লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আলিম
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক। জীবনানন্দ যেহেতু ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন তাই দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের বহুমাত্রিকতায়। জীবনানন্দ ইউরোপীয় কাব্যধারাকে গ্রহণ করেছিলেন এবং সফলভাবে বাংলা কবিতায় প্রয়োগ করেছিলেন। সেজন্য তাঁর কবিমনস্কতাতেও পাশ্চাত্য কবিদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। শুধু জীবনানন্দই নন রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিদের কবিতার অভিমুখ পাশ্চাত্যমুখী। যেহেতু জীবনানন্দ দাশকে আধুনিক কবিতার প্রাণ পুরুষ বলা হয় সেজন্য তাঁর কবিতায় পাশ্চাত্যের অনুকরণ প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই প্রভাব জীবনানন্দ তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেন নি।
পাশ্চাত্যের কবিদের অনুকরণ করেও জীবনানন্দ দাশ হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। বিংশ শতকের অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তিনি বাংলা কবিতার আধুনিকতার পথিকৃৎ। রবীন্দ্র-জোয়ারের যুগে অধিকাংশ বাঙালী কবি যখন ভেসে যাচ্ছেন তখন জীবনানন্দ পাশ্চাত্যের কবিদের হাত ধরে হাঁটলেন অন্য পথে; তিনি প্রবেশ করেলেন ইম্প্রেশনিস্টিক যুগে। তাঁর সময়ের বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ কবি টিএস এলিয়ট, উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস এবং ঊনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, জন কীটস, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, জুল ভার্ন, এইচ জি ওয়েলস তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। ইউরোপীয় আধুনিকতার মাধ্যমে তিনি বাংলা কবিতা ধারায় নিয়ে হাজির হলেন নতুন ব্যঞ্জনা ও নতুন কাব্যশৈলী।
জীবনানন্দ দাশ কাব্যচিন্তায় ইয়েটস, এলিয়ট, র্যাবো, বোদলেয়ার, ভালেরি, ভেরলেন, এডগার এলান পো প্রভৃতি কবিদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। সেজন্য তাঁর ‘কবিতার কথা’ নামক গ্রন্থের প্রবন্ধগুলিতে ইয়েটস, এলিয়ট, বোদলেয়ার, পাউণ্ড, ভেরলেন, মালার্মে, কামিংস, স্পেণ্ডার, অডেন, হাইনে, হ্যেল্ডারর্লিন, রিলকে প্রভৃতি কবিদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এঁদের সবার দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন বলা যায়না। তবে ইয়েটস, বোদলেয়ার এবং এডগার এলান পো-ই জীবনানন্দ দাশকে সর্বাধিক প্রভাবিত করেছেন।
জীবনানন্দ যে এডগার অ্যালান পো-র, ইয়েটসের, কীটসের বা এলিয়টের কবিতা অনুকরণ করেছেন সেকথা অকপটে স্বীকারও করেছেন।
জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতায় এডগার অ্যালান পোর ‘টু হেলেন’ কবিতার অনুকরণে লিখেছেন সেটা অনস্বীকার্য। এই অনুকরণের জন্য জীবনানন্দকে বিদেশি কবিতা চুরির অপবাদ দিলে গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ একবার জীবনানন্দ দাশকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “লোকে বলে, আপনি নাকি ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি এডগার অ্যালান পোর ‘টু হেলেন’ থেকে মেরেছেন?” এ প্রশ্ন শুনে কবি প্রথমে চুপ করেছিলেন। কিছুক্ষণ পরে বলেছিলেন, “তুমি কি কুম্ভীলকবৃত্তির কথা বলছ?” ভূমেন্দ্র গুহ বলেন, “তা না, লোকে বলে।” জীবনানন্দ দাশ এই চুরির অপবাদের মোক্ষম জবাব দেন। তিনি বলেন, “তুমি যে সমাজে বাস করো, সে সমাজের ভাষাও তোমার জিভে চলে আসে। তুমি বাংলা ভাষায় কেন কথা বলো? ছেলেবেলায় তুমি বাঙালি সমাজে বড় হয়ে উঠেছ। অতএব বাংলা ভাষা তোমার জিভে আছে। তুমি যদি এডগার অ্যালান পো, ইয়েটস, কীটস বা এলিয়টের সমাজে বাস করো, তোমার জিভে কী ভাষা আসবে? সেই ভাষাই চলে আসবে। একে কুম্ভীলকবৃত্তি বলে না।”
জীবনানন্দ দাশ অন্যত্র বলেছেন– “বাংলা সাহিত্যে যা নেই অথবা শীর্ণভাবে রয়েছে সেই সব প্রাণ ও পরিসরের থেকে রশ্মি পেতে হলে ইয়োরোপীয় সাহিত্য ছাড়া আমাদের অন্য কোনো আলোভূমি নেই।”
এমনকি বুদ্ধদেব বসুও জীবনানন্দ দাশের ইউরোপীয় অনুকরণ নিয়ে বলেছেন। বুদ্ধদেবের মতে, “জীবনানন্দ ছিলেন ব্যক্তি-জীবনে নিতান্তই বাঙালি, কিন্তু ক্রমশ ধরা পড়ছে যে বাংলা ভাষায় অন্য কোনো কবি তাঁর মতো ‘য়োরোপীয়’ নন”।
জীবনানন্দ দাশ আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ বলা হলেও, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ (১৯২৭) আধুনিকতার স্পর্শ ছিল না। ‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থটি ছিল কাজি নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) প্রভৃতি যুগশ্রেষ্ঠ কবিদের কবিতার অনুকরণে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, “প্রথম দিকের কবিতায় তিনি (জীবনানন্দ দাশ) রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন দত্তের অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন প্রাণপনে।” সেইসময় কল্লোলে সুকুমার সেন তাঁর কাব্যের সমালোচনা করে লিখেছিলেন, “ঝরা পালক এর একটি কবিতায় (পলাতক) দ্বিতীয়-তৃতীয় দশাব্দসুলভ পল্লী-রোমান্সের-অর্থাৎ করুণানিধান-যতীন্দ্রমোহন-কুমুদরঞ্জন-কালিদাস-শরৎচন্দ্র প্রভৃতি কবি ও গল্পলেখকের অনুশীলিত- ছবি পাই।”
জীবনানন্দ দাশ এবং উইলিয়ম বাটলার ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯)
জীবনানন্দ সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন পাশ্চাত্যের প্রথিতযশা কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের দ্বারা। ইয়েটস জীবনানন্দ দাশের সবচেয়ে প্রিয় কবি। জীবনানন্দ ইয়েটসের দ্বারা সর্বাধিক উপকৃত হয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ যেভাবে তাঁর কবিতার মধ্যে পল্লীগ্রামের সৌন্দর্যের চিত্র অঙ্কন করেছেন তার চিত্র খুব সহজেই ইয়েটসের কবিতার সঙ্গে সাদৃশ্যতা পাওয়া যায়।
ইয়েটস সম্বন্ধে স্টুয়ার্ট হলরয়েড বলেছেন,
“Never was there more peraistent a seeker after the unitive life, never a man more aware of the dichotomies within himself.” (Stuart Holroyd, Emergence From Chaos, P. 113)
স্টুয়ার্ট হলরয়েডের এই মন্তব্য জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। জীবনানন্দের কাব্যও ইয়েটসের মতো,
“A record of the struggles, creative and stimulating in themselves, of a scrupulously honest human mind enaged in an heroic endeavour to know reality, and of those other struggles suffered by representive modern man who would establish ‘Unity of Being’ within himself in despire of the world.” (Stuart Holroyd, Emergence From Chaos, P. 120)
ইয়েটস স্বয়ং তাঁর ‘Essays’ গ্রন্থে সংকলিত ‘The Symbolism of Poetry’ নামক প্রবন্ধে আত্মধর্মকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। ইয়েটসের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের কবিচিন্তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ইয়েটসের প্রথম কাব্য ‘Crossways’-এর (১৮৮৯) ‘The Falling of the Leaves’ ও ‘Ephemera’ কবিতা-দুটির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় জীবনানন্দ দাশ এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
অধ্যাপক মঞ্জুভাষ ঘোষ লিখেছেন,
“বিষন্ন পাতাঝরার ঋতু হেমন্ত এসে গেছে; খড়ের আঁটির উপর নিঃশব্দে ইদুরেরা খেলা করে যাচ্ছে। এই মুহূর্ত প্রেমের ক্ষয়ের, অতএব প্রেমিক তার প্রেমিকার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। এক অপূর্ব বিষগ্ন সময়ে প্রিয়তমার সঙ্গে নদী ও মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার চিত্রকল্প ইয়েটসের এইসব প্রাথমিক কবিতায় আছে। জীবনানন্দ দাশ ইয়েটসের এই সুরটিকে নিজের মতো মতো করে বারবার বাজিয়েছেন, ধূসর পাণ্ডুলিপির প্রাথমিক কিছু কবিতা এবং বনলতা সেন-এর কোনো কোনো কবিতাপাঠে এই কাব্যবাণিজ্যের পথ কীভাবে উন্মুক্ত হয়েছে অনুভব করা যায়। ধূসর পাণ্ডুলিপির ‘পচিশ বছর পরে’ নামক কবিতায় মাঠের মাঝে প্রেমিকার সাথে প্রেমিকের শেষবার দেখা, ‘পেঁচা’ নামক কবিতায় প্রথম ফসল ঘরে যাওয়ার পর হেমন্ত্রে মাঠের শূন্যতা, ‘নির্জন স্বাক্ষর কবিতায় হেমন্তের ঝড়ে সর্বশূন্যতার বেদনা সবই ইয়েটসের প্রথম দিকের কিছু কবিতার রূপরসগন্ধস্পর্শ দ্বারা মৃদুভাবে রঞ্জিত। ‘The Rose’ কাব্যগ্রন্থের ‘The Pity of Love’ কবিতার ‘mouse-grey water’ বা ইঁদুরের মতো ধূসর জলস্রোতের সঙ্গে জীবনানন্দের নেউল-ধূসর নদী ইত্যাদি অলংকারের বিক্ষিপ্ত তুলনা ছেড়ে দিলেও দেখা যায় বনলতা সেন-এর মতো পরিণত কাব্যেও ইয়েটসের প্রভাব বিদ্যমান। (আধুনিক বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় প্রভাব, পৃষ্ঠা-৭২ দে’জ পাবলিশিং হাউস)
ইয়েটস লিখেছেন,
‘Your eyes that once were never weary of mine
Are bowed in sorrow under pendulous lids,
Because our love is waning’
And then she:
‘Although our love is waning, let us stand
By the lone border of the lake once more,
ইয়েটস আরও লিখেছেন,
The woods were round them and the yellow leaves
Fell like faint metcors in the gloom,
ইয়েটসের এই কবিতাটি অনুকরণ করে ‘অঘ্রান প্রান্তরে’ কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন,
জানি আমি তোমার দুচোখ আজ আমাকে খোঁজেনা,
আর পৃথিবীর পরে—
বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশ্বখপাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে
শুকনো মিয়োনো ঘেঁড়া;—অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;
সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার
মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে-সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার
ছড়িয়ে পড়েছে জলে’,
জীবনানন্দ দাশের এই কবিতাটির পাশে প্রতিস্থাপন করে পড়ুন ইয়েটস ‘Ephemera’-কবিতাটি। দুটি কবিতা পাঠ করলে লক্ষ্য করা যায় ইয়েটসের কবিতার সঙ্গে জীবনানন্দের কবিতাটির অদ্ভুত মিল রয়েছে। দুটি কবিতার বার্তা ও অন্তরঙ্গ স্বরূপ এক। কবিতার মধ্যে পুরুষ ও নারী উভয়ের যে সংলাপভঙ্গি রয়েছে তাতেও একটি অপরটির সঙ্গে সাদৃশ্যতা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘দুজন’ কবিতায়ও ‘Ephcmera’ কবিতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রেমের বেদনা এবং হেমন্তের শূন্যতা এই দুই বিষয় কবির অত্যন্ত প্রিয় বর্ণণীয় বিষয়।
জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘আমি যদি হতাম’ কবিতায় যে সৌন্দর্যতার চিত্র অঙ্কন করেছেন তাও ইয়েটসের কবিতার অনুকরণে। জীবনানন্দ লিখেছেন,
তোমার পাখনায় আমার পালক,
আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-
নীল আকাশে খই ক্ষেতের সোনালী ফুলের মতো অজস্র তারা
… … … … … … … … … … … … … … … … … … … …
আমি যদি বনহংস হতাম ।
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।
জীবনানন্দের এই কবিতাটির উৎস হল ইয়েটসের একটি কবিতা। ইয়েটস লিখেছেন,
Or the flame of the blue star that lingers hung low in the fall of the
dew :
For I would we were changed to white birds on the wandering foam :
I and you !
(The White Birds : The Rose)
ইয়েটসের ‘The Wild Swan At Coole’ ও জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘হাঁস’ কবিতায় এক শান্তির বাণী উল্লেখ রয়েছে।
ইয়েটসের কবিতায় ব্যঙ্গ, ঘৃণা এবং আত্মঘৃণা, অস্থিরতা এইসব মনোবৃত্তি রয়েছে। অনুরূপ মনোবৃত্তি জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেও লক্ষ্য করা যায়। জীবনানন্দ দাশ ইয়েটসকে অনুকরণ করেছেন আজীবন। জীবনানন্দের বিড়ালের সঙ্গে ইয়েটসের বিড়ালের মিল কোনো কাকতালীয় মিল নয়, অবশ্যই জীবনানন্দ ইয়েটসকে অনুকরণ করে তাঁর কবিতায় বিড়ালের ধারণা অবতারণা করেছেন। ইয়েটসের বিড়াল চাঁদের কাছে নিঃশব্দে সাঁতার কাটে আর জীবনানন্দের বিড়াল সূর্যের শরীরে থাবা বুলিয়ে খেলা করে। যেমন ইয়েটস লিখেছেন,
The cat went here and there
And the moon spun round like a top,
And the nearest kin of the moon
The creeping cat, looked up.
(The Cat and the Moon : The Wild Swans at Coole)
অপরদিকে জীবনানন্দও লিখেছেন,
হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান রঙের সূর্যের শরীরে
শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে,
(বেড়াল : বনলতা সেন)
এখানে ইয়েটসের কবিতায় বেড়াল ও জীবনানন্দের কবিতায় বেড়ালের সাদৃশ্যতা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও ইয়েটস এর He Reproves the Curlew (The Wind Among the Reeds) অথবা The Scholars (The Wild Swas al Coole) কবিতার সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের ‘হায় চিল’ (বনলতা সেন) বা সমারূঢ়-র (সাতটি তারার তিমির) কবিতার সঙ্গে সাদৃশ্যতা লক্ষ্য করা যায়। কবিতা দুটি পাশাপাশি রেখে পাঠ করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
ইয়েটস লিখেছেন,
He Reproves the Curlew
O curlew, cry no more in the air,
Or only to the water in the West;
Because your crying brings to my mind
Passion-dimmed eyes and long heavy hair
That was shaken out over my breast;
There is enough evil in the crying of the wind.
অনুবাদঃ
হে চাতক
হে চাতক, তুমি আর কেঁদো না বাতাসে,
অথবা শুধু পশ্চিম সাগরের জলের বিস্তারে;
কারণ তোমার কান্না আমার হৃদয়ে নিয়ে আসে
ভাবাবেগে ম্লান তার চোখ আর দীর্ঘ কেশভারে
ঘেরা মুখ, যার ছোঁয়া পেয়েছিলো আমার এ বুক।
বাতাসের কান্নাতেই এমনিতে যথেষ্ট অসুখ।
অপররিকে জীবনানন্দ দাশও ইয়েটসের এই কবিতাকে অনুকরণ করে লিখেছেন,
হায় চিল হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার স্নান চোখ মনে আসে।
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আন? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে।
ইয়েটস ‘The falling of the leaves’ কবিতায় লিখেছেন,
Autumn is over the long leaves that love us,
And over the mice in the barley sheaves;
Yellow the leaves of the rowan above us,
And yellow the wet wild-strawberry leaves.
The hour of the waning of love has beset us,
And weary and worn are our sad souls now;
Let us part, ere the season of passion forget us,
With a kiss and a tear on thy drooping brow.
ইয়েটসের এই কবিতাকে অনুকরণ করে জীবনানন্দ লিখেছেন,
দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হ’য়ে ঝরেছে দু-বেলা
নির্জন মাছের চোখে; পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ–মেয়েলি হাতের স্পর্শ ল’যে গেছে তারে;
মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,
বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন নীল হ’য়ে আছে,
নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার বার তীরটিরে মাখে,
খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে;
বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ—বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে;
(মৃত্যুর আগে, ধূসর পাণ্ডুলিপি)
ইয়েটস ও জীবনানন্দের কবিতা দুটির মধ্যে তুলনা করলেই বোঝা যাবে, জীবনানন্দ ইয়েটসের কবিতার থেকে অনুকরণ করে রচনা করলেও নতুন বাংলা শব্দ যোগ করেছেন। যোগ করেছেন নতুন অনেক অনুষঙ্গ, যেমন– ‘সোনালি ডানা’, ‘ভিজে মেঝের দুপুর’, ‘ধানসিড়ি নদী’, ‘বেতের ফলের মতো’, ‘রাঙা রাজকন্যা’, ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো’; সবশেষে প্রথম পংক্তিদ্বয়কে পুনরাবৃত্ত করিয়ে কবিতার বাণী ও উপলব্ধিতে একটি ঘুরন্ত অন্তহীনতার আবহ তৈরি করলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। ইয়েটসকে অনুকরণ করে লেখা হলেও ‘হায় চিল’ যে অত্যন্ত সুন্দর, শিল্পোত্তীর্ণ খাঁটি বাংলা কবিতা, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
একজন সুন্দরীর প্রেমে পড়ে যেমন নতুন কবিতা লেখা যায়, তেমনি এক নিটোল কবিতার প্রেমে পড়েও অনুরূপ আরেকটি নতুন কবিতা রচনা করা যায়, যা শিল্পোত্তীর্ণ দাবিদার হতে পারে। ইয়েটসের কবিতাটি থেকে জীবনানন্দ যদি প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত হলেও, তিনি তাকে নিজের করে সৃষ্টি করেছেন নতুন ভঙ্গিমায়, নতুন আঙ্গিকে।
ইয়েটসের গোধূলি ও প্রতীকময় জগতের সঙ্গে জীবনানন্দের গোধূলি ও প্রতীকময় জগতের কিছু সাদৃশ্য সহজেই লক্ষ্য করা যায়। ইয়েটসের উক্ত কবিতাটিকে সামনে রেখে জীবনানন্দের কবিতা পাঠ করলে দেখা যায় জীবনানন্দ নতুন কিছু সৃষ্টি করেন নি। ইয়েটসের কবিতাকে সফলভাবে অনুবাদ করেছেন মাত্র। তবে এমন সফলভাবে নিখুঁত অনুবাদ করেছেন তাতে অনুদিত কবিতাটি স্বতন্ত্র কবিতায় পর্যবসিত হয়েছে।
জীবনানন্দ দাশ এবং এডগার অ্যালান পো (১৮০৯-১৮৪৯)
এডগার অ্যালান পো জীবনানন্দ দাশের কবিতার অন্যতম উৎস। জীবনানন্দ দাশ পো’র স্তুতি বন্দনা করেছেন। বাংলাভাষার কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ (১৯৩৫) কবিতার মূল উৎস এডগার অ্যালান পোর লেখা ‘টু হেলেন’ (১৮৩১) কবিতাটি। ‘বনলতা সেন’ লেখার সময় জীবনানন্দ দাশ হুবহু পোর লেখা ‘টু হেলেন’ কবিতাটি অনুকরণ করেছেন। বাংলাসাহিত্যে যে কবিতাটি সবচেয়ে সুমিষ্ট প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করে আজও অপামর বাঙালি পাঠক হৃদয়ে। যার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে এ যাবত কালের কাব্যিকতার জটিল সমীকরণ। এমন ছন্দময় শিল্পিত কবিতাটি কবি এডগার অ্যালেন পো’র কবিতা ‘টু হেলেন’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তার ছায়া অবলম্বনে বাংলাসাহিত্যে পরিবেশন করা হয়েছে নিজস্ব উপমা-উপাদানে : সেই কবিতার নাম ‘বনলতা সেন’। পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে নিচে পুরো কবিতাটি উদ্ধৃত করছি।
বনলতা সেন
হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
‘টু হেলেন’ ও ‘বনলতা সেন’ কবিতা দুটিই নারীর প্রেম আর সৌন্দর্য দ্বারা অনুপ্রাণিত। বলা হয় এডগার এলান পো ‘টু হেলেন’ লিখেছেন তাঁর বন্ধুর মা জেন স্ট্যানার্ডের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে; কিন্তু জীবনানন্দ কার প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলেন তা আমরা জানা যায় না। যদিও প্রখ্যাত গবেষক ড. আকবর আলী খান গবেষণা করে দেখাতে চেয়েছেন যে, এর পেছনে নাটোরের এক বেশ্যার ছায়া আছে।
‘টু হেলেন’ (১৮৩১) নামক কবিতায় এডগার অ্যালান পো নারী সৌন্দর্যের বর্ণনা করেছেন। এডগার অ্যালান পো লিখেছেন,
Helen, thy beauty is to me
Like those Nicean barks of yore
That gently, o’er a perfumed sea,
The weary, way-worn wanderer bore
To his own native shore.
On desperate seas long wont to roam,
Thy hyacinth hair, thy classic face,
Thy Naiad airs have brought me home
To the glory that was Greece,
And the grandeur that was Rome.
Lo, in yon brilliant window-niche
How statue-like I see thee stand,
The agate lamp within thy hand,
Ah! Psyche, from the regions which
Are Holy Land!
বাংলা অনুবাদঃ
হেলেন, আমার চোখে সৌন্দর্য তোমার
সেই কবেকার নিসীয়* বল্কলের মতো,
ক্লান্ত, পথশ্রান্ত পরিব্রাজক ধীরে ধীরে সুরভিত
সাগরের পথে নিয়ে আসে যারে স্বদেশে তাহার।
কতদিন আহা ঘুরছি উত্তাল সাগরে সাগরে
তোমার শ্যওলা চুল, তোমার ধ্রুপদী মুখ,
জলপরী রূপ ডেকে আনে গ্রিসের গৌরবে,
রোমের মহিমায় আমাকে নিজ ঘরে।
ওই তো দূরে আলোকোজ্জ্বল জানলার ধারে
মর্মরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছো তুমি
রত্নদীপ হাতে যেন দেবী কোনো স্বর্গভূমি
হতে নেমে এলে এই পৃথিবীর পারে।
[*নিসিয়া: খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের রোমান সাম্রাজ্যের বিথিনিয়া রাজ্যের একটি শহর। আধুনিক তুরস্কের অন্তর্গত এ শহরের বর্তমান নাম ইজনিক।]
এই কবিতাটি কবি বিষ্ণু দে নিজের মত করে অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুবাদটিও উদ্ধৃত করা হল,
হেলেন তোমার রূপ মোর মনে হয়
সেকালের ভিনীসীয় তরণীর মতো
সুগন্ধ সমুদ্র বক্ষে শান্তধীরে বয়
ক্লান্ত প্রবাসীকে দীর্ঘপথসমাহত
আপন স্বদেশ সমাগত।
কত না দুরন্ত সমুদ্রবিহারের পরে
তোমার অতসী ক্লেশ, ক্লাসিক বয়ান।
নেয়াড তোমার লাস্য, মোরে আনে ঘরে
গ্রীসে চিরগৌরবের আদিপীঠস্থান
আর রোমে, আছিল যে বৈভবশিখরে।
দেখি বতায়নবেদীতে উদ্ভাস
আভঙ্গে খোদাই স্তব্ধ স্থির মূর্তি তুমি
মর্মরের দ্বীপ জ্বলে করপুট চুমি।
আহা সাইকি! সেই দেশে তোমার নিবাস
সে যে পুন্যভূমি।
এডগার অ্যালান পোর ‘টু হেলেন’ ও জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ পাশাপাশি রাখলে আপাতদৃষ্টিতে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়না। জীবনানন্দ কবিতাটিকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সাজিয়ে লিখেছেন। পো লিখেছেন, “Thy Hyacinth hair, thy classic face” (তোমার শ্যওলা চুল, তোমার ধ্রুপদী মুখ) এই পংক্তিকে জীবনানন্দ “মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য” বলে বর্ণনা করেছেন। জীবনানন্দ দাশ নারীর সৌন্দর্যের সঙ্গে দ্বীপের যে তুলনা করেছেন সেই তুলনা উৎস এডগার অ্যালান পো’র লেখা থেকে।
জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতায় আমরা দেখি হাল ভাঙা অসহায় নাবিক, যে দারুচিনি দ্বীপের ভেতর পথের সন্ধান খুঁজে পায়। এডগার এলান পোর ক্লান্ত নাবিক সুধা খুঁজে পায় হেলেনের মাধুরীতে—অবশ্য তিনি তাকে নাবিক না বলে বলেছেন ‘ক্লান্ত পরিব্রাজক’। হেলেনের সৌন্দর্য কবিকে তার আবাসভূমি রোম ও গ্রীস সভ্যতায় পৌঁছে দেয় আর বনলতা সেনের অনুপম সৌন্দর্য জীবনানন্দের কথককে মুখোমুখি দাঁড় করায়—
‘সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন,
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার নাটোরের বনলতা সেন।’
প্রকৃতপক্ষে এখানে ‘বনলতা সেন’ জীবনের ক্লান্তির বিপরীতে জীবনমুখী এক যাত্রার প্রতীক হিসেবে একটি কাঠামো হয়ে এসেছে। ডাব্লিউ বি. ইয়েটসের ‘সেইলিং টু বাইজান্টিয়াম’ কবিতায় এই পরিব্রাজনার কাঠামোচিত্র আরো ব্যাঞ্জনাময় হয়ে ওঠে। কবি লিখছেন—
‘থাকবো না আমি এই দেশে আর
চলে যাবো বাইজান্টিয়াম।’
এই এষণা পো বর্ণিত প্রাচীন রোমে ও গ্রীস সভ্যতা যাত্রার মতো রূপক। এর সঙ্গে জীবনানন্দের বিম্বিসার, বিদিশা, বিদর্ভ নগরের মিল দেখতে পাওয়া যায়।
‘বনলতা সেন’ কবিতায় এডগার এলান পো’র ‘টু হেলেন’ কবিতাটির চিত্রকল্পের প্রতিচ্ছবিটিটি উঠে এসেছে। জীবনানন্দের ‘চুল তার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’ই পো’র কবিতাটিতে পাওয়া যায়, ‘The hyacinth hair, the classic face’ রূপে। ‘শ্রাবস্তী’-’বিদিশা’ও গ্রীস ও রোমের স্মৃতিতে প্রতিরূপ লাভ করেছে, ‘To the glory that was Greece! And the grandeur that was Rome!’ অথচ সে-সব চিত্রকল্পের প্রতিরূপ লক্ষ করা গেলেও, তা যে তার অনুরূপ নয়, জীবনানন্দের চিত্রকল্পেই প্রতীয়মান।
জীবনানন্দের দাশের সবচেয়ে পরিচিত কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’-এর সংস্করণ দুটি। প্রথমটি ১৯৪২ সালে কবিতাভবন সংস্করণ এবং এর দশ বছর পর সিগনেট প্রেস-সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এ কাব্যগ্রন্থে জীবনানন্দের সময়বোধের নতুন ধারণা গভীরভাবে লক্ষনীয়। পূর্বের দুটি কাব্যগ্রন্থে ‘ঝরা পালক’ ও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, তিনি ইতিহাসকে লুকিয়ে রেখেছিলেন মৃত্যুবিলাসের মধ্যে। কিন্তু ‘বনলতা সেন’-এ এসে তিনি অকপটে প্রকাশ করেছেন ইতিহাস ও কালসচেতনতা। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং জীবনানন্দ দাশ বলতেই যে কবিতাটি আমাদের মস্তিষ্কে অনুরণিত হয়, তা হল- ‘বনলতা সেন’।
‘বনলতা সেন’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ তৎকালীন সময়ের বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেছেন অন্তর্মুখে। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯০৫ সালের দিকে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের অবিস্মরণীয় সূত্র Special theory of relativity প্রকাশের পর শুধুমাত্র বিজ্ঞান জগতে নয়, কবি-সমাজেও এক নিরব হৈচৈ পড়ে যায়। কারণ কবিতা লেখার উপাদান হিসেবে ‘সময়’ বা ‘কাল’ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেক্ষেত্রে আইনস্টাইনের তত্ত্ব প্রমাণ করেছে আমাদের চিরচেনা ত্রিমাত্রিক জগৎ আসলে ত্রিমাত্রিক নয়; প্রকৃতপক্ষে ‘সময়’ও এর সঙ্গে যুক্ত আছে। অর্থাৎ ‘সময়’ সহ আমাদের জগৎটি চতুর্মাত্রিক। এর ফলে শিল্প-সাহিত্যে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়; যা ‘subjective and relative reality’ দ্বারা নির্ধারিত। এখানে জেমস জয়েসের একটি উক্তি এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য- “….time and space are artificial and that all its related, and that art should be a symbol of that relationship.”
জীবনানন্দ দাশও ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় ‘কবিতা প্রসঙ্গে’ লেখেন: “মহাবিশ্বলোকের ইশারা থেকে উৎসারিত সময়চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো; কবিতা লিখবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি। এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই আমার কাছে।”
এ থেকে স্পষ্ট হয়- জীবনানন্দ বর্তমানকে খুঁজে নিয়েছেন অতীতের মাঝে। এবং সেখানে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্য্যের প্রাণপ্রাচুর্য বিদ্যমান রয়েছে।
‘বনলতা সেন’ কবিতায় অবশ্য আরো একটি বিখ্যাত ইংরেজি কবিতার ছায়াপাত দেখা যায়, এবং সেটা হলো কবি কীটসের সনেট (চতুর্দশপদী) ‘On First Looking into Chapman’s Homer’। এ কবিতার শুরুর কয়েকটি পংক্তি–
Much have I traveled in the realms of gold?
And many goodly states and kingdoms seen;
Round many western islands have I been
Which bards in fealty to Apollo hold.
বাংলা ভাষান্তরে-
অনেক ঘুরেছি আমি সুবর্ণ অঞ্চলে,
দেখেছি অনেক রাষ্ট্র, রাজ্য শুভময়;
পশ্চিমে অনেক দ্বীপে গেছি আমি চলে
যেথা অ্যাপোলোর স্তব চারণেরা গায়।
এই লাইন দুটি পড়ার জীবনানন্দের এই লাইনটি পড়ুন –
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
এখানে জীবনানন্দ কিছুটা সরাসরি আর কিছুটা বাক্যাংশ পাল্টে নিজের মত করে কবিতাটি লিখেছেন। যাকে বলে ডাইলিউশান।
এই পংক্তিগুলোর সঙ্গে ‘বনলতা সেন’-এর শুরুর পংক্তিগুলো মেলালেই কিছুটা সাদৃশ্যের বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে। কিন্তু তারপরও স্বীকার করে নিতে হবে, জীবনানন্দের অনন্যসাধারণ স্বকীয়তায় আরো গভীর থেকে গভীরের দিকে, ধূসর থেকে ক্রমধূসরতায়, ‘আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে’র পথে চলে যাওয়ার কথা।
এ বার পড়া যাক কীটসের কবিতা। কীটস লিখেছেন,
Then felt I like some watcher of the skies
When a new planet swims into his ken;
Or like stout Cortez when with eagle eyes
He star’d at the Pacific— and all his men
look’d at each other with a wild surmise—
Silent, upon a peak in Darien.
কীটস আরও লিখেছেন,
O! Let me have thee whole, all, all be mine!
That shape, that fairness, that sweet minor zest
Of love, your kiss; those hands, those eyes divine,
That warm, while, lucent, million-pleasured breast.
(I Cry Your Mercy, Keats)
এর পর জীবনানন্দের অবিস্মরণীয় লাইন,
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’
জীবনানন্দ আরও লিখেছেন,
শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন:
যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল…
তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনও
আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রে নীল,
দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা,
বিকেলের উপকন্ঠে সাগরের চিল,
নক্ষত্র, রাত্রির জল যুবাদের ক্রন্দন সব
শ্যামলী, করেছি অনুভব।
(শ্যামলী)
কীটসের hearing sense ভালো। কীটসের পর্যবেক্ষণক্ষমতাও অত্যন্ত শক্তিশালী। উপযুক্ত উপমা ও অলংকার ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে চিত্রকল্পনির্মাণ দ্বারা সেটাই বোঝা যায়। যেমন-
(1)
The clouds were pure and white as flocks new-shorn,
And fresh from the clear brook;sweety they slept
On the blue fields of heaven, and then there crept
A little noiseless noise amobg the leaves
Born of the very sigh that silence heaves
(I Stood Tiptoea, Keats)
(2)
Thou shalt see the field-mouse peep
Meagre from its called sleep,
And the snake all winter-thin
Cast on sunny bank its skin:
Freckled nest-eggs thou shalt see
Haching in the hawthorn tree…
(In Fancy, Keats)
(3)
In deepest grass, beneath the whisp’ ring roof
Of leaves and trembled blissoms, where there ran
A brooklet scarce espied:
(Ode to Psyche)
(4)
As late I rambled in the happy fields,
What time the skylark shakes the tremulous dew
From his lush clover covert (To Charles Wells),
rose-bloom fell on her hands
(The Eve of St. Agnes)
(4)
The boisterous, mid-night, festive clarion,
The kettle-drum, and far-heard clarionet
(The Eve of St. Anes, Keats)
কিটসের আর একটি কবিতার পংক্তি,
A bright torch, and a casement ope at night,
To let the warm Love in!’
(Ode to Psyche)
জীবনানন্দও লিখেছেন,
একদিন মনে হতো জলের মতন তুমি।
সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা…
তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল;
তোমার বুকের পরে আমাদের বিকেলের রক্তিম বিন্যাস;
তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর রাত;
নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।
(তোমাকে)
যাইহোক এবার পোর প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। একটি কবিতায় পো বলেছেন, তোমার স্মৃতি আমার নিকট সফেন সমুদ্রে দুর মায়াবী দ্বীপের মতন:
And thus thy memory is to me
Like some enchanted far-off isle
In some tumultuous sea …
(To F5)
স্পষ্টভাবে বোঝা যায় পোর লেখা ‘টু হেলেন’ ও জন কীটসের সনেট ‘On First Looking into Chapman’s Homer’ থেকেই ‘বনলতা সেন’ কবিতার উৎপত্তি হয়েছে। সুতরাং বলা যায় ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি জীবনানন্দের কোনো মৌলিক সৃষ্টি নয়। এডগার এলান পো, জন কীটস, উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস প্রভৃতি বিখ্যাত কবিতার পংক্তির মিশেলে এক অনবদ্য ভাবানুবাদ।
বনলতা সেন কবিতাটি জীবনানন্দ স্বয়ং ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। অনুবাদটি হল,
BANALATA SEN
Long I have been a wanderer of this world,
Many a night,
My route lay across the sea of Ceylon somewhat winding to
The seas of Malaya.
I was in the dim world of Bimbisar and Asok, and further off
In the mistiness of Vidarbha.
At moments when life was too much a sea of sounds,
I had Banalata Sen of Natore and her wisdom.
I remember her hair dark as night at Vidisha,
Her face an image of Sravasti as the pilot,
Undone in the blue milieu of the sea,
Never twice saw the earth of grass before him,
I have seen her, Banalata Sen of Natore.
When day is done, no fall somewhere but of dews
Dips into the dusk; the smell of the sun is gone
off the Kestrel’s wings. Light is your wit now,
Fanning fireflies that pitch the wide things around.
For Banalata Sen of Natore.
মার্কিন অনুবাদক ক্লিন্টন বি শেলীর ইংরেজি অনুবাদ,
For thousands of years I roamed the paths of this earth,
From waters round Sri Lanka, in dead of night, to seas up the Malabar Coast.
Much have I wandered. I was there in the gray world of Ashoka
And of Bimbisara, pressed on through darkness to the city of Vidarbha.
I am a weary heart surrounded by life’s frothy ocean.
To me she gave a moment’s peace—Banalata Sen from Natore.
Her hair was like an ancient darkling night in Vidisha,
Her face, the craftsmanship of Sravasti. As the helmsman when,
His rudder broken, far out upon the sea adrift,
Sees the grass-green land of a cinnamon isle, just so
Through the darkness I saw her. Said she, “Where have you been so long?”
And raised her bird’s-nest-like eyes—Banalata Sen from Natore.
At day’s end, like hush of dew
Comes evening. A hawk wipes the scent of sunlight from its wings.
When earth’s colors fade and some pale design is sketched,
Then glimmering fireflies paint in the story.
All birds come home, all rivers, all of life’s tasks finished.
Only darkness remains, as I sit there face to face with Banalata Sen.
জীবনানন্দ-গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ দাশ: পাণ্ডুলিপির কবিতা-২’ গ্রন্থের ভাষ্য মতে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির রচনাকাল হল ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ। তবে মজার বিষয় হল ‘বনলতা’ নামটি জীবনানন্দ কিন্তু প্রথম কবিতায় ব্যবহার করেননি। তাঁর ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ‘কারুবাসনা’ নামক উপন্যাসে বনলতা নামটি ব্যবহার করেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে লেখা একটি উপন্যাসে ‘বনচ্ছবি’ নামে আর একটি চরিত্র আছে। ১৯৪৬-৪৭ এর দিনলিপিতে একজন ‘বনলতা সেন’ এর নাম উল্লেখ আছে এইভাবে- “Frustration in Lit, Love, Herodias’ daughters, বনলতা সেন Imaginary women, Bus women and life impel me to invoke God.”
সুতরাং বোঝা যায় বনলতা সেন জীবনানন্দের কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়।
জীবনানন্দ বিভিন্ন সময় তাঁর কবিতা সংশোধন ও পরিমার্জনা করতেন। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিকেও জীবনানন্দ বেশ কয়েকবার পরিমার্জনা করেছেন। প্রথম পাণ্ডুলিপির সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান কবিতাটি মিলিয়ে পড়লে পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়। প্রথমে পংক্তি ছিল ‘শেষ হল জীবনের সব লেনদেন/বনলতা সেন।’ পরিমার্জিত কবিতাটি ১৯৩৫ সালের ডিসেম্বরে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় ছাপা হয়। বুদ্ধদেব বসুর কবিতাভবন থেকে ‘এক পয়সায় একটি’ নামে কবিতা পুস্তিকার সিরিজ প্রকাশ করতেন। এই সিরিজের আওতায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বই আকারে প্রকাশ হয় ‘বনলতা সেন’। তবে প্রকাশকের জায়গায় নাম ছিল জীবনানন্দের। বইটির প্রুফ দেখে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। বইটিতে ছিল মোটে ১২টি কবিতা। তবে জীবনানন্দের বইটি পছন্দ হয়নি। দুই বছর পর আবার ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রকাশিত নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’তে স্থান পায় ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি। এতেও জীবনানন্দ সন্তুষ্ট হননি। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত ‘বনলতা সেন’। প্রকাশ করে সিগনেট প্রেস। আগের ১২টির সঙ্গে আরও নতুন ১৮টি কবিতা যোগ হয় এই কাব্যগ্রন্থে। প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এ কাব্যগ্রন্থটিই ‘বনলতা সেন’-এর পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ সংস্করণ। এখন বাজারে ‘বনলতা সেন’ এর সেই সংস্করণের প্রতিলিপিটিই কাব্যগ্রন্থ আকারে পাওয়া যায়। সেই সময়ে কাব্যগ্রন্থটির চরম সমালোচনাও হয়েছিল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, রঞ্জিৎ সিংহ, পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়, আলোক সরকার এই কবিতার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। এমনকি ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও করা হয়েছে। সব চেয়ে বেশি তীর্যক মন্তব্য করেছিলেন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক ও সুসাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি নিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’তে লেখা হয়, “এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল_কবিতা লিখিতে লিখিতে অকস্মাৎ অকারণে এক একজন ভদ্রলোকের মেয়ের নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক ও উৎসাহিত করিয়া তোলেন।…ইহার সূত্রপাত হইয়াছে নাটোরের ‘বনলতা সেন’কে লইয়া।” (শনিবারের চিঠি, বৈশাখ ১৩৪৪)।
তবে অবশ্য জীবনানন্দ দাশ ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে আকস্মিক মৃত্যুর পর সজনীকান্ত দাস ‘শনিবারের চিঠি’তে তাঁর প্রশংসাই করেছিলেন।
যাইহোক জীবনানন্দ দাশের আরও কবিতা রয়েছে যেগুলি বিদেশি অনুকরণে লেখা হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,
পথের পাতার মতো তুমিও তখন।
আমার বুকের ‘পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন,
সেদিন তোমার!
তোমার আকাশ-আলো-জীবনের ধার
ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল?
(নির্জন স্বাক্ষর : ধূসর পাণ্ডুলিপি)
কখনো পাই জলময় মৃত নারীর দ্যোতনা (শব : মহাপৃথিবী) অথবা জলতলের বন্দী কলমীলতার জালে জড়ানো প্রেতিনীর মতো ক্রন্দনময়ী কণ্ঠের আভাস (রূপসী বাংলা : একদিন জলসিঁড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে)।
এইসব কবিতায় এডগার অ্যালান অ্যালান পোর লেখার প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায়। যেমন পো এক জায়গায় লিখেছেন,
Be silent in that solitude,
Which is not loneliness for then
The spirit of the dead who stood
In life before thee are again
In death around thee-and their will
Shall overshadow thee : be still.
(Spirits of the Dead)
“মৃতেরা আবার জাগিয়াছে” এই ধ্বনিকল্প জীবনানন্দ ব্যবহার করেছেন (প্রেম : ধূসর পাণ্ডুলিপি) এছাড়াও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ গ্রন্থের ‘জীবন’ নামক কবিতাটি থেকে কিছু পংক্তির উপর দৃষ্টিপাত করা যাক।
কবরের থেকে শুধু আকাঙক্ষার ভূত লয়ে খেলা
… … … … … … … … … … … …
মড়ার চোখের রঙ সকল পৃথিবী থাকে ভ’রে
যে মরে যেতেছে তার হৃদয়ের সব শেষ শ্বাস
সকল আকাশ আর পৃথিবীর থেকে পড়ে ঝ’রে।
… … … … … … … … … … … …
মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহূরে আঁধারে
জীবন ডাকিতে আসে;
এডগার অ্যালান অ্যালান পোর কবিতার মধ্যে অতিপ্রাকৃত বিষয়ের বিশেষ স্থান ছিল; যেমন প্রেতযোনি, পরিত্যক্ত সমাধি বা ভগ্ন প্রাসাদ অথবা ব্যাধির পরিকল্পনায় পো বিশেষভাবে আনন্দলাভ করতেন। মৃত্যুর এই চিরন্তন শব্দগুলি জীবনানন্দের কবিতাতেও লক্ষ্য করা যায়। ‘জীবন’ (ধূসর পাণ্ডুলিপি) কবিতার পংক্তিগুলির মধ্যে স্থানবিশেষে যে পোর ‘Spirits of the Dead’ কবিতার কিছু প্রত্যক্ষ স্পর্শ অনুভব করা যায়। ‘জীবন’ কবিতায় ঘাসের থেকে শিশিরের মতো শব্দগুলি পো ব্যবহার করছেন “like dew-drops from the grass” এই শব্দগুলি। ‘The Haunted Palace’ কবিতায় পো এক প্রেতজগতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করছেন। এই জগতের অনুরূপ সংকেত আমরা পাই জীবনানন্দের ‘শঙ্খমালা’ (বনলতা সেন) কবিতায়। এইরকম বেশকিছু কিছু প্রেতসত্য জীবনানন্দের কবিতায় লক্ষ্য করা যায় যা পোর কবিতার প্রেতসত্য ও ভৌতিক পরিবেশ আমাদের চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে। “শীতরাতে গাছের শাখা নড়ে মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন” (সহজ : ধূসর পাণ্ডুলিপি); নারীকে কঙ্কালের হাতে সমর্পণের প্রস্তাবনা (স্থবির যৌবন : মহাপৃথিবী); এক ভগ্নপ্রাসাদের অবশেষ যেখানে শেয়াল পেঁচার ক্রন্দন (বিভিন্ন কোরাস : মহাপৃথিবী); জোৎস্নারাতে বাতাসে এক ছায়াময় অশ্বারোহীর খুরধ্বনি (রূপসী বাংলা : পৃথিবী রয়েছে ব্যস্ত কোনখানে সফলতা শক্তির ভিতর)। এইসব পংক্তির অশরীরী পরিবেশ আমাদের চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে।
জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,
হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
পো লিখেছেন,
BELOVED! amid the earnest woes
That crowd around my earthly path—
(Drear path, alas! where grows
Not even one lonely rose)—
My soul at least a solace hath
In dreams of thee, and therein knows
An Eden of bland repose.
সুতরাং দেখা যায় পোর দ্বারা জীবনানন্দ দাশ বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
জীবনানন্দ দাশ এবং টি. এস. এলিয়ট
এলিয়ট বিংশ শতাকের অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর কবিতার মধ্যে আধুনিক কবিতার অনেক নিয়ম দেখা যায়, সেই নিয়মকে জীবনানন্দ দাশ মহৎ বলে উল্লেখ করেছেন। জীবনানন্দ দাশের ‘কবিতার কথা’ নামক গ্রন্থে এলিয়টের বার বার উল্লেখ আছে। তিনি The; Hollow Men থেকে উদ্ধৃত করেছেন। জীবনানন্দের কবিতায় এলিয়টের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন এলিয়টের কবিতা,
The brown waves of fog toss up to me
Twisted faces from the bottom of the street,
And lear from a passerby with muddy skirts
An aimless smile that hovers in the air
And vanishes along the level of the roofs.
(Morning at the Window : Prufrock, 1917)
এই কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনানন্দ লিখেছেন,
অনেক রাত হয়েছে—অনেক গভীর রাত হয়েছে;
কলকাতার ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে—ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে –
কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো
এই যে-ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে।
পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ
অনুভব করে হাঁটছি আমি।
(ফুটপাথে : মহাপৃথিবী)
জীবনানন্দের এই কবিতা ও এলিয়টের কবিতার প্রেক্ষাপট অভিন্ন। দুটি কবিতার মধ্যেই নগরকেন্দ্রীক জীবনযাত্রার কথা উঠে এসেছে। ট্রামলাইলনে নাগরকেন্দ্রীক মানুষের জীবনযন্ত্রণা এই কবিতায় বিদ্যমান। এছাড়াও এলিয়টের ‘Sweeny Erect’ কবিতাটিও লক্ষ্য করা যেতে পারে। এখানে এলিয়ট লিখেছেন,
The ladies of the corridor
Find themselves involved, disgraced,
Call witness to their principles
And deprecate the lack of taste.
(Poems)
এই কবিতার সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের ‘রাত্রি’ কবিতার তুলনা করা যেতে পারে। জীবনানন্দ লিখেছেন,
হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল;
অথবা সে-হাইড্র্যান্ট হয়তো বা গিয়েছিলো ফেঁসে
এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে।
একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে
অস্থির পেট্রল ঝেড়ে; সতত সতর্ক থেকে তবু
কেউ যেন ভয়াবহভাবে প’ড়ে গেছে জলে।
তিনটি রিক্শ ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাসল্যাম্পে
মায়াবীর মতো জাদুবলে।
আমিও ফিয়ার লেন ছেড়ে দিয়ে— হঠকারিতায়
মাইল-মাইল পথ হেঁটে— দেয়ালের পাশে
দাঁড়ালাম বেণ্টিঙ্ক স্ট্রিটে গিয়ে— টেরিটিবাজারে;
চীনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বাতাসে।
মদির আলোর তাপ চুমো খায় গালে।
কেরোসিন কাঠ, গালা, গুনচট, চামড়ার ঘ্রাণ
ডাইনামোর গুঞ্জনের সাথে মিশে গিয়ে
ধনুকের ছিলা রাখে টান।
টান রাখে মৃত ও জাগ্রত পুথিবীকে।
টান রাথে জীবনের ধনুকের ছিলা।
শ্লোক আওড়ায়ে গেছে মৈত্রেয়ী কবে;
রাজ্য জয় ক’রে গেছে অমর আত্তিলা।
নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরের জানালার থেকে
গান গায় অধো জেগে ইহুদী রমণী;
পিতৃলোক হেসে ভাবে, কাকে বলে গান—
আর কাকে সোনা, তেল, কাগজের খনি।
ফিরিঙ্গি যুবক কটি চ’লে যায় ছিমছাম।
থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে;
হাতের ব্রায়ার পাইপ পরিষ্কার ক’রে
বুড়ো এক গরিলার মতন বিশ্বাসে।
নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়
লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।
তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব— অতিবৈতনিক,
বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত।
(রাত্রি : সাতটি তারার তিমির)
এলিয়ট লিখেছেন,
1.
The winter evening settles down
With smell of steaks in passageways.
Six o’clock.
The burnt-out ends of smoky days.
And now a gusty shower wraps
The grimy scraps
Of withered leaves about your feet
And newspapers from vacant lots;
The showers beat
On broken blinds and chimney-pots,
And at the corner of the street
A lonely cab-horse steams and stamps.
And then the lighting of the lamps.
2.
The morning comes to consciousness
Of faint stale smells of beer
From the sawdust-trampled street
With all its muddy feet that press
To early coffee-stands.
With the other masquerades
That time resumes,
One thinks of all the hands
That are raising dingy shades
In a thousand furnished rooms.
3.
You tossed a blanket from the bed,
You lay upon your back, and waited;
You dozed, and watched the night revealing
The thousand sordid images
Of which your soul was constituted;
They flickered against the ceiling.
And when all the world came back
And the light crept up between the shutters
And you heard the sparrows in the gutters,
You had such a vision of the street
As the street hardly understands;
Sitting along the bed’s edge, where
You curled the papers from your hair,
Or clasped the yellow soles of feet
In the palms of both soiled hands.
4.
His soul stretched tight across the skies
That fade behind a city block,
Or trampled by insistent feet
At four and five and six o’clock;
And short square fingers stuffing pipes,
And evening newspapers, and eyes
Assured of certain certainties,
The conscience of a blackened street
Impatient to assume the world.
I am moved by fancies that are curled
Around these images, and cling:
The notion of some infinitely gentle
Infinitely suffering thing.
Wipe your hand across your mouth, and laugh;
The worlds revolve like ancient women
Gathering fuel in vacant lots.
সুতরাং দেখা যায় এলিয়টের নাগরিক কবিতার সঙ্গে জীবনানন্দের নাগরিক কবিতার সংযোগ রয়েছে। যা নিরুপন করা সহজসাধ্য।
একটি কবিতায় এলিয়ট লিখেছেন লিখেছেন,
Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherized upon a table;
এলিয়টের মতোই জীবনানন্দের কাব্যচেতনাকে ভারাক্রান্ত করেছে। জীবনানন্দ লিখেছেন,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি—ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়—স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে, শুক্লাকাশে নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক
তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!
(নীলিমা, ঝরা পালক)
অন্য একটি কবিতায় এলিয়ট লিখেছেন,
What is the city over the mountains?
Cracks and reforms and bursts in the violet air
Falling towers
Jerusalem Athens Alexandria
Vienna London
Unreal
অপরদিকে জীবনানন্দও লিখেছেন,
পশ্চিমে প্রেতের মতন ইউরোপ;
পূব দিকে প্রেতায়িত এশিয়ার মাথা;
আফ্রিকার দেবতাত্মা জন্তুর মতন ঘনঘটাচ্ছন্নতা;
(রাত্রির কোরাস, সাতটি তারার তিমির)
এলিয়ট লিখেছেন,
‘Lilacs out of the dead land’ ,
‘And the dead tree gives no shelter’
এলিয়টের এই কবিতার চিত্রকল্প পাওয়া যায় জীবনানন্দের কবিতায়। জীবনানন্দ লিখেছেন,
ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন — ক্ষেত মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম — সাপের খোলস নীড় শীত।
এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ — কেমন নিবিড়।
(ধান কাটা হয়ে গেছে, বনলতা সেন)
কিংবা
হেমন্ত ফুরায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে;
এ-রকম অনেক হেমন্ত ফুরায়েছে
সময়ের কুয়াশায়;
(নাবিকী, সাতটি তারার তিমির)
এলিয়টের কবিতায় নরক থেকে উদ্ধারের আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। এলিয়টের কবিতা ‘concept of purgatory’ এর মধ্যে যে শুদ্ধিচিন্তা আছে সেখানে মহাকবি দান্তের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এলিয়ট লিখেছেন,
Teach us to care and not to care Teach us to sit still,
Pray for us sinners now and at the hour of our death
Pray for us now and at the hour of our death.
(Ash Wednesday)
অনুরূপ জীবনানন্দও বলেছেন,
মানুষের সভ্যতার বয়ঃসন্ধি দোষ
হয়তো কাটেনি আজো, তাই
এরকমই হতে হবে আরো রাত্রি দিন;-
নক্ষত্র সূর্যের সাথে সঞ্চালিত হয়ে তবু আলোকের পথে
মৃত ম্যামথের কাছে কুহেলিত ঋণ
শেষ ক’রে মানুষ সফল হতে পারে
উৎসাহ সংকল্প প্রেমে মূল্যের অক্ষুন্ন সংস্কারে;
আশা করা যাক।
সুধীরাও সেই কথা ভাবে,
আপ্রাণ নির্দেশ দান করে।
ইতিহাসে ঘুরপথ ভুল পথ গ্লানি হিংসা অন্ধকার ভয়
আরো ঢের আছে, তবু মানুষকে সেতু থেকে সেতুলোক পার হতে হয়।
জীবনানন্দ আরও লিখেছেন,
হে পাবক, অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে
তোমার পবিত্র অগ্নি জ্বলে।
অমাময়ী নিশি যদি সুজনের শেষ কথা হয়,
আর তার প্রতিবিম্ব হয় যদি মানব-হৃদয়,
তবুও আমার জ্যোতি সৃষ্টির নিবিড় মনোবলে
জ্ব’লে ওঠে সময়ের আকাশের পৃথিবীর মনে;
বুঝিছি ভোরের বেলা রোদে নীলিমায়,
আঁধার অরব রাতে অগণন জ্যোতিষ্ক শিখায়;
মহাবিশ্ব একদিন তমিস্রার মতো হ’য়ে গেলে,
মুখে যা বলোনি, নারি, মনে যা ভেবেছো তার প্রতি
লক্ষ্য রেখে অন্ধকার শক্তি অগ্নি সুবর্ণের মতো
দেহ হবে মন হবে-তুমি হবে সে-সবের জ্যোতি!
(মাঘসংক্রান্তির রাতে)
এলিয়ট ১৯৪৩ সালে রচিত ‘দি সোশ্যাল ফাংশান অফ পোয়েট্রি’ নামক প্রবন্ধের মধ্যে লিখেছেন, “he is also individually different from other people , and from other poets too, and can make his readers share consciously in new feelings which they had not experienced before ..” (On Poetry and Poets)
এলিয়টের এই ভাবনার সঙ্গে সাদৃশ্যতা দেখা যায় জীবনানন্দের নিম্নলিখিত কবিতায়,
ফুরায়েছে পুরনো তা —
কোনো এক নতুন কিছুর
আছে প্রয়োজন,
তাই আমি আসিয়াছি, আমার মতন
আর নাই কেউ!
(কয়েকটি লাইন)
সময় চেতনার রূপায়নে জীবনানন্দ অনেকটা এলিয়টকে অনুসরণ করেছেন। ‘মহাপৃথিবী’ ও ‘সাতটি তারার তিমির’ এর যুগে জীবনানন্দের ‘উজ্জ্বল সময় ঘড়ি’র প্রসঙ্গে তিনি এলিয়টকে অনুসরণ করেছেন। ঘড়ি নিরন্তর চক্রাকারে ঘুরে চলেছে। অতীত থেকে বর্তমান, বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ আবার ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে। এলিয়ট তাঁর ‘ফোর কোয়ার্টেস’ কবিতার মধ্যে বলেছেন,
Time present and time past
Are both perhaps present in time future
এলিয়টের এই ভাবনার সাযুজ্য পাওয়া যায় জীবনানন্দের নিন্মলিখিত কবিতায়,
আমাদের মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
কাচের গেলাসে জলে উজ্জ্বল শফরী;
সমুদ্রের দিবারৌদ্রে আরক্তিম হাঙরের মতো;
তারপর অন্য গ্রহ নক্ষত্রেরা আমাদের ঘড়ির ভিতরে
যা হয়েছে, যা হতেছে, অথবা যা হবে সব এক সাথে প্রচারিত করে।
সৃষ্টির নাড়ীর ‘পরে হাত রেখে টের পাওয়া যায়
অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে র’য়ে গেছে অমোঘ আমোদ;
তবু তা’রা করেনাকো পরস্পরের ঋণশোধ।
(আবহমান/জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা)
জীবনানন্দের এলিয়টকে অনুকরণ প্রসঙ্গে মঞ্জুভাষ মিত্র লিখেছেন, “এলিয়টের Tradition and the Individual Talent প্রবন্ধটি (The Sacred Wood 1919) নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এলিয়ট তাঁর উক্ত প্রবন্ধে জানিয়েছেন : ‘The historical sense which is a sense of timeless as well as the temporal and of the timeless and of the temporal together, is what makes a writer a writer tradition.’ অন্যদিকে জীবনানন্দ তাঁর ‘কবিতার কথা’য় বলেছেন, “কবির পক্ষে সমাজককে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।”
এলিয়টের সেই ইতিহাসচেতনা জীবনানন্দের কবিতায় বার বার উচ্চারিত হয়েছে। ইতিহাসযাপন জীবনানন্দের মানসে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেছে। যেমন উর, ব্যাবিলন, নিনেভে, মিশর, পেগান গ্রীস, কনফুসিয়াসের চীন থেকে বিদিশা, উজ্জয়িনী বা ধর্মাশোকের ভারতবর্ষ প্রভৃতি স্থানে জীবনানন্দের অবাধ বিচরণ। অবশ্য জীবনানন্দ দাশও ঐতিহ্য ও ইতিহাসচেতনার মধ্যে সত্তার শূন্যতাবোধে স্মৃতির আশ্রয় নয়, বরং স্মৃতির মধ্যে সত্তাকে খুঁজে পাওয়ার চেতনা বিস্তার লাভ করে। তাঁর কবিসত্তায় ‘exile, anguish, ignominy & misery’ অর্থাৎ নির্বাসন, যন্ত্রণা, অপমান ও দারিদ্রের আধুনিক বস্তুবিশ্ব থেকে মুক্তির দিশায় স্বকীয় মানসের সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আকাশ গড়ে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সেখানে ‘বনলতা সেন’-এর ‘হাজার বছর ধরে আমি হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’ র বিস্তার থেকে ‘রূপসী বাংলা’র ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়’-এর প্রত্যাশা সবই আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে।
এলিয়টও তাঁর প্রবন্ধে ঐতিহ্য ও সময়চেতনার অর্থ বিশদ করেছেন। ঐতিহ্য শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ। একে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায় না, এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক বোধ এবং ঐতিহাসিক বোধ বলতে শুধু অতীতের অতীতত্ব বোঝায় না তার বর্তমানত্বও বোঝায়; ঐতিহাসিক অনুভূতি একজন মানুষকে লিখতে বাধ্য করায় শুধু তার হাড়ের মধ্যে নিজস্ব প্রজন্মের অস্তিত্ব অনুভব করে নয়, বরং এমন একটি অনুভূতি নিয়ে যেখানে তাবৎ ইয়োরাপের সাহিত্য হোমার থেকে শুরু করে ও তৎসহ তার নিজের সাহিত্যের পূর্ণবৃত্তটি একটি পাশাপাশি অস্তিত্ব ও নিয়ম প্রতিষ্ঠা করে। ঐতিহাসিকবোধ হচ্ছে সময়াতীতের ধারণা ও সাময়িকের ধারণা এবং যুগপৎ সময়াতীত ও সাময়িকের ধারণা, তাই-ই একজন লেখককে ঐতিহ্যগামী করে। অতএব ঐতিহ্য, ইতিহাসচেনা, সময়চেতনা তথা কালচেতনা প্রভৃতি শব্দগুলি নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। একজন আধুনিক কবি অবশ্যই ইয়োরাপীয় ও ইংরাজী সাহিত্যপ্রবাহ সচেতনভাবে অনুভব করবেন, অতীত হবে বর্তমান দ্বারা পরিবর্তিত যেমন বর্তমান হবে সতত অতীত দ্বারা নির্দেশিত। “No poet no artist of any art, has his complete meaning alone.” কোনো কবি কোনো শিল্পীই একা-একা নিজের সম্পূর্ণ অর্থ খুঁজে পান না। তাঁকে অতীত ও বর্তমানে, স্বদেশের ও বিদেশের কবিদের সঙ্গে তুলনাসূত্রে আক্ষিপ্ত হতে হয়। এলিয়টের এই মূলতত্ত্ব জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘কবিতার কথা’ নামক গদ্যগ্রন্থে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার বলেছেন। “কবির পক্ষে সময়কে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতর থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।” (উত্তররৈবিক বাংলা কাব্য, ১৩৫২)। অথবা অন্যত্র যেমন বলেছেন কবিতা লিখতে হলে ইমাজিনেশন অর্থাৎ কল্পনাপ্রতিভা বা ভাবপ্রতিভার দরকার, কিন্তু “এ জিনিস ইতিহাসচেতনায় সুগঠিত হওয়া চাই।” (কবিতাপ্রসঙ্গে, ১৩৫৩)। একই প্রবন্ধে আবার নিজের কবিতার স্বরূপ প্রসঙ্গে আলোকপাত করে বলছেন, “মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময়চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক সত্যের মতো; কবিতা লিখবার পথে। কিছুদূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি গ্রহণ করেছি।” জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন আধুনিককালে আমরা এক তুমুল জটিল পৃথিবীতে বাস করছি, কবিতা লিখবার জন্য অনেক। উৎসে অবগাহনের প্রয়োজন হয় এবং সে-সবের সম্মিলিত সম্বন্ধশৃঙ্খলা থেকেই প্রেরণার জন্ম হয়। একজন বিংশ শতকীয় বাঙালী কবির আগাগোড়া বাংলা কাব্যের সঙ্গে আত্মীয়তা দরকার, তারি সঙ্গে দরকার ইংরাজী, ফরাসী প্রভৃতি কবিতার মর্ম উপলব্ধি করা (দ্রষ্টব্য : অসমাপ্ত আলোচনা, ১৩৬০)। [তথ্যসূত্রঃ আধুনিক বাংলা কবিতায় ইয়োরোপীয় প্রভাব, পৃষ্ঠা-৭৮]
আধুনিক এলিয়টের কবিতার সঙ্গে জীবননানন্দের কবিতার বিন্দু যে এক তা সহজেই অনুমান করা যায়। ইলিয়টের কবিতায় ইতিহাসচেতনা ও জীবনানন্দের কবিতায় ইতিহাসচেতনা এক। এক্ষেত্রে জীবনানন্দ এলিয়টকে অনুকরণ করেছেন।
এলিয়টের কবিতার পংক্তি,
In that open field
If you do not come too close,
if you do not come to close
On a summer midnight, you can hear the music
Of the weak pipe and the little drum
And see them dancing around bonfire
The association of man and woman
… … … … … … … … … … … …
Round and round the fire
Leaping through the flames, or joined in circles,
Rustically solemn or in rustic laughter
Lifting heavy feet in clumsy shoes,
Earth feet, loam feet, lifted in country mirth
Mirth of those long since under earth
Nourishing the corn.
(East Coker I : Four Quatrets, 1940)
জীবনানন্দও তাঁর কবিতায় লিখেছেন,
মাঝে মাঝে প্রান্তরের জ্যোৎস্নায় তারা সব জড়ো হয়ে যেত
কোথাও সুন্দর প্রেতসত্য আছে জেনে তবু পৃথিবীর মাটির কাকালে
কেমন নিবিড়ভাবে বিচলিত হয়ে ওঠে, আহা।
সেখানে স্থবির যুবা কোনো এক তন্বী তরুণীর
নিজের জিনিস হতে স্বীকার পেয়েছে ভাঙা চাঁদে
অর্ধ সত্যে অর্ধ নৃত্যে আধেক মৃত্যুর অন্ধকারে;
অনেক তরুণী যুবা-যৌবরাজ্য যাহাদের শেষ
হয়ে গেছে—তারাও সেখানে অগণন
চৈত্রের কিরণে কিম্বা হেমন্তের আরো
অনবলুষ্ঠিত ফিকে মৃগতৃষ্ণিকার
মতন জ্যোৎস্নায় এসে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে প্রান্তরের পথে
চাদকে নিখিল করে দিয়ে তবু পরিমেয় কলঙ্কে নিবিড়
করে দিতে চেয়েছিল, …..
(ইতিহাসযান: বেলা অবেলা কালবেলা)
এলিয়টের এই কবিতার প্রতি লক্ষ্য করলে বোঝা যায় জীবনানন্দ এলিয়টের এইসব পংক্তি এবং কবিতা ভালোভাবেই পাঠ করেছিলেন, ফলে তাঁর মনে ইয়েটসের এইসব সংকেত ও চিত্রকল্প সহজেই প্রবেশ করেছে। এলিয়টের কবিতাটিকে জীবনানন্দের ‘ইতিহাসযান’ কবিতার পাশাপাশি রেখে পড়লেই বোঝা যায় জীবানানন্দের কবিতাটির উৎস এলিয়টের কবিতা।
জীবনানন্দ দাশ ও টি. এস. এলিয়টের কবিতার মধ্যে আরও সাদৃশ্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। ইয়েটসের কবিতা,
“Headpiece filled with straw. Alas!”
(The Hollow Man, 1925)
এবং
“সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয় আজ ঘাস”
(আকাশলীনা : সাতটি তারার তিমির)।
অথবা একই বাক্য বা বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তিমূলক এলিয়টের কবিতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় প্রয়োগ করেছেন। যেমন এলিয়ট লিখেছেন,
Because I do not hope to turn again
Because I do not hope
Because I do not hope to turn.
(Ash-Wednesday 1930)
এলিয়ট ‘Waste land’ কবিতায় লিখেছেন,
Here is no water but only rock
Rock and no water and the sandy road
The road winding above among the mountains
Which are mountains of rock without water….
(Waste land)
এই কবিতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনানন্দও একই পংক্তি পুনরাবৃত্তি করে লিখেছেন,
সে-আগুন জ্বলে যায় দহেনাকো কিছু।
সে আগুন জ্বলে যায়
সে আগুন জ্বলে যায়।
সে আগুন জ্বলে যায় দহেনাকে কিছু।
(একটি কবিতা, সাতটি তারার তিমির)
‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন,
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।
(আট বছর আগের একদিন, মহাপৃথিবী)
‘আমাকে তুমি’ কবিতায় লিখেছেন,
পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়।
তারপর
দূরে
অনেক দূরে
খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানে— গান গায়— গান গায়
এই দুপুরের বাতাস।
(বনলতা সেন)
পংক্তির পুনরাবৃত্তিমূলক কৌশলটির আবিস্কার করেছেন এলিয়ট। এলিয়ট এই কৌশলটি সফলভাবে তাঁর কবিতায় প্রয়োগ করেছেন। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ এলিয়টের এই কৌশলকে অনুসরণ করেছেন। এছাড়াও কবিতায় বিভিন্ন স্থানের নাম বর্ণনায় জীবনানন্দ এলিয়টের কৌশল গ্রহণ করেছেন। এলিয়টের কবিতায় লন্ডন শহরের বর্ণনা যেভাবে পাওয়া যায় অনুরূপ জীবনানন্দের কবিতায় “কলকাতা টোকিয়ো দিল্লী মস্কৌ, অতলান্তিকের কলরব” প্রভৃতি বর্ণনা পাওয়া যায়। কবিতায় এইসব রীতিগুলি এক হিসাবে এলিয়টই প্রথম আবিস্কার করেন। এক কথায় এলিয়টের কবিতায় জীবনানন্দ দাশ চরমভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
শুধুমাত্র কাব্যনির্মাণ বা কাব্যদর্শণের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ এলিয়টের সমর্থক ও অনুসারী ছিলেন না কাব্যতত্ত্বের কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর অনুসারী ছিলেন। এলিয়টের ‘historical sence’ বা ইতিহাসচেতনাকে জীবনানন্দও সমর্থন করেছেন। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে জীবনানন্দের কাব্যে এলিয়টের প্রভাব যথেষ্ট লক্ষ্য করা যায়। ‘কবিতার কথা’ নামক প্রবন্ধে এই প্রভাবের কথা জীবনানন্দ অকপটে স্বীকার করেছেন।
জীবনানন্দ দাশ এবং শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-৬৭)
জীবনানন্দ দাশ বোদলেয়ার ও ফরাসী প্রতীকী কবিদের যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। জীবনানন্দ স্বয়ং লিখেছেন, “মধুসূদন যেমন বিদেশী সাহিত্যিকদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে ঋণী রবীন্দ্র-বঙ্কিমও তাদের কাছে অম্লাধিক গিয়েছিলেন বর্তমান কবিদেরও পরস্পরনিঃসক্ত বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী তেমনি বোদলেয়ার ও ফরাসী প্রতীকী কবিদের থেকে শুরু করে ইয়েটস, এলিয়ট ও পাউণ্ডের কাছে গেল খানিকটা হৃদয়ের সাহচর্য ও কিছুটা অভিনবত্বের গরিমা সে সব জায়গায় খুঁজে পেয়েছে বলে” (কবিতার কথা : উত্তররৈবিক কাব্য, ১৩৫২)
একটি প্রবন্ধে জীবনানন্দের এই উচ্চারণ ফরাসী কবিতার কাছে বাংলা কবিতার ঋণ স্বীকার করেছেন। জীবনানন্দ দাশের অনেক পংক্তিকে বোদলেয়ারের সঙ্গে প্রতিতুলনায় অতি সুন্দরভাবে সমস্থাপন করা যেতে পারে।
আলো অন্ধকারে যাই ভিতরে
স্বপ্ন নয়,—কোন এক বোধ কাজ করে।
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ মনে হয়,—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়।
শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়!
(বোধ : ধূসর পাণ্ডুলিপি)
এই কবিতায় জীবনানন্দ দাশ বোদলেয়ার থেকে ভালোভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এই কবিতায় যে ধরণের মানসিক ভঙ্গি চিহ্নিত করা হয়েছে তা সর্বপ্রথম বোদলেয়ারই কবিদের বুঝতে শেখান।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ‘নারী’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। বনলতা সেন, শেফালিকা বোস, অরুণিমা সান্যাল থেকে শুরু করে সুচতেনা, শ্যামলী, সবিতা, সরোজিনী নানা নারীনাম ও নারীসংকেত তাঁর কবিতায়। এই সবেও বোদলেয়ার যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
জীবনানন্দ লিখেছেন,
পৃথিবীর সেই মানুষীর রূপ?
স্থূল হাতে ব্যবহৃত হয়ে ব্যবহৃত ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়ে
ব্যবহৃত ব্যবহৃত-
আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা হো-হো করে হেসে উঠলো,
ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়ে শুয়ারের মাংস হয়ে যায়?’
হো-হো করে হেসে উঠলাম আমি!
(আদিম দেবতারা : মহাপৃথিবী)
জীবনানন্দ দাশ নারী সম্পর্কে যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার সাদৃশ্যতামূলক পংক্তি পাওয়া যায় বোদলেয়ার কবিতার মধ্যে। বোদলেয়ার লিখেছেন “আমি উন্মত্তের মতো ভালোবাসি এবং ঘৃণা করি।”
জীবনানন্দ দাশ নারী সম্বন্ধে যে ধারণা পোষণ করতেন তা বোদলেয়ার কবিতা পাঠে আরও সংগঠিত হয়। জীবনানন্দ বোদলেয়ারের কবিতা থেকে নানা উপাদান সংগ্রহ করে প্রতিভার নিজস্ব মৌলিকতায় নতুনভাবে কবিতার সৃষ্টি করেছেন-
অন্তরঙ্গ করে নিয়ে বানায়েছে নিজের শরীর
চুলের ভিতরে উঁচু পাহাড়ের কুসুম বাতাস
দিনগত পাপক্ষয় ভুলে গিয়ে হৃদয়ের দিন
ধারণ করেছে তার হৃদয়ের ফাঁস।
… … … … … … … … … … … …
না ভেবে মানুষ কাজ করে যায় শুধু
ভয়াবহভাবে অনায়াসে।
কখনো সম্রাট শনি শেয়াল ও ভাঁড়
সেনারীর রাঙ দেখে হো হো করে হাসে।
(বেলা অবেলা কালবেলা : মহিলা)
জীবনানন্দের এই কবিতায় বোদলেয়ারের নারীবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি ও নারী চেতনার সাদৃশ্যতা লক্ষ্য করা যায়। অধুনিক কবিতায় বোদলেয়ার যা উদ্ভাবন করেছেন তা অনুসরণ করেছেন জীবনানন্দ।
বোদলেয়ারের কাব্যে কবির যে বিলাপ লক্ষ্য করা যায় তা হল,
O sorrow, sorrow! Time eats life away,
The Foe obscure which does our hearts consume
Grows stronger from our blood and decay!
(L’ENNEMI : SPLEEN ET IDE’AL)
জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেও বোদলেয়ারের মত বেদনার সুর লক্ষ্য করা যায়। এই ভঙ্গিটি বোদলেয়ারই আধুনিক কবিদের উপহার দিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ বোদলেয়ারের এই উদ্ভাবনকে অনুসরণ করে লিখেছেন,
শীতরাত ঢের দূরে—অস্থি তবু কেঁপে ওঠে শীতে!
শাদা হাত দুটো শাদা হাড় হয়ে মৃত্যুর খবর
একবার মনে আসে,-চোখ বুজে তবু কি ভুলিতে
পারি এই দিনগুলো!—আমাদের রক্তের ভিতর
বরফের মত শীত, আগুনের মত তবু জ্বর!
(জীবন : ধূসর পাণ্ডুলিপি)
এছাড়াও জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘রাত্রি’ কবিতায় বোদলেয়ারের রীতি অনুসরণ করেছেন।
নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তত উপরের জানালার থেকে
গান গায় আধো জেগে ইহুদি রমণী;
পিতৃলোক হেসে ভাবে, কাকে বলে গান
আর কাকে, সোনা, তেল, কাগজের খনি।
(সাতটি তারার তিমির)
এই কবিতাতেও বোদলেয়রীর শহর পরিক্রমার সুর বেজে ওঠে। অন্ধকার নেমে আসে, গণিকাবৃত্তি তার ডানা বিস্তার করে:
Meanwhile darkness dawns, filled with demons familiars
Who rousc, reluctant as business men, to their affairs,
Their ponderous flight rattling the shatters and the blinds.
Against the lamplight, whose shivering is the wind’s,
Prostitution sprcads its light and life in the streets :
(LE CRÉPUSCULE DU SOIR :
COMES THE CHARGING EVENING : T. P.)
জীবনানন্দের বিখ্যাত ‘বনলতা সেন’ নামক কবিতায় আছে “হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে”। এখানেও আমাদের মনে পড়ে যায় বোদলেয়ারের অবিস্মরণীয় পংক্তি: “I have more memories than a thousand years” (দ্বিতীয় Spleen : SPLEEN ET IDEAL)।
‘বনলতা সেন’ কবিতাটিতে জীবনানন্দ দাশ এডগার অ্যালেন পোকেও অনুসরণ করেছেন। কিন্তু এই একই কবিতায় সম্ভবত বোদলেয়ারের একাধিক কবিতা থেকে সচেতন পরিগ্রহণ আছে, অতি সূক্ষ্ম সমীকরণ ক্রিয়ার ফলে আজ আর ওই পরিগ্রহণের পরিমাণ সম্বন্ধে কোনো বিশেষ ধারণা সম্ভব নয়।
I have long lived beneath vast colonades
Dyed by the suns marine with myriad lights,
Their mighty pillars, splendid and erect,
Basaltic grottoes every night displayed.
(LA VIE ANTERIEURE :
Past Life : SPLEEN ET IDEʻAL)
বাংলা অনুবাদ,
আমি বহুকাল ধরে বাস করে গেছি
বিশাল বারান্দাসমূহের নীচে।
সমুদ্র সূর্যের আলোর লঘুনৃত্য বর্ণমালা
তাদের সুরঙীন করেছে,
বিশাল থামসমূহ যা ছিল বিস্ময়কর ও সরল দণ্ডবৎ
প্রতি রাত্রিতে প্রস্তর-গাম্ভীর্য ব্যক্ত করত।
এই কবিতাকে হুবহু অনুসরণ করে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে;
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকার মালয়সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে;
এছাড়াও বোদলেয়ারের বিখ্যাত LA CHEVELURE: Hair কবিতায় লিখেছেন,
Languorous Asia, Africa aglow,
A whole world distant, absent, almost gone,
Lives aromatic forest, dcep in you!
As other souls to sca on music go,
Mine, o my love ! upon your scent sails on.
বাংলা অনুবাদ,
তোমার চুলের ভিতর আফ্রিকা ও এশিয়া উজ্জ্বলিত,
দূর পৃথিবীর সংকেত আসে,
তোমার ভিতর গন্ধঅরণ্যের বসবাস,
সমুদ্রসংগীতে ভেসে যাওয়া আত্মার মতো,
তোমার সুগন্ধে আমি পাল তুলে দিয়েছি।
এরই পাশাপাশি জীবনানন্দের পংক্তিসমূহ লক্ষ্য করুন,
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার দিশা
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে;
(বনলতা সেন)
বোদলেয়ারের এই কবিতা ও জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতা পাশাপাশি পড়লে সামান্যে শব্দের হেরফের ছাড়া বিশেষ কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়না।
বোদলেয়ার ও জীবনানন্দ দাশ দুজনকেই অন্ধকারের কবি বলে চিহ্নিত করা যায়। বোদলেয়ার-ও গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে তার অন্ধকার-আসক্তি ঘোষণা করেছেন: আমি অন্ধকার, নিরাবরণ ও শূন্যকে ভালোবাসি “Because I seek the dark, the bare, the void.”
পক্ষান্তরে জীবনানন্দের বিখ্যাত ‘অন্ধকার’ কবিতাটি (বনলতা সেন) লক্ষ্যণীয়। এছাড়াও জীবনানন্দ লিখেছেন, “অন্ধকারে হাড়কঙ্করের মতো শুয়ে” (সময়ের কাছে : সাতটি তারার তিমির), “মসৃণ হাড়ের মতো শাদা হাত দুটি” (পরস্পর : ধূসর পাণ্ডুলিপি), “বরং নারীকে ছেড়ে কঙ্কালের হাতে” (স্থবির যৌবন : মহাপৃথিবী), “মড়ার খুলির মতো ধ’রে” (বোধ : ধূসর পাণ্ডুলিপি)
বোদলেয়ার লিখেছেন,
“I wish to sleep! to sleep rather than live!
In a slumber doubtful as death,
I shall remorselessly cover with my kisses
Your lovely body polished like copper.
To bury my subdued sobbing
Nothing equals the abyss of your bed,
Potent oblivion dwells upon your lips
And Lethe flows in your kisses.
My fate, hereafter my delight,
I’ll obey like one predestined;
Docile martyr, innocent man condemned,
Whose fervor aggravates the punishment.
I shall suck, to drown my rancor,
Nepenthe and the good hemlock
From the charming tips of those pointed breasts
That have never guarded a heart.”
অপরদিকে জীবনানন্দ দাশও উক্ত কবিতাটিকে অনুকরণ করে লিখেছেন,
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,
অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে
থাকতে চেয়েছি।
হে নর, হে নারী,
তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;
আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।
যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,
সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
শত-শত শূকরের চিৎকার সেখানে,
শত-শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;
এই সব ভয়াবহ আরতি!
গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে কেন জাগাতে চাও?
হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া,
আমাকে জাগাতে চাও কেন।
অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর;
তাকিলে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে
অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে
কীর্তিনাশার দিকে।
ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো— ধীরে— পউষের রাতে—
কোনোদিন জাগবো না জেনে—
কোনোদিন জাগবো না আমি— কোনোদিন আর।
মানুষের অস্থিকঙ্কালকে সংকেতরূপে বোদলেয়ারই প্রথম ব্যবহার করেছিলেন যা পরবর্তীকালে জীবনানন্দ অনুকরণ করেছেন। সুতরাং জীবনানন্দের কবিতায় বোদলেয়ারের কবিতার প্রভাব যথেষ্ট লক্ষ্য করা যায়।
জীবনানন্দ দাশ এবং র্যাবো (১৮৫৪-৯১)
ফরাসী কবি র্যাবোর কবিতা জীবনানন্দ দাশকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করে। এছাড়াও দুজনের মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্যতা ছিল ফলে জীবনানন্দ সহজেই র্যাবোর প্রতি প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। র্যাবো লিখেছেন,
Vengeance entire ? Nothing ! oh, yes, entire !
Captains of Industry, Princes, perish ! This we desire !
Power, Justice, History, Fall ! Down with the old !
You owe us that Blood ! Blood ! And Flames of gold !
(“Quést-ce pour nous, mon coeur”:
What Do We Care My Heart)
র্যাবোর এই কবিতার পাশে জীবনানন্দের কবিতা রাখলে বোঝা যায় যে তিনি কী পরিমাণ র্যাবোর প্রতি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। জীবনানন্দও লিখেছেন,
আমার চোখের পাশে আনিও না সৈন্যদের মশালের আগুনের রং
দামামা থামায়ে ফেল,-পেঁচার পাখার মত অন্ধকারে ডুবে যাক রাজ্য
আর সাম্রাজ্যের সং!
(অবসরের গান : ধূসর পাণ্ডুলিপি),
র্যাবোর একটি কবিতায় লিখেছেন,
When I was a child,
My vision was refined in certain skies;
My face is the product of every nuance.
(War : Gueree)
র্যাবোর কবিতায় শিশু ও কবি যেন সমার্থক। জীবনানন্দও এই মতে বিশ্বাস করেন। তিনিও শিশুকে ও কবিকে সমার্থক বোধ করেছেন। সেজন্য তিনিও লিখেছেন,
মনে হয় কোন শিশু মরে গেছে—
আমার হৃদয় যেন ছিল শিশু সেই
(নদীয়া : অপ্রকাশিত কবিতা : জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ ১)।
সমুদ্র দেখে জীবনানন্দ শৈশবকালকে স্মরণ করে লিখেছেন,
সমুদ্রের নীল জানালায়।
আমারই শৈশব আজ আমারেই আনন্দ জানায়।
(সিন্ধুসারস : আদিলেখন, কাব্যগ্রন্থ ১)
র্যাবো লিখেছেন,
‘-My guts are on fire. The power of the poison
Twists my arms and legs ; cripples me, drives me to
the ground. I die of thirst, I suffocate, I cannot
cry. This is Hell, eternal torment ! see how the flames
rise ! I burn as I aught to. Go on, Davil !
(Night in Hell : Nuit de l’enfer)
র্যাবোর এই বর্ণনা জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেও যথেষ্ট বর্তমান। সেজন্য তিনিও লিখেছেন,
সাপের মতন বিষ লয়ে সেই আগুনের ফঁসে।
জীবন পুড়িয়া যায় আমরাও ঝরে পুড়ে যাই।
(জীবন : ধূসর পাণ্ডুলিপি)
সুতরাং জীবনানন্দের কবিতায় র্যাবোর কবিতার প্রতিচ্ছবিব স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।
জীবনানন্দ দাশ এবং পল ভেরলেন (১৮৪৪-৯৬)
জীবনানন্দ ভেরলেনের কবিতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন একথা বেশ ভালোবভাবেই প্রমাণিত হয়, কেননা জীবনানন্দ এবং ভেরলেনের কবিতার অনেক অংশে চিন্তাধারার সাদৃশ্যতা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও জীবনানন্দ দাশ তার ‘কবিতার কথা’ গ্রন্থে পল ভেরলেনের নামোল্লেখ করেছেন।
ভেরলেনের কবিতায় পাই ‘বিষাদ’ এই শব্দটির পৌনঃপুনিক ব্যবহার, অস্তসূর্যের বিষন্নতার সঙ্গে মিশে যায় মৃত হৃদয়ের বিষন্নতা (soleils couchants : Sunsets-poémes Saturniens)। কবির দুঃখপূর্ণ সত্তা ঝরা মরা পাতার মতো বাতাসতাড়িত সংযোগহীন (Chanson d’automne : Autumn Song)।
জীবনানন্দও লিখেছেন,
“হলদে পাতার মতো আমাদের পথে ওড়াওড়ি!”
(জীবন : ধূসর পাণ্ডুলিপি)
জীবনানন্দের এই কবিতায় ভেরলেনের কবিতার বক্তব্য স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।
অন্য একটি কবিতায় ভেরলেন লিখেছেন,
The morning sun serenely warms and gilds
The rye and corn still damp in dewy fields,
The sky has kept the freshness of the night.
One wanders out just for the sake of it,
Beside the river with deem yellow weeds,
Along a grass-path edged by alder trees
The air is sharp. At times a bird will soar
Bearing some honey from the hedge, or straw,
And its reflection lingers, when it’s gone
That’s all.
(<LE SOLEIL DU MATIN DOUCEMENT
CHAUFFE ET DORE…>; ‘The Morning Sun Serenely Warms And Gilds…’)
ভেরলেনের এই কবিতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় জীবনানন্দের কবিতার মধ্যে। তিনি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যের ‘অবসরের গান’ কবিতায় লিখেছেন,
শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
অলস গেঁয়োর মত এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে;
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার, চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,
তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,
এখানে স্পষ্ট জীবনানন্দ ভেরলেনের কবিতার প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও ভেরলেনের কবিতাতে চাঁদের চিত্রকল্প রয়েছে La Lune Blanche বা The Silver Moon নামক কবিতায়। জীবনান্দের কবিতাতেও চাঁদ ও নক্ষত্রের চিত্রকল্প বারবার দেখা গেছে। ‘বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা’ (পেঁচা : ধূসর পাণ্ডুলিপি); তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে,- চাঁদ’ (কার্তিক মাসের চাঁদ : ধুসর পাণ্ডুলিপি)
সুতরাং জীবনানন্দের কবিতায় ভেরলেনের প্রভাব যথেষ্ট লক্ষ্য করা যায়।
জীবনানন্দ দাশ এবং পল ভালেরি (১৮৭১-১৯৪৫)
পল ভালেরি জীবনানন্দের কবিতাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। পল ভালেরির কাব্যচিন্তা ও ভাবধারার মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্যতা পরিলক্ষিত হয়। কবিতার ভাষা সম্পর্কেও উভয়ের মিল দেখা যায়।
পল ভালেরি মনে করতেন কবিতার ভাষা ঠিক মুখের ভাষা নয়, তার মধ্যে একধরনের শুদ্ধতা ও অনন্যতা থাকবে। পল ভালেরি বলেছেন,
All literature which has passed a certain age revels a tendency to create a poetic language apart from ordinary speech, with a vocabulary, syntax, licenses and prohibitions that differ more or less from those in ordinary use” (The poets’ Rights Over language : Collected Works of Paul Valery, Vol. 7, ed. Jackson Mathcws, p. 171).
ভালেরি নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতার উপাসক, আর জীবনানন্দও জলের মতো ঘুরে ঘুরে নিজের হৃদয়ের নির্জনতার সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসতেন। ভালেরি তাঁর কবিতায় বলেছেন “I am alone” আমি একা অথবা “My solitary essence interests me” (Narcisse : Narcissus) এই কথাকেই জীবনানন্দ নিজের মত করে বলেছেন, “সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়” (বোধ : ধূসর পাণ্ডুলিপি), অথবা “গভীর, অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত” (অন্ধকার : বনলতা সেন) ইত্যাদি পংক্তি দ্বারা বোঝা যায় যে জীবনানন্দ ভারেরি দ্বারা যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
পল ভালেরি লিখেছেন,
We were thinking of things pure,
Side by side, alone the paths,
We were holding hands
Without speaking…among the dark flowers.
We strolled like a couple betrothed,
Alone, in the green night of the fields,
Sharing the fruit of fairyland
The moon friendly to madness.
And then we lay dead on the moss,
Far away, all alone, in the soft shadows
Of the intimate murmuring wood;
And above us, in the immense light,
We found ourselves weeping
Oh my dear companion of silence.
(Le Bois Amical : The Friendly Wood)
জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,
দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবী ও আকাশের পাশে
আবার প্রথম এল–মনে হয়–যেন কিছু চেয়ে কিছু একান্ত বিশ্বাসে
লালচে হলুদপাতা অনুষঙ্গে জাম বটে অশখের শাখার ভিতরে
অন্ধকার নড়েচড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে;
তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল
যেখানে আকাশে খুব নীরবতা, শান্তি খুব আছে,
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ
আশ্বাস খুঁজিছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে:
সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন;
(দুজন : বনলতা সেন)
এই কবিতাটি অবিকল ভালেরির একটি কবিতার অনুরূপ। সুতরাং দেখা যায় ‘দুজন’ কবিতাটি জীবনানন্দ পল ভালেরি দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়ে লিখেছেন। জীবনানন্দ দাশ একটি কবিতায় লিখেছেন,
ঘুমোনো সে এক মেয়ে,—নিঃসাড় পুরীতে এক পাহাড়ের কাছে;
সেইখানে তার নাই কেহ।
একঘরে পালঙ্কের ‘পরে শুধু একখানা দেহ
পড়ে আছে; পৃথিবীর পথে-পথে রূপ খুঁজে-খুঁজে
তারপর, তারে আমি দেখেছিগো,—সেও চোখ বুজে
পড়েছিল; মসৃণ হাড়ের মতো শাদা হাত দুটি…
বুকের উপর তার রয়েছিল উঠি।
আসিবেনা গতি যেন কোনোদিন তাহার দু’পায়ে
পাথরের মতো শাদা গায়ে
এর যেন কোনোদিন ছিলনা হৃদয়-
(পরস্পর : ধূসর পাণ্ডুলিপি)
এই কবিতার অনুরূপ এক ঘুমন্ত মেয়েকে ভালেরির কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। পল ভালেরিও লিখেছেন, স্বপ্নময় কবিহৃদয়ের সংকেত স্বরূপিণী, যে-কবিহৃদয় জগতের সংস্পর্শ থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনেছে নির্জনের অনুধ্যানে, যেহেতু নির্জনতার মধ্যেই স্বপ্নের জন্ম :
In a palace of pale-rose purity she sleeps,
The princess, in leaf-animated murmurings;
She listens neither to the tinkling water-sounds,
… … … … … … … … … … … … … … … … … …
Of treasure hidden in a wilderness of days,
Nor, on the far-off forests, to flute-blended winds
That icar these ruminations with a horn’s clcar phrase.
(Au Bois Dormant : The Sleeping Beauty)
জীবনানন্দও যেমন বলেছিলেন,
“স্বপ্ন দিয়ে দুই চোখ একা একা রেখেছে সে ঢাকি।”
পল ভালেরি লিখেছেন,
The wind is rising! . . . We must try to live!
The huge air opens and shuts my book: the wave
Dares to explode out of the rocks in reeking
Spray. Fly away, my sun-bewildered pages!
Break, waves! Break up with your rejoicing surges
This quiet roof where sails like doves were pecking.
ভালেরির এই কবিতাটিকে অনুকরণ করে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,
পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভ’রে-
শস্য ফ’লে গেছে মাঠে,- কেটে নিয়ে চ’লে গেছে চাষা;
নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ ক’রে
নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা,-
মৃত্যুর মতন তার জীবনের বেদনার ভাষা,-
আবার জানায়ে যায়।- কবরের ভূতের মতন
পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা হতাশা,-
বাতাসে ভাসিতেছিলো ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন!-
মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন!
সুতরাং দেখা যায় পল ভালেরির কবিতা জীবনানন্দকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।
জীবনানন্দ দাশ বিভিন্ন পাশ্চাত্যের কবিদের মধ্যে রিলকের দ্বারাও যথেষ্ঠ প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন।
যেমন রিলকে লিখেছেন,
His vision, from the constantly passing bars,
has grown so weary that it cannot hold
anything else. It seems to him there are
a thousand bars; and behind the bars, no world.
As he paces in cramped circles, over and over,
the movement of his powerful soft strides
is like a ritual dance around a center
in which a mighty will stands paralyzed.
Only at times, the curtain of the pupils
lifts, quietly–. An image enters in,
rushes down through the tensed, arrested muscles,
plunges into the heart and is gone.
এই কবিতাটি রিলকের কবিতার অনুকরণ করে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,
শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে —
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।
এদিকে কোকিল ডাকছে – পউষের মধ্য রাতে;
কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব’লে?
কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ’য়ে যেতে দেখেছি,
তারা কিশোর নয়,
কিশোরী নয় আর;
কোকিলের গান ব্যবহৃত হ’য়ে গেছে।
সিংহ হুঙ্কার ক’রে উঠছে:
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,
স্থবির সিংহ এক — আফিমের সিংহ — অন্ধ — অন্ধকার।
চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে
মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে
যায় সব।
সিংহ অরন্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ’শে খ’শে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ,— তুমি
পাশ ফিরে শোও,
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।
‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার সঙ্গে শেলীর কবিতার অনুকরণও লক্ষ্য করা যায়। জীবনানন্দ লিখেছেন,
সমস্ত পৃথিবী ভরে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাসে
দোলা দিয়ে গেল কবে!-বাসি পাতা ভূতের মতন
উড়ে আসে! কাশের রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন!
কবি শেলীর ‘Ode de the West Wind’ কবিতার সাথে এ মৃত্যুভাবনার সাদৃশ্যতা লক্ষ করা যায়:
Thou, from whose unseen presence
The leaves dead
Are driven, like ghosts from an
Enchanter fleeing,
Yellow, and black, and pale, and
Hectic red,
Pestilence stricken multitudes:’
জীবনানন্দ দাশের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। মূলত এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই তাঁর মধ্যে প্রথম ব্যাপক আকারে আধুনিকতার স্ফুরণ ঘটে। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্রে তিনি লিখেলেন দীর্ঘ একেকটি কবিতা। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি পূর্ণ স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারেন নি। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘মৃত্যুর আগে’-
দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দুবেলা
নির্জন মাছের চোখ;- পুকুরের পাড়ে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ- মেয়েলি হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে;
জীবনানন্দ দাশ শুধুমাত্র বিদেশি কবিদের দ্বারাই প্রভাবিত হন নি, দেশিয় কবিদের দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। দেশিয় কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ সবচেয়ে বেশি অনুকরণ করেছেন কাজি নজরুল ইসলামকে। নজরুল ও জীবনানন্দ একই বছরে অর্থাৎ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারপরেও নজরুল হয়ে গেলেন জীবানন্দের পূর্বসূরী আর জীবনানন্দ হয়ে যান নজরুলের উত্তরসূরী। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ যখন প্রকাশিত হন তখন নজরুল ইসলাম বাংলাসাহিত্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। প্রতিষ্ঠিত নজরুলকে অনুকরণ করলেন জীবনানন্দ। যেমন জীবনানন্দের ‘ঝরাপালক’ (১৯২৭) কাব্যগ্রন্থের কবিতায় নজরুলের অনুকরণ লক্ষ্য করা যায়। নজরুল তাঁর ‘সন্ধ্যা’ কাব্যগ্রন্থের ‘চল্ চল্ চল’ কবিতায় লিখেছেন,
চল চল চল!
ঊর্ধ গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণি তল।
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল।
ঊষার দুয়ারে হানি’ আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,
আমরা টুটাব তিমির রাত,
বাধার বিন্ধাচল।
নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মশান,
আমরা দানিব নতুন প্রাণ
বাহুতে নবীন বল!
চল রে নও-জোয়ান,
শোন রে পাতিয়া কান
মৃত্যু-তরণ-দুয়ারে দুয়ারে
জীবনের আহ্বান।
ভাঙ রে ভাঙ আগল,
চল রে চল রে চল
চল চল চল।
নজরুলের এই কবিতাকে অনুকরণ করে জীবনানন্দ দাশ ‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘নব নবীনের লাগি’ কবিতায় লিখেছেন,
‘নব নবীনের লাগি
প্রদীপ ধরিয়া আঁধারের বুকে আমরা রয়েছি জাগি।…
‘গাহি মানবের জয়
কোটি কোটি বুকে কোটি ভগবান আঁখি মেলে জেগে রয়।।
সবার প্রাণের অশু-বেদনা মোদের বক্ষে লাগে,
কোটি বুকে কোটি দেউটি জ্বলিছে, কোটি কোটি শিখা জাগে,
প্রদীপ নিভায়ে মানবদেবের দেউল যাহারা ভাঙে
আমরা তাদের শত্রু, মাসন, কবির ক্ষয়।
– জয় মানবের জয়!
(নব নবীনের লাগি; ঝরাপালক : জীবনানন্দ দাশ)
‘চলছি উধাও’ কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন,
চলছি উধাও, বল্পাহারা- ঝড়ের বেগে ছুটি;
শিকল কে, সে বাঁধছে পায়ে।
কোন সে ডাকাত ধরেছে চেপে টুটি!
নজরুল বিবেকানন্দকে নিয়ে গান রচনা করেছেন-
‘জয় বিবেকানন্দ বীর সন্যাসী চীর গৈরিকধারী’
(নজরুল রচনাবলী ৩য় খণ্ড-পৃ. ৪১২)।
জীবনানন্দ দাশও বিবেকানন্দকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। ‘বিবেকানন্দ’ কবিতায় জীবনানন্দ নজরুলীয় শৈলীতে লিখেছেন,
জয়-তরুণের জয়।
জয় পুরোহিত অহিতাগ্নিক, জয়, জয় চিন্ময়!
স্পর্শে তোমার নিশা টুটে দিল- উষা উঠেছিল জেগে
পূর্ব তোরণে, বাংলা-আকাশে, অরুণ-রঙিন মেঘে;
আলোকে তোমার
ভারত, এশিয়া-জগৎ সে দিল রেঙে।
নজরুলের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ বা কবিতায় বলেছেন,
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বলো ডুবিয়ে মানুষ, সন্তান মোর মার!
‘হিন্দু মুসলিম যুদ্ধ’ কবিতায় বলেছেন-
‘খালেদ’ আবার ধরিয়াছে আসি, ‘অর্জুন’ ছোড়ে বাণ।
জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান।
জীবনানন্দ দাশও ‘হিন্দু-মুসলিম’ শিরোনামে কবিতা লিখেছেন। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন –
কে বলে হিন্দু বসিয়া রয়েছে একাকী ভারত জঁকি।
মুসলমানের হস্তে হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখি,
‘নিখিল আমার ভাই’ কবিতায় জীবনানন্দ দাশ বলেছেন –
নিখিল আমার ভাই
– কীটের বুকেতে সেই ব্যথা জাগে আমি সেই বেদনা পাই
যে প্রাণ গুমারি কাঁদিছে নিরালা শুনি যেন তার ধ্বনি।
কোন ফণি যেন আকাশ বাতাসে তোলে বিষ গরজানি!
আমার শস্য-স্বর্ণপসরা নিমেষে হয় যে ছাই
– সবার বুকের বেদনা আমার, নিখিল আমার ভাই।
‘পতিতা’ কবিতায় লিখেছেন,
সে যে মন্বন্তর, – মৃত্যুর দূত-অপাঘাত, – মহামারী –
মানুষ তবু সে, – তার চেয়ে বড়ো, – সে যে নারী।
‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থে ‘সিন্ধু’ নামক একটি কবিতা রয়েছে। অপরদিকে নজরুলের একটি কাব্যগ্রন্থের নাম ‘সিন্ধু-হিন্দোল’। এই গ্রন্থে সিন্ধু (প্রথম তরঙ্গ), সিন্ধু (দ্বিতীয় তরঙ্গ), সিন্ধু (তৃতীয় তরঙ্গ) নামে তিনটি কবিতা রয়েছে। জীবনানন্দ দাশের এ ধরনের কবিতার সঙ্গে নজরুলের বিষয় এবং আঙ্গিকের ছিল প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। ‘ঝরাপালক’ এ প্রচলিত অর্থে প্রেমের কবিতা না থাকলেও ‘ছায়া প্রিয়া’ ‘অস্ত চাঁদে’ ‘যে কামনা নিয়ে’, ‘ওগো দরদিয়া’, ‘মরীচিকার পিছে’ প্রভৃতি কবিতায় নজরুলের প্রেমের কাব্য ‘দোলন-চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, গ্রন্থের আঙ্গিকের ছাপ রয়েছে। যেমন,
জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,
দুপুর রাতে ও কার আওয়াজ!
গান কে গাহে, – গান না!
কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে।
নিঝুম ঝিঝির বুকের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
এ কার তবে কান্না।
গান কে গাছে, গান না।
(ছায়াপ্রিয় : ঝরাপালক]।
নজরুল লিখেছেন,
গাইতে বসে কণ্ঠ ছিড়ে আসবে যখন কান্না,
বলবে সবাই ‘সেই যে পথিক তার শেখানো গহান না?
আসবে ভেঙে কান্না!
[অভিশাপ : দোলন-চাপা]
জীবনানন্দের কবিতা ও নজরুলের কবিতা পাশাপাশি রাখলে স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয় যে জীবনানন্দ নজরুলের কবিতাকে হুবহু অনুকরণ করেছেন। এছাড়াও জীবনানন্দ ‘ঝরপালক’ কাব্যগ্রন্থে নজরুলীয় শব্দ-শব্দাংশ চরণ, উপমা-উৎপেক্ষা প্রচুর ব্যবহার করেছেন এমনি কি আরবি ফারসি শব্দ পর্যন্ত। যেমন, আনমনা, দাদুরী কাঁদানো, স্বপ্ন-দুয়ার, দিওয়ানা, পেয়ালা, তরবারি, সরাইখানা, দিলদারদের দরাজ গলায়, বেহুঁশ হওয়ার, দিলওয়ার, বাতায়ন, সুদূর মরুদ্যান, মাস্তানা, বেদুঈন, খুন্নরোজী মুসাফের, জিঞ্জীর, তুরানী প্রিয়া, রোজা, ঈদরাত, প্রলয়ধ্বনি, যুবানবীনের, সফেন সুবার, মজলুম, সুরা, ফেনার বৌয়ের নোনতা মৌয়ের- মদের গেলাস লুটে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কেবল নজরুল নন সত্যেন্দ্রনাথ এবং মোহিতলাল ও জীবনানন্দকে আকৃষ্ট করেছিলেন। তবে সব ছাপিয়ে ঝরাপালকেও নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন;- গভীরভাবে না দেখলে প্রথমে ঠাওর করা যায় না।
‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার ঠিক নয় বছর পর অর্থাৎ ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’। জীবনানন্দ দাশ এই গ্রন্থে নজরুলের অনুকরণ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। তবে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তেও অতি সামান্য হলেও নজরুলের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন নজরুল তাঁর ‘দোলন চাপা’ কাব্যগ্রন্থের ‘বেলা শেষে’ নামক কবিতায় লিখেছেন,
ধরণী দিয়াছে তার
গাঢ় বেদনার
রাঙা মাটিরাঙা স্নান ধূসর আঁচলখানি।
দিগন্তের কোলে কোলে টানি।
পাখি উড়ে যায় যেন কোন, মেঘ-লোক হ’তে
সন্ধ্যা-দীপ-জ্বালা গৃহ-পানে ঘর-ডাকা পথে।
আকাশের অস্ত-বাতায়নে।
অনন্ত দিনের কোন বিরহিনী কনে
জ্বালাইয়া কনক-প্রদীপখানি
উদয়-পথের পানে যায় তার অশু-চোখ হানি।
হেমন্তের এমনই সন্ধ্যায় যুগযুগ ধরি বুঝি হারায় চেতনা।
উপুড় হইয়া সেই স্থূপীকৃত বেদনার ভার।
মুখ গুজে পড়ে তাকে; ব্যথা গন্ধ তার
গুমরিয়া গুমরিয়া কেঁদে কেঁদে যায়
এমনি নীরবে শান্ত এমনি সন্ধ্যায়।…
ক্রমে নিশীথিনী আসে ছড়াইয়া ধূলায়, মলিন এলোচুল
সন্ধ্যা-তারা নিবে যায়, হারা হয় দিবসের কূল।…
[বেলা শেষে : দোলন চাপা]
জীবনানন্দ দাশও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র কবিতা ‘নির্জন স্বাক্ষর’ এ লিখেছেন,
তুমি তা জান না কিছু, না জানিলে, –
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!
যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে,
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের পরে শুয়ে রবে?…
হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন –
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের পরে শুয়ে রবে?…
আমার বুকের পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল।
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই! শুধু তার স্বাদ।”
[নির্জন স্বাক্ষর : ধূসর পাণ্ডুলিপি]
যদিও নজরুলের এই কবিতার সঙ্গে জীবনানন্দের কবিতার সাদৃশ্যতা খুবই দুর্বল। তবে বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ দেখিয়েছেন যে জীবনানন্দ দাশ নজরুলীয় বিষয় এবং আঙ্গিক থেকে মুক্ত হলেও চেতনাগত ঐক্যে সংযুক্ত থাকেন। তিনি লিখেছেন, “একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে হয় ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে এসে জীবনানন্দ দাশ বিষয়ে এবং আঙ্গিকে নজরুল-বলয় মুক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু ‘জয় মানবের জয়’ বলে জীবনানন্দ দাশ যে শুভ উদ্বোধনীর ঘোষণা দিয়েছিলেন অভিজ্ঞতা ও অর্জনের পথ পরিক্রমার অতলচক্র পেরিয়ে তিনি সেই বোধের কাছে স্থির হয়েছিলেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হলো ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭) ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ (১৯৬১)। সবগুলি গ্রন্থ মিলে জীবনানন্দ দাশ একটি কাব্য শৃঙ্খল তৈরি করেছিলেন। তাঁর কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য একটি ছক ও বৃত্তের সাহায্যে দেখানো সম্ভব। জীবনানন্দ দাশ এ পর্যায়ে নজরুলীয় বিষয় এবং আঙ্গিক থেকে মুক্ত হলেও চেতনাগত ঐক্যে সংযুক্ত থাকেন। সে চেতান মানবীয় কল্যাণবোধ, যে শুভ উদ্বোধনের অংশীদারিত্বে উভয়ই সক্রিয় ছিলেন।” [নজরুল ও জীবনানন্দ দাশ: মানস সাযুজ্য]
জীবনানন্দের কাব্যজীবন সূচনার যুগটা ছিল রবীন্দ্রময়। সেই সময় একমাত্র নজরুল ছাড়া কোনো কবিই পুরোপুরিভাবে রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। এমনকি জীবনান্দও পারেন নি। তাঁর কবিতায় রবীন্দ্র প্রভাব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। তবে তিনি রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য আপ্রাণ সচেষ্ট ছিলেন। প্রথম থেকেই তিনি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের অনুসরণ করলে বাংলা কাব্যের মুক্তি নেই। ফলে জীবনানন্দ ‘ঝরা পালকের’ যুগ থেকে রবীন্দ্র প্রভাব এড়াবার জন্য সচেতনভাবে নজরুলকে অনুকরণ করেছেন। তিনি নজরুলের সাহিত্য থেকে শিখেছিলেন কীভাবে রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। এই মুক্ত হতে গিয়ে তিনি নজরুলের সৃষ্টিজগতে অনুপ্রবেশ করেন সচেতনভাবে। তাঁর কাব্যজগত রবীন্দ্রময় থেকে হয়ে ওঠে নজরুলময়। তবে জীবনানন্দ নিজেকে নজরুলীয় প্রভাব থেকেও মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন কারণ তিনি বুঝেছিলেন দেশিয় কবিদের অনুকরণ করলে বাংলা সাহিত্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না। বাংলা পাঠক কবিতার নতুন কোনো ব্যঞ্জনা পাবেন না। সেজন্য তিনি নিজেকে নজরুলীয় সাম্রাজ্য থেকে মুক্ত হবার জন্য বিদেশি কবিদের অনুকরণ শুরু করেন। নিজস্ব কাব্য প্রতিভা ও পাশ্চাত্যের কবিদের অনুকরণে সৃষ্টি করেন এক স্বতন্ত্র কবিতার সাম্রাজ্য। যে সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ।
১৯৪২ সালে নজরুল ইসলাম অকালে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লে কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় নজরুল সংখ্যা বের করার মনস্থির করেন। সেই সংখ্যায় জীবনানন্দ দাশ নজরুলের কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করেন, যা প্রকাশিত হয় ‘নজরুলের কবিতা’ (কবিতা, পৌষ, ১৩৫১) শিরোনামে। এছাড়াও শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় (১৩৫৪) ‘কবিতা পাঠ দুজন কবি’ নামে প্রবন্ধ লেখেন। কবি দুজন হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাজি নজরুল ইসলাম। জীবনানন্দ দাশ নিজের মত করে তাদের কবিতা বিশ্লেষণ করেছেন এবং নজরুলের ভূয়সী প্রসংশা করেছেন। জীবনানন্দ দাশ নজরুল ইসলামকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন, এমন তথ্য আমাদের অজানা ছিলো, অবশেষে পাওয়া গেল ‘এই শতাব্দী সন্ধিতে মৃত্যু’ নামে কবিতা। নজরুলের নাম না থাকলেও ‘অগণন সাধারণের’ উৎসর্গ রয়েছে। তাতেই বোঝা যায় নজরুল ইসলামই হলেন এই কবিতার বিষয়বস্তু। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল পরিক্রমা শারদীয় ১৩৫০ সংখ্যায়। কবিতাটি নিচে উল্লেখ করা হল,
এই শতাব্দী সন্ধিতে মৃত্যু
(অগণন সাধারণের)
সে এক বিচ্ছিন্ন দিনে আমাদের জন্ম হয়েছিল
ততোধিক অসুস্থ সময়ে
আমাদের মৃত্যু হয়ে যায়।
দুরে কাছে শাদা উঁচু দেয়ালের ছায়া দেখে ভয়ে
মনে করে গেছি তাকে ভালোভাবে মনে করে নিলে-
এইখানে জ্ঞান হতে বেদনার শুরু-
অথবা জ্ঞানের থেকে ছুটি নিয়ে সান্ত!
নার হিম হ্রদে একাকী লুকালে
নির্জন স্ফটিকস্তম্ভ খুলে ফেলে মানুষের অভিভূত উরু
ভেঙে যাবে কোনো এক রম্য যোদ্ধা এসে।
নরকেও মৃত্যু নেই প্রীতি নেই স্বর্গের ভিতরে;
মর্ত্যে সেই স্বর্গ-নরকের প্রতি সৎ অবিশ্বাস
নিস্তেজ প্রতীতি নিয়ে মনীষীরা প্রচারিত করে।
কবির প্রথম পংক্তিমালা আমাদের মনে করিয়ে দেয় জীবননান্দ দাশ ও কাজি নজরুল ইসলাম একই সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জীবনানন্দ কবিতা লেখার ক্ষেত্রে নজরুলকে যেমন অনুকরণ করেছেন তেমনি নজরুলের প্রতি আজীবন শ্রদ্ধা লালন করেছেন অন্তর থেকে।
‘নবজাগরণ’ অ্যান্ড্রোয়েড অ্যাপ্লিকেশনটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন হতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।
‘নবজাগরণ’ এর ফেসবুক পেজে লাইক করতে নিচের আইকনে ক্লিক করুন।