১৭৫৭ সালে পলাশি – তে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের১ পর ব্রিটিশ বিরােধী যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, উইলিয়াম হান্টারের ভাষায় তা চলেছিল ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহের সমাপ্তিকাল অবধি। ইংরেজ বিরােধী এই অব্যাহত বিদ্রোহাত্মক তৎপরতার কারণে বিশেষত মুসলমানদেরকে বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে। অনেকে ফাঁসিতে জীবন দিয়েছেন, আন্দামানে নির্বাসনে গিয়ে হারিয়ে গেছেন শত শত বিপ্লবী, ইংরেজদের জেলে ধুকে ধুকে মরেছেন হাজার হাজার মুক্তি সংগ্রামী।২ আর ইংরেজদের বিদ্বেষ ও বৈষম্য নীতির শিকার হয়ে ভারতীয় মুসলমানদের জীবন কাঠামাে সব দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে যায়। উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন,
“…ভারতীয় জনসমষ্টির একটা বিরাট অংশ, যাদের সংখ্যা ৩ কোটির মত হবে, ব্রিটিশ শাসনে নিজেদের ধ্বংস দেখতে পাচ্ছে।…মাত্র গতকালই যে দেশে তারা ছিল বিজেতা ও শাসক, আজ সে দেশেই ভরণপােষণের যাবতীয় সুযােগ থেকে তারা বঞ্চিত।…তাদের প্রতি আমাদের উপেক্ষা এবং আমাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতাই এর কারণ।…তারা পুরানাে জাতীয় চেতনার অভিব্যক্তি ও যুদ্ধংদেহী মনােভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে সব ব্যাপারেই তারা ধ্বংস হয়ে গেছে।”৩
এই যখন মুসলমানদের অবস্থা, তখন প্রতিবেশী হিন্দু জনগণ ইংরেজদের সাহায্য-সহযােগিতায় জাতীয় সমৃদ্ধি ও জাতি গঠনের দিকে প্রবলভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। ব্রিটিশ বিরােধী কোনাে সংগ্রামকেই তখন তারা সহযােগিতা দান দূরে থাক, সুনজরেই দেখেনি। ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তারা সুযােগ পেলেই ব্যঙ্গ করেছে। বস্তুত হিন্দুরা ইংরেজ প্রেমে এতটাই অন্ধ হয়ে পড়েছিল যে, ইংরেজ বিরােধী সংঘর্ষে ভারতের মুসলমানরা যখন দেশের জন্য প্রাণ দিচ্ছে, তখন তারা বলেছে, “আমাদের যদি বলা হয় ব্রিটিশ কিংবা কার শাসন তােমরা চাও, উত্তরে আমরা এক বাক্যেই বলিব ব্রিটিশ শাসন, এমনকি হিন্দু শাসনও নয়।”৪ প্রসন্নকুমার ঠাকুরের (১৮০১-১৮৬৮) একটি উক্তি বিখ্যাত হয়ে আছে— যখন তিনি বলেন, “ভগবান যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি স্বাধীনতা চাও না ইংরেজদের অধীন হইয়া থাকিতে চাও, আমি মুক্তকণ্ঠে ইংরেজদের অধীনতাই বর বলিয়া গ্রহণ করিব।”৫ শুধু তাই নয়, বিদেশি ব্রিটিশ শাসনের বি(দ্ধে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামকেও তাদের সচেতন শ্রেণি সমর্থন করেনি। ২৬ মে হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজে রাধাকান্ত দেবের (১৭৮৪-১৮৬৭) সভাপতিত্বে এক সভা হয়, সেখানে বিদ্রোহী সিপাহীদের নিন্দা ও ব্রিটিশ সরকারকে সর্বতােভাবে সাহায্য করার প্রস্তাব নেওয়া হয়। তাই তাে দেখি, ১৮৫৭ সালের সংগ্রামে ইংরেজদের কামানের গােলায় মানুষ যখন জীবন দিচ্ছিল, তখন সংবাদ প্রভাকর’ লিখেছে, “আমরা পরমের্থরের সমীপে সর্বদা প্রার্থনা করি, পুরুষানুক্রমে যেন ইংরেজাধিকারে থাকিতে পারি।”৬ ১৮৫৭-র বিদ্রোহীদের তারা কী দৃষ্টিতে দেখেছে, বন্দি বিপ্লবীদের প্রতি কী নিষ্ঠুর মনােভাব প্রকাশ করেছে, তার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে। ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখেছেন,
“আগ্রা, দিল্লী, কানপুর, অযােধ্যা, লাহাের প্রদেশীয় ভাস্কর পাঠক মহাশয়েরা এই বিষয়ে মনােযােগ করিবেন এবং পাঠ করিয়া বিদ্রোহীদের আড্ডায় ইহা রাষ্ট্র করিয়া দিবেন, সিপাহীরা জানুক ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট সিপাহী ধরা আরম্ভ করিয়াছেন, আর বিদ্রোহী সিপাহী সকল শােন শােন, তােদের সর্বনাশ উপস্থিত হইল, যদি কল্যাণ চাহিস তাে এখনও ব্রিটিশ পদানত হইয়া প্রার্থনা কর…।”৭
[১]
সাধারণভাবে হিন্দু সমাজের সচেতন শ্রেণির এই মনােভাব ব্রিটিশ সরকারও জানতেন। স্বভাবতই ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সমূহ দায় মুসলমানদের ঘাড়েই এসে পড়েছিল। পাশবিক শাস্তি ও ভয়ংকর হত্যালীলার প্রাথমিক শিকার হন মুসলমান বিপ্লবীরাই। যাইহােক, দেশের হিন্দু জনগণ সাধারণভাবে সব সময় ইংরেজদের সহযােগী হিসেবে কাজ করেছে, অন্তত বিশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত স্পষ্ট করে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরােধী আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সহযােগিতাকালীন সময়ে হিন্দুরা শিক্ষা, চাকুরি, ইংরেজদের অধীন ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা গ্রহণ করে এবং ১৭৯৩-র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে প্রায় সমূহ জমিদারি তারা পেয়ে যাওয়ায় শিক্ষা-অর্থ-রাজনীতি সব েত্রে হিন্দুরা জাতি হিসেবে সচেতন হয়ে ওঠে। এই সচেতনতার একটা বড়াে কারণ ছিল হিন্দু মধ্যবিত্তের একটা অংশের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি। ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত এই গােষ্ঠী হিন্দুধর্মের সবকিছুই দোষণীয় ভাবতে থাকে এবং প্রকাশ্যে হিন্দুধর্মের বিরােধিতা করা বীরত্ব ও গর্বের বিষয় বিবেচনা করতে থাকে। ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও নানাভাবে ইংরেজদের সাথে অবাধ মেলামেশা, পশ্চিমী ভাবধারা বিশেষ করে জেমস্ মিল, বেন্থামের শিক্ষার প্রভাবে এই অবস্থার উদ্ভব ঘটে। সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন,
“ইয়ােরােপে রেনেসাঁসের সময়ে ধর্মে আমূল পরিবর্তন হয়। সেখানে ধর্ম ঈশ্বরকেন্দ্রিক হওয়ার পরিবর্তে মানবকেন্দ্রিক হয়ে গেল, একটা সাংঘাতিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে নতুন শিল্প তৈরি হল, চার্চের মাথায় কাপা কাপা হাত দিয়ে শিল্পী ছবি আঁকছে, মিকেলাঞ্জোলাের সেই চিত্রাঙ্কণ স্মরণ করলে দেখা যায় যে, অ্যাডাম ঈশ্বরের হাত ধরার চেষ্টা করছে। পেশীবহুল হাত বাড়িয়ে মানুষ সে ঈরকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছে—এইখানেই তাে রেনেসাঁস। এইখানেই তারা বলেছে তাদের কথা। তারা বলল যে, আমরা সেই ঈরকে বিৰাস করি না যে অনেক যােজন দূরে অবস্থান করে। ঈর্বর আমাদের পর্যায়ে এসে গেল। ইয়ােরােপের সেই ঈশ্বকেন্দ্রিকতা থেকে মানবকেন্দ্রিক মানসিকতা এই দেশে মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) ও ডিরােজিও-এর (১৮০৯-১৮৩১) প্রভাবে শুরুটা হলেও স্থায়ী হলও না। মধুসূদনের গৌণভাবে সেই রাবণকেন্দ্রিক রচনা ‘Ram and his rabble doesn’t appeal to me’ লিখেছেন বন্ধুকে। ভুলে গেলে চলবে না যে, তিনি মাদ্রাজে চাকরী করেছেন এবং মাদ্রাজে সাধারণ মানুষের কাছে রামায়ণের নায়ক কিন্তু রাম নয়, রাবণ। মাদ্রাজের সেই প্রভাব মধুসূদনের উপরে পড়েছিল। তাছাড়াও মধুসূদনের কৃত্তিবাস রামায়ণ ভাল লাগেনি এবং সেই কারণেই তিনি রামায়ণে একটি প্রতিবাদী চরিত্র আঁকতে চেষ্টা করেছেন, যে রাবণের পেছনে কোনও দেবতা প্রত্যক্ষ ভাবে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেননি। মধুসূদনের এই প্রচেষ্টার পেছনে কিন্তু নবজাগরণের একটি দিক খুঁজে পাওয়া যায়। তবে দুঃখের বিষয় যে, মধুসূদন বা ডিরােজিওদের এই প্রভাব কিন্তু স্থায়ী হয়নি। তারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, সেটাই একটা মুখ্য কারণ, বা তারা হয়তাে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছিলেন বলেই গ্রহণযােগ্য হয়ে ওঠেনি। যদিও বেশি বাড়াবাড়ি করে তাদের গাে-মাংস খাওয়া চালিয়ে যাবার বােধ হয় সে সময়ে প্রয়ােজন ছিল না, আবার প্রয়ােজন হয়তাে ছিলও। তবে প্রতিবাদ করে তাদের দেখানাে প্রয়ােজন ছিল যে, বৈদিক আর্যদের গাে-মাংস ছাড়া আর কোনও খাদ্য ছিল না। বৈদিক আর্যদের মাছ খাওয়ার রীতিই ছিল না, তারা ষাড়ের মাংস খেতেন। আর্যরা বৈদিকযুগে নৈবেদ্য হিসাবে যজ্ঞে রুটি, ক্ষীর, মদ, মধু, ষাড়ের মাংস, দুধ ও দই দেবতাকে দিতেন এবং সেটাই তারা বৈদিক আর্যদের সূত্রেও খেতে পারতেন, তা না করে সাহেবদের সূত্রে খেলেন কেন? তারা তাে বলতে পারতেন যে প্রাচীন আর্যদের মুখ্য খাদ্যই ছিল গােমাংস, সেটা তাে তারা বলেননি, সেটা না বলে তারা কেন বলেছিলেন যে সাহেবরা খাচ্ছে, অতএব আমরাও খাব।”৮
এই পরিস্থিতিতে হিন্দুধর্মের সংস্কার ও হিন্দু জাতীয়তার উত্থান ত্বরান্বিত হয়ে উঠে। হিন্দুধর্মের ভাঙন রােধে এগিয়ে আসেন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীগণ। তারা প্রত্যেকেই পাশ্চাত্য বিদ্যাবত্তায় দীক্ষিত ও ভারতীয় হিন্দু ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধান্বিত ছিলেন। এঁরা একেকজন একেক ধারার উদ্গাতা হয়েছিলেন। কেউ ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, কেউ ধর্মের ক্ষেত্রে, কেউ সামাজিকতার ক্ষেত্রে, কেউবা হিন্দুত্বের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে। এঁদের প্রত্যেকের সামগ্রিক চিন্তাধারা ছিল হিন্দু সমাজকে সমৃদ্ধ করা এবং হিন্দুত্বের সৌকর্য উদঘাটিত করা। এঁদের কারও দৃষ্টিতেই প্রতিবেশী মুসলমান চিহ্নিত হয়নি। এঁদের কারাে বক্তব্যেই মুসলমানকে নিয়ে নয় এবং মুসলমান ও হিন্দু মিলিয়ে একটি জাতিসত্তার কল্পনা এঁদের কারােরই ছিল না। রাজা রামমােহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩) ছিলেন এদেরই পথ প্রদর্শক। তিনি আচরণগত দিক থেকে হিন্দু সমাজের বিকলতা ও বিভ্রান্তি দূর করে আর্য সমাজে উদ্ভূত আদি বৈদিকতার পুনরুজ্জীবন যাচনা করেছিলেন। তিনি ১৮২৮ সালে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। রামমােহন হিন্দুধর্মের গণ্ডির মধ্যেই আত্মরক্ষা করে ভাঙনের গতিরােধ করলেন ব্রাহ্মধর্ম প্রবর্তন করে। নিরাকার পরম ব্রহ্মের উপাসনাই ছিল এ মতের সারমর্ম। ব্রাহ্মমতের এহেন বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেকে মনে করেন ব্রাহ্মমত হিন্দুধর্ম হতে পৃথক। একথা ঠিক নয়। ব্রাহ্মমত পােষণের জন্য হিন্দুধর্ম ত্যাগ করতে হয় না। শুধু অমানবিক ও অসামাজিক প্রথা-আচরণগুলােকে (যেমন সতীদাহ) ত্যাগ করে সাধারণ মন্দিরে পরম ব্রহ্মের উপাসনা করতে হয় আদি বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে। রামমােহন নিজে একজন ধার্মিক হিন্দু ছিলেন, সেই সঙ্গে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণও। তিনি কখনাে নিজেকে হিন্দু ছাড়া অন্য ভাবেননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে যারা তাকে নতুন ধর্মের প্রবর্তক বলেছে।
বলা হয়ে থাকে, নবজাগরণের সার্থক পথিকৃৎ হিসেবে রামমােহন আধুনিক ইউরােপীয় চিন্তা-ভাবনার প্রভাবে একেরবাদ, পৌত্তলিকতা বিরােধিতা ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের আধার হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন ব্রাহ্ম সমাজ। কিন্তু এজন্য তার ইউরােপের অনুকরণ বা অনুসরণ করার দরকার ছিল কি? দেশের মাটিতে কান পাতলেই তাে এদেশের জমিতেই তিনি পেয়ে যেতেন এই মতের সন্ধান। রামমােহনের জন্মের পূর্বে সেই মধ্যযুগ থেকেই রামানন্দ-নানক-কবীর-মইনুদ্দিন চিস্তি-নিজামুদ্দিন আওলিয়া ও শ্রীচৈতন্যের পথ ধরে বাংলার আকাশে বাতাসে বিরাজমান ছিল “পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে, একেরবাদের পথে , জাতিভেদ প্রথা ও অন্যান্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত…ইংরেজ শাসন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বে ভারতবর্ষের সবটাই অশিক্ষায় আচ্ছন্ন ছিল না। আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে রস আহরণ করে অনেক সাধক ও সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটেছিল, যাঁরা গ্রাম বাংলায় আলাে বিকিরণ করেছিলেন—এক উদার মানবতাবাদী ভাবধারা প্রচার করেছিলেন।৯
রামমােহন বলেছেন, “অন্ততপক্ষে রাজনৈতিক সুযােগ ও সামাজিক সুবিধা পাওয়ার জন্য তাদের ধর্মের কিছু পরিবর্তন প্রয়ােজন বলে আমি মনে করি।”১০ অর্থাৎ ডিরােজিও-বিদ্যাসাগরের মতাে মানবতাবােধের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়, কিংবা জাতীয় স্বার্থে অথবা কোনও উচ্চতর মতাদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নয়, কেবলমাত্র নিজেদের শ্রেণিস্বার্থে রাজনৈতিক সুযােগ-সুবিধা লাভের জন্য রাজা রামমােহন উনিশ শতকে হিন্দুদের সমাজনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে হিন্দুধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সামাজিক নেতৃত্ব লাভের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল রক্ষণশীল হিন্দুধর্ম এবং গোঁড়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সর্বব্যাপী প্রভুত্ব। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সৃষ্ট অসংখ্য শাস্ত্রীয় বন্ধন ও বিধিনিষেধের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিতকামী নতুন শিথিত ভূস্বামীগােষ্ঠী সংস্কার আন্দোলন আরম্ভ করেন।
আর রামমােহনের যে ‘ভাবের ঘরে চুরি ছিলাে’—একথার প্রমাণও বাস্তব তথ্য থেকে মিলে যায়। হিন্দুধর্মের কুসংস্কার ও কুআচারগুলির বিরুদ্ধে সােচ্চার হলেও, বাবার মৃত্যুর পরে কলকাতার বাড়িতে আলাদা করে তিনি শ্রাদ্ধ করেন, বিলেত যাবার সময় সঙ্গে করে ব্রাহ্মণ রাঁধুনি নিয়ে যান, রক্ষিতা পােষণ করার সমার্থক হিসেবে বিবেচিত শৈব বিবাহের প্রতি তার বিলক্ষণ সমর্থন ছিল। ব্রাহ্ম নেতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭-১৯০৫) কাছে ‘ঈশ্বরের প্রত্যাদেশের’ ফলে নির্বাচিত একমাত্র কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-৮৪) ছাড়া আর কোনও অব্রাহ্মণ ব্রাহ্ম সমাজের বেদি থেকে উপাসনা পরিচালনার অধিকারী ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এতে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য ছিল। রামমােহনের নেতৃত্বে প্রতি শনিবারের প্রার্থনা সভায় দুজন তেলেগু ব্রাহ্মণ বেদ পাঠ করতেন, সম্ভবত এ কারণে যে বাঙালি ব্রাহ্মণদের চেয়ে দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণদের তখন উন্নত বলে গণ্য করা হত। তারপর উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশ নামে এক ব্রাহ্মণ উপনিষদ পাঠ করতেন। শেষে ব্রাহ্মণ রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ধর্মোপদেশ দেবার পর ব্রহ্মসংগীত দিয়ে সভা ভঙ্গ হত। তবে ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে ব্রাহ্মণ, শূদ্র, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলের সমান অধিকার থাকলেও যে স্থলে বেদমন্ত্র পাঠ হত শূদ্রদের সেখানে যাওয়ার অধিকার ছিল না।১১ বৈদিক শ্লোকের ব্যাখ্যাতেও মিলত সম্পূর্ণ হিন্দুভাব। রামমােহন অহিন্দুদের সঙ্গে কিংবা অন্য জাতের সঙ্গে একত্রে আহার করতেন না।১২ তিনি আমরণ ব্রাহ্মণের উপবীত ধারণও করেছেন।১৩
[২]
জাতিভেদ প্রথা সম্পর্কে ব্রাহ্ম সমাজের বা রামমােহনের কথায় ও কাজের পার্থক্যকেও উপেক্ষা করা যায় না। জাতীয় অগ্রগতির পথে জাতিভেদ প্রথা বাধা স্বরূপ বলে তিনি মনে করতেন। কিন্তু তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে কোনও বৌদ্ধিক বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেননি। চাতুর্বর্ণ ও জাতিভেদের যে অমানবিক আর্থ-সামাজিক কাঠামাে তখন হিন্দুধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এবং এখনও আছে, তার উপর কোনও উল্লেখযােগ্য বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক আঘাত হানতে রামমােহন পরিচালিত ধর্মসংস্কার আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। বৈদান্তিক তত্ত্বের দিক থেকে রামমােহন ও ব্রাহ্ম সমাজ জাতিভেদ প্রথাকে গ্রহণ না করলেও কার্যত আর্থ-সামাজিক কলুষের প্রতি উদাসীন ছিলেন। অনেকে অবশ্য এ প্রসঙ্গে রামমােহন কর্তৃক মৃত্যুঞ্জয়াচার্য রচিত সংস্কৃত পুস্তিকা ‘ব্রজসূচী’র অংশবিশেষের অনুবাদের উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু এটিতে কী কী গুণ থাকলে ব্রাহ্মণত্ব সূচিত হয় শুধু তারই উল্লেখ রয়েছে, চাতুর্বর্ণের বিরুদ্ধে একটি শব্দও নেই। ইংরেজদের কাছে লেখা চিঠিপত্রে অবশ্য রামমােহন কখনাে কখনাে কিছুটা ব্যতিক্রমী মনােভাব ব্যক্ত করেছেন। রংপুর জেলার ইংরেজ কালেকটার যে জন ডিগবীর অধীনে তিনি অনেক বছর দেওয়ানের চাকরি করেছিলেন, তার কাছে ১৮২৮ সালের ১১ জানুয়ারির একটি চিঠিতেও রামমােহন লিখেছিলেন যে জাতিভেদ প্রথার অসংখ্য ভেদাভেদে বিভক্ত থাকবার ফলেই ভারতের জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়নি। বরং কার্যক্ষেত্রে রামমােহন বা ব্রাহ্ম সমাজ জাতিভেদ প্রথার মতাে অমানবীয় কুপ্রথাকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন করে গেছেন। এমনকী দেবেন্দ্রনাথের পরবর্তী আদি ব্রাহ্ম সমাজের সভাপতি রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯) জাতিভেদ প্রথার সমর্থন করে বলেন যে, ইংল্যান্ডের ডিগার, লেভেলার প্রভৃতি আন্দোলনের সমাজতান্ত্রিক সাম্যের আদর্শের জন্য পৃথিবী তখনও প্রস্তুত হয়নি। কিন্তু এই খোঁড়া অজুহাত শুধুমাত্র রামমােহন ও ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মানবতাবাদ ও সাম্যচিন্তার অভাবই সূচিত করে। ইউরােপের নবজাগরণের মধ্য থেকেই মানবতাবাদের উন্মেষ হয়েছিল, আর ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মধ্য থেকেই ডিগার, লেভেলার প্রভৃতি সাম্য ও সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনাময় আন্দোলন জন্মলাভ করেছিল। এক্ষেত্রেও রামমােহন এবং ব্রাহ্ম সমাজ প্রকৃত নবজাগরণ, এমনকী প্রকৃত ধর্মসংস্কার আন্দোলনের উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছিল।
যদিও রামমােহন কতকগুলি বিষাক্ত সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে বিরূপ মনােভাব পােষণ করেছেন, কিন্তু “সহজ সত্যটি হল, হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত সামাজিক প্রথাগুলির কোনও পরিবর্তনের প্রতি তিনি বিরূপ মনােভাব পােষণ করতেন।”১৪ সতীদাহ প্রথার বিরােধিতা প্রসঙ্গে তার ভূমিকা নিঃসন্দেহে বিশেষ উল্লেখযােগ্য। তবে এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ্য যে, ষােড়শ শতকে আকবর ও সপ্তদশ শতকে মােগল সম্রাট আওরঙ্গজেব এই প্রথা নিষিদ্ধ করতে আইন জারি করেছিলেন। তারপর ১৭৭২ থেকেই খ্রিস্টান মিশনারি ও ইংরেজ রাজকর্মচারীরা এই অমানবিক প্রথা বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাতে শুরু করেন, ১৮০৪ সালে রাম রাম বসু এর বিরুদ্ধে পুস্তক রচনা করেন, ১৮০৫ সালে পণ্ডিত ঘনশ্যাম শর্মা ও ১৮১৭ সালে পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার শাস্ত্রীয় যুক্তি দেখিয়ে এর বিরােধিতা করেন। কাজেই এ বিষয়ে পথিকৃৎ-এর স্বীকৃতি রামমােহনের প্রাপ্য নয়। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে তিনিই গতি দিয়েছিলেন। ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক শেষপর্যন্ত যখন আইন করে এই প্রথা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন রামমােহন তাঁকে অভিনন্দন জানান—যদিও এর আগে লর্ড বেন্টিঙ্ককে তিনি অজ্ঞাত কারণে এই আইন প্রণয়ন না করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্তত একটি বিষয়ে রামমােহনের অবস্থান তার নিজস্ব চিন্তাধারার সঙ্গেই সঙ্গতি পূর্ণ নয়। যে বিধবা বিবাহের আন্দোলন বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে রামমােহন পরবর্তী বাংলায় সমাজ সংস্কারের ত্রে বিশেক্ষেষ গুরুত্ব পেয়েছিল অজ্ঞাত কারণে রামমােহন ‘শাস্ত্রীয়’ যুত্তির সাহায্যে তার বিরােধিতা করেন। এ েত্রে ‘প্রগতিশীল চিন্তার পথিকৃৎ’ রামমােহন ও ‘প্ৰতিক্রিয়াশীল রক্ষণশীলতার ‘স্তম্ভ’ রাধাকান্ত দেবের অবস্থান প্রকাশ্য ও স্পষ্টতই অভিন্ন ছিল।১৫ তা ছাড়া সমাজ সংস্কার ও আধুনিক শিক্ষার প্রসারে রামমােহনের ভূমিকা কতটা ছিল সেই বিতর্কে প্রবেশ না করেও বলা যায়, তিনি ‘ধর্মানুগত শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন।১৬
অনেক তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন হয়েছে যার সুবিস্তৃত ইতিহাস বর্তমানে আমাদের জানা। শিক্ষা-ধর্ম-সমাজ সংস্কারের আন্দোলন—এসব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তথাকথিত বাঙালি রেনেসাঁস-এর ভাবমূর্তি প্রকাশিত হয়। এসব আন্দোলনের প্রগতিশীলতা এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য। রামমােহন রায়-দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৭) এসব আন্দোলনের নেতা ছিলেন যাঁরা ধর্মের সংস্কার চাননি, তাদের মধ্যেও কেউ কেউ, যেমন রাধাকান্ত দেব, শিক্ষাবিস্তারের জন্য সচেষ্ট হন, এমনকী বিধবাদের চিতায় তুলে মারবার কুসংস্কারের ঘােরতর সমর্থক হলেও রাধাকান্ত স্ত্রীশিক্ষার প(পাতী ছিলেন। দেখা যায়, রেনেসাঁসের আদিপর্বে প্রগতিশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যবধান ছিল না। রামমােহন বিধবা বিবাহের বিরােধী ছিলেন, কিন্তু বৈধ মদ্যপান তার মতে, ভদ্র ব্যবহার বলা যেতে পারত। রামমােহন লিখেছিলেন, “বিধবার বিবাহ তাবৎ সম্প্রদায়ে অব্যবহার্য হইয়াছে সুতরাং উহা সদ্ব্যবহার কহাইতে পারে না কিন্তু বিহিত মদ্যপান …অনেকের ব্যবহার্য অতএব তৎপক্ষে সে সর্বদা সদাচার ও সদ্ব্যবহারে গণিত হইয়াছে।” এই একটি উদ্ধৃতি থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, রামমােহনের মতে সামাজিক আচার ভালাে কি মন্দ তার বিচারের একমাত্র উপায় ছিল লােকমত। এসব কূট-তর্কের মধ্যে না গিয়ে বলা যায়, এসব সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনের ফলে বাংলার কৃষকদের কোনাে উপকার হয়নি, এবং তাদের উপকার সমাধনের জন্যও এসব আন্দোলন হয়নি।
বস্তুত ব্রিটিশরা নিজেদের প্রশাসনিক প্রয়ােজনে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন শুরু করলে জমিদার মধ্যস্বত্বভােগী মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ীর দলই সেই সুযােগ সর্বপ্রথম গ্রহণ করতে এগিয়ে আসে। তৎকালীন সমাজের রক্ষণশীল পরিবেশ, ধর্মীয় প্রাধান্য এবং অসংখ্য যুক্তিহীন কুসংস্কার ও বিধিনিষেধের নাগপাশে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদী মননশীলতার বিকাশের কোনও সুযােগই প্রায় ছিলও না। ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রসাদপুষ্ট এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একাংশ স্বাভাবিকভাবেই তাগিদ অনুভব করে তাদের শ্রেণিগত স্বার্থকে সংহত ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং তার পথে বাধা হিসেবে বিরাজমান সামাজিক বিধিনিষেধগুলি অপসারণ করার জন্য। সদ্য প্রাপ্ত ইংরেজি শিক্ষা এবং তার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের উন্নততর সামাজিক চেতনা, উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, যুক্তিবাদ এমনকি ইউটোপিয়ান সমাজতান্ত্রিক ভাবনা-চিন্তা তাদের ভাবজগতে যে প্রতিত্রি(য়ার, যে আলােড়নের জন্ম দিয়েছিল, তারই প্রেরণায় তারা এগিয়ে ছিল বিরাজমান সমাজের বিবিধ সংস্কার সাধনের জন্য। ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য প্রভৃতি সমস্ত ক্ষেত্রেই তার ছাপ পড়ছিল। কিন্তু যেহেতু তাদের অস্তিত্বই ছিল পরনির্ভর, ফলে তাদের এই চেতনার উন্মেষও সীমিত ছিল ঔপনিবেশিক শাসন তথা ভূমিব্যবস্থার স্বার্থের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ও নির্দিষ্ট একটি গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই বাংলার ‘রেনেসাঁ’র নায়কদের ধার করা প্রগতিশীলতার দৌড় ছিল ঠিক ওই নির্দিষ্ট গণ্ডিটি পর্যন্তই এবং এটাই ছিল তাদের সমস্ত ধ্যানধারণা ও কর্মপ্রবাহের অন্তর্নিহিত মৌলিক স্ববিরােধিতার উৎস।
তাই যে রামমােহন বীভৎস সতীদাহ প্রথা বন্ধের আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন, স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা বলেছিলেন, সংবাদের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন যে রামমােহন স্পেনে গণতান্ত্রিক বিবের জয়ের সংবাদে উল্লসিত হয়ে কলকাতার টাউন হলে ভােজসভা দিয়েছিলেন ইতালির বিবের পরাজয়ের সংবাদে হতাশায় শয্যা গ্রহণ করেছিলেন, ফরাসি বিপ্লবের বিজয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে খোঁড়া পা নিয়েও ফরাসি জাহাজে ফরাসি বি-বের পতাকাকে অভিবাদন করতে ছুটেছিলেন—তিনিই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছিলেন, “ইংরেজ জাতির অভিজাত সম্প্রদায় ভারতে উপনিবেশ বিস্তার করলে তার ফল ভারতীয়দের পথে বিশেষ মঙ্গলজনক হবে।” লিখতে পেরেছিলেন। “ভারতবাসীর পরম সৌভাগ্য যে, ভগবৎ কৃপায় তারা ইংরেজদের রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে।” তিনিই এদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের বসবাস ও পুঁজি বিনিয়ােগের ঘাের সমর্থক ছিলেন যে নীলকর দস্যুদের অত্যাচারে বাংলার কৃষকেরা সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন তাদের সার্টিফিকেট দিয়ে বলতে পেরেছিলেন ‘নীলকর সাহেবরা এদেশে অকল্যাণের চেয়ে কল্যাণই করেছে বেশি’ এবং নীলকরদের শােষণ উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বঙ্গীয় কৃষকদের গৌরবময় বি-বী সংগ্রামের সূচনার স্তরেই একে ‘সংস্কারবদ্ধ মনের অদূরদর্শী আন্দোলন’ আখ্যা দিতে সংকোচবােধ করেননি।
[৩]
কলকাতাস্থিত রাজা রামমােহনের বাড়ি থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরবর্তী বারাসাত ও পার্ববর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তিতুমিরের নেতৃত্বে কৃষকেরা ও কৃষি-শ্রমিকেরা যে বছরে বিদ্রোহের দ্বারা ইংরেজ শাসনকে উচ্ছেদ করে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন, সেই বছরেই অর্থাৎ ১৮৩১ সালে রামমােহন ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করার উপায় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে লিখেছেন, “কৃষক ও গ্রামবাসীরা নিতান্ত অজ্ঞ, সুতরাং তারা পূর্বকালের বা বর্তমান কালের শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে নিস্পৃহ। ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মচারীদের আচরণের উপরেই তাদের নিরাপত্তা বা দুঃখ কষ্ট নির্ভর করে। …যাঁরা ব্যবসায়ে নিযুক্ত থেকে ঐধর্যশালী হয়েছেন এবং যাঁরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে শান্তিতে জমিদারি ভােগ করছেন, তাঁরা তাঁদের বিচক্ষণতা দ্বারা ইংরেজ শাসনাধীনে ভবিষ্যৎ উন্নতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে সক্ষম। আমি তাদের সাধারণ মনােভাব সম্বন্ধে বিনা দ্বিধায় বলতে পারি যে, তাদের ক্ষমতা ও গুণানুসারে তাদেরকে ক্রমশ উচ্চতর সরকারি মর্যাদা দান করলে ইংরেজ সরকারের প্রতি তাদের আনুরক্তি আরাে বৃদ্ধি পাবে। কারণ ব্রিটিশ শাসকেরা তাদের কাছে কেবলমাত্র শাসক হিসাবে নয়, পিতা ও অভিভাবক’রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যাঁরা তাঁদের জীবন, সম্পত্তি ও ‘ধর্মের রক্ষক’ ছিলেন।১৭
অবশ্য দিলীপকুমার বিধাস অনেক অনুসন্ধানের পর ব্রিটেনের নটিংহাম বিবিদ্যালয়ে রথিত লর্ড বেন্টিঙ্কের কাগজ পত্রের মধ্যে অপ্রকাশিত রামমােহনের একটি স্মারকপত্র আবিষ্কার করেছেন, যেটি ১৮২৯-এ (অর্থাৎ পার্লামেন্টারী সিলেক্ট কমিটিতে তার সাথে তার আগে) তিনি ব্রিটিশ সরকারকে দিয়েছিলেন। এই ‘স্মারকপত্রটির’ প্রতি ছত্রে করভার নিপীড়িত ও নানা উপায়ে শােষিত কৃষককুলের জন্য রামমােহনের ‘সহানুভূতি প্রতিফলিত’ বলে দিলীপবাবু অভিমত প্রকাশ করেছেন। স্মারকপত্রটি পড়ে দিলীপবাবুর সঙ্গে মূলত দ্বিমত প্রকাশের কোনও কারণ না থাকলেও একটি প্রগ্ন থেকেই যায় তাহলে কেন মাত্র দুবছর পর রামমােহন ১৮৩১-এর সাথে বাংলার কৃষককুলের দুঃখ-দুর্দশার মূল উৎস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তুকে বাতিল করার দাবি না জানিয়ে বরং এই বন্দোবস্তকে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে রায়তদের ক্ষেত্রে পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার পরামর্শ দিলেন? কৃষকদের প্রতি তার সহানুভূতিকে এই স্মারকপত্রের ভিত্তিতে আন্তরিক বলে ধরে নিলেও, তাঁর জমিদারি স্বার্থকেই যে শেষপর্যন্ত তিনি প্রাধান্য দিয়েছিলেন—এ সিদ্ধান্ত বর্জন করা যায় না। কিংবা হয়তাে বা বলা যায়, তার শ্রেণি স্বার্থের যুপকাষ্ঠে হৃদয়ের সহানুভূতিকে শেষপর্যন্ত তিনি বলিই দিয়েছিলেন।
আসলে দিলীপ বাবুসহ সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (“রাজা রামমােহন রায়), সুশােভন সরকার (‘Rammohan Roy on Indian Economy’) অমলেন্দু দে (‘বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ’) রবীন্দ্র গুপ্ত১৮ প্রমুখদের কেউই রামমােহনের কৃষি-সম্পর্কিত সামগ্রিক চিন্তাধারাকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেননি। এঁরা ইতিহাসকে খণ্ডিত করেছেন, বিচ্ছিন্ন করে দেখাবার চেষ্টা করেছেন। এরা রায়ত-কৃষকদের জন্য রামমােহনের কর-হ্রাসের দাবির কথা জোরের সঙ্গে বলেছেন, কিন্তু রামমােহন। যে জমিদারদের জন্যও সমান হারে রাজস্ব-হ্রাসের দাবি করেছিলেন, সে কথা এঁরা কোথাও বলেননি। এঁরা নিজেদের বক্তব্য সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সুবিধামতাে রামমােহনের রচনা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃতি উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি দেননি। পাশাপাশি আশ্রয় নিয়েছেন কল্পনারও, ইতিহাসের পথে হাঁটার পরিবর্তে। তাই এদের আলােচনায় রামমােহনের রায়ত-প্রীতির পরিচয় মেলে, রামমােহনের জমিদার-প্রীতির কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। অথচ রামমােহন জমিদারশ্রেণি প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন। ভূমি-রাজস্ব সম্পর্কিত রামমােহনের সামগ্রিক চিন্তাধারায় এই সত্যটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
উল্লেখ্য, এই রায়ত-কৃষক জনগণকে আধিবিদ্যক দর্শন আর ধর্মমােহে আচ্ছন্ন করবার হাতিয়ার হিসেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বেছে নিয়েছিল বেদান্ত দর্শনের পুনরুদ্ধার এবং বিশেষত শিক্ষিত সমাজে এ দর্শনের আত্মা-পরমাত্মা, জীবনমুক্তি ও মায়াবাদের তত্ত্ব পুনঃপ্রচার। সম্রাট কনস্টানটাইন যেমন রােমক সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা এবং স্থায়িত্বের উদ্দেশ্যে খ্রিস্টধর্মের প্রসারে সাহায্য করেছিলেন, তেমনিভাবে ব্রিটিশ সরকার ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার লক্ষে বেদান্তের পুনরুদ্ধার এবং পুনঃপ্রচারে উৎসাহিত হয়ে পড়ল। ভারতে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতি জনগণের, বিশেষত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রত্যক্ষ বিরােধিতা থেকে ইংরেজ সরকার আগেই বুঝতে পেরেছিল যে এদেশের ধর্মীয় ঐতিহ্যের মধ্য থেকেই সাম্রাজ্যবাদী শাসনশােষণের পরিপূরক ধর্মমােহ সৃষ্টি করতে হবে। আর তা করতে হলে অন্যতম শর্ত হল কোনাে দেশ বা জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাস। ঐতিহ্যের আলােচনা। সেই ঐতিহ্যের গৌরবময় ও মহত্তর ব্যাখ্যান, যাতে দেশ ও জাতি তার সুদীর্ঘ ইতিহাসকে শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করতে পারে এবং সেই গৌরবময় ঐতিহ্যকে জাতীয় জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আধুনিক অর্থে ইতিহাস বলতে যা বােঝায় প্রাচীন ভারতের সেরকম ইতিহাস ছিল না, মধ্যযুগের মুসলমান ঐতিহাসিকরা অনেক ইতিহাস লিখলেও তারা প্রাচীন ভারত সম্পর্কে খুব একটা আগ্রহ প্রদর্শন করেননি। কিন্তু ভারতে ইউরােপীয়দের আগমনের গােড়া থেকেই বিভিন্ন পর্যটক, ধর্মপ্রচারক ও বাণিজ্যিক কোম্পানির কর্মচারীরা ভারত সম্পর্কে উৎসুক হন এবং ভারতীয় ধর্ম, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে পরিশ্রমী গবেষণা করতে থাকেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এইসব আলােচনা
গবেষণা ভারততত্ত্ব আন্দোলনের জন্ম দেয়। ওয়ারেন হেস্টিংসের (১৭৩২-১৮১৮) সাংস্কৃতিক নীতি এবং স্যার উইলিয়াম জোনসের (১৭৪৬-১৭৯৪) এশিয়াটিক সােসাইটি (১৭৮৪) প্রতিষ্ঠা দেশে-বিদেশে ভারততত্ত্ব সম্পর্কে তুমুল আগ্রহ সৃষ্টি করে।
এশিয়াটিক সােসাইটি প্রতিষ্ঠার পূর্বে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কোম্পানির অফিসারদের ভারততত্ত্বচর্চায় উৎসাহ প্রদান করতেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভারততত্ত্বের চর্চা করেছেন যেমন, চার্লস উইলকিত্স, জন করনাক, ন্যাথলিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড, জন শাের, ফ্রান্সিস –গ্ল্যাডউইন, জোনাথন ডানকান, উইলিয়াম চেম্বারস প্রমুখ। কিন্তু এইসব বিদ্বান ব্যক্তিগণের গবেষণায় কোনাে সাম্য ছিল না এবং অনেক সময় একে অপরের রচনা অবহিতও ছিলেন না। সর্বোপরি কলকাতায় কোনােরূপ সাংস্কৃতিক বাতাবরণ ছিল না। শহর কলকাতা বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে থাকলে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায় প্রশাসন কেন্দ্র স্থাপন করেন। জোনস এশিয়াটিক সােসাইটি প্রতিষ্ঠা করলে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইউরােপীয় সংস্কৃতিবান মানুষের সম্মিলনের মাধ্যমে বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী রূপে কলকাতার প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। উইলিয়াম জোনসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুপ্রিমকোর্টের গ্রান্ড জুরি রুমে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি ৩০ জন বিশিষ্ট ইউরােপীয় একটি সভায় মিলিত হন। এক সংবাদে বলা হয় : ‘Thirty gentleman attended and they repesented the elite of the European Community in Calcutta at the time.’ সভায় জোন্স তাঁর ভাষণে বলেন, ‘Whether you will enrol as members any number of learned Natives you will hereafter decide.’ এই সভাতেই এশিয়াটিক সােসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যে ত্রিশজন এই সভায় উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন—স্যার উইলিয়াম জোনস, স্যার রবার্ট চেম্বারস, মিস্টার জন হাইড, জেনারেল জন করনাক, হেনরি ওয়াটসন, ডেভিড অ্যান্ডারসন, হেনরি ভ্যানসিটার্ট, চার্লস ক্র্যাফটস, উইলিয়াম চেম্বারস, রিচার্ড জনসন, জন শাের, ফ্রান্সিস –অ্যাডউইন, চার্লস চ্যাপম্যান, ন্যাথনিয়েল মিডলটন, মেজর ডেভি, চার্লস উইলকিত্স, জোনাথন ডানকান, জন ব্রিস্টো, টমাস গ্রাহাম, ফ্রান্সিস ফোক, টমাস লাে, ক্যাপ্টেন জোনাথন স্কট, ফ্রান্সিস বেলফোর, ডেভিড প্যাটারসন, র্যালফ ব্রুম, বারিশ ক্রিস্প, লেফটেনান্ট জেমস অ্যান্ডারসন, ক্রবেন বরাে, চার্লস হ্যামিলটন এবং জর্জ বালো।
উইলিয়াম জোনসের অন্তত দুটি সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটিতে তিনি বলেন, আজকের হিন্দুদের যতই অধঃপতিত বলে প্রতীয়মান হােক না কেন সুদূর অতীতে সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে তারা উন্নত ছিল,
“…how degenerate and abased so ever the Hindus may now appear, that in some early age they were splendid in arts and arms, happy in government, wise in legislation, and eminent in various knowledge.”১৯
জোনসের দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটিও গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃত ভাষা ইউরােপীয় গােষ্ঠীরই ভাষা, গ্রিক ও ল্যাটিনের চেয়েও নিখুঁত এবং অন্যান্য বহু ভাষার জননী। টমাস কোলব্রুক (১৭৭৫-১৮৩৭) জোনসের গবেষণাকে আরও বিস্তৃত করেন। বৈদিক যুগে একেরবাদ ও বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল এই তত্ত্ব কোলব্রুকেরই আবিষ্কার। জোনস ও কোলব্রুকের গবেষণায় প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার স্বর্ণযুগতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।২০ কোলব্রুকের উত্তরাধিকারী ছিলেন হােরেস হেম্যান উইলসন (১৭৮৬১৮৬০)। উইলসন, তারাচঁাদ চক্রবর্তী (১৮০৬-১৮৫৭) ও রামকমল সেনের (১৭৮৩-১৮৪৪) সহযােগিতায় সংস্কৃত পুরাণ সাহিত্যে উল্লেখযােগ্য গবেষণা করেন। সমসাময়িককালে এশিয়াটিক সােসাইটিতে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাও শুরু হয়। বিশেষ করে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের (১৮১৪-১৮৯৩) প্রচেষ্টায় প্রত্নতত্ত্ব আবিষ্কারের ফলে ভারতীয় সভ্যতার অনেক লুপ্ত সম্পদের পুনরুদ্ধার হয়। জেমস প্রিন্সেপ (১৭৯৯-১৮৪০) ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধারে সফল হলে ভারতীয় ইতিহাসের একটি নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। সম্ভবত ভারততত্ত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষক ম্যাক্স মূলার (১৮২৩-১৯০০)। এছাড়াও যে সমস্ত প্রাচ্যবিদ সংস্কৃত ভাষাচর্চার সাথে সাথে হিন্দু দর্শন, হিন্দু ঐতিহ্য ও হিন্দু ইতিহাস বিষয়ে চর্চা ও গবেষণা করেন তারা হলেন—স্যার উইলকিন্স (১৭৫০১৮৩৬), ফ্রাঞ্জ বােপ (১৭৯১-১৮৬৭), ইউজিন বুর্নফ(১৮০১-১৮৫২), যােহান বুলার (১৮১৭-১৮৯৮), স্যার মনিয়ার উইলিয়াম (১৮১৯-১৮৮৯), আলব্রেখট ভেবর (১৮২৫-১৯০১), এডওয়ার্ড কাউয়েল (১৮২৬-১৯০৩), উইলিয়াম হুইটনি (১৮২৭১৮৯৪), জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন (১৮৫১-১৯৪১), উইলিয়াম টমাস (১৮৬১-১৯৫৬), আর্থার ব্যারিডেল কিথ (১৮৭৯১৯৪৪) প্রমুখ। এইসব ব্রিটিশ ও ইউরােপীয় গবেষকদের আলােচনায় প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি বর্ণাঢ্য চিত্র পণ্ডিতদের নজরে আসে, যা ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষিত পাঠকদের মনে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম জাগিয়ে তােলে।
১৮০০ সালে লর্ড ওয়েলেসলি (১৭৬০-১৮৪২) ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই কলেজের অন্যতম বাহ্যিক উদ্দেশ্য ছিল এদেশে কোম্পানির ইংরেজ প্রশাসকদের ভারতীয় ভাষা ও সস্কৃতিতে জ্ঞান দেওয়া। কিন্তু ওয়েলেসলি নিজেই একটি নােটে এই কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে মগ্ন সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। এই নােটে তিনি লেখেন যে, এই কলেজের মাধ্যমে তরুণ ভারতীয়দের মনে ধর্ম এবং ব্রিটিশ রাজত্ব সম্বন্ধে সঠিক আদর্শ রােপণ করাই হবে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান রক্ষাকবচ। ওয়েলেসলি নির্দেশিত এই দায়িত্ব পালনে প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক টমাস কোলব্রুক এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য অনেক ইংরেজ পণ্ডিত অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৮০৫ সালে একটি প্রবন্ধে কোলব্রুক বলেন যে, বেদান্তই ভারতীয় দার্শনিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের নির্যাস, আর বাকি সবই বর্জনীয়। প্রাচীন ভারতের যুক্তিবাদী ও বস্তুবাদী দর্শনগুলির সঙ্গে যদিও তারা পরিচিত ছিলেন, তথাপি বেদান্তের পুনরুদ্ধার এবং প্রচারেই বিশেষভাবে যত্নবান হয়েছিলেন।
বেদান্তের পুনরুজ্জীবনের ফলে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের অস্তিত্ব বিরহও নিঃসন্দেহে বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পরম ব্রহ্মের তত্ত্ব, জীবাত্মা-পরমাত্মার ঐক্য, জীবন্মুত্তি, জন্মান্তরবাদ এবং হিন্দু ধর্মগ্রন্থের উপর এই দর্শনের নির্ভরতা ইসলামের মূল বিধাসগুলির বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। অতএব সরকারি পৃষ্ঠপােষকতায় বেদান্তের এই উত্থানকে তারা হিন্দুধর্মের জয় এবং নিজেদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আশঙ্কার কারণ হিসেবেই গণ্য করেছিল। আর ইংরেজ শাসনের প্রতি মুসলিম বিরূপতার ঐতিহাসিক প্রোপটে ব্রিটিশ সরকারও বেদান্তের মাধ্যমে এই হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে আরও চাঙ্গা করে হিন্দুদের মধ্য থেকেই একটি মুৎসুদ্দি শ্রেণি তৈরি করতে উৎসাহী ছিল। এই বেদান্তভিত্তিক ধর্মসংস্কার আন্দোলন থেকেই পরবর্তীকালে হিন্দু জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে আর এভাবে ভারতে হিন্দু-মুসলিম সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংঘাত এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সৃষ্টি হয়।
তরুণ বয়স থেকেই রামমােহন মূর্তিপূজার বিরােধী ছিলেন বিধায় তিনি প্রথমে বেদান্তের প্রতি আকৃষ্ট হননি, যদিও অল্প বয়স থেকেই তিনি পণ্ডিত নবকুমার বিদ্যালংকারের কাছে মূল সংস্কৃতে উপনিষদ সহ চারটি বেদ গ্রন্থ পাঠ করেছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি ইসলাম ধর্মের একেরবাদ ও সামাজিক সাম্যের দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। বেদান্ত প্রচারের প্রেরণা তিনি সম্ভবত পরিণত বয়সে জন ডিগবীর অধীনে দেওয়ানের চাকরি করার সময় তার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। এই ডিগবীই ১৮০১-১৮০৩ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্র ছিলেন। আগেই বলা হয়েছে, এই কলেজ সে সময়ে কোলব্রুকের নেতৃত্বে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে বেদান্তের পুনরুজ্জীবন ও প্রচারের প্রধান কেন্দ্র ছিল। সে সময়ই রামমােহনের সঙ্গে ডিগবীর পরিচয় হয়েছিল। ১৮০৫-১৮০৯ সালে তিনি ডিগবীর অধীনে রামগড়, যশােহর ও ভাগলপুরে চাকরি করবার সময় তার সঙ্গে রামমােহনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। ১৮০৯-১৮১৫ সালে রংপুরে থাকাকালে সে সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। এ সময়েই রামমােহন উপনিষদ অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করতে আরম্ভ করেন। আর ডিগবী ইংল্যান্ডে গিয়ে তাঁর দুটি বেদান্ত গ্রন্থ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এর একটি ছিল রামমােহন কর্তৃক ‘কেনােপষদের’ ইংরেজি অনুবাদ, যার মুখবন্ধ লিখেছিলেন স্বয়ং ডিগবী। দ্বিতীয়টি ছিল রামমােহনের লেখা ইংরেজি গ্রন্থ ‘অ্যাব্রিজমেন্ট অফ দ্য বেদান্ত’। আর এ সময়েই পরমব্রহ্মের ধ্যান করবার উদ্দেশ্যে রামমােহন কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে ‘আত্মীয়সভা’ (১৮১৫) প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিগণ হলেন—দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুত্র গােপীমােহন ঠাকুর (১৭৬০-১৮১৯), তার পুত্র প্রসন্নকুমার ঠাকুর (১৮০১-১৮৮৬), তেলিনীপাড়ার জমিদার অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, টাকীর জমিদার কালীনাথ রায়, রাজনারায়ণ বসুর পিতা নন্দকিশাের বসু, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা ও রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৭), রাজেন্দ্রলাল মিত্রের পিতামহ বৃন্দাবন মিত্র, ভূকৈলাসের (খিদিরপুর) রাজা কালীশঙ্কর ঘােষাল, জাস্টিস অনুকূলচন্দ্রের পিতামহ বৈদ্যনাথ মুখােপাধ্যায়, আন্দুল রাজবংশের রাজা কাশীনাথ প্রমুখ আরও অনেকে।
১৮২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর লর্ড আমহার্স্টকে (১৭৭৩-১৮৫৭) লেখা দীর্ঘ পত্রে রামমােহন সংস্কৃত, বেদান্ত ও ন্যায় শিক্ষার কুফল, আর ইউরােপীয় গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, রসায়ন, শারীরবিজ্ঞান এবং অন্যান্য শাখার বিজ্ঞান শিক্ষার সুফল বিশ্লেষণ করে এদেশে ইউরােপীয় শিক্ষক আমদানি করে এসব বিষয় পড়াবার ব্যবস্থা করতে আবেদন জানিয়েছিলেন। এতে অবশ্য ব্রিটিশ শাসকদের বিশেষ আপত্তির কারণ ছিল না, কেননা রামমােহন ইউরােপের ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা অর্থনীতি পড়াতে বলেননি, যার মধ্য থেকে নতুন রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠতে পারত। সরকার বাহাদুরকে শিক্ষাবিস্তারের জন্য আরও টাকা খরচ করার অনুরােধও করলেন না, তা তিনি দাবিও করলেন না। তিনি বললেন, যে টাকা শিক্ষার জন্য খরচ করার কথা, তা কেবল ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য খরচ করা হােক। এ চিঠির উত্তরে লর্ড আমহাস্টের তরফ থেকে রামমােহনের জ্ঞান-দান সম্পর্কে মন্তব্য করা হল,
“(The letter) is obviously written under an imperfect and erroneous conception of the plan of education and course of study…that the defects and demerits of Sanskrit literature, and philosophy, are therein represented in an exaggerated light, and that the arguments in favour of encouraging native learming, as well as the positive obligation to promote its revival and improvement, imposed on the Government by the terms of the Act of Parliament …have been wholly overlooked by the writer.”
“General Committee of Public Instruction’-এর সভাপতি জে এইচ হারিংটন ওই চিঠি সম্পর্কে মন্তব্য করলেন,
“The application to Government against the cultivation of Hindu literature, and in favour of the substitution of Education tuition, is made professedly on the part, and in the name of the natives of India. But it bears the signature of one individual alone, whose opinions are well-known to be hostile to those entertained by almost all his countrymen.”২১
দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ইউরােপীয় বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রচারের জন্য রামমােহন কী করেছিলেন? এ প্ররে উত্তরে বলা যায়, কলকাতায় কিছু আংলােইন্ডিয়ান ভদ্রলােকদের নিয়ে তিনি ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘Commercial and Patriotic Association’ নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এ সভার কর্মকর্তাদের মধ্যে বাঙালি হিসেবে একমাত্র রামমােহনই ছিলেন অন্যান্য সভ্যরা ছিলেন অ্যাংলােইন্ডিয়ান এবং তৎকালীন শেয়ার বাজারের ব্যবসায়ী। যােগানন্দ দাসের মতে, রামমােহন ‘১৮২৮ সালের বহু পূর্ব হইতেই স্টক এক্সচেঞ্জের সহিত যুক্ত ছিলেন’।২২ সে যাই হােক, ‘Commercial and Partiotic Association’ -এর একটি উদ্দেশ্য ছিল ‘to promote the work of sound and wholesome education among the native population…’ কিন্তু এই উদ্দেশ্য আদৌ সফল হয়েছিল কিনা তা জানা যায় না। লক্ষণীয় বিদ্যাসাগরও পরে বেদান্ত দর্শনকে ‘false system’ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি একা, নিজের চেষ্টায় গ্রামে গ্রামে যেভাবে স্কুল পাঠশালা খুলেছিলেন, নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য এবং জনশিক্ষার প্রসারের জন্য অক্লান্তভাবে যে পরিশ্রম করেছিলেন, অন্যান্য বড়মানুষ বাঙালিদের মধ্যে তার নজির খোঁজ করা পণ্ডশ্রম। রামমােহন, রাধাকান্ত, দ্বারকানাথ, নব্যবঙ্গ—এঁরা কৃষকদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের জন্য কী করেছিলেন? এঁদের শিক্ষামূলক চিন্তাধারায় কৃষকদের স্থান ছিল, এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু তিন বছর পরেই (১৮২৬) রামমােহন আবার মূলত বেদান্ত শিক্ষাও প্রচারের উদ্দেশ্যে নিজেই ‘বেদান্ত’ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই আপাত দ্বৈতভাবের ব্যাখ্যা যাই হােক, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই যে, রামমােহন এবং ব্রাহ্ম সমাজ প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে বেদান্তকে বেছে নিয়েই এদেশে ধর্মসংস্কার আন্দোলনে ব্রতী হয়েছিলেন। আর প্রকৃত নবজাগরণের পরিপন্থী এই উদ্যোগ রামমােহনের আগেই ব্রিটিশ শাসকেরা এদেশে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্ট্র্যাটেজির অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
দ্বারকানাথ ছাড়াও আর অনেক ঐধর্যশালী ব্যক্তি তখন ছিলেন। তাদের ধারণাতীত ঐধর্যের তিল পরিমাণও লােকশিক্ষার জন্য ব্যয় করা হয়নি যদি তা হত, তবে তার প্রচারে আকাশ কেঁপে উঠত। এ বিষয়ে সমকালীন একমাত্র জমিদারের বিদ্যোৎসাহিতার অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের বিধাসযােগ্য বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি হলেন উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখােপাধ্যায়।২৩ তিনি তার জমিদারির মধ্যে স্কুল-পাঠশালা নিজের খরচেই চালিয়েছিলেন। কিন্তু দেশের মানুষের দুঃখে যাদের হৃদয় জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে, যে নব্যবঙ্গের গুণাগুণ এখনও গীত হয়ে থাকে, গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য কিছু করার মতাে মানসিকতাও তাদের ছিল না। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন, পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের আন্দোলন, ব্রাহ্ম ধর্মান্দোলন, এসব আন্দোলন সমকালীন অবস্থার বিচারে প্রগতিশীল ছিল না—একথা কেউ বলবে না। কিন্তু এসব আন্দোলনের পেছনে যে উদ্দেশ্য ও মনােবৃত্তি সক্রিয় ছিল, তা আসলে ছিল নিতান্তই নাগরিক। এসব আন্দোলনের অব্যক্ত উদ্দেশ্য ছিল মধ্যবিত্ত এবং জমিদার-তালুকদারদের মানসিক উন্নতিবিধান। দেশের অগণিত গরিব এসব আন্দোলন সম্পর্কে কোনাে উৎসাহি বােধ করেনি, দেখায়নি।
[৪]
তখন বাংলার অর্ধেক অধিবাসী ছিল মুসলমান। হিন্দুদের মধ্যেও নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের সংখ্যা ছিল বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলমান সমাজ বা নিম্নশ্রেণির হিন্দু সমাজ ‘পরজীবী’ গােষ্ঠীর বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাভাবনায়, কাজে-কর্মে কোনও স্থান পায়নি। জীবিকার দিক থেকে ধরলে, তৎকালীন বাংলার শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই হয় কৃষক, না হয় কৃষি-নির্ভর খেতমজুর। সেই কৃষক ও খেতমজুরদের মঙ্গল চিন্তা এই বুদ্ধিজীবীদের মাথায় আসেনি। বরং তারা অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের ন্যায়সংগত বিদ্রোহের বিরােধিতা করেছেন।
রেনেসাঁ-বুদ্ধিজীবীদের মুসলিম বিরােধিতার প্রসঙ্গটি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সেদিনকালের কঠিন পদ-সঞ্চালনে মুসলমান সম্প্রদায় ইতিহাসের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। এই নিক্ষেপণ কর্মে ইংরেজ সেদিনের শিতি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির অকুণ্ঠ সহযােগিতা লাভ করেছিলেন। শিল্পে-সাহিত্যে, সভা-সমিতিতে এই সম্প্রদায় এত সরবে নিজেদের অস্তিত্ব ঘােষণা করেছিলেন যে, তার সামনে মুসলমান সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। এই অস্তিত্বের সংগ্রামের সঙ্গে সেদিনের জাগরণকে একীভূত করা অযৌক্তিক। কারণ সেদিনের আন্দোলনটি ছিল মূলত শ্রেণিভিত্তিক। ফলে একটা বিশেষ শ্রেণিই সেই আন্দোলনের সুযােগ-সুবিধে লাভ করেছেন। তাতে মুসলমান যা, হিন্দুও তা। যেখানে বৃহত্তর হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গেই তাদের যােগ ছিল না, সেখানে মুসলমানের কথাই আসে না। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তারা একটা বিশেষ শ্রেণিকেই অস্বীকার করেছেন, করেছেন অবহেলা। সেদিন এই অবহেলিত শ্রেণির ভেতর কোনও প্রকার বিবাদ-বিসংবাদ ছিল বলে ইতিহাস বলে না।
তবে একথা সত্য যে, সেদিন যাদের ভেতর এই জাগরণ সূচিত হয়েছিল, তাঁদের ভেতর কোনও মুসলমান ছিলেন না।
এর জন্যে কোনও বিশেষ ব্যক্তিকে দায়ী না করে সেদিনের সমাজ ও রাষ্ট্র-কাঠামােকেই দায়ী করা উচিত। কারণ যে ইংরেজি শিক্ষাকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল মুসলমান সম্প্রদায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অভিমানে সে শিক্ষা গ্রহণ করেননি। ফলে জাগরণে অংশগ্রহণের সুযােগও তারা পাননি। একথা জোর করে বলা যায় যে, সেদিন যদি কোনও মুসলমান পাশ্চাত্য শিক্ষায় সুসজ্জিত হবার সুযােগ পেতেন, তাহলে তারা একাত্মতা ঘােষণা করতেন উল্লিখিত ইংরেজি শিথিত হিন্দু শ্রেণির সঙ্গে, শহর ও গ্রামের অশিক্ষিত মুসলিম শ্রমজীবী বা কৃষিজীবী শ্রেণির সঙ্গে নয়। পরবর্তীকালে সর্বভারতীয় পর্যায়ে জল নানাদিকে গড়িয়েছে বলে হিন্দু মধ্যবিত্তশ্রেণি সম্পর্কে মুসলমান মধ্যবিত্তশ্রেণির মনােভাবে পরিবর্তন এসেছিল বটে, কিন্তু একটি ক্ষেত্রে এই শ্রেণির মুসলমানদের মনােভাব ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে অভিন্ন। অর্থাৎ এই মুসলমান উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণিও বিত্তহীন মুসলমান শ্রেণির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখেনি। এমনকী নিজেদের উর্দুভাষী বলে দাবি করে ভাষা নামক অভিন্ন সূত্রটিও তারা ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর যে সময় এই জাগরণ সূচিত হয়েছিল, সে-সময় যদি মুসলমানেরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতেন তাহলে তারাও শ্রেণিশত্রু শােষিতের বিরুদ্ধে শ্রেণিমিত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতেন তা এক প্রকার বলা যায়।
ইউরােপের অনুকরণে বাংলার এই সংস্কার আন্দোলনের নাম নবজাগরণ রাখা হলেও ইউরােপের রেনেসাঁ ছিল সামন্ত প্রথার বিরুদ্ধে শিল্প বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত বৈপ্লবিক আন্দোলন—সামন্ত-কাঠামাের পরিবর্তে ধনতান্ত্রিক কাঠামাে প্রবর্তন। এই বৈপ্লবিক সংগ্রাম শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি—গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ ইউরােপীয় রেনেসাঁ সেখানকার গ্রামীণ অর্থনীতিকে বেশ ভালভাবেই প্রভাবিত করেছিল ফলে সে দেশে সামন্ততান্ত্রিক শােষণ ব্যবস্থার অবসান ঘটেছিল। “কিন্তু বাংলাদেশের রেনেসাঁ আন্দোলন সামন্ততান্ত্রিক শােষণ ব্যবস্থা উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়নি…এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সমাজ নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ইংরেজ শাসকদের কাছ থেকে নয়া ভূস্বামীগােষ্ঠীর জন্য কিছু রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করে ‘শাসকগােষ্ঠীর গৌণ অংশীদার হওয়া।’ তাই বাংলার রেনেসাঁ ছিল জমিদার-মধ্যশ্রেণির আত্মসংহতি ও আত্ম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এর সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কোনও সম্পর্ক ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক পরিকাঠামাে ভেঙে ফেলে ধনতান্ত্রিক পরিকাঠামাে গড়ে তােলার কোনও প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় সমাজসংস্কার আন্দোলন হলেও বাংলার গ্রামগুলি ঘুমিয়ে রইল, আচ্ছন্ন হয়ে রইল প্রাচীনযুগীয় চিন্তাভাবনায়, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারে। বজায় থাকল সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামাে, আধুনিক যুগে অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক যুগে তার উত্তরণ ঘটল না।”২৪
তবে ইউরােপের রেনেসাঁর সঙ্গে বাংলার রেনেসাঁর তুলনা আনাটা ঠিক নয়। কেননা রেনেসাঁর সময়ে ইউরােপ পরাধীন ছিল না, রাষ্ট্রশক্তির কোনও ক্ষমতা ছিল না যে এই নবজাগরণের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু আমাদের বাংলায় যখন রেনেসাঁর উন্মেষ দেখা গেল তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি এবং তাদের নিচুতলায় উচ্চবিত্ত ও মুৎসুদ্দিরা অবস্থান করছেন, যারা ‘পরশ্রমভােজী’, সাধারণ মানুষের কীভাবে উন্নতি সম্ভব সে নিয়ে এই ‘পরশ্রমভােজী’দের কোনও মাথা ব্যথা ছিল না। অনেকেই হয়তাে জানেন, দান্তের কবিতা গ্রামের সাধারণ মানুষ পড়তেন, যদিও মধুসূদনের একটি কবিতা গ্রামে একজন মুদী ভুল পাঠ করছিলেন এবং কবি নিজে তা শুধরে দেন, মনে রাখতে হবে সেটা কিন্তু সাধারণ চিত্র নয়, ব্যতিক্রম মাত্র। সেই সঙ্গে যেভাবে ইউরােপে রেনেসাঁর ঢেউ গােটা মহাদেশে আছড়ে পড়েছিল বাংলায় তার কাছাকাছিও সাড়া পড়েনি, সাড়া পড়া সম্ভব ছিল না। প্রথমত, আমাদের দেশে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার ফলে কৃষক সমাজে নবজাগরণের চেতনা পৌছয়নি। সমাজের উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের চেতনার ফারাক বিস্তর ছিল। কেননা সে সময়ে মধ্যবিত্ত সমাজ মাথা তুলেছে। ইউরােপে সমাজের উঁচুতলার মানুষের সঙ্গে নিচুতলার মানুষদের চেতনার এতটা পার্থক্য ছিল না। তবে এই দেশে নবজাগরণের ফলে ভাষা, সাহিত্য ও নাটকের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল, যাকে নবজাগরণের স্থায়ী দান হিসাবে চিহিত করা যায়।
[৫]
এটা অনস্বীকার্য যে, ভারতবর্ষে পাশ্চাত্যের আধুনিকতা ও জাতীয়তাবাদের সম্যক উপলব্ধির প্রথম পরিচয় পাওয়া যায় রামমােহন রায়ের চিন্তাভাবনার মধ্যে। ব্রিটিশ সহযােগী রামমােহন জানতেন যে, মুঘল-আলিবর্দি-মীরজাফরেরা অত্যাচারী ছিলেন এবং তুর্কি-মুঘল আমলে হিন্দুরা পরাধীন ছিল। মুঘল শাসনকে রামমােহন দেশীয় বা স্বজাতির শাসন বলে মনে করেননি। ব্রিটিশ শাসনে রামমােহন তাই পরাধীনতার শনি অনুভব করেননি, হয়েছিলেন আনন্দিত ও উল্লসিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ছিল নিছক লুণ্ঠন, বাংলার লুণ্ঠিত সম্পদের ফলেই ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সম্পন্ন হয়। নবজাগরণের অগ্রপথিক হিসেবে রাজা রামমােহন রায় শুধু ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানাননি, ইংরেজ বাণিয়াকে ‘পিতা’ ও ‘রক্ষাকর্তা’ রূপে বরণ করেছিলেন। রামমােহনের দৃষ্টিতে ব্রিটিশ তথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ছিল বিধাতার আশীর্বাদ, ইংরেজ ছিল ধর্মের রক্ষক। তার মতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহারের শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করার আগে অর্থাৎ ‘মুসলমান শাসন’-এর আমলে মুসলমানের অত্যাচারে ও নিপীড়নে হিন্দুর ধর্ম পদদলিত হয়েছে২৫ ও বিশেষত দৈহিক দুর্বলতার জন্য বাঙালির রক্তপাত ঘটেছে বারবার, বাঙালির ধর্ম লাঞ্ছিত হয়েছে, তাদের সম্পত্তি লুণ্ঠিত হয়েছে, যদিও তারা বরাবরই রাজানুগত ছিল।
রামমােহনের চিন্তা-চেতনা ও বিভিন্ন লেখায় সংকীর্ণতার ছাপ ছিল সুস্পষ্ট। ১৮২২-এ রামমােহন নিজে একটি ইংরেজি স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলের ‘অ্যাংলাে হিন্দুস্কুল’ নামেই তাঁর মানসিকতার ইঙ্গিত মেলে। তা ছাড়া রামমােহন রেভাঃ আলেকজান্ডার ডাফকে দিয়ে ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলী ইনস্টিটিউশন’ নামে স্কুল তৈরি করিয়েছেন। ওইসব স্কুলে বিত্তবান জমিদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও উচ্চহিন্দু ছাড়া অনুন্নত হরিজনদের শিক্ষালাভের কোনও অবকাশই ছিল না, আর মুসলমান তাে সেখানে কল্পনার বাইরে। ১৮০৪ সালে মুর্শিদাবাদে থাকাকালে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ‘তুহাফাত-উল-মুওয়াহিদিন’-এ তিনি বলেন, “দেশের জনসমষ্টির তুলনায় ব্রাহ্ম গােষ্ঠীর লােক অপোকৃত কম। …এই গােষ্ঠী দাবি করেন যে, তারা নিজেরাই তাদের মতবাদগুলিকে ভগবানের কাছ থেকে পাওয়া পবিত্র নির্দেশগুলির উপর ভিত্তি করে রচনা করেছিলেন। কিন্তু তাদের যথেষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল। ইসলাম সম্প্রদায়ভুক্ত লােকদের ভীতি প্রদর্শন, হত্যা প্রভৃতি ঘটনা সত্ত্বেও ব্রাহ্মগণ তাদের ধর্মে দৃঢ় ছিলেন এবং তা থেকে বিচ্যুত হননি। যাঁরা বহু প্রতীক ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিধাসী ছিলেন, তাদের হত্যা ও তাদের প্রতি অত্যাচার প্রায়ই ঘটেছে কারণ ইসলাম বিধাসী ব্যক্তিগণ ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের প্রতি অপেক্ষাকৃত নিষ্ঠুর হয়ে থাকেন।”২৬ পাশাপাশি বসবাসকারী দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ ও বিভেদ সৃষ্টির কাজে রামমােহনের এই বক্তব্যের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। রামমােহন রায় তখন কলকাতা বাঙালি শিথিত মহলের নেতা। তার বক্তব্যের এই সুযােগে ইংরেজরা খুব সহজভাবে বিভেদের অস্ত্রটি প্রয়ােগ করতে সক্ষম হয়।
রামমােহন রায় ১৮০৪ সালে ব্রিটিশ সম্রাটের কাছে তার বিখ্যাত আবেদনে (Appeal to the king in council) বলেছিলেন কয়েক শতাব্দী ধরে ‘মুসলিম শাসনাধীনে ভারতের ‘মূল অধিবাসীদের’ পৌর ও ধর্মীয় অধিকার পদদলিত হয়েছে—এখন ‘ভগবৎকৃপায় সেই অত্যাচারীদের শাসনের জোয়াল উৎপাটিত হয়েছে, কাজেই প্রত্যাশা করা যায় ‘মূল অধিবাসীরা এখন অধিকার ফিরে পাবে।২৭ এখানে রামমােহন ‘ভারতের মূল অধিবাসী’ বলতে বুঝিয়েছেন হিন্দুদের এবং হিন্দু ও মুসলমানদের স্পষ্টতই তিনি দুটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসেবে তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রাথমিক ইঙ্গিত পাওয়া যায় বলে কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন।২৮
রামমােহন প্রাক্-ব্রিটিশ যুগে অসহায় ‘হিন্দুর’ ওপর মুসলমানের অত্যাচারের এই ইতিহাস প্রচার করেন ১৮২৩ সালে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির প্রথম প্রকাশ্য ঘােষণার মাত্র দু-বছর পর রামমােহনের এই ইতিহাসচর্চা তাৎপর্যপূর্ণ! ধূর্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ হিন্দু-মুসলমানে বিভেদ বিদ্বেষ সৃষ্টি করার জন্য রামমােহনের এই ইতিহাসচর্চাকে সাদরে বরণ করে নেয়। ঐতিহাসিক ইলিয়টের মতে, মধ্যযুগের ভারতে হিন্দুর ধর্ম, প্রাণ, সম্পদ, নারী এইসব ছিল নির্মম অত্যাচারের শিকার, হিন্দুর এই অসহনীয় অবস্থার অবসান ঘটে ইংরেজের রাজ্য প্রতিষ্ঠায়।২৯ তিনি অপকটে স্বীকার করেন যে, তার ইতিহাসচর্চার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ-শাসনের বহুবিধ সুফল সম্পর্কে প্রজাদের অবহিত করা আর বাবু’দের দেশপ্রেম সম্পর্কিত হইচই ঠান্ডা করা।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, রামমােহনের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের ইতিহাস চর্চার বিশেষ তফাত নেই। আজও হিন্দুদের একাংশ বিশ্বাস করেন, একমাত্র আকবর আর দারাশিকো ছাড়া প্রতিটি মুসলমান শাসকই ছিলেন এক একটি বিভীষিকা। মুসলমান কর্তৃক হিন্দুর নারীহরণ, মন্দির ধ্বংস, হত্যাকাণ্ড, বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ ইত্যাদি ছিল মধ্যযুগের। নিত্যদিনের ঘটনা। উনিশ শতকে ‘হিন্দু আইডেনটিটি’ তথা ‘রাজনৈতিক হিন্দুত্ব’ গড়ে ওঠার পেছনে এই চিন্তার এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। রামমােহনই এই চিন্তার জনক কিনা তা তর্ক সাপেক্ষ, আর তার ভাবনাও যে সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন ছিল তা কোনওভাবেই বলা যাবে না। কিন্তু এটা বাস্তব যে, তিনি আপন জীবনচর্চায় হিন্দু সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, মুসলমান সমাজের নয়।
পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকদের একাংশ রামমােহনের এই বক্তব্য দ্বারা চালিত হয়েছেন। এখানে ঐতিহাসিক সত্যটি হচ্ছে, মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমানে বিরােধ ছিল না।৩০ কিছু সংঘর্ষ হলেও তার কোনাে স্থায়ী রূপ ছিল না। মধ্যযুগে সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনে ভারতের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি বজায় ছিল। এর কারণ মুসলমান শাসকদের উদার ও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি। সমগ্র মধ্যযুগে সরকারি চাকুরিতে হিন্দুরা যােগ্যতা ও প্রতিভা অনুযায়ী স্থান লাভ করেছিল। হিন্দু পণ্ডিত, কবি, গুণীজনেরা প্রত্যক্ষ সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছিল। এক কথায়, হিন্দু জনগােষ্ঠীর একাংশের সাহায্য-সহযােগিতা ছাড়া মুসলমানদের সাম্রাজ্য বিস্তার বা প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। তাই মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক বিরােধের তত্ত্ব বা ধারণাটি অমূলক। মুসলমান শাসকরা হিন্দু নরপতি ও প্রজাদের ধর্মচেতনায় আঘাত দিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করার মতাে নির্বোধ ছিলেন না।৩১ মধ্যযুগীয় ভারতে মুসলমান শাসকরা রাজনীতিকে ধর্মের অধীনে করেননি, ধর্মকে রাজনীতির অধীনে রেখেছিলেন। তাই বলা যায় যে, উনিশ শতকের শুরুতে রামমােহনের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ভেতর দিয়ে ‘হিন্দু আইডেনটিটি’ ক্রমবিকশিত হতে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে রামমােহনের প্রবর্তিত শাস্ত্রভিত্তিক সংস্কার আন্দোলনটি গতিশীল মনে হলেও এরই মধ্যে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের উপাদানগুলাে নিহিত ছিল।
[৬]
রামমােহনের মৃত্যুর পর রামমােহনপন্থীরা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েন। প্রত্যেকের বৈষয়িক আসক্তিজনিত সামাজিক ভয়ও ছিল যথেষ্ট। সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আদর্শের সপক্ষে সংগ্রাম করার মতাে চরিত্রবলও সকলের ছিল না। অনেকে ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে প্রায় গোঁড়া হিন্দু হয়ে উঠেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের বদান্যতায় ব্রাহ্ম সমাজের অস্তিত্ব বজায় থাকে বটে, কিন্তু তার আদর্শ নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আর ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের আচরণের সঙ্গেও তাদের প্রচারিত আদর্শের কোনও সামঞ্জস্য রথিত হত না। অবশ্য সমকালীন সামাজিক জীবনে গোঁড়া হিন্দু, ইয়ং বেঙ্গল দল ও খ্রিস্টানদের আক্রমণের মূল লক্ষবস্তু ছিল এই ব্রাহ্ম সমাজ। এমতাবস্থায় উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে সমন্বয়পন্থী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববােধিনী সভা’ (১৮৩৯) ও এর মুখপত্র ‘তত্ত্ববােধিনী পত্রিকা’ (১৮৪৩-৮৩) প্রকাশের মাধ্যমে রামমােহন প্রচারিত আদর্শকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসেন।
দেবেন্দ্রনাথ নিজেই ব্রাহ্ম ধর্মকে হিন্দু ধর্মের সমুন্নত রূপ বলে মনে করতেন।৩২ বস্তুতপক্ষে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় ব্রাহ্ম সমাজ ও তাদের সংস্কার প্রয়াস প্রচলিত সনাতনী সমাজকে কঠোরভাবে আঘাত করতে পারেনি। এর ফলশ্রুতিতে সনাতন হিন্দু ধর্ম ও ব্রাহ্ম ধর্ম মিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে। প্রবীণদের অতি সাবধানী ধীরগতির সমাজ সংস্কার নীতি উনিশ শতকের সপ্তম-অষ্টম দশকের হিন্দু পুনরুত্থানবাদে কিছুটা সহায়তা করে। সনাতনপন্থীদের সামনে সংস্কারবাদীরা কোনাে বিকল্প আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদনে অথবা প্রকৃত হিন্দুধর্মই ব্রাহ্মধর্ম—এসব কথা যতই যুক্তিসংগত হােক এবং সময়ের প্রয়ােজনে তা প্রতিপন্ন করার যতই সার্থকতা থাকুক, মনে হয় আদি ব্রাহ্ম সমাজ এ বিষয়ে বেশ কিছুটা প্রচারাতিশয্য দেখিয়েছে এবং তার ফলে হিন্দু নবজাগরণবাদীরা আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযােগ পায়। এ সম্পর্কে ১৮২২ শকাব্দের ৬৮৬ সংখ্যা ‘তত্ত্ববােধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও হিন্দু সমাজ’ শিরােনামের প্রবন্ধটি বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। আবার ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রগতিশীল অংশটি প্রচণ্ডভাবে হিন্দুবিরােধী মনােভাবের পরিচয় দেয়। ব্রাহ্ম আন্দোলনের মধ্যযুগে লিখিত অক্ষয়কুমার দত্তের (১৮২০-১৮৮৬) ভারতবর্ষীয় ‘উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থটি উগ্র হিন্দুবিরােধী মনােভাবের পরিচয় প্রদান করে। অনেকটা হিন্দুবিরােধী কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়ারূপেই উনিশ শতকের শেষার্ধে হিন্দু নবজাগরণের আন্দোলন দেখা দেয়।
সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের প্রবাহ উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বিশেষ বেগবান ছিল। হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনটি প্রথম অবস্থায় ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে অগ্রসর হলেও পরবর্তীকালে তা সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎকে আক্রন্ত করে। প্রথমদিকে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ ইংরেজ শক্তির নিয়ে আসা নতুন ভাবধারার সঙ্গে বৈরী মনােভাব পােষণ করলেও সময়ের গতিতে এদের একাংশ শিথিত হয়ে পড়ে। এই শিক্ষিত হিন্দুদের একাংশ সনাতন হিন্দুধর্মের সমার্থক হিসেবে আবির্ভূত হয়, যারা প্রাচীন হিন্দু আদর্শ ও ভাবধারাকে মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে সদর্পে ঘােষণা করতে থাকেন। বলা যায় যে, রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ এই সময় পর্যন্ত ব্রাহ্ম সংস্কার আন্দোলনের আক্রমণে ছিল প্রায় অতিষ্ঠ, তারাই এখন ভারতীয় চেতনার উৎস খুঁজতে দৃষ্টি ফেরায় মুসলমান-পূর্ব যুগে—প্রাচীন ভারতে, গৌরবময় ভারতে। আর এই গৌরবের প্রেরণাই নব্য-হিন্দুবাদী আন্দোলনকে বেগবান করে তােলে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধকে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হন। ১২৬৫ সনের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, “তাদের অন্ন নেই, দাঁড়াবার স্থান নেই, যুদ্ধ শতবর্ষ পরে সামগ্রী নেই, তথাপি পাপাত্মাদের আশা যায় নাই।”৩৩ ঐতিহাসিকভাবে এটাও সত্য যে, ১৮৫৭ সালের ভারতীয় প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলমানরা ঝাপিয়ে পড়লেও হিন্দু জমিদার, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইংরেজ শক্তিকে সর্বোতােভাবে সহায়তা করেছে। আর এই সময় থেকেই হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনটি জোরদার হতে থাকে।
তবে একথা স্বীকার করতেই হবে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত ইউরােপীয় গবেষকদের গবেষণার ফলাফল শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি এবং প্রাচীন হিন্দু গৌরব আধুনিক গবেষণার নিরিখে মূল্যায়ন হওয়া শুরু হয়নি। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিশেষ করে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে যখন কানিংহামের ব্যক্তিগত পরিচালনায় প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান ও খননকার্য পরিচালিত হতে থাকে এবং ম্যাক্স মূলার, উইলসন, জেমস ফাগুসন (১৮০৮-১৮৮৬), রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২৩১৮৯১) ও অন্যান্যদের রচনাগুলাে জনপ্রিয়তা লাভ করে কেবলমাত্র তখনই শিক্ষিত ভারতীয়দের কাছে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস উজ্জ্বল ও গৌরবময়রূপে প্রতিভাত হতে থাকে এবং ইউরােপীয় সভ্যতার ভিত্তি-ভূমি গ্রিস ও রােমের মতাে প্রাচীন ভারতও ভারতীয়দের নিকট পরিগণিত হয়। বিশ্ব সভ্যতায় ভারত যে একদা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতীয়রা অত্যন্ত গৌরব বােধ করে। ভারতীয়দের মনে এক ধরনের আত্মপ্রত্যয় জাগে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি ভেসে আসতে থাকে। বাঙালি তথা ভারতীয়দের মনে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ঐতিহাসিক রাখালচন্দ্র নাথ লিখেছেন, “(উনিশ শতকের) সত্তরের দশকের শুরু থেকেই বাঙালি হিন্দুদের কাছে ভারতের একটি ঐতিহাসিক ছবি ফুটে উঠতে শুরু করে, কল্পনার সেই ছবি ছিল একটা মহান ভারতের, যে ভারত যুদ্ধ এবং শান্তিতে, শিল্পকলা ও বিজ্ঞানে, ধর্ম ও অনন্য নিরপেক্ষ সভ্যতায়, সংক্ষেপে, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের সবরকম সৃষ্টিশীলতায় শ্রেষ্ঠতম।”৩৪ তবে ভারততত্ত্বচর্চার প্রভাবের ফলে ভারতে যে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয় সে জাতীয়তাবাদ ছিল বহুলাংশেই হিন্দু জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ নয়।।
এই জাতীয় চেতনার সূচনা হয়েছিল মুসলমান বিদ্বেষ দিয়ে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি সমর্থন দিয়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে হিন্দুরা মােগল শাসকের তথাকথিত অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে স্বস্তির নিবাস ফেলে এবং কোম্পানির শাসনকে সাদরে বরণ করে নেয়। সুদীর্ঘকাল মুসলমান শাসনকে তারা হিন্দুধর্মের অবনতি ও পতনের যুগ বলেই গণ্য করে। মুসলমান শাসনে হিন্দুরা ধর্ম ও অন্যান্য কারণে লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হয়েছে, শােষিত হিন্দুদের সুদীর্ঘ প্রার্থনার ফলেই যেন ঈর্থর তাদের মুক্তি দিতে ভারতে ইংরেজদের প্রেরণ করেছে। প্রভাতকুমার গােস্বামী লিখেছেন,
“এই প্রচারের দ্বারা আমরা প্রভাবিত হইনি এমন নয়। আমাদের নাট্যকারেরা মােগল রাজপুতের সংগ্রাম কাহিনির মধ্য দিয়ে দেশাত্মবােধ জাগ্রত করেছেন নিশ্চয়ই কিন্তু সেই সঙ্গে দুঃখের সঙ্গে একথাও স্বীকার করতে হয় যে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারা সাম্প্রদায়িক মনােবৃত্তিরও পরিচয় দিয়েছেন।”৩৫
শুধু নাট্যকারেরাই নন, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতাে কবি এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতাে ঔপন্যাসিক যাঁরা এইসব লেখকদের উপাদান সাহিত্য সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করেছেন তারাও অনেকে সাম্প্রদায়িক মনােভাবের পরিচয় দিয়েছেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজত্বের প্রতি হিন্দুদের সমর্থন ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি সাধারণ ঘটনা, কেবল মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী নয়, সাধারণ মানুষও ইংরেজ রাজত্বের প্রতি একই মনােভাব পােষণ করত। অন্যদিকে মুসলমান যবন শাসনের প্রতি ছিল তাদের স্বাভাবিক বিদ্বেষ। মােগল শাসন তথা বাংলার নবাবি শাসনকে তারা অত্যাচারমূলক ছিল বলে গণ্য করত। এইভাবে হিন্দুদের সমর্থন নিয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ শাসন ছিল প্রত্যক্ষ বাস্তবতা, মােগল শাসন স্মৃতিমাত্র, কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে এই হিন্দু মানসিকতাই বহমান ছিল। সংক্ষেপে, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় জাতীয়তাবাদ সূচনার বৈশিষ্ট্য ছিল তিনটি—হিন্দু গৌরব, ইংরেজ শাসনের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি এবং পূর্বর্তন মুসলমান শাসনের প্রতি বিদ্বেষ-ঘৃণা।
হিন্দু অভিজাত শ্রেণির একটা অংশ ইংরেজদের সৃষ্ট মনােভাবের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, সমসাময়িক পত্রপত্রিকার পাতায় বার বার সে মনােভাব ব্যক্ত হয়েছে। অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৪০ সালে বিজ্ঞানদায়িনী সভায় বক্তৃতাদানকালে বলেন,
“যবন নৃপতিগণের অধীনে বাঙ্গালীরা যদ্রপ দুর্দশা সাগরে নিমগ্ন ছিল, তাহা স্মরণ করিতে হইলে কঠিন হৃদয় একেবারে বিদীর্ণ হইয়া যায়, তাহারা এদেশের রাজা ছিলেন বটে, কিন্তু প্রজারা প্রায় তাহাদিগের অধীনে সুখী ও সুস্থির চিত্ত থাকিতে পারিতেন না, বরং নিয়তই অনিয়ম ও অত্যাচারের সহিত সাক্ষাৎ করিতেন, যেহেতু প্রথমত যবন রাজাদিগের রাজকীয় বিষয়ে বর্তমান দেশাতিপতিদিগের ন্যায় সুচারু নিয়ম ও ঐক্য ছিল না—যবনাধিকারে এতদ্দেশীয় মনুষ্যগণ শান্তির সহিত প্রায় কখনই সাক্ষাৎ করেন নাই, একে রাজার দৌরাত্ম্য তাহাতে আবার দুর্দান্ত ও দুরাচারি লােকেরা অনায়াসে দিবসে নির্ভয়ে ডাকাইতি করিয়া সর্বস্ব হরণ করিত এবং এক এক বার বর্গির হামলায় লােকেরদিগের ধনপ্রাণ প্রভৃতি সমুদয় বিষয়ে দুদর্শা ঘটিত, তাহা স্মরণ মাত্রে আমারদিগের হৃৎকম্প উপস্থিত হয়, কোন সময় কি বিপদ ঘটিবে, এই দুর্ভাবনাতেই লােকেরা দিবারাত্র সশঙ্কিত থাকিত।”৩৬
এই অক্ষয়কুমারই পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্ববােধিনী পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ‘তত্ত্ববােধিনী’তেও ‘মুসলমানরূপী পিশাচ’ কর্তৃক বিবিধ অত্যাচারের বিবরণ এবং “ইংরেজদের প্রাদুর্ভাবে ৮০০ বছর পর্যন্ত যে দুঃখ এদেশে সঞ্চিত হইয়াছে তাহা ক্রমে দূরীভূত হইতেছে” বলে মন্তব্য করা হয়। ১৮৫০ সালে ‘সর্বশুভকরী’ নামে একটি পত্রিকাতেও মুসলমান শাসনে হিন্দুদের অবস্থা উল্লেখ করে মন্তব্য করা হয়, “এই দেশ যখন দুরন্ত যবনজাতি দ্বারা আত্রান্ত হইয়াছিল তৎকালে ঐ দুবৃর্ত্তজাতির দৌরাত্মে আমাদিগের সুখ সম্পত্তির একেবারেই লােকাপত্তি হইয়াছিল… দুশ্চরিত্র যবনজাতির ভয়ে স্ত্রীলােকদিগের প্রকাশ্য স্থানে গমনাগমন ও বিদ্যানুশীলন সম্পূর্ণ রূপে স্থগিত হইয়া গেল। সকলেই আপনাপন জাতি প্রাণ কুলশীল লইয়া শশব্যস্ত, স্ত্রী জাতিকে বিদ্যাদান করিবেক কি পুরুষদিগেরও শাস্ত্রালােচনা মাথায় উঠিল। তদবধি স্ত্রীদিগের অন্তঃপুর নিবাস ও বিদ্যাভ্যাস নিরাশ হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে জগদীর্থরের কৃপায় আমাদিগের আর সে দুরবস্থা নাই। শুভদিন পাইয়া সকল শুভকর্মেরও অনুষ্ঠান করিতেছি। আমাদের লুপ্তপ্রায় অন্যান্য সদ্ব্যবহার পুনরুদ্ধার করিতেছি।৩৭
১৮৭০ সালে ‘সােমপ্রকাশ’ পত্রিকাতেও বলা হয়, “মুসলমানদিগের রাজত্বকালে প্রজাদিগকে যে সমস্ত অত্যাচার ও পীড়া সহ্য করিতে হইয়াছিল, এক্ষণে ঐ সকল অত্যাচারের কথা শুনিলে হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বকাল স্মরণ হইলে শরীরের শােণিত শুষ্ক হইয়া যায়। সে সম্বন্ধে ব্রিটিশ রাজ্যকে ‘রাম রাজ্য’ বলিলে বােধ হয় অত্যুক্তি হয় না। অত্যাচারের কথা দূরে থাকুক এক্ষণে কেহ কাহাকে একটি উচ্চ কথা বলিতে সমর্থ হয় না। প্রজাগণ নিঃশঙ্কচিত্তে ও পরম সুখে ব্রিটিশ রাজ্যে বাস করিতেছেন। এই সকল বিষয় পর্যালােচনা করিয়া দেখিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ভারতবর্ষের সৌভাগ্য সূৰ্য্য ক্রমশ উদয় হইতেছে।”৩৮
এবারে হিন্দু গৌরব। প্রাচীন ভারত হিন্দু ভারত। প্রাচীন ভারতের গৌরব ও মাহাত্ম্য হিন্দু ধর্মেরই সত্যতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরব। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এই কারণেই হিন্দু জাতীয়তাবাদ। আর সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে বাংলাকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলােড়িত করেছে তা হল ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন। রামমােহন থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত সকল জাতীয় নেতাই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনে যত্নশীল ছিলেন। সুতরাং ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কখনাে সেকুলার নয়, সর্বাগ্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদ, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের স্থান পরে, বাংলার ইতিহাসে ধর্মের এই অবিচ্ছিন্ন ভূমিকার জন্যই জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিন্দু জাতীয়তাবাদ। প্রাচীন যুগে হিন্দুধর্ম তার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে উপস্থিত ছিল, মধ্যযুগের মুসলমান শাসনের অত্যাচারে হিন্দুধর্মের অবনতি হয়, বর্তমান ইংরেজ সরকার ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করে না, তাই ব্রিটিশ শাসনে হিন্দুধর্মের পুনরুভ্যুত্থানের আকাঞ্জ য় হিন্দু নেতারা যেমন স্বপ্ন দেখতেন তেমনি পুনুরুদ্দীপিত হিন্দুধর্মের উত্থানে উদ্যোগী ছিলেন।
[৭]
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঝড়ের বেগে এই হিন্দু জাতীয়তার যে রাজনৈতিক উত্থান আমরা লক্ষ করি, তার ভিত্তিভূমি রচনা করে তাদের উনিশ শতকের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক উত্থান। এই সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক উত্থান শুরু হল ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ চালুর মধ্যে দিয়ে। এই বিভাগের প্রধান ছিলেন শ্রীরামপুরের পাদরি উইলিয়াম কেরী (১৭৬১-১৮৩৪)। আর এই বিভাগে পণ্ডিত হিসেবে নেওয়া হল মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার (১৭৬২-১৮১৯), রামনাথ বিদ্যাবাচস্পতি, শ্রীপতি মুখােপাধ্যায়, আনন্দ চন্দ্র, কাশীনাথ, পদ্মলােচন চুড়ামণি ও রামরাম বসুকে (১৭৫১-১৮১৩)। এই পণ্ডিতরা দুটি কাজ করলেন—
- ১. মুসলিম আমলের বাংলা গদ্যের ধারা বাদ দিয়ে তারা সংস্কৃত শব্দ ভারাক্রান্ত নতুন বাংলা গদ্যের উদ্ভব ঘটালেন।
- ২. বিভিন্ন গ্রন্থের মাধ্যমে হিন্দু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সামনে আনলেন।
রামরাম বসু লিখলেন ‘প্রতাপাদিত্য (১৮০১), মৃত্যুঞ্জয় লিখলেন ‘বত্রিশ সিংহাসন’ ও ‘রাজাবলী’ (১৮০৮), রাজীবলােচন লিখলেন ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্র। এসব গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে প্রতাপাদিত্য, রূপ সনাতন ও বীরবল প্রভৃতি যেসব চরিত্র সামনে এল সেগুলাে হিন্দু ইতিহাসের উপজীব্য চরিত্র। মৃত্যুঞ্জয়ের ‘রাজাবলী’ হল চন্দ্রবংশের ক্ষেত্রজ-সন্তান বিচিত্রবীর্য থেকে বাংলায় কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার একটা ধারাবাহিক ইতিহাস। এ ইতিহাসে মুসলিম শাসন আমলকে বিদ্বেষদুষ্ট ভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। এইভাবেই ভাষা ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে পণ্ডিতদের সাধনায় সংস্কৃত ও হিন্দুদের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠায় ইংরেজের পৃষ্ঠপােষকতায় সৃষ্টি হয়েছিল প্রশস্ত ক্ষেত্র।৩৯
উপরােক্ত পণ্ডিতগণ ছাড়াও ঈর্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯), রাজা রামমােহন রায়, অক্ষয়কুমার চন্দ্র, প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩), রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২-১৮৮৬) প্রমুখ লেখকের গ্রন্থরাজী হিন্দুধর্মের উত্থান ও হিন্দুদের চেতনা বিকাশে সাহায্য করে এবং নতুন ভাবে সংস্কৃতি চর্চার এক বুনিয়াদ গড়ে তােলে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা চালু এবং ছাপাখানা বিস্তার লাভের পর হিন্দুদের দ্বারা একের পর এক পত্রিকা প্রকাশ পেতে শুরু করে। এসব পত্রিকার মধ্যে রয়েছে দিগদর্শন (এপ্রিল ১৮১৮), সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পণ (১৮১৮), সাপ্তাহিক ‘বঙ্গল গেজেটি’ (১৮১৮), ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ (১৮২১), ‘সম্বাদ কৌমুদী’ (১৮২১), সাপ্তাহিক ‘শাস্ত্রপ্রকাশ’ (১৮৩০), ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১), ‘সংবাদ সুধাকর’ (১৮৩১) ইত্যাদি। এসব পত্রিকার সবগুলােই হিন্দুদের। এসব পত্রিকা হিন্দুধর্ম ও জাতিসত্তার বিকাশে অমূল্য ভূমিকা পালন করে। পত্রিকাগুলাে অব্যাহত ধারায় তৈরি করে চলে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মী। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে লেখকদের আমরা দেখি, তা এ পত্রিকাগুলাের হাতে গড়া। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর ভূমিকা সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, “এই পত্রিকাটি বাংলায় সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ঈর্বরচন্দ্রের প্রতিভা গদ্য, পদ্য ও ব্যঙ্গাত্মক লেখার মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত ধারায় মানুষের তষ্ণ মােচন করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র ও দীনবন্ধু মিত্রের মত বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য প্রতিভার বেশ কয়েকজন এ পত্রিকায় শিশু কলামে লিখার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য জীবন শুরু করেন। সাহিত্য প্রতিভার সন্ধানে এবং তরুণ লেখকদের উৎসাহ দানে ঈশ্বরগুপ্ত নিরলস ছিলেন। রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য’ (১৮০১), মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের ‘রাজাবলী’ (১৮০৮) ইত্যাদির মাধ্যমে হিন্দু-ঐতিহ্যের যে সন্ধান শুরু হয়, তা উনিশ শতকের শেষ পাদে এসে অসহনশীল ও বিনাশীরূপে আবির্ভূত হয়।
তথ্যসূত্রঃ
- ১. ১৭৫৬ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে সিরাজউদ্দৌলা (১৭৩৪-৫৭) বাংলার সিংহাসনে আরােহণ করলে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদের শাসকগােষ্ঠীর একটি অংশ এবং ইংরেজ উভয়ের কায়েমি স্বার্থের পথে নবাব ছিলেন অত্যন্ত বিপদস্বরূপ। সৈনাধ্যক্ষের পদ থেকে মীরজাফরের অপসারণ, রাজা মানিকচঁাদের কারাদণ্ড এবং সর্বোপরি আলিবর্দির একান্ত বিস্ত ও প্রভূত ক্ষমতাশালী হুকুম বেগের দেশ থেকে বিতাড়নের মধ্যে শাসক শ্রেণির চত্রীদল বিপদ সংকেত পেয়ে যায়। এসব সত্ত্বেও ইংরেজদের সক্রিয় সংযােগ ছাড়া পলাশি বিপ্লব সম্ভব হত না। সিরাজ নবাব হওয়ায় ইংরেজদের কায়েমি স্বার্থও বিঘ্নিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। পাছে নতুন নবাব তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার সমূলে বিনাশ করে বসে। ইংরেজরা সিংহাসনে বসানাের জন্য ঘসেটি বেগম, সওকৎ জঙ্গ, ইয়ার লুতফ, সবশেষে মীরজাফরকে খুঁজে পেয়েছিল, অথাৎ এক্ষেত্রে এঁরা কেউই প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারী নন। কিন্তু রাজবল্লভ, মানিকচঁাদ ও নন্দকুমার প্রথম থেকেই ইংরেজদের সহচর ছিল আর জগৎ শেঠ ভ্রাতৃবর্গ, উমিচাদ প্রমুখ প্রাসাদ-বিপ্লবে সিদ্ধহস্ত ছিল। প্রকৃতপক্ষে মুর্শিদাবাদ রাজদরবারে এঁদের আধিপত্য এতই প্রবল ছিল যে, তাদের না জানিয়ে বা তাদের অগােচরে রাজ্যের কোনােপ্রকার গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার উপায় ছিল না। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় তার ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’তে লিখেছেন, “এক জন ঐতিহাসিক বলিয়াছেন যে, হিন্দু মহাজনের অর্থ ও ইংরাজ সেনাপতির তরবারি বাঙ্গলার মুসলমান রাজত্বের বিপর্যয় ঘটাইয়াছে। বাস্তবিক জগৎশেঠ গণ অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার সমুদায় রাজনৈতিক ব্যাপারেরই মূলে ছিলেন।”
- ২. প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহণ হেতু যে সমস্ত বিদ্রোহীদের আত্মবলিদান দিতে হয়েছে তাদের তালিকা সুদীর্ঘ। ২ লক্ষেরও বেশি মানুষকে এই বিদ্রোহে শহিদ হতে হয়। প্রথম ২ বছরেই (১৮৫৭-৫৮) প্রাণ হারিয়েছিল লক্ষাধিক বিদ্রোহী। এদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম। ১৮৫৮-র ৪ মার্চ হতে ১৮৬৪-র মধ্যে প্রায় ৩ হাজার বিদ্রোহীকে আন্দামানে পাঠানাে হয় (কারও মতে, সংখ্যাটা ১০ হাজারের মতাে)। এদের বেশিরভাগই সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। (দেখুন-এল ট্রটার, ইন্ডিয়া আন্ডার কুইন ভিক্টোরিয়া, পার্ট-২, লন্ডন, ১৯৬৭, পৃ. ৮৯, বিধানাথ চক্রবর্তী ও অনিলচন্দ্র নাগ, আন্দামান ব্রিটিশ ভারতের বাস্তিল, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ১৭)।
- ৩. উইলিয়াম হান্টার, দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস, বাংলা সংস্করণ, খােশরােজ কিতাব মহল, ঢাকা, ১৯৭৫, পৃ. ১৩১।
- ৪. তৎকালে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ব্রিটিশ-মনােভাবও অনুরূপ ছিল। ১৮৫৮ থেকে সৈয়দ আহমদ ব্রিটিশরাজ ও মুসলমান সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের রূপরেখা সম্বন্ধে গভীরভাবে বিবেচনা করতে থাকেন। ওই বছরে সিপাহী বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধান করে তিনি একটি নথি প্রস্তুত করেন যার নাম দিয়েছিলেন ‘আসবাব-এ-বাগাওয়াত-এ-হিন্দ’ (১৮৫৯), ইংরেজি অনুবাদে অর্থ দাঁড়ায় ‘দ্য কজেস ফর ইন্ডিয়াজ রিভােল্ট’। এই পুস্তিকাতে সৈয়দ আহমদ-এর বক্তব্য ছিল যে, রাজশক্তির প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান প্রজার আনুগত্য অটুট আছে। ১৯০৭ সালে ভিখার-উল-মুলকও তাই একইভাবে ব্রিটিশের তােষামােদ করে বলেছেন, “আল্লাহ না করুন, ভারতে ব্রিটিশ শাসন যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে হিন্দুরা এই দেশটা শাসন করবে সবসময় বিপন্ন হবে আমাদের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মান। ব্রিটিশ শাসন বজায় রাখতে সাহায্য করাই এই বিপদ থেকে মুসলমানদের বাঁচানাের একমাত্র পথ।” (রামগােপাল, ইন্ডিয়ান মুসলিমস এ পলিটিক্যাল হিস্টরি ১৯৫৮-১৯৪৭, এশিয়া পাবলিশিং হাউস, বােম্বাই, ১৯৬৪, পৃ. ১০১)।
- ৫. দেখুন- বি বি মজুমদার, হিস্টরি অফ পলিটিক্যাল থট ফ্রম রামমােহন টু দয়ানন্দ (১৮২১-৮৪), কলকাতা ইউনিভার্সিটি, কলকাতা, ১৯৩৪, পৃ. ১৮৬-৮৭।
- ৬. সংবাদ প্রভাকর ২০-০৬-১৮৫৭। ১৮১৩ সালে স্যার জন ম্যালকথ ইংল্যান্ডে সিলেক্ট কমিটির সামনে এক বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে, ভারতে হিন্দুদের সহযােগিতাই ইংরেজ নিরাপত্তার প্রধান সহায়।
- ৭. সংবাদ প্রভাকর ২০-০৬-১৮৫৭।
- ৮. সুকুমারী ভট্টাচার্য, উত্তরাধিকার, ছাত্র সংগ্রাম প্রকাশনা, কলকাতা, ২০০০, পৃ. ৬৯-৭০।
- ৯. অমলেন্দু দে, বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ২। ১০. Mohit Moitra, A History of Indian Journalism, National Book Agency, Calcutta, 1969, P. 7.
- ১১. মনােতােষ চক্রবর্তী, হিন্দু কলেজ ও উনিশ শতকের বাংলার সমাজ, সুবর্ণরেখা, প্রথম প্রকাশ, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ. ১২২।
- ১২. S. D. Collet : The life and letters of Raja Rammohan Roy, Edited by D.K.Biswas and P. C. Ganguli,3rd edition, Sadharan Bramho Samaj, Calcutta, 1988, P. 212.
- ১৩. রমেশচন্দ্র মজুমদার এইচ সি রায়চৌধুরী কালীকিংকর দত্ত, অ্যান অ্যাডভান্সড হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, ম্যাকমিলন, নিউইয়র্ক, ১৯৬৭, পৃ. ৮৭৭।
- ১৪. R.C. Majumdar, On Rammohan Roy, The Asiatic Society, Calcutta,1972, P. 40.
- ১৫. দেখুন-দীপঙ্কর চক্রবর্তী, বাংলার রেনেসাঁস ও রামমােহন, অনীক, কলকাতা, ১৯৯০, পৃ. ৬১-৬২।
- ১৬. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, নিউ এজ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৭০, পৃ. ৮০।
- ১৭. কুমুদকুমার ভট্টাচার্য, রাজা রামমােহন বঙ্গদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি, বর্ণপরিচয়, কলকাতা, ১৩৯৯, পৃ. ৮২।
- ১৮. রবীন্দ্র গুপ্ত, ‘রামমােহন রায় কয়েকটি প্রসঙ্গ’, নন্দন, বৈশাখ ১৩৭৯।
- ১৯. শিবদাস চৌধুরী সম্পাদিত, প্রসিডিংস অফ দ্য এশিয়াটিক সােসাইটি, খণ্ড-১ (১৭৮৪-১৮০০), কলকাতা, ১৯৮০, পৃ. ৭৬।
- ২০. David Kopf, British Orientalism and the Bengal Renaissance, University of California Press, 1969, P. 41.
- ২১. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা সংস্কৃত কলেজের ইতিহাস, খণ্ড-১, কলকাতা, ১৯৭৬, পৃ. ৬৭-৭১।
- ২২. যােগানন্দ দাস, রামমােহন ও ব্রাহ্ম আন্দোলন, কলকাতা, ১৯৬৮, পৃ. ১২০, পদটীকা দেখুন।
- ২৩. রামমােহন ও ব্রাহ্ম আন্দোলন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২০।
- ২৪. কুমুদকুমার ভট্টাচার্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১।
- ২৫. অজিতকুমার ঘােষ সম্পাদিত, রামমােহন রচনাবলি, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৭৩, পৃ. ৭২৭।
- ২৬. রামমােহন রায়, তুহাফাত-উল-মুওয়াহিদিন, বাংলা অনুবাদ-রামের মিত্র, জিজ্ঞাসা, বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৯৪, কলকাতা, পৃ. ১-২৩।
- ২৭. অজিতকুমার ঘােষ সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০৮-৫০৯। দীপঙ্কর চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩।
- ২৯. মধ্যযুগে ভারতে মুসলিম শাসনের মূল্যায়নে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকরা ইতিহাস-লিখনের নীতিমালা ও মৌলিক সত্য অস্বীকার করে সম্পূর্ণভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের রচনায় তাই সাজানাে গল্প ও জালিয়াতি ব্যাপার পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত ছিল। স্যার উইলিয়াম রবার্টসন, চার্লস গ্রান্ট, জেমস মিল, টমাস মরিস, আলফ্রেড লায়াল, আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম, এইচ টি প্রিন্সেপ, ফাগুসন, হেনরি ইলিয়ট প্রমুখ ব্যক্তিরা বুদ্ধিজীবী মঞ্চ থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিরামহীন তৎপরতা চালিয়েছেন। তারা তাদের লেখায় প্রচার করেছেন যে, ভারতীয় হিন্দুরা ভয়াবহরূপে মুসলিমদের দ্বারা শােষিত, পদদলিত ও অত্যাচারিত হয়েছিল এবং বাস্তবিক পক্ষে ইংরেজরাই হিন্দুদের মুসলিমদের নিপীড়ন থেকে ‘মুক্ত’ করেছিল। হিন্দুরা যেহেতু ইংরেজ শাসনে শান্তিতে বসবাস করছে, ইংরেজ শাসনের প্রতি তাদের ‘ঋণী মনােভাব গ্রহণ করে তাই ইংরেজ শাসনকে পূর্ণ সমর্থন জানানাে উচিত।
- ৩০. Rajendra Prasad, India Divided, Penguin Random House India, New Delhi, reprint, 2017, P. 17.
- ৩১. সমগ্র মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলমানরা পরস্পরের জীবনধারাকে প্রভাবিত করেছিল। গ্রামাঞ্চলে তারা মােটামুটি শান্তিতে বাস করত এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সুখকর। সাধারণ মুসলমানরা হিন্দুদের সামাজিক অনুষ্ঠানগুলিতে যােগ দিত, এমনকী কোনাে ধনী হিন্দুর বিয়ের শােভাযাত্রাও তাদের উপস্থিতি ছাড়া সম্পূর্ণ হত না। বৈষ্ণব সাহিত্যে উল্লেখ আছে যে, মুসলমানরা বৈষ্ণবদের সংকীর্তনও উপভােগ করত। কাজেই হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ এবং ধর্মান্ধতার ঘটনা ছিল বিরল। দিলীপকুমার বিধাস, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তত্ত্ববােধিনী সভা, ইতিহাস, পঞ্চম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, কলকাতা, পৃ. ৪৮।
- ৩৩. সংবাদ প্রভাকর ৭ চৈত্র ১২৬৫।
- ৩৪. রাখালচন্দ্র নাথ, উনিশ শতক ভাব সংঘাত ও সমন্বয়, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ২২।
- ৩৫. প্রভাতকুমার গােস্বামী, দেশাত্মবােধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটক, সাহিত্যশ্রী, কলকাতা, ১৩৮৫, পৃ. ২৬।
- ৩৬. বিনয় ঘােষ সম্পাদিত, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১৮৪০-১৯০৫, খণ্ড-১, কলকাতা, ১৯৬২, পৃ. ১৬০-১৬১।
- ৩৭. বিনয় ঘােষ সম্পাদিত, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, খণ্ড-২, পৃ. ৩৯৩-৩৯৪।
- ৩৮. বিনয় ঘােষ সম্পাদিত, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, খণ্ড-৩, পৃ. ৫৪৫।
- ৩৯. রমেশচন্দ্র মজুমদার-এইচ সি রায়চৌধুরী-কালীকিংকর দত্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৭৭।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।