লিখেছেনঃ আমিনুল ইসলাম
বিভাগোত্তর পশ্চিমবাংলায় বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতিচর্চার ধারাটি যখন ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল তখন গুটিকয় সাহিত্যসেবী যারা কলম ধরে সামনে এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে আবদুল জব্বার (১৯৩৪-২০০৯) ছিলেন অন্যতম। বাঙালি জীবনের এই কথাকার উঠে এসেছেন গ্রামবাংলা থেকে (বজবজ)। ছিলেন বহু উপন্যাসের স্রষ্টা। তার ‘ইলিশমারির চর’ (১৯৬২), ‘ঝিনুকের নৌকো’, মাতালের হাট’ ‘বিদ্রোহী বাসিন্দা’ ‘অশান্ত ঝিলম’ (১৯৮৭), শঙ্খবালা’, মাটির কাছাকাছি’ (১৯৯৭), ‘ভরা কোটাল’ (১৯৯৮), ‘রাতের জোয়ার’ (১৯৯৯), ‘সুন্দরীঅরণ্য’ (১৯৯৯) বদরবাউল’, ‘অমৃতসমান’(২০০১), ‘চোরাবালি'(২০০২), ‘পাহাড়ী ময়ূর’ (২০০৩), ভাবসমাধি’ (২০০৪), ‘মোহিনী’ (২০০৬), ‘রাত পাখির ডাক’, ‘অলৌকিক প্রেমকথা’, মরিয়মের কান্না’, ‘লালবানু’, ‘আনোর ঠিকানা’, ‘ভালোবাসা মধুময়’, ‘রূপবতী রাত’, ‘লাজবতী’ (২০০৮), ‘আপনজন’, রূপের আগুন’, কনকচূড়া’, ‘বেদেনী’, ‘অন্ধকারের নদী’, ‘সবুজ নক্ষত্র’, সরমার ঐশ্বর্য, ‘গণ্ডির বাইরে’, নলখাগড়া’, ‘মোগল প্রেম কথা’, ‘গরল’, বাঘের খোঁজে’, সাত সাগরের নাবিক’, নীলাঞ্জনা’, মানুষজন’, ‘শিশিরভেজা’, ‘আলোর ঠিকানা’, ‘দহন’, ‘স্বপ্নের পরকাষ্ঠা’ প্রভৃতি উপন্যাসে বাঙালি জীবনের রূপাঙ্কন স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
মনীষী কাজী আবদুল ওদুদ সাহেবের সাহচর্যে থাকার সময়ে আবদুল জব্বার তার প্রথম উপন্যাস ‘ইলিশমারির চর’ রচনা করেন। ‘বাংলার চালচিত্র’ বেশি জনপ্রিয়তা পেলেও ‘ইলিশমারির চর’-ই আবদুল জব্বারের সেরা লেখা। বইটি প্রকাশিত হয় ‘জাগরণ’ সম্পাদক আবদুল আজিজ আল-আমনের উদ্যোগে। ১১০, মহাত্মা গান্ধি রোডের দোতলায় ছিল ‘জাগরণ’ পত্রিকার অফিস। আদতে সেটি মল্লিক ব্রাদার্সের আবাসস্থল। ব্রাইট স্ট্রিটের এক আড্ডায় পরিচয়ের পর মল্লিক ব্রাদার্সের কর্ণধার আবুল কালাম মল্লিকের মাধ্যমে জাগরণ সম্পাদক আবদুল আজিজের সাথে আবদুল জব্বারের ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ‘জাগরণ’-এর ঈশ্বর সংখ্যায় ‘ইলিশমারির চর’ প্রকাশিত হয়। পরে তারই উদ্যোগেই উনিভার্সালবুক ডিপো থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। লেখক এই উপন্যাসকে বলেছেন ‘ধীবর জীবনের চিত্রকল্প’। তিনি লিখেছেন, ‘ইলিশমারির চরের আসল মানুষরা হল জেলে। তাদের পাড়াটা একটু ভেতরের দিকে….আঁকবন্দি বাড়ি। গাব গাছের ভিড়। তলতা আর বাঁশরী গাছের ঝাড় চারদিকে।‘’ এই উপন্যাসে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ইলিশ মাছশিকারীদের জীবনযাপনের ছবি ধরা পড়েছে।’ আঞ্চলিকতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এ উপন্যাস। এই জেলার আঞ্চলিক উপভাষা, বাগবিধি, প্রবাদ প্রবচন অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন লেখক। প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র এই উপন্যাস সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ইলিশমারির চর ফড়ের কাছে কেনা ফসল নয়, নিজের হাতে ফলানো।
‘অশান্ত ঝিলম’ উপন্যাসের পটভূমি কাশ্মীর। ভূস্বর্গ কাশ্মীরের অন্তরালে যে অন্ধকার, শোষণ, দারিদ্র, অশ্লীলতা, মেয়েদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা প্রভৃতি উপন্যাসটিতে ফুটে উঠেছে। সিরাজ এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। সে আর্টিস্ট বা শিল্পী। কলকাতায় থাকতে ছবি এঁকে যে অল্প স্বল্প খ্যাতি পেয়েছে, তার চোখে আরও বড় শিল্পী হতে চায়। সে কলকাতা থেকে কাশ্মীর চলে আসে। সেখানে থাকে তার মামা ও মামী। কাশ্মীরে থেকে সে ছবি এঁকে নিজের এ পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। বইটি উৎসর্গীকৃত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে।
করুণা প্রকাশনী ‘শঙ্খবালা’ নামে আবদুল জব্বার সাহেবের যে উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে তার আদ্যোপান্ত প্রান্ত মানুষের জীবন-সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে লেখা। লেখক যেহেতু প্রান্তজীবনের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত, সে কারণে তাঁর উপন্যাসটিতে খেটে-খাওয়া লড়াকু মানুষের জীবনযাত্রা বিশেষ দক্ষতায় ও চিত্রিত হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের সমুদ্র উপকূলের মাছ-মারা ও ডুবুরিদের জীবন নিয়ে লেখা হয়েছে ‘শঙ্খবালা’। মুসলিম সমাজের নানা কথা অর্থসহ উপস্থাপন করেছেন আবদুল জব্বার।
উপন্যাসের নায়ক রশীদ ডুবুরির কাজ করে। তার বাপ আরিফ আমেদ দীর্ঘ চল্লিশ বছর ডুবুরির কাজ করে চোখ দুটো খুইয়ে বসেছে। তার রক্তবর্ণ ও বীভৎস চোখের দিকে তাকালে মানুষের ভয়হয়। মহাজনেরা কীভাবে মানুষকে শোষণ করে বর্ণহীন ও মৃতপ্রায় করে তোলে আরিফ তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। আরিফের স্ত্রী আন্নাবিবি সর্বংসহা জননীর প্রতিমূর্তি। সংসার চালানোর পাশাপাশি পথের ধারে বসে শুঁটকি মাছ বেচতে হয় তাকে। সংসারটা মোটেই এতটুকু নয় অথচ রোজগারের পরিমাণ সামান্যই। আরিফের বয়েস হয়েছে, খুব বেশি জলে নামতে পারে না। সমুদ্রের নোনা জলে চোখের যন্ত্রণা শুরু হয়। রশীদ অবশ্য ডুবুরির কাজ শুরু করেছে কিন্তু জলের নিচে বেশিক্ষণ থাকার কৌশল এখনও রপ্ত হয়নি তার। ফলে তার রোজগারও তেমন কিছু নয়। আরিফ, আন্নাবিবি ও রশীদ ছাড়াও সংসারে আরও কয়েকটি প্রাণী। আজরা বানু, গুলবদন, সেলিম, গফুর, কদম ও হালিম-গরিব মুসলমান পরিবারের সন্তান সংখ্যা একটু বেশিই। অজ্ঞতার কারণে পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা ঠিক ঠিক অবহিত নয়। সে-কারণে সংসারে অভাবের অন্ত থাকেনা। এইঅভাবী মানুষগুলোকেই মহাজনেরা তাদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে শোষণ করে আর কৌশলে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে।
উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই রঙ্গভূর পল্লিতে শবেবরাত’-এর মহোৎসব।গ্রামজুড়ে উৎসব অথচ এই উৎসবের মধ্যেও মহাজন শাঁখ তোলার কাজ বন্ধ রাখেনি। রঙ্গভূর আর পুতুলিপত্তমের আকাশে-বাতাসেশাখ ভোলার আঁশটানি দুর্গন্ধ। মহাজন আবদুর রহমানের বাড়ি আলোর মালায় সেজে উঠেছে আর গরিব নুলিয়ারা শাঁখ তোলা ও শাঁখ পোতার কাজে প্রাণপাত করে সন্ধের পর একটু আনন্দের জন্যে মুখিয়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতি চলছে দীর্ঘকাল ধরে। তরুণ রশীদও তার বন্ধুরা এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায়। তারা চায় মহাজনদের কাছ থেকে তাদের প্রাপ্যটুকু লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আদায় করে নিতে।
তুহিনা চরিত্রটি একটি বনেদি মুসলিম পরিবারের লেখাপড়া জানা মেয়ের জীবনের আদলে গড়ে উঠেছে। সে ছবি আঁকে, শিক্ষকতা করে। এমন একটা মেয়ে যেভাবে চাঁদনি রাতে নব্য পরিচিত রশীদের পেটে মুখ গুঁজে কামড় বসায় কিংবা হোটেলের একটি ছেলেকে নিয়ে সমুদ্রে স্নান করতে যায় তাতে কে কখনও-কখনও রাহিলার সমগোত্রীয় বলে মনে হয়। সে রশীদকে লিখেছিল, ‘তুমি একদিন এসো। তোমাকে আমার ভয়ানক প্রয়োজন। অনেকের সঙ্গে মিশলাম ঠিক তোমার মতো অরিজিন্যাল কাউকে পাইনি। সবই মেকি, কৃত্রিম ভন্ড। তুমি কবে আসবে? পথ চেয়ে আছি। যে সময়ে এই চিঠি লেখা, প্রায় সমসময়েই সে মহম্মদ আলীকে বিয়ে করে। এমনটা হতে পারে যে, তুহিনা চরিত্রের অস্থিরতা মধ্যে দিয়ে জব্বার সাহেব নারীচরিত্রের প্রহেলিকাময় সত্যটি প্রকাশ করেছেন তবুও কোথাও কোথাও তুহিনা চরিত্রটিকে বুঝতে হিমশিম খেতে হয়।
সুজাতা সাকসেনার জন্মবৃত্তান্ত উদঘাটনে আবদুল জব্বার সাহেব যে উপকাহিনিটি রচনা করেছেন তা রীতিমত আকর্ষণীয়। এই উপকাহিনিটি উপন্যাসের গতিময়তা বৃদ্ধি করেছে। উপন্যাসের শেষ অংশে আমরা দেখতে পাব, এম এল এ সুজাতা সাকসেনা তার রশীদ ভাইকে বিধায়ক পদের টিকিট পাইয়ে দিয়েছে। রশীদকে তৈরি করার জন্যে তাকে রমা রাল্যাঁ, তলস্তয় ও গোর্কি পড়িয়েছে। রশীদের বাচনভঙ্গী ও জীবন-যাপন, রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি অনুরাগ প্রভৃতিতে লেখকের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ও ছায়াপাত দেখা গেলেও ডুবুরি সম্প্রদায়ের লড়াকু একটি ছেলেকে আবদুল জব্বার যে প্রত্যয়ে ভারত-রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। আব্দুল জব্বার আমাদের বিস্মিত করে দেন ২০০১-এ প্রকাশিত ‘অমৃত সমান’ উপন্যাসে। উপন্যাসে একটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, যেখানে মুসলমান সমাজের গার্হস্থ্য সামাজিক আচার ও প্রথা সম্পর্কে যতদূর সম্ভব খুঁটিনাটি তুলে ধরা যায়। ‘পাহাড়ী ময়ুর’নামের ছোটো উপন্যাসটিতে বিভিন্ন দিক থেকে তুলে ধরেছেন মুসলমান সমাজকে। মেদিনীপুরের পীর পরিবারের ছেলে পারভেজ শাহেরী। কিন্তু জমিজমা এবং অঞ্চলের ধর্মগুরুর জীবিকা ছেড়ে সে তমলুকে কাপড়ের কল করেছে। সে রক্ষণশীল এবং অস্বাস্থ্যকর সামাজিক আচরণ অনুসরণ করতে চায় না। আখ্যানটিতে বিশেষ কোনো গল্প নেই। পারভেজ-এর বিবাহ তার সহপাঠী ইলিয়াসের বোনের সঙ্গে; ইলিয়াসের বিবাব পারভেজের ধর্ম-বোন রশীদা-র সঙ্গে। পারভেজ একবার গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের নামাজ পড়ায়। এইসব ঘটনা বিবৃতির মধ্য দিয়ে মুসলমান সমাজের খুঁটিনাটি, রক্ষণশীলতা ও আধুনিকতার দুটি দিক পেশ করেছেন আবদুল জব্বার। ঠিক যেমন ‘পোড়ামাটির ঘোড়া’ নামের বড় গল্পটিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে সুন্দরবনের মানুষ।
উন্নতমানের মানুষের কাছে আমরা যে ধর্মনিরপেক্ষতা আশা করি ‘রূপবতী রাত’ উপন্যাস তারই আকর। ‘মোহিনী’র কাহিনির পঁচাত্তর ভাগ অংশ জুড়ে থাকা চরিত্রগুলি উচ্চ মধ্যবিত্ত কিন্তু গল্পের নায়ক দরিদ্র, একেবারে মাটিঘেঁষা মানুষ। পরে অবশ্য তার অবস্থানগত উন্নতি ঘটেছে। লেখকের বাস্তব সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়—শাকসবজি, বিভিন্ন ধরনের মাছ, কোন মাছ কীভাবে ধরা যায়, কী মাছের কী টোপ, মুসলিম সমাজের বিভিন্ন উৎসব, রুচি, পোশাক, খাবার-দাবার, হার্ডওয়্যারের ব্যবসায় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ—ইট ক’ধরনের হয়, কীটনাশক ব্যবহার ক্ষতিকারক বলে আমেরিকা বন্ধ করে দিয়েছে অথচ আমাদের মতো অনুন্নত দেশগুলি তা মহাসমারোহে চাষের কাজে ব্যবহারের ফলে চর্মরোগ থেকে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে, কৃষি আধিকারিকদের সব জেনেও চুপচাপ থাকা, মিছরি গাছ অধিক কোথায় হয়, নারকেল গাছ কোথায় বেশি জন্মায় ইত্যাদি প্রকৃতি সংক্রান্ত নানান তথ্য জ্ঞাপনে। অন্যান্য উপন্যাসের মতো এখানেও বিন্দুমাত্র ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় না দিয়ে ইসলাম ধর্মের মানুষদের দোষত্রুটিকে তুলে ধরেছেন। ‘মরিয়মের কান্না’ উপন্যাসটি তার অন্যান্য উপন্যাসের মতো খেটে খাওয়া মানুষের জীবন্ত দলিল। স্বার্থ, দ্বন্দ্ব, প্রেম, হিংসা, শঠতা, যৌবন বৃত্তির রসায়নে ভিয়েন করা এক আস্বাদময় আখ্যান।
‘লাজবতী’র কাহিনির শুরুতেই সাংসারিক ট্রাজেডির আভাস পেয়ে যাই। লেখক যেন আমাদের সমাজের আনাচ-কানাচ থেকেই অনুসন্ধান করে তুলে এনেছেন এমন নিদারুণ চিত্র। যে ঘটনা, যে চিত্র আমাদের হৃদয় ব্যথিত করে। সহমর্মিতা আদায় করে নেয়। ‘লাজবতী’ মাটির পথ ছাড়িয়ে উঠে আসা অন্য এক জগতের কাহিনি। যে কাহিনি লেখকের অনুসন্ধানের-প্রজ্ঞার, মানুষ সম্পর্কে, মানুষের ধর্ম সম্পর্কের এক উহ্য উন্মেষণ। ইসলাম ধর্মের সম্পর্কে পড়াশোনার এবং সমালোচনার গভীর দীক্ষা।