লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
খিলজী বংশের উৎপত্তিঃ খিলজী বংশের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। মুসলমান ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারাণী বলেন, দিল্লিতে কাচান ও সুরখা’র নেতৃত্বে তুর্কি দল এবং জালালউদ্দিন খিলজীর নেতৃত্বে খিলজী দল পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল। খিলজীগণ ছিল তুর্কি জাতি হতে সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র । এর বেশি কোনাে বর্ণনা বারাণী দেননি। পরবর্তী ঐতিহাসিক নিজামউদ্দিনের মতে, খিলজীগণ ছিল চেঙ্গিস খাঁর জামাতা কুলিজ খাঁর বংশধর। কুলিজ খাঁর নামানুসারে তাঁর বংশধরগণ ‘কালিজ’ ও ‘খালিজ’ নামে পরিচিত হয়। নিজামউদ্দিনের এই মত সমর্থন করে ঐতিহাসিক ফিরিস্তা কালিজ খাঁকে খিলজী বংশসস্তৃত এবং জালালউদ্দিন খিলজীকে কুলিজ খাঁর বংশধর বলে অভিহিত করেন। যাইহােক, গভীরভাবে বিচার করলে খিলজীগণকে তুর্কি বংশোদ্ভূত বলেই মনে হয়। আফগানিস্তানের হেলমন্দ নদীর উপকূল অঞ্চল ‘খিলজী অঞ্চল’ এবং এখানকার অধিবাসীগণ ‘খিলজী’ নামে পরিচিত। ‘তাবাকাৎ-ই-নাসিরি’ গ্রন্থের রচয়িতা মিনহাজউস-সিরাজ বলেন যে, খিলজীগণ ঘাের ও গজনী রাজবংশের অধীনে বহু যুদ্ধ-বিগ্রহে অংশগ্রহণ করেছিল। আধুনিককালের ঐতিহাসিক লেনপুল অনুমান করেন যে, খিলজী বংশ তুর্কি জাতি হতে উদ্ভূত এবং দীর্ঘকাল আফগানিস্তানের গরমূশির নামক অঞ্চলে বসবাস করার ফলে তাঁদের মধ্যে আফগান জাতির বহু আচারআচরণ, রীতি-নীতি প্রবেশ করে। মধ্য এশিয়ার ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ বারথােল্ড (Barthold)-এর মতে, খিলজীগণ ছিল তুর্কি এবং এরা খ্রিস্টিয় চতুর্থ অব্দের পর আফগানিস্তানে বসতি স্থাপন করেন। মােটামুটিভাবে একথাটি বলা যেতে পারে যে, খিলজীগণ অবশ্যই তুর্কি ছিলেন। প্রথমদিকে তাঁরা গজনী ও ঘােরের আক্রমণকারীদের সাথে ভারতে প্রবেশ করেন এবং অনেকে মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে মােঙ্গল আক্রমণের সময় আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতে আসে। কিন্তু ভারতে বহুদিন ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ইলবারি তুর্কিগণ নবাগত খিলজীগণকে কখনােই মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি, যদিও উভয়েই এক জাতি বা গােষ্ঠীভুক্ত ছিল।
খিলজী বংশের উত্থানঃ জালালউদ্দিন খিলজী ইলবারি তুর্কি বংশের শেষ সুলতান কায়কোবাদকে হত্যা করে জালালউদ্দিন ফিরােজ খিলজী ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। খিলজীদের উত্থান ভারতের ইতিহাসে ‘খিলজী বিপ্লব’ (Khalji Revolution) নামে অভিহিত হয়েছে। জালালউদ্দিন খিলজীর পূর্বপুরুষেরা তুর্কি জাতীয় লােক ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে তুর্কি অভিযান শুরু হওয়ার সাথে সাথে আক্রমণকারীদের সঙ্গে ভারতে তাদের আগমন ঘটে। শুরু থেকেই খিলজীরা ভারতের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শাসনকার্যে লিপ্ত হয়েছিলেন। জালালউদ্দিন খিলজীর সাফল্যের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা উচচ শিখরে উপনীত হয়। খিলজীদের এই শক্তিবৃদ্ধিতে ইলবারি তুর্কিদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। তুর্কিরা খিলজীদেরকে অ-তুর্ক মনে করতাে। এ কারণে জালালউদ্দিন খিলজী শক্তিশালী তুর্কি ওমরাহগণের স্বত:প্রবৃত্ত আনুগত্য হতে বঞ্চিত হন। এমনকি কৈলুগড়ি প্রাসাদে অভিষেক হবার পরও তিনি অনেকদিন পর্যন্ত দিল্লিতে প্রবেশ করতে পারেননি। যাইহােক, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সিংহাসনে উপবেশন করেন। জায়গীর ও সরকারি চাকুরির বন্টনে সুলতান তাঁর পুত্র ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেন; অবশ্য কিছু সুযােগ-সুবিধা দিয়ে তুর্কি আমীর ওমরাহগণের মনােরঞ্জনের চেষ্টাও তিনি করেন। বলবন পরিবারের সদস্য এবং প্রবীন ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে সুলতান অনেকের আস্থা ও আনুগত্য লাভ করেন। কিন্তু যে ব্যক্তি বলবনের সিংহাসনকক্ষের সামনে অশ্রু বিসর্জন করতেন তিনি বলবনের পরিত্যক্ত বিশাল রাজ্য শাসনের যােগ্য কিনা সে বিষয়ে রাজ্যের নবীনেরা সন্দেহ পােষণ করতেন। জালালউদ্দিনের দুর্বলতাও ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়। তিনি বিদ্রোহী বন্দিদের মুক্ত করে দেন, তাদেরকে পানসভায় আপ্যায়ন করেন; পরকালের চিন্তায় রক্তপাত থেকে বিরত থাকেন; গ্রেপ্তারকৃত সহস্রাধিক ‘ঠগ’ কে শাস্তি প্রদানে ব্যর্থ হন এবং সামগ্রিকভাবে তাঁর সম্পর্কে জনগণের ধারণা হয় যে, তিনি ঈশ্বরের কৃপাধীন নন। রণথম্ভোরের বিরুদ্ধে প্রেরিত এক অভিযানই (১২৯১ খ্রি:) ছিল সুলতানের একমাত্র উল্লেখযােগ্য সামরিক প্রয়াস। মােঙ্গলদের বিরুদ্ধেও জালালউদ্দিন কিছুটা শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। ১২৯২ খ্রিস্টাব্দে মােঙ্গলদের এক বাহিনী সিন্ধু নদ অতিক্রম করে সুনাম পর্যন্ত অগ্রসর হলে সুলতান তাদেরকে পরাজিত করেন।
খিলজী বিপ্লবের গুরুত্বঃ ইলবারি তুর্কিদের বিরুদ্ধে খিলজীদের সাফল্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের সময় হতে ইলবারি তুর্কিরা দিল্লিতে জেঁকে বসে। তারা নিজেদেরকে দিল্লির সিংহাসনের ধারক ও বাহক মনে করতাে। তুর্কিরা মনে করতেন তারাই একমাত্র অভিজাত শ্রেণী। অন্য কেউ তাদের আভিজাত্য ক্ষুন্ন করুক এটা তারা সহ্য করতেন না। কিন্তু জালালউদ্দিন ফিরােজ খিলজীর সাফল্য এবং দিল্লির সিংহাসন অধিকার ইলবারি আভিজাত্যের ওপর চরম আঘাত হানে। এরপর থেকে খিলজীদের সাথে অন্যান্য অ-তুর্ক মুসলমানদেরও ক্ষমতা লাভের পথ প্রশস্ত হয়। মাত্র ত্রিশ বছর স্থায়ী খিলজী শাসন দিল্লি সাম্রাজ্যের মােড় পরিবর্তন করতে সমর্থ হয়। সকল স্তরের, সকল গােত্রের মুসলমানদের সমন্বয়ে তারা এমন শক্তি সঞ্চয় করেন, যাতে শুধু দিল্লি সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বৃদ্ধিই নয় বরং সুদূর দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত মুসলমান শাসনের সম্প্রসারণ ঘটে। খিলজীগণ এটাই প্রতিপন্ন করেন যে, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমর্থন ছাড়াও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও শক্তি অক্ষুন্ন রাখা যায়। সর্বোপরি খিলজীদের সাফল্য শুধু যে রাজবংশের পরিবর্তন ঘটায় তা নয়, এটা ভারতে মুসলমান প্রভুত্বের সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন এবং শিক্ষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে অভাবনীয় উৎকর্ষ সাধন প্রভৃতিরও সূত্রপাত করে। খিলজীগণ কোন রাজপরিবারভুক্ত ছিলেন না- রাজত্বসূচক কোন ঐতিহ্যও তাঁদের ছিল না। তাঁরা ছিলেন সাধারণ শ্রেণীভুক্ত। সুতরাং খিলজীদের সাফল্যে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সার্বভৌম অধিকার কোনাে বিশেষ শ্রেণীর একচেটিয়া নয়।
আলাউদ্দিন খিলজী: প্রথম জীবনঃ সিংহাসনে আরােহণের পর জালালউদ্দিন খিলজী তাঁর প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা ‘আলি ঘুরশাস্প’ কে ‘আমীর-ই-তুজুক’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করেন। এই আলিই হলেন শ্রেষ্ঠ খিলজী শাসক আলাউদ্দিন খিলজী। সুলতানি সাম্রাজ্যের একজন বিখ্যাত সুলতান হিসেবেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে। আলাউদ্দিনের বাল্যকাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। সম্ভবত ১২৬৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন জন্মগ্রহণ করেন। ছােটবেলায় বিদ্যাশিক্ষার কোনাে সুযােগ তার হয়নি। কিন্তু তরুণ বয়সে তাঁকে অশ্বচালনা ও অসিচালনায় বিশেষ শিক্ষা দেয়া হয়। তখন তিনি সামরিক নৈপুন্যের পরিচয়ও দেন। ১২৯১ সালে বলবনের ভ্রাতুস্পুত্র মালিক চজু (মতান্তরে ছৰ্জ্জু) বিদ্রোহী হলে তিনি তাঁকে দমন করেন। এই কৃতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ আলাউদ্দিনকে এলাহাবাদের নিকটবর্তী কারা-মানিকপুরের জায়গীর দেয়া হয়। এরপর থেকেই আলাউদ্দিনের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ প্রকাশ পেতে শুরু করে। মালিক চজুর অনুচরদের প্ররােচণায় এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক ও পারিবারিক পরিস্থিতিতে তিনি স্বাধীন ক্ষমতা লাভের সংকল্প করেন। কিন্তু এই উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক পরিকল্পনা রূপায়নের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন ছিল। আলাউদ্দিন নিজের অনুচরদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হন। বহু সেনা ও আমীর-ওমরাহ্ তাঁর দলভুক্ত হয়। এরপর অর্থ সংগ্রহে তিনি কয়েকটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ১২৯২ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন ভিলসা নগর আক্রমণ করে প্রচুর ধনরত্ন সংগ্রহ করেন। ভিলসায় তিনি দেবগিরির যাদব রাজ্যের বিপুল সমৃদ্ধির কথা শুনেছিলেন। বিন্ধ্য পর্বত অতিক্রম করে সেখানে আক্রমণের জন্য তিনি সংকল্প করেন। ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি দাক্ষিণাত্যের পথে যাত্রা করেন। আলাউদ্দিনের সাথে ৮ হাজার অশ্বারােহী ছিল। দেবগিরিতে তিনি সাফল্য লাভ করেন। বহু অশ্ব ও হস্তি তার হস্তগত হয়। যাদবরাজ রামচন্দ্র সন্ধি করেন এবং আলাউদ্দিনকে বিপুল পরিমাণে স্বর্ণ ও রত্নাদি প্রদানে রাজি হন। আলাউদ্দিনের দেবগিরি অভিযানের রয়েছে বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব। কেননা, বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে এটাই হলাে মুসলমানদের প্রথম অভিযান। এ সময় হতেই দাক্ষিণাত্যে মুসলমানদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সূত্রপাত হয়। তদুপরি এ অভিযানে আলাউদ্দিন তাঁর রণ নৈপুন্য ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেন।
আলাউদ্দিনের সিংহাসনারােহণঃ ধনসম্পদ নিয়ে আলাউদ্দিন কারায় ফিরে আসেন। কারায় তার অনুপস্থিতিকালে সুলতানের বিশ্বস্ত কর্মচারীরা সুলতানকে আলাউদ্দিন সম্পর্কে বুঝাবার চেষ্টা করেন যে, উচ্চাভিলাষী আলাউদ্দিনকে বিশ্বাস করা উচিত নয়। কিন্তু সুলতান এ প্রচারণায় কান দেননি। আলাউদ্দিনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা উলুঘ খাঁ দিল্লিতে আলাউদ্দিনের স্বার্থের প্রতি লক্ষ রাখতেন। তিনি সুলতানকে আলাউদ্দিনের প্রতি বিশ্বস্ত রাখতে তৎপর ছিলেন। এমনকি উলুঘ খাঁর পরামর্শ মতাে সুলতান জালালউদ্দিন খিলজী আলাউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার সাহায্যে পূর্বের ব্যবস্থা অনুযায়ী আলাউদ্দিনের ইঙ্গিতে দুজন দুবৃত্ত জালালউদ্দিনকে হত্যা করে। নিহত সুলতানের মস্তক একটি বর্শাফলকে বিদ্ধ করে শাসনাধীন অঞ্চলে প্রদর্শন করা হয় বলেও সমসাময়িক সূত্র থেকে জানা যায়। তবে অনেকে মনে করেন, সুলতানের হত্যাকান্ড আলাউদ্দিনের পূর্বপরিকল্পনাপ্রসূত নয়। পরিস্থিতির বাস্তবতায় তাৎক্ষণিকভাবেই এটি ঘটেছে। যাহােক, এরূপেই ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন সিংহাসনে আরােহণ করেন। সিংহাসনে বসে তিনি জালালউদ্দিনের পুত্র আরকালী খাঁকে পরাজিত করে নিজ অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। যে সকল আমীর-ওমরাহ্ অর্থলােভে আলাউদ্দিনের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন তাঁদেরকে তিনি কঠোর শাস্তি দেন। কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন, অর্থলােভী ব্যক্তিরা যে কোন সময়ই প্রভু বদল বা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।
আলাউদ্দিনের সাম্রাজ্যবাদী নীতিঃ আলাউদ্দিন যুদ্ধপ্রিয় ও সাম্রাজ্যবাদী সুলতান ছিলেন। সিংহাসনে বসেই তিন দিগ্বিজয় – নীতি গ্রহণ করেন। তিনি নতুন এক ধর্ম প্রবর্তনেরও উদ্যোগ নেন। যাহােক আলেকজান্ডারের মতাে বিশ্বজয়ের বাসনার বাস্তবায়ন না হলেও আলাউদ্দিন ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালান। সুতরাং, আলাউদ্দিনের সাম্রাজ্যবাদী নীতির মূল উদ্দেশ্য হিসেবে সমগ্র ভারতে সার্বভৌম রাজশক্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলা যেতে পারে। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আলাউদ্দিন একের পর এক যুদ্ধ শুরু করেন। প্রথমেই তিনি মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার দিকে মনােযােগ দেন। মােঙ্গলদের উপর্যুপরি আক্রমণের বিপরীতে ভারতের নিরাপত্তা বিধান সুলতান আলাউদ্দিনের রাজত্বের একটি অন্যতম কীর্তি। ইলতুৎমিশের আমল থেকে সুলতানি সাম্রাজ্যের সীমাকে বৃদ্ধি করার কোন চেষ্টা কোন সুলতান করেননি। আলাউদ্দিন খিলজী শুরুতেই তার পিতৃব্য জালালউদ্দিনের রাজত্বকালে দেবগিরি লুণ্ঠন করে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সাম্রাজ্যবাদী মনােভাবের পরিচয় দেন। তিনি তাঁর সাম্রাজ্য সম্প্রসারণকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করে পরিচালনা করেন। প্রথমে উত্তর ভারত এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ ভারত।
উত্তর ভারত অভিযান: গুজরাটঃ সিংহাসনে আরােহণের পর আলাউদ্দিন খিলজীর প্রথম অভিযান ছিল গুজরাট অভিযান। ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই অভিযান প্রেরণ করেন। গুজরাট ছিল খুবই সমৃদ্ধশালী অঞ্চল। বাঘেলা রাজপুত বংশীয় কর্ণদেব বা রায়করণ এ সময় গুজরাটের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আলাউদ্দিন তার দুই সেনাপতি নসরৎ খান ও উলুঘ খাঁকে গুজরাট জয়ের জন্য পাঠিয়ে দেন। রাজা কর্ণ আমেদাবাদের যুদ্ধে পরাজিত হন। রাণী কমলাদেবী সুলতানের সৈন্যদের হাতে বন্দি হন। অত:পর আলাউদ্দিন তাকে বিয়ে করেন। রাজা কর্ণ তাঁর কন্যা দেবলরানীসহ দক্ষিণে দেবগিরিতে পালিয়ে যান। আলাউদ্দিনের সৈন্যরা ক্যাম্বে বন্দর ও সােমনাথের মন্দির লুণ্ঠন করে প্রচুর ধনরত্নসহ দিল্লিতে ফিরে আসেন। ক্যাম্বেতে নসরৎ খান জনৈক খােজা মালিক কাফুরকে কিনেন এবং সুলতানকে উপহার দেন। পরে মালিক কাফুর আলাউদ্দিনের প্রধান সেনাপতি হন।
রণথম্ভোর অভিযানঃ ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন রণথম্ভোর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং আমীরদের সঙ্গে পরামর্শ করে যুদ্ধের সকল পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি উলুঘ খাঁ ও নসরৎ খানের নেতৃত্বে বিরাট সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। সেনাপতিদ্বয় রণথম্ভোর অবরােধ করেন। অবরােধ চলাকালে সেনাপতি নসরৎ খান অবরােধ কার্য পরিদর্শনের সময় হঠাৎ একটি গােলার আঘাতে আহত এবং কয়েকদিনের মধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হন। রণথম্ভোরের রাজা রাণা হাম্মীর প্রায় দুই লক্ষ সৈন্যের নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। উভয়পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে উলুঘ খাঁ অনেক ক্ষতি স্বীকার করে পশ্চাদপসরণ করেন। এই সংবাদ দিল্লি পৌঁছলে সুলতান নিজে রণথম্ভোরের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু পথে তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র আকাত খান তাঁকে অতর্কিত আক্রমণ করেন কয়েকজন অসন্তুষ্ট আমীরের প্ররােচণায় আকাত খান সুলতানকে হত্যা করে সিংহাসন দখলে অভিলাষী হন। সুলতান আহত হন যদিও তাঁর আঘাত গুরুতর ছিল না, আকাত খানকে তৎক্ষণাত হত্যা করা হয়। এছাড়াও সুলতানের বিরুদ্ধে অপর কয়েকটি বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়। কিন্তু সুলতানের সতর্কর্তার নিকট সকলেই নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এসব বিপদ কেটে গেলে সুলতান সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে রণথম্ভোর আক্রমণে মনােযােগ দেন। প্রায় এক বছর ধরে রণথম্ভোর দুর্গ অবরােধ করার পর দিল্লি বাহিনী দেওয়াল টপকিয়ে দুর্গ অধিকার করে। রাণা হাম্মীরকে পরিবার-পরিজনসহ হত্যা করা হয়। যে সকল সৈন্য শেষ পর্যন্ত বীরত্ব প্রদর্শন করে যুদ্ধ করে, তাদেরও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
চিতাের অভিযানঃ আলাউদ্দিন খিলজীর অন্যতম বিখ্যাত অভিযান ছিল চিতাের আক্রমণ। তিনি ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে রাজপুতনার সর্বশ্রেষ্ঠ রাজ্য মেবারের এই দুর্গ আক্রমণ করেন। চিতাের ছিল মেবার রাজ্যের রাজধানী। মেবারের রাজবংশ ‘শিশােদিয়া বংশ’ ছিল খুবই প্রাচীন ও সম্মানিত। চিতােরের রাণা রতন সিংহ আলাউদ্দিনের বশ্যতা স্বীকারের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে সুলতান চিতাের অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, চিতাের দুর্গ বিরােধী শক্তির হাতে থাকলে সুলতানি সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিপন্ন হবার আশঙ্কা ছিল। সুতরাং চিতােরের ওপর দিল্লির আধিপত্য স্থাপন করার উদ্দেশ্যে তিনি এক শক্তিশালী বাহিনী প্রেরণ করেন। চিতাের দুর্গটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ছিল। আলাউদ্দিন খিলজী বহু চেষ্টা করে সম্মুখ যুদ্ধে দুর্গ দখল করতে বিফল হন। রাজপুতরা বীরবিক্রমে সুলতানি বাহিনীকে হঠিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত আলাউদ্দিন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে দুর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলেন। প্রায় সাতমাস অতিবাহিত হওয়ার পর আর টিকতে না পেরে চিতাের রাজা রতনসিংহ আত্মসমর্পণ করেন। রতন সিংহ আত্মসমর্পণের পূর্বে রাজপুত রমণীরা অগ্নিকুন্ডে ঝাপ দিয়ে জহরব্রত পালন করে বলে কথিত আছে। প্রায় ত্রিশ হাজার রাজপুত সৈন্য নিহত হয়। কয়েকদিন চিতাের থাকার পর পুত্র খিজির খানকে চিতােরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে সুলতান আলাউদ্দিন দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন।
পদ্মিনী উপাখ্যানঃ আলাউদ্দিন খিলজীর চিতাের আক্রমণকে কেন্দ্র করে একটি সুন্দর উপাখ্যান প্রচলিত আছে। কথিত আছে যে, রাজা রতন সিংহ-এর সুন্দরী রাণী পদ্মিনীকে পাবার উদ্দেশ্যেই সুলতান আলাউদ্দিন চিতাের আক্রমণ করেন; কিন্তু অনেক বিশ্বাসঘাতকতার পরও সুলতান পদ্মিনীকে তাঁর হারেমে আনতে সক্ষম হননি। ষােড়শ শতকের মধ্যভাগে মালিক মুহাম্মদ জয়সী নামক এক কবি সর্বপ্রথম “পদ্মিনী উপাখ্যান” রচনা করেন এবং এরপর পদ্মিনী উপাখ্যান লােক সমাজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও মুসলমান সুলতানদের হিন্দু রমণীর পাণিগ্রহণ করার নজির আছে, বিশেষ করে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর হিন্দু রমণী বিয়ে করার প্রমাণও। আছে, তথাপি পদ্মিনী-উপাখ্যানের সত্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশও রয়েছে। সমসাময়িক কোন ইতিহাস গ্রন্থে এর উল্লেখ নেই। এমনকি আমীর খসরু, যিনি চিতাের অভিযানে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, তিনিও পদ্মিনী উপাখ্যানের উল্লেখ করেননি। আধুনিক কোন কোন পন্ডিত মনে করেন যে, পদ্মিনী উপাখ্যান একান্তই মালিক মুহাম্মদ জয়সীর কল্পনা-প্রসূত ভাবনার কাব্যিক রূপ মাত্র।
মালব জয়ঃ চিতাের অধিকারের পর সুলতান আলাউদ্দিন মালব আক্রমণ করেন। মালবের রাজা অনেক যুদ্ধ করেও পরাজিত হন এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। মালব জয়ের পর সুলতান সেখানে একজন মুসলমান শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এরপর সুলতান মান্ডু, উজ্জয়িনী এবং চান্দেরী ইত্যাদি এলাকা জয় করেন। এভাবে সমগ্র উত্তর ভারত সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর অধিকারে আসে।
দাক্ষিণাত্য অভিযানঃ উত্তর ভারত বিজিত হওয়ার পর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী দাক্ষিণাত্য বিজয়ের দিকে মনােনিবেশ করেন। দাক্ষিণাত্যের ভৌগােলিক অবস্থান এবং দিল্লি হতে দূরত্ব-এই উভয় কারণে দাক্ষিণাত্য বিজয় মুসলমানদের। জন্য একরূপ অসম্ভব ছিল। দক্ষিণে এই সময় চারটি হিন্দু রাজ্য ছিল, যেমন বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ-পশ্চিমে দেবগিরি রাজ্য; বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তেলেঙ্গনা বা বরঙ্গল রাজ্য অবস্থিত ছিল; কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে ছিল দ্বারসমুদ্র রাজ্য; সর্বদক্ষিণে ছিল পান্ড্যরাজ্য, এর রাজধানী ছিল মাদুরাই। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী তাঁর প্রিয় ক্রীতদাস মালিক কাফুরকে দাক্ষিণাত্য অভিযানে সেনাপতি নিযুক্ত করে পাঠান। দাক্ষিণাত্য যাওয়ার পথে মালিক কাফুর মালওয়া ও গুজরাট আক্রমণ করেন, বাঘেলারাজ। করণকেও পরাজিত করেন।
দেবগিরি জয়ঃ বিন্ধ্যের দক্ষিণে আলাউদ্দিন খিলজীর বাহিনীর সফলতা ছিল বিস্ময়কর। ১৩০৬-৭ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিনের সেনাপতি মালিক কাফুর দেবগিরির রামচন্দ্রদেবকে পরাস্ত করে দেবলাদেবীকে বন্দি করেন। আলাউদ্দিনের পুত্র খিজির খানের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। রামচন্দ্রদেব দিল্লিতে এসে বশ্যতা স্বীকার করেন এবং রায়-রায়ান উপাধি পান। অত:পর তিনি দক্ষিণে সুলতানি অভিযানের প্রধান সাহায্যকারীতে পরিণত হন।
তেলেঙ্গানা জয়ঃ দেবগিরি জয়ের পর মালিক কাফুর ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে তেলেঙ্গানা আক্রমণ করেন। দেবগিরির রামচন্দ্রদেব তাঁকে বহু রসদ দিয়ে সাহায্য করেন এবং তেলেঙ্গানা দুর্গে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেন। রাজা প্রতাপরুদ্রদেব তেলেঙ্গানা দুর্গে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে কাফুরের সৈন্যবাহিনী দুর্গ অবরােধ করে। রাজা রুদ্রদেব দুর্গের ভিতর আশ্রয় নিয়ে বিপুল বিক্রমে কাফুরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। অনেকদিন অবরুদ্ধ থাকার পর কাকতীয়রাজ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন এবং সন্ধির প্রস্তাব দেন। কিন্তু মালিক কাফুর এ প্রস্তাবে অসম্মতি জানান। কাফুর দাবি করেন যে, রাজা তার সম্পূর্ণ ধন-সম্পত্তি প্রদানসহ প্রতি বছর নিয়মিতভাবে দিল্লিতে কর পাঠাবার অঙ্গীকার করলে, তিনি ব্যাপক নরহত্যা করবেন না। মালিক কাফুরের শর্ত মেনে নেয়া ছাড়া রুদ্রদেবের কোন উপায় ছিল না। বিপুল ধন-রত্নসহ মালিক কাফুর দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করেন।
দ্বারসমুদ্র জয় দিগ্বিদিকে সুলতানি বাহিনীর উত্তরােত্তর সাফল্যে সুলতান আলাউদ্দিন বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠেন। দাক্ষিণাত্যের বিপুল ধনরত্ন তাঁকে লােভী করে তােলে। কৃষ্ণা নদী পার হয়ে ১৩১০ খ্রিস্টাব্দে কাফুরের নেতৃত্বে সুলতানি বাহিনী দ্বারসমুদ্র বা হােয়শল রাজ্য আক্রমণ করে। রাজা তৃতীয় বীরবল্লাল এই সময় দক্ষিণে পান্ড্যরাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। সুলতানি বাহিনীর আক্রমণের সংবাদ পেয়ে তিনি রাজধানী রক্ষার জন্য ছুটে আসেন। বীর পান্ড্যও একটি সেনাদল তাঁর সাহায্যের জন্য পাঠান। কিন্তু সুলতানি সেনাদলের সঙ্গে যুদ্ধ অর্থহীন বুঝে বীরবল্লাল যুদ্ধ ত্যাগ করেন। তিনি তাঁর বহু ধনরত্ন, ঘােড়া ও হাতি কাফুরের হাতে তুলে দেন। আলাউদ্দিনের বশ্যতা স্বীকার করে তিনি বার্ষিক কর প্রদানেও অঙ্গীকারাবদ্ধ হন।
পান্ড্যরাজ্য জয়ঃ অত:পর মালিক কাফুর মাদুরার পান্ড্য রাজাদের দিকে মনােনিবেশ করেন। মালিক কাফুর বিরাট সৈন্যবাহিনীসহ মাদুরা গমন করেন। তিনি পথে অনেক হাতি হস্তগত করেন এবং বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে পান্ড্য রাজ্যের রাজধানী মাদুরার নিকট পৌঁছান। সুলতানি বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে রাজা পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। এখানেও মালিক কাফুর হাতি-ঘােড়াসহ প্রচুর ধন-সম্পত্তি হস্তগত করেন। দিল্লিতে ফিরে আসলে সুলতান তাকে সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। দেবগিরির রাজা রামদেবের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শঙ্করদেব দিল্লিতে কর পাঠানাে বন্ধ করে দেন। সুলতান অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শঙ্করদেবকে শাস্তি দিতে মনস্থ করেন। আলাউদ্দিন মালিক কাফুরকে দেবগিরি আক্রমণ করতে পাঠান। ১৩১২ খ্রিস্টাব্দে মালিক কাফুর বিরাট সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে দেবগিরি অভিমুখে রওনা হন। শঙ্করদেব কাফুরকে বাধা দেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তিনি পরাজিত হলে মালিক কাফুরের নির্দেশে তাঁকে হত্যা করা হয়। এভাবে সুলতান আলাউদ্দিন সারা দাক্ষিণাত্য জয় করতে সমর্থ হন। উত্তর ভারতে সকল বিজিত রাজ্য আলাউদ্দিন সুলতানি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু দাক্ষিণাত্যে তিনি অবলম্বন করেন কিছুটা ভিন্ন নীতি। দক্ষিণী রাজ্যগুলাের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সেগুলােকে তিনি দিল্লির করদ রাজ্যে পরিণত করেন। সম্পূর্ণভাবে মুসলমান শাসন দাক্ষিণাত্যে প্রবর্তিত হয়নি। সুলতানের এই বদান্যতায় ও অনুগ্রহে সন্তুষ্ট হয়ে দক্ষিণী নৃপতিগণ তার মিত্রে পরিণত হন। এমনকি তারা সুলতানের অন্যান্য সামরিক অভিযানে সাহায্যও করেন।
সারসংক্ষেপঃ জালালউদ্দিন খিলজী হলেন প্রথম উল্লেখযােগ্য খিলজী পুরুষ। ‘খিলজী বিপ্লব’-এর তিনিও একজন অংশীদার। মােঙ্গলদের বিরুদ্ধে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। জালালউদ্দিনের ভ্রাতুস্পুত্র আলাউদ্দিন খিলজী হলেন শ্রেষ্ঠ খিলজী শাসক। নানাবিধ ঘটনার মধ্যদিয়ে ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহাসনে বসেন। আলাউদ্দিন ছিলেন যুদ্ধপ্রিয় এবং সাম্রাজ্যবাদী। ভারতের উত্তর ও দক্ষিণ উভয় অংশেই তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমরাভিযান পরিচালনা করেন। এগুলাের মধ্যে গুজরাট, রণথম্ভোর, চিতাের, মালব, দেবগিরি, পান্ড্যরাজ্য ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। আলাউদ্দিনের চিতাের অভিযানকে কেন্দ্র করে প্রচলিত ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ বিপুলভাবে জনপ্রিয়। দাক্ষিণাত্যে মূলত আলাউদ্দিন করদ রাজ্য সৃষ্টি করেন, কিন্তু উত্তরভারতে তার প্রত্যক্ষ শাসন প্রবর্তিত হয়।
আলাউদ্দিন খিলজীর সংস্কার ও আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বকালের বৈশিষ্ট্য
আলাউদ্দিন খিলজী ছিলেন তৎকালীন যুগের শক্তিশালী শাসকের এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ট। আলাউদ্দিনের রাজত্বকালের তিনটি বৈশিষ্ট্য স্থায়ী গুরুত্ব অর্জন করেছে। প্রথমত: দিল্লির মুসলমান শাসকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ভারতের বৃহত্তর অংশ নিয়ে একটি সাম্রাজ্য গঠন করেন। দ্বিতীয়ত: যে তুর্কি সাম্রাজ্য এতােদিন পর্য ছিল কেবল কতকগুলাে ‘সামরিক জায়গীর’ এর সমবায়, আলাউদ্দিন তার শাসনব্যবস্থায় কিছু পরিমাণে সংহতি সাধন করেন। তৃতীয়ত: আলাউদ্দিন রাষ্ট্রের সঙ্গে ইসলামি আইনের সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে নতুন বলিষ্ঠ নীতি প্রবর্তন করেন এবং সংস্কার কর্মসূচির দিক থেকে উলে-খযােগ্য অবদান রাখেন।
প্রশাসনিক সংস্কারঃ মধ্যযুগীয় রীতি অনুযায়ী রাজতন্ত্রের ওপর অভিজাত শ্রেণী এবং উলামাদের প্রভাব ছিল সর্বময়। আমীর, মালিক প্রভৃতি অভিজাত শ্রেণীর মানুষ ছিলেন রাজনৈতিক পদাধিকারবলে সুবিধাভােগী শ্রেণী এবং প্রবল কর্তৃত্বের অধিকারী। নব প্রতিষ্ঠিত দিল্লি সালতানাতের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির উৎসভূমি এই শ্রেণীর বিরুদ্ধাচরণ করার ক্ষমতা বা সাহস আলাউদ্দিন খিলজীর পূর্ববর্তী শাসকদের ছিলনা। বলবনও শ্রেণী হিসেবে অভিজাতদের মর্যাদা খর্ব করতে চাননি। কিন্তু আলাউদ্দিন খিলজী দৃঢ়ভাবে অভিজাত শ্রেণী এবং উলামাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অস্বীকার করে রাজতন্ত্রকে একটি নতুন মর্যাদা দেন। বলবনের মতাে সুলতান আলাউদ্দিনও শাসনকার্যে দক্ষতা ফিরিয়ে আনেন। তিনি নি:সন্দেহে সুচতুর সমরকুশলী ছিলেন এবং সমরকুশলতার সাথেসাথেশাসনকার্যেও সুচতুর ছিলেন। তিনি প্রথম হতেই কুচক্রী ও বিদ্রোহীদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন এবং তাদের মূলােৎপাটন করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি এদের দমন করার জন্য একাধিক আইন প্রণয়ন এবং কঠোরভাবে তা প্রয়ােগ করেন। আলাউদ্দিন খিলজী সুলতানের নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী ক্ষমতার তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই আত্মীয় পরিজন এবং রাজকর্মচারীদের উপর্যুপরি বিদ্রোহ তাঁকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তােলে। তিনি অনুভব করেন যে, প্রচলিত রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থার মধ্যেই বিদ্রোহাত্মক প্রবণতার বীজ লুকায়িত আছে। তিনি বিভিন্ন সময় আলােচনার মাধ্যমে সনাক্ত করতে সক্ষম হন যে, বিদ্রোহের চারটি সম্ভাব্য কারণের মধ্যে রয়েছে
- (১) প্রজাসাধারণের শুভাশুভ সম্পর্কে সুলতানের অজ্ঞতা;
- (২) অবাধ মদ্যপানের সুবাদে বিভিন্ন মানুষের একত্রিত হওয়া এবং মিত্রতাবদ্ধ হয়ে সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া;
- (৩) অভিজাতদের অবাধ মেলামেশা, পারস্পরিক আত্মীয়তা এবং পারিবারিক মিলনসূত্রে সুলতানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জোটবদ্ধ হওয়া; এবং
- (৪) জনগণের হাতে অধিক অর্থ সম্পদ সঞ্চিত হওয়া এবং সেই সূত্রে তাদের মনােবল বৃদ্ধি পাওয়া। এবং প্রচুর অবসরের সুযােগে “অলস মস্তিষ্ককে শয়তানের কর্মশালায়” পরিণত করা ইত্যাদি।
চারটি জরুরি নির্দেশনামাঃ উপযুক্ত কারণগুলাে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন খিলজী চারটি জরুরি নির্দেশনামা জারি করেন। প্রথমত: তিনি রাষ্ট্রপ্রদত্ত সমস্ত রকমের ধর্মীয় দান (ওয়াকফ), অনুদান (মিল্ক), উপহার (ইনাম) ইত্যাদি হিসেবে প্রদত্ত জমি অধিগ্রহণ করে ‘খালিসা’ জমিতে পরিণত করেন। ইতােপূর্বে ইনাম, মিল্ক, ওয়াকফ ইত্যাদি সূত্রে সম্পত্তি লাভ করার ফলে বহু পরিবার সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল। এমনকি আলাউদ্দিন খিলজীও সিংহাসনে আরােহণ করার সময় এসব খাতে বহু জমি দান করেন। অবশ্য দুএকটি ব্যতিক্রম ছিল। যেমন ইসামীর বংশধরদের প্রদত্ত দুটি গ্রাম ফিরিয়ে নেয়া হয়নি। তবে সামগ্রিকভাবে এই ব্যবস্থা অনেক পরিবারের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়। একই সঙ্গে আলাউদ্দিন তার কর্মচারীদের আদেশ দেন যে, আইন বাঁচিয়ে প্রজাদের কাছ থেকে যতাে বেশি সম্ভব অর্থ আদায় করে নেবার ব্যাপারে তারা যেন যত্নবান হন। আলাউদ্দিনের এই ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে দিল্লিতে মালিক, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, বণিক ও হিন্দু ব্যাংকারগণ ব্যতিত খুব কম লােকের হাতেই স্বর্ণ সঞ্চিত ছিল। ফলে জনসাধারণ জীবিকা অর্জনের জন্য সদাব্যস্ত থাকতে বাধ্য হয় এবং সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অবকাশ কমে যায়। দ্বিতীয়ত: আলাউদ্দিন খিলজী রাজ্যের গুপ্তচরবাহিনী পুনর্গঠন করেন। তিনি হাট-বাজার এবং অভিজাতদের আবাস থেকে সমস্ত ধরনের সংবাদ সংগ্রহ করে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তা সুলতানের কর্ণগােচর করার জন্য বারিদ, মুনহি, জাসুস নামক অসংখ্য গুপ্তচর নিয়ােগ করেন। গুপ্তচর ব্যবস্থার ব্যাপকতার ফলে অভিজাতগণ সর্বদা সংকুচিত ও সন্ত্রস্ত থাকতেন। এমনকি প্রকাশ্যে তাঁরা নিজেদের মধ্যে মতবিনিময়ের একান্ত প্রয়ােজন হলে মুখে না বলে আকারে ইঙ্গিতে তা ব্যক্ত করতেন। এ ব্যবস্থার ফলে ষড়যন্ত্রের সামান্যতম সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয়ত: আলাউদ্দিন খিলজী দিল্লিতে মদ্যপান ও মদ প্রস্তুত নিষিদ্ধ করেন। সরকার অনুমােদিত মদ প্রস্তুতকারকদের দিল্লি থেকে বহিষ্কার করা হয়। সুলতান স্বয়ং মদ্যপান ত্যাগ করেন এবং সমস্ত মদের বােতল বাদাউন গেটের সামনে এনে ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন। প্রচলিত আছে, এখানে এতাে মদ ঢালা হয়েছিল যে, বিস্তীর্ণ এলাকা বর্ষাকালের মতাে কাদায় পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য মদের চোরাই আমদানি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই নির্দেশ কিছুটা সংশােধিত করা হয়। বলা হয় যে, কোন ব্যক্তি একান্তভাবে নিজের গৃহাভ্যন্তরে আইনানুগভাবেই মদ প্রস্তুত করতে পারতেন। তিনি জুয়া খেলা সমানভাবে নিষিদ্ধ করেন। চতুর্থত: আলাউদ্দিন খিলজী অভিজাতদের মধ্যে অবাধ মেলামেশা, কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে আনন্দ সভায় একত্রিত হওয়া এবং সুলতানের অনুমতি ব্যতিত নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া নিষিদ্ধ করেন। বস্তুত, এই নির্দেশের ফলে সমাজ জীবনে বেশ পরিবর্তন সূচিত হয়। তবে অভিজাতদের গােষ্ঠীচক্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা এই নির্দেশে কিছুটা দূরীভূত হয়।
রাজস্ব নীতিঃ আলাউদ্দিন খিলজী প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মসূচির পাশাপাশি সংস্কারমূলক কর্মসূচিও রূপায়িত করার উদ্যোগ নেন। কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে রাজকোষের আয়ের প্রধান উৎস যে ভূমি রাজস্ব, এ বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি পূর্ববর্তী সুলতানদের নীতি পরিহার করেন এবং রাজস্ব ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রয়ােজন অনুভব করেন। কেবল রাজকোষকে সমৃদ্ধ করা নয়; রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, সামাজিক ন্যায়বিচার ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতেও তিনি রাজস্ব-প্রশাসনের কাঠামাের পরিবর্তনের গুরুত্ব অনুভব করেন। তিনিই প্রথম রাজস্ব ব্যবস্থায় উলে-খযােগ্যভাবে পরিবর্তন ঘটান। আলাউদ্দিন খিলজী সিংহাসনে আরােহণের সময় প্রচলিত ভুমি ব্যবস্থা অনুসারে কৃষিযােগ্য জমি কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। সুলতানের ‘খালিসা’ জমির রাজস্ব সরাসরি রাজকোষে জমা পড়তাে। ‘দেওয়ান-ই-উজিরত’ -এর অধীনে আমিল, কারকুন প্রমুখ কর্মকর্তা এই রাজস্ব সংগ্রহ করতেন। কিছু জমি ‘ইজারা’ হিসেবে ইদার বা মাতিরা ভােগ দখল করতেন। এই জমিকে বলা হতাে ইকতা। মাকতি জমির রাজস্ব সংগ্রহ করে ইত্যার ব্যয় বাদ দিয়ে উদ্বৃত্ত অংশ কেন্দ্রীয় রাজকোষে পাঠাতে বাধ্য ছিলেন। তবে এই সময়ে ইকতা প্রশাসন নানা অজুহাতে সমস্ত রাজস্বই ভােগ করতাে। খুৎ, মুকদ্দম, চৌধুরী নামধারী রাজস্ব সংগ্রাহকবৃন্দ ইত্যর রাজস্ব আদায় এবং কারচুপির কাজে জড়িত ছিলেন। স্বাধীন হিন্দু রাজাদের অনেকেই সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। এরা দিল্লির আনুগত্য স্বীকার এবং নিজ নিজ ভূখন্ড থেকে আদায়ীকৃত রাজস্বের নির্দিষ্ট অংশ সুলতানের কোষাগারে জমা দেবার শর্তে কিছু ভূমি ভােগ-দখল করতেন। এ ছাড়া কিছু জমি দান বা উপহার হিসেবে (মিল্ক, ইনাম, ওয়াকফ) জ্ঞানী বা ধার্মিক ব্যক্তিদের বরাদ্দ করা হয়েছিল। বহু সরকারি কর্মকর্তা বা অভিজাতও এরূপ জমি ভােগ দখল করতেন। রাজস্ব সংস্কার কর্মসূচি হিসেবে আলাউদ্দিন এক জাওবিৎ জারি করে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা, অভিজাত বা অন্যান্যদের হাতে বরাদ্দ মিল, ইনাম, ওয়াকভুক্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করে নেন। এগুলাে সুলতানের খালিসা জমির অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং সরকারি সংগ্রাহকদের মারফৎ সরাসরি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। হিন্দু-মুসলমান, সরকারি বেসরকারি নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর কাছ থেকেই এ ধরনের জমি কেড়ে নেয়া হয়। অত:পর আলাউদ্দিন গ্রামীণ রাজস্ব সংগ্রাহকদের দিকে নজর দেন। পূর্বরীতি অনুসারে খুৎ, মুকদ্দম ও চৌধুরীরা নির্দিষ্ট গ্রাম বা গ্রাম সমষ্টির রাজস্ব সংগ্রহ করে তা চুক্তি মতাে রাজকোষে জমা দিতেন। আলাউদ্দিন এ সব রাজস্ব-সংগ্রাহকদের গ্রামীণ-বৈভব ও অসাধুতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে কঠোরভাবে এদের দমন করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ এসব খুৎ, মুকদ্দম প্রমুখ মহার্ঘ পােশাক পড়তাে, ঘােড়ায় চড়ে শিকার করে বেড়াতাে, কিন্তু নিজেদের জমি থেকে এরা খারাজ, জিজিয়া, ঘরী, চরাই ইত্যাদি খাতে এক জিতলও রাজকোষে প্রদান করতাে না। অথচ এরা সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট জমি থেকে যথারীতি, অনেক ক্ষেত্রে বেশি, ‘খুতি’ আদায় করতেন এবং নিজেদের ভােগে লাগাতাে। ফলে সাধারণ চাষী শােষিত হতাে, কিন্তু সরকার উপকৃত হতেন না। এই অব্যবস্থা দূর করার উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন কয়েকটি সংশােধনমূলক আইন জারি করেন। আলাউদ্দিনের প্রথম জাওবিৎ অনুযায়ী চাষযােগ্য জমি জরিপ করে খুৎ, মুকদ্দম এবং বলহার বা সাধারণ কৃষককে একই হারে রাজস্ব প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়। রাজস্বের হার নির্দিষ্ট করা হয় উৎপাদনের ৫০ শতাংশ। দ্বিতীয় জাওবি অনুযায়ী ভূমি রাজস্ব ছাড়াও ‘ঘরী’ বা গৃহকর, চরাই বা পশুচারণ কর প্রবর্তন। করেন। ‘করহি’ নামের একটি করের উল্লেখ পাওয়া যায়, যদিও এর অর্থ সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা নি:সন্দেহ নন। গ্রামীণ মধ্যস্বত্বভােগীদের অস্তিত্ব লুপ্ত করার ফলে প্রশাসন পরিচালনার জন্য একদল সুদক্ষ সরকারি রাজস্ব কর্মকর্তার প্রয়ােজন হয়। আলাউদ্দিন এই কাজের জন্য মুহশিল (রাজস্ব-নির্ধারক), আমিল(করসংগ্রাহক), গােমস্তা (প্রতিনিধি), মুতাশরিফ (হিসাব-পরীক্ষক), দপ্তরী (অফিস কর্মী), নভীসদাস (করণিক) প্রমুখকে নিয়ােগ করেন। পাটোয়ারী বা গ্রামীণ হিসাব রক্ষকের কাছে সমস্ত দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়। আলাউদ্দিনের রাজস্ব-ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল জমির পরিমাপ বা জরিপ। সমগ্র রাজ্য জরিপের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলেও জমির পরিমাপের ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারণের রীতি প্রবর্তন করে আলাউদ্দিন খিলজী রাজস্বব্যবস্থাকে বিজ্ঞানসম্মত রূপ দেন। তিনিই সর্বপ্রথম জমি জরিপের রীতি প্রবর্তন করেন। আলাউদ্দিন রাজস্ব আদায় কাজে নিয়ােজিত অন্য কর্মীদের অসাধুতা বন্ধ করার বিষয়েও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। সুলতানের নির্দেশে গােমস্তা, মুতাশরিফ, মুহশিল প্রভৃতি রাজস্ব-কর্মচারীর ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার জন্য ‘দেওয়ান-ই-মুস্তাকরাজ’ নামে একটি স্বতন্ত্র দপ্তর খােলা হয়। কোন কর্মচারী তাঁর কাজে ফাঁকি দিলে কিংবা সংগৃহীত অর্থ রাজকোষে জমা না দিয়ে পুরােপুরি বা আংশিক আত্বসাৎ-এর চেষ্টা করলে তাদের ওপর কঠোর শাস্তি নেমে আসতাে।
আলাউদ্দিন তার রাজস্ব নীতির মাধ্যমে খুৎ, মুকদ্দম প্রমুখের শােষণ থেকে সাধারণ কৃষক বা বলাহারদের রক্ষা করেন। তবে আলাউদ্দিন একটি নির্দেশে বলেন যে, রাজস্ব এমনভাবে আদায় করতে হবে যাতে কৃষকের খাদ্যশস্য, দুধ, দই ইত্যাদির অভাব না হয়, আবার তাদের হাতে যেন অতিরিক্ত সম্পদও সঞ্চিত না হয়। তাঁর নীতি অনুসারে দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করতাে। কারণ দৈনিক খাদ্য-পানীয়ের অতিরিক্ত সঞ্চয় চাষীদের কাছে থাকতাে না, যা দিয়ে আপদকালীন অবস্থা তারা সামাল দিতে পারতাে। তথাপি ইতােপূর্বে কখনােই মােট উৎপাদনের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি রাজস্ব। হিসেবে আদায় করা হতাে না। কিন্তু আলাউদ্দিন এই হার ৫০ শতাংশে উন্নিত করেন। অনেক ঐতিহাসিক এই বৃদ্ধিকে সুস্থ অর্থনৈতিক চিন্তাপ্রসূত সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন না।
সামরিক সংস্কারঃ মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিরােধ, সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ও সুদক্ষ শাসনব্যবস্থা স্থাপনই আলাউদ্দিনের সুলতানি রাজতন্ত্রের চরম সাফল্য। তিনি বুঝেছিলেন, এই সাফল্য নির্ভর করে স্থায়ী এক সুদক্ষ সেনাবাহিনীর ওপর। তাই তিনি এক সুদক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে সামরিক বাহিনীর সংস্কারে তার সমস্ত শক্তি নিয়ােগ করেন।
আলাউদ্দিন খিলজীই দিল্লির প্রথম সুলতান, যিনি একটা স্থায়ী শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। দিল্লিতে সদা-সর্বদা যে-কোন প্রয়ােজনের জন্য এই স্থায়ী সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। তিনি এই বিশাল সুগঠিত ও সুসংহত সামরিক বাহিনীর জন্যই প্রায় বিশ বছর ধরে নিরঙ্কুশ একনায়কের মতাে বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনায় সক্ষম হয়েছিলেন। তাই আলাউদ্দিন পূর্ববর্তী সামরিক বিভাগের ত্রুটিগুলাে দূর করে সেনাবাহিনীকে নতুন পদ্ধতিতে সংগঠিত ও সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে, এক নতুন খিলজী সামরিক পদ্ধতির গােড়াপত্তন করেন।
সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের ও সংস্কারের জন্য ‘আরিজ-ই-মমালিক’ নামে সামরিক বিভাগের মন্ত্রীকে বিশেষ ক্ষমতা দেন। সামরিক বিভাগের মন্ত্রী প্রত্যক্ষভাবে প্রতিটি সৈন্য নিয়ােগ করতে থাকেন। প্রতিটি রাজকীয় বাহিনীকে একজন দক্ষ সামরিক অফিসারের কর্তৃত্বে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আলাউদ্দিনের সেনাবাহিনীতে দেহরক্ষী, অশ্বারােহী ও পদাতিক এই তিনটি বিভাগ ছিল। এই বাহিনীতে হিন্দু-মুসলমান উভয়কেই নিয়ােগ করা হতাে।
আলাউদ্দিন খিলজীর সেনাবাহিনীর গঠন ও ব্যবস্থাসমূহ মূলত তুর্কিদের সামরিক ব্যবস্থার আদর্শের ওপর গড়ে ওঠে। তবে তিনি জায়গীরের পরিবর্তে রাজকোষ থেকে সরাসরি নগদে সৈন্যদের বেতন দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তাঁর মােট ৪,৭৫,০০০ অশ্বারােহী সৈন্য ছিল। প্রত্যেক স্থায়ী সৈন্যকে বছরে ২৩৪ তঙ্কা বেতন দেয়া হতাে। তবে কোন অশ্বারােহী সৈন্য যদি দুটি ঘােড়া রাখতাে, তাদের ৭৮ তঙ্কা বেশি দেয়া হতাে। আলাউদ্দিন খিলজী সৈন্যবাহিনীতে দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য হুলিয়া ও দাগ প্রথার প্রচলন করেন। নিয়মিত সৈন্যরা যুদ্ধের সময় হাজিরা না দিয়ে অশিক্ষিত লােকদের বদলী হিসেবে পাঠাতাে এবং যুদ্ধের ভাল ঘােড়ার পরিবর্তে চাষের ঘােড়া পাঠাতাে। এই দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য তিনি হুলিয়া ব্যবস্থা দ্বারা খাতায় প্রতি সৈন্যের দৈহিক বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করেন। ঘােড়ার গায়ে লােহা পুড়িয়ে দাগ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
অর্থনৈতিক সংস্কার ও মূল্যনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাঃ আলাউদ্দিন খিলজী একজন সাম্রাজ্যবাদী শাসক ছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর বিরাট সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বিধানের জন্য বিরাট সৈন্যবাহিনী প্রয়ােজন। সুতরাং তিনি সৈন্যবাহিনী পুনর্গঠন করেন। বিশাল সৈন্যবাহিনীর পাশাপাশি আলাউদ্দিন খিলজীকে প্রায় ৫০ হাজার ক্রীতদাস কর্মচারীর ভরণপােষণ করতে হতাে। তিনি সৈন্যবাহিনীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতিও খেয়াল রাখতেন। অধিকন্তু, ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দের পর আলাউদ্দিন খিলজী বেশ কয়েকটি ব্যয়বহুল প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এ সব কারণে তাঁর বিপুল অর্থের প্রয়ােজন হয়। এদিকে দাক্ষিণাত্য জয়ের পর দিল্লিতে প্রচুর স্বর্ণ-রৌপ্যের আমদানির ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সৈন্যদের বেতন বৃদ্ধি করার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। যদিও তিনি রাজস্বের হার বৃদ্ধি করেন এবং দেবগিরি হতে বহু অর্থ সংগ্রহ করেন। কিন্তু হিসাব করে দেখা যায় যে বর্ধিত হারে বেতন দিলে পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে রাজকোষ শূন্য হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় তিনি উপলদ্ধি করেন যে, যদি জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তবে সৈন্যবাহিনীর প্রতিজনকে ২৩৪ টাকা হারে বেতন দিলেই চলবে। কারণ জিনিসপত্রের দাম কম থাকলে এই টাকায় সৈন্যরা তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে। আলাউদ্দিন খিলজী মূলত তাঁর বিশাল সৈন্যবাহিনীর স্বার্থেই মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রথার প্রচলন করেন। সুলতান আলাউদ্দিনের সময় যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতাে; স্বভাবতই যুদ্ধের সময় ব্যবসায়ীদের মালপত্র আনা নেয়ার বিশেষ অসুবিধা হতাে। মােঙ্গল আক্রমণের সময় মুলতানের শস্য-বিক্রেতারা দিল্লিতে আসতে পারতাে না এবং এই কারণে দিল্লির শস্যের বাজার প্রায়ই উর্ধ্বগামী থাকতাে। সুলতান এটি বিশেষভাবে অনুধাবন করেন এবং এই অসুবিধা দূর করার জন্য তিনি দুটি পন্থা অবলম্বন করেন। প্রথমত: তিনি দিল্লি ও এর আশেপাশে রাজকীয় শস্যভান্ডার নির্মাণ করে সেখানে খাদ্যশস্য মজুদ করতেন, যাতে অভাবের সময় কম মূল্যে ঐ খাদ্যশস্য বাজারে ছাড়া যায় এবং দ্বিতীয়ত: তিনি বাজারদরও নির্ধারণ করে দেন। অভাবের সময় তিনি খাদ্যশস্য বন্টন ও সীমিত করে দেন অর্থাৎ নির্ধারিত পরিমাণের বেশি কেউ ক্রয় করতে পারতাে। অবশ্য অন্যান্য সময়ে জনসাধারণ ইচ্ছামতাে কেনাবেচা করতে পারতাে। সুলতানের আদেশ মতাে খাদ্যশস্য রাজকীয় শস্যাগারে জমা করা হতাে। বিভিন্ন এলাকা হতে শস্য আমদানি করার জন্য ব্যবসায়ীদের অগ্রিম টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দোয়াব এলাকায় জমির খাজনাস্বরূপ শস্য আদায় করতে সুলতান নির্দেশ দেন। বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য-শস্য, কাপড়-চোপড়, ঘােড়া এবং অন্যান্য গৃহপালিত পশু, এমনকি দাসদাসীও বাজারদর নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতাভুক্ত হয়। এই আইন। যথাযথভাবে পালনের জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয় এবং আইন ভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই আইন যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কিনা তা তদারক করার জন্য সুলতান একটি বিশেষ গােয়েন্দা বাহিনী নিয়ােগ করেন। বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হয়। সকল ব্যবসায়ীকে রেজিস্ট্রি করা হয় এবং তাদের পরিবারের দিল্লিতে বসবাস বাধ্যতামূলক করা হয়। বাজারদর নিয়ন্ত্রণ এবং বাজার তদারক করার জন্য সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী ‘দিওয়ান-ই-রিয়াসাত’ এবং ‘শাহানা-ই-মন্ডি’ উপাধিধারী দুজন উচ্চপদস্থ অফিসার নিযুক্ত করেন। তাদের অধীনে আরও অসংখ্য নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারী নিযুক্ত করেন। তারা ঘুরে ঘুরে বাজার পরিদর্শন করতাে এবং আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতাে। সুলতান কর্তৃক আইন প্রণয়নের ফলে জিনিসপত্রের দাম কমে যায়। একটি প্রথম শ্রেণীর ঘােড়া ১০০ টাকা হতে ১২০ টাকায় পাওয়া যেতাে। একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর ঘােড়া ৮০ হতে ৯০ টাকায় এবং একটি ৩য় শ্রেণীর ঘােড়া ১০ হতে ২৫ টাকার মধ্যে পাওয়া যেতাে। একটি গাভীর দাম ছিল ৪ থেকে ৫ টাকা। অনুরূপভাবে সব ব্যবহার্য জিনিসের দাম কম ছিল। খাদ্যশস্যের দাম মণ প্রতি নির্দিষ্ট ছিল এবং কোন ব্যবসায়ীই তা অমান্য করতে পারতাে না। সুলতান নিজেও মাঝে মাঝে বাজার তদারক করতেন। তিনি কারও কারও মাধ্যমে বাজার দর পরীক্ষার জন্য বাজার থেকে জিনিসপত্র ক্রয় করাতেন। জিনিসপত্রের ওজন কম হলে বা দাম বেশি হলে সুলতান দিওয়ান ও শাহানাকে সতর্ক করে দিতেন এবং অপরাধীর বিচারের ব্যবস্থা। করতেন। আলাউদ্দিন খিলজী তার মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতিকে কার্যকরী করার জন্য মালিক কাবুলকে শাহানা-ই-মন্ডির দায়িত্ব দেন। এই সৎ কর্মচারীটি তার সহকারীদের সাহায্যে মূল্য তালিকা স্থির করতেন, ব্যবসায়ীদের নামধামের খবর রাখতেন এবং অশ্বারােহী সৈন্যের দ্বারা বিদ্রোহী কৃষকদের খাদ্য বিক্রি করতে বাধ্য করতেন। আলাউদ্দিন খিলজীর মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। মতভেদের প্রধান কারণ হলাে, সুলতান সারা সাম্রাজ্যে এই নীতি প্রবর্তন করতে পারেননি। এই নীতি শুধু দিল্লি এবং এর আশেপাশের জন্য প্রযােজ্য ছিল। ফলে অন্যান্য অঞ্চলে এটি বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল – এটাই স্বাভাবিক। কেননা কৃষক এবং ব্যবসায়ী তারা উৎপাদন এবং বাণিজ্য কার্য পরিচালনা করে থাকে অধিক লাভের আশায়। সঙ্গত কারণেই তারা ছিল ক্ষুব্ধ; তেমনি ভাবে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত জনগণও তুষ্ট ছিলনা এটাই স্বাভাবিক। কারণ দিল্লির অধিবাসীদের মঙ্গল সাধন করে সকল মানুষের মঙ্গল কামনা করা সুলতানের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তারপরেও মধ্য যুগের পরিস্থিতিতে আলাউদ্দিন খিলজীর ব্যবস্থা অভিনব ছিল সন্দেহ নেই। এই নীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি মুদ্রাস্ফীতি রােধ করতেও সক্ষম হন।
সারসংক্ষেপঃ দিল্লির মুসলমান শাসকদের মধ্যে আলাউদ্দিন খিলজী সংস্কারক হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। প্রশাসনিক দিক থেকে আলাউদ্দিন অভিজাত শ্রেণী এবং উলামাদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। তিনি ছিলেন সুলতানের নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী ক্ষমতায় বিশ্বাসী। তিনি চারটি জরুরি নির্দেশনাও জারি করেন। রাজস্ব ব্যবস্থায় উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন সাধন আলাউদ্দিনের অবদান। তিনি জমি জরিপ এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারি কর্মচারি নিয়ােগ করেন। এ কাজে তিনি কঠোর শাস্তিরও প্রবর্তন করেন। মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিরােধ, সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ও সুদক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই আলাউদ্দিনের সুলতানি রাজতন্ত্রের চরম সাফল্য। সামরিক বিভাগে তিনি কার্যকর সংস্কার সাধন করেন। তাঁর প্রবর্তিত হুলিয়া ব্যবস্থা ও দাগপ্রথা কার্যকর হয়। আলাউদ্দিন খিলজীর মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল এক অভিনব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অবশ্য এ ব্যবস্থার মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি রােধ করাও সম্ভব হয়েছিল।