অমুসলিম নাগরিক তথা হিন্দুদের উপর ১৬৭৯ সালে ঔরঙ্গজেব কর্তৃক জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন করার ঘটনাটিকে মধ্যযুগের ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণ বলে মনে করা হয়। এ সম্পর্কে ঔরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭) বিরুদ্ধে আনীত হিন্দুবিদ্বেষের অভিযােগের সবটাই সঠিক নয়। একমাত্র ফিরােজ তুঘলকের (১৩৫১-১৩৮৮) রাজত্বকাল ছাড়া ভারতবর্ষে ঔরঙ্গজেবসহ সমগ্র মুসলমান শাসনকালে অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে নারী, শিশু বা ১৪ বছরের নিম্নের ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, সাধু-সন্ত, ধর্মর্যাজক, ব্রাহ্মণ, অন্ধ, পঙ্গু, ভিখারি, তীর্থযাত্রী, নিঃস্ব, অসহায়, দিন মজুর, ক্রীতদাস, পাগল, সম্বলহীন, সরকারি সকল কর্মচারী, কৃষকদের জিজিয়া হতে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।১ এমনকি অমুসলিম সৈনিকদেরও জিজিয়া কর হতে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ বলতে গেলে অমুসলিম জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ লােককে জিজিয়া দিতে হত। ধনী মুসলিমদের বাধ্যতামূলক জাকাতকর (বাৎসরিক উদ্বৃত্ত সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ) দিতে হত। এছাড়া খামস, ফিদিয়া, ওশর (উৎপন্ন ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ) ইত্যাদি করও কেবল মুসলিমদের বাধ্যতামূলকভাবেই দিতে হত। এই সমস্ত কর হিন্দুদের কাছ থেকে আদায় করা হত না। মুসলিমদের এতসব ধর্মীয় কর দিতে হবে অথচ হিন্দুদের কাছ থেকে কোনাে ধর্মীয় কর নেওয়া হবে না, তা হয় না। ইংরেজ, ফরাসি ও পর্তুগীজ বণিকদের ওপরও জিজিয়ার পরিবর্তে ১.৫ শতাংশের একটি অতিরিক্ত শুল্ক চাপানাে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে একথাও বলা জরুরি যে, জিজিয়া বিলুপ্তির জন্য ধনী হিন্দু ব্যবসায়ী-কারিগররা করমুক্ত ছিল; অন্যদিকে মুসলিম ব্যবসায়ী-কারিগরদেরকে সােনা, রূপা, জীবজন্তু ও ব্যবসায়ের পণ্য দ্রব্যের ওপর জাকাত দিতে হত। অমুসলিমরা শুধু খারাজ বা ভূমি-রাজস্ব দিত, যা মুসলিমদেরও দিতে হত। সুতরাং সংখ্যালঘু মুসলিমদের সংখ্যাগুরু অমুসলিমদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণ কর দিতে হত।২
স্মর্তব্য যে, ঔরঙ্গজেব কর্তৃক জিজিয়া পুনঃপ্রবর্তিত হওয়ার ঘটনাটির সঙ্গে ভারতে ধর্মীয় তথা ইসলামিক রাষ্ট্র স্থাপন ও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে বিরােধ জিইয়ে রাখার যে তত্ত্বটি প্রচারিত হয়ে থাকে তা মােটেই যুক্তিযুক্ত নয়। তাছাড়া যে জিজিয়াকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে মুঘলদের ‘হিন্দু বর্জন নীতি’র কথা বলা হয়ে থাকে, তার প্রচলিত সময় ছিল সংক্ষিপ্ত। অথচ জিজিয়াকেই বড় করে হিন্দু-বিদ্বেষের অঙ্গ হিসাবে দেখানাে হয়। শিবলি নােমানি রচিত ‘আল জিজিয়া’৩ গ্রন্থে ও সতীশচন্দ্রের ‘জিজিয়া এবং সপ্তদশ শতাব্দীর ভারত রাষ্ট্র’ প্রবন্ধেও এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলােচিত হয়েছে।
(১)
জিজিয়া পুনঃপ্রবর্তনের পদক্ষেপটির গুরুত্ব বুঝতে হলে মুঘল সাম্রাজ্যের দলীয় রাজনীতি ও অর্থনীতির বিকাশ, দরবারের ধর্মীয় প্রবণতাগুলি এবং বিশেষত রাষ্ট্রীয় চরিত্র সম্পর্কিত নানা বিতর্ক সম্বন্ধেও আমাদের সম্যক জ্ঞান রাখতে হবে, যা ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনের সময় থেকেই তার রূপ ও রঙ বদলের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্য যতদিন শক্তিশালী থাকে, ততদিন বিভিন্ন গােষ্ঠীর পরস্পরবাদী দাবি অগ্রাহ্য করা যায়; বিদ্রোহের আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু দুর্বলতা দেখা দিলে, পরস্পরবাদী শক্তিগুলি মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি খুঁজে পায়। এই দুর্বলতা ঔরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষের দিকে তীব্রভাবে দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে আর একটা বিষয় বিস্মৃত হলে চলবে না যে, আকবরকেও (১৫৫৬-১৬০৫) ১৫৬৪ সালে জিজিয়া প্রত্যাহার৫ করে ১৫৭৫ সালে আবার তা পুনর্বহাল করতে হয়েছিল অর্থনৈতিক সংকট মােকাবিলার জন্য। ১৫৮০-র বিদ্রোহ দেখিয়ে দেয়, আকবরের নীতি তুরানি ও পারসীয় অভিজাতদের খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি, এঁরাই বিদ্রোহে মূলত অংশ নিয়েছিল এবং আকবরের বাহ্যত ইসলামীয় ভাবমূর্তি গড়ে তােলার প্রয়াস অসফল হয়। এই অস্বস্তিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর কর্তৃত্ব আনতে আকবর ১৫৮০ খ্রীস্টাব্দে জিজিয়া দ্বিতীয়বার রদ করেন। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি ঔরঙ্গজেবের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযােজ্য। কারণ, ঔরঙ্গজেব ১৬৮৯ খ্রীস্টাব্দ থেকে জিজিয়া আদায়ে শিথিলতা প্রদর্শন করেন এবং তার মৃত্যুর পরই জিজিয়া পুনরায় তার উত্তরাধিকারীকে রহিত করতে হয়।
সমসাময়িক এক ঐতিহাসিক বলেছেন যে, ঔরঙ্গজেবের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলামীয় আদর্শ ও রীতিনীতির ব্যাপক প্রসার এবং অমুসলিমদের আচার-আচরণের বিলােপসাধন। এই দরবারী ঐতিহাসিক বলেছেন: “যেহেতু ধর্মপ্রাণ সম্রাটের ঐকান্তিক উদ্দেশ্য ছিল ইসলামি কানুনের প্রসার ও নাস্তিক আচরণের উচ্ছেদ, তাই তিনি দিওয়ানীর ঊধ্বর্তন কার্যাধিকারীদের আদেশ দিলেন যে, কোরআনের যতদিন তারা দীনভাব সহকারে জরিমানা (জিজিয়া) দেবে’ এই নির্দেশ মান্য করে, এবং ধর্মানুশাসনিক ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে রাজধানী ও সুবাগুলির কাফেবদের (জিম্মি) কাছ থেকে জিজিয়া আদায় করতে হবে।”৬ ঈশ্বরদাস নাগর ও আলি মুহম্মদ খানও মােটামুটিভাবে দরবারের পণ্ডিত বা উলেমাদের ভূমিকাকে বড় করে দেখেছেন। ঈশ্বরদাস বলেছেন: “ধর্মজ্ঞ বিদ্বজ্জন ও সনাতনপন্থীরা ঈশ্বরের প্রতিরূপ সম্রাটকে (সাচ্চা) বিশ্বাসের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার দৃষ্টিকোণ থেকে বােঝাল যে, ‘শরিয়া’ অনুসারে জিজিয়া বলবৎ করাটা অত্যাবশ্যক এবং অপরিহার্য।”৭ আলি মুহম্মদ খান বলেছেন: “যেহেতু সম্রাট যত্নবান ছিলেন ব্যয়নির্ধারণ এবং রাজস্ব ও প্রশাসনসহ সমুদয় রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে শরিয়া’র অনুগমনকে উৎসাহ দিতে, তাই এই শুভক্ষণে বিদ্বজ্জন, ধর্মজ্ঞ ও ঋষিতুল্য ব্যক্তিরা সম্রাটকে বিশ্বাসের প্রতি তার শ্রদ্ধার দৃষ্টিকোণ থেকে বােঝাল যে, (সাচ্চা) বিশ্বাসের বিরুদ্ধাচারীদের উপর জিজিয়া বলবৎ করাটা ‘শরিয়া’ অনুসারে অপরিহার্য, এবং তাঁকে বারংবার উপরােধ করল সাম্রাজ্যের সুবাগুলিতে ঐটি পুনর্বলবৎ করতে।”৮ অপর এক ঐতিহাসিক কাফি খান বলেছেন যে, নতুন করে এই কর প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের এক দরিদ্র জাতিতে পরিণত করা।৯ সুরাট-এ ইংরেজ কারখানার প্রেসিডেন্ট টমাস রােল ১৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দে লেখেন যে, কঠোর হাতে জিজিয়া আদায়ের উদ্দেশ্য ছিল, শুধুমাত্র ঔরঙ্গজেবের শূন্য কোষাগার পূর্ণ করাই নয়, দরিদ্র জনগণকে মুসলমান হতে বাধ্য করাও।১০ ইউরােপীয় পর্যটক মানুচিও একই বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন: “তিনি (ঔরঙ্গজেব) হিন্দুদের উপর মাথট (মাথাপিছু কর) ধার্য করেন যা প্রত্যেককেই দিতে হত, কম অথবা বেশি…। ঔরঙ্গজেব এটা করেছিলেন দুটি কারণে, প্রথমত, এসময়ে যুদ্ধাভিযানের খরচ যােগাতে গিয়ে রাজকোষ শূন্য হয়ে যাচ্ছিল এবং দ্বিতীয়ত, হিন্দুদের মুসলমান হতে বাধ্য করার জন্য।”১১ মানুচি এমনও বলেছেন, যেটা বিশ্বাস করা কঠিন যে টাকা দিতে না পেরে বহু হিন্দুই মুসলিম হয়ে গিয়েছিল।১২
জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তনের চেষ্টাকে ঔরঙ্গজেবের ধর্মান্ধ নীতির চরম দৃষ্টান্ত হিসাবে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই এই তথ্যগুলির উপর নির্ভর করেছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা যদুনাথ সরকারের কথা বলতে পারি। তিনি জিজিয়া পুনঃপ্রবর্তনের পেছনে হিন্দুদের ধ্বংসসাধনের বিষয়টিকে বড় করে দেখেছেন।১৩ আরও বলা হয়েছে যে, জিজিয়া পুনঃপ্রবর্তনের মূলে ছিল হিন্দুদের উপর আর্থিক চাপ প্রয়ােগ করে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা।১৪ কিন্তু সতীশচন্দ্র বলেছেন, এটা বােঝা যায় না, কি কারণে ঔরঙ্গজেব স্বয়ং ইসলামি বিধানে সুশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও সিংহাসনে আরােহনের ২২ বছর পর জিজিয়া চাল (১৬৭৯) করলেন।১৫ শরিয়াকে শিরােধার্য করে ধর্মান্ধতাবশত তিনি এই কাজ করলে সিংহাসনে বসেই (১৬৫৮) করতে পারতেন, বাইশ বছর অপেক্ষা করার কোনাে দরকার ছিল না। উল্লেখ্য, ১৫২৬ খ্রীস্টাব্দে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ১৭৩৯ খ্রীস্টাব্দে নাদির শাহের ভারত আক্রমণ পর্যন্ত ২১৩ বছরের মধ্যে মাত্র ৫৭ বছর জিজিয়া বলবৎ ছিল। এর কারণ হিসাবে সতীশচন্দ্র যথার্থই লিখেছেন যে, যে সমস্ত সামাজিক শক্তি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতা ও বােঝাপড়া এবং দুই সম্প্রদায়ের সহযােগিতার ভিত্তিতে মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে তােলার অনুকূলে ছিল সেগুলি মুঘল যুগে এতই শক্তিশালী হয় যে, তাদের সাময়িক রাজনৈতিক দুর্বিপাকের ফলে সহজে পথভ্রষ্ট করা সম্ভব ছিল না।১৬ তাছাড়া দেশের বৃহত্তর অংশে ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুসলমান শাসন বহাল থাকা সত্ত্বেও হিন্দুরা দৃঢ়ভাবে। তাদের ধর্ম বিশ্বাস আঁকড়ে রেখেছিল। জিজিয়া পুনর্বলবৎ করা হলেই যে ওই চিত্র পাল্টে যাবে—এমন আশাবাদী হওয়ার কারণ ছিল না ঔরঙ্গজেবের। যদিও চাপটা ধনীদের চেয়ে গরিবদের উপরই বেশি পড়েছিল, তা সত্ত্বেও এর ফলে তখন তেমন কোনাে ধর্মান্তরের নজির পাওয়া যায় না। তেমন যদি কিছু হত, সম্রাটের প্রশস্তিকাররা নিশ্চয়ই তা আনন্দের সঙ্গে নথিবদ্ধ করে রাখত ঔরঙ্গজেবের কর্মনীতির জয় হিসাবে।১৭ এছাড়া জিজিয়াকে যদি ইসলাম গ্রহণ না করার জরিমানা বলা হয়, তাহলে জাকাৎকে কি বলা হবে? জাকাৎ তাে শুধু সক্ষম মুসলমান পুরুষই নয়, বরং সক্ষম মুসলমান নারীর কাছ থেকেও আদায় করা হয়। ওটা কি তাহলে ইসলাম গ্রহণের জরিমানা?
আসলে ইসলাম গ্রহণ করলে জিজিয়া কর আর দিতে হত না ঠিকই, কিন্তু জাকাত দেওয়ার আওতাতে এসে পড়তে হত। মুসলিম হলে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থার যেমন হানি ঘটত না, তেমনি ধর্মান্তরিত ব্যক্তিটিরও আর্থিক সুবিধা হত না কিছুই। “তর্কের খাতিরে যদিই বা ধরে নেওয়া হয় যে, জিজিয়া করের উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণই ধর্মীয়, তাহলেও একথা মনে করার কোনাে কারণ নেই যে, হিন্দুরা তাদের ধর্ম সম্বন্ধে এমনই উদাসীন ছিলেন যে সামান্য একটা কর এড়াবার জন্যে ধর্মত্যাগ করতে পারতেন। তাছাড়া যদি মনে করতে হয় যে, হিন্দুরা কিছু টাকা বাঁচাবার জন্যেই ধর্মান্তর গ্রহণ করতেন, তাহলে আমরা কেনই বা ধরে নেব না যে রাষ্ট্রও শুধুমাত্র আর্থিক কারণেই এই কর বসিয়েছিলেন?”১৮ শাসক এটাকে আয়ের মাধ্যম হিসাবেই দেখেছেন অর্থাৎ তার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এর থেকে আয় করা।
পাশাপাশি এটাও বলা অসঙ্গত নয় যে, তখন ভারতে মুসলমানের তুলনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা চারগুণ কি ঔরঙ্গজেবের জিজিয়া করের নেতিবাচক প্রভাব বা অমুসলিমের প্রতি অত্যাচারের ফসল? ইসলামের খলিফারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করেছিলেন যে, ইসলামকে তরবারির জোরে প্রচার করা সম্ভব নয়। ফলে দেখা গেছে যেখানেই মুসলমানেরা বিজয়ী হয়ে প্রবেশ করেছেন সেখানেই নগরবাসীদের সাথে খুব নম্র ও ভদ্র ব্যবহার করেছেন এবং তাদের সুখ শান্তির দিকে নজর দিয়েছেন। সামান্য কিছু জিজিয়া করের বিনিময়ে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। দেখা গেছে যে, দেশে অমুসলিমগণ পূর্বের রাজাকে যে সমস্ত কর দিত তার তুলনায় জিজিয়া কর ছিল নগণ্য। তার ওপর যাঁদের উপর জিজিয়া আরােপ করা হয়েছিল, ক্ষেত্র বিশেষে তাদেরকেও এই কর হতে মুক্ত রাখার সুযােগ-সুবিধা ও আইন রয়েছে ইসলামি সংবিধানে। যদি অমুসলিম নাগরিকদেরকে হীন প্রতিপন্ন করা বা তাদেরকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা এই কর নীতির উদ্দেশ্য হত তাহলে কোনাে অমুসলিম নাগরিককেই জিজিয়ার আওতার বাইরে রাখার সাংবিধানিক সুযােগ থাকত না।
(২)
জিজিয়া থেকে অর্থ আদায়ের পরিমাণ খুব কম ছিল না। জিজিয়া থেকে সংগৃহীত অর্থ দাতব্য কাজের জন্য নির্দিষ্ট করে জিজিয়া নামে একটি পৃথক খাতে সংরক্ষিত হত। এমতবস্থায় প্রধান কোষাগারের ভার কিছুটা লাঘব করার উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আবার শুধুমাত্র বিশুদ্ধ আর্থিক উদ্দেশ্যেই জিজিয়া পুনর্বলবৎ হয়নি। পদক্ষেপটি সম্যক বুঝতে হলে রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল বিপুল সংখ্যক বৃত্তিধারীর চরিত্র, ধর্ম ইত্যাদি বুঝতে হবে। বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যটি বিচার করলে দেখা যায় যে, ঔরঙ্গজেব তার ত্রয়ােদশ শাসনবর্ষে আর্থিক পরিস্থিতি নতুন করে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বুঝলেন, বিগত বারাে বছরে ব্যয় হয়েছে আয়ের চেয়ে বেশি। ফলে অর্থনৈতিক রদবদল হল, এবং এমনকি সম্রাট, শাহজাদা ও বেগমদেরও ব্যয়সংকোচ করা হল। এই সঙ্গে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, দাক্ষিণাত্যে নিরন্তর যুদ্ধ বিশেষত ১৬৭৬-এর পর থেকে উত্তর-পূর্বে সীমানা নিয়ে হাঙ্গামা, আফগান উপজাতিগুলির সঙ্গে সবিরাম লড়াই এবং পরে শিশােদিয়া ও রাঠোরদের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা—এগুলির কোনােটি থেকেই রাজ্যসীমা বৃদ্ধি কিংবা অর্থাগম হচ্ছিল না, বরং রাজকোষে টান পড়েছিল। তার উপর ঔরঙ্গজেব অত্যাচার-নিপীড়নমূলক বহু সংখ্যক উপকর প্রত্যাহারের আদেশও দিয়েছিলেন, যেগুলি সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল নাগরিককে আবশ্যিকভাবে প্রদান করতে হত। ফলে এই তিন শাসককে জিজিয়া কার্যকরী করতে হয়নি। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যে, জিজিয়া কর আরােপ করে ঔরঙ্গজেব ৬৬টি (মতান্তরে ৮০টি) প্রচলিত উপকর১৯ সাম্রাজ্যের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি সত্বেও কেবল জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে জনস্বার্থে প্রত্যাহার করেছিলেন, যার বাৎসরিক পরিমাণ ছিল প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। কিন্তু জানা যায় যে, এই উপকরগুলি প্রত্যাহারের আদেশ সত্ত্বেও রাজস্ব দপ্তর থেকে জাগির-এর মূল্য নির্ধারণে ওই উপকরগুলি থেকে প্রাপ্তব্য আয়ও ধরে নেওয়া হত।২০ সম্ভবত এটাই আশা করা হত যে, জাগিরদাররা তাদের অনুমােদিত আয় থেকে ওই ছাড়টুকু দিয়ে দেবে। কিন্তু অল্প কয়েকজন আমিরই, যেমন রাজা যন্ত সিংহ এই ব্যবস্থায় সম্মত ছিলেন। অন্যান্যরা ভরতুকি দাবি করেছিলেন, এবং যেহেতু তা দেওয়ার মতাে অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ছিল না, তাই ওই জাগিরগুলিতে কর ছাড়ের আদেশটি নিষ্ফল হয়ে গিয়েছিল। কাজেই এরকম ধারণার কোনাে ভিত্তি নেই যে, যেহেতু ইসলাম অনুমােদিত নয় এমন উপকরগুলি ঔরঙ্গজেব উচ্ছেদ করেছেন, অতএব ইসলামি আইনে অনুমােদিত করগুলির অন্যতম জিজিয়া পুনঃপ্রবর্তন করে তিনি সঠিক কাজই করেছিলেন।২১
জিজিয়া তুলে নেওয়ার সপক্ষে আবুল ফজলের মূল যুক্তিগুলি রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত হলেও, অর্থনৈতিক দিকটিও উপেক্ষিত হয়নি। তিনি বলেছেন, জিজিয়া প্রাথমিকভাবে বলবৎ করা হয়েছিল হিন্দুদের বিরােধিতা ও শাসকদের অর্থ ‘লালসা’র কারণে। তবুও, ‘যুগপরিত্রাতার অপার শুভকামনা ও মহানুভবতার প্রভাবে বিভিন্ন ধর্মমতের মানুষ ‘একাত্মার মতাে, ভক্তি ও সেবার সংকল্প নিয়ে কোমর বেঁধে নামল রাজ্যের উন্নতিসাধনে নিজেদের উজাড় করে দিতে। এই কারণেই ঔরঙ্গজেবকে পার্থক্য করতে হয়েছিল উপরােক্ত জনগণের সঙ্গে পুরনাে সেই শ্রেণির মানুষদের, যাঁরা ভয়ংকর শত্রুতা পােষণ করত। আবুল ফজল আরও বলেছেন যে, প্রথম যুগের শাসকবর্গ ও তাদের সহকারীদের অর্থ লােলুপতার জন্যই জিজিয়া কর কার্যকরী করা হয়েছিল, কিন্তু এখন সম্পদের প্রাচুর্য থাকায় সম্রাটের জনগণের উপর প্রায় উৎপীড়ন করার প্রয়ােজন ছিল না। তাই তার সিদ্ধান্ত যে, জিজিয়া আদায়ের সুফল ছিল ‘অবাস্তব’, বরং এটি বলবৎ করায় প্রজাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছিল২২ এবং তার ফলে রাজনৈতিক লাভ তাে হয়ইনি, বরং ক্ষতি হয়েছিল।
ইসলামের সমতাবাদী ও মানবতাবাদীদের একাংশ মনে করতেন যে, সমস্ত সক্ষমদেহ মুসলমান—বিশেষত যাঁরা শিক্ষিত ও ইসলামে বিশ্বাসী, তাদের জীবনধারণের ব্যবস্থা করে দেওয়াটা রাষ্ট্রেরই কর্তব্য। বলবনের আমল থেকেই এঁদের অনুদান ও বিশেষ সুবিধাগুলি ছাঁটাই করা হচ্ছিল। কিন্তু সাধারণভাবে এঁদের জীবনধারণের ব্যবস্থা করার দায়িত্বটি, যা ছিল রাষ্ট্রের জনকল্যাণকর্মের অন্যতম অঙ্গ, তা কোনাে সরকারই অস্বীকার করতে পারেনি। আকবর ব্যাপারটিকে নতুন ভিত্তিতে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন গ্রামগুলির দাবি অগ্রাহ্য করে। কিন্তু কালক্রমে সমস্যাটি আবার গুরুতর হয়ে ওঠে এবং ঔরঙ্গজেবকে নতুনভাবে মােকাবিলা করতে হয়। আবার বৃত্তিধারীদের মধ্যে ধর্মজ্ঞদের প্রাধান্য বেশি ছিল। অনেক সম্রাট প্রশাসনিক কাজেও তাদের সাহায্য নিতেন। তাদের ঔদ্ধত্য অনেক ক্ষেত্রেই শাসকদের রুচিকর হত না। তারা এমন ঔদ্ধত্যও দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, কোনাে কোনাে ধর্মজ্ঞ জিজিয়া আদায়কারীদের দিয়ে হিন্দুদের উৎপীড়ন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন; কিন্তু সম্রাট তথা প্রশাসক তা গ্রহণ করেননি।
কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক বলেছেন, ঔরঙ্গজেব মনে করলেন, জিজিয়া পুনর্বলবৎ করার মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের নতুন পর্যায়টিকে চিহ্নিত করার চেয়ে অধিকতর ফলদায়ক আর কোনাে পদক্ষেপই হতে পারে না। দাক্ষিণাত্যে ঘনায়মান রাজনৈতিক সংকটের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এই আগ্রাসী মেজাজের পরিপ্রেক্ষিতেই রাজপুত যুদ্ধটিকেও বিচার করতে হবে। কিন্তু জিজিয়া পুনর্বলবৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাঠোর যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়া থেকে এটা বােঝা যায় না যে, রাজপুত ও অন্যান্য দেশীয় শাসকবর্গের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের আকবরী কর্মনীতিটি বর্জিত হয়েছিল কিনা। কিন্তু তা যে হয়নি, সেটা ঔরঙ্গজেব-এর বিভিন্ন ঘােষণার মধ্যেই আপাতদৃষ্ট। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, ১৬৭৯-র পরে অর্থাৎ জিজিয়া পুনর্বহালের পর থেকে আমির-ওমরাহদের বিভিন্ন স্তরে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যায়নি, বরং বেড়েছিল। আতাহার আলি ‘মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে ১৬৫৮-১৬৭৮ সালের মধ্যে ৫১ জন বড় অভিজাতদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ১০ জন, কিন্তু ১৬৭৯-১৭০৭ সালের মধ্যে ৭৯ জন বড় অভিজাতদের মধ্যে ২৬ জন ছিলেন হিন্দু অর্থাৎ প্রায় ৩০ শতাংশ।২৩ কাজেই এক্ষেত্রে জিজিয়াকে হিন্দু বিদ্বেষের অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরাটা ইতিহাসের সরলীকরণ ছাড়া কিছুই নয়।
(৩)
সতীশচন্দ্রের মতে, প্রকৃতপক্ষে দাক্ষিণাত্যের ঘনায়মান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধর্মোপজীবী শ্রেণির অর্থনৈতিক সংকটের জন্য জিজিয়া পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছিল। এমনকি মুঘলদের কুলাচার্য খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির (রহঃ) বংশধরগণ পর্যন্ত দারিদ্র্য ও অভাবে দিন কাটাচ্ছিলেন। জিজিয়ার আয় থেকে ধর্মোপজীবী শ্রেণির ব্যয় নির্বাহের জন্য জিজিয়ার একটা অংশ আলাদা করে রাখা হত।২৪ এই নতুন দপ্তরের জন্য যে কর্মচারী নিয়ােগ হল তা এই শ্রেণির মধ্য থেকে। স্বভাবতই এই শ্রেণিটিকে অনুগত রাখাও হয়ত ঔরঙ্গজেবের উদ্দেশ্য ছিল। এঁদের প্রভাবে মুসলমানদের সব গােষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রিত রাখা যাবে এটা হয়ত ঔরঙ্গজেব ভেবেছিলেন। কিন্তু ধর্মোপজীবী শ্রেণিটি পরিস্থিতির সুযােগে শােষণ ও নিপীড়ন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি জমানাের কাজে নেমে পড়ল। মেরথা থেকে সরকারি সংবাদদাতা এরকম একটা তথ্য দিয়েছেন যে, স্থানীয় কাজি জিজিয়া জোর করে হিন্দুদের কাছ থেকে আদায় করেছেন। মানুচি বলেছেন, জিজিয়া দপ্তরের কর্মচারীরা জিজিয়া আদায়ের অর্ধেক বা তিন-চতুর্থাংশ পর্যন্ত নিজেদের বিলাস ব্যসনের জন্য রেখে দিত। স্বভাবতই রাজনৈতিকভাবে হিন্দুদের একটি প্রভাবশালী অংশকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তােলা হচ্ছিল। জিজিয়া আদায়কারীরা কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে অত্যাচারের সীমাও ছাড়িয়ে যেত (রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীগণ অত্যন্ত নির্মমভাবে জাকাতও আদায় করতেন, তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন শায়েস্তা খানের সমসাময়িক লেখক শিহাবউদ্দিন তালিশ) এবং এর প্রতিবাদও হয়েছে, সে তথ্যও পাওয়া যায়।২৫ এর দ্বারা মনে হতে পারে ঔরঙ্গজেব বােধহয়। রক্ষণশীল রাষ্ট্রের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন। কিন্তু সকলের অগােচরে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। পারস্পরিক সহাবস্থান ও সহিষ্ণুতা ততদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। ঔরঙ্গজেব ও তার আমিরমণ্ডলী উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে হিন্দুদের বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। এদিক থেকে দেখলে জিজিয়ার পুনর্বহাল করাটা নিরর্থক হয়েছিল। আমিরমণ্ডলীর একটা বড় অংশ এর বিরােধিতা করেছিলেন। এমনকি এঁদের সাথে জাহানারাও প্রতিবাদ করেছিলেন। এখানে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট যে, শাসকশ্রেণির প্রধান গােষ্ঠী জিজিয়াকে রাজনৈতিকভাবে অনুপােযােগী ভাবতেন এবং রাজনীতিতে ধর্মোপজীবী সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ ও ক্ষমতা বৃদ্ধিকে অরুচিকর মনে করতেন।
জিজিয়া মকুব হত এই তথ্যও পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র তার গ্রন্থে২৬ বলেছেন, “আওরঙ্গজেবের আমলে পাঞ্জাবের একটি গ্রামে জিজিয়া কর ধার্য সংক্রান্ত দলিল থেকে দেখা যায় যে, ২৮০ জনের মধ্যে ৭৩ জনকে নানারকম কারণের জন্য জিজিয়া থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে।” ‘মিরাৎ-উল-আলম’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “এক ব্যক্তির যদি কোনাে সম্পত্তি না থাকে এবং শ্রম থেকে তার উপার্জন যদি নিজের ও পরিবারের প্রয়ােজন অপেক্ষা অধিকনা হয়, তাহলে তার ওপর জিজিয়া ধার্য হবে না।”২৭ ঔরঙ্গজেবের আমলে এটা বিধিবদ্ধ হয়েছিল। দিনমজুর ও যাঁদের সম্পত্তি নেই কিংবা বছরে ৪০ দেরহাম (দশ টাকা) না জমাতে পারে সে দরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের জিজিয়া দিতে হত না। চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও জমির মালিকগণকে ধনী শ্রেণি বলে গণ্য করা হত। ধনীদের ক্ষেত্রে, যাদের বছরে সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ১০,০০০ দেরহামের উর্ধ্বে, তাদের বাৎসরিক কর ছিল ৪৮ দেরহাম; মধ্যম শ্রেণির, যাদের সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ২০০-১০,০০০ দেরহামের মধ্যে, বাৎসরিক কর ছিল ২৪ দেরহাম এবং অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের, যাদের সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ২০০ দেরহাম, তাদের জন্য বাৎসরিক কর ছিল ১২ দেরহাম।২৮ এছাড়া ১৭০৪ খ্রীস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধজনিত কারণে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের জিজিয়া মুকুব করা হয়েছিল।২৯ ফসল উৎপাদন খারাপ হলেও জিজিয়া মুকুব করা হত।৩০ ১৬৮৮-৮৯ সালে হায়দ্রাবাদ সুবায় খরার জন্য এক বছরের জিজিয়া মকুব করা হয়েছিল।৩১ সরকারি সকল কর্মচারীও এই জিজিয়া কর হতে মুক্ত ছিল। তবে ‘ধনী’ হলে অন্ধ, পঙ্গু, পাগল এবং উন্নত ও সমৃদ্ধ মঠের সন্ন্যাসীদেরকে অবশ্য জিজিয়া দিতে হত।৩২ এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, অমুসলিমদের মধ্য হতে শুধু আর্থিক সংগতিসম্পন্নদেরকেই জিজিয়া কর দিতে হত। ফলে একটা ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল (শুধু জিজিয়া কেন, সমকালে জনগণ তাদের শাসকদের কোনাে কর বা খাজনা দিতে সাধারণভাবে স্বেচ্ছায় অনীহা প্রকাশ করত। ফলে জোর করে তা আদায় করতে হত), কিন্তু কোন স্তরে কতটা ক্ষোভ ছিল তার হিসাব করা খুব সহজ নয়। এই কারণেই মনে হয় জিজিয়া আদায়কারী হিসেবে এক সময়ে ব্রাহ্মণদেরও নিযুক্ত করা হয়েছিল। এমন তথ্য টি এম তিতাস তার গ্রন্থে৩৩ তুলে ধরেছেন।
(৪)
শেষ বিচারে সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে জিজিয়ার স্লোগান ছিল হিন্দু সেন্টিমেন্টকে সমাবেশিত করার এক জুতসই হাতিয়ার। তাই বুঝি জিজিয়া করের বিরুদ্ধে শিবাজী একপত্রে ঔরঙ্গজেবকে লিখতে পেরেছিলেন: “বাদশাহ আলমগীর, সালাম! আমি আপনার দৃঢ় এবং চিরহিতৈষী শিবাজী। ঈশ্বরের দয়া এবং বাদশাহর সূর্যকিরণ অপেক্ষাও উজ্জ্বলতর অনুগ্রহের জন্য ধন্যবাদ দিয়া নিবেদন করিতেছি যে, যদিও এই শুভাকাঙক্ষী দুর্ভাগ্যবশত আপনার মহিমামণ্ডিত সন্নিধি হইতে অনুমতি না লইয়াই আসিতে বাধ্য হয়, তথাপি আমি, যতদূর সম্ভব ও উচিত, ভৃত্যের কর্তব্য ও কৃতজ্ঞতার দাবি সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন করিতে সদাই প্রস্তুত আছি। এখন শুনিতেছি যে আমার সহিত যুদ্ধের ফলে আপনার ধন ও রাজকোষ শূন্য হইয়াছে, এবং এই কারণে আপনি হুকুম দিয়াছেন যে জিজিয়া নামক কর হিন্দুদের নিকট আদায় করা হইবে, এবং তাহা আপনার অভাব পূরণ করিতে লাগিবে।…আপনার রাজত্বকালে সৈন্যগণ অস্থির, বণিকেরা অত্যাচার-পীড়িত, মুসলমানেরা কাঁদিতেছে, হিন্দুরা জ্বলিতেছে, প্রায় সকল প্রজারই রাত্রে রুটি জোটে না এবং দিনে মনস্তাপে করাঘাত করায় গাল রক্তবর্ণ হয়।
এই দুর্দশার মধ্যে প্রজাদের উপর জিজিয়ার ভার চাপাইয়া দিতে কি করিয়া আপনার রাজ-হৃদয় আপনাকে প্রণােদিত করিয়াছে? অতি শীঘ্রই পশ্চিম হইতে পূর্বে এই অপযশ ছড়াইয়া পড়িবে যে হিন্দুস্থানের বাদশাহ ভিক্ষুকের থলিয়ার প্রতি লুব্ধ-দৃষ্টি ফেলিয়া ব্রাহ্মণপুরােহিত, জৈন যতি, যােগী, সন্ন্যাসী, বৈরাগী, দেউলিয়া, ভিখারী, সর্বহীন ও দুর্ভিক্ষপীড়িত লােকদের নিকট হইতে জিজিয়া কর লইতেছেন! ভিক্ষার ঝুলি লইয়া কাড়াকাড়িতে আপনার বিক্রম প্রকাশ পাইতেছে। আপনি তাইমুর-বংশের সুনাম ও মান ভূমিসাৎ করিয়াছেন।
বাদশাহ, সালাম! যদি আপনি খােদার কেতাব-এ (অর্থাৎ কোরআন) বিশ্বাস করেন, তবে দেখিবেন সেখানে লেখা আছে ঈশ্বর সর্বজনের প্রভু, শুধু মুসলমানের প্রভু নহেন। বস্তুত ইসলাম ও হিন্দুধর্ম দুইটি পার্থক্যব্যঞ্জক শব্দ মাত্র; যেন দুইটি ভিন্ন রং যাহা দিয়া স্বর্গবাসী চিত্রকর রং ফলাইয়া মানবজাতির (নানাবর্ণে রঙ্গীন) চিত্রপট পূর্ণ করিয়াছেন।
মসজিদে তাহাকে স্মরণ করিবার জন্যই আজান উচ্চারিত হয়। মন্দিরে তাহার অন্বেষণে হৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রকাশ করিবার জন্যই ঘন্টা বাজান হয়। অতএব, নিজের ধর্ম ও ক্রিয়াকাণ্ডের জন্য গোঁড়ামী করা ঈশ্বরের গ্রন্থের কথা বদল করিয়া দেওয়া ভিন্ন আর কিছুই নহে। চিত্রের উপর নূতন রেখা টানিলে আমরা দেখাই যে চিত্রকর ভুল আঁকিয়াছিল!
প্রকৃত ধর্ম অনুসারে জিজিয়া কোনমতেই নায্য নহে। রাজনীতির দিক হইতে দেখিলে, জিজিয়া শুধু সেই যুগের ন্যায্য হইতে পারে যে যুগে সুন্দরী স্ত্রীলােক স্বর্ণালঙ্কার পরিয়া নির্ভয়ে এক প্রদেশ হইতে অপর প্রদেশে নিরাপদে যাইতে পারে। কিন্তু আজকাল আপনার বড় বড় নগর লুঠ হইতেছে, গ্রামের ত কথাই নাই। জিজিয়া ত ন্যায়বিরুদ্ধ, তাহা ছাড়া ইহা ভারতে এক নূতন অত্যাচার ও ক্ষতিকারক।
যদি আপনি মনে করেন যে, প্রজাদের পীড়ন ও হিন্দুদের ভয়ে দমাইয়া রাখিলে আপনার ধার্মিকতা প্রমাণিত হইবে, তবে প্রথমে হিন্দুদের শীর্ষস্থানীয় মহারাণা রাজসিংহের নিকট হইতে জিজিয়া আদায় করুন। তাহার পর আমার নিকট আদায় করা তত কঠিন হইবে না, কারণ আমি ত আপনার সেবার জন্য সদাই প্রস্তুত আছি। কিন্তু মাছি ও পিপীলিকাকে পীড়ন করা পৌরুষ নহে।
বুঝিতে পারি না কেন আপনার কর্মচারীরা এমন অদ্ভুত প্রভুভক্ত যে তাহারা আপনাকে দেশের প্রকৃত অবস্থা জানায় না, কিন্তু জ্বলন্ত আগুনকে খড় চাপা দিয়া লুকাইতে চায়। আপনার রাজসূৰ্য্য গৌরবের গগনে দীপ্তি বিকীর্ণ করিতে থাকুক!”৩৪
শাহজাদা আকবরও অনুরূপ লিখেছিলেন: “আপনার রাজত্বে, হে মহামহিম, উজিরদের কোনাে ক্ষমতা নেই, আমিরদের কেউ বিশ্বাস করে না, সৈনিকদের দারিদ্র্য মর্মান্তিক, লেখকরা কর্মহীন, ব্যবসায়ীরা সঙ্গতিহীন, কৃষকশ্রেণি ভূপতিত…হিন্দু ফির্কা (জাতি সম্প্রদায়) বিপর্যয়ের সম্মুখীন—(প্রথম) শহরে জিজিয়ার উৎপীড়ন এবং (দ্বিতীয়) গ্রামাঞ্চলে হানাদারদের (অর্থাৎ, মারাঠাদের) অত্যাচার। চতুর্দিক থেকে এইরকম দুর্বিপাক মাথার উপর চেপে বসতে থাকলে কেনই বা তারা শাসকদের ধন্যবাদ দিতে বা মঙ্গল কামনা করতে ভুলে যাবে না?”৩৫
উপসংহারে বলি, যেহেতু জনসাধারণ জিজিয়ার প্রকৃত ও অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত নন, সেহেতু ঔরঙ্গজেবের প্রতি দোষারােপ করা হয়ে থাকে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বশবর্তী হয়ে সম্রাট অমুসলিমদের উপর জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন করেননি। নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যাবে যে, জিজিয়া কোনাে অপ্রিয় বস্তু নয়। বরং অমুসলমানদের জন্য কল্যাণকর—এটা ছিল তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। তবু অস্বীকার করে লাভ নেই যে, হিন্দু জনগণ এতে মনঃক্ষুণ্ণ। কারণ যে কর রহিত হয়ে গিয়েছিল পুনরায় তার প্রবর্তন কী করে তারা পছন্দ করতে পারেন? ভারতের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী পণ্ডিত আবুল কালাম আজাদ তাই সখেদে বলেছিলেন, “পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাস পড়াশােনার সুযােগ থাকা সত্বেও ভারতের হিন্দু জনসাধারণ অনেকে জিজিয়া করকে বিরাট ভুল বুঝেছেন। আসলে এটা আসল তথ্যের অজ্ঞতা।”৩৬ ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্রের বক্তব্যও একই: “জিজিয়া পুনর্বলবৎ হওয়াটাকে তিক্ততর হিন্দু-বিরােধী কর্মনীতির সূচনা বলে চিহ্নিত করা মুশকিল।”৩৭
তথ্যসূত্রঃ
- ১. সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বাংলা অনুবাদ-সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ১৪০। এ কে এম আবদুল আলিম, ভারতে মুসলিম শাসন ব্যবস্থার ইতিহাস, মাওলা ব্রাদার্স, চতুর্থ সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ. ১৪২। চার্লস হ্যামিলটন কর্তৃক অনুদিত ও এস গ্রোভ সম্পাদিত, হিদায়া, খণ্ড-২, লন্ডন, ১৯৭০, পৃ. ২১১-২১৪; আরও দেখুন-Thomas Patrick Hughes, Dictionary of Islam, Reprint, New Delhi, 1985, P. 248 97 এবং এনপি আগনাইডস, মহামেডান থিয়ােরিজ অফ ফিনান্স, পৃ. ৩৯৮-৯৯।
- ২. এস এ কিউ হুসায়নি, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আন্ডার দ্য মুঘলস, ঢাকা, ১৯৫২, পৃ. ৯৯।
- ৩. শিবলি নােমানি, আল জিজিয়া, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ, ১৯৫৯।
- ৪. সতীশচন্দ্র, জিজিয়া এবং সপ্তদশ শতাব্দীর ভারত রাষ্ট্র, অন্তর্ভুক্ত-ইরফান হাবিব সম্পাদিত, মধ্যকালীন ভারত, খণ্ড-১, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৯০।
- ৫. আবুল ফজল, আকবরনামা, খণ্ড-২, গ্যারেট অনূদিত, কলকাতা, ১৮৯৪, পৃ. ২০৩। অবশ্য আবদুল কাদের বাদাউনি ১৫৭৯ সালে জিজিয়া বিলােপ করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন (দেখুন-আবদুল কাদের বাদাউনি, মুন্তাখাব-উত-তারিখ, খণ্ড-২, এইচ লােয়ে অনূদিত, কলকাতা, ১৯২৫, পৃ. ২৭৬। আরও দেখুন-কেমব্রিজ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-৪, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯২৮, পৃ. ৮৭)। ঐতিহসিক সতীশচন্দ্র লিখেছেন, “সাম্প্রতিক কালের কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে আকবরের উদারনীতিবাদকে বড়াে করে দেখানাের জন্যে আবুল ফজল ইচ্ছাকৃতভাবে জিজিয়া কর রদের সময় কালকে পিছিয়ে ১৫৬৪ সাল বলে বর্ণনা করেছিলেন, কিন্তু বাদায়ুনি সেখানে এই সময়কালকে ১৫৭৯ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বদায়ুনি বলেছিলেন যে ১৫৭৫-৭৬ সালে আকবর শেখ আবদুন নবি ও মাখদুম-উল-মুলককে জিজিয়া কর সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে খোঁজখবর করা ও হিন্দুদের থেকে এই কর বাবদ ঠিক কত পরিমাণে অর্থ আদায় করা হবে তার হিসাব করতে আদেশ দিয়েছিলেন। সেই হিসাবে তারা সাম্রাজ্যের সর্বত্র ফরমান জারি করে দিয়েও ছিলেন; কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সেই ফরমানের আদেশ জলের ঢেউয়ের মতাে মিলিয়ে গিয়েছিল। ফলে আকবর ১৫৬৪ সালে জিজিয়া কর রদের নিদের্শ ফিরিয়ে নেওয়ায় কর আদায়ের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।” (সতীশচন্দ্র, মধ্যকালীন ভারত, খণ্ড-২, বাংলা অনুবাদ- সায়ন দে ও রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, কলকাতা, ২০১৩, পৃ. ২০৩)। তাহলে বােঝা যাচ্ছে, সম্রাট আকবর কিন্তু সিংহাসনে বসেই জিজিয়া লােপ করেননি—করেছিলেন ২২ বছর পর। তাই যারা আকবরের জিজিয়া প্রত্যাহারের পিছনে ‘হিন্দু-প্রীতি’র যুক্তি প্রদর্শন করেন, তাদের কাছে প্রশ্ন ২২ বছর পরে কেন এই ‘হিন্দু প্রীতি’?
- ৬. সাকি মুহম্মদ মুস্তাইদ খান : মাসের-ই-আলমগীরী, বিবলিওথেকা ইন্ডিকা, কলকাতা, ১৮৭১, পৃ. ১৭৪।
- ৭. ঈশ্বরদাস নাগর : ফুতুহাত-ই-আলমগীরী, ব্রিটিশ মিউজিয়াম অতিরিক্ত সংগ্রহ, ২৩, ৮৮৪, পৃ. ৭৪-এ।
- ৮. আলি মুহাম্মদ খান : মিরাত-ই-আহমদী, বিবলিওথেকা ইন্ডিকা, কলকাতা, পৃ. ২৯৬।
- ৯. কাফি খান, মুন্তাখাব-উল-লুবাব, সৈয়দ আনিস জাহান কৃত ইংরেজি অনুবাদ, বম্বে, ১৯৭৭, পৃ. ২৭৫-৭৬।
- ১০. ফস্টার সম্পাদিত, দ্য ইংলিশ ফ্যাক্টরিজ ইন ইন্ডিয়া ১৬১৮-৬৯, নিউ সিরিজ, খণ্ড-৩, লন্ডন, পৃ. ২৪১।
- ১১. মানুচি, স্টোরিয়া দ্য মােগর অর মুঘল ইন্ডিয়া, খণ্ড-২, ডব্লিউ আরভিন অনূদিত ও সম্পাদিত (চার খণ্ড, ১৯০৬-০৮); নিউ দিল্লি, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৮১, পৃ. ২৩৪। আরও দেখুন- সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪১।
- ১২. মানুচি, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৪।
- ১৩. যদুনাথ সরকার, এ শর্ট হিস্টরি অফ ঔরঙ্গজেব, কলকাতা, ১৯৩০, পৃ. ১৫৭।
- ১৪. যদুনাথ সরকার, হিস্টরি অফ ঔরঙ্গজেব, খণ্ড-৩, কলকাতা, ১৯২১, পৃ. ২৭৪।
- ১৫. সতীশচন্দ্র, জিজিয়া ও সপ্তদশ শতাব্দীর ভারত রাষ্ট্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৯।
- ১৬. সতীশচন্দ্র, মুঘল দরবারে দল ও রাজনীতি, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ২৯৫।
- ১৭. সতীশচন্দ্র, জিজিয়া ও সপ্তদশ শতাব্দীর ভারতরাষ্ট্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০। মধ্যযুগের ভারতে ইসলামীয় ধর্মান্তরণের সমস্যাটির জন্য দেখুন- এস নুরুল হাসান, চিস্তি অ্যান্ড সুরাওয়ার্দি সিলসিলাজ ইন ইন্ডিয়া ডিউরিং দ্য থার্টিনথ আ্যন্ড ফোর্টিনথ সেঞ্চুরিজ, অপ্রকাশিত গবেষণা পত্র, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি; এস এ এ রিজভি, মুসলিম রিভাইভ্যালিস্ট মুভমেন্টস ইন নর্দার্ন ইন্ডিয়া ইন দ্য সিক্সটিনথ অ্যান্ড সেভেনটিনথ সেঞ্চুরিজ, আগ্রা, ১৯৬৫, পৃ. ১৫ – ২১।
- ১৮. হরবংশ মুখিয়া, মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, অন্তর্ভুক্ত-থাপার মুখিয়া-চন্দ্র, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত ইতিহাস রচনা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ২য় মুদ্রণ, ১৯৮৯, পৃ. ৪৬। ১৯. আলি মুহাম্মদ খান, মিরাত-ই-আহমদী, মেজর বার্ডকৃত অনূদিত ও সৈয়দ নবাব আলি সম্পাদিত, বরােদা, ১৯২৭-২৮, পৃ. ৩০৩-৩০৪; আরও দেখুন- J N Sarkar, Mughal Administration, Kolkata, 1920, P. 121-27. সম্রাট ঔরঙ্গজেব কর্তৃক ১৬৭৩ সালে জারি করা ফরমানে বাতিলকৃত করের মধ্যে কয়েকটি হল : ১. বাজারে বিক্রির জন্য আনা মাছের ওপর কর। ২. বাজারে আনা কৃষকের বসতবাড়িতে উৎপাদিত সবজির ওপর কর। ৩. জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত কৃষকের গােবরের ওপর কর। ৪. কৃষকের উৎপাদিত দুধ ও দই বিক্রির ওপর কর। ৫. জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য আনা পাতা ও গাছের আঠার ওপর কর। ৬. জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য বাজারে আনা ঘাস ও জ্বালানি কাঠের ওপর কর। ৭. তৈল বিক্রির জন্য কর। ৮. তৈরি মৃৎপাত্র বিক্রির জন্য কর। ৯. জমি বিক্রির জন্য কর। ১০. তামাকের ওপর কর। ১১. বাড়ি ভেঙে ইট প্রভৃতি বিক্রির ওপর কর। ১২. দাসদাসী বিক্রির ওপর কর। ১৩. মােটা থেকে চিকন সকল কাপড় বিক্রির জন্য কর। ১৪. বাজারে মাটিতে বসে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রেতার নিকট থেকে আদায়কৃত কর। ১৫. বড় লােহার কড়াইয়ে গুড় তৈরির ওপর কর। ১৬. শুকনাে মরশুমে হেঁটে নদী পার হয়ে যাওয়ার জন্য খেয়া ঘাটের কর। ১৭. খেয়া পারাপারের কর। ১৮. অস্ত্র গণনার জন্য কর। ১৯. নিষ্কর ভূমি ভােগের জন্য বকশিশ। ২০. ওজনের বাটখারা ব্যবহারের জন্য কর। ২১. গােচারণ ভূমির জন্য কর। ২২. গরুর গাড়ি ভাড়ার জন্য কর। ২৩. আবগারি কেন্দ্র থেকে ওজনের বাটখারা ব্যবহারের জন্য কর। ২৪. নবাগত অফিসারের জন্য শস্যবিক্রেতাদের নিকট থেকে আদায়কৃত কর। ২৫. কৃষকের কাজে ব্যবহৃত কাগজ ক্রয়ের জন্য কর। ২৬. নিজের বাড়ির গাছ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কর্তনের অনুমতি কর। ২৭. বিক্রির জন্য বাজারে আনা পশুর ওপর কর। ২৮. বিক্রিত পশুর ওপর কর। ২৯. বিক্রির জন্য বাজারে আনা আখ, আম ও কলা ইত্যাদির ওপর কর। ৩০. গােখাদ্য হিসাবে ঘাসের আঁটি ও জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত শুকনাে ঘাসের আঁটির ওপর কর। ৩১. সাধারণভাবে চালু না থাকলেও কোনাে কোনাে অঞ্চলের জমিদার কর্তৃক আরােপিত সন্তান জন্মের ওপর কর। ৩২. হিন্দু বিধবাকে নিম্নবর্ণ হিন্দু বিবাহ করলে এবং তার দ্বারা সন্তান লাভ করলে ফি ‘ধারিচা’। ৩৩. জবাই করার উদ্দেশ্যে ক্রয় করা পশু (গাে-মহিষাদি) ও সেগুলাে জবাইয়ের জন্য লাইসেন্স কর। ৩৪. পদব্রজে চলা লােকের লাঠির ওপর কর। ৩৫. আখ মাড়াই করে উপার্জনকারী পেশাদার ব্যক্তির ওপর ব্যবসা কর। ৩৬. কারুশিল্প শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষা সমাপ্তির পর স্থানীয়ভাবে দেয় কর। ৩৭. উট ভাড়া করার সময় এলাকার হেডম্যান বা মােকাদ্দমের জন্য দর্শনী। ৩৮. সবজি বাজারে হেডম্যানের কমিশন। ৩৯. বিয়েবাড়ি থেকে ভাড়দের আদায় করা অর্থের ওপর কর। ৪০. বারুদ দিয়ে চালানাে বন্দুকের জন্য কর। ৪১. শ্রমিকদের বেগার খাটানাে ব্যক্তির নিকট থেকে আদায়কৃত কর। ৪২. শবে বরাত, দিওয়ালী ও আশুরার রাতে আলাে জ্বালানাের জন্য কর। ৪৩. গঙ্গা ও অন্যান্য পবিত্র নদীতে স্নানের জন্য হিন্দু পুণ্যার্থীর নিকট থেকে আদায়কৃত কর। ৪৪. গ্রামে বড় আয়ােজনে ভূরিভােজের জন্য দেয় কর। ৪৫. অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বড় আয়ােজনে আপ্যায়নের জন্য কর। ৪৬. মুঘল তহশিলদারের বেতন বাবদ দেয় কর। ৪৭. মৃত হিন্দুদের অস্থি গঙ্গানদীতে নিক্ষেপ করার জন্য আরােপিত কর। ৪৮. নৃত্যশিল্পী ও গায়ক-গায়িকাদের আয়ের ওপর কর। ৪৯. বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির ওপর কর। ৫০. বাড়ি বিক্রির ওপর কর। ৫১. উদ্ধারকৃত চুরি হওয়া দ্রব্য সামগ্রীর ওপর কর। ৫২. সুগন্ধি তৈরি ফ্যাক্টরির জন্য ফুল বিক্রির ওপর কর।
- ২০. আলি মুহাম্মদ খান : মিরাত-ই-আহমদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮৮-৯১।
- ২১. আজিজ আহমদ,ইসলামিক কালচার ইন দ্য ইন্ডিয়ান এনভায়রনমেন্ট, অক্সফোর্ড, ১৯৬৪, পৃ. ১৪৮।
- ২২. আবুল ফজল, আকবরনামা, বেভারিজ অনুদিত, খণ্ড-২, পৃ. ৩৯৬-৯৭।
- ২৩. আতাহার আলি, দ্য মুঘল নােবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব, অনুবাদ-অরুণকুমার দে, ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল অভিজাত শ্রেণি, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ৩৯।
- ২৪. সতীশচন্দ্র, জিজিয়া এবং সপ্তদশ শতাব্দীর ভারত রাষ্ট্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৮।
- ২৫. Thomas Patrick Hughes, ibid, P. 248.
- ২৬. গৌতম ভদ্র, মুঘল যুগে কৃষি-অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ, সুবর্ণরেখা, পঞ্চম সংস্করণ, কলকাতা, ১৪২০, পৃ. ৪৩।
- ২৭. বক্তার খান, মিরাৎ-উল-আলম, খণ্ড-১, পৃ. ১৬৬-৬৭।
- ২৮. যদুনাথ সরকার, হিস্টরি অফ ঔরঙ্গজেব, খণ্ড-৩, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭০। এক দেরহাম এক টাকার এক-চতুর্থাংশের বেশি ছিল। (জার্নাল অফ এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল, ১৯১৭, পৃ. ৪৫)। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে আদায়কৃত জিজিয়ার মােট পরিমাণের হিসাব নেই। কিন্তু ১৭২০ সালে যখন মহম্মদ শাহ এই কর উচ্ছেদ করেন তখন এর বার্ষিক পরিমাণ ছিল প্রায় চার কোটি টাকা। দেখুন-ডব্লিউ আরভিন, লেটার মুঘলস, খণ্ড-১, দিল্লি, ১৯৬২, পৃ. ৩৩৮-৩৯।
- ২৯. ইরফান হাবিব, অ্যাগরেরিয়ান সিস্টেম অফ মুঘল ইন্ডিয়া, বম্বে, ১৯৬৩, পৃ. ২৪৬।।
- ৩০. মালিক জাদা:নিগরনামা-ই-মুনশি (চিঠিপত্র ও শাসন সংক্রান্ত দলিলের গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ) , ব্রিটিশ মিউজিয়াম প্রাচ্য সংগ্রহ, ১৭৩৫, পৃ-১৮০-এ। আরও দেখুন-সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৫।
- ৩১. ঈশ্বরদাস নাগর : ফুতুহাত-ই-আলমগীরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১-বি। আরও দেখুন- সতীশচন্দ্র, মধ্যযুগের ভারত, খণ্ড-২, বুকপােস্ট পাবলিকেশন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৫।
- ৩২. এস এ কিউ হুসাইনি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০।
- ৩৩. টি এম তিতাস,ইন্ডিয়ান ইসলাম:এ রিলিজিয়াস হিস্টরি অফ ইসলাম ইন ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, অক্সফোর্ড, ১৯৩০; দিল্লি সংস্করণ, ১৯৭৯।
- ৩৪. যদুনাথ সরকার, শিবাজী, ওরিয়েন্ট লংম্যান, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ১২৪-২৭। খতুৎ-ই-শিবাজী (ঔরঙ্গজেবের উদ্দেশ্যে শিবাজীর পত্র), রয়েল এশিয়াটিক সােসাইটি পাণ্ডুলিপি, পত্র নং-৩২, ইংরেজি অনুবাদ, কলকাতা। এই চিঠিতে শিবাজীর তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে অত্যাচারমূলক জিজিয়া করের বিরুদ্ধে। কিন্তু শিবাজীর মুখে এই প্রতিবাদ মানায় না। কারণ তিনিও ‘চৌথ’ কর আদায়ে জনগণের উপর কম অত্যাচার করেননি। যদুনাথ সরকার লিখেছেন : “আমি তিনবারের বার এই শেষবার তােমাদের বলিতেছি যে, সুরত প্রদেশের খাজনার এক সিকি অর্থাৎ চৌথ আমাকে পাঠাইয়া দাও। তােমাদের বাদশাহ আমাকে নিজ দেশ ও প্রজা রক্ষা করিবার জন্য প্রকাণ্ড সৈন্যদল রাখিতে বাধ্য করিয়াছেন; সুতরাং তাহার প্রজারাই সৈন্যদলের খরচ জোগাইবে। যদি এই টাকা শীঘ্র না পাঠাও, তবে আমার জন্য একটা বড় বাড়ী প্রস্তুত রাখিও, আমি গিয়া সেখানে বসিয়া থাকিব এবং সুরতের খাজনা এবং মালের মাশুল আদায় করিয়া লইব। এখন আমাকে বাধা দিতে পারে এমন লােক তােমাদের মধ্যে কেহ নাই।” (যদুনাথ সরকার, শিবাজী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯০-৯১)। এরকম আরও উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আসলে প্রজা শােষণে বা নিপীড়নে শিবাজী বা ঔরঙ্গজেব বা আকবরে খুব বেশি যে তফাৎ নেই তা বলাই যায়।।
- ৩৫. খতুৎ-ই-শিবাজী, প্রাগুক্ত, পত্র নং-১৫। দেখুন-সতীশচন্দ্র, জিজিয়া এবং সপ্তদশ শতাব্দীর ভারত রাষ্ট্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৯।
- ৩৬. আবুল কালাম আজাদ, সলতানাতে দেহলী মে গায়ের মুসলিম, দিল্লি, ১৯৬৭, পৃ. ৬৮।
- ৩৭. সতীশচন্দ্র, জিজিয়া এবং সপ্তদশ শতাব্দীর ভারত রাষ্ট্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৮।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।