লিখেছেনঃ প্রদ্যুম্ন মিত্র
প্রকৃতি, ইতিহাস, সময় ও সমাজ-অনুধ্যানের পাশাপাশি অনেকটা সমান্তরাল, কখনো বা কিছুটা উচ্চতর ভূমিকায়, যে বিষয়টি জীবনানন্দের কাব্যে পূর্বাপর প্রাণরস সঞ্জীবিত করেছে, তা হলো প্রেম। এমন অনেক পাঠক-ই আছেন, যাদের কাছে জীবনানন্দের কাব্যের মুখ্য আবেদন প্রকৃতি নয়, প্রেম। কাব্যের রসাস্বাদনে পাঠকের মনে যে আবেদন প্রাথমিক ও অতি প্রত্যক্ষ, তার গুরুত্ব কোনো সময়েই অস্বীকার করা যায় না। তাই জীবনানন্দের কাব্যের যদি কোনো দুটি মৌল বিষয় বেছে নিতে বলা হয়, তা হবে প্রকৃতি ও প্রেম। অথবা কবি স্বয়ং যেমন লিখেছিলেন, প্রকৃতির শোভাভূমিকায় প্রেম। অন্তত তাঁর সৃষ্টির মধ্যপর্ব পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত অবশ্যমান্য। তবু যে প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে আসে, তা হলো, যে কবি কাব্যের মধ্যে মানব অস্তিত্বের ‘উৎসনিরুক্তি’ সন্ধান করেছেন বার বার, তাঁর সৃষ্টিতে প্রেমের মুখ্যতম স্বরূপ কী। একমাত্র পরম্পরা ও প্রবণতাসাপেক্ষ বিশ্লেষণেই জীবনানন্দের বিকাশপ্রবণ কবিচেতনায় প্রেমের স্থান ও মহিমা নিরূপিত হতে পারে।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’-এর প্রভাবিত পদ্য প্রয়াসগুলিতে কোনো স্বকীয় উচ্চারণের সন্ধান পাওয়া দুরূহ। তবু ছন্দচাপল্য এবং দূরাবগাহী ভাবপ্রবণতার (যা দেশজ পরিসীমা থেকে পাঠককে ভুলিয়ে নেয় পরদেশী আবহের বৈচিত্র্য ও রহস্যময়তার মোহে) পাশাপাশি ‘ঝরাপালকে’ রয়ে গেছে এমন কিছু ধ্বনি ও ভাববিশিষ্টতা, যা উত্তরসূরি জীবনানন্দকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তেমনই কিছু উদাহরণ থেকে যে-কবি সামনে এসে দাঁড়ান, তিনি প্রেমের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের উত্তাপ কবিতায় সঞ্চারিত করে দিতে পারেন নি, পরিবর্তে নিয়ে এসেছেন এক অস্পষ্ট, অনির্দেশ্য প্রেমব্যাকুলতা, যা ঈপ্সিতাকে খুঁজে ফিরেছে অতীতের লুপ্ত গরিমা, বিষাদ ও মৃত্যু স্পৃষ্ট এমন এক অলীক জগতে, যা বাস্তব থেকে দূরস্থিত অথচ কল্পনার যথার্থ উজ্জীবনে স্বপ্নেও আশ্বস্ত নয়। তাই ‘ঝরাপালকে’র ‘বিহ্বল বিরহী’ চলেছে ‘কত শত যুগজন্ম বহি’, অথচ তার ঈপ্সিতা তবুও হয়ে ওঠেননি কোনো স্বপ্ন, প্রত্যয় কি নিশ্চিত অৰিষ্টের প্রতিমা। তাই, ‘প্রেমপিপাসার অগ্নিঅভিসার’ ‘হৃদয়ের পাণ্ডুলিপি’ রচনা করেছে ‘অনন্ত অঙ্গারে’। ‘কারা কবে বেসেছিল ভালো কি যুগ যুগ ছুটিতেছে কার অন্বেষণে’ জাতীয় চরণের অজস্র বিক্ষিপ্ত উদাহরণ পাঠকের কাছে স্পষ্ট করে তোলে ‘ঝরাপালকে’র কবির প্রেমভাবনার অনিশ্চয়তা ও অপরিণতির রূপটি।
‘অস্তচাঁদ’ বা ‘ছায়াপ্রিয়া’র মতো কবিতা পাঠ করলেই দেখা যায়, এ সময়কার রচনায় প্রেমের কথা উচ্চারণ করতে গিয়ে নায়ক আত্মবিস্মৃত ভাবাতিশয্যে আপনাকে দেখেছে ‘দূর উর ব্যবিলোন মিশরের মরুভূসংকটে’ ‘ইতিহাস বেদিকার মূলে’ আসীরীয় সম্রাটের বেশে; কখনো সে তার কি স্পেনীয় জলদস্যুর মতো দাবিতে নির্মম, আবার কখনো ‘বাংলার মাঠে ঘাটে’ বেণু হাতে ময়ুরপঙ্খচূড়া চিরকিশোরের মতো মায়াবী। এভাবে অতীত ও ইতিহাস, পুরাণ ও লোককথার উচ্ছ্বাসপ্রবণ, কিন্তু উদ্দেশ্যবিহীন মিশ্রণে, ঝরাপালকে প্রেম ব্যক্তিগত আবেগের উত্তাপও প্রাণস্পন্দন হারিয়ে ফেলেছে। তবুও তার-ই মধ্যে কখনো ‘ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দলে’-এর মতো কবিতা দীর্ঘায়িত অক্ষরবৃত্তের বিষাদভারাবনত পদচারণায় অভ্রান্ত জীবনানন্দীয় আমেজ নিয়ে আসে :
চুল যার শানের মেঘ আর—আঁখি গোধূলির মতো গোলাপিরঙিন,
আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে’—স্বপ্নে—কতদিন।
উদ্ধৃত চরণ বুদ্ধদেব বসুর আলোচনার ফলে আজ যথেষ্ট পরিচিত ও প্রচারিত। কিন্তু রাজার দুলাল, যাকে ঘিরে কবির স্বকণ্ঠ উচ্চারিত হতে শুনেছেন বুদ্ধদেব, তাকে অতিক্রম করে এ কবিতামধ্যেই দাঁড়িয়ে আছেন অভ্রান্ত জীবনানন্দীয় নায়িকা—সেই শঙ্খমালা নারী, যাকে বার বার দেখি কবির স্বপ্নে ও জাগরণে বিষন্ন প্রত্যাবর্তনে :
মীনকুমারীর মতো কোন দূর সিন্ধুর অতলে
ঘুরেছে সে মোর লাগি।
…নরম লালিমা!
জ্বলে গেছে, নগ্ন হাত,—নাই শাখা, হারায়েছে রুলি
এলোমেলো কালোচুল খসে গেছে খোপা তার,
বেণী গেছে খুলি’।
সাপিনীর মতো বাঁকা আঙুলে ফুটেছে তার কঙ্কালের রূপ,
ভেঙেছে নাকের ডাঁশা,—হিমস্তন,—হিম রোমকূপ!
একবিতার ক্রটি তার রয়েছে অন্যত্র; সে ত্রুটি দৃষ্টিকোণের; অসংলগ্ন সংস্থান ও ভাবকেন্দ্রহীনতার ‘ডালিমফুলের মতো ঠোট যার’ সেই রাজার দুলাল, যাঁকে দিয়ে কবিতার সূচনা ও শেষ, যিনি নায়িকার ঘুমপথে, স্বপ্নে বারবার ফিরে আসেন—তাঁকে বিস্মৃত হয়ে কবিতার মধ্যপথ হতে কবির চেতনায় বড় হয়ে উঠেছেন এক বিষাদময়ী নারী। সেই ম্লান বিষন্ন নারীর রূপ চোখ ভরে দেখে নিয়ে ছবি এঁকেছেন কবি স্বয়ং কিন্তু কবিতার প্রারম্ভিক ও অন্তিম উচ্চারণে আছেন নায়িকা নিজেই। এ ভাবসংস্থানগত বিচ্যুতি কবিতাটিকে যথোচিত সংযম ও ভারসাম্য দেয়নি, যদিও যথার্থ জীবনানন্দীয় কাব্যধ্বনি ‘ঝরাপালক’-এর পাঠক এখানেই প্রথম শুনে নেন। এ নারীকে আবার দেখি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘পরস্পর’ কবিতায়, ‘বনলতা সেন’-এর ‘শঙ্খমালা’য়। ‘রূপসী বাংলা’র চতুর্দশপদীগুলিতে তাঁর-ই মুখমণ্ডলের প্রচ্ছায়া বিষাদ ও প্রতিভারাতুরতার এক অপরূপ রোমান্টিক আবহ রচনা করে দেয়।
‘ঝরাপালক’ থেকে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে এসে জীবনানন্দের পাঠক কবিকে আবিষ্কার করেন তার নিজস্ব মনোভঙ্গি ও স্বকীয় শৈলীতে। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র চিত্রের পর চিত্রে ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্ন শীত ও নৈসর্গিক পৃথিবীর রূপ। সেই প্রাকৃতিক পটভূমিকায় প্রেম বারবার নিয়ে এসেছে এক রোমান্টিক দীর্ঘশ্বাস। এ কাব্যের প্রথমতম কবিতা ‘নির্জন স্বাক্ষর’, যেখানে এক পরিব্যাপ্ত নৈসর্গিক নশ্বরতার প্রেক্ষাপটে মানবিক প্রেম তার মৃত্যুহীনতার এমন দ্যোতনা আনে, যা ‘নক্ষত্রের আকাশ’ কিংবা ‘সমুদ্রের জল’ কখনো জানেনি। চারপাশের সবুজ মাঠ ঘাস আর আকাশে ছড়ানো নীল আকাশ, ইন্দ্রিয়গোচর সব জাগতিক মাধুরিমার চেয়েও ঢের বড় বিস্ময় যেন এই প্রেম :
কোনো এক মানুষীর মনে
কোনো এক মানুষের তরে
যে জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে।
নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে
কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।
লক্ষণীয়, আদি পর্বের এ কবিতাটিতে জীবনানন্দ প্রেমকে জৈব নশ্বরতার ঢের ঊর্ধ্বে রেখেছেন। নিসর্গের যে সৌন্দর্য, তা স্পষ্টতই ইন্দ্রিয়গোচর, সামোহনীক। কিন্তু ‘জীবনের রঙ’, কবির প্রশ্ন, ফলানো কি হয় এইসব ছুঁয়ে ছেনে? উত্তরও তিনি দিয়েছেন :
সে এক বিস্ময়
পৃথিবীতে নাই তাহা-আকাশেও নাই তার স্থল—
চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল।
অর্থাৎ প্রেমের আসন মানবহৃদয়ের গভীরে জৈব এবং ইন্দ্রিয়গোচর রূপাবিষ্টতার চেয়ে বড় এই প্রেম। তাই কবির অনুভবে, যদিও প্রকৃতির বুকে নিত্য নবীনের। আনাগোনা, নতুন সময় আর নতুন নক্ষত্রের ভিড়, তবু ‘কোনো এক মানুষীর তরে’ পুরোহিত হয়ে যে প্রেমের পূজাদীপ তিনি জ্বালিয়েছেন তার শিখা চির-অম্লান। এভাবেই প্রেম কবির চেতনায় জড় এবং জৈব অস্তিত্ব ও কামনার উর্ধ্বে স্থিত এক অপরিবর্ত দিব্যসত্তায় মূর্ত হয়েছে। এভাবেই কবি তার মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন চির আকাক্ষিত অপ্ৰাপণীয়তার রোমান্টিক বোধ। প্রেমানুভূতির এ বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনাকে আশ্রয় করেই ‘নির্জন স্বাক্ষর’ এবং ঐ জাতীয় আরো কয়েকটি কবিতায় ঘনীভূত হয়েছে বিষাদ ও স্মৃতিভারাতুরতার রোমান্টিক অনুষঙ্গ। জীবনানন্দ যখন বলেন, ‘জীবনের স্বাদ লয়ে জেগে আছ—তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে পার তুমি’—তখনই আমাদের মনে পড়ে শেলী, কীটস, হাইনে, হুগো, গত্যিয়ের, হোল্ডারলিন প্রমুখ রোমান্টিক কবিকুলের কথা, যারা প্রেমকে জেনেছিলেন এক অপ্রতিরোধ্য মরণাকর্ষ, এক চিরঅতৃপ্ত তীব্র আকাক্ষার স্বরূপে যার হাত থেকে প্রেমিকের কোনো পরিত্রাণ নেই। মৃত্যু ও জীবনের প্রবল বিষমানুপাতিক টানে দীর্ণ হতে হতেই যেন ‘নির্জন স্বাক্ষর’-এর নায়ক বলে ওঠেন :
আমি চলে যাবো, তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর পরে;
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে :
জীবনানন্দের এ পর্যায়ের কবিতাবলীতে প্রেমের এ ক্ষণশাশ্বতী স্বরূপ কবিতার চরণে চরণে সঞ্চারিত করেছে আত্মবিদারী অনুভবের গাঢ়তা। প্রেমের যে লোকোত্তর মহিমার উপলব্ধি ‘নির্জন স্বাক্ষর’-এর নায়ককে শেষ পর্যন্ত প্রত্যয়ী করেছে, ঠিক তার বিপরীত সংক্ষোভ ‘সহজ’, ‘কয়েকটি লাইন’ প্রভৃতি কবিতায় নিয়ে এসেছে তীব্র, অপরিতৃপ্ত বাসনার প্রহার, প্রেমের ক্ষণউদ্ভাসের বেদনা। এসব কবিতার নায়িকা নিতান্তই মানুষী, দেহবদ্ধ বাসনার প্রতিমা। এখানে পক্তির পর পঙক্তিতে ধ্বনিত ভালবাসার ক্ষণউল্লাস, নশ্বরতার বেদনা :
ক. তুমি শুধু একদিন,—এক রজনীর।
খ. একদিন এসেছিলে,
দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারে যত!
গ. একদিন দিয়েছিলে যেই ভালোবাসা,
ভুলে গেছ আজ তার ভাষা।
তবু ক্ষোভ, সংশয়, হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনাই কেবলমাত্র ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র প্রেম-ভাবনাকে বিশিষ্টতা দেয়নি, তার-ই পাশাপাশি আছে ভালোবাসার চিরন্তনতার জন্য প্রেমিকের সেই ব্যগ্র আকাক্ষা, যা সর্বকালীন :
তুমি যদি রহিতে দাঁড়ায়ে।
নক্ষত্র সরিয়া যায়,—তবু যদি তোমার দু’পায়ে
হারায়ে ফেলিতে পথ-চলার পিপাসা।
একবার ভালোবেসে— যদি ভালোবাসিতে চাহিতে তুমি
সেই ভালোবাসা।
জৈব দেহবদ্ধ বাসনার বিপরীত এ অনুভূতি দেহজ উপভোগের ক্ষণিক উল্লাসবোধ থেকে মুহুর্তের আনন্দকে উত্তরিত করে নিতে চায় চিরকালীন সম্পদে। তাই জীবনানন্দের আদিপর্বের প্রেমকাব্যে কখনো কখনও যুক্ত হয়েছে বাস্তবতার অতিরিক্ত লোকোত্তরতার মাত্রা। রচনারীতির কিছু অপসৃয়মান মুদ্রায় এবং মানসিকতার কোনো কোনও পুনরাবৃত্ত প্রকাশে এসময়কার কাব্যেও কল্লোলকালীন দেহবাদিতার ভাবানুষঙ্গ স্পষ্ট। তবু রোমান্টিক প্রেমকাব্যের বিশিষ্ট কুললক্ষণ যে নিয়তিতাড়িত আকাক্ষার মরণাকর্ষণ, এবং তার-ই বিপরীত মেরুতে আশ্রিত যে অতীন্দ্রিয় লোকোত্তর সৌন্দর্যের প্রতিভাস রোমান্টিক কবি তাঁর ইপ্সিত নারীর মধ্যে খুঁজে পান, অপ্রাপণীয় বলেই যা আকাঙ্খাকে করে নিরন্তর অচরিতার্থতায় তীব্রতর, জীবনানন্দের এ সময়কার প্রেমের কবিতাগুলিতে তার লক্ষণ আদৌ অপরিস্ফুট নয়।
‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র কবিতাবলীর যে স্বতন্ত্র চেতনা ও আসক্তি বাংলা নিসর্গ-কাব্যে এক অশ্রুতপূর্ব ধ্বনিগভীরতা যুক্ত করেছে, তা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটিতে। এ কবিতায় নিসর্গ-রূপের অজস্র উদ্ভাসন ও মাধুরিমার অনুপুঙ্খ ভাষ্যকার কবি পাঠকের আবিষ্ট দৃষ্টি আলেখ্য থেকে আলেখ্যান্তরে চালিত করে নিয়ে যান এক ভারাক্রান্ত দীর্ঘশ্বাসে :
…জানিনা কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে ।
ধূসর মৃত্যুর মুখ, …
‘কামনার আগে রাঙা’ বিশেষণ মৃত্যুর মুখ ধূসরতর করেছে এ চিত্রে; সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘দেয়ালের মত’ শব্দ দুটির আঘাতের ব্যঞ্জনা। যেন এতক্ষণ যে আলোছায়ার খেলা হিজলের জানালা থেকে নেমে এসেছিল জ্যোৎস্নার উঠানে, বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাস আর নীলাভ নোনার বুকে আকাক্ষায় গাঢ় হওয়া রস, ঘনান্ধকার বটের নিচে লাল লাল ফল—পৃথিবীর মাস ঋতু বৎসরের এ বর্ণাঢ্যতাকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে কবিতাটিতে আর এক প্রচ্ছায়া—যেদিকে ‘বিকেলবেলার ধূসরতায়’ ‘পৃথিবীর কঙ্কাবতী’কে কেড়ে নেয় অন্ধকার নদী’ : ‘পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় স্নান ধূপের শরীর’। লক্ষণীয়, কী আশ্চর্য অনায়াস কল্পনায় একটি সহজসরল গ্রাম্য নিসর্গচিত্রের বর্ণনার মধ্য দিয়েই কবিতার মধ্যে জীবনানন্দ সঞ্চারিত করে। দিতে পেরেছেন তন্নিষ্ঠ নিসর্গ-বৰ্ণনার অতিরিক্ত অন্য ব্যঞ্জনার মাত্রা। বিকেলের ক্রমক্ষীয়মান আলোয় নদীর ওপর জমে ওঠা অন্ধকার আর তার মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যাওয়া নারীর শরীর—এ পরিচিত সাধারণ গ্রাম্য ছবিটি থেকে উঠে এসেছে মৃত্যুস্পৃষ্ট সৌন্দর্যের এক অপরূপ প্রতিমা—’ধূপের শরীর পাওয়া পৃথিবীর কঙ্কাবতী’ নারী। ‘কঙ্কাবতী’ শব্দটির সুপ্রয়োগে লোক-কাহিনীর রূপসী নায়িকা বিয়োগান্তক বেদনায় সর্বকালীন ও সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। তবু সাধারণভাবে বলা যায়, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্যায়ে জীবনানন্দের কাব্যের নায়িকারা সকলেই প্রবলভাবে মানবী, দেহজ বাসনার বদ্ধ, ঈর্ষা, বঞ্চনা, অবহেলা, ব্যর্থতায় চরিত্রায়িত। দেহাতীত প্রেমের দিব্যতা সেখানে ক্ষণিক বিদ্যুৎ দ্যুতির মতই কখনো কখনও আবির্ভূতমাত্র।
মৃত্যুর দীর্ঘ প্রলম্বিত ছায়া ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র নিসর্গ-নিবিষ্টতাকে যেমন বিষাদঘন করেছে, তেমনই সেই মৃত্যুস্পষ্ট নিসর্গভূমিতে আবির্ভূত হয়ে কবির প্রেম-ভাবনাও হয়ে উঠেছে মৃত্যু আহত। এ পর্যায়ে জীবনানন্দের কাব্যে প্রেম মরণজয়িতার অনুভবে বলশালী নয়, যতটা মরণার্ত নশ্বরতার বোধে পীড়িত। কবি জানেন, ‘সূর্যের চেয়ে, আকাশের নক্ষত্রের থেকে প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি’; এবং মানুষের জীবন ‘প্রার্থনার গানের মতন’ হয়ে ওঠে ‘তুমি আছ বলে প্রেম’। তবু সেই সঞ্জাবনী—সকল ক্ষুধার চেয়ে বড়, সকল শক্তির আগে যে প্রেম, সেও মৃত্যুর কাছে পরাহত :
আমি শেষ হবো শুধু ওগো, তুমি শেষ হলে।
তুমি যদি বেঁচে থাক, জেগে রব আমি এই পৃথিবীর পর—
যদিও বুকের পরে মৃত্যু রবে,—মৃত্যুর কবর।
এ সৰ্বায়ত মরণশীলতার বোধ-ই কবিচেতনায় সঞ্চারিত করেছে নশ্বরতার বেদনা, ক্ষণউল্লাসে অতৃপ্তি। একটির পর একটি কবিতায় ‘সিন্ধুর-জল’, ‘সমুদ্রের ঢেউ’ প্রেমের উপমেয় হয়ে আসে :
ক. তুমি জল—তুমি ঢেউ—সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন
খ. জলের আবেগে তুমি চলে যাও
কারণ, ঢেউয়ের-ই মতন প্রেম চিরপলাতক, উদ্বেল, অস্থির; আবার ঢেউয়ের-ই মতন প্রত্যাবর্তিত হতে জানে স্মৃতির হাড়ের মাঠে-কার্তিকের শীতে।
অতএব দেখছি, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’-রূপসী বাংলা পর্যায়ে জীবনানন্দের প্রেমচেতনা দুটি বিপ্রতীপ বিন্দুতে আবর্তিত। একদিকে প্রেমের ঐশ্বর্যময় আবির্ভাবের লোমহর্ষ নৈসর্গিক প্রেক্ষাপটে মুদ্রিত :
যখন সবুজ অন্ধকার,
নরম রাত্রির দেশ, নদীর জলের গন্ধ কোন্ এক নবীনগতার
মুখখানা নিয়ে আসে—মনে হয় কোনোদিন পৃথিবীতে প্রেমের
আহ্বান
এমন গভীর করে পেয়েছি কি : প্রেম যে নক্ষত্র আব নক্ষত্রের গান,
প্রাণ যে ব্যাকুল রাত্রি প্রান্তরের গাঢ় নীল অমাবস্যার—
চলে যায় আকাশের সেই দূর নক্ষত্রের লাল নীল শিখার সন্ধানে,
প্রাণ যে আঁধার রাত্রি আমার এ, আর তুমি স্বাতীর মতন
রূপের বিচিত্র বাতি নিয়ে এলে,—তাই প্রেম ধুলায় কাঁটায় যেইখানে
‘হৃদয়ে প্রেমের দিন’ মৃত হয়ে পড়েছিল, পৃথিবীর শূন্যপথে পেল সে গভীর শিহরণ। অন্যদিকে বিচ্ছেদকাতরতা, নশ্বরতার বেদনা, অচরিতার্থতার ভারাক্রান্ত দীর্ঘশ্বাস :
ক. শরীরে ননীর ছিরি, ছুঁয়ে দেখো—চোখা ছুরি, ধারালো
হাতির দাঁত!
হাড়ের-ই কাঠামো শুধু,—তার মাঝে কোনোদিন হৃদয় মমতা
ছিল কই!
[‘পরস্পর’ : ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’]
খ. জানি তবু, নদীর জলের মতো পা তোমার চলে,—
তোমার শরীর আজ ঝরে
রাত্রির ঢেউয়ের মতো কোনো এক ঢেউয়ের উপরে।
যদি আজ পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই,
যদি আমি চলে যাই
নক্ষত্রের পারে,—
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!
[‘১৩৩৩’: ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’]
গ. জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে।
আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়, আমার কাতর চোখ,
আমার বিমর্ষ ম্লান চুল
এই নিয়ে খেলা করে : জানে সে যে বহুদিন আগে আমি
করেছি কি তুল
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে,
[‘এইসব ভালো লাগে…’ ‘রূপসী বাংলা’]
চিরঅলভ্য প্রেম আর চিরঅতৃপ্ত হৃদয় উভয় মিলে রচনা করেছে জীবনানন্দের প্রথম পর্যায়ের কাব্যে স্মৃতিভারাতুরতার এমন আবহ, যা স্বাভাবিকভাবেই রোমান্টিক কাব্যঐতিহ্যের ধারায় আশ্রিত।
রোমান্টিক প্রেমকাব্যের নায়িকা নিষ্ঠুরা মোহিনী; ‘লা বেল্ দাম্ সা মের্শি’ (অকরুণা এক রূপসী)। সেই ‘ফাম ফাতাল’ বা সর্বনাশীর প্রতি রোমান্টিক কবি অনুভব করেছেন অপ্রতিরোধ্য নিয়তিতাড়িত জৈব-বাসনা-সংগক্ষুব্ধ মৃত্যু-আকর্ষণ। সেই তীর একাগ্র আকাক্ষা আপন অতৃপ্তি থেকে রচনা করেছে এমন এক অধরা মোহিনী-প্রতিমা, যা কাম্য তবু অপ্রাপণীয়, চিরঅধরা তাই দিব্য। এভাবেই দেহজ বাসনায় প্রোথিত থেকেও শেষ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কাব্যে প্রেম হয়ে উঠেছে দেহাতীত দিব্য এক অৰিষ্টের প্রতীক— ঈপ্সিতা নারী সেখানে মানবাত্মার চিরন্তন সৌন্দর্য পিপাসার গরীয়সী দেবী। মনে করা যাক, শেলীর সেই বিশ্রুত পঙক্তিগুলির কথা :
The desire of the moth for the star,
Of the night for the morrow,
The devotion to something afar
From the sphere of our sorrow?
রোমান্টিক প্রেমকাব্যের মূল্য ও মহিমার শিখরস্পর্শী তাৎপর্য এ চরণগুলিতে অভিব্যক্ত। এখানে ঊষার পশ্চাতে ধাবমান রাত্রির চিত্রকল্পে এক নিরবচ্ছিন্ন একাগ্র অন্বেষার কথা উচ্চারিত, যা কিন্তু নিয়তিতাড়িত সর্বনাশের ইঙ্গিত বহন করছে প্রথম চরণের ‘বহ্নিমুখবিবিক্ষু’ পতঙ্গের উল্লেখে। আবার, এ সবকিছুকে ছাপিয়ে বড় হয়ে। উঠেছে, অতীন্দ্রিয় দেহাতীত ব্যঞ্জনা : কারণ শেলী লিখলেন না অগ্নিশিখার প্রতি ধাবমান পতঙ্গের কাহিনী, নিয়ে এলেন নক্ষত্র-আলোকমুখী পতঙ্গের চিত্র, যা শেষ দুটি চরণে আরো বিস্তারিত, ব্যাখ্যাত হয়েছে : প্রেম যেন এক অর্মত্য আকাক্ষা, যা আমাদের শোক-দুঃখপীড়িত এ ভূলোক থেকে উত্তীর্ণ করে নেয় অন্য এক সুদূর জগতে; অন্যতর মহত্তর অনন্যমুখী অন্বেষায়। একদিকে স্পর্শগন্ধময় এ নশ্বর মর্ত্যভূমির সহস্র আকর্ষণ আর সহস্র প্রহারে ধূলিস্নান মানব-হৃদয়ের আকুতি, অন্যদিকে মরণাতীত দিব্য সৌন্দর্যের প্রতিভাস ভালবাসায় ঐশ্বর্যময়ী এক নারীর প্রতিমায়—দেহ, ওঁ দেহাতীত, ইন্দ্রিয়গোচর ও অতীন্দ্রিয় এ দুই বিপ্রতীপ টানে রোমান্টিক প্রেমকাব্য গভীর ব্যঞ্জনাবহ।
জীবনানন্দ দাশ সময়ের দিক থেকে আধুনিককালের কবি। তবু কবিচেতনার নানা লক্ষণে তার শ্রেষ্ঠ প্রেম-কবিতাগুলিতে রোমান্টিক ভাবনার স্পষ্ট স্বাক্ষর লক্ষ্য না করে উপায় নেই। অবশ্যই তার শ্রেষ্ঠ প্রেম-কবিতাগুলি খুঁজে নিতে আমাদের পেরিয়ে আসতে হয় তাঁর কাব্যের আদিপর্যায়—’ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘রূপসী বাংলা’র মানসিকতা—পৌছাতে হয় মধ্যপর্যায়ে, ‘বনলতা সেন’-সমকালীন কবিতাগুচ্ছে, যার অনেকটাই উদ্ধৃত হয়েছে সিগনেট সংস্করণ ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থটি! তবু তার আগেই, রোমান্টিক প্রেম-ভাবনার কিছু কিছু সর্বকালীন বিশিষ্টতা ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ যুগেও অনুপস্থিত নয় তাঁর কাব্যে। আমরা দেখেছি, নৈসর্গিক ক্ষয়-বিলয়ের প্রেক্ষাপটে নিয়তিকে অতিক্রম করে সম্ভোগের ক্ষণ-উল্লাস খুঁজে পেতে চায় শাশ্বতের অভিজ্ঞান। মুহূর্তের মধ্যে চিরন্তনকে ধরার আকুতি, দেহজ রমণীয়তাকে কেন্দ্র করে বৈদেহী সৌন্দর্যের রহস্যময়তার উদ্ভাস—এ সবকিছুই উনিশশতকী রোমান্টিক মানসচেতনার মনোবীজ বহন করছে।
লক্ষণীয়, জীবনানন্দের আধুনিক মন সনাতন দেশজ রীতিতে প্রেমকে কামগন্ধহীন কোনো ‘নিকষিত হেম’ প্রমাণে আগ্রহ দেখায়নি। দেহ এবং সম্ভোগের উল্লাসানুভূতি দুই-ই তাঁর প্রথম পর্যায়ের কাব্যে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত। ‘পিপাসার গান’-এর মতো কবিতায় জীবনানন্দ কোন রকম সংশয়ের অবকাশ না রেখেই বলেন : ‘দেহের পীড়নে/সাধ মোর—চোখে ঠোটে চুলে/শুধু পীড়া—শুধু পীড়া’। আবার, ‘নারীর অধরে/চুলে চোখে—এঁয়ের নিঃশ্বাসে/ঝুমকোতার মতো তার দেহ ফাঁসে’ একদিন কবি ‘রক্ত-মাংসের স্পর্শ-সুখভরা’ ‘পৃথিবীর ঘ্রাণের পসরা’ জেনেছেন। কিন্তু তখনকার মতো রোমান্টিক ভাবুক এ কবি কোনো জৈব বাসনা কি দেহোল্লাসকেই প্রেম বলে চিহ্নিত করেননি; আরো পরিণত ভাবনায় উচ্চারিত করেছেন : ‘দেহ ঝরে—তার আগে আমাদের ঝরে যায় মন’। এ মন’ই তাকে শিখিয়েছে জৈবতা-অতিরিক্ত সংবেদ : ‘এ জীবন ইহা যাহা, ইহা যাহা নয়’; এবং সেই বোধের নিরন্তর অনুভাবনাতেই তাঁর কাব্য। আধুনিক আসলে জীবনানন্দের কবিতায় প্রেম কোনো দেহবাদী প্রতিন্যাসেই আবদ্ধ। থাকেনি, যদিও কাব্য-সাধনার শিক্ষানবিশী যুগে তিনি ছিলেন মোহিতলাল, নজরুল প্রমুখের শৈলী ও বিষয়গত অনুকারী। দেহসর্বস্ব দেহবাদিতা জীবনানন্দকে প্রবলভাবে। প্রভাবিত করেনি বলেই ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ যুগে তাঁর কাব্যে শোনা যায় দেহকে স্বীকার করে নিয়ে উচ্চারিত বৈদেহী প্রার্থনা : ‘সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নিয়া/তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া’। সেই সঙ্গে একথাও অবশ্যমান্য যে, এ সময়ে তাঁর কাব্যে প্রেমের অতীন্দ্রিয় দেহাতীত উপলব্ধি ক্ষণভাসিতমাত্র। স্বপ্নপ্রয়াণের অন্তিম আবেদন সত্ত্বেও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে প্রেম ঐহিক অস্তিত্বের সীমারেখা প্রবলভাবে লঙ্ঘন করেনি। কারণ, জীবনানন্দ জেনেছেন : ‘নক্ষত্রের পানে যেতে যেতে/পথ ভুলে পৃথিবীর পথে/জন্মিতেছি আমি এক সবুজ ফসল।’ (‘স্বপ্নের হাতে’) ‘জন্মিতেছি’ এ ক্রিয়াপদটির অনবদ্য প্রয়োগে অন্তহীন ও প্রবহমান মানব জীবনধারার ইঙ্গিত, যেখানে একের ‘পিপাসার ধার’ অন্যের বুকে জাগিয়ে তুলেছে বার বার ‘প্রেমের পিপাসা’। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র নায়িকা তাই শেষাবধি এক মর্ত্যনারীই থেকে যান—যাঁর চোখে ঠোটে অসুবিধা ভিতরে অসুখ। কবিরা যে রূপসীর কথা বার বার উচ্চারণ করেছেন তাদের কাব্যে, তিনি এক রূপকথার নায়িকা। ‘আমরা সাধিয়া গেছি যার কথা—পরীর মতন এক ঘুমানো সে মেয়ে।’ কিন্তু জীবনানন্দ যার কথা আমাদের শোনালেন, ‘সে–এ ঘুমানো মেয়ে/পৃথিবীর, ফোপরার মতো করে এরে লয় শুষে/দেবতা গন্ধর্ব নাগ পশু ও মানুষে।’ তাই শেষ পর্যন্ত ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে প্রেম লৌকিক বাসনাসংরাগে মথিত মৃত্যুআহত সৌন্দর্যানুভূতির বিষন্ন আবহ রচনা করেছে; যা একান্তভাবেই মর্ত্যমুখিন।
তোমার সৌন্দর্য চোখে নিয়ে আমি চলে যাব পৃথিবীর থেকে
রূপ ছেনে তখনও হৃদয়ে কোন আসে নাই ক্লান্তি অবসাদ।
(‘পৃথিবীতে থেকে’ : ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’)
এমন কি সব আহত ব্যর্থতার গ্লানিও উত্তীর্ণ এ নিবিড় মর্তপ্রাণ রূপপিপাসায় :
তুমি প্রেম দাও নাইজানি আমি—তবুও রক্তাক্ত কোনো রেখা
সোনার ভাঁড়ারে আমি রাখি নাই শীতমধু মোমের সঞ্চয়ে
কুয়াশা হতাশা নিয়ে সরে আমি আসি নাই পৃথিবীর থেকে;
যে অগাধ ইন্দ্রিয়মগ্ন সৌন্দর্য উপলব্ধি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’—’রূপসী বাংলার’ নিসর্গবর্ণনায় সঞ্চারিত করেছে আঞ্চলিক স্বাদ আর অনুপুঙ্খতার রমণীয় জাদু, তা-ই যেন জীবনানন্দের এ সময়কার প্রেমের কবিতায় যুক্ত করেছে এক গভীর বিস্ময়বোধ :
তোমারে দেখেছে ভালোবেসেছে অনেকে
তাহাদের সাথে আমি—আমিও বিস্ময় এক পেয়েছি যে ঢের
গভীর বিস্ময় এক শুধু তার ম্লান হাত-চুল-চোখ দেখে।
এ বিস্ময়বোধেই কবি বলে ওঠেন :
তোমার মুখের রূপ নিয়ে তুমি বেঁচেছিলে তোমার শরীরে
তাইতো মসৃণ তুলি হাতে লয়ে জীবনেরে এঁকেছি এমন
অনেক গভীর রঙে ভরে দিয়ে, চেয়ে দেখ ঘাসের শোভা কি
লাগেনি সুন্দর আরো একবার তোমার মুখের থেকে ফিরে
যখন দেখেছি ঘাস ঢেউ রোদ মিশে আছে তোমার শরীরে।
এ অশ্রুতপূর্ব উচ্চারণের পর ‘প্রকৃতির শোভা ভূমিকার প্রেম’ বলে জীবনানন্দ কী বোঝাতে চেয়েছেন, তার আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না।
‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্যায়ে জীবনানন্দের কাছে প্রকৃতিই ছিলেন সমস্ত প্রতীকের জননী; ‘মেঠো চাঁদ, শিঙের মতো বাঁকা চাঁদ’, ‘কার্তিকের মাঠ’ কিংবা তাদের নিজস্ব নৈসর্গিক পরিমণ্ডলের অতিরিক্ত কিছু দ্যোতনায় কবিতার ভাববস্তুতে সঞ্চারিত করেছে প্রতীকী ব্যঞ্জনা। ‘বনলতা সেন’ পর্যায়ে প্রতীকায়নের সেই প্রবণতা আরো প্রবল ও পরিণত এবং বিষয়ের সঙ্গে গাঢ় সাযুজ্যে উপস্থাপিত। এ পর্যায়ে প্রতীক আর শুধুমাত্র । কিছু নৈসর্গিক উপকরণের মধ্য দিয়ে শব্দের অভিধার অতিরিক্ত মাত্রাযোজনার কারণ হয়নি; প্রায়শই তা বিষয় বা ভাববস্তুর উপস্থাপনার মধ্য হতেই উৎসারিত। প্রতীকী রীতির এ নবপ্রসৃতি অনেকগুলি কবিতার নামকরণেই আভাসিত। ‘বনলতা’ এ নামের মধ্যেও যে এক নিসর্গপ্রতিম নারী উপস্থিত, তা আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি; প্রেম ও প্রকৃতি এ কবিতাটিতে এক অভিন্ন প্রতিমায় উপস্থিত থেকে কবিতাটির ভাববস্তুতে যোগ করেছে তাৎপর্য-গভীরতা। আর সেভাবে গৃহীত হলেই কবিতাটি যথার্থ অর্থময় হয়ে ওঠে। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে বা জীবনানন্দের সেই সময়ের অন্য রচনায় প্রেম প্রকৃতির ‘শোভাভূমিকা’য় উপস্থিত শুধুমাত্র এটুকু বললে তা অর্ধসত্যের মতো শোনাবে। ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থের কবিতাবলীতে নারী এসেছেন বার বার নানা মূল্যবোধের আধারিকারূপে। প্রকৃতির প্রশান্তির সম্ভার নিয়ে ‘বনলতা সেন’ অপেক্ষা করে আছেন অন্বেষাক্লান্ত মানবাত্মার জন্য। ‘সুরঞ্জনা’, ‘সুদর্শনা’, ‘সুচেতনা’ প্রভৃতি কবিতার বাহিরের আয়োজনে কোনো নারী, কোনো মানবীয় প্রেম বিষয়ীভূত বলে মনে হলেও নিবিষ্ট অনুধাবনে এসব কবিতার প্রতীকী আবরণ উন্মোচিত হয়ে যায়। দেখা যায়, মানবজীবনের কোনো না কোনো অভীলার শক্তি বা প্রেরণা এখানে নারীর প্রেমের রূপকে আশ্রিত; নারী হয়ে উঠেছেন প্রতীক। ‘সুরঞ্জনা’ কবিতায় ‘সুরঞ্জনা’কে সম্বোধন করে কবি মানব-হৃদয়ের দুর্মর প্রেম-বাসনাকেই তাঁর কবিতার উপজীব্য করেছেন এবং তাকে ইতিহাস-চেতনায় জারিত করে নিয়েছেন (সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছে)। কিংবা ‘সুচেতনা’ কবিতাটিতে পৃথিবীর গীবতর অসুখের যুগে মানব-হৃদয়ের সুচৈতন্য তথা শুভ চেতনা দূরতর দ্বীপের প্রতীকে অবসিতপ্রায়, এ কথাটিই কবি জানাতে চেয়েছেন।
‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’-’রূপসী বাংলা’ পর্যায়ের প্রেমের কবিতাবলী থেকে ‘বনলতা সেন’-এর অন্তর্ভুক্ত প্রেম বিষয়ক কবিতার স্বাদ তাই ভিন্নতর। পূর্ব পর্যায়ের কাব্যের অনুপুঙ্খ চিত্রায়ণের অবিরল প্রবাহের পরিবর্তে এ পর্যায়ের কবিতায় এসেছে মিতভাষণ আর প্রতীকী ব্যঞ্জনার নবীন বিস্তার। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে কবির ভূমিকা এক মুগ্ধ আবিষ্ট দর্শকের; প্রকৃতির ক্ষয়-বিলয়ের পটভূমিতে তাঁর সেই তাকিয়ে দেখার আনন্দ রূপান্তরিত হয়েছে বিষন্ন সংবেদনায়। ধূসর ম্লান হিমার্ত নিসর্গজগতে আবির্ভূত হয়ে প্রেম সেখানে বহন করে এনেছে ‘বঞ্চনা, হতাশা, ক্ষোভ, যন্ত্রণার বিষ’। প্রেমের মৃত্যুহীনতার কথা সেখানেও আছে; আছে তার অমর্ত্যপ্রসাদ আর ক্ষণভাসিত উল্লাসের কথাও। কিন্তু অপ্রাপণীয়ের জন্য আর্তি আর বঞ্চিত প্রেমের সংক্ষোভ-ই সেখানে প্রবল, নেই কোনো গাঢ় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বাণী। ‘বনলতা সেন’ পর্যায়ে প্রেম আরো বড়, আরো গভীর চেতনার আলোকে মূল্যায়িত। নিসর্গ তাঁর একালের কাব্যে১ শুধু প্রেক্ষিতই রচনা করেনি, হয়ে উঠেছে জীবনের মূলাধার। ফলে ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থটিতে ও পরবর্তীকালের অনেক কবিতায় বহু সময়েই জীবনানন্দের প্রেম ভাবনা প্রকৃতিলীন এ জৈবিক অস্তিত্বের চেতনায় নিরাপত্তা ও শান্তি খুঁজেছে।২ আবার, জায়মান এক ইতিহাসচেতনায় এ সময়কার কাব্যে প্রেম এক স্থির প্রতিশ্রুতির স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়েছে, পরিণত হয়েছে প্রশান্ত বিশ্বাসদীপ্ত উপলব্ধিতে। ফলে কবিতার পর কবিতায় প্রেম আবির্ভূত এক গাঢ় আবেগার্ল উচ্চারণে।
এ পর্যন্ত জীবনানন্দের কাব্যে প্রেম-প্রতিরোধের প্রকাশনায় সংবেদনা ও মননের নবীন বিস্তারের কথাই বলেছি। ‘বনলতা সেন’ পর্যায়ের কবিতায় ভাবের প্রকাশ মাধ্যমগুলিকেও জীবনানন্দ নূতন শক্তি ও ব্যঞ্জনায় সঞ্জীবিত করেছেন। ঠিক যতটা অংশে মাধ্যমে বা রীতির নবীনতা এবং স্বাতন্ত্র বিষয়বস্তুকে এ যাবৎ দুর্লক্ষ্য কোনো ব্যঞ্জনা ও শক্তিতে চিহ্নিত করে, ততটাই তা আমাদের বর্তমান আলোচনার অংশভুক্ত হবার দাবি রাখে। তেমনই একটি প্রসঙ্গ : ‘বনলতা সেন’ পর্যায়ের কবিতাবলীতে প্রতীকের স্বচ্ছন্দ ব্যবহার ও তাৎপর্যময়তা। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ থেকে ‘সাতটি তারার তিমির’ পর্যন্ত জীবনানন্দের বিবর্তনশীল কাব্যপ্রবাহে এ প্রতীকী তাৎপর্যের উপলব্ধি কাব্যের অর্থ-অনুধাবনের বিশেষ সহায়ক। সুচেতনাকে সোধন (‘সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ’) করে এ জাতীয় উচ্চারণের অর্থোদ্ভাস কোনো রসবেত্তা পাঠকের কাছে গোপন থাকে না। কিন্তু কেন জীবনানন্দ বিশেষ করে নারীকেই বেছে নিলেন মানুষের চেতনানিহিত কোনো মূল্যবোধ তথা প্রেরণা-শক্তির বিমূর্ত উপস্থিতিকে তাঁর কবিতায় একটি অবয়ব দিতে, কেন কোনো মানবীর প্রেমের সাঙ্গীকরণে রূপায়িত করলেন। মানব-সভ্যতার সম্মুখ-যাত্রার অন্তর্জাত শক্তিরূপী মূল্যবোধগুলি—সেসব প্রশ্ন স্বাভাবিক। উত্তরে বলা যায়, সৌন্দর্য ও কল্যাণের সমাহারে নারী মানব-হৃদয়ের চির আদরণীয়া, তার আকাক্ষার অভীষ্ট, যেমন মানব-মনের মূল্যবোধগুলি ইতিহাসের ঘনঘটায় কখনো কখনও দুর্নিরীক্ষ্য হলেও চিরন্তন; নাবিকের কাছে সৈকতের সত্যের মত, ধ্রুবতারকার মতো অকম্প ও দিশারী; আবার প্রেমের-ই মতো তারা যন্ত্রণাহত ও মৃত্যুস্পৃষ্ট হয়েও দুর্মর ও চিরজীবিত। জীবনানন্দের এ পর্যায়ের কবিতায় নারী শুধু তার সৌন্দর্যরূপেই আবির্ভূতা নন, তিনি এসেছেন তার কল্যাণস্বরূপে। তাঁর কাব্য নায়িকাদের অনেকের-ই নামের আগে তাই ‘সু’ শব্দটি উপস্থিত, যথা-সুদর্শনা, সুরঞ্জনা, সুচেতনা।
নারীর প্রেমের রূপককে আশ্রয় করে কবিতাবস্তুর এ প্রতীকী বিস্তার (‘বনলতা সেন’ পর্যায়ে) জীবনানন্দের প্রেমচেতনায় নবীনতার স্বাদ ও তাৎপর্য সংযুক্ত করলেও বাংলাকাব্যের পূর্ব ঐতিহ্যে তা একেবারে অপরিজ্ঞাত ছিল না। মনে করা যেতে পারে, ‘মহুয়া’র সেই ‘নারী’, কবিতাগুচ্ছ : ‘শামলী’, ‘কাজলী’, ‘জয়তী’, ‘উষসী’, ‘করুণী’ ইত্যাদি কবিতাগুলি। লঘুভার হলেও এসব রচনায় নারীর ভাবরূপের এক একটি দিক চিহ্নিত এবং সেই ভাবানুযায়ী নামে নায়িকা সম্বোধিত। এভাবেই কোনো অব্যবহিত প্রয়োজনে রচিত হয়েও কবিতা সেই প্রয়োজনের বাস্তব সীমারেখা অতিক্রম করে যায় :
সৃষ্টির রহস্য আমি তোমাতে করেছি অনুভব
নিখিলের অস্তিত্ব গৌরব।
অন্তহীন কাল আর অসীম গগন
নিদ্রাহীন আলো
কী অনাদি মন্ত্রে তারা অঙ্গ ধরি তোমাতে মিলাল।
যুগে যুগে কী অক্লান্ত সাধনায়,
অগ্নিময়ী বেদনায়,
নিমেষে হয়েছে ধন্য শক্তির মহিমা
পেয়ে আপনার সীমা,
ওই মুখে ওই চক্ষে ওই হাসিটিতে।৩
রবীন্দ্রনাথের হাতে যা ছিল বিমূর্ত ভাববস্তুর রূপাধার, জীবনানন্দের কাব্যে সেই রীতিতে সংযুক্ত হলো প্রতীকী দ্ব্যর্থকতার অতিরিক্ত মাত্রা। রূপকায়ণের মধ্যে অর্থের সমান্তরাল সাযুজ্য বা বিস্তার অনেক সময়েই আরোপিত যুক্তিসৃত, তাই কৃত্রিম বলে মনে হয়। জীবনানন্দের আধুনিক শিল্পী-মনস্কতা সেই রীতিগত কৃত্রিমতাকে অতিক্রম করতে চেয়েছে প্রতীকের গহনতায় ও অভেদে। কবিতার বহিরঙ্গের আয়োজন তিনি। সম্পূর্ণ করেছেন বাস্তবের পরিচ্ছেদে; কিন্তু তার অন্তরঙ্গ আবেদন এ বাইরের বেশ খুলে ফেলেই মেলে ধরে শব্দের প্রতীকী রহস্য-গভীরতা ও ভাব-তাৎপর্য। তাঁর নারীনায়িকাদের নামের সঙ্গে জীবনানন্দ কখনো যুক্ত করেছেন পদবী (‘সেন’, ‘সান্যাল’, ‘ঘোষাল’), কখনো বা আঞ্চলিকতার আবহ (‘নাটোরের ‘বনলতা সেন’, ‘কবেকার পাড়াগার অরুণিমা’)। এ সব-ই কিন্তু এসেছে শিল্পরূপসিদ্ধির সম্পূর্ণতার প্রয়োজনে। প্রতীককে একটি নাতিস্পষ্ট বাস্তবসম্ভব যাথার্থ্য দেবার জন্য যেন কবিতার ওপরে বিস্তৃত রাখা হয়েছে শরীরী বিশ্বাসযোগ্যতার এক আবরণ।
রবীন্দ্রনাথ শক্তির মহিমা’কে নারীর চোখ, মুখ ও হাসিতে, এক কথায় নারীর আবয়বিক রূপের সীমায় প্রকাশিত হতে দেখেছিলেন। জীবনানন্দ মানবের চৈতন্যগত শুভবোধ বা প্রেরণাগুলির কল্যাণশক্তি ও ঐশ্বর্য নারীর প্রতীকে উদ্ভাসিত করেছেন। তাঁর ‘সুরঞ্জনা’, ‘সুচেতনা’, ‘সুদর্শনা’, ‘বনলতা’, ‘শ্যামলী’, ‘সবিতা’রা তাই শুধু রক্তমাংসের মর্তমানবীমাত্র হয়েই কবিতার পর কবিতায় উপস্থিত হননি, এনেছেন যথাক্রমে মানব-হৃদয়ের দুর্মর প্রেমবোধ, শুভচেতনা, সৌন্দর্য-পিপাসা, আদি নিসর্গমুখিনতা, মানবেতিহাসের অন্তলীন যৌবন-অভীপ্সা ও প্রেমের সৌরপ্রেরণার ব্যঞ্জনা। এসব কবিতার অর্থবোধ সহজতর হয় এবং যৌক্তিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ায় যখন আমরা কবিতার এ প্রতীকী ব্যঞ্জনার দিকটি সম্পর্কে অবহিত থাকি। এ কবিতাগুলির পূর্ণতর ব্যাখ্যা স্বতন্ত্র মনোযোগের দাবি রাখে, যা এ পর্যালোচনার বর্তমান ধাবার পক্ষে প্রক্ষিপ্ত মনে হতে পারে বলেই এখানে সে চেষ্টায় বিরত থাকাই উচিত মনে করেছি।
প্রেমচেতনার দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থটির অধিকাংশ কবিতাই রোমান্টিক ভাবাদর্শে চিহ্নিত। এক পরিপূর্ণ জীবন ও সৌন্দর্য-জগতের কল্পনা, সেই জগতে প্রয়াণের আকাক্ষা এবং অনুষঙ্গী অপ্রাপণীয়তার বোধ, স্মৃতিভারাতুরতা ও বিষাদ, মধ্যযুগীয় গরিমা ও সৌন্দর্যের জগতে বিচরণ এবং তার লুপ্ত জীবনৈশ্বর্যের বোধন—এ চেতনালক্ষণ জীবনানন্দের একালের কবিতাবলীকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।
স্মৃতিভারাতুরতা ও ব্যর্থতার বিষাদ ‘কুড়ি বছর পরে’, ‘দুজন’, ‘অঘ্রাণপ্রান্তরে’ কবিতাগুলিতে নিজস্ব জীবনানন্দীয় আমেজ সঞ্চার করেছে। ‘দুজন’ ও ‘অঘ্রাণ প্রান্তরে’ কবিতা দুটি দীর্ঘ অক্ষরবৃত্তের চলনে, হৈমন্তিক নিসর্গপট ভূমির বিস্তারে, চিত্রকল্পে ও ধ্বনির নানা অনুষঙ্গে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ক্ষয়িষ্ণু নিসর্গ-সৌন্দর্যের জগতের স্মৃতি বহন। করে। তবে এখানে আর শুধু চিত্ররূপময় প্রাকৃতিক পটভূমিতে তাকিয়ে দেখার আনন্দ’ই শেষ কথা নয়; তার সঙ্গে যুক্ত হলো মানবিক অনুভাবনার মাত্রা :
অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে,
সে সবের ঢের আগে আমাদের দু’জনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু,৪
এখানে অঘ্রাণপ্রান্তর আর ঘাসের ভেতরে পড়ে থাকা শুকনো ঘেঁড়া পাতা যেন। নিষ্প্রেম হৃদয়ের-ই শূন্য প্রান্তর আর জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি’র ভাববহ। মেজাজের দিক থেকে ‘কুড়ি বছর পরে’ কবিতাও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ভাবানুষঙ্গ নিয়ে আসে। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে প্রেমিক পঁচিশ বছর ঈপ্সিতা নারীর প্রতীক্ষায় কাটিয়ে শীতের শিশিরে ভেজা মাঠে পাখির ঠাণ্ডা কড়কড়ে ডিম, নষ্ট সাদা শসা, ছেড়া মাকড়ের জাল দেখতে দেখতে ব্যর্থ ক্লান্তিতে বলেছেন : ‘পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে’—নারী তার প্রতীজ্ঞা রাখেননি। ‘কুড়ি বছর পরে’ কবিতার নায়ক কার্তিকের শস্যরিক্ত নৈশ প্রান্তরে পাঠককে ডেকে নিয়ে এসে হঠাৎ স্মৃতি-বিস্মৃতির সরু আলপথে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়, যখন শিরীষের ডালপালার ফাঁকে মধ্যরজনীর চাঁদ উঁকি দিয়ে যায়। তখন কবির সঙ্গে পাঠকও অনুভব করেন স্মৃতিমথিত আবেগ :
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার।৫
যে তিনটি কবিতার কথা এতক্ষণ উল্লেখ করেছি, তার কোনোটিই কিন্তু জীবনানন্দের প্রেমচেতনার কোনো নতুন দিকনির্দেশ করে না; ‘প্রকৃতির শোভাভূমিকায় তার মানবিক প্রেমকে উপস্থাপিত মাত্র করে, প্রায় ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্যায়ের কবিতাবলীর-ই মত। তবু কবির নিজেরই কথায়, ‘হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে সেখানে মানুষ আশ্বাস খুঁজেছে এসে’। এই সেখানে অবশ্যই নিসর্গের বিলয়ধূসর রূপের জগৎ, যেখানে ‘ঝরিছে মরিছে সব—বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের বলে’। দুজন কবিতার নায়ক-নায়িকাকে কবি ডেকে এনেছেন প্রকৃতির হৈমন্তিক বিষন্নতার জগতে, কারণ হেমন্তের শস্যহীন মাঠের সঙ্গে প্রেম-অবসিত মানব-হৃদয়ের সার্থক সাযুজ্য তিনি অনুভব করেছেন : ‘আজ এই মাঠ সূর্য সহধর্মী ঘ্রাণ কার্তিকে/প্রাণ তার ভরে গেছে।’ এই ‘দুজন’৬ কবিতাটির কয়েকটি উচ্চারণ-ই পাঠককে সচেতন করে তোলে জীবনানন্দের প্রেম-ভাবনার নবনীত মনন-রূপটির দিকে। কবির কাছে ‘পৃথিবী ও আকাশ’, অর্থাৎ নিসর্গভুবন চিরস্থায়ী। মানুষের মনোজগতে ভালবাসার জন্ম-মৃত্যুর চঞ্চল নশ্বরতার পাশে পরিকৃতির শান্তি ও সান্ত্বনার অপরিবর্তনীয় আশ্বাসের বাণী এখানেই যেন প্রথম উকি দিয়ে যায়। আবার, এ কবিতায় নায়িকা যখন বলে ওঠেন, ‘আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না/হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের’, কিংবা তার প্রেমিকের যখন মনে হয়, ‘এই নারী অপরূপ খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে’ যেখানে ‘অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতাকে’ খুঁজে পাওয়া যায়, তখন তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় প্রেমের সেই চিরন্তন দিব্যতার আদর্শ, যা এক অপ্রাপণীয়ের সৌন্দর্যমূর্তি ঘিরে উৎসারিত হয়েছে রোমান্টিক কাব্যের দেশকাল নিরপেক্ষ সম্ভারে।
জীবনানন্দের কল্পনা এবং চেতনায় (‘বনলতা সেন’ গ্রন্থটিতে বা সেই পর্যায়ের কবিতাবলীতে) নিসর্গ শুধু সৌন্দর্যের জগৎ নয়; শান্তি ও নিশ্চিতির এক আশ্রয়ভূমি। এ পরিবর্তিত চেতনাভূমির ওপর-ই কবির প্রেম-ভাবনা নবাঙ্কুরিত হয়েছে মননোজ্জ্বলতায় এবং ইতিহাসবেদী বিশ্বাসে। শুদ্ধ প্রতর্কের ‘ইঙ্গিত’ (বা যুক্তিবাদী মনন) এবং ‘চতুর্দিককার প্রতিবেশ-চেতনা’ কিভাবে কবি-কল্পনায় সঞ্চারিত হয়ে তাকে পরিণতি ও সারবত্তা দেয়, সে প্রসঙ্গে জীবনানন্দের অভিমত ‘কবিতার কথা’ নিবন্ধে অভিব্যক্ত। সেই মনন ও প্রতিবেশচেতনার অভিঘাত পরোক্ষ ধারণ করেছে তাঁর একালের কাব্য চতুম্পার্শ্বের বিরুদ্ধবাস্তব, খণ্ডচৈতন্যের গ্লানি ও অপূর্ণতা থেকে প্রেম এখানে এক পূর্ণতর জীবন-অভিজ্ঞতার আস্বাদ ও আশ্রয় খুঁজেছে নিসর্গের জৈব প্রাণরঙে। নিসর্গের নিবিড় নিরবচ্ছিন্ন প্রণপ্রবাহের মধ্যে আত্মনিমজ্জনের অভীপ্সা ‘আমি যদি হতাম’ ও ‘ঘাস’ এ দুটি কবিতায় অভিব্যক্ত। ঘাসের ভিতরে ঘাস হয়ে জন্মানোর যে ঈপ্স কবির চেতনায় ধ্বনিত, তার-ই স্পষ্টতর, সরলতর প্রকাশ ঘটেছে ‘আমি যদি হতাম’-এর মতো রোমান্সধর্মী কবিতায়। একটি কবিতার বিষয় প্রেম; প্রেক্ষিত প্রকৃতি। প্রেম এখানে মুক্তি ও শান্তির আশ্রয় খুঁজছে নিসর্গলোকে, মনুষ্যভিন্নঅস্তিত্বের প্রকৃতিলীন জৈব সম্পূর্ণতার মধ্যে : “কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে ধানক্ষেতের কাছে/ছিপছিপে শরের ভিতরে/এক নিরালা নীড়ে”। বনহংসমিথুনের জৈব প্রাণোল্লাস, প্রতীকের অন্তরাল থেকে আভাসিত করে নিসর্গ-জীবন প্রবাহের মধ্যে নিমজ্জনে কিভাবে কবির চেতনা খুঁজছে বাধা-বন্ধনহীন জীবনের পরিপূর্ণতা। কবি জানেন, নিসর্গ-জীবন নানা মারণআকস্মিকতায় ভরা, যে কোন মুহূর্তে নেমে আসতে পারে মৃত্যুর যবনিকা : ‘হয়তো গুলির শব্দ আবার/আমাদের স্তব্ধতা,/আমাদের শান্তি’। তবু সেই জীবন-ই কবির অভিপ্রেত; কারণ সেখানে মানুষের জীবনের ‘টুকরো টুকরো মৃত্যু’, টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার নেই। এভাবেই মানুষের আধুনিক জীবনের ক্ষুদ্র খণ্ডত্বের বিপরীতে নিসর্গলীন অস্তিত্বের সপ্রাণ পূর্ণতার বাণী ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থেই পরিণত মননের মধ্য দিয়ে কাব্যরূপ নিয়েছে। শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় সংবেদিতার মধ্য দিয়েই প্রকৃতি জীবনানন্দের একালের কাব্যে তার ঐশ্বর্য অবারিত করেনি, নিয়ে এসেছে পূর্ণতব মনন অভিজ্ঞতায় লব্ধ এক নিশ্চিতি, অখণ্ড পরিপূর্ণ অস্তিত্বের বোধ ও প্রশান্তির আশ্বাস। মানবের ইহজাগতিক অস্তিত্বে নিসর্গের এ নবমূল্যায়িত মহিমার পরিপ্রেক্ষিতেই এ পর্বে প্রেমের আবির্ভাব এমন উজ্জ্বল। ‘বনহংস-মিথুন’, ‘বুনোহাঁস’, ‘হরিণ’ হয়ে উঠেছে এক মুক্ত, নির্বাধ, পূর্ণতর জীবন-বাসনার প্রতীক। বুনোহাঁসের প্রতীকটি এক-ই সঙ্গে বন্য জৈব কামনা ও বাধা মুক্ত বাসনার উল্লাস আভাসিত করে। বুনোহস তখন-ই পাখা মেলে, যখন ‘পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রর পানে’। পেঁচা এখানে বিচক্ষণতা, বুদ্ধি বা সংস্কার-আশ্রিত জীবনের প্রতীক, যে জীবন ‘নিয়মের রূঢ় আয়োজনে’ বা নিষেধের শাসনে অবদমিত রেখেছে মানব-হৃদয়ের প্রেমের মুক্তি-স্পৃহা। ‘পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে গেলে’ অর্থাৎ বিচারপ্রবণ বিচক্ষণ সতর্কতার অবরোধ অপসৃত হলে, ‘বুনোহাঁস পাখা মেলে’—মগ্ন-চৈতন্যের গহনতা থেকে বেরিয়ে আসে বুনো হাঁসের দল। নির্বাধ উল্লসিত বাসনার পাখিরা তখন মুক্তির আনন্দে ডানা মেলে দেয় ‘পউষের জ্যোৎস্নায়’। এ কবিতার শিল্পসিদ্ধি এমন-ই অনায়াস যে, কখন বুনোহাঁসের দল। নির্বাধ উল্লসিত বাসনার পাখিরা তখন মুক্তি আনন্দে ডানা মেলে দেয় ‘পউষের জ্যোৎস্নায়’। এ কবিতার শিল্পসিদ্ধি এমন-ই অসহায় যে, কখন বুনো হাঁসের দল। কল্পনার হাঁসে রূপান্তরিত হয়ে গিয়ে পউষের জ্যোৎস্না ছেড়ে হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভেতর উড়তে থাকে, তা বুঝে ওঠার অনেক আগেই কবিতার যাদুকরী চরণগুলি পাঠকের কল্পনায় মুদ্রিত করে দেয় ‘কবেকার পাড়াগায় অরুণিমা সান্যালের মুখ’— দূরকালের ব্যবধান ভেঙে উঠে আসে হারানো প্রেম, ভালবাসার নারী, তার লজ্জারুণ মুখশ্রী। কিন্তু এখানেও দেখি, নিসর্গের অবারিত জৈব প্রাণপ্রবাহের মধ্যে বুদ্ধিগত চেতনাকে নিমজ্জিত করে দিয়েই হৃত, অবদমিত প্রেম-বাসনা কথা কয়ে উঠেছে। বুনোহাঁসের প্রতীকটির ব্যবহার সেই নিমজ্জনের-ই ইঙ্গিতবহ। যা কিছু চেতনার গভীরে বন্যতায় মূলবদ্ধ, তা-ই যেন হঠাৎ উড্ডীন ডানায় নির্বাধ, স্বাধীন।
ব্যবহারিক জীবনের অবলেপে দমিত প্রেম-বাসনার ক্ষণজীবী মুক্তির উল্লাসের সাক্ষ্য বহন করছে এ গ্রন্থের সমধর্মী আর একটি কবিতা : ‘হরিণেরা’। হরিণ শুধু তার লোকপ্রসিদ্ধ সৌন্দর্যের জন্যই নয়, প্রেয় ও অপ্রাপণীয়ের প্রতীক হিসেবেও আবহমান মানব চেতনায় সুপ্রতিষ্ঠ। আবার দ্রুতচারী এ প্রাণীটি মুক্তির দ্যোতনাও বহন করে তার উল্লাসস্পৃষ্ট গতির ইঙ্গিতে। কিন্তু ভুললে চলবে না, হরিণ নিসর্গচারী—জীবনানন্দের কবিতাটিতে সে স্বপ্নের মধ্য হতে উঠে এসেছে ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় পলাশের বনে। চারদিককার নিসর্গ মাধুরিমার মধ্যে ক্রীড়াচঞ্চল হরিণদের নির্বাধ উল্লাস কবির চেতনায় জাগিয়ে তুলছে হারানো প্রেমের জন্য আর্তি : ‘বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা বোস’ নিসর্গের এ রম্য অন্তরাল থেকে তার মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যায়। এক দূরাপসারিত স্বপ্নের জগৎ অবদমিত প্রেম-বাসনার মুক্তির মধ্য দিয়ে আবার বাজয় হয়ে ওঠে :
বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা, আহা,
ফারুনের জ্যোৎস্নায় হরিণেরা জানে শুধু তাহা।
আলোচিত দুটি কবিতাতেই দেখা যায়, ভালোবাসা বা ব্যর্থ বাসনার বিষাদভার যে জগতে মুক্তি খুঁজছে, তা প্রাত্যহিকতায় অবলীন আমাদের পরিচিত পৃথিবী নয়, এক কল্পজগৎ (‘পৃথিবীর সব রঙ ধ্বনি মুছে গেলে পর’) যেখানে নৈসর্গিক প্রশান্তির সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে বয়ে চলেছে এক পরিপূর্ণ প্রাণপ্রবাহ, যা ইন্দ্রিয়সংবেদী, প্রতকতাড়িত নয়।
‘প্রকৃতির শোভাভুমিকায় প্রেম’-এর উপস্থাপনা জীবনানন্দের পূর্বপর্যায়ের কাব্যেও দেখা গেছে। সে প্রকৃতিলোক ছিল ধূসর, হৈমন্তিক বিষাদ ও মৃত্যুর ভারাবলীন। নিসর্গসৌন্দর্যের ক্ষণজীবী রমণীয়তায় কবি তখন অনুভব করেছিলেন বিষাদ, আর তারই সঙ্গে মিলেয়ে দিয়েছেন ভালোবাসার নশ্বরতার বেদনা। জীবনানন্দের কাব্যের প্রাথমিক পর্বে প্রেম মৃত্যুস্পষ্ট। তার মধ্যপর্যায়ের কাব্যে, অর্থাৎ ‘বনলতা সেন’ ও সমসাময়িক কবিতাবলীতে, প্রেমের এ মৃত্যুআহত নশ্বর রূপটিই বড় নয়। একালে প্রকৃতি-পৃথিবী জীবনানন্দের কাছে হয়ে উঠেছে প্রশান্তি ও নিশ্চিতির কেন্দ্র, এক পরিপূর্ণ প্রাণরঙের দ্যোতক। নিসর্গ-নিমগ্ন প্রেমকে সেই পূর্ণ জীবনলোকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন কবি। তাই প্রেম ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থে ও পরবর্তী পর্যায়ের বহু কবিতাতেই মৃত্যুর বৈনাশিক বিষাদকে অতিক্রম করে মরণজয়িতার শক্তিতে আবির্ভূত। আহমান মানবচেতনার সৌল অপরাহত বোধের স্বরূপেই যেন তার প্রকাশ। প্রেমের মরণজয়িতার বোধ পরিপুষ্ট হয়েছে কবির ইতিহাসচেতনায়—জীবনানন্দের একালের কাব্যে যার একটি সুনির্দিষ্ট ও মননঋদ্ধ বিগ্রহ পাওয়া যায়। এবং প্রকৃতি যেন সংযুক্ত করেছেন মানবচিত্ত-গহনবাসা এ মৃত্যুত্তীর্ণ প্রেমবোধে তাঁর প্রশান্তির সম্পদ। এভাবেই জীবনানন্দের মধ্যপর্যায়ের কাব্যে ‘প্রেম’ হয়ে উঠেছে প্রেয় অন্বিষ্টের এক গরীয়সী প্রতিমা। তাঁকে আমরা আবিষ্কার করি দীর্ঘ ক্লান্ত সহস্রবর্ষব্যাপী অন্বেষার পরে ‘সবুজ ঘাসের দেশে’ বনলতা সেনের ইতিহাসমণ্ডিত অবয়বে, তার ‘পাখির নীড়ের মতো’ চোখের প্রত্যাশিত প্রশান্তির আশ্রয়ে।
এ কবিতার প্রথম স্তবকে যুগ-যুগান্তরব্যাপী মানব-অন্বেষার উত্তর-ব্যক্তিক আবহ; দ্বিতীয় স্তবকে দিশাভ্রান্ত নাবিকের ঘাসের দেশে আশ্রয়-গ্রহণের চিত্রকল্প, নায়িকার ইতিহাসমণ্ডিত মুখচ্ছবি, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ইতিহাসচেতনায় অভিষিক্ত প্রেমবোধের মূল্যমহিমার কথা। এ প্রেম চিরজীবিত; তাই দুদণ্ডের শান্তির প্রসঙ্গ অতিক্রম করে নায়ক শেষ পর্যন্ত ‘বনলতা সেন’কে পুনরাবিষ্কার করেন, কবিতার শেষ স্তবকে, ইহজাগতিক বিনিময়ের উধ্বেস্থিত চিরন্তনতার মধ্যে। আবার প্রথম স্তবক থেকেই নায়ক যখন নিজেকে যুক্ত করে নেন হাজার বছর ধরে পথ-হাঁটা মানবসত্তার সঙ্গে, তখন-ই বনলতা সেন’ হয়ে ওঠেন আবহমানকালব্যাপী ভ্রাম্যমাণ মানবসত্তার অন্বিষ্টের প্রতীক, চিরমানবাত্মার প্রেয়সী। বিদিশা-শ্রাবস্তীর উল্লেখ তখন তাঁকে ঐশ্বর্যময়ী করে তোলে; কবির ইতিহাসচেতনায় সুগঠিত হয়ে ওঠে মানব-প্রেয়সীর প্রত্নপ্রতিমা। জীবনানন্দ যেন ঐহিক প্রেমের আয়োজন স্বীকার করে নিয়েই বনলতা সেনকে ঘিরে রচনা করেছিলেন মানব-হৃদয়ের চিরন্তন অভীপ্সর পরিমণ্ডল। প্রেয়সী নারী হলেন শ্রেয় অভিষ্টের ও নিশ্চিতির প্রতীক।
কিন্তু ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে প্রেম মুক্তি ও শান্তির আশ্রয় খুঁজেছে নিসর্গলোকে, প্রকৃতি পৃথিবীর নির্বাধ ও অখণ্ডিত প্রাণপ্রবাহে। নাম-কবিতাটির তাৎপর্য তাই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রণিধেয়। ‘বনলতা’ নামটির মধ্যেই রয়েছে প্রকৃতি-পৃথিবীর অপ্রতিরোধ্য উপস্থিতির ব্যঞ্জনা। এ ‘বনলতা সেন’ শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ অন্বেষার সফেন সমুদ্র পেরিয়ে আবিষ্কৃত হন ‘সবুজ ঘাসের দেশের মতন’, আর অন্বেষাক্লান্ত মানবপ্রেমিকের প্রতি অভ্যর্থনা জানায় তার ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’। দু’টি চিত্রকল্পই নিসর্গপৃথিবী থেকে আহৃত (‘ঘাস ও পাখি’) হয়ে ‘বনলতা’কে আরো সুনিশ্চিতভাবে করে তোলে প্রকৃতি স্বরূপিনী। এ কবিতাটিতে এক প্রকৃতি (নিসর্গলোক) ভাব-সাযুজ্য পেয়েছে আর এক প্রকৃতির (নারী) মধ্যে। জীবনানন্দের বিবর্তনশীল কাব্যপ্রবাহের পূর্বপর প্রকৃতিমুখিনতা এবং ‘বনলতা সেন’ পর্যায়ের কবিতাবলীতে অভ্রান্তভাবে লক্ষণীয় প্রকৃতির জীবন-অস্তিত্বের পূর্ণতা ও প্রশান্তির প্রসঙ্গটি স্মরণে রাখলে এ দাবি স্বীকার্য মনে হয়। কিভাবে লৌকিক প্রেম-আখ্যানের বহিরঙ্গ ও আঞ্চলিক ভৌগলিক স্বাদের বাস্তবতা (‘নাটোর’ ও ‘সেন’ উপাধির প্রয়োগ) বজায় রেখেও জীবনানন্দ তার এ অনবদ্য কবিতাটিতে সঞ্চারিত করেছেন লোকোত্তর ব্যঞ্জনা, তা ভেবে আমরা বিস্ময়াবনত হয়ে পড়ি ঠিকই, তবু নিছক ব্যক্তিগত প্রেম-কাহিনীর কবিতা হিসেবে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি সমস্ত রোমান্টিকতা ও উত্তাপ নিয়েও তার। অর্থের বহুতলবিস্তার উন্মোচিত করে না।
‘বনলতার সেন’ পর্যায়ে জীবনানন্দের প্রেমচেতনা ইতিহাসবেদে আশ্রিত ও পরিপুষ্ট। মানবসভ্যতার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মানবসত্তার প্রেয় অৰিষ্টের জন্যে সম্মুখযাত্রার চিত্রকল্পটি ‘বনলতা সেন’ কবিতার প্রথম স্তবকেই ইতিহাসবেদিতার ভূমিতে আশ্রিত হয়ে মহত্তর ব্যঞ্জনা সঞ্চার করেছে। এ হাজার বছর ধরে পথহাঁটা মানবপথিকের চিত্রটি ‘পথহাঁটা’ কবিতাটির শেষ দুটি চরণে সহসা এক অপ্রতিরোধ্য অভিঘাতে পাঠককে পৌছে দেয় অব্যবহিত নাগরিক অস্তিত্ব থেকে আবহমান মানবঅস্তিত্বে : ‘বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর/কেন যেন, আজো আমি জানিনাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।’ কিন্তু সেই কবিতার প্রসঙ্গ প্রেম নয়, শুধু হাজার বছরের ভ্রাম্যমাণতার চিত্রকল্পটি কেমনভাবে পুনরাবৃত্ত হচ্ছে-তাই দেখানোর প্রয়োজনে বিষয়টি উল্লিখিত হলো। অন্যদিকে, হাজার বছর শুধু খেলা করে কবিতাটি অভ্রান্তভাবে সময়ের বিলয়ধর্মী পটভূমিতে চিররাত্রির আবহে (‘চারিদিকে চির দিন রাত্রির নিধান) মানবচেতনায় দীপ্যমান রেখেছে প্রেম। ইহজাগতিক লেনদেনের পরও, ব্যক্তি মানবের মৃত্যু হলেও (শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের’) যেন এক মরণাতীত সত্তায় বিরাজ করেন বনলতা সেন—মানবচেতনার গভীরে নিহিত দুর্মর প্রেমবোধ : ‘মনে আছে’? শুধাল সে—শুধালাম আমি শুধু—বনলতা সেন’।
‘পৃথিবীর বয়সিনী’ যে মেয়েটিকে কবি ‘সুরঞ্জনা’ বলে সম্বোধন করেছেন, তিনিও এ চিরন্তন প্রেমের-ই প্রতিমা। ‘সুরঞ্জনা’ নামটির বাগর্থ বিশ্লেষণেই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে নারীপ্রতীকের অন্তরালবর্তিনী প্রেমের মুখশ্রী। তিনিই সুরঞ্জনা, যিনি আমাদের হৃদয়কে সুন্দরভাবে রঞ্জন করেন। (মনে রাখা ভাল, ‘রঞ্জন’ আর ‘রাগ’ এ দুটি শব্দ এক-ই ধাতু থেকে সংগঠিত)। ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থে প্রেম বার বার আবির্ভূত হয়েছে নারীত্বের প্রত্নপ্রতিমায়, ইতিহাসচেতনার সারাৎসারে পরিপুষ্ট হয়ে। ‘সুরঞ্জনা’ কবিতাটিতে জীবনানন্দের দৈবী উচ্চারণে মানবসভ্যতার অন্তর্লীন প্রেরণা-স্বরূপিণী এ প্রেম অঙ্গীকৃত হয়ে ওঠে কবির ইতিহাসবেদে; ধর্মাশোকের সন্তান মহেন্দ্রের সমুদ্রযাত্রা ও সভ্যতাবিস্তারের আকাক্ষার পেছনে প্রেরণার মতো কাজ করেছে এ কল্যাণী প্রেমের-ই। শক্তি :
তবুও কাউকে আমি পারিনি বোঝাতে।
সেই ইচ্ছা স নয় শক্তি নয় কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়,
আরো আলো : মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।
পূর্ব স্তবকের নৈসর্গিক প্রেক্ষাপটে এই বক্তব্যকেই কবি উপস্থাপিত করেন যখন তিনি জানান, মানুষের সভ্যতার বয়স বাড়ে, সঙ্গে সঙ্গেই সূর্য-নক্ষত্রের আলোও ক্রমক্ষীয়মান; তবু প্রকৃতির-ই জগতে আছে চিরপ্রার্ণরঙ্গলীলা। সমুদ্রের নীল, ঝিনুকের গায়ের আল্পনা, পাখির গান নবীন মানব-মানবীকে ডেকে নেয় ভালবাসায়। কারণ, ‘মানুষ কাউকে চায়’ তার জায়মান বিশ্বচেতনার কেন্দ্রে এক নিশ্চিতির আশ্রয়। একদিন তার ছিল ঈশ্বরে উজ্জ্বল। বিশ্বাস; সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেই ধর্মবিশ্বাসের আশ্রয়চ্যুত মানব নতুন আশ্রয় খুঁজেছে ‘অন্য কোনো সাধনার ফলে’, যা হলো প্রেম। আর এ প্রেম বলতে জীবনানন্দ যদিও বোঝেন ‘মানুষের তরে কে মানুষীর গভীর হৃদয়’, তবু তার অমর্তদাক্ষিণ্য, মৃত্যুহীনতা ও প্রয়াণের শক্তি সম্পর্কে তিনি আশ্বস্ত করেন পাঠককে ইতিহাস-প্রদক্ষিণ পথে :
যেন সব অন্ধকার সমুদ্রের ক্লান্ত নাবিকেরা
মক্ষিকার গুঞ্জনের মতো এক বিহ্বল বাতাসে
ভূমধ্যসাগরলীন দূর এক সভ্যতার থেকে
আজকের নবসভ্যতায় ফিরে আসে, —
তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল
দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।
‘মিতভাষণ’ ও ‘সবিতা’ কবিতা দু’টির কেন্দ্রেও রয়েছেন জীবনানন্দের এ ইতিহাসবেদী প্ৰেম-চেতনায় উদ্ভিন্ন শ্রেয়সী নারী। ‘মিতভাষণ’ কবিতাটির প্রথম স্তবকেই প্রেয়সী নারীর সৌন্দর্যদীপ্তিকে কবি চিনেছেন তার ঐতিহ্য মহিমায় (তোমার সৌন্দর্য, নারি, অতীতের দানের মতন)। প্রেম যেন এক ‘শ্রেয়তর বেলাভূমি’, যা ‘সময়ের শতকের মৃত্যু’ হলেও, অর্থাৎ মানবেতিহাসে যুগ থেকে যুগাবসানের পরেও, ‘ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো’ মানবকে ডেকে নেয় উজ্জ্বল বিশ্বাসে ও প্রেরণায়। নারীর মুখশ্রীর ‘মিগ্ধ প্রতিভায়’ কবি সেই বিশ্বাস ও প্রেরণার শক্তি দেখেছেন। তাই কবিতার অন্তিম স্তবকে সভ্যতা থেকে নবসভ্যতায় উত্তরণের যাত্রায় মানবের ভ্রান্তি, হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের বিকল্পে কবি রেখেছেন প্রেমের মৃত্যুমথিত উদ্বর্তনের ঘোষণা :
মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে,
বড় বড় নগরীর বুক ভরা ব্যথা
ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সংকল্প স্বপ্নের
উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা।
তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রুষার জল, সূর্য মানে আলো :
এখানে নারীর মনে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো
লক্ষণীয়, জীবনানন্দ এখানে জল, আলো কিংবা সেসবের উৎস নদী সূর্যের মতো প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত রেখেছেন নারীর প্রেমের প্রেরণাশক্তিকে। এভাবেই ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থটিতে বারেবারেই নারী ও নিসর্গ—‘প্রকৃতি’ শব্দটির এ দুই অভিধা-ই খুব কাছাকাছি এসেছে, সাঙ্গীকৃত হয়েছে একে অপরের ভাব ও শক্তির সাযুজ্যে (যে কথা আমরা পূর্বেই ‘বনলতা’ নামকরণটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছি)। সবিতা কবিতাটিতেও নর-নারীর প্রেম জীবনচর্যার প্রেক্ষাপটে এসেছে ইতিহাসের বিস্তৃত প্রান্তরে সভ্যতা থেকে নবসভ্যতার যাত্রায় মানব-যুগলের পরস্পরকে চেনা। তাই প্রেয়সী নারীর মুখের রেখায় আভাসিত ‘মৃত কত পৌত্তলিক খ্রিস্টান হিন্দুর/অন্ধকার থেকে এসে সব সূর্যে জাগার মতন’ অগ্রসরনের, সম্মুখযাত্রার প্রেরণার শক্তি; তার নিবিড় কালো চুলের ভিতর কবেকার মুদ্রের সন’। ইতিহাসচেতনার উৎসারে ও বিস্তারে নারী হয়ে উঠেছেন শক্তি ও প্রেরণার প্রত্নপ্রতিমা—শুধুমাত্র সৌন্দর্য আর নিয়তিতাড়িত প্রেম-বাসনার চির-অলভ্য প্রতীক নন তিনি। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ যুগে প্রেম যদি হয়ে থাকে প্রেয় ও অপ্রাপণীয়, একালের কাব্যে তা হয়ে উঠলো শ্রেয় ও আরাধ্য। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ যুগে প্রেমের ক্ষণজীবি অমর্ত আস্বাদের উল্লাস ধ্বনিত হয়েছে কবিতার পর কবিতায়, নশ্বরতার বেদনাবহ উপলব্ধির প্রেক্ষাপটে। ‘বনলতা সেন’ পর্যায় কবিতার পর কবিতায় প্রেম তার মরণজয়িতার শক্তিতে উপলব্ধি এবং প্রেমের শক্তির এ মরণাতীত মহিমার আনন্দবোধ জারিত হয়েছে কবির ইতিহাসচেতনায়। তাই প্রেমিক নায়ক হয়ে উঠেছেন আবহমান মানবসত্তার প্রতিভূ, প্রেয়সী নারী হয়েছেন এক পরমা অভিষ্টের প্রতীক। ইতিহাসচেতনায় বলয়িত হয়ে এ প্রেম মানবাত্মাকে ডেকে এনেছে প্রকৃতি-পৃথিবীর আশ্রয়ে; প্রেমের প্রেরণার শক্তি ও নৈসর্গিক পূর্ণপ্রাণের শক্তি যেন সাঙ্গীকৃত হয়েছে একটি বিন্দুতে। ‘বনলতা সেন’ পর্যায়ের কাব্যে এভাবেই জীবনানন্দের প্রেমচেতনা স্বাতন্ত্র ও পূর্ণতর পরিণতি চিহ্নিত হয়েছে।
তবে কোনো কবিই, যদি তিনি মানব অভিজ্ঞতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন, তার প্রেমের কবিতাবলী হতে সম্পূর্ণভাবে হতাশা, বিষাদ ও মৃত্যুর বোধগুলিকে মুছে দিতে পারেন না। তাই বিষাদ ও মৃত্যুর প্রচ্ছায়া, ব্যর্থতা, আহত বাসনার আর্তি ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থের অনেক কবিতার সুরেই আবর্তিত। তবে সে সবকিছুই আগের মতো সংবেদনার প্রবলতায় প্রেমের শুভ প্রেরণাশক্তির নবজাত বোধকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। ‘দুজন’ বা ‘অঘ্রাণ প্রান্তরে’ কবিতা দু’টি পাঠককে ফিরিয়ে আনে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র হিমার্ত, মৃত্যুস্পষ্ট জগতে। ‘শঙ্খমালা’ কবিতার নারী যেন পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেয় ‘ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল’, কিংবা ‘পরস্পর’ কবিতায় জীবনানন্দীয় নায়িকার অনুষঙ্গে, যাকে ঘিরে মৃত্যুর আবহ। তবু তিনি আমাদের হৃদয়-সন্ধানে অব্যর্থ, ঘোর মায়াবিনী নিষ্করুণা এক নারী। ‘সোনালি ডানার চিল’ এ মায়াবিনীর-ই অপ্রাপণীয় মুখচ্ছবি বহন করে আন ‘ভিজে মেঘের দুপুরে’। পৃথিবীর যত রূপকথার রাজকন্যার সৌন্দর্যের সুদূরতা ও চির অলভ্যতা যা মানবকে চিরদিন করেছে হতাশ স্বাপ্নিক, তা এ শঙ্খমালার প্রতীকেই হাহাকার করে ওঠে জীবনানন্দের কবিতায়। শঙ্খমালাও রূপকথা থেকে উঠে এসেছেন; তিনি সুদূরিকা, অপ্রাপণীয় সৌন্দর্য ও প্রেমের প্রতীক। এ চির-আকাক্ষিতা অথচ চির অলভ্যা নারী হয়ে ওঠেন অপ্রাপণীয়ের প্রত্নপ্রতিমা। কবি যখন তার চোখে দেখেন ‘শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার’, তার মধ্যে খুঁজে পান ‘কবেকার শঙ্খিনীমালা’কে।
‘শঙ্খমালা’ কবিতাটি কয়েকটি কারণে আরো নিবিষ্ট মনোযোগ দাবী করে। ‘শঙ্খমালা’কে আমরা অপ্রাপণীয়ের প্রতীক বলে দেখেছি; কবিতার শেষচরণে (‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে—পায়নাকো আর’) তার সমর্থন মেলে। শঙ্খমালা লোককাহিনী বা রূপকথার কল্পনাভূমি থেকে উঠে এসেছেন। তিনি ‘কবেকার শখিনীমালা’র অনুষঙ্গ বহন করেন, আর সেই অনুষঙ্গ হলো : ‘পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে।’ সেই সুদূরে কালের রূপসীকে কবি ডেকে এনেছেন তাঁর স্বকালে। কিন্তু ‘বনলতা’; ‘সুরঞ্জনা’ ‘সবিতার মতো শঙ্খমালা’ কবিকে মিলন ও প্রাপ্তিতে পূর্ণ করেননি, রেখে গেছেন কবিতার চরণে চরণে ব্যবধানে, হাহাকার, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। কোনো একদিন যে মানব শঙ্খমালার মতো নারীকে ঘিরে রচনা করেছিল সৌন্দর্য ও প্রেমের রূপকথা, প্রাপ্তির আনন্দে এ অবিশ্বাসী সময়ে কবি তাঁকে স্বচেতনায় আবির্ভূত হতে দেখলেন সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে, বিষাদ (‘বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা তার দেহ’), চঞ্চল নশ্বরতা (‘শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ’), আর মৃত্যুর আয়োজনে : ‘কড়ির মতন সাদা মুখ তার,দুইখানা হাত তার হিম;/চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম/চিতা জ্বলে’ : ‘দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়/সে আগুনে হায়।’ এ সব-ই যেন ইঙ্গিতে পাঠককে জানিয়ে দেয় এক রিক্ত বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতিহীনতার যুগে পূর্ণ সৌন্দর্য আর প্রেমের অপমৃত্যুর কথা।
আর লক্ষণীয়, কিভাবে এ কবিতায় দুই নারী পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ‘কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে’ যে নারী কবিকে আহ্বান করেছেন নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে, তার-ই চোখে ‘হিজল মাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে’, যার আগুনে ‘শঙ্খমালা’ পুড়ে যায়। অন্যদিকে, জীবনানন্দের কবিতায় যে পেঁচা বারবার উপস্থিত বিজ্ঞতা ও জাগতিক বিচক্ষণতার প্রতিভূরূপে, সেই পেঁচার প্রাণের সঙ্গে সাযুজ্য দেখেছেন কবি কান্তারে আবির্ভূত নারীর, যাঁর যুগপ্রতিবেশসত বিচক্ষণ মানসতা মানব-হৃদয়ের চিরআকাক্ষিত সৌন্দর্য ও প্রেমের স্বপ্নপ্রতিমা শঙ্খমালাকে দগ্ধ করে। একদিকে কঠিন জাগতিক আধুনিক; অন্যদিকে স্বপ্নবাসনা শঙ্খমালা—এই দুই নারীর ট্রাজিক অনন্বয় থেকে “শঙ্খমালা” কবিতাটি আহরণ করেছে তার অর্থপূঢ়তা। এ ‘শঙ্খমালা’ নারীকেই কবি ‘হাওয়ার রাতে’ আবিষ্কার করেছেন এশিরিয়া মিশর বিদিশার মৃত রূপসীদের মধ্যে, যারা ‘দীর্ঘ বর্শা’ হত, কাতারে কাতারে হানা দিয়েছে কবির আধোঘুমের স্বপ্নে—
মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?
জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করার জন্য?
প্রেমের ভয়াবহ গভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?
এই নারীকে ঘিরেই গুঞ্জরিত ‘নগ্ননির্জন হাত’ কবিতার স্মৃতিভারাতুর অতীতচারিতার আনন্দ-বিষাদ : ‘তোমার মুখে রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না, খুঁজি না’। এমনকি নিতান্তই স্বকালে, কুড়ি বছরের ব্যবধান ভেঙে, কবি যাকে ‘ধানের ছড়ার পাশে কার্তিকের মাসে’, হেমন্তের নতুন কুয়াশার ভিড়ে ফিরে পেতে চান, সেই নারীও মানব হৃদয়বাসিনী চিরন্তন স্বপ্নের প্রেয়সী এ ‘শঙ্খমালা’। তাঁকে আমাদের কবি পুড়ে যেতে দেখেন ‘হিজল কাঠের রক্তিম চিতায়’—যেন তার নিজের-ই সমকালবদ্ধ ঐহিক অভিজ্ঞতার আগুনে! তাই ‘শঙ্খমালা’কে বলেছি, সৌন্দর্য ও প্রেমের এক প্রত্নপ্রতিমা বা Archetype। এ ব্যাখ্যার সমর্থন জানাবে ‘মহাপৃথিবী’র ‘সিন্ধু সারাস’ কবিতার শেষতম স্তবকটি—যেখানে শ্রেয়সী নারী হয়েছেন পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী, যার সঙ্গে তার মানবপ্রেমিকের চিরন্তন ব্যবধানের যন্ত্রণা। শঙ্খমালার প্রেমিকের মুখের রূপ তাই ম্লান নিঃসঙ্গ, বিশুষ্ক তৃণের মতো তার প্রাণ।
জীবনানন্দের বিবর্তনশীল কাব্যপ্রবাহে ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থটি কবির প্রেম-ভাবনাকে রেখেছে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্যায়ের বিপরীতে; কিন্তু প্রথম যুগের সেই প্রকৃতিলোক ক্ষয়িষ্ণু রূপের বেদনায় মৃত্যুস্পষ্ট। অন্যদিকে বনলতা সেন ও তৎপরবর্তী মহাপৃথিবী এবং সমসাময়িক অন্যান্য কবিতাবলীতে প্রকৃতির বিষন্ন ম্লান মৃত্যুপীড়িত রূপটিই বড় হয়ে ওঠেনি, তার মধ্যে স্থান করে নিয়েছে এক শান্ত সুষমা ও পরিপূর্ণ প্রাণলীলা : অকূল সুপুরি বন স্থির জলে ছায়া ফেলে এই মাইল শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে এখানে; ‘এখানে প্রশান্ত মনে খেলা করে উঁচু উঁচু গাছ’; এখানে ‘ফারুনের জ্যোৎস্নায় পলাশের বনে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে’ ‘হরিণেরা’ খেলা করে, এখানে ‘কচি লেবু পাতার মতো নরম সবুজ আলোয়’ ভোরের পৃথিবী জেগে ওঠে; এখানে নীল আকাশে খই ক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারার সমারোহ। এভাবেই অপরাজেয় শান্তি ও সৌন্দর্যের এক প্রকৃতি-পৃথিবী নিজের আসন নিঃশব্দে বড় করে নিয়েছে জীবনানন্দের কাব্যে। প্রেমের উপস্থাপনাও ঘটেছে এক শান্ত নিরুদ্বেগ নিসর্গ পটভূমিতে। শুধুমাত্র নর-নারীর প্রণয়, বিরহ মিলন প্রসঙ্গই নয়, মানবেতর প্রাণীকূলের মধ্যে এ প্রেমের বিস্তার ঘটিয়েছেন কবি কাব্যের শিল্পপ্রসাদ বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন না হতে দিয়ে। অন্ধকার রাতে অশ্বথের চুড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখ, মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জন, বনহংসমিথুনের উল্লাস, সুন্দর বাদামি হরিণের সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেয়া—নিসর্গ আবহ নির্মাণের মধ্যে এসব ছোট ছোট অনুপুখ কারুকর্ম কবিতার পর কবিতায় রমণীয় চমক-ই শুধু নিয়ে আসেনি, প্রকৃতির বিরাট সজীব নিরবচ্ছিন্ন প্রাণরঙ্গপ্রবাহের শান্তি ও নিশ্চিতির মধ্যে অস্তিত্বের মৌল তাড়না বা প্রেরণাশক্তিটিকে উপস্থাপনার উপযুক্ত পটভূমিক্ষেপ-ই সে সবের লক্ষ্য।
প্রাকৃতিক জীবনের আদিম প্রাণময়তা ও পূর্ণতার সঙ্গে অন্বয়ের উৎসাহ ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে কবির চেতনায় এনেছে স্বাতন্ত্র্য ও অপূর্বতা। নর-নারীর প্রেম যেমন নিসর্গ-জীবনের পূর্ণতা ও সজীবতার পটে চিত্রিত হয়ে মানবিক অস্তিত্বের দুর্বলতাগুলিকে স্পষ্টতর করেছে; অন্যদিকে তেমনই এ মানব-পৃথিবী ঘনিষ্ঠতর ও একাত্ম হয়েছে। যেমন, ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিতেই এক প্রকৃতি (নিসর্গ) অন্য প্রকৃতির (নারী) সঙ্গে ভাব-সম্মিলনে অভেদাত্ম ও অভিন্নকায় হয়ে উঠেছে। মানব ও প্রকৃতির এ মিলনে মৃত্যুও ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে কোনো অন্তরাল রচনা করেনি। জীবনের অমোঘ সত্যের মতো মৃত্যু এখানে উপস্থিত ঠিক-ই; কিন্তু অখণ্ড প্রাণপ্রবাহচেতনার উন্মেষে তার নিজের ভূমিকাটিতে সীমিত। কবি জেনেছেন এক ব্যাপ্ত নিয়মের কথা, যার ফলে সবকিছুই একদিন বিদায় নেয়। কিন্তু তবু আকাশ ও পৃথিবী ‘চিরস্থায়ী’, যেখানে ‘মানুষ বারবার ফিরে আসে যেন কিছু চেয়ে কিছু একান্ত বিশ্বাসে’।৭ এভাবেই ব্যক্তিক প্রেমের স্বপ্ন ও হতাশা’, ‘পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞানে’ ও ইতিহাসবেদে জীবনানন্দকে ফিরিয়ে আনে ‘মাটি-পৃথিবীর টানে’। স্বপ্ন ও সৌন্দর্যের কল্পজগৎ ছেড়ে সেখানে ফেরার ইচ্ছা কবির প্রবল ছিল না।৮ কিন্তু প্রত্যাবর্তিত হয়ে তিনি জেনেছেন মানবেতিহাসের সারসত্য, সু-চৈতন্যের উদ্বোধনে সভ্যতা থেকে নবসভ্যতায় বার বার উত্তীর্ণ হওয়া।৯ এ মানবজন্মের ঘরে ফিরে আসা তাই কবির কাছে হয়ে উঠলো, ‘গভীরতর লাভ’। তার-ই আলোকে মানবের প্রেমানুভূতিকে ঘিরে বিষাদ, হতাশা ও মরণাধীনতার গ্লানিকে জীবনানন্দ যেন অনেকটাই অতিক্রম করেছেন শান্ত প্রজ্ঞায়। এ প্রজ্ঞার একটি উৎস ইতিহাসচেতনা, একটি পরিপূর্ণ নিসর্গমগ্নতা। প্রিয় যে নারীটির সঙ্গে ‘হৃদয়ের খেলা নিয়ে’ একদিন ‘কত অপরাধ’ করেছেন,১০ তার মুখ মনে পড়ে এরকম মিগ্ধ পৃথিবীর পাতাপতঙ্গের কাছে এসে।১১ তবু অনর্গলিত যন্ত্রণার হাহাকার নেই; কারণ কবি জানেন কাচপোকা গঙ্গাফড়িঙের মতো সেও আজ ‘ঘুমে’—‘আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছে’—প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো’।১২ মানুষের জীবন যে চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অসংখ্য অভিঘাতে কাতর এবং দিশাভ্রান্ত, তাঁর থেকে ঢের গভীরতর এক শান্তির মধ্যেই শুয়ে আছেন কবির প্রেয়সী :
শান্তি তবু—গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।১৩
‘শিরিষের ডালপালা’, ‘ধানকাটা হয়ে গেছে’ ও ‘তুমি’—এ তিনটি কবিতায় মৃত্যু শুধু দীর্ঘ প্রলম্বিত ছায়াই ফেলেনি, এসেছে চিরবিচ্ছেদের রূপে। তবু সব কবিতার কোনটিতেই ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ রূপসী বাংলা পর্যায়ের কবিতার মৃত্যু-আক্রান্ত আর্তি ও হাহাকার নেই—আছে মৃত্যুর শান্ত সম্মত অহিণ, যার অন্তরাল হতে স্কুরিত হয় দীর্ঘশ্বাস। মৃত্যুর শেলতীব্রতাকে অতিক্রম করে জৈব সংসক্তির মধ্যে তাকে দেখা সম্ভবপর হয়েছে নিসর্গ-জীবনে নিমজ্জন ও প্রকৃতি পৃথিবীর সঙ্গে অন্বয়ের চেতনার উদ্বর্তনের ফলেই, একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন।
‘শঙ্খমালা’ কবিতাটিকে কেন্দ্র করে ‘বনলতা সেন’ পর্যায়ে জীবনানন্দের প্রেমের কাব্যের কয়েকটি বিশিষ্ট লক্ষণ স্পষ্ট করতে চেয়েছি। এ গ্রন্থে প্রশান্তিমগ্ন প্রকৃতিভুবনের দাক্ষিণ্যে স্মিত, লাবণ্যে স্নিগ্ধ ‘সুরঞ্জনা’, ‘সবিতা’, ‘শ্যামলী’ প্রমুখ নারী-প্রতিমাদের মাঝখানে ‘শঙ্খমালা’ দাঁড়িয়ে রয়েছেন বিষাদ ও মৃত্যুর পরিমণ্ডলে। বনলতা সেন কবির কাছে ‘দ্বিতীয় প্রকৃতি’ হয়ে উঠেছেন তার কল্যাণ ও প্রশান্তির আশ্বাসে, ‘শঙ্খমালা’কে ঘিরে কিন্তু অপ্রাপণীয়তার দীর্ঘশ্বাস (এ পৃথিবী একবার পায় তারে—পায়নাকো আর) আর স্বপ্নবিনাশের আর্তি (‘শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়’)। এ কবিতায় নেই নিসর্গ, জীবনের সঙ্গে একায়নের প্রত্যয়; পেঁচা এখানে রচনা করেছে ব্যবধান স্বপ্নের শ্রেয়সী নারী আর কান্তারের পথ থেকে উঠে আসা সেই স্বপ্নের প্রেতপ্ৰতিমার মধ্যে। ‘শঙ্খমালা’ এ অনন্বয় আর ব্যবধানের মধ্য দিয়ে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় কবির আদিপর্বের কাব্যে অপ্ৰাপণীয় সৌন্দর্য আর পরিপূর্ণ জীবনের রোমান্টিক আদর্শের অনুধ্যানে; স্বপ্ন আর বাস্তব আবার রচনা করে দূরপনেয় ব্যবধান, যার পরিণতি ঘটে ‘মহাপৃথিবী’র ‘সিন্ধুসারস’ কবিতাটিতে। সিন্ধুসারসের গান কবির চেতনায় বহন করে আনে স্বপ্নের প্রবলতা :
নতুন সমুদ্র এক সাদা রৌদ্র, সবুজ ঘাসের মতো প্রাণ
পৃথিবীর ক্লান্ত বুকে
তার নৃত্যময় দু’টি ডানার ছন্দে মানুষের মনে জেগে ওঠে প্রয়াণের নবীন উদ্যম। তবু জৈব প্রাণেষণা ও উল্লাসের প্রতীক এ সিন্ধুসারসের সঙ্গে মানবের কোনো আত্মিক যোগাযোগ নেই। কারণ, সিন্ধুসারস স্বপ্ন দেখতে জানে না; সিন্ধুসারস জানে না বাস্তবের অপর পিঠে আছে মানবের কল্পনার জগৎ, যেখানে দেখা মেলে পৃথিবীর শমালার নারীর :
স্বপ্ন তুমি দ্যাখোনি তো—পৃথিবীর সব সিন্ধু সব পথ ছেড়ে দিয়ে একা
বিপরীত দ্বীপে দূরে মায়াবীর আরশিতে হয় শুধু দেখা
রূপসীর সাথে এক;
তাই সিন্ধুসারসের সাদা ডানা ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীকে আনন্দ জানায় বটে, তবে সেই ‘আনন্দের অন্তরালে’ নেই মানবাস্তিত্বের প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত। এভাবেই প্রকৃতি-পৃথিবীর জৈব প্রাণোল্লাসময় জীবনের সঙ্গে মানব-পৃথিবীর জীবনের আত্মিক সংযোগ, যা ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থে অর্জিত হয়েছিল, তা যেন ছিন্ন হয়ে যায়। প্রকৃতি-পৃথিবীর কান্ত আবাস ও আশ্রয় থেকে কবি চলে আসেন মহাপৃথিবীর বৃহদায়তন জীবন প্রান্তরে, যেখানে নিসর্গ এবং মানব আর একাত্ম নয়। বরং তাদের মুখোমুখি সাক্ষাতে দুই ভিন্ন জীবন অস্তিত্বের মৌল ব্যবধানের চারিত্র বড় হতে থাকে। ‘মহাপৃথিবী’র কবিতার পর কবিতায় নিসর্গ-জীবনের নিবিড়তা ও প্রশান্তির মধ্যে হানা দিয়েছে রূঢ় বাস্তব, পারিপার্শ্বিক মানব জগতের নানা সমস্যার অভিঘাত দীর্ণ করেছে প্রকৃতি-পৃথিবীর প্রাচীন প্রশান্তির আশ্বাস। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মানব-মানবীর প্রেম আবার ক্লিন্ন দেহবাদিতায় প্রত্যাখ্যান ও প্রত্যয়হীনতার অভিশাপে জান্তব ও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে; সঙ্গে সঙ্গে আর্ত ও বাজয় হয়েছে কবির আহ্বান। প্রেমকে তিনি ফিরিয়ে আনতে চান ‘স্বপ্নে’, ‘ডাইনির মাংসের’ থেকে ‘কল্পনার অবিনাশ মহনীয় উদগীরণে’১৪ ‘আম নিম ঝাউয়ের জগতে’১৫। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে আমরা দেখি, ‘শঙ্খমালা’ (যিনি অভ্রান্তভাবেই জীবনানন্দীয় নায়িকা) ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থে প্রকৃতি-পৃথিবীর প্রশান্ত ভূখণ্ডে আবির্ভূত হয়ে আমাদের সচকিত করে তোলে, বিষমানুপাতিক টানে। একদিকে অপ্রাপণীয় সৌন্দর্য : প্রেমের রোমান্টিক আদর্শ ঘিরে নিয়তিতাড়িত মৃত্যুর পরিমণ্ডল, অন্যদিকে প্রাকৃতিক জৈব প্রাণরঙের সঙ্গে বিশ্বাস ও চিন্তার সংকটে দীর্ণ মানব জীবনের পূর্ণ আত্মিক অন্বয়ের অসম্ভাব্যতার ব্যঞ্জনা যেন ‘শঙ্খমালা’ বহন করেন কবির কল্পনায় বিধৃত তাঁর প্রত্নপ্রতিমার সংকেতময় নির্দেশে।
জীবনানন্দের অধিকাংশ প্রেমের কবিতাই রোমান্টিক প্রেম-কবিতার চারিত্রে চিহ্নিত এ কথা আদি সংস্করণ ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থ সম্পর্কেই বিশেষভাবে সত্য। প্রেমের কবিতামাত্রেই স্বপ্নের কবিতা। জীবনানন্দের কাব্যসৃষ্টির ইতিহাসে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘রূপসী বাংলা’ ও ‘বনলতা সেন’ পর্যায়ে সেই স্বপ্ন বিশেষভাবে অপ্রাপণীয় ও প্রেয়কে ঘিরে গুঞ্জরিত। উনিশ শতকী মহাদেশীয় রোমান্টিক কাব্যের আরো একটি বিশেষ লক্ষণ ছিল, অতীত গরিমা ও সৌন্দর্যের জগতে প্রত্যাবর্তন। মধ্যযুগীয় শৌর্য ও ঐশ্বর্যবহুল জীবনচর্যার কাব্যিক পুনঃনির্মাণ ঘটেছিল সেই যুগের কবিতায়। রোমান্টিক কাব্যের সমালোচকরা কল্পনার এ জাতীয় ফুরণের পশ্চাতে দেখেছেন পরিপূর্ণতা ও সৌন্দর্যের কল্পজগৎ পরিনির্মাণের শৈল্পিক প্রয়াস। আধুনিককালের কাব্যে অতীতচারিতা কোনো সময়েই মুখ্য প্রসঙ্গ হয়নি; স্মৃতিভারাতুরতার অনুষঙ্গ সেখানে নিয়ে এসেছে বিগতের জন্য শোচনার পাশাপাশি সাম্প্রতের গ্লানিদীন খণ্ড জীবনের প্রতি প্রগাঢ় অনীহার প্রকাশ। ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থে বা তার পরবর্তী কাব্যেও অতীতচারী আবেগ বারবার উচ্ছ্বসিত হয়েছে বটে, তবে সে আবেগ মহিমামণ্ডিত অতীত জীবনের শোচনায় বা স্বপ্নপ্রয়াণে অবসিত না হয়ে প্রকাশ করেছে বর্তমানের খণ্ডিত জীবনের গ্লানি, চেতনার শূন্যতা। ‘হাওয়ার রাতে’ এবং ‘নগ্ননির্জন হাত’-এর মতো কবিতা দু’টি এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার্য। ‘নগ্ননির্জন হাত’ কবিতাটিতে ‘মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ’-এর ধূসররূপ কবির মনে জেগে ওঠে, যার অনুষঙ্গে বাঙ্ময় হয়েছে লুপ্ত স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষার স্মৃতি। দু’টি নিটোল গদ্য পঙ্ক্তি পাশাপাশি রেখে জীবনানন্দ বিগত ও বর্তমানের অনপনেয় ব্যবধান ও তজ্জনিত শোচনার অনুভূতি মুদ্রিত করে দেন পাঠকের মনে :
পারস্য গালিচা, কাশ্মিরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্ত প্রবাল,
আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা
বিগতকালের ঐশ্বর্যবহুল জীবনোপকরণের উল্লেখমাত্র প্রথম চরণটির অবলম্বন; কিন্তু দ্বিতীয় চরণ তাকে অতিক্রম করে উদ্বর্তিত করে গত জীবনের পরিপূর্ণতার সম্পদ, যা থেকে কবি ভ্রষ্ট হয়েছেন এ অধুনায়। এভাবেই তুলনামূলক বৈপরীত্যে অতীত ও অব্যবহিত জীবন তাদের ব্যবধান প্রকট করে অপরূপ খিলান ও গম্বুজ হয়ে ওঠে বেদনাময় রেখা। এ ক্লিন্ন সাম্প্রতে অনধিগম্য সেই ঐশ্বর্যময় জীবনচর্যা; তাই তার কাহিনী যেন এক ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, তাকে ঘিরে ‘লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ’। কিন্তু লক্ষণীয়, ‘নগ্ননির্জন হাত’-এ এই লুপ্ত ঐশ্বর্যে জগতের কেন্দ্রে রয়েছেন এক নারী, সেই চির অপ্রাপণীয়া প্রেয়সী, যার মুখের রূপ কত শত শতাব্দীর বিস্মৃতির অন্তরাল পেরিয়ে হানা দিয়ে কবির অনুভাবনায়। ‘হাওয়ার রাত’ কবিতার পরাবাস্তব বিস্তারেও এ অতীত ঐশ্বর্যের জগতের প্রবল উপস্থিতি কবির হৃদয়ে। পৃথিবী তথা অব্যবহিত অস্তিত্বের বন্ধন ছিঁড়ে উড়িয়ে নিয়ে যায় তাঁকে এক দুরন্ত ‘শকুনের মত’, উপমাটি ব্যগ্র ক্ষুধার ইঙ্গিত বহন করে এবং মৃত জীবনের অনুষঙ্গ গাঢ়তর করে। ‘হাওয়ার রাতে’ কবির সংবেদনা রয়েছে এক ‘আধোঘুমে’র ভেতর, এবং এ ‘আধোঘুম’ কবিচেতনায় জাগরণ ও স্বপ্ননিমজ্জনের বহির্সাক্ষ্য বহন করছে। কবি দেখেন মৃত রূপসীদের কাতারে কাতারে বর্শা হাতে দাঁড়াতে—মৃত রূপসীরা এক লুপ্ত সৌন্দর্য জগতের প্রতিভূ; তাদের হাতে বর্শার মতো মারণাস্ত্র পাঠককে প্রস্তুত করে তোলে ‘হাওয়ার রাতে’র প্রবল নীল অত্যাচারেব কাহিনী শোনাবার জন্য। এ অত্যাচার কবির আধ-জাগরিত চেতনার ওপর; তা ‘প্রবল’, কারণ অতীতের ঐশ্বর্যময় জীবনের বলশালী উদ্বোধনে তা বর্তমানকে নিক্ষেপ করে এক তুচ্ছ গ্লানিময়তার দৈন্যে। আবার এ ‘অত্যাচার’ ‘নীল’—’নীল’ বিশেষণটি নিয়ে আসে স্বপ্নের অনুষঙ্গ—যে স্বপ্নের প্রবলতায় ‘পৃথিবী কীটের মতো’ মুছে যায় এক অখণ্ডিত পূর্ণ ‘নীল মত্ততায়’।
জীবনানন্দের কাব্যসৃষ্টির ধারায় প্রেমচেতনার উদ্বর্তনের প্রসঙ্গে ‘বনলতা সেন’ পর্যায়ের কবিতাবলীর আলোচনা স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘতর হয়ে পড়ে! তার অন্যতম কারণ, একালের কাব্যেই কবির প্রেমচেতনা পূর্ণতর প্রেক্ষিত, পরিণতি ও স্বকীয়তায় লোজ্জ্বল হয়েছে। রোমান্টিক প্রেম আদর্শের প্রভাব নিঃসন্দেহে তার এ সময়কার কবিতায় এনেছে এমন এক বিশিষ্টতা, যা বাংলা কাব্যের বহতাধারায় সহজদৃষ্ট নয়। নিয়তিতাড়িত প্রেম-বাসনার আর্তি ও মরণাকর্ষ, অচরিতার্থর বেদনা ও প্রেমের ব্যক্তিগত উপলব্ধির বিশ্বাসযোগ্য উত্তাপ ও তীব্রতা জীবনানন্দের প্রেমের কবিতায় যতটা প্রবলভাবে ও শিল্পপ্রসাদে অভিব্যক্ত, তা বাংলা কবিতার আর কোথাও, এমন কি রবীন্দ্রনাথেও তেমন সুলভ নয়। তবু জীবনানন্দ প্রথমাবধি প্রকৃতিমগ্নপ্রাণ এবং প্রেমকে তিনি ‘প্রকৃতির শোভাভূমিকায়’ দেখতে ও দেখাতে চেয়েছেন। ‘বনলতা সেন’ পর্যায়ে সেই প্রকৃতিনিমগ্নতা পূর্বের চেয়ে গভীরতর ইন্দ্রিয় সংবেদনার ঐশ্বর্যের সঙ্গে এখানে যুক্ত হয়েছে মননের দীপ্তি। সেই মননোভাসিত প্রকৃতিচেতনার আলোকে প্রেম হয়েছে তাৎপর্য-গভীর। ইতিহাসচেতনার অঙ্গীকারে এবং প্রকৃতি-জীবনের একাত্মতার মধ্য দিয়ে প্রেম, বঞ্চনা ও প্রাপ্তির, বিষাদ ও উল্লাসের ব্যক্তিগত অনুভূতির সীমারেখা পেরিয়ে বিশ্বজনীন মূল্যমহিমায় অভিষিক্ত ও অভিব্যক্ত হয়েছে। এরই ফলে অধিকাংশ প্রেমের কবিতা, যেমন ‘বনলতা সেন’, ‘সুরঞ্জনা’, ‘মিতভাষণ’ ‘সুবিতা” বা ‘শ্যামলী’—এমন এক ভাব-অনন্যতা পেয়েছে, যা কবিতার মিগ্ধ সুষমামণ্ডিত বাণীরূপেও প্রতিফলিত।
পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’কে কবি একটি সংলগ্ন বা পরিপূরক গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। তবু মহাপৃথিবীর অন্তর্গত কবিতাবলী, মৌল ভাব ও সুরের বিচারে বহুলাংশেই বিচ্যুত হয়েছে ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থের নিবিষ্ট প্রকৃতিমুখিনতার প্রশান্তি ও নিশ্চয়তা থেকে। ‘মহাপৃথিবী’র আপদকালীন প্রেক্ষাপট বিপন্ন মানব অস্তিত্বের গ্লানিদীনতা, উদভ্রান্তি ও অনিশ্চিত মানব-মানবীর প্রেম প্রসঙ্গ করে তুলেছে গৌণ। অন্যদিকে নৈসর্গিক অস্তিত্বের জৈবতা ও নিরবচ্ছিন্ন নিশ্চিতি, প্রশ্ন, সংশয় ও নিশ্চয়তাহীনতায় দীৰ্ণ বিশ শতকী মানব-অস্তিত্বের সঙ্গে কবির সংকল্পনা-সৃষ্টি প্রকৃতি পৃথিবীর ব্যবধান প্রকট করে দেয়। সিন্ধুসারসেরা জানে না, মানবের রক্তাক্ত অন্বেষা ও ব্যর্থ স্বপ্নের কাহিনী। যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের, তার সঙ্গে মানুষের কোনওদিন দেখা হয় নাকো জেনেই আত্মঘাতী চলে আসে অশ্বথের কাছে। প্রেম ও প্রকৃতির নিকট হতে ক্রমাপসারিত, অন্যদিকে রূঢ় বাস্তব পৃথিবীর সন্নিকটবর্তী কবি প্রত্যক্ষ করেছেন মানুষের বিরতিহীন অচরিতার্থতার শ্রম। তাই ‘লাখো লাখো যুগ রতিবিহারের ঘরে’১৬ তিনি প্রার্থনা করেছেন ‘মনোবীজ’। আর সেই বীজ যখন উপ্ত হয়েছে চেতনায়, তখন ‘কান্তারের পথে সৌন্দর্যের ভূতের মতন’১৭ তিনি আবিষ্কার করেন ‘প্রণয়ের সম্রাজ্ঞী’দের। এক বিপন্ন পৃথিবী যখন ‘সৌন্দর্যকে ফেলিতেছে ছিঁড়ে’, ‘তখন পৃথিবীর বয়সিনী’ সুরঞ্জনাদের জীবনানন্দ হারিয়ে যেতে দেখেন কুশ্রীতার মধ্যে :
—তুমিও তো পৃথিবীর নারী
কেমন কুৎসিত যেন১৮
একদা যারা ছিল অপ্সরা উর্বশীর মত, ক্রমে বাদুড়ের খাদ্য যায় তারা; ‘পৃথিবীর মানুষীর রূপ’ ব্যবহৃত হতে হতে শেষ পর্যন্ত ‘শুয়ারের মাংস’ হয়ে যায়।১৯ এভাবেই ‘মহাপৃথিবী’র জগতে প্রেমের সৌন্দর্য আর মাহাত্ম্য যুগবৈগুণ্যে ক্ষুন্ন হয়েছে; প্রেম হয়েছে নির্দেশে পরাহত, অচরিতার্থ, প্রেরণাবিহীন নিরাশ্বাস এক বোধ।
প্রেমের এই নিরর্থকতা ও প্রেরণাবিচ্যুতির বোধ ‘মহাপৃথিবী’র ‘প্রেম অপ্রেমের কবিতা’ শীর্ষক তিন স্তবকবন্ধেই স্ফুট হয়েছে। কবি অনুভব করেছেন ‘পৃথিবী ক্রমশ তার আগেকার ছবি’ বদলে ফেলেছে যেন দানবের মায়াবলে। পুরনো বিশ্বাস, বোধ, সংকল্প ও স্বপ্নের জগৎ মৃত; নতুন কোনো প্রত্যয়ও জন্ম নেয়নি :
একটি পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের আগে
আরেকটি পৃথিবীর দাবি
স্থির করে নিতে হলে লাগে
সকালের আকাশের মতন বয়স,
সে সকাল কখনো আসেনি ঘোর স্বধর্মনিষ্ঠ রাত্রি বিনে!
এ ঘোর অমাময়ী রাত্রির দেখা জীবনানন্দের পাঠক পান ‘সাতটি তারার তিমির’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’র জগতে পৌঁছে। কিন্তু তার আগে এ সন্ধিপর্বে, যখন সবকিছুই ধ্বংস ও পতনের তীরে, তখন মানব-হৃদয়ের প্রেমচেতনাও অপসৃত নিরালোক প্রত্যয়হীনতায়, যার প্রতিধ্বনি ‘মহাপৃথিবী’র কবিতার চরণে চরণে :
ক. তোমার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলে তুমি চলে গেলে কবে
সেই থেকে অন্য প্রকৃতির অনুভবে
খ. সেই নারী ঢের দিন আগে এই জীবনের থেকে চলে গেছে।
ঢের দিন প্রকৃতি ও বইয়ের নিকট থেকে সদুত্তর চেয়ে
হৃদয় ছায়ার সাথে চালাকি করেছে।
গ. তোমার সংকল্প থেকে খসে গিয়ে ঢের দূরে চলে গেলে তুমি,২০
এ সবের বিকল্পে ‘মহাপৃথিবী’র কাব্যজগতে নেই কোনো তীব্র অন্বেষার আর্তি, নেই অন্যতর প্রত্যয়ের আহ্বানও; আছে এক বিপন্ন মানব-অস্তিত্বের কাহিনী, যা আমাদের জানিয়ে দেয় ‘নারীর হৃদয় প্রেম শিশু গৃহ নয় সবখানি’।২১ উদ্ভ্রান্তি, বিমূঢ়তা, প্রেমের আলোকদেশিতা বা অন্য কোনো উদ্দীপ্তির অভাবে মহাপৃথিবী যেন মোহভঙ্গের তিক্ততা ও বিবমিষায় সংক্ষুব্ধ। প্রেমের অন্তর্ধানের পর :
ক. হলেও বা হয়ে যেতো এ জীবন দিনরাত্রির মতো মরুভূমি
খ. তবুও হেমন্তকাল এসে পড়ে পৃথিবীতে, এমন স্তব্ধতা,
জীবনেও নেই কো অন্যথা,
গ. হেমন্তের সহোদর রয়ে গেছে, সব উত্তেজের প্রতি
উদাসীন।২২
আসলে ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থে কোনো শুদ্ধ প্রেমের কবিতাই নেই। যা আছে, তা প্রকৃতির সান্ত্বনা ও প্রশান্তির জগৎ থেকে উৎপাটিত মানবের অনিকেত অস্তিত্বের মধ্যে অপসৃয়মান, ব্যবধানদীৰ্ণ প্রেমানুভূতির আকস্মিক আবির্ভাব, যা সাম্প্ৰতের গ্লানি এবং অবক্ষয়ী জীবনের স্বরূপ আরো উলঙ্গ করে উন্মোচিত করে দেয়। একটি কথা উল্লেখ না করে পারি না, নারীর প্রেমের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাসভ্রষ্ট কবি প্রেমপাত্রীর জীবন থেকে সরে যাওয়ার পর প্রকৃতি (অন্যপ্রকৃতির অনুভবে) ও গ্রন্থের নিকট আত্মসমর্পণ করেছেন প্রেরণা ও প্রত্যয়ের প্রার্থনায়। কিন্তু সেখানেও যথেষ্ট উদ্দীপ্তির অভাবে কবিকে শেষে বলতে হয়, হৃদয় ছায়ার সাথে চালাকি করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই ‘ফিরে এসো’ কবিতাটির আর্ত আহ্বানের স্পষ্ট আন্তরিকতা বিচার্য। প্রেমকে সেখানে তিনি প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন সেই প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ নিসর্গ-জীবনের প্রশান্তি ও সৌন্দর্যের জগতে (‘আম নিম ঝাউয়ের জগতে’)। প্রেমের অবক্ষয়, বিশ্বাসভ্রষ্ট পৃথিবীতে তার দূরাপসারণ তথা অন্তর্ধানের স্থির, স্পষ্ট অথচ শশাকাবহ কাব্যোচ্চারণেই পরবর্তী গ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির’-এর মুখবন্ধী কবিতা ‘আকাশলীনা’কে আধুনিকের মানস অভিজ্ঞতার প্রতিনিধি করেছে। অন্যস্তরে মানব-হৃদয়ের মৃত্যুহীন প্রেমচেতনাকে এক সমকাল চিহ্নিত অথচ চিরন্তন বাণীরূপ দিয়েছে।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থের ‘শঙ্খমালা’ কবিতাটিতে কবি প্রেম ও সৌন্দর্যের নারী কবেকার ‘শঙ্খিনীমালা’কে চিতার আগুনে পুড়ে যেতে দেখেছিলেন; সে চিতা কান্তারের পথে সন্ধ্যার আঁধারে আবির্ভূতা এক রমণীর চোখের আগুন। এ রমণীর পরিচয় আরো স্পষ্টতর হয় ‘মহাপৃথিবী’র অন্তর্গত ‘মনোবীজ’ কবিতাটির অনুধাবনে। “মনোবীজ” কবিতায় এ রমণীর দেখা মেলে আবার সেই কান্তারের পথে। এখানে কবি তাকে আবিষ্কার করেন সৌন্দর্যের ভূতের মতন। যে পৃথিবীতে স্বপ্ন অবসিত, সৌন্দর্য ছিন্নভিন্ন (‘পৃথিবী আজ সৌন্দর্যেরে ফেলিতেছে ছিঁড়ে’) সেখানে প্রণয়ের সম্রাজ্ঞীরা তো যুগবিলীন মালিন্যেই উপস্থিত হবে। এ কবিতাটিতে এবং অন্যত্র (‘আদিম দেবতারা’) জীবনানন্দ তাঁর পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি প্রেমের সমুজ্জ্বল মহিমার অবক্ষয় ও দেহসর্বস্বতায় হারিয়ে যাওয়ার কথা। একদিকে পৃথিবীর মানুষীর রূপ স্থূল হাতে ব্যবহৃত হয়ে শূয়ারের মাংস হয়ে যায়; অন্যদিকে অপ্সরা উর্বশীরা ‘ডাইনির মাংসের মতন’ তাদের ‘জঙঘা ও স্তন’ মেলে ধরে। ‘মহাপৃথিবী’র প্রধান উচ্চারণ তাই, অন্যান্য প্রসঙ্গে যেমন কবির প্রেম-ভাবনার ক্ষেত্রেও তেমনই, মূল্যবোধ ও আদর্শ বিচ্যুতির অনুষঙ্গে ঘনীভূত হয়ে হয়ে ওঠা এক শোকাবহ নিস্পৃহা, কবি নিজে যাকে বলেছেন, জীবনের হেমন্তকাল–সব উত্তেজের প্রতি ‘উদাসীন’ এক নৈরাশা।
‘সাতটি তারার তিমির’—‘বেলা অবেলা কালবেলা’ পর্বে (আনুমানিক (১৯৩০১৯৫০) পৌছে জীবনানন্দের কবিতার পাঠক বিশ্বসঙ্কটের, বিশ্বাসভঙ্গ ও মূল্যবোধের বিষমানুপাতিক টানে তাঁর কাব্যের ভাব ও বাণীরূপ, বিষয় ও চারিত্র আমূল পরিবর্তিত হতে দেখেন। পূর্ববর্তী কাব্যজগতের নৈসর্গিক শান্তি ও সৌন্দর্যের সমাহিতির রূপ ভেঙে দিয়ে এখন তাঁর রচনায় প্রবলভাবে প্রবেশ করতে চাইছে প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধের অভিঘাতে বিপর্যস্ত বিশ্বমানবের বিপন্ন নাগরিক অস্তিত্ব। সে বিপন্নতা, মহাপৃথিবীর পাঠকমাত্রেই জানেন, তীব্রতম উপলব্ধির প্রহারে একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও উত্তরব্যক্তিক, যুগ-যন্ত্রণার উদ্ভ্রান্তি ও নৈরাশা থেকে সঞ্জাত। জীবনানন্দের এ সময়ের কাব্য সৃষ্টির পরিধির মধ্যে মহাপৃথিবীতেই এ বিপন্নতার বোধ গাঢ়তর এবং নাগরিক জীবনের বাস্তবতার দংশনে তীব্র। তবু ‘মহাপৃথিবী’কে জীবনানন্দ ‘বনলতা সেন’-এর সংলগ্ন গ্রন্থ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। প্রকৃতিলোক ও নগরজীবন উভয়ের-ই অন্তঃসারে কবিচেতনা তখনও পর্যন্ত দুই ভিন্নাবর্তে ঘূর্ণিত। একদিকে ‘আট বছর আগের একদিন’এর মতো কবিতায় আধুনিক মানবের তীব্র বিপন্নতার বোধ; অন্যদিকে, ‘সিন্ধুসারস’, ‘ফিরে এসো’, ‘শ্রাবণরাত’ কিংবা ‘বলিল অশ্বথ সেই’ প্রভৃতি কবিতার নিসর্গ অভীক্ষার মদিরতা। উপলব্ধির এ দ্বিচারণিক স্পৃহা ও প্রবণতায় ‘মহাপৃথিবী’র কবিচেতনা ‘যুগের সঞ্চিত পণ্যে’ অবলীন হলেও নিসর্গ পৃথিবীর প্রশান্তি ও কল্যাণবহ আকাক্ষার একাগ্রতা সেখানে যে দুর্লভ ছিল না, তার স্বপক্ষে একটি উদাহরণ উপস্থিত করছি :
অবাক হয়ে ভাবি, আজ রাতে কোথায় তুমি?
রূপ কেন নির্জন দেবদারু দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়া চেনেনা—
পৃথিবীর সেই মানুষীর রূপ?
‘আদিম দেবতারা’ নামক বিখ্যাত কবিতাটির থেকে উদ্ধৃত এ চরণগুলির তাৎপর্য অনেক পাঠকেরই চোখ এড়িয়ে যায়। ‘নির্জন দেবদারু দ্বীপ’ ও ‘নক্ষত্রের উল্লেখ সুচেতন’ কবিতাটির ভাবানুষঙ্গ বহন করে আনে :
সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁক
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণরক্ত সফলতা,
সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোল্লিনী তিলোত্তমা হবে,
তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।
মানবহৃদয় তথা সমাজ থেকে যে সু-চৈতন্য দূরনির্বাসিত, তাকে কবি ‘নির্জন দারুচিনি বনানী’ তথা প্রকৃতি-পৃথিবীর প্রশান্তি ও সৌন্দর্যের জগতে পুনরাবিষ্কার করেন। আবহমান মানবসত্তা যে তার-ই প্রেমে চিরপ্রাণিত ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থের কবিতাবলীর মৌল ভাব-প্রেরণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উদ্ধৃত চরণগুলিতে সেই কথাটিই অভিব্যক্ত। মহাপৃথিবীর ধ্বস্ত আধুনিক পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে কবি আহত বিমূঢ়তায় যেন প্রশ্ন করেন : পৃথিবীর মানুষীর রূপ তথা সৌন্দর্য কেন সেই নির্জন দেবদারু দ্বীপের (নিসর্গ ভুবনের) নক্ষত্রের (যা ধ্রুবতার প্রতীক) ছায়া চেনে না, অর্থাৎ এককথায়, সুচেতনার প্রচ্ছয়ে আশ্রিত নয়। সৌন্দর্য ও মঙ্গলের চির অনুয়ের প্রাচীন বেদনাই এখানে আধুনিক মানবের অভিজ্ঞতার নিকষে প্রতীকী কবিতার তির্যক উচ্চারণে অভিব্যক্ত। অনুরূপ দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থের ‘সুদর্শনা’ কবিতাটিও বিচার্য হলে গভীর, অর্থময় হয়ে দেখা দেয়। আরো বহু অনুভূত উল্লেখের সমর্থন পাঠককে জীবনানন্দের মধ্যপর্যায়ের কাব্যের অন্তিমপর্বে, অর্থাৎ ‘মহাপৃথিবী’র কবিতালীর রচনাকালের শেষ পর্যায়ে, কবিমানসে প্রকৃতি-ভুবনের সৌন্দর্য ও শান্তি ফিরে পাবার অন্তঃশীল প্রত্নআকাক্ষাটি স্পষ্ট করে।
‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থ বা তৎপরবর্তী কবিতা কিন্তু এ সন্ধিপর্ব সুলভ দ্বিধা বা দ্বিচারণা থেকে মুক্ত। নৈসর্গিক অভিকর্ষের বাইরে, সমকাল ও প্রতিবেশের অগ্নিপরিধির মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে জীবনানন্দের কাব্য-জীবনের এ উনশেষতম পর্যায়, দুই বিশ্বমহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তী ও সমসাময়িক তাঁর কাব্যে, যার কিছুটা সংকলিত ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮) ও ‘বেলা অবেলা’ (১৯৬১) কাব্যগ্রন্থদ্বয়ে। এসব রচনায় নিসর্গ জীবনের শান্তি, সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতার প্রসঙ্গ তিরোহিত। পরিবর্তে এসেছে ভয়াল অন্ধকারময় এ নাগরিক জগৎ, যেখানে মানুষের সংকটময় জীবন কেবল-ই জেগে ওঠে ‘অফুরন্ত রৌদ্রের অনন্ত তিমিরে’, ‘যেখানে লিবিয়ার জঙ্গলের মতো’ অস্তিত্বে নিমজ্জিত মানব সভ্যতার স্মরণীয় উত্তরাধিকারের দিকে তাকিয়ে দেখে সেইসব রীতি আজ মৃতের চোখের মতো তবু’—যেখানে ‘হরিণ খেয়েছে তার আমিষাশী শিকারীর হৃদয়কে ছিঁড়ে’। ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের অজস্র অনুরূপ উল্লেখ এক সমাচ্ছন্ন। অন্ধকার, সভ্যতার জান্তব অধঃপতন ও মূল্যবোধ-বিপর্যয়ের ইঙ্গিতবহ। এ পরিব্যাপ্ত মূল্যবোধহীনতা ও বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে ‘সাতটি তারার তিমির’ চিত্রকল্পটি অর্থবহ হয়ে ওঠে। সাতটি তারা আমাদের মনে আনে সপ্তর্ষিমণ্ডলের অনুষঙ্গ, যা চিরকাল অন্ধকার রাত্রিতে, সমুদ্রে, বিপর্যয়ের ঘনঘটায় মানবকে দেখিয়েছে পথ। তেমনই যে সমস্ত মূল্যবোধের আশ্রয়ে মানুষের সমাজ এতকাল লালিত ও প্রাণিত হয়েছে, যুদ্ধ-অবলীন পৃথিবীর এ সংকট লগ্নে যে সবকিছুই আজ নির্দেশে ব্যর্থ, তাই নিরর্থক। সপ্তর্ষিমণ্ডল বা ‘সাতটি তারা’ আজ আর আলোকদেশি নয়, তিমিরাচ্ছন্নতায় অবলীন। স্বাভাবিকভাবেই এ আবিশ্ব ঘোর অমানিশায় পথভ্রষ্ট মানবিক পৃথিবীতে প্রেম ও প্রকৃতির ভূমিকা গৌণ ও অনুল্লেখ্যপ্রায় হয়ে পড়েছে, জীবনানন্দের পূর্বাপর কাব্য রচনায় সেই প্রেম ও প্রকৃতিই কিন্তু বারংবার আবির্ভূত হয়েছে প্রেরণা ও শুভচেতনার কল্যাণ-ভূমিকায়। এ প্রসঙ্গে কবি নিজে মনে করেছেন তাঁর ‘শেষের দিকের কবিতায়’ ‘পারিপার্শ্বিক-চেতনা’ ‘প্রৌঢ় পরিণতি’ লাভ করেছে। সেই পারিপার্শ্বিক অবশ্যই সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে।
‘সাতটি তারার তিমির’ ও তৎপরবর্তী কাব্যের আলোচনায় এ দিক পরিবর্তন ও কালপ্রেক্ষিত বিস্মৃত হওয়া যায় না। এ সময়কার কাব্যে প্রেমের ভূমিকা নির্ণয়ে আগ্রহী পাঠক কবিকে বলতে শোনেন, ‘প্রেমিকেরা সারাদিন কাটায়েছে গণিকার বারে’ কিংবা ‘প্রেমিককে শিখায়েছি ফাঁকির কৌশল’। প্রেমের দিব্যপ্রেরণা, তার মূল্যমহিমার এ অপহ্নব, ‘আমাদের স্পর্শাতুর কন্যাদের মন বিশৃঙ্খল শতাব্দীর সর্বনাশ হয়ে গেছে জেনে’ সপ্রতিভ রূপসীর মতো বিচক্ষণ করে তুলেছে; তারা যে কোনো ‘রাজার কাজে উৎসাহিত নাগরের তরে’। এক দিৎসাহীন প্রেমবিবিক্ত অন্ধকার আধুনিক পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে ‘অচল অভ্যাসের ভিতর চেতনা ও বিবেক হারিয়ে যেতে দেখে কবির মতন পাঠকও যেন বলে ওঠেন : ‘প্রেম নেই/প্রেমব্যসনেরও দিন শেষ হয়ে গেছে। সাতটি তারার তিমির’ তাই বীতপ্রেম বিশ্বাসরিক্ত আধুনিকের মনের ছবিটিই প্রবলভাবে একেছে। কখনো ক্ষীণ বিদ্যুৎ-দীপ্তির মতো হয়তো বা শোনা যায় প্রেমের প্রত্যয় ও স্বপ্ন ফিরে পাবার ব্যাকুল আহ্বান : ‘কোথায় প্রেমিক তুমি দীপ্তির ভিতরে’। লক্ষণীয়, ‘দীপ্তি’ শব্দটি এখানে কীরকম অর্থবহভাবে সুপ্রযুক্ত। শুধুমাত্র জ্যোতি বা আভা নয়, শব্দটির উদ্দিষ্ট অভিধা এখানে উদ্দীপ্তি বা প্রেরণার ইঙ্গিত নিয়ে আসে, যে প্রেরণা, কবি তাঁর ইতিহাসবেদী প্রজ্ঞায় জানেন, প্রেম-ই ফিরিয়ে দিতে পারে অবিশ্বাসী মানবসমাজকে। এ উপলব্ধির আলোকে.যখন ‘দীপ্তি’ ও ‘জনান্তিকে’ কবিতা দু’টি পড়া যায়, তখনই তারা উন্মোচিত হয় তাৎপর্যে। ‘জনান্তিকে’ কবিতাটির আরম্ভে রয়েছে এক প্রেমবিবিক্ত অন্ধযুগের উদ্ভ্রান্ত মানব-অভিজ্ঞতার কথা; মানুষের চেতনার গভীরে তবু নিহিত রয়েছে এক শুভ প্রেমবোধ :
তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই—তবু
গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই তুমি
আজো এই পৃথিবীতে রয়ে গেছ।
আধুনিক মানবের বিপন্ন অভিজ্ঞতার ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে কবি অনুভব করেছেন, মেশিন ও মেশিনের দেবতার জোরে নিজেকে স্বাধীন বলে মনে করে নিতে গিয়ে তবু মানুষ এখনো বিশৃঙ্খল। যুদ্ধ-আলোড়িত পৃথিবীতে কোথাও নেই সান্ত্বনা ও শান্তির নীড়। এ রিক্ততা ও উদ্ভ্রান্তির মূলে কিন্তু আছে জাতি ও নেশনের প্রতিভূদের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বিবেকবর্জিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং তার থেকেও যা বড় মর্মঘাতী, সেই আধুনিক মানুষের যান্ত্রিক জীবনচর্যা আর হৃদয়হীনতা। তাই মানুষের হৃদয়কে না জাগালে, প্রতিটি ব্যক্তির হৃদয়ে প্রেম ও সৌন্দর্যের ‘সুনিবিড় উদ্বোধনে’ জাগরিত করতে পারলে মানবতার মুক্তি নেই; মুক্তি নেই মানুষের অন্তর্লোকের চির মানবের :
মানুষের হৃদয়কে না জাগালে তাকে
ভোর, পাখি, অথবা বসন্তকাল বলে
আজ তার মানবকে কী করে চেনাতে পারে কেউ।
চারদিকে রণরক্ত, মৃত্যু ও অন্ধ উদ্ভ্রান্তির মধ্যে জীবনানন্দ অনুভব করেন ‘আরো এক আভা’, যা আমাদের ‘এ ধৃষ্ট শতাব্দীর, হৃদয়ের জিনিস না হয়েও চিরন্তন মানবতার হৃদয়ের নিজের জিনিস’ হয়ে রয়ে গেছে। সংস্কার, গ্রন্থ বা বিজ্ঞানের কাছে নয়, মানুষকে ফিরে যেতে হয় মানব-হৃদয়ের সেই শাশ্বত প্রেমবোধের উদ্দীপ্তি বা প্রেরণার-ই কাছে শুভ ও শান্তির প্রত্যাশায়। প্রেয়সী নারী হয়ে ওঠেন যেন তার-ই প্রতিভূ ও প্রতীক :
অপর নারীর কণ্ঠ তোমার নারীর দেহ ঘিরে
অতএব তার সেই সপ্রতিভ অমেয় শরীরে
আমাদের আজকের পরিভাষা ছাড়া আরো নারী
আছে। আমাদের যুগের অতীত এক কাল
রয়ে গেছে।
‘জনান্তিকে’ কবিতার এ ‘আদি নারী শরীরিণী’ যাকে কবি মানবের হৃদয়ের ভাঙা নীলিমায় কিংবা ‘বকুলের বনে অপার রক্তের ঢলে’র মধ্যেও চির জীবিতের মতো আবিষ্কার করেছেন, ‘দীপ্তি’ কবিতাটিতে তাকেই আবার পাঠক দেখেন সাম্প্রত ও শাশ্বতের অন্বয়ের পটভূমিতে : ‘তুমি যত বহে যাও/আমি তত বহে চলি/তবুও কেহই কারো নয়’। এ অনুয়ের পশ্চাদভূমিতে রয়েছে বিশ্ব-সংকট ও মূল্যবোধের বিপর্যয় : ‘কলকাতা থেকে দূর/গ্রীসের অলিভবন’ রক্তের সমুদ্রে যখন একাকার এবং অগণন মানুষের নিরন্তর মৃত্যুর ঘটনাও যখন ব্যাসনের মতো মনে হয়, তখন মৈত্রেয়ীও ভূমার চেয়ে ‘অন্নলোভাতুর’ হয়ে দেখা দেন। তবুও এ গ্লানি-অবলীন সাম্প্রতের ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকের দিৎসাহীন অনিশ্চিতির মধ্যেও মানুষের অন্তর্লোকের মানব তার চেতনায়। অনুভব করে :
‘তবু এক দীপ্তি রয়ে গেছে।
‘সাতটি তারার তিমির’ বা এ পর্যায়ের কাব্য সৃষ্টির চেতনা পটভূমিটির উল্লেখ আমরা আগেই করেছি। যে অন্ধ দেশকালে মানুষ কেবলি জেগে উঠেছে ‘অফুরন্ত রৌদ্রের অনন্ত তিমিরে’, সেখানে সমাজ চাইছে সকলের কাছ থেকে নিরন্তর ‘তিমির বিদারী অনুসূর্যের কাজ’। যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে মূল্যবোধের ব্যাপক বিনষ্টিতে যখন ঘরে ও বাইরে নিরন্তর তমসা এবং সেই ভীষণ অমার উৎস শুধু বহির্জাগতিক বিপর্যয়-ই নয় (এই দিকে ঋণ, রক্ত লোকসান, ইতর, খাতক),২৩ মানবের হৃদয় থেকে মহৎ সত্য বা রীতি’ অর্থাৎ, সব মূল্যবোধের অন্তর্ধান, যার পরিণামে বিশ শতকী মানুষের নাগরিক বাসভূমি হয়ে যায় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো,২৪ এবং কবি অনুভব করেন, সত্যদ্রষ্টার মতো, সভ্যতার এই জান্তব অধঃপাতের পেছনে আছে ‘হৃদয়বিহীনভাবে ব্যাপ্ত ইতিহাস’।২৫ ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থে যে নিরন্ধ্র তিমিরাচ্ছন্নতার সম্মুখীন হন জীবনানন্দের পাঠক, তা প্রতিবেশজাত এবং সমকালবদ্ধ। কবি এ অমারাত্রির উৎস দেখেছেন মানুষের-ই অধঃপতিত ইতিহাসবিবর্ণ হৃদয়ে—’বেবুনের রাত্রি নয় তার হৃদয়ের রাত্রির বেবুন’২৬। কিন্তু যুগতমসা ও বীতবিশ্বাস উদভ্রান্তি থেকে মানবের অন্তর্লোকের প্রেমবোধ-ই যে মুক্তির পথ দেখাতে পারে, এ কথাটিও বারম্বার উচ্চারিত হয়েছে জীবনানন্দের শেষ পর্যায়ের কাব্যরচনায়, কিছুটা ক্ষীণ ও বিক্ষিপ্তভাবে ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থে, প্রবলতরভাবে ‘বেলা অবেলা কালবেলা’য় এবং একেবারে অনন্য নিরপেক্ষভাবে তাঁর শেষতম রচনাসম্ভারে। প্রেমের শক্তি ও প্রেরণায় এ আস্থাশীলতা ‘মহাপৃথিবী’ এবং ‘সাতটি তারার তিমির’ পর্যায়ের কাব্যের প্রবল বিবমিষা, বিদ্রুপ ও উদ্ভ্রান্তির বিপরীতে কবিচেতনার অন্তঃশীল মৌল আস্তিকতার প্রতিই সংবেদনশীল পাঠকের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে।
‘সাতটি তারার তিমির’-এর নাগরিক জগৎ ভাব ও আবহে যেমন জীবনানন্দের কাব্যসৃষ্টির পূর্ব-পর্যায়ের শান্ত নির্জন প্রকৃতি-ভুবন থেকে দূরস্থিত, তেমনই প্রেমও এ জগতে তার চিরন্তন ঐশ্বর্য ও মহিমা থেকে স্খলিত হয়েই আত্মপ্রকাশ করেছে। গ্রন্থের প্রারম্ভিক কবিতা ‘আকাশলীনা’র নায়িকা সেই ‘পৃথিবীর বয়সিনী’, প্রেমস্বরূপা ‘সুরঞ্জনা’কে কবি দেখেন যুবকের বাহুলগ্না, দূরাপসৃয়মানা। স্পষ্টতঃই যুবক এখানে দেহী বাসনার, জৈব জীবনের প্রতিভূ; ‘সুরঞ্জনা’ যুগাবলীন মালিন্যে অধঃপতিত মনে পড়ে ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থে আমরা যে সুদর্শনা নারীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, তিনি ‘যুগের সঞ্চিত পণ্যে’ লীন হতে না দিয়ে তার প্রেমিকের চেতনাকে করেছিলেন অমৃত সূর্যমুখী। ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থে সেই কবির-ই উপলব্ধিতে প্রেম মূল্যবোধের অবক্ষয়ে মহিমাবিহীন, জৈব জীবন উপচারে পর্যবসিত। ‘বনলতা সেন’ কাব্যের ইতিহাসউদ্ধৰ্তিত চিরশ্রীময়ী ‘সুরঞ্জনা’র হৃদয় তাই ‘সাতটি তারার তিমির’-এর জীবনানন্দের কাছে ‘ঘাস’, ইতর প্রাণের খাদ্যবস্তু হয়ে দেখা দেয়। এ গ্রন্থের অন্তিম কবিতা সূর্যপ্রতিম’—সেখানেও যুগের যন্ত্রণাহত মানবচেতনার নিকষে প্রেমের অবমূল্যায়নের অভিব্যক্তি—’প্রেমিককে শিখায়েছি ফাঁকির কৌশল। শেখাইনি?’২৭ শতাব্দীর যুদ্ধধ্বস্ত সামাজিক ভূখণ্ডে মূল্যবোধবিবিক্ত নাগরিক দুনিয়ায় মুখ আর রূপসীর ভয়াবহ সঙ্গমই স্বাভাবিক। তাই নিবিড় রমণী তার জ্ঞানময় প্রেমিকের খোজে, “অনেক রক্তমলিন পথ হেঁটে ‘আজ এই সময়ের পারে’ খুঁজে পায় ‘আবহমানের ভাড়’কে।২৮ জ্ঞানও প্রেমের যে শুভ অন্বয় বা মিলনের স্বপ্ন ও নির্মাণ জীবনানন্দের পূর্বাপর কাব্যে অভিব্যক্ত, ‘সাতটি তারার তিমির’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ পর্যায়ের রচনায় তাদের ব্যবচ্ছেদ ও অন্বয়ের যন্ত্রণা-ই প্রধান।
প্রেমের এ অবনমন ও নিরর্থকতার পরিপ্রেক্ষিতে জীবনানন্দের একালের কাব্যে তমসার আধিপত্য। কারণ, নারীকে জীবনানন্দ বারবার দেখেছেন জ্যোতি স্বরূপ— প্রেমের আন্তরমূল্যেই নারীকে ঘিরে এ উদ্ভাসনা, এ আলোকদেশিতা। তাঁর ‘সুরঞ্জনা’ (‘বনলতা সেন’) ‘দেহ দিয়ে ভালোবেসে তবু ‘ভোরের কল্লোল হয়ে ওঠেন; তার আলোকদেশি আহ্বান কোনো একদিন ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রকে যেমন, তেমনই অন্ধকার সমুদ্রের অন্বেষাক্লান্ত মানবকে, যুগ যুগে নবসভ্যতার উদয়সৈকতে ডেকে নিয়ে আসে। তার ‘মিতভাষণ’ কবিতার নায়িকার হাতে সেই ‘মণিকা-আলো’, যা ‘শ্রেয়তর বেলাভূমি’তে নাবিককে আহ্বান জানায়। ‘শ্যামলী’ বা ‘মিতভাষণ’-এর, নায়িকার মুখশ্রীর বর্ণনা দিতে গিয়ে কবিকে ব্যবহার করতে হয় ‘প্রতিভা’ শব্দটি, যা অভ্রান্তভাবেই বিভার ঔজ্জ্বল্যের দ্যাতক। আর ‘সবিতা’র নায়িকার মুখ স্পষ্টতই ‘অন্ধকার থেকে এসে নবসূর্যে জাগার মতন’ বলে কবির কাছে মনে হয়েছে।
এভাবে জীবনানন্দের পূর্বাপর কাব্য সৃষ্টিপটে নারী বার বার আবির্ভূতা এক উজ্জ্বল আলোকবৃত্তে। এ আলো অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারে, প্রয়াণের পথ-নির্দেশী; সে প্রয়াণ ইতিহাসবেদে জারিত প্রেমচেতনার আলোকে, অথবা যেমনটি জীবনানন্দের পাঠক জানেন, নব সভ্যতার শ্রেয়তর বেলাভূমির অন্বেষায়। স্বভাবতই আলোক-মহিমাময়ী প্রেরণাদাত্রী ও সভ্যতার ধাত্রী এ জীবনানন্দীয় নারী ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থে অনুপস্থিত। কারণ, এ কাব্য সমাচ্ছন্ন আঁধারের কাব্য—যেখানে পৃথিবী প্রতিভা হয়ে আকাশের মতো শুভ্রতাকে চেয়ে শেষ পর্যন্ত ভঙ্গুর হয়ে নিচে রক্তে নিভে যেতে চায়। তবু এখানেও কবির চেতনালোক থেকে সেই ‘আদি শরীরিণী নারী’ সম্পূর্ণ নির্বাসিত নন। কবি গভীর বিস্ময়ে টের পান, প্রেম এখনও এ পৃথিবীতে রয়ে গেছে। দীপ্তি ও ‘জনান্তিকে’ এ দু’টি কবিতাই এ প্রসঙ্গে আবার স্মর্তব্য। তবে প্রেম তথা নারী ‘সাতটি তারার তিমির’-এ ঈপ্সিত ভূমিকায় অবতীর্ণ নয়—প্রেমের সেই প্রাচীন প্রেরণাশক্তির অন্তর্ধান-ই বরং প্রকটতর। এর একটি কারণ ইতিহাসবেদী চেতনার আলোকে স্বকাল ও প্রতিবেশে নিবদ্ধ কবি জেনেছেন : ‘তিমির হননে’ অগ্রসর হয়ে আমরা আজ ‘তিমিরবিলাসী’ বলেই ‘কোথাও দিৎসা নেই’, ‘প্রেম নেই’। পুনরাবৃত্তির মতো শোনালেও বলতে হয়, জীবনানন্দ প্রেমের দিব্য-প্রেরণার শক্তিতেই যুগ-বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও সম্পূর্ণ আস্থাভ্রষ্ট হতে পারেন নি :
চোখ না এড়ায়ে তবু অকস্মাৎ কখনো ভোরের জনান্তিকে
চোখে থেকে যায়।
আরো-এক আভা :
আমাদের এই পৃথিবীর এই ধৃষ্ট শতাব্দীর
হৃদয়ের নয়—তবু হৃদয়ের নিজের জিনিস,
হয়ে তুমি রয়ে গেছ!২৯
এখানে সচেতন পাঠককে লক্ষ্য করতে হয়, নারীর প্রেম-প্রতিমা ঘিরে ‘আভা’; তার আবির্ভাবের পটভূমি ভোরের আলোকলগ্ন। জীবনানন্দের চেতনায় প্রেম তাই সর্বদাই এক আলোকবৃত্তের অনুষঙ্গে সৌন্দর্য ও পবিত্রতার মেলবন্ধনে আবির্ভূত। প্রেমকে কেন্দ্র করে নারীর রূপ-বর্ণনায় কবি ‘আভা’ ‘দীপ্তি’, ‘প্রতিভা’র মতো ঔজ্জ্বল্যদ্যোতক শব্দগুলিকে বেছে নিয়েছেন। যা আলোকদেশি, তা-ই তিমির হন্তারক। তাই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ নারীকেই জীবনানন্দ ‘তিমির-পিপাসী’ রমণীর চিত্রকল্পে অঙ্কিত করেছেন ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থে। তিমিরপিপাসী নারী-প্রেয়সীকে হারিয়ে নাবিক-মানবতা আজ পথভ্রান্ত; সভ্যতার প্রয়াণ ও উত্তরণও তাই যেন স্তব্ধ।
পরবর্তী গ্রন্থ ‘বেলা অবেলা কালবেলা’র (রচনাকাল ১৯৩৪-১৯৫০ বলে গ্রন্থে উল্লিখিত হলেও কবিতাগুলির আন্তরসাক্ষ্যে কালপ্রেক্ষিত মনে হয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত অগ্নিমুহূর্ত নয়, এক উত্তর-সামরিক অধ্যায়, যেখানে বহির্জাগতিক ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিপর্যস্ত মানব-চেতনা নির্মাণ ও সৃজনের মৃত্যুহীন শক্তিগুলি চিনে নিতে, সংঘবদ্ধ করে নিতে চাইছে। স্বাভাবিকভাবেই মানব-হৃদয়ের দুর্মর প্রেমবোধ, যা জীবনানন্দের কাব্যে চিরদিন-ই সৃজনের প্রতীতি ও উৎসবের প্রতীকে অভিব্যক্ত, এ গ্রন্থে আরো প্রবল ও প্রয়াণমুখী ভূমিকায় উপস্থিত। প্রেমের আধারস্বরূপা প্রেয়সী নারীও অঙ্কিত হয়েছেন সৃষ্টির প্রেরণাদাত্রী ও সভ্যতার ধাত্রীর আলোকদীপ্ত দ্বৈত ভূমিকায়। তবে এখানেও জীবনানন্দ সমসাময়িককালের তিমিরাচ্ছন্ন রক্ত-অবলীন রূপটিকে বিস্তৃত হননি, উপেক্ষা করতে পারেননি। ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থে প্রেমের মূল্যমহিমা খণ্ডিত, দেশকালের আপাতিক দৌরাত্মে অধঃপতিত। বেলা অবেলায় সেই প্রেম যেন ইতিহাসচেতনার সঞ্জীবনে তার সনাতন কল্যাণশক্তিতে কিছুটা পুনরুজ্জীবিত। ‘বেলা অবেলা’র মুখবন্ধী কবিতায় ঘোর তমিস্রার মহাবিশ্বপটে একটি পবিত্র নারীবোধনের সুর। অনুরণিত; জ্যোতিষ্কের উজ্জ্বল আলোকবৃত্তের মতো সৃষ্টির নিদ্রাহীন ধাত্রীর ভূমিকায়। আবিষ্কৃত হয়েছেন শাশ্বত মানব-প্রেয়সী :
মহাবিশ্ব একদিন তমিস্রার মতো হয়ে গেলে
মুখে যা বলনি, নারি, মনে যা ভেবেছে তার প্রতি
লক্ষ্য রেখে অন্ধকার শক্তি অগ্নি সুবর্ণের মতো।
দেহ হবে মন হবে তুমি হবে সে সবের জ্যোতি।৩০
এ মূল সুরটি গ্রন্থের অন্যান্য কবিতাতেও প্রতিধ্বনিতে। ‘তোমাকে’ কবিতাটির সমকালীন অবক্ষয়ের চিত্রে বিচ্ছিন্নতা ও বিনাশের অপশক্তিগুলিই সক্রিয় (‘প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো’)। তবু তার-ই মধ্যে কবি নারীকে চেনেন ইতিহাসের শেষে এসে মানব-প্রতিভার নিষ্ফলতার অক্ষম অন্ধকারে এক মৃত্যুহীন সৌন্দর্যদীপ্তির পরিচয়ে
মানবকে নয়, নারি, শুধু তোমাকে ভালবেসে
বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।
‘মানবকে নয়, নারি’—কথাগুলি লক্ষণীয়। সমকাল ও যুগপ্রতিবেশবদ্ধ মানবকে জীবনানন্দ দেখেছেন ঐতিহ্যবিস্মৃত (‘ব্যর্থ উত্তরাধিকারে’), মানবতা বর্জিত (‘রক্তনদীর পারে’) এবং জৈব জীবনে অধঃপতিত (‘ক্ৰম-পরিণতির পথে লিঙ্গশরীরী’)। পৃথিবীকে যখন ‘বলয়িত মরুভূমি’ বলে কবির মনে হয়েছে এবং ইতিহাসবোধের মধ্যেও যখন। তিনি বাণী খুঁজে পাননি, বরং মৃততাপম মানুষের ভিড় থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তিনি নারীর মধ্যেই পেয়েছেন স্থির শুভ প্রেরণার আশ্বাস ও উদ্দীপ্তির বাণী :
মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন :
আমি যাকে ভালবেসেছি আবহমান কাল সেই নারীর।
আমার পূর্ব-বক্তব্যের সূত্র ধরে বলা যায়, ‘সাতটি তারার তিমির’-এর নির আঁধারে আবৃত পৃথিবী কবির প্রেমচেতনার আলোকে প্রয়াণের পথ খুঁজে পায় যেন ‘বেলা অবেলা কালবেলা’-এর জগতে পৌঁছে—
যে নারী দেখেনি কেউ ছ’সাতটি তারার তিমিরে
হৃদয়ের এসেছে সেই নারী।…..
সৃষ্টির গভীর গভীর হংসীপ্রেম
নেমেছে—এসেছে আজ রক্তের ভিতরে।৩১
‘খণ্ডিত রক্তবণিক পৃথিবীতে’ ‘অন্ধকারে যে শরণ সবচেয়ে ভালো’, সেই শরণ-ই বেছে নিয়েছেন জীবনানন্দ, আর তা হল : ‘যে প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো’।৩২ এ জ্ঞানসিঞ্চিত প্রেম-ই প্রয়াণের শক্তিতে বলীয়ান, কারণ এ প্রেম-ই মানুষকে জানায় ‘মানব ক্ষয়িত হয়না জাতি ব্যক্তির ক্ষয়ে’ এবং খণ্ড সময়ের আপতিত আঁধারের আধিপত্য ভেঙে পৃথিবীতে বার বার জ্যোতির তারণ কণা আসে। প্রেমেইএ পৃথিবীতে নিয়ে আসে বার বার ‘ক্রমায়াত আঁধারকে আলোকিত করার প্রমিতি’।৩৩ এভাবেই একটির পর একটি কবিতায় আশ্চর্য অর্থ-গভীর সব উচ্চারণ ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে সভ্যতার প্রয়াণে ইতিহাসের প্রেমপ্রাণিত ভূমিকার কথা জীবনানন্দ তুলে ধরেছেন তাঁর কাব্যের উপান্ত পর্বে। স্বকাল চিহ্নিত অভিজ্ঞতায় ‘আদি নারী শরীরিণী প্রেমকে কবি নতুন করে চেনেন :
অন্ধ অন্ধকার তুষারপিচ্ছিল এক শোণ নদীর নির্দেশে।
সেখানে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হল, নারি,
তুমি যে মর্ত্যনারকী ধাতুর সংঘর্ষ থেকে জেগে উঠেছ নীল
স্বর্গীয় শিখার মতো,
সকল সময় স্থান অনুভবলোক অধিকার করে সে তো থাকবে
এইখানেই,
আজ আমাদের এই কঠিন পৃথিবীতে। (‘সময়ের তীরে’)
লক্ষ্য করা যায়, এ কবিতায় নারী জেগে উঠেছেন মানবের ‘অনুভবললাকে’, জেগে উঠেছেন ক্লিন্ন পার্থিব অভিজ্ঞতার ঘর্ষণ থেকে (‘মর্ত্যনারকী ধাতুর সংঘর্ষ থেকে’) এক ‘স্বর্গীয় শিখার মতো’ এবং তাকে ঘিরেই আজ আমাদের এ কঠিন পৃথিবীতেও এক চিন্তন স্বপ্নময়তা (‘নীল’ ও ‘স্বর্গীয়’ দু’টি সুনির্বাচিত বিশেষণেই জীবনানন্দ চিনিয়ে দিয়েছেন নারীর স্বকাল-অতিক্রমী অনৈহিক চরিত্রটি)।
‘সাতটি তারার তিমির’-এর পরবর্তী পর্যায়ের কাব্যসৃষ্টিতে প্রেম-ই প্রবলতম বিষয় হিসেবে আবির্ভূত, যদিও কখনো কখনও কবির দৃষ্টি প্রত্যাবর্তিত স্মৃতি, নির্জনতা ও সর্বোপরি প্রশান্তি ও সৌন্দর্যের অনুষঙ্গময় প্রকৃতিলোকে। নিবিষ্ট পাঠক আরো অগ্রসর হয়ে কবির অন্তিমতম কবিতাবলীতে পৌঁছালে আবিষ্কার করবেন মানবীয় প্রেমের। হৃদয়মূল্য এবং নৈসর্গিক প্রশান্তির সমাহারে এক নবজায়মান ‘আলোক পৃথিবী’। কবিচেতনায় সে সংকল্পনা আন্তরিক প্রত্যয়ের শক্তিতে ও মন্ত্রকল্প ভাষার ধ্বনিময়তার প্রসাদে উজ্জ্বল বিগ্রহরূপ ধারণ করেছে। সেসবের পর্যালোচনার আগেই ‘বেলা অবেলা’র চেতনা-গোধূলি উজ্জ্বল হয়েছে কবি-মানসে প্রেমের ইতিহাসপ্রাণিত প্রেরণার। আবির্ভাবে। মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন, ‘বেলা অবেলা’ বা তৎপরবর্তীকালের কাব্যেও ব্যক্তিগত প্রেমের বিশ্বাসযোগ্যতার উত্তাপ অনুপস্থিত বা অস্বীকৃত হয়নি; তবে ব্যক্তিক উপলব্ধির খণ্ডিত সীমায় কবির প্রেমবোধ আবদ্ধ থাকেনি, আত্মস্থ হয়েছে ইতিহাসবেদী চিরমানব-চেতনার ঐতিহ্যে। তাই ‘এই পৃথিবীর সাটিনপরা দীর্ঘগড়ন’ কোনো নারীকে দেখে কবির মনে হয়, সকল অলাত ইতিহাসের হৃদয় ভেঙে বৃহৎ সবিতার মতো সে আত্মপ্রকাশিত অথবা অন্যত্র :
কোথাকার মহিলা সে? কবেকার? ভারতী নর্ডিক গ্রীক
মুশ্লিম ও মার্কিন?
অর্থাৎ, সময় তাকে সনাক্ত করে না আর, (অবরোধ/বে.অ.কা.) বলেই দেশকাল-নিরপেক্ষ বিশ্বজনীন চিরন্তনতায় ব্যক্তিগত প্রমানুভূতির তাৎক্ষণিক সীমারেখাগুলি অতিক্রান্ত হয়ে যায়, এবং অনন্তকালের পটে অপরাহত আলোকবৃত্তের মধ্যে নারী এসে দাঁড়ান উদ্দীপ্তি ও প্রয়াণের বাণী বহন করে :
নিজের নারীকে নিয়ে পৃথিবীর পথে
একটি মুহূর্ত যদি আমার অনন্ত হয় মহিলার জ্যোতিষ্ক জগতে।৩৪
পঙক্তি দু’টি মনে করিয়ে দেয় ব্রাউনিঙের সেই ‘The instant made eternity’ প্রত্যয়টির কথা। ব্রাউনিঙে যেমন, জীবনানন্দের কবিতাতেও তেমনি, এ-জাতীয় উচ্চারণ ফিরে ফিরে এসেছে; পাঠক দেখতে পারেন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘জীবন’ কবিতাটি।
‘সাতটি তারার তিমির’-এর মুখবন্ধী কবিতাটিতে অপসৃয়মানা এক নারীর প্রতীকেই জীবনানন্দ আমাদের জানিয়েছিলেন সমরোত্তর নাগরিক পৃথিবীতে প্রেমের অবক্ষয় ও অধোগতির কথা। তবে ‘ধৃষ্ট’ স্বকালের ভূখণ্ডে দাঁড়িয়েও তিনি ভুলতে পারেননি কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের সমস্ত গোল সোনার ভিতরে এগিয়ে যাওয়া এক অনন্যা নারীকে। সেই সূর্যপ্রতিভ প্রেরণাময়ী নারীকে জীবনানন্দ বার বার আহ্বান জানিয়েছেন প্রথমাবধি, এবং অন্তিম পর্যায়ের কাব্যেও। ‘বেলা অবেলা’র কবি প্রেমচেতনার সেই নবীন বিবর্তনের স্বাক্ষর বহন করেছেন অজস্র কবিতায়। এ নবাঙ্কুরিত প্রেম ‘ইতিহাসবেদে’ ‘আশ্রিত ও পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞানে’ শীলিত হয়েই দেশকালের গণ্ডি অতিক্রম করেছে। সে উক্রান্তি ব্যক্তিগত প্রেমানুভূতির আন্তরিকতা আত্মস্থ করেই ঘটেছে। সময়াতীতের বোধে ও উত্তর-ব্যক্তিক অষ্টিপ্রবণ অনৈতিকতার স্পর্শে লৌকিক প্রেম-ভাবনা থেকে জীবনানন্দ পাঠককে নিয়ে যান লোকোত্তর ‘প্রেমচেতনায়’। সকল প্রতীতি উ’সবের চেয়ে বড় কোনো ভূমিকায় তিনি নারীকে চিনতে পারেন বলেই শুধুমাত্র ‘মিলন ও বিদায়ের প্রয়োজনে’ প্রেয়সী নারীর সঙ্গে মিলিত হতে পারে না। অখণ্ড কাল ও মানবেতিহাসের মহাবিশ্বপটে তিনি নারী তথা প্রেয়সী তথা প্রেমের শক্তি উপলব্ধি করেন আপন চেতনায় :
তুমি তো জাননা, তবু, আমি জানি, একবার তোমাকে দেখেছি
পিছনের পটভূমিকায় সময়ের
শেষনাগ ছিল, নেই, বিজ্ঞানের ক্লান্ত নক্ষত্রেরা
নিভে যায়, মানুষ অপরিজাত সে অমায়, তবুও তাদের একজন
গভীর মানুষী কেন নিজেকে চেনায়।৩৫
সেই অভিজ্ঞান সাময়িকতা ও ব্যক্তিক প্রয়োজনের দাবী সীমারেখার বাইরে নিয়ে আসে কবির প্রেম চেতনাকে :
সুপার কালের স্রোতে না পেলে, কী করে তবু, নারি,
তুচ্ছ, খণ্ড, অল্পসময়ের স্বত্ব কাটায়ে অঋণী তোমাকে কাছে পাবে,৩৬
উদাহরণ বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই। ‘মাঘসংক্রান্তির রাতে’ ‘তোমাকে’, ‘অনেক নদীর জল’, ‘সূর্য নক্ষত্ৰনারী’, ‘অবরোধ’, ‘উত্তর সামরিকী’, ‘নারীসবিতা’ ‘গভীর এরিয়েলে’ একটির পর একটি কবিতায় ইতিহাসবেদে অন্তর্দীপ্তি প্রেমের প্রয়াণোজ্জ্বল কালাতীত ভূমিকাই উপজীব্য। প্রেম এক ‘তিমির-বিদারী’ অভিজ্ঞতা; প্রকৃতির বিকীর্ণ শক্তিগুলির মতো প্রেমও এক অবিনাশী সত্তায় বিরাজমান। জীবনানন্দের কাব্যের অভিনিবিষ্ট পাঠকের কাছে এ বক্তব্য অপরিচিত নয়। কারণ, সেই ‘বনলতা সেন’ পর্যায় থেকেই জীবনানন্দ নারী ও নিসর্গকে শুধুমাত্র প্রথাসিদ্ধ পটভূমিগত সামীপ্যের পরিবর্তে আন্তরমূল্যের সততায় উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। বিশ্বযুদ্ধের অন্তবর্তী ও উত্তরকালীন কাব্যরচনার কালে জীবনানন্দের চেতনাভূমি থেকে আপদকালীন বিমূঢ়তায় অপসৃত হয়েছে নিসর্গের প্রশান্তি ও নারীর কল্যাণ-সুন্দর ধ্রুবতার আদর্শ। কিন্তু এ অপসৃতি দীর্ঘ বা স্থায়ী হয়নি।
‘সাতটি তারার তিমির’—‘বেলা অবেলার’ (১৯৩৪-১৯৫০) পরবর্তী পর্বে নারী তার সমুজ্জ্বল মহিমায় প্রত্যাবর্তিত হয়েছেন প্রবলভাবে, কবিতার পর কবিতায় :
জ্বলন্ত তিমিরের ভিতর তোমাকে দেখেছি
শুনেছি বিরাট শ্বেত-পাখি সূর্যের
ডানার উড্ডীন কলরোল
আগুনের মহান পরিধি গান করে উঠেছে।৩৭
এই সেই চিরদীপ্তিময়ী নারী, যাকে ঘিরে ‘অপার আলোকবর্ষ’; তিমির-পিপাসী অগ্নিপরিধির মধ্যে যার দৈবী সাক্ষাৎ একদা কবিকে জানিয়েছিল ‘অমৃতসূর্যে’র ‘আহ্বান’। বেলা অবেলায় এ শাশ্বতীর আবির্ভাব ‘বিদ্যুতের মতো উজ্জ্বল প্রাণনে’, এ কথা ঠিক। তবে তা ছিল বিদ্যুতের-ই মতো, আবির্ভাবে আকস্মিক ও অস্থায়ী। সংশয়, হতাশা ও দিশাহীনতার যে তিমিরে সমাজ ও রাষ্ট্রের মতো কবির চেতনাও উদভ্রান্ত ছিল ‘সাতটি তিমির’ এবং ‘বেলা অবেলা’ পর্বে, প্রেমের আলোকদেশি প্রত্যয়ের নবজাগরণেই তার থেকে উজ্জ্বল উদ্ধার যেন সম্ভব হয়ে ওঠে। কবির কাব্যের এ দিক পরিবর্তনের পাশাপাশি আরেকটি প্রসঙ্গও লক্ষণীয় : প্রেমের উজ্জ্বল পরাক্রান্ত আবির্ভাবের জন্য পাঠককে অপেক্ষা করতে হয় জীবনানন্দের উত্তরপঞ্চাশী (১৯৫০ পরবর্তী) কবিতাবলীর জন্য, যার সিংহভাগ কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত (এবং ইদানীং ‘আলোপৃথিবী’ সঙ্কলনটির অন্তর্ভুক্ত)। নিসর্গের নিঃশব্দ পুনরাধিষ্ঠান একালের রচনাতেই ঘটেছে। নারীকে জীবনানন্দ ‘উজ্জ্বল পাখিনী’, ‘বনহংসী,’ ‘সৃষ্টির মরালী’র চিত্রকল্পে অধিষ্ঠিত করেছেন। কখনো ‘তাকে জলের উৎসারণের মতো’, কখনো ‘আভা আলো শিশিরের মতন’ নিসর্গের নানা অনুষঙ্গে চিনেছেন। মহাপ্রাণের বৃক্ষের ওপর অধিষ্ঠিত এক উজ্জ্বল পাখিনীর মতো এ নারীকে আরো পরিচ্ছন্ন প্রাণান্ত রঙে জীবনানন্দের পাঠক চিত্রিত হতে দেখেন কবির কাব্যসৃষ্টির শেষতমলগ্নে : ‘একটি বৃক্ষে সময় মরুভূমি/লীন দেখেছে, গভীর পাখি গভীর বৃক্ষ তুমি’।৩৮ অথবা “মহাপ্রাণের বৃক্ষ ও তার পাখি তো বারবার ভস্ম হয়ে জাগছে হরিৎ-নবহরিৎ আছে”।৩৯ এ জাতীয় চিত্রকল্প অসংখ্যবার আবৃত্ত হয়েছে জীবনানন্দের শেষতম পর্যায়ের কবিতা-সংরচনায়। এ সময় তার চিত্রকল্পের ও প্রতীকের প্রিয় বিষয়গুলি ছিল, নদী ও নীলিমা, সূর্য, বৃক্ষ ও পাখি; অন্য অর্থে জল, আলো ও নিসর্গ শ্যামলিমার এক উজ্জ্বল প্রেক্ষাপট। বিষয়গুলি সব-ই জীবনানন্দের পূর্বাপর কাব্যের পাঠকের কাছে পরিচিত ও প্রিয়। শুধু অন্তিম পর্যায়ের কাব্যে সেসব বিষয়ের নবীন সম্বন্ধের অর্থদ্যোতনাই কবির চেতনার সাম্প্রতিক, উদ্বর্তনটিকে পরিস্ফুট করে। সেই অন্তিমতম চেতনাবিবর্তনে এক নবীন সূর্যকরোজ্জ্বল আলো-পৃথিবীর সংকল্পনাই অভিব্যক্ত; এবং নারী ও তার প্রেমান্বেষী মানবপুরুষ আছেন এ পৃথিবীর জ্যোতির্বলয় কেন্দ্রে।
জীবনানন্দের কবি-মানসে প্রকৃতিচেতনার বিবর্তন প্রবাহে আমরা দেখেছি, যুদ্ধ-অবলীন পৃথিবীর বিপন্নতা, উদ্ভ্রান্তি ও নিরাশার বোধকে অতিক্রম করে তার অন্তিম পর্যায়ের কাব্য পাঠককে আহ্বান জানিয়েছে নিসর্গের প্রশান্তি ও মানব-হৃদয়ের চিরন্তন ভালোবাসায় লালিত এক ‘সুচেতনা’-ভাসিত আলো-পৃথিবীতে :
আমাদের পৃথিবীর পাখলী ও নীলডানা নদী
আমলকী জামরুল বাশ ঝাউয়ে সেখানেও খেলা
করছে সমস্ত দিন; হৃদয়কে সেখানেও করে না অবহেলা
বুদ্ধির বিচ্ছিন্ন শক্তি; শতকের ম্লান চিহ্ন ছেড়ে দিয়ে যদি
নর-নারী নেমে পড়ে প্রকৃতি ও হৃদয়ের মর্মরিত হরিতের পথে—
অশ্রু রক্ত নিষ্ফলতা মরণের খণ্ড খণ্ড গ্লানি
তাহলেও রবে; তবু আদি ব্যথা হবে কল্যাণী
জীবনের নবনব জলধারা-উজ্জ্বল জগতে।৪০
এ অনির্বচনীয় কবি-স্বপ্নের জগতেই আমাদের প্রেমচেতনার পর্যালোচনা পাঠককে ফিরিয়ে নিয়ে আসে চিত্রকল্পের অপ্রতিরোধ ভাবানুষঙ্গে :
সে সঞ্চিত মানবতা আজ প্রায় শূন্যে ফুরালো
অনুভব কবে মানুষ তবুও
মৃত্তিকায় মূল রেখে লক্ষ্য রেখে আদি নীলিমায়
শ্যামল গাছের থেকে অবিনাশ ধর্ম শিখবে?
অথবা নশ্বর প্রেম ভালবেসে বসবে ছায়ায়।৪১
নিসর্গের অবিনাশী প্রাণ আর মানবিক প্রেমের আলোক উদ্বর্তনাই মানবকে দিতে পারে রক্তনদীর তীরে এ ধ্বস্ত পৃথিবীতে ধ্রুব জীবনের দিশা। তাই জীবনানন্দকে মন্ত্রোচ্চারণের পবিত্রতায় বলতে শুনি : ‘মুখ থেকে রক্তের ফেনা/পায়ের নিচের থেকে ক্ষমতা যশের মরুভূমি/ফেলে দিয়ে হে হৃদয় কখন বসেবে/কয়েক মুহূর্ত নীল শ্যামল বৃক্ষের নিচে তুমি’।৪২
এ নিসর্গচ্ছায়ায় মানবচেতনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন জ্যোতিঃস্বরূপিণী সূর্যপ্রতিভ নারী, যার কথা আমরা এ যাবৎ আলোচনা করেছি :
যে নারীর মতো এই পৃথিবীতে কোনদিন কেউ
নেই আর—সে এসে মনকে নীল—রৌদ্রনীল শ্যামলে ছড়ালো
কবে যেন—আজকে হারিয়ে গেছে সব,৪৩
সভ্যতার সঙ্কটে, যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর মূল্যবোধ-বিপর্যয়ে, এ ‘নারীসবিতা’কে কবি সাময়িকভাবে হারিয়ে ফেললেও ইতিহাসবেদী চেতনার প্রসাদে মহাসময়ের প্রেক্ষাপটে তাকে চিরভাস্বর স্বরূপে আবিষ্কার করেন :
মনে হয় যেন কোন হরিতের—নব হরিতের
সঙ্গীতে নিশ্চিহ্ন হয়ে মানুষের ভাষা
এ জন্মের আরো দূর জন্ম-জন্মান্তের মুখোমুখি ফিরে এসে
অনাদি আলোর ভালবাসা
সামাজিক অন্তহীন আকাশের নিচে
জ্বালিয়ে শ্যামলনীল ব্যথা হতে চায়।
আমি সেই মহাতরু লাবণ্যসাগর থেকে নিজে
উঠে তুমি জাগিয়েছে অনাদির সূর্য নীলিমায়।৪৪
এ গম্ভীর মন্ত্র উচ্চারণে বোধনের পবিত্রতার সঙ্গে উপলব্ধির তীব্র আন্তরিকতা একাত্ম হয়েছে। কবির প্রেম-ভাবনা বৃক্ষের মতো দিব্য নীলিমার অন্বেষায় ঊর্ধ্বমুখী লৌকিক প্রেমোপলব্ধির সত্যে সংযুক্ত হয়েছে বিশ্বজনীনতা ও লোকোত্তরতার ব্যঞ্জনা। বৃক্ষের প্রতীকটি এদিক থেকে সার্থক। মাটিকে আশ্রয় করে বৃক্ষের যে ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা, জীবনানন্দের অন্তদৃষ্টির গভীরতা তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে মৃত্তিকা ও নীলিমা, পার্থিব ও স্বর্গীয়, জৈব ও আত্মিক-এর সহজ অন্বয়ের প্রতীকসূত্র।
জীবনানন্দের আদ্যন্ত কাব্যসৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত পাঠকের কাছে এ বৃক্ষটি সুপরিচিত। ‘সুদর্শনা’ কবিতাটিতে শুনেছি ‘কিন্নরকণ্ঠ দেবদারু গাছে’, পঙক্তিটি যে। দিব্যরমণীয়তার উদ্ভাস নিয়ে আসে পাঠকের মনে। লাবণ্যসাগর থেকে নিজে উঠে জাগানো ‘মহাতরু’টি তারই আরো ব্যঞ্জনাগভীর বিকাশের সাক্ষ্য বহন করছে। বৃক্ষের অনুষঙ্গে, ‘শ্যামল নীল’ বা ‘নবহরিৎ’-এর মতো শব্দের প্রয়োগে, প্রকৃতি লালিত জীবনচর্যার ইঙ্গিত; অন্যদিকে, পাখি, শ্বেতহংসী বা সৃষ্টির মরাল-এর চিত্রকল্পগুলি প্রয়াণ ও প্রাগ্রসরমানতার ভাববাহী। সূর্য, নক্ষত্র বা রৌদ্রস্বচ্ছল ভূখণ্ডের প্রতীকে উচ্চারিত এক নতুন পৃথিবী অৰিষ্টের ব্যঞ্জনা। এ সবকিছুর কেন্দ্রে বা এগুলির কোনো একটি আশ্রয় করে বা তাদের হার্দ্য সমন্বয়ে রূপায়িত হয়েছে চিরন্তন এক নারীপ্রতিমা—যার ভালবাসার ঐশী প্রসাদে মানবচিত্তে অঙ্কুরিত শুভ-প্রয়াণের শক্তি ও প্রেরণা। এভাবেই শুভ ও সুন্দরের প্রেরণায় মানবচেতনার যে দেশকালাতীত অন্বেষা, তার-ই মহত্তর পরিসরে জীবনানন্দের প্রেম-ভাবনা শেষ পর্যন্ত উত্তরিত হয়ে চিরমানবের যুগযুগ ধাবিত সৌরপ্রয়াণের অংশভাক হয়ে উঠেছে। কবির ব্যক্তিক প্রেমোপলব্ধি, লৌকিক ও লোকোত্তরের আততি ও অন্বয়ের মধ্য দিয়ে, দিব্যপ্রেরণাস্বচ্ছল হয়েও মর্ত-বিমুখী হতে দেয়নি কবির সৃষ্টিকে। মানুষের পৃথিবী তথা ঐহিক অভিজ্ঞতার বাস্তবতা থেকেই বৃক্ষের মতো উদ্বর্তিত, উধ্বায়িত হয়েছে তার কল্পনায়। মানবের শুভ ও সুন্দরের সৌরচেতনা যার অপর নাম, জীবনানন্দের কবিতার ক্ষেত্রে অন্তত, প্রেম :
ইতিহাসের অন্ধকারে প্রথম শিশু মানুষ জাগিয়ে
চলছে আজো একটি সূর্য হঠাৎ হারিয়ে ফেলার ভয়ে;
হয়তো মানুষ নিজেই স্বাধীন অথবা তার
দায়ভাগিনী তুমি;
ওরা আসে, লীন হয়ে যায়; হে মহাপৃথিবী
সূর্যকরোজ্জ্বল মানুষের প্রেম চেতনার ভূমি।৪৫
তথ্যসূত্র
- ১। ‘বনলতা সেন’—মহাপৃথিবী’ পর্যায়ের কাব্যের রচনাকাল ১৩৩৬ থেকে ১৩৪৫-৪৮ সন; কবির নিজের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী। দ্রষ্টব্য : মহাপৃথিবী, ১ম সং ভূমিকা।
- ২। ‘আমি যদি হতাম’ ও ‘ঘাস’ কবিতা দুটি দ্রষ্টব্য।
- ৩. ‘সৃষ্টিরহস্য’ — মহুয়া : রবীন্দ্রনাথ।
- ৪. ‘ঘ্রাণ প্রান্তরে’ —বনলতা সেন।
- ৫, ‘কুড়ি বছর পরে’ — বনলতা সেন।
- ৬. ‘দুজন’—বনলতা সেন।
- ৭. ‘দুজন’—বনলতা সেন
- ৮. ‘হাওয়ার রাত’: ‘আমি যদি হতাম’—বনলতা সেন।
- ৯. ‘সুচেতনা’—বনলতা সেন।
- ১০. ‘ধান কাটা হয়ে গেছে’ —বনলতা সেন।
- ১১. ‘শিরীষের ডাল পালা’ —বনলতা সেন।
- ১২. ‘তুমি’—বনলতা সেন।
- ১৩. ধান কাটা হয়ে গেছে — ’বনলতা সেন।
- ১৪. ‘মনোবীজ’ —মহাপৃথিবী।
- ১৫. ‘ফিরে এসো’ — মহাপৃথিবী।
- ১৬. ‘সিন্ধুসারস’ — মহাপৃথিবী।
- ১৭. ‘আট বছর আগের একদিন’ — মহাপৃথিবী।
- ১৮. ‘মনোৰীজ’ — ম, পৃ.।
- ১৯. ‘আদিম দেবতারা’ — ম, পৃ.।
- ২০. ‘প্রেম অপ্রেমের কবিতা — ম. পৃ।
- ২১. ‘আট বছর আগের একদিন’ — ম, পৃ।
- ২২. ‘প্রেম অপ্রেমের কবিতা — ম. পৃ.।
- ২৩. ‘নাবিকী’ — সা, তা, তি,।
- ২৪. ‘রাত্রি’ — সা, তা, তি।
- ২৫. ‘সূর্যপ্রতিম’ — সা, তা, তি।
- ২৬. ‘উন্মেষ’ — সা, তা, তি।
- ২৭. ‘সূর্যপ্রতিম’ — সা, তা, তি; পৃঃ-৭৯।
- ২৮. ‘উন্মেষ’ — সা, তা, তি; পৃঃ-২৪। জীবনানন্দ-১৬
- ২৯. ‘জনান্তিকে’ — সাতটি তারার তিমির।
- ৩০. ‘মাঘ সংক্রান্তির রাতে’ — বেলা অবেলা কালবেলা।
- ৩১. ‘অনেক নদীর জল’ — বেলা অবেলা
- ৩২. ‘যতদিন পৃথিবীতে’ — বে, অ. কা.।
- ৩৩. ‘অনেক নদীর জল’ — বে. অ, কা।
- ৩৪. ‘সূর্য নক্ষত্র নারী’ — বেলা অবেলা কালবেলা।
- ৩৫. ‘সূর্য নক্ষত্র নারী’ — এক : বেলা অবেলা।
- ৩৬. সূর্য নক্ষত্র নারী— দুই: বেলা অবেলা।
- ৩৭. সময়ের তীরে — বেলা অবেলা।
- ৩৮, ‘সূর্য নিভে গেছে’ — একক, ২য় বর্ষ, ১১শ সংখ্যা, ১৩৫৯।
- ৩৯. ‘নবহরিতের গান’ — একক, শারদীয়, ১৩৬০।
- ৪০. ‘আলোপৃথিবী’ — দেশ, কার্তিক; ১৩৬১।
- ৪১. ‘বৃক্ষ’ — দেশ, কার্তিক; ১৩১১।
- ৪২. ‘বৃক্ষ’ — ঐ।
- ৪৩. ‘দু’দিকে ছড়ায়ে আছে’ — শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় (নাভানা), গ্রন্থিত।
- ৪৪. ‘দু’দিকে ছড়ায়ে আছে’ — শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় (নাভানা), গ্রন্থিত।
- ৪৫. ‘সূর্যকরোজ্জ্বল’ — মাসিক বসুমতী, ফারুন, ১৩৫৬।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।