকে পাস করা ছেলেও রয়েছে। একসময় এদের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করত। সাম্প্রতিক এস. এস, সি. ও প্রাথমিক রেজাল্টের পর (২০১৪) এদের মুখে হাসি ফুটতে দেখেছি। এরা নিজেও চাকরি পেয়েছে, নিকটাত্মীয় পেয়েছে..হতাশা ভুলে নতুন উদ্যমে লেখা-পড়া করতে দেখেছি।
গ্রাম বাংলার বঞ্চিত-হতদরিদ্র মানুষজনের মধ্যে পুরনো বনেদি পরিবারগুলোও রয়েছে। এই পরিবারগুলির সদস্যরা শুধু তাদের পূর্বপুরুষের বিরিয়ানি, কোর্মা-পোলাও খাওয়ার ও দাপটের স্মৃতিমন্থন করে এবং ছোটখাট জীবিকা নিয়ে বেঁচে রয়েছে। দাপটের মধ্যে রয়েছে অমুক নেতার দাদোর (ঠাকুরদা) বাগানো চুলের টেরি কেটে নেওযা হয়েছিল, দলিজের সামনে জুতো পায়ে পরে হাঁটার দায়ে জুতোর বাড়ি মারা হয়েছিল, রেডিও বাজিযে গান শোনার অপরাধে নাক খত দিতে হয়েছিল, অমুক জনের সুন্দরি কন্যাকে অপহরন করে বিয়ে করা হয়েছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। এরা ভুলেই গিযেছে গ্রামের একমাত্র মক্তব, মাদ্রাসা, দাতব্য চিকিৎসালয় ও মসজিদটি তাদেরই পূর্বপুরুষের দান। এবং তাদের পরিবারের উদ্ভবই হয়েছিল দরিদ্র পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শণ করে, দাপট দেখিযে নয়। এই অত্যাচারের ফলও ফলেছিল, বামেরা অত্যাচারিত মানুষের ক্ষোভকে উস্কানি দিয়ে প্রতিশোধ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষ দিকে এবং আশির দশকের প্রথম দিকে প্রায়ই খবরের কাগজের শিরোনাম হত অমুক মিঞার কাঁচা ধান কেটে নেওযা হয়েছে, পাকা ধান-মরাই লুঠ হয়েছে, পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরে নেওয়া হয়েছে, বিশাল জনতা এসে ঘর-বাড়ি তছনছ করে পুড়িয়ে একমাত্র ছেলেকে মেরে ফেলেছে, মেয়ের শ্লীলতাহানি করেছে। এসবই করা হয়েছে সাধারণের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার নামে এবং গ্রাম বাংলার কংগ্রেসি বিরোধীপক্ষকে ছত্রভঙ্গ করার জন্যে। একসময় সত্যই একচ্ছত্র বাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার অনেকটাই ভীতি প্রদর্শনের ফল।
বামেদের তথাকথিত বিপ্লব থিতিয়ে এলে গ্রামের মানুষের উপর সাংস্কৃতিক হামলাও হয়েছিল। অতি সাধারণ মানুষকে নাস্তিকতা ও ধর্মবিমুখতার পাঠ দিয়ে বস্তু সর্বস্বতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এর ফলই হয়েছিল ফাঁকা পড়ে থাকা বনেদি, মার্জিত লোকটির ছেড়ে যাওয়া চপ্পলে পা গলিয়ে ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করা, যেন তেন প্রকারে সম্পদের পাহাড় তৈরী করা। ক্ষমতা হাত ছাড়া হওয়ার সামান্যতম বিরোধিতাকে নির্মূল করার জন্যে আরেক দফা খুনোখুনির প্রযোজন পড়ে। পরবর্তী গণহত্যা ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর দুঃসাহসিকতা নির্মূলের জন্যে যা মোটামুটি শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে।
গ্রামের হিন্দু-মুসলিম বনেদি পরিবারগুলির ধ্বংসসাধনে অনেকসময় জ্ঞাতিশত্রুতাও কাজ করেছিল। কোন এক পক্ষ প্রবল রাজনৈতিক পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে অপরদিকে নিজেরই জ্ঞাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। এই জ্ঞাতিশত্রুতার আরম্ভই হল জমি-জায়গার বাগ বাঁটোযারার অস্বচ্ছতা থেকে। এককালে অঢেল জমি-জায়গা থাকায় মুখে বলেই জমি হস্তান্তরিত হয়েছিল এবং এই ধরনের হস্তান্তরে যতই উদারতা থাক পরবর্তীতে সম্পদ কমে যাওয়ায় ঝগড়া লাঠা-লাঠির মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এই ফাঁক দিয়েই রাজনীতির প্রবেশ। মুসলিম এলাকায় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে বোনের বা মেয়ের ফারাজ আদায়ে অস্বচ্ছতা। এমন কোন বনেদি পরিবার নেই যাদের জমি-জায়গা, বাস্তুর ভাগ-বাঁটোযারার অস্বচ্ছতা নেই। শরিয়তের উল্লঙ্ঘনকারী মুসলিম বিয়ে, মেয়ের বিয়ে ইত্যাদিতে পুরনো ঠাট-বাট বজায় রাখতে গিযেও জমি বিক্রয় করতে হয়েছে, বহু ক্ষেত্রে বহু বিবাহের ফলে বিভিন্ন শরিকের মধ্যে জমি বন্টনে বাধ্য হতে হয়েছে। জলপূর্ণ কলসি থেকে ক্রমাগত জল গড়িয়ে খেলেও একদিন না একদিন শেষ হতে বাধ্য। আমদানি থেকে খরচা বেশি হলেও সম্পদ হাত গলে বার হয়ে যায়। পুরনো সব পরিবারগুলোর প্রায় একইরকম ইতিহাস।
[৩]
বর্ধমান সংলগ্ন বাঁকুড়ার বনেদি এক বংশের সঙ্গে দুই বাংলার বেশ কিছু পীর-দরবেশ পরিবারের যোগ রয়েছে এবং নিজেরাও অল্প-বিস্তর আধ্যাত্মিক বলে বলিয়ান। এই পরিবারের পর্দানশিণ বিবিদের ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দেওযা হয়েছিল। বাধ্য করা হয় পর্দা ছেড়ে বার হযে কাঁখে করে পানি আনা, বাজার-হাট করা ইত্যাদি গৃহকর্ম করতে এবং এ-ও ছিল বিপ্লবের এক অংশ বিশেষ। আজীবন যে সকল ব্যক্তিবর্গ এই পরিবারের সেবা করে নিজেদের ধন্য মনে করত, তারাই হয়ে গেল বিপ্লবী। পরিশ্রম ছাড়াই নগদ বস্তু অর্জনের কি মহিমা ? এমনকি উক্ত পীর বংশীয় পরিবারের কোন সদস্যের ইন্তেকালের পর কবরের মাটি খোঁড়ার জন্যেও লোকজন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বস্তুত গ্রামবাংলা থেকে শহর প্রতিটি ক্ষেত্রেই বেশ কিছু মানুষকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল কর্ম না করেই শুধুমাত্র দলবাজি করেই উপার্জন করতে। এ সবই সাংস্কৃতিক হামলা। সাড়ে তিন দশক পরে এই দুই যুযুধান পক্ষের অবস্থান কি রকম? প্রথমেই বলি, যে দল বা মতবাদ লড়াইয়ে ইন্ধন যুগিয়েছিল, উভয় যুযুধান পক্ষই একত্রিত হয়ে তাদের উতখাত করেছে। কারণ, দেখা গিয়েছিল তথাকথিত বুর্জোয়া ও শ্রেণিশত্রু উৎখাতের পর যারা এই তথাকথিত বিপ্লবে ইন্ধন যুগিয়েছিল তারাই এধার-ওধার করে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয় এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে আরও সড়গড় হয়ে পড়েছিল। পুরনো বনেদি পরিবারটি এলাকাকে মক্তব, মাদ্রাসা, স্কুল, চিকিতসালয় দিয়েছিল কিন্তু নব্য ধনীরা শুধু নিতেই জানে দিতে জানে না, দেওয়ার মত তাদের মানসিকতাই তৈরী হয়নি। তা ছাড়াও বনেদি পরিবারটির শুধু বাংলাদেশ যোগই ছিল না বরং পাকিস্তান, আরব থেকে ভিন মহাদেশেও তাদের যোগাযোগ থাকায় অত্যাচারের ফলে প্রাথমিক গ্রাম ছাড়া হলেও বিভিন্ন দুরূহ কোণ থেকে সাহায্য আসায় পুনরায় প্রায় একই অবস্থায় ফিরে আসে। যতই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হোক যাদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তনই হয়নি। যে টুকু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছিল তা হল নেতৃত্বে থাকা মানুষজনের। পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে তারা গ্রামছাড়া, এমনকি ওই দরিদ্র মানুষগুলি পুনরায় উক্তি বনেদি পরিবারের সাহায্যপ্রার্থী।
বনেদি পরিবারগুলির সদস্যদের সাধারণ মানুষের প্রতি ব্যবহারের পরিবর্তনের ফলেই তাদের প্রতি মানুষের ব্যবহারের পরিবর্তন হয়েছিল এবং এই ফাঁকফোকর দিয়েই রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানিরা প্রবেশ করতে পেরেছিল। একটি উদাহরণ দিই, মালদহের এক রাজনৈতিক পরিবার তাদের একদা প্রজাদের প্রতি সেবা ও সহমর্মিতার আদর্শে কোন পরিবর্তন আনেনি বলেই তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি বামেদের মত কোন রাজনৈতিক দল খর্ব করতে পারেনি।
যাই হোক, সমস্ত পশ্চিমবাংলার (হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে) একদা স্বচ্ছল, বনেদি পরিবারগুলির প্রায় একই কাহিনি হলেও আমি বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বাঁকুড়া, হাওড়া, হুগলি, দুই ২৪ পরগণা ঘুরে তথ্যগুলি সংগ্রহ করেছি। ব্যতিক্রম কিছু থাকলেও কাহিনি প্রায় একই। উক্ত বনেদি পরিবারগুলির বর্তমান অবস্থা কেমন? এখন প্রায় সকলের জানা হযে গেছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মাথাপিছু জমির পরিমাণ ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কম হওয়ায় পুরনো সামন্ত প্রভুদের ফিরে আসা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এই গোষ্ঠীটির মধ্যে যারা শহরমুখি তারা আগেই বুঝে গেছে এবং এখন গ্রামে বসবাসকারীরাও বুঝে গেছে লেখা-পড়ার কোন বিকল্প নেই এবং লেখা-পড়া করলে তার প্রকৃত মূল্য দেওযা হবে। লেখা-পড়ার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের ওবিসি সংরক্ষণ একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
সংযোজনঃ চাকরিতে তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি এবং ওবিসি সংরক্ষণের মূল যে সমস্যা তা হল উচ্চ পদের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত প্রার্থী না পাওয়া। বর্তমান সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণ সেই অভাব পূরণ করবে বলেই মনে হয়ে। মুসলিম খান ও শেখদের সংরক্ষণ দেওয়ায় এর ইতিবাচক ফল ফলতে দেরি হবে না। কারণ মোল্লা, খান ও সেখরা একটু উন্নত, যার জন্যে প্রাক্তন সিবি আই ডিরেক্টর উপেন বিশ্বাসের কাছে মুসলিমরা অনেকটাই ঋণী। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বামেদের আমলের সরকারি চাকরির ২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫.৭ শতাংশ (আনন্দবাজার ২৮.০১.১৬)। যদিও ৩০ শতাংশের জন্যে উন্নতির ঢের জায়গা রয়েছে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।