বাংলা গদ্য সাহিত্যের অঙ্গনে চলিত গদ্যের পথিকৃৎ বলা যায় ‘সবুজপত্র’র (১৯১৪) সম্পাদক ‘বীরবল’ খ্যাত প্রমথ চৌধুরীকে (১৮৬৮-১৯৪১)। তার সুযােগ্য বাহক ছিলেন ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলি (১৮৯০-১৯৫১)। তার পূর্ণ নাম শেখ ওয়াজেদ আলি (অপর খ্যাতনামা প্রবন্ধকার মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলির নামের সঙ্গে তাঁর নাম যাতে মিশে না যায় সেজন্য এমন নামকরণ)। তিনি উল্লেখযােগ্য সাহিত্যচর্চা করেছেন, বিশেষ করে প্রগতিবাদী প্রবন্ধকার হিসেবেই তার খ্যাতি। তাঁর প্রগতিবাদিতা অবশ্য এই সীমাবদ্ধ অর্থে যে, তিনি অতীতমুখীনতা এবং সাম্প্রদায়িকতার সীমানা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতে চল্লিশের দশকে যাঁদের বলা হত জাতীয়তাবাদী মুসলমান, অর্থাৎ পাকিস্তান আন্দোলনের বিরােধী।
যুক্তিবাদী মননশীল শিল্পী এস ওয়াজেদ আলির জন্ম হুগলি জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার জনাই-এর বড়তাজপুরে ৪ সেপ্টেম্বর ১৮৯০ সালে। পিতা সেখ বেলায়েত আলি, মাতা খাদিজা বেগম—অত্যন্ত মেধার অধিকারিনী ছিলেন। ব্যবসার কারণে শিলং-এ বসবাসের দরুন ১৮৯৮ সালে সেখানকার মােখার ইংরেজি মাধ্যমের হাইস্কুলে ভর্তি হন ওয়াজেদ আলি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত এই স্কুল থেকে তিনি ১৯০৬ সালে স্বর্ণ পদক পেয়ে এনট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন। ১৯১০-এ এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. পাশ করেন। ১৯১২-তে ইংল্যাণ্ড যাত্রা। ১৯১৫-তে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বার অ্যাট ল হন এবং পুনর্বার বি এ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯১৫-এ ইংল্যাণ্ড থেকে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯২৩-এ কলকাতা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন এবং ওই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালে। ১৯২৫-এ ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৭-এ পদত্যাগ করেন। ১৯৩২-এ সচিত্র ‘গুলিস্তা’ (বাংলা) পত্রিকা প্রকাশ করেন। বাংলার পাশাপাশি তিনি ইংরেজি রচনায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ১৯১৯ সাল থেকেই তিনি ‘বুলেটিন অফ দ্য ইন্ডিয়ান রেশনালিস্টিক সােসাইটি’ নামে ইংরেজি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন। এছাড়া ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায়ও তার উৎকৃষ্ট রচনা প্রকাশিত হত।
প্রমথ চৌধুরী ওয়াজেদ আলিকে ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকায় বাংলা সাহিত্য চর্চায় আহ্বান জানান। বস্তুত প্রমথ চৌধুরীর উপদেশ, বন্ধু এস খােদাবক্স ও সৌরীন্দ্রমােহন মুখােপাধ্যায়ের (১৮৮৪-১৯৬০) প্রেরণাতেই তিনি ইংরেজি ছেড়ে বাংলার চর্চা শুরু করেন। ওয়াজেদ আলির সৃজনশীল প্রতিভা আত্মপ্রকাশের নেপথ্যে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের (১৮৯৩-১৯৭৪) অবদানও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, তিনিই এস ওয়াজেদ আলিকে ধরে বেঁধে বাংলা শিখিয়েছেন। ওয়াজেদ আলির প্রথম রচনা ‘অতীতের বােঝা’ ‘সবুজপত্রে’-ই প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ সালে ইসলাম দর্শন’ পত্রিকায় ওয়াজেদ আলির প্রথম ছােটোগল্প ‘রাজা’ প্রকাশিত হয়। তারপর বঙ্গবাণী, সওগাত, ইসলাম দর্শন, সবুজপত্র, সাহিত্যিক, ভারতবর্ষ, প্রবাসী, ভারতী, নওরােজ, মােহাম্মদী, গুলিস্তা, বুলবুল, বিচিত্রা প্রভৃতি সাময়িক পত্রে তার একের পর এক রচনা প্রকাশিত হতে থাকে। এই রচনাগুলি মূলত ১৩৩২ থেকে ১৩৫৪ পর্যন্ত সময়কালে রচিত।
এস ওয়াজেদ আলির উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলি প্রবন্ধ গ্রন্থ- ইকবালের ‘পয়গম’ (১৯৩২), ‘জীবনের শিল্প’ (১৯৪১), ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’ (১৯৪৩), ‘ভবিষ্যতের বাঙালী’ (১৯৪৩), ‘ইসলামের ইতিহাস’, ‘আকবরের রাষ্ট্র সাধনা’ (১৯৪৯), ইবনে খালদুনের ‘সমাজ বিজ্ঞান’ (১৯৪৯), ‘মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ’, ‘সভ্যতা ও সাহিত্যে ইসলামের দান’ (১৯৪৮), গল্পগ্রন্থ- ‘গুলদাস্তা (১৯২৭), ‘মাশুকের দরবার’ (১৯৩০), ‘দরবেশের দোয়া’ (১৯৩২), ‘ভাঙাবাঁশি’, ‘গল্পের মজলিশ’ (১৯৪৪), শিশুতােষ গ্রন্থ ‘বাদশাহী গল্প’ (১৯৪৪), ‘ইরান তুরানের গল্প’ (১৩৫৯), ‘আল্লাহর দান’, ‘খেয়ালের ফেরদৌস’, নাটক-‘সুলতান সালাদিন’। উপন্যাস-‘গ্রানাডার শেষ বীর’ (১৯৪০), ভ্রমণ গ্রন্থ- ‘মােটরযােগে রাঁচির সফর’ (১৯৪৯), ‘পশ্চিম ভারতে’ (১৯৪৮) প্রভৃতি। এসব গ্রন্থে সমাজ, রাষ্ট্র, জাতি, ধর্ম, সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে এস ওয়াজেদ আলির পূর্ণাঙ্গ মানস রূপটি ধরা পড়ে।
(১)
এস ওয়াজেদ আলি অখণ্ড বঙ্গেই লেখালেখি বেশি করেছেন। পরে পশ্চিমবঙ্গে থেকে অল্পই লিখেছেন। অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক মনের মানুষ ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মনেপ্রাণে ছিলেন নজরুলপন্থী, কিন্তু বিদ্রোহী নন। আধুনিক, দৃষ্টিভঙ্গিতে উজ্জ্বল, কোথাও পক্ষপাতদুষ্ট গোঁড়ামি নেই। প্রবন্ধ যেমন পাণ্ডিত্যপূর্ণ তেমনি সরস। যুক্তি প্রাণতার সঙ্গে মিশেছে সরসতা। ওয়াজেদ ভেবেছেন ভবিষ্যৎ বাংলার কথা। লিখেছেন ‘ভবিষ্যতের বাঙালী’ নামক প্রবন্ধ-গ্রন্থ। এই গ্রন্থে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় জীবন, নাগরিক জীবন, ধর্মীয় জীবন, শিক্ষা জীবন ও বাঙালি সমাজ জীবনের সামগ্রিক রূপ বিধৃত হয়েছে। এখানে লেখক হিন্দু-মুসলমানের মিলনে এক জাতি গড়ে তােলা যায় কিনা, সে সম্বন্ধেও নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি ভবিষ্যতের বাঙালী’ গ্রন্থের ‘প্রেমের ধর্ম’ প্রবন্ধে বলেছেন,
“আমি এক শতাব্দী পরবর্তী যে বঙ্গদেশের স্বপ্ন দেখি তা বর্তমানের ধূলি ধূসরিত, বন-জঙ্গল-আগাছা সমাকীর্ণ, শ্রীহীন, সৌন্দৰ্য্যভ্রষ্ট ঘর বাড়িতে ভরা হত-গৌরব নদ-নদীর খাতের দাগে কলঙ্কিত বঙ্গদেশ নয়। আমি শতাব্দী পরের যে বাঙালী জাতির স্বপ্ন দেখি—সে বর্তমানের ক্ষীণকায়, মাংসপেশীহীন, রােগ-বিশীর্ণ, অনশন ক্লিষ্ট, গতী, আনন্দহীন, প্রেরণাহীন, কলহপ্রিয় বাঙালী জাতি নয়। আমি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দেখি তাতে কেরানি সৃষ্টির ‘আগ্রহ নাই’, গোঁড়া হিন্দু-মুসলমান সৃজনের উকট প্রয়াসও নাই, অতীতের প্রাণহীন দেহগুলি সাজিয়ে রাখবার যাদুঘর সে প্রতিষ্ঠান নয়।”
শতবর্ষ পরে কী চান তাও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন,
“আমি যে ভবিষ্যৎ বঙ্গদেশের কল্পনা করি, তাতে মজা নদীর এবং শুষ্ক খালের খাতে প্রচুর জলপ্রবাহের অশ্রান্ত কলধ্বনি শােনা যাচ্ছে। তাদের বক্ষেরর ক্ষীরধারায় সমস্ত দেশ ফলে ফুলে শস্যে অপূর্ব শ্রী ধারণ করেছে।…আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি, তাতে হিন্দুতার ধর্মের অন্তর্নিহিত সনাতন সত্যের সন্ধান পেয়েছে, মুসলমান তার ধর্মের অন্তর্নিহিত শার্ধত সত্যের সন্ধান পেয়েছে( আর উভয়েই মর্মে মর্মে বুঝেছে যে যেখানে সত্য সেখানে দ্বন্দ্ব নেই যেখানে শ্রেয় সেখানে সংকীর্ণতা নাই, কার্পণ্য নাই, আলােকের পথে অন্তহীন একাগ্র অভিযানই সকলের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
এস ওয়াজেদ আলির ভাবনার মূলসুর ছিল—হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য, বাংলার রাষ্ট্রীয় জীবনের স্বকীয়তা, শুভবােধ ও জ্ঞানের উন্মেষ। তিনি মনে করতেন, “মানুষ শুধু ধর্মীয় আদর্শবাদ লইয়া বাঁচিতে পারে না। বাঁচিবার আকাঙ্খ, শক্তিলাভের আকাঙ্খা কার্যকরী করিতে হইলে যুক্তিসঙ্গত, প্রয়ােজনানুরূপে শিক্ষা পদ্ধতির প্রচলন হওয়া চাই। জীবনযুদ্ধ জয়ে, আক্রমণ ও প্রতিরােধ উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের হাতের সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র হইতেছে শিক্ষা।” তিনি ভারতের মঙ্গল কামনা করেছেন, তবে স্বধর্মপ্রীতিকে এর অন্তরায় বিবেচনা করেননি। তাঁর মতে, প্রকৃত হিন্দু প্রকৃত মুসলিম এবং প্রকৃত খ্রিস্টানের মধ্যে বিরােধ বাধে না। নিজেদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র সম্বন্ধে তীব্রভাবে সচেতন ব্যক্তির পক্ষে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি সম্ভব নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের এই হচ্ছে অভিজ্ঞতা। ঐ ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য-চেতনা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত রাখতে পারলে এবং একটা জাতীয়তাবাদী অনুভব যথেষ্ট পরিমাণে প্রবল হলে তবেই অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি সম্ভব।
বাঙালি মুসলিম সমাজে বােধ হয় এস ওয়াজেদ আলিই প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে একটা মােটামুটি পরিষ্কার ধারণায় উপনীত হয়েছিলেন। তিনি ভাষার ভিত্তিতে জাতীয়তামূলক রাষ্ট্রতন্ত্রের কথা বললেও সম্পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেননি, ঐভাবে গঠিত বিভিন্ন জাতির সমবায়ে ভারতীয় রাষ্ট্র-সমবায় অথবা ফেডারেশন গঠনের কথা বলেছেন। কিন্তু সেইসঙ্গে তার এই বিধাসও ছিল যে, ভাষা নৃতত্ত্ব ও অন্যান্য কারণে জাতিগঠনের উপকরণ একমাত্র বঙ্গদেশেই পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান। বাংলা ভাষার সহায়তায় অখণ্ড জাতিগঠনই বাঙালির নিয়তি, এই বিশ্বাস তিনি ব্যক্ত করেছেন। তিনি একটা ‘বাঙালি’ আদর্শের ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন। ঐ বাঙালি আদর্শ হওয়া উচিত বাঙালির চিন্তা, সাধনা এবং প্রার্থনার লক্ষ্য। এরপর তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ উক্তি করেন “বাঙ্গালা দেশ এবং বাঙালি এই দুইয়ের মঙ্গলামঙ্গলের মাপকাঠি দিয়েই সব জিনিসের ভালােমন্দের বিচার আমাদের এখন করতে হবে,…মহাদেশের আদর্শ ছেড়ে দেশের আদর্শকেই এখন আমাদের বরণ করতে হবে।” তিনি ‘মহাদেশ’ বলতে ভারতবর্ষ এবং ‘দেশ’ বলতে বঙ্গদেশ বুঝিয়েছেন এটা বােঝা কঠিন ব্যাপার নয়। কিন্তু এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হচ্ছে বাংলা ও বাঙালির ভালােমন্দের একটা মাপকাঠি নির্দেশ। এ হচ্ছে জাতীয়তাবাদের লক্ষণ। এর অর্থ, রাজনীতি-অর্থনীতি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই যা কিছু বাংলা ও বাঙালির জন্য মঙ্গল তা-ই ভালাে, যা বাংলা ও বাঙালির জন্য কল্যাণকর নয় তা ভালাে নয়। তিনি অন্তরের ঐক্যের উপরেও জোর দিয়েছিলেন। অতীতে ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যসমূহ বারবার খণ্ড বিখণ্ড হয়েছে, কারণ রাষ্ট্রগঠনের উল্লিখিত ঐক্যপুঞ্জের প্রতি দৃকপাত করা হয়নি, এবং শাসকবর্গ অন্তরের ঐক্যের বাহুবলের উপরেই নির্ভর করেছিল বেশি। উগ্র দেশপ্রেম নয়, বাস্তবজ্ঞানই রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব-বিধানের সহায়ক হতে পারে। তিনি বলেছেন “বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সহজেই আমরা বুঝতে পারব, সমস্ত ভারতবর্ষকে এক অখণ্ড কেন্দ্রীয় শাসনের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস শেষ পর্যন্ত অসন্তোষ এবং ব্যর্থতাই এনে দেবে। কেননা সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে ভাষার ঐক্য নাই, কৃষ্টির ঐক্য নাই, ধর্ম এবং গােষ্ঠীরও ঐক্য নাই, এরূপ ক্ষেত্রে কৃত্রিম উপায়ে একটা বাহ্য একতানয়নের প্রয়াসে সমাজের অন্তর্নিহিত অনৈক্য আরও স্পষ্টতর। হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। এক সময় কোনাে কোনাে ভারতীয় নেতাও এরূপ চিন্তা করেছিলেন।
‘ভবিষ্যতের বাঙালী’ গ্রন্থের অন্যতম প্রবন্ধ ‘হিন্দু-মুসলমান। এখানে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা ও বিরােধের প্রকৃত কারণ ও তার সমাধানের উপায় নির্ধারণে তিনি ব্রতী হয়েছেন। বিরােধের কারণ হিসাবে মূলত দশটি কারণ উল্লেখ করেছেন—
১. ঐতিহাসিক শিক্ষার প্রণালী।
২. ধর্মগুদের অবাঞ্ছনীয় প্রভাব।
৩. সাম্প্রদায়িক মনােবৃত্তিসম্পন্ন সাহিত্যের প্রভাব।
৪. চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক প্রতিযােগিতা।
৫. রাজনৈতিক জীবনে এই চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির আধিপত্য।
৬. অতীতের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনার দুরাশা ও দুঃস্বপ্ন।
৭. বিভিন্ন ধরনের জীবনধারণ প্রণালী।
৮. সম্মিলিতি অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানাদির অভাব।
৯. ভবিষ্যতের বিষয়ে কোনাে সুস্পষ্ট ব্যাপকতর সমবারিক আদর্শের অভাব।
১০. বাঙালির জীবনে অবাঙালির অতিরিক্ত প্রভাব।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক প্রতিযােগিতার ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়গত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপারটি বাদ দিলে, বাকি কারণগুলি বিভাগােত্তর কালেও মােটামুটি বহাল থাকে। পরিবর্তিত বাস্তবতায় দু-একটি কারণ হয়তাে সমস্যা হিসেবে নতুন চেহারা বা মাত্রা পায় (যেমন চাকুরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে পূর্বের হিন্দু-মুসলমান প্রতিযােগিতার পাকিস্তানি আমলে পশ্চিমাবাঙালি দ্বন্দ্বে রূপ নেওয়া, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার অনুপস্থিতিতে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার একাধিপত্য ইত্যাদি)। এই অবস্থায় দেশ-বিভাগকে যাঁরা বাংলা তথা উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখেছিলেন, কিংবা হয়ত সত্যিসত্যিই বিশ্বাস করেছিলেন যে এর ফলে হিন্দু-মুসলমানের বৈরিতা বা বিদ্বেষ-ভাবের স্বাভাবিক অবসান বা প্রশমন ঘটবে, অচিরেই তাদের সে বিধাস ভুল প্রমাণিত হতে শুরু করে। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগের পরিণতি উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা বা বিরােধকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রায় স্থায়ী রূপ দেয়। সম্প্রীতি ও সহযােগিতার পরিবর্তে পাকিস্তান ও ভারত এই দুটি দেশের সম্পর্ক হয় পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস আর বৈরিতার।
বিভাগপূর্বকালেই এস ওয়াজেদ আলি তাঁর ‘ভবিষ্যতের বাঙালী’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রের রূপ’ প্রবন্ধে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে লিখেছিলেন, “ধর্মে আমি একান্তভাবে আস্থা রাখি, আর ধর্মকে আমি জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলেই মনে করি। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনাে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ আছে বলে আমি বিধাস করি না।…বর্তমান যুগের রাষ্ট্রীয় জীবনের সঙ্গে কিছুমাত্র পরিচয় যাদের আছে তারা জানেন, রাষ্ট্রের কারবারই হল এ যুগে সবচেয়ে বড় কারবার। এরূপ অবস্থায় ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক না করলে, ধর্ম আর ধর্মই থাকে না বড় একটা একটা ব্যবসায়ে পরিণত হয় এবং ধর্ম ব্যবসায়ে পরিণত হওয়ার মানেই হল তার মৃত্যু।” ভারতবাসী তথা বাঙালির জন্যও যুগধর্ম অনুসরণ করে জাতীয়তার ভিত্তির উপর রাষ্ট্রীয় জীবন গড়ে তােলার তাগিদ দিয়ে এস ওয়াজেদ আলি তার উক্ত প্রবন্ধে আরও লিখেছিলেন, “বর্তমান যুগে ধর্মের ভিত্তির উপর সে প্রতিষ্ঠান গড়তে গেলে বিড়ম্বনাই বাড়বে। বাঙালি এ বিষয়ে অবহিত হবে কি?” জাতীয়তাবাদ কথাটার দ্বারাও এস ওয়াজেদ আলি তথাকথিত ধর্মীয় জাতীয়তা নয় ধর্মনিরপেক্ষ, ভাষাভিত্তিক বা ভৌগােলিক জাতীয়তার কথাই বুঝিয়েছিলেন। তার মতে, “জাতীয়তাবাদের আদর্শ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুবিধাজনক এক ভৌগােলিক পরিবেশ বা এলাকার মধ্যে মূর্ত করে তােলা…। মানুষ ধর্মে বিধাস করে কি করে না, দেবতাদের বিষয়ে কি কি ধারণা মনে পােষণ করে, পরকাল বিশ্বাস করে কি —জাতীয়তাবাদ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না।” ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য ‘বিড়ম্বনা সম্পর্কে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সেদিন সচেতনতার পরিচয় দিতে পারেননি সত্য, তবে পাকিস্তানােত্তরকালে, ১৯৪৭-৭০ সময়পর্বে, এদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষের, অন্ততপক্ষে তার সচেতন একটি অংশের, যে সাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ ব্যক্ত হয়েছে তাতে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই।
ইতিহাসের পাঠ পদ্ধতিকে তিনি তীব্রভাবে সমালােচনা করেছেন—
“ছেলেবেলা থেকে আমরা পড়ে আসছি, সুলতান মাহমুদ ভারত আক্রমণ করে হিন্দুদের অসংখ্য মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, মন্দিরের পবিত্রতা ধূলিসাৎ করেছিলেন, পুরােহিতদের লাঞ্ছিত করেছিলেন, সাধারণকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। সুলতান আলাউদ্দিন কেমন করে রানী পদ্মিনীর লােভে রিপু পরবশ হয়ে চিতাের রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। আমাদের পড়ান হয় আওরঙ্গজেবের গোঁড়ামির কথা। সিরাজউদ্দৌলার অত্যাচার ও স্বৈরাচারের কথা। এই সব অর্ধ ঐতিহাসিক, অর্ধ কাল্পনিক বিষয় এমনভাবে লিখিত হয়েছে, এমনভাবে এসবের শিক্ষা দেওয়া হয় যে, হিন্দু ছেলেদের মনে মুসলমান বিদ্বেষ আপনা থেকেই জেগে ওঠে। আর বাল্যজীবনের শিক্ষা এমন গভীরভাবে ছাত্রের অন্তরে প্রবেশ করে যে, পরে তার বিষময় প্রভাব থেকে তার মনকে শত চেষ্টা সত্ত্বেও মুক্ত করা যায় না।”
এই বিষয়ের প্রতিকারের উপায় হিসাবে এস ওয়াজেদ আলি মনে করেন বিদ্যালয়ের পাঠ্য ঐতিহাসিক পুস্তকাদির আমূল পরিবর্তন করতে হবে। ইতিহাসের লেখক এবং শিক্ষকদের একথা সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে অন্যায় এবং অত্যাচার মুসলমানদের একচেটিয়া জিনিস নয়। দু’একজন মুসলমান বাদশা যদি প্রজাপীড়ন করে থাকেন, তারা মুসলমান হিসাবে তা করেননি, তাদের স্বভাবের অনুসরণ করেছেন। তাদের স্বৈরাচারের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের এবং মুসলমান জাতির কোন সম্পর্ক নেই। পক্ষান্তরে অসংখ্য মুসলমান বাদশা, নওয়াব, সুবেদার প্রভৃতি ন্যায় বিচার ও উদারতার যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গেছেন, তারও ভুরি ভুরি প্রমাণ এবং দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসে পাওয়া যায়। দু-কজন অত্যাচারী শাসনকর্তার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলােচনার চেয়ে অসংখ্য মহানুভব শাসন কর্তাদের মহানুভবতার কথা স্মরণ করাই ভবিষ্যৎ অখণ্ড জাতি গঠনের পক্ষে শ্রেয়।”
(২)
আধুনিকতার প্রায় সব গুণই আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এস ওয়াজেদ আলি। রাজনীতি সচেতনতা ও জাতীয়তাবােধের নিরিখে তিনি বিশ শতকের অপেক্ষাকৃত প্রাগ্রসর বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তুলিত হবার যােগ্য। উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ যে বাঙালি জাতীয়তা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উদ্ভবের কারণ ঘটিয়েছে, এস ওয়াজেদ আলি সে সম্পর্কে বিশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি এতটাই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। তার বিবেচনায়, যুক্তি-বিবেক দিয়ে যাচাই করার পরই ধর্মের গ্রহণযােগ্যতা থাকে, সঙ্গীতচর্চার আবশ্যকতাকে তিনি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন, শাস্ত্র নিরপেক্ষ মুক্ত দৃষ্টিতে নারী সমাজের অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, সর্বোপরি সাম্প্রদায়িকতার প্রণে তিনি পরমত ও পরধর্মর্সহিষ্ণুতার গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে ভােলেননি।
এস ওয়াজেদ আলি ধর্মনিরপেক্ষ তার উপরেই নির্ভর করছেন সবচেয়ে বেশি। তীব্র সাম্প্রদায়িকতার পরিণাম শুধু ভারতীয় জাতীয়তা নয় বাঙালি জাতীয়তারও সম্ভাবনা বিলােপ। জাতিগঠনের ব্যাপারে তিনি ভাষা ও সাহিত্যের উপরেও সমান গুরুত্ব আরােপ করেছেন। তিনি ভাষা শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেছেন “উর্দু ভাষার সহিত ইসলাম ধর্মের কী সম্পর্ক আমি তাহা বুঝিতে অক্ষম। আর আরবীতে গভীর জ্ঞান লাভ না করিলে যদি প্রকৃত মুসলমান হওয়া না যায়, তা হইলে মুসলমানের সংখ্যা বস্তুত অতি অল্প হইয়া দাঁড়াইবে এবং অনারব দেশে ইসলামের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হইয়া পড়িবে।” ভারতীয় জাতীয়তাকে তিনি প্রাদেশিক জাতীয়তার ভিত্তির উপর সংগঠনের প্রস্তাব করেন, কেননা প্রদেশগুলাে মােটামুটি ভাষার ভিত্তিতে গঠিত। এটাই সাম্প্রদায়িকতা বিলােপের প্রকৃষ্টতম পথ বলে তিনি মনে করতেন। তিনি সাহিত্যিক ছিলেন, হয়তাে এটাই এর কারণ। তাঁর মতে, অন্তরের মিলনের ভিত্তি হচ্ছে ভাষা ও সাহিত্য। এরূপ ভাষা ও সাহিত্য প্রাদেশিক ভিত্তিতেই শুধু আছে, সর্বভারতীয় কোনাে একক ভাষা ও সাহিত্য নেই।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যখন বিপন্ন বােধ করছে সে সময় ওয়াজেদ আলির সাহিত্যকর্ম বাংলাসাহিত্যে বিস ও জীবনবােধের জন্ম দেয়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘জীবনের শিল্প’ (১৯৪১) যখন প্রকাশিত হয় তখন মুসলিম শিক্ষিত সমাজে এর একটা আলােকিত প্রভাব পড়ে। যেন সবাই জাগ্রত হওয়ার প্রচেষ্টায় কিঞ্চিৎ নেড়েচেড়ে বসে। বিলম্বের আর সময় নাই। কালৰে পণ অনেকটাই হয়ে গেছে। এখনও না জাগলে মুসলিম জাগরণ ও জাতীয় উন্নতি আরও বিলম্বিত হবে। এমন একটা চেতনার আলােকিত ধারার প্রকাশ ঘটতে থাকে মুসলিম সমাজ থেকে।
এস ওয়াজেদ আলি বােঝাতে সচেষ্ট ছিলেন যে, ইসলামের সঙ্গে দর্শন ও বিজ্ঞানের কোনও বিরােধ নেই। দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তা, গবেষণা এবং আলােচনার পথ ইসলাম যেমন পরিষ্কার এবং প্রশস্ত করে দিয়েছে অন্য কোন ধর্মমত তেমন করেছে বলে মনে হয় না’ (‘জীবনের শিল্প’)। তার জীবনের শিল্প’-র মধ্যে মূলত বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলাের মধ্যে মুসলমান এবং বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলােচনা আছে, গণসেবায় ইসলাম বিষয়ে প্রবন্ধ আছে, বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য নিয়েও কথা আছে। তিনি লেখেন, ইসলাম বুঝতে হলে ‘কেবল অভিধান এবং ব্যাকরণের সাহায্যে ধর্ম বােঝা যায় না, অন্তরের সাহায্য দরকার। যার মন যত বড়, সে-ই ধর্মকে বড় ভাবে বােঝে। আর যার মন ছােট সে পণ্ডিত হলেও ধর্মকে বিকৃত ব্যাখ্যা করে।
এস ওয়াজেদ আলি তাঁর ‘জীবনের শিল্প’ গ্রন্থের একাধিক প্রবন্ধে হিন্দু ও মুসলমানের সম্পর্কের উন্নতি এবং উভয় সংস্কৃতির মিলনের জন্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। ‘বাঙালী মুসলমান’ নামক প্রবন্ধে হিন্দু ও ‘মুসলমান কালচার’ নামক অধ্যায়ে বলেছে,
“মুসলমানকে হিন্দু কালচারের সম্মান করতে হবে, হিন্দুকে মােসলেম কালচারেরও সম্মান করতে হবে এই দুই কালচারের মধ্যে যা কিছু মূল্যবান এবং স্থায়ী জিনিস আছে তার কদর উভয়কে করতে হবে। আর আস্তে আস্তে মানুষের দৃষ্টি অতীত থেকে বর্তমানের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে, এবং অবর্তমানের বিষয় ভাববার যে একটা স্বাভাবিক বৃত্তি আছে তাকে ভবিষ্যৎমুখী করতে হবে।” হিন্দু ও মুসলমানকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—“অতীতের মধ্যে যা কিছু হিন্দু এবং মুসলমান উভয় জাতির পক্ষে সমান আনন্দদায়ক, সেইসব জিনিসের বেশী আলােচনা করতে হবে, আর যা কিছু এই জাতির কোন একটির পক্ষে পীড়াদায়ক, তাকে আমাদের ভুলতে হবে।” (“বাঙালী মুসলমান’)
হিন্দু এবং মুসলমান সখ্যতা স্থাপনের ক্ষেত্রে, অতীতের চেয়ে বর্তমানের বিষয়ে বেশী ভাবা এবং বর্তমানকে অতীতের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক বলে তিনি মনে করেছেন। বাংলার উন্নতি সম্পর্কে ‘বাঙালী মুসলমান’ প্রবন্ধে তার অভিমত অত্যন্ত স্পষ্ট “হিন্দু এবং মুসলমান উভয়ের মঙ্গল ছাড়া বাংলার মঙ্গল হতে পারে না, আর হিন্দু এবং মুসলমানের সম্প্রীতি ছাড়া, বাংলার গৌরব কখনও মাথা তুলতে পারে না।” এই প্রবন্ধে যারা মুসলিম ভারত’ ও ‘হিন্দু ভারত’ গড়ার স্বপ্নে বিভাের থাকেন, তাদের সেই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন বলে অভিহিত করেছেন এবং তাদের তীব্র ঘৃণা করেছেন।
এস ওয়াজেদ আলি ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন এবং সেই জাতীয়তাবাদে মুসলমানদের একটা স্থান থাকবে বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর আরও বিশ্বাস ছিল যে, হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিতভাবে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ নির্মাণ করবে। যেটা হবে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনের এক অটুট হাতিয়ার।
১৩৫১ বঙ্গাব্দে ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্মেলন’-এ সভাপতির পদ অলংকৃত করেন এস ওয়াজেদ আলি। সভাপতির বক্তব্য প্রদানকালে তিনি বলেন,
“প্রাচীন আলঙ্কারিকেরা রসের সৃষ্টিকেই সাহিত্যের ল(রূপে নির্দিষ্ট করেছেন। সাহিত্যিকের কাজ সে হিসেবে ছিল রসের সৃষ্টি ও তার পরিবেশন। তবে রস বিভিন্ন রকমের হয়। আর বিভিন্ন রসের পরিবেশনে বিভিন্ন ফল সমাজে দেখা দেয়। যে রসের ফল অনিষ্টকর হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সে রকম রসের অধিবেশন আমরা সমর্থন করতে পারি না, পক্ষান্তরে সে রস থেকে আসে বিমল আনন্দ, উচ্চ আদর্শের প্রেরণা কল্যাণপ্রসু চিন্তাধারা, সেই রসের পরিবেশনই হল সাহিত্যিকের প্রকৃত কাজ।”
আজীবন জ্ঞানপিপাসু ছিলেন এস ওয়াজেদ আলি। লেখনিতে তিনি যেভাবে পাঠকশ্রেণিকে ইতিহাস সন্ধানে যেমন প্রাণিত করেছেন, ঠিক তেমনি কৌতূহলী হয়ে জাতির ঐতিহ্য বিকাশে উদ্বুদ্ধ করতে পিছপা হননি। ‘শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারে মুসলমান’ প্রবন্ধটির তার তেমনি একটি ঐতিহ্যপ্রিয়তার বিরল উদাহরণ। প্রবন্ধটি থেকে উদ্ধৃত কয়েকটি কথা আশা করি উক্তমতের পক্ষে সমর্থনে সহায়ক হবে “হযরত মুহাম্মদ (স.) শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা অতি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। …হযরত মুহাম্মদের (স.) অল্পকালের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন সাম্রাজ্য এবং রাজ্য দখল করে যেমন যশস্বী হয়েছেন, জ্ঞান সাধনার দিক থেকে তাদের কীর্তিও তেমনি বিস্ময়কর ও অবিস্মরণীয়। ধর্মে, সাহিত্যে, কাব্যে, দর্শনে, বিজ্ঞানে, শিল্পে, সঙ্গীতে প্রায় সহস্র বৎসর ধরে তারা বিধবাসীর পথপ্রদর্শক হয়েছিলেন। …মুসলিম জগতের সহস্র বর্ষব্যাপী বিজ্ঞানচর্চার আর একটি বিশেষত্ব এই যে, অমুসলিমরা জ্ঞানের এই দীপালি-উৎসবে সমানভাবে অংশ নিতেন।..সর্বধর্মের, সর্বজাতির এবং সর্বদেশের ছাত্রদের জন্য শিক্ষা নিকেতনের দ্বার উন্মুক্ত ছিল। সুদূর জার্মানি, ইংল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশ থেকে খ্রিস্টান বিদ্যার্থীরা এসে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে প্রবেশ করতাে। আর সেখানে থেকে বিদ্যা আহরণ করে চিন্তার গৌরবময় পতাকা উত্তোলন করতাে। তাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলেই বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগের আবির্ভাব সম্ভবপর হয়েছে।” উক্ত প্রবন্ধ যেমন মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা বলে, ঠিক তার পাশাপাশি তেমন মুসলিম ভারতে শিক্ষার প্রসার নিয়ে আলােচিত। এই প্রবন্ধে লেখক প্রকৃতই মুসলিম তরুণ সমাজকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর আহ্বানের মর্মার্থ হচ্ছে আমাদের সকলের উচিত অতীত থেকে শিক্ষা। গ্রহণ করে সােনালি ভবিষ্যত নির্মাণে প্রণােদিত হওয়া।
এস ওয়াজেদ আলির জাতীয়তাবােধ নাগরিকদের মধ্যে বিচারবােধের সৃষ্টি করে। ফলে তারা ভালােমন্দের ধারণা লাভ করে। জাতীয়তাবােধের “আদর্শ সেবার এবং সাধনার নিত্য নূতন পথে যেতে মানুষকে উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণিত করে। দেশের মঙ্গল যখন আদর্শ, তখন কিসে সে মঙ্গল সাধন করা যেতে পারে, সে দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়, অন্য কোনাে অবান্তর কথা ভাবার তঁার সময় থাকে না এবং সেই মঙ্গল সাধনের জন্য মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিত্য নতুন পথে অগ্রসর হয়। কেন না, সে বােঝে যে, অতীতের অভিজ্ঞতার উপর নূতন পন্থা প্রাচীনপন্থার চেয়ে ভাল। প্রাচীনপন্থীদের মতামত, সমর্থন বা অসমর্থন তার সহজ বুদ্ধিকে বিকৃত কিংবা লক্ষ্যভ্রষ্ট করে না।”
এস. ওয়াজেদ আলি বিশ্বাস করতেন জাতীয়তাবােধ আধুনিক বিজ্ঞান ও মানব বিদ্যার চর্চায় নাগরিকদের উৎসাহিত করে। ফলে তাদের সৃষ্টিশীলতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়। তারা প্রকৃত অর্থেই অনুধাবন করতে পারে যে, দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষার প্রসার ছাড়া জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নতি সাধিত হয় না। আর সেই বিকাশ ও অগ্রগতি অর্জিত হলে অধিবাসীদের পরস্পর শ্রদ্ধাবােধ বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং তার জাতীয়তাবােধ তাকে ঐক্যের পথে নিয়ে যায়। আর এ পথেই মানুষ দেশপ্রেমিকের সহযােগিতা লাভ করতে পারে এবং তাঁর সাধনাকে সার্থক করে তুলতে পারে। এস. ওয়াজেদ আলির জাতীয়তাবাদের আদর্শ মানুষের দৃষ্টিকে ভবিষ্যতের দিকে প্রসারিত করে। জাতীর মঙ্গল চিন্তা ও ভবিষ্যতের ভাবনা তখন বিজ্ঞান বােধ দ্বারাই পরিচালিত হয়। জাতীয়তাবােধ মানুষকে তার নিজের কর্মের সামাজিক মূল্য অনুধাবনে সাহায্য করে। এস. ওয়াজেদ আলি মনে করেন জাতি আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করে একতার মধ্য দিয়ে। একতার বন্ধনই জাতিকে শক্তিশালী করে তােলে। তার বিশ্বাস, যে জাতির জীবনে বৈচিত্র্য নেই, সে জাতির জীবনে একতা আসে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিয়েই জাতির জীবন বিকশিত হয় এবং তাদের অবলম্বন করেই জাতি আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। জাতীয় একতার জন্যে তাই তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর গুরুত্ব আরােপ করেন.
“দশজনের সম্মিলিত শক্তি একজনের শক্তির চেয়ে অনেক বেশী। সেই জন্য যেসব জাতি মিলিতভাবে কাজ করতে পারে, তাদের শক্তি যেসব জাতি মিলিতভাবে কাজ করতে পারে না, তাদের চেয়ে অনেক বেশী। এই জন্য জাতীয় শক্তির সম্যক বিকাশের জন্য আমাদের মধ্যে অসংখ্য সংঘের এবং অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজন যেখানে মিলিতভাবে কাজ করতে আমরা অভ্যস্ত হতে পারি। এতে আমাদের শক্তি বাড়বে।”
এস ওয়াজেদ আলি মনে করেন যে জাতি প্রকৃতির ওপর যত বেশি আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে, সে জাতি তত সভ্য।
প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের নামই হচ্ছে সভ্যতা। তার মতে, দাসত্ব সভ্যতার ভিত্তি নয়। যে সমাজে দাসত্ব আছে তার জীবনে বর্বরতার বীজও আছে। দাসত্বের মাধ্যমে সমাজে সভ্যতা আসে না। প্রত্যেক জাতির ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ ও কালচার থাকলেও তিনি চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমানকে একটি জাতিতে পরিণত করতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একতা আনতে পারলেই যথাসময়ে তারা একটি জাতিতে পরিণত হবে। জীবন সংগ্রামে যে জাতি সামনে এগিয়ে যেতে পারে সে জাতিই টিকে থাকে। মানুষের মধ্যে আছে বির্বজনীন সত্তা। আর এই বির্বজনীন সত্তা মানুষের মধ্যে আছে বলেই এক জাতির মানুষ অন্য জাতির মানুষের ভাব ও ভাষা বুঝতে পারে।
ওয়াজেদ আলি নানা স্বাদের প্রবন্ধ রচনা করেছেন। কিন্তু রচনা, রম্য রচনার সমগােত্র। তার প্রবন্ধ-গ্রন্থ ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’তে নদী’, ‘সমুদ্রের কথা’, ‘মাছ ধরা’, ‘চাদমামার ভরসা’, ‘এভারেষ্ট পর্বতের কথা’, ‘বাক্যালাপ’, ‘প্রদীপ ও পতঙ্গ’, ‘বােকামির চূড়ান্ত’, ‘একটি গল্প’, ‘অজেয় সােনালি ঈগল’, ‘একটি স্বপ্ন’, ‘চলার শেষ’, ‘স্মৃতির ফসল’ প্রভৃতি প্রবন্ধ ছাড়াও ‘জীবনে শিল্পের স্থান’, ‘রেল ভ্রমণ’, ‘ভিক’, ‘পটভূমিকা’ প্রভৃতি প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলি রম্যধর্মী। এই গ্রন্থে লেখক সমাজ, জাতীয় ঐতিহ্য ও জাতীয় জীবন সম্পর্কে তার মনােভাব ব্যক্তি করেছেন। বহমান সমাজ-সভ্যতা ও চৈতন্যমুখী জীবনের উচ্চতর সাধনার পরিচয় রয়েছে। এখানে। রাজনৈতিক নেতাদের অপপ্রয়াস ও অপপ্রচারের জাতীয় সন্ধীক্ষণে তিনি ভবিষ্যৎদর্শী মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন এই গ্রন্থে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এই দুই সভ্যতার যা কিছু ভাল, যা কিছু কল্যাণকর, তাকেই মিলনের বাহুডােরে বেঁধেছেন। দুই সভ্যতার কল্যাণকর মূল নির্যাস নিয়ে এক ব্যাপকতর এবং পূর্ণতর নব সভ্যতার গঠনে বলিষ্ঠ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কেননা আমাদের প্রকৃত পথ হচ্ছে মিলনের, বিরােধের নয়। ইতিহাসের পটভূমিতে মুঘল সম্রাট আকবরের জীবন ও রাষ্ট্র সাধনার সম্যক উপলব্ধি ধরা পড়েছে ‘আকবরের রাষ্ট্র সাধনা’ গ্রন্থে। ওই গ্রন্থে ওয়াজেদ আলি লিখেছেন,
“ধর্ম সমস্যার যে সমাধান আকবর করে গিয়েছেন, ভারতবর্ষের লােক এখনও তা গ্রহণ করতে পারেনি। তবে আমার স্থির বিশ্বাস এমন একদিন আসবে যখন ভারতবাসীরা সে সমাধানকে সুষ্ঠুতম এবং শ্রেষ্ঠতম সমাধান বলে গ্রহণ করবে, আকবর ভারতবাসীর জন্য রাষ্ট্রনেতারও অনিন্দ্য অতুলনীয় এক আদর্শ চিরকালের জন্য রেখে গেছেন। ভবিষ্যতের ভারতবাসী আকবরের মত রাষ্ট্রনেতাই খুঁজবে, অন্য কাউকে নিয়ে তারা সন্তুষ্ট হবে না। যিনি রাষ্ট্রের নায়ক তিনি সকলের আপনজন। এই মহামান্য বাদশার দেহ সমাধিস্থ হয়েছে। বটে, কিন্তু তার অমর আত্মা ভারতবাসীকে মঙ্গলময় রাষ্ট্র ও জীবনের পথ অহরহ দেখিয়ে যাচ্ছে।”
(৩)
এস. ওয়াজেদ আলি মূলত ছিলেন প্রাবন্ধিক। তবে ছােটগল্প ও উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর মৌলিকতা চোখে পড়ে। তার। ছােটগল্পের সংখ্যা কম নয়, কিন্তু তিনি একটি মাত্র উপন্যাস রচনা করেন। উপনাসটির নাম ‘গ্রানাডার শেষবীর’ (১৯৪০)। উপনাসটি ‘গুলিস্তা’ পত্রিকায় চৈত্র ১৩৪১ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাস আমাদেরকে নীরস জীবন থেকে অতীতের এক বীরত্বপূর্ণ গৌরবমণ্ডিত যুগে নিয়ে যায়, যেখানে আমরা একটি মুক্ত ও বিশাল জীবনের আস্বাদ পাই, যেখানে জীবন দুটি পরস্পর বিরােধী মহান আদর্শের দ্বন্দ্বক্ষেত্র। এখানে শুধু বেঁচে থাকবারই প্রবল চেষ্টায় মানুষের জীবনীশক্তি ব্যয়িত হয় না। তার এই ঐতিহাসিক উপন্যাসে আমরা বিপদসঙ্কুল গৌরবময় বীরত্ব কাহিনিপূর্ণ অতীত যুগে ফিরে যাই। এখানে বিরােধপূর্ণ কলহের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা ইতিহাসের বিশাল ঘটনার অন্তরালে মানুষের সংকীর্ণ সামাজিক জীবনের বাস্তব ছবি বলে বিশেষ উপভােগ্য হয়েছে। এখানে ঐতিহাসিক ঘটনার এমন একটা বাস্তব তথ্য পরিপূর্ণ জীবন্ত চিত্র দেওয়া হয়েছে যে, আমরা। একটা গুরুতর রাজনৈতিক কলহ হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করি।
‘গ্রানাডার শেষ বীর’ উপন্যাসের নায়ক একজন ইতিহাসখ্যাত ব্যক্তি এবং তার ভাগ্য বিপর্যয়ই এ উপন্যাসের আখ্যানবস্তু। অবশ্য ঐতিহাসিক উপন্যাসে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যে নায়ক হবে এমন কোনাে কথা নেই। ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দে গ্রানাডার খ্রিষ্টান বাহিনীর সাথে মুসলিম বাহিনীর সংঘঠিত যুদ্ধের পটভূমিতে ‘গ্রানাডার শেষ বীর’ রচিত। খ্রিষ্টান বাহিনীর নেতৃত্ব দেন রাজা ফার্দিনান্দ ও রাণী ইসাবেলা এবং মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দেন আবু আবদুল্লাহ। এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী পরাজিত হয় এবং কঠিন কিছু শর্ত স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মুসলিম বাহিনীর প্রধান আবু আবদুল্লাহ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।
‘গ্রানাডার শেষবীর’ উপন্যাসের উৎসভূমি বাইরের পৃথিবী। কারণ ঔপন্যাসিকের কাহিনি-বিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণনার কুশলতা উপন্যাসকে গুণান্বিত করে। উপন্যাসটি দুটি জাতির মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষের কাহিনি। একদিকে খ্রীষ্টান ধর্মের গৌরব বৃদ্ধির জন্য ফার্দিনান্দের উদগ্র বাসনা, অন্যদিকে ইসলাম ধর্ম ও মূর সংস্কৃতির ঐতিহ্য রক্ষায় আবদুল্লাহর প্রাণপণ প্রচেষ্টা কাহিনিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। গ্রানাডা হতে বিচ্যুত শেষ বীর আবদুল্লাহর অপরিসীম বীরত্ব এশিয়াবাসীকে উদ্বুদ্ধ করবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই ঐতিহাসিক কাহিনিকে এস ওয়াজেদ আলি অপরিসীম দক্ষতার সঙ্গে হৃদয়গ্রাহী করেছেন। তার সরল ভাষা ও গল্পবলার ভঙ্গীই এই সার্থকতা এনে দিয়েছে।
বাঙালি মুসলিম জাগরণে এস ওয়াজেদ আলি কতটা চিন্তান্বিত ছিলেন এবং মুসলিম ছেলেদের চাবুকপেটা করে দিকনির্দেশনা প্রদান করতে কতটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, ‘গ্রানাডার শেষবীর’ গ্রন্থটি তার বিরল উদাহরণ। তাতে গ্রানাডায় মুসলিম শৌর্যের সূর্য কীভাবে অস্ত গেছে, মুসলিম শাসন থেকে মুসলিম নামধেয় শাসকগােষ্ঠী কর্তৃক ক্রমে ক্রমে কীভাবে খ্রিস্টান শাসনের দিকে দেশকে নিয়ে যেতে গুপ্তবীজ রােপণে সহায়তা দেওয়া হয়েছে, আন্তঃকলহ কীভাবে দেশের শাসনব্যবস্তাকে খ্রিস্টানদের করতলগত করতে ইন্ধন জুগিয়েছে, মুসলিম সেনানীদের মধ্যে কীভাবে কলহের বীজ পুঁতে দেওয়া হয়েছে এবং নেতিবাচক কর্মকাণ্ড কীভাবে মুসলিম রাজত্বের অবসানে সময়কে ত্বরান্বিত করেছে, সেসব ইতিহাস বিধৃত হয়েছে। ছােট্ট পরিসরের একটি গ্রন্থ। কিন্তু বক্তব্য বিশাল বিস্তৃত। একজন জাগরণের সৈনিকের পথেই কেবল এমন সাহসী কলম ধরা সম্ভব।
‘গ্রানাডার শেষবীর’ উপন্যাসের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য জগতে একটা বিপুল সাড়া পড়ে। তৎকালীন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এই উপনাস সম্পর্কে নানা অভিমত প্রকাশিত হতে থাকে। আনন্দবাজার পত্রিকায় সাহিত্য সমালােচনা বিভাগে সম্পাদক বলেন,
“বাঙ্গলা সাহিত্যক্ষেত্রে মিঃ এস. ওয়াজেদ আলী সুপরিচিত ও সুপ্রতিষ্ঠত। তাহার আলােচ্য গ্রন্থখানি কিশােরদের উপযােগী করিয়া লেখা। সহজ ও সাবলীল ভাষায় লিখিত। মাঝে মাঝে বিষয়বস্তুর পরিচায়ক ছবি সঙ্গে থাকায় পুস্তকের সৌষ্ঠব বৃদ্ধি পাইয়াছে। আমরা পুস্তকখানির বহুল প্রচার কামনা করি।” ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক ‘গ্রানাডার শেষবীর’ সম্পর্কে মন্তব্য করেন “পুস্তকখানির ভাষা সরল, অথচ হৃদয়গ্রাহী। বস্তুত গ্রন্থকার বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে নবাগত নহেন। তাঁহার রচিত বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত আরও কয়েকখানি পুস্তক বঙ্গবাসীর সমাদর লাভ করিয়াছে।”
ওয়াজেদ আলির গল্পে জীবনের অভিজ্ঞতা যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি প্রকাশিত হয়েছে ভাবপ্রাধান্য ও মননতীমতার দীপ্তি—এক্ষেত্রে তিনি প্রমথ চৌধুরীর অনুসারী। আমাদের সমাজজীবনের বিশেষ বিশেষ জায়গার অবস্থা ও সমস্যায় তিনি আলাে ফেলেছেন সুকৌশলে ও শিল্প দক্ষতায়। ঘটনার বাহুল্য কিংবা বর্ণনার আধিক্য তার গল্পে তেমন নেই। তিনি মূলত রূপক ও চিন্তন প্রধান গল্প রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন। ওয়াজেদ আলির ‘মাশুকের দরবার’ গল্পগ্রন্থটি এককালে খুবই খ্যাতি অর্জন করেছিল। এখানে ১৯টি ছােটো গল্প স্থান পেয়েছে। সৌরিন্দ্রমােহন মুখােপাধ্যায় এগুলােকে তুর্গেনিভের ‘Prose-poemsএর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সৌরিন্দ্রমােহন গল্প গ্রন্থটির পরিচয়’ নামক ভূমিকায় লিখেছিলেন “শ্ৰীযুক্ত এস ওয়াজেদ আলী বি-এ, মহাশয়ের লেখা গল্পগুলি আমার বড় ভালাে লাগে। গল্পগুলিতে জ্ঞান আছে, বস্তু আছে, এবং গল্প বলিবার কৌশলটুকুও ওয়াজেদ আলী সাহেব বেশ জানেন। তিনি সুপণ্ডিত, কিন্তু তার রচনায় পাণ্ডিত্যের হুঙ্কার নেই, ইসেন-হামশুনকে বাঁধিয়া মারিবার কসরৎ নাই। হাল্কা ঝরঝরে ভাষায় ভাবের স্রোত বহিয়া চলিয়াছে অজস্র, বেশ স্বচ্ছন্দ মুক্ত ধারায়! রচনায় থট’ আছে, তা সত্যই ‘টু ডিপ ফর টিয়ার্স’, মানব-চিত্ত নিমেষে তাহা স্পর্শ করে। রচনার সার্থকতা এইখানে।
তাঁর রচিত ‘গুলদাস্তা’ পড়িয়া এই কথাই মনে হইয়াছিল। ‘গুলদাস্তা’র গল্পগুলিতে প্রেক্ষাট ছিল বিচিত্র এবং তার প্রকাশের ভঙ্গিও ছিল মনােরম। ‘মাশুকের দরবার’ বইখানিতে যে গল্পগুলি বাহির হইয়াছে, তার সবগুলিতে বেশ লাগসৈ’ প্রেক্ষাপট নাই, কিন্তু গল্পের যা প্রাণ, মৃদু ইঙ্গিতে জীবনের সুখদুঃখের আভাস জাগাইয়া তােলা… ‘মাশুকের দরবার’-এর প্রতি গল্পে সেই প্রাণ বিদ্যমান আছে। প্রত্যেকটি গল্প প্রাণের দরদে আগাগােড়া ভরা। তবে এগুলিকে বােধ হয় ঠিক গল্প বলা চলে না। এর জুড়ি পাই টুর্গেনিভের ‘Prose-poems’ নামক রচনায়। দু-চারিটা রচনা লইয়া আলােচনা করিলে আমাদের কথা বুঝা যাইবে।
প্রথম গল্প—“পূর্বাভাষ। স্টীমারে চড়িয়া নায়ক চলিয়াছেন। নদীর তীরে আশেপাশে গ্রামের নর-নারীর কাজকর্ম, অলসভাবে বসিয়া থাকা, ছেলেদের ছুটোছুটি—এগুলি যেমন দেখিয়াছেন, তেমনি বলিয়া গিয়াছেন—সেগুলি যেন নিখুঁত ফটো। আমাদের চোখের সামনে দুষ্টু ছেলেদের দৌরাত্ম, ঘােমটায় মুখ-ঢাকা বধূর কলসীতে জল ভরিতে ভরিতে ঘােমটার আড়ে স্টিমার দেখা লাঙ্গল লইয়া চাষার মাঠচষা—এগুলি একেবারে সজীব হইয়া ওঠে। এদের এই হাসিখেলা দেখিয়া লেখক বলিতেছেন— ‘বীরভােগ্যা বসুন্ধরার কত অল্প ঠাই নিয়েই এরা সন্তুষ্ট! জীবনের কর্মকোলাহল থেকে অতি দূরে অবস্থিত ঐ গণ্ডগ্রামে এরা জন্মেছে, আর এই গণ্ডগ্রামেই এরা মরবে। বাহিরের জগৎ কখনাে এদের নামও শুনবে না, আর এদের গায়ের নামও শুনবে না। চমৎকার! মনস্তত্ত্বের অনেক সত্য এই কটি ছত্রে আশ্চর্য সহজভাবে ব্যঞ্জিত হইয়াছে। শেষে গাছের ছায়ায় ঐ যে ছেলেটি ‘উপুড় হয়ে শুয়ে নদীর স্রোতের দিকে চাহিয়াছিল! গাছের ডালে পাখির আনন্দ কলরব, নদীর ঢেউ, বয়স-সুলভ চাপল্য-বশে সে সবের পানে সে চাহিতে জানে না—মন তার কোথায় কোন্ দূর-দূরান্তরে চলিয়াছে! এ ছেলেটির এই স্বাতন্ত্র লেখক লক্ষ্য করিয়াছেন ! এই লক্ষ্য করাতেই তার দরদী প্রাণের পরিচয় পাই। স্টিমারে চড়িয়া অনেকেই বেড়ান, কিন্তু এমন করিয়া দেখার চক্ষু এবং দেখিয়া এভাবে তা ভাষায় ফুটাইবার শক্তি আমাদের ক’জনের আছে।
‘প্রেমের পুষ্পরথ’—প্রাণের চমৎকার ছবিটুকু! প্রথম প্রণয়ে উচ্ছ্বসিত-চিত্ত প্রেমিক-প্রেমিকা পথে চলিতেছিল, নয়নে তাদের হাসির মাধুরি…প্রেমের পুষ্পরথে চড়িয়া আনন্দলােকে চলিয়াছে! গতির বিরাম নাই, যাত্রীদের মনে ভয় নাই, ভাবনা নাই। কমাস পরে পথ চলা আছে, কিন্তু সে বাহুতে-বাহুতে মালা গাঁথার স্পৃহা নাই! তারা পাশাপাশি চলে না। তরুণ চলিয়াছে আগে আগে, আর দশ-পনেরাে হাত পিছনে তরুণী! ‘পুষ্পরথে’র গতি আজ স্বচ্ছন্দ নয়। তারপর? মুখে অকারণ আনন্দের সে অফুরান হাসির লেশমাত্র নাই! হায়রে, সে পুষ্পরথ আজ যেন মেরামত করা একখানা গাড়িমাত্র! আনন্দলােকে পৌঁছাইয়া দেবার তার সাধ্য কি! তারপরে? তরুণ একা পথে চলে, তরুণী সঙ্গে নাই! পুষ্পরথ তবে অচল হইয়াছে! তাই হয়। কবিও বলিয়াছেন—
‘সুখ দিন হায় যবে চলে যায়, আর ফিরে কভু আসে না। পুলকের হাসি নিমেষের চিরদিন দীর্ঘশ্বাসের বােঝা লইয়াই নরনারীর দিন কাটে! এই সনাতন সত্য লেখক অপরূপ কৌশলে এত মৃদু ইঙ্গিতে বুঝাইয়াছেন, আর সে ইঙ্গিতে এমন কবিত্ব যে প্রাণে চিরদিনের জন্য রেখাপাত করে! লেখার আর্ট ইহাকেই বলে!… এমনি স্বচ্ছ অনাড়ম্বর বর্ণনাভঙ্গি, এমনি ভাবুকতায় এ বইয়ের প্রতিপৃষ্ঠা পূর্ণ। বাংলা ভাষার বিলাতি সেক্স-সমস্যার ধূমধাড়াক্কার মধ্যে এই বইখানির সরল সহজ ভাষা, তার বিচিত্র ভাব, আর ‘সাজেসটিভনেস’ আমাকে একান্ত মুগ্ধ করিয়াছে এবং আমার বিধাস সেক্স-তত্ত্ব লইয়া যাঁরা মাথা ঘামাইতে বসেন নাই তারাও এই বইখানি পড়িয়া আনন্দ পাইবেন। ভাবিবার অনেক কথা এ বইয়ে আছে। কিন্তু এত কথা বলিবার প্রয়ােজন নাই। জ্যোৎস্না-কিরণ দেখাইতে প্রদীপ ধরা বাতুলতা।”
‘মাশুকের দরবার’ গ্রন্থের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘ভারতবর্ষ। ‘ভারতবর্ষ’ ট্রাডিশনাল জীবন সত্যের সম্যক দৃষ্টান্ত সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভূতির ফসল। এটি একটি রূপক গল্প। এ গল্পে তৎকালীন সমাজের সাধারণ মানুষের জীবন-আলেখ্য তুলে ধরা হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে সবকিছুর পরিবর্তন হলেও সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের কোনাে পরিবর্তন হয়নি। যে বিধাসে জনৈক বৃদ্ধ দোকানদার রামায়ণ পড়তাে পঁচিশ বছর পরও সেই একই বিধাসে তার ছেলে রামায়ণ পড়ে তার নাতি নাতনিকে শােনাচ্ছে। এই গল্পে অস্পষ্ট হয়েছে তৎকালীন সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের অর্থনৈতিক পরিবর্তনহীনতার স্বরূপটি। এ গল্পে অল্প কথায় লেখক তৎকালীন সমাজ চিত্র নিখুঁতভাবে তুলে ধরে এক রূপক-প্রিয় শিল্প প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। এ গল্প ঘটনাত্ৰ(মে অতিক্রম করে আমাদের পৌঁছে দেয় এক বােধের জগতে। যখন ‘মাসিক মােহাম্মদী’ পত্রিকায় ‘ভারতবর্ষ’ গল্পটি প্রকাশিত হল, তখন ওয়াজেদ আলি ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে’ প্রবচনের সৃজনপুরুষ। প্রায় সমসাময়িককালের আর এক মননশীল লেখক কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০)। দুজনের মধ্যে গড়ে উঠল একটা হার্দিক সম্পর্ক। তাদের পূর্বসূরী মীর মশাররফ হােসেন (১৮৪৭-১৯১২) প্রদর্শিত পথেই দীক্ষিত এই দুই মনস্বীর যােগে বাংলা সাহিত্য অচিরে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠল। তিন ডজনেরও বেশি গল্পের লেখক ওয়াজেদ আলির খ্যাতি ‘ভারতবর্ষকে কেন্দ্র করে যে বিস্তারিত হয়েছিল তার অবশ্য একটা গৌণ কারণও ছিল—এটি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের বাংলা পাঠক্রমের অন্তর্গত হয়েছিল। ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘গ্রানাডার শেষ বীর’ও (১৯৪০) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার দ্রুত পঠন-পাঠ্য হিসেবে (১৯৪৩ সালে) অনুমােদিত হয়েছিল।
‘দরবেশের দোয়া’ গ্রন্থে সাতটি গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে—দরবেশের দোয়া, ফেরেস্তাদের কলহ, নবী দর্শন, প্রেমের মােসাফের, তরুণ আরব, সুরাটের কাফিখানা, প্রচারক। সবকটি গল্পেই ইসলামি জীবন ও তত্ত্ব দর্শন প্রাধান্য পেয়েছে। ‘ভাঙাবাঁশী’-র গল্পগুলিতে মানব মহিমার বাণীই স্পষ্টায়িত হয়েছে। জীবনের দৈনন্দিন বাস্তবতা ও অতীত প্ৰেক্ষাপটে স্মৃতি তাড়িত কল্পনা-মােহ ‘গুলদাস্তা’-র গল্পগুলিতে বিধৃত হয়েছে। নবতর জীবনবােধের সুস্পষ্ট উন্মেষ ওয়াজেদ আলির প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘গুলদাস্তায় লক্ষ্যণীয়। ভ্রাতৃপ্রেম, দেশপ্রেম কিংবা মানবীয় প্রেম সর্বত্রই তিনি আধুনিকতাবাদী মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন।
(৪)
এস ওয়াজেদ আলি হিন্দু ও মুসলমান মিলনের মাধ্যমে এক বলিষ্ঠ জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৩২-র সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এই মিলনের পথকে প্রশস্ত করার উদ্দেশ্যে ‘গুলিস্তা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। এই পত্রিকা ছিল এস ওয়াজেদ আলির জীবন ও সাহিত্যের আদর্শস্বরূপ। এই পত্রিকা প্রতিষ্ঠার কাল তার জীবনে এক কর্মময় অধ্যায়। পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন লক্ষ্যমুখী সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক আসর। ‘গুলিস্তা’র মাধ্যমে এস. ওয়াজেদ আলি তার আকাঙ্খিত এক মিলন মধুর পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তাই পত্রিকার প্রচ্ছদে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকত “গুলিস্তাঁ’—হিন্দু-মুসলমান মিলনের অগ্রদূত।” পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাতেই থাকত ‘সম্পাদকীয়’। ‘গুলিস্তাঁর’ নিয়মিত বিভাগগুলি পরিচালনা করতেন সেই সময়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ—
১. ছবি বিশ্বাস (অভিনেতা ও পরিচালক),
২. আব্বাসউদ্দিন আহমেদ (গায়ক শিল্পী)
৩. বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (বিখ্যাত রেডিও শিল্পী)। পত্রিকার নারী জগৎ বিভাগটি পরিচালনা করতেন বিশিষ্ট মহিলা সাহিত্যিক অনুরূপা দেবী।
বৃটিশের চক্রান্তে ভারতবাসীর রাজনৈতিক জীবন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ১৯৪৪-র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ‘গুলিস্তাঁ’র বার্ষিক উৎসব ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ইংরেজদের দমন পীড়ন ও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের আগুনকে তীব্র রূপ দেবার প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে চল্লিশের দশকে ‘গুলিস্তা’ পত্রিকার অন্যতম দর্শন ছিল— ‘বাংলার জয় হউক’ আর ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ভিতর দিয়া স্বাধীনতা আমাদের কাম্য।
‘গুলিস্তা’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমগ্র সুধী বাঙালিকে সমসাময়িককালে ওয়াজেদ আলি জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পেরেছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় পত্রিকার বিভিন্ন বিভাগে খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের নামের তালিকা থেকে। এই সময়ে এস.ওয়াজেদ আলি ৪৮ নং ঝাউতলা রােড, কলকাতা বাসভবনে প্রায় রবিবার বিকেলে ‘গুলিস্তা’ কেন্দ্রিক আসর বসাতেন। সেই আসরে উপস্থিত থাকতেন তৎকালীন কলকাতার বিখ্যাত সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক ও ভাবুক সমাজের ব্যক্তিবর্গ। ১৩৫১র পৌষ সংখ্যা ‘গুলিস্তা’ পত্রিকায় এক বর্ণনায় বলা হয় “গুলিস্তা আসরের প্রধান পৃষ্ঠপােষক বাংলার ভূতপূর্ব মন্ত্রী এ.কে. ফজলুল হক সাহেবের সভাপতিত্বে সম্পন্ন হয়। এস. ওয়াজেদ আলি সাহেব সভার কার্য্য বক্তৃতা দ্বারা আরম্ভ করেন। তিনি বলেন, মাসিক পত্রিকা গুলিস্তার আসরই হচ্ছে ‘গুলিস্তাঁ’ আসর। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হিন্দু-মুসলমানের মিলন। সভায় বহু আলােচনা হয়। রেডিও-বিখ্যাত মিঃ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যেতে নাহি দিব’ এবং মিঃ প্রবােধ সান্যাল ‘শ্মশান’ নামক কবিতা আবৃত্তি করিয়া সকলকে মােহিত করেন। মিঃ আব্বাসউদ্দীন, মিঃ কালিদাস রায়, মিঃ কালােবরণ দাস, মিঃ চিত্ত রায়, মিসেস দীপালি গুপ্তা, মিঃ বেদারউদ্দীন সকলকে গান দ্বারা আনন্দ দান করেন। মিস স্নেহলতা চক্রবর্তীর বাঁশী বাজানও সুন্দর হয়েছিল।
সভায় যাঁহারা উপস্থিত ছিলেন তাহাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য—বাংলার ভূতপূর্ব মন্ত্রী খান বাহাদুর হাশেম আলী খান, তােফেল আহম্মদ চৌধুরী এম.এ., প্রফেসার ডঃ বিনয় সরকার, প্রফেসার প্রমথনাথ বিশী, প্রফেসার হরিচরণ ঘােষ, শ্ৰীযুক্ত কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদক, ‘প্রবাসী’) শিশিরকুমার বসু (সম্পাদক, ‘বঙ্গদূত’), শ্রী রাধারমণ চৌধুরী (সম্পাদক, ‘প্রবর্তক’), ডঃ অজিতশংকর দে (সম্পাদক, ‘প্রত্যহ ও পরাগ’), শ্রী অখিলনিয়ােগী, মিঃ নুল ইসলাম খান, (‘নবযুগে’র পক্ষে), মৌলভী মিজানুর রহমান, কবি কাদের নওয়াজ, কবি হাতেম আল নওরােজী, মিঃ এস. সিদ্দিকী এবং মিঃ অনিল দেব প্রমুখ।”
এই পত্রিকাকে ঘিরেই এস.ওয়াজেদ আলি সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে বাঙালিকে এক ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই আমরা দেখতে পাই, ‘গুলিস্তা’ পত্রিকা এবং ‘গুলিস্তা আসর’-এ রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে, ধর্মের ধারক-বাহক মােল্লা-ব্রাহ্মণ-পুরােহিত, সমাজসেবক, বিপ্লবী, শিল্পানুরাগী, শিক্ষক, সংস্কৃতিবিদ বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক এবং গায়ক শিল্পীর এক মহান মধুর মিলন।
এস ওয়াজেদ আলি প্রথমে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করলেও পরে বাংলা সাহিত্য সাধনায় নিজেকে নিয়ােজিত করেন। সীমাবদ্ধতা হয়তাে ছিলই তবে তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিষয়বস্তুতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। এস ওয়াজেদ আলি বলেছেন “বঙ্গভাষায় বিখ্যাত সাহিত্যিক সবুজপত্রের সম্পাদক বন্ধুবর শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরীর…উপদেশ পেলে হয়তাে বাঙ্গলা সাহিত্যের জনতাবহুল আসরে আমি কখনও নামতুম না।” ওয়াজেদ আলির এই মন্তব্য যথার্থ, কেননা বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্র (১৮৭৬-১৯৩৮), রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭), কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৬৩-১৯৪৯), চারুচন্দ্র (১৮৭৭-১৯৩৮), নরেশচন্দ্র (১৮৮২-১৯৬৪), নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬), প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪১), সৌরীন্দ্র মুখােপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬০), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) প্রভৃতি বিখ্যাত সাহিত্যিকদের উপস্থিতি বাংলা ভাষার জনতাবহুল আসরই বটে। তবে তিনি এই আসরে নিজের স্থানটুকু উজ্জ্বল করতে পেরেছিলেন এবং বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান মিলনের অগ্রদূত সাহিত্যিক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। আর সেজন্যই বাঙালির সাহিত্য-সমাজ-ভাষাচিন্তাজাতি বৈশিষ্ট্য-সংস্কৃতি-শিক্ষা-ধর্মবােধ-রাজনীতি-অর্থনীতি—তার এগিয়ে যাওয়া, পিছিয়ে পড়া—পূর্ণাঙ্গ জীবনের প্রতি পরতে পরতে এস ওয়াজেদ আলির বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনা আমাদেরকে এখনও ভাবিত ও প্রভাবিত করে।।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. সৈয়দ আকরম হােসেন সম্পাদিত, এস ওয়াজেদ আলী রচনাবলী, খণ্ড-১, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ৫৬৯।
- ২. মুহাম্মাদ আহসান আলী, এস ওয়াজেদ আলী জীবন ও সাহিত্য, নতুন গতি প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ. ২৪।
- ৩. মােহাম্মদ জামান খান, বিশ শতকের প্রথমার্ধের বাঙালি মুসলিম-মানস ও এস ওয়াজেদ আলির সাহিত্যকর্ম, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ৩৮।
- ৪. সবুজপত্র, বৈশাখ-আর্বিন, ১৩২৬।
- ৫. ইসলাম দর্শন, অগ্রহায়ণ ১৩৩২।
- ৬. এস ওয়াজেদ আলী, ভবিষ্যতের বাঙালী, ঢাকা, ২০০০, পৃ. ৩৫।
- ৭. মুহম্মদ আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ২০০৬, পৃ. ১৫৬।
- ৮. এস ওয়াজেদ আলি, আকবরের রাষ্ট্র সাধনা, দ্য সি বুক কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৪৯।
- ৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ জানুয়ারি, ১৩৪৭।
- ১০. ভারতী, ৭ এপ্রিল ১৯৪০।
- ১১. মাসিক মােহাম্মদী’, কার্তিক ১৩৩৪। ২৬. ‘গুলিস্ত’, পৌষ ১৩৫১।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।