লিখেছেনঃ সুরজিৎ দাশগুপ্ত
ভাষার জন্য প্রাণদান? পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য আত্মবলির ঘটনা খুবই বিরল। আমাদের জানা ইতিহাসের মধ্যে একমাত্র বাংলাভাষীরাই মুখের ভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছে। একবার নয়, বারবার তিনবার।
প্রথমবার ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি। সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সথা মনে রেখেই ১৯৫৩-র একুশে ফেব্রুয়ারি শান্তিনিকেতনে বসানো হয় আর এক ঐতিহাসিক সাহিত্যমেলা। সেখানে পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গ থেকে পাঁচজন সাহিত্যিক এসে মিলিত হন পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের সঙ্গে। পাঁচ বছর আগে যাঁরা অখণ্ড দেশে একত্রে ছিলেন তাঁদের মধ্যে আবার কোলাকুলি। পাকিস্তানি সরকার বাঙালি সাহিত্যিকদের এই শর্তে ভারতে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন যে তারা অন্য কোথাও যাবেন না, শুধু শান্তিনিকেতনেই থাকবেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের পরিকল্পনায় ও পৌরোহিত্যে পূর্ববঙ্গের মাটির বাইরে সেই প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপিত হয়। অবশেষে সাতচল্লিশ বছর পরে রাষ্ট্রসংঘ বাংলা ভাষার জন্য প্রাণদানের সেই একুশে ফেব্রুয়ারিকেই মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু বাংলাভাষার জন্য প্রাণদানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারিতেই শেষ হয়ে যায়নি। এটা এক আশ্চর্য ব্যাপার। এশিয়ার ভাষাগুলির মধ্যে বাংলাভাষার সাহিত্যিই প্রথম নোবেল পুরস্কার পেলেন, বাংলা ভাষার সাহিত্যই প্রথম বিশ্বখ্যাতি লাভ করে, ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং সেন্টার বিবিসি ১৯৪২ সালে প্রথম কোনও ভারতীয় ভাষার অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে বাংলা ভাষাতেই, অথচ এই বাংলা ভাষার কণ্ঠ রোধের চেষ্টাই হয়েছে বারবার।
কোথায় হয়েছে? যেখানকার সাহিত্য-সংস্কৃতি বাংলাভাষীদের সাহিত্য-সংস্কৃতির চেয়ে দুর্বল হলেও উর্দি বারুদে বলীয়ান। এখানে বরাক উপত্যাকার কথা বলছি। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান প্রজন্মের অনেক বাঙালিই হয়তো জানেন না যে, বাংলাদেশের। পূর্বে এককালে বাংলাভাষী অধ্যুষিত বিস্তৃত অঞ্চল ছিল, যা আজ অসম রাজ্যের অন্তর্গত হয়ে গেছে। এখানে একটু ইতিহাসচর্চা করলে ভালো হয়।
১৮২৬ সালে ইয়ানডাবার সন্ধির সূত্রে অসমে ব্রিটিশ শাসনের শুরু। তখনকার অসম ছিল কামরূপ, দরং, নওগাঁ, শিবসাগর ও লখিমপুর নিয়ে। ইংরেজরা কাছাড় অধিকার করে ছ’বছর পরে ১৮৩২ সালে, কিন্তু কাছাড়-শ্রীহট্ট তখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ছিল। ব্রিটিশ সরকার যে-অসম প্রদেশ গড়েছিল তার রাজস্ব ছিল অল্পই। তাই রাজস্ব বৃদ্ধির প্রয়োজনে ১৮৭৪ সালে ঢাকা বিভাগ থেকে ছিড়ে শ্রীহট্ট ও কাছাড়কে জুড়ে দেওয়া হল অসমের সঙ্গে এবং নবনির্মিত অসমের রাজধানী করা হল শিলঙে। অর্থাৎ ১৮৭৪ সাল উত্তর-পূর্ব ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর—
১) ইয়ানডাবার সন্ধির সূত্রে অধিকৃত অঞ্চলের সঙ্গে
২) বাংলাভাষী শ্রীহট্ট-কাছাড় যোগ করে
৩) শিলঙে রাজধানী স্থাপন করে ব্রিটিশ অসমের সৃষ্টি হল।
১৮৭৪ সালে গঠিত অসম প্রদেশের গঠনের রদবদল হয়েছে মধ্যে মধ্যে, বিশেষ করে গোয়ালপাড়া জেলাকে নিয়ে, এই জেলাকে কখনও বাংলার সঙ্গে আবার কখনও অসমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা সেসব খুঁটিনাটির মধ্যে না গিয়ে সরাসরি চলে আসি ১৯৩১-এর জনগণনার হিসেবে। সেখানে দেখতে পাচ্ছি যে সুরমা উপত্যকা অর্থাৎ শ্রীহট্ট কাছাড়ের জনসংখ্যার মধ্যে বাংলাভাষীদের সংখ্যা সাড়ে ২৮ লক্ষ, আর অসমীয়াভাষীদের সংখ্যার প্রায় ৪ হাজার এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা অর্থাৎ কামরূপ শিবসাগর ইত্যাদির জনসংখ্যার মধ্যে অসমীয়াভাষীদের সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষ, আর বাংলাভাষীদের সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ। ইচ্ছে করেই পার্বত্য জনজাতি ভাষাভাষীদের। প্রশ্নটাকে বাদ দিলাম। মহাযুদ্ধের কারণে ১৯৪১-এ জনগণনা হয়নি। যখন ১৯৫১ তে জনগণনা হল তখন দেখা গেল সমগ্র অসমে ১৯৩১-এর বাংলাভাষীর সংখ্যা। প্রায় ৪০ লক্ষ থেকে ১৯৫১-তে কমে গিয়ে হয়েছে প্রায় ১৭ লক্ষ আর অসমীয়াভাষীদের সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৯ লক্ষেরও বেশি। তাজ্জব! বাংলাভাষীর সংখ্যা হ্রাস হওয়ার একটা কারণ অবশ্য শ্রীহট্ট জেলার কুশিয়ারা নদীর পশ্চিমে অবস্থিত জেলার বৃহত্তর অংশই পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল, শুধু পূর্বতীরের। করিমগঞ্জ মহকুমার সাড়ে তিনটে থানা থেকে যায় ভারতে, এবং এই মহকুমাকে জড়ে দেওয়া হয় কাছাড়ের সঙ্গে। কিন্তু অসমিয়া বাঙালি জনবিন্যাসের ব্যাপারটা গালমেলে থেকেই যায়। আর জনগণনার প্রধান আর বি ভাগাইওয়ালা ১৯৫১-র সনসাস রিরোর্টের অষ্টম ভাগের ১১ পার্টে ব্যাপারটাকে শুধু বায়োলজিক্যাল মিরা C(biological miracle) বলেই ক্ষান্ত হননি, সেসঙ্গে মন্তব্য করেন, ‘The figures donot fail to reflect the aggressive linguistic nationalism now prevailing in Assam.’ তবে কি স্বাধীনতার সঙ্গে লুসাই পাহাড়, খাসি পাহাড়, নাগা পাহাড় প্রভৃতি নিয়ে গঠিত এক বিশাল অসম প্রদেশ গঠনের পরে যে জনগণনা হয় তার পেছনে বিপুল কারচুপি ছিল?
দুঃখের বিষয়, লুসাই পাহাড় নিয়ে যখন মিজোরাম, খাসি পাহাড় নিয়ে মেঘালয় ইত্যাদি গড়া হল তখন বাংলাভাষী কাছাড়-করিমগঞ্জ নিয়ে একটা রাজ্য’ গড়া হল, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাবাসীদের মর্জির খুঁটিতে বেঁধে রাখা হল বরাক উপত্যকাবাসীদের। মিজো, খাসি, নাগারা পার্বত্য জনজাতি, কিন্তু বাংলাভাষীদের তো পার্বত্য জনজাতি বলা যায় না। তাছাড়া যে কারণে ব্রিটিশরা এই বাংলাভাষী অঞ্চলকে অসমের সঙ্গে জুড়েছিল, অর্থাৎ অসমের ঘাটতি রাজস্ব পূরণ করার জন্য, সেই কারণটি তো তখনও বজায় ছিল, এখনও বজায় আছে। পশ্চিমবঙ্গের ও বাকি ভারতের বঙ্গভাষীদেরও কাছাড়-শিলচর করিমগঞ্জ সম্বন্ধে চেতনা বা বেদনা কোনও কিছুই নেই। এই প্রসঙ্গে এই অঞ্চলের বিশিষ্ট কবি দিলীপকান্তি লস্কর-এর লেখা একটি কবিতা এখানে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। কবিতাটি এই-
আমি কোথেকে এসেছি, তার জবাবে যখন বললাম :
করিমগঞ্জ, আসাম
তিনি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন : বাঃ, বেশ সুন্দর
বাংলা বলছেন তো!
একজন শিক্ষিত তথা সাহিত্যিকের যখন এই ধারণা, তখন
আমি আর কী বলতে পারি!
ওঁকে ঠিক জায়গাটা ধরিয়ে দিতে গিয়ে বললাম :
বাংলাভাষার পঞ্চদশ শহীদের ভূমিতে আমার বাস।
তিনি তখন এক্কেবারে আক্ষরিক অর্থেই
আমাকে ভিরমি খাইয়ে দিয়ে বললেন :
ও! বাংলাদেশ? তা-ই বলুন।
একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই। বেশিদূর আগের নয়, ১৯৪৭-এর পরের ইতিহাস। মাত্র ১৯৪৮ সালে কাছাড় জেলা কংগ্রেস কমিটি মণিপুর, ত্রিপুরা, মিজো অধ্যুষিত লুসাই পাহাড় এবং কাছাড় নিয়ে এক পূর্বাচল রাজ্য গড়ার প্রস্তাব দেয় দিল্লিতে। সবাই একমতও হয়। কিন্তু ১৯৪৯-এর ১ মে অর্থাৎ সংবিধান গৃহীত হবার আগেই দিল্লির ইচ্ছাক্রমে মণিপুর ও ত্রিপুরাকে কেন্দ্রীয় শাসিত রাজ্য করা হয়, পরিণামে। পুর্বাচল রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। অন্যদিকে অসমকে অসমিয়া প্রধান রাজ্য গড়ে তোলার জন্য ১৯৫০ থেকে বাংলাভাষীদেরকে বিদেশি অভিধা দিয়ে হামলা শুরু হয়। ওই হামলার প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৫১-র জনগণনার হিসেবে। গোপীনাথ বরদলোই সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই ‘অসম অসমিয়াদের জন্য’ (‘Assam is for Assemese.’ Shillong times 29 August 1947) আন্দোলনের ডাক দিয়ে আসছেন। তারও পরিণাম দেখা যায় ১৯৫১-র জনগণনায়। ইতিমধ্যে ১৯৫৩ সালে সৈয়দ ফজল আলিকে চেয়ারম্যান করে যে রাজ্য পুনর্গঠন আয়োগ গঠিত হয় তার ১৯৫৫ সালে প্রদত্ত প্রতিবেদনে বলা হয়— ‘a state should be treated as unlikingual only where one language group constitutes about 70 percent or more of its entire population.’ আমরা আগেই দেখেছি যে ১৯৫১তে জনগণনার ফল বিদেশি বিতাড়ন এবং অন্যান্য রহস্যময় কারণের ফলে কী হয়েছিল। এত সবের পরেও কিন্তু রাজ্যপুনর্গঠন আয়োগের ১৯৫৫-তে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নথিবদ্ধ করা হয় যে ‘the Assamese speaking population still constitutes only about 55 percent of the population of the state. Us নতুন অসম রাজ্য গঠিত হল অসমিয়া ভাষার ভিত্তিতে স্পষ্টতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। পশ্চিমবাংলায় যেমন বিধানচন্দ্র রায় তেমনই অসমে তখন গোপীনাথ বরদলোই।
দশ বছর বাদে বাদে জনগণনা। আবার ১৯৬১-তে জনগণনা হবে। এবারের জনগণনাতেও যদি অসমিয়াভাষীরা সমগ্র জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ হতে না পারে তা হলে অসমিয়াদের জন্য গঠিত অসম রাজ্যের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে রাজ্য পুনর্গঠন আয়োগই। তাই ১৯৬০ সালে আবার বিদেশি খেদাও আন্দোলন শুরু হল। তার প্রস্তুতি শুরু হয় ১৯৬০-এর ২১ ও ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত অসম প্রদেশ কংগ্রেসের রাজ্য সম্মেলনে। এখানে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র ভাষারূপে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হলে কাছাড়ের সদস্যগণ প্রস্তাবটির বিরােধিতা করেন। কিন্তু অসম কংগ্রেসে স্বভাবতই ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকার অসমিয়া সদস্যদের তুলনায় বরাক উপত্যকার বাঙালি সদস্যদের সংখ্যা কম ছিল। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই বাঙালিদের বিরোধিতাকে দাবিয়ে দিল অসমিয়ারা। সংখ্যালঘুতা ছাড়াও বরাক উপত্যকার ভৌগোলিক অবস্থান ছিল বিশেষ সঙ্গিন। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের সঙ্গে তার যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উপর নির্ভরশীল। ফলে ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকার অসমিয়াদের পক্ষে বরাক উপত্যকার বাঙালিদের কোণঠাসা করা সহজ হল। তবু ১৯৬০-এর ২ ও ৩ জুলাই শিলচরে অসম বঙ্গভাষাভাষী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল এবং তাতে মাতৃভাষার গৌরব ঘোষিত হল। তার জবাবে পরদিনই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় শুরু হল বাংলাভাষীদের উপর হামলা। তখন তার প্রতিক্রিয়াতে করিমগঞ্জে ৭ জুলাই নিশীথরঞ্জন দাসকে সভাপতি করে এক সম্মেলনে গঠন করা হল ছাত্র সংগ্রাম সমিতি। এই সমিতির আহ্বানে ১১ জুলাই ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকার বঙ্গাল খেদাও ও অসম রাজ্যে শুধু অসমিয়া ভাষা গ্রাহ্য এই সরকারি নীতির প্রতিবাদে করিমগঞ্জে বনধ পালিত হল। তারপর ১৬ জুলাই এক মহকুমাভিত্তিক ছাত্র সম্মেলনে সরকারের ভাষানীতির তীব্র সমালোচনা করে বক্তৃতা দেন নৃপতিরঞ্জন চৌধুরী, নিশীথরঞ্জন দাস, আবদুর রউফ প্রমুখ। এই আন্দোলন বরাক উপত্যকা জুড়ে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। এ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু শিলঙে এসে ১৮ জুলাই। এক প্রকাশ্য জনসভায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সংঘটিত হিংস্র বঙ্গাল খেদাও আন্দোলনের তীব্র নিন্দা করেন। কিন্তু শিলং পাহাড় তো আর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সীমান্তভুক্ত নয়, তা খাসি পাবর্ত্যজাতির বাসস্থানের প্রধান শহর। এবার প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস অনুসারে ১৮ আগস্ট অজিতপ্ৰসাদ জৈনের নেতৃত্বে এক সংসদীয় প্রতিনিধি দল আসে সরেজমিনে সমস্যার তদন্ত করার জন্য। এই সংসদীয় দলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাজ্যভাষা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানসূত্রের সন্ধানে ৫ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ এলেন শিলং পাহাড়ে। বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্য শুনে তিনি প্রস্তাব দিলেন যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমিয়া, পার্বত্যজাতিগুলি অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলে ইংরেজি এবং বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার প্রচলন ও ব্যবহারই বাঞ্ছনীয়। এই তিন ভাষার সূত্রের সঙ্গে তিনি যোগ করলেন যে মহাকরণ বা সচিবালয়ের কাজকর্ম হবে হিন্দি ভাষাতে। এইভাবে তিনি অসমের ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দিভাষার জন্য একটা সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করে দিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্থজির চার ভাষার সূত্র অনুসারে শেষ পর্যন্ত যে ব্যবস্থা বহাল হল তাতে কাছাড়ের জন্য সরকারি ভাষা হল বাংলা ভাষাই, কিন্তু মহকুমা পরিষদগুলির কাজকর্ম হবে অসমিয়া ভাষাতে। অর্থাৎ বাংলা হল সদরের ভাষা, কিন্তু অন্দরের ভাষা হবে অসমিয়া। এই বিলটি যখন ২৪ অক্টোবর বিধানসভায় গৃহীত হয়। তখন বিলটির প্রতিবাদে কাছাড়ের বদরপুর থেকে নির্বাচিত বিমলাপ্রসাদ চালিহা ও আবদুল মতলিব ছাড়া অন্য সব কংগ্রেসী সদস্য, পার্বত্য অঞ্চলের অধিকাংশ বিধায়ক, কাছাড়ের অকংগ্রেসী দুজন বিধায়ক, এমনকি অসমের কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীও সভাকক্ষ ত্যাগ করেন এবং বিলটি দিনভর বিতর্কের শেষে রাত বারোটায় ৫৬-০ ভোটে গৃহীত হয়।
১৯৬০ সালের ২৬ ডিসেম্বর শিলচরের কংগ্রেস ভবনে এক সভায় পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে ১৯৬১-র ১৫ জানুয়ারি এক সম্মেলন আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়। এই সম্মেলনটি হয় করিমগঞ্জে, তাতে সভাপতিত্ব করেন, নেতাজির সহকর্মী শীলভদ্র যাজি। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে অসমের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলাকে যদি স্বীকার না করা হয় তাহলে বাংলাভাষী বরাক উপত্যকাকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র শাসনতান্ত্রিক একক রূপে গঠন করা হোক। এই সিদ্ধান্তের জের টেনে ৫ ফেব্রুয়ারি হাইলাকান্দিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পুনর্ঘোষিত হয় : যদি এই অবিচারমূলক রাজ্যভাষা আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার ক্রমে বাংলাভাষাকে অন্যতম রাজ্যভাষা করিয়া অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাকেও যোগ্য মর্যাদা দানের ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ না করেন তবে কাছাড় জেলা ও প্রয়োজনবোধে অন্যান্য সংলগ্ন অনসমিয়াভাষী অঞ্চলকে আসাম রাজ্য হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া স্বতন্ত্র প্রশাসনিক সংস্থার স্বীকৃতি ঘোষণা করিতে হইবে। অবশ্য ইতিহাসবিদ ড. কামালুদ্দিন আহমদ মনে করেন যে বাংলাভাষার স্বীকৃতির জন্য দাবির বিকল্প হিসেবে আর-একটি দাবি তোলা ভুল হয়েছিল, শুধু বাংলার জন্য দাবিতেই লেগে থাকা উচিত ছিল। বিকল্প দাবিটার পরিণামে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা আন্দোলনটা থেকে বাদ পড়ে যায়, অথচ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলাভাষীদের সংখ্যা বরাক উপত্যকার তুলনায় বেশি ছিল।
যাহোক বরাক উপত্যকা সংগ্রাম পরিষদ থেকে ৫ফেব্রুয়ারি যে ঘোষণা করা হয় তাতে দুটি অংশ ছিল—প্রথমাংশে বলা হয়েছিল যে ১৩৬৭ বঙ্গাব্দের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিলের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে ঘোষণাটির দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছিল ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ অর্থাৎ ১৯৬১-র ১৫ এপ্রিল থেকে অসহযােগ আন্দোলন শুরু করা হবে। ঘোষণা অনুযায়ী প্রথমাংশের দাবি পূরণগ হওয়ার ফলে দ্বিতীয়াংশের কার্যক্রম শুরু হয়। এক মাস ধরে অসহযোগ আন্দোলন যদি কোনও ফল না দেয় তাহলে কী করা হবে? এর উত্তরে ২ মে করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত এক সভাতে ঘোষণা করা হল যে ১৯ মে বরাক উপত্যকায় সর্বাত্মক ধর্মঘট ও পূর্ণ হরতাল পালন করা হবে। এই সময় গান্ধিশিষ্য বিনোবা ভাবে অসম সফরে আসেন। দুর্ভাগ্যের কথা, অসমের জন্য শুধু অসমিয়া ভাষার দাবিকেই ন্যায্য দাবি বলে ঘোষণা করে বাঙালিদের উন্নাসিকতা বর্জনের উপদেশ দিয়ে তিনি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি বিতাড়নের হিংসাত্মক কর্মসূচিকে উৎসাহ দেন। পক্ষান্তরে ১৯ মে নিকটবর্তী হলে দিল্লি থেকে নিখিল ভারত কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি ১৬মে এক টেলিগ্রাম মারফত কংগ্রেস কর্মীদেরকে বাংলাভাষার জন্য আন্দোলনের থেকে দূরে থাকার নির্দেশ পাঠান। এর ফলে বরাক উপত্যকার কংগ্রেস কর্মীরা আপন কর্তব্য সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। একদিকে প্রশাসনের প্রশ্রয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় চলছিল বাংলাভাষীদের উপর হামলা—যা নিয়ন্ত্রণের কোনও চেষ্টা দিল্লির কর্তারা করেননি, অন্যদিকে প্রশাসন তৈরি হচ্ছিল ১৯মে আন্দোলনকারীদের মোকাবিলা করার জন্য। তার জন্য প্রশাসন ১৮মে মাঝরাতে হঠাৎ হানা দিয়ে আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তার করেছিল। সেদিন বিকেলে শিলচরের নরসিংহটোলার মাঠে এক বিশাল জনসমাবেশ হয় এবং সভাশেষে হাজার হাজার মানুষ মশাল মিছিল বের করে শহর পরিভ্রমণ করে। ওই সভা এবং মিছিলের আড়াল দিয়ে নৃপতিরঞ্জন চৌধুরী, নিশীথরঞ্জন দাস, পরিতোষ পালচৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ পুলিশের নজর এড়িয়ে গা ঢাকা দেন যাতে প্রশাসন তাদের নাগাল না পায়। কিন্তু তাঁরা গা ঢাকা দিলেও বহু নেতাকে ১৮ মে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়। সেই রাত্রেই প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে।
অবশেষে ঐতিহাসিক ১৯ মের সূর্যোদয়। শত শত মানুষ ১৪৪ ধারা ভেঙে বেরিয়ে পড়ল পথে পথে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শত শত মানুষের মিছিল পরিণত হল হাজার হাজার মানুষের বিপুল জনজোয়ারে। বন্ধ ও ধর্মঘটকে বাস্তব রূপ দেওয়ার কাজ শুরু হল প্রবল উদ্দীপনাতে। সবার মুখে মুখে উদ্দীপ্ত ঘোষণা—জান দেব, তবু জবান দেব না’, ‘আমার ভাষা তোমার ভাষা, বাংলা ভাষা, বাংলাভাষা’, ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’, ‘ভাষা জননী ডাকে ওই, মাভৈ-মাভৈ’। অসমের পুলিশ বাহিনীও শুরু করল তাদের কাজ হাতের নাগালে যাকে পেল তাকেই গ্রেপ্তার। সঙ্গে সঙ্গে চালাল বুটের লাথি, বন্দুকের বাঁট দিয়ে মার। শত শত সত্যাগ্রহী জখম। তবু শিলচর ও করিমগঞ্জ স্টেশনে ট্রেনের চাকা বন্ধ থাকল। প্রশাসন যন্ত্রের সবচেয়ে দৃশ্যমান শব্দময় শক্তিশালী প্রতীক হল ট্রেন। সেই ট্রেনকে অচল করে দেওয়াতে প্রমাণ হয়ে গেল প্রশাসনের ব্যর্থতা। করিমগঞ্জ ও শিলচরের পথে পথে যখন চলছে পুলিশের গ্রেপ্তারি অভিযান আর নৃশংস নির্যাতন তখন প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করার জন্য বেলা আড়াইটা নাগাদ সত্যাগ্রহীদের উপর গুলি চালাল আধা সামরিক বাহিনী। শহিদের মৃত্যুবরণ করলেন সবে স্কুলফাইনাল পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসা ১৬ বছরের মেয়ে কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্রমোহন পাল, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, তরণী দেবনাথ, কুমুদ দাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, সুনীল সরকার, বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সত্যেন্দ্র দেব। স্বাধীন দেশের মাটিতে বাংলা ভাষার জন্য এই এগারোজনই প্রথম প্রাণ দিয়েছেন। যে-ভাষার কবি এশীয়দের মধ্যে প্রথম বিশ্বখ্যাতি পেয়েছেন, স্বাধীন ভারতের জাতীয় সংগীত রচনা করেছেন যিনি, তার শতবর্ষেই তাঁর ভাষার উপরে এই জঘন্য আক্রমণ!
এই হত্যাকাণ্ডে বরাক উপত্যকার মানুষ দুঃখে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। ফলে জারি হল কারফিউ। কারফিউ ভেঙে রাস্তায় আছড়ে পড়ল উত্তাল ক্রুদ্ধ জনতার ঢেউ। ফলে প্রত্যাহৃত হল কারফিউ। ২৯ মে শিলঙে অনুষ্ঠিত হল নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সমিতির এক বিশেষ সভা, যেখানে ৪ জুনকে সমস্ত অসম জুড়ে দাবি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরদিন ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এলেন শিলঙে। কারণ ১৯ মে-র প্রশাসনিক কাণ্ড সমগ্র পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের আকাশে দুর্যোগের মেঘ হয়ে উঠছিল। লালবাহাদুর শাস্ত্রী ৪ জুনের কর্মসূচি বাতিল করার জন্য অনুরোধ করলে ১ জুন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বঙ্গভাষাভাষী সমিতি ওই কর্মসূচি মূলতুবি রাখার কথা ঘোষণা করে। শাস্ত্রীজির সূত্র অনুসারে বাংলা। ভাষাকে বরাক উপত্যকার প্রশাসনের সর্বস্তরে অর্থাৎ সদরে ও অন্দরে সরকারি ভাষাহিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হল। আর গুয়াহাটি হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস গোপালজি মেহরোত্রাকে দিয়ে ১৯ মে-র ঘটনাবলি সম্বন্ধে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত আয়োগ গঠিত হল। তবে প্রকাশ থাকে যে ওই মেহরোত্ৰা কমিশনের তদন্তের প্রতিবেদন অদ্যাবধি প্রকাশ পায়নি। শোনা যায়, ওই প্রতিবেদনে প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা ছিল।
লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আগমনের আসল উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনের উপরে জল ঢালা অর্থাৎ পালের হাওয়া কেড়ে নেওয়া। সুতরাং ১২ জুন শিলচরে নন্দকিশোর সিংহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি এই তিন জেলার তিন কংগ্রেস কমিটি এবং ভাষা আন্দোলনের কমিটি মিলিতভাবে শাস্ত্রীসূত্র প্রত্যাখ্যান করে। তখন দিল্লি থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভাষা সংগ্রামীদের এক প্রতিনিধি দল গঠন করে দিল্লিতে আরও আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠায়। ১৬ জুন এক জরুরি বৈঠকে ওই প্রতিনিধি দলে কে কে থাকবেন তা স্থির করা হয়। বারো সদস্য বিশিষ্ট দলটি ১ জুলাই দিল্লিতে পৌঁছে ২ ও ৩ জুলাই দুদিন ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাস্ত্রীজির সঙ্গে সমস্যাটা নিয়ে পর্যালোচনা ও সমাধান সূত্র সন্ধান করে। কিন্তু তোড়জোড়ই সার হল, কাজের কাজ কিছু হল না। বরং অসম প্রদেশে কংগ্রেস থেকে বরাক উপত্যকার কংগ্রেসি সদস্যদের উপরে দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযোগ আনা হল। অসম প্রদেশ কংগ্রেসের ভেতরেই বিবাদ-বিভাগ দেখা দিল। শেষ ১৪ অক্টোবর অসম বিধানসভায় রাজ্যভাষা সংক্রান্ত সংশোধনী বিলটি গৃহীত হয় ও আইনে পরিণত হয়। এই আইনের ফলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জন্য অসমিয়াই সরকারি ভাষা থেকে গেল আর বরাক উপত্যকার জন্য অসমিয়া ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষাও পেল সরকারি স্বীকৃতি। অথচ বরাক উপত্যকার চেয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলাভাষীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু এই ঘটনাক্রম থেকেই জন্ম নিয়েছে উনিশের চেতনা এবং উনিশের উত্তরাধিকার। ফলে ভাষার প্রশ্নে বরাক উপত্যকায় একটা অসন্তোষের আবহ জেগেই থাকল।
দশবছর পরে আবার ভাষার প্রশ্নটিকে অসম সরকার খুঁচিয়ে জাগাল গুয়াহাটি ও ডিব্ৰুগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম সম্বন্ধে এক নতুন ফরমান বা সার্কুলার জারি করে। ফরমানটা এই যে এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যমকে, কার্যত সমস্ত অসম রাজ্যের শিক্ষার মাধ্যমকে, দশ বছরের মধ্যে ইংরেজি থেকে একমাত্র অসমিয়াতে নিয়ে আসতে হবে। আবার অসমিয়া ভাষার রাজ প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে জেগে উঠল বরাক উপত্যকা এবং সেই সঙ্গে জেগে উঠল কার্বিআংলং, কোকরাঝাড় প্রভৃতি জেলাও। এই আন্দোলন দমন করার জন্য পুলিশের চালানো গুলিতে ১৯৭২ এর ১৭ আগস্ট নিহত হলেন বিজন চক্রবর্তী, যিনি বাচ্চু নামে সবার প্রিয় ছিলেন।। তা হলে বিজন বা বাচ্চু হলেন স্বাধীন ভারতের মাটিতে দ্বাদশ ভাষা শহিদ। কিন্তু অসমিয়া ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে যাদের কোনও সম্পর্ক নেই, শুধু অসমিয়া ভাষা নিয়ে রাজনীতি করাতেই যাদের আগ্রহ তথা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করাই যাদের লক্ষ্য তারা বাংলা ভাষার জন্য বারোজনকে হত্যা করেও সন্তুষ্ট হল না। কংগ্রেসকে হটিয়ে অসম গণপরিষদ ১৯৮৫-তে ক্ষমতায় এসেই ভাষার আবেগে হাওয়া দিতে শুরু করল। ধুলো ঝেড়ে খুঁজে বের করল একমাত্র অসমিয়া ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার জন্য সেবা সার্কুলারের ফাইল। আবার উত্তপ্ত বাতাস বইতে লাগল ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকায়। যখন জানা গেল যে ১৯৮৬-র ২১ জুলাই অসম গণপরিষদের নেতা ও অসমের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লকুমার মহন্ত, করিমগঞ্জে এসে বরাক উপত্যকা পরিক্রমা শুরু করবেন তখন ১৭ জুলাই কংগ্রেসের কার্যালয়ে এক সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হয়। সভার বৃহত্তর অংশ স্থির করেন যে ওইদিন শহরের দোকানবাজার বন্ধ রাখা হবে এবং সার্কিট হাউসে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো হবে।
২১ জুলাই সকাল ৯টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লকুমার মহন্ত সার্কিট হাউসে এসে পৌঁছলেন। চারদিকে সশস্ত্র পুলিশের কঠিন পাহারা। সত্যাগ্রহী জনতার একাংশ সরকারি স্কুলের মাঠে, একাংশ রেডক্রস রোডে, একাংশ ট্রেজারির সম্মুখে সমবেত হয়েছে। মাধবেন্দ্র দত্ত চৌধুরীও ছিলেন সত্যাগ্রহীদের একজন। তার সাক্ষ্য থেকে জানতে পাই যে জনতাকে একজন পুলিশের প্রতি পাথর ছোঁড়ার জন্য উত্তেজিত করছিল ও নিজেও পাথর ছুঁড়ছিল। ট্রেজারির সামনেই পুলিশ-জনতার খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়। এখানেই পুলিশ বেষ্টনী ভেঙে পড়ে। জনতা যখন সার্কিট হাউস থেকে প্রায় তিনশো মিটার দূরে পৌছয় তখন পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হন জগন্ময় দেব, যাঁর ডাকনাম ছিল জগন আর দিব্যেন্দু দাস—যাঁর ডাকনাম ছিল যিশু। পরে মাধবেন্দ্রবাবু থানার লকআপে থাকাকালে দেখতে পান যে, যে-লোকটিকে তিনি পাথর ছুঁড়তে ও জনতাকে। উত্তেজিত করতে দেখেছিলেন সেই সত্যাগ্রহীদের নাম-ঠিকানা বলে দিচ্ছে পুলিশকে। আর মুখ্যমন্ত্রী গোপনে ফকিরাবাজার-গান্ধাই-পাথারকান্দির পথে করিমগঞ্জ ছেড়ে চলে যান। কারফিউ জারি হল করিমগঞ্জে। জবরদস্ত পুলিশ পাহারায় জগন্ময় ও দিব্যেন্দুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় করিমগঞ্জ শ্মশানে। তাদের দুজনকে নিয়ে অসম রাজ্যে বাংলা ভাষার জন্য শহিদের সংখ্যা দাঁড়াল চোদ্দো।
আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য প্রাণদানের ঘটনা শুধু বাঙালিরাই দেখিয়েছে। ভাষাশহিদ—এই শব্দটা শুধু বাঙালিদের সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। কথাটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এই ছোট্ট লেখা। ‘যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই শয়নে স্বপনে।’
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।